অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
ডুয়ার্স নামটা কোন শব্দ থেকে এসেছে, সে সম্পর্কে আমি এখনও নিশ্চিত নই ৷ অনেক নামেরই উৎপত্তি বেশ রহস্যময় ৷ এমনকী কলকাতা শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়েও নানা মুনির নানা মত ৷ অনেক সময়ই স্থানীয় কোনও দুর্বোধ্য শব্দকে সংস্কৃত রূপ দেবার চেষ্টা হয়েছে ৷
বইপত্রে লেখা থাকে, ডুয়ার্স এসেছে দুয়ার থেকে ৷ অর্থাৎ ভুটানের প্রবেশদ্বার ৷ ঠিক বিশ্বাস হয় না ৷ দ্বার, দোর, দরজার তুলনায় দুয়ার একটা কবিত্বময় শব্দ ৷ এই অঞ্চলে ওঁরাও, মুণ্ডা, রাভা, টোটো এই রকম নানা উপজাতির বাস ৷ তারা দুয়ার শব্দটা ব্যবহার করত? ইংরেজরা সেটাকে ডুয়ার্স করে দিল?
ডুয়ার্স অঞ্চলটি আমাকে খুব টানে ৷ সমুদ্রের তুলনায় পাহাড় ও জঙ্গল অনেক বেশি নাটকীয় ৷ চোখও বেশি জুড়োয় ৷
কিছু একটা সাহিত্য সমাবেশে গিয়েছিলাম কোচবিহার ৷ সেখান থেকে হাসিমারায় এক বন্ধুর বাড়িতে ৷ সে বাড়িতে আগে থেকেই বসে আছে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ৷ বসে আছে বলাটাও ঠিক হল না, উঠোনের একটা খাটিয়ায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে ৷ শুনলাম, প্রায় তিনদিন ওই খাটিয়া ছেড়ে প্রায় নড়েইনি ৷ আমাকে দেখে অবশ্য তড়াক করে উঠে বসল, শুরু হল নানান পরিকল্পনা ৷
এর আগে আমি জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের পাশ দিয়ে বেশ কয়েকবার গেছি, কিন্তু ভেতরের কোনও বাংলোতে থাকা হয়নি ৷ সে কথা শুনে শক্তি এমনভাবে তাকালো, যেন জলদাপাড়ায় রাত্রিবাস না করলে আমার জীবনটাই বৃথা ৷
এত কাছে এসে এই সুযোগ সদ্ব্যবহার না করারও কোনও মানে হয় না ৷ আমাদের অন্য বন্ধুটি যেতে পারবে না, তার অফিসের বস আসবেন পরিদর্শনে, সুতরাং তার জায়গা ছাড়ার উপায় নেই ৷ তবে, সে একটা জিপ গাড়ি জোগাড় করে দিল ৷ সেটি দুদিন থাকবে আমাদের সঙ্গে ৷ এছাড়া কিছু খাদ্য-পানীয়ও সঙ্গে নেওয়া হল, এসবই শক্তির ব্যবস্থাপনা ৷ শক্তি সঙ্গে থাকলে কোনও ভ্রমণেই আমাকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয় না ৷
বেরিয়ে পড়ার আগেই একটি দুঃসংবাদ পাওয়া গেল ৷ হলং ফরেস্ট বাংলোতে জায়গা পাওয়া যাবে না ৷ সেখানে সদলবলে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷
এমনিতেই হলং বাংলোর জন্য অনেকদিন আগে থেকে রিজার্ভেশন করে রাখতে হয় ৷ তার ওপর মুখ্যমন্ত্রী বলে কথা ৷ মুখ্যমন্ত্রীদের ওসব রিজার্ভেশনের ঝামেলা পোহাতে হয় না ৷ এমনকী আগে থেকে যাদের ঘর বুক করা আছে, তাদের রিজার্ভেশন বাতিল করেও মুখ্যমন্ত্রী আসতে পারেন ৷ এইটুকু সুযোগ-সুবিধা না পেলে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে লাভ কী?
রিজার্ভেশন ছাড়াই অনেক ফরেস্ট বাংলোতে আমরা আগে থেকেছি ৷ তার একটা কায়দা আমাদের জানা আছে ৷ এবারে সে ঝুঁকি নেওয়া যায় না ৷ অন্য মন্ত্রী কিংবা বড় গোছের আমলা হলেও কথা ছিল, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর জন্য এমন সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকবে যে কাছে ঘেঁসতেই দেবে না ৷
অগত্যা মাদারিহাটের ট্যুরিস্ট লজে যাওয়া যেতে পারে ৷ সেখানে পৌঁছে জায়গাটি ঠিক মনঃপূত হল না ৷ এটা জঙ্গলের বাইরে, কাছেই বড় রাস্তা, গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ৷ এখানে অরণ্যের অনুভব নেই ৷ এখান থেকেও ভোরবেলা জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রাত্রিবাসের রোমাঞ্চই তো আসল ৷
শক্তি যত হলং বাংলোর গুণপনার বর্ণনা দিতে লাগল, আমি ওকে তত শোনাতে লাগলাম আসামের মানস রিজার্ভ ফরেস্টের জঙ্গল-বাংলোর কথা ৷ শক্তি সেখানে যায়নি ৷ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার গেলে মানস নদীর ধারে সেই অপরূপ বাংলো, রাতের বেলা বারান্দায় বসে বসেই ঘাই হরিণীর ডাক শোনা যায় ৷ ‘ঘাই হরিণী’ জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ধার করা, সবাই বলে বার্কিং ডিয়ার, মানসে সে ডাক সত্যিই আমি অনেকবার শুনেছি, তবে হরিণ না হরিণী ছিল, তা বলতে পারব না ৷
মাদারিহাট ট্যুরিস্ট লজের ভেতরে না ঢুকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, এর চেয়ে গরুমারা স্যাঙ্কচুয়ারিতে যাওয়াও অনেক ভালো ৷ আমরা দুজনেই আগে সেখানে গেছি যদিও, তবু ওখানে বারবার যাওয়া যায় ৷
জিপে স্টার্ট দেবার পর শক্তি বলল, যাবার পথে তোমাকে একবার শুধু হলং বাংলোটা দেখিয়ে নিয়ে যাব ৷ ওখানে বসে এক কাপ চাও খাওয়া যেতে পারে ৷
যদি পুলিশ ঘিরে থাকে? কাছে যেতেই না দেয়?
শক্তি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল ৷ যেন দুনিয়ার কোনও পুলিশই ওকে আটকাতে পারবে না ৷
সেখানে আমাদের জন্য একটা দারুণ চমক অপেক্ষা করছিল ৷
জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাবছি, কোথায় ঘাপটি মেরে পুলিশ বসে আছে, কোথায় আমাদের আটকাবে ৷ বাংলোর একেবারে কাছে পৌঁছে দেখি চতুর্দিক ভোঁ ভোঁ! কোথায় মুখ্যমন্ত্রী, কোথায় পুলিশ? একটা গাড়ি পর্যন্ত নেই ৷ আমাদের জিপটা দেখে দু-তিনজন অবাক চোখে কাছে এল ৷
তখন জানা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর আজ সকালে এসে পৌঁছবার কথা ছিল ৷ শেষ মুহূর্তে তিনি এদিককার সফর বাতিল করেছেন, তাঁর সঙ্গীরাও কেউ আসেনি ৷ বাংলো একেবারে ফাঁকা ৷
যে-কক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর থাকার কথা ছিল, আমরা সেটারই দখল নিলাম ৷ ফুল টুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো, এসব যেন আমাদেরই জন্য ৷ একদিন কা বাদশা হতে ক্ষতি কী? চা চাইতেই সঙ্গে চলে এল টা হিসাবে গরম গরম ফিস ফিঙ্গার ৷
মনে আছে, সন্ধেবেলায় অনেকক্ষণ শক্তি ও আমি তর্কে মেতে ছিলাম স্থানীয় নাম-রহস্য নিয়ে ৷ গরুমারা নামের মানে বোঝা যায়, তাহলে হাসিমারা মানে কী? ‘রাজাভাতখাওয়া’র মতো এমন অদ্ভুত নাম কে দেয়? কাছেই ‘জয়ন্তী’, কী সুন্দর নাম ৷ দার্জিলিংয়ের সঙ্গে দুর্জয় লিঙ্গের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে কি? সবচেয়ে বিস্ময়কর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ৷ এর আদিনাম হয়তো অন্য কিছু ছিল ৷
একটু বেশি রাতে আমরা বেরিয়ে আসি বাংলোর বাইরে ৷ অরণ্যের নির্জনতার সঙ্গে অন্য নির্জনতার তুলনা হয় না ৷ এখানে নীরবতা বাঙ্ময় ৷ মাঝে মাঝে একটা পাখি ডাকছে দূরে ৷ শক্তির মতে, ওটা জলতরঙ্গ পাখি ৷ সুন্দরবন অঞ্চলে ওই নামটা আমিও শুনেছি, পাখিটাকে চোখে দেখিনি ৷
ভোরবেলা হাতির পিঠে জঙ্গল ঘোরাবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আমাদের ৷ সেটা গ্রহণ করিনি ৷ মানস স্যাঙ্কচুয়ারিতে হাতির পিঠে জঙ্গল ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার আছে ৷ ওরকম একবারই যথেষ্ট ৷ মোটেও আরামদায়ক নয় ৷ গদাই লস্করি চালে হেলতে দুলতে চলে হাতি, তার ওপরে বসে কখন কোন জন্তু-জানোয়ার দেখা যাবে সে জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয় ৷ জঙ্গলে গিয়ে জন্তু-জানোয়ার খোঁজার ব্যাপারে আমার কখনও আগ্রহ হয়নি ৷
শক্তি অত ভোরে উঠতেই চায় না!
আমাদের সঙ্গে জিপ আছে, একজন গাইডকে নিয়ে আমরা নিজেরাই ঘোরাঘুরি করতে পারি ৷ চা খেয়ে একটু বেলার দিকে বেরিয়ে পড়া গেল ৷
জলদাপাড়ায় সবাই দেখতে যায় একশৃঙ্গী গণ্ডার ৷ এই প্রাণীটি ক্রমশই দুর্লভ হয়ে আসছে ৷ তবু দু-চারটি গণ্ডার পর্যটকদের প্রতি মায়াবশত দেখা দেয় শুনেছি ৷ আমরা দেখিনি ৷ এত বেলায় হরিণ এমনিতেই দেখা যায় না ৷ জিপগাড়ির আওয়াজে বাঘই বা কাছে আসবে কেন? ডুয়ার্স অঞ্চলে বুনো হাতি অনেক সময় রাস্তার ওপরেই দেখা যায়, একবার লঙ্কাপাড়া চা-বাগানে একসঙ্গে প্রায় পনেরোটা হাতি দেখেছিলাম ৷
এ যাত্রায় আমরা জীবজন্তু দেখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না, দেখাও পাইনি ৷ অনেকটা ভগবানের মতো, খুব ভক্ত না হলে ওরা দেখাও দেয় না ৷ শুধু দূরে গোটা কয়েক মোষ চোখে পড়েছিল, সেগুলি সাধারণ মোষ না বাইসন, তা বোঝা গেল না ৷ আমাদের গাইডটি অবশ্য সোৎসাহে বোঝাতে লাগল, এগুলো বাইসনই বটে ৷
বরং এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাওয়া ময়ূর অনেক বেশি দৃষ্টি-নন্দন ৷ এখানকার গাছগুলি লম্বা লম্বা ৷ দক্ষিণবঙ্গের কোনও জঙ্গলেই এত লম্বা গাছ নেই ৷ পরগাছাও অনেক বেশি ৷ এত সবুজের সমারোহের মধ্যে একটা গাছ বাজে পোড়া, একটিও পাতা নেই, কালো ৷ সেই কালো রঙের নিঃস্ব গাছটার ডগায় একটা ময়ূর বসে আছে ৷ সেদিকে তাকিয়ে থেকে আপসোস হল, কেন আমি একেবারেই ছবি আঁকতে পারি না!
এক জায়গায় একটা ছোট্ট কাঠের সেতু, তার তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট একটা কুলকুলে নদী ৷ অতি স্বচ্ছ জল ৷ সঙ্গে সঙ্গে জিপটা থামাতে বললাম ৷
গাড়ি থেকে নামার ব্যাপারে গাইডের খুব আপত্তি ৷ সে এই জঙ্গলের বিপদের গুরুত্ব বোঝাতে চায় ৷ কিন্তু কাছাকাছি কোনও হিংস্রতার গন্ধ নেই ৷ তাছাড়া, কেমন যেন একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে, জন্তু-জানোয়ারের দাঁতে আমাদের মৃত্যু নেই ৷ মানুষের হিংস্রতাই বেশি ভয়াবহ ৷
একটা নদী দেখেও উপেক্ষা করে চলে যাব, এমন পাষণ্ড কি হতে পারি?
শক্তি প্রথমেই ঘোষণা করল, এ নদীর নাম তোর্সা ৷
গাইডটি মিনমিন করে বলল, না স্যার, এটা মালঙ্গী ৷
শক্তি তা মানতে চায় না ৷ নদীর নাম কোথাও লেখা নেই, সুতরাং এ ব্যাপারে এখনই কোনও মীমাংসা করা গেল না ৷ কিন্তু নদীটি বেশ পছন্দ হল ৷
এমন নিরালা নদী সহসা দেখা যায় না ৷ দুদিকে জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে আপনমনে বয়ে চলেছে ৷ মাঝখানে বড় বড় পাথর, তার ওপর দিয়ে অনায়াসে টপকে যাওয়া যায় ৷ খুব কাছেই একটা বাঁক ৷ বড় নদীর তুলনায় ছোট নদীর বাঁক বেশি হয় ৷ রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লিখেছেন, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে ৷
সেই বাঁকের কাছে একটা গাছ ভেঙে পড়ে আছে ৷ অর্ধেকটা জলের মধ্যে ৷ পাতাগুলি এখনও সবুজ ৷ হাতিরা নাকি গা চুলকোলে এরকম একেকটা গাছ ভাঙে ৷ ইস, এ গাছটাকে যদি আবার বাঁচিয়ে তোলা যেত ৷
আমরা কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করলাম বটে, কিন্তু এ কাজ আমাদের অসাধ্য ৷ তারপর কিছুক্ষণ বসে রইলাম সেই নদীর ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে ৷ আমাদের চারপাশে ঝিমঝিম করতে লাগল অরণ্য ৷
ভ্রমণ জানুয়ারি, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন