এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়

সবরকম আইনি অনুমতি সত্বেও এবার স্পিতিতে ঢুকতে হয়েছিল প্রায় সেই প্রাচীন অনুপ্রবেশকারীদের মতোই ৷ রাস্তা ধসে একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত ৷ প্রথমে একটা মাল খালাস করা ট্রাকের পিঠে ‘চাঙ্গো’ তারপর ছোট ক্যান্টার ভ্যানে চেপে ‘সামদো’ চেকপোস্টে এসে দাঁড়ালাম ৷ ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৷ সেই ভোরবেলা রেকংপিও থেকে বাসে চাপার পর পুরো রাস্তাটাই ছন্দপতনের বিলাপ মাত্র ৷ বাস ইয়াংথাং পৌঁছতে দুঃসংবাদ ৷ কাছেই নাকো গ্রামের মুলিং নালা হঠাৎ খেপে উঠেছে ৷ তার উচ্ছল নাচের ধাক্কায় ওই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কের বিশাল এক খাবলা একেবারে নিশ্চিহ্ন ৷

সামদো এই রাস্তায় স্পিতির প্রথম গ্রাম ৷ কাছেই তিব্বতের পারে চু এবং স্পিতি নদীর সঙ্গম ৷ চেকপোস্টের চেকিং নেহাতই মোলায়েম ৷ ধুলোমলিন আমাদের চেহারাগুলো দেখে এবং কলকাতার শখের পাহাড়ি জেনে একমুখ হাসি ৷ আরও একঘণ্টা ক্যান্টার যাত্রা শেষে হারলিংয়ে পৌঁছতেই সূর্যাস্ত ৷ খবর ছিল একটু পরেই চাঁদ উঠবে শুক্লা দশমীর ৷ একটা দোকানে বসে শুয়োরের মাংসের মোমো খেয়ে অভুক্ত শরীরে প্রায় ষাঁড়ের শক্তি এল ৷ ভাবছিলাম অচেনা চাঁদনি পথে পদযাত্রার কথা ৷ হঠাৎই একটা কেরোসিনের ড্রাম বোঝাই ট্রাক্টর আমাদের এককথায় তুলে নিল ৷ আজকের মতো শেষ গন্তব্য ১৫ কিলোমিটার দূরের বিখ্যাত তাবো গ্রাম ৷

ধুলো ধোঁয়া আর ট্রাক্টরের বিকট আওয়াজে নদী-পাহাড় কাঁপিয়ে ছুটছিলাম সোজা পশ্চিমমুখো ৷ পূর্বদিকে পাহাড় টপকে হ্যালোজেন চাঁদ উঠতে থাকল পাল্লা দিয়ে, রাত দশটা নাগাদ ‘তাবো’র লোকনির্মাণ বিভাগের বাংলোর নরম গদিতে শুয়েও সকলেরই ট্রাক্টর হ্যাংওভার চলছিল ৷

স্পিতিতে প্রথম সকাল ৷ কাছে চায়ের দোকানে প্রাতরাশ সারলাম ৷ লেখা আছে যে ৯৯১ খ্রিস্টাব্দে লামা রিঞ্চেন গাংপো প্রতিষ্ঠিত এই ‘তাবো’ গুম্ভাটি সহস্রতম প্রতিষ্ঠা দিবস পেরিয়ে গেছে ৷ সব ভুলে সাদা চোখে ইতিহাস দেখার ইচ্ছেয় ঢুকে পড়লাম প্রাচীনের অঙ্গনে ৷

এই রুক্ষ ধূসর দেশটা একমাত্র লামাদেরই বাসযোগ্য ৷ ধর্মের অনুশাসন আর কঠোর প্রাণধারণের প্রচেষ্টা মিলেমিশে এ এক অকল্পনীয় জীবনধারা ৷ স্পিতির মানুষদের ইতিহাস শুধু অসম্ভব সহিষ্ণুতা আর সংগ্রামের ৷ তাবো গুম্ভার ঠিক উল্টোদিকের খাড়া পাহাড়ের গায়ে এক সারি গর্ত দেখিয়ে এক যুবক লামা বললেন, ওঁদের পূর্বপুরুষেরা ওই গুহাগুলোরই বাসিন্দা ছিলেন ৷ কারণ ধূসর উপত্যকার অধিবাসীরাও যুদ্ধ-লুঠতরাজ-খুনজখমের সাক্ষী ৷ উত্তর লাদাখ আর তিব্বতের শাসকরা দক্ষিণের কুলু ও বাসার (কিন্নর) অঞ্চলে বারবার হানা দিয়েছে এই শান্তিপ্রিয় পরিশ্রমী মানুষগুলোর ওপর ৷ শত্রুর আক্রমণ এড়াতে এখানকার প্রাচীন অধিবাসীরা দুর্গম পাহাড়ের চূড়ার ওপর তৈরি করেছিলেন বেশ কয়েকটা গড় বা ‘ধানকার’ ৷ শত্রুর অনুপ্রবেশ জানতে পারলেই একদল উঁচু পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বালাত ৷ সংকেত বুঝেই কাছাকাছি সব গ্রামবাসীরা ছুটে চলে আসত গড়ের মধ্যে ৷ সঙ্গে নিয়ে আসত সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় সম্পত্তি, শিশু এবং নারীদেরও ৷ শত্রুরা কাউকে না পেয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে যেত গ্রামগুলো ৷ বাদ দিত না গুম্ভার অমূল্য সম্পদ এবং অপূর্ব শিল্পগুলোও ৷ কখনও আবার শত্রুদের সঙ্গে কপট বন্ধুত্ব পাতিয়ে সুরায় মত্ত করে মেরে ফেলত ৷ এখনও প্রাচীন এক গড় দাঁড়িয়ে আছে ‘লিংটি’ গ্রামের কাছে-সবাই চেনে ধানকার গুম্ভা নামে ৷ এইখানেই ছিল স্পিতির পুরনো রাজধানী ৷ দুর্গের ভেতরকার এক কুখ্যাত বন্দীশালায় বা অন্ধকূপ প্রাচীন স্পিতির ভয়ঙ্কর ইতিহাস শোনাতে পারে পর্যটকদের ৷

স্পিতির সদর শহর কাজাতে পৌঁছলাম সেইদিন বিকেলের দিকে ৷ ছোট হোটেলে জায়গা পেতে অসুবিধে হল না ৷ প্রায় দশ বছর আগে দেখা কাজা বদলেছে অনেকটাই ৷ উন্নয়নের প্রকটতম চিহ্ন হিসেবে মাটি পাথরের ঘরগুলোর মাথায় বসেছে ডিশ অ্যান্টেনা ৷ ঘরবাড়ি দোকানপাটের সঙ্গে রাস্তা জুড়ে ময়লাও জমেছে দ্বিগুণ ৷ নদীর ওপারের গ্রামটার এখন নাম হয়েছে নিউ কাজা, বেশ কয়েকটা পাকা অফিস বাড়ি ৷ ভাঙাচোরা রাস্তায় কয়েকটা মারুতি গাড়ি ৷ দশ বছর আগে সন্ধের পর আর মানুষ দেখা যেত না ৷ এখন ঝলমলে জেনারেটারের আলো ৷ মানুষ বাড়ছে আর হারিয়ে যাচ্ছে সেই শান্ত গম্ভীর হিমালয়ের গ্রামগুলো ৷

সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে হোটেলের বারান্দায় একজন স্থানীয় লামা এসে আলাপ জমালেন ৷ উনি তিব্বতী ওষুধের ফেরিওয়ালা ৷ আমরা অবশ্য ওঁর ঝোলা থেকে পেয়ে গেলাম এই ‘আজবনগরের’ মানুষ-সমাজ-সংস্কার নিয়ে বেশ কিছু লোভনীয় তথ্য মাত্র দুকাপ চায়ের বদলে ৷

আনুমানিক খ্রিস্টজন্মের তিনশো বছর আগে পশ্চিম হিমালয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রধানতম পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই স্পিতি ৷ প্রকৃতির সীমাবদ্ধতায় সহনশীলতার, সংযমের শিক্ষা দেয় এই ধর্ম ৷ তাই আজও এখানে রয়েছে প্রকৃতি-সমাজধর্মের এক অপূর্ব ভারসাম্য ৷ যেমন এখানকার বহুপতি প্রথা, একদিকে যেমন জনসংখ্যা সীমিত রাখে অন্যদিকে দুর্মূল্য চাষজমিগুলো ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ হতে দেয় না ৷ অবশ্য আধুনিক স্পিতির যুবতীরা এখন আর দ্রৌপদীর জীবন মেনে নিতে চাইছে না ৷ আবার এখানকার লামা ধর্মের নির্দেশে পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রকে সাত বছর বয়সে গুম্ভায় পাঠিয়ে দিতে হয় ৷ সংসার, বিবাহ, প্রজনন ও ভোগবিলাস থেকে দূরে ৷ অবাক লাগলেও এখনও স্পিতির প্রত্যেক পরিবারই মেনে নেয় ‘ঝোভা’র নির্দেশ ৷ একজন বিদগ্ধ গণৎকার হিসাবে এই ঝোভা বিচার করে দেন একটি মৃতদেহ পোড়ানো হবে, কবর দেওয়া হবে নাকি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে অথবা টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখা হবে উঁচু পাহাড়ের ওপর পাখিদের খাদ্য হিসেবে ৷

কাজায় পুরো একটা দিন চলে গেল অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ৷ আমাদের এবারের লক্ষ্য শৃঙ্গ অভিযান ৷ বালি ভাগীরথী ক্লাবের উদ্যোগে ৷ এই স্পিতির লিংটি উপত্যকার শেষপ্রান্তে চাউ-চাউ-কাংনিলডা-বাংলায় যার অর্থ ‘আকাশের গায় এক টুকরো নীল চাঁদ’ ৷ পর্বত অভিযান মানেই উপযুক্ত রসদ আর গাইড পোর্টারের সুবন্দোবস্ত ৷ ডেপুটি কমিশনার থেকে খাদ্য ও রেশন বিভাগ ছোটাছুটি করে চাল-ডাল-আটা-কেরোসিন এক বেলাতেই জোগাড় হল স্থানীয় আধিকারিকদের বদান্যতায় ৷ এমনকী কাজার পুলিশ আধিকারিক স্বেচ্ছায় নানান উপদেশ সহ সাহায্যের হাত বাড়ালেন ৷ কিন্তু আবার সেই ট্রাক্টর ভরসা ৷ কাজা থেকে লাংচা গ্রামে পৌঁছবার ১৮ কিলোমিটার পাথুরে চড়াই এখনও হালকা গাড়ির উপযুক্ত নয় ৷ তাই ট্রাক্টরই এখানে একমাত্র ভরসা ৷ গড়্গড় করে পাহাড় চড়ে আর হুড়মুড় করে নদী পেরিয়ে যায় ৷ তবে কান ফাটানো আওয়াজ আর হাড়ভাঙা ঝাঁকুনি ৷ মালপত্তর কম হলে হাঁটাই ভালো ৷

পরদিন সন্ধ্যার মুখে লাংচা (১৪,৫০০ ফুট) গ্রামে পৌঁছে বুকের মধ্যে টের পেলাম হিমালয়ের খাঁটি অন্তরঙ্গতা ৷ ছোট্ট স্কুলবাড়ির আস্তানায় সেদিন সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর গা এলিয়ে দিলাম ৷ সামনে রাতের আকাশ, পূর্ণিমা গেছে গতকাল ৷ একটা স্বর্গীয় পাখির মতো দুটো ডানা মেলে উত্তরের দিগন্ত ছুঁয়ে বসে রয়েছে আমাদের অভীষ্ট কাংনিলডা শৃঙ্গ ৷

খাপছাড়া মেঘ আর শীতের জড়তা নিয়ে ভোর হল লাংচা গ্রামে ৷ নিচের দিকে গ্রামের বাড়িগুলোর ছাদ দিয়ে সাদা ধোঁয়া উঠছে ৷ আমাদের পোর্টার চেতন আংরূপ তার ‘খতা’ (পাহাড়ি ছোট গাধা) নিয়ে আসবে বেলা নটায় ৷ আমাদের লিডার সাহেব একটা হাঁক ছেড়ে বড় বিস্কুটের টিনটার ওপর বসলেন ৷ প্রথমে ফর্দ অনুসারে সমস্ত খাবার ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে নিতে হবে ৷ তারপর বস্তা বাঁধাবাঁধি ৷ এদিকে এ গ্রামের অভিজ্ঞ গাইড মশাই তাঁর মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েছেন ১৫ কিলোমিটার দূরের রংরিক গ্রামে ৷

এরই মধ্যে আমাদের একজন হঠাৎ কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল একটু দূরে দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়ানো একদল বাচ্চার দিকে ৷ ওদের সকলের হাতেই নানা আকারের কালো কালো পাথরের ঢেলা মতো কিছু ৷ অল্প সময়ের মধ্যেই ওই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রাচীন বিনিময় প্রথায় হাতবদল হয়ে গেল কলকাতার লজেন্স আর স্পিতি হিমালয়ের ‘জুরাসিক জীবাশ্ম’-স্পিলবার্গের সিনেমার থেকেও রোমাঞ্চকর ৷ হাতের প্রত্যেকটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ নিচ্ছিলাম প্রায় ১৯ কোটি বছরের পুরনো ওইসব শামুক গেঁড়ি ঝিনুক ৷ আজ যেখানে স্পিতি উপত্যকা সেখানটায় টেথিস সাগরের মজে যাওয়া শেষ জলভাগ একটা বিরাট সরার মতো অঞ্চলে এখনও জমে রয়েছে ৷ বৃষ্টি আর বরফের জলে সেই অগভীর হ্রদের জল আর নোনতা নয় ৷ হ্রদের জল লালচে মাটির পাড়ে ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে ৷ ঢেউয়ের তালে তালে মাটি কাদার মধ্যে খেলা করে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ল্যামেলিব্রাঞ্চ (ঝিনুক), অ্যামোনাইট (গেঁড়ি, গুগলি) এবং আরও অনেক প্রাচীন মাছ ও কীট ৷ অবশ্য এই জুরাসিক হ্রদে নেই মহানায়ক ডাইনোসরেরা ৷ ক্রমশ মাথা চাগাড় দেওয়া হিমালয়ের এই উচ্চতা ওইসব দৈত্যদের জন্য যথেষ্ট বাসযোগ্য ছিল না ৷ ফিরে এসে কলকাতার ভূ-বিজ্ঞানীদের কাছে জেনেছিলাম দুষ্প্রাপ্য এইসব জীবাশ্ম মূলত তিব্বতের মানস সরোবরের আশপাশেই পাওয়া যায় ৷ আর এই অ্যামোনাইট জীবাশ্মই প্রাচীনকাল থেকে স্থান করে নিয়েছে আমাদের ঠাকুর ঘরে পবিত্র নারায়ণ শিলা হিসাবে ৷ অতএব ব্যাপারটা দাঁড়াল যে এই জীবাশ্মগুলো সত্যযুগের নারায়ণ অবতার শ্রীরামচন্দ্রের তুলনায় বেশ কয়েক কোটি বছরের প্রৌঢ় গুরুজন ৷

এরমধ্যে ঢং ঢং করে গলার ঘণ্টা বাজিয়ে পৌঁছে গেল চারটি গো-বেচারি প্রাণী ৷ উচ্চতায় সাড়ে তিন ফুট, হালকা বাদামি আর ছাই রঙা চেহারা ৷ মাথাটা তুলনায় বড় এবং কান দুটো আরও ৷ স্থানীয় নাম ‘খতা’ ৷

প্রথমে ঘণ্টাখানেক বেশ ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড় ৷ অবশ্য গাছগাছালি একদম অনুপস্থিত ৷ ছোট ছোট হলুদ কমলা ঘাসফুল আর নীল আকাশ দেখতে দেখতে মনেই ছিল না পিঠের বোঝাটা ৷ পিছন দিকে তখন সকালের একপেশে সোনালি রোদে লাংচা গ্রামটা ঝকঝকে একটা ত্রিমাত্রিক রঙিন ছবি ৷ তবে রাস্তা বেশ মজার ৷ সবটাই যেন সবুজ, বাদামি আর ধূসর প্রলেপ দেওয়া ঢেউ খেলানো মালভূমি ৷ সামনে উত্তর থেকে পুবে কানামো, কাংনিলডা হয়ে শিলা গিরিপথ ৷ সবই শুকনো, জলের দেখা নেই ৷ পিঠের স্যাকটা নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সময় দেখা হল একটা বছর দশেকের ছেলে খতার পিঠে ইয়াকের শুকনো গোময় সংগ্রহ করে ফিরছে ৷ আগামী শীতের জ্বালানি ৷ সারামুখে পরিশ্রমের কাঠিন্য-এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই ৷

দিনের চলা শেষ ৷ ঘড়িতে প্রায় সাতটা ৷ ঢালু, চওড়া মাঠ ৷ দুপাশে দুটো জলের ধারা, অভিযানের মূল শিবিরের একমাত্র আদর্শ জায়গা ৷ দুজন গাইড ও পোর্টার নিয়ে সাতজনের দলটার জন্যে দুটো তাঁবু আর একটা রান্নার জায়গা পাতা হল ৷ সওয়া সাতটায় শিবির তৈরি ৷ সূর্য তখনও ওভারটাইম খাটছে ৷ তবে ওর ছুটি হতেই আমাদেরও জবুথবু অবস্থা ৷ ব্যাগ থেকে থার্মোমিটার বার করে দেখি রাত আটটার সময়ই তাপমান হিমাঙ্কের নিচে ৷ দুপুরবেলায় পারা উঠেছিল প্রায় ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ৷ খাঁটি আলপাইন মরু প্রদেশের আবহাওয়া ৷ ম্যাপ খুলে দেখলাম জায়গাটার উচ্চতা ১৬,৫০০ ফুটের মতো এবং আজ আমরা মোট ২১ কিলোমিটার হেঁটেছি ৷ ঘুমের মধ্যে দূরে অ্যাভালাঞ্চের গুড়গুড় শব্দ শুনে স্বপ্ন দেখলাম জুরাসিক পার্কে আছি ৷

মূল শিবিরে প্রথম সকাল ৷ রোদ এসে আলতো ছোঁয়া দিল টেন্টের গায়ে-তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে ৷ সুন্দরী কাংনিলডার এক পাশের গালে সোনালি আভা ৷ চোখ ফেরানো যায় না ৷ মনটাও শিখর সমীপে ৷ কাব্য ছেড়ে মন দেওয়া হল দিন অনুযায়ী প্যাকিংয়ে ৷ নিখুঁত চুলচেরা রসদের হিসাব ৷

পরিকল্পনামাফিক একদিনের বাড়তি খাবার মজুত রাখা হল আলাদা, আগামী তিনদিনের মাথায় শিখর অভিযাত্রীরা ক্লাইম্ব শেষ করে মূল শিবিরে ফিরবে ৷ এক নম্বর শিবির হবে ঠিক ক্লাইম্বিং ফেসের পায়ের কাছে ৷ এখান থেকে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় ৷

পরদিন সকাল নটায় আমরা তিনজন আর দুজন হ্যাপ (high altitude porter) রওনা দিলাম পরবর্তী শিবির স্থাপন করে আসবার জন্য ৷ এইরকম মালপত্র নিয়ে যাতায়াত করলে পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে খুব সুবিধে হয় ৷ শহুরে শরীরগুলো হিমালয়ের উচ্চতার সঙ্গে পরিচিত হয় ৷ আমরা কাংনিলডা চড়বার প্রচলিত পথ ছেড়ে বেছেছিলাম দক্ষিণমুখো সাদা বরফের ঢালটা ৷ এপথে কাংনিলডার কাঁধে উঠতে কম সময় এবং বেশি পরিশ্রম লাগে ৷ ওখান থেকে শিখর আর মাত্র হাজার দেড়েক ফুট ৷

আমাদের প্রথম দল তৈরি হল দুজন সদস্য আর দুজন হ্যাপকে নিয়ে ৷ এই দল সফল না হলে দ্বিতীয় দল তৈরি থাকবে পরদিনের জন্য ৷ শেষ শিবির (Summit Camp) রাখা হয়েছে বিশাল একটা হিমবাহের তৈরি বেসিনের এক প্রান্তে, প্রান্ত গ্রাবরেখার (end morain) ওপর ৷ এখান থেকে ঘাড় উঁচু করেও শিখর দেখা যায় না ৷ ভূগোলের ভাষায় এই জায়গাটার এক দারুণ নাম আছে-glacial amphitheatre, এখানে উচ্চতা ১৮,০০০ ফুট ৷ অতএব চড়তে হবে আরও প্রায় ২,৭০০ ফুট এবং সেইদিনই নেমে আসতে হবে অতটাই ৷ শিবির গুছিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম সামনের চড়াইটা বুঝে নিতে ৷ এবং নেমে আসার সময় অন্য কোনও পথ পাওয়া সম্ভব কিনা ৷ প্রায় ঘুম ছাড়াই রাতটা কাটল ৷ ভোরবেলা স্টোভ জ্বেলে বরফ গলিয়ে একটু স্যুপ আর গতরাতের পাথর হয়ে যাওয়া সুজিকে গরম করতে বেশ হিমসিম অবস্থা ৷ গত রাতের মাইনাস টেনের ঠেলায় ফাইবারের জুতোগুলোও যেন কাঠ ৷ তার তলায় ক্র্যাম্পন (crampon) বাঁধতে ঘাম ঝরল ৷ সকলের পকেটেই কিছু শুকনো খাবার ৷ পিঠে হালকা ন্যাপস্যাকে একটা দেশের ও একটা ক্লাবের পতাকা দলনেতার শুভেচ্ছাসহ ৷ চোখে বরফ চশমা আর হাতে আইস অ্যাক্স ৷ বরফ ঢাল শুরু হতেই চারজন ১২০ ফুট দড়ির মধ্যে একসূত্রে বাঁধা পড়লাম ৷

পুবের প্রাচীর টপকে সূর্য উঁকি মারতেই চোখ ঝলসে গেল ৷ বহুযুগের শক্ত বরফ নীলচে হীরের চাদরের মতো ঠিকরে উঠল ৷ জুতোর তলায় কাঁটাগুলো ধাতব টংকার তুলে ছিটকে উঠছে ৷ বরফ গাঁইতির ফলাও হার মানছে পদে পদে ৷ ক্রমশ আলো বাড়ছে আর বাড়ছে চড়াই ৷ লাগাতার ৩০ ডিগ্রি থেকে ৫০ ডিগ্রি ঢাল ৷ পা দুটোকে আরাম দিতে হলে ছোট একটা গর্ত কেটে দাঁড়াতে হচ্ছে ৷ পিছন দিকে হাজার পাঁচেক ফুট নিচে দূরে আমাদের মূল শিবিরের নীল কমলা টেন্ট চোখে পড়ছে ৷ ওরা হয়তো পালা করে দূরবিনে চোখ রেখে উৎকণ্ঠায় ৷ এ খেলায় কোনও দর্শক গ্যালারি সমর্থকের জায়গা নেই ৷ নিজেদের মধ্যে দুয়েক টুকরো কথা ৷ গলায় পাথর হয়ে বসা ক্যামেরা দিয়ে ভালোলাগার অবিস্মরণীয় দৃশ্যগুলো তুলে রাখছি মাঝে মাঝে ৷

প্রায় পাঁচঘণ্টা লাগাতার দেওয়াল চড়ার লড়াই শেষ হল ৷ কাংনিলডার কাঁধে তখন দুপুরের মেঘেরা পথ আগলে দাঁড়িয়েছে ৷ একটু পরেই এল শনশনে হাওয়া ৷ যেন চেকপোস্টে আবার অনুমতিপত্র দেখাতে হবে ৷ আমরা চার অবাধ্য প্রাণী তখন বিশ হাজার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে দেহ-মন-রসদের সঙ্গে সময়ের এক কঠিন ঐকিক নিয়মের অঙ্ক কষতে বাধ্য হলাম ৷ এই খেলায় হারাজেতার তফাৎটা বড় সূক্ষ্ম কিন্তু চরম ৷ কাংনিলডার হাওয়া ধমক দিয়ে জানাল আলো কমে গেলে এ রাস্তায় নামাটা আত্মঘাতী হবে ৷

সাফল্যের শিখর কাছেই ছিল ৷ কঠিন বাধাগুলোও ছিল অতিক্রান্ত ৷ অতএব কাব্য করলে দাঁড়ায় ‘কাছে থেকে দূর রচিলে-’ ৷ আর মোদ্দা কথা আপনি বাঁচলে আবার হবে ৷ প্রায় সারা বছরের আয়োজন ৷ কঠোর বাস্তব বেদনা নিয়ে আবার আমরা ফেরার পথ ধরলাম ৷ তবে হিমালয় সত্যিই কখনও একদম খালি হাতে ফেরায় না ৷ আমার কাছে হিমালয়ের প্রতিটি মুহূর্তই দুর্মূল্য অভিজ্ঞতা আর অনন্য এক বোধ ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন