কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

নভেম্বর মাসের শেষ দিক, কালিম্পং-এ ক্যাম্প করছি ৷ পাঁচদিন ঠাসা কাজে কেটেছে, এবার বাড়ি ফেরা ৷ বারান্দায় হেলানো চেয়ারে বসে বিকেলের পড়ন্ত রোদে কাঞ্চনজঙ্ঘাদের দিকে তাকিয়ে আছি ৷ এখনও ঝকঝকে রুপোর তৈরি, অল্পক্ষণের মধ্যে হবে আগুনে লাল, তারপরে তামার, তারপর সীসের ৷ উত্তর-পূর্ব আকাশ জুড়ে এই আশ্চর্য উপস্থিতি পৃথিবীর আর কোথাও নেই, এমনকী হিমালয়েরও অন্যত্র কোথাও নয় ৷ কোথাও দেখা যায় চব্বিশ হাজার ফুটের চেয়েও উঁচু পাশাপাশি এমন সব অলৌকিক হিমগিরি? আয়াসহীন আলস্যে হাতের কাছে চায়ের কাপ নিয়ে বসে বসে দেখছি বাল্যকাল থেকে আলাদা করে চেনা বিশিষ্ট অনেকগুলো রূপ: কাং, জানু, কাবরু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, পানডিম, সিমভু, সিনিয়লচু, চোমিও মো, কাংচেনজাউ, পাউহুনরি ৷ এই বিস্তৃত, আয়ত তুষারজগতের সমগ্র চেহারা আমাদের এমন অভিভূত করে যে স্বতন্ত্র শৃঙ্গগুলোর অস্তিত্ব ও অবস্থানের প্রশ্ন মনে আসে না ৷ সব মিলিয়ে, সবটাই বাঙালির কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷ সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম থেকে, পিকচার পোস্টকার্ড থেকে, হাজার হাজার দর্শকের তোলা ফটোগ্রাফের একটাই শিরোনামা ৷ আমরা এদের প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূর থেকে দেখতে অভ্যস্ত ৷ আরও অনেক দূর থেকে দেখা যায় ৷ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আকাশ পরিষ্কার থাকলে জলপাইগুড়ি থেকেও ৷ সে এক আশ্চর্য দৃশ্য আকাশে ভাসছে ৷ সামনের জমিতে কলাগাছ পানাপুকুর কুঁড়েঘর আর পশ্চাৎপটে কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্গলোক, একটু আবছা কিন্তু অস্পষ্ট নয় ৷

যে সব গিরিশৃঙ্গের নাম করেছি তাদের প্রত্যেকটির শিখরে মানুষ চড়েছে ৷ যে সময়ের কথা বলছি, ১৯৫২ সাল, তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা অনেক প্রাণ হরণ করেছে কিন্তু বিজিতা হয়নি ৷ এভারেস্ট বিজয় হয়েছে ১৯৫৩ সালে ৷ তারও অনেক পরে কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷

এই অতুলনীয় তুষারজগতের আরও কাছে যাওয়া যায় ৷ বরফগলা অসংখ্য স্রোতের ধারা নেমে আসছে, একে অপরের সঙ্গে মিলে নদীর রূপ নিচ্ছে, আরও বড় নদী হয়ে শেষে গিয়ে পড়ছে তিস্তায়, তারপর ব্রহ্মপুত্রে (যার স্থানীয় নাম যমুনা) তারপর পদ্মা মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে ৷ এই সব পাহাড়ি নদীর সূত্র ধরে উত্তরমুখে গেলে পৌঁছনো যায় একেক স্বতন্ত্র গিরিশৃঙ্গের পাদদেশে ৷ আরও উত্তরে গেলে পৌঁছনো যায় তিব্বতের মালভূমিতে, যেমন শরৎ দাস গিয়েছিলেন ৷ তাঁরও আগে যেসব সাহেব উত্তর সিকিম অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ডগলাস ফ্রেশফিল্ড ৷ এই শতকের প্রথম দশকে তাঁর Round Kangchenjunga বইখানা প্রকাশিত হয় ৷ তখন থেকেই এভারেস্ট চড়বার পরিকল্পনা ৷ আগ্রহী ও একমাত্র দাবিদার ইংরেজরা ৷ এভারেস্টের অবস্থান নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তে, কিন্তু সেই সময় নেপালে বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সুতরাং দক্ষিণদিক থেকে এভারেস্ট পৌঁছনো যাবে না ৷ উত্তরদিকটা তিব্বতের অধিকারে, সেইপথ ইংরেজদের কাছে খোলা, কারণ ইয়ংহাজব্যান্ড অভিযানের পর তিব্বত পথ খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে ৷ সিকিম ও তিব্বতের মধ্য দিয়ে এভারেস্টের উত্তর-পাদদেশে পৌঁছনোর সম্ভাব্য সব পথ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে ৷ ডগলাস ফ্রেশফিল্ডের অভিযান এইসবের অন্যতম ৷ এই জন্য তাঁর নাম করছি যে উত্তর সিকিম, যে অঞ্চলে প্রধানতম সব গিরিশৃঙ্গ অবস্থিত-দার্জিলিংয়ের দূরত্ব থেকে যেসব দেখে আমরা মুগ্ধ হই-তার জিওগ্রাফি, প্রধান প্রধান হিমবাহের অবস্থিতি ও প্রকৃতি, সব কিছুর প্রাথমিক ও চমকপ্রদ বর্ণনা এই বইটিতে রয়েছে ৷ সঙ্গে ম্যাপ ও তখনকার আমলে তোলা ফটোগ্রাফ ৷ এই বই দার্জিলিংয়ের জিমখানা ক্লাবের লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে পড়েছিলাম, পরে আর কোথাও এই বই দেখিনি ৷ ইতিমধ্যে হিমালয়-সাহিত্য পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে, Round Kangchenjunga তার নিচে অদৃশ্য ৷

একলা, কোনও বন্দোবস্ত নেই, কোন পথে যাব ৷ পশমের রাস্তা ধরব নাকি ৷ মধ্য এশিয়ায় যে রকম একটা রেশমের রাস্তা ছিল, বাগদাদ থেকে বোখারা সমরখন্দ উরুমচি তাকলা মাকান গোবি হয়ে চিন পর্যন্ত যে রাস্তায় একসময় উটের ক্যারাভান চলাচল করেছে, যে রাস্তা মার্কোপোলো সাহেব ডাকাতদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন, সেইরকম একটা পশমের রাস্তা আছে কালিম্পং থেকে গ্যানটসে লাসা পর্যন্ত, যে রাস্তা জেলেপ-লা গিরিপথ অতিক্রম করে তিব্বতে প্রবেশ করেছে ৷ এই রাস্তা হচ্ছে তিব্বত-ভারত বাণিজ্যের একমাত্র না হলেও প্রধান বাহক ৷ বর্তমানে তিব্বত-ভারত বাণিজ্য অন্তর্হিত হয়েছে, কিন্তু ১৯৫২ সালে এই রাস্তা দিয়ে প্রভূত পরিমাণে তিব্বতি ভেড়ার পশম ও কিছু পরিমাণে চমরি গাইয়ের লোম আমদানি হত, অধিকাংশ আসত কালিম্পংয়ের বাজারে, সামান্য কিছু যেত গ্যাংটকে ৷ কালিম্পং শহরের পূর্ব উপান্তে, দশমাইল মাইলপোস্টের আশপাশে (তিস্তা ব্রিজ থেকে দশমাইল) তখন ছিল অনেকগুলি পশমের গুদাম ৷ খচ্চরের পিঠে আসত, এই রাস্তায় দিনমানে যে কোনও সময় দেখা যেত সার সার খচ্চর আসছে, তাদের পিঠে দুপাশে সমান আকারের বোঝা ৷ ফেরবার সময় এই খচ্চররা নিয়ে যেত চাল ডাল কেরোসিন কাপড় কম্বল থেকে আরম্ভ করে যন্ত্রপাতি রেডিও গ্রামোফোন আয়না চিরুনি পর্যন্ত সব কিছু ৷ দলাই লামার প্রয়োজনে যে দু-তিনটি মোটরগাড়ি পাঠানো হয় তাও অনেকগুলি বিভিন্ন অংশে প্যাক করে খচ্চরের পিঠে এই পথে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে গিয়েছে মিস্ত্রী, লাসায় পৌঁছে সব অংশগুলি যথাযথ জোর লাগিয়ে সম্পূর্ণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ৷ এইভাবে গিয়েছে অনেক জেনারেটর, টিউবওয়েল, লেদমেশিন ও বিবিধ আরও যন্ত্রপাতি ৷ চিনারা তিব্বত অধিকার করার পরেও কিছুদিন এই ব্যবসায়িক লেনদেন অব্যাহত ছিল ৷

যে সময়ের কথা বলছি, তখন তিব্বত-ভারতের এই বাণিজ্য খুবই ফলাও হয়ে উঠেছে ৷ স্বভাবতই, ভারতের তরফে এই ব্যবসার মালিকানা কয়েকঘর মাড়োয়ারির হাতে, যেমন কোডামল জেঠমল, শ্রীরাম নন্দরামরা ও আরও অনেক মেজো-ছোটরা ৷ তিব্বতের সঙ্গে টাকাকড়ি লেনদেন, তথা ব্যাঙ্কিংয়ের কাজে সর্বপ্রধান ছিল দার্জিলিংয়ের জেঠমল ভোজরাজরা, তারা কালিম্পংয়ের পরিবর্তে গ্যাংটকে স্থিত একটি মস্ত গদি থেকে তাদের এই ব্যবসা পরিচালনা করত ৷ পশমের ব্যাপারে এইসব মাড়োয়ারি ব্যবসাদাররা প্রত্যক্ষভাবে খচ্চরওয়ালাদের কাছ থেকে মাল কিনে নগদে চুকিয়ে দিত ৷ যুদ্ধের পর এই ব্যবসার খুব বাড়বৃদ্ধি হয়, কারণ তিব্বতি পশমের একটা মস্ত বড় বাজার ছিল আমেরিকায়, কার্পেট তৈরির জন্য এই সস্তা রুক্ষ পশম সেখানে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হত ৷ কালিম্পংয়ের দশ মাইলে তিব্বতি খচ্চর ও খচ্চরওয়ালাদের একটি বড় রকম বস্তি ৷ পশম ঝাড়াই গাঁঠবাঁধাই হচ্ছে, ভারতীয় পণ্যসামগ্রী প্যাকিংবাক্সে, বস্তায় ভরা হচ্ছে, ট্রাকের মাল উঠে যাচ্ছে খচ্চরের পিঠে ৷ একদল খচ্চর এসে মাল খালাস করছে, আরেক দল বোঝা পিঠে নিয়ে গুটি গুটি রওনা দিয়েছে তিব্বতের দিকে ৷ তিব্বতি খচ্চরওয়ালা, নেপালি কুলি ও মাড়োয়ারি গোমস্তাদের যেন একটা রাসায়নিক মিশ্রণ বনে গেছে ৷ একমাত্র চালু ভাষা হচ্ছে তিব্বতি, যে ভাষা আমার মনে হয়েছে দশমাইলের মাড়োয়ারিরা তিব্বতিদের চেয়েও ভালো বলে ৷ মানুষে পশুতে মিলিয়ে এই দশমাইল যেন একটা ছোটখাটো খচ্চরের গড়মুক্তেশ্বর ৷

১৯৫২ সালে, আমি যখন এদের মধ্যে ইনকাম ট্যাক্সের কৃপাণ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, তখন এই সমৃদ্ধ ব্যবসায়ে মাড়োয়ারিদের একনায়কত্ব একটু টলেছে ৷ কয়েকটি বড় বড় তিব্বতি ফার্ম কালিম্পংয়ে এসে বাসা বেঁধেছে ৷ তাদের মধ্যে মুখ্যতম ছিল দুটি পরিবার, পাংডাংসাং আর সাদু-ৎ সাং ৷ এদের মধ্যে তিব্বতি নীলরক্ত প্রবাহিত ৷ জোত জমি ব্যবসা (দাসব্যবসা সমেত) যাদের করায়ত্ত ছিল এরা তাদের অন্যতম ৷ আরেকটি ফার্ম ছিল বিখ্যাত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রেটিং লাদরেং, তিব্বতে যাদের গুম্ভাতে সহস্রাধিক লামা প্রতিপালিত হয় ৷ এছাড়া তখন সবে গজিয়েছে দুটি লিমিটেড কোম্পানি, ইন্ডো-টিবেট লিমিটেড ও উল-এজেন্টস লিমিটেড ৷ এই কোম্পানি দুটি ভারতে রেজিস্ট্রিকৃত, কিন্তু এদের অসংখ্য শেয়ারহোল্ডারদের হরেকরকম তিব্বতি নাম, এবং ঠিকানা তিব্বতের বিভিন্ন জায়গায় ৷ কারা এইসব তিব্বতি? গভীর সন্দেহের চোখে তিব্বতি মাড়োয়ারি সকলের দিকে তাকাচ্ছি, তাদের তিব্বতি ভাষায় লেখা হিসাবপত্র ইংরিজিতে অনুবাদ করাচ্ছি ৷ কোনও হদিশই পাচ্ছি না কেন সহসা এতগুলি তিব্বতি কালিম্পংয়ে এসে অধ্যবসায় সহকারে পশমের ব্যবসায় নামল ৷

একটা প্রত্যক্ষ কারণ অবশ্যই আছে ৷ ১৯৪৮ সালে চিনে কমিউনিস্ট শাসন কায়েম হবার পর পরই তিব্বতের প্রতি চিনের আকর্ষণ শুরু হয় ৷ প্রথম দিকটায় ভলান্টিয়ার রূপে দলে দলে খাকি পরিহিত চিনারা তিব্বতে এসে পৌঁছয়, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ৷ মুখ বুজে খেতখামার, পশুপালন, সেচ ব্যবস্থা, রাস্তা সেতু তৈরি মেরামতের কাজে নিজেদের বিনিয়োগ করে ৷ এই অনুপ্রবেশের পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলি আমরা এতদিনে সবই জানি ৷ উচ্চবিত্ত তিব্বতিরা, তাদের মধ্যে অনেকে নানাবিধ মঠের অধ্যক্ষ, এক পা এক পা করে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছয় ৷ সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান কালিম্পং, তিব্বত সীমান্ত থেকে খচ্চরের পিঠে দুদিনে পৌঁছে যাওয়া যায় ৷ এই সময় একাধিক রাজ্যচ্যুত রাজা (যেমন প্রিন্স পিটার অব গ্রিস), ঘরছাড়া মধ্য-ইউরোপীয় প্রৌঢ়রা, মালয় সিঙ্গাপুর থেকে উৎপাটিত শ্বেত-চিন ব্যবসায়ীরা কিছু সংখ্যায় কালিম্পংয়ে এসে পৌঁছেছেন, ছবির চেয়েও সুন্দর শহরে ছবির মতো বাড়ি তৈরি করে বসবাস আরম্ভ করেছেন ৷ তাঁদের টাকা কোথা থেকে আসছে তা তাঁরা ও ব্যাঙ্ক অব চায়না ছাড়া আর কেউ জানে না ৷ ইনকাম ট্যাক্স অল্পস্বল্প কৌতূহল অনুভব করছে, এই মাত্র ৷

কর্মসূত্রে এইসব বিদেশিদের কিছু কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যিনি তাঁর নাম রাজা এস টি দোরজি, ভুটানের প্রধানতম ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, কালিম্পংয়ে প্রচুর বিষয় আশয়, ব্যবসা দোকানদারির ধার ধারেন না ৷ ইনি দার্জিলিংয়ে আমার মাতামহের জীবৎকালে তাঁর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, বাল্যকালে অনেক দেখেছি, সবসময় ভুটানি পরিচ্ছদ, রুচিতে সংলাপে পাকা ইংরেজ ৷ এঁর দুই কন্যার মধ্যে ছোটটির বিবাহ হয়েছিল ভুটানের রাজার সঙ্গে ৷ বর্তমান মহারাজা এই ছোটটিরই সন্তান ৷ রাজা দোরজির বড় মেয়ে তাসি অবিবাহিতা রয়ে গেছেন ৷ কেন, তা বোঝা মুশকিল ৷ তখন তাঁর কত বয়স তা জানি না কিন্তু চেহারায় একটি সদ্যফোটা চাঁপাফুল, চোখে মুখে সুশিক্ষা ও সহবতের দীপ্তি উজ্জ্বল হয়ে আছে ৷ রাজা দোরজির বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানো এক সৌভাগ্যের বিষয় ৷ ছোটখাটো পালিশ করা কাঠের বাড়ি, চতুর্দিকে পরিচ্ছন্ন বাগান, অনেকরকম অর্কিড, ফিউশিয়া, হাইড্র্যানজিয়া, অ্যাজেলিয়া ৷ ভেতরের সজ্জা সাবেকি তিব্বতি ৷ উচ্চস্তরের ভুটানিরা তিব্বতি বংশোদ্ভব ৷ বসবার ঘরে কয়েকটি আশ্চর্য তনখা ঝুলছে, মেঝেতে কয়েকটি ছোট সাইজের কার্পেট, যেমন তিব্বত ভুটানে হয় ৷ এক কোণে তথাগতের জন্য একটু জায়গা, তাঁর সোনালি মূর্তির সামনে মাখনের প্রদীপ জ্বলছে, পিছনের তনখায় তাঁরই ছবি, সামনে উপাসনার জন্য আসন পাতা ৷ ঘরে পুরু উঁচু গদিতে বসবার ব্যবস্থা, সামনে ল্যাকারের কাজকরা নিচু টেবিল, তার ওপর ক্রিম-দ্য-মেনথ পরিবেশিত হয়ে রয়েছে ৷

এই স্মৃতির সঙ্গে জড়িত হয়ে আছেন আরেক বৃদ্ধ, তাঁর নাম হেন ফং ৷ মান্দারিন চিনা, জাপানি উৎপাতের সময় থেকে ইনি দেশছাড়া ৷ সিল্কের ব্যবসা ছিল ৷ সাংহাই, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর পর পর এই তিন জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে কালিম্পংয়ে এসে পৌঁছেছেন ৷ বাড়ি করেছেন, তার পরেও ব্যাঙ্কে অনেক টাকা, যার ফলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ ৷ হেন ফং অশীতিপর বৃদ্ধ, প্রায় অন্ধ ৷ একটি কিশোরী পৌত্রীর হাত ধরে আমার ক্যাম্প অফিসে আসা-যাওয়া করেন ৷ কাঁপা কাঁপা গলায় সুন্দর ইংরিজিতে তাঁর কাহিনী সব আমায় বলেন ৷ ওই পৌত্রীটি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই ৷

কে জানে এখন এরা সব কে কোথায় ৷ চিন কর্তৃক তিব্বত গ্রাস হয়ে যাবার পর আমেরিকা তিব্বতি পশম কেনা বন্ধ করে দেয়, কমিউনিস্ট দেশে উৎপন্ন সামগ্রী বলে ৷ তাছাড়া তিব্বতিদের পক্ষে প্রয়োজনীয় বিবিধ ভোগ্যপণ্য, যা দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষ জোগান দিয়েছে, চিন থেকে সরাসরি তিব্বতে পৌঁছতে লাগল ৷ কয়েক বছরের মধ্যে কালিম্পং-লাসা পশমের লাইনে ব্যবসা বাণিজ্য সব শেষ ৷ নাথুলা জেলেপলা গিরিবর্ত্মে ১৯৬২ সালের পর সৈন্যশিবির ছড়ানো, সাধারণের প্রবেশ নিষেধ ৷

আমার স্টেনোগ্রাফার ব্রজেনকে বললাম গ্যাংটক হয়ে নাথুলা যাচ্ছি, ফিরতে কদিন দেরি হবে, বাড়িতে একটু খবর দিয়ে দিও ৷ ব্রজেন বলল, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি?’ শুনে আমার খুবই ভালো লাগল ৷ সক্ষম, চঞ্চল যুবক ৷ আমাকে একলা ছেড়ে দিতে রাজি নয় ৷

পরদিন সকালে মোটরযোগে কালিম্পং থেকে গ্যাংটক ৷ কালিম্পং থেকে গাড়ি দ্রুত নেমে যায় তিস্তার প্রবাহিকায়, যেখানে রঙ্গিত নদী তিস্তায় এসে পড়েছে ৷ এখানে তিস্তা ব্রিজ, তিনটি প্রধান রাস্তার জংশন ৷ ব্রিজ পেরিয়ে একটি চলে গেছে, তিস্তাকে বাঁদিকে রেখে, শিলিগুড়ির দিকে, দ্বিতীয় রাস্তাও ব্রিজ পেরিয়ে পাকদণ্ডী নিয়ে পাহাড়ে উঠে গেছে, পেশক ও লোপচু চা-বাগানের মধ্য দিয়ে দার্জিলিংয়ের দিকে, আর তৃতীয় রাস্তা তিস্তা না পেরিয়ে তার আশপাশে চলে গেছে সিংতাম পর্যন্ত ৷ সেখানে অপর একটি সেতু পেরিয়ে রোংগনি নদীর পথ ধরে বেশ চড়াই রাস্তায় গ্যাংটক পৌঁছতে হয় ৷ কালিম্পং থেকে গ্যাংটক মোটরে যেতে ঘণ্টাচারেক লাগে, যখন পৌঁছলাম তখন বেলা বারোটা হবে ৷ কিছু খাদ্যদ্রব্য ও সফরের পক্ষে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনবার ছিল, রুকস্যাক, ভারি মোজা, কানঢাকা টুপি, উইন্ডচিটার ইত্যাদি ৷ তখনও আমেরিকান সৈন্যদের পরিত্যক্ত ডিসপোজালের মাল গ্যাংটকের বাজারে প্রচুর পড়েছিল, পাহাড়ে সফরের পক্ষে উপযুক্ত সুন্দর সব জিনিস পেয়ে গেলাম ৷ মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে এবং গুটিদুই পোর্টার সংগ্রহ করে পরদিন সকালে নাথুলার পথে রওনা হয়ে গেলাম ৷ গ্যাংটক থেকে কারপোনাং পর্যন্ত আট-দশ মাইল চমৎকার প্রায় সমতল রাস্তা, পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে চলে গেছে ৷ নভেম্বর মাসের ঈষৎ কনকনে শীত, পরিষ্কার আকাশ থেকে উজ্জ্বল উষ্ণ রৌদ্র পাচ্ছি ৷ কারপোনাং বাংলোতে যখন পৌঁছলাম তখনও মধ্যাহ্ন হয়নি ৷ অল্প বিশ্রামের পর দ্বিতীয় ধাপের পর্যটন শুরু হল ৷ এবার আর ততটা স্বচ্ছন্দ ও সরল নয়, বেশ চড়াই ও বন্ধুর ৷ পরবর্তী গন্তব্যস্থল হচ্ছে ছাঙ্গু, দশমাইল দূরে, কারপোনাং থেকে আরও ৪,০০০ ফুট উঁচুতে ৷ এ রাস্তায় কাঞ্চনজঙ্ঘা বা অন্যান্য তুষারশৃঙ্গ বাঁদিকের পাহাড়ের পিছনে অদৃশ্য হয়েছে, ডানদিকে খাদ, যতদূর চোখ যায় নেমে গিয়েছে, তার ওপারে বিবর্ণ ধোঁয়াটে পাহাড়ের ঢেউ ৷ দশ হাজার ফুট উচ্চতার ওপর দিয়ে চলছি, গতি অনেক মন্থর, সারাদিন ধরে পর্যটনে সর্বাঙ্গে ক্লান্তি ৷ আশপাশ তৃণহীন হয়ে আসছে, রডোডেনড্রন ম্যাগনোলিয়া বা অন্য গাছ যা চোখে পড়ে তা সম্পূর্ণ পত্রহীন, কালো বিকৃত ভঙ্গিতে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে ৷ দিগন্তে রুক্ষ, পাথুরে পাহাড় ৷ শীতের প্রাক্কালে অতি নিরস ও নিষ্করুণ হিমালয়ের মধ্য দিয়ে চলেছি ৷

ছাঙ্গুতে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে ৷ এখানে একটি হ্রদ, মাইলখানেক লম্বা, আধ মাইল চওড়া, ১২,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ৷ শীতে জমে সমতল মাঠ হয়ে গেছে ৷ পরবর্তীকালে, শুনেছি, শীতকালে সৈন্যরা এর ওপর দৌড়োদৌড়ি করে বেড়ায়, স্কি চালানোর অভ্যাস করে ৷ এই হ্রদের কোলে একটি ছোট ও অপেক্ষাকৃত জীর্ণ বাংলো দেখতে পেলাম, আমাদের আজ রাতের আশ্রয় ৷ অবসন্ন, ক্ষুধার্ত, শীতে জরজর অবস্থায় ব্রজেন আর আমি এবং আমাদের দুই পোর্টার বাংলোয় প্রবেশ করলাম এবং দেখতে পেলাম ফায়ারপ্লেসে গনগনে কাঠের আগুন জ্বলছে ৷ তাকে ঘিরে বসে আছে তিনজন লোক ৷ সম্ভবত আমাদের কিছু আগে এরা এসে পৌঁছেছে ৷

অন্ধকার ঘরের দেওয়ালে ফায়ার প্লেসের আগুন থেকে প্রক্ষিপ্ত মানুষগুলোর ছায়া কাঁপছে ৷ আমাদের সর্বাঙ্গ ভারি জামাকাপড়ে ঢাকা, মাথাঢাকা টুপি ৷ সহসা চেনবার উপায় নেই, ওরা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে ৷ কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম, যার চোখে চশমা চকচক করছে, সে রামেশ্বর ৷ রামেশ্বর আগরওয়ালা, কালিম্পংয়ের একজন প্রধান পশম ব্যবসায়ী, শিক্ষিত ও মার্জিত ৷ আমাদের দেখে রামেশ্বর অবাক ৷ চেয়ার-টেয়ার এল, আগুনকে ঘিরে আমরাও বসে গেলাম ৷ কেটলি ভরা গরম চা, বিস্কুট, আখরোট, বাদাম ৷ ব্যবসা উপলক্ষে রামেশ্বর ইয়াটুং যাচ্ছে, তার সঙ্গী দুজন তিব্বতি ৷ একজন পোশাকে, সহবতে সম্ভ্রান্ত বলে বোঝা গেল, নামটা মনে নেই, ‘কুশো’ অর্থাৎ ‘মহাশয়’ জাতীয় একটা সম্বোধন ব্যবহার করা হচ্ছিল ৷ অপরজন কুশোর কোনও অনুচর ৷ কুশো অল্পস্বল্প হিন্দি ও ইংরিজি বলে, রামেশ্বর ভালো তিব্বতি বলে ৷ পারস্পরিক আলাপের কোনও অসুবিধে হল না ৷ ইয়াটুং যেতে হলে নাথুলার ১৪,৫০০ ফুট উঁচু গিরিবর্ত্ম পার হয়ে ওপারে তিব্বতের মধ্যে প্রবেশ করতে হয় ৷ আমি জানালাম যে, আমার উদ্দেশ্য নাথুলা পৌঁছে সেখান থেকে ফেরত চলে আসা ৷ তিব্বত আমার পক্ষে নিষিদ্ধ বিদেশ, সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিনা অনুমতিতে তিব্বতে প্রবেশ করা আমার উচিত হবে না ৷ এই যে সিকিমে এসেছি তাও আমার পক্ষে উচিত হয়নি, গ্যাংটকে পৌঁছেই আমার পলিটিক্যাল অফিসার জে এস লালের সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল, তা করিনি ৷ তখন, মনে রাখতে হবে, সিকিম ভারতবর্ষের ২২তম রাজ্য হয়নি ৷

আমার আপত্তি বা দ্বিধার কথা শুনে রামেশ্বর বলল: মুখার্জি সাহেব, শাসন আর আইন কানুনের রাজত্ব থেকে অনেক দূরে ইতিমধ্যেই চলে এসেছেন ৷ নাথুলার চুড়োয় কোনও পুলিশ বসে নেই ৷ স্বচ্ছন্দে আপনি আমাদের সঙ্গে ইয়াটুং চলে আসতে পারেন, আমি ছাড়া আর কোনও সাক্ষী থাকবে না ৷ যাইহোক, রামেশ্বরের দলে সামিল হয়ে যাবার ফলে রাতে আহারাদির ব্যবস্থা ভালো হল ৷ কর্মী ও রসদ তার সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে ৷ খাঁটি ঘি-এ ভাজা পরোটা, আলু কপির ঝাল তরকারি, ঘন ছোলার ডাল ও আচার দিয়ে পরম তৃপ্তির ডিনার উপভোগ করলাম ৷ খাট তোশক কম্বল সব জুটে গেল, সঙ্গে আমাদের নিজেদের বিছানার বান্ডিলও ছিল ৷ এক ঘুমে রাত কাবার ৷

পরদিন প্রত্যুষে প্রথমেই গায়ে কম্বল জড়িয়ে ছাঙ্গু লেকের ধারে ৷ তাপমান শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে, লেকে জল জমে আছে, একটা কুয়াশার স্তর ভাসছে ৷ ক্রমশ সূর্যের আলো এসে পড়ল ন্যাড়া ব্রাউন পাহাড়ের মাথায়, কুয়াশা কেটে এল, বৈরাগী হিমালয়ের চেহারা পরিষ্কার হল ৷ আজ একটু পরে নাথুলার দিকে অগ্রসর হব ৷ ছ-মাইল পথ ধরে আড়াই হাজার ফুট উঠতে হবে ৷ রাতের বিশ্রামের পর ক্লান্তি অপনোদিত হয়েছে, পরিষ্কার কনকনে হাওয়ায় শরীর চাঙ্গা ৷ মানুষ ও পশুর যাতায়াতের ফলে যে সঙ্কীর্ণ রাস্তা তৈরি হয়েছে তাই অবলম্বন করে ধীর পদক্ষেপে চলেছি ৷ হাওয়ায় অক্সিজেন কমে এসেছে বোঝা যায় ৷ কিছুক্ষণ উঁচুপথ অতিক্রম করার পর সামান্য বিশ্রাম, কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে ৷ এই উচ্চতা থেকে শরীরকে সইয়ে সইয়ে শনৈঃ পর্বতল9ন করাই বিধেয় ৷ রামেশ্বরদের দলে কয়েকটি টাট্টুঘোড়া, সে নিজে একটির ওপর বসে আছে, আমাদের অফার করে রেখেছে ৷ কিন্তু কোনও প্রয়োজন অনুভব করছি না, ধীরে ধীরে চতুর্দিক দেখতে দেখতে বেশ চলেছি ৷ এতটুকু সব ঘোড়া দেখলে মায়া হয় ৷ তার ওপর চড়তে রুচি হয় না ৷ হৃদযন্ত্র ও হাঁটু দুটোর বিরুদ্ধে এখনও কোনও অভিযোগ নেই ৷

যেমন সব গিরিশৃঙ্গে হয়, শেষ পাকদণ্ডীটা অতি কঠোর ৷ এক পা এক পা করে উঠছি ৷ ব্রজেন অল্পবয়স্ক যুবক ৷ একটানা খানিকটা তরতর করে উঠে গিয়ে হাঁপ ধরিয়ে ফেলে, পাথরের ওপর বসে পড়ে ৷ আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে, পোর্টারদের পিছন পিছন তাদের অনুসরণ করে চলেছি ৷ যত উঁচুতে উঠছি, গতি তত মন্থর হচ্ছে ৷ দূরে, হাজার খানেক ফুট উঁচুতে, দড়িতে টাঙানো নানা রঙের পতাকা দেখা গেল, ওই নাথুলা ৷

আরও একঘণ্টা এইরকম এক পা এক পা করে, বসে, দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত গিরিবর্ত্মের সমতল শিখরে ৷ তখন বেলা এগারোটা হবে ৷ চতুর্দিকে দিগন্তবিস্তৃত হিমালয় ৷ পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের লাইন, পূর্বদিক থেকে দেখা তার অন্যরকম প্রোফাইল উঁচুনিচু হয়ে ব্ল্যাক রক নামে এক শিখরে শেষ হয়েছে ৷ পিছনে, অনেক দূরে ছাঙ্গু লেক যেন এক ক্ষুদ্র জলাশয় ৷ দক্ষিণে নিচু হিমালয় ভুটান হয়ে সমতলে নেমে গিয়েছে ৷ আর সামনে তিব্বত-ভুটানের সীমান্তে অত্যাশ্চর্য তুষারশৃঙ্গ চুমু-লাহরি, সাদা বরফের যেন একটি আইসক্রিম কোন ৷ হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে, একটু বিশ্রামের পর এককাপ গরম কফি, শরীরে সাড়া পাচ্ছি, মনে আত্মতৃপ্তি ৷ এখানে লম্বা কাঠের দণ্ডে বাঁধা একেক গুচ্ছ নিশান পথের দুপ্রান্তে দড়ি দিয়ে দুদিক বাঁধা ৷ তার গায়ে ছোট ছোট মন্ত্রলেখা কাপড়, সাদা, হলুদ, লাল, সবুজ ৷ নাথুলায় পৌঁছে তিব্বতি যাত্রীরা ভক্তিভরে বুদ্ধ ভগবানকে স্মরণ করে, স্তোত্র লেখা কাপড়ের টুকরো দড়িতে বেঁধে দেয় ৷ আর পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে স্তূপ বানিয়ে রাখে ৷ আমি কুশোর কাছ থেকে ওইরকম একটি নিশান চেয়ে নিয়ে এক জায়গায় বেঁধে দিলাম, স্তূপে পাথর বসালাম ও বাংলা ভাষায় মনে মনে ভগবানকে প্রণাম জানালাম ৷

এখন ব্রজেন ও আমার সামনে একটি প্রশ্ন: তিব্বতে প্রবেশ, অথবা ছাঙ্গুতে প্রত্যাবর্তন ৷ ওরা সব এগিয়ে চলে যাবে, আমরা দুজন ম্লানমুখে ফিরে আসব? সেই ১৪,৫০০ ফুট গিরিবর্ত্ম থেকে দেখছি ঘন নীল নির্মেঘ আকাশে হিমালয়ের লাইন, সামনের পথ নেমে গিয়েছে চুম্বি উপত্যকার দিকে, চুমু-লাহরির দিকে ৷ দ্বিধা বর্জন করে সামনে এগিয়ে যাওয়া স্থির করলাম ৷ চলো ব্রজেন, ইয়াটুংয়ে গিয়ে যা হয় স্থির করা যাবে ৷

ম্যাপে দেখা যাবে তিব্বতের একটা সরু ফালি পূর্বদিকে ভুটান ও পশ্চিমদিকে সিকিমের মধ্য দিয়ে কালিম্পং সাবডিভিশনের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে ৷ এই ফালিটি আমু-ছু বলে একটি নদীর অববাহিকা ৷ আমু-ছু চুমু লাহরির হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে, পথে বিভিন্ন অনেক নদীর জল বহন করে, ভুটানের পশ্চিম অংশের মধ্য দিয়ে জলপাইগুড়িতে এসে পড়েছে ৷ তখন তার নাম হয়েছে তোরসা ৷ ফালিটির নাম হচ্ছে চুম্বি উপত্যকা ৷

আধঘণ্টা বিশ্রাম, কিছু উপাহার ও দ্বিতীয় এককাপ কফি খেয়ে নাথুলার অপর প্রান্ত দিয়ে নামতে শুরু করলাম ৷ পায়েচলা একটি পথের রেখা ধরে সটান নেমে যাচ্ছি ৷ অপরদিক থেকে মাঝে মাঝে পশমের বোঝা পিঠে খচ্চরের সারি আর রুক্ষ বলিষ্ঠ খচ্চরওয়ালারা ওপরে উঠে আসছে, কুশো ও আমাদের দেখে লম্বা জিভ বার করে অভিবাদন জানাচ্ছে ৷ পদক্ষেপ সামলে চলেছি, অতি সত্বর চার পাঁচ মাইলে হাজার তিনেক ফুট নেমে এসেছি ৷ ছোটখাটো গাছপালার রাজ্য আবার আরম্ভ হয়েছে, সরস সুন্দর বনভূমি ৷ কখনও সখনও ছোট বড় ঝরনা নেমে এসেছে ৷ রাতের শীতে তাদের জল জমে গিয়েছিল, এতক্ষণে রোদে কিছু কিছু গলছে, কিছু কিছু কাচের মতো স্বচ্ছ জমা জল আটকে আছে পাথরের কোলে কোলে, গাছের গুঁড়ির গায়ে গায়ে আইসিকল ঝুলছে, টপটপ করে বরফগলা জল ঝরছে, এক আধটা ক্ষীণ স্রোতের ধারা প্রায় নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে ৷ কিছুক্ষণ পরে একটি গ্রাম, নাম চুম্বিথাং ৷ কয়েকটা নিচু পাথরের বাড়ি গায়ে গায়ে লেগে আছে ৷ একটা চুড়ো-উঁচু মন্দির, মণিপদ্ম খোদাই করা তামার উপাসনাচক্র, নানা আকারের স্তূপ ৷ খোলা অঙ্গনে ক্রীড়ারত অনেকগুলি শিশু, অন্যরকম মানুষ দেখে খেলা ফেলে ছুটে পথের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে ৷ পাথরের ওপর বসা একজোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ৷ আশপাশে ভুট্টা, যব, আলুর খেত, জোয়ান মেয়েপুরুষরা সেখানে কাজ করছে ৷ কুশোর অনুরোধে আমাদের কয়েক মিনিটের জন্য ব্রেকজার্নি করতে হল ৷ মন্দিরের চত্বরে একটা কাঠের বেঞ্চির ওপর বসলাম ৷ মোটা বাঁশের পাত্রে ছাং এল, সরু কঞ্চির নল দিয়ে মুখের মধ্যে টেনে নিতে হয় ৷ ছাংয়ের দুর্গন্ধ আমার আদপেই বরদাস্ত হয় না, ঈষৎ দুয়েক চুমুক কোনওক্রমে পান করে সৌজন্য বজায় রাখলাম ৷ টক ও বিস্বাদ ৷ গ্রামবাসীদের সঙ্গে সৌহার্দ্য বিনিময় করে আবার পথ চলা ৷ নামতে নামতে আমু-ছু নদীর তীরে এসে পৌঁছলাম ৷ এখানকার উচ্চতা ৫-৬ হাজার ফুটের মতো হবে, বড় গাছপালা কিন্তু শীতের দিন বলে নিষ্পত্র ৷ আমু-ছুর জল কাকচক্ষুর মতো পরিষ্কার ৷ তার পাশ দিয়ে দিয়ে সমতল রাস্তা ৷ ইয়াটুং আর বেশি দূর নয় ৷ পড়ন্ত রোদে নদীর জল ঝকঝক করছে, কানে স্রোতস্বিনীর সঙ্গীত ৷ এইখানেই আমরা চিনা কর্মীদের প্রথম দেখতে পেলাম ৷

এইসব চিনা শ্রমিকেরা ছোট ছোট দলে নানারকম কাজ করছে দেখতে পাওয়া গেল ৷ কোনও দল রাস্তা মেরামত করছে ৷ অনেকখানি রাস্তা এমন চওড়া ও সমতল করছে যে তার ওপর চার চাকার গাড়ি চলতে পারে ৷ অন্যান্য দল জঙ্গলের গাছ কাটছে, কাঠ চেরাই ফাড়াই করছে, নিজেরাই মাথায় করে গুঁড়ি তক্তা নিয়ে এসে নদীনালার ওপর ভাঙা সাঁকোগুলো মেরামত করছে ৷ এদের পরনে তুলোর প্যাড দেওয়া জামা, প্যান্ট ৷ সব সুতির, সব খাকি ৷ মাথায় পিক-ক্যাপ, বুকে মাও-সে-তুঙের ছবিওলা ব্যাজ এবং নাম ও নম্বর ৷ অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, মুখ-চোখ ভাবলেশ বর্জিত ৷ আমাদের বিজাতীয় চেহারা দেখেও চোখে কোনও প্রশ্ন নেই ৷ কাছাকাছি গিয়ে হাসিমুখ দেখিয়ে বাও করার ফলে প্রতিনমস্কার পেলাম ৷ তাদের মুখে কোনও উচ্চারিত ভাষা নেই, কোনও আলাপ সম্ভব হল না ৷ ১৯৫২ সালের কথা বলছি, তখনও হিন্দি-চিনি বৈরীভাবের জন্ম হয়নি ৷ জওহরলাল নেহরু তিব্বতের ওপর চিনের অধিকার পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন ৷

যেতে যেতে লক্ষ করলাম আমু-ছু নদীর অপর পারে চিনাদের ক্যাম্প ৷ পরিষ্কার করা অনেকখানি জায়গায় সার সার তাঁবু, কিছু কিছু লগ-কেবিন, গোলপোস্ট লাগানো ফুটবল খেলার মাঠ, বাস্কেটবলের কোর্ট ৷ কুশোর সঙ্গে আলাপ করে জানলাম চিনারা নিজেদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে রেখেছে ৷ কোনও তিব্বতি গৃহে তারা পদার্পণ করে না ৷ তাদের খাদ্যশস্য প্রধানত আসে নিজস্ব ডিপো থেকে, কাঁচা সবজি, ডিম, ভেড়ার মাংস ইত্যাদি প্রয়োজনমতো ইয়াটুংয়ের খোলা বাজার থেকে কিনে নেয় নগদ টাকা দিয়ে, হয় তিব্বতি নয় ভারতীয় মুদ্রায় ৷ চিনা টাকা তখনও এখানে সচল হয়নি ৷ কুশো জানাল যে সাধারণ তিব্বতি শ্রমিক ও চাষাদের বিশেষ কোনও অভিযোগ নেই, তিব্বতি মেয়েরা তাদের চিরাচরিত স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতায় সংসারধর্ম পালন করে যাচ্ছে, চিনাদের কোনও কুনজর তাদের ওপর পড়েনি ৷ বেশ বোঝা যায় এই অঞ্চলে নবাগত চিনারা তাদের নিচু প্রোফাইল বজায় রাখবার জন্য আদিষ্ট হয়ে এসেছে ৷ আপাতত অতি সুন্দর সহাবস্থান ৷ কুশোর বর্ণনায় কোনও আক্রোশ নেই ৷ কিন্তু সে তিব্বতের ধনিক সম্প্রদায়ের একজন ৷ তার অনেক জোত জমি, ভেড়ার পাল, চমরি গাই, ভারতের সঙ্গে লাভবান ব্যবসায়ে লিপ্ত ৷ একটা আশঙ্কা ও সম্ভাব্য অশনি সঙ্কেত তার সঙ্গে কথাবার্তায় অনুভব করা যায় ৷

এইসব চিনা শ্রমিকরা সবাই নিরস্ত্র ৷ নভেম্বর মাসের শীতে তুলোভরা সুতির কোট গায়ে দিয়ে প্রাতঃকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত যে যার কাজ করে যাচ্ছে ৷ ছোটখাটো, মেদবর্জিত সব মানুষ ৷ বিশালকায়, মেরুন রঙের পশমি জোব্বাপরা উঁচু টুপি মাথায় তিব্বতিদের তুলনায় তাদের একটু নিরেট ও বিবর্ণ বলে মনে হওয়া কিছু বিচিত্র নয় ৷

যেতে যেতে ইয়াটুংয়ের বাংলোর লাল ঢেউটিনের ছাদ চোখে পড়ল ৷ আমাদের আজকের গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি ৷ এই বাংলো ব্রিটিশ আমলে সেন্ট্রাল পি ডাব্লু ডি-র তৈরি করা ৷ ডাক-তার বিভাগ, সিকিমস্থিত পলিটিক্যাল অফিসার, সৈন্য বিভাগের কিছু পদস্থ ব্যক্তি কখনও সখনও ঘোড়ার পিঠে লাসায় যাতায়াত করতেন ৷ সেখানে ভারতের একটি কনস্যুলেট অফিস ছিল, যে অফিসে আমার ফালুটের সহযাত্রী দেবশঙ্কর শীল পরে কিছুদিনের জন্য রেডিও অফিসারের কাজ করেছে ৷ ইয়াটুংয়ের পরেও লাসার পথে দু-চারটি এইরকম বাংলো তৈরি করা হয়েছিল ৷

প্রথম চিনা সশস্ত্র সৈনিক দেখলাম ইয়াটুং বাংলোর কাছে ৷ একটি ছোট কাঠের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে স্টেনগান জাতীয় অস্ত্র ৷ পোশাক টুপি দেখে মনে হল একজন অফিসার ৷ এর গায়ে একটি ভারি উলের কোট ৷ অল্প বয়স, শান্ত চেহারা ৷ কুশোর সঙ্গে ভাঙা ভাঙা তিব্বতিতে কিছু কথা বললেন ও শুনলেন ৷ তারপর একটি স্যালুট করে আমাদের বাংলোয় প্রবেশের অনুমতি দিলেন ৷

ইয়াটুংকে গ্রাম না বলে একটি ছোটখাটো শহর বলা যায় ৷ আমু-ছু নদীর পশ্চিম পার্শ্বে এই পি ডাব্লু ডি বাংলোটি অবস্থিত ৷ একটু এগিয়ে নদীর ওপর একটি শক্তপোক্ত সেতু ৷ সেটি পেরিয়ে শহরের প্রধান রাস্তা ৷ দুপাশে দোকানপাট, বসতবাটি ৷ বেশ কয়েকটি পাথরের দোতলা বাড়ি, কোনও কোনওটার সুন্দর চেহারা, জানলায় সিল্কের পর্দা হাওয়ায় উড়ছে, বাড়ির সামনে গেট, ফুলের টব, খোঁটায় বাঁধা সুস্থ চেহারার ঘোড়া ৷ বোঝা যায় সম্পন্ন গৃহস্থদের আবাসস্থল ৷ রাস্তায় অনেক লোকজন, দোকানে কেনাকাটা চলছে ৷ কার্পেট, তিব্বতি পোশাক-আশাক, নানা রকম তিব্বতি জুতো, তামা পেতলের বাসনকোসন, থালা, ঘড়া, ঘটি বিবিধ সাইজের সামোভার ৷ এছাড়া ভারত থেকে আমদানি কম্বল কাপড় থেকে পুঁতির মালা, ছুঁচ সুতো থেকে কেরোসিন স্টোভ ৷ ঘুরে ঘুরে সব দেখছি ৷ বাংলোয় চা-বিস্কুট খেয়ে, একটু বিশ্রাম করে বেরিয়ে পড়েছি ৷ এখনও কিছুটা দিনের আলো রয়েছে ৷ এই রকম তিব্বতিদের দোকান দার্জিলিং, কালিম্পং, গ্যাংটকে কিছু কিছু বরাবরই ছিল ৷ তিব্বতি কার্পেট, পুরু সিল্কের বখু নামক হাউসকোটের মতো পরিচ্ছদ, অথবা অতি সুন্দর কাজকরা তামা পেতলের বাসন, হাতের, গলার অলঙ্কার ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরেই আদর পেয়ে এসেছে ৷ দার্জিলিং চৌরাস্তার বাজারে অভিজাত দোকানে চড়া দামে বিক্রি হয় ৷ এখন তো দেখি দিল্লির জনপথে তিব্বতি দোকানের লম্বা সারি ৷ যদিও তিব্বত থেকে সরাসরি মাল আসা অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে, তবু লাদাখিরা ও ভারতবর্ষে প্রবাসী কয়েক লক্ষ তিব্বতিরা এইসব শিল্প এখনও যথেষ্ট সজীব রেখেছে ৷

ইয়াটুংয়ের বাজারে কয়েকটি ভারতীয় দোকান, যারা প্রধানত কালিম্পংয়ের পশম ব্যবসায়ীদের এজেন্ট ৷ আর আছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে নামকরা ব্যবসাদার জেঠমল ভোজরাজদের একটি গদি ৷ সেখানে কিছুক্ষণ বসতে হল, আলাপাদির পর যখন ফিরলাম তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে ৷ দোকানপাট বন্ধ হয়েছে বা হচ্ছে, রাস্তা প্রায় জনশূন্য ৷ এক ব্যক্তি হাতে একটি হ্যাজাক নিয়ে আমাদের বাংলোয় ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে, তার পিছনে আরেকজন দুহাতে দুটি টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে, আমাদের রাতের আহার্য ৷ সন্ধের সঙ্গে সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা, মাথা কান ঢেকে দ্রুতপদে চলেছি ৷ ইয়াটুংয়ের উচ্চতা ৭-৮ হাজার ফুট হবে, কিন্তু উত্তরে খোলা তিব্বত, নভেম্বর মাস ৷

রাতে খানার টেবিলে প্রধান আলোচ্য বিষয়: কাল ব্রজেন ও আমি কি দেশে ফিরে যাচ্ছি? অথবা তিব্বতের অভ্যন্তরে আরেকটু? রামেশ্বরকে খুব একটা অনুরোধ উপরোধ করতে হল না ৷ বাংলোয় বসে রাতের নিস্তব্ধতায় আমু-ছুর ঝিরঝিরে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, উত্তর তিব্বত থেকে প্রবাহিত ঠান্ডা নির্মল হাওয়ায় ফুসফুস ভরে আছে ৷ দেশে অবশ্যই ফিরব, কিন্তু আরেকটু এগিয়ে দেখে আসি ৷

সকাল হতেই সবাই তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে ভারি জুতো পরে আবার হাঁটবার জন্য প্রস্তুত ৷ রামেশ্বরও তার ইয়াটুংয়ের কাজ আপাতত মুলতুবি রাখছে, সেসব ফেরবার সময় হবে ৷ এখানে আমরা নিজেদের কুশোর জিম্মায় সমর্পণ করেছি ৷ তার বাড়ি গ্যান্টসিতে, সেখানে আমাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্য বদ্ধপরিকর ৷ গ্যান্টসি অনেক দূরের পথ, হেঁটে অন্তত আরও সাতদিন লাগবে, তেজী ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেও অন্তত তিন দিন ৷ অত দিন চুরি করব কী করে?

আপাতত আমু-ছুর উপত্যকা অবলম্বন করে অপেক্ষাকৃত সরল রাস্তায় হেঁটে চলেছি ৷ দূরে উত্তর-পূর্বে চুমু-লাহরি কখনও দেখতে পাচ্ছি, কখনও পাহাড়ের আড়ালে পড়ছে ৷ গাছপালা আবার কমে আসছে, নদীর ধারা শীর্ণতর হয়ে আসছে, দুপুরের রোদে বেশ তেজ ৷ দুপাশে উচ্চাবচ গেরুয়া প্রান্তর ৷ আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল সামচেন নামক একটি গ্রামে, সেখানে রাত্রিবাস ৷ এখানে খানিক বেলা থাকতেই পৌঁছলাম ৷ সাহেবি কোনও বাংলো নেই ৷ কুশোর পরিচিত এক তিব্বতি গৃহস্থের বাড়িতে আমাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হল ৷ অসুবিধে কিছু নেই ৷ পরিচ্ছন্ন একটি ঘরে স্থান পেলাম ৷ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে আহারাদি সেরে শয্যাশায়ী ও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ৷

পরদিন আমাদের গন্তব্যস্থল ফারি জং, এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর ৷ তিব্বত ভ্রমণকারীদের বইতে এই শহরের অনেক বর্ণনা পড়েছি, লোকমুখেও শুনেছি ৷ একটি প্রাচীন দুর্গকে ঘিরে এই শহর ৷ এককালে এই শহরের দখল নিয়ে বিবিধ সামন্তনেতাদের মধ্যে অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে ৷ লাসা, এমনকী অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী গ্যান্টসিতে কোনওদিন যেতে পারব এমন আশা রাখি না, ফারি জংয়ে প্রবেশ করতে পারলে আমার একটা বাসনা চরিতার্থ হয় ৷

অতি প্রত্যুষে সামচেন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি ৷ খুব উৎসাহের সঙ্গে চলেছি যাতে যথেষ্ট দিনের আলো থাকতে থাকতে ফারি জংয়ে পৌঁছনো যায় ৷ কিছুদূর গিয়ে আমু-ছু নদী পেরোতে হয়, পেরিয়ে উত্তরপূর্বে রাস্তা চলে গেছে ৷ এক জায়গায় একটি গ্রামগঞ্জ মতো ৷ বসতি ছাড়িয়ে খানিক অগ্রসর হতে নজরে পড়ল একসার খাকি রঙের তাঁবু, কাঠের কেবিন, খেলার মাঠ এবং চিনা শ্রমিকদের ছোটখাটো দল ৷ যেমন ইয়াটুংয়ে দেখেছি ৷ অধিকন্তু বেশ কয়েকজন সশস্ত্র চিনা সৈন্য ৷ আমাদের তিনজনের কালো চেহারা, প্যান্ট সোয়েটার পরা, দেখেই ভারতীয় বলে বোঝা যায় ৷ সৈন্যরা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করতে শুরু করল ৷ তাদের মধ্যে একজন পরিষ্কার তিব্বতি বলছে ৷ যদিও তার খাকি ইউনিফর্ম তবু চেহারায়, ভাষায় ও হাবেভাবে বুঝলাম সে তিব্বতি, চিনা সৈন্যদলে সামিল হয়েছে ৷ কথাবার্তা হচ্ছে কুশোর সঙ্গে, আমরা আর সবাই চুপচাপ খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছি ৷ একটু পরে কুশো জানাল যে আমরা তিনজন ভারতীয় ফারি জংয়ে প্রবেশ করতে পারব না, কারণ সঙ্গে কোনও অনুমতিপত্র নেই ৷ সৈন্যদের কথাবার্তায় বা আচরণে কোনও ঔদ্ধত্য অশিষ্টতা নেই ৷ জানলাম, তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু ফারি জংয়ে গিয়ে আমরা মুশকিলে পড়তে পারি ৷ সেখানে শহরের প্রবেশপথে মস্ত বড় ছাউনি, অনেক সৈন্য ও অফিসার ৷ আমাদের কোনও অনুমতিপত্র নেই, পাসপোর্ট নেই, কোনও ব্যবসা-ব্যাপারের অজুহাত নেই, ফারির কাছাকাছি আমাদের না যাওয়াই ভালো ৷

দুঃখিত চিত্তে ফারির পথ থেকে নিবৃত্ত হতে হল ৷ কুশোরও অত্যন্ত মনখারাপ, তার দেশ আমাদের আরও ভালো করে দেখা হল না ৷ যাইহোক এবার কি সোজা ফেরত পথ নিতে হবে? তা তো হবেই, কিন্তু কুশো প্রস্তাব করল ফেরার পথে আমরা ডোংকার মনাস্ট্রিতে একদিন কাটিয়ে আসতে পারি ৷ যেখানে এসে পড়েছি সেখান থেকে খুব দূরে নয়, আজই সন্ধের পূর্বে পৌঁছে যেতে পারি ৷ সুতরাং ফারি জংয়ের পরিবর্তে আমরা ডোংকারের পথ ধরলাম ৷

অনেক দূর থেকে ডোংকার গুম্ভা দেখতে পাওয়া যায় ৷ একটি পাহাড়ের শিখরে অবস্থিত, পরিষ্কার রৌদ্রে তার সোনালি চূড়া ঝকঝক করছে ৷ ক্রমে ক্রমে আমরা তার নিচে এসে উপস্থিত হলাম ৷ মস্ত বড় এই মঠ ৷ বিরাট ও বহুতল তার প্রধান মন্দির, আশপাশে ছোট-বড় অনেক তিব্বতি ধরনের বাড়ি, কয়েকশো বৌদ্ধ শ্রমণ এখানে বসবাস করে ৷ আমাদের দলটিকে দেখে কয়েকটি যুবক ভিক্ষু তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল, এবং কুশোর সঙ্গে কথাবার্তা বিনিময়ের পর সাগ্রহে ও সানন্দে আমাদের মঠে নিয়ে চলল ৷ মঠের সামনের অঙ্গনে এক বর্ষীয়ান লামা কাঠের চৌকির ওপর বসেছিলেন, আমরা নিচু হয়ে তাঁকে নমস্কার করলাম, তিনিও হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন ৷ ইনি, পরে জানলাম, মঠের প্রধান অধ্যক্ষ নন, মেজো-সেজো কেউ হবেন ৷ যিনি প্রধান তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ, নিজের ঘরে বিশ্রাম করছেন, কাল সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে ৷

তিব্বতে ছোট-বড় মিলিয়ে অনেক মঠ মন্দির, তার মধ্যে ডোংকার মঠের একটি ঐতিহ্য আছে ৷ প্রায় প্রতিবছর শীতকালে দলাই লামা কয়েকদিনের জন্য এখানে এসে থাকেন ৷ তিনি শেষ এসেছেন ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে, লাসা থেকে গোপন পলায়নের পথে ৷ সঙ্গে তাঁর অনেকগুলি সহচর থাকে ৷ অতিথিদের থাকবার উপযুক্ত কয়েকটি ঘর রয়েছে, তার মধ্যে দুটিতে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হল ৷ কোনও অসুবিধা নেই ৷ আমার ঘরে নিচু তক্তপোশে কার্পেট পাতা, মেঝেতে কার্পেট, সরু নিচু টেবিল, তার ওপর নানা ডিজাইন ও তিব্বতি অক্ষরে অলঙ্কৃত ব্রোঞ্জের সামোভার, আরেকটি টেবিলের ওপর বেশ বড় একটি পুজোর ঘণ্টা, দেওয়ালে দুটি তনখা ঝুলছে, একটিতে তারা, অপরটিতে বজ্রপাণি ৷ দুটি জানলা, একটি দিয়ে দেখা যায় মাঠ, খেত, রাস্তা, গেরুয়া পাহাড়ের ঢেউ ৷ অপরটি দিয়ে দেখতে পেলাম ভেতরের প্রাঙ্গণ ৷ চারদিকে বাড়ি ঘর দিয়ে ঘেরা একটি পাথর বসানো উঠোন, একটি টেনিসকোর্টের মতো বড় হবে ৷ আট-দশটি কিশোর ও বালক একটা ন্যাকড়ার তৈরি বল নিয়ে অতি আনন্দে লাফালাফি করে খেলছে ৷ এরা সব শিক্ষার্থী লামা, সব মাথা ন্যাড়া, পরিধানে মেরুন রঙের খাটো বখু, অধিকাংশের নগ্নপদ ৷

ডোংকার মঠ আশপাশের অনেকখানি জমির মালিক ৷ যেখানে এবং যখন সম্ভব চাষবাস হয়, যব, গম, আলু, রাঙালু, সর্ষে, মুসুর ডাল ইত্যাদি ৷ এই অঞ্চলে উত্তর তিব্বতের মালভূমির তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিচু, হয়তো ৮,০০০ ফুট হবে ৷ প্রকৃতি এখানে ততটা অকৃপণ নয়, সামান্য বৃষ্টিপাত হয় ৷ উৎপন্ন কৃষিজাত সামগ্রীতে এদের চলে যায়, কিছুটা বিক্রি করে চাল, কাপড়, কেরোসিন ইত্যাদি সংগ্রহ করা যায় ৷ এছাড়া এদের আছে চমরি গাইয়ের পাল, জেবু ও ভেড়া, যে সূত্র থেকে প্রচুর মাখন, পশম, চামড়া আসে ৷ মোটের ওপর মঠের অবস্থা ভালো ৷ রক্ষণাবেক্ষণ, শাসনকার্য, পরিচালনা, আর্থিক লেনদেনের দায়িত্ব মঠাধ্যক্ষের ওপর ৷ তিনি এখন অত্যন্ত বৃদ্ধ বলে তিন-চারজন প্রধান লামাদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিয়েছেন ৷ এই সাবেকি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থায় লাসা কর্তৃপক্ষ বিশেষ হস্তক্ষেপ করে না ৷ তাদের যেটুকু কর প্রাপ্য সেটুকু পাওয়ার পর সম্পর্কটা সোজা ধর্মীয় স্তরে পৌঁছে যায়, দলাই লামার প্রতি আনুগত্য ৷ এই স্বায়ত্তশাসন এতদিনে অবশ্যই অন্তর্হিত হয়েছে, কোথায় মঠ, কোথায় সেইসব লামারা আর তাদের খেতখামার কে জানে ৷ যেসব ছোট ছোট ছেলেদের খেলতে দেখেছিলাম তারা সব এখন মধ্যবয়স্ক, কেউ ধর্মশালায়, কেউ সারনাথে বা বুদ্ধগয়ায় বা কর্নাটকে তিব্বতিদের ক্যাম্পে, অথবা তিব্বতেই থেকে গিয়ে বর্তমান সমাজব্যবস্থার মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে ৷

চা পানের পরও দিনের আলো খানিকটা অবশিষ্ট ছিল ৷ মঠের নানা অংশ আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হল ৷ অন্ধকার ঘর, গলি গলি রাস্তা, স্বর্ণশিখরভূষিত নানা আকারের স্তূপ, জলের ধারায় ভগবানের নাম লেখা প্রার্থনার ড্রাম ঘুরে যাচ্ছে ৷ ঘরে ঘরে তনখা ঝুলছে, অবতারদের সোনালি প্রতিমূর্তি আর শেষে, সবচেয়ে বড় ঘরে ভগবান বুদ্ধের মস্ত বড় মূর্তি, হাতে অভয়মুদ্রা, শান্ত স্মিত মুখাবয়ব ৷ সামনে, পাশে, পিছনে অনেক মাখনের প্রদীপ জ্বলছে ৷ দুপাশের দেওয়াল লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা পুঁথিতে ঠাসা ৷

সর্বত্র আবছা, বাসি মাখনের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে ৷ বৃদ্ধ, অশক্ত লামারা এখানে ওখানে প্রার্থনার চক্র অথবা জপমালা হাতে ভগবানের নামের সঙ্গে সঙ্গে শেষের ক্ষণগুলিকে গুনে যাচ্ছেন ৷ অল্পবয়স্করা বিবিধ কাজে, কেউ বাসনে অলঙ্করণ দাগছে, কেউ ল্যাকারের কাজ করছে, কেউ তনখাতে তুলি টানছে, কেউ মাখনের প্রদীপ ও বিবিধ স্তূপাকৃতি নৈবেদ্য প্রস্তুত করছে ৷ মঠের মধ্যে সবকিছু কাজ ধর্মের আনুষঙ্গিক ৷ তার সঙ্গে আছে এক প্রশস্ত বিদ্যালয়, যেখানে কয়েকটি ঘরে লেখাপড়ার কাজ চলছে ৷ অতি শিশু থেকে আরম্ভ করে বেশ বয়স্করাও পড়াশোনা করে যাচ্ছে, সযত্নে অতি সুন্দর তিব্বতি হরফে পুঁথি লিখে যাচ্ছে ৷ তিব্বতে রাশি রাশি বই, প্রত্যেকটি মঠে লাইব্রেরি ৷ দীর্ঘকাল ধরে এদেশে পুঁথিপত্র, তনখা, অন্যান্য চিত্র বা কারুকার্যমণ্ডিত সামগ্রী লাদাখের বিবিধ মঠে চলে গেছে ৷ কিছুদিন পূর্বে দিল্লিতে যে তনখার প্রদর্শনী হয়ে গেল, তাতে দেখলাম সব এসেছে লাদাখ থেকে, কিন্তু সবই মধ্য ও পূর্ব তিব্বত থেকে আহরণ করা ৷ এখনও তিব্বতে পুঁথি ও অন্যবিধ শিল্পের অপরিসীম ঐশ্বর্য রয়ে গেছে ৷ বর্তমান মালিকদের ব্যবস্থাপনায় নিশ্চয় সেসব বস্তুর উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে ৷

পরদিন সকাল আটটায় মঠের প্রধান অধ্যক্ষের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকার স্থির হয়ে আছে ৷ অতি প্রত্যুষে উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছি ৷ সাক্ষাৎকারের পর প্রাতরাশ, তারপর আমাদের ফেরত পথে যাত্রা ৷ নিচে নেমে দেখলাম বড় মন্দিরের সামনে প্রশস্ত অঙ্গনে লামাদের ভিড় গিজ গিজ করছে ৷ সকলের অঙ্গে মেরুন রঙের বখু, মাথায় নানারকম টুপি, অনেকের পায়ে বিচিত্র কাজ করা ফেলটের বুট জুতো ৷ সভা আরম্ভ হবার পূর্বে সর্বত্র যেমন একটা গুঞ্জন শোনা যায় সেইরকম শুনছি ৷ একটা চাপা উত্তেজনা কৌতূহলী সব মুখে মুখে ৷ তার কারণ বুঝতে পারলাম আমার হাতে ঝোলানো মুভি ক্যামেরা ৷ সকলে জেনে গিয়েছে এইসময় রিমপোচের সঙ্গে তাদের ছবি তোলা হবে ৷ রিমপোচে, অর্থাৎ গুরু অবতার ৷ যেমন দলাই লামার মৃত্যু হবার পর তিনি অন্যত্র কোথাও জন্মগ্রহণ করেন, সেইরকম আরও অনেক গুরু আছেন যাঁদের পুনর্জন্ম হয়, বিবিধ লক্ষণ মিলিয়ে তাঁদের আবিষ্কার করতে হয় ৷ ডোংকারের গুরুও এইরকম একজন বোধিসত্ব ৷

আমরা অঙ্গনে প্রবেশ করবার পর লামারা দুপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল ৷ কুশোর পিছন পিছন অবনত মস্তকে আমরা রিমপোচের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ সভার সবাই আসন গ্রহণ করেছে, স্তব্ধ নম্র আবহাওয়া ৷ আমাদের হাতে একেকটি পাতলা সাদা কাপড় ৷ রিমপোচের স্থুলবপু, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, বয়সের ভারে একটু নুয়ে পড়েছেন ৷ শুনলাম নব্বই বছর অতিক্রম করেছেন ৷ কুশো আমাদের পরিচয় দিলেন, একে একে আমরা তার জানুর ওপর আমাদের শ্রদ্ধার অর্ঘ্য, ওই পাতলা সাদা চাদর রাখলাম ৷ মৃদু কণ্ঠে তিনি আমাদের কল্যাণ কামনা করলেন, হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন ৷ পায়ে পায়ে আমরা পিছনে সরে এলাম ৷ তিনি ছবি তোলবার অনুমতি দিয়েছেন, অনেক ছবি তোলা হল ৷ সব বয়সের সবরকম আকৃতি ও প্রকৃতির লামা ৷ তাদের মধ্যে রিমপোচের পরেই যাকে আমার সবচেয়ে বেশি মনে আছে সে একটি তিনবছর বয়স্ক শিশু লামা ৷ তার বাপ-মা সম্প্রতি তাকে মঠে অর্পণ করেছে ৷ জানি না বাপ-মা তাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় সে কতটা কেঁদেছিল ৷ এখন তার হাসিমুখ, সম্ভবত সকলের ভালোবাসা পেয়েছে ৷ বোর্ডিং ইস্কুলে যখন বাচ্চাদের রেখে আসা হয় তখন তাদের কত কষ্ট হয়, তা তাদের অসহায় ছলছলে চোখ দেখলে বোঝা যায় ৷ পুত্রকে দেখেছি, পৌত্রকে দেখেছি ৷ এরা বছরে দু-তিনবার বাড়ি আসে, কৈশোর উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মা-বাপের সঙ্গে নাড়ি কাটায় না ৷ কিন্তু মঠে রেখে আসা শিশু তার শৈশব থেকেই সন্ন্যাসী ৷ গ্রাম, বাড়ি, বাপ-মা, খেলার সঙ্গী ভাই বোন সকলের কাছ থেকে চিরজীবনের মতো বিচ্ছিন্ন ৷ মঠ, মনাস্ট্রি, কনভেন্ট; ধর্মজগতের সব বিচিত্র প্রতিষ্ঠান ৷

তিব্বতি লামাদের যৌথ জীবন, যেমন হিন্দু, জৈন, অন্যান্য বৌদ্ধ বা ক্রিশ্চান মঠ মন্দিরে হয়ে থাকে ৷ কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে কোনও-কোনও তিব্বতি সন্ত স্বেচ্ছায় একাকীত্ব বরণ করেন ৷ কীরকম একাকীত্ব তার একটা বর্ণনা স্বেন হেডিনের বইতে আছে ৷ তিনি মধ্য তিব্বতের এক মঠে কিছুদিন লামাদের মধ্যে কাটিয়েছেন ৷ এই মঠে উচ্চকোটির কিছু লামা প্রবীণত্ব অর্জন করার পর একা একদিন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করেন এবং তার দরজা চিরতরে তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে যায় ৷ সেই প্রকোষ্ঠে একটি ছোট জানলা ৷ দিনে একবার সেই জানলার ধারে কিছু খাদ্য ও জল রেখে আসা হয় ৷ খালি পাত্র সেই জানলা দিয়ে ফেরত আসে ৷ বহির্জগতের সঙ্গে এই একমাত্র সম্পর্ক ৷ সেই লামার সমস্ত সময়, যতক্ষণ তিনি জেগে থাকেন, ধ্যান ও নামজপে ব্যয়িত হয় ৷ এইরকম দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ৷ একসময় আসে যখন জানলায় রাখা খাদ্য ও জল পড়ে থাকে ৷ দু-চারদিন এইরকম পড়ে থাকার পর সবাই যখন নিঃসন্দেহ হয় তখন দরজা খুলে সেই সাধুর মরদেহ বাইরে নিয়ে গিয়ে যথারীতি সৎকার করা হয় ৷ ‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরম’ ৷ তিব্বতি বৌদ্ধ শ্রমণদের কথা লিখছি, কিন্তু এই বিশ্বাসের মূল বৃহত্তর ও ব্যাপক হিন্দুধর্মের মধ্যেই নিহিত ৷ সংসার ও সমাজকে বর্জন, সন্ন্যাস, একাকীত্ব ও আত্মলোপের ত্রিপুটি বলয় হিন্দুমানসে মোক্ষলাভের শ্রেষ্ঠ উপায় বসে স্বীকৃত হয়ে এসেছে ৷ গৌতমবুদ্ধের নির্বাণ তারই উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত ৷

ডোংকার গুম্ভা থেকে বেরিয়ে যথাকালে আমু-ছু নদীর তীরে এসে পৌঁছলাম, ফেরত রাস্তা ধরে ইয়াটুং বাংলোয় ৷ রাত্রিবাসের পর চুম্বি উপত্যকার মধ্য দিয়ে আবার গাছপালার জগতে ৷ পিছনে পড়ে আছে তিব্বতের রুক্ষ গৈরিক জগৎ, যার প্রায় কিছুই দেখা হল না ৷

এবারে আমরা নাথুলার পরিবর্তে নিকটস্থ জেলেপ-লা গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে সিকিমে প্রবেশ করব ৷ জেলেপ-লাও নাথুলার মতো ১৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় ৷ তিব্বতের দিক থেকে জেলেপ-লার পথ, শেষের পাঁচ-ছ মাইল, অতি কঠিন চড়াই ৷ ধীরে ধীরে, বসে দাঁড়িয়ে যখন পৌঁছলাম তখন শরীর একেবারে জীর্ণ ৷ দীর্ঘ রাস্তা দীর্ঘকাল ধরে হাঁটতে হয়েছে ৷ সন্ধে ঘনিয়ে আসছে ৷ পিছনে চুমু-লাহরি শৃঙ্গে সূর্যাস্তের শেষ রশ্মি ৷ একনজর দেখে আবার পথ ধরলাম ৷ ঘণ্টাখানেক পরে যখন কাপুপ বাংলোতে পৌঁছলাম তখন ঘন অন্ধকার ৷ শেষের দু-তিন মাইল টর্চের আলোয় পথ চলতে হয়েছে ৷ তার পরদিন কাপুপ থেকে ছাঙ্গু, স্বল্প পাঁচ-ছ-মাইলের পথ, গাছপালার মধ্য দিয়ে, অনেক ছোট ছোট স্রোতস্বিনী পাথরে-পাথরে পার হয়ে ৷ প্রথম শীতের বরফ অনেক জায়গায়, বুটের নিচে মচমচ করে ভাঙছে ৷ ছাঙ্গুতে পুরো একবেলার সময়, হ্রদে দুপুরবেলার রোদে খানিকটা বরফ গলেছে ৷ আনন্দে ও অলসপায়ে পরিক্রমণ করা হল ৷ তার পরদিন গ্যাংটক ৷ আর তার পরদিন সকালে ভালো করে খেউরি হয়ে, ডিমটোস্টের ব্রেকফাস্ট এবং তৎপরে মোটরযোগে সোজা জলপাইগুড়ি ৷

শীতকাল এসে পড়ল, আমার সদর অফিস জলপাইগুড়িতে অধিকাংস সময় কাটে, পাহাড় পর্বতে ট্যুরের সুযোগ এই সময় কম ৷ তাছাড়া আমার প্রধান কাজ হচ্ছে জলপাইগুড়িতে দেশি মালিকানায় যেসব চা-কোম্পানি আছে, তাদের ইনকাম ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট শেষ করে সরকারের প্রাপ্য টাকা ঘরে তোলা ৷ এইসব নিয়ে দিনমানে খুব ব্যস্ত থাকি ৷ আবার সংসার আছে, সমাজ আছে, প্রতিবেশী, বন্ধু টেনিস, ক্লাব সব আছে ৷ আর আছে আমার ফটোগ্রাফি ৷ এর মধ্যেও একটি আকাঁ মনের মধ্যে পোষণ করে চলেছি ৷ সেটি হচ্ছে এই তিস্তা নদীর উৎস সন্ধান ৷

জলপাইগুড়ি মানেই তিস্তা নদী ৷ এখন শীতকাল, নদীর ধারা কোথায় কতদূরে সরে গিয়েছে ৷ বিস্তীর্ণ ধু-ধু চর ৷ কিন্তু বর্ষাকালে সারা সিকিম, দার্জিলিং তরাই পশ্চিম ডুয়ার্সের বর্ষাধোয়া সব জল, হিমালয়ের অনন্ত হিমবাহগলা জল প্রবল তাড়নায় পাহাড় থেকে নেমে এসে সমতল জলপাইগুড়িকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৷ এখন শুনেছি জলপাইগুড়ি শহরকে রক্ষা করার জন্য লম্বা বাঁধ দেওয়া হয়েছে, তখন ছিল না ৷ হু-হু করে বন্যার জল নেমে এসে, আধখানা শহর প্লাবিত করে দিত ৷ একবার নয়, এক বর্ষায় বারবার ৷ ১৯৫২ থেকে তিনটি বর্ষাকাল জলপাইগুড়িতে কাটিয়েছি, প্রতি বর্ষায় এই দুর্যোগ ৷ যেমন কোশী বা গণ্ডক, সেইরকম তিস্তা ৷ সেইরকম জলঢাকা, তোর্সা, সঙ্কোশ ৷ যে তিস্তার ওপর জলপাইগুড়ির বাঁচা-মরা নির্ভর করছে, তার উৎস সিকিমের উত্তরপ্রান্তে কয়েকটি হিমবাহের গলা জল ৷ সেই জল এসে জমেছে একটি বিস্তীর্ণ হ্রদে, সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছে একটি শান্ত স্রোতে ৷

যে অঞ্চলে এই হ্রদ অবস্থিত, তার উচ্চতা ১৮-১৯,০০০ ফুট হবে ৷ মানস সরোবরের চেয়ে কিছুটা উঁচুতে ৷ মানস সরোবর আমাদের তীর্থস্থান, বহুলোক সেখানে ভ্রমণ করে এসেছেন ৷ চিন কর্তৃক তিব্বত অধিকৃত হবার পূর্বে স্বামী প্রণবানন্দ প্রায় প্রতিবছর সেখানে যেতেন ৷ তাঁদের বর্ণনা এবং বিবিধ ভ্রমণকারীর তোলা ছবির প্রদর্শনীর ফলে কৈলাস ও মানস সারা ভারতবর্ষময় খুবই পরিচিত ৷ প্রমোদ চট্টোপাধ্যায়ের বই বহুদিন পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে ৷

কিন্তু তিস্তা বড়ই উপেক্ষিত ৷ আমাদের ধর্মে তার স্থান নেই, গঙ্গে চ যমুনে চৈব-র শ্লোকে তার উল্লেখ নেই, দীর্ঘ গতিপথের কোনওখানে হিন্দুমন্দির নেই ৷ কেউ কেউ কাব্য করে তিস্তাকে ত্রিস্রোতা বলেছেন, যেমন দার্জিলিংকে বলেছেন দুর্জয়লিঙ্গ ৷ কিন্তু এরা সব আদ্যোপান্ত অসংস্কৃত, তিস্তার আসল নাম দিসতাং, যেমন দার্জিলিংয়ের আসল নাম দোরজি-লিং ৷ শুধু তিস্তা নয় সমস্ত অঞ্চলটা, সিকিম, তরাই ডুয়ার্স সবটা হিন্দু কৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কে রহিত ৷ এর আসল ঐতিহ্য জঙ্গল, পাহাড় ও পাগলা সব নদীর মধ্যে নিহিত ৷ ধর্ম, সাহিত্য ও কৃষ্টি যেটুকু এসেছে তা উত্তরের তিব্বত থেকে, দক্ষিণের বঙ্গদেশ বা ভারতবর্ষ থেকে নয় ৷ সারা পূর্ব হিমালয়ে এই চরিত্র, পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের অর্ধেকটা পর্যন্ত ৷ পশ্চিম হিমালয় ঠিক এর বিপরীত ৷ মধ্য নেপালে গৌরীশঙ্কর থেকে আরম্ভ হয়ে ধবলগিরি, অন্নপূর্ণা, নন্দাদেবী, ত্রিশূল, নীলকণ্ঠ, কেদারনাথ এবং আরও সব নাম হিন্দু ঐতিহ্যবাহী ৷ আলমোড়া, গাড়োয়াল প্রাচীন হিন্দুমন্দিরে ছাওয়া, সর্বত্র জটাধারী, ভস্মাচ্ছাদিত সন্ন্যাসী, পুণ্যকামী যাত্রীর দল ৷ তিস্তার পথ ধরে কেউ ধর্মেকর্মে যায় না ৷ সিকিমে দু-চারটি বৌদ্ধগুম্ভা, স্থানীয় বৌদ্ধ সংস্কৃতি বহন করে চলেছে ৷ কখনও কদাচিৎ হয়তো কোনও বৌদ্ধভিক্ষু তিব্বত থেকে তিস্তার অববাহিকা ধরে নেমে আসেন, কালিম্পং-শিলিগুড়ি হয়ে সারনাথ বা বুদ্ধগয়ার উদ্দেশে ৷ এই যা দু-চারজন পথচারী ৷ অন্যথা তিস্তার পাহাড়ি গতিপথ মনুষ্যবিরল, পরিত্যক্ত ৷

তিস্তা এবং সিকিম হিমালয় সম্বন্ধে বাঙালির খুব একটা সজীব চেতনা আছে বলে মনে হয় না ৷ দার্জিলিং বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত, সেখানে স্থায়ী বাঙালির সংখ্যা কম নয় ৷ প্রতিবছরের দুটি মরসুমে হাজার হাজার সমতলবাসী বাঙালি দার্জিলিং কালিম্পং ইত্যাদি জায়গায় আসেন ৷ সিকিম দার্জিলিংয়ের সংলগ্ন নিউ জলপাইগুড়ি থেকে চার-পাঁচ ঘণ্টায় গ্যাংটকে পৌঁছনো যায় ৷ এইসব পার্বত্য অঞ্চলের সব জায়গা থেকে তুষারাচ্ছন্ন পর্বত শৃঙ্গের অলৌকিক দৃশ্য দেখা যায় ৷ কিন্তু আরও এগিয়ে গেলে, আরেকটু কষ্ট স্বীকার করলে যে কী দেখা যায়, তার চেষ্টা খুব একটা হয়নি ৷ অথচ ধর্মের টানে কিনা জানি না, পালে পালে বাঙালি হরিদ্বার হৃষীকেশ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদার, বদ্রির পথে বেরিয়ে পড়েন বছর বছর ৷ বেশ কিছু যান মহাগুনাস অতিক্রম করে অমরনাথ, এমনকী কৈলাস মানস সরোবর ৷ এসবের বর্ণনায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ, অনেক গল্প উপন্যাস ও সিনেমা স্ক্রিপটের লোকেশন ৷ কিন্তু সিকিম তিব্বত ভুটান অথবা তিস্তা রঙ্গিত তোর্সা সঙ্কোশ বাংলার মধ্যে অথবা এত কাছে হয়েও বাঙালি মানসে প্রায় অনুপস্থিত ৷ যদিও বাঙালির শিরায় ভোট-মঙ্গোল রক্ত যথেষ্ট পরিমাণে বইছে, তবু তার সংস্কৃতি এবং রুচি একেবারেই উত্তর ভারতীয় ৷

১৯৫৩ সালে তেনজিং-হিলারি কর্তৃক এভারেস্ট বিজয়ের পর নেহরু-বিধান রায়ের চেষ্টায় দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ এতে বছর বছর কিছু বাঙালির ছেলে অন্যান্যদের সঙ্গে পর্বতারোহণের শিক্ষালাভ করে থাকে ৷ সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কাং-পিক, জোংরি, সেবু-লা চোম্বু ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত অল্পায়াসসাধ্য পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করার ব্যবস্থা হয়, বিবিধ হিমবাহে পর্যটন করানো হয় ৷ তারা অবশ্য ভাগ্যবান ৷ বিশ্বদেব বিশ্বাস প্রমুখ কিছু বাঙালি যুবক পশ্চিম হিমালয়ের নন্দাঘুণ্টি আরোহণ করেছেন, বই লিখেছেন ৷ আরও অনেক বাঙালি যুবক-যুবতী পর্বতারোহণ করেছেন ৷ প্রায় সবাই কিন্তু পশ্চিম হিমালয়ে পরিভ্রমণ করেছেন ৷ সেখানেই সবার ভিড় ৷ আসল সিকিম এবং জানু কাবরু পানডিম সিনিয়লচু চোমিয়োমো ইত্যাদি সব পর্বত ব্রিটিশ আমল শেষ হবার পর থেকে এখনও অনাদৃত পড়ে আছে ৷

উত্তর সিকিম এবং তিস্তার উৎপত্তিস্থল বিষয়ে যখন কয়েকটি বন্ধু ও আমি, ১৯৫২ সালে, বিশেষ মানসিক চাঞ্চল্য অনুভব করছি, তখন ওইসব অঞ্চল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল মানুষের খবর পাওয়া মুশকিল ৷ একটা পুরনো বইতে কিছু কিছু বর্ণনা পড়ে চমৎকৃত আছি, সেটি জোসেফ হুকারের হিমালয়ান জার্নাল, ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত ৷ হুকার সেইসময়ের একজন বিখ্যাত বটানিস্ট ও পর্যটক, লন্ডনের কিউ গার্ডেন এবং শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধির মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তিনি তাঁদের একজন ৷ হুকার প্রধানত পূর্ব হিমালয়ের বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ৷ এই ভ্রমণের একটা পর্যায়ে তিনি উত্তর সিকিমে গাছপালার রাজ্য পেরিয়ে সুউচ্চ তিব্বতি মালভূমিতে উপস্থিত হন ৷ তিস্তার একটি উপনদী, যার নাম লা-চেন, তাকে অবলম্বন করে অনেকদূর গিয়েছিলেন ৷ পথঘাটের •যদিও পথও নেই, ঘাটও নেই — ও স্থানীয় ভূগোলের অনেক বিবরণ তাঁর বইতে পাওয়া যায় ৷ পরে পার্সি ব্রাউনের ট্যুরস ইন সিকিম বইতেও সংক্ষিপ্ত কিছু বর্ণনা দেখেছি ৷ এইসময় দার্জিলিংয়ের তখনকার দিনের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ফটোগ্রাফার মণি সেনের সঙ্গে নতুন করে ঘনিষ্ঠতা হল ৷ তিনি আমার পিতৃবন্ধু, ১৯৫২ সালে তাঁর বয়স ষাট অতিক্রম করেছে ৷ ব্রিটিশ আমলে চৌরাস্তার কাছে অভিজাত দোকানগুলির সারিতে একটি বিশেষভাবে নজরে পড়বার মতো শপউইনডো ছিল ‘বারলিংটন স্মিথ’, সেটি মণি সেনের স্টুডিও ৷ এখানে দেখতে পেতাম অন্যান্য আশ্চর্য ছবিদের সঙ্গে, গুরুদোংমার হ্রদে প্রতিফলিত কাংচেনজাউ তুষারশৃঙ্গের ছবি ৷ মণি সেন তাঁর অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে উত্তর সিকিমে পরিভ্রমণ করেছেন, ভারি ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন, সেইসব ফটোগ্রাফ অবলম্বনে বড় মাপের অয়েলপেন্টিং এঁকেছেন ৷ তাঁর কাছে অনেক খবর পেলাম, অনেক উৎসাহ পেলাম ৷ মণি সেন একজন শ্রেষ্ঠ পর্বতপ্রেমিক ছিলেন ৷ ষাট বছর বয়সে তখন কৈলাস মানস সরোবর পর্যটন করে সবে ফিরেছেন ৷ কিছুদিন পূর্বে দার্জিলিংয়েই তাঁর দেহান্ত হয় ৷

এছাড়া, তখন আমার ঘনিষ্ঠতা জমছে আরও দুজনের সঙ্গে, একজন আংথারকে, আরেকজন তেনজিং নোরগে ৷ পর্বতারোহণের রাজ্যে দুটি শ্রেষ্ঠ নাম ৷ তেনজিং তখনও এভারেস্টের শীর্ষে চড়েননি, সেই বছর সুইস দলের সঙ্গে প্রায় শিখর থেকে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন ৷ আংথারকে ফরাসি দলের সঙ্গে অন্নপূর্ণা পর্বতে সাহস ও সহ্যক্ষমতার এক রেকর্ড স্থাপন করে ফিরেছে ৷ এরা দার্জিলিংয়ের তুংসুং শেরপা বস্তিতে থাকে ৷ শহরে এদের নিজস্ব বড় বাড়ি তখনও হয়নি ৷ এদের কাছে সবকিছুর হদিশ: কোথায় নদী, কোথায় সাঁকো নেই, কোথায় পথ অদৃশ্য হয়েছে, কোথায় তৃণটুকুর চিহ্ন নেই, কোথায় হিমবাহ কী নিয়মে নেমে এসেছে, কোথায় হ্রদ এবং কোথায় কোথায় ক্যাম্প করবার জায়গা ৷

অক্টোবর মাসে দুর্গাপুজোর দিনকয়েক আগে আমাদের পাহাড়ের দিকে অভিযানের দিনস্থির হয়েছে ৷ তিনজন সঙ্গী কলকাতা থেকে আসছে, শান্তিপ্রিয় ঘোষ, দেবশঙ্কর শীল ও কল্যাণ রায় ৷ এই তিনজন ও আমি চারটি বিভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির মানুষ, চারজনের চাররকমের জাত ৷ যে একটি জায়গায় আমাদের প্রচণ্ড মিল সেটি হচ্ছে পাহাড় নিয়ে পাগলামি ৷ শিলিগুড়ি স্টেশনে একত্রিত হয়ে মোটরে গ্যাংটক ৷ সেখানে পোর্টার সংগ্রহ করে, তাদের মধ্যে বোঝা বণ্টন করে রওনা হয়ে গেলাম ৷ এবার যাত্রাপথ উত্তরদিকে, কিন্তু এই যাত্রার বর্ণনার কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ কিছুদূর এগিয়েই শান্তি ঘোষ ও আমাকে ফিরে আসতে হল ৷ প্রবল ও অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টির ফলে মধ্য সিকিমের মংগনবাজার অঞ্চলে বৃহৎ ধস নামে, রাস্তাটাস্তা ভেঙে অদৃশ্য হয় ৷ শান্তি ঘোষ ও আমি ফিরে আসি, দেবশঙ্কর ও কল্যাণ রায় কোনওক্রমে এগিয়ে যেতে পারে ৷ তারা উত্তর সিকিমের নানা জায়গায় সফর সমাপ্ত করে যখন ফিরে আসে তখন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমি খানিকটা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম ৷

খুব মনখারাপ নিয়ে শান্তি ঘোষ কলকাতায় চলে গেল, আমি জলপাইগুড়িতে ফিরে এলাম ৷ ছাড়াছাড়ির পূর্বে উভয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি যে সামনের বছর আবার আমরা ওই পথে যাচ্ছি ৷ আরও দীর্ঘ ও বিস্তৃত পরিক্রমণের প্ল্যান আমাদের মাথায় ৷ ইতিমধ্যে একবছরের চাকরি ও সংসারধর্মে নিয়োজিত হওয়া যাক ৷ শান্তি তখন দমদম জেলের একজন অধিকর্তা ৷ কয়েক বছর আগে দার্জিলিং জেলে কাজ করার সময় হিমালয়রোগে আক্রান্ত হয় ৷

উত্তর সিকিমে বিফলতার গ্লানি কিছুতেই যেন মন থেকে মুছে ফেলতে পারা যায় না ৷ দ্বিতীয় সুযোগ আসবে, কিন্তু একবছর পরে ৷ এই অস্থিরতা থেকে নাথু-লা পেরিয়ে তিব্বত প্রবেশের আকর্ষণ জন্মেছিল, যে বিষয়টা একটু আগে লিখে শেষ করেছি ৷

ইতিমধ্যে জলপাইগুড়ির ইনকাম ট্যাক্স অফিসে একটু অদলবদল হয়ে, একটি যুবক ইনকাম ট্যাক্স অফিসার এসে পৌঁছেছে ৷ তার নাম কৃষ্ণমূর্তি, তামিল ব্রাহ্মণ ৷ অবিবাহিত, শান্ত প্রকৃতির, লেখাপড়া নিয়ে থাকতে ভালোবাসে ৷ পূর্বে হিমালয় দেখেনি, কিন্তু দুয়েকবার দার্জিলিং কালিম্পং ট্যুরে যাবার ফলে এবং আমার ছোঁয়াচ লেগে পর্বত রোগটা তারও ধরল ৷ দার্জিলিংয়ে যায়, জিমখানা ক্লাব থেকে পর্বতারোহণের বই ধার নিয়ে আসে, শেরপাদের সঙ্গে ভাঙা হিন্দিতে সুদীর্ঘ আলোচনা করে ৷ একবার তাকে সঙ্গে করে টংলু সান্দাকফু গেলাম ৷ তার অভিজ্ঞতা নেই, শরীর অনভ্যস্ত ৷ কিন্তু সান্দাকফু থেকে যে দৃশ্য সে দেখল তাতে সে চিত্রার্পিত ও রুদ্ধবাক ৷ পাহাড়ের নেশা শ্যাম্পেনের মতো তার মাথায় ৷ এরপর সুযোগ পেলেই ছুটি নিয়ে কৃষ্ণমূর্তি পাহাড়ে চলে যায় ৷ একলা, একটি দুটি শেরপা নিয়ে ৷ অন্য কোনও সঙ্গীর প্রয়োজন সে অনুভব করে না ৷ তার লক্ষ্য কোনও-না-কোনও পর্বতশিখর ৷ একবার সিকিম-নেপালের সীমান্তে কাং পিক চড়ে এল ৷ আরেকবার নারসিং পাহাড়ে চড়বার চেষ্টা করেছিল শেষ পর্যন্ত শিখরে পৌঁছতে পারেনি ৷ আরও একবার চোমিয়োমোর ওপর চড়ছে, এমন সময় একটি বরফের ঝড়ের মধ্যে পড়ল ৷ এইরকম উঁচু পাহাড়ে চড়বার উপযুক্ত ব্যবস্থা, পোশাক-আশাক ও সরঞ্জাম তার ছিল না, যেন নেশার ঘোরে দুটি শেরপার ভরসায় সে শিখরে চড়বার চেষ্টা করছিল ৷ বরফের ঝড় ও তীব্র শীতে আক্রান্ত হয়ে তাকে নেমে আসতে হল ৷ হাতপায়ের আঙুলগুলো, নাক কান জমে পাথর হয়ে গিয়েছে, পুরো তুষারের কামড়ে আক্রান্ত ৷ কোনওক্রমে দার্জিলিংয়ের হাসপাতালে ৷ নাক কান বেঁচে গেল, কিন্তু হাতপায়ের আঙুলের ডগায় গ্যাংগ্রিন এসে গেছে ৷ খানিকটা করে কেটে ফেলতে হল ৷ বেশ কিছুদিন ভুগে কৃষ্ণমূর্তি আবার দাঁড়াল ৷ আবার, একলা পাহাড়ের সফর শুরু করল ৷ বছর দেড়েক পরে, আমি তখন দিল্লিতে বদলি হয়ে এসেছি, খবর পেলাম যে সে সরকারি চাকরি ছেড়ে নেপালে চলে গিয়েছে, একটা শিক্ষকতার কাজ নিয়ে ৷ তার আর কোনও খবর পাইনি ৷

ক্রমশ ১৯৫৩ সালে জলপাইগুড়িতে বর্ষা নামল ৷ যথানিয়মে এল বন্যা ৷ যে বাড়িতে বসবাস করি, তা তিস্তার অন্য সময়ের কিনারা থেকে অন্তত এক মাইল দূরে, কিন্তু সর্বব্যাপী প্লাবন সেখানেও এসে পৌঁছয় ৷ মাটি থেকে পাঁচ ফুট উঁচুতে বাড়ির গাঁথুনি, তাতেও কানায় কানায় জল ৷ জল নেমে গেলে গামবুট পরে সাইকেল রিকশায় গিয়ে উঠি ৷ অফিসে গিয়ে দেখি জলে ভাসছে ৷ বাড়িতে ফিরে দেখি আবার বন্যার জল বেড়েছে ৷ কতবার জল এল, চলে গেল ৷ এইভাবে আরেকটা বর্ষাকাল কাটল, আবার আকাশ পরিষ্কার ৷ আমাদের উত্তর সিকিমে রওনা হবার দিন এগিয়ে এসেছে ৷

ইতিমধ্যে শান্তি ঘোষ ও আমি এই দুজনের দলে আরেকজন এসে যোগদান করেছে ৷ তার নাম পার্থ রায়, ২৪-২৫ বছর বয়স, জলপাইগুড়ির একজন নবীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ৷ দীর্ঘ খেলোয়াড়ের শরীর, স্মিতমুখ ও সংযতবাক ৷

পোশাক-আশাক, তাঁবু ইত্যাদি প্রায় সব সংগ্রহ হয়ে আছে ৷ প্রত্যেকের জন্য একটি করে স্লিপিং ব্যাগ ও এয়ার ম্যাট্রেস ৷ শান্তির আছে একটি নাইলনের সুইস তাঁবু, তাতে একজন শুয়ে থাকতে পারে ৷ আমারটা একটু বড়, তাতে দুজন ধরে, সেটি পার্থ ও আমার জন্য ৷ এছাড়া নানারকম উপকরণ ৷ ফটোগ্রাফির জিনিসই একগাদা ৷ সাদা-কালোর জন্য রোলিফ্লেক্স, রঙিন স্লাইডের জন্য লাইকা ও তার বিবিধ লেন্স ১৬ মিলিমিটার চলচ্চিত্রের জন্য Bolex-H 16, গাদাখানেক ফিল্ম, স্ট্যান্ড ইত্যাদি সব মিলিয়ে এক বোঝা ৷ অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে দার্জিলিংয়ে গিয়ে পোর্টারদের ব্যবস্থা করতে হল ৷ আংথারকে তার বাছাই করা ন-জন শেরপা সংগ্রহ করে রেখেছে, তাদের সর্দার নিযুক্ত হয়েছে নোরবু নামধেয় এক প্রধান শেরপা ৷ নোরবু আংথারকের সহকারী হিসেবে উত্তর সিকিমে পর্বতারোহী দলের সঙ্গে যুদ্ধের পূর্বে অনেক পরিভ্রমণ করেছে, রোদে জলে বরফের ঝড়ে পাক করা তার বলিষ্ঠ শরীর ৷ অন্যান্য ন-জন তাগড়া যুবক, নাম পাসাং, আংনিমা, দোরজি, ফু-টারকি এইরকম সব ৷ সবাই উৎসাহে টগবগ করছে ৷

নির্ধারিত দিনে শান্তি শিলিগুড়ি স্টেশনে এক সকালবেলায় এসে পৌঁছচ্ছে, আমি আর পার্থ আমাদের কিটব্যাগ, রুকস্যাক, রসদের ঝোলাঝুলি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছি ৷ শান্তি এল তার মালপত্র নিয়ে, বিরাট মুখমণ্ডলে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ ৷ গত কয়েকদিন যাবৎ দাড়ি কামানো বন্ধ রেখেছে ৷ ট্যাক্সি নিয়ে গ্যাংটক রওনা হয়ে গেলাম ৷ সুন্দর নির্মেঘ দিন, স্বচ্ছন্দে গ্যাংটকের ইনস্পেকশন বাংলোয় পৌঁছে সেখানে মাংসের ঝোল ভাতের লাঞ্চ ৷ বিকেলে নোরবু ও পোর্টাররা সব এসে পৌঁছল, তারা দার্জিলিং থেকে হেঁটে পেশক রোড দিয়ে তিস্তায় নেমে, কী কী সব শর্টকাট ধরে গ্যাংটকে উঠে এসেছে ৷ এবার সমান ওজনের নটি বোঝা প্রস্তুত করতে হবে, প্রত্যেকটি আন্দাজ ৩০-৩২ সের ৷ নোরবু সর্দারের সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শ করে ও একটা বিশেষ হিসেব করে আমরা জিনিসপত্র এনেছি ৷ প্রথমত, জামাকাপড়, তাঁবু এয়ারম্যাট্রেস ইত্যাদি যা আমাদের প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সঙ্গে থাকবে ৷ দ্বিতীয়ত, খাদ্যবস্তু, যথা চাল, ডাল, আটা, নুন, তেল, কেক বিস্কুট, টিনের মাংস, ফল ইত্যাদি এবং কেরোসিন তেল যার ওজন ক্রমশ কমতে থাকবে ৷ আমাদের পর্যটন ছাব্বিশ দিনের, তিনজন খাদক ৷ সফরের অর্ধেক সময় তারা অতিশয় ক্ষুধার্ত, অর্ধেক সময়, ১৩-১৪,০০০ ফুট উচ্চতায়, তারা হয়তো আহারে অনিচ্ছুক ৷ অধিক উচ্চতায় পৌঁছতে পৌঁছতে খাদ্যের ভার খানিকটা লাঘব হবে, কিন্তু সেখানে গাছপালা অদৃশ্য, রান্নার কাঠ পাওয়া যাবে না ৷ বনরেখা অতিক্রম করার পূর্বে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বহন করতে হবে ৷ সেইসব বোঝার হিসেব ৷ এইসব নানাবিধ হিসেবপত্র করে এবং বোঝার ওজন ও পরিমাপ বিবেচনা করে এই ন-জন পোর্টারের মধ্যে বন্টন করা খানিকটা সময়সাধ্য ব্যাপার ৷ বড় বড় অভিযানে যারা যায় তাদের একশো-দেড়শো পোর্টার লাগে ৷ তাদের ও রসদপত্রের ম্যানেজমেন্ট অভিযাত্রীদের একটা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ৷ আমাদের অভিযান তাদের তুলনায় কিছুই নয়, তবু বোঝা তৈরি, তার তালিকা বিবরণ ইত্যাদি সমাপ্ত করতে অনেক রাত হয়ে গেল ৷ ইনস্পেকশন বাংলোর বারান্দায় এই একসার বোঝা প্রস্তুত রেখে এবং নোরবু ও তার সঙ্গীদের বিদায় জানিয়ে আমরা শয্যাগ্রহণ করলাম ৷ যাত্রার প্রাক্কালে একটু উত্তেজিত ও আশান্বিত ৷

পরদিন সকাল আটটায় পদব্রজে গ্যাংটক পরিত্যাগ করে যে পথ ধরলাম সেটি দ্রুতগতিতে তিস্তা নদীর খোলে নেমে গিয়েছে ৷ গ্যাংটকের উচ্চতা ৬,৫০০ ফুট, দশ-বারো মাইল রাস্তা ধরে নেমে যাওয়ার পথে এক জায়গায়, বোধহয় ১,৫০০ ফুট উচ্চতায়, দিক-ছু বলে একটি উপনদী তিস্তায় এসে মিশেছে ৷ সেই সঙ্গমস্থলে একটি ডাকবাংলো আছে, সেইটি আমাদের প্রথমদিনের লক্ষ্যবস্তু ৷ স্বচ্ছন্দ ভ্রমণ, গ্যাংটক থেকে নিষ্ক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দুপাশে বনভূমি, কখনও কোনও গ্রাম, থাকে থাকে খেত, খামার, প্রধানত বড়-এলাচ, আলু, সর্ষে ৷ আজ আমাদের সঙ্গে উত্তম লাঞ্চ প্যাকেট, গ্যাংটক বাংলোর খানসামা কর্তৃক প্রস্তুত সামি কাবাব, হ্যামস্যান্ডউইচ ইত্যাদি এবং শান্তির কলকাতা থেকে আনা কড়াপাক সন্দেশ ৷ পাহাড়ি রাস্তায় গাছের নিচে পাথরের ওপর বসে এইরকম সব লাঞ্চব্রেকের স্মরণে এখনও চক্ষু আর্দ্র হয় ৷

পোর্টাররাও সব আশপাশে বসে তাদের আহার্যের পুঁটলি খুলেছে ৷ হাতে গড়া মোটা রুটি, একটু আচার, একচিলতে শুকনো গোমাংস একটি পেঁয়াজ ৷ প্রচুর কলরব ও হাস্যপরিহাসে তারা মশগুল ৷ এখানে বলা প্রয়োজন যে, সাধারণভাবে, তাদের খাদ্যব্যবস্থার জন্য অভিযাত্রীদের কোনও দায়িত্ব নেই ৷ তাদের যা মজুরি তারমধ্যে থেকেই তারা নিজেদের খাদ্যবস্তু কিনে আসে ৷ এরজন্য সর্দারকে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে রাখতে হয় ৷ ঠিক মনে নেই, তখনকার দিনে মজুরি ছিল সর্দারের দৈনিক পাঁচ টাকা এবং অন্যান্যদের সাড়ে তিন টাকা ৷ এর ওপর, বনরেখার ওপরের উচ্চতায়, অর্থাৎ ১৩-১৪,০০০ ফুটের ওপরে যে কদিন কাটবে তার জন্য এক টাকা করে অতিরিক্ত ৷ পোর্টাররা আমাদের যে ৩০-৩২ সেরের বোঝা বইছে তার ওপর তাদের নিজস্ব কাঁথাকম্বল ও আহার্যের পোঁটলা ৷ এইসব ওজন নিয়ে তারা আমাদের দ্বিগুণ গতিতে পাহাড়ে ওঠানামা করে থাকে ৷

দিক-ছুর ডাকবাংলোয় যখন পৌঁছলাম তখনও অনেক বেলা আছে ৷ নদীর ধারে একটু উঁচু জমিতে বাংলো ৷ দুদিকে ঘন বনাকীর্ণ পাহাড় উঠে গেছে, বাংলোটি যেন একটি গহ্বরে বসানো ৷ টানা বারান্দায় ইজিচেয়ার নিয়ে বসে নিচে নদীর গর্জন শোনা এবং চতুর্দিকে পাহাড়ের গায়ে গাছের গা-দোলা দেখা ছাড়া চক্ষু কর্ণের আর কোনও মুক্তি নেই ৷ উষ্ণ, আর্দ্র আবহাওয়া, কীটপতঙ্গের জগৎ ৷ সন্ধে হতে না হতে হ্যারিকেন লণ্ঠনের গায়ে হাজারও রকম পোকার লাফালাফি, ঝিঁঝিপোকার উচ্চতান ৷ সত্বর রাতের আহারাদি সেরে আলো নিভিয়ে দিতে হল ৷ তারপর বুকচাপা অন্ধকারে ক্লসট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত এই বাংলোয় কোনও এক সময় আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম ৷

দার্জিলিংয়ের মতো সিকিমেও পি ডাব্লু ডি-র বাংলো অনেক ছড়িয়ে আছে, সেইসব জায়গায় যেখানে অফিসাররা ট্যুরে যান ৷ আমাদের মতো শখের ভ্রমণকারীদের জন্য নিয়ম হল যে, পূর্বাহ্নে নির্দিষ্ট তারিখ জানিয়ে এবং অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে বাসের অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়, যা আমরা করেছি ৷ বাংলোর চৌকিদারকে অনুমতিপত্র দেখালে সে তালা খুলে দেয়, থাকবার বন্দোবস্ত করে দেয় ৷ ফার্নিচার এবং রান্নাখাওয়ার বাসনপত্র সবই থাকা উচিত ৷ তবে যেসব বাংলোয় অফিসাররা কখনও কদাচিৎ আসেন, বা মোটেই আসেন না, সেইসব অবহেলিত বাংলোর অবস্থা বড়ই করুণ ৷ হয়তো চৌকিদারকেই খুঁজে পাওয়া গেল না, আশপাশের কোনও গ্রামে গিয়ে বসে আছে, পোর্টাররা কেউ গিয়ে ধরে নিয়ে এল ৷ নচেৎ জরাজীর্ণ অথবা ছাংয়ের ভারে মাথা তুলতে পারছে না ৷ সাবধানী পথিকরা এইসব কারণে দলে এমন একজনকে রাখে যে রান্নাবান্নার কাজও করতে পারে ৷ আমরা বাংলোর এলাকা ছাড়িয়ে অনেকদূরে যাব, কদিন পরেই তাঁবুতে বসবাস করতে হবে ৷ এইজন্য ভারবাহী পোর্টারদের মধ্যে এমন একজনকে এনেছি যে রান্নাবান্নার কাজও করতে পারে ৷ তার নাম পাসাং, হাসিখুশি একটি যুবক ৷ সকালবেলার টোস্ট-ওমলেট, কর্নফ্লেকের পরিজ, দুপুরবেলার পরোটা তরকারি এবং রাতের ভাত মাংস চটপট তৈরি করে দিতে পারে ৷ এছাড়া আছে শান্তি ঘোষ, পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ রাঁধিয়ে ৷

আহারাদির সরঞ্জাম এবং রসদপত্র, পূর্বেই বলেছি, আমাদের সঙ্গে চলেছে ৷ পথে লোকালয় পড়লে সেখান থেকে সংগ্রহ করা হয় ডিম, মুরগি, আলু, পেঁয়াজ, সর্ষে শাক ৷

দিক-ছুর পর তিস্তার অববাহিকা ধরে আমাদের পথ ৷ দশ-বারো মাইল দূরে সিংঘিক বাংলোর দিকে আমরা যাচ্ছি ৷ দুটি কারণে এই রাস্তাটি ভয়াবহ ৷ প্রথম, উপহিমালয়ের অজগর বিজবনের মধ্য দিয়ে এই রাস্তা ৷ সদ্য শেষ হওয়া বর্ষাকালের সৃষ্ট আগাছা জঙ্গল দুপাশ থেকে রাস্তাকে প্রায় বুজিয়ে ফেলেছে ৷ সাপ-খোপ ততটা দেখিনি, কিন্তু এটি হচ্ছে জোঁকের রাজ্য ৷ আমাদের পায়ে ভারি বুট জুতো, মোজা এবং প্যান্টের ধারিকে বেঁধে পট্টি লাগানো ৷ তাতে নিম্নাঙ্গ বাঁচছে, কিন্তু সামনে পা-বেয়ে, গা-বেয়ে জোঁক উঠছে ৷ আশপাশের পাতালতার থেকে সোজা এসে হাত ধরছে, ঘাড়ে আটকে যাচ্ছে ৷ এর প্রতিকার হচ্ছে জোঁকের গায়ে নুন ছড়ানো অথবা জ্বলন্ত সিগারেটের ডগা চেপে ধরা ৷ কিছুক্ষণ পর পর একটু পরিষ্কার জায়গায় বসে পরস্পরের জোঁক ছাড়াচ্ছি ৷ আমাদের সামনে সামনে পোর্টাররা চলেছে, দেখছি যে তাদের খোলা হাত-পা থেকে বড় বড় কালো পরিপুষ্ট জোঁক ঝুলছে, তাদের বিশেষ ভ্রূক্ষেপ নেই ৷ উপোসি জোঁককে দেখতে হয় দেড়-দু ইঞ্চি লম্বা কালো সুতোর মতো, বাড়ছে কমছে ৷ মানুষ কি আর কোনও প্রাণীর গায়ে ধরার পর রক্তপান করে ফুলে টোপর হয়ে যায় ৷ জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিলে টুপ করে মাটিতে পড়ে ৷ তারপর জুতো দিয়ে পিষে দিলে গলগলে অনেকখানি তাজা রক্তে তার পরিসমাপ্তি ৷

এই রাস্তার দ্বিতীয় আপদ হচ্ছে বর্ষাকালের ভাঙন ৷ ছোট, মাঝারি, বড় সব ধস নেমে গেছে, তার নিচে রাস্তা অদৃশ্য ৷ অসংখ্য ঝরনা, ছোট ছোট নদী পার হতে হয় কিন্তু সাঁকো ভাঙা অথবা বিপজ্জনক অবস্থায় নড়বড় করছে ৷ জলে নেমে পাথরে পাথরে লাফিয়ে পার হচ্ছি ৷ যেখানে তা সম্ভব নয় সেখানে ঘুর পথে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি ৷ নোরবু সর্দার আমাদের সকলের আগে, তার হাতে খোলা কুকরি, কোমরে মোটা দড়ি জড়ানো ৷ গাছপালা ডালপাতা কেটে পোর্টারদের পথ সরল করে দিচ্ছে, এপার-ওপারের গাছে দড়ি বেঁধে সকলের নদী পারের সময় হাত দিয়ে একটা কিছু ধরার অবলম্বন করে দিচ্ছে ৷

এইভাবে সারাদিন ধরে কল্লোলিনী তিস্তার অববাহিকায় চলে চলে এক জায়গায় এসে চড়াই রাস্তা ৷ তিস্তা নিচে পড়ে রইল, মাইল দূর চড়াই ভেঙে সিংঘিক বাংলোর চত্বরে এসে পৌঁছলাম ৷ এ-জায়গাটির উচ্চতা ৪,০০০ ফুটের মতো ৷ হাওয়ায় ঠান্ডার আমেজ, আর সবচেয়ে বড় কথা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আবার দেখতে পেলাম ৷ প্রায় সটান পূর্বদিক থেকে দেখছি এই শৃঙ্গের উন্মুক্ত বক্ষপট ৷ সারাদিনের সমস্ত গ্লানি এক মুহূর্তে অন্তর্হিত হল ৷

পরদিন আমাদের গন্তব্যস্থল চুং-থাং নামক একটি গ্রামে ৷ পাহাড়ের গা-বেয়ে-বেয়ে রাস্তা, কখনও তিস্তার খোলে নামছে, কখনও উঠে আসছে ৷ প্রধানত ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, কোথাও-কোথাও বড়-বড় ধস নেমে রাস্তা ভেঙে নিয়ে গেছে পাহাড়ের শরীরকে উলঙ্গ করে, সেসব স্থান আলগা মাটির ওপর অতি সন্তর্পণে পা ফেলে অতিক্রম করতে হয় ৷ একবার দুবার হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেল ৷ চটচটে কাদায় পথ পিছল, অনবরত গায়ে জোঁক উঠছে, গরম, ঘাম, জিভের ডগা পর্যন্ত তৃষ্ণায় শুষ্ক ৷ এইসব নিচু হিমালয় অঞ্চল পদব্রজে অতিক্রম করা বড় কষ্টকর ৷ তবে পুরস্কারও আছে, এ অঞ্চলের অর্কিড ও পক্ষীজগৎ ৷ তখন অক্টোবর মাস, প্রায় সব অর্কিড গাছে ফুল ফোটা শেষ হয়ে গেছে, কিছু কিছু শেষে ফোটা ফুল তখনও গাছের গায়ে লেগে রয়েছে, ঈষৎ গোলাপী, মভ, সাদা ৷ দেখবার মতো হয়ে রয়েছে প্রত্যেকটি বড় বড় গাছের গুঁড়িতে, ডালে আশ্রিত ও দোদুল্যমান অর্কিডের সুস্থ, মাংসল পাতা, বিগত বর্ষার জলে তাদের নবজন্ম হয়েছে ৷ এদের বিশেষ কিছু আলাদা করে চিনি না ৷ শুনেছি সিকিমে চারশো রকমের অর্কিড আছে ৷ ফেরবার পথে, যদি পারি, চেনা-অচেনা কিছু অর্কিড গাছ তার আশ্রয়দাতা গাছের বল্কলসমেত দার্জিলিংয়ে নিয়ে যেতে হবে ৷ তখনকার দিনে প্রখ্যাত অর্কিডবিশেষজ্ঞ কাকঝোরার মিঃ ঘোষের কাছে প্রতিশ্রুত আছি ৷

এছাড়া মধ্য সিকিমের এই অঞ্চলটি পাখিদের রাজ্যও বটে ৷ প্রাতঃকাল থেকে তাদের ডাকাডাকি শুনছি ৷ সর্বত্র তাদের বহুবর্ণ শরীরের ঝিলিক ৷ শূন্য থেকে সামনের ডালে, সে ডাল থেকে অন্য ডালে, সেখান থেকে অদৃশ্যে ৷ একা, জোড়ায়, দলে দলে ৷ ছোট্ট দুর্গাটুনটুনির মতো উইলো-ওয়ার্বলার, কি চড়াইয়ের সাইজের মিনিভেট থেকে বড় বড় ট্রি-পাই, ফর্কটেল, নীল থ্রাশ ৷ এমন অনেক পাখি যা দার্জিলিংয়ের বার্চ হিল কিংবা সিঞ্চল লেকের আশপাশে জঙ্গলে দেখিনি ৷

পথে মঙ্গনবাজার নামে একটি লোকালয় ৷ এখানে মাড়োয়ারিদের গুটি দুই-তিন বেনেতি দোকান ৷ আশপাশের সব পাহাড়ি মানুষ তাদের সবকিছু প্রয়োজনীয় জিনিস এসব দোকানে পায় ৷ লেপচা নামধেয় একটি পাহাড়ি জাতি কোণঠাসা হয়ে এই অঞ্চলে বসবাস করে ৷ এককালে মধ্য ও দক্ষিণ সিকিমের সমস্ত বনে-ঢাকা অঞ্চল লেপচাদের অধিকৃত ছিল ৷ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে পশুপাখির অন্তরঙ্গতায় তারা জীবন কাটাত ৷ তিব্বতিরা এসে ক্রমশ তাদের স্থানচ্যুত করে ৷ সিকিমের রাজা চোগিয়াল বংশ, সব সামন্ত জমিদার, সেনাপতি, জমাদার, নায়েব, তহশিলদার অথবা মঠের অধ্যক্ষ বা পরিজন সবাই তিব্বতি ৷ তারপর এল নেপালি যাদের অধিকারে এখন ব্যবসা, কৃষিকর্ম, শিল্প ৷ অদৃশ্যপ্রায় আদিবাসী লেপচারা এখন মধ্য সিকিমের ঘন জঙ্গলে পশুপক্ষীর সঙ্গে মিলিয়ে গেছে ৷ ব্রিটিশ আমলে লেপচাদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা ছিল ৷ স্কুলে পড়া, থাকা খাওয়া সব তারা বিনামূল্যে পেত ৷ পরে, যদি না তারা মধ্যপথে পালিয়ে যেত, ম্যাট্রিক পাশ করলেই চাকরি ৷ আমি যখন দার্জিলিংয়ের সরকারি স্কুলে পড়ি, ১৯২৫-৩১ সালের কথা বলছি, তখন হঙ্গু লেপচা বলে একটি ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত ৷ ফোর্থ ক্লাস পর্যন্ত (বর্তমানের বোধহয় ক্লাস সেভেন) উঠল ৷ সেইখানেই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখন তার বয়স ১৮-১৯ হবে ৷ কয়েক বছর ফোর্থ ক্লাসে কাটানোর পর সে পুলিশ হয়ে গেল ৷

সিকিমের রাজা চোগিয়ালের উল্লেখে একটি কথা মনে পড়ে গেল যা পূর্বে বলতে ভুলে গিয়েছি ৷ গ্যাংটক ছাড়বার পূর্বদিন অপরাহ্নে আমরা তিনজন কিছুক্ষণের জন্য মহারাজার প্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন মনাস্ট্রির আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি ৷ যাকে প্রাসাদ বলছি সেটি একটি নাতিবৃহৎ কাঠের তৈরি দোতলা বাংলো ৷ ঝাউগাছ দিয়ে ঘেরা এই পরিমিত ও রুচিকর বাড়িটির সামনে ফুলে ভরা বাগান, দু-তিনটি স্থানীয় উর্দি পরা ছেলেমানুষ-চেহারার প্রহরী ৷ সবকিছুর পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘার সারি ৷ ছবি তুলছি, এমন সময় প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন সিল্কের বখু পরা এক তিব্বতি বৃদ্ধ ৷ ছোটখাটো, ছটফটে ৷ মুহূর্তে বুঝে গেলাম ইনিই চোগিয়াল ৷ আনত নমস্কার করলাম, দুচার কথায় জানালাম আমরা তাঁর রাজ্যের অতিথি, উত্তর সিকিম ভ্রমণে যাচ্ছি ৷ কথায় বার্তায় ভরসা পেয়ে তাঁর ছবি তোলবার অনুমতি চাইলাম ৷ বৃদ্ধ খুব খুশি, বখুর হাতা থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছে ফেললেন ৷ তারপর, কী মনে করে হাত তুলে বললেন, দাঁড়াও ৷ বলেই হনহন করে তাঁর বাড়িতে ঢুকে গেলেন ৷ দাঁড়িয়ে আছি, দুমিনিট পরেই চোগিয়াল বেরিয়ে এলেন ৷ তখন তাঁর মাথায় একটা স্টিলের হেলমেট, হাতে স্টেনগান ৷ দেখে আমরা একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি ৷ কিন্তু চোগিয়ালের মুখে হাসি, পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ৷ ছবি তুললাম ৷ মাথায় হেলমেট, হাতে স্টেনগান, নীল সিল্কের বখু পরা সিকিম মহারাজার সেই রঙিন ছবিটি দেখে এখনও আনন্দ হয় ৷ বার্ধক্যের ফলে মহারাজ তখন যেন শিশুর মতো হয়ে গিয়েছেন ৷

পরবর্তী চোগিয়ালের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগও হয়েছিল অনেক পরে, ১৯৭১ সালে ৷ ইনিই শেষ চোগিয়াল, যাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হোপ কুক ৷ সিকিম মাইনিং কর্পোরেশনের কিছু সমস্যা ছিল, সেই সম্পর্কে আমন্ত্রিত হয়ে আমায় সিংতাম মাইনিং ক্ষেত্রে ও গ্যাংটকে আসতে হয় ৷ গ্যাংটক শহরের একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখলাম ৷ অতি ছোট, ঘুমন্ত, খেলনার শহর ছিল ৷ সেখানে বড় বড় বাড়ি, চওড়া রাস্তায় জিপ, ট্রাক সব চলাচল করছে, বিস্তৃত সেনানিবাস ৷ শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনও পরিবর্তন নেই ৷ রাজা তখন রাজধানীতে ছিলেন না, তাঁর সঙ্গে দেখা হল ফেরবার সময় বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ৷ ততদিনে এয়ারপোর্টও বদলেছে, একটি ভি আই পি ঘরও হয়েছে ৷ সেই ঘরে চোগিয়াল, হোপ কুক ও তাঁদের দুটি সন্তান ৷ এক ঘণ্টার গল্প সল্প হল, সাধারণ সাংসারিক আলাপ, পুরনো সিকিম, দৃশ্যের পরিবর্তন ৷ খুব সাধারণ চেহারা এই পরিবারের, রাজা রানি বলে মনেই হয় না ৷ চোগিয়াল যে অনতিদূর ভবিষ্যতে রাজ্যচ্যুত হবেন, তার কোনও আভাস তখনও সিকিমের আবহাওয়ায় নেই ৷

সিংঘিকের ডাকবাংলোয় রাত্রিযাপন করে পরদিন সকালে আবার তিস্তার লাইন ধরে উত্তরমুখী আরেকদিনের পর্যটন ৷ মাইল দশেক দূরে চুং-থাং নামক একটি গ্রামে আমাদের আজকের যাত্রা শেষ হবে ৷ পথটি ৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, ঘন বনজঙ্গলের মধ্যে সরু পথের রেখা প্রায়শই ছোট বড় পাহাড়ের ধসে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন আগের দুদিনে দেখেছি ৷ সেইরকম লতাপাতা, পাখি, প্রজাপতি, ঝিরঝিরে ঝরনার প্রবাহ ৷ সেইরকম জোঁক ৷ কখনও সখনও শরৎকালীন হঠাৎ বৃষ্টির পশলা ৷ এইভাবে সারাদিন হেঁটে বিকেলের দিকে চুং-থাং বাংলোয় এসে পৌঁছলাম ৷ বেশ বড় আকারের মনোহর বাংলো ৷ এটি কোনও পাহাড়ের উচ্চতায় তৈরি না করে এমন এক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে যেখানে দুটি উপনদী এসে মিশ্রিত হয়েছে ৷ একটির নাম লা-চেন, অপরটির নাম লা-চুং ৷ লা-চেন আসছে উত্তর সিকিমের পশ্চিম অঞ্চলের জলধারা বহন করে ৷ এই জলে এসে পড়েছে কাবরু-সিনিয়লচু-কাঞ্চনজঙ্ঘা-জংসং ইত্যাদি তুষারশৃঙ্গ থেকে নেমে আসা বিবিধ হিমবাহের সৃষ্ট নদীর জল ৷ তার মধ্যে আছে বিখ্যাত দুটি হিমবাহ, জেমু এবং তালুং ৷ দ্বিতীয় নদী লা-চুং উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জলধারা, এতে এসে পড়ছে পাউহুনরি, চোম্বু এবং অন্যান্য শৃঙ্গের বরফগলা জল ৷

চুং-থাং-এ এই দুটি নদীর সঙ্গম, সেখান থেকে তাদের সাধারণ নাম দিস্তাং, অথবা তিস্তা ৷ এই দুটির মধ্যে লা-চেন বড় নদী, তিস্তার প্রধান উপনদী ৷ সিকিমের সবচেয়ে আধুনিক ও বিশ্বাসযোগ্য যে মানচিত্র আমার কাছে আছে (1969, University of Kentacky, 1 cm-1.5 km) তাতে দেখছি যে এই লা-চেন নদীকে তিস্তা বলা হয়েছে ৷ চুং-থাং থেকে আমাদের গতিপথ ছিল উত্তরদিকে লা-চেন অথবা তিস্তার অববাহিকা অবলম্বন করে ৷

পরদিন আমাদের গন্তব্যস্থল লা-চেন গ্রামে ৷ এটি চড়াইয়ের পথ, ১২ মাইলে ৪,০০০ ফুট উঠতে হবে ৷ প্রথমার্ধ নদীর ধার দিয়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত সহনীয় চড়াই, পরে ক্রমশ কষ্টকর ৷ এইবার দৃশ্যের পরিবর্তন, জঙ্গল কমে এসেছে, আবহাওয়া শুকনো ও ঠান্ডা, পাখিরা এখনও অগুনতি কিন্তু জোঁক অদৃশ্য ৷ পরিশ্রান্ত শরীরে পাথরের ওপর বিশ্রামের জন্য বসলে মসৃণ শীতল হাওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যে ক্লান্তি বিদূরিত হয় ৷ ক্রমশ উঁচুতে পাহাড়ের মাথায় ছোট বাংলোর লাল ঢেউটিনের ছাদ দেখা গেল, আরও দেখা গেল বাংলোর অনতিদূরে গাছপালার মধ্যে লাচেন মনাস্ট্রির সোনালি রং করা শিখর ৷ ক্লান্ত, অবসন্ন চোখে এই দৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়ে কম মনোহর মনে হয়নি ৷ যখন বাংলোয় পৌঁছলাম তখন সূর্যাস্ত হব হব ৷

লাচেন বাংলোর উচ্চতা ৯,৫০০ ফুট মতো হবে ৷ প্রাতঃকালে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে গায়ে ভারি সোয়েটার চাপিয়ে ও একেক মগ ধূমায়িত চা হাতে নিয়ে আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম ৷ এ এমন এক জায়গা যেখানে দুচার দিন থেকে যেতে ইচ্ছে করে ৷ আমাদের আজই ছেড়ে যেতে হবে ৷ তবু স্থির হল যে ঘণ্টা দুইয়ের জন্য আশপাশে একটু ঘুরে চরে বেড়ানো হোক ৷ খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আমরা তিনজন মনাস্ট্রির দিকে চলে গেলাম ৷ পথে একটি ভুটিয়া গ্রাম, খেতখামার, আপেলের বাগান, গাছে লাল লাল আপেল ঝুলছে ৷ গ্রামের প্রান্তে মনাস্ট্রি, দু-দিনটি বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রার্থনাচক্র ঘুরিয়ে নাম জপছে ৷ ভেতরে স্বর্ণকান্তি গৌতম বুদ্ধ ৷ এইখানে মনাস্ট্রির প্রাঙ্গণে আমরা প্রথম ইয়াক অথবা চমরিগাই দেখতে পেলাম ৷ বিরাট পশু, গা বেয়ে লোমের জঙ্গল নেমে এসেছে ৷

তিব্বতে একসময় খ্রিস্টান ধর্ম আনবার চেষ্টা হয়েছিল ৷ সেই সময় লা-চেন-এ ডেনমার্কের একটি মিশন এক ধর্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ দুয়েকটি সাহেব এখানে থাকতেন, যুদ্ধের সময় সবাই চলে যান, আর কেউ তারপর আসেনি ৷ খ্রিস্টান মঠটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ৷ আশপাশে ক্রশচিহ্নিত কয়েকটি কবর, আগাছায় আবৃত ৷

গাছে আপেল দেখে আমরা কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু গ্রামবাসীরা আমাদের এককোঁচড় ফল উপহার দিল, কিছুতেই দাম নিতে চাইল না ৷ বাংলোয় ফিরে আমরাও পোর্টারদের মধ্যে সেগুলি বিতরণ করে দিলাম ৷ তারপর নিজ নিজ রুকস্যাক বা অন্যান্য বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আমরা লাচেন পরিত্যাগ করলাম ৷ আজকের পর্যটনের লক্ষ্য থাংগু, প্রায় ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় ৷

লাচেন থেকে সাধারণ গাছপালার উচ্চতা কমে আসছে ৷ বিবিধ কনিফার দেখছি, জুনিপার, ক্রিপটোমেরিয়া ইত্যাদি ৷ অধিকাংশ গাছই আমার অজানা ৷ এখনও রডোডেনড্রন গাছে কিছু কিছু ফুল রয়ে গেছে ৷ সব ক্রমশ হ্রস্বাকৃতি হতে হতে চলেছে ৷ এখানে ওখানে হাইড্র্যানজিয়া, স্যাক্সি ফ্রাজ, এজেলিয়ার বিস্তৃত কিন্তু খর্বাকৃতি ঝোপঝাড় ৷ পাখির ডাক কম শোনা যাচ্ছে, প্রজাপতি প্রায় নেই ৷ ১০-১১,০০০ ফুট থেকে উচ্চতার প্রভাব অনুভূত হয়, আমাদের গতি বেশ মন্থর ৷ তিস্তা ধরে চলেছি, সে এখন শীর্ণকায়া কিন্তু খরবাহিনী ৷

দিনের শেষে থাংগু ডাকবাংলো দেখা গেল, সেই লাল টিনের ছাদ ৷ উত্তর সিকিমের পথে এই শেষ বাংলো ৷ পথ বা পথের ভগ্নাবশেষ এখানেই শেষ হয়েছে, এরপর তিব্বতি মালভূমির অপার বিস্তৃতি ৷ থাংগুতে লোকালয় বলতে কিছু নেই, বাংলোর বৃদ্ধ বিশুষ্ক চৌকিদার প্রায় একাই বসবাস করে ৷ বাংলো থেকে অল্প দূরে একটি ছোট পাহাড়ি ঝরনার ধারে তার একটি রুমালের সাইজের আলুর খেত ৷ প্রতি মাসে সে একবার হেঁটে গ্যাংটক যায়, বেতন সংগ্রহ করে, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে আসে ৷ দুদিনে যায়, দুদিনে ফিরে আসে ৷ আমাদের এখানে এসে পৌঁছতে পাঁচদিন লাগল ৷

থাংগুতে খোলা উত্তরের হাওয়া, বাংলোর কোনও পাশে কোনও গাছের আবরণ নেই ৷ সারাক্ষণ পুরনো দরজা জানলায় খটখট শব্দ, ছুরির ফলার মতো ঠান্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে ৷ চৌকিদার ও নোরবু সর্দার উভয়ে মিলে ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন জ্বালিয়ে দিতে সেটিকে ঘিরে আমরা সব বসলাম, শেরপারাও সব একেক করে এসে বসে গেল ৷ সাধারণত এইসব বাংলোয় চৌকিদারের ঘরে এবং রান্নাঘরে পোর্টাররা আশ্রয় নেয় ৷ আজ আমাদের পর্যটনের আদি বাংলো পর্ব শেষ হল, এবার তাঁবু পর্বের আরম্ভ, মধ্যে একদিনের বিশ্রাম ৷ প্রথমত, পাঁচদিন একনাগাড়ে হেঁটেছি ৷ কতবার হোঁচট খেয়েছি, কাদায় শ্যাওলা ধরা পাথরে পা-পিছলে পড়ে গেছি, কাঁটা ঝোপে শার্ট প্যান্ট ছিঁড়েছে ৷ গা ছড়ে গিয়েছে ৷ সবারই গায়ে অল্পবিস্তর জোঁক ধরার ক্ষত ৷ এসবের মেরামতির প্রয়োজন ৷ তাছাড়া এই উচ্চতায় বাতাসে অক্সিজেন খানিকটা কমে যায় ৷ মানুষের শরীর সেটা সইয়ে নেয় ঠিকই কিন্তু একটু সময় দেওয়া ভালো, বিশেষত আমাদের বাঙালি শরীরে ৷ পরিশ্রমে হাঁফ ধরে যাওয়া কোনও অসুস্থতার লক্ষণ নয়, এমনকী অল্পস্বল্প মাথা ধরা, গা বমি বমি করা, অখিদে এবং অনিদ্রাও অস্বাভাবিক কিছু নয় ৷ কিন্তু এসব লক্ষণ একদিন দুদিনে অন্তর্হিত হওয়া উচিত ৷ সৌভাগ্যক্রমে আমার শরীর খানিকটা পাহাড়ে ঝালানো, শান্তি ঘোষের শরীরে তখন একটু মেদের প্রলেপ পড়লেও আসল গ্র্যানাইট দিয়ে তৈরি, এবং পার্থ রায় অতিশয় তাগড়া কাঁচা বয়সের যুবক ৷ তিনজনেই বেশ আছি এবং বেশ চলেছি ৷ থাংগুতে আমাদের একদিনের বিশ্রামের অর্থ শরীরকে বোনাস দেওয়া ৷

ফায়ারপ্লেসে আগুনের এক কিনারায় কালো হয়ে যাওয়া মস্ত লোহার কেটলিতে বিনাদুধের চা ফুটে যাচ্ছে ৷ আমাদের সকলের হাতে অ্যালুমিনিয়ামের মগ, পোর্টাররাও তাদের নিজ নিজ মগ নিয়ে এসেছে ৷ এক সময় নোরবু সর্দার উঠে সকলের পাত্রে কিছুটা করে ফুটন্ত চা ঢেলে দিল ৷ তারপর শান্তি ঘোষ তাতে যোগ করল দু-আঙুল করে রাম ৷ সত্বর শীত বিদূরিত হল, রক্ত চলাচল দ্রুততর হল, এবং জমে উঠল আমাদের পার্টি ৷ কাঠের আগুনের লাল আলোয় জ্বলজ্বল করছে শেরপাদের টান-টান মুখের চামড়া ৷ এই পার্টির মধ্যমণি হচ্ছে নোরবুসর্দার ৷ ধরা-ধরা গলায় সে নেপালিতে বলে যাচ্ছে তার পুরনো পাহাড়ে চড়ার কাহিনী, কবে কোন সাহেবদের সঙ্গে কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কোথায় বরফের ধসে তাঁবু সুদ্ধ নেমে এসেছিল, কোথায় পাহাড়ের ফাটলে কে পড়ে গিয়েছিল, কোথায় ইয়েতি দেখেছে ৷ আমরা সব মন দিয়ে শুনছি, তার হাত নাড়া ও বিচিত্র মুখভঙ্গি দেখছি, তার উৎসাহের জোগান দিচ্ছি ৷ আরও গরম চা, আরও দু-আঙুল করে রাম, আরও চিনেবাদাম ও ককটেল সসেজ ৷ তাড়া নেই, কাল আমাদের ছুটি ৷

পরদিন সকালে সামনে ম্যাপ নিয়ে বসে আছি ৷ কিন্তু ম্যাপ দেখব কী, সবটাই খালি ও একরঙা ৷ শুধু একটি সরু রেখায় তিস্তা উত্তর-পূর্ব দিকে চলে গেছে, কিছু কিছু উপনদী এদিক ওদিক থেকে এসে তার সঙ্গে মিশেছে ৷ মধ্যে মধ্যে বিবিধ পর্বতশৃঙ্গের অবস্থান দেখাচ্ছে ছোট ছোট ত্রিভুজ ৷ একটি ভাঙা লাইন, দেখতে পাচ্ছি, তিস্তার পাশে পাশে চলে গিয়েছে ৷ এই পথ ধরে আমরা যাব, যেদিন যতদূর পারি ৷ নোরবু আমাদের গাইড, তার চেয়ে বড় গাইড তিস্তা নদী ৷ একটি ভয়, মাঝে মাঝে যে সব জলধারা গড়িয়ে এসে তিস্তায় মিশেছে যদি ভুল করে সেইরকম কোনও উপনদী ধরে এগিয়ে যাই তাহলে কোথায় গিয়ে পৌঁছব কে জানে ৷ পথে আমাদের ডানদিকে পড়বে চোম্বু ও তার প্রতিবেশী কিছু তুষারশৃঙ্গ ৷ সেগুলি থেকে একাধিক জলধারা নেমে আসছে ৷ আরও কিছু উত্তরে গিয়ে পাব কাংচেনজাউ, গুরুদোংমার ও অন্যান্যদের, যাদের ডানদিকে রেখে উত্তরে এগিয়ে যেতে হবে ৷ যদি বাঁদিক থেকে, অর্থাৎ তিস্তার পশ্চিমদিক থেকে নেমে আসা কোনও উপনদী ভুল করে অবলম্বন করি তাহলে চলে যাব জংসং তুষারশৃঙ্গের দিকে ৷ এই জনমানবশূন্য প্রান্তরে আসল তিস্তার গতিপথ নির্ধারণ করতে হবে বিবিধ পর্বতশৃঙ্গের অবস্থান বিবেচনা করে ৷ এইসব পাহাড়ের কাছ থেকে দেখা চেহারা হিমালয়ান জার্নালের পুরনো সংখ্যা ও মনি সেনের তোলা ফটোগ্রাফ দেখে দেখে অনেকটা পরিচিত হয়ে আছে ৷

একদিন বিশ্রামের পর থাঙ্গু থেকে রওনা হয়ে গেলাম ৷ দুচার মাইল এগিয়ে রাস্তার চিহ্ন অদৃশ্য ৷ গাছপালা শেষ হব হব ৷ কদাচিৎ কোনও জুনিপার, খর্বাকৃতি ৷ যে গাছ দুদিন আগে ৩০-৩৫ ফুট লম্বা দেখেছি তারা এখন কোমরের নিচে, তারপর হাঁটুর নিচে ৷ থাঙ্গুর পর বেশ খানিকটা চড়াই, প্রায় ১৫,০০০ ফুট উচ্চতার ওপর দিয়ে মন্থরগতিতে চলেছি ৷ পশ্চিমে, আমাদের বাঁদিকে তিস্তা, তার অপর পারে বিস্তৃত তৃণভূমি, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার লাইনে দেখা যায় জংসং পিক, লোহন পিক, নেপাল পিক, টেন্ট পিক ৷ কখনও দৃশ্যমান, কখনও আড়ালে অদৃশ্য ৷ পূর্বদিকে, অর্থাৎ আমাদের ডানদিকে চোম্বু ও তার আশপাশের সঙ্গীরা ৷ এদের অনেকটা কাছে এসে পড়েছি ৷ এক জায়গায় এসে চোম্বু আমাদের সামনে উন্মুক্ত হল ৷ খুব একটা উঁচু শৃঙ্গ নয়, ২১,০০০ ফুট মতো হবে, কিন্তু শিখর থেকে সোজা নেমে এসেছে একটি বরফের দেওয়াল ৷ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ৷ এর আরও কাছে যাওয়া যায় না? চোম্বু অঞ্চলের নিচে সেবু-লা গিরিবর্ত্ম, সেখান থেকে একটি জলের ধারা নেমে এসে তিস্তায় পড়েছে ৷ আমাদের অনুরোধে আসল পথ ছেড়ে নোরবু আমাদের সেবু-লার দিকে নিয়ে চলল ৷ খানিকদূর গিয়ে ভালো করে চোম্বুকে দেখে আবার ফিরে আসব ৷ কাছে গিয়ে চোম্বুর সোজা খাড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবাক হতে হয় মানুষ এই পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠবার চেষ্টা করেছে ভেবে ৷

চোম্বুর পাদদেশ থেকে ফিরে আবার তিস্তা ধরে উত্তরের পথ ৷ পাহাড়ি চড়াই উতরাই শেষ হয়ে এসেছে, এখন ঢেউ খেলানো রুক্ষ তৃণভূমি ৷ গাঢ় নীল মেঘশূন্য আকাশ, দুয়েকটি চিল উড়ছে, তিস্তার জলের আশপাশে দুয়েকটি বৃহদাকার তিব্বতি কাক ৷ হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে ৷ ঝকঝকে রোদ কিন্তু তাতে কোনও তাপ নেই ৷ ক্রমশ রোদ ম্লান হয়ে এল, আর বেশি অনগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় ৷ বড় একটা পাথরের আড়াল দেখে নোরবু আমাদের ছাউনি ফেলার জায়গা স্থির করল ৷ আমাদের সঙ্গে চারটি তাঁবু ৷ একটি শান্তি ঘোষের একলার, দ্বিতীয়টিতে পার্থ ও আমি ৷ তৃতীয়টি বড় ভারি মোটাকাপড়ের তাঁবু, সেটি সবকটি পোর্টারদের জন্য, চতুর্থটি রান্নাঘর ৷ শেষের দুটি তাঁবু ভাড়া করে আনা হয়েছে ৷ দক্ষ, ক্ষিপ্র হাতে পোর্টাররা চারটি তাঁবু খাড়া করে ফেলল, মালপত্র একপাশে সাজিয়ে রাখল ৷ তারপর রসদ বার করে ডিনারের ব্যবস্থা হতে লাগল ৷ পাসাং শেরপা রান্নাবান্না ভালো জানে, লাচেনে উত্তম খাসির মাংসের রোস্ট রেঁধে খাইয়েছে ৷ কিন্তু আজ আমাদের আহারে রুচির অভাব, উচ্চতার প্রভাব কিছু অনুভূত হচ্ছে ৷ আজ কোনও বাহুল্য নয় ৷ দুপুরে বিশুষ্ক কেক, টিনকেটে বার করা সসেজ সালামি ও আপেলের রস খেয়েছি ৷ এবেলা আমাদের মেনু হল মুগের ডাল দিয়ে খিচুড়ি, তাতে আলু ও পেঁয়াজ, ডিমসেদ্ধ ও একদলা মাখন ৷ শেষপাতে একখণ্ড চকোলেট ৷ রান্নার একটি সমস্যা এই যে এইবার বয়লিং পয়েন্ট খুব নেমে গিয়েছে, চাল ডাল ফুটছে তো ফুটছেই অথচ ঠিক সেদ্ধ হচ্ছে না ৷ দীর্ঘকাল ধরে ফোটানোর মতো অত আগুনই বা কোথায় পাব ৷ একটি প্রাইমাস স্টোভ, তাতে কেরোসিন তেল র্যাশন করা ৷ কাঠের বোঝা ঘাড়ে করে আনা হয়েছে, খুব হিসেব করে খরচ না করলে মুশকিলে পড়তে পারি ৷ কতদিন তাঁবুতে কাটাতে হবে কে জানে ৷ পোর্টারদের ব্যবস্থা অতি সংক্ষিপ্ত ৷ প্রধানত এইসব শেরপারা সোম্পা, অর্থাৎ যবের ছাতু, শুকনো মাংস এবং কড়া ধরনের তিব্বতি আচার খেয়ে থাকে ৷ তাছাড়া আমাদের স্টকের চাল, ডাল, গম সব নেবার খোলা অনুমতি দিয়ে রেখেছি ৷ দেখলাম, পাসাং চমৎকার হাতরুটি বানিয়ে ফেলছে ৷ যেন তন্দুরি নান ৷ গরম রুটির ওপর একচিলতে চিজ দিয়ে খেতে ভালোই লাগল ৷

আমাদের রাতের আহারাদি তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় হঠাৎ যেন অন্ধকার নামল ৷ বাতাসে ধূলিকনা নেই, বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই, সুতরাং কোনও গোধূলিস্নিগ্ধ সন্ধ্যাকাল নেই ৷ দিগন্তে সূর্যাস্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় কালো রাত্রি ৷ দেখতে দেখতে সারা আকাশময় তারায় ছেয়ে গেল ৷ মহালয়ার কিছু আগে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ৷ আকাশের চাঁদের এক অতি উজ্জ্বল ভগ্নাংশ ৷ বিজ বিজে তারায় পরিচিত রাশি ও নক্ষত্রমণ্ডলরা সব হারিয়ে গিয়েছে ৷ শুধু চিনতে পারছি কালপুরুষকে, আর তার নিকটবর্তী লুব্ধককে ৷ কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হল না, কনকনে শীত, উত্তরের হাওয়া ছুঁচের মতো মুখে চোখে ফুটে যাচ্ছে ৷ সত্বর সবাই যে যার তাঁবুর ভেতরে, আড়ষ্ট হাতে বুটজুতো খুলে ফেলে মাথার ঢাকনাসমেত উইন্ডচিটার গায়ে এবং ডবল মোজা পায়ে একেবারে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ৷ একটু পরে হাত পা গা গরম হয়ে এল, কিন্তু ঘুম আর আসে না ৷ পার্থ আর আমি পাশাপাশি শুয়ে আছি ৷ পার্থর নিচে দুখানা কম্বল, আমার নিচে হাওয়া-ভরা রবারের তোশক, তবু নিচে পাথর থেকে ঠান্ডা উঠে আসছে ৷ এপাশ ওপাশ করছি, পরস্পর দুয়েকটা কথা বলছি ৷ পাশের তাঁবু থেকে শান্তি ঘোষের কাশির শব্দ, হুঁহুঁ হাঁহাঁ শুনছি ৷ কিছু জাগরণে, কিছু ঘুমে, কিছু তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে আছি ৷ হাওয়ায় তাঁবু দুলছে, ফ্ল্যাপগুলো ফটফট করছে ৷ পোর্টারদের তাঁবু থেকে কিছুক্ষণ হাসি-গল্পের আওয়াজ পাচ্ছিলাম, এখন সব নিঃশব্দ ৷ ক্রমশ হাওয়া পড়ে এল, একবার টর্চ জ্বেলে হাতের ঘড়ি দেখলাম, তখনও রাত নটা বাজেনি ৷ তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে ৷

সকালে ঘুম ভাঙল পাসাংয়ের ডাকে ৷ তাঁবুর ফাঁক দিয়ে একখানা বলিষ্ঠ হাত গরম চায়ের মগ ধরে আছে ৷ স্লিপিং ব্যাগের জিপ ফাসটনার অর্ধেক নামিয়ে দিয়ে উঠে বসলাম, কৃতজ্ঞচিত্তে চায়ের মগ ধরে নিলাম ৷ আরেকটি মগ এল পার্থর জন্য ৷ দ্রুত কয়েকটি চুমুকে মগ শেষ ৷ গলায় আওয়াজ ফিরে এসেছে ৷ যুগ্ম গলায় গুডমর্নিং বলে শান্তিকে আহ্বান জানালাম, তার গলার হর্ষধ্বনি শুনলাম ৷ প্রাতঃসূর্যের আলো তাঁবুর কাপড়ে ফিল্টার হয়ে আমাদের গায়ে এসে পড়েছে ৷ আরেক মগ চা চাই ৷ স্লিপিং ব্যাগ পরিত্যাগ করে বাইরে বেরোবার জন্য জুতো পরতে গিয়ে দেখলাম সে দুটি শীতে জমে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে ৷ বুঝলাম, এর পরে জুতোজোড়াকে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে আশ্রয় দিতে হবে ৷ কষ্টেসৃষ্টে জুতো পরে বেরিয়ে এলাম, শান্তিও বেরিয়েছে ৷ পাশে পোর্টারদের তাঁবুতে কোলাহল, কেটলির পর কেটলি চা তৈরি হচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে ৷ আরও এক মগ চা খেয়ে আমরাও এই নতুন দিনটির জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম ৷ অনির্বচনীয় সকালের রোদ, কাছে দূরে গিরিশিখরে তুষারকে রৌপ্যমণ্ডিত করে রেখেছে, আশপাশের গৈরিক প্রান্তর আলোয় ভেসে যাচ্ছে ৷ এই সকাল এক মুহূর্তে গত রাতের জঞ্জালকে সরিয়ে নিয়ে গেল ৷ আবার আমরা তাজা, আবার সারাদিন হাঁটব ৷

প্রাতরাশ এল, এনামেলের বোলে গুঁড়ো দুধ দিয়ে তৈরি কোয়েকার ওটস-এর পরিজ, তার ওপর একখাবলা মার্মালেড ভাসানো, আর দুটি করে সেদ্ধ ডিম ৷ পাথরের ওপর বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি, পোর্টাররা তাদের নিজ নিজ খানা শেষ করে তাঁবু গোটাচ্ছে, স্লিপিং ব্যাগ ইত্যাদি প্যাক করে ফেলছে ৷ ঘুম থেকে ওঠার একঘণ্টার মধ্যে সব তৈরি, আমাদের দুপুরের পরোটা-লাঞ্চ সমেত ৷ যখন হাঁটতে শুরু করেছি তখন সাতটাও বাজেনি ৷ নোরবু বলেছে আজ দীর্ঘপথের যাত্রা ৷ গিয়াগং বলে একটি জায়গা, তার আগে সে আমাদের তাঁবু গাড়তে দেবে না ৷ গিয়াগং, শুনলাম, তিস্তার ধারে যাযাবরদের একটি অস্থায়ী আড্ডা ৷ এখানে দু-তিনটি পাথরের কুটির আছে ৷ এটি সিকিম-তিব্বত সীমান্তের অদূরে ৷ সীমান্ত বলে ম্যাপে একটি লাইন দেখানো আছে অবশ্যই, কিন্তু কে জানে কোনটা কোন দেশের সীমান্ত ৷ যেখানে এসে পড়েছি সেখানে জনমানবের কোনও চিহ্ন নেই, কোনওদিন ছিল না ৷ এখানে তিব্বতি মালভূমি সিকিমে প্রবেশ করেছে ৷ স্থানীয় উচ্চতা ১৪-১৫,০০০ ফুট থেকে ১৬-১৭,০০০ ফুট ঢেউ খেলানো প্রায় সমতল প্রান্তর উত্তরে বিস্তৃত হয়েছে ৷ গ্রীষ্মকালে যাযাবর তিব্বতিরা তাদের ভেড়া ও চমরিগাইয়ের পাল নিয়ে চলে আসে, থাংগু লাচেন পর্যন্ত চলে যায় ৷ পশু এবং পশুজাত পশম, রোম, চামড়া হচ্ছে তাদের একমাত্র পণ্যদ্রব্য ৷ এ লাইনে কার্পেট, গৃহশিল্পজাত রম্যবস্তু আসে না, সেসবের জন্য বাণিজ্যের লাইন ইয়াটুং জেলেপ লা নাথুলা গ্যাংটক কালিম্পং ৷ এই উত্তর সিকিমে যারা পশু চরাতে আসে তারা তিব্বতের রুক্ষতম ও দরিদ্রতম মানুষ ৷ এপ্রিলের শেষ ও মে মাসের প্রথমে যখন বরফ গলে যায়, তখন থেকে তারা আসতে আরম্ভ করে ৷ তবে এ অঞ্চলে বরফ খুব কম, দক্ষিণ ও পশ্চিম সিকিমের পাহাড় জঙ্গলে মৌসুমী বৃষ্টিপাত প্রায় সব শেষ হয়ে যায় ৷ বাতাসে আর্দ্রতা নেই ৷ গ্রীষ্মকালের আরম্ভ থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত এইসব যাযাবরদের যাওয়া আসা ৷ এদের সংখ্যা অতি নগণ্য ৷ এক তো তিব্বত একটি বিরাট জনশূন্য দেশ, তার ওপর সিকিমের সংলগ্ন অঞ্চলে তাদের পৃথিবী তৃণহীন, পাথুরে অত্যুচ্চ মালভূমি, খোলা, বর্বর হাওয়ার রাজত্ব ৷ যাইহোক, কিছু লোক আসে আবার ফিরে যায় ৷

এইরকম একটি দলের সঙ্গে দুপুরবেলা নাগাদ আমাদের দেখা হয়ে গেল ৷ দশ-বারো জন বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ, পাচ-ছটি ছেলেমেয়ে, দু-তিনটি স্ত্রীলোকের পিঠে বাঁধা শিশুদের বাদ দিয়ে ৷ শখানেক ভেড়া, ১৭-১৮টি চমরিগাই ৷ মেয়েগুলির একমাথা অবিন্যস্ত রাক্ষসীর মতো চুল, কিন্তু মুখ রাঙা আপেলের মতো ৷ কিশোর দুয়েকটি ছেলের নরম ও সরস মুখমণ্ডল, কিন্তু বয়স্ক পুরুষগুলি পোশাকে ও আকারে প্রকারে রাক্ষুসে ডাকাতদের মতো ৷ তবু, সামনাসামনি এসে পড়লে তাদের রেখাবহুল মুখ খোলা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, জিভ বার করে তাদের সাবেক রীতিতে অভিবাদন করে ৷ ভাষা জানি না, কথা বলবার উপায় নেই ৷ আমাদের সঙ্গী শেরপারাও আসলে তিব্বতি, কিন্তু তাদের ভাষা গোর্খালির সঙ্গে মিশে অনেক বদলে গেছে ৷ জানলাম তারা থাংগু পর্যন্ত নামবে, হয়তো লাচেন ৷ মাসখানেকের মধ্যে তাদের ফিরতে হবে ৷ সিগারেট দিলাম, পেয়ে মেয়েপুরুষ সবাই খুব খুশি ৷ এই একটি জিনিস যা দিয়ে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় মানুষকে খুশি করা যায় ৷

তিব্বতিরা খুশি, ভেড়াগুলিও পথ ছেড়ে দিচ্ছে কিন্তু পর্বতাকার ইয়াকগুলির মেজাজ সম্বন্ধে সন্দেহ হয় ৷ আর সবচেয়ে খারাপ হল ভেড়ার প্রহরাদার আপসু কুকুরগুলো ৷ বন্য ও কুৎসিত দর্শন ৷ তাদের সামলে রাখতে হয়েছে, প্রান্তর কাঁপিয়ে তারা সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে ৷

উত্তর-পশ্চিমে চোমিওমো দেখা যাচ্ছিল, ক্রমশ তার অনেক কাছে এসে পড়লাম ৷ যেন একটি হমবুর্গ হ্যাটের মতো দাঁড়িয়ে আছে ৷ তার নিম্নাঙ্গ মেরুন-ব্রাউন, মাথায় বরফের প্রলেপ ৷ এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২,৫০০ ফুট মতো ৷ আমরা দেখছি ১৬-১৭,০০০ ফুট থেকে, ম্যাপের হিসেবে দূরত্ব হবে হয়তো ৭-৮ মাইল ৷ কিন্তু অতি বিশুদ্ধ, স্বচ্ছ আবহাওয়ায় দেখাচ্ছে যেন অতি নিকটে এসে গিয়েছে ৷ যেন দেওঘরের নন্দন পাহাড়, এক দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়া যায় ৷ আপাতদৃষ্টিতে অতি স্নিগ্ধ রেখায় এর নরম চড়াই শিখরের মালভূমিতে পৌঁছে গিয়েছে ৷ সুশ্রী এই পাহাড়ে চড়বার আকর্ষণ উপেক্ষা করা মুশকিল ৷ পাশ দিয়ে দিয়ে চলেছি, পাহাড়ের রূপ ও রং বদলাচ্ছে, আর ভাবছি প্ল্যান বদলে এই পাহাড়ের শিখরে পৌঁছবার চেষ্টা করলে কেমন হয় ৷ আমাদের বর্ণনা শুনে ও বিবিধ কোণ থেকে তোলা ছবি দেখে পরের বছর মে মাসে আমার সহকর্মী কৃষ্ণমূর্তি চোমিয়োমোর শিখরে চড়বার চেষ্টা করেছিল ৷ আগেই লিখেছি তার সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি ৷ পাহাড়ের গায়ে অনেকটা চড়বার পর একটা বরফের ঝড়ের মধ্যে পড়ে নেমে আসতে বাধ্য হয় ৷

ক্রমশ আমাদের পূর্ব-দক্ষিণে আরও সব অপূর্ব তুষারশৃঙ্গের উত্তর মুখ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে ৷ এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাংচেনজাউ ৷ এটিও ২২,৫০০ ফুটের কিছু ঊর্ধ্বে ৷ দার্জিলিংয়ের অবজারভেটরি থেকে দৃশ্যমান তুষার লাইনের দক্ষিণদিকে প্রায় শেষ বরাবর কাংচেনজাউয়ের দক্ষিণ মুখ ঈষৎ দেখতে পাওয়া যায়, সোজা দৃষ্টিপথে ৭০ মাইল দূরে ৷ সেইরকম দেখা যায় চোমিয়োমোকে এবং পাউহুনরিদের ৷ টেলিস্কোপে বা শক্তিমান বাইনোকুলার দিয়ে না দেখলে এদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বোঝা মুশকিল ৷ আর এখন আমরা এদের উল্টোদিক, তিব্বতের দিকে ফেরানো মুখগুলো দেখতে দেখতে চলেছি ৷ একপাশে চোমিয়োমো, অপর পাশে কাংচেনজাউ, গুরুদোংমার এবং অন্যান্য, মাপে না দেখানো মাঝারি উচ্চতার চূড়া, সব কিছু বরফে আবৃত, গায়ে গায়ে স্থাপিত হিমবাহের নেমে আসা নিশ্চল নদী ৷ মধ্যে প্রান্তরে শিথিলস্রোতা তিস্তার এপাশে ওপাশে আমরা হেঁটে চলেছি ৷ মাথার ওপর দিগন্তবিস্তৃত ঘননীল আকাশ অপরাহ্নের আলোয় অলৌকিক হয়ে আছে, সামনের গৈরিক প্রান্তরকে আলোয় বিধৌত করে রেখেছে ৷ আর যত উত্তর-পূর্বে চলেছি, কাংচেনজাউয়ের পিছন থেকে গুরুদোংমার উন্মুক্ত হয়ে আসছে, এখন এই যুগ্মশৃঙ্গের দুটিকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ৷ কত কাছে, রোলিফ্লেক্সে সাধারণ লেন্স লাগানো, কিন্তু তার ভিউফাইন্ডার স্ক্রীনের সবটা জুড়ে আছে কাংচেনজাউ ৷

অন্ধকার নেমে আসবার কিছু পূর্বে আমরা গিয়াগং পৌঁছে গেলাম ৷ নিস্তব্ধ, জনহীন প্রান্তরে কয়েকটি শূন্য পাথরের কুটির ৷ চারখানা দেওয়ালের ওপর কাঠের পাটাতন, তার ওপর পাথর চাপানো, যাতে ঝড়ে না উড়ে যায় ৷ কিন্তু ঝড়ে উড়ে যায়ই, দুটি কুটিরের ছাদ নেই, আশপাশে কাঠ, পাথর পড়ে আছে ৷ যে যাযাবর দলটিকে আমরা পথে পেয়েছি তারা গত রাতে এখানে আস্তানা নিয়েছিল ৷ কয়েকটি আগুন জ্বালানোর চিহ্ন, মানুষ ও পশুদের দেহনিঃসৃত আবর্জনা, একগাছা চমরিগাইয়ের লোমে বোনা দড়ি ৷ তাঁবু খাটানোর খোটা পোঁতবার গর্ত ৷ এরা চমরির লোমের তৈরি তাঁবু নিয়ে পরিভ্রমণ করে ৷ এই কুটীরগুলি থেকে কিছুদূরে আমাদের শিবির স্থাপিত হল ৷ প্রথমে চা বিস্কুট, তার অল্প পরেই আধসেদ্ধ খিচুড়ি, গুঁড়োদুধ দিয়ে তৈরি চিঁড়ের পায়েস ও পিণ্ডিখেজুর দিয়ে ডিনার ৷ রাতের অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র শীত ও ঝোড়ো হাওয়ার তাড়না ৷ আমাদের সৌভাগ্য, এখন অক্টোবর মাস, আকাশ মেঘমুক্ত, তুষারপাতের কোনও সম্ভাবনা নেই ৷ আজ বুটজুতো খুলে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়েছি ৷ বিনিদ্র মস্তিষ্কে ফেলে আসা সমাজ ও সংসারের আসাযাওয়া ৷ তারপর ঘুমের নৈঃশব্দে এই অপ্রাকৃত জগতের সঙ্গে একাকার হয়ে গেলাম ৷

পরদিন সকালে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আমরা জবাকুসুমসন্নিভ সূর্যের আলোয় আলোকিত কাংচেনজাউ ও গুরুদোংমারদের সামনা সামনি ৷ স্তব্ধ ও হতবাক বসে আছি ৷ ক্রমশ সূর্য উজ্জ্বলতর হল ৷ এবার প্রস্তুত হতে হয় ৷ পরবর্তী ক্যাম্পিংয়ের জায়গা ডংকুং, সেটিও যাযাবরদের বিশ্রামস্থান ৷ খুব দূরে নয়, যদিও আমাদের গতি ক্রমশ আরও মন্থর হয়ে আসছে, তবু এখনও সমান প্রান্তর দিয়ে চলেছি, চড়াই-উতরাইয়ের কষ্ট নেই ৷ আজ আমরা একটু অন্যপথ ধরে উত্তরমুখে তিস্তার একটি উপনদী অবলম্বন করে গ্যামসোনা হ্রদ দেখব ৷ এটি চোমিয়োমোর পাদদেশে ৷ ঘণ্টাদুয়েক হাঁটার পর গ্যামসোনায় পৌঁছে গেলাম ৷ শান্ত রুপোলি পাতের মতো পড়ে আছে, চোমিয়োমো প্রতিফলিত ৷ এমন জায়গায় তাঁবু ফেলে এক বা একাধিকদিন কাটাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমাদের সময় কম এবং লক্ষ্যবস্তু আরও অনেক পুবদিকে অন্য একটি হ্রদে, যেখান থেকে তিস্তার উৎপত্তি হয়েছে ৷ গ্যামসোনায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার তিস্তা ধরলাম, ক্রমশ এসে পৌঁছে গেলাম ডংকুংয়ে ৷ সেখানেও কয়েকটি পাথরের কুটির, কিছু বৌদ্ধ স্তূপ, উঁচু খোঁটায় বাঁধা মন্ত্রলেখা কাপড়ের টুকরো ৷ ডাংকুংয়ে দেখলাম একদল যাযাবর ও তাদের একপাল ভেড়া ৷ আমাদের দেখে এদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল, একপাল শিশু এসে আমাদের ঘিরে ফেলল ৷ মনে হল, যেন লোকালয়ে এসে পৌঁছে গেছি ৷ কম্বলের তাঁবু, কম্বলের জামা পরিহিত স্ত্রী, পুরুষ ও শিশু, চমরি আর ভেড়ার পাল নিয়ে ব্যস্ত ৷ ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তামার পাত্র নিয়ে ভেড়ার দুধ দোয়াচ্ছে, বিশুষ্ক যবগাছের খড় অথবা রোদে জ্বলে যাওয়া তৃণ খাওয়াচ্ছে, ভেড়াদের পিছনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে ৷ হাসি, খেলা, কলরব ৷ স্ত্রীলোকেরা গোল হয়ে বসে কাঠের বড় হামানদিস্তায় শস্য গুঁড়ো করছে, কেউ বা গোলাকার কুলোয় শস্য ঝেড়ে পরিষ্কার করছে ৷ পুরুষরা প্রধানত চমরিদের পিছনে ৷ এরা হয়তো আরও দুয়েকদিন এই শিবিরে অবস্থান করবে ৷ জানলাম, এরা তিব্বতে ফেরবার মুখে ৷

খানিকটা দূরে গিয়ে আমাদের তাঁবু পড়ল, সেখান থেকে তিব্বতিদের দেখা যায় না ৷ অদূরে তিস্তার শান্ত জলধারা অস্তগামী সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে ৷ সামনে তুষারশৃঙ্গের সারি, পুবদিকের দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ৷

পরদিন আমাদের লক্ষ্য গুরুদোংমার হ্রদ, ওই নামের পর্বতশৃঙ্গের ঠিক নিচে ৷ সেই হ্রদের কোলে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন দিবা দ্বিপ্রহর ৷ খানিকটা চড়াই ভাঙতে হয়েছে, উচ্চাবচ পাথুরে জমিতে ছড়ানো ছোটবড় নানারকম বোল্ডারের মধ্য দিয়ে পথ খুঁজে অগ্রসর হয়েছি ৷ এসব পাথর কাংচেনজাউ ও গুরুদোংমার পাহাড়ের অংশ ৷ বহুকাল পূর্বে তুষার যুগ যখন শেষ হয় তখন বিশাল সব হিমবাহের সঙ্গে পাহাড় ভেঙে নেমে আসে ৷ এইসব বিক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ড তারই অবশিষ্ট, কয়েক যুগের সূর্যরশ্মি, ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিপাতের ফলে তারা বহুধাবিভক্ত ৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা অথবা এভারেস্ট অঞ্চলে, যেখানে হিমবাহের চাপ আরও অনেকগুণ বেশি ছিল, সেখানে এইরকম ভাঙা পাথরের (যাকে moraine বলে) মহানদী নেমে এসেছে ৷ এদের অতিক্রম করে তুষারশৃঙ্গের সানুদেশে পৌঁছনো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার ৷

গোরুদোংমার হ্রদের প্রান্তে এসে আমরা এক স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করেছি ৷ এতদিন যা দেখেছি, এমনকী গ্যামসোনা হ্রদেও যা দেখেছি, এর কাছে সেসব কিছুই নয় ৷ প্রায় ১৭,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদের বিস্তৃতি হয়তো ৫-৬ বর্গ মাইল হবে ৷ মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ, নিচে সামনে হ্রদের জল সবুজে নীলে ধাতব কোবাল্ট ৷ এখন কোনও ঝোড়ো হাওয়া নেই, হ্রদের ধারে ধারে ঈষৎ ভাঙা ভাঙা ঢেউ ৷ আর মধ্যের স্থির জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে রয়েছে যুগ্ম শৃঙ্গ গুরুদোংমার, কাংচেনজাউ ও উভয়ের মধ্যে একটি সুউচ্চ তুষারের সেতুবন্ধনী ৷ চোখ ফেরানো যায় না ৷ আজ আর অন্যত্র কোথাও নয়, এইখানেই তাঁবু ৷ বাকি সারাদিন ধরে এই হ্রদের ধারে ধারে বিভিন্ন দিক থেকে দেখবার পরম সৌভাগ্য হল ৷ জানি না আর কোথাও এরকম আছে কিনা ৷ মানসসরোবরে যাবার সুযোগ হয়নি, তবে সেখানে শুধু কৈলাস ও গুরলামান্ধাতা, এখানে সারে সারে আরও বিচিত্র সব তুষারশৃঙ্গ ৷ সুইজারল্যান্ডে অনেক লেক ও বরফের পাহাড় দেখেছি, সেসব খুবই মনোহর ও মিষ্টি, দেখে এখানকার মতো হৃৎপিণ্ড স্থির হয়ে যায় না ৷

পরদিন প্রাতঃকালে এই হ্রদটিকে শেষবার দেখে আবার তিস্তার কোলে নেমে এলাম এবং আবার উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হলাম ৷ আজই আমরা ছো-লামো হ্রদে গিয়ে পৌঁছব, যেখান থেকে তিস্তা নদীর উৎপত্তি হয়েছে ৷ যত এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের দক্ষিণে গুরুদোংমার ও কাংচেনজাউয়ে দৃশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে ৷ চোমিয়োমো পিছনে পড়ে আছে ৷ সামনে ক্রমশ উঠে আসছে আরও কয়েকটি শৃঙ্গ, পাউহুনরি ১, ২ ও ৩, কোনাকৃতি সরু পিরামিড আকাশে উঠে গিয়েছে ৷ ১ নম্বরের উচ্চতা ২৩,৪০০ ফুট মতো, অপরদুটি তার কাছাকাছি ৷ এমন সটান খাড়াই যে শৃঙ্গে ও গায়ে খুব একটা বরফ ধরে রাখতে পারেনি ৷ নগ্ন পাথরের দেওয়াল অনেকাংশে দৃশ্যমান ৷ পাউহুনরির গা থেকে বড় একটি গ্লেসিয়ার নেমে এসেছে, তার প্রান্তে একটি বৃহদাকার হ্রদ, নাম ছো-লামো ৷ এইটি আমাদের আজকের লক্ষ্যস্থল ৷ যত এর নিকটবর্তী হচ্ছি তত বিক্ষিপ্ত পাথরের moraine ঘনতর হচ্ছে ৷ এবার আমরা তিব্বতি মালভূমি ছেড়ে পার্বত্য বন্ধুরতার মধ্যে প্রবেশ করেছি ৷ যে সহজ গতিতে গত তিনদিন আমরা মালভূমি অতিক্রম করে এসেছি তা আর সম্ভব নয় ৷ উচ্চতাও বাড়ছে, ১৭,০০০ ফুটের ওপর দিয়ে চলেছি ৷ অসমান পাথর, ওঠা আর নামা ৷ মুখ বুজে চলেছি, ক্লান্ত মন্থর পদক্ষেপে ৷ তবু একসময় আমাদের আজকের পর্যটন শেষ হল ৷ এবার আমরা ছো-লামো হ্রদের সামনে ৷ যে তিস্তা অবলম্বন করে আমরা এতদূরে এসে পৌঁছেছি, সেই তিস্তার শেষ এইখানে ৷ ছো-লামো হ্রদের একটি প্রান্ত সরু হয়ে বেরিয়ে গেছে, সেইটিই তিস্তা ৷ যে হিমবাহ থেকে ছো-লামো হ্রদের জন্ম, তার নাম দিস্তা-খাংসে ৷

ছো-লামো হ্রদও, গুরুদোংমার হ্রদের মতো, অপার্থিব সৌন্দর্যের আধার ৷ এটি আকারে লম্বা মতো, আরও বড়, যেন আরও নীল-সবুজ ৷ যেদিকে আমরা দাঁড়িয়ে তার অপরদিকে কোনও উঁচু নামকরা তুষারশৃঙ্গ নেই, পাউহুনরির প্রতিবিম্ব এখানে আমরা পাচ্ছি না ৷ ওপারে শুধু বরফে ঢাকা উঁচু জমি গড়িয়ে গেছে ৷ অবসন্ন দেহে তিস্তার উৎপত্তিস্থলে আমরা পাথরের ওপর বসে আছি ৷ শেষ অপরাহ্নের আলোয় চতুর্দিক মহিমময়, ছো-লামোর জল কালো হয়ে আসছে ৷ বাতাসে তীব্রতা, হ্রদের জলে ছোট ছোট ঢেউ ৷ সন্ধের শীত নামছে, হ্রদের কিনারায় এসে ঢেউ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে জল জমে যাচ্ছে ৷ দেখতে দেখতে সবুজ কালো হ্রদের কিনারায় চওড়া সাদা পাড় এসে জমল ৷

ইতিমধ্যে শেরপারা অনতিদূরে বড় বড় পাথরের আড়ালে তাঁবু তুলে ফেলেছে ৷ মাথার টুপি ভালো করে এঁটে আমরা সেইদিকে অগ্রসর হলাম ৷

ছো-লামোর তীরবর্তী তাঁবুর মধ্যে স্লিপিং ব্যাগের অন্দরে আমরা শয্যাশায়ী ৷ শীতে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে ৷ যে ধরনের খাদ্য খেয়ে কদিন কাটছে তার কথা আর বলবার না ৷ রোজই শুয়ে শুয়ে পরস্পর হাহুতাশ করি কেন মরতে এসেছিলাম, আর তো সহ্য হয় না ৷ এইসব বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি ৷ পরদিন সকালে তাঁবু থেকে বেরিয়ে অন্য মানুষ ৷ আদি দেবতা সূর্যের আশীর্বাদে দেহমনের নবজন্ম হয় ৷

ছো-লামোর ক্যাম্প তুলে ফেলা হয়েছে ৷ হ্রদের পাশ দিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ যাবার পর পাথর ছড়ানো চড়াইয়ের মধ্যে রাস্তা খুঁজে আমরা ক্রমশ পাউহুনরির গায়ে উঠছি ৷ আজকের পথ বড়ই কঠিন ৷ ডংখিয়ালা নামক ১৮,৫০০ ফুট উঁচু গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে পাউহুনরির দক্ষিণ গাত্র বেয়ে নেমে যাব ৷ নোরবু সর্দার দেখিয়ে দিচ্ছে পাউহুনরি এবং তার সঙ্গে সংলগ্ন আরেকটি বরফের পাহাড়ের মধ্যে এক জায়গায় একটি খাঁজ, সেইটি ডংখিয়ালা ৷ সবটা বরফে আচ্ছাদিত, সাদা ৷ সেই বরফের চাদর নেমে এসে নিকটবর্তী এক জায়গা পর্যন্ত পৌঁছেছে ৷ আরেকটু পরেই আমাদের বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে চড়াই ভাঙতে হবে ৷ অতি মন্থর গতিতে চলেছি ৷ নোরবুর মুখ গম্ভীর, পশ্চিম আকাশে এক খণ্ড মেঘ আকৃতিতে বাড়ছে ৷ কপাল কুঁচকে তার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে এবং আমাদের পর্বতারোহণে উৎসাহ দিচ্ছে ৷ ডংখিয়া লা এখনও অনেক দূরে, সেখানে পৌঁছতে আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে ৷ এখন সকাল দশটা, যদি বারোটা নাগাদ এই গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করতে পারি তাহলে বেলা চারটে নাগাদ মোমে-সামডং নামক একটি ভালো জায়গায় গিয়ে আজকের তাঁবু বসাতে পারি ৷

স্থির পদক্ষেপে উঠছি তো উঠছি ৷ কখনও সখনও রুকস্যাক নামিয়ে রেখে দু-পাঁচ মিনিটের বিশ্রাম, ফ্লাস্ক থেকে এক চুমুক কফি, একখণ্ড চকোলেট ৷ পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি ছো-লামো হ্রদ অনেক নিচে নীল সবুজ একটি মাঠের মতো পাতা রয়েছে ৷ পায়ের নিচে মুড়মুড় করে বরফ ভাঙছে ৷ বাঁদিকে পাউহুনরির গা থেকে নামা দিস্তা-খাংসে হিমবাহ, ডানদিকে বরফে ছাওয়া নানা উচ্চতার পাহাড়, একটু দূরে গুরুদোংমার ও কাংচেনজাউ ৷ পিছনে, অনেক নিচে, সেই ঢেউখেলানো গেরুয়া রঙের তিব্বতি প্রান্তর যার মধ্য দিয়ে তিস্তার রুপোলি ফিতে চলে গিয়েছে ৷

কে জানে কতটা উঁচুতে উঠেছি ৷ প্রতি পদক্ষেপে উচ্চতার প্রভাব বুঝতে পারছি ৷ আমাদের তিনজনের প্রত্যেকের মুখে একটু আশঙ্কার একটু কষ্টের ছাপ ৷ এক সময় মেঘ মধ্যাকাশে উঠে সূর্যকে আচ্ছন্ন করল, ত্রূর হাওয়ায় নাক কান ঠোঁট কেটে নিচ্ছে ৷ যদি ঝড় শুরু হয় তাহলে কোথায় আশ্রয় নেব? চলেছি তো চলেইছি ৷ দেখছি যে জোয়ান শেরপারা অনেকখানি এগিয়ে গেছে ৷ নোরবু আমাদের সামনে, তাকেই অনুসরণ করছি ৷ আমাদের পিছনে আরও কয়েকজন শেরপা ৷ এক জায়গায় এসে নোরবু দেখাল, ওই ডংখিয়ালা ৷ অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়ে দেখলাম, নাগালের মধ্যে এসে পড়েছি ৷ শুধু তাই নয়, আমরা এখন ডংখিয়ালা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে ৷ বাকি পথটার অধিকাংশ আমাদের নেমে যেতে হবে, তারপর শেষটায়, ১০০ গজ মতো দূরত্ব থেকে খাড়া চড়াই ৷ একটু বিশ্রাম ৷ আমাদের সৌভাগ্য, যে মেঘ আকাশে জমছিল তা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, আবার মুক্ত সূর্যালোক পেয়েছি ৷ চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখছি উত্তরে নিঃসীম শূন্যতা ৷ পূর্বে পাউহুনরির গায়ে আমাদের দৃষ্টি আটকানো, পশ্চিমে ঢেউখেলানো প্রোফাইলে বিবিধ হিমগিরির লাইন সুদূর কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে রয়েছে ৷ আর দক্ষিণে, আমাদের সামনে ডংখিয়ালার দেওয়াল ৷

অনেক নিচে, আমাদেরই চলে আসা পথে দেখতে পেলাম একসারি চলমান প্রাণী ৷ কয়েকটি তিব্বতি যাযাবর ও তাদের পাঁচ-ছটি ইয়াক ৷ মনে হল, আমাদের ডবল গতিতে তারা পর্বতারোহণ করছে ৷

এবার নামছি সন্তর্পণে, নুড়ি এড়িয়ে পা ফেলতে হচ্ছে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে এমন জায়গায় এলাম যেখান থেকে খাড়া চড়াই ৷ ওপরে তাকিয়ে দেখি তিন-চারটি শেরপা গিরিবর্ত্মের ওপর, তাদের বোঝা নামিয়ে রেখে মহা উৎসাহে আমাদের ডাকাডাকি করছে ৷ ক্রমে, বরফের মধ্যে পূর্বগামীদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এই শেষ অতি কষ্টসাধ্য চড়াই অতিক্রম করে আমরা ডংখিয়া-লার গিরিদ্বারে পদার্পণ করলাম ৷ এখানে একটুখানি বরফের আস্তরে ঢাকা সমতল ৷ প্রথমেই নোরবু তার ঝোলা থেকে একমুঠো চাল সংগ্রহ করে কী কী মন্তর পড়তে পড়তে চতুর্দিকে ছিটিয়ে দিল ৷ তথাগতর কল্যাণদৃষ্টি আমাদের সকলের ওপর থাকুক, ভূত-প্রেত-পিশাচ সব দূরীভূত হোক ৷ এখানেও ছোট ছোট নুড়ির স্তূপ, তাতে আমরাও প্রস্তরখণ্ড যোজনা করলাম, মন্ত্রপূত কাপড়ের টুকরো একটি খোঁটায় বেঁধে দিলাম ৷ তারপর নোরবু একটি ওয়াটারপ্রুফ ক্যানভাস পেতে দিতে সবাই বসলাম ৷ ঘড়িতে দেখলাম সবে দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হয়েছে, ঠিক সময়ে আমরা এসে পৌঁছেছি ৷ আমাদের মুখে বিজয়ীর হাসি ৷ মাথা থেকে টুপি ও চোখ থেকে গগলস নামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ডংখিয়ার আলোবাতাস উপভোগ করছি ৷ এবার কফি ব্রেক ৷ যার ফ্লাস্কে যতটুকু কফি ছিল সব ঢেলে সবাই ভাগ করে নিলাম ৷ তার সঙ্গে চিনাবাদাম, আখরোট ও চকোলেট ৷ শান্তির চোখ চকচক করছে ৷ বলল, একটা জিনিসের অভাব বড়ই বোধ করছি ৷ আমি বললাম, জানি, শ্যাম্পেন ৷ পার্থ চেঁচিয়ে একলাইন গান গাইবার চেষ্টা করল-আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ ৷

কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকবার উপায় নেই ৷ শনশনে বাতাস এবার বাড়ছে, আশ্রয় নেবার মতো কোনও পাথরের আড়াল নেই ৷ শেরপারাও সব যে-যার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে নেমে যাবার জন্য উৎসুক ৷

এবার সোজা খাড়াই উত্তরণ ৷ ডংখিয়ালার এই দক্ষিণগাত্র একেবারেই বরফমুক্ত এবং বিপজ্জনকভাবে নুড়ি ছড়ানো ৷ এখন হৃৎপিণ্ড বেঁচে যাচ্ছে, কিন্তু হাঁটু দুটো গেল ৷ খটাস করে লাগছে, দুমড়ে যাচ্ছে, মুচড়ে যাচ্ছে ৷ নামছি, নামছি, নামছি ৷ একসময় ওপর থেকে দুড়দাড় শব্দ ৷ পিছনে তাকিয়ে দেখি সেই ইয়াকগুলো নামছে ৷ একেকটি যমদূতের মতো, যেন ঘাড়ে এসে পড়ল ৷ আমরা এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে তাদের পথ করে দিলাম ৷ এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো ইয়াকের সারি এবং তাদের পিছনে তিব্বতিগুলো আমাদের পেরিয়ে চলে গেল ৷ অবাক হতে হয়, কী শক্তিমান এই পশু ও মানুষগুলো ৷

আমরা আমাদের নিজস্ব গতিতে নেমে চলেছি ৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বোধহয় দু-আড়াই হাজার ফুট নেমে এলাম ৷ এবার পাহাড়ের গা আবার শ্যামল, আবার গাছগাছালি, পাখি ও পাহাড়ি ঝরনার কলস্বর ৷ হাঁটু আর বইছে না, ক্ষুধায় জঠর জ্বলে যাচ্ছে, এবার আমাদের লাঞ্চ চাই ৷ একটি ঝরনার ধারে পাথরের আড়ালে বসে আমাদের খানার পোঁটলাপুঁটলি খোলা হল ৷ যা পেলাম গোগ্রাসে খেলাম, এক বোতল করে বিস্বাদ ফোটানো জল ৷ আগুন জ্বেলে কফি তৈরি হল প্রত্যেকের জন্য একেক মগ ৷ আর তাড়াহুড়ো নেই, হাঁপধরা চড়াই নেই ৷ ধীরে, ভদ্রলোকের মতো চললেও সন্ধের অনেক পূর্বে আমরা মোমে-সামডং পৌঁছে যাব, সেখানে আজ রাতের ক্যাম্প ৷

এই পথে আমাদের সঙ্গী ও গাইড হচ্ছে লা-চুং নদী ৷ পাউহুনরির দক্ষিণদিকে এবং সিকিমের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত বিবিধ পর্বতশৃঙ্গের গ্লেসিয়ার গলা জল বহন করে চলেছে, শেষে গিয়ে মিশেছে চুং-থাং নামক গ্রামে লা-চেন নদীর সঙ্গে ৷ এর কথা আগেই বলেছি ৷ আমরা লা-চেন অর্থাৎ তিস্তাকে অবলম্বন করে সিকিমের উত্তরপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছিলাম, এখন লা-চুং অবলম্বন করে নামছি এবং চুং-থাংয়ের দিকে ফিরে যাচ্ছি ৷ মোমে-সামডং একটি বড় জংশন ৷ এখানে চোম্বু ও অন্যান্য হিমবাহের পূর্বদিকে গড়ানো জল লা-চুং নদীতে এসে পড়ছে ৷ একটি পথে আছে যেটা দিয়ে মোমে-সামডং থেকে সেবু-লা গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে পশ্চিমে থাঙ্গুতে গিয়ে পৌঁছনো যায় ৷ থাঙ্গু ও চোম্বু গিরিশৃঙ্গের কথা আগেই লিখেছি ৷

মোমে-সামডংয়ে ঠিকঠাক এসে পৌঁছলাম ৷ এই জায়গাটির উচ্চতা হল ১৪,০০০ ফুট মতো ৷ এখানে একসময়ে আলপাইন ক্লাব দ্বারা একটি কাঠের কুটির নির্মিত হয়েছিল ৷ তার ধ্বংসাবশেষ দেখলাম ৷ নিকটবর্তী এক জায়গায় আমাদের তাঁবু পড়ল ৷ অতি মনোহর এই জায়গা ৷ পাহাড়ের গা কিয়দংশ তৃণাচ্ছাদিত, অধিকাংশ মেরুন ও গেরুয়া, তামা, লৌহ ও দস্তার মিশ্রণে এই রং ৷ পর্যবেক্ষণ ও জরিপ হয়েছিল একসময়ে, কিন্তু যতদূর জানি এখান থেকে এইসব খনিজ উদ্ধার করা অথবা কারখানা বসানোর চেষ্টা করা হয়নি ৷

এই মেরুন অববাহিকা দিয়ে সেবু-ছু নদীর ক্ষীণ জলধারা গড়িয়ে এসেছে, তারই কোলে আমাদের ক্যাম্প ও রাত্রিবাস ৷ সন্ধের অন্ধকার নামবার পূর্বে আমরা ইতস্তত খানিকটা পরিভ্রমণ করলাম ৷ সেবু-ছু ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলে দূর থেকে চোম্বুকে দেখা যায় ৷ পাহাড়ের গা দিয়ে খানিকটা উঠলে দেখা যায় উত্তরে কাংচেনজাউয়ের শীর্ষ ৷ আর পূর্বদিকে লা-চুং নদীর অপরপারে সিকিমের পূর্ব সীমান্ত প্রহরাদার হিমগিরির লাইন ৷

এখানে তাঁবুতে রাত্রিবাস আর কষ্টকর নয়, অন্তত অতটা কষ্টকর নয় ৷ তিব্বতি প্রান্তরের নিষ্করুণ ঝোড়ো হাওয়া থেকে মধ্য সিকিমের পাহাড়গুলো আমাদের আড়াল করে রেখেছে ৷ মনে আশঙ্কা নেই, আর ডংখিয়ালা অতিক্রম করতে হবে না ৷ এবং এটিই আমাদের শেষ তাঁবু ৷ কাল, যদি কোনও দুর্যোগ এসে উপস্থিত না হয়, তাহলে আমরা ১১,০০০ ফুট উচ্চে অবস্থিত ইয়ুমথাং বাংলোয় পৌঁছে যাব ৷

পরদিন লা-চুং নদীর অববাহিকা ধরে অগ্রসর হলাম ৷ এখান থেকে একটি ভাঙাচোরা পায়ে চলার পথ পেয়ে গেছি ৷ ক্রমশ গাছপালা বড় হচ্ছে ৷ লা-চুংয়ের অববাহিকা এখানে খুব চওড়া অপর পারে বড় বড় কোনাকৃতি গাছের জঙ্গল ৷ এই রমণীয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বিকেল নাগাদ ইয়ুমথাং বাংলো দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হল ৷ এবারে আবার লোকালয়, পাথরের অথবা কাঠের বাড়িঘর, খেতখামার গরু-ছাগল দেখা যাচ্ছে ৷ মাঠে কর্মরত পুরুষ, পিঠে ঝুড়িবাঁধা মেয়েরা, ক্রীড়ারত শিশুরা, আবার সব ফিরে এসেছে ৷ নদীতে, পাহাড়ে, গাছপালায়, আশপাশের নরম অনুচ্চ তুষারশৃঙ্গে লা-চুং উপত্যকা ঠিক সুইজারল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের মতো ৷ তফাত এই যে এখানকার উচ্চতা ১১,০০০ ফুট, যে উচ্চতায় সুইজারল্যান্ড চিরস্থায়ী বরফে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে ৷ তাছাড়া এখানে মোটর চলাচলের মসৃণ পিচঢাকা পথ নেই, চমকপ্রদ কটেজ ও ভিলেজ ছড়াছড়ি নেই, পরিচ্ছন্ন সুবেশধারী ও সুসভ্য ইউরোপীয় নেই ৷ মুষ্টিমেয় যেসব সিকিমি তিব্বতিরা এখানে অল্পস্বল্প খেতখামার নিয়ে বেঁচে আছে তারা অতি দরিদ্র ৷ গায়ে রুক্ষ পশমের ঘরের তাঁতে বোনা একটা ঝোলা মতো ঝুলছে, কোমরে দড়ি বাঁধা ৷ ছেঁড়াখোঁড়া জামার মধ্য দিয়ে কখনওবা গায়ের উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেখা যায় ৷ প্রথম যৌবনে এদের মেয়েপুরুষদের চেহারা অতিশয় সুশ্রী ও সুঠাম ৷ অতি উচ্চভূমিতে বসবাস করার জন্য, খাদ্যাভাবে, পরিশ্রমে এবং বিবিধ রোগে এদের অকালবার্ধক্য এসে যায় ৷ তার ওপর আছে আগন্তুক নেপালিদের চাপ ৷ এই ক্ষয়িষ্ণু সিকিমিরা লেপচাদের মতোই ক্রমশ অবলোপের পথে চলেছে ৷

ইয়ুমথাং বাংলোয় পৌঁছে আমরা চমৎকৃত হলাম ৷ বৃহৎ সুন্দর বাংলো, বোধহয় এই অঞ্চলের সুন্দরতম ৷ ইংরেজ আমলে লাটসাহেবরা এখানে এসে দু-চারদিন করে কাটিয়ে যেতেন ৷ ভিজিটার্স বুকের পিছনের পাতা উল্টে দেখলে অনেক মহারথীর নাম ও তাঁদের মন্তব্য আবিষ্কার করা যায় ৷ প্রতিটি বাংলোতেই এই ভিজিটার্স বুক একটি দেখবার বস্তু ৷ যেমন লাচেন বাংলোতে দেখেছি, স্মাইথ, শিপটন, টিলম্যান ডাইরেনফার্থ ইত্যাদি প্রাকযুদ্ধ আমলের শ্রেষ্ঠ পর্বতারোহণকারীদের সই, দু-চার লাইন লেখা ৷ তাঁদের বিবিধ অভিযানের পথে এইসব বাংলোয় এক আধদিন থেকে গেছেন ৷ একজন অভিযাত্রী, তাঁর নাম মনে নেই, গ্যাংটক থেকে পায়ে পেডোমিটার বেঁধে বেরিয়েছিলেন ৷ তাঁর পদক্ষেপের সংখ্যা এই মিটারে গোনা হয়ে যেত ৷ দিক-ছু থেকে পর পর বাংলোয় তিনি তাঁর পদক্ষেপের সংখ্যা বাংলোর বইতে লিখে লিখে চলেছেন ৷ পক্ষী বা উদ্ভিদতত্ববিদরা অতি আহ্লাদের সঙ্গে তাঁদের আবিষ্কারের কথা বড় বড় প্যারাগ্রাফে লিখে রেখেছেন ৷ আরেকজন নদীতে জলধারার চাপ মেপে চলেছেন ৷ এইরকম সব লেখায় ভিজিটার্স বুকগুলি সমৃদ্ধ হয়ে আছে ৷ কে জানে এসব বই এখন কোথায় ৷

ইয়ুমথাংয়ে আমাদের বড়া খানা, পরোটা, মুরগির রোস্ট, কনডেন্সড মিল্কের পুডিং সহ ৷ বিলিতি চিনেমাটির প্লেট, গ্লাস, ছুরি কাটা সহ মস্ত ডাইনিং টেবিলে বসে ৷ শান্তি ঘোষের তদারকে চমৎকার রান্নায় আদিম ক্ষুধার সঙ্গে আহার সমাপ্ত করে, ছোট ডাঁটিওয়ালা গ্লাসে অবশিষ্ট ব্র্যান্ডি ভরে নিয়ে আমরা আবার, কতদিন পরে যেন, ফায়ারপ্লেসের ধারে বসে গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা নিশ্চিন্তে পর্যালোচনা করার সুযোগ পেলাম ৷ গরম ঘর, গদিওয়ালা খাট, সুসভ্য বাথরুমে গরম জল ৷ কেবলমাত্র আমাদের খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ ও নোংরা পরিচ্ছদটাই এই বাংলোয় বেমানান ৷ অনেক বেলা পর্যন্ত অচেতন হয়ে ঘুমে কাটিয়ে যখন উঠলাম তখন পোর্টাররা সব তৈরি, ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে পাসাং আমাদের তাড়া দিচ্ছে ৷

ইয়ুমথাং থেকে লা-চুং ৷ সেই নদীর পাশে পাশে রাস্তা, গাছপালা পাখি, আপেল, কমলালেবুর বাগান, আলুর, বড় এলাচের, যবের খেত, পাথরের কাঠের বাড়ি, স্ত্রী-পুরুষ-শিশুর প্রসন্ন মুখ ৷ এখন পথ নেমে যাচ্ছে, বারো মাইল অতিক্রম করে ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লা-চুং বাংলোয় আমরা অপরাহ্ন তিনটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম ৷ টানা লম্বা বারান্দায় বসে বিকেলের পড়ন্ত রোদে চায়ের পট থেকে ঢালা দার্জিলিং চা ও কেকের প্লেট থেকে বিস্কুট খেতে খেতে লা-চুং নদীর কলধ্বনি শুনতে লাগলাম ও শান্ত হিমালয়ের ছবি দেখতে লাগলাম ৷ আকাশ ধূসর হয়ে আসছে, বাইরে বসে থাকলে বেশ ঠান্ডা ৷ এবার ঘরের আশ্রয়ে প্রবেশ করতে হবে ৷

তার পরদিন চুং-থাং, যেখানে লা-চুং নদী গিয়ে পড়েছে লা-চেন নদীতে ৷ এই সঙ্গমে আমরা দ্বিতীয়বার এসে পৌঁছলাম ৷ পাঠকের মনে পড়বে, বারো-তেরো দিন পূর্বে যাত্রার প্রথম পর্যায়ে, এখান থেকে আমরা পূর্বোত্তরমুখী লা-চেন অথবা তিস্তা নদীকে অবলম্বন করে উত্তর সিকিমের দিকে চলে গিয়েছিলাম ৷ তারপর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের পর বিভিন্ন দৃশ্যের মধ্য দিয়ে, শেষে লা-চুং নদীর অববাহিকা ধরে আবার সেই বিন্দুতে ফিরে এসেছি ৷ এক বৃহৎ বৃত্তাকার গতিপথ ধরে আমাদের পর্যটনের শুরু ও শেষ এইখানে ৷ যে তিস্তাকে বহুদূর ছো-লামো হ্রদের এককোণ থেকে নিঃসৃত ক্ষীণ ও মসৃণ জলধারার রূপ দেখে এসেছি, আবার তাকে এখানে পেয়ে গেলাম ৷ এখন সে স্ফীতকায়া, মুখর গর্জনে পাহাড়ি বনভূমি কেটে দক্ষিণে চলে যাচ্ছে ৷

চুং-থাং থেকে সিংঘিক, সেখান থেকে দিক-ছু, সেখান থেকে গ্যাংটক ৷ তিনটি দীর্ঘদিনের পর্যটন, আবার জঙ্গল, জোঁক ভাঙা রাস্তা, ভাঙা সাঁকো ৷ কিন্তু এখন আমরা প্রত্যাবর্তনের মুখে, পিছনে সফল অভিযাত্রার উত্তপ্ত স্মৃতি ৷ গ্যাংটকে পৌঁছে নোরবু ও অন্যান্য পোর্টারদের তাদের সব প্রাপ্য ও পারিতোষিক মিটিয়ে দিয়ে, বেঁচে যাওয়া রসদপত্র বিতরণ করে ও অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নিয়ে আমাদের পদযাত্রা সমাপ্ত হল ৷ তার পরদিন শিলিগুড়ি স্টেশনে শান্তি ঘোষের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল, সে চলে যাবে কলকাতায়, আমি আর পার্থ জলপাইগুড়িতে ৷

তখনও পুজোর ছুটির কয়েকদিন অবশিষ্ট আছে ৷ বিশুদ্ধ আলস্যে, পায়জামা-পাঞ্জাবি মাছের ঝোলভাত ও দিবানিদ্রায় সে কয়েকদিন কাটল ৷ এবার ডার্করুমে প্রবেশ করতে হবে, একগাদা সাদা-কালো ফিল্ম অপেক্ষমাণ রয়েছে, সেগুলির ডেভেলপ প্রিন্ট করে ফলাফল দেখবার জন্য উৎসুক আছি ৷ রঙিন কোডাক্রোম ৩৫ মিলিমিটার স্থিরচিত্র ও ১৬ মিলিমিটার চলচ্চিত্র মুম্বইতে পাঠিয়ে দিয়েছি, তৈরি হয়ে ফিরে আসতে মাসখানেক লাগবে ৷ এবার আরেকটা নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম, সাদা-কালো ছবির এনলার্জমেন্ট ৷ সন্ধে হতে না হতে ডার্করুমে ঢুকে পড়ি বাছাই করা নেগেটিভ নিয়ে, বড় বড় এনামেলের ট্রেতে বিবিধ সলিউশন তৈরি করি, এনলার্জারে নেগেটিভ পরিয়ে ছবির ছায়া সাজাই, ১০  ১২ ইঞ্চি ক্লোরো ব্রোমাইড কাগজে যখন ছলছলে ডেভেলপারের মধ্যে ফুটে ওঠে তখন ঘরের আবছা লাল আলোয় সেসব ছবি দেখে আরেকরকমের আনন্দ অনুভব করি ৷ গাছের ফাঁকে তিস্তা, বাঁকা বনপথে চলমান তিব্বতি দম্পতি, ইয়ুমথাং বাংলোর পিছনে তীক্ষ্ণ তুষারশৃঙ্গের সার, গুরুদোংমার হ্রদে প্রতিফলিত যুগ্ম তুষারশৃঙ্গ, কালো আকাশ ছেয়ে কাংচেনজাউয়ের শ্বেত তুষার বিস্তৃত ৷ কাজ করতে করতে রাত বারোটা-একটা বেজে যায় ৷ ডাকাডাকির পর ক্লান্ত, গলদঘর্ম, সুখি, বেরিয়ে আসি ৷

রঙিন ছবিগুলোও এল ৷ দেওয়াল জোড়া বর্ণাঢ্য প্রতিচ্ছবি ৷ চলচ্চিত্র কাটা, সাজানো, টাইটেল যোগ করা ৷ তারপর একদিন জলপাইগুড়ির ইন্ডিয়ান টিপ্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের বড় অডিটোরিয়ামে সেই একঘণ্টার ডকুমেন্টারি ‘Trek to North Sikkim’-এর মুক্তি ৷ তারপর দার্জিলিংয়ের টাউন হলে, কালিম্পংয়ের গ্রেহামস হোমে ও অন্যত্র ৷

এর মাঝে মাঝে পার্থ রায়ের সঙ্গে বসে জল্পনা কল্পনা হয় সামনের বছর কোথায় যাওয়া যায় ৷ কলকাতা থেকে শান্তি ঘোষের চিঠিতে প্রস্তাব আসে এবার কাং-লা পেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম পাদভূমি ধরে শেরপাদের দেশ থাংবোচিতে চলে গেলে কেমন হয় ৷ কাঞ্চনজঙ্ঘার এই পশ্চিম সানুদেশ তখনও অনেকাংশে অনাবিষ্কৃত, তার ফটোগ্রাফ নিয়ে ফিরতে পারলে, থাংবোচে থেকে এভারেস্ট মাকালু লোৎসে আমা-দাবলাম ইত্যাদি তুষারশৃঙ্গের নিকট দৃশ্য দেখে আসতে পারলে একটা সার্থক কাজ হবে ৷ কিন্তু যদি বা শারীরিক সামর্থের ওপর ভরসা রাখতে পারি, আবার একবছরের মধ্যে এই অভিযাত্রার খরচ কী করে সংগ্রহ করব? পোর্টার রসদ ফটোগ্রাফির সামগ্রী মিলিয়ে ন্যূনতম যা খরচ হবে বুঝতে পারছি, তা আমার সাধ্যের অতিরিক্ত ৷ তিস্তা অভিযাত্রার খরচে তো কাহিল হয়ে বসে আছি ৷ হবে না ৷ শান্তি, পার্থ রায়, আমি অতিশয় দুঃখিত চিত্তে মেনে নিয়েছি যে সামনের বছর বড়সড় কোনও অভিযাত্রা সম্ভব হবে না ৷

তবু টাইমটেবিলের ভ্রমণ চলতেই থাকে ৷ ম্যাপ, ফটোগ্রাফ, দেশি-বিদেশি বই ও পত্রিকার ওপর ঝুঁকে পড়ে অধিকাংশ অবসর কাটাই ৷ দার্জিলিংয়ে ট্যুরে গিয়ে জিমখানা ক্লাবের লাইব্রেরিতে, আলপাইন ক্লাবের স্থানীয় সেক্রেটারি জিল হেন্ডারসনের বাংলোয়, মণি সেনের স্টুডিওতে, তেনজিংয়ের নতুন কেনা বাড়িতে কৃষ্ণমূর্তি, তেনজিংয়ের বিশিষ্ট বন্ধু রবি মিত্র, আমি ও অন্যান্য উৎকেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তি মিলিত হয়ে কাল্পনিক হিমালয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আত্মহারা হয়ে পড়ি ৷

তেনজিং যে বাড়িটি কিনেছে সেটি স্যার যদুনাথ সরকারের ছিল ৷ দার্জিলিং শহরে পৌঁছনোর কিছু পূর্বে কার্ট রোড থেকে টোঙা রোড নামে একটি চওড়া রাস্তা উঠে গিয়ে মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলের ঠিক নিচে অকল্যান্ড রোডে গিয়ে পড়েছে ৷ নির্জন রাস্তা, সুদীর্ঘ বর্ষীয়ান ক্রিপ্টোমেরিয়া গাছের ছায়ায় ঢাকা ৷ এই রাস্তার ধারে স্যার যদুনাথ একটি অতি মনোরম সবুজ ঢেউটিনের ছাদবিশিষ্ট দোতলা সুইসশ্যালে জাতীয় বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন ৷ কালক্রমে স্যার যদুনাথ চলে গেলেন, আর সব বাসিন্দারাও যথানিয়মে দার্জিলিং থেকে অপসৃত হলেন ৷ তারপর ১৯৫৪ সাল থেকে এই বাড়ি তেনজিংয়ের ৷ তখন সে এভারেস্ট বিজয় করে ফিরেছে, কিছু টাকা পেয়েছে ৷ রবি মিত্র ও অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তায় এই বাড়ি কিনে, মেরামত করিয়ে তেনজিং, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুয়েকটি অনুগত শেরপাদের নিয়ে বসবাস আরম্ভ করেছে ৷ দেশবিদেশ থেকে যেসব সামগ্রী উপহার পেয়েছে এবং পাচ্ছে, সেসব সাজানো-গোছানো হচ্ছে, ছবির মোটা মোটা অ্যালবাম ৷ গোছা গোছা চিঠির ফাইল ৷ ক্রমশ এই বাড়িটি যেন একটি মিউজিয়াম হয়ে দাঁড়াল ৷ বহু লোক তেনজিং ও তার বাড়িটি দেখতে আসে ৷ বিনম্র, স্মিতমুখ ও স্বল্পবাক তেনজিং তাদের সব দেখিয়ে বেড়ায়, প্রশ্নের জবাব দেয় ৷

১৯৭১ সালে আমার শেষবার দার্জিলিং যাওয়া ৷ তেনজিংয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য বার্চহিলে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে গেলাম ৷ তখন আমার বয়স পঞ্চান্ন, তেনজিংয়ের আটান্ন ৷ তখন সে অত্যন্ত সজীব ও সুঠাম, মেদহীন শক্ত শরীর ৷ সিনিয়র ছাত্রদের নিয়ে জোংরি, লোহনক, সেবুলা অঞ্চলে ট্রেনিং দিতে যায় ৷ অনেক গল্প হল, অনেক কাপ চা ৷ অতি সম্প্রতি তেনজিংকে শেষ দেখলাম, তার মৃত্যুর পর টেলিভিশন পর্দায় ৷ তার দেওয়া একটি আইস-এক্স এখনও আমি অতি সযত্নে রক্ষা করছি ৷

ভ্রমণ নভেম্বর, ১৯৯৫

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন