চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

চন্দ্রভাগা নদীর সৃষ্টি হয়েছে চন্দ্র ও ভাগা-এই দুই ধারার মিলনে ৷ চন্দ্র নদীর উৎপত্তি হয়েছে চন্দ্রতাল থেকে ৷ এরপর স্পিতি উপত্যকায় প্রবাহিত হয়ে ভাগা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে তাণ্ডিতে ৷ উত্তরে লাদাখ সীমান্তে বারালাচা পাসের ঠিক পাশে সূর্যতাল ৷ ভাগা নদীর জন্ম এই সূর্যতাল থেকেই ৷

আগস্টের মাঝামাঝি ৷ ভোর ছটায় মানালি থেকে সমস্ত মালপত্র রুকস্যাক নিয়ে চড়ে বসলাম দুটো মারুতি ভ্যানে ৷ আমাদের যাত্রার প্রথমদিনের লক্ষ্য দারচা ৷ গাড়ি আস্তে আস্তে রডোডেনড্রন ও পাইনের জঙ্গল পিছনে রেখে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের গা বেয়ে রোটাং পাসের দিকে এগিয়ে চলল ৷ ওপর থেকে দেখা যায়, পিছনের ফেলে আসা সবুজ প্রান্তরের মাঝে বয়ে চলেছে সঙ্কীর্ণ বিয়াস নদী ৷ দুধারে উঁচু পাহাড় ৷ নীল আকাশ ৷ তারই মাঝে তুলোর মতো ভেসে চলেছে সাদা-সাদা মেঘ ৷ সব পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি অজানা সুন্দরের টানে ৷ রোটাং পাস অতিক্রম করে হাজির হলাম লাহুল উপত্যকার খোকসার গ্রামে ৷ সেখানে দুপুরের আহার সেরে চন্দ্র নদীর ধার ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল কেলংয়ের পথে ৷ বেশ কিছুটা এগনোর পর দেখলাম চন্দ্র নদী প্রবল গতিতে আছড়ে পড়ছে অন্য একটা নদীর বুকে ৷ এই নদীটাই সূর্যতাল থেকে আগত ভাগা নদী ৷ জায়গাটার নাম তাণ্ডি ৷ বস্তুত এখান থেকেই চন্দ্রভাগার জন্ম ৷ এই তাণ্ডি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমবাহিনী হয়ে চন্দ্রভাগা কাশ্মীর উপত্যকায় প্রবেশ করেছে ৷ সেখানে এর নাম চেনাব ৷ এখান থেকে একটা বাসরাস্তা চন্দ্রভাগাকে অনুসরণ করে বাঁদিকে চলে গেছে উদয়পুরের বা উদেপুরের দিকে ৷ আর ডানদিকের রাস্তাটা কেলং হয়ে চলে গেছে দারচায় ৷ গাড়ি ওই পথেই এগিয়ে চলল ৷

অবশেষে বিকেল পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছই দারচায় ৷ অপূর্ব সৌন্দর্য দারচার ৷ চারপাশ রংবেরঙের পাহাড়ে ঘেরা ৷ দূরে কোনও কোনও পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যায় বরফের আস্তরণ ৷ তারই মাঝে একটা স্বল্পপরিসর সমতলভূমি ৷ একধার দিয়ে কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলেছে জাঁসকার নদী ৷ পাশেই ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ ৷ সেখানেই আমরা প্রথম তাঁবু খাটাই ৷

এখান থেকে একজন গাইড-কাম-পোর্টার ও মালবহনের জন্য দুটো খচ্চর সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা হয় ৷ ঠিক হয় গাইড খচ্চর দুটোকে সঙ্গে নিয়ে আগামীকাল ভোরে বারালাচার উদ্দেশে রওনা দেবে এবং একদিন পর সেখানে হাজির হবে ৷ পরদিন বেলা দশটা নাগাদ এসে দাঁড়াই রাস্তার ধারে বাস ধরার আশায় ৷ সামনে পাহাড়ের ডানদিকের রাস্তাটা লে-সড়ক ৷ আর বাঁদিক দিয়ে একটা ট্রেকিং রুট সিংগলা পাস অতিক্রম করে চলে গেছে পাদমে ৷ এই পথেই কয়েক কিলোমিটার দূরে শেলং টপকো ৷ ১৯৮৮ সালে এখানেই কলকাতার ছয়জন তরুণ ট্রেকার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন ৷ প্রায় ঘণ্টাদেড়েক অপেক্ষা করেও কোনও বাসের সন্ধান পেলাম না ৷ ফলে আমরা চড়ে বসলাম একটা কাঠবোঝাই ট্রাকে ৷ দশ হাজার টাকার পরিবহন খরচে আড়াই হাজার টাকা মূল্যের কাঠ নিয়ে ট্রাকটি চলেছে লাদাখে ৷ আসছে হিমালয়ের মাণ্ডি থেকে ৷

সামনেই বিশাল পাহাড় ৷ গাড়ি আস্তে-আস্তে ঘুরে ঘুরে মানালি-লে সড়ক ধরে ওই পাহাড়ের মাথায় উঠতে লাগল ৷ এই সড়ক পৃথিবীর সর্বোচ্চ দীর্ঘ হাইওয়ে ৷ এই পথেই হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন ও আরও অনেক পর্যটক তিব্বত থেকে ভারতে এসেছিলেন ৷ এই রাস্তাটা বড়ই রুক্ষ ও বিপদসঙ্কুল ৷ বাঁদিকে পাহাড়ের ঢালে গাড়ি যাওয়ার মতো সরু রাস্তা ৷ আর ডানদিকে কয়েক হাজার ফুট নিচ দিয়ে প্রবল গতিতে এগিয়ে চলেছে ভাগা নদী ৷ তাকালে ভয় লাগে ৷

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর বেলা তিনটে নাগাদ গাড়ি এসে থামে তিব্বত প্রভাবিত প্যাটসিওতে ৷ তখন একটা বিরাট মিলিটারি কনভয় লে থেকে এদিকে এগিয়ে আসছিল ৷ ফলে প্যাটসিওতে আমাদের দীর্ঘসময় আটকে থাকতে হয় ৷

প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পরে আমরা আবার চড়ে বসলাম ট্রাকে ৷ গাড়ি বারালাচার দিকে এগিয়ে চলল ৷ শুরু হল অল্প-অল্প বরফপাত ৷ ট্রাকের মাথায় কোনও আচ্ছাদন নেই ৷ কাঠের ওপর বসারও উপায় নেই ৷ পাহাড়ি পথ ৷ গাড়ি সবসময় উঁচু-নিচু পাথরে হোঁচট খাচ্ছে, আর অসমান কাঠের গুঁড়ির কোণাগুলো এসে বিঁধছে আমাদের গায়ে ৷ তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই ৷ গাড়ি যত ওপরে উঠতে লাগল, ঠান্ডাও তত বাড়তে লাগল ৷ একসময় মনে হল হাত দুটো সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছে ৷ গাড়ির রডটা পর্যন্ত ধরে থাকার শক্তি নেই ৷

গাড়ি যখন বারালাচার ওপর পৌঁছয় তখন রাত হয়ে গেছে ৷ চারদিক অন্ধকার ঘুটঘুট করছে ৷ পাঁচ-ছ ফুট দূরের জিনিসও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না ৷ প্রচণ্ড বৃষ্টি ৷ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবল গতিতে ধেয়ে চলেছে তুষারঝড় ৷ হাড়কাঁপানো ঠান্ডা ৷ ট্রাক থেকে নেমে ওই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে তাঁবু খাটানো প্রায় অসম্ভব ৷ এমন সময় দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু দেখে মনে সাহস জাগে ৷ ওইদিকে একটু এগিয়েই চোখে পড়ে একটা ছোট্ট টিনের বাড়ি ৷ ট্রাকের মালিক ও ড্রাইভারের সাহায্যে সমস্ত মালপত্র নিয়ে ওই বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে জানতে পারি, এটা পি ডাব্লু ডির কর্মীদের আবাসস্থল ৷ আমরা ওখানে রাতটুকু থাকার অনুমতি চাওয়ার আগেই তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ৷ মুগ্ধ হয়ে যাই তাদের ব্যবহারে ৷

সারারাত ধরে চলতে থাকে মুষলধারে বৃষ্টি ৷ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে ৷ মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যদেব মাঝে মাঝে উঁকি মারছেন ৷ বারালাচার রূপ উপভোগ করার এটাই প্রকৃষ্ট সময় ৷ তাই চালাঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম ৷

বারালাচা পাসের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় ৷ চারধারে বিশাল বিশাল পাহাড় ৷ তারা যেন আকাশকে স্পর্শ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ৷ সব পাহাড়ের চূড়াগুলোর ওপর বিছানো রয়েছে শ্বেতশুভ্র বরফের আস্তরণ ৷ সকালের সূর্যের কোমল আলোয় সেগুলি আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে ৷ মাঝখানে বিরাট একটা তৃণভূমি ৷ আর সমস্ত ভূমিটা সবুজ মোটা পাহাড়ি ঘাসে ঢাকা ৷ লে-সড়ক ধরে পিছনের দিকে এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে হাজির হলাম উঁচু পাহাড়ের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা বিরাট জলাশয়ের কোলে ৷ এই জলাশয়েরই নাম সূর্যতাল-ভাগা নদীর উৎস ৷ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই মনোরম ৷ কিন্তু মেঘলা আবহাওয়ায় সূর্যতালের পূর্ণ রূপমহিমাকে উপলব্ধি করতে পারলাম না ৷ দুপুর থেকে প্রকৃতি আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করল ৷ শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি, তুষারঝড় ৷ এই বৃষ্টি মাথায় করে বিকেল পাঁচটা নাগাদ গাইড তার খচ্চরদুটোকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসে হাজির হল ৷ কারণ আগামীকাল এখান থেকে টোপকো গংমা ও টোপকো ইয়ুংমা হয়ে চন্দ্র নদীর উৎস চন্দ্রতালে পৌঁছনোর কথা ৷ কিন্তু প্রবল তুষারঝড় ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য তিনদিন বারালাচার ওই ঘর থেকেই বেরোতে পারলাম না ৷ এরই মধ্যে একটা অশুভ সংবাদে আমরা আরও হতাশ হয়ে পড়লাম ৷ গাইড এসে জানাল, সে তার খচ্চর দুটোকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না ৷ আর এখান থেকে নতুন কোনও পোর্টার বা খচ্চর পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাও নেই ৷ চারদিনের মাথায় পি ডাব্লু ডির কর্মচারীরাও কেলংয়ের পথে ফিরে যাওয়ার আগে আমাদেরও ফিরে যাওয়ার উপদেশ দিল ৷ তাদের ধারণা, প্রকৃতি দুয়েকদিনের মধ্যে আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে এবং প্রবল তুষারঝড়ে সমস্ত পাসটা বরফে ঢেকে যাবে ৷ তখন সামনে এগনো বা পিছনে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়বে ৷ ফলে চন্দ্রতাল যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের ত্যাগ করতে হল ৷ পাঁচদিনের মাথায় আমরা অন্য রুট বাতাল থেকে চন্দ্রতাল-এই পথে যাত্রা করি ৷ এখানে থেকে ট্রাকের পিছনে চড়ে হাজির হই কেলংয়ে ৷ সেখান থেকে চড়ে বসি কাজার বাসে ৷ ছত্রুর কাছাকাছি পৌঁছে গাড়িতে গোলযোগ দেখা দেয় ৷ তখন রাত প্রায় দশটা ৷ অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে ৷ গাড়ির বাইরে ভালো ঠান্ডা ৷ ড্রাইভার আর গাড়ি যাবে না বলে ঘোষণা করল ৷ বাস থেকে নেমে একটা ফাঁকা জায়গায় তাঁবু খাটাব বলে চিন্তা করছি এমন সময় একটা ট্রাক এসে হাজির ৷ সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মালপত্র নিয়ে চড়ে বসলাম মালভর্তি ছোট ট্রাকের পিঠে ৷ রাত বারোটা নাগাদ এসে পৌঁছই বাতালের এক ধাবার দোরগোড়ায় ৷ অনেক ডাকাডাকির পর ধাবার মালিক দরজা খোলে ৷ কিন্তু অনেক অনুরোধ করেও আমরা ওইখানে রাতটুকু থাকার অনুমতি পেলাম না ৷ ফলে বাঁদিকে কিছুটা ওপরে উঠে দেখতে পেলাম দরজা-জানলাহীন পি ডাব্লু ডির একটা ভাঙা বাড়ি ৷ অন্ধকারে মনে হল কারা যেন ঘরগুলো আগেই দখল করে আছে ৷ অগত্যা ওই বাড়ির ফাঁকা বারান্দাতেই আশ্রয় নিতে হয় ৷ অবশ্য রাত একটার সময় ওই বারান্দাই আমাদের কাছে রাজপ্রাসাদ বলে মনে হল ৷

পরদিন সকালে দেখি-এক মনোরম জায়গা বাতাল ৷ যেদিকে তাকাই বিশাল বিশাল পাহাড় ৷ দূরে দেখা যায় হোয়াইট শেল-এর সাদা ধবধবে চূড়াটিকে ৷ সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় ওটা রক্তিম হয়ে উঠেছে ৷ মাঝখান দিয়ে প্রবলগতিতে বয়ে চলেছে চন্দ্র নদী ৷

সামনে চন্দ্র নদীর সেতুটা অতিক্রম করে শুরু হচ্ছে লাহুল ও স্পিতি ডিভিশন ৷ আমরা ব্রিজটা অতিক্রম করে চন্দ্র নদীকে বাঁদিকে রেখে কাজা যাওয়ার বাসরাস্তা ধরে চড়াই ভাঙতে লাগলাম ৷ বেশ কিছুটা হাঁটার পর দেখলাম একটা মোড় থেকে কাজা ও কুনজুম লার রাস্তা ডানদিক দিয়ে ওপরে উঠে গেছে ৷ আর বাঁদিকের রাস্তাটা চন্দ্র নদীর গায়ে গায়ে এগিয়েছে চন্দ্রতালের দিকে ৷

দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়েনি ৷ ঝিরঝির করে অবিরাম বৃষ্টি হয়ে চলেছে ৷ সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ৷ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ৷ ওই বৃষ্টির মধ্যেই আমরা পাহাড়ের ঢালে সরু রাস্তা দিয়ে চন্দ্র নদীর ধার ধরে এগিয়ে চললাম ৷ বেশিরভাগ পথটাই বোল্ডারের ওপর দিয়ে ৷ ঢালু পাহাড়ের গায়ে কোথাও কোথাও চলার পথ খুবই সঙ্কীর্ণ ৷ ঝুরঝুরে আলগা মাটি ৷ একটু অসাবধানতার জন্য দিতে হতে পারে চরম মূল্য ৷ বেশ কিছুটা চলার পর আমরা হাজির হলাম একটা বিরাট ভ্যালিতে ৷ সেখানে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা সুন্দর শেফার্ড হাট ৷ এইরকম সুন্দর হাট সচরাচর দেখা যায় না ৷ মনে হল এস্কিমোদের ইগলুর এটা পাথুরে সংস্করণ ৷ টুকরো-টুকরো স্লেটপাথর একটার পর একটা সাজিয়ে ক্রমে ক্রমে গোলাকার রূপ দেওয়া হয়েছে ৷ ভেতরে স্বল্পপরিসর একটা ঘর ৷ এরমধ্যে কয়েকজন লোক ভালোভাবে থাকতে পারে ৷ মাটিতে বিছানো রয়েছে মোটা ঘাসের আস্তরণ এবং এর ভেতরে ফায়ারপ্লেসও রয়েছে ৷ এই বিশাল মাঠ অতিক্রম করে হাজির হলাম একটা বড় নালার পাশে ৷ ওই ঝরনার ধার ধরে দুটো পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ডানদিকে বেশ কিছুটা চড়া ভেঙে পৌঁছলাম একটা ছোট গ্লেসিয়ারের ওপর ৷ সেখান থেকে সোজা পথে একটা বোল্ডারে ভরা বিশাল মাঠ পার হয়ে প্রবেশ করলাম একটা সবুজ তৃণভূমিতে ৷ এই মাঠের ঘাসগুলো এতই মসৃণ ও নরম, মনে হচ্ছে আমরা কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি ৷ অতঃপর দূর থেকে দেখতে পেলাম রংবেরঙের রুক্ষ পাহাড়গুলির মাঝে শান্ত শীতল একটা সরোবরকে ৷ এই সরোবরটাই আমাদের বহু ঈপ্সিত চন্দ্রতাল-চন্দ্র নদীর উৎস ৷ চন্দ্রতালের রূপ-সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম ৷ ৪,২৭০ মিটার উঁচুতে এইরকম একটা মনোরম হ্রদ যে থাকতে পার, তা আমাদের কল্পনাতীত ৷ চন্দ্রতালের পাশেই রয়েছে একটা সবুজ মসৃণ ঘাসের মাঠ ৷ আমরা ওই সরোবরের একেবারে গা-ঘেঁসে তাঁবু খাটাই ৷ আস্তে আস্তে সূর্যদেব অস্ত যেতে লাগলেন আর তারই রক্তিম আভায় সরোবরটা আরও মায়াবী হয়ে উঠতে লাগল ৷

ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ১১টা ৷ পূর্ণিমার রাত ৷ তাঁবু থেকে বাইরে বেরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ান্বিত হয়ে গেলাম ৷ উপলব্ধি করলাম রাতেও চন্দ্রতালের একটা স্বতন্ত্র রূপ আছে ৷ বসতিহীন, নিস্তব্ধ, রুক্ষ পাহাড়গুলির মাঝে চন্দ্রতালের যে এত মনোরম ও হৃদয়গ্রাহী রূপ লুকিয়ে আছে, তা দিনেরবেলায় কল্পনাই করতে পারিনি ৷ নীল আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করছে অজস্র নাম না-জানা নক্ষত্র ৷ পূর্ণিমার চাঁদের কোমল আলো ছড়িয়ে রয়েছে সারা চন্দ্রতালের ওপর ৷ আর ওই জ্যোৎস্নালোকিত চন্দ্রতালকে মনে হচ্ছে একটা রুপোর থালা ৷

পরদিন ভোরে চন্দ্রতালের রূপ আবার ভিন্ন ৷ রংবেরঙের পাহাড়ে ঘেরা চন্দ্রতাল তখন স্থির, শান্ত ও শীতল ৷ সূর্যদেবের ছোঁয়া তখন এসে পড়েনি লেকের বুকে ৷ দূরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রভাগা পাহাড়গুলি ৷ সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় বরফাচ্ছাদিত চূড়াগুলি ঝলমল করছে ৷ ঘন নীল আকাশ ৷ দিন যত বাড়তে লাগল, চন্দ্রতালের সৌন্দর্যও তত বাড়তে লাগল ৷ অপার বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রতালের অতি স্বচ্ছ জলে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার দূরে দাঁড়ানো পাহাড়গুলোর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে ৷ প্রথমে দেখা গেল, শুধু চূড়াটার সামান্য একটু অংশ ৷ তারপর ওই সামান্য অংশটা আস্তে আস্তে বড় হতে হতে চন্দ্রভাগা পাহাড়গুলোর পূর্ণ প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল তালের বুকে ৷ একসময় দেখলাম হাঁসের মতো কিছু পাহাড়ি পাখি ওই সরোবরে মনের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে ৷ দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে তারা আকাশের দিকে ডানা মেলে দিল ৷

এবার আমাদের ফেরার পালা ৷ মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে চন্দ্রতালকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে বাতালের পথে ফিরে চললাম ৷ পরিচয় মাত্র একদিনের ৷ কিন্তু এই একদিনেই চন্দ্রতালের রূপের প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি যে, তাকে ছেড়ে চলে আসতে মন চাইছে না ৷ তাই বিদায় জানিয়েও বিষণ্ণ মনে বারবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছি ৷

বেলা ১২টা নাগাদ কাজা থেকে আগত বাসে চড়ে বসলাম ৷ গাড়ি চন্দ্র নদীর কোল ঘেঁসে মানালির পথে ফিরে চলল ৷

ভ্রমণ আগস্ট, ১৯৯৪

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন