অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
নদী যে ঠান্ডায় জমে গিয়ে ফুটবলের মাঠ হয়ে যেতে পারে, লাসা শহরে না এলে এ অভিজ্ঞতা হয়তো কোনদিনই হত না ৷ শহরের নামে নদী, নাকি নদীর নামেই শহর, এ তথ্য তিব্বতের রাজধানীতে আমাকে কেউ দিতে পারেননি ৷ তবে নদীর সঙ্গে শহরের একাত্মীকরণ দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না ৷
লাসা নদী বয়ে গেছে লাসা শহরের প্রায় শরীর বিদীর্ণ করে ৷ তখন জানুয়ারির শীত ৷ নদীর ধার বরাবর সারি সারি পাতাহীন গাছ ৷ পাতা না থাকলেও কয়েকটিতে আবার নানা রঙের মরসুমি ফুল ফুটেছে ৷ তাদের ওপর চড়া রোদের ছটা ৷ ওই একই রোদ নদীর জমে থাকা বরফের ওপরেও ৷ সেই রোদ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বরফ থেকে ৷ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ ৷ কোথাও আবার বরফের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে রামধনুর রঙের বাহার ৷ সেই রঙের ওপর দিয়ে পাখি উড়ে গেলে মাঝপথেই শিলুয়েট হয়ে যাচ্ছে তারা ৷ যেন রঘু রাইয়ের বাওল বয়সের ছবি ৷
পাতাহীন গাছের ডালে সারি দিয়ে বসে আছে এক দঙ্গল চড়াইপাখি ৷ দেখতে অবিকল কলকাতার চড়াইপাখির মতো ৷ বারো হাজার ফুট উঁচু তিব্বতের এই শহরেও একইরকম ছটফটানি ওদের ৷ অত ঠান্ডাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই কোনও ৷ ডাল থেকে ডানা মেলে নদীর মধ্যে চলে যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত ৷ তারপর ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে আবার ফিরে আসছে ডালে ৷
নদীর ঠিক মধ্যিখানে ঝকঝকে বরফের ওপর দু’ধারে দুটি গোলপোস্ট পুঁতে একদল শিশু ফুটবল খেলায় মত্ত ৷ স্কেটিং শু নয়, সাধারণ বুট জুতো পরেই খেলছে ৷ দূর থেকে রেফারির বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে ৷ মনে পড়ে গেল, অনেক-অনেক বছর আগে রাশিয়া থেকে কলকাতার গড়ের মাঠে খেলা দেখাতে এসেছিল ‘হলিডে অন আইস’ ৷ সেখানে কৃত্রিম উপায়ে জমানো হয়েছিল বরফ ৷ অথচ লাসা নদীর এমন বরফ হয়ে যাওয়া কিন্তু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ৷ এই সময়ে লাসার মানুষ নদী পারাপার করেন সাইকেলে চেপে ৷ এখন লাসা নদীর ওপর মোটর সাইকেলের রেস হয় ৷ নদীর ধারে, যেখানে বরফের আস্তরণ একটু পাতলা, মাইগ্রেটেরি হাঁসেরা সেখানে ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে-ঠুকরে বরফ ভাঙছে ৷ সম্ভবত জ্যান্ত মাছ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে ৷ তিব্বতী মেয়েরা বরফের ওপর ঘুরে ঘুরে রোদে চুল শুকোচ্ছে ৷ রক্তিম পোশাকে এক বৃদ্ধ লামা নদীর ওপাড় থেকে এপারে আসছেন ধর্মচক্র ঘোরাতে ঘোরাতে ৷ গায়ে এক ফোঁটাও গরমজামা নেই ৷ অনেক দূরে লাসা ব্রিজের তলা দিয়ে এক ঘোড়সওয়ারকে দুলকি চালে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে ৷ এখানকার ঘোড়ারাও বরফের ওপর দিয়ে চলতে অভ্যস্ত ৷ শীতে যেন এখানে বসন্তের চাঞ্চল্য ৷
এত শীতেও ইওরোপ থেকে লাসা শহরে বেড়াতে এসেছে বেলগ্রেডের মেয়ে রাইসা ৷ আলাপ সেই চেংডু শহরে ৷ জিন জিয়াং হোটেলের ফুটপাতে আর্ট স্কুলের ছেলেমেয়েদের আঁকা পেইন্টিং কিনছিল ৷ ওইসব শিল্পী ছেলেমেয়েদের কিন্তু একটাই বৈশিষ্ট্য ৷ আর্ট স্কুলে পড়েও কিন্তু বিমূর্ত ছবি আঁকতে শেখেনি ওরা ৷ ওই ফুটপাতে বসেও ছবি আঁকছে অবিরাম ৷ এবং যা আঁকছে তার সবকটিই বিশুদ্ধ চাইনিজ পেইন্টিং ৷ বাড়ির ঠাকুরঘরে চন্দন ঘষার পিঁড়ির সঙ্গে যে মোটা চন্দন কাঠটি থাকে, সেইরকম একটি বস্তুকে জলে ভিজিয়ে কাগজের ওপর পাকা হাতে রেখা টানছে তারা ৷ কোনওটি হয়ে যাচ্ছে ইয়াক, কোনওটি গোম্ভা, কিংবা দাড়িওয়ালা কোনও বৃদ্ধ, ছেলেবেলায় ইতিহাসের পাতায় তৈমুরলঙের যেমন ছবি দেখেছি ৷
মেনল্যান্ড চায়নার চেংড়ু শহর থেকে আমি আর রাইসা একই বিমানে লাসা এসেছি ৷ রাইসা খেতে ভালোবাসে খুব ৷ শুধু খাওয়াই নয়, মদ্যপানেও ওর যথেষ্ট আসক্তি ৷ তবে আসক্তি না বলে আগ্রহ বলাই ভালো ৷ কারণ কোথাকার খাবার কেমন খেতে, কোন মদে নেশা বেশি হয়, এসব নিয়েই ওর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ৷ লাসায় এসে পর্যন্ত ও খুঁজে বেড়াচ্ছে মাওতাই ৷ এটা নাকি এক ধরনের ঘাস থেকে তৈরি মদ ৷ চেংড়ুর জিন জিয়াং হোটেলে আমাকে একদিন লাল রঙের একটা মদ খাইয়েছিল ৷ ওটা নাকি ওয়াইন, অথচ ভাত থেকে তৈরি ৷ আমার ধারণা ছিল আঙুর ছাড়া ওয়াইন হয় না ৷ রাইসাও সেটাই জানত ৷ কিন্তু ভাত থেকে তৈরি লাল মদ আমরা ওই দেখলাম ৷ মদের নাম শাওসিং ৷
খাবার নিয়েও রাইসার উৎপাত অনেক ৷ লাসায় আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেটি হলিডে ইন গোষ্ঠীর ৷ এই হোটেলে খাবার নিয়ে আমার সমস্যা হত খুব ৷ বছর দুয়েক আগেও লাসায় এসে এই একই হোটেলে ছিলাম আমি ৷ তখন আমার খাওয়ার মতো একটি জিনিসই পেতাম মেনুকার্ডে ৷ চিকেন স্যান্ডউইচ ৷ সঙ্গে প্রায় কিলোখানেক কাঁচা গাজরের কুচি ৷ ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার পর্যন্ত ওই একটি পদ দিয়েই খাওয়া শেষ করতে হত আমাকে ৷ পেট ভরানোর জন্য কাঁচা গাজরগুলোও চেটেপুটে খেয়ে নিতাম ৷ আর গরুর মতো ওই কাঁচা গাজর খেয়ে খেয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হত না ৷
এবছর এসে দেখছি আমার খাওয়ার উপযোগী আরও একটি পদ রয়েছে এখানে ৷ ইয়াকের মাংসের টিকিয়া দিয়ে মিট বার্গার ৷ কিন্তু সেখানেও রসিকতা অনেক ৷ অর্ডার দেওয়ার সময়ে বলে দিতে হবে আমি গ্রিলড মিট চাই, না সান-ড্রায়েড ৷ তিব্বতীরা রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়া কাঁচা ইয়াকের মাংস খেতে খুব ভালোবাসে ৷ সেই মাংস দিয়ে তৈরি বার্গারও পরিবেশন করা হয় এখানে ৷ আমি অবশ্য অর্ডার দিতাম গ্রিলড মিটের ৷ কারণ গরম থাকার ফলে চোখ-কান বুজে গিলে ফেলতাম তাড়াতাড়ি ৷ গাজরের বদলে এই পদের সঙ্গে একগাদা কাঁচা বাঁধাকপির কুচো ৷ নাকে গন্ধ লাগলে মুখের মধ্যে ঠুসে দিতাম এক গোছা ওই কাঁচা বাঁধাকপি ৷
রাইসা কিন্তু খেত রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়া কাঁচা ইয়াকের মাংস ৷ নতুন জায়গায় এসে নতুন খাবার খেতেই নাকি ওর মজা ৷ মেনু থেকে উদ্ভট সব খাবার বেছে নিয়ে অর্ডার দিত ও ৷ মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হত যে আমার খাবারটা হাতে নিয়ে আমি অন্য টেবিলে গিয়ে বসতাম ৷ ওর পছন্দ করা খাবারের বিটকেল গন্ধ আমি সহ্য করতে পারতাম না ৷ ব্রেকফাস্টে ও প্রায়ই খেত হাঁসের পা-ভাজা ৷ আঙুলসুদ্ধ হাঁসের পাগুলো পাম তেলে ভাজা ৷ আমার সামনে বসে কচকচিয়ে খেত ও ৷ আমি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিতাম ৷
একদিন ডিনারে বসে রাইসা আমাকে বলল, ‘আজ যে খাবারটার অর্ডার দিয়েছি সেটা মিং সম্রাটেরা খেতেন ৷ এমন চমৎকার ইনগ্রেডিয়েন্ট বিশ্বের খুব কম খাবারেই পেয়েছি আমি ৷ তুমিও আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারো ৷ অবশ্য তুমি তো আবার ইন্ডিয়ান পন্ডিত ৷’
আমার খাওয়াদাওয়ার ন্যাটা দেখে রাইসা আমার নাম দিয়েছিল ইন্ডিয়ান পণ্ডিত ৷
ভারতীয় এই পণ্ডিতদের সঙ্গে কিন্তু হিমালয়ের একেবারে রক্তের সম্পর্ক ৷ আসলে এই পণ্ডিতেরা হলেন কাশ্মীরি হিন্দু ৷ কিংবা এককালে রাজপুতানা থেকে আগত কুমায়ুনের ভোটিয়ারা ৷ তিব্বতীদের সঙ্গে এঁদের ছিল চমৎকার সম্পর্ক ৷ কয়েকশো বছর আগে থেকেই অন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে তিব্বতীদের সঙ্গে যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত, তার মূল অংশীদার ছিলেন এঁরাই ৷ তিব্বত যখন সকলের জন্য নিষিদ্ধ, তখন ভারতবর্ষ থেকে একমাত্র এই ভোটিয়া তথা পণ্ডিতদেরই ছিল সেখানে অবাধ গতিবিধি ৷ এমনই একজন পণ্ডিত হলেন নয়ন সিং রাওয়াত ৷ ব্রিটিশ আমলে এঁদের কাজ ছিল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পক্ষে হিমালয়ের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় গোপন জরিপের কাজ চালানো ৷ এক অর্থে গুপ্তচরের কাজ করতেন তাঁরা ৷ তিব্বত তখন নিষিদ্ধ দেশ ৷ বিভিন্ন ছদ্মবেশে তিব্বতে ঢুকে এঁরা ওইসব এলাকার মানচিত্র তৈরি করতেন ৷
তিব্বতের এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে নয়ন সিংকে পাঠানো হয়নি ৷ নয়ন সিংয়ের জন্ম ১৮২১ সালে ৷ মানস সরোবর থেকে শুরু করে লাসা পর্যন্ত, এমনকী ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থলেও অভিযান চালিয়ে ছিলেন নয়ন সিং ৷ তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় বাহাদুর উপাধি দেন ৷ উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কৈলাস ও মানস সরোবর’ গ্রন্থে এব্যাপারে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া আছে ৷ উমাপ্রসাদ লিখেছেন, রায় বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয়েছিল কিষেণ সিং রাওয়াতকে ৷ আসলে কিন্তু রায় বাহাদুর পেয়েছিলেন নয়ন সিং ৷ শুধু রায় বাহাদুরই নয়, ১৮৭৭ সালে অর্থাৎ যে বছর রানি ভিক্টোরিয়া ‘এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া’ হলেন, সেই বছরেই নয়ন সিংকে দেওয়া হয়েছিল ‘কম্প্যানিয়ন অফ দি নিউ অর্ডার অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ নামক তকমা ৷ এছাড়াও তিনি পেয়েছিলেন রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির সর্বোচ্চ সম্মান ‘পেট্রন্স গোল্ড মেডাল’ ৷ তাঁর জন্মস্থান মিলাম গ্রামে তাঁকে জায়গীর দেওয়া হয় ৷ নয়ন সিংয়ের মৃত্যু হয় ১৮৯৫ সালে ৷
উমাপ্রসাদের গ্রন্থে এমন তথ্যের অসম্পূর্ণতা আরও অনেক ৷ মানস সরোবরের প্রথম ব্রিটিশ আবিষ্কারক হিসেবে তিনি মুরক্রফেটর নাম উল্লেখ করেছেন ৷ কিন্তু ওই অভিযানে তাঁর সহযাত্রীটিকে তিনি শুধু ‘সঙ্গী’ বলেই ছেড়ে দিয়েছেন ৷ সম্ভবত ওই সঙ্গীটির নাম তিনি সংগ্রহ করে উঠতে পারেননি ৷ তিনি বোধহয় জানতেন না যে ওই সঙ্গীটিও ছিলেন বিখ্যাত এক সৈনিক এবং অভিযাত্রী ৷ ১৮০৮ সালে উইলিয়াম ওয়েবের সঙ্গে একটি অভিযানে গিয়ে তিনি নদীর উৎস খুঁজে বার করেছিলেন ৷ এই ‘সঙ্গী’-র নাম ছিল হায়দার জং হিয়ারসে ৷
হায়দার জং-এর পরিচিতি ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হিসেবে ৷ তাঁর পিতা ছিলেন খাঁটি সাহেব ৷ কিন্তু তিনি দুটি বিবাহ করেছিলেন ৷ তাঁর খাঁটি মেমসাহেব স্ত্রী থাকতেন ইংলন্ডে ৷ কিন্তু ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি করতে এসে তিনি ভারতীয় এক জাঠ রমণীকে বিবাহ করেন ৷ হায়দার জংয়ের জন্ম ওই জাঠ রমণীর গর্ভে ৷ সেকালে ভারতবষের সামন্ত রাজারা ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে চাকরি দিতেন গোরা সাহেবদের ৷ হায়দার জং-এর প্রথম চাকরি ওই ভাড়াটে সৈন্য হিসেবেই, এক মারাঠা রাজার কাছে, জেনারেল পেরনের অধীনে ৷ কিছুকাল মধ্যপ্রদেশের সিন্ধিয়া পরিবারেও কাজ করেছিলেন তিনি ৷ বিয়ে করেছিলেন ক্যাম্বের রাজকুমারী জুহুর-উল-মিসাকে ৷ তাঁর জায়গীর ছিল বেরিলিতে ৷
১৮১২ সালের মে মাসে মুরক্রফট এবং হায়দার জং ভোটিয়া বণিকের ছদ্মবেশে তিব্বতের পথে রওয়ানা হন ৷ তাঁরা তিব্বতে ঢোকেন নিতি গিরিপথ পার হয়ে ৷ তারপর গার্টোক হয়ে দারচেনের মধ্য দিয়ে ঘুরপথে মানস সরোবরে পৌঁছন আগস্ট মাসে ৷ হায়দার জং এবং মুরক্রফটই প্রথম ঘোষণা করেছিলেন, মানস সরোবর কোনও নদীর উৎস নয় ৷ মানুষের এতদিনের ধারণা ভুল ৷
উমাপ্রসাদ জাপানি পরিব্রাজক একাই কাওয়াগুচির মানস সরোবর অভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে ৷ তিনি লিখেছেন, কলকাতা থেকে দার্জিলিং হয়ে কাওয়াগুচি মানস সরোবর রওয়ানা হন ৷ কিন্তু একাই কাওয়াগুচি কলকাতা থেকে কেন দার্জিলিং গিয়েছিলেন, সে তথ্য সম্ভবত উমাপ্রসাদ জানতেন না ৷ কাওয়াগুচি আসলে ছিলেন পরিব্রাজক, অভিযাত্রী নয় ৷ তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন বৌদ্ধগয়া দর্শন করতে ৷ সেখান থেকেই খবর পেয়ে তিনি দার্জিলিং গিয়েছিলেন গুরুর সন্ধানে ৷ দার্জিলিং শহরে তখন থাকতেন বিখ্যাত বাঙালি টিবেটোলজিস্ট শরৎচন্দ্র দাশ ৷ দীর্ঘ ১৩ মাস দার্জিলিং শহরে বসে শরৎচন্দ্রের অধীনে তিব্বতী ভাষা ও সংস্কৃতির তালিম নিয়েছিলেন তিনি ৷ তারপর মূলত শরৎচন্দ্রের অনুপ্রেরণাতেই তিনি মানস সরোবরের পথে রওনা হন ৷ এটা ১৮৯৯ সালের কথা ৷ মানস সরোবর থেকে কাওয়াগুচি পৌঁছে যান লাসা শহরে ৷ তিব্বতে দীর্ঘ ২ বছর কাটিয়েছিলেন তিনি ৷ ১৯০১ সালে তিব্বত থেকে ফেরার সময়ে কাওয়াগুচি আবার আসেন দার্জিলিং শহরে, শরৎচন্দ্রের অধীনে তাঁর তিব্বতী ভাষা ও সংস্কৃতির তালিম শেষ করতে ৷ সেবারেও দীর্ঘকাল দার্জিলিং শহরে কাটান তিনি ৷ কারণ যতদূর জানা যায়, ১৯০৩ সালের আগে কাওয়াগুচি জাপানে ফিরে যাননি ৷ কাওয়াগুচির প্রসঙ্গ এনেও উমাপ্রসাদ এতবড় একটা বাঙালি মহিমার কথা এড়িয়ে গেলেন কীকরে জানি না! আসলে উমাপ্রসাদ এসব খবর জানতেন না ৷ এশিয়াটিক সোসাইটির পুথির ভাণ্ডারে তিনি এসব তথ্য খুঁজে পাননি ৷
শরৎচন্দ্র দাশ যে তখন কত বিখ্যাত তার একটা চমৎকার উদাহরণ দিই ৷ রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘কিম’ গ্রন্থে একটি বাঙালি চরিত্র হল বাবু-গুপ্তচর হরিচন্দর মুখার্জি ৷ হরিচন্দর ছিলেন কিম্বাল ও’হারার গুরু ৷ গুরুর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কিম্বালও ভেবেছিলেন তিব্বতে গিয়ে তিনি ব্রিটিশ রাজকে কিছুটা সাহায্য করবেন ৷ প্রায় কাওয়াগুচির ঘটনার মতো ৷ রুডইয়ার্ড কিপলিং বহু জায়গায় স্বীকারও করে গেছেন যে তিনি হরিচন্দরের চরিত্রটি এঁকেছিলেন বাবু শরৎচন্দ্র দাশের কথা ভেবেই ৷ সেটা ১৯০০ সাল ৷
যাকগে, ইতিহাস আওড়াতে গিয়ে রাইসা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ৷ রাইসার সঙ্গে সেদিনের ডিনার খাওয়ার কথা বলি ৷ কিছুক্ষণ পরে একটি বিশাল চিনেমাটির বাটিতে খাবারটি পরিবেশন করা হল ৷ বাটি থেকে ধোঁয়া উঠছে ৷ সামনে ঝুঁকে পড়ে বাটির মধ্যে কী আছে দেখতে গেলাম ৷ রাইসা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, চায়ের লিকারের মধ্যে পনেরোটি কচি হাঁসের মুণ্ডু সিদ্ধ করা ৷ আমি হতবাক ৷ হাঁসের শুধু মুণ্ডুই নয়, ঠোঁটগুলিও যেমন থাকে ঠিক তেমনই ৷ আর ওপরে কর্পূরের গুঁড়ো ছড়ানো ৷ এমন বিদঘুটে খাবার আমি জীবনে কখনও দেখিনি ৷ চায়ের লিকারের সঙ্গে হাঁসের মুণ্ডুর কী সম্পর্ক সেটাও বুঝলাম না ৷ রাইসা আমাকে ভাগ দিতে যাচ্ছিল ৷ আমি হাতজোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চাইলাম ৷ আমার তখন প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা ৷ খাবারের নাম নাকি জাংচা ইয়াসি ৷ মনে মনে ভাবলাম, মিং সম্রাটেরা সম্ভবত বনমানুষের স্পিসিস ছিলেন ৷ রাইসাও তাই ৷
রাইসা যে প্রকৃত অর্থে মনুষ্য নয় সেটা আরও বেশি করে বুঝেছিলাম ওর সঙ্গে পোতালা প্রাসাদ দেখতে গিয়ে ৷ পোতালা প্রাসাদে পৌঁছতে হয় প্রায় হাজারখানেক সিঁড়ি ভেঙে ৷ ছোটবেলা থেকেই বড় বড় অভিযাত্রীদের কাছ থেকে শিখেছি, উঁচুতে উঠতে হয় ধীরে ধীরে, স্বাভাবিক নিশ্বাস নিতে নিতে ৷ আমিও তাই করছিলাম ৷ রাইসা কিন্তু সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল প্রায় একশো মিটার দৌড়ের স্পিডে ৷ বেশ খানিকটা উঠে গিয়ে পিছন ফিরে আমাকে একবার ঠাট্টা করে আবার দৌড় ৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে শূন্যে মিলিয়ে গেল রাইসা ৷ আমার সঙ্গে ওর আবার দেখা হল প্রায় দেড় ঘন্টা পরে, দলাই লামার ঘরের নিচের উঠোনে ৷ ও তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত ৷ এমন প্রাণশক্তি বোধহয় বনমানুষেরও হয় না ৷ উঠোনে প্রায় অর্ধশায়িত অবস্থায় রাইসা তখন ওপরে দলাই লামার ঘরের বারান্দার ছবি তুলছে, যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দলাই লামা সকলকে হাত তুলে আশীর্বাদ করতেন ৷
আমি আর রাইসা লাসার বারখোর বাজারে গিয়েছিলাম, এখনও সেখানে টাটকা শিকার করা বাঘের ছাল বিক্রি হয় কিনা দেখতে ৷ সেই বাজারে একগাদা বড় বড় পুঁতির মালা কিনে গলায় পরে ফেলল রাইসা ৷ মাথায় টিকলির মতো ঝুলিয়ে নিল প্রায় পিংপং বলের আকারের একটা সবুজ পুঁতি ৷ তারপর হঠাৎ সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ল মাটিতে ৷ বলল, বারখোর বাজার থেকে জোখং মন্দির পর্যন্ত দণ্ডি কেটে যেতে চায় ও ৷ তিব্বতীরা যদি কয়েকশো কিলোমিটার ধরে এইভাবে জোখং মন্দিরে আসতে পারে তাহলে ওই বা পারবে না কেন ৷ বোঝ ঠ্যালা! ওর যাবতীয় ব্যাগ এবং রুকস্যাক তখন আমার ঘাড়ে ৷ রাইসা দণ্ডি কাটছে ৷ আমি প্রভুভক্ত ভৃত্যের মতো গুটিগুটি পিছনে হাঁটছি ৷ কাণ্ড দেখে স্থানীয় তিব্বতীরা জড়ো হয়ে গেল সেখানে ৷ তাদের মুখে খিলখিল হাসি ৷ সেই জনতাও পিছু নিল আমাদের ৷ একজন বয়স্ক তিব্বতী কী এক মন্ত্রপাঠ শুরু করে দিল ৷ সেও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে ৷
শেষবারের মতো দণ্ডি কেটে রাইসা যখন জোখং মন্দিরের চৌকাঠ পার হল, সমবেত জনতা তখন সজোরে হাততালি দিতে শুরু করেছে ৷ এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করল রাইসাও ৷ ও প্রচণ্ড উত্তেজিত ৷ আমি শুধু ওর মুখের দিকে তাকালাম ৷ সারা মুখে ধুলোর আস্তরণ ৷ চুলের সামনের দিকটায় কে যেন ছাই মাখিয়ে দিয়েছে খানিকটা ৷ ভুরু দুটো মনে হচ্ছে যেন ধুলো দিয়েই তৈরি ৷ আর সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছে ওর নাকের ৷ যেন জোকারের মতো নাকের ওপর একটা ধুলোবালির বল বসিলে দিয়েছে কেউ ৷ জনতার দিকে তাকিয়ে রাইসা বলল, ওঁ মণিপদ্মে হুঁ ৷ জনতার আবার হাততালি ৷ এটা ও লাসায় এসে শিখেছে ৷ কিন্তু ওর সাহেবি উচ্চারণে কথাটা শোনাল অনেকটা এইরকম: অং মানিপাডমে ঢুঁন ৷
জোখং মন্দিরের ভেতরে ঢুকলে গা শিউরে ওঠে ৷ সর্বত্র ঘুটঘুটে অন্ধকার ৷ যেন বিশালকায় এক গুহা ৷ আলো বলতে শুধু শত শত চর্বির প্রদীপ ৷ চতুর্দিকে চাপা স্বরের মন্ত্রপাঠ ৷ কেউ প্রদক্ষিণ করছেন ৷ কেউ চর্বির বাতি জ্বালচ্ছেন ৷ কেউ কেউ সাষ্টাঙ্গে মাটিতে শুয়ে ৷ পুরো মধ্যযুগীয় পরিবেশ ৷ বৌদ্ধভিক্ষু হতে গেলে এই মন্দিরে এসেই সর্বস্ব দান করে দিতে হয় ৷ এই মন্দির থেকেই দেওয়া হয় ভিক্ষাপাত্র ৷ সেই ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ভিক্ষুকের জীবন শুরু করতে হয় সর্বপ্রথম এই মন্দিরের সামনে বসে ভিক্ষা করে ৷ সম্যক কৃচ্ছসাধন ৷
পুরনো লাসা শহরে এখনও খচ্চরে টানা কাঠের চাকা লাগানো মালগাড়ি চলে ৷ সহিসের পোশাক এবং চেহারা দেখলে মনে হবে এইমাত্র কাওয়াগুচির সঙ্গে দর কষাকষি করে এল ৷ সেই দুশো বছরের ট্র্যাডিশন এখনও অটুট ৷ মালবোঝাই ইয়াককে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিব্বতী শিশু ৷ তিব্বতী রমণীর সারা গায়ে লর্ড ক্লাইভের আমলের অলঙ্কার ৷ এসব দৃশ্য এখনও কিছু কিছু চোখে পড়ে লাসা শহরে ৷
১৯৫২ সাল তিব্বতের ইতিহাসে অভিশাপের বছর ৷ ওই বছরেই তিব্বত চলে গেল চিনের অধীনে ৷ ওই বছরেই মারা গেলেন আরেক বিখ্যাত তিব্বত-অভিযাত্রী সোয়েন হেডিন ৷ ওই বছরেই ভারতীয়দের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল তিব্বতের দরজা ৷ লাসা, কৈলাস কিংবা মানস সরোবর বাঙালির কাছে হয়ে গেল অতীতের স্বপ্ন ৷ সেই স্বপ্ন পুনরায় বাস্তব হতে সময় লেগে গেল প্রায় তিরিশ বছর ৷ ১৯৮০ সালে চিন সরকার ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের জন্য আবার খুলে দিলেন দরজা ৷ ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত সরকারের বিদেশ দপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ২০ জনের একটি তীর্থযাত্রীর দল লিপুলেখ দিয়ে মানস সরোবরে পৌঁছলেন ৷ ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন আরেক পণ্ডিত, কিষেণ সিংয়ের নাতি এস সি রাওয়াত ৷ কালক্রমে বাঙালিদেরও উৎসাহ বেড়ে গেল ৷ নেপাল-চিন সীমান্ত দিয়ে না হেঁটে জাপানি জিপে চড়ে কৈলাস ও মানস পৌঁছে গেলেন কয়েকশো বাঙালি ৷ সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে ৷ এই বছরেও ওই পথে তীর্থ করে এসেছেন প্রায় চল্লিশজন বাঙালি ৷ লাসাতেও পৌঁছেছেন কয়েকজন ৷ শিগার, শিগাৎসে এবং গিয়ান্তসে হয়ে ৷
আমি আর রাইসা লাসা থেকে ঝাংমু এসেছিলাম ওই একই পথে, জাপানি জিপে চড়ে ৷ রাইসাকে নিয়ে পথে আরও কত কাণ্ড ঘটেছিল সে আরেক ইতিহাস ৷ রাইসার হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে এতদিনে ৷ কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকতে চায় না, রাইসার মতো এমন বিচিত্র মেমসাহেব বউদের সাহেবরা সামলায় কী করে? যাদু জানে বোধহয় ৷ কী জানি!
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন