কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়

স্বাভাবিক আদিম পরিবেশে বন্যপ্রাণী দেখতে কেনিয়া গিয়েছিলাম এবছর মে মাসে ৷ কেনিয়াতে চৌত্রিশটি অভয়ারণ্য ৷ তাদের নানা নাম, ন্যাশনাল পার্ক, ন্যাশনাল রিজার্ভ, ন্যাশনাল স্যাঙ্কচুয়ারি ৷ সাধারণ মানুষ সবগুলিকে বলে গেম পার্ক ৷ গেম পার্কগুলির প্রধান তোরণ নাইরোবি, কেনিয়ার রাজধানী ৷ এক প্রসন্ন সকালে নাইরোবির জোমো কেনিয়াটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে যাঁরা বাড়িতে নিয়ে গেলেন, তাঁরা দীর্ঘকাল নাইরোবির অধিবাসী ৷ প্রায় একশো বছর আগে তিন-চারটি বাঙালি পরিবার আফ্রিকার রেললাইন পাতবার কাজে কেনিয়া এসেছিলেন ৷ তাঁদের উত্তরপুরুষের অনেকে কেনিয়াতে থেকে গিয়েছেন ৷ প্রধানত নাইরোবিতে ৷ মিত্র পরিবার তাঁদের অন্যতম ৷ আমরা দুদিন এখানে ছিলাম ৷ তারপর ছ-দিনের সাফারিতে পাঁচটি গেমপার্ক বা অভয়ারণ্য ঘুরলাম ৷

কেনিয়ার বড় ব্যবসা পর্যটন ৷ নাইরোবি শহরে দেখেছি এক-পা গেলেই ট্র্যাভেল এজেন্সি ৷ আমরা আমাদের সাফারি কলকাতার ট্র্যাভেল এজেন্সিকে দিয়ে বুক করিয়েছিলাম ৷ ছশো ত্রিশ ডলার মাথাপিছু ৷ বস্তুত, ভালো ট্র্যাভেল এজেন্সি কদিনের সাফারিকে সার্থক ও মনে রাখবার মতো করে দেয় ৷ প্রকৃতির অগোছালো সম্ভার এবং মানুষের সুপরিকল্পিত বিলাসের আয়োজন কত আনন্দময় হয়, আমাদের সাফারির দ্বিতীয় দিনেই অনুভব করেছিলাম ৷ যোগাযোগ এমন, মাউন্ট কেনিয়া সাফারি ক্লাবে প্রবেশের প্রথম ফটকের পাশেই সেদিন দাঁড়িয়েছিল একটি উটপাখি ৷ আমাদের অভ্যর্থনার জন্য নয় সেটা বুঝিয়ে দিল তার তাচ্ছিল্যের দ্বারা ৷ কিছুমাত্র বিব্রত হল না ৷ সদ্য বুঝি আহার করেছিল, একটা টেনিস বলের মতো তার ঠোঁট থেকে ক্রমশ দীর্ঘ গলা বেয়ে নামতে থাকল ৷ ক্লাব বা লজগুলি আসলে হোটেল ৷ সভ্যেরা কিছু বাড়তি সুখ-সুবিধা পায় ৷ বলে রাখা ভালো ক্লাব, হোটেল আর লজগুলি সাধারণত অভয়ারণ্যের মধ্যেই অবস্থিত ৷ তাই বন্য মুক্ত অস্ট্রিচটি নির্ভয়ে আমাদের ফটকের কাছে এসে গিয়েছিল ৷ আসলে আমরাই অনধিকার প্রবেশ করেছি তার বিচরণ ক্ষেত্রে ৷ আরও একটা কথা বলে রাখি ৷ অভয়ারণ্য মানেই জঙ্গল নয় ৷ মাসাইমারা তো বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ৷ মারা-কে বলতে পারি ঘাসের জঙ্গল ৷

অস্ট্রিচকে ডাইনে রেখে আমরা মাউন্ট কেনিয়া সাফারি ক্লাবের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকলাম ৷ ঢেউখেলানো মাঠ দু-একশো একরে ছড়ানো ৷ বর্ষার শুরুতে এখন সবুজে সবুজ ৷ মাউন্ট কেনিয়া সাফারি ক্লাব বিভিন্ন অভয়ারণ্যে নানা ধরনের বাসস্থানের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ৷ তার লাউঞ্জের কোমল আরামদায়ক সোফায় প্রায় নিমজ্জিত হয়ে কেনিয়ান কফি এবং উগ্রতর কোনও পানীয় হাতে নিয়ে সামনের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম ৷ লাউঞ্জের ছাদ থেকে আভূমি কাচের জানালা, ঢেউখেলানো গাঢ় সবুজের অবারিত লন, দূরে দূরে কিছু গাছপালা, দুটি বৃহদাকার সারস অলস গতিতে ইতস্তত চলেছে, আরেকটি স্থিরচিত্রের মতো নিস্পন্দ ৷ একপাশে দূরে সুইমিংপুলের জলের নীল ছোপ, রঙিন প্রজাপতির মতো বহু বর্ণে সংবৃত কিছু মানুষ, অনেকখানি বাঁদিকে ছোট লেক, ডানদিকে গাছের আড়ালে একসারি কটেজ অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে ৷ দৃষ্টি আরও প্রসারিত করলে শেষপর্যন্ত পৌঁছচ্ছে মাউন্ট কেনিয়াতে, আফ্রিকার দ্বিতীয় উচ্চতম শিখর, সমবাহু ত্রিভুজের মতো ৷ এতক্ষণ মেঘে ঢাকা ছিল, হঠাৎ চূড়ার হালকা বরফ চিকমিক করে উঠল ৷ শান্তি ও প্রমোদের এমন অগাধ অপার আয়োজন আর দেখিনি ৷ বাসকক্ষগুলি সুসজ্জিত এবং আরামদায়ক, তেমনই সুন্দর বিশাল ভোজনকক্ষ ৷ হবার কথাই ৷ এই ক্লাবের সদস্যরা তো সামান্য মানুষ নন ৷ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি লিনডন জনসন, আগা খান, বব হোপ, এমনকী টেলিভিশনের ডেভিড ফ্রস্ট ইত্যাদি এই ক্লাবের সদস্য ৷ আমরা তাঁদের সৌজন্যে একদিনের অতিথি ৷ যে দোতলা বড় লম্বা বাড়িতে আমরা ছিলাম সেটা ঢালের ওপর তৈরি করা ৷ ঘরের সামনে টানা বারান্দা ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে ৷ শেষ ঘরটা প্রায় বিশ ফুট নিচে ৷

আহারাদির আয়োজনও তেমনই রাজকীয় ছিল ৷ সন্ধ্যা সমাগমে স্যুট পরা বিধি ৷ স্যুট পরিহিত না হলে ভোজনকক্ষে প্রবেশ বারণ ৷ জঙ্গলে বেড়াতে এসে স্যুট পরতে হবে শুনে কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়েছিল ৷ বন্যপ্রাণী দেখতে অভয়ারণ্যে এইসব অবান্তর কেতা কার ভালো লাগবে ৷ কিন্তু সন্ধ্যার আগেই আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে এল ৷ ছ-টার সময় ঘরে ঘরে ফায়ারপ্লেসে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল পরিচারিকারা ঘটা করে ৷ শয্যায় গরম জলের ব্যাগ ৷ খাবার ঘরে ঢুকে মনে হল অনধিকার প্রবেশ করেছি ৷ মৃদু আলো জ্বলছে ইতস্তত ৷ মহার্ঘ সাজসজ্জার আভাস পাওয়া যাচ্ছে তার অল্প আলোয় ৷ সুসজ্জিত স্ত্রী-পুরুষ মৃদুকণ্ঠে কথা বলছেন, ভোজনকক্ষে একপ্রান্তে ওয়ালটজ বাজাচ্ছেন পাঁচজন শিল্পী ৷ খাদ্যাদিও রমণীয় ছিল ৷ ছ-পদের এমন ডিনার এখন শুধু বইতেই পড়া যায় ৷ স্যুট পরার বিরক্তি কখন চলে গিয়েছিল, প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন ৷

যাত্রার দ্বিতীয় দিনে আমরা মাউন্ট কেনিয়া সাফারি ক্লাবে ছিলাম ৷ প্রথমদিন সকালবেলা রওনা হয়ে আমরা প্রথম থেমেছিলাম নিয়েরি নামের একটি ছোট শহরে ৷ স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল তাঁর শেষ জীবনের ক-বছর এই শহরে কাটিয়েছিলেন ৷ এখন বাড়িটি পর্যটকের দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে ৷ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার জন আমাদের আধঘণ্টা সময় দিয়ে একটা বড় দোকানের সামনে নামিয়ে দিল ৷ দোকান বলতে একটা বিশাল চালাঘর ৷ কাঠের আর পাথরের ছোট-বড় কাজে ভর্তি ৷ মনে হল কয়েক হাজার মূর্তি আছে ৷ দাম জিজ্ঞাসা করে প্রায় নির্বাপিত হয়ে গেলাম ৷ কিন্তু দোকানদার বেরোতে দিতে চায় না ৷ নিজেই দাম কমায়, জেদ করতে থাকে আমরা একটা কিছু দাম বলি ৷ কী বলব? দাম যা বলছে তাতে ওই চালাঘরের দোকানে মোট হিসাবে বিশ-ত্রিশ লক্ষ টাকার সামগ্রী আছে ৷ একটু পরেই আমরা খেলাটা বুঝে গেলাম ৷ দোকানি শুরু করে পাহাড়ের চূড়া থেকে, আর আমরা শুরু করি একেবারে পাদদেশে ৷ আমাদের দরদস্তুরে ব্যুৎপত্তি দেখে আমাদের সঙ্গী দুটি আইরিশ মেয়ে চমৎকৃত ৷ যদিও এখানে কিছু কেনা হল না ৷ ব্যাডেন পাওয়ালের বাড়িও যাওয়া হল না ৷ আমরা আবার প্রশস্ত মসৃণ রাস্তা দিয়ে তীব্রগতিতে রওনা হলাম ৷ বড় রাস্তা অর্থাৎ হাইওয়েগুলি খুব ভালোভাবে দেখাশোনা করা হয় ৷ কোথাও গতির অন্তরায় হয় না ৷ দুপাশে সবুজ ঢেউখেলানো প্রান্তর, কদাচিৎ কিছু বসতি ৷ দূরে ছোট-বড় পাহাড়ের সারি ৷

দ্বিপ্রহরের অল্পপরেই আমরা যেখানে পৌঁছলাম সে অঞ্চলের নাম অ্যাবারডেয়ার ৷ বড় রাস্তা থেকে কাঁচা উঁচু-নিচু জনহীন পথ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার যাবার পর অ্যাবারডেয়ার কান্ট্রি ক্লাব দেখা গেল ৷ কয়েকটি সুদৃশ্য ছোট-বড় বাড়ির সমষ্টি ৷ এখানেই আমাদের দ্বিপ্রহরের ভোজন হবে ৷ ক্লাবের চৌহদ্দির মধ্যে ঢোকবার আগে বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে, সেইদিকে নির্দেশ করে সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে টু গেম পার্ক ৷ ড্রাইভার জন বলল, আমাদের ভারি মোটঘাট সব এখানে জমা থাকবে ৷ লাঞ্চের পর, শুধুমাত্র ছোট হাতব্যাগ নিয়ে আমরা অন্য একটা গাড়িতে করে দ্য আর্ক-এ যাব ৷ সেখানেই রাত্রিবাস ৷

আমাদের আর কিন্তু শোনার ধৈর্য ছিল না ৷ সাইনবোর্ডের নির্দেশিত পথ ধরে আমরা গেম পার্কের দিকে দৌড়লাম ৷ প্রথমেই একদল বেবুনের সঙ্গে দেখা হল ৷ এই বানর-প্রজাতি বেবুনদের মুখটা লম্বাটে হয় ৷ তারা একদল খেলা করছিল মাঠে ৷ আমাদের দেখে দ্রুত চলে গেল ৷ অনেকখানি হেঁটেও আর কোনও প্রাণী দেখতে পেলাম না ৷ লাঞ্চের সময়ও হয়ে আসছে, আমরা কান্ট্রি ক্লাবে ফিরে চললাম ৷ দেখি আমাদের গাড়ির মতো আরও কয়েকটি গাড়ি পর্যটক নিয়ে এসে গিয়েছে ৷ এই মধ্যবর্তী স্থানে সবারই মধ্যাহ্নভোজন হবে ৷ ভোজনও পরম রমণীয় ছিল ৷ বুফে অর্থাৎ সব খাবার, সম্ভবত পঞ্চাশটি পদ, টেবিলে সাজানো ৷ খাবার নিয়ে ছুরি-কাঁটা সাজানো সুন্দর টেবিলে গিয়ে বসা যায় ৷ আমরা একটা বারান্দায় গিয়ে বসলাম ৷ পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই ৷ বিয়ার অথবা ওয়াইন কিনে খেতে হচ্ছে ৷ তার কত দাম জানি না, আমি একবোতল মিনারেল ওয়াটার চাইলাম ৷ বড় আনন্দদায়ক ভোজন হল, সম্পূর্ণ ইউরোপীয়-দুয়েকটি সবজির পদ দেখে মনে হয়েছিল ভারতীয় ধারার ৷ জলের বিল আসতে বিব্রত হয়েছিলাম ৷ আমার সঙ্গে কেনিয়ান শিলিং, প্রায় শ-দেড়েক ছিল-ভারতীয় টাকার হিসাবে একশো টাকা ৷ ভেবেছিলাম সুবিধা মতো ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে নেব ৷ এক বোতল জলের বিল এল দেড়শো শিলিং ৷ আমার কাছে দু-চার শিলিং কম আছে, তার ওপর বকশিশ ৷ দ্বিধা করেও সঙ্গী আইরিশ মেয়েদের কাছ থেকে কিছু শিলিং নিতে হয়েছিল ৷

হঠাৎ পর্যটকদের চাঞ্চল্য দেখে আমরাও উঠে পড়লাম ৷ সবাই বাগানে নেমে দৌড়চ্ছেন ৷ দূরে একটা ময়ূর দেখে সকলের আনন্দ আর ধরে না ৷ শেষপর্যন্ত কিন্তু সবাইকে দমে যেতে হল ৷ ক্লাবের পোষা ময়ূর ৷

এবারে কয়েক গাড়ির যাত্রী মিলিয়ে আমরা একটি বড় বাসে করে যাব ৷ আফ্রিকার অশেষ প্রান্তরের মধ্যে ভালো রাস্তা দিয়ে ঘণ্টাখানেক যাবার পর আমাদের বাস কাঁচা রাস্তায় উঠল এবং ক্রমশ দুপাশে গাছপালার জটলা বাড়তে থাকল ৷ আমরা অ্যাবারডেয়ার পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকছি ৷ বন্যপ্রাণী দেখবার জন্য অধীরতায় অস্পষ্ট অর্থাৎ জন্তু-সদৃশ কোনও কিছু দেখলেই সবাই লাফিয়ে উঠছিল ৷ যাত্রীরা জানলায় মুখ রেখে বসে আছেন ৷ সামনের দিকের আসন থেকে উৎসাহব্যঞ্জক আওয়াজ শুনে আমরা সেদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ৷ নিরাশ হতে হল, রাস্তার ধারে একটা গাছের গুঁড়িমাত্র ৷ অমনি আরেকবার উত্তেজনায় সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখলাম একপাল বেবুন ৷ জঙ্গলের মধ্যে একটা ক্লিয়ারিং-এ বাস থামল ৷ বাসের গাইড জানাল, আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছে, এরপর আর বাস যায় না ৷ এখান থেকে আর্কে পৌঁছতে হবে পায়ে হেঁটে ৷ যাবার পথটা বিচিত্র, সরু পুলের মতো, কোথাও গাছের মাথার ওপর দিয়ে, কোথাও গভীর খাদ পার হয়ে আমরা কাঠের তৈরি মস্ত একটা চারতলা বাড়ির দোতলায় গিয়ে পৌঁছলাম ৷ বাড়িটা বজরার আকার ৷ তিনদিকের জঙ্গল প্রায় ঘিরে রেখেছে ৷ একদিকে খানিকটা খোলা জমি, পাশে একটা জলা, তারপর জঙ্গল আবার ঝাঁপিয়ে এসেছে ৷ খোলা জমির একস্থানে নুন ফেলে দেওয়া হয় ৷ বন্যপ্রাণী নুনের স্বাদ নেবার জন্য এবং জল পানের জন্য এখানে আসে ৷

কেনিয়াতে দ্য আর্কের মতো আরও দুটি হোটেল আছে, যাদের বলা হয় ট্রি হোটেল ৷ এই পর্যায়ের প্রথম হোটেল ট্রি-টপস পৃথিবী-বিখ্যাত ৷ ১৯৫২ সালে যখন সত্যিই ছিল ট্রি হোটেল অর্থাৎ গাছের ওপরে হোটেল, তখন বর্তমান ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ যে রাতে এই হোটেলে বাস করেছিলেন সেই রাতে তাঁর বাবা ষষ্ঠ জর্জ মারা যান ৷ সন্ধ্যার রাজকুমারী সকালে রানি হয়ে ট্রি-টপস থেকে নেমেছিলেন ৷ তখনকার সেই ট্রি-টপস আর নেই, দুকামরার ট্রি-টপস ৷ এখন সেখানে ৫২ কামরার হোটেল ৷ খুঁটির ওপর তৈরি এই হোটেলটিতে থাকবার ইচ্ছা ছিল ৷ কিন্তু আমাদের ট্যুর প্রোগ্রামে ছিল দ্য আর্ক ৷ এই ট্রি হোটেলগুলির বিশেষত্ব হল তাদের অবস্থান, গভীর জঙ্গলের মধ্যে ৷ হোটেলে প্রবেশ করে হোটেলেই বাস করতে হয় ৷ বেরিয়ে অথবা নেমে কোথাও যাবার উপায় নেই ৷ বলা যায় হোটেলের আকারে এক ওয়াচটাওয়ার ৷ তবে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ৷ দ্য আর্কের বাসকক্ষগুলি ছোট ৷ কিন্তু সঙ্গে ঝকঝকে বাথরুম ৷ লাউঞ্জ ইত্যাদি বেশ বড় ৷ তেমনই বড় ভোজনকক্ষ ও পানশালা ৷ সুসজ্জিত ৷ সর্বত্র মস্ত মস্ত কাচের জানলা ৷ এছাড়া তিনটি অবজারভেশন পোস্ট ৷ দুটি বন্ধ কাচের জানলার এপারে, আরেকটি খোলা ডেকে বা ছাদে ৷ আমরা বন্যপ্রাণী দেখবার জন্য চঞ্চল ৷ নির্দিষ্ট ঘর চিনে নিয়েই অবজারভেশন পোস্টে ছুটলাম ৷ সল্ট লিকে তখন গুটি ছয় হাতি এবং দশ-বারোটি বন্যমহিষ ৷ পর্যটকরা উত্তেজিত ৷ ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলছে, ভিডিওর চাকা ঘোরার শিরশির ৷ কথা বলা বারণ, বারবার বলে দেওয়া হয়েছে ৷ যথাসম্ভব কম কথা বলবেন, আস্তে বলবেন, ফ্লাশ জ্বালাবেন না ক্যামেরার-জন্তুরা বিরক্ত হবে, ত্যক্ত হবে ৷ ট্রি-হাউস হোটেলগুলিতে ছোট ছেলেমেয়েদের আনা বারণ ৷

আরেকটু দূরে ঘাসের আবছা আড়ালে দুটি ওয়ার্টহগ ৷ হাতিরা প্রায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে, মহিষেরা মাটি চাটছে ৷ ক্রমে বেলা পড়ে আসতে ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠল-সামনেটা পরিষ্কার দিনের মতো উজ্জ্বল ৷ কিছুক্ষণ পরে চারটি হাতি ফিরে বাঁদিকের জঙ্গলে চলে গেল ৷ মহিষ দুটি জলার ধার দিয়ে ডানদিকে হাঁটতে লাগল ৷ ওয়ার্টহগ দুটি ঘাসের আড়ালে বসে থাকল ৷ আমাদের চা-পানের ডাক এসেছিল ইতিমধ্যে ৷ চায়ের আসর থেকেও কাচের জানলা দিয়ে একপাশের জঙ্গল দেখা যায় ৷ আবার দুটি হাতি মন্থর পায়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল ৷ হঠাৎ থেমে গেল ৷ আমরাও চুপচাপ বসে দেখছি, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল নেই ৷ বলে দেওয়া হয়েছিল যাঁরা সারা রাত অবজারভেশন পোস্টে বসে থাকতে না চান, তাঁরা নিজের ঘরের উষ্ণশয্যায় থাকবেন ৷ উল্লেখযোগ্য কোনও ঘটনা ঘটলেই প্রত্যেক ঘরে সাংকেতিক ঘণ্টি বাজাবার ব্যবস্থা আছে ৷ একটা ঘণ্টা বাজলে হাতি, দুবার বাজলে গণ্ডার ইত্যাদি ৷

রাতের প্রথম অংশ জাগরণেই কাটল ৷ খাবার ঘর থেকেও একদিক দেখা যায় ৷ কখনও গাছপালা নড়ে উঠল, হয়তো ছায়া ছায়া কিছু দেখা গেল, আমরা তৎক্ষণাৎ টেবিল ছেড়ে জানলার ধারে ৷ শোবার আগে অনেকক্ষণ নানাদিক থেকে জন্তুদের দেখলাম ৷ আফ্রিকায় বলে ‘বিগ ফাইভ’-হাতি, সিংহ, বন্যমহিষ, গণ্ডার ও লেপার্ড (চিতাবাঘ) ৷ লেপার্ডের সাক্ষাৎ পাওয়া সহজ নয় ৷ আমরা গণ্ডার দেখতে পাইনি আর্কে ৷ মনে দুঃখ থেকে গিয়েছিল, তখন তো জানি না আর্ক উপক্রমণিকা মাত্র ৷

রাতে মাঝে মাঝে উঠে অবজারভেশন পোস্টে আসছি ৷ শুধু আমরা নয়, আরও অনেকে ৷ বন্যপ্রাণীদের ধৈর্য দেখে অবাক হচ্ছিলাম ৷ একটা হাতির লেজ ধরে ছোট্ট বাচ্চা হাতি এল ৷ সল্ট লিকের কাছে দুজন দাঁড়িয়ে থাকল, প্রায় ঘণ্টাখানেক ৷ কোনও কিছু ঘটছে না, কী ভাবছে বোঝার উপায় নেই ৷ ছটা-আটটা মহিষ চিত্রার্পিত দাঁড়িয়ে ৷ তবে একটা বিষয় লক্ষ করলাম ৷ মহিষকে হাতিও সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখে ৷ কেউ কারও কাছাকাছি যায় না-সবাই যদিও অল্প একটু স্থানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ৷ একসময় বাচ্চা হাতি আবার তার মায়ের লেজ ধরে জঙ্গলে ফিরে গেল ৷ কেন এসেছিল, কেন চলে গেল, কে জানে ৷ ডানদিকের জঙ্গল থেকে একজোড়া হরিণ এসেছিল, তারা হাতি ও মহিষের থেকে একটু দূরে দূরে থাকল ৷ একটি পাশে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ৷ অনেকক্ষণ পরে অন্য হরিণটি আবার ধীরে সুস্থে জঙ্গলে ফিরে গেল ৷ তার সঙ্গীকে আর দেখলাম না ৷ একটা বড় খরগোশ হাঁটু মুড়ে বসে যেন ধ্যান করছিল, দুটো হাতি আসতে দেখে, একটু পাশে সরে গিয়ে আবার ধ্যানমগ্ন হল ৷

রাত গভীর হতে জঙ্গল কিন্তু নীরব হল না ৷ ঝিঁঝি এবং নানা কীটপতঙ্গ অবিরাম তীব্র আবহ সৃষ্টি করল ৷ মাঝে মাঝে রাতচর অন্যান্য পাখির আওয়াজ, ব্যাঙের ডাকও কদাচিৎ ৷ জলা থেকে দুটো হাঁস উঠে এল, এবার হাতির মস্ত কান নাড়ার শব্দ ৷ আর কোনও শব্দ নেই ৷ আসন্ন কোনও অঘটনের জন্য যেন সারা প্রকৃতি স্থির হয়ে আছে ৷ প্রখর আলো যেন সেই সম্ভাবনাকে আরও প্রবল করে তুলেছে ৷

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ৷ কোনও ঘণ্টা শুনতে পাইনি ৷ শোনার দরকারও ছিল না ৷ আমাদের আর্কের রাত পূর্ণ হয়েছে ৷ ব্রেকফাস্টের পর রওনা হয়েছিলাম কেনিয়া সাফারি ক্লাবের উদ্দেশে ৷ পথে অ্যাবারডেয়ার কান্ট্রি ক্লাবে আমরা বাস ছেড়ে আবার জনের গাড়িতে উঠলাম ৷

মাউন্ট কেনিয়া সাফারি ক্লাব থেকে তৃতীয়দিন প্রাতরাশের পর রওনা হলাম নাকুরু লেক ৷ পথে, অ্যাবারডেয়ার পাহাড়ের অন্য পাশে টমসনস ফলস ৷ টমসন জলপ্রপাত ৷ ৭৩ মিটার উঁচু থেকে একটা মাঝারি ধারা নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ৷ এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয় ৷ প্রপাতের শীর্ষে এবং নিচের জলাধার পর্যন্ত যাবার রাস্তা আছে ৷ দুদিকে বড় গাছের জটলা ৷ গাড়ি থেকে নেমেই দেখি একটা কিকুয়ু নাচের দল বসে আছে ৷ দল বলতে দুজন ৷ কথাকলি নর্তকের মতো নানা রং লাগানো মুখে ৷ পরিধানও চিত্র-বিচিত্র ৷ হাতে বর্শা ৷ পাশে ইংরিজিতে নোটিস লাগানো, ছবি তুললে এক ডলার দিতে হবে, ভিডিও ফিল্ম তুললে দশ ৷

নাকুরু বুঝি কেনিয়ার তৃতীয় প্রধান শহর ৷ বর্তমান রাষ্ট্রপতির বাড়ি এই শহরে ৷ জন বারবার সখেদে বলতে লাগল, এখন তো কালেনজিন উপজাতির পোয়াবারো, রাষ্ট্রপতি ময় ওই উপজাতির মানুষ ৷ সব উন্নয়ন তাই এখন নাকুরু শহরে, নাকুরু জেলায় ৷ বলল, মাসাইরাও খানিকটা সুযোগ নিচ্ছে, মন্ত্রিসভায় তাদের মন্ত্রী টিমামার প্রভাব খুব বেশি ৷ অন্যদের জন্য শুধুই অবহেলা ৷

ইতিমধ্যে আমরা নাকুরু লেকের ধারে চলে এসেছি ৷ অন্যপাড়ে গোলাপি রঙের বর্ডার লেকের সমস্ত বিস্তার জুড়ে ৷ ওই বর্ডার আসলে ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি ৷ বৃহদাকার এই পাখিগুলির এই লেকে বাস ও প্রজননক্ষেত্র ৷ পৃথিবীর অন্য কোথাও একসঙ্গে এত ফ্ল্যামিঙ্গো দেখা যায় না ৷ জন বলল, পনেরো-বিশ লক্ষ পাখি থাকে এখানে ৷ এখন লেকের জল কমে যাওয়ার জন্য কিছু পাখি চলে গিয়েছে ৷ জল তটরেখা থেকে অনেক দূরে ৷ সূর্য অতি প্রখর ৷ হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল ৷ তবু আমরা আধ কিলোমিটার হাঁটলাম ৷ খোলা চোখেও পাখিগুলিকে আলাদা করে দেখা যাচ্ছে তখন ৷ বাইনোকুলার লাগিয়ে তো পরিষ্কার ৷ বেশিরভাগই জলে ৷ কিছু আকাশে ইতস্তত উড়ছে ৷ হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে একটা পাখি জল থেকে আকাশে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আরও ত্রিশ-চল্লিশটা পাখি জল থেকে উঠে পড়ল ৷ তারা একটা সরলরেখার ফর্মেশন করে গোলাপি একটা দীর্ঘ বর্শার মতো আকাশে ভেসে থাকল কিছুক্ষণ ৷ আবার কোনও অদৃশ্য সংকেতে প্রথম পাখিটি জলে নেমে পড়ল, অন্যেরাও পরের পর নামতে থাকল ৷ হঠাৎ দেখি একটা পাখি অল্পজলে মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছে ৷ পনেরো-ষোলটা পাখিও তার পিছন পিছন বাহিনীর সৈন্যের মতো মার্চ করে চলেছে ৷ মনে মনে আমরা লেফট রাইট শুনতে পাচ্ছি ৷ হলট-দলটা থমকে দাঁড়াল ৷ সামনের পাখি ঘুরে আবার উল্টো দিকে চলতে আরম্ভ করল, বাহিনী তখনও তার পিছনে ৷ চড়া রোদ এবং ভূমি বৃক্ষহীন না হলে আরও অনেকক্ষণ দেখতে পারতাম ৷ লাঞ্চ অপেক্ষা করছে, সুতরাং আমরা পৌঁছলাম লেকের ধারে ছোট পাহাড়ের ওপর হোটেলে-লায়ন হিল সারোভা লজ ৷ খাবার ঘরটা নাইরোবির কার্নিভোর রেস্টুরেন্টের মতো, কাঠের মোটা কাজ ৷ তবে এখানে ইতিহাসের ও মাটির আরও কাছাকাছি ৷ নিচে লেক দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ের বিশাল গাছে নানা পাখির কলরব এবং একটু আলো কম ৷

পানীয় জল এখানেও কিনতে হল ৷ বুফে লাঞ্চ ৷ ইউরোপীয় ভোজ্যের কয়েক পদ ৷ গুজরাটি ডাল রুটি কড়হি আর উপরি হল কেনিয়ান ভোজ্যের চারটি পদ ৷ আমি কেনিয়ান ভোজ্যে মন দিলাম ৷ খুব মন দেবার মতো নয় যদিও ৷ কেনিয়ানদের অঞ্চল ভেদের কথা বাদ দিলে প্রধান খাদ্য ভুট্টা ও কাঁচকলা ৷ সিদ্ধ ও পিষ্ট ভুট্টার দানা বড় বরফির আকারে কেটে রাখা আছে, তার নাম উগালি ৷ স্বাদে নিতান্তই নিরেশ ৷ উগালির সঙ্গে খাবার জন্য একটা কাঁচকলার ব্যঞ্জন, মাটোকে ৷ ব্যঞ্জন না বলে কাঁচকলা সিদ্ধ বলা যায়-মশলাপত্র অতি সামান্য ৷ আর মটনের যে পদটি ছিল, সেটিতে স্পষ্ট ভারতীয় প্রভাব ৷ নারকোল মেশানো ৷ এরা তেল ঘি পরিহার করে ৷ লঙ্কাও অপছন্দ ৷ কখনও সামান্য মেশানো হয়, বলে পিলপিলি ৷ নাইরোবিতে একদিন নির্ভয়কুমার কেনিয়ান খাবার আনিয়েছিল, ইরিও ৷ আলু, ভুট্টার দানা, সিমের বিচি ইত্যাদি সেদ্ধ করে মাখা আলুভাতের মতো ৷ কিঞ্চিৎ সরষের তেল এবং কাঁচা লঙ্কা যোগ করলে ভালোই লাগত ৷ কাঁচা পিঁয়াজ সংযুক্ত হলে তো কথাই নেই ৷

লাঞ্চের পর বিশ্রাম নেই ৷ চারজনে গাড়িতে উঠে নাকুরু রিজার্ভে চললাম ৷ জন বলেছিল এখানে চিতাবাঘ দেখা যাবে ৷ আমরা সমানে বড় গাছের নিচের ডালে নজর রাখছিলাম ৷ চিতাবাঘ অর্থাৎ লেপার্ড নাকি এই সময়টাতে অর্থাৎ দুপুরে বিশ্রাম করে ৷ বিশ্রামের স্থান গাছের ডালে ৷ আগের দিনের শিকারও তুলে রাখে ৷ আমাদের দুর্ভাগ্য কোনও গাছের ডালে নিদ্রিত চিতাবাঘের দেখা মিলল না ৷ ইংরিজি চিতা এবং লেপার্ড দুই প্রজাতিকেই আমরা চিতা বলি ৷ পরে আমরা চিতা দেখেছি, কিন্তু লাজুক, শঠ লেপার্ড বা চিতা বাঘের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হল না ৷ সন্ধ্যার মুখে এবং ভোরবেলায়, কোনও সময়ই নয় ৷

নাকুরু রিজার্ভে গণ্ডার দেখেছি কয়েকটি ৷ গাড়ির রাস্তার পাশাপাশি ত্রিশ-চল্লিশ হাত দূরে আমাদের সঙ্গে একদিকে চলেছে ৷ আমরা গাড়ির গতি কমিয়ে একটা জোড়ার পাশে পাশে চলতে থাকলাম, চলন্ত ট্যাঙ্কের মতো এবং তেমনই ধীর গতিতে ৷ জোড়া খড়্গের এই গণ্ডার আফ্রিকার বিশেষত্ব ৷ এগুলো ছিল কালো গণ্ডার ৷ সাদা গণ্ডার দেখতে গেলে অন্যত্র যেতে হত ৷ আপাত-নিরীহ প্রাণীগুলি আমাদের প্রতি নির্বিকার ৷ নিজের সামর্থ্যে ভরসা থাকলে এমনই হয় ৷ আরেকটা দল দেখেছিলাম তৃণভোজে ব্যস্ত ৷ আমাদের একপাশে দূরে নাকুরু লেক ৷ মধ্যে হালকা জঙ্গল ৷ অন্যপাশে তৃণভূমি-বড় দু-আড়াই ফুটের ঘাস, তারপর পাহাড় বড় গাছে ভরা ৷ জিরাফও এখানে দেখলাম ৷ বিচিত্র দর্শন প্রাণী তার অস্বাভাবিক লম্বা গলা বাড়িয়ে গাছের মাথার কাঁটাপাতা খাচ্ছে ৷ কারও প্রতি ভ্রূক্ষেপ নেই ৷ হরিণ অজস্র, নানা প্রজাতির-ছোট বড় ৷ অনেক নামও শুনলাম, গ্যাজেল, হল্যান্ড, ইমপালা, অরিস, বুশবাক, ওয়াটার বাক ৷ কাছাকাছি গেলে তারা শূন্যে অপরূপ লাফ দিয়ে মুহূর্তে চলে যায় ৷ তারপর সতর্ক কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে গ্রীবা বেঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে ৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, আমাদের বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার যেতে হবে নাইভাশা লেকের ধারে, যেখানে আমাদের রাত্রিবাস ৷ বৃহৎ পাঁচের তিনটি দেখেছি, চিতা ও সিংহ এখনও বাকি ৷

নাইভাশা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল ৷ নাইভাশা কান্ট্রি ক্লাব নাইভাশা লেকের ধারে ৷ যদিও পাঁচ প্রধানের কেউ নয়, হিপো, জলহস্তী তখনও দেখিনি ৷ শুনেছি নাইভাশা লেকে অনেক জলহস্তীর বাস ৷ এখানে ঠান্ডা একটু বেশি ৷ হোটেলের বিশাল কম্পাউন্ডে ছোট ছোট এক বা দুকামরার কটেজ ৷ আয়োজনের কোনও ত্রুটি নেই ৷ এখানে প্রথম মশারি দেখলাম ৷ শুনেছিলাম ম্যালেরিয়ার ভয় খুব বেশি ৷ ট্যাবলেটে না শানাতেও পারে ৷ মস্ত মাঠের ভেতর টালিপাতা সরু পথ মাঝে মাঝে, ওপরে ঢাকা দেওয়া নিচু আলোর রাস্তাটা একটা আলোকিত ফিতের মতো দেখাচ্ছে ৷ মস্ত মস্ত গাছ ৷ আমাদের কটেজ থেকে ভোজনকক্ষ ও পানশালা অনেক দূরে ৷ যেতে যেমন ভালো লাগছিল তেমনই একটু ভয়ও করছিল ৷ লাউঞ্জে গিয়ে নানা নোটিস পড়ছিলাম ৷ লেখা আছে রাতে ভোজনকক্ষ থেকে ঘরে যাবার সময় আমাদের প্রহরীকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন ৷ গাটা শিরশির করে উঠল ৷ ভোজন এখানেও পরিপূর্ণ তুষ্টির হল ৷ নিরামিষ একটা অঞ্চল রয়েছে, সেখান লুচি, আলুর তরকারি, ডাল, ভাজা, পাঁপড় ইত্যাদি দেখলাম ৷ সব জায়গাতেই স্যালাড খুব পছন্দের ৷ আহারের পর লাউঞ্জে বসে কফি পান হল, সামনে আগুন জ্বলছে ফায়ারপ্লেসে, টিভিতে কী একটা ছবি হচ্ছিল ৷ ঘরে ফেরবার সময় এক প্রহরী আমাদের সঙ্গে গেল ৷

শুনলাম সকালে অনেক জলহস্তী আমাদের হোটেলের হাতার কাছাকাছি চলে আসে ৷ জলহস্তীরা এলে ঘণ্টি বাজিয়ে ডেকে দেবার ব্যবস্থাও আছে ৷ আমরা অনুরোধ লিখিয়ে ঘরে ফিরে এলাম ৷ ভোরে কোনও ঘণ্টি বাজল না ৷ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে লেকের ধারে গিয়ে জলহস্তী দেখার জন্য উঠে পড়লাম ৷ টালি-বাঁধানো সরু রাস্তা শেষ হবার পর বড় বড় গাছের তলা দিয়ে লেকের ধারে চলেছি ৷ কোথাও জনপ্রাণী নেই, অনেকখানি যেতে হল ৷ নিস্তব্ধ,জনহীন, একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল ৷ একটা ছোট জেটি, মোটরলঞ্চ বাঁধা আছে সেখানে ৷ পর্যটকদের লেকে ঘুরিয়ে একটা ছোট দ্বীপেও নিয়ে যায় ৷ ত্রিসীমানায় কোনও জলহস্তী নেই ৷ হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছি, হোটেলের এক কর্মচারীকে দেখা গেল ৷ বলল, হিপো দেখতে পেলেন না? চারটে হিপো সকালেই এখানে এসেছিল ৷ চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে লেকের মাঝখানে নির্দেশ করে বলল, ওই যে, ওই ওখানে দুটো হিপো ৷ বহুদূরে জলে কালো একটা ছায়ার মতো ৷ হিপো কোনটা বুঝতে পারলাম না ৷ একটা খেদ থেকে গেল ৷

পরদিন প্রাতরাশের পর মাসাইমারা যাত্রা ৷ এইদিন সকালটা সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল ৷ তৃণগুল্মের বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে আবার গাছপালার জগতে ফিরে এলাম ৷ হঠাৎ ছবির মতো স্থির একজোড়া জিরাফ ৷ নানা স্থানে, আমাদের গোচারণভূমিতে যেমন একশো-দুশো জেব্রা ৷ হরিণ যত্রতত্র ৷

আমরা যাব রিফটভ্যালির মধ্য দিয়ে ৷ ভূতাত্বিকেরা বলেন, এটা হল প্রথম ঢালাইয়ের পর স্থপতির সংশোধনের কাজ ৷ লম্বালম্বি প্রায় দুহাজার মাইল, কোথাও পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত চওড়া, পৃথিবীর একাংশ দুহাজার ফুট নিচে নেমে গিয়েছে, যেন দুই স্পষ্ট থাক বা স্তরে ভাগ করা ৷ নিচের উপত্যকাকে বলা হয় রিফটভ্যালি ৷ প্রচুর চাষবাস উপত্যকায় ৷ খেতে কাজ করছে মানুষ ৷ মাইলের পর মাইল কফি চাষ ৷ আরেকটু নিচে অনুরূপ চা-বাগান ৷

ক্রমে আমরা নিচের উপত্যকা থেকে ওপরে উঠতে লাগলাম ৷ গাছপালা কমে এল ৷ রুক্ষ, নিষ্ফলা, বিশাল সব প্রান্তরের মধ্য দিয়ে আমরা মাসাইমারার দিকে চলেছি ৷ পাহাড়ের সারি দূরে সরে গিয়েছে ৷ রাস্তা ভালো নয় ৷ দীর্ঘ ঘাসে ভরা দিগন্ত-ছোঁওয়া সমতল ৷ দু-দশটা অ্যাকেশিয়া, কদাচিৎ একটা বড় গাছ, আর কোনও উদ্ভিদ নেই ৷ জেব্রা, ওয়াইলডবীস্ট, হরিণ, ওয়ার্টহগ দেখা যেতে লাগল ৷ আর ছোট-বড় নানা পাখি, সেক্রেটারি বার্ড, বুজার্ড, লম্বালেজ উইডোবার্ড, প্লোভার, স্টার্লিং ৷

১৮০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে মাসাইমারা সংরক্ষিত অঞ্চল ৷ কয়েকটি মাসাই গ্রাম পার হয়ে এলাম ৷ গ্রাম অর্থে কুড়ি-ত্রিশটি ছেঁচাবেড়ার কুটির বৃত্তাকারে গায়ে গায়ে লাগানো ৷ মাসাইদের দৈর্ঘ্য দেখবার মতো, ছ-ফুট বা তারও বেশি ৷ চড়া লাল রঙের একটা চাদর সর্বক্ষণ গায়ে থাকে ৷ হাতে একটা ছোট লাঠি, তার মাথাটা গদার আকারে ঈষৎ স্ফীত ৷ মাসাই উপজাতি পশুপালনে দক্ষ, এটাই তাদের জীবিকা ৷ কিন্তু কৃষিকাজ জানে না ৷ প্রাগৈতিহাসিক পরম্পরা থেকে তারা এখনও চাষবাস করতে চায় না ৷ আদিম রীতির পরিবর্তন হয়নি বলা চলে তাদের সমাজে ৷ এখনও পালিত পশুর রক্তক্ষরণ করে পান করে ৷ গ্রামের মানুষের পাকশালায় দেখেছি রক্ত রাখা হয়েছে, রন্ধনে ব্যবহার হবে ৷

অসম সাহসী মাসাইরা যেখানে বাস করে সেটা সিংহের অঞ্চল ৷ আমাদের ড্রাইভার জন বলল, সিংহেরা মাসাইদের ভয় করে ৷ অস্ত্রশস্ত্রকে নয় ৷ মাসাই এবং সিংহ অনাদিকাল থেকে পাশাপাশি বাস করছে, তারা পরস্পরকে বংশানুক্রমে জানে, সমীহ করে ৷

মাসাইমারাতে আমরা উঠলাম কিকোরক লজে ৷ লজটি দেখে মন প্রসন্ন হল ৷ দূরে দূরে ছড়ানো কটেজ এবং ভিলা ৷ লাঞ্চ প্রস্তুত ছিল ৷ লাঞ্চের পরই আমরা বন্যপ্রাণী দেখতে বেরিয়ে পড়লাম ৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত মারার যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো যাবে ৷ সূর্যাস্তের পর মারা অঞ্চলে যানবাহন বা লোক চলাচল নিষিদ্ধ ৷ মাসাইমারার মতো এত বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আর কোথাও নেই ৷ শুধু মাসাইমারাতে গেলেই আফ্রিকার সব বন্যপ্রাণী দেখা যায় ৷ এখানে আমরা হাতির যূথ দেখলাম কয়েকটি ৷ আফ্রিকার হাতিদের মাথা ভারতীয় হাতিদের অনুপাতে ছোট হয় ৷ যদিও এখানের হাতি আকারে বড় ৷ আমরা বিশ-পঁচিশ গজ দূরে গাড়িতে ৷ হাতিরা বিশেষ গ্রাহ্য করল না ৷ সিংহও তেমনই ৷ যতবার দেখেছি সিংহের দল বিশ্রামে মগ্ন ৷ পর্যটকদের দিকে একবার চোখ মেলেই আবার নিশ্চিন্তে নিদ্রা দিচ্ছে ৷ মারা জুড়ে অনেক পর্যটকের গাড়ি এসে গেছে ৷ সব গাড়িতে বেতারের বন্দোবস্ত আছে ৷ কোথায় কোন প্রাণী আছে পরস্পর কথা হচ্ছে ৷ রাস্তা ছেড়ে মারার ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে ৷ দু-আড়াই ফুট ঘাসের আড়ালে কোথায় জন্তু আছে ড্রাইভারেরা সহজেই খুঁজে বার করছে ৷

হঠাৎ সামনে চারটি সিংহ ৷ আমরা একটু ঘুরে তাদের কাছাকাছি চলে এলাম ৷ ত্রিশ-চল্লিশ ফুটের মধ্যে ৷ একটি সিংহ এবং তিনটি সিংহী ৷ সবাই বিশ্রামের ভঙ্গিতে ৷ সিংহীরা হঠাৎ দেখলাম স্থির হয়ে একদিকে তাকিয়ে, তারপর গুঁড়ি মেরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল ৷ দূরে দেখতে পেলাম দুটি হরিণ ভয়হীন ঘাস খাচ্ছে ৷ তিনজনের দল ছেড়ে এক সিংহী বাঁদিকে চলে গেল, অন্যজন ডানদিকে ৷ সবটাই হচ্ছে নীরবে এবং সন্তর্পণে ৷ জন বলল, সিংহ এভাবেই শিকার করে ৷ ওরা দৌড়তে পারে না হরিণের মতো ৷ হরিণ একবার জানতে পারলে মুহূর্তে পালিয়ে যাবে, তাই সিংহেরা তাকে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরবার চেষ্টা করছে ৷ আমরা আসন্ন একটা হত্যালীলা দেখবার সম্ভাবনায় টানটান হয়ে আছি ৷ স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ছে ৷ একটি হরিণ বোধহয় সিংহের গন্ধ পেয়েছিল ৷ মাথা উঁচু করে স্থির হয়ে একদিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বিদ্যুতের মতো দৌড়তে লাগল ৷ তার সঙ্গীও মুহূর্তে তার সঙ্গে যোগ দিল ৷ হরিণের দৌড়ের মতো এমন মনোরম দৃশ্য আর দেখিনি ৷ মনে হয় ক্ষণিক মাটি ছুঁয়ে আবার হাওয়াতে তীরের গতি পেয়েছে ৷ সিংহীর দল অনেকক্ষণ নিজেরা নিজের জায়গায় বসে থাকল ৷ তারপর আবার সিংহের কাছে ফিরে এল ৷ সিংহ সমস্তক্ষণ নিশ্চিন্তে আলস্য উপভোগ করছিল ৷

চিতাবাঘ দেখবার জন্য অনেক ঘোরা হল ৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, তাই লজে ফিরে এলাম ৷

লজে ফিরে মনে পড়ল হিপো তো দেখা হয়নি ৷ মারার যেখানে আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরছিলাম সেখানে কোনও জলা জায়গা ছিল না ৷ হিপো থাকবেই বা কোথায় ৷ খবর পেলাম কিকোরক লজের চৌহদ্দির বাইরে একটা জলা, সেখানে একটি হিপো আছে ৷ তাকে দেখতেই পরদিন সকালে হোটেলের বিশাল মাঠ পেরিয়ে সুইমিংপুল পার হয়ে একটা কাঠের সরু উড়াল পুল দিয়ে জলার ওপর পৌঁছে গেলাম ৷ সত্যিই একটা হিপো ৷ সে তখন সর্বাঙ্গ নিমজ্জিত রেখে শুধু নাক-কান আর চোখ দুটি জলের ওপরে তুলে রেখেছিল ৷ প্রায় চিড়িয়াখানায় হিপো দেখার মতো ৷ পরিবেশ যদিও আলাদা ৷ জায়গাটায় বড়-বড় গাছ, চারদিকে মানুষের বসতির চিহ্ন নেই ৷ যাই হোক তবু তো হিপো দর্শন হল ৷

পরের দিন সকালে আমাদের আক্ষেপের কথা শুনে জন বলল, হিপো দেখতে মারা নদীর পারে যেতে হবে ৷ আমরা তো তৈরি ৷ তৎক্ষণাৎ আবার বড় রাস্তা, ছোট কাঁচা রাস্তা, ঘাসে ভর্তি প্রান্তরের মধ্য দিয়ে আমরা দক্ষিণে মারা নদীর উদ্দেশে রওনা হলাম ৷ মারা নদী তানজানিয়া সীমান্তে ৷ আরেকটু গেলেই সেরেনগেটি গেম পার্ক, তানজানিয়ার ৷ সে স্থান নাকি আরও বিশাল ৷ বন্যপ্রাণীর প্রাচুর্য ৷ আমাদের আগে আগে একটা জিপ চলেছে ৷ জিপটা আসলে একটা চিত্রবিচিত্র বেলুনকে অনুসরণ করছে ৷ বেলুন তখনও বেশি ওপরে ওঠেনি ৷ পাঁচ-ছ জন যাত্রীকে দেখা যাচ্ছে ৷ ধনী মানুষেরা বেলুনে চড়ে উভয় অর্থে সিংহাবলোকন করেন ৷ বেলুন যেখানে নামবে জিপ সেখান থেকে যাত্রীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ৷ খরচ শুনলাম মাথাপিছু তিনশো ডলার ৷ জন অবশ্য আমাদের আশ্বস্ত করল, জিপে করে ব্রেকফাস্ট চলেছে যাত্রীদের ৷ অবতরণ করামাত্রই উত্তম ব্রেকফাস্ট এবং শ্যাম্পেন দিয়ে তাঁদের সৎকার করা হবে ৷

মারা নদীর ধারে কিছু বড় গাছপালা এবং দীর্ঘ ঘাস ৷ একটা বাঁকের মুখে নদীর জলে দশ-বারোটি হিপো ৷ ছোট-বড় নানা মাপের হিপো মিলিয়ে একটা বড় পরিবার ৷ হয়তো উপনিবেশ বলা ঠিক হবে ৷ নদীর ধার দিয়ে একটু পশ্চিমে যেতেই আরেক দল হিপোর জটলা ৷ কেউ সারা শরীর জলে ডুবিয়ে শুয়ে আছে ৷ দুজন নদীর মাঝে একটা পাথরে উঠে বসেছে ৷ অনেকগুলি অগভীর জলে দাঁড়িয়ে আছে ৷ দুটি শিশু মায়ের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে ৷ পাথরের ওপর থেকে একটা হিপো তার দু-আড়াই টনের বিশাল শরীর নিয়ে কেমন অনায়াসে জলে নেমে গেল ৷ সকালের রোদে হিপোগুলির গোলাপি মসৃণ চামড়া চকচক করছে ৷ মস্ত শরীর, অবিশ্বাস্য ছোট ছোট পা, প্রশস্ত মাথায় বিরাট চোয়াল ৷ হিপোর ছোট-বড় কাঠের ও পাথরের মূর্তি সব কিউরিওর দোকানেই বিক্রি হয় ৷ সম্পূর্ণ বাস্তব অনুসরণ না করে গ্রামীণ শিল্পীদের কল্পনায় হিপোর চোয়াল আরও প্রকাণ্ড এবং পা চারটি অতি ক্ষুদ্রাকার ৷ কাঠ ও পাথরের বিবিধ জন্তুর, পুতুলের মধ্যে হিপোর মূর্তিটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করছিল ৷ যেন আদর করবার মতো প্রাণী ৷ গায়ে হাত দেবার ইচ্ছা হচ্ছিল ৷ রাতে তীরে উঠে ঘাসপাতা এবং জলে মৎস্যাদি যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে হিপোর ভোজন ৷ তার থেকেই এত বড় শরীর ৷

বিকেলে দুটি চিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল ৷ আফ্রিকার গাইড ও ড্রাইভারদের অসাধারণ ক্ষমতা ৷ দু-আড়াই ফুট উঁচু ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে প্রাণীগুলিকে দেখতে পারে ৷ দুনিয়ার সর্বোচ্চগতির প্রাণী চিতা ৷ ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার বেগে দৌড়তে পারে ৷ মানুষের মতো নতজানু ভঙ্গিতে চিতা দুটি বসেছিল দিগন্তে দৃষ্টি মেলে ৷ আমাদের দেখে বিশেষ ভ্রূক্ষেপ করল না ৷ হয়তো এক মাইল দূরে সম্ভাব্য শিকারকে দেখছিল একাগ্র হয়ে ৷ আমার মনে হয়েছে চিতার চোখের নিচে দীর্ঘ কালো রেখাটি যেন অশ্রুর দাগ ৷ চিতার অশ্রুপাতের কোনও কারণ নেই ৷ প্রাণীটি অতি হিংস্র ৷ তখন অপরাহ্নের ছায়া দীর্ঘ হয়ে এসেছে ৷ একটা চিতা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আমরা সচকিত হয়েছিলাম ৷ জন বলল, ওরা ছায়া খুঁজছে ৷ সত্যিই তাই, একটা গাড়ির ছায়ায় এসে দুজন আবার উবু হয়ে বসে দিগন্তে চোখ মেলে দিল ৷

মাসাইমারার শেষ সন্ধ্যায় কিকোরক লজে মাসাই নৃত্যের আয়োজন হল ৷ একদল অতি-দীর্ঘদেহী মাসাই খাটো রক্তাম্বরে ছোট ড্রাম বাজিয়ে কিছুক্ষণ নাচ দেখাল ৷ মেয়েরাও খাটো পোশাকে, তার ওপর চুল অত্যন্ত ছোট করে ছাঁটা, প্রায় মুণ্ডিত ৷ নতুন অবশ্যই, খুব ভালো লেগেছিল বলতে পারব না ৷

দুদিন সকাল বিকেল মারায় প্রচুর ঘোরা হল ৷ বন্যপ্রাণীও দেখেছি প্রচুর ৷ এবার ফেরার দিন ৷ মারাতে প্রাতরাশ, নাইরোবিতে মধ্যাহ্নভোজন ৷ পথে রিফটভ্যালির একাংশ দিয়ে উঁচুতে উঠে মাসাইমারা ও রিফটভ্যালির অনেকটা দেখা যায় ৷ মনে হয়েছিল এখানে দিগন্ত কত বেশি দূরে চলে যায় ৷

যাঁদের সময় অল্প, তাঁরা দুদিন বা তিনদিনের সাফারি নিতে পারেন ৷ মোট হিসাবে মাথাপিছু প্রতিদিন ১৩০ থেকে ১৫০ ডলার পড়ে ৷ তবে যাতায়াত, শয়নভোজন সব খরচ এর মধ্যে ৷ তাঁবু নিয়েও থাকা যায় কোনও কোনও অঞ্চলে, খরচ অল্পই কম পড়ে, তাঁবুর ভাড়া দৈনিক পাঁচ ডলারের কম, আহারাদির এবং যাতায়াতের খরচ নিজের ৷ তার ওপর গাইডের খরচ আছে ৷ দল ভারি হলে তাঁবু ভাড়া নিয়ে থাকা খুব আনন্দের, খরচের সাশ্রয়ও হয় ৷ রাতে একটু ভয়ভয় করে, তবে গা-ছমছম আনন্দের কি তুলনা হয় ৷ অনেক লজেও তাঁবুতে বাসের আয়োজন আছে ৷ তার জন্য অবশ্য দাম কম হয় না ৷ কারণ অন্য সব সুখের আয়োজন থাকে, শুধু নতুন অভিজ্ঞতা হয় ৷

সময় যদি থাকে মাত্র একদিন, তাহলে নাইরোবি শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে, নাইরোবি ন্যাশনাল পার্ক ৷ ভেতরে গাড়ি করে ঘোরা যায়, সর্বত্র গাড়ি থেকে নামা বারণ, অসংখ্য বন্যপ্রাণী দেখা যাবে ৷ সামান্য একশো বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যে এত বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সমাবেশ দেখে আশ্চর্য হতে হয় ৷ পার্কের দক্ষিণ সীমান্তে বাগাথি-আথি নদীতে হিপো ও কুমিরের দেখা মিলবে ৷

দশ কিলোমিটারের ব্যবধানে একদিকে বিংশ শতাব্দীর শহর নাইরোবি, আর অন্যদিকে আদিম বন্য পরিবেশে প্রাণীজগৎ-না দেখলে বিশ্বাস হয় না ৷ এত সহজে এত অল্পে বিংশ শতাব্দীকে দূরে ফেলে আসা যায়?

ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন