অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
যাবার উদ্যোগ করেছিলাম গ্রিনল্যান্ড ৷ পৌঁছে গেলাম ল্যাপল্যান্ডে ৷ ঠিক সুকুমার রায়ের গেছো দাদার মতো অনিশ্চিত গন্তব্যে নয় ৷ শেষ মুহূর্তে গ্রিনল্যান্ডের ক্যাঙ্গারলুসুয়ান যাত্রার টিকিট পাওয়া গেল না ৷ তাই আমরা যাত্রা করেছিলাম ল্যাপল্যান্ডের উদ্দেশে ৷ আমাদের দ্বিতীয় প্রেফারেন্স ৷
গত জুলাই মাসের শেষে সেই যাত্রাপথে কোনও রোমাঞ্চ ছিল না ৷ কোপেনহেগেন থেকে আড়াই ঘণ্টায় হেলসিঙ্কি, ফিনল্যান্ড ৷ সমস্তক্ষণ সমুদ্রের ওপর দিয়ে, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায়, নিচের কিছুই যখন আর দৃশ্য নয় ৷
ল্যাপল্যান্ড একটা ভৌগোলিক ধারণা মাত্র, কোনও রাজ্য বা রাষ্ট্র নয় ৷ ল্যাপ ভাষা, যার অন্য নাম সামি ভাষা, যারা বলে তাদেরই বলা হয় ল্যাপ বা ল্যাপল্যান্ড-বাসী ৷ নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এই তিন দেশের উত্তরে যে অংশ মাথার মুকুটের মতো, তাকে বলা হয় ল্যাপল্যান্ড ৷ পৃথিবীর উত্তরে প্রায় শেষ বসতি ৷ ল্যাপদের পরে কোথাও কোথাও এসকিমোদের পাওয়া যায়, যারা বাস করে বরফের ইগলুর মধ্যে ৷ ল্যাপেরা চিরকালীন বরফ ঢাকা অঞ্চলে থাকে ৷ দক্ষিণে বরফমুক্ত সমতলেও বাস করে ৷ শীতে পাহাড় থেকে এবং বরফ থেকে নেমে আসে ৷ দক্ষিণের সমতলও তখন বরফে ঢাকা, তবে অনেক উষ্ণ ৷ অর্থাৎ তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বেশি নিচে নয় ৷ ল্যাপল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম রাশিয়াকেও ছুঁয়ে আছে ৷ ল্যাপদের ভাষা স্বতন্ত্র ৷ ফিনল্যান্ডের প্রতিবেশী এস্টোনিয়ার ভাষার সঙ্গে তার কিছু মিল আছে ৷
ল্যাপল্যান্ডের অনেকখানিই সুমেরু বৃত্তের উত্তরে ৷ সুমেরু বৃত্তরেখার কোনও শারীরিক উপস্থিতি নেই ৷ ৬৬ ডিগ্রি অক্ষাংশের উত্তরের অংশকে বলা হয় আর্কটিক অঞ্চল ৷ ৬৬ ডিগ্রি অক্ষাংশকে ভৌগোলিকেরা বলেন সুমেরু বৃত্ত ৷
যাত্রার প্রথম ধাপে পৌঁছেছি হেলসিঙ্কি ৷ এখান থেকে যাব রোভানিয়েমি ৷ সুমেরু বৃত্তের ঠিক নিচে ৷ বিশ-ত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে গেলেই সুমেরু বৃত্ত ৷
সারাদিন ধরে হেলসিঙ্কি থেকে ট্রেনে চললাম ৷ রাত দশটার ফুটফুটে আলোয় রোভানিয়েমি নামলাম ৷ আসলে এই আলো দেখতেই এখানে আসা ৷ সামান্য দেরি হয়ে গিয়েছে ৷ আর মাত্র সাতদিন আগে এলেই অস্ত-না-যাওয়া সূর্য দেখতে পেতাম ৷ এখন আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিটের মতো হেলসিঙ্কি সূর্যহীন ছিল, আমরা দেখতে পাইনি ৷ পরিশ্রম কিছু হয়নি তবু সারাদিন রেলযাত্রায় কিঞ্চিৎ ক্লান্ত ৷ তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ৷ পথে একবারও চোখ বন্ধ করতে পারিনি, করবার ইচ্ছাও হয়নি ৷
এ কোন দেশে এলাম যেখানে সবুজ ছাড়া রং নেই ৷ আকাশ অবশ্য ধূসর নীল ৷ সাত-আটশো কিলোমিটার পথ কখনও অরণ্য, কখনও তৃণভূমি ৷ খুব বেশি জলাজমি বা জল দেখলাম না প্রথমদিন ৷ শুধুই গাছ দুপাশে, প্রায় বসতিহীন ৷
ফিনল্যান্ডে তিনভাগের দু-ভাগ অরণ্য ৷ মানুষের বাসমাত্র এক অংশে ৷ বার্চ আর পাইনের অরণ্য ৷ প্রথম দিকটায় সমতল, সেখানে বার্চ বেশি ৷ বার্চের কাণ্ডে সাদা সাদা ছোপ ৷ বোধহয় একেই ইউরোপিয়ান হোয়াইট বার্চ বলে ৷ জঙ্গল দিগন্ত পর্যন্ত ৷ বার্চ পাইনের সারি দেখে আশ্চর্য হয়েছি ৷ এ দেশের প্রধান উৎপাদন কাঠ এবং কাঠ থেকে উদ্ভূত, যেমন কাগজ ৷ ফিনল্যান্ডের বাৎসরিক রপ্তানির আয়ের চল্লিশ শতাংশ কাঠ এবং কাঠ থেকে উদ্ভূত বস্তু থেকে আসে ৷ তবু কিন্তু এদের বৃক্ষসম্পদ শেষ হয় না ৷ কারণ গাছ যেমন একদিকে কাটা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই রোপণ হচ্ছে ৷ ফলে বৃক্ষসম্পদ প্রায় অটুট থেকে যায় ৷ স্থানে স্থানে বার্চ পাইন স্প্রূসের গাছ এমন সার দিয়ে লাগানো যে মনে হয় এগুলি মানুষ রোপণ করেছে ৷ প্রকৃতির স্বভাবে উচ্ছৃঙ্খলতা আছে ৷ গাছের তলাগুলোও বেশ পরিষ্কার ৷ লতাগুল্মের জঞ্জাল নেই ৷
ট্রেন দ্রুত চলেছে ৷ ফিনল্যান্ডের ট্রেন বেশ ভালো ৷ লাইনের ওপর মসৃণ দৌড়চ্ছে ৷ গাড়ি দুলছেও না বিশেষ ৷ রেস্টুরেন্ট গাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট কিনে এনে নিজের আসনে বসে দিব্যি ভোজন হল ৷ এদেশে যে সব কিছুই মহার্ঘ আবার বুঝতে পারলাম ৷
ক্রমশ নিসর্গ বদলাতে থাকল ৷ সমতল পার হয়ে একটু ওপরে উঠছি ৷ পাশে বার্চের সংখ্যা কমে আসছে, পাইন বা ওই জাতীয় গাছ বাড়ছে ৷ গাছ বদলালেও জঙ্গলের চেহারা বদলাচ্ছে না, নিটোল জঙ্গল ৷ অনেকগুলি লেক দেখা গেল দ্বিপ্রহরের পর ৷ ছোট নদী পার হলাম কয়েকটি ৷ দুপাশে এবার পাহাড় দেখা যেতে লাগল ৷ আমাদের পাশের জঙ্গল ওদিকে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ে উঠে পড়েছে ৷ সেখানেও তাই নিখাদ সবুজ ৷ চাষবাসের প্রায় কোনও চিহ্নই দেখছি না ৷ আমার স্ত্রী বললেন, চাষ করবেই বা কে, মানুষই তো দেখছি না ৷
আমাদের ট্রেনের স্টপেজ নেই বললেই চলে ৷ কোনও বড় স্টেশন পথে পড়ল না ৷ ছোট দুচারটে স্টেশন অবহেলার সঙ্গে পার হয়ে গেল ৷ লক্ষ করে দেখি, কোনও পাহাড়ের মাথায় বরফের আস্তরণ ৷ এখন মধ্য গ্রীষ্মে বরফ কমে এসেছে, তবু কোথাও বেশ খানিকটা বরফ দেখা গেল ৷
যাত্রীদের কারও সঙ্গে পরিচয় হল না ৷ আমরা এসেছি দ্বিতীয় শ্রেণীর চেয়ারকারে ৷ বেশি লোকজন নেই ৷ সামান্য কয়েকজন আছেন মাত্র ৷ ওরই মধ্যে রেস্টুরেন্টে কিছু ভিড় ৷
এদেশে ধূমপানের বড় অসুবিধা ৷ বোধহয় একটি ছাড়া সব কামরাই ধূমপান-বর্জিত ৷ রেস্টুরেন্টেও ধূমপান অচল ৷ এক সহযাত্রী সিগারেট বার করতে আমার অবাক চোখ দেখে বললেন, তিন কামরা পরে ধূমপানের কামরা, সেখানে যাচ্ছি ৷ কোনও পাবলিক প্লেসে ধূমপান বারণ ৷ ধূমপান করেনও খুব সামান্য মানুষ ৷ সুইডেন, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ডেই আপনার অসুবিধা হবে ৷
বোধহয় সেই কারণেই সিগারেট দুর্মূল্য এই দেশে ৷ কত দাম ঠিক মনে নেই, আমাদের হিসাবে এক প্যাকেট তিনশো টাকার বেশি ৷
ঘটনাটা পরের, তবু এখানেই বলে রাখি ৷ আমাদের হেলসিঙ্কির হোটেল রোভানিয়েমির হোটেল ঠিক করে দিয়েছিল ৷ হোটেলটি একটু নিরিবিলি অঞ্চলে ৷ ভারি সুন্দর ৷ আমাদের নির্দিষ্ট ঘর দেখে আমরা মোহিত ৷ সবে নিশ্চিন্ত আয়েসে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছি, দেখি দেওয়ালে লেখা আছে নোটিস, এ কামরায় ধূমপান বারণ ৷ রিসেপশনে ফোন করতে হল অন্য ঘর দেবার জন্য ৷ পিছনদিকের একটি ঘর পাওয়া গেল ৷ প্রথম ঘরটি এতই ভালো ছিল, এ ঘর পছন্দ হতে চায় না ৷ উপায় নেই ৷ হোটেলের অধিকাংশ ঘরেও ধূমপান বারণ ৷
রোভানিয়েমিতে নামলাম যখন, তখন রাত আটটা বাজে ৷ নির্মেঘ আকাশ, পরিচ্ছন্ন দিন ৷ তখনও বেশ দিনের আলো ৷ রোভানিয়েমিকে ফিনরা বলে ল্যাপল্যান্ডের রাজধানী ৷ আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম ৷ সেদিন রবিবার ৷ সব দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই, তারপর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে ৷ এমন নীরব নিস্তব্ধ শহর বেশি দেখিনি ৷ মনে হবে শহরবাসীরা বাইরে কোথাও চলে গিয়েছেন ৷ অধিকাংশ বাড়ির জানলা বন্ধ ৷ খাবার দোকান, অর্থাৎ রেস্টুরেন্টগুলি খোলা ছিল ৷ তারই একটায় প্রবেশ করা গেল ৷ সেখানে কবাব পাওয়া যায় দেখে আমার রসনা সজল হয়েছিল ৷ পরে দেখেছি সারা স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে কবাবের নামে দোনাকবাবের মাংস বিক্রি হয় ৷ যাঁদের দোনাকবাবের সঙ্গে পরিচয় নেই, তাঁদের জন্য বলে রাখি, মাংসখণ্ডের একটি তাল বানিয়ে, ছোট পাশ বালিশের আকারে ওপরে নিচে শিক বিঁধিয়ে তার ওপর বালিশটি ঘুরতে থাকে ৷ পাশে লম্বালম্বি দাঁড়ানো ইলেক্ট্রিক হিটার ৷ এইভাবেই মশলাহীন মাংস পাক হয় ৷ খদ্দের এলে ধারালো ছুরি দিয়ে মাংসের ওপরের আস্তরণ থেকে পাতলা করে মাংসের টুকরো কাটা হয় ৷ এক কথায় ঝলসানো মাংস ৷ পিটা ব্রেডের খোলের মধ্যে পুরে সস ও স্যালাড যোগ করে গ্রাহকের জন্য তৈরি হয় ৷ আগে চিকেন দোনাকবাব দেখিনি ৷ ইদানীং পাঁচ-সাত বছর দেখছি চিকেন দোনাকবাবও বিক্রি হচ্ছে ৷ সদ্য ঝলসানো তপ্ত মাংস, সুস্বাদু সস এবং স্যালাডের সঙ্গে লম্বা জড়ানো কাশ্মীরি মরিচ যুক্ত করে পিঁয়াজসহযোগে খেলে ভালোই লাগে ৷ প্রথম প্রথম খুবই ভালো লাগত, এখন অতিপরিচয়ের বিরাগ এসেছে ৷
রোভানিয়েমির রেস্টুরেন্টে কবাব চাইতে, রুটি এবং মাংসখণ্ডগুলি আলাদা পরিবেশন হল ৷ মাংস সুস্বাদু ছিল না ৷ লঙ্কা অর্থাৎ কাশ্মীরি মরিচের আচার সামান্য ছিল, অনেকবার চেয়েও বেশি পিঁয়াজের স্লাইস আদায় করা গেল না ৷ দাম ভালোই লাগল ৷ কোক বা পেপসি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করলাম ৷
দু-বোতল জল নিয়ে ঘরে ফিরব, জল পাওয়া গেল না, কাছেপিঠে কোনও দোকানও নেই যেখানে জলের বোতল পাব ৷ ইউরোপে সর্বত্রই মানুষ বোতলের জল সঙ্গে নিয়ে ঘোরে ৷ হোটেলে বোতলের জল পাওয়া যাবে ৷ কিন্তু সেখানে ছোট এক বোতল জলের দাম আমাদের টাকায় আশি বা নব্বই ৷ রিসেপশনকে জিজ্ঞাসা করতে মহিলাকর্মী অভয় দিলেন, এখানের কলের জল আপনি নির্ভয়ে খেতে পারেন ৷
জল সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে শহরটা দেখতে বেরোলাম ৷ ঘুমন্ত, স্তব্ধ শহরের একটা গা চমকানো প্রতিক্রিয়া আছে ৷ হঠাৎ স্তব্ধতা ভেঙে একটা গাড়ি গেলে চমকে যাচ্ছি ৷ কোনও বাড়িতেই আলো জ্বলছে না, পর্দাটানা জানলা, হয়তো মানুষ শয্যাগ্রহণ করেছে ৷ কাল সকালেই সবাইকে আবার কাজে যেতে হবে ৷ এদেশে সাতটা বা আটটার মধ্যে, যে প্রতিষ্ঠানে যেমন, কাজে পৌঁছে যেতে হয় ৷ সপ্তাহান্ত ছাড়া মানুষ দীর্ঘকাল ঘুমোতে পারে না ৷
ছোট জনহীন শহরের শব্দহীন সন্ধ্যার আবছা আলোয় তখন রাত্রি দশটা ৷ বেশ ভালো লাগছিল ৷ পাশেই কেমিয়োকি নদী ৷ নদীর ধারে স্থানে স্থানে বেঞ্চি পাতা ৷ আমরা ছাড়া আর একটিও মানুষ দেখলাম না ৷ কিছুকাল অনির্দেশ ঘোরাঘুরি করে হোটেলের ঘরে ফিরে এলাম ৷ ঘরে তখনও বেশ আলো ৷ আমাদেরও পর্দা টেনে দিতে হল ৷ মাঝরাতে উঠে দেখি, যেমন আলো ছিল তেমনই আলো আকাশে এখনও ৷ মাঝে কখন কিছুক্ষণ অন্ধকার হয়েছিল বুঝতে পারিনি ৷
যেটুকু দেখেছিলাম সন্ধ্যায়, ল্যাপল্যান্ড বলতে আমার মনে যে ছবি ছিল তার সঙ্গে মিলল না ৷ ইউরোপের আর সব দেশের মতো বাড়িঘর, পানশালা, ভোজনশালা ৷ উঁচু মাথা বাড়ি নেই রোভানিয়েমির ওই অঞ্চলে ৷ শীতও তেমন নেই যে ল্যাপ-রা চামড়ার পোশাক পরে আসবে ৷ রাইন ডিয়ার নেই, স্লেজের কথা উঠছে না, বরফ অনুপস্থিত ৷
সকালে শহরে প্রাণের চিহ্ন দেখা গেল ৷ মানুষজন কয়েকটি ৷ এদেশে পথে চলার লোক নেই ৷ দু-চারটে গাড়ি যাচ্ছে ৷ দোকানগুলি খুলেছে ৷ পথের ধারে ভোজনশালায় প্রাতরাশ পর্ব চলেছে ৷ কোথাও বেশি লোকজন নেই ৷ না থাকবারই কথা ৷ এই শহরের মোট জনসংখ্যা সাতান্ন হাজার ৷ পর্যটক খুব বেশি দেখিনি ৷ ফিনল্যান্ডের এই প্রত্যন্ত প্রদেশে আসবার আগ্রহ নেই সবার ৷ তবু, আমাদের হোটেলের কর্মী বলল, শীতকালে, যখন বরফে সব ঢেকে যায় তাপাঙ্ক শূন্যর নিচে নামে, তখন বহু পর্যটক আসে ৷ আশপাশের অনুচ্চ পাহাড়গুলি নাকি স্কি করার জন্য প্রশস্ত স্থান ৷ এখন বরফ দেখতে পাচ্ছি শুধু পাহাড়ের মাথায় টুপির মতো ৷ অঙ্গ নিরাভরণ, কোথাও সবুজ ঘাসে ঢাকা, কোথাও ইতস্তত কিছু পাইন স্প্রুস গাছ, হাতুড়ে নাপিতকে দিয়ে চুল কাটলে যেমন হত, তেমনই ৷ কোথাও আবরণ ছাড়া নগ্ন পাথর ৷
আমাদের সহযাত্রী বললেন, শীতকালে এই সব পাহাড় তুষারে তৈরি মনে হবে ৷ আমরা চলেছি সান্তাক্লজের গ্রামে, সান্তাক্লজ ভিলেজ ৷ বাসে রোভানিয়েমি থেকে আধঘণ্টার যাত্রা ৷ এখান দিয়ে গিয়েছে সুমেরু বৃত্ত ৷ বৃত্তের থেকে শুরু হয় মেরু অঞ্চলের প্রকৃতি ৷ লাইন দিয়ে অবশ্য প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ৷ সান্তাক্লজ ভিলেজ রোভানিয়েমির উপকণ্ঠের গ্রামগুলির মতোই ৷ অবশ্য কাঠের বাড়ি সব ৷ মনে পড়ছে, ইট পাথরের বাড়ি আদৌ দেখিনি এখানে ৷
সুমেরু বৃত্ত রেখার ওপরে সান্তাক্লজ ভিলেজ মানুষের তৈরি করা, পর্যটক আকর্ষণের জন্য ৷ প্রবাদ বলে বড়দিন বা ক্রিসমাসের অগ্রদূত সান্তাক্লজ ফিনল্যান্ডের এই অঞ্চলের বাসিন্দা ৷ সাজানো একটা ঘরে শীতকালের মোটা জামা পরে, সান্তাক্লজের প্রচলিত পোশাকে এক বড়সড় মানুষ বসে আছেন ৷ আগন্তুক ছেলেবুড়ো সবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন ৷ তাঁর ছবিও তুলছে একদল পেশাদার ফটোগ্রাফার ৷ অল্প সময়ের মধ্যেই ছবি তৈরি করে বিক্রি হচ্ছে ৷ যথেষ্টই দাম হবে ৷ আমরা খবর নিইনি ৷ ওই ঘরে প্রবেশ করাও সহজ ছিল না ৷ এত ভিড় ৷ এখানে যথেষ্ট পর্যটক দেখলাম ৷ দেশান্তরের পর্যটকেরা সার বেঁধে ল্যাপল্যান্ডের হস্তশিল্প কিনছেন, পিকচার পোস্টকার্ড কিনছেন ৷ ল্যাপল্যান্ডের নিজস্ব শিল্পের আধার হল কাঠ এবং চামড়া ৷ সুন্দর, বিশিষ্ট জিনিস সব ৷ অগ্নিমূল্য ৷ আমার স্ত্রী বললেন, হাত দিও না, ছ্যাঁকা লেগে যাবে ৷
এখানে ব্যাকপ্যাকারদের সংখ্যা কম ৷ এই গ্রীষ্মে ইউরোপের সর্বত্র ব্যাকপ্যাকারদের ভিড় দেখে আশ্চর্য হয়েছি ৷ দার্জিলিংয়ের বা অন্য পাহাড়ের কুলিদের ধরনে পিঠে যাবতীয় মোটঘাট নিয়ে ব্যাকপ্যাকাররা ঘুরে বেড়ান ৷ শুধু, কুলিদের মতো মাথায় দড়ি লাগান না বোঝা বইবার জন্য ৷ সবার সঙ্গেই একটা রবারের সতরঞ্চি রোল করা আছে ৷ প্রয়োজনে মাটিতে বিছিয়ে শুয়ে পড়তে পারেন ৷ সব সময় যে এঁরা যত্রতত্র শয়ন করেন তা নয় ৷ হোটেলের ঘর থেকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরুচ্ছে এমন যাত্রী অনেক দেখেছি ৷ আমার মনে হয়েছে সুটকেস বহনের থেকে এই কাজটা অনেক সহজ, আর এখন বোধহয় কিঞ্চিৎ ফ্যাশানের তাগাদাও আছে ৷
কয়েকজন জাপানি পর্যটকও দেখলাম ৷ ইউরোপে জাপানি পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে ৷ তাই বহু স্থানে জাপানি ভাষায় লেখা ফোল্ডার ইত্যাদি পাওয়া যায় ৷ বড় দোকানে তো জাপানি ভাষায় লেখা আগেই উপস্থিত হয়েছে ৷
সান্তাক্লজ ভিলেজে যত দোকান, ছোট বড়, তেমনই নানা ধরনের, নানা মূল্যের ভোজনশালা ৷ যেন কোনও বড় মেলা বসেছে ৷ শুনলাম, সন্ধ্যাতে আরও জমবে, গানবাজনা হবে ৷ নিকটেই একটি রাইন ডিয়ার ফার্ম আছে ৷ সেখানে রাইন ডিয়ার, মস্ত শিংওলা মস্ত হরিণ, আমাদের বারশিঙার ধরনের, পালন করা হয় ৷ সেখানে ছাড়া আর অন্য কোথাও ল্যাপদের নিত্যসঙ্গী, তাদের ভরণপোষণের প্রতিশ্রুতি রাইন ডিয়ার দেখলাম না ৷ আরও কয়েক কিলোমিটার গেলে হাস্কি বা মেরু প্রদেশের কুকুর দেখা যেত ৷ প্রদর্শনীর মতো ৷ বরফ নেই যে তারা স্লেজ টেনে নিয়ে যাবে ৷
বিকেলে শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম ৷ ছোট শহর ৷ নদীর এপার সময় থাকলে হেঁটেই দেখা যায় ৷ লোকসংখ্যা কম, সাতান্ন হাজার, কিন্তু শহরের ঐশ্বর্য কম নয় ৷ শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অনেক বহুতল বাড়ি ৷ দামি দোকানপাট, ভোজনশালা ৷ বেশিরভাগই আমাদের আয়ত্তের বাইরে ৷ শহরের একমাত্র পদাতিকের জন্য সংরক্ষিত পথটি বড় সুন্দর ৷ গাছ এবং ফুলে সাজানো শহরের সর্বত্র অবশ্য অজস্র ফুল ৷ সব পার্কই যেন ধনীর পুষ্পোদ্যান ৷ পথের ধারে, বিজলির থামের মাঝখানে থরে থরে ফুলগাছ ৷ এবং সর্বত্র বহু বর্ণের ফুল ৷ এক দোকানদার বলল, এই তো কটি মাস মাত্র সময় ৷ তারপর তো অন্ধকার ৷ চব্বিশ ঘণ্টা ৷
শীতকালে সূর্য প্রায় ওঠেই না এদেশে ৷ তবে দিনেরবেলায় একটি বিচ্ছুরিত আলো থাকে, মনে হল আমাদের গোধূলির মতো, সেই আলোতেই জীবনযাত্রা চলে ৷ আবার গ্রীষ্মের অপেক্ষা করে সবাই ৷
রোভানিয়েমি ছোট শহর বলে আয়ত্তের মধ্যে ৷ শহরে সর্বাপেক্ষা দ্রষ্টব্য আর্টিকাম, বা আর্কটিক মিউজিয়াম ৷ নদীর ধারে বিশাল এই মিউজিয়ামটির স্থাপত্যও দেখবার মতো ৷ ছাদ কাচের ৷ স্থপতির নাম ক্লস বোডরুপ ৷ তিনি ফিনল্যান্ডের বিশিষ্ট স্থপতি ৷ তাঁর তৈরি আরও কয়েকটি অনবদ্য সৌধ আছে রোভানিয়েমিতে ৷ ফিনল্যান্ডের মানুষেরা শুধু নয়, সমগ্র স্ক্যান্ডিনেভিয়া-বাসীই স্থাপত্যকে জীবনযাত্রার বিশিষ্ট অঙ্গ মনে করেন ৷ কোন অট্টালিকা বা সৌধ কোন খ্যাতনামা স্থপতির কীর্তি, তাঁরা সর্বদা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন ৷
শুধু স্থাপত্যের জন্যই নয়, দ্রষ্টব্যের আয়োজনেও আর্টিকাম বিশিষ্ট ৷ আর্টিক অঞ্চলের মানুষদের ইতিহাস, তাদের জীবনধারা এবং তাদের ক্রমবিবর্তন দেখানো হয়েছে এই মিউজিয়ামে ৷ ল্যাপল্যান্ডের মানুষের জীবনযাত্রা কেমন করে কয়েক শতাব্দী ধরে পরিবর্তিত হয়েছে, তার নানা নিদর্শন রয়েছে এখানে ৷ প্রত্যেক ঘরে কম্পিউটার রাখা আছে ৷ বোতাম টিপে আপনার আগ্রহের বিষয়টি জানালে সে সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্যচিত্র ও কথার সাহায্যে বিবৃত হয় ৷ যাযাবর জাতি কেমন নিজের অজ্ঞাতে আধুনিক সভ্যতার আচার অভ্যাসে প্রভাবিত হয়েছে, এই মিউজিয়াম দেখলে সহজে বোঝা যায় ৷
রোভানিয়েমির রেলস্টেশন, টাউন হল ইত্যাদির স্থপতি আলভার আলটো ৷ মুদ্রিত প্রচার পুস্তিকায় পড়েছিলাম, ল্যাপল্যান্ডের মানুষদের জীবনযাত্রার মর্যাদা দিয়ে স্টেশনটির রূপ দেওয়া হয়েছে রাইন ডিয়ারের শৃঙ্গের আকারে ৷ তথ্যটা আগে পড়া হয়নি, তাই হরিণের শিঙের রূপ ধরতে পারিনি ৷
রোভানিয়েমি থেকে হেলসিঙ্কি ফেরার জন্য রওনা হলাম, তখন বোধহয় বিকেল ছটা বাজে ৷ হেলসিঙ্কি পৌঁছব সকাল আটটা ৷ এবারে রাতে শয়নের কামরা ৷ অতিশুভ্র চাদর বালিশে সাজানো-দুই যাত্রী কামরা ৷ কম্বলের সঙ্গে আরেকটি সাদা চাদর ৷ বিছানা করাই ছিল ৷ কামরা ও সিট নম্বর মিলিয়ে উঠে পড়লাম ৷ স্টেশনে একজনও রেলকর্মী নেই ৷ নামের তালিকাও টাঙানো নেই কোথাও ৷ আমাদের টিকিটেই কামরা ও আসনের নম্বর দেওয়া আছে ৷
দিনের আলোয় চেনা পথ দিয়ে চলেছি ৷ কাচের জানলা স্বচ্ছ পরিষ্কার ৷ কোনও কিছু দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না ৷ পণ্ডিতেরা বলেন, তুলনা করা গর্হিত কাজ ৷ তবু আমাদের দেশের তুলনা না করে পারি না ৷ আমাদের রেলের কামরার কাচ কেন সর্বদা অস্বচ্ছ নোংরা হয়ে থাকে-একথা স্বাভাবিকভাবেই মনে এল ৷ আমাদের এ সি ফার্স্ট ক্লাস, অর্থাৎ সর্বোচ্চ শ্রেণীর কামরার জানলাও কখনও পরিচ্ছন্ন দেখিনি ৷ কেন এমন হয় জানি না ৷ আমাদের তো ধোয়া-মোছার লোক অনেক বেশি ৷ তবুও ৷ কেন? আরও একটা কথা মনে হল ৷ আমাদের রেলের কামরার সর্বত্র বৃহৎ লোহার স্ক্রুর মাথা দেখা যায় ৷ এরা কি করে নাটবল্টু মুক্ত করে ভেতরটাও এমন মসৃণ সুন্দর করতে পেরেছে!
রেস্টুরেন্ট কার সঙ্গে ছিল ৷ সেখান থেকেই খাবার আনা হল ৷ অন্ধকার হবার অনেক আগেই আমরা শয্যাগত হয়েছিলাম ৷ সকাল আটটায় হেলসিঙ্কি পৌঁছলাম ৷
হেলসিঙ্কি থেকে বিকেলেই রওনা হব জাহাজে স্টকহোমের উদ্দেশে ৷ জাহাজে সমুদ্রযাত্রা এই নিবন্ধের পক্ষে অবান্তর ৷ স্টকহোম থেকে আমরা যাব সুইডেন ও নরওয়ের ল্যাপল্যান্ড অঞ্চলে ৷ তবু এই জলযাত্রার বিষয়ে একছত্র বলে নিই ৷
সিলিয়া কোম্পানির দশতলা একটি জাহাজে উঠতে গিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ৷ এত লোক! জাহাজে হাজারখানেক যাত্রী স্টকহোম চলেছেন ৷ সন্ধ্যা ছটায় উঠছি, সকাল দশটায় নামব ৷ অত ভিড়, কিন্তু কী শৃঙ্খলার সঙ্গে সবার জাহাজে ওঠা শুরু হল ৷ কাউন্টারে গিয়ে আমাদের টিকিট দেখাতেই আমাদের কামরার ইলেক্ট্রনিক চাবি দিয়ে দেওয়া হল ৷ আমাদের ঘর সাততলায় ৷ এসকেলেটর ও সিঁড়ি পার হয়ে, শেষে লিফটে উঠে আমাদের নির্দিষ্ট কামরায় পৌঁছলাম ৷ কামরাটি সুন্দর, সঙ্গে বাথরুম ৷
চটপট তৈরি হয়ে আমরা ছতলায় চলে গেলাম ৷ সেখানে আট-দশটি ভোজনশালা আর শুল্ক-ছাড় জিনিসের দোকান ৷ সর্বত্র মানুষের ভিড় ৷ নিচের তলায় আরও দোকান এবং ভোজনশালা ৷ যেন বড় কোনও মেলা বসেছে ৷ মেলা শেষ হবার অনেক আগেই আমরা কামরায় ফিরে শয্যাগত হয়েছিলাম ৷
স্টকহোমে কটা দিন মহানন্দে কাটল ৷ সময়টা ভালো ৷ প্রত্যহ রোদ ওঠে ৷ গা শিরশিরে ঠান্ডা ৷ সেন্ট্রাল স্টেশনে গিয়ে আমরা নারভিক যাবার রিজার্ভেশন করালাম ৷ রিজার্ভেশনের কর্মীটি সদালাপী মানুষ ৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় এই এক সুবিধা ৷ প্রায় সবাই ইংরিজি বলতে ও বুঝতে পারেন ৷ ইংরিজি ভাষা স্কুলে অবশ্য-পাঠ্য ৷ রিজার্ভেশনের যুবকটি আমাদের নানা খবর নিলেন ৷ নিজের দেশের অনেক কথা শোনালেন ৷ রিজার্ভেশন করে আমাদের কাগজটা দিলেন ৷ আমাদের যাত্রা পরদিন বিকেলে ৷
তখন তো জানি না, অত সদালাপের জন্য ঈষৎ অন্যমনস্ক রিজার্ভেশন কর্মী আমাদের ভুল রিজার্ভেশন করেছেন ৷ প্রসঙ্গটা আমাদের ল্যাপল্যান্ডে যাত্রার সঙ্গে না লিখলেও চলত ৷ লিখছি এই জন্য যে, গর্হিত হলেও তুলনা না করে পারছি না ৷
পরদিন বিকেলে আগেভাগে পৌঁছে আমাদের সংরক্ষিত কামরায় আসন নিলাম ৷ এবারে আমরা স্থান পেয়েছি চারশয্যার কামরায় ৷ কিছুক্ষণ পরে দুটি জার্মান যুবতী পৌঁছল ৷ এবং তারপর আরও দুই ওদেশি যুবক ৷ আমরা অবাক হয়ে ভাবছি এই চারশয্যার কামরায় ছজন কেমন করে থাকবে ৷ আমার স্ত্রী বিভ্রান্ত হয়ে সেই প্রশ্নই তুললেন ৷ আমরা নিশ্চিত জানি, আমরা ছাড়া বাকি চারজনের দুজন অনাধিকার প্রবেশ করেছে ৷ পরস্পরের টিকিট মিলিয়ে দেখা গেল, আমরা দুজনই এ কামরায় অবাঞ্ছিত আগন্তুক ৷ আরও আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আমাদের সংরক্ষণ কালকের জন্য, আজকের নয় ৷ মিষ্টভাষী রিজার্ভেশন কর্মী আলাপচারীতে ব্যস্ত থেকে এই ভুলটা করেছে ৷
দিশাহারা হয়ে পড়লাম ৷ কী করব, কাকে জিজ্ঞাসা করব? যাত্রীরা সবাই গাড়িতে উঠে পড়েছে ৷ প্ল্যাটফর্মে একজনও রেলকর্মী নেই ৷ ট্রেন ছাড়তে এক মিনিট বাকি, নেমে যাব কিনা ভাবছি, জার্মান যুবতীরা আশ্বাস দিল, আপনারা বসুন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই ৷ চেকার আসুক ৷
আমি ধাতস্থ হয়ে বললাম, মা লক্ষ্মীরা, তোমাদের পদতলে বসতে দিও ৷ আমরা বসেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারব, তোমাদের অসুবিধা না হলে ৷
প্রস্তাবটা অন্য দুজন যুবক যাত্রীর পছন্দ হয়নি, তাদের বিরস মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ৷ এমন সময় টিকিট চেকার মহিলা এলেন ৷ আমার মনের মধ্যে আসন্ন ভবিষ্যতের করুণ ছবি পরের পর ফুটে উঠছে ৷ আমাদের পরের স্টেশনে নেমে যেতে হয়েছে ৷ অনেক অপেক্ষার পর স্টকহোমে ফিরে গিয়েছি, স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে হোটেলে, হোটেলে আবার একদিনের খরচ ৷ তার ওপর আমাদের গন্তব্য নারভিক এবং বোডার হোটেলের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে হোটেলে স্থান রিজার্ভেশন করা হয়েছে ৷ হায়, সে সব টাকাও মারা যাবে ৷ তার ওপর আমাদের গন্ধমাদন মোটঘাট আবার কতবার ওঠাতে নামাতে হবে ৷
এসবের কিছুই হল না ৷ চেকার মহিলা বললেন, আপনারা আপাতত এখানে বসুন ৷ আমি দেখছি কোথাও কিছু খালি আছে কিনা ৷ সংক্ষেপে বলি, শেষ পর্যন্ত আমরা অন্য একটি চারশয্যার কামরায় দুটি বার্থ পেয়েছিলাম ৷
ভেবেছি, এমন পরিণতি কি এদেশে হত? আমাদের আইনকানুন যে সর্বনেশে ৷
রাত দশটা পর্যন্ত ছোটবড় স্টেশন পার হতে থাকলাম ৷ এ দিকটায় জনবসতি আছে ৷ মাঝে খেতখামারও দেখা যাচ্ছে ৷ তা বলে পাইন, ফার এবং স্প্রুসের কমতি নেই ৷
নিদ্রাভঙ্গে দেখি অরণ্য হ্রদ আর তৃণপ্রান্তর ৷ বড় হ্রদের পাশ দিয়ে যাচ্ছি ৷ হ্রদের তীরে জনজীবনের আভাস পাচ্ছি ৷ হ্রদের তীরে মাছ ধরার আয়োজন ৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার প্রিয়তম খাদ্য বোধহয় মাছ ৷ কাঁচা, শুকনো এবং রান্না করা ৷ ট্রেন অতি দ্রুতগতি ৷ আমরা সকাল দশটায় নামব নারভিকে, ৯৫০ মাইলের দূরত্বে ৷
পাহাড় দেখা যাচ্ছে দুপাশে ৷ বন্য মানুষের মাথায় পালক গোঁজার মতো মাথায় বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ কোথাও দেখছি হিমবাহ নামতে নামতে অকস্মাৎ থেমে গিয়েছে ৷ গ্রীষ্মকাল তাই শেষাংশে বরফ গলে গিয়েছে ৷ পাহাড়ের পাশাপাশি, কখনও পাহাড় ভেদ করে টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলেছে ৷ দিনটা সূর্যালোকে প্রসন্ন ৷
আমরা নরওয়ে সুইডেনের ল্যাপল্যান্ডে যাচ্ছি ৷ সুইডেনের উত্তরতম শহর কিরুনা এসে গেল ৷ বড় শহর, নানা শিল্পের অবস্থান এখানে ৷ দুপাশে উচ্চ পর্বতমালা ৷ এই অঞ্চল লৌহ আকরের জন্য খ্যাত ৷ এখান থেকে নারভিকের বন্দর হয়ে লক্ষ লক্ষ টন আকর দেশবিদেশে চালান হয় ৷ কিরুনার কাছেই সুইডেনের উচ্চতম পর্বতশীর্ষ ৷ সঙ্গের অভিযাত্রীরা ট্রেন থেকে বোঁচকা-পিঠে নেমে গেলেন ৷ চূড়ায় উঠতে বুঝি দুদিন লাগবে ৷ তাঁদের উদ্দীপনা কত সহজে আমাদের মনেও সঞ্চারিত হল ৷
আর ঘণ্টা দুই পরে আমরা নরওয়ের বন্দর নারভিক পৌঁছব ৷ নারভিকের স্টেশন-বাড়ি ছোট ৷ যাত্রীও খুব বেশি নামল না ৷ হাইকিং আর হিলক্লাইম্বিংয়ের ভক্তেরা কিরুনাতেই নেমে গিয়েছে ৷ আশা করি, তার নারভিকে আসবে ৷ এত সুন্দর শহর আমরা বেশি দেখিনি ৷
হোটেলের ঘর দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম ৷ আমরা সর্বত্র মধ্যবিত্ত হোটেলে থাকি ৷ এটিও তাই ৷ ঘর অবশ্যই কার্পেটে মোড়া ৷ একপাশে ফায়ারপ্লেস, শীতে আগুন জ্বালাবার জন্য ৷ সেকালের আসবাব, ভেলভেটে মোড়া ৷ ঝালর লাগানো বিছানার চাদর দুগ্ধ ফেননিভ বালিশ-বিছানা, সুন্দর লেস-লাগানো ফুল-ছাপ পর্দা ৷ প্রাচীন একটি আলোস্ট্যান্ড ৷ যেন পঞ্চাশ বছর আগের একটি ঘর এখন এইমাত্র আমাদের জন্যই খোলা হল ৷
সঙ্কোচবশে জিজ্ঞাস করতে পারিনি, প্রৌঢ়া যিনি মহিলা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, তিনি মালিক, না ম্যানেজার ৷ তিনিই ঘরে এলেন, বললেন, চা, না কফি? এখানে আপনি যখনই চাইবেন চা, কফি অথবা জুস তখনই পাবেন ৷ অনুল্লিখিত ছিল, এটা হোটেলের অতিথিপরায়ণতার অঙ্গ ৷ তার জন্য কোনও মূল্য দিতে হবে না ৷
নারভিক পৃথিবীর উত্তরতম রেলস্টেশন ৷ সুমেরু বৃত্তের প্রায় তিনশো কিলোমিটার উত্তরে নারভিকের অবস্থান ৷ সুমেরু বৃত্তের তিনশো কিলোমিটার অভ্যন্তরে ৷ এখানেও বিশেষ ঠান্ডা নেই ৷ পাঁচ-ছ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ৷ চা-পান করেই বেরিয়ে পড়া গেল ৷ দুদিকের পাহাড়ের মাথায় বরফ ৷ সামনের পাহাড় এতক্ষণ মেঘাচ্ছন্ন ছিল ৷ মেঘ সরতেই বিস্তৃত হিমবাহ দেখা দিল ৷ আমাদের সামনেই সমুদ্রের খাঁড়ি ৷
নরওয়ে সুইডেনে বলে ফিয়র্ড ৷ সমুদ্র যেখানে স্থলভূমির গভীরে প্রবেশ করেছে ফিয়র্ড বলতে তাই বোঝায় ৷ বড় মানচিত্র দেখলে বুঝতে পারি সমুদ্র কেমন তার সহস্র নখর চিহ্নে স্থলভূমিকে আক্রমণ করেছে ৷ ফিয়র্ডের জল শুধু সমুদ্রের সামনেই সীমিত নয়, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে, পাশ কাটিয়ে অনেক অভ্যন্তরে চলে গিয়েছে ৷ বহু ফিয়র্ডে জাহাজ চলে ৷ এমনই এক ফিয়র্ডের পাড়ে নারভিক ৷ একদিকে বন্দর ৷ সেই সদাব্যস্ত বন্দর থেকে আকরিক লোহা বিদেশে চালান হয় ৷
আমরা ফিয়র্ডের অন্য তীরে ৷ সেখান থেকে বন্দর দেখা যায়, ব্যস্ততা বোঝা যায় না, এমন প্রশস্ত ফিয়র্ড ৷ নারভিক শহর ফিয়র্ডের তীরে, স্থলভূমি প্রশস্ত নয়, একটু পরেই পাহাড়ের শুরু ৷ সেই পাহাড়ের গায়ে খাঁজে খাঁজে আমাদের হিল স্টেশনের মতো ছোট বড় বাংলো ৷ সব বাড়িতে ফুল, রাস্তার ধারে ফুল, নানা বর্ণের নানা আকারের ৷ হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে পরিপূর্ণ রৌদ্রে পাহাড়ের শিখরশ্রেণী ঝলসে উঠল ৷
কিরুনা থেকে নারভিক আসবার পথ একেবারে অন্যরকম ৷ তখন আমরা ক্রমশ পাহাড়ে উঠেছি, যেমন হয় পাহাড়ের ট্রেন, এঁকেবেঁকে, এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে ৷ একপাশে ভয়ংকর খাদ, অনেক নিচে ফিয়র্ডের জল ৷ পথের ধারে ঝরনা নেমেছে, পাথর পড়বার ভয়ে কোথাও চালা করে দেওয়া হয়েছে, যার তলা দিয়ে ট্রেন নিরাপদে যেতে পারে ৷ এক পাশের পাহাড়ে নগ্ন পাথর, সোজা জল থেকে উঠেছে, বিভীষিকার মতো ৷ ট্রেনের গতি অনেক কমে এসেছে ৷ এমন যাত্রা যে সমতল শহরে শেষ হতে পারে বিশ্বাস হয় না ৷ নারভিকের দীর্ঘ তট ফিয়র্ডের ওপর ৷ ছোট দোকানপাট ৷ এমন একটা রাজপথে টুকিটাকি ভোজনের আয়োজন নেই দেখে আশ্চর্য হয়েছি ৷
নিকটের কিয়স্কে কিছু ফাস্ট ফুড ভোজনান্তে আমরা চললাম মাউন্টেন লিফট চড়বার জন্য ৷ ফিয়র্ডের তট থেকে অনেকখানি ওপরে উঠে মাউন্টেন লিফট ধরতে হবে ৷ আমাদের হোটেলের মহিলা বললেন, ট্যাক্সি করে যাওয়াই ভালো ৷ অতটা উঠতে পারবেন না ৷ অগত্যা ট্যাক্সি ৷ মাউন্টেন লিফটের স্টেশনে টিকিটবাবু ছাড়া আর কোনও মানুষ নেই ৷ তিনি টিকিট দিয়ে আমাদের একটা খাঁচায় বসিয়ে দিলেন ৷ প্রায় ৭০০ মিটার ওপরে উঠব, অর্থাৎ দু হাজার ফুটের বেশি ৷ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, ওই যাত্রায় নিচের টিকিটবাবু ছাড়া ওপরে নিচে কোনও কর্মী নেই ৷ তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করছেন ৷ ওপর থেকে নিচে নামার সময়ও কেউ নেই ৷ খাঁচায় উঠে বসলে স্বয়ংক্রিয় দরজা নিজেই বন্ধ হয়ে যায় এবং নিচের দিকে চলতে শুরু করে ৷ একটু অস্বস্তি হয় বৈকি ৷
পাহাড়ের একটা খাঁজে কাঠের মস্ত পাটাতন ৷ রোপওয়ে স্টেশন ৷ হঠাৎ চারদিকের দিগন্ত যেন মুক্ত হয়ে গেল ৷ আমরা হিমবাহের তলদেশে এসে পৌঁছেছি ৷ এখন গ্রীষ্মে হিমবাহগুলি সংকীর্ণ ৷ আমাদের সঙ্গীরা অনায়াসে একটু উঠে হিমবাহে বসে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে লাগলেন ৷ অনেক নিচে ফিয়র্ড ৷ বন্দর দেখা যাচ্ছে শিশুর খেলাঘরের মতো ৷ তিনদিকের পাহাড়ে বরফ ৷ কয়েকজন পিঠে-বোঁচকা যাত্রী হাইকিংয়ে বেরিয়ে পড়লেন ৷ আর দুই যাত্রী ভারি বোঝা কাঁধে নিয়ে দুহাজার ফুট উঠে এসেছেন ৷ তাঁরা পাহাড়ের বিশুদ্ধ হিমেল হাওয়াতে সাময়িক বিশ্রাম নিচ্ছেন ৷ পুরুষটি যৌবন পার হয়েছেন ৷ পরিচয় হতে বললেন, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী, কিরুনার পাহাড়ে চড়তে এসেছিলেন ৷ একদিনে পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটেছেন ৷ এই মাউন্টেন লিফটের চূড়া তো সামান্য ব্যাপার ৷ নস্যি ৷
ওপরে একটি সুদৃশ্য ভোজনশালা ৷ গরম চকোলেট পান করে আমরা ক্লান্তি নিরসন করলাম ৷ কিছু টুকিটাকি জিনিস বিক্রি হচ্ছে ৷ ল্যাপদের হাতের কাজ, কাঠ এবং চামড়ার ৷ প্রবল দাম ৷ কিন্তু ল্যাপেরা কোথায়, তাদের সেই চামড়ার পোশাকে রাইন ডিয়ার বাহিনীর পিছনে দাঁড়িয়ে স্লেজ হাঁকাচ্ছে, তারা কোথায়? এখানেও তারা অনুপস্থিত ৷ আরও দুশো মাইল উত্তরে গেলে তাদের দেখা পাওয়া যেতে পারে ৷ আমাদের সে অভিযানের সাহস নেই, সামর্থ্যও নেই ৷ আমাদের সদ্যলব্ধ বন্ধু দুজন ফিনল্যান্ডের মানুষ ৷ আমরা রোভানিয়েমি গিয়েছি শুনে বললেন, কী রকম মশা পেলেন ওখানে? আমরা আদৌ মশা দেখিনি শুনে আশ্চর্য হলেন ৷ বললেন, এই সময়টা ল্যাপল্যান্ডের জলার বদ্ধ অঞ্চলে প্রচুর মশা হয়, মানুষকে মুখে নেট ঢেকে ঘুরতে হয় ৷
মশা নেই কেন আমাদের জানবার আগ্রহ হল না ৷ আমরা ম্যালেরিয়ার ভুক্তভোগী ৷ মশার কথা শুনে চকিত হয়েছিলাম ৷ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বললেন, না, না এ মশায় ম্যালেরিয়া হয় না ৷ কিঞ্চিৎ চুলকোয় এই যা ৷ এরা নিরীহ মশা ৷ কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তাঁরা আবার নামতে শুরু করলেন ৷ আজই যেন অন্য কোন পর্বতশিখরে ওঠবার জন্য ট্রেন ধরতে হবে ৷
এঁদের সঙ্গে ফিনল্যান্ড এবং সমগ্র স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভোজন-ধারার বিষয়ে কথা হয়েছিল ৷ বললেন, এ দেশের কাঁচা এবং শুঁটকি মাছের কোনও তুলনা হয় না ৷ তাঁর জিভে জল এসে গিয়েছিল ৷ সশব্দে টেনে নিয়ে বললেন, রাইন ডিয়ার স্টেক খেয়েছেন, ভালো ৷ কিন্তু এদেশের মাছের কাছে কোনও মাংসই দাঁড়াতে পারে না ৷
নারভিকে নির্বাধ মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কোনও কাজ ছিল না ৷ কোনও দ্রষ্টব্যে যাবার তাগিদও নেই ৷
ফেরার দিন হোটেলের মহিলা আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন, আবার আসবেন ৷ এবার আপনাদের জন্য আমাদের হনিমুন স্যুট রিজার্ভ থাকবে ৷
আমাদের বয়স শুনে তিনি বিশ্বাস করতে চাননি ৷ বললেন, যদি সত্যিই ওই বয়স হয় আপনাদের, হনিমুন স্যুট তো আপনাদেরই জন্য ৷
নরওয়ে সুইডেন ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড ঘুরে আমরা সাবেকি পোশাকে ল্যাপদের দেখা পাইনি বটে, কিন্তু এই ভ্রমণে সুখের সীমা ছিল না ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন