অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
আমি এঘর থেকেই গান-বাজনা শুনতে পাচ্ছি, হাসিখুশি গলার স্বরগুলো অন্ধকারে ভেসে আসছে, রাতের ঠান্ডা বাতাসকে উষ্ণ করে তুলছে ৷ ওরা সবাই পুরিম পার্টি করছে ৷ পুরিম উৎসব ইজরায়েলে খুব জরুরি, বসন্ত উৎসবের মতো ৷ আজ ১৫ মার্চ ১৯৯৫, এই সময়টা বসন্ত উৎসবের ঋতু সারা বিশ্বজুড়ে-আমার দেশেও এখন হোলি হ্যায় ৷ পুরিম উৎসবকে এরা কার্নিভ্যালের রূপ দিতে চেষ্টা করে ৷ করলে কী হবে, ইজরায়েল তো ব্রাজিল নয় ৷ এখানকার মানুষ অতিরিক্ত সিরিয়াস প্রকৃতির ৷ অমন হালকা পলকা ফাজলামি এদের ধাতে নেই ৷ নাচতে ভালোবাসে এরা (হাভা না গিলা, হাভা না গিলা)-নাচতে ভালোবাসলেও এরা ঠিক ছন্দের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিতে পারে না, এলিয়ে দিতে পারে না ৷ ইজরায়েলীরা স্বভাবতই অধিজ্য জাতি, বড্ড টেনস মানুষ এরা ৷ পুরিম পার্টির জন্য যতই আজগুবি সাজপোশাক করুক, মাথায় শিং পরুক, আর রং মেখে সং সাজুক, এদের পুরিম উৎসবের নাচগানের মধ্যে কোথাও ব্রাজিলের গা ছেড়ে দেওয়া আহ্লাদ নেই, বাঁধন ছাড়া উন্মাদনা নেই ৷ লাতিন আমেরিকার আমুদেপনা, অমন ফুর্তিবাজি জুডাইয়াতে আশাই করা যায় না ৷ জাতটা নিজেদের চিরকাল পরিস্থিতির শিকার হিসাবে দেখে এসেছে ৷ গোটা জাতটা যুগযুগান্তের যন্ত্রণার স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরে, আঁকড়ে রেখে, নিজেদের বংশ-পরিচয় গড়ে নিয়েছে ৷ প্রাকপুরাণিক স্তর থেকেই এই জাতি দুঃখ-যন্ত্রণা-ব্যথা-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে স্থিতি খুঁজে খুঁজে বেড়িয়েছে ৷ কাফকা একবার মিলেনাকে চিঠি লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মিলেনা, তুমি জানো না, ইহুদিরা কিছুই ছেড়ে দিতে পারে না, হাতের কাছে যা কিছু পায় আঁকড়ে ধরতে চায়, সেটা হয়তো একটা পাউরুটির টুকরোও হতে পারে ৷’ ইহুদিরা কখনও ভুলে যায় না যে তারা বঞ্চিত হয়েছে, বিতাড়িত হয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে ৷ তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও তীব্রভাবে রয়েছে এই মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ৷
পুরিম উৎসবের দিনটি কীসের স্মরণে? ওইদিনে ঈশ্বর ইহুদিদের বলেছিলেন, চরম দুর্দিনেও তারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে না, ঈশ্বর সদা সর্বদা তাদের রক্ষা করবেন ৷
পুরিম উৎসব কীসের স্মারক? পুরিম ইহুদি-বিরোধী দুষ্টু মানুষদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি ইহুদিদের বিজয় উৎসব ৷
দোলপূর্ণিমার পূর্ণশশী আর মাত্র দু-রাত দূরে ৷ আমি বসে রয়েছি ৷ ত্রয়োদশীর চাঁদ মাথার ওপরে নিয়ে, নেতানিয়া গ্রামে, ইজরায়েলের মাটিতে ৷ ভূমধ্য সমুদ্রের ঢেউ আছড়াচ্ছে ঠিক পাঁচিলটার ওপারেই ৷ এখানে সবচেয়ে বড় পাওয়া বোধহয় এই, যে এরা কেউ আমাকে চেনে না ৷ আমিও তাদের জানি না ৷ সবই নতুন করে শুরু হবার অপেক্ষায় ৷
প্রথমত, এসেছি জেরুসালেমে ‘মিশকেনট শা আনানিম’-এর আয়োজিত আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে ৷ সে এক অপার আনন্দময় দশটি দিন ৷ সেখান থেকে এসেছি ‘উলপান আকিভা’-তে, হিব্রুভাষা ও সংস্কৃতি শিখতে ৷ বড়দের হিব্রু শিক্ষার স্কুলগুলিকে বলে উলপান ৷ একটা ফেলোশিপ পেয়েছি এক টার্মের জন্য ৷ তার বেশি থাকতেও পারব না এযাত্রায়, দেশে কাজ আছে ৷
প্রথম পাঠ শেষ ৷ কিছু কিছু হিব্রু শিখেছি ৷ অক্ষরগুলি, কিছু শব্দ, কিছু ধাতুরূপ ৷ কিছু কিছু শব্দ আমি এর মধ্যে লিখতে পড়তে বলতে পারছি ৷ এরা আশ্চর্য আমার তৎপরতা দেখে ৷ আমি বুঝতে পারছি না এতে এত আশ্চর্য হবার কী আছে ৷ সারা জীবন ধরে একাধিক ভাষা শিখতে চেষ্টা করেছি বলেই হয়তো একটা কাজ চালানোর কায়দা রপ্ত করতে পেরে যাই ৷ অন্য অন্য যাঁরা আমার সঙ্গে পড়েন, তাঁরা দুই জাতের ৷ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রুশ উদ্বাস্তু ৷ তাঁরা শিক্ষার আলো দেখেননি-তাঁরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান বিদেশি ভাষা শিখতে ৷ আর কিছু শখের বাস্তুছাড়া-নব-বসতি পাততে এসেছেন মার্কিন দেশ থেকে স্বামী-স্ত্রী মিলে-রিটায়ার করার পরে ৷ ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের দেশে রেখে ৷ বয়স্ক হলেও তাঁরা অনেক বেশি মনোযোগী, দ্রুত শিখছেন ৷ একটি জাপানি ছাত্র, দুটি আরব ছাত্র, একজন সুইস ডিপ্লোম্যাট, এক সুইস বৃদ্ধা-এই আরব ছাত্ররা এই প্রথম এসেছে ৷ এদের নিয়ে শ্রীমতী শুলামিথ কার্টজ নেলসন, এই উলপানের প্রাণলক্ষ্মী, ছিয়াশি বছর বয়স্কা প্রতিষ্ঠাত্রী অধ্যক্ষা, যারপরনাই গর্বিত ৷ ১৯৪৮-এ ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই শুলামিথ এখানে এসেছেন সুইজারল্যান্ড থেকে ৷ আরব-ইহুদি মৈত্রী তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ৷
আমার শিক্ষায়িত্রী তরুণী নাটাশা নিজে একজন রুশ উদ্বাস্তু, নীল চোখ, সোনালি চুল, যাদের ইজরায়েলে বলে আশকেমাজি, আর আমাদের গানের শিক্ষক আপারেম ইয়েমেনের ইহুদি-কালো চুল, বাদামী চামড়া, সাফারডিক ইহুদি যাদের বলা হয় ৷ ইজরায়েলে বর্ণবৈষম্য নেই বলা যায় না, রীতিমতোই আছে ৷ আশকেমাজিরাই শক্তিমান ৷ উন্নতি হয় তাদেরই-নীল চোখ সোনালি চুলেদের ৷ বাদামী চামড়ার ইহুদিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুচ্চারিত হিসেব আছে ৷ এখানে ইহিওগিয়াম ইহুদিরাও আছে ৷ কালো রং, আর অত্যন্ত শ্রীমন্ত তাদের রূপ ৷ তাদের পোশাক-আশাকও আলাদা, তাদের সাংস্কৃতিক জগৎও ভিন্ন ৷ তাদেরও ইজরায়েল ঠিক দুহাত মেলে গ্রহণ করেনি ৷ যেমন করেনি ভারতীয় ইহুদিদেরও ৷ ‘বেন ইজরায়েল’ জাতি যখন পশ্চিম ভারতের উপকূল থেকে ইজরায়েলে উপস্থিত হয়েছিল, তাদের ইহুদি বলে স্বীকারই করা হয়নি অনেক বছর ৷ ইজরায়েল নতুন দেশ বটে, কিন্তু পুরনো সংস্কৃতি, আর সনাতন ধর্ম নিয়ে চলে যারা, তারা অচেনাদের সন্দেহ করে, নতুনদের চট করে ঠাঁই করে দিতে চায় না ৷ ইজরায়েলও চায়নি ৷
আমাকে এরা ফেলোশিপ দিয়েছে, যাতে হিব্রু ভাষা শিখে আমি হিব্রু কবিতা পড়তে পারি ৷ আমি হিব্রু কবিতা পড়লে ইজরায়েলের বিদেশ মন্ত্রকের কী লাভ হবে কে জানে? আমি ইজরায়েলের সংস্কৃতি বিষয়ে জানতে উৎসুক ৷ আমার আগ্রহের কারণ বাইবেল থেকে শুরু করে আউশাভৎস পর্যন্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস ৷ এই সেই পবিত্র ভূমি, সেই দুধ আর মধুর দেশ, যার জন্য এত অশ্রুজল, এত রক্তপাত, এত সহস্র বৎসর যাবৎ চলে আসছে ৷ এই সেই জাতি যারা নাকি ঈশ্বরের স্বনির্বাচিত জাতি ৷ যাদের ঈশ্বর প্রচণ্ড জ্বালা, যন্ত্রণা, ব্যথা, বঞ্চনা অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন, কেবল নিজের কাছাকাছি রাখবেন বলে, কোলের মাঝখানটিতে টেনে নেবেন বলে ৷ তাই এত স্থিতিহীন, বেদনাতাড়িত জীবনেও তারাই শত শত বছর ধরে পশ্চিম পৃথিবীর মস্তিষ্কটাকে নিজেদের মুঠোয় রেখেছে ৷ বুদ্ধিজীবী মহলটা প্রায় ইহুদিদেরই নিজস্ব এলাকা ৷
নিশি রাত, ভরা চাঁদ ৷ বাতাসে নুনের গন্ধ ৷ নোনা হাওয়ার সঙ্গে জলের সঙ্গে বেলাভূমির অনাদ্যন্ত প্রণয়লীলার মৃদুগম্ভীর শব্দ ৷ একটু চেষ্টা করলেই এই গ্রিন বিচ হোটেলের পাঁচিলের ওপাশে সবুজ, নীল, কালো স্তরে স্তরে রং পাল্টানো সমুদ্রে সাদা ফেনার বুটিদার অনন্ত ডুরে শাড়ির লুটিয়ে পড়ে থাকা দেখা যায় ৷ হিব্রুর মতো প্রাচীন ভাষা শেখার পক্ষে আদর্শ ঠাঁই, যেখানে জল আর আকাশ এত কাছাকাছি, ‘মাইম’ আর ‘শামাইম’ ৷ মরুময় ভূমির দেশ ৷ চরাচরব্যাপী বালুকার দেশ, উটের, আর তৃষ্ণার, আর বেদুইনের আর ইহুদির, প্যালেস্টিনিয়ান আর ইজরায়েলি-দুই যুধ্যমান ভাইয়ের দেশ ৷ এবং কিছু ধর্মমুগ্ধ খ্রিস্টানের ৷ এখানে তুমি কী করছ নবনীতা? কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? গঙ্গা-যমুনার পলিমাটি দিয়ে তৈরি মেয়ে তুমি ৷ তোমার ‘পবিত্র ভূমি’ সেখানে ৷ তুমি এখানে কেন? এ তো তোমার শিকড় সন্ধানের যাত্রা নয়?
তা নয়, কিন্তু এ আমার স্বপ্ন-সন্ধানের যাত্রা তো বটে ৷ যিশুর দেশে আসা! যেখানে পথে-ঘাটে কিংবদন্তীরা সত্য হয়ে আছে ৷ গ্যালিলিও, সাগর, মাউন্ট কারমেল, বেথলেহেম, জেরুসালেম, জর্ডন নদী, নাজারেথ-এইসব নাম যেখানে ভূগোলের মানচিত্রে জীবন্ত হয়ে পার্থিব মানুষে ভরে আছে ৷ সেখানে হাটবাজার বসছে, স্কুল-কলেজে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা, সিনেমা হলে ছবি চলছে ৷ পুজোপাঠ হচ্ছে সিনাগগে, গির্জেতে, অফিসে যাচ্ছে মানুষ, হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটছে শোঁ শোঁ ৷ প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় বাস্তব হয়ে উঠেছে প্রাক-ইতিহাস ৷ ম্যাপে দাগ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে প্রত্যেকটা প্রবাদপ্রতিম শহর, গ্রাম, নদী, পাহাড়, হ্রদ ৷ বাইবেলের মানুষদের নামে রাস্তাঘাট যেখানে-কিংবদন্তী যে দেশে জীবন্ত ৷ এক্সটিক? হ্যাঁ, আমার পক্ষে তাই ৷ অতি-দুর্লভ, অতি-অভিনব অভিজ্ঞতা ৷ যেন অন্য কারও স্বপ্নের মধ্যে পদচারণা করছি ৷ যেন অন্য কারও স্বপ্নে ভাগ বসাচ্ছি ৷ ইজরায়েলের রাষ্ট্রনায়ক হেরৎসেল বলেছিলেন-‘বাসনা যদি গভীর হয়, তাহলে কিংবদন্তী আর কিংবদন্তী থাকে না ৷’ বাসনা গভীর ছিল, তাই স্বপ্নের দেশ ইজরায়েল জন্ম নিয়েছিল ১৯৪৮-এ ৷ স্বপ্ন সত্য হয়েছিল ইহুদি মানুষের ৷ পুরনো একটি ভাষাকে আধুনিক মানুষেরা প্রত্যহের ভাষা করে তুলেছে সেই স্বপ্ন ৷
সংস্কৃত ভাষার ঝকঝকে বিজ্ঞানসম্মত পটভূমি থেকে এসে কিন্তু যাই বলো হিব্রু ভাষাটাকে যেন অসংস্কৃত, অবৈজ্ঞানিক, আদিম বলে মনে হয় ৷ যে ভাষা ব্যাকরণ নয়, ব্যবহার নির্ভর ৷ ভাষাটা মুখে মুখে জানা থাকলে, তবেই হিব্রুর লিখিত ভাষায় অধিকার সহজ হয়, অর্থবোধ সহজ হয় ৷ হিব্রু শেখার পক্ষে কল্পনা এবং পূর্ব পরিচয়-দুটোই জরুরি ৷ ইংরিজির মতো অবৈজ্ঞানিক ভাষাকেও হিব্রুর চেয়ে পরিশীলিত মনে হয় ৷ ইংরিজির তো কোনও মাথামুণ্ডু নেই, P-U-T পুট, B-U-T বাট, SO, SEW, SOW সবই সো, DRAFT/ DRAUGHT দুটোই ড্রাফট-যথেষ্ট গোলমেলে বানান ৷ আমাদের ণত্ব-ষত্ব তার চেয়ে ভালো ৷ তার একটা নিয়ম আছে, প্রণালী আছে ৷ তবু ইংরিজিতে পাঁচটা ভাওয়েল আছে, অন্তত কিছু স্বরবর্ণ তো আছে! হিব্রুতে নেই ৷ স্বরবর্ণগুলো সব কল্পনা করে নিতে হবে ৷ একই বর্ণ, অবস্থাবিশেষে স্বরবর্ণও হতে পারে ৷ ব্যঞ্জনবর্ণও হতে পারে ৷ বিভিন্ন অবস্থানে তার বিভিন্ন ব্যবহার ৷ কিন্তু শব্দরূপ, ধাতুরূপ বেশ স্পষ্ট ৷ প্রণালীবদ্ধ ৷ যে আরবের সঙ্গে ইহুদির এত অবন্ধুতা, সেই আরবি ভাষাতেও শুনেছি স্বরবর্ণ নিয়ে এই একই সমস্যা আছে ৷
অনেককাল পরে আমি আবার হস্টেলে আছি ৷ ছোট ঘর, অ্যাটাচড বাথ ৷ জানলা নেই ৷ সেজন্যই বোধহয় কেমন একটা জেলখানা-জেলখানা ভাব ৷ সরু খাট ৷ একটি চেয়ার ৷ দেওয়াল আলমারি ৷ আশ্রমের যেমন কঠোর জীবনযাত্রা হওয়া উচিত ৷ একটা পড়ার টেবিল পর্যন্ত নেই, গালচেবিহীন, ঠান্ডা পাথরের মেঝেটা রাতে বরফ হয়ে থাকে ৷ বাইরে বাগানে টেবিল চেয়ার আছে ৷ সেখান বসে পড়াশোনা করতে পারি ৷ রঙিন ফুলে ঘেরা, সুগন্ধে ভারী বাতাসে, দিনের বেলায় পড়াশোনা করতে দিব্যি ভালোই লাগে ৷ কিন্তু সূয্যি ডুবে গেলে, গাঁয়ের মানুষের মতো লেখাপড়া বন্ধ ৷ পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায় ৷ সূর্য ডুবলে সমুদ্রও ডুবে যায় ৷ কিন্তু সমুদ্র একমুহূর্তও আমাদের ভুলে থাকে না, পরিত্যাগ করে না আমাকে-শ্রবণে তার নিত্য অধিষ্ঠান ৷
সমুদ্রের সঙ্গে প্রথম দেখা ইজরায়েলে পা দিয়েই ৷ তেল আভিভের উপকণ্ঠে ছোট্ট শহর হের্ৎসলিয়া পিটুয়াক ৷ তার সমুদ্রতীরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে একটা এবড়ো-খেবড়ো বাড়ি ৷ অবিকল মৌচাকের মতো বাড়িটা ৷ মৌচাকের মতো একটা একটা করে যেন তার কোটরগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ শরীরে যেমন করে কোষ বৃদ্ধি পায় ৷ আশ্চর্য স্থাপত্য এই বাড়িটার ৷ সমুদ্রতীরের সরকারি পাহাড় আর বালিতে জবরদখল করে একটু একটু করে একটা বাসস্থান গড়ে নিয়েছে পাগল যুবকটি, গুহা, কিংবা বাসা, কেল্লা কিংবা প্রাসাদ বলা যায় তাকে ৷ তার মধ্যে নানারকমের পাখপাখালি, জন্তু-জানোয়ার নিয়ে সে মানুষটি থাকে ৷ তার একটি মানুষী সঙ্গিনীও আছে ৷ ভোরবেলা ছটার সময় সে কাচা কাপড় মেলে দিচ্ছে পাথরে ৷ একটা দরজা-খোলা খাঁচাতে অনেক পাখির কলকাকলি ৷ এখানে সেখানে নানা রকমের কুকুর, ছানাপোনা নিয়ে বেড়ালগিন্নি ৷ প্রাসাদ? না মন্দির? গুহা? না বাসা? কেল্লা? না লাইটহাউস? না মৌচাক? হনলুলুর বিচের কোনও ফ্যান্সি রেস্তোরাঁও হতে পারত ৷ সরকার তাকে তুলে দেননি ৷ যত রাজ্যের ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে এনে, রাজ্যের অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা যত্ন করে তুলে এনে এই সুন্দর বাসস্থলটি গড়েছে পাগল শিল্পী ছেলেটি ৷ প্রধানত ব্যবহার করেছে প্রকৃতিকেই ৷ দুটি একটি দোর-জানলা শুধু মানুষী সভ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে ৷ যা দিয়ে মানুষ প্রকৃতি থেকে নিজেকে আলাদা করে নেয় ৷ একজনের থেকে আরেকজনকে আলাদা করে, নিজের নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করে, সেই জিনিস হল দোর-জানলা ৷ ওদের কি ইলেক্ট্রিসিটি আছে? ওদের দরজায় কি খিল আছে? ছিটকিনি? তালাচাবি? ওই বাড়িতে শঙ্খ ঝিনুকের ছড়াছড়ি ৷ ইংরিজিতে গেঁড়ি ও গুগলি, শঙ্খ, ঝিনুক সবকিছুরই একটা নাম: শেলস, খোলস ৷ নামটা ভালো নয় ৷ আমরা কি সুন্দর প্রত্যেককে আলাদা আলাদা নামে ডেকে আপনার জন করে নিই! ওই সমুদ্রতীর থেকে আমি সুন্দর সুন্দর ঝিনুক আর শঙ্খ কুড়িয়ে এনেছি ৷ আমার ঘরটাকে সাজিয়েছি ৷ একটি সাদা রঙের কচুরিপানার ফুলগাছও আছে আমার ঘরে ৷ লীলাখের দেওয়া ৷ সাদা রঙের হায়াসিনথ-কেমন সোনার পাথরবাটির মতো! হায়াসিনথ তো একটা রঙের নাম ৷ কচুরিপানা ফুলের রং ৷ সুদূর ইজরায়েলে এসে টবের মধ্যে কচুরিপানাকে পোষ-মানা ফুলগাছ হিসাবে দেখতে পেলাম ৷ এভাবে ওকে কখনও দেখব ভাবিনি ৷ সুশ্রী টবের মধ্যে, দুটি সুন্দর পাতার মাঝখানে একটি শুভ্র কলিকা হয়ে কোনওদিন আমার ঘর আলো করে থাকবে কচুরিপানা, কে ভেবেছিল? মৃদু সুগন্ধও আছে ৷ সাদা ফুলের যেমন থাকা উচিত ৷ সাদা ফুলের নাম হায়াসিনথ ৷
ইজরায়েলি প্রাতরাশের টেবিল কাঁচা সব্জিতে, ফলেতে ঝলমল করে ৷ এ এক নতুন রকমের অভিজ্ঞতা ৷ ব্রেকফাস্টে স্যালাড খায় এরা ৷ অন্য কোথাও এটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না ৷
নানারকমের চিজ, দশ-বারো ধরনের শাকসব্জি, বিনস বরবটির স্যালাড, তিন-চার রকমের ফলের রস, দুধ, কফি, চা ৷ কালো রুটি, ব্রাউন রুটি ৷ ইজরায়েলের রুটিটা খুব ভালো ৷ ডিমসেদ্ধ থাকে ৷ কোলড কাটসও কিছু থাকে মাংসের, হ্যাম জাতীয় ৷ কিন্তু এরা প্রধানত শাকাহারী, যা দেখছি ৷ ডিনারেও স্যালাড খাওয়ারই চল বেশি ৷ প্রধান খাওয়াটা হচ্ছে মধ্যাহ্নভোজন ৷ ওটাই বড় করে খাওয়া হয় ৷ সেদিন হের্ৎসলিয়া পিটুয়াক-এর সমুদ্রতীরে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রাতরাশ করেছিলাম ৷ সেই ছোট রেস্তোরাঁতেও প্রাতরাশের বিপুল সম্ভার দেখে আমি তো অবাক! বাইরে বসে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি জলের কিনারা বেয়ে ভিজে বালির ওপরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাচ্ছে একটি মানুষ ৷ তার পিছনে পিছনে ছুটে যাচ্ছে দুটি সাদা ঘোড়া ৷ ওদের পিঠে কোনও সওয়ারি নেই ৷ যেন স্বপ্নের মতো মনে হল ৷ যতদূর দৃষ্টি গেল ঘোড়াগুলি ছুটছে ৷ সমুদ্রতীরে জল ঘেঁসে শেষপর্যন্ত বিন্দু হয়ে আকাশে মিশে গেল ৷ দৃশ্যটা আমাকে অনেক কিছু মনে পড়িয়ে ছিল ৷ ‘রাইডার্স টু দ্য সী’-সিঞ্জের নাটক মনে পড়ল ৷ শিল্পী চিরিকোর ছবি মনে পড়ল ৷ আর মনে পড়ল ১৯৭৯-এ দেখা দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরে কামার্গের বুনো সাদা ঘোড়ার দল ৷ জল ছিটিয়ে তাদের আধা-সমুদ্রে আধা-বালিতে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য ৷ ঠিক স্বপ্নের মতো ৷ কে ছিল ওই ঘোড়সওয়ার? দূরে সমুদ্রের মাঝখানে একটিমাত্র জাহাজ স্থির হয়ে ৷ নোঙর করা জাহাজ, সে শুধুই ভাসছিল, দুলছিল, ভেসে যাচ্ছিল না কোথাও ৷ ইজরায়েলে পা দিয়ে আমার প্রথম সূর্যোদয় এই হের্ৎসলিয়া পিটুয়াক-এর সমুদ্রতীরেই ৷ ভোর চারটেয় প্লেন নেমেছে ৷ লীলাখ প্রথমেই নিয়ে এসেছিল সমুদ্রে ৷ ইজরায়েলে সূর্যোদয় দেখাতে ৷ গুড মর্নিং ইজরায়েল! বোকের তোভ, ইজরায়েল! এই সবে যাত্রা শুরু!
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন