গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়

নদীমাতৃক বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই হয়তো নদীবিহীন কোনও দেশের কথা কল্পনাও করতে পারি না ৷ এই নদীগুলিকেই তো মহাভারতে বলা হয়েছে ‘বিশ্বস্য মাতর’ ৷ নদীতীরের উভয় কূলেই প্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ৷ কাজেই নদীই সভ্যতার মূল কথা ৷

গত দশ বছরে পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণের সময় গঙ্গা প্রবাহপ্রণালীকে নিয়েই যেন ব্যস্ত ছিলাম বেশি ৷ গঙ্গার উৎসমুখ সঠিক কোনটি তা নির্ণয় করতে গিয়ে এত অজস্র নদী ও তাদের উৎসমুখগুলির বৈচিত্র্যের সন্ধান পেয়েছি, যেন নতুন দৃষ্টিতে নদীগুলিকে দেখতে পেয়েছি ৷ কত অসংখ্য স্রোতস্বিনী এসে গঙ্গাকে সমৃদ্ধ করেছে, তার আর ইয়ত্তা নাই ৷ প্রত্যেকটি উৎস ও সঙ্গমের কাহিনী একেকটি নতুন ইতিহাস ৷

এর মধ্যে নেপালের গণ্ডকী নদীপ্রবাহকে দেখবার সুযোগ ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে ৷ গ্রীষ্মকালে মে-জুন মাসে ত্রিশূলীগণ্ডকী ও অক্টোবর মাসে কালীগণ্ডকীতে ভ্রমণ করবার সৌভাগ্য হওয়াতে নদী উৎসগুলিকে দেখার সুযোগ মিলেছিল ৷ নেপালের তিনটি প্রধান নদী প্রবাহপ্রণালী (River System)-কর্ণালী সর্ব পশ্চিমে, সপ্তগণ্ডকী মধ্যাঞ্চলে ও সপ্তকোশী পূর্বাঞ্চলে ৷ এর মধ্যে সপ্তগণ্ডকীর অববাহিকা অঞ্চল পশ্চিমে কালীগণ্ডকী থেকে পূর্বে ত্রিশূলীগণ্ডকী অবধি প্রায় ১৪০ মাইল বিস্তৃত! এই দুই প্রবাহিণীর মাঝখানে শ্বেতগণ্ডকী, বুড়্গিণ্ডকী, মারসুরান্দী, রাপ্তী প্রভৃতি ক্ষুদ্র বৃহৎ অনেক নদী আছে ৷ এই ১৮টি মিলিত স্রোতধারা মহাভারত লেখ পর্বতশ্রেণী পর্বতমালাকে ভেদ করে একটি গিরিবর্ত্মের মধ্য দিয়ে গিয়ে ভারতে গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে ৷ এই সমস্ত স্রোতের মিলনস্থলকে বলে সপ্তগণ্ডকী ৷ এটি একটি দর্শনীয় স্থান ৷ কাঠমান্ডু থেকে নারায়ণগড় অবধি বাসে যাওয়া যায় তবে রাতে থাকতে হয় ৷ গণ্ডকী নদীর রূপ ভারতে কত শান্ত কিন্তু নেপালে তার উৎস মুখগুলি কী ভয়ঙ্করী! কালীগণ্ডকীর উৎসস্থল তিব্বতের দামোদর কুণ্ড-খাম্পাদের অঞ্চল ৷ বিখ্যাত শালগ্রাম শিলা বা নারায়ণশিলা (Ammonitefossil) এই নদীগর্ভে বা দামোদর কুণ্ডেই যথেষ্ট পাওয়া যায় ৷ বাংলাদেশে এই শালগ্রাম শিলা নারায়ণের প্রতীক ৷ সমস্ত ধর্মীয় ও শুভ কাজে এ ছাড়া ক্রিয়াকলাপ চলে না ৷ এই কারণে কালীগণ্ডকীর দক্ষিণাংশকে বলা হয় নারায়ণী নদী ৷ বিখ্যাত তীর্থস্থান মুক্তিনাথ যা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায় কর্তৃকই পূজিত, তা এই নদীর কাছেই ৷ অন্নপূর্ণা ও ধবলগিরি শৃঙ্গদ্বয়ের মাঝখান থেকে বয়ে এসেছে এ নদী ৷ কাজেই ওই সমস্ত তুষারাবৃত অঞ্চলের বরফ গলা জল বয়ে নিয়ে এসেছে-একেক জায়গায় নদীর প্রসার ১-২ মাইলের মতো ৷

সর্বাপেক্ষা পুবের নদী হল ত্রিশূলীগণ্ডকী ৷ এই নদীর উৎস গোঁসাইকুণ্ড, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে বায়ুপথে ৩৬ মাইল ৷ কালীগণ্ডকী নদীর মতো এর সঙ্গেও একটি ধর্মীয় কাহিনী জড়িত আছে ৷ ফলে এটিও হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে একটি প্রধান তীর্থস্থান হিসাবে পরিগণিত হয়েছে ৷ গোঁসাইথান পর্বতশৃঙ্গের নিচের ঢালে এই গোঁসাইকুণ্ড হ্রদটি অবস্থিত ৷ এইটি ও আরও ১০-১২টি হ্রদের জল নিয়ে ত্রিশূলীগণ্ডকী নদীর উৎপত্তি ৷ এই নদী ল্যাংটাং হিমল পর্বতশ্রেণীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এবং স্থানীয় অধিবাসীরা (গুরুং) তিব্বতী জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ৷ এই অঞ্চল থেকে বাইরঙ্গ গিরিপথ দিয়ে তিব্বতে যাবার একটি দুর্গম গিরিপথ আছে ৷ Seven years in Tibet-এর লেখক জার্মান অভিযাত্রী Heinrich Harrer দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কারাগার থেকে তিব্বতে পালাবার সময় ভারত সীমান্ত থেকে এই পথ দিয়েই গিয়েছিলেন এবং তাঁদের স্কেচ, মানচিত্র ও অন্যান্য জরিপগুলিই এখন প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত হচ্ছে ৷ কিন্তু পথটি খুব দুর্গম বলে সাধারণত এ পথটিতে বেশি চলাচল নেই, সেই কারণেই হয়তো নেপাল সরকার এখানে Checkpost ইত্যাদি রাখেননি ৷

বিদেশি অভিযাত্রীদের লেখায় প্রথম গোঁসাইকুণ্ড সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া যায় ৷ এর মধ্যে বিখ্যাত নৃতত্ববিদ Duncan Forbes, Snell Grove ও Oldham-এর বই উল্লেখযোগ্য ৷ গোঁসাই বা গোস্বামী হলেন গবাদি পশুদের রাজ ৷ তাঁরই ত্রিশূল দ্বারা প্রথিত হয়েছে এই কুণ্ড ৷ কাহিনীটি হচ্ছে যে সমুদ্র মন্থনের পরে যে তীব্র বিষ উঠেছিল, পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য মহাদেব তা পান করেন ৷ কিন্তু বিষের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে তাঁর ত্রিশূল দিয়ে এই হ্রদ খনন করে শীতল জলের নিচে শয়ন করেন তীব্র জ্বালা জুড়োবার জন্য ৷ তাঁরা দেখেছেন একটা খুব বড় পাথরের খণ্ড জলের নিচে দেখা যায় ৷ ওইটিই নাকি শিবের শায়িত মূর্তি ৷ অবশ্য তীরেও বেশ কিছু প্রস্তরখণ্ডে সিঁদুর ইত্যাদি লেপা আছে, যেগুলি শিবলিঙ্গ বলে বর্তমানে পূজা পাচ্ছে ৷ পরিষ্কার দিনে গোঁসাইথান শৃঙ্গটিকে কুণ্ড জলে প্রতিবিম্বিত দেখা যায় ৷ ভক্তেরা এবং স্থানীয় লোকরাও বলে থাকে যে গোঁসাইথান শৃঙ্গটি কিছু চ্যাপ্টা-কারণ শিবের অবস্থিতি তো পাহাড়ের ওপর নয়-সেটি কুণ্ডের জলে স্থিত ৷ এর সঙ্গে আরও একটি কাহিনীও জড়িত আছে ৷

নেপালে বহু জায়গায় শিব ও বিষ্ণু একই মূর্তিতে পূজা পাচ্ছেন যেমন শিউপুরী লেকের কাছে-বুঢ়ানীলকণ্ঠ-আসলে সেটি বিষ্ণুর অনন্তশয্যায় শয়ান মূর্তি কিন্তু নাম বুঢ়ানীলকণ্ঠ ৷ গোঁসাইকুণ্ডের সঙ্গে এ মূর্তির সম্বন্ধ এই যে, গোঁসাইকে দর্শন করতে লোকেরা যেতে পারে না-কারণ পথ খুব দুর্গম-সুতরাং সকলের দর্শনের জন্য তার জায়গায় এই ২৫ ফুট লম্বা বিষ্ণুমূর্তিকে (বা শিবকে) একটা বড় পুকুর কেটে স্থাপিত করা হয়েছিল ৷ কিন্তু রাজবংশের ওপর কী একটা আদেশ থাকাতে বর্তমান রাজাদের পক্ষে বিষ্ণুর অবতার হওয়া সত্বেও ওই মূর্তি দেখা নিষিদ্ধ ৷ সেজন্য কাঠমান্ডুর উপকণ্ঠে একটি সুন্দর বাগানের মধ্যে ওই শায়িত বিষ্ণু মূর্তির একটি প্রতিমূর্তি আছে-যা রাজা দর্শন করতে পারেন ৷ মনে হয় এসব কাহিনী পরবর্তীকালে গোঁসাইকুণ্ড ও শিবের কাহিনীর সঙ্গে জড়িত করা হয়েছে ৷

এ যাত্রায় আমার সঙ্গী হবার জন্য ২ জন লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম ৷ একজন শক্ত সমর্থ ও উপযুক্ত পর্বতারোহী কথা দিলেন আমাদের-(অর্থাৎ আমি ও আমার ছাত্রী বি, টি কলেজের অধ্যাপিকা মিনতি বিশ্বাস)-সঙ্গে যাবেন ৷ যাবার দিন দুপুর বেলা তিনি জানালেন-তাঁর পক্ষে অফিসের জরুরি কাজের জন্য তিনি যেতে পারছেন না ৷ আমি একটু দ্বিধায় পড়লাম ৷ কিন্তু আমার নবীনা সঙ্গিনী অবিচল-তিনি জানালেন, ‘দুজনেই একলা যাব’ কুছ পরোয়া নাই ৷ তাঁর ভরসাতেই আমারও উৎসাহ হল-কারণ সঙ্গীবিহীন তো ওইসব জায়গায় যাওয়া চলে না ৷ এর পরেও দেখেছি তাঁর কী অসাধারণ মনোবল ৷ এইরকম একজন সঙ্গী পেলে যাত্রা সার্থক হয় ৷

কলকাতা থেকেই পথঘাটের মোটামুটি খবরাখবর নিয়েছিলাম ৷ বোধনাথ স্তূপের ভারপ্রাপ্ত চিনি লামা এ পথের প্রধান সহায়ক কারণ তিনি ওই অঞ্চলের ধর্মগুরু ৷ তাঁর পূর্ব পুরুষ চিন থেকে এসেছিলেন, এজন্যই ‘চিনি লামা’ বলা হয় তাঁকে ৷ রক্সৌল হয়ে কাঠমান্ডু পৌঁছলাম মে মাসের শেষের দিকের এক বিকেলে ৷ পরদিন সকালেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ৷ ৮৬ বছরের বৃদ্ধ লামা-যৌবনে কলকাতায় ছিলেন ৷ রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুস্পুত্র সুরেন্দ্র ঠাকুরকে খুব চিনতেন ৷ কলকাতার বর্তমান খবর জিজ্ঞেস করলেন ৷ বেশ ইংরিজি জানেন ৷ এঁর বসবার কক্ষটিই একটি মিউজিয়াম বিশেষ ৷ প্রকাণ্ড একটা গুরু রিমপোছের (পদ্মসম্ভব) ছবি টাঙানো আছে ৷ ইনিই এই লামা গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা ৷ তাছাড়া বহুবিধ পিতলের, ব্রোঞ্জের ও তাম্র টাকা ৷ দেওয়ালে টাঙানো সিল্কের বা কাগজের ওপর বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের নানা কাহিনী অঙ্কিত, কবচ, প্লেটও বহু কারুকার্য দেখা গেল ৷ এমনকী আসন গালিচাগুলি, চা খাবার পাত্রগুলিতে বিভিন্ন চিত্র খোদিত করা হয়েছে ৷ আমরা থাকতে থাকতেই, কয়েকজন জার্মান ও সুইডিশ অভিযাত্রী পিতলের বুদ্ধমূর্তি কিনতে এলেন ৷ বোধনাথ স্তূপের চারদিকে যে বসতি, তাতে এঁর বাসস্থান, ল্যাংটাং অঞ্চলের লোকই বেশি এখানে ৷ এঁরা নানাবিধ ধাতুর কাজ করে থাকে ৷ ছোটখাটো একটা বাজারও আছে ৷ ইনি থাকেন ওই অঞ্চলের হেলম্বু জনপদের পাশে মালেমচি গ্রামে ৷ দুজন মেয়ে যাচ্ছি শুনে কিছুমাত্র নিরুৎসাহ করলেন না-বরঞ্চ সর্বরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন ৷ কুলি ঠিক করে দিলেন ও কতটুকু জিনিস নিতে হবে তাও বলে দিলেন ৷ কোন জায়গায় জল পাওয়া যায়, গ্রাম আছে, বা গুহা পাওয়া যায়-তার দূরত্ব সমেত লিখে দিলেন ৷ এগুলি এত নির্ভুল ছিল যে গোঁসাইকুণ্ড থেকে ফেরার পরে কাঠমান্ডু ট্যুরিস্ট অফিসের লোকরা সে সব নিজেদের বইয়ে ছাপবার জন্য লিখে নিলেন ৷

পরদিন অর্থাৎ ২৬ মে ট্যাক্সি নিয়ে-‘চিনি লামার’ আস্তানায় গিয়ে পৌঁছলাম ৷ তার স্ত্রী খুব চিন্তান্বিত ছিলেন আমাদের পথের বিপদের কথা ভেবে ৷ চিনি লামা দৈনিক ৯ নেপালি টাকায় দুজন ওই অঞ্চলের লোককে কুলি ও গাইড হিসাবে সঙ্গে দিলেন, ওই অঞ্চলের গ্রামপ্রধানদের কাছে তিব্বতীতে একটা আজ্ঞাপত্র দিয়ে দিলেন ও তাতে নিজের সিলমোহর দিয়ে ছাপ দিয়ে দিলেন ৷ বার্ধক্য সত্বেও দোতলা থেকে একতলায় নেমে এসে আমাদের আশীর্বাদ ও স্বস্তিবাচন করে ড্রাইভারকে ‘সুন্দরীজল’ অবধি নিয়ে যেতে বললেন ৷ কুলি দুজনই তিব্বতী, ল্যাংটাং অঞ্চলের লোক-এসেছিল লবণ কিনতে, তাদের ওইভাবে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিলেন ৷ ধর্মগুরুর আদেশ তারা অমান্য করে না-তাই সঙ্গে গেল ৷ এখানে তাদের জিভ বার করে আদেশ গ্রহণ করার রীতি দেখে খুবই কৌতুক অনুভব করলাম ৷ বাস্তবিক এই ধর্মগুরুর সাহায্য না পেলে আমাদের গোঁসাইকুণ্ড যাত্রা কী হত বলা কঠিন কারণ ট্যুরিস্ট অফিসও পথঘাট সম্পর্কে খুব ভালো খোঁজ রাখেন না ৷

আমাদের পথপ্রদর্শক দুজন কুলি হল গুরুং জাতি গোষ্ঠীর ৷ বয়ঃজ্যেষ্ঠটির নাম জিৎ বাহাদুর ৷ একজন তো তিব্বতী ছাড়া কিছুই জানে না ৷ অন্যজন কিছুটা হিন্দি বলতে পারে ৷ খুবই সাধারণ গ্রাম্যলোক কিন্তু সরল ও বিশ্বাসী-এই দুটি লোকের ভরসায় আমরা নিশ্চিন্তে রওনা দিলাম ৷ তিব্বতীদের এই পাহাড় অঞ্চলে জীবনযাত্রা অতি কঠোর, যা ফসল ফলায় তাতে সারাবছর চলে না ৷ এইসব অঞ্চলে জমির ওপর কোনও কর নেই ৷ গম, রামদানা, ভাং ও কিছুটা চাল উৎপাদন করে ৷ তবে এরা ভাত খায় না, তা দিয়ে মদ জাতীয় জিনিস তৈরি করে ৷ ওইসব অঞ্চলে চা পাওয়া যায় না, কেউ খায়ও না, শরীর গরম রাখতে এই তাড়িই ভরসা ৷ সেইজন্য মনে চিন্তা ছিল পথের মাঝে এরা মাতাল হয়ে না পড়ে-আর গ্রামবাসীরা তো তাদেরই স্বজন ও জ্ঞাতি! কিন্তু বাস্তবে কোনওরকম বিপদেই পড়তে হয়নি আমাদের ৷ এই সমস্ত এলাকায় বেশ জলাভাব ৷ আমরা মে-র শেষে রওনা হয়ে এখানে এসেছি, বর্ষা এখনও শুরু হয়নি, ঝরনা ও নালাগুলি শুকনো ৷ বর্ষা শুরু হলে এ পথে চলাই যাবে না কাজেই আমাদের যেতে হবে তাড়াতাড়ি ৷

সুন্দরীজল হল সমতল প্রান্তরের অন্তিম সীমা-এখান থেকেই ধাপে ধাপে সিঁড়ির মতো পথ উঠে গেছে ৷ সুন্দরীজল হল পানীয় জলের জলাধার-এখান থেকেই কাঠমান্ডু ও তার ৫ মাইলের মধ্যের অঞ্চলগুলিতে পানীয় জল সরবরাহ করা হয় ৷ স্থানটি Protected Area এখানে ৷ আমাদের কুলিরা তাদের যাত্রাপথের রসদ ইত্যাদি কেনবার জন্য ও কিছুটা বিশ্রাম করার জন্য থামল-অগত্যা আমরাও থামলাম ৷ এই যাবার পথের বৈশিষ্ট্য হল যে ৫ দিনে প্রায় ৩৬ মাইল যেতে হবে-সবটাই খাড়া চড়াই ৷ উতরাই বিশেষ কিছু নেই ৷ তাই আমরা ঠিক করেছিলাম প্রতিদিন সম্ভব হলে ৯-১০ মাইল করে হাঁটব ৷ সেই অনুসারে বেলা ৯টা নাগাদ রওনা হয়ে ৯ মাইল পথ অতিক্রম করব এই স্থির হল ৷ উপত্যকার শেষে শিশুপুরী লেখের পার্বত্য অসমান পথ শুরু হল ৷ প্রথমেই বেশ কয়েকটা পাথরের বড় বড় ধাপ পার হতে হল, গ্রামের মধ্যেই আছি, এগুলি আমাদের কুলিদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি ৷ বেলা ১২টার মধ্যে মূলখড়্গা (মূলখড়ক) পার হলাম কিন্তু রাস্তা না বলে পথটিকে পাথরখণ্ডের স্তূপ বলাই উচিত ৷ যে গ্রামগুলি পার হলাম, তাতে বড়জোর ৮-১০ ঘর পরিবার বাস করে ৷ এদের কুটিরগুলি হয় উপত্যকার খেতের পাশে নয়তো চলার রাস্তার পাশে ৷ নিয়মিত পথ বলে কিছু নেই ৷ সকলেই সাবধান করে দিল পথের বিষয়ে-কিন্তু আমরা ভাবলাম এই ৯ মাইল পথ হেসে খেলে চলে যাব ৷ এখন তো সমতল রাস্তা ৷ কিছুদূর যাবার পর এ অঞ্চলের সবচাইতে বড় গ্রাম পাতি-ভান জেঙের প্রান্তে উপস্থিত হলাম ৷ ভানজেং শব্দটির অর্থ হল গিরিপথ ৷ কিন্তু কী ধরনের গিরিপথ তা চলবার আগে ধারণাই করতে পারিনি ৷ অতীতে কোনও পার্বত্য ঝরনা হয়তো কোনওদিন কোনও পথ বেয়ে চলে গিয়েছিল, চারপাশের নরম শিলা গলে মাটির স্তূপ হয়েছে, তার মধ্যে তীক্ষ্ণ সব পাথরখণ্ড গাঁথা-এইভাবে অনেক ওপর থেকে আসা পাহাড়ি ঝরনার স্রোতের পথে-বর্তমান পথের সৃষ্টি হয়েছে ৷ এখন এ পথে জল নেই, সুতরাং ওপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে নিচের মাটির স্তূপে পা ঠেকলে তবেই দাঁড়াতে পারছি, কখনও দু পাশের দেওয়াল ধরে সরু পথের মধ্য দিয়ে চলেছি, কী সাংঘাতিক পথ! এইভাবে এই গিরিবর্ত্মসদৃশ ভানজেং পার হতে আমাদের লাগল প্রায় একঘণ্টা ৷ শুনেছি, চম্বলের ডাকাতরা এইরকম Ravines-এ লুকিয়ে থাকত ৷ এখানকার শিলাচূর্ণ ও মাটির রং গেরুয়া ৷ এইভাবে প্রায় বিকেল ৪টের সময় পাতি ভানজেং গ্রামে এসে পৌঁছলাম ৷ অন্য গ্রামগুলির তুলনায় এটি একটু বড় গ্রামই বটে ৷ এর উচ্চতা ৭,০০০ ফুট ৷ এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বাঁধানো কুয়া, কয়েকটি মুদির ও চায়ের দোকান, একটি মণি বা বৌদ্ধমন্দির ও পুলিশ চেকপোস্ট আছে ৷ বিশ্রাম নিয়ে চা খাবার সময় একটি দোতলা বাড়ির জানলা খুলে গেল-একজন মোড়ল গোছের লোক জিজ্ঞেস করল-আমরা কে, কোথায় যাচ্ছি ইত্যাদি ৷ আমরা কিছু জবাব দেবার আগেই, আমাদের জিৎ বাহাদুর চিনি লামার মোহর দেওয়া চিঠিটি দেখাল এবং নিজেদের ভাষায় কী বলল ৷ ব্যস, জানলা বন্ধ হয়ে গেল-আমাদের পথ মুক্ত হল ৷ মনে মনে চিনি লামার ক্ষমতাকে তারিফ করলাম ৷ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, ৬ মাইল পথ এসে পড়েছি, আর ৩ মাইল পথ দেখতে দেখতে চলে যাব, এই ছিল আমাদের মতলব ৷ কারণ খুব চড়াই যখন শুরু হবে তখন হয়তো ৫ মাইলের বেশি যেতে পারব না ৷ পাতি ভানজেঙের পঞ্চায়েত অফিস থেকে সামনের পথও বেশ সোজা মনে হচ্ছে ৷ পাতি ভানজেঙের পরে আর ইউরোপীয়দের বিনা অনুমতিতে যাবার হুকুম নেই ৷ পথে দেখেছি মাঠেঘাটে বহু হিপি নরনারী উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে, রোদ পোহাচ্ছে ৷ আরও আগে যেতে পারবে না বলে কত দুঃখ তাদের! আমাদের কাছে সে সব দুঃখের কাহিনী বলল ৷

এখান থেকেই ডানদিকে একটা পথ গেছে হেলম্বুতে, খুবই স্বাস্থ্যকর জায়গা ৷ উত্তর প্রদেশের একজন মিলিটারি অফিসার ও তাঁর স্ত্রী সেইদিকে রওনা দিলেন ৷ এটাই চিনি লামার পরিবারের বাসস্থান ৷ চা পানের পর ৩ মাইল দূরের চিপলিং গ্রামের দিকে চললাম ৷ পথ প্রথমে সোজা তারপর ঘুরে গিয়েছে, সুতরাং সহজে যাওয়া সম্ভব হল না ৷ পাহাড়ি পথের বাঁক ঘুরে দেখা গেল একটা চড়াই পথ সোজা ওপরে উঠে গেছে ৷ সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আর যাওয়া মুশকিল ৷ আমার সঙ্গিনীও ক্লান্ত সুতরাং পথের বাঁকে যে বাড়িটি প্রথম পেলাম, সেখানেই রাত কাটানো স্থির করলাম ৷ কুটিরটি একটি চৌকিদারের বাড়ি, সে তখন ছিল না কিন্তু আমাদের কুলির চেনা ৷ সেই কথাবার্তা বলে বারান্দায় থাকা ঠিক করে ফেলল ৷ বাইরেই উনুন-সেখানেই রান্নাবাড়ি করে রাতের খাওয়া সেরে চারদিকে প্লাস্টিকের চাদর খাটিয়ে ঘর বানানো গেল ৷ বাড়ির মেয়েরা শিশুসহ ভেতরে শুল ৷ কিন্তু সারারাত ধরে লোকের আনাগোনা, চৌকিদারের সঙ্গে কথাবার্তা, চৌকিদারের আদর আপ্যায়ন এসব শুনতে শুনতেই কেটে গেল ৷ ভোরে চৌকিদার সবিনয়ে জানাল আমাদের কী হুকুম হয় খাবার? আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চড়াই বেয়ে উঠে ১ ঘণ্টার মধ্যে চিপলিং গ্রামে পৌঁছলাম ৷ চিপলিং নামটি শুনে সন্দেহ হয় তা শিবলিঙ্গ নামের অপভ্রংশ কিনা-এখানে অনেক নামই ওই ধরনের আছে ৷ চিপলিং থেকে যাবার পথে একটি আমেরিকান অভিযাত্রীদলের সঙ্গে এবড়ো খেবড়ো পথের মধ্যে আলাপ হল ৷ তারা উল্টোদিক থেকে আসছেন ৷ আমরা যে পথ দিয়ে এসেছি সেখান দিয়ে নেমে কাঠমান্ডু যাবে ৷ আমাদের দুটি মেয়েকে একলা দেখে খুবই বিস্মিত হল ৷ এরা বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ৷ বেলা ১০টা নাগাদ গুলফা ভানজেং গ্রামে পৌঁছলাম ৷ এটিও বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম ৷ কিছু শেরপা পরিবার গোষ্ঠীর মানুষ এখানে থাকে বাকিরা গুরুং গোষ্ঠীর তিব্বতী ৷ এখানে মহিষ চরছে, দুধ দইও যথেষ্ট পাওয়া যায় ৷ এবারকার যাত্রায় আমরা স্থির করেছিলাম দিনের বেলা চিঁড়ে ও গুড়, দুধ জুটলে দুধ চিঁড়ে খেয়েই থাকব ৷ রাতে শুধু রান্না হবে ৷ এতে সময় অনেকখানি বাঁচবে ৷ এখানে দুধ পাওয়া যেতেই সেই চিঁড়ে দুধ দিয়ে ফলার করা হল ৷ আর কুলিরা এখানে তৈরি ভাত পেয়ে খুশি হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ৷ ভাত খেল কি তাড়ি খেল জানি না ৷ তবে শেরপা অধিবাসীরা আমাদের ঠাট্টা করে জানাল, ‘তোমাদের কুলিরা নেশা না করে থাকতে পারবে না-যতই কেন না তোমরা চা খাওয়াও!’ প্রত্যেক শেরপা ও স্থানীয় লোকের দুটি করে কুকরি থাকে-একটা বড় ৷ সেটা থাকে খাপের মধ্যে, তা দিয়ে তারা জন্তুজানোয়ার মারে, বনপথ কেটে পরিষ্কার করে ৷ তার খাপটা কাঠের কারুকার্যওয়ালা হয়-দেখতে খুব সুন্দর ৷ সেইসব কাঠের কাজ এখানেই হচ্ছে দেখলাম ৷ আরেকটা ছোট ছুরি থাকে তরকারি, মাংস ইত্যাদি কাটবার জন্য ৷ এগুলি পাহাড়িদের কাছে অতি প্রয়োজনীয়-এ দুটি ছাড়া তারা কখনওই পথ চলে না ৷ আমাদের যাত্রাপথে এগুলি খুবই কাজে লেগেছিল কারণ বহু জায়গায় বন কেটে যেতে হয়েছে ৷

এরপর আমরা এলাম বালেমচি বলে একটা গ্রামে-অধিবাসীরা খুবই গরিব কিন্তু যতদূর পারল আদর আপ্যায়ন করল ৷ একটা মাত্র ঘরে এক বুড়ি তার মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে থাকে ৷ জিনিসপত্রে ঠাসা, তার মধ্যেই কোনওমতে একটু জায়গা করে আমাদের শুতে দিল ৷ কুলি দুজন এদের চেনা হলেও বাইরে ভেড়া বা মহিষের ঘরে তাদের শুতে হল ৷ রাতে রোজই বৃষ্টি পড়ত ৷ সেদিনও প্রবল ধারায় বৃষ্টি-বেচারীরা তার মধ্যেই শুল ৷ শুকনো পাতার ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে তাদের শুকনো রাখবার চেষ্টা করলাম ৷ এদিকের গ্রামবাসীরা এত সরল ও সহজ যে ঘরভাড়া বা কাঠের জন্য কখনওই কোনও পয়সা নেবার কথা ভাবেনি ৷ আমরাই দুধের দাম বাবদ বাচ্চাদের কিছু দিয়ে এলাম ৷ মুক্তিনাথের পথের থাকালদের সঙ্গে কী প্রভেদ! থাকালরাও তিব্বতী গোষ্ঠীর-বহুদিন নেপালে আছে, কিন্তু সমস্ত কিছুর জন্যই পয়সা চাই ৷ বেশ ভালো অবস্থা তাদের ৷ শুধু একরাত ঘরে বা বারান্দায় থাকার জন্যই আট আনা করে নিত ৷ এদিককার লোক গরিব, অত ব্যবসা বুদ্ধি মাথায় এখনও ঢোকেনি ৷ দিন চালানোই এদের পক্ষে কঠিন ৷ কিন্তু মনটি সুন্দর আছে ৷ পথে দেখেছি বন থেকে বিশেষ বিশেষ গাছ কেটে করাত দিয়ে চেরা হচ্ছে, গ্রামবাসীরা এগুলি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের ঘর তুলবার জন্য ৷ এসব সরকারি বদান্যতায়ই হচ্ছে ৷ বালেমচি থেকে রাস্তা ক্রমাগত ওপরে উঠছে ৷ ৪-৫টা পাহাড়ের চূড়া পার হলাম-অনেক দূরে ‘মণি’ দেখা গেল-জায়গাটির নাম সৌনেমণি ৷ অর্থাৎ মণিপদ্মে লেখা প্রস্তরের স্তূপ-তার মাথায় নিশান উড়ছে ৷ বহুদূর ও চারদিক থেকে লোকে ওই নিশান দেখে পথের দিশা পায় ৷ এইখানেই কিছু লোকের সঙ্গে দেখা হল ৷ এরা কাঠ আনতে বা শিকার করতে গিয়েছিল, এখন ফেরত আসছে ৷ বিকেল হয়ে গেল ৷ আমরা যাচ্ছি থাটেপটি বলে একটা জায়গায় ৷ সেখানে সরকারি কাঠের ঘর ভেড়াওয়ালাদের জন্য তৈরি করা আছে, সেখানেই রাত কাটাব ৷ বালেমচির পরে আর কোনও গ্রাম নেই, কোনও অস্থায়ী আস্তানাও নেই ৷ এটা আমাদের তৃতীয় রাত ৷ কাঠের বিশ্রামঘরে পৌঁছে অগ্নিকুণ্ডে দুপাশের কাঠের তক্তার ওপর বিছানা করে আরাম করে বসলাম ৷ আমার সঙ্গিনীর একটু গ্যাসট্রিক কষ্ট দেখা দিয়েছে, কুলিরা নিচে ঝরনা থেকে জল আনতে গেল ৷ বেশ খানিকক্ষণ পরে তারা নিদারুণ খবর শোনাল-ওপরে বা নিচে, সব ঝরনা শুকনো ৷ অর্থাৎ রাতে আর কোথাও জল মিলবে না-শুনে তো মাথায় বজ্রাঘাত হল! সারাদিন হেঁটেছি, Water bottle-এর জল নিঃশেষ ৷ কুলিরা বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে না ৷ আমাদের অন্তত সারাদিনের পর কিছু খেতে হবে, অন্তত চা তো খেতেই হবে ৷ সঙ্গিনী দিনের বেলা চিঁড়েও খাননি-তাঁকে কোনও গরম পানীয় দিতে হবে, কী হবে উপায়? এমন সময় রোজকার মতো মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল ৷ অমনি যত বাটি, ঘটি, হাঁড়ি গেলাস সব বাইরে রাখা হল-কুলিরা প্লাস্টিকের চাদর মুড়ে চৌব্বাচার মতো করে রাখল জল ধরে রাখবার জন্য ৷ ব্যস জলের ভাবনা ঘুচল ৷ খাওয়াদাওয়া হল-রাত ১টার সময় বৃষ্টি থামল ৷ ওপরের অঞ্চলে রোজই প্রথম রাতে এমন ধারা বৃষ্টি হত ৷ পরদিন ভোরে উঠেই মাইলখানেক গিয়ে একটি সুন্দর ঝরনা পাওয়া গেল-সেখানেই প্রাতঃকৃত্য সারা হল, চা ইত্যাদি খাওয়া হল-এখান থেকে ডানদিকে উঁচু পাহাড় ৷ দূরে রৌদ্রোজ্জ্বল এক উঁচু পর্বতশৃঙ্গ দেখিয়ে আমাদের প্রধান পথপ্রদর্শক জানাল-সূর্যকুণ্ড থেকে একটি ঝরনা ওইখানে এসে পড়েছে ৷ চা খাবার সময় আমাদের সঙ্গে ডাঃ ফ্রেমিন্ড বলে একজন আমেরিকান পক্ষীবিশারদের সঙ্গে দেখা হল ৷ তাঁর সঙ্গে দুজন শেরপা কুলি আছে ৷ তিনি কিছুটা ওপরে কয়েক মাস ধরে আছেন ৷ বিভিন্ন ধরনের পাখি ও তাদের স্বভাব চরিত্র বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন ৷ আমাদের অনভ্যস্ত চোখে তো পাখি প্রায় চোখেই পড়েনি-ইনি নাকি ২৫-৩০ রকম পাখি দেখেছেন ৷ তাঁর কাছেই আমাদের গন্তব্যস্থলের ও হ্রদগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল ৷ তাঁর মতে গোঁসাইকুণ্ডকেই যদিও ত্রিশূলীগণ্ডকীর উৎস বলে ধরা হয়-কিন্তু বিভিন্ন উচ্চতায় প্রায় ১৫-১৬টা হ্রদ আছে-গোঁসাইকুণ্ডই এর মধ্যে সবচাইতে বৃহৎ ৷ কিন্তু সবচাইতে ওপরের হ্রদটি সূর্যকুণ্ড ৷ সাড়ে ৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, সেখান থেকে জলধারা গোঁসাইকুণ্ডে পড়ছে ৷ এর জল আবার নিচের কুণ্ড বা হ্রদে পড়েছে, এইভাবে হ্রদগুলির জল নিয়েই ত্রিশূলীগণ্ডকী নদীর সৃষ্টি ৷ সূর্যকুণ্ড অতটা উঁচুতে অবস্থিত হওয়াতে, চারপাশের তুষারক্ষেত্র থেকে তুষার গলে জল এখানে আসে ৷

পরে জেনেছি ১২,০০০ ফুটের ওপরে বর্তমানে এ অঞ্চলে জলাভাবে কোনও বসতি নেই ৷ বর্ষার সময় কিছু লোক ভেড়া চরাতে আসে বটে কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ঝরনাগুলি শুকিয়ে যাওয়ায় কোনও স্থায়ী বসতি বা গ্রাম নেই ৷ পথে দুজন শেরপা ছেলের সঙ্গে দেখা হল-তারা কাঠমান্ডু কতদিনের পথ আমাদের কুলিদের কাছে জানতে চাইল ৷ এখানে মাইলটাইলের কোনও কথা নেই, অমুক গ্রামে কদিনে যাওয়া যাবে, তাই হিসাব করে এরা পথ চলে ৷ তারা জানল দু দিনের মধ্যে তারা কাঠমান্ডু পৌঁছতে পারবে ৷ এরা আসছে গোঁসাইকুণ্ডের পাশের গ্রাম থেকে ৷ এদিন চলার পথে পাঁচ ভাই বলে একটা জায়গা পার হতে হল ৷ এমন খারাপ রাস্তার কথা কল্পনা করা যায় না ৷ কেউ যেন রসিকতা করে এ নামটি দিয়েছে! পাঁচ ভাই আর কিছু নয় পথ পাঁচবার এক মাইল করে নেমেছে, মাঝের শিলাগুলি নরম বলে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে, সুতরাং প্রত্যেকবারই আবার এক মাইল উঠতে হয়েছে ৷ আমাদের দম ফুরিয়ে যাবার জোগাড় ৷ দুপুরে একটা প্রকাণ্ড পাহাড়ের সিঁড়ির ধাপে বসে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে কুলিরা রান্না করে খেয়েছে ৷ আমি যথারীতি চিঁড়ে খেয়েছি ৷ আমার সঙ্গিনীর Gastric pain-এর জন্য অনবরত বমি হচ্ছে ৷ ওষুধ দিয়েছি ৷ তরল পানীয় দিয়ে কিছুতেই তা বন্ধ করা যাচ্ছে না ৷ অথচ না চলে উপায় নেই ৷ ১৩-১৪,০০০ ফুট ওপরে এসেছি ৷ এরপর আর লোকালয় তো দূরের কথা, একটা মেষপালকদের অস্থায়ী আস্তানা অবধি নেই ৷ বিকেলের দিকে পথ-ভানজেং বলে একটি অর্ধগুহার কাছে এলাম ৷ মাথার ওপর বেশ ছাদের মতো আছে, তিনদিক খোলা-বেশ রাজসিংহাসনের মতো-কিন্তু জল কাছাকাছি নেই বলে আরও একটু এগিয়ে ওই ধরনের একটা পাথুরে আচ্ছাদন জোগাড় করা গেল ৷ সেখানে মাটির তলা থেকে স্বল্প ধারায় জল আসছে ৷ সেদিন বিকেল থেকেই আমাদের বয়ঃজ্যেষ্ঠ কুলি জিৎ বাহাদুর একটু যেন আনমনা ৷ কারও অপেক্ষায় আছে ব্যাপারটা শেষে বোঝা গেল ৷ সন্ধে ৬টার মধ্যে খাওয়া সেরে শোবার ব্যবস্থা করছি, এমন সময় দেশি গাদা বন্দুক নিয়ে এক শিকারির আগমন ৷ কী শিকার করবে? আমাদের নয়তো? এখন বেশ উঁচু পাহাড়ের গায়ে এসে পড়েছি, চতুর্দিকে পর্বতশ্রেণী ৷ মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে নিচের উপত্যকায় ৷ জনপ্রাণী নেই, আমরা দুজন ও তিনজন তিব্বতী যাদের সঙ্গে পরিচয় এই যাত্রাপথেই যেটুকু ৷ বয়ঃকনিষ্ঠ কুলি বরাবরই চুপচাপ ৷ হিন্দি বোঝে না-তার সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই ৷ কোনওমতে তিনদিক খোলা সেই গুহার মধ্যে লাঠি পুঁতে প্লাস্টিকের চাদর টাঙিয়ে ঘর বানানো গেল ৷ মাঝখানে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হল ৷ রাত ৯টায় বৃষ্টি শুরু হল-কী বজ্রপাতের শব্দ ৷ অগ্নিকুণ্ডের অপরদিকে ওরা তিনজন-শুয়ে ৷ যত রাত বাড়তে লাগল শীতের প্রকোপ তত বেশি ৷ ১,৫০০ ফুট ওপরে এসেছি ৷ সেদিন আমার সঙ্গিনীর কিছুই খাওয়া হয়নি ৷ আমারও চিন্তায় ভাবনায় শরীর ভালো নেই ৷ যদি কিছু অঘটন ঘটে, কুলিরা যদি মেরে ফেলে টাকা পয়সার জন্য! তবে কী হবে? মিনতির অভিভাবকরাই বা কী বলবেন এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য! হঠাৎ রাত ১টার সময় ঠান্ডায় তন্দ্রা ভেঙে কী সব শুনতে পেলাম ৷ Sleeping bag থেকে মুখ তুলে দেখি-কুলিরা উঠে বসেছে ৷ তাদেরও শীত করছে ৷ কথাবার্তা শুরু করলাম-৫ দিনের দিন পৌঁছে, চিনি লামাকে 8 পাঠাতে হবে এসব অনেক আজগুবি কথা বললাম ৷ ওরা নাকি ভূত দেখে এখানে মাঝে মাঝে ৷ যাহোক আগুন জ্বালিয়ে আবার শোওয়া গেল ৷ এসব ক্রিয়াকলাপের মধ্যে রাতে ঘুম হল না ৷ বলাই বাহুল্য ৷ চতুর্থ দিনের রাতের অভিজ্ঞতা অতীব ক্লান্তিকর বিভ্রান্তিকর তো বটেই ৷ পরদিন সূর্যকুণ্ড-সবচাইতে উঁচু বিন্দুতে উঠতে হবে ও নেমে গোঁসাইকুণ্ডে যেতে হবে-রাতে বিশ্রামের কত দরকার ছিল! তা আর হল না ৷

পরদিন সকালে উঠেই রওনা-আজ গোঁসাইকুণ্ডে পৌঁছে রাতে সেখানে থাকব ৷ কিন্তু আজকের পথের কঠিনতা ও উচ্চতা সবচাইতে বেশি-১৭,০০০ ফুট উচ্চে উঠতে হবে ৷ একটু এগিয়েই দেখা গেল মাঝের পাহাড়টা ভেঙে গেছে, বেশ খানিকটা ভাঙা পাথরের ওপর দিয়ে নামতে হবে ও আবার ততখানি উঠতে হবে-প্রাণান্তকর পরিশ্রম! খানিকটা ওঠার পর সামনে এক অপরূপ মহিমময় দৃশ্য দেখলাম ৷ বহু উঁচু থেকে এক জলস্রোত সূর্য কিরণে স্নাত হয়ে প্রবলবেগে ও শব্দে নিচে নেমে আসছে আর তার কর্ণবিদারী শব্দে কোনও কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না ৷ ক্রমশ পথ উঁচুতে যাচ্ছে ৷ রাস্তা বলে কোনও জিনিস নেই, কেবল পর্বত ও গড়িয়ে পড়া পাথরের খণ্ড, পাঁচ-ছটা করে ধারালো কোণ বার করে চলবার গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে ৷ আমার কাপড় ‘হকি সুর’ কোনা কেটে গেল এমন সাংঘাতিক এসব প্রস্তরখণ্ডের তীক্ষ্ণতা ৷ বেলা ৯-১০টা নাগাদ সামনের পর্বতস্তূপ থেকে একদল লোক আসছেন দেখা গেল ৷ একজন মোহন্ত বা ধর্মগুরু কয়েকজন স্ত্রীলোক ও কয়েকজন শিষ্য তাঁদের জিনিসপত্র লোটা কম্বল নিয়ে সকালে গোঁসাইকুণ্ড থেকে রওনা দিয়েছেন ৷ আসামের কোনও এক আশ্রমের সাধুবাবা, শিষ্যশিষ্যা নিয়ে তীর্থভ্রমণে বেরিয়েছেন ৷ বেশ আনন্দেই আছেন ৷ আমাদের কাছে, পথঘাট জেনে নিলেন, অতজন রাতে কোথায় থাকবেন-সে বিষয়েও নিশ্চিত হয়ে নিলেন-কারণ সেদিন গ্রাম পাওয়া মুশকিল ৷ আমাদের পথের হদিশ দিয়ে দিলেন-সূর্যকুণ্ডের পর মাটি বরফে ঢাকা ৷ সে জায়গাটি সাবধানে যেতে হবে-তাও কুলিদের বিশেষভাবে বলে দিলেন ৷ বেশ হৃষ্টপুষ্ট শরীর, ধুতি চাদর ও সাধারণ পাম্পসু পরে এক হাতে ছাতা অন্য হাতে একটা পোঁটলা নিয়ে অনায়াসে ও অক্লেশে নামছেন ৷ তাঁদের সহজভাব দেখে নিজেদেরও আত্মবিশ্বাস ফিরে এল ৷

দূরে বরফ বিছানো সবুজ ভূমি-আমাদের কুলি ও পথপ্রদর্শক জানাল, ওই বরফের পাশেই সূর্যকুণ্ড, তার পাশ দিয়েই পথ নেমে গেছে গোঁসাইকুণ্ডে ৷ বেলা ১২টার মধ্যে পৌঁছে যাব ৷ কিন্তু কী সাংঘাতিক চড়াই, পদে পদে অসমান তীক্ষ্ণ পাথরগুলি খোঁচা মারছে ৷ ওপরে উঠছি, আর পিছনে ফিরে দেখছি মিনতি আসতে পারছে কিনা ৷ সে গত দুদিন কিছুই খায়নি ৷ দেখছি ধীরে ধীরে আসছে সে ৷ একজন কুলিকে তার সঙ্গে থাকতে বললাম ৷ কুলিরা খিদে সহ্য করতে পারে না-১১টার সময়েই রান্না করে খেয়ে নিল ৷ তাদের রান্না খাওয়ার ব্যাপারটা খুবই সহজ ৷ আটা গুলে গরম জলে ঢেলে দিল, একটু লবণ দিল-বেশ একটা বড় আটার কাই হয়ে গেল ৷ আর আলু ও পেঁয়াজ বা শাক যাই জোটে, তা তেল মশলা দিয়ে একটা ঝোল বানিয়ে নিল ৷ আমরা ডাল বা ডিম দিয়ে দেখেছি, সেগুলি খায় বটে কিন্তু তা ওদের পক্ষে বিলাস সামগ্রী বা শখের খাওয়া ৷ বাসন মেলে তো ভালো, না হলে এক গুচ্ছ পাতা পেড়ে ধুয়ে নিয়ে তার ওপর ওই কাই রাখবে ৷ ঝোল দিয়ে ৪-৫ মিনিটের মধ্যে ওইসব উদরস্থ করে পেট ভরাবে, তবে তারা চলতে পারবে ৷ খালি পেটে তাদের চলা হয় না ৷ কখনও কখনও আটার কাইটা শক্ত করে নাড়ু বানিয়ে নেয়-পথে যদি খিদে পায়, তবে তা খায় ৷ চা খায় বটে, তাও আমরা খাই বলে ৷ এত গরিব এরা এর বেশি খাবার জোটানো অসম্ভব ৷ দিবারাত্র পরিশ্রম করে বলতে হয় ৷ এই যে আমাদের কুলিগিরি করে ১০০-১৫০ টাকা পাবে-তাতেই এদের অনেক কিছু বাড়তি জিনিস কেনা হবে ৷ সেইজন্যই এসেছে এরা ৷

তাদের খাওয়া হলেও আমার সেদিন খাওয়া হল না ৷ খানিকটা আমার সঙ্গিনীর না খাওয়ার জন্য ৷ ভাবছি, আজকের দিনটা ভালোয় ভালোয় কাটলে হয় ৷ আর কখনও এমন দুঃসাহস করব না ৷ বেশ উঁচুতে পৌঁছে দেখি মিনতি বা অন্য কুলি কাউকেই দেখা যাচ্ছে না ৷ এত শ্রান্ত যে আবার পিছিয়ে নেমে কী হয়েছে দেখব,-সে শক্তিটুকুও নেই ৷ এখনও দুরন্ত চড়াই ওঠা বাকি ৷ কাজেই অপেক্ষা করতে লাগলাম ৷ দেখি নিচের কুলি ওপরের কুলিকে ডাকছে ৷ তারও খানিক পরে দেখি তারা মিনতিকে পিঠে করে নিয়ে আসছে ৷ বেলা তখন ২টো বেজে গেছে ৷ সূর্যকুণ্ডে ৪টের মধ্যে না পৌঁছতে পারলে গোঁসাইকুণ্ডে পৌঁছনো অসম্ভব ৷ কাছে এসে তারা আমার কাছ থেকে চাদর চেয়ে নিয়ে মিনতিকে পিঠের সঙ্গে বাঁধল-অপর কুলি দুজনের মাল বহন করল ৷ এইভাবে মাল ও মানুষকে বদলাবদলি করে নিয়ে তারা যাত্রাপথ পাড়ি দিল ৷ নিচে গিয়ে অন্য লোক আনা যায় কিনা বলাতে, তারা জানাল তাতে দেরি হবে ৷ আমি শুধু জানালাম টাকা পয়সার জন্য ভাবনা কোরনা-এখন নিরাপদে পৌঁছে দাও ৷ এইভাবে বেলা ৪টের সময় সূর্যকুণ্ডের পাশে অর্থাৎ সর্বোচ্চ বিন্দুতে (১৬,৭৪৬ ফুট) পৌঁছলাম ৷ বিকেল হলেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় এসব অঞ্চল ৷ তবু তার মধ্যেই দেখলাম চারপাশের বরফ গড়িয়ে এসে সূর্যকুণ্ডের টলটলে স্ফটিকের মতো জলে পড়ছে ৷ তার পাশ দিয়েই পথ গেছে নিচে ৷ উঁচু থেকে গোঁসাইকুণ্ড হ্রদটি বেশ দেখা যাচ্ছে ৷ নিচু পথে এসে মিনতি জানাল সে এখন স্বচ্ছন্দে যেতে পারবে-সুতরাং সেই তুষারাবৃত প্রান্তর দিয়ে দুজনে নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে চললাম ৷ বাস্তবিক তার মনোবলের তুলনা হয় না ৷ আর মাইল দুই গেলেই গোঁসাইকুণ্ড-(১৫,০০০ ফুট) দূরে দেখা যাচ্ছে ৷ সারাদিন রৌদ্রতাপে বরফ গলে গলে জল হয়ে গেছে, পা কেবলই ডুবে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি হাঁটা যাচ্ছে না ৷ অবশেষে বেশ অন্ধকার নেমে এল, আমরাও হ্রদের পাশে সরকারি চটিতে (যা তখনও অর্ধসমাপ্ত) এসে পৌঁছলাম ৷ সঙ্গে সঙ্গে আবার মুষলধারে বৃষ্টি, অর্ধেক ছাদে কাঠ লাগানো হয়েছে, বাকি অর্ধেকে তখনও লাগানো হয়নি ৷ মাস দুয়েক পরে এখানকার মেলা ও তীর্থযাত্রীদের জন্য এসব চটি তৈরি হচ্ছে ৷ সেদিন রান্নার ভার সম্পূর্ণ কুলিদের ওপর দিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম ৷ আমরা ছাড়াও সরকারি ঠিকাদার নিযুক্ত সাত জন কুলি সেখানে ছিল-সুতরাং ওই অর্ধসমাপ্ত ঘরে গাদাগাদি করে কোনওমতে রাত কাটানো, খাওয়া, সবই করতে হল ৷ মিনতি জানাল, তার হাঁটতে বেশি দেরি হচ্ছিল, সেজন্য সেদিন যদি গোঁসাইকুণ্ডে না পৌঁছতে পারি তাই সে নিজেই তাকে পিঠে তুলে নিতে প্রস্তাব করেছিল বিশেষ কোনও অসুস্থতার জন্য নয় ৷ রাতে শুয়ে ভাবছি-যে আগের রাতে এই কুলিদেরই সন্দেহ করেছি, এমনই আমরা সভ্য ও শিক্ষিত জাতি ৷ ওরা না থাকলে কী হত?

এই অঞ্চলের তিনটি শৃঙ্গের মধ্যে ল্যাংটাং শিখরটি আগেই ছেড়ে এসেছি, সকালের পরিষ্কার আলোয় গোঁসাইথান শৃঙ্গকে হ্রদের জলে দেখা গেল ৷ হ্রদের আকার প্রায় ত্রিকোণ-স্বচ্ছ ঠান্ডা জল-কয়েক দিকের কিনারায় পাথরখণ্ডগুলি সিঁদুর দিয়ে লেপা ৷ ফুল বেলপাতা পড়ে রয়েছে, কিন্তু সেই বিরাট প্রস্তরখণ্ডটি দেখলাম না ৷ তীরের পাথরগুলিকে লিঙ্গের মতো করে তৈরি করেছে বোঝা যায় ৷ আমরাও শ্রদ্ধা ভক্তি জানিয়ে স্নান করে রওনা দিলাম ৷ এরই এক কোণ থেকে জল চুঁয়ে চুঁয়ে নিচের হ্রদে পড়ছে ৷ এখানকার কুণ্ডগুলির মধ্যে দুধকুণ্ড, সরস্বতীকুণ্ড, ভৈরবকুণ্ড ও সর্বশেষ নাগকুণ্ড প্রভৃতি বিখ্যাত-প্রত্যেকটি পাশাপাশি কিন্তু সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে অবস্থিত ৷

কুণ্ডগুলির সবগুলিতে যেতে পারলে হয়তো দোরজে লাকপার চেহারা দেখা যেত-কিন্তু কীভাবে যাওয়া যায় জানি না ৷ এরপরে ফেরার পালা ৷ এবার শুধু উতরাই ৷ কিন্তু গোঁসাইকুণ্ড বেশ নিচে হওয়াতে বেশ খানিকটা পাথুরে পথ ধরে উঠতে হল ৷ বাঁদিকে বিভিন্ন কুণ্ডগুলিকে দেখতে দেখতে চললাম-ক্রমশ পর্বতের ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে নিচের দিক অদৃশ্য হয়ে গেল ৷ এবার নামার পালা ৷ ত্রিশূলীবাজার ৫৩ মাইল দূরে ৷ সেখান থেকে বাসে ৪৬ মাইল যেতে হবে কাঠমান্ডুতে ৷ এখানকার পথটি উঁচুতে হলেও সমতল ৷ সুতরাং এ পথের কোনও বিশেষ বর্ণনা দেব না ৷ পথে অজস্র ফুল, বনের সমারোহ, লোকজন বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে, কাঠ কাটছে ৷ এর সবচেয়ে কাছের গ্রাম ধুনজে ৷ প্রায় ১৭ মাইল ৷ অতদূরে যাওয়া কুলিদের অনিচ্ছা ৷ বৃষ্টিপাত হওয়া সত্বেও একদিনেই ধুনজে গ্রামে পৌঁছতে হবে সেইরকম ইচ্ছা ছিল ৷ এইভাবে বিকেলে চা খেয়ে হাঁটা শুরু করলাম-দূরে পাহাড়ের নিচে বর্ধিষ্ণু ধুনজে গ্রামটিকে দেখা যাচ্ছে ৷ আমরা যে পাহাড়ের দিকে আছি তার মাঝে ত্রিশূলীগণ্ডকী ৷ তার ওপারে পর্বতের সানুদেশে ধুনজে গ্রামটিকে ছবির মতো দেখা যাচ্ছে ৷ দ্রুত চলতে আরম্ভ করলাম ৷ হঠাৎ উঁচু জায়গাটি শেষ হয়ে গেল-সুগন্ধি পুষ্পযুক্ত বনরাজিমালার মধ্য দিয়ে একটি উতরাই পথ নিচে নামতে শুরু করল ৷ কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, জায়গাটি একটু ভিজে কিন্তু অসংখ্য ফুলের ও লাতার সুগন্ধে জায়গাটি ভরপুর-টুপটাপ করে জলকণার সঙ্গে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, ধাপে ধাপে কেবলই নেমে যাচ্ছি ৷ কুলিরা দ্রুত চলেছে, কারণ সেদিন তাদের খাওয়া হয়নি ৷ বেলা ৫টা বেজে গেছে ৷ ঘণ্টাখানেক শুধু নেমেই চলেছি চারদিকে গাছপালা লতার আবেষ্টনীতে অন্ধকার কিছুই প্রায় দেখা যায় না-মাঝে মাঝে সাড়া দিয়ে চলেছি ৷ প্রায় ২-৩ হাজার ফুট একনাগাড়ে নেমে একটা সমভূমির মতো জায়গায় পড়লাম-ডানদিকে ধুনজে গ্রাম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ৷ বেশ বড় গ্রাম ৷ অনেক দোতলা বাড়িও দেখা যাচ্ছে ৷ কিন্তু কুলিরা বাঁদিকের পর্বতটা দেখিয়ে জানাল সমস্ত পাহাড়টি ঘুরে ঘুরে নেমে যেতে হবে ৷ সেখানে ত্রিশূলীগণ্ডকীর ওপর পুল পার হয়ে মাইল খানেক গিয়ে ধুনজে গ্রাম ৷ এরা এদিককার লোক নয় তাই খুবই অচেনা অজানা এদের ৷ একটু বিরক্তও হয়েছে একদিনে এতটা আসার জন্য ৷ যাহোক আমরা ভাবলাম উতরাই পথে নিশ্চয়ই নেমে যেতে পারব ৷ কিন্তু একটা পুরো পাহাড় কেটে বনপথ, কেবল ঘুরে ঘুরে চলেছি ৷ ৭টা বেজে যায়-কাঠ সংগ্রহকারীরা চলে গেছে ৷ গভীর বন-শুধু পথের রেখা দেখে চলেছি ৷ মাঝে মাঝে পথে ঝরনা বয়ে যাচ্ছে-অন্ধকার নেমে আসছে ৷ কোথা থেকে কুলিদের ডাকাডাকি শুনতে পাচ্ছি ৷ একেক জায়গায় পথ হারিয়ে ফেলছি কারণ ২-৩টে পথ বার হয়ে গেছে ৷ অবশেষে তাদের গলার স্বর শুনে দেখি পথের ডানদিকে পার্বত্য আচ্ছাদন দেখে ও জলের ধারা দেখে, সেইখানেই রাতের আস্তানা পেতেছে ৷ তাদের কুকরি দিয়ে জঙ্গল সাফ করে একটা বেদি মতো জায়গায় আমাদের বিছানা পেতেছে, অন্যদিকে পাথর দিয়ে উনুন বানিয়ে নিজেদের খাবার তৈরি করেছে ৷ শীত একেবারেই করছে না ৷ তাতেই বুঝলাম অনেকখানি নেমে এসেছি ৷ সেদিন খুব ভালো করে পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া হল, আমার সঙ্গিনীর শরীর সুস্থ হয়েছে ৷ অনেক রাত জেগে মোমবাতি জ্বেলে আমাদের ডায়েরি লেখা হল ৷ মাঝরাতে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠলে পর অদ্ভুত অনুভূতিতে মনটা ভরে গেল ৷ অস্পষ্ট আলোয় ধুনজে গ্রাম দূরে দেখা যাচ্ছে ৷ রাতের নৈঃশব্দে বহু নিচে প্রবহমানা ত্রিশূলীগণ্ডকীর কলধ্বনি শোনা যাচ্ছে ৷ ঘন জঙ্গল ৷ চারদিকে জনপ্রাণী নেই ৷ আমরা যেন মর্ত্যলোক ছেড়ে অপার্থিব স্বর্গলোকের পথে আরোহণ করেছি ৷ মনটা আনন্দে ভরা-এক বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে সেদিন প্রায় না ঘুমিয়েই কাটালাম ৷

পরদিন ভোরে আলো ফুটতেই পাহাড়িপথ বেয়ে নামছি ৷ মাঝে মাঝে পথ এত সঙ্কীর্ণ যে রাতে আসা বোধহয় সম্ভবই হত না ৷ নিচে খরস্রোতা নদী, যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারি কারণ কোনও রেলিং বা ওই ধরনের কিছুই নেই ৷ এইভাবে সকাল ৮টা নাগাদ ত্রিশূলীগণ্ডকীর জলস্রোতের কাছে এসে পৌঁছলাম ৷ কী স্বচ্ছ ও পরিষ্কার জলের ধারা! তখনই স্নান করে ফেলে ভেড়াওয়ালাদের আস্তানা থেকে চা খেয়ে পুল পার হয়ে ওপারে গেলাম ৷ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পরিবার এখানে আছে, তাছাড়া নদীর জলকে বিভিন্ন দিকে খেতের দিকে নেওয়া হয়েছে ৷ এখান থেকে আবার চড়াই পথ ১,৫০০ ফুটের মতো উঠতে হল ৷ খেতের মধ্যে চাষ হচ্ছে, পাশেই বাড়ি ৷ এইভাবে ২ মাইল পথ উঠে ধুনজে গ্রামে পৌঁছলাম ৷ বেশ বড় গ্রাম, পুলিশ ফাঁড়ি আছে, বড় গেট সামনে ৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়, দোকান ঘর কিছুরই অভাব নেই-অনেক লোক থাকে ৷ নেপালের পুরনো গ্রামগুলির মতোই ঘনবসতি ৷ নেই শুধু মমতা ৷ কিন্তু না পাওয়া গেল দুধ বা জল অথবা বিশ্রাম করার আস্তানা ৷ পুলিশরা স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে ক্যারাম খেলছে ৷ তাদের জানালাম একটা পঞ্চায়েতের ঘর খুলে দিতে, কোনও উত্তর পেলাম না ৷ এমন ব্যবহার পাব আশা করিনি ৷ অতএব সেদিন দুপুরে যে বিশ্রাম ভোগ করব মনে করেছিলাম তা আর হল না ৷ স্বাগতম লেখা gate দিয়ে বার হয়ে পথের ধারে ঝরনার পাশে বসে আমাদের রান্না খাওয়া সারা হল ৷ দিন পরিষ্কার-নিচে নামছি, বৃষ্টির উৎপাত নেই, শীতও কম ৷ বেলা ১২টা নাগাদ আবার রওনা হওয়া গেল ৷ কঞ্চি খেতের পাশ দিয়ে পথ, মাঝে মাঝে লোকজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে ৷ প্রতি গ্রামেই ঢোকার পথে মণিপাথর অর্থাৎ পাথরে ‘ওম মণি পদ্মে হুঁ’ কথাটি তিব্বতীতে খোদাই করা আছে ৷ গুরু রিম্পোচে বা বুদ্ধ অবতারের কোনও মূর্তি কুলুঙ্গীতে রাখা আছে ৷ কোথাও রাস্তার মাঝে দড়ি দিয়ে আটকানো-মুরগির পালক ইত্যাদি ছড়ানো ৷ মুরগি বলি দিয়ে পূজা হয় ৷ অন্তত ভূত প্রেত যাতে না ঢোকে গ্রামে তার জন্য এই ব্যবস্থা ৷ সেদিন সন্ধেবেলা বেশ বড় একটি গ্রাম ধারাং পৌঁছলাম ৷ এসব গ্রামে স্কুল পঞ্চায়েত ঘর প্রভৃতি আছে ৷ কুলিদের এক বন্ধু জুটল, তার ঘরে ভালো খেতে পাওয়া যাবে ও জলও কাছে বলে সেইখানেই থাকা গেল ৷

এতদিন গ্রাম্য লোকদের ব্যবহার একটু rough বা অমার্জিত হলেও তারা সরল ও অকপট ছিল-ধুনজে গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী লোকদের ব্যবহার কি বিপরীত? আমরা মুক্ত প্রকৃতির কোলে বসে বিশ্রাম ও রান্নাখাওয়া সারলাম ৷ দিন পরিষ্কার ৷ মৃদু মন্দ বাতাস চারদিকে ঢেউ খেলানো উপত্যকা, গাছে গাছে সাদা অর্কিড ও অন্যান্য নাম না জানা ফুল ও পাখির কূজনে আমরা মুগ্ধ ৷ মানুষের চাইতে প্রকৃতির আশ্রয়ই ঢের শ্রেয় ৷ যাইহোক এবার পথে শাক সবজি, আলু ও ডিম কিছুটা পাওয়া গেল ৷ ধারাং গ্রাম থেকে বেত্রবতী কতদূর কেউ বলতে পারে না ৷ কিন্তু আমরা ঠিক করেছিলাম তিনদিনে ত্রিশূলীবাজার পৌঁছব-সেটা এখান থেকে প্রায় ২৮ মাইল ৷ তিনদিনে না হোক রওনা তো হওয়া যাক যতদিনে পৌঁছই ৷ ধারাং গ্রাম থেকে সীমান্তের রসুয়াগড় ঘাটি ৪ দিনের পথ-আগে নেপাল ও তিব্বতের ওই সীমানা দিয়ে লবণ ও পশম আদানপ্রদান হত-বর্তমানে ওইসব পথ বন্ধ ৷ ভোরে ধারাং থেকে রওনা হয়ে একটা মস্ত পাথরের খণ্ডকে বেষ্টন করে এক পাকদণ্ডী বেয়ে পথকে অনেক সংক্ষেপ করা গেল ৷ দুপুরে এক জায়গায় থামলাম খাবার জন্য ৷ প্রখর রোদ চারদিকে, এ সময়ে খুবই জলকষ্ট এখানে ৷ চটির লোকেরা কিছুটা সাহায্য করতে সেখানেই দ্বিপ্রাহরিক আহার করা গেল ৷ জায়গাটির নাম মণি গ্রাম, সেখান থেকে বেত্রবতী মাত্র তিন মাইল ৷ এখানে বেত্রবতী নদী এসে ত্রিশূলীগণ্ডকীর সঙ্গে মিশেছে ৷ উতরাই পথ হলে কী হবে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় না-পাথুরে পথ, বৃষ্টিতে মাটি পাথর ধসে পড়েছে ৷ মাটির রং গৈরিক ৷ তবে এদিকের চড়াই বা উতরাই দুয়েরই Slope ধীরে ধীরে হয়েছে, কাঠমান্ডু থেকে অত খাড়া পথ নয় ৷ দূর থেকে বেত্রবতী, ভৈঁসে, ত্রিশূলীবাজার-ছবির মতো দেখা যাচ্ছে ৷ বেত্রবতী বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম ৷ স্কুল, পঞ্চায়েত সবই আছে, একজন শিক্ষক জানালেন, সমতল পথ, তাই আজই চেষ্টা করলে ত্রিশূলীবাজার পৌঁছতে পারি ৷ অতএব তাড়াতাড়ি পুল পার হয়ে ভৈঁসে গ্রামে আসা গেল ৷ তখন বিকেল ৪টে ৷ মণি গ্রামের মতো এটাও বিভিন্ন উপত্যকা থেকে আসার কেন্দ্রস্থল ৷ কাঠের ব্যবসাই প্রধান-অন্য দোকানপাটও আছে ৷ এখান থেকে ত্রিশূলী প্রজেক্টের কাজকর্ম দেখা গেল ৷ নদীকে বাঁধ দিয়ে লকগেট দিয়ে জলকে একদিকে প্রবাহিত করা হয়েছে-সুন্দর পরিষ্কার পথ ৷ কুলিদের একদিন রোজ মারা যাবে, তাদের প্রবল আপত্তি যেতে ৷ আমরা তবু আধা অন্ধকারে রওনা দিলাম ৷ বেশ অন্ধকারে ধীরে ধীরে গিয়েও আমরা সন্ধে ৭টার সময় ত্রিশূলীবাজারের রাস্তায় এসে পড়লাম ৷ এখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং নানাবিধ ক্রিয়াকলাপ হচ্ছে ভারতের অর্থানুকূল্যে ৷ এখানে আমেরিকান মিশনের কর্মীরা স্কুল হাসপাতাল চালাচ্ছেন ৷ রাস্তার নিচে পুরনো ত্রিশূলীবাজারে এসে পৌঁছলাম ৷ এ জায়গাটি পুরনো গ্রাম যেমন নেপালি গ্রাম হয় সেরকম ৷ বাজারের দুপাশেই বাড়ি ৷ সেখানেই ব্যবসায়ীরা পরিবারসমেত থাকেন ৷ প্রাচীন নেওয়ার জাতিই এখানকার বেশিরভাগ ব্যবসা পরিচালনা করেন ৷ হঠাৎ তামাকের আড়তে দুই-তিনজন জন মুসলমানের সঙ্গেও দেখা হল যা নাকি নেপালে বিরল ৷ দুয়েক জন তিব্বতী হোটেল খুলেছেন ৷ কোথায় থাকব জিজ্ঞেস করাতে সকলে একবাক্যে জানাল রামমন্দিরে বা স্কুলে ৷ বিদ্যালয়ের পাশেই রামমন্দির-জায়গাটি এত সুন্দর যে সেখানেই থাকা মনস্থ করলাম ৷ পূজারীকে বলতেই মন্দিরের প্রাঙ্গণটি ছেড়ে দিলেন, খাবার জল ইত্যাদি দিয়ে জানালেন-যেখানে ইচ্ছা থাক ৷ মন্দিরের সামনে প্রশস্ত নদীতীর পরিষ্কার ৷ বট গাছগুলির নিচে প্রশস্ত বাঁধানো বেদি ৷ পাশে ত্রিশূলীগণ্ডকী বিপুল বেগে বয়ে যাচ্ছে ৷ বাঁধানো ঘাট নেই বটে কিন্তু বিরাট পাথর ফেলে ফেলে ঘাট করা হয়েছে ৷ নদীর অপর দিকে উঁচু পর্বত ৷ আমাদের প্রধান কুলি জিৎ বাহাদুর জানাল, ওই পাহাড়ের ওপর দিয়েই কাল ভোরে ওরা বাড়ি চলে যাবে-গোঁসাইকুণ্ডের রাস্তায় ৷ পায়ে ফোস্কা পড়ছে, সে ব্যথা ভুলে নদীর ধারে অনেকক্ষণ বসে রইলাম-সেখান থেকে উঠতে আর মন চায় না ৷ এটাই কী সেই পুরাকালের মুনিদের আশ্রম! রাতে বাঁধানো বেদিতেই শোব ঠিক করা হল ৷ শুকনো পাতার ছড়াছড়ি, তাই দিয়ে রান্না করা হল ৷ মন্দিরের কাছে ফিরে গিয়ে দেখি অসংখ্য জুঁই ও বেল ফুলের গন্ধে সমস্ত প্রাঙ্গণ সুরভিত, এত ফুলের গাছ একসঙ্গে আর কখনও দেখিনি ৷ কখন যেন সেই ফুলের গন্ধের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়লাম ৷ ভোরে উঠে দেখি পূজারিণীরা ফুল তুলে মালা গেঁথে ফেলেছেন-তবুও গাছের ফুলের সংখ্যা কমেনি ৷ এছাড়া জবা, রক্তকরবী ইত্যাদি অন্যান্য ফুলের গাছও আছে ৷ যাত্রীরা এসে বৌদ্ধ প্রথায় একটি স্তম্ভে ফুল চড়াচ্ছেন ও মন্দির পরিক্রমা করে ভেতরে ঢুকছেন ৷ ভেতরে রামসীতার মূর্তি, খুব বেশি প্রাচীন নয় ৷ পূজারী নেপালি তবে হিন্দু ৷ নেপালে রামের মন্দির খুবই বিরল ৷ তবে পরে দেখলাম হিন্দু, বৌদ্ধ সকলেই এ মন্দিরে সমানভাবে পূজা দিচ্ছেন ৷ বাজারে গিয়ে টাকা ভাঙাতে গেলাম ৷ শনিবার নেপালে বন্ধ-অতএব টাকা ভাঙাতে কিছু জিনিসপত্র কাপড় ও নেপালি চাদর কেনা হল ৷ তখনই ‘করুণাময়’ মূর্তির (বুদ্ধের এক অবতার) পূজা হচ্ছে দেখতে পেলাম ৷ অন্যান্য মন্দিরের মতো এখানেও একজন পূজারী ও পূজারিণী (বৌদ্ধ) ৷ দুটি আলাদা পাত্রে পূজার সামগ্রী রয়েছে ৷ এত রকমের উপাচার (অন্তত ২০-২৫ রকম) যে গোনা যায় না ৷ বৌদ্ধ বা লামাধর্মের বজ্র, কাপড়, ঘি, দই, তেল, ফুল, সলতে, অসংখ্য পাথর, শঙ্খ-সবই রয়েছে ৷ করুণাময় মূর্তিতে বুদ্ধমূর্তির ছাপ, বেশ প্রাচীন মূর্তি ৷ নেপালে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের সহাবস্থান ঘটেছে সর্বত্র, কেউ কাউকে সরাতে পারেনি-কিন্তু একটি অন্যটিকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করেছে, এখানেও তার নিদর্শন দেখা গেল ৷ বাজারটি ওপর থেকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে ৷ যেখানে সব চাইতে নিচু, সেখানেই বাসরাস্তা শুরু ৷ সকালে যখন বাজারে যাচ্ছি ওপর থেকে নদীর জল এনে ফেলা হচ্ছে-ওপর থেকে নিচে জলের স্রোত আসছে, চলাই মুশকিল ৷ বেশ ঘিঞ্জি শহর ৷ কুলিরা টাকা ও বকশিস নিয়ে চলে গেল-আমরাও বাসরাস্তার দিকে পা বাড়ালাম ৷ ৪৬ মাইল, তবে কাঠমান্ডু ৷ তারপর কলকাতা ৷ ২১ মে রওনা হয়ে জুনের ৩-৪ তারিখেই ফিরেছি ৷ যেতে ৫ দিন, নামতে ৩ দিন-মোট ৮ দিন লেগেছে ৷ ৩৬ মাইল ও ৫২ মাইল পথ হেঁটেছি ৷ আসার সময় অত তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে পায়ে ফোস্কা পড়েছিল বটে, তবে মনে হয় আমরা যে পথে এসেছি সেটাই ভালো ৷ প্রথমে উঠে পরে নামাই ক্লান্তির দিক থেকে সুবিধাজনক ৷ রুক্ষ কর্কশ পথ ৷ কিন্তু সেই কঠোর দৃশ্যাবলীকেও মাধুর্যমণ্ডিত করেছে ত্রিশূলীগণ্ডকী ৷ বিশেষ করে রামমন্দিরের পাশের সেই অপূর্ব স্থানটি অত ক্লান্তির পরে মনোরম বিশ্রামস্থল হয়ে উঠেছিল ৷

ভ্রমণ মে ও জুন, ২০০২

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন