অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
হিমাচলে পার্বতী উপত্যকায় সার পাসের লক্ষ্যে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম এবছরের জুন মাসে ৷ সার-এর অর্থ কুণ্ড বা তালাও ৷ পাস গিরিবর্ত্ম ৷ এই ১৩,৮০০ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ২৭০ ডিগ্রি কোণ জুড়ে দেখা যায় বরফাবৃত পর্বতমালা ৷ এপথের একেক দিনের সৌন্দর্য একেক রকম ৷ বৈচিত্রময় সুন্দরের আকর্ষণে চেপে বসেছিলাম হিমগিরি এক্সপ্রেসে ৷ প্রায় বত্রিশ ঘণ্টার রেল সফর শেষে আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট ৷ ৩০০০ টাকার চুক্তি টাটা সুমোর সঙ্গে ৷ পৌঁছে দেবে ৩৮৪ কিলোমিটার দূরের কাসোলে ৷ জেলা সদর কুলুর ১০ কিলোমিটার আগে ভুন্টার ৷ বিপাশা নদীর সঙ্গ ছেড়ে পথ ডাইনে ৷ এবার পার্বতী নদীর ধারে ধারে পথ ৷ শিখ তীর্থক্ষেত্র মণিকরণের ৪ কিলোমিটার আগে কাসোল গ্রামে পৌঁছলাম প্রায় রাত নটায় ৷
খরব পেলাম অতিরিক্ত তুষারপাত ও ঝোড়ো আবহাওয়ার জন্য একটি দল সার পাস অতিক্রম করতে না পেরে ফিরে এসেছে আজ ৷ সারা রাতের অবিরাম বৃষ্টি দুশ্চিন্তা বাড়াল ৷ এই ৫২০০ ফুট উচ্চতায় বৃষ্টি মানেই অধিক উচ্চতায় তুষারপাত ৷ তখন ক্যাম্প খাড়া রাখাই মুশকিল ৷ নতুন বরফে পাস দুর্গমতর হবে ৷ আরও চিন্তার কারণ আমাদের দলে আছে পঞ্চাশোর্ধ্ব যুবা, মহিলা ও পাহাড়ে প্রথম এমন পর্বতপ্রেমী ৷
পরদিন সকাল ৷ অবিশ্রান্ত বর্ষণে সব কিছু যেন ঘষা কাচের আড়ালে ৷ পার্বতীর গর্জন আর ফুঁসে ওঠা স্রোত ভয়ঙ্কর ৷ পলি শিটের মোড়কে হাঁটু পর্যন্ত মুড়ে দুরু দুরু বুকে পা বাড়ালাম পথে ৷
গন্তব্য এপথের অন্তিম গ্রাম গ্রহণ ৷ উচ্চতা ৭৭০০ ফুট ৷ দূরত্ব মাত্র ৯ কিলোমিটার ৷ বাসরাস্তা ছেড়ে গ্রহণ নালা পার হয়ে এগিয়ে চলি ৷ আজ আর কাছছাড়া হবে না এই সুন্দর নালাটা ৷ কিন্তু যে শীর্ণকায় গ্রহণ নালা সুবোধ বালকের মতো পার্বতীর বুকে আশ্রয় নিয়েছে এই কাসোলেই, তার আজ এ কী উদ্দামতা ৷ যেন পার্বতীর সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে চাইছে ৷ পাহাড় ধোয়া জলে তার স্বচ্ছ জল কৃষ্ণবর্ণে রূপান্তরিত ৷ উৎপাটিত বৃক্ষকে অবহেলায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ৷ বোল্ডারকে গড়িয়ে নিয়ে চলেছে তীব্র স্রোত ৷ মামুলি এক নালার এ প্রলয়নৃত্য সত্যি দুর্লভ ৷ শুধু তাই নয় অসাধারণ রংবেরঙের ঝরনাধারা এ নালার সঙ্গীসাথী ৷ একটি শীর্ণ জলপ্রপাত প্রায় কয়েকশো ফুট উচ্চতা থেকে দীর্ঘ ওড়নার মতো নেমে এসেছে পাহাড়ের সবুজ কালো গা বেয়ে ৷ দুপাশে পাইন দেওদারের গহীন অরণ্য বর্ষার মেঘ মেখে কেমন এক আবছা জগৎ সৃষ্টি করেছে ৷ এ অভয়ারণ্যের নাম কানাওয়ার ৷ কস্তুরী মৃগ, পাহাড়ি ছাগল, কালো ভালুক ইত্যাদির অভয় আশ্রয় ৷ মোনাল, ফেজ্যান্ট ইত্যাদি পাখিরা ছাড়াও আছে নানারকমের ফুল ও প্রজাপতি ৷ তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বর্ণময় স্নেক লিলি ও ঘিয়ে রঙের নাগমণি ৷ ঠিক যেন সাপের ফণা ৷ কখনও পথের দুপাশে খাড়া রুক্ষ পাহাড়ের পাঁচিল ৷ আবার বাঁকের প্রান্তে উন্মুক্ত আকাশ ৷ দূরে সারিবদ্ধ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ধোঁয়ার মতো মেঘেরা হামাগুড়ি দেয় ৷ কোথাও একফালি সবুজ তৃণক্ষেত্র ৷ সেখানে মস, ফার্ন ও আগাছার দখলে চলে যাওয়া ভগ্নপ্রায় কাঠের ঘর ৷ যেন ডাইনি বুড়ির গোপন ডেরা ৷ তারপর যব, গম, ভুট্টার আলবাঁধা ধাপ ধাপ জমি ৷ মাত্র সাড়ে তিনঘণ্টায় এসে পড়ি গ্রহণ গ্রামের মুঠির মধ্যে ৷
খান চল্লিশেক ঘরের ছোট্ট গ্রাম ৷ কাঠের বরগা ও পাথরের স্তর সাজিয়ে দেওয়াল ৷ স্লেট পাথরের ঢালু চাল ৷ দু-তিনতলা বাড়ির তিনদিক মোড়া প্রশস্ত ঝোলা বারান্দা ৷ হাতে টানা তাঁতে চাদর ও কার্পেট বোনার সরঞ্জাম ৷ অদূরে ছোট্ট সুন্দর চারচালা মন্দির ৷ চারপাশ গভীর সবুজ পাহাড় দিয়ে মোড়া ৷ গ্রামবাসীদের সঙ্গে সহজ সরল বন্ধুত্ব ও আতিথ্যলাভ ৷ রাতে হিমাচলি লোকসঙ্গীত ও নৃত্য ৷
আবার দুঃসংবাদ রেডিওর খবরে ৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কিন্নর ও গাড়োয়ালের বহু স্থানে ৷ এদিকে পরবর্তী ক্যাম্পে যাবার পুল জলের তোড়ে ভেসে গেছে ৷ বিকেলে বৃষ্টিটা থেমেছিল হয়তো দম নেবার জন্য ৷ রাতে আবার শুরু হল ৷
পরদিন উপনিষদের মন্ত্রোচ্চারণে ঘুম ভাঙল ৷ এক সদস্য উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করছেন ৷ আমরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ি ঝলমলে রোদ্দুরে ৷ খবর আসে নালার ওপর গাছের গুঁড়ি পাতা গেছে ৷ তাড়াতাড়ি গোছগাছ ও খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ি পথে ৷ আজকের লক্ষ্য বরাথাচ ৷ উচ্চতা ৮৯০০ ফুট ৷ দূরত্ব ১০ কিলোমিটার ৷
গ্রামকে বিদায় জানিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে ছোট্ট একটা ঝোরা পার হলাম পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ৷ নালার উঁচু পাড়ে বনবিভাগের সাদামাটা বাংলো ৷ বাঁপাশে খাড়া পাহাড়ের ঢাল উঠে গেছে অনেক ওপরে ৷ ডাইনে হলুদ-সবুজ খেতজমি ৷ তারও পরে গ্রহণ নালার গভীর খাত ৷ ওপারের পাহাড় কালচে সবুজ আর ঘন নীলে মাখামাখি ৷ ধোঁয়ার মতো মেঘেরা বসে আছে পাহাড়ের গায়ে ৷ একটু এগোতেই জমির সীমানা শেষ ৷ আর কোনও মানুষের দেখা পাওয়া যাবে না এপথে ৷ একমাত্র যাযাবর পশুপালক হয়তো মিলতে পারে ৷ ঠিকানাবিহীন সুন্দরের দেশের প্রবেশদ্বারে লাল রঙের ফুলের তোরণ আমাদের স্বাগত জানায় ৷ গোলাপের গন্ধভরা বাতাস ৷ পথের ওপর, পাহাড়ের ঢালে কত অসংখ্য ছোট ছোট ফুল ৷ এই বৃষ্টি শেষের ঝলমলে রোদে সবকিছু ঝকঝক করছে ৷
গ্রহণ নালার ধার বরাবর চড়াই উৎরাই পথ ৷ কোথাও দুপাশে খাড়া পাহাড় ৷ পথ ক্রমশ সরু হতে থাকে ৷ একটা বাঁকের পর দেখি পথরেখা পাথরের ফাটলে গিয়ে মিশেছে ৷ তাতে জুতোর ইঞ্চি দুয়েক ধরতে পারে কোনওরকমে ৷ নিচে নালার তীব্র স্রোত ৷ প্রায় ফুট পঞ্চাশেক বিপজ্জনক অংশ সাবধানে পার হয়ে আসি ৷ কানে আসে প্রবল গর্জন ৷ পাহাড়ের ফাঁকে জলীয় বাষ্পের ধূমরাশি ৷ একটা ছোট্ট হালকা রামধনু ভেসে আছে শূন্যে ৷ একটু এগোতেই জলপ্রপাতের পূর্ণ রূপ ধরা দেয় ৷
প্রায় তিরিশ ফুট উচ্চতা থেকে বিপুল জলরাশি সমন্তরাল পথে সবেগে আছড়ে পড়ছে নিচে ৷ প্রখর সূর্যালোকে তার রং দুধের মতো সাদা ৷ নিচের কুণ্ডের জল যেন টগবগ করে ফুটছে ৷ তার জলবিন্দু উড়ে আসে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতো ৷ বাঁয়ে হেলানো বোল্ডার ৷ ঠিক যেন এক দৈত্যের মাথার খুলি ৷ পাশে বেতাল গুহার প্রবেশদ্বার ৷ ভেতরে বালির গদিপাতা বিছানা ৷ অনায়াসে দশজনের আস্তানা হতে পারে ৷ তবে কতটা নিরাপদ তা জানা নেই ৷
পায়ে পায়ে প্রপাতের শীর্ষে ৷ বুনো আগাছার ঝোপ পার হয়ে নতুন গাছ পাতা পুল ৷ দুটি গুঁড়ির মধ্যে পাথরের স্ল্যাব পাতা ৷ মিনিট পনেরো বাদেই আরেক ভয়ঙ্কর প্রপাতের মুখোমুখি ৷ ঠাস বুনোট সবুজের ফাঁক দিয়ে তার যতটুকু অবয়ব চোখে পড়ছে তা প্রায় একশো ফুটের মতো ৷ দৃষ্টির আড়ালে আরও কতটা আছে কে জানে ৷ সে প্রপাতের দুটি ধারা ৷ একটি নেমেছে ডাইনের সবুজ ফুঁড়ে ৷ অন্যটি গুহার অন্দর থেকে ৷ গুহার পিঠ যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক কাছিমের খোল ৷ গুহার অন্ধকারে আরও একটা ছোট্ট প্রপাত ৷ এ দুই সম্মিলিত ধারা নেমেছে অর্ধবৃত্তাকার খাড়া পথে ৷ স্তর স্তর পাথরের ভাঁজে সমান্তরাল দাগ ৷ প্রপাতের বুকে খয়েরি একজোড়া পাখি ওড়াওড়ি করে ৷ এমন অপূর্ব জলপ্রপাতের জন্য হাজার মাইলও পার হওয়া যায় অনায়াসে ৷
প্রপাতের শব্দ পিছনে ফেলে হালকা চড়াই ৷ সামনে ত্রিভুজাকৃতি ঢাল, ঘন ঝোপঝাড় ৷ শীর্ষদেশে নীল আকাশ ৷ আঁকাবাঁকা পথে উঠে যাওয়া ৷ হঠাৎ বাঁদিকে মোচড় খেয়ে একটা চড়াই বেয়ে পথ যেখানে পৌঁছে দিল সে ভারি অদ্ভুত স্থান ৷ ঠিক যেন এক নাকের প্রান্তভাগ ৷ গিরিশিরার ঢাল এখানে শেষ ৷ তারপর অতল খাদ ৷ অন্যপাশ দিয়ে বরাবর নেমে চলি ৷ উৎরাই গিয়ে পড়ে এক জোড়া ঝোরার সঙ্গমের বুকে ৷ আশ মিটিয়ে স্নান ৷ প্যাকেট লাঞ্চ সাবাড় ৷ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে ৷ দ্রুত পায়ে পাহাড় ভাঙি ৷ সূর্যের স্পর্শ না পাওয়া এক অরণ্যের মধ্যে পাইন দেওদার বৃক্ষেরা বয়সের ভারে ভূমিশয্যা নিয়েছে ৷ গুঁড়ির কাঠ ঝুরো বালির মতো খসে পড়ে ৷ চড়াইয়ের প্রান্তে দেখি ঝলমলে নীল আকাশ ৷ বিকেলের সোনা রোদ মাখা বরাথাচের প্রান্তরে এসে পড়ি মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে ৷
ঝোলাঝুলি রেখে স্যুপের মগ হাতে বসি ঝুলন্ত পাথরের টেবিলের ওপর ৷ নিচে অনামী ঝোরা ৷ দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এক টুকরো বরফাবৃত শৃঙ্গ ৷ সূর্যাস্তের রঙে সোনালি ৷ সামনে আড়াল করা রুক্ষ বাদামি পাহাড় ৷ খাঁজে খাঁজে হিমবাহের ঢাল ৷ নিচের ঘন সবুজের মধ্যে টুকরো টুকরো জলপ্রপাত ৷ সেই ধারাই নেমে এসেছে এখানে ৷ সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ৷ কিন্তু স্তর স্তর মেঘের ফাঁকে সূর্যরশ্মির অপূর্ব বিচ্ছুরণ ৷ ওপরের স্তরের মেঘ তরল লোহার মতো লাল ৷ নিচের মেঘ অন্ধকার ৷ সাড়ে সাতটায় সন্ধে নামে ৷ ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত ধেয়ে আসে পাহাড়ের ফাঁক বেয়ে ৷ তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে তাঁবুর অন্দরে ৷
পদযাত্রার তৃতীয় সকাল ৷ ঝলমলে রোদ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর স্তূপ ভাসে ৷ বরাথাচের পিছনের ঘন জঙ্গলে খাড়া পাহাড়ের মধ্যে পথরেখা ঢুকে পড়েছে ৷ টানা চড়াই ৷ পাহাড়ের বুক বেয়ে শুধুই ওপরে ওঠা ৷ দৃষ্টি রোধ করা ঘন জঙ্গল ৷ তার ফাঁক দিয়ে দূরের পাহাড়ে সরু ঝরনা আর টুকরো টুকরো হিমবাহ চোখে পড়ে ৷ তাই দেখে বুঝতে পারি কতটা উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছি আমরা ৷ চড়াইয়ের তীব্রতায় মন বাঁধা পড়ে থাকে পরবর্তী পা রাখার লক্ষ্যে ৷ একটা পাহাড় ডিঙিয়ে আবার একটা ৷ এভাবে প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা পর বিশাল এক সবুজ প্রান্তর ৷ অসংখ্য ফুলের সমারোহ ৷ চারপাশে ছড়ানো ছেটানো বোল্ডার আর ছোট বড় টিলা ৷ তারই একটায় একদল পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়া রাজসিক মেজাজে বিশ্রাম নিচ্ছে ৷ আমরাও বসে পড়ি জলখাবার নিয়ে ৷
দূরে খাদের ওপারে ধূসর আবছা পাহাড় ৷ ডাইনে এ পাহাড়ের নিচ থেকে উঠে আসা পাইনের বন ৷ যেন অসংখ্য আকাশমুখি বর্শা ৷ পিছনের পাহাড়ের ঢালে তাদের সীমানা শেষ ৷ গুল্মঝোপের পর তৃণভূমির ঢাল ৷ সেখানে সরু সুতোর মতো পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে রুক্ষ পাহাড় চূড়ায় ৷ ওপারেই আমাদের উচ্চতম ক্যাম্প নাগারু ৷ ঠিক সার পাসের নিচে ৷ বাঁয়ের পাহাড়ের পিছন দিয়ে যমদূতের মতো কালো মেঘ উঠে আসে ৷ তার তাড়ায় দৌড়েও নিস্তার পাই না ৷ প্রবল ধারাপাত পলিশিটের ওপর ৷ সাবুদানার মতো বরফ পড়ে ৷ পথের দখল নেয় জলধারা ৷ সহজ রাস্তা হয়ে ওঠে দুর্গম ৷ এভাবে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটানা আধঘণ্টা চড়াই ভেঙে উঠে এলাম এক বৃত্তাকার সমতলে ৷ বৃষ্টি কমলেও ঘন সাদা ধোঁয়ায় সবকিছু আবছা ৷
একঘণ্টা মেঘের ঘেরাটোপে বন্দী থাকার পর ঝলমলে রোদে সবকিছু পরিষ্কার ৷ ভেসে ওঠে অপূর্ব নিসর্গ ৷ প্রায় বৃত্তাকার মিংথাচের অর্ধেকটা ঘিরে পাহাড়ের সুষম ঢাল ৷ বেঁটেখাটো পাইন দেওদার ৷ ওপরের রুক্ষ পাথরের ফাঁকে বরফের ছেঁড়া স্তর ৷ তার পিছনে উঁকি দিচ্ছে স্থায়ী বরফে মোড়া ধরাথাচ পর্বতচূড়া ৷ ঠিক এর উল্টোপিঠ স্পর্শ করে আছে সার পাসকে ৷ মিংথাচের অপর অংশে খাদ নেমে গেছে গভীর জঙ্গলে ৷ প্রায় আধ কিলোমিটার ব্যাসের এই প্রায় সমতল তৃণক্ষেত্রের বুক জুড়ে রংবেরঙের ফুলের আসর ৷ সরু সরু নালার আলপনা ৷ কোনও নালার জলের রং তামাটে, পাথরেও তার আস্তরণ ৷ আকরিক বাহিত জলের জন্যই হয়তো ৷ অদূরে একটা ঢিবির ওপর বসি ৷ নানা পাখির সুরেলা ডাক ৷ দূরে অথচ স্পষ্ট ৷ ছড়িয়ে থাকা মরা গাছের কঙ্কালে অপূর্ব সব ভাস্কর্য ৷
অভিযানের চতুর্থ সকাল ৷ নির্মল আকাশ ৷ পূর্বদিকের খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে এলাম শীর্ষে ৷ ডাইনের গিরিশিরা বেয়ে ওপরে উঠি ৷ রজতশুভ্র গিরিশিখরেরা প্রকাশিত হয় ৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক পর গিরিশিরা মিশে যায় আরেক পাহাড়ের বুকে ৷ আর কোনও গাছপালা নেই ৷ নেই লতাগুল্মের ঝাড় ৷ এরপর শুধু সবুজ আর সবুজ ৷ আর তারার মতো উজ্জ্বল রঙিন ফুল ৷ সবুজের বুকে হলদে রঙে আঁকা পথরেখা বরাবর এগিয়ে চলি ৷ সামনে উন্মুক্ত আকাশ ৷ আরও ঘণ্টাদেড়েক পর বহু বহু নিচে দেখি ছোট্ট গ্রহণ গ্রাম ৷
দুটো সোনালি চিল পাক খেয়ে যায় বার বার ৷ শেষ আধঘণ্টা বেশ কষ্টকর চড়াই ৷ পাথরের ধাপ বেয়ে শীর্ষের ডাইনে ঘুরতেই চোখে পড়ল সবুজ মাঠ ৷ তার ঢাল গিয়ে ছুঁয়েছে সার পাসের পদপ্রান্ত ৷ তারপরই বরফের রাজত্ব শুরু ৷ অনেক নিচে সুতোর মতো পার্বতী নদী ৷ পাড়ে পাড়ে বাসরাস্তা, বিন্দু বিন্দু ঘরবাড়ি ৷ এখানে জলের অভাব ৷ তাই আধ কিলোমিটার দূরে একটা ছোট্ট গ্লেসিয়ারে গিয়ে বরফগলা জল বয়ে আনতে হয় ৷
হঠাৎ নাগারুর দখল নিল মেঘ ৷ চারদিক অন্ধকার ৷ তোড়ে শুরু হল শিলাবৃষ্টি ৷ নরম সবুজ ভূমি ঢাকা পড়ে গেল তিন চার ইঞ্চি বরফের কার্পেটে ৷ সঙ্গে প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ার দাপট ৷ ঘণ্টাদুয়েক বাদে ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ ৷ ঠিক পাসের মাথার ওপর বিশাল রামধনু ৷
এই ১২,৫০০ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে এক বিরল দৃশ্য দেখি ৷ প্রায় ১৮০ ডিগ্রি কোণ জুড়ে শ্বেতশুভ্র পর্বতমালার সারি ৷ দক্ষিণের আকাশে ঘন কালো মেঘ ৷ উত্তরের আকাশ নির্মল নীল ৷ পূর্বে পাসের ওপর রামধনু ৷ পশ্চিমাকাশে অপূর্ব সূর্যাস্ত ৷ মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির অসাধারণ বিচ্ছুরণ ৷ সোনালি আলোক রশ্মি স্পট লাইটের মতো নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ৷ যেন দেবতারা আশীর্বাদ করছেন আমাদের ৷ গনগনে লাল সূর্য মেঘের ফাঁকফোকর গলে নামতে নামতে ধৌলাধার পর্বতশ্রেণীর পিছনে ডুব দিল ৷
মাঝরাত থেকে কিচেন টেন্ট ব্যস্ত ৷ সাড়ে চারটেতে বেড টি হাজির ৷ গাইডের তাড়ায় সাড়ে পাঁচটায় সবাই প্রস্তুত ৷ আকাশের রং সবে ফিকে হচ্ছে ৷ কোথাও এক কণা মেঘ নেই ৷ কাল রাতে যে পর্বতশৃঙ্গদের চাঁদ-তারার আলোয় জ্বলতে দেখেছি, আজ তাদের গায়ে নরম নীল আলো ৷ একের পর এক শীর্ষ সোনালি আলোর স্পর্শে জেগে উঠছে ৷ পাহাড়ের আড়াল থেকে আলোক স্তম্ভ এসে ধুয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের গা ৷
মালবাহকেরা একটা ত্রিভুজাকৃতি পাথরকে প্রণাম করতে বলে ৷ ইনি নাগারু দেবতা, সন্তুষ্ট না হলে পাস পার হওয়া অসম্ভব ৷ পাথরে সিঁদুর দিয়ে আঁকা ত্রিশূল ও ডম্বরু ৷ ওদের কাছে নাগারুদেবের উপাখ্যান শুনি ৷ বহুদিন আগে এখানে ক্যাম্প স্থাপন করা যাচ্ছিল না ৷ বারবার তুষারঝড়ে তাঁবু উড়ে যাচ্ছিল ৷ তখন মালবাহকরা এই পাথরকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করেন ৷ প্রকৃতি শান্ত হয় ৷
সশ্রদ্ধচিত্তে দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে শুরু হল আমাদের চূড়ান্ত অভীষ্টের পথে অভিযান ৷ আজ ১৩০০ ফুট টানা চড়াই ভেঙে উঠতে হবে, ১৩,৮০০ ফুট উচ্চতার সার পাসের শীর্ষে ৷ তারপর চড়াই থেকে মুক্তি ৷ তৃণভূমির সহজ ঢাল বেয়ে এগোতে থাকি ৷ দৃষ্টিতে উন্মুক্ত হয় ধরাথাচ শৃঙ্গের প্রায় পুরোটাই ৷ ডাইনের তৃণক্ষেত্রটা যেন হঠাৎ ভেঙে পড়েছে কয়েক হাজার ফুট নিচে ৷ সেখানে মিংথাচ ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড ৷ মেঘহীন নীল আকাশে চকচকে উড়োজাহাজ ৷ দিল্লি-চণ্ডিগড়-লে রুটের বিমান ৷
ভোর সাড়ে ছটায় স্পর্শ করলাম বরফের সীমানা ৷ পাথরের খাঁজে খাঁজে জমাট বরফ ৷ পা ঠুকে ঠুকে সমতল গ্রিপ তৈরি করে উঠতে হচ্ছে ৷ ঢাল প্রায় ৬০ ডিগ্রি ৷ এঁকেবেঁকে এমনভাবে উঠছি যাতে পথের দৈর্ঘ্য বাড়ছে কিন্তু ঢালের তীব্রতা কমে যাচ্ছে ৷ কপাল ভালো যে নতুন বরফ পড়েনি বিশেষ ৷ সেক্ষেত্রে নতুন করে পথ তৈরি করতে হত ৷ পাথরের খাঁজগুলোর সাহায্যও পাওয়া যেত না ৷
ঠিক আটটায় উঠে এলাম সার পাসের শীর্ষে ৷ বিশাল সমতল প্রান্তর জুড়ে শুধু বরফ আর বরফ ৷ কোথাও কালো পাথরের ঢিবি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ৷ কোথাও অল্প অল্প সবুজ তৃণক্ষেত্র নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ৷ আর ২৭০ ডিগ্রি কোণ জুড়ে শিবালিক পর্বতমালার চিরতুষারাবৃত সব পর্বতশৃঙ্গ ৷ গাইড পরিচয় দেয় তাদের ৷ সবচেয়ে কাছের শৃঙ্গের নাম ধরাথাচ ৷ যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে ৷ তার পিছনে রোবক গাই, ধুকপুক গ্লেসিয়ার, আলিরত্না, আলিরত্নি ৷ এই দুই পর্বতশৃঙ্গ বহু পর্বতারোহীকে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত করে আজও অজেয় ৷ কিঞ্চিৎ হলুদাভ ত্রিভুজাকৃতি শিখরের নাম টাইগার টিথ ৷ ঠিক ওর পিছনেই লাহুল স্পিতি ৷ তারপর ইন্দ্রাসন ৷ ঠিক যেন ইন্দ্রের সিংহাসন ৷ অন্য নামে দেওটিব্বা ৷ উচ্চতা প্রায় ১৯,০০০ ফুট ৷ আরও বাঁয়ে পর পর কাছাকাছি তিনটি পর্বতচূড়া, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ৷ এরকম পর পর পর্বতশিখরাদি ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে ধৌলাধার শ্রেণীর সঙ্গে মিশে গেছে ৷ যার নিচে ডালহৌসি চাম্বার অবস্থান ৷ এছাড়াও দেওটিব্বার পাশে আছে হোয়াইট শেল, পীনপার্বতী ও ক্ষীরগঙ্গা ৷ সেখানে প্রতিবছর ট্রেকিং ও অভিযান হয় বেশ কয়েকটা ৷ আকাশের রং ঘন নীল ৷ এক চিলতে মেঘ নেই কোথাও ৷ সমগ্র দিগন্ত জুড়ে হালকা রামধনুর মতো রং ৷ এমন দেখিনি কখনও ৷ পাথরের আড়াল খুঁজে ধূপ জ্বেলে গ্লুকোজ ও বিস্কুট দিয়ে পুজো দেওয়া হয় ৷ সকলে বিনম্র চিত্তে সুন্দরের প্রতি প্রণাম জানাই ৷ নিচের দিকে একটা ছোট্ট জলের কুণ্ড ৷ জল প্রায় নেই বললেই চলে ৷ ওমপ্রকাশ বলে, এই জলাশয়ের নামেই এই পাসের নাম সার পাস ৷ আরও জানায়, হিমাচলে সমতল তৃণভূমি হল থাচ ৷ গাড়োয়ালে যাকে বলে বুগিয়াল, আর কিন্নরে নাম কান্ডা ৷
প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে পাসকে উপভোগ করি ৷ তারপর গাইডের তাড়ায় নেমে চলি নিচে ৷ ৪৫ ডিগ্রি ঘাসের ঢাল বেয়ে নেমে জলের ধারা পেরিয়ে পথের ওপর বিশাল এক গ্লেসিয়ার ৷ ধরাথাচ শীর্ষ থেকে একটানা নেমে গেছে প্রায় হাজার ফুট নিচে ৷ খুব সাবধানে পা টিপে টিপে প্রায় ৩০০ ফুট চওড়া বরফের স্ল্যাব পেরিয়ে শুরু হল বোল্ডার অঞ্চল ৷ তারপর পথ রোধ করা রুক্ষ বাদামি পাহাড় ৷ প্রায় আধঘণ্টা এঁকেবেঁকে দুরন্ত চড়াই ভেঙে উঠে এলাম সঙ্কীর্ণ গিরিশিরার ওপর ৷ বাঁদিকের শিখরে জাতীয় পতাকা টাঙিয়েছে পোর্টাররা ৷ ডাইনের গিরিশিরা স্পর্শ করেছে রোবাক গাই চূড়ার বরফঢালা বুক ৷ এই হল সার পাসের শেষ সীমানা ৷ এরপর একটানে নেমে যেতে হবে ১৩,৮০০ ফুট থেকে ১১,০০০ ফুটে, বিসকারি থাচে ৷ গিরিশিরার অন্যদিকটা গোল বাটির মতো নেমে গেছে নিচে ৷ ওমপ্রকাশ জানায়, অন্যান্য বছর এই বেসিনটা বরফে ভর্তি থাকে ৷ তখন স্লাইড করে এই ৪ কিলোমিটার পথ পার হওয়া যায় মাত্র ১০ মিনিটে ৷ এখন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে আশপাশের পাহাড়ে প্রচুর ব্লাস্টিং হচ্ছে ৷ তারপর থেকেই এখানে বরফের মাত্রা কমে গেছে ৷
বেলা বারোটায় নামতে শুরু করলাম ৷ ঝোপ ও গুল্মের মধ্য দিয়ে পথ ৷ ওপর থেকে নামাটা যত ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল নামতে গিয়ে আর ততটা কঠিন মনে হল না ৷ একটা গ্লেসিয়ারের স্নাউট থেকে দেখি ঝরনাধারা বেরিয়েছে ৷ সবুজ প্রান্তরের অন্তে রডোডেনড্রনের বন ৷ বেঁটে বেঁটে গাছের গুঁড়িগুলো সব মাটির সমান্তরাল ৷ গাছে শুকনো গোলাপি ফুল ৷ জলের ধারা গড়িয়ে যে পথ তৈরি হয়েছে সেই শুকনো মাটি পাথরের পথে নেমে চলেছি ৷ একটানা নামতে নামতে হাঁটু ধরে আসে ৷ ভেড়া ছাগলের দল, মেষপালকের পাথুরে আস্তানা ছাড়িয়ে প্রায় আড়াইটে নাগাদ আমাদের আস্তানায় পৌঁছে গেলাম ৷ দেখি বিসকারি থাচে কাচ্চা বাচ্চা সহ মুক্ত ঘোড়ারা চরে বেড়াচ্ছে ৷
পদযাত্রার পঞ্চম সকাল, পীনপার্বতী শিখরের পাশ দিয়ে অপূর্ব সূর্যোদয় ৷ ডাইনে বাসুকিনাগ ৷ এখান থেকে ক্রিভাসগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ৷ পাশে ক্ষীরগঙ্গা, তার পিছনে আছে পার্বতীর উৎস মানতালাও ৷ পীনপার্বতীর বাঁদিকে হোয়াইট শেল ও দেওটিব্বা ৷ তারপরের চূড়ারা পাহাড়ের আড়ালে ৷
বেলা দশটায় হাঁটা শুরু ৷ অভিযানের অন্তিম তাঁবু পড়বে বন্দকথাচে ৷ দূরত্ব ১২ কিলোমিটার ৷ উচ্চতা ৭৬০০ ফুট ৷ আজকের প্রায় পুরো পথ জুড়েই বিসকারির ঘন জঙ্গল ৷ নানান প্রজাতির গাছের মধ্যে ভুজগাছ অন্যতম ৷ এখানে প্রচুর ভালুক ও লঙ্গুর আছে ৷ পথ বেশ সঙ্কীর্ণ ৷ টানা উৎরাইয়ের মাঝে মাঝেই ঝোরা ৷ পার হবার পর অল্প চড়াই, পায়ে বেশ আরাম জোগাচ্ছে ৷ আরেকটা ভয়ঙ্কর ঝোরার মুখোমুখি হলাম ৷ খুব সঙ্কীর্ণ অঞ্চলটা পার হবার জন্য পঞ্চাশ ফুট মতো দড়ি ঝোলাতে হল সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে ৷ ঝোরার ঠিক ওপরে একটা গুহা ৷ ওমপ্রকাশের কথায় ওটা ভালুকের আস্তানা ৷ জঙ্গলের মাঝে মাঝে সুন্দর সবুজ মাঠ ৷ শুয়ে বসে বিশ্রাম নেবার আদর্শ স্থান ৷
পথের পাশের ঢালু জমিতে স্ট্রবেরির ঝোপ ৷ ছোট ছোট লাল রসালো স্ট্রবেরিতে পকেট ভর্তি ৷ এ জঙ্গলে দেখি করাতের কোপে বহু বৃক্ষ ধরাশায়ী ৷ নালার বুকে বহুমূল্য গুঁড়ির স্তূপ ৷ গাছের কোটরে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিয়েছে ভেতরে ভেতরে ৷ মানুষের এ ধ্বংসলীলায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ৷ বাঁয়ের ঢালু পথ নেমে গেছে পুলগাঁও ৷ আর সোজা চড়াই পথের প্রান্তে সবুজ মাঠ ৷ অনেকগুলো মোষ চরে বেড়াচ্ছে মহানন্দে ৷ পলিশিট ঢাকা পাথর সাজানো দেওয়ালে মেষপালকদের অস্থায়ী আবাস ৷ দেওদার পাতার গদিতে প্রায় দশজনের ঢালা বিছানা ৷ ওঁরা প্রায় ছমাস এখানেই থাকে ৷ দুধ পাঠায় পুলগাঁও ও মণিকরণে ৷ তারপর দলবল সহ এক মাস ধরে হেঁটে ফিরে যাবে লুধিয়ানা ৷
আজই অনায়াসে পুলগাঁও হয়ে বারসোনি রোডে নেমে যাওয়া যেত ৷ কিন্তু বেলা তিনটেতে শেষ বাস ছেড়ে যায়, সেই কারণে ও পীনপার্বতী, বাসুকিনাগ, হোয়াইট শেল ও দেওটিব্বাকে আরও কাছ থেকে আরও একদিন উপভোগ করার লোভে এই বন্দকথাচে তাঁবু ফেলা হল ৷
পদযাত্রার শেষ ভোরে পীনপার্বতীর শির ছুঁয়ে সূর্যকিরণ সরাসরি এসে পড়ে তাঁবুর মধ্যে ৷ প্রথম বাস ছাড়বে বেলা ১১টায়, তারমধ্যে ৭ কিলোমিটার দূরের বারসোনি রোড পৌঁছতে হবে আমাদের ৷ তাই তাড়াতাড়ি গোছগাছ সেরে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়ি পথে ৷
একটানা ঢালু পথ ৷ মাথার ওপর জঙ্গলের চাঁদোয়া ৷ মাঝে মাঝে ছোট ছোট মাঠ, মেঘ রোদ্দুরের খেলা, বনবিভাগের ঘেরা চত্বরে নতুন গাছের চারা, এসব পেরিয়ে মাটি, পাথর আর শিকড়ের মুঠিতে ধরা সিঁড়িতে পা ফেলে এগিয়ে চলি ৷ কোথাও ঝোরার পাশ দিয়ে পথ ৷ কোথাও ভেঙে পড়া পাইন গতি রোধ করছে ৷ এভাবে নামতে নামতে সাড়ে নটায় ছোট্ট সুন্দর পুলগাঁও ৷ দু-তিনতলা রংবেরঙের বাড়ি ৷ ট্যুরিস্ট লজ ৷ গ্রাম ছাড়িয়ে পার্বতীর ওপর কাঠের সেতু ৷ ওপরের দিকে তোষনালার সঙ্গে পার্বতীর মিতালি ৷ উঠে এলাম বারসোনি রোড ৷ পথের অন্তিম প্রান্ত থেকে বাস ধরে ১২ কিলোমিটার দূরে পৌনে এক ঘণ্টায় মণিকরণ ৷
উষ্ণ কুণ্ডে স্নান ৷ শরীরের সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে দূর ৷ মণিকরণ থেকে বাস ধরে রওনা হলাম কুলু অভিমুখে ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন