নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

একেবারে বদ্রীনাথের কোলে সুপ্রিয়া হোটেল, বালানন্দ তীর্থাশ্রমের ঠিক নিচে ৷ হোটেলের লাগোয়া সাদামাটা বাসস্থান ৷ তৈরি করেছিলেন সুপ্রিয়ার স্বামী ৷ এখন তিনি নেই, কিন্তু ঘরের সামনে সকৌতুকে লিখে রেখে গেছেন নিজের নাম-ভ্রমণানন্দ সংসারী ৷ ভ্রমণে আমারও আনন্দ, সংসারী আমিও ৷ কিন্তু আমার কি সাহস হত স্বর্গের কাছাকাছি এই হিমালয়ের চূড়ায় বসে হোটেল চালানোর?

আগেও গিয়েছি, এবারও গেলাম ৷ কিন্তু কোথায় যেন একটা তফাত ছিল ৷ ছিল সেই হাওড়া স্টেশন থেকেই ৷ এবার কেদার-বদ্রী যাত্রায় আমাদের সহযাত্রিণী ছিলেন সপরিবারে স্বয়ং মা দুর্গা ৷ উপাসনা এক্সপ্রেস ছাড়ব ছাড়ব, অথচ তিনি এখনও এসে পৌঁছলেন না ৷ উৎকণ্ঠ আমরা, দশজনের ছোট্ট ট্যুরিস্ট দল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ৷ অবশেষে মিনিট পনেরো সময় হাতে থাকতে এসে পৌঁছলেন ৷ কেউ একজন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, মা এবার ঘোটকে আসছেন কি না!

আমাদের পনেরো দিনের প্যাকেজ ট্যুরে নিয়ে যাচ্ছে চাটুজ্যে পরিবার-সুপ্রিয়া, তার ছেলে নীরব, তার বৌ সোমা এবং তাদের ছ বছরের দুর্ধর্ষ ছেলে নিমু ৷

ভ্রমণে স্থানমাহাত্ম্যটা জরুরি তো বটেই, তবে তার পাশাপাশি মানুষের সান্নিধ্যও জরুরি হয়ে ওঠে, বা বলা যায় ‘ইন্টারেস্টিং’, যদি মানুষগুলো একটু অন্য রকমের হয় ৷ এবারে এরকম অন্য রকম কিছুর সন্ধান পেয়েছিলাম, তাই পুরনো বদ্রীর নতুন কাহানিটা না লিখে পারলাম না ৷

প্রথমেই এই সুপ্রিয়া ট্যুরের উদ্যোক্তাদের সম্বন্ধে দু কথা লিখি ৷ ট্যুরিজমের ব্যবসাটা এই বাংলায় জমে উঠেও যেন ঠিক জমছে না ৷ আমরা যারা বেড়াতে ভালোবাসি, প্রায়ই ভাবি আরও কত কী করা যায় ৷ সেক্ষেত্রে, এই যে হিমালয়ের চূড়ায় বসে হোটেল চালায় সুপ্রিয়া, আর তার পাশাপাশি ছোট বড় ট্যুর পরিচালনা করে মাঝারি খরচায়, এতে নিজের সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্যে আনন্দিত হওয়া ছাড়াও আমার আনন্দ হয়েছিল একজন বাঙালি মহিলা ব্যবসায়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ায় ৷ সত্যি বলতে কি, পনেরো দিনের এই ভ্রমণে জায়গা দেখা ছাড়াও এই সব প্রাপ্তিও নগণ্য ছিল না ৷

শুনলাম ওরা নাকি প্রত্যেক বছরই কলকাতা থেকে মূর্তি নিয়ে গিয়ে বদ্রীতে দুর্গাপুজো করে ৷ তাই, বলাই ছিল, এই ট্যুরের শেষ পাঁচ দিন টানা বদ্রীতে থাকা হবে ৷ এতে কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, বোরিং ৷ আমার কিন্তু এই পাঁচটা দিন মনে থাকবে অনেক কাল ৷ হরিদ্বার থেকে রিজার্ভ করা বাসে মা দুর্গাকে নিয়ে সোজা গৌরীকুণ্ড ৷ সেখান থেকে কেদার হয়ে, কালীমঠ, চোপতা হয়ে যোশিমঠ, সেখানে রোপওয়ে চেপে আউলি দেখে বদ্রীর রাস্তা ধরে বালানন্দ তীর্থাশ্রমে গিয়ে হল্ট ৷ হু হু ঠান্ডা ৷ রাতে নাকি এক পশলা বরফ বৃষ্টি হয়ে গেছে ৷ পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল মন্দির থেকে ভেসে আসা ভজনের আওয়াজে ৷ লেপের মায়া কাটিয়ে উঠে লম্বা করিডরের প্রান্তে বড় কাচের জানলা দিয়ে দেখি নারায়ণ পর্বতের পাশ দিয়ে নীলকণ্ঠ উঁকি দিচ্ছেন ৷ ভোরের আলোয় একটু আবছা, কিন্তু একটু পরেই স্বমহিমায় দৃপ্ত হয়ে উঠলেন ৷ আর তো ঘরে থাকা যায় না ৷ আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ছুটলাম মন্দিরের দিকে ৷ নারায়ণের অভিষেক শুরু হয়ে গিয়েছে ৷ সামনে ঘেরা জায়গায় বেশি টাকার টিকিট কাটা সৌভাগ্যবানেরা বসে ৷ আমরা ভিড়ের মধ্যে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে ব্যারিকেডের পাশে একদম সামনেই দাঁড়িয়ে গেলাম ৷ বেশ দেখা যাচ্ছে ৷ গর্ভগৃহে কালো জোব্বা সোনালি কোমরবন্ধ পরা সুদর্শন গাড়োয়ালি পূজারী দুধে, ঘিয়ে, অলকনন্দার জলে বিগ্রহকে স্নান করিয়ে, মুছিয়ে, অন্তত দু কেজি ওজনের চন্দনের তাল জঠরে লেপে দিলেন ৷ কি জানি, নারায়ণের এটা কেন প্রয়োজন, জঠরাগ্নি নেভাতে কি? এদিকে কাঁপা কাঁপা গলায় রানিং কমেন্টারি দিয়ে যাচ্ছিলেন আরেক পুরোহিত ৷ গলা কাঁপছে, সে কি ঠান্ডায়, না এটাই মন্ত্রোচ্চারণের রীতি? তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন অভিষেকের নিয়মকানুন, পরিচয় দিচ্ছিলেন দেবতার ৷ সব বুঝলাম না ৷ বুঝলাম না পদ্মাসনে বসে কালো পাথরের উনি বিষ্ণু না বুদ্ধ, যাঁকে অলকানন্দার জল থেকে উঠিয়ে এনেছিলেন স্বয়ং শঙ্করাচার্য ৷ এ সবই ক্রমে অবান্তর হয়ে যাচ্ছিল, এত ভিড়েও একলা হয়ে যাচ্ছিলাম, আর সেই একাকীত্বের ওড়নার তলায় কার সঙ্গে যেন শুভদৃষ্টি হচ্ছিল ৷ তিনি বুদ্ধ, না বিষ্ণু, না নীলকণ্ঠ, নাকি বদ্রীনাথের রুক্ষ পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়ানো পাথুরে রূপের তরঙ্গ যাঁর পায়ের তলায় তেমনই রূপের তরঙ্গ তুলে নেচে চলেছে অলকানন্দা? বলা মুশকিল ৷

হিমালয় নাকি দেবতাত্মা ৷ এখানে এলে সেটা অস্বীকার করা যায় না ৷ আমি সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে গল্পগুজব করার সময় এবার অনেক অলৌকিক কাহিনী শুনলাম ৷ কুন্তলা বলল, সেবারের ভীষণ ভূমিকম্পের আগে ও বদ্রীতে ছিল ৷ পার্বতী মা, সেই সুন্দরী নেপালি বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী যিনি রোজ ভোর চারটেয় অলকানন্দার বরফ গলা জলে শরীর ডুবিয়ে পূজার্চনা করতেন, প্রণাম করতেই ওকে ডেকে বললেন, বেটি, তোমার পুজো তো সারা হয়ে গেছে, আর দেরি কেন, ঘরে ফিরে যাও ৷ হঠাৎ এ কথা শুনে ওর সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, ও তড়িঘড়ি বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে হৃষীকেশে যেই নামল অমনি হিমালয় মাথা ঝাঁকিয়ে তাণ্ডব নাচ শুরু করে দিলেন ৷ সেবার সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল ৷ ও বেঁচে গিয়েছিল ৷ সোমা বলল, সেবার ও কালীশিলা দেখবে বলে কালীমঠ থেকে রওনা হয়েছিল ৷ অসম্ভব চড়াই, কঠিন রাস্তা, ওর মাথা ঘুরছিল, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল, চোখ অন্ধকার হয়ে আসছিল ৷ ও যখন একটা পাথরের ওপরে বসে হাঁফাচ্ছে, তখন এক ফুটফুটে পাহাড়ি বালিকা মিষ্টি জল খাইয়ে ওকে বলেছিল, ওঠ! ও উঠে গিয়েছিল কালীশিলায় ৷ কিন্তু সেই বালিকাকে ও আর দেখতে পায়নি ৷ নীরব বলেছিল, কালীমঠে ওর দিব্যজ্যোতি দর্শন হয়েছিল ৷ এ সবই আমি বিশ্বাস করেছিলাম ৷ এখানে এ সব বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয় না ৷ কলকাতায় ফিরে গেলেই সব অন্যরকম হয়ে যায় ৷ গঙ্গাভারতী নামে সেই সন্ন্যাসী, যিনি বদ্রীর মন্দির থেকে আরও অনেক, অনেক উঁচুতে থাকেন, সব যখন বরফে ঢেকে যায়, মন্দির বন্ধ হয়ে যায়, তখনও নেমে আসেন না, তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল বছর পঞ্চাশেক বয়স, যদিও চুল দাড়ি সব কাঁচা ৷ ও মা, শুনলাম ওঁর একশো পেরিয়ে গেছে ৷ বিশ্বাস করতে হল, কারণ যাঁরা ওঁকে অনেক দিন থেকে দেখছেন তাঁদের এটাই হিসাব ৷

এবার কেদার দর্শনে যাইনি ৷ গেলে ডুলি করে যেতে হবে, সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসতে হবে ৷ রক্ষে করো! এর আগে কেদারে থেকে প্রাণভরে সব দেখে এসেছি ৷ এবার বরং ত্রিযুগীনারায়ণ দেখে আসা যাক ৷ গৌরীকুণ্ড থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে ওপরে উঠে গেলাম, দেখলাম বহু যুগের পুরনো মন্দির ৷ এখানে নাকি হরপার্বতীর বিয়ে হয়েছিল, নারায়ণকে সাক্ষী রেখে ৷ মন্দিরের সঙ্গে খাপ খাওয়া এক জীর্ণদেহী প্রাচীন পুরোহিত সামান্য দক্ষিণা নিয়ে আমাদের দিয়ে আবার হরপার্বতীর বিয়ে দেওয়ালেন, সেটাই পুজোর নিয়ম ৷ তারপর অন্ধকার এক ঘরের মধ্যে প্রজ্বলিত যজ্ঞের আগুন দেখলাম যা নাকি সেই প্রথম বিয়ের দিন থেকেই জ্বলছে ৷ বেশ রোমাঞ্চ হল এ কথা বিশ্বাস করতে, থাক না অবিশ্বাস কলকাতায় পড়ে ৷ মনে অবিশ্বাস নিয়েই তো রায়সাহেব অক্ষয় তৃতীয়ায় মন্দির খোলার দিন বদ্রীতে ছুটে এসেছিলেন ৷ ভেবেছিলেন ছ মাস আগে জ্বালানো অক্ষয় প্রদীপ এখনও জ্বলছে, তাও কী হয়! প্রদীপ কিন্তু জ্বলছিল ৷

কালীমঠ এবার আমার প্রথম দেখা ৷ অন্যদের কেদার দর্শন সারা হলে রাতটা গৌরীকুণ্ডে কাটিয়ে সকালে ভুখা সড়ক নামে বদ্রী যাওয়ার এক শর্টকাট রাস্তা ধরলাম ৷ এ পথ তৈরি হওয়ার দাবিতে নাকি স্থানীয় অধিবাসীরা অনশন ধর্মঘট করেছিল, তাই এই নাম ৷ কালীমঠ কালীগঙ্গার ধারে এক নিভৃত পীঠস্থান ৷ নারায়ণ ও মহাদেবের স্থান এই হিমালয়ে এটাই একমাত্র দেবী পীঠ ৷ এখানে দেবীর তিন রূপ-বালিকা, যুবতী ও বৃদ্ধা ৷ এই পাহাড়ের তিন জায়গায় তাই তিন পীঠ ৷ সবচেয়ে উঁচুতে কালীশিলা, দুর্গম, তাই যাওয়া গেল না ৷ অনেক নিচে আছেন ধারি মা-দেবীর বৃদ্ধা রূপ ৷ সেখানেও যাওয়া হয়নি ৷ তবে কালীমঠ মনকে ভীষণভাবে টেনেছিল ৷ সেদিন নবরাত্রির উৎসবে মন্দির ঝলমল করছিল, ঢাক বাজছিল, আর অনেক ঘণ্টা ৷ অনেক পাহাড়ি মানুষ পুজো দিতে এসেছে, আমরাও দিলাম ৷ কোনও মূর্তি দেখলাম না, শুনলাম এখানে মায়ের খাঁড়া মাটিতে পোঁতা আছে ৷ কালীগঙ্গার ঠিক ওপরেই চমৎকার গেস্টহাউস ৷ ইচ্ছে হল একবার এসে থাকবার ৷ এত সুন্দর জায়গাটা ৷ ফেরার আগে ছুটলাম গণেশ মন্দিরে ৷ ওখানকার মাটি সংগ্রহে থাকলে নাকি সব কিছুতেই অনিবার্য সিদ্ধিলাভ ৷ ওমা, গিয়ে দেখি সবাই এমন চেঁচেপুঁছে মাটি নিয়ে গিয়েছে, একটুও পড়ে নেই ৷

কালীমঠ থেকে বাস চলল যোশিমঠের দিকে, চোপতা হয়ে ৷ চোপতার পথে সারি সারি বরফের পাহাড় দেখা গেল ৷ ভাসা ভাসা নামগুলো শুনলাম-চৌখাম্বা, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী ৷ অপরূপ দৃশ্য, কিন্তু ক্যামেরার শাটার টিপতেই পারলাম না ৷ বাস খালি গোঁ গোঁ করে চক্কর মেরে ওপরে উঠে চলেছে ৷ সেই চোপতা গিয়ে থামল ৷ ততক্ষণে মেঘ এসে পাহাড় ঢেকে দিতে শুরু করেছে ৷ চোপতা বেশ উঁচুতে, হয় তো বারো হাজার ফুটের কাছাকাছি হবে ৷ স্টোভ জ্বালিয়ে চটপট গরম ভাত, তরকারি, পাঁপড় ভাজা, চাটনি তৈরি হয়ে গেল ৷ এত উঁচুতে বসে এমন বাঙালি খানা খেতেও মজা ৷ শুনলাম এখান থেকে খুব কাছেই পঞ্চকেদারের এক কেদার-তুঙ্গনাথ ৷ ঘোড়াওয়ালারা নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু পথ দুর্গম, সময়ও নেই, তাই এ যাত্রায় আর ওঠা হল না ৷ পঞ্চকেদারের কথা শুনেছি, এবারেই শুনলাম পঞ্চবদ্রীও নাকি আছে ৷ তবে সে সব গল্প এখন নয় ৷ এখন চল যোশিমঠ ৷

যোশিমঠ বেশ বড় জায়গা ৷ হোটেলটিও সুন্দর ৷ হাত-পা ছড়িয়ে একটু আরাম করে নিয়ে নিচে নামলাম বুথ থেকে ফোন করে ছেলেকে আমেরিকায় একটু চমকে দিতে ৷ লাইন পাওয়া গেল না, তবে অপেক্ষা করতে করতে বুথের মালিক আর্মি কন্ট্রাক্টার ছেলেটির নানা আষাঢ়ে গল্প বেশ উপভোগ করা গেল ৷ শুনলাম এখানকার নৃসিংহ মন্দিরে বিশেষ তিথিতে এক ছোটখাটো নররাক্ষস একটা পাঁঠার রক্ত চোঁ চোঁ করে পান করে আস্ত পাঁঠাটা কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ঘরে ঢুকে আরও কী কী সব খেয়ে প্রচুর জল পান করে বিশ্রাম নেয় ৷ সেদিন সে অন্য মানুষ, পরের দিন থেকে আবার স্বাভাবিক ৷ অবিশ্বাসী এক আর্মি অফিসার নিজে বসে থেকে সবটা দেখে স্বীকার করেছিলেন, হ্যাঁ, এমনটি হয় বটে ৷

পরদিন সকালে রোপওয়ে চেপে আউলি গেলাম ৷ লাল টুকটুকে কেবিন, কাচে ঘেরা, তার মধ্যে থেকে বেশ দেখাচ্ছিল চারদিকের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম ৷ শুনেছিলাম, ছবিও দেখেছিলাম এত উঁচুতে স্কি করার জায়গা আর কোথাও নেই ৷ গিয়ে একটু হতাশ হলাম, বরফে ঢেকে না গেলে এ জায়গা আর পাঁচটা পাহাড়ি জায়গার মতোই ৷ ফিরে এলাম ৷ তাড়া থাকায় এখানকার শঙ্করাচার্যের মঠটি দেখা হল না ৷

এবার বদ্রীর পথে ৷ যোশিমঠ থেকে বদ্রীনারায়ণ, নন্দনকানন, হেমকুণ্ড ইত্যাদির পথ চলে গিয়েছে ৷ বিখ্যাত সব তুষারশৃঙ্গ-কামেট, মানা, নীলকণ্ঠর পথ এই যোশিমঠ থেকেই ৷

বদ্রীর উচ্চতা প্রায় সাড়ে দশ হাজার ফুট ৷ বিশাল অলকানন্দা উপত্যকার দুই তীর জুড়ে এই তীর্থক্ষেত্র ৷ অলকানন্দার বরফগলা স্রোতের পাশেই রয়েছে তপ্তকুণ্ড ৷ ঋষি মার্কণ্ড এখানে বসে তপস্যা করেছিলেন বলে একে মার্কণ্ডেয় শিলাও বলে ৷ অলকানন্দার তীরে ব্রহ্মকপাল ৷ এখানে পারলৌকিক কাজ করলে প্রেতাত্মা ব্রহ্মে লীন হয়ে যায় বলে বিশ্বাস ৷ কোনও প্রিয়জন লীন হয়ে গেলেন, আর কোথাও থাকলেন না, স্বপ্নেও দেখা দিলেন না-এ সব বিশ্বাস করা খুবই কষ্টের ৷ তবু যুগ যুগ ধরে যে সব বিশ্বাস এ সব জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়েছে, হয়তো বাড়িয়ে তুলেছে ওই পাহাড়ের উচ্চতা, তাকে অস্বীকার করার মতো মনের জোর ছিল না, তাই বসে গেলাম কাজ করতে ৷ নিচে অলকানন্দার নীল রং ৷ ওপরে নীল আকাশ আর চোখ ঝলসানো সাদা নীলকণ্ঠ ৷ মন ক্রমশ স্থির হয়ে এল ৷

এদিকে সুপ্রিয়া হোটেলের পাশের ঘরে সাড়ম্বরে শুরু হয়ে গেছে দুর্গাপুজোর আয়োজন ৷ মা অক্ষতই এসেছেন, শুধু কার্তিকের অমন টিকোলো নাকটি গেছে ভেঙে ৷ সোমা অসামান্য দক্ষতায় ময়দার নাক তৈরি করে নিমুর রংয়ের বাক্স থেকে রং লাগিয়ে সব ঠিক করে দিল ৷ অবাক হয়ে দেখলাম দুর্গাপুজো করার মতো কঠিন কাজও কত সহজে করা যায় ৷ ট্রেনের খাঁচাবন্দী কুমারটুলির মূর্তি ক্রমশ ধূপধুনো আচার অনুষ্ঠানে কখন মা দুর্গা হয়ে গেলেন ৷ ওই ছোট্ট ঘরের কোণে একটি মাত্র স্টোভে সুপ্রিয়া আর সোমা মায়ের জন্য পোলাও পায়েস খিচুড়ি মালপোয়া সবই তৈরি করে ফেলল ৷ গাড়োয়ালি পণ্ডিত যুবক রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিশুদ্ধ উচ্চারণে মন্ত্র বলে আচারনিষ্ঠ পূজার্চনায় আমাদের সম্মোহিত করে রাখলেন ৷ দরিদ্রনারায়ণ সেবা হল ৷ সন্ন্যাসী ভোজন হল ৷ দলে দলে বাঙালি ট্যুরিস্ট এসে অঞ্জলি দিয়ে, প্রসাদ খেয়ে বলতে লাগল, আমাদের কী ভাগ্যি, ভাবতে পারিনি বেড়াতে এসে এমন ভালো পুজো দেখা হয়ে যাবে ৷

আমরা একটু করে পুজো দেখি আর একটু করে বাইরে পাতা চৌকিতে রোদ্দুরে বসে নীলকণ্ঠকে দেখি, ওপাশের কুবের পর্বত দেখি যাকে নাকি এখনও কোনও উড়োজাহাজ ডিঙিয়ে যেতে পারেনি ৷ এত তার চৌম্বকশক্তি ৷ শুনলাম নীলকণ্ঠে যারা উঠেছে, খুব কমই তাদের সংখ্যা ৷ তবু তার মধ্যে বাঙালি আরোহী ছিলেন ৷ দেখছিলাম তিব্বত থেকে উড়ে আসা কালো কুচকুচে কাকের দল যাদের ঠোঁট হলুদ, পা লাল, প্রসাদের লোভে ঘুরঘুর করছে কিন্তু কলকাতার কাকের মতো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে না ৷ ওদের নাকি ‘কাংসা’ বলে ৷ এখবর দিয়েছিল বিনোদ, আমাদের ছোট্ট গাইড, যাকে সঙ্গে করে আমরা মানা গ্রাম হয়ে সরস্বতী নদী, ভীম পুল, ব্যাসগুহা, গণেশ গুহা-এ সব একদিন দেখে এসেছিলাম ৷ সরস্বতী, যাঁকে এতদিন লুপ্ত বলেই জেনে এসেছি, এখানে প্রবলা, খরস্রোতা ৷ সরস্বতীর মিষ্টি জল ঝকঝকে ঘটি থেকে ঢেলে দিলেন গাড়োয়ালি মহিলা ৷ এরা বেশ আছে, জানে না লাদেন কেমন করে পৃথিবী ধ্বংসের মতলব আঁটছে, জানে না অটলবিহারী প্রাইম মিনিস্টার না চিফ মিনিস্টার ৷ বিনোদ স্কুলে পড়ে ঠিকই কিন্তু বরফ পড়তে শুরু হলে ও লম্বা ছুটিতে নেমে যাবে ওর গাঁয়ে ৷ সেখানে খেতি আছে, গাই আছে-অভাব কিসের? শুধু ওর ইংলিশ পড়তে ইচ্ছে করে, স্কুলে পড়ায় না ৷ বিনোদ, পড়াশোনা করে আমেরিকা যাবে? জিজ্ঞাসা করাতে ও কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে টেনে বলল ‘ছি’!

এ সব জায়গা ছেড়ে এইসব লোকেদের ছেড়ে এবার চলে যেতে হবে ৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল ৷ কিন্তু উপায় নেই ৷ যার যেথা ঘর ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন