অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
ভ্রমণ সম্পর্কে নিজস্ব কোনও অভিজ্ঞতার কথা বলতে বসব, এমন কথা ভাবিনি কখনও ৷
ভাবলেই হল?
বলতে বসার পুঁজিপাটার দরকার নেই? মাল-মশলা? ভ্রমণ শব্দটার সত্যিকার মানেই কী জানলাম কখনও?
বেড়াতে যাওয়ার মানে কিছুটা বুঝি, হাওয়া বদলাতে যাওয়ারও ৷ কিন্তু ভ্রমণ? মনের মধ্যে সেই কোন ছেলেবেলা থেকে যে একটি ধারণা বদ্ধমূল ছিল, সে ধারণার ধারে-কাছেই তো গেলাম না কখনও ৷ যেতে পেলাম কই?
আমার সেই শৈশবকালের চেতনায় ছিল ভ্রমণ মানে একটি দুঃসাহসিক অভিযান-যে অভিযানের পদে-পদে বিপদ, মোড়ে-মোড়ে বাঁকে-বাঁকে অজানা কোনও ভয়ঙ্করের মুখোমুখি হতে হবার আতঙ্ক ৷ দূর-দুর্গম-দুস্তর সব জায়গাই তার লক্ষ্য ৷ সেই অভিযানের সঙ্গের সাথী হচ্ছে-অভ্যস্ত অশন-বসন-শয়ন-ভোজন আর পরিবেশের শতেক যোজন দূরত্ব ৷ এমনকী মেনে নিতে হবে কখনও বা অর্ধাহার, অনাহারও ৷ ভ্রমণ সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকে এই ছিল আমার ধারণা ৷ আর সেই ধারণাটিকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ভবিষ্যতের একটি রোমাঞ্চময় স্বপ্ন ৷ স্বপ্নটির উৎস হচ্ছে-ছেলেবেলায় পিতামহীর কাছে বসে তাঁর ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চময় বিপদসঙ্কুল ভ্রমণ বৃত্তান্ত শোনা ৷
জেনেছিলাম আমার জন্মের আগেই নাকি ঠাকুমা পায়ে হেঁটে চারধাম করে এসেছেন ৷ তার তখনও আরও কত সব পরম ধামে ঘোরাঘুরি চলছে ৷
সারা ভারতে ধামের অভাব নেই ৷ সর্বত্রই তীর্থস্থান! সর্বত্রই পুণ্য সঞ্চয়ের পথ খোলা পড়ে আছে ৷ যেতে হবে না সেখানে? গেছেন ৷ অবশ্য সবই পায়ে হেঁটে ৷ তাছাড়া উপায় কী? তখন তো আর ভারতভূমির ভূমিতে রেললাইন এসে আসন পাতেনি ৷ যাদের পক্ষে প্রচলিত সব যানবাহনের সহায় নেওয়া সম্ভব নয়, তাদের তো ওই চরণযুগলই সম্বল ৷ আর্থিক সামর্থ নেই বলে সামর্থিককে কাজে লাগাবে না? সেটা তো নিজের এক্তিয়ারে ৷
পরে যখন রেললাইন খুলল, তখন তো এক কবি মনের আনন্দে বলে উঠেছিলেন, ‘এসো কে বেড়াতে যাবে-শীঘ্র করো সাজ! ধরাতে পুষ্পক রথ এনেছে ইংরাজ ৷’ বেচারী সে জন ৷ রেলগাড়িকে ‘পুষ্পক রথের’ সম্মান দান ৷ তবে দেখা যাচ্ছে কবি ডাক দিয়েছেন, বেড়াতে যাবার ৷ ভ্রমণের নয় ৷ তার মানেই হচ্ছে-রেলগাড়ি চড়ে বেড়াতে যাওয়াই হয়, ভ্রমণ হয় না ৷
ঠাকুমা নাকি রেললাইন খোলার পরও অনেকদিন পর্যন্তই তাকে গ্রাহ্য করেননি ৷ বলতেন-পা থাকতে পরপিত্যেসী হতে যাব কেন? ঠাকুমার ভ্রমণ বৃত্তান্তর শ্রোতা যে কেবলমাত্র একা এই অতি মুগ্ধ বিহ্বল আমিই ছিলাম তা নয় ৷ ছিল আরও অনেকে ৷ বৃহৎ বিরাট পরিবার তো ৷ অতএব অন্য স্তর থেকে এ প্রশ্নও উঠত-আচ্ছা ঠাকুমা, শুধু-শুধু এত কষ্ট করা কেন? কাছে কাছেও তো কত ঠাকুর, মন্দির আছে ৷ সেও তো বলো ‘মহাতীর্থ’ ৷ উত্তরে-সহাস্য জ্ঞানদান ৷ আরে বাবা, শুধু মন্দিরই তো নয়, ওই ‘পথ’ই হচ্ছে আসল তীর্থ ৷ পথের টানেই ছোটা ৷ তো একাকী কী এই আমি? চিরকাল ধরে লক্ষ-কোটি লোক ওই মরণ-বাঁচন পথে ছুটে যাচ্ছে না? এখন ওর মর্ম বুঝবি না ৷ বড় হলে বুঝবি ৷
শুনতাম আর মনে হত-কবে বড় হব ৷
কিন্তু আমার এই পথপ্রেমিক পিতামহীর পুত্ররত্নরা? তাঁরা কি আর বড় হননি? তাঁরা সেদিন ওর মর্ম বুঝতে বসেননি ৷ পঞ্চপুত্রের একটিও না ৷ তাঁরা মাতৃভক্তিতে ফার্স্ট প্রাইজ পাবার যোগ্য হলেও মাতৃ-মানসিকতার ধারকাছ দিয়েও যেতেন না ৷ তাঁদের মানসিকতা হচ্ছে-নেহাৎ মতিভ্রম না হলে, কারও ভ্রমণে মনে হয় না ৷ ভ্রমণ মানেই তো ইচ্ছে করে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা ৷ যেচে ঝঞ্ঝাট-ঝক্কি ঘাড়ে নেওয়া ৷ কে জানে-মাতৃদেবীর সারাজীবনের অদম্য কর্মকাণ্ডের ফলেই তাঁর পুত্রদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল কিনা ৷
তা সে যাই হোক, পারিবারিক এই ভ্রমণে অনীহার ফলেই বাল্য-কৈশোরে একটু বেড়াতে যাওয়ারও সুযোগ ঘটেনি ৷
মূল শেকড় তো এই এপার বাংলায় ৷ কাজেই বছরে বছরে গোয়ালন্দগামী স্টিমারে চেপে বসে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার আবেগময় অভিজ্ঞতার স্মৃতিটুকুর সম্বলও নেই ৷ থাকলে হয়তো সেই পুঁজি ভাঙিয়েও ভ্রমণ বৃত্তান্ত বলতে বসা যেত ৷ সেও অবশ্যই অনিবর্চনীয় আনন্দের স্বাদবাহী ছিল ৷
অতিবাল্যে একবার বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে রাঁচি যাওয়া হয়েছিল ৷ ট্রেন থেকে নেমেই পুশপুশ গাড়ি ঈষৎ খোলা দরজার মধ্য দিয়ে সোনার মুকুট পরা মোরাবাদী পাহাড়ের যে অপূর্ব সৌন্দর্যটি চোখে পড়ে চমক লেগেছিল, সে চমক এখনও মনে পড়ে ৷ সোনার মতো ঝকঝকে পেতলে গড়া সেই বৃহৎ ‘ওঁ’ অক্ষরটিকে সত্যিই পাহাড়ের মাথায় সোনার মুকুটের মতো লেগেছিল ৷
পরবর্তীকালে তো আরও বার দুই-তিন রাঁচি যাওয়া হয়েছিল, সেই দৃশ্যটিও না দেখা হয়েছে তা নয় ৷ তবু সেই প্রথম চমকটিকে মুছে ফেলতে পারেনি ৷ শৈশব-বাল্যের স্মৃতি যেন পাথরে খোদাই হয়ে থাকে ৷ তাই সেই সুদূরকালে শোনা কথাটি-ওরে, পথই হচ্ছে তীর্থ ৷ সেটাই তীর্থভ্রমণ!
এযুগে অবশ্য ভ্রমণ শব্দটির দারুণ রমরমা ৷ অবশ্যই যাবতীয় গাড়ি-টাড়ি চড়েই এবং যতটা পারা যায় আরামদায়ক ৷ দিকে-দিকে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ পর্যটন দপ্তর এবং ভ্রমণ সংস্থারা অবিরতই ঘরকুনোদের ঘরছাড়া হয়ে বেরিয়ে পড়বার ডাক দিয়ে হাতছানি দিয়ে চলেছে ৷ বড় মায়াবী সেই হাতছানি ৷ আজকাল তো এই ভ্রমণের ডাক একটি শিল্পের পর্যায়ে উঠেছে ৷ অতি সূক্ষ্ম শিল্প ৷ মনের যে তারটিতে ঝঙ্কার তুলে দিতে পারলেই ঘরকুনোকে ঘরছাড়া করে ফেলা যায়, সেই তারটিতে ঠিকমতো ঝঙ্কার তুলতে পারার যাবতীয় কৌশলই এই শিল্পের সাফল্যের উপকরণ ৷ একবার বেরিয়ে পড়তে পারলেই, ক্রমশ সেটা নেশা ধরায় ৷ অতএব ক্রমশই এইসব দপ্তরের প্রসার আর নিরুদ্যম জনেদের মধ্যে প্রেরণার সঞ্চার ৷
আমাদের সমাজজীবনে আজ ভ্রমণ শব্দটি যেন একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে ৷ সমাজজীবনের বেশ অনেকখানি জায়গা দখল করে চলেছে ৷ এর অনেকটাই হয়তো ওই শিল্প কৌশলের দৌলতে ৷ তবে সেকালেও যে এ কৌশলটি ছিল না, তা নয় ৷ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল ৷ ঘরকুনো নিরুদ্যম জনেদের কাছে-বিশ্ব-প্রকৃতির অনন্ত ভাণ্ডারের চাবিকাঠিটি এগিয়ে দিতে যত সব দূর-দুর্গম-দুস্তর-দুরারোহ জায়গার অনিবর্চনীয় বিউটি স্পটে এক-একখানি মহাতীর্থ বানিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা ৷ সহস্র ক্লেশ স্বীকার করেও ছুটতে হবে সেখানে ৷ পৌঁছতে পারলেই তো অক্ষয় স্বর্গ ৷ কাজেই মরণপণ করেও তীর্থযাত্রা ৷ সে যাত্রা মহাযাত্রায় পরিণত হল কিনা বাড়ির লোকের হয়তো জানবারও উপায় থাকত না ৷ সেই অক্ষয় স্বর্গের লোভনীয় হাতছানি থেকেই ধরে যায় পথের নেশা ৷ সুদূরের নেশা ৷
আমাদের কালে গেরস্থালি ঘরে হাওড়া স্টেশন পার হলেই বলা হত পশ্চিমে যাওয়া ৷ তা সে গন্তব্যস্থল পুব-দক্ষিণ-উত্তর-পশ্চিম যেদিকেই হোক ৷ আহা! এখনকার এই জটিল জটাজাল ঘেরা পশ্চিমের সঙ্গে, সেই অবোধ পশ্চিমের কী আকাশ-পাতাল তফাত ৷ তা তখন হাওড়ার ওপারেই পশ্চিম ৷ স্বাস্থ্যোদ্ধারের পরমতীর্থ সাঁওতাল পরগনা ৷ যেখানে গেরস্থ লোকে হরদমই যেত ৷ হয়তো বা ড্যাম চীপ-এর টানে, অথবা কখনও পরিবারের কারও কখনও স্বাস্থ্যোদ্ধারের দরকার হত-ডাক্তারবাবুরা যখন নির্দেশ দিতেন হাওয়া বদল দরকার ৷ তখন ৷
তা হাওয়া বদল শব্দটি বড় তাৎপর্যপূর্ণ, অর্থবহ ৷ যে বদল শরীরের থেকেও বোধহয় মনের ৷ নিত্যদিনের একঘেয়ে চক্রে আবর্তিত জীবনটা থেকে অন্তত গোটা কয়েক দিনও রেহাই মিললেই যেন নতুন হয়ে ওঠা যায় ৷ ফেলে যাওয়া বিরক্তিকর পরিবেশটাতেই আবার আনুরক্তি আসে ৷ কয়েকদিনের অনুপস্থিতির ধুলো ঝেড়ে, সংসারটাকে আবার সাফ-সুতর করে নিতে উৎসাহ আসে ৷ হাওয়া বদল ব্যাপারটি বেশ ৷ তাই বলে তো তাকে ভ্রমণের মর্যাদা দেওয়া যায় না ৷
হাওয়া বদলই ৷ তবে হাওয়ার মতো হালকা অবশ্যই নয় ৷ যে অভিযানের সঙ্গী কেবলমাত্র বাক্স, বিছানা, জামা, জুতো, ছাতা, ছড়ি, টুপি, মোজা এবং আর কিছুই নয় ৷ তার সঙ্গীর তালিকায় থাকে হাঁড়ি-কড়া, হাতা খুন্তি, চাকি-বেলুন, চিমটে, চাটু, বঁটি-কাটারি, শিল-নোড়া, হামানদিস্তে, আটা চালার চালুনি চাল ধোয়ার ধুচুনি, ধামা-কুলো, মায় উনুনে বাতাস দেবার তালপাতার পাখাখানা পর্যন্ত ৷ তাকে তো আর বাতাসের তুল্য বলা যায় না ৷
কর্তারা অবশ্য গোড়া থেকে টাইট দেন মাল-মোট বাড়ানো চলবে না ৷ কটা দিন যাহোক করে চালিয়ে নিতে হবে ৷ কিন্তু গিন্নীরা কি তা শুনবেন?-তারা জানেন না ওই ড্যাম চীপ জায়গায় গিয়ে পড়লে কর্তারা এন্তার বাজার করবেন, আর রান্নাঘরে নিত্য নব মেনুর বায়না করবেন?
জল-হাওয়ার গুণে খিদে তো এমনিই বেড়ে চলে, তার ওপর আবার সেটা আরও বাড়াতে দু-দশ মাইল হাঁটা হয় ৷ কাজেই ফিরে এসে ভালোমন্দ কিছু খেতে সাধ হবে না? মহিলাদের অবশ্য বেড়ানোর সময় জোটে না ৷ নেহাৎ যেখানে যেসব অবশ্য দ্রষ্টব্য আছে, এবং স্থানীয় দেব মন্দির-টন্দির (সে আর ভারতে কোথাও নেই!) এবং বাজার ঘোরবার জন্য একটি চুক্তি হিসেবে গাড়ি ভাড়া করে সব সেরে নেওয়া ৷
তা মহিলাদের কাছে সেও পরম প্রাপ্তি ৷ নিজস্ব জায়গায় দোকান-পাট বাজার-হাট-এর মুখ দেখতে পান কখনও তাঁরা ৷ বাইরে এনে ওইটুকু ছাড়পত্র ৷ অভিজ্ঞতা এইরকমই প্রায় ৷ কিন্তু পরে?
মনের মধ্যে সেই কোন কাল থেকে স্বপ্নটি ছিল আসা প্রতীক্ষায় ৷ তাদের বাস্তব রূপ দেবার চেষ্টা যে করা হয়নি, তা নয় ৷ সাধ্যমতোই হয়েছে ৷
অতঃপর বয়েস এসে বসিয়ে দিয়ে জব্দ করে রেখেছে ৷ যতক্ষণ না তেমন জব্দ করেছে-বঙ্গ, বিহার, উৎকল, পাঞ্জাব, মারাঠা, রাজপুতানা কোনও-না-কোনওখানে ঢুঁ মেরে আসা হয়েছে ৷ দ্রষ্টব্যবহুল জায়গাগুলিতেই প্রধানত ৷ তবে দ্রষ্টব্যরা আর কোনদিক থেকে হাতছানি না দিচ্ছেই? উত্তর-ভারত, দক্ষিণ-ভারত, পূর্ব, পশ্চিম, কে নয় ৷
বড়ই মায়াবী ওই হাতছানি ৷ আসমুদ্রহিমাচল তার ওই মায়াবী ডাক ৷ সেই ডাকের আকর্ষণে অন্তত এক-আধবার উঁকি মারতে যাওয়ার বাসনায় যাওয়ার তালিকায় সংযোজিত হয়েছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, অজন্তা-ইলোরা থেকে অমরনাথের পথে কাশী-বৃন্দাবন দু-চারবার সারা হয়ে যায় ৷ বারবার হরিদ্বারের দ্বারে পৌঁছে, আবার সেই দরজা দিয়েই কেদার-বদ্রী ৷
এইভাবেই কতবারই ঘোরাফেরা-পুরী থেকে পণ্ডিচেরী, বাউলের দেশ থেকে বালুচরী শাড়ির দেশে ৷
কিন্তু এর কিছুই কী সেই স্বপ্নের ভ্রমণ? অনেক আগে থেকে হোটেল বুক করে রেখে এবং ট্রেনের টিকিট কেটে রেখে সম্ভাব্য যতকিছু অসুবিধের ফাঁকফোকর বুজিয়ে রাখার চেষ্টায় অতিষ্ঠ হয়ে যে ঘোরাঘুরি তাতে কী মন ভরে?
দেশের মানুষ ৷ তাদের দেখবার সুযোগ এ ভ্রমণে কোথায়? অথচ সেটাই তো আসল দেখবার জানবার ৷
তবু ওরই মধ্যে পথে-পথে কিছু সঞ্চয় জমা পড়েছে ঝুলিতে ৷ সে ঝুলি হাতড়ালে হাতে উঠে আসে এক-এক কুচি সোনা ৷ সেই কতদিন যেন আগে পহেলগাঁওয়ের এক ডাকবাংলোয়, ভেতরে খিল ছিটকিনিহীন একখানা ঘরে হয়েছে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ৷ খিল-ছিটকিনিরা নিজেরাই ছিটকে হারিয়ে গেছে ৷ না অন্য কিছু? যা সারারাত হাড় হিমকরা ভয়, ওখানকার হাড় মজ্জা হিমকরা শীতকেও তুচ্ছ করে কম্বলের আবরণ থেকে চোখ বার করে জাগিয়ে রেখেছিল ৷ প্রতিটি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে ওই অনর্গল কপাটটা ঠেলে আস্তে-আস্তে ঘরে ঢুকে আসছে একটা কালো কম্বলে মোড়া জমাট অন্ধকার ৷ যার হাতটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে ৷ চাদরে-কম্বলের মোড়কে মোড়া সেই হাতখানা কী হাত মাত্র না মৃত্যুর থাবা?
ডাকবাংলোর রাত পাহারাদের দৈত্যাকৃতি বিশাল চেহারাখানা বুকের মধ্যে পাথর হয়ে বসে আছে ৷
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক-এর মতো হৃদযন্ত্রের মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে ধকধক শব্দ ৷ কতক্ষণ? কে জানে ৷ অতঃপর এল সেই সময় ৷ নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা ৷ মৃত্যুর মতোই নিঃশব্দ চরণে এগিয়ে এল সেই জমাট অন্ধকার দৈত্যদেহ ৷ আস্তে এগিয়ে এল একখানা কম্বলমোড়া হাত ৷ আরও এগিয়ে-হাত চলে আসে ৷ না গলা পর্যন্ত আসে না সে হাত ৷ কারণ হাতে চায়ের সরঞ্জামে সাজানো ট্রে ৷ বয়ে এনেছে বেড টী ৷ একি পরম প্রাপ্তি ৷
আবার সেই একদিন? পুষ্কর তীর্থে ঘাটের চাতালে বসে স্বামী তাঁর পরলোকগত পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে পিণ্ডোৎসর্গ করতে বসেছেন ৷ সোচ্চার মন্ত্রপাঠ চলছে ৷ যেখানে নিজের কোনও ভূমিকা না দেখতে পেয়ে ফালতুর মতো এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে কী ভেবে ঘাটের সিঁড়িতে নেমে গেছি একটু পুণ্যসলিল মাথায় ছিটোতে ৷ ব্যস ৷ সঙ্গে সঙ্গেই অনন্তকালের জমে থাকা ঘন কালো কোমল পানার আকর্ষণে সোজা হ্রদের নিচে ৷
তলিয়ে যাবার মহা মুহূর্তে, নিশ্চিত মৃত্যুর প্রত্যয়ে যখন ভাবছি-পতি পরিবারের পরলোকগত সদস্যদের তালিকায় একটি নতুন সংযোজন হল, ঠিক তখনই এক অজানা অচেনা তাগড়াই চেহারার পাণ্ডাঠাকুরের বজ্রমুষ্ঠির আকর্ষণে জলের তলা থেকে ঘাটের চাতালে ৷ উদ্ধারকারী সেই প্রায় তলিয়ে যাওয়া জনকে টেনে তুলে ঠুকে বসিয়ে দিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় বোধকরি আমার চোদ্দ পুরুষকেও উদ্ধার করে একবার আমার দিকে জ্বলন্ত ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুমদাম করে চলে গেলেন ৷ কিন্তু রেখে তো গেলেন কিছু সেই জ্বলন্ত দৃষ্টির মধ্য দিয়েই ৷
আবার সেই একদিন ৷ ঘনটানাটি নেহাৎই তুচ্ছ ৷ ঘটনার নায়কও তাই ৷
তবু সঞ্চয়টুকু তুচ্ছ নয় ৷ নায়ক হচ্ছে বাংলা কথনে রীতিমতো রপ্ত এক উড়িষ্যানন্দন রাঁধুনি ঠাকুরমাত্র ৷ বয়সে তরুণ হলেও-বোধহয় দক্ষতার গুণে সে তখন দার্জিলিঙের ‘লুইস জুবিলি স্যানাটোরিয়ামের অর্থোডক্স ডিপার্টমেন্টের’ হেড রাঁধুনি ৷ তার অবিরত আমাদের কাছে অনুযোগ-অহেতুক আমরা এ ডিপার্টমেন্টে কেন? বাঙালি হয়েও কেন ভেজিটেরিয়ান? সেই আক্ষেপেই বোধহয় সে আমাদের দুজনের জন্য সর্বদা স্পেশ্যাল কেয়ার নিত ৷ বেশ বোঝা যেত আমাদের থালায় রান্নাঘরের নিয়মমাফিক মেনুর বাইরেও তার নিজস্ব প্রেরণার কিছু অবদান থাকে ৷ যার মধ্যে অহেতুক ভালোবাসার অলক্ষ্যস্পর্শ ৷ এটাই তো পরম প্রাপ্তি ৷ কিন্তু ফেরার দিন?
জমার ঘরে তো জমল অনেক ৷ সেদিন ঠিক সময়ে বাগডোগরায় পৌঁছবার তাড়ায় সাতসকালে ভাত চেয়ে লজ্জিতভাবে খেতে এসে দেখে অবাক ৷ পাতে যথারীতি নিত্যকার মতোই পঞ্চব্যঞ্জন সাজানো ৷ দই থেকে লেবুটি পর্যন্ত ৷ এই ত্রুটিহীন কুশলতার মধ্যে ঠাকুর বারবার আক্ষেপ জানাচ্ছে-আজ আমাদের একটা নতুন পদ খাওয়াবার জন্য-সে অনেক চেষ্টায় যে দ্রব্যটি জোগাড় করে রেখেছিল ৷ তাড়াহুড়োয় সেটি এখনও ঠিকমতো হয়ে ওঠেনি ৷
আমাদের বারংবার সান্ত্বনাবাক্যেও তার ক্ষোভ ঘোচে না ৷ তারপর? যখন দেখা গেল যাওয়ার প্রায় শেষভাগে সে হঠাৎ ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে একথাবা অতি উত্তপ্ত মোচার ঘণ্ট নিয়ে এসে দুজনের পাতে ভাগ করে দিয়ে, একখানা পাটকরা খবরের কাগজ নেড়ে নেড়ে বাতাস করতে শুরু করল ৷ তখন চোখের জলকে চোখের মধ্যে আটকে রাখা সত্যিই শক্ত হয়েছিল ৷
পথে পথে এমন কত প্রাপ্তির স্মৃতি জমা হয়ে আছে, যা আমার কাছে বিশেষ মূল্যবান ৷ কিন্তু অন্যের কাছে পরিবেশনযোগ্য কিনা এই দ্বিধায় পরিবেশন করতে এগোইনি ৷ তাছাড়া এ যুগে ভ্রমণ মানে পৃথিবীর মানচিত্রে ঘুমিয়ে থাকা সব জায়গায় গিয়ে গিয়ে হানা-দেওয়া ৷ চিরকালের কুমারী মাটিতে নির্ভীক পদপাত ৷ দুই হাতে দুই কালের মন্দিরার মতো দুই মুঠোয় উত্তর-দক্ষিণ দুই মেরুকে বাগিয়ে ধরে অবলোকন এবং হয়তো সেখান থেকে সম্পাদকদের দপ্তরে নিত্য দিনলিপি প্রেরণ ৷ হয়তো বা উঁকি মেরে আসা মহাসমুদ্রের গভীরে ৷ আঁচল উড়িয়ে আসা মহাকাশের অলিন্দে ৷ এহেন যুগে কিনা রেলগাড়ি বাসগাড়ি চেপে কেবলমাত্র স্বদেশের চিরচেনা সব জায়গায় গিয়ে পড়ে ভাবতে সাধ-এইটাই বুঝি ভ্রমণ ৷
দূর! এ আবার একটা বলবার মতো? তাও আবার কাল-তারিখ পেশ করার বালাই নেই ৷ সবই স্মৃতিনির্ভর ৷
এযুগের পাঠকরা বড় হুঁশিয়ার ৷ সেই স্মৃতির শৈথিল্যে কোথাও একটু ভুলভাল ঘটলেই ধরে ফেলে, আর ছুটে আসে ভুল ধরতে ৷ অতএব এই না-ভ্রমণের বৃত্তান্তটিই সম্পাদকমশাইয়ের দপ্তরে পেশ করে ইতি টানা ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন