অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
ডিকুম, বকুল, টাটা টি-এর চা-বাগানের বুক চেরা রাস্তা ধরে বাসের চলা তিনসুকিয়ার দিকে ৷ রাস্তা খুবই খারাপ, তবে তা পুষিয়ে দেয় সঙ্গী হয়ে চলা চা-বাগান ও টোকা-মাথায় শ্রমিকের দল ৷ পিছনে ফেলে এসেছি ডিব্রুগড়, এখান থেকে মাত্র ১৬৩ কি-মি দূরেই আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত নামদাফা জাতীয় অরণ্যের প্রবেশদ্বার মিয়াও ৷
তিনসুকিয়া থেকে ফের বাসযাত্রা, একে একে মার্গারিটা, ডিগবয়, লিডো (এখান থেকে মিয়াও ৫৬ কি-মি), লেথপানি, তিরাপ জাপুন পেরিয়ে বাসের থামা আসাম ও অরুণাচলের সীমান্ত চেকপোস্ট নামচিক-এ ৷ এখানে ইনার লাইন পারমিট পরীক্ষা করা হয় ৷
জঙ্গলের বুক চেরা পাকা রাস্তা ধরে বাসের চলা ৷ চারদিক শুনশান, রাস্তার ধারে আকাশ ছোঁয়া বনস্পতির গায়ে লতাগুল্মের বহু পুরনো বাসস্থান ৷ ঘন সবুজের মাঝে ফুটে থাকা দুয়েকটি সাদা ফুলের ঝাড় মনটাকে ছুঁয়ে গেল ৷
খারসান, নামপাই পেরিয়ে যখন মিয়াও এল তখন লালচে আকাশের বুকে আঁধারের ছায়া ৷ টিয়ার দল টিঁ টিঁ শব্দে উড়ে গেল ৷
মিয়াও জায়গাটি গঞ্জ প্রকৃতির, সরকারি অফিস ও বাংলোর প্রাধান্যই বেশি ৷ ইলেক্ট্রিসিটি আছে ৷ চতুর্দিকে পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত সুন্দরী মিয়াওয়ের বুক চিরে অরণ্য দুহিতা নোয়া ডিহিং নদী বয়ে গেছে ৷
থাকার জায়গা বলতে সার্কিট হাউস, পি ডাব্লু ডি বাংলো ৷ এখানে থাকতে গেলে সরকারি আনুকূল্যের প্রয়োজন ৷ ফলে অগতির গতি বাজার থেকে ২ কি-মি দূরবর্তী ট্যুরিস্ট লজ ৷ ঠিক নদীর ধারেই গড়ে ওঠা এই লজের অন্যতম প্লাস পয়েন্ট হল আতিথেয়তা ৷
জঙ্গলে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় জিপ মেলে বনবিভাগ থেকে ৷ ভাড়া ৩০০ টাকার মধ্যে ৷ তবে তা অধিকাংশ সময় খারাপ থাকার দরুন মিয়াও বাজার থেকে বেশি ভাড়ার প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে প্রায়শই জঙ্গলে ঢুকতে হয় ৷
রাতে সবাই ঘুরতে বেরোলাম ৷ চাঁদের আলোর বন্যা চতুর্দিকে ৷ দূরের পাহাড়, গাছের মাথা সাদা হয়ে আছে, নদীর জলে চাঁদের প্লাবন ৷ লজের পিছনের জঙ্গলে চলছে আলো-আঁধারির খেলা ৷ অজানা পাখির ডাক মাঝে মধ্যে কানে আসছে ৷ প্রচণ্ড ঠান্ডায় কম্পমান দেহ নিয়ে ঘরে এলাম ৷
পরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে আমাদের যাত্রা মিয়াও থেকে ২৪ কি-মি দূরত্বে দেবান ফরেস্ট বাংলোতে ৷ সময় লাগে ঘণ্টাদুয়েক ৷ রাস্তা খুবই খারাপ ৷ পথের ওপর দিয়ে মাঝে মধ্যে বহমান পাহাড়ি ঝোরা রাস্তার বুক ভেঙে খাদের দিকে ঝাঁপ দিয়েছে-তার পান্না গলানো জল সাদা ফেনা ছিটিয়ে হারিয়ে গেছে প্রকৃতির মাঝে ৷ এই জল ডিঙিয়ে আমাদের পথ চলা ৷ চতুর্দিকে বিভিন্ন রকম পাখির কলতান ৷ ছোট ছোট পাখি, বাহারি তাদের গায়ের রং ৷ এসে পৌঁছলাম চেকপোস্ট ৷ ডিউটিতে আছেন মণ্ডলবাবু ৷ জঙ্গলের প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দিয়ে গেট খুলল ৷
আমরা যাত্রা করলাম উত্তর পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বনানী নামদাফা ব্যাঘ্র প্রকল্পের উদ্দেশে ৷ ১৯৮৫ বর্গ কি-মি বনাঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠেছে এই ব্যাঘ্র প্রকল্প ৷ এক অদ্ভুত জঙ্গল এই নামদাফা ৷ কী বিস্তৃত এর ব্যাপ্তি ৷ প্রায় হাজার ফুট থেকে শুরু করে ১৫০০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত এই জঙ্গলের পরিধি ৷ আসলে ঠিক পাশেই বর্মা সীমান্ত হওয়ার দরুন এখানকার উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে ইন্দো-বার্মিজ প্রজাতির শঙ্করীকৃত সবকিছুর মধ্যেই বৈচিত্র্যের ছটা ৷
দেবানের পথে নোয়া-ডিহিং বাঁদিকের নিত্যসঙ্গী ৷ চেকপোস্ট থেকে কিছুটা এগিয়ে লঙ্কার খেত চোখে পড়ল ৷ দুয়েকটি গ্রাম পেরিয়েই এসে গেল গিবন পয়েন্ট ৷ এখানে হুলক গিবনের দেখা মেলে ৷ পর্যটকেরা যদি সাহসী হন তবে এখান থেকে ৫ কি-মি দূরবর্তী মতিঝিল সল্টলেকে গিয়ে বন্যপ্রাণীদের দর্শন পেতে পারেন ৷ চড়াই-উৎরাই ভাঙতে হবে আর যেহেতু ওয়াচ-টাওয়ারটি যথেষ্ট উঁচু নয়, সেহেতু হাতিদের দেখা পেলে মুশকিল হলেও হতে পারে ৷
বনমধ্যে ট্রপিকাল এভারগ্রিন ফরেস্টের রূপ ও বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো ৷ ট্রি ফার্ন, বাঁশ, অর্কিড ও বেতের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে নজর বিঘ্নিত হয় ৷ পথিমধ্যে হাতির পায়ের ছাপ ও হঠাৎ উড়ে আসা সাদা টুপি পরা রেড-স্টার্ট পাখি চমক লাগায় ৷
দেবানে পৌঁছে মন রোমান্টিক হয়ে উঠল ৷ উজ্জ্বল গোলাকৃতি আকারের দ্বিতল বাংলো, পুরোটাই মশারি দিয়ে ঘেরা ৷ একতলায় তিনটি ও দ্বিতলে দুটি ভি আই পি রুম ৷ এছাড়া এখান থেকে সওয়া কি-মি দূরে চারটি স্যুইট বিশিষ্ট ট্রানসিট লজ ও ডর্মিটরিতে থাকার ব্যবস্থাও আছে ৷ শেষোক্তটিতে থাকার জন্য নিজেদের বিছানাপত্র নিয়ে যেতে হবে ৷
দেবান বাংলোর সামনে সুন্দরভাবে ছাঁটা ঘন সন্নিবিষ্ট গাছের বেড়া দেওয়া বিস্তৃত লন ৷ তারপরেই শুরু নদীখাতের বোল্ডারের রাজত্ব ৷ এর মাঝে বয়ে যাওয়া ক্ষীণ কটি নোয়া-ডিহিং বর্ষায় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, শীতকালেও যথেষ্ট খরস্রোতা ৷ দু-দিকের মন মাতাল করা ঘন বনাকীর্ণ পাহাড়ের মাঝ বরাবর কুলকুল শব্দে বাহিতা অরণ্যদুহিতা ডেবান নালা ও নামদাফা নদী সৃষ্টি করেছে এই অপরূপা নোয়া-ডিহিংকে ৷
এখানকার ফরেস্টার পাত্রীবাবুর উৎসাহে বাংলোতে মালপত্র রেখে খাওয়া সাঙ্গ করে, দুপুর একটায় রওনা দিলাম দেবান থেকে ১৬ কি-মি দূরে গহীন অরণ্যে বুলবুলিয়া ক্যাম্পে-সালফার স্প্রিংয়ের দিকে ৷
প্রথম এক থেকে দেড় কি-মি পথ চলা বোল্ডারের ওপর দিয়ে ৷ তারপর সরকারি পারানির সাহায্যে ঘন কাশবনের মধ্য দিয়ে জঙ্গুলে মেঠো চড়াই বেয়ে আমাদের এগনো ৷ সঙ্গে শুকনো খাবার ও কুকরি হাতে গাইড বাহাদুর ৷ পথিমধ্যে পাহাড়ি ঝোরাখাত চলার গতি নষ্ট করে দেয় ৷ যত এগোচ্ছি বন তত ঘন হচ্ছে ৷ দুপুর আড়াইটে নাগাদ আলোর অভাব বোধ হতে লাগল ৷ দুদিকে জঙ্গল, মাঝে পায়ে হাঁটা সরু পথ ৷ হঠাৎ নাম না-জানা জন্তুর সরে যাওয়া, হুলক গিবনের চিৎকার পরিবেশকে আরও ভয়ানক করে তুলল ৷ তিনটে নাগাদ এল ৬ কি-মি দূরবর্তী হলদিবাড়ি ৷ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা আরও ৬ কি-মি দূরে হর্নবিল পয়েন্টের দিকে ৷ পথে যেতে অর্জুন, খোকন, হুলক, মেকাই, গর্জন প্রভৃতি বনস্পতি ছাতা মেলে দাঁড়িয়ে আছে ৷ পচা-গলা পাতায় ভরা পথে পা ডুবে যাচ্ছিল, জোঁক ধরার সম্ভাবনা প্রচুর ৷
এই অঞ্চলে বিড়ালধর্মী চার প্রজাতির বাঘ, চিতাবাঘ, স্নো লেপার্ড ও ক্লাউডেড লেপার্ডের বাস ৷ উচ্চতার তারতম্যে প্রাণীকুলের বাসস্থানের রদবদল ঘটে ৷ নিচের ভাগে বার্কিং ডিয়ার, সম্বর, শুয়োর, বাঘ আর হাজার সাতেক ফুট উঁচুতে হিমালয়ের রেডপাণ্ডা, বিন্টুরং ও আরও উঁচুতে লুপ্তপ্রায় তুষার ও মেঘবরণ (ক্লাউডেড) লেপার্ডের দেখা মেলে ৷
এছাড়া হাতি, বানর ও বাইসনের দল তো আছেই, তৎসহ হাজারও পাখির কলকাকলি মাতিয়ে রাখে নামদাফার জলসাঘর ৷ রংবেরঙের ধনেশ ছাড়াও কালিজ, ফেজেন্ট, মিনিডেট, সাদা কাক, টিয়া ও হর্নবিলের আড্ডার জেরে জঙ্গল থেকে থেকে চমকে ওঠে ৷ এছাড়া সাপেদের ঐতিহ্যের কথা উহ্যই থাক ৷
ভাগ্যে থাকলে বুনো কুকুর, শেয়াল বা হাতির দেখা বা তাদের পদচিহ্ন চোখে পড়তে পারে ৷ সাড়ে চারটের মধ্যে অন্ধকার নেমে আসাতে টর্চ হাতে পথ চলে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে এসে পৌঁছলাম হর্নবিল ৷ হর্নবিল পয়েন্টের ওয়াচটাওয়ার দেখে আঁতকে উঠলাম ৷ টিনের চালা দেওয়া একটি দু-ফুট উঁচু কুঁড়েঘরবিশেষ ৷ দেওয়ালের বালাই নেই ৷ আমরা আর যাইনি, তবে এখানে থেকে ৪ কি-মি দূরবর্তী বুলবুলিয়া ও ৩০ কি-মি দূরবর্তী ফার্ম বিচ হাউসে যাওয়া যেতে পারে ৷ উল্লেখ্য, প্রথমটির ওয়াচটাওয়ারটির অবস্থা তথৈবচ আর দ্বিতীয়টিতে যেতে গেলে তাঁবু নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ৷
আগুন জ্বলেছে সারারাত ৷ দেওয়ালের অভাব পূর্ণ করেছে সঙ্গে আনা সতরঞ্চি ও কম্বলের দল ৷ সারারাত এই নির্জন নির্বাসনে জন্তুদের পিলে চমকানো ডাক যে মোটেই সুখপ্রদ হয়নি তা বলাই বাহুল্য ৷
সকাল হতেই ফেরা দেবানের দিকে ৷ পথে দেখা মিলল হাতি পরিবারের ৷ মহানন্দে কলাগাছ গলাধঃকরণে নিমগ্ন তারা ৷ দুগ্গা বলে স্রেফ পালিয়ে আসা ৷ ফেরার পথে দেখি এক জায়গায় কাশফুল ফুটে রয়েছে, ঘন কাশবনের ওপারে পাহাড়ভেদি নদীর প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস, ঠিক পাশেই দেবান বাংলো, আপাতত এখানেই দু-দিন রাত্রিবাস ৷
দেবান থেকে মিয়াওতে ফেরার পথে দেখি পথের ওপর পাখিদের সভা বসেছে ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন