অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
বেসক্যাম্প রাহুং পর্যন্ত পর্যটন বিভাগের বাসে যাওয়ার কথা ৷ কিন্তু বেসক্যাম্পের পৌনে ১ কিলোমিটার আগেই রাস্তায় ধস ৷ নেমে পড়তে হল ৷ বনবাসের আগে সীতার অবস্থা অনুভব করতে পারছি ৷ আমাদের এই বনবাসযাত্রা অরুণাচলের পাহাড়ে-পাহাড়ে প্রায় অজ্ঞাত পথে ৷
যে যার রুকস্যাক পিঠে তুলে নিলাম ৷ বিদায় নিতে হবে দলের অন্যদের কাছ থেকে ৷ প্রায় ৫০ কিলোমিটার চড়াই-উতরাই নিজের পায়ে চরে খাওয়ার জন্য ৷ চরে খাওয়াই বটে ৷ ছয় ট্রেকারের সঙ্গে পাঁচদিন চার রাতের রেশন নিয়ে পাঁচ পোর্টার আর পথ জানা আপাতানি যুবক মিচি তাজো ৷ ‘ভ্রমণ’-এর এই অভিযাত্রী দলে আছে সর্বকনিষ্ঠা মহাশ্বেতা চক্রবর্তী, ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা শূন্য, ট্রেকিং-অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমি, সবচেয়ে বয়স্ক ৷ অভিজ্ঞতা? ‘ভ্রমণ’-এর জন্য ‘হিলারির পথে’ ট্রেকিং কাহিনীর অনুবাদ করেছিলাম মাত্র ৷ গতবছরও বিষ্ণুপুরের ছোট পাথরের চাঙর বাইতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে ক্ষান্তি দিয়েছিলাম ৷ বরাবর ট্রেকিং রসে বঞ্চিত ৷ এযাত্রায় না হলে বুঝতাম না লোকে কোন সাধে খামোকা শামুকের মতো বোঝা বয়ে পাহাড়ে চড়তে যায় ৷ কেন দিনের পর দিন অমূল্য সময় খরচ করে ৷ জানতাম না, পাহাড়ের যে আকর্ষণে আমরা ট্রেনে-প্লেনে-বাসে-ট্রেকারে বারবার ছুটে যাই, ছুটি কাটানোর ট্যুরিস্ট স্পট খুঁজে বেড়াই, তা পাহাড়লোকের বিস্ময়ের আভাসমাত্র ৷ ট্রেকাররা ছোটে তার গহন গভীরের টানে ৷ অভিযান ও আবিষ্কারের রোমাঞ্চে ভরা সে এক অন্য অনুভূতি ৷
ট্রেকিং শেষে বাসে করে ফেরার সময়েও সেই গতি আমার শরীরমন জুড়ে ৷ পাশে পাহাড় দেখলেই মনে মেটাল ডিটেক্টরের সাড়া-পায়ে সুড়সুড়ি-কোথায় আছে পথের চিহ্ন, যে পথ গেছে নগরসভ্যতার থেকে বহুদূরে বুনো ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্সের মতো ফুটে থাকা কোনও পাহাড়ি গ্রামে ৷ জীবনযাপনের অপরিসীম লড়াইয়ের মধ্যে আতিথেয়তায় ভরা সেই জনগোষ্ঠীর সান্নিধ্য এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা ৷ ৮-১০ কিলোমিটার বা আরও দূর-দূরান্তের পথে একেকটি দেবলোক দর্শন ৷ শুধুমাত্র পথের কষ্ট সহ্য করেই সে পুরস্কার পাওয়া সম্ভব ৷ পথের কষ্টও তো পথই ভোলায় তার রোমাঞ্চ ও ঐশ্বর্যে ৷ তাছাড়া পাহাড়ে চড়া তো নিজের ক্ষমতার পাহাড়েই চড়া-তাকে তিল-তিল অনুভূতিতে আবিষ্কার করা ৷ সেও এক নেশা ৷
ফেরার বাসযাত্রায় বিভোর ছিলাম পায়ে পায়ে পথভাঙার দিনগুলির স্মৃতিতে ৷ সেই পথকে বিদায় জানাতে পারিনি ৷ বরং পাহাড়ে-পাহাড়ে আমন্ত্রণ ৷ পুনরাগমনায় চ ৷ আবার আসব ৷ আসতেই হবে ৷
রাহুংয়ের ধসটুকু পেরিয়ে বেসক্যাম্প পর্যন্ত মিনিট পনেরোর সমতল রাস্তা ৷ তারপর রান্না খাওয়া সেরে মূল ট্রেকিং শুরু ৷ এবার নেমে যেতে হবে বাঁদিকের নালার মতো পথে ৷ ওটাকে এতক্ষণ মনে হয়েছিল স্থানীয়দের প্রাতঃকৃত্যের অলিগলি ৷ এই পথেই একশো মিটারের মতো নেমে আবার উঠতে হবে সামনের পাহাড়ে, ডানদিকে ৷ এ একটা কাজ বটে ৷ পরেও দেখেছি, যখনই কোনও পাহাড়ে উঠতে হবে, তার আগে আছে অনেকটা নেমে সেই পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছনো ৷ পা থেকে মাথায়, আকাশে-পাতালে, এপাশে-ওপাশে, এপিঠে-ওপিঠে ঘুরিয়ে পাহাড়ের এ এক খেলা বটে ৷
পথনালায় মলমূত্র নেই, তবে কাদা জোঁক জংলায় হুঁশিয়ার থাকতে হয় সর্বক্ষণ ৷ পিছলে যাওয়ার ভয়ে পা রাখছিলাম পথের দুধারের ঝোপজঙ্গলে ৷ পা ফাঁক করা কাঠের পুতুলের মতো থপথপ করে ৷ তাতে জংলার থেকে জোঁকে ধরার ভয় বেশি, বিশেষত এই বৃষ্টির পর ৷ আর কিছুদিন পরে অবশ্য জোঁক শীতঘুমের জন্য মাটির নিচে অদৃশ্য হবে ৷ এই জোঁক-জংলা-কাদাকে জয় করাও আমাদের ক্রমশ শিখে নিতে হয়েছে ৷ শুনেছি, এক জায়গায় প্রথমজনের পদক্ষেপে জোঁকের ভয় তেমন থাকে না, দ্বিতীয়জন একই জায়গায় পা রাখলে জোঁক তৎপর হয়, তৃতীয়জনকেই নাগালে পায় ৷ ফলে তৃতীয়জনকে বিশেষ সাবধান হতে হয় ৷ চোখ খোলা রেখে বা গা-হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে বা আগের জনের পায়ের ছাপ এড়িয়ে ৷ আগাগোড়া উইন্ডচিটার জাতীয় পোশাকে ঠিকমতো মোড়া থাকলে জোঁক সহজে শরীরের ছোঁয়া পায় না, তবে এরকম পোশাকে শিলেমূলে মোড়া থাকাও বেশ কষ্টকর-খুব শীতেও ট্রেকিংয়ের সময় দরদর করে ঘাম হয় ৷ পাহাড়ের চোরাগোপ্তা ঠান্ডার কথা জানা ছিল, কিন্তু ট্রেকিংয়ে ক্রমাগত ঘেমে আমরাও ক্রমশ পাহাড়িদের মতোই বেপরোয়া ও সহনশীল ৷ তবে কাণ্ডজ্ঞান হারাইনি, হাঁটার সময় উইন্ডচিটারের চেন খুলে ফেলতে যেমন বাধ্য হচ্ছি, তেমনই হাঁটা বন্ধ হওয়ামাত্র চেনও বন্ধ ৷ তাতে ঘাম গায়ে বসে না, বাইরের ঠান্ডাও লাগে না ৷ এই ব্যাপারটায় প্রথমদিকে অবশ্য আমার একটু মুশকিল হয়েছিল ৷ বেসক্যাম্পে পৌঁছনোর আগে বমডিলায় এক সেনা-অফিসার পরামর্শ দিয়েছিলেন, এরকম পাহাড়ি উচ্চতার দেশে বছরের এই সময়ে খাঁটি উলের মোটা সোয়েটারেও শানাবে না, লাগবে চামড়া বা ফারের গরম পোশাক বা কোট ৷ তাছাড়া গ্লাভস, উলের মোজা, মাফলার, টুপি ৷ ড্রয়ার তো চাই-ই ৷ ঠান্ডা জল একদম নয়-স্নান, পান এমনকী দাড়ি কামাতেও গরমজল অপরিহার্য ৷ না হলে, আমরা সমতলের লোক-নির্ঘাত নিউমোনিয়া! আমাদের দলপতি, ট্রেকিং পর্বের নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন ‘ভ্রমণ’-সম্পাদক নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নন ৷ অতএব, উইন্ডপ্রুফ কাম ওয়াটারপ্রুফের নিচে চাপাতে হল গেঞ্জি, ড্রয়ার, জামা, হাল্কা সোয়েটার, তার ওপর ভারি সোয়েটার, প্যান্ট, টুপি ৷ উইন্ডচিটারের নানা উপকার অবশ্যই পেয়েছি পুরো ট্রেকিং পর্বে, তার নিচে শুধু অন্তর্বাস পরেই চলেছি আরামে, রাতে ঘুমিয়েছি ওই পোশাকেই স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে, কিন্তু প্রথমদিনের কয়েকপ্রস্থ পোশাকে ঘেমেনেয়ে একাকার ৷ সারাটা পথ সেই সেনা-অফিসারের মুণ্ডপাত না করে পারিনি ৷ একে বৃষ্টি-কাদার চড়াই, চোখের ঘামের ফলে ঝাপসা চশমা খুলে রাখতে হয়েছে, জুতোর মধ্য কাদাজল আর ঘাম, ভেতরের জামাকাপড়ও জবজবে ৷ তায় সন্ধে ঘনিয়ে এল ৷ দেখতে দেখতে গাঢ় অন্ধকার ৷ পা আর চলতে চায় না ৷ কিছুটা হাঁটার পর বিশ্রামের প্রয়োজন ক্রমশ বেশি করে টের পাচ্ছি ৷ যেদিক থেকে আসছি সেদিকে ফিরে দু-পা ফাঁক করে দুই হাঁটুতে হাতের চেটো রেখে মাটির দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ স্থির বিশ্রাম ৷ তাতে মসৃণ শ্বাসপ্রশ্বাসের ফলে শরীরে অক্সিজেনের জোগান বাড়ে, আরাম লাগে ৷ আবার নতুন করে চলা যায় ৷ সেই নতুন করে চলার ক্ষমতাও ক্রমশ কমতে লাগল ৷ কিন্তু বেশিক্ষণ থেমে থাকলে কেউ সহজে জানতে পারবে না দলভ্রষ্টের কথা ৷ থাকতে হবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ৷ সে অভিজ্ঞতা বিকেলের দিকে হয়েছিল-প্রথম পৌনে একঘণ্টার মতো উতরাই-চড়াইয়ে হাঁটার পর ৷ তার আগে দলের সবাই রাহুংয়ের পাহাড়ি নদী দিগিন-এর সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম (ব্রিজের রেলিং দিয়ে জলের স্রোতের দিকে কিছুক্ষণ তাকালে মাথা ঘুরে যায়) ৷ পোর্টাররা আগে এসেছিল, আগেই রওনা দিল ৷ আমিও এবার তাদের পথ ধরলাম ৷ মিনিট কুড়ি এগিয়েই পথ দুমুখো ৷ বুঝতে পারলাম না কোথায় যাব ৷ শেষপর্যন্ত চড়াইয়েই যেতে হবে বলে আমিও ধরলাম ওপরের পথ ৷ কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছি, আগে-পিছে কারও সাড়া নেই ৷ তবে কি ভুল পথে এসেছি? আমি হারিয়ে গেলাম? আরও ওপরে ওঠার ভরসা পাই না ৷ নিচের অতটা পথ নেমে যাওয়াও সামর্থ্যের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নেওয়া ৷ কিন্তু নেমেও যদি দেখি কেউ নেই, অন্য পথে হতো অনেকদূর কোথাও এগিয়ে গেছে-তাহলে? একে-একে দলের সবার নাম ধরে ডাকলাম মুখের দুপাশে হাত দিয়ে, এদিকে ফিরে, ওদিকে ফিরে ৷ কোথাও কোনও সাড়া নেই ৷ বিদেশ-বিভুঁইয়ে সে এক অসহায়তা ৷ কেউ কি টের পাবে, আমি যে দলে নেই? ট্রেকিংয়ে কেউ এগিয়ে কেউ পিছিয়ে তো পড়েই-যার যেমন চলার সার্মথ্য বা গতি ৷ বারবার পিছনের লোকেদের খোঁজ নিতে হলেও চলে না-পেরে ওঠা কঠিন ৷ কে কাকে দেখবে? প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা বুঝি মানুষকেও নিষ্ঠুর করে তোলে ৷ অসহায়কে তাই লড়াই করতে হয় আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে ৷ হয় পথ থাকে, না হয় থাকে না ৷ পরে বুঝেছি, সমুদ্র যেমন কোনও কিছুকে নেয় না, সবই ফিরিয়ে দেয়, পাহাড়েও তেমনই পথ সহজে হারায় না, শেষপর্যন্ত এক জায়গাতেই পৌঁছে যায়-দিকজ্ঞান যদি ঠিক থাকে ৷
ঝুঁকি নিয়েই বেশ কিছুক্ষণ এক জায়গায় বসেছিলাম ৷ একসময় নিচের জঙ্গলের আড়ালে মানুষের কথাবার্তা ৷ তারা যে আমাদেরই লোকজন সে বিষয়েও প্রায় নিশ্চিত ৷ কারণ পথ দেখে মনে হয় না এখানে এরকম সময়ে লোকজন যাতায়াত করে ৷ একটু পরেই উঠে এল দলের পিছিয়ে পড়া লোকেরা ৷ তারা আমার হাঁক একটু-আধটু শুনেছিল, তবে তার মর্ম বুঝতে পারেনি ৷ ভেবেছে পাহাড়ের অন্য কারও আওয়াজ ৷ হায়! পরে পরীক্ষা করে দেখেছি, চিৎকার করে জানান দিলে আগের বা পিছনের দল কখনও তা ঠিকমতো শুনতে পায়, পাল্টা আওয়াজ দেয়, কখনও আবার আদৌ আওয়াজ দেয় না, ঠিক শুনতে না পেয়ে ৷ যদিও দূরত্ব মোটামুটি এক বা কমই ৷ আসলে পাহাড়ে তো ঘুরে-বেয়ে ওঠা ৷ তাই দলের লোকেদের প্রতি আর আওয়াজের গতি একমুখি বা অভিমুখি হলে তবেই শোনা যায়, ভিন্নমুখি হলে তা নাও হতে পারে ৷ যতই চেঁচাই ৷ এরপর আর দলছাড়া হইনি ৷ ক্রমশ মন্থর হয়ে আসা পায়ে বৃষ্টি-কাদা-অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে চলার কঠিন পরীক্ষা ৷ তিনঘণ্টার মধ্যেই শরীরটা বোঝা হয়ে উঠল ৷ সামনের যে যখন যেখানে বিশ্রামের জন্য দাঁড়ায়, সে সুযোগে নিজেও না দাঁড়িয়ে পারছি না ৷ প্রতি পদক্ষেপে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই ৷ পাষাণের মতো শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নেওয়া ৷ পিছিয়েও পড়েছিলাম ৷ আমাদের লাইটহাউস বরুণ ৷ সামনে-পিছনে টর্চের আলো দুলিয়ে পথ-বিপথ জানান দিচ্ছিল ৷ অন্ধকার হলেও এটা তো ঠিকই যে কখনও-কখনও পা একটু বেশি পাশের দিকে পড়লেই আর দেখতে হবে না ৷ পরিণাম কেউ বলতে পারে না ৷ আমাকে পিছন দিক থেকেও গার্ড দিয়ে চলল সঙ্গী অভিযাত্রী ৷ পাহাড়ি ছেলে হলেও ওর এটাই প্রথম ট্রেকিং ৷ আমাকে আগলাচ্ছিল বটে, যদিও আমার পা ফসকালে ওরও একই অবস্থা হবে ৷
সন্ধে ৭টা নাগাদ প্রায় সওয়া ৪ কিলোমিটার পেরিয়ে কিছুটা সমতল পথ ৷ ভুট্টার খেত বা এইরকম কিছুর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ৷ বৃষ্টিতে-অন্ধকারে ওসব খেয়াল করার মতো বোধশক্তি তখন এমনিতেই ছিল না ৷ শরীর-মন নির্বিকার ৷ হাত-পা যেন অন্যের ৷ ধৈর্য ভাঙছে ৷ মনে হল, পোর্টাররা আর যারা এগিয়ে গেছে যাক, আমরা গা এলাই, এখানেই রাত কাটাই, যা হয় হোক ৷ সঙ্গের মেয়েদের কথা ভেবে তবু চলতে হল ৷ মাতালের পায়ে ৷ ঘণ্টাখানেক পর হঠাৎ দূরে আলো ৷ তাহলে এসে গেছি? কিন্তু টর্চের আলো হাতে দেবদূতটির দেখা পেলাম আরও মিনিট-দশেক নবোদ্যমে চলার পর ৷ সে থেম্বাং গ্রামের এক কিশোর ৷ আমাদের আগের লোকেদের মুখে খবর পেয়ে গ্রামের মানুষগুলিই ব্যস্ত হয়ে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ৷ এইসব পথে এরা হরিণ ৷ ৫-৭ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া এদের কাছে নিশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ৷ আমরা কাদা, ঘোড়ার মল ও জঙ্গলের বিছুটির মধ্যে আরও আধ ঘণ্টার মতো নাস্তানাবুদ হয়ে গ্রামের মানুষদের মধ্যে পৌঁছলাম যেন এক উৎসবের রাতে ৷ রীতিমতো সাড়া পড়ে গেছে ৷ আমাদের দেখতে ও আলো ধরতেই যেন তারা হঠাৎ রাতে জেগে উঠেছে ৷ বাচ্চা, মেয়ে, বয়স্ক-সব বয়সের মানুষ ৷ অনেকেরই হাতে কাঠের আগুনের মশাল ৷ ইনস্পেকশন বাংলোয় পৌঁছলাম রাত সাড়ে আটটায় ৷ মোট ৭ কিলোমিটার পথ সাড়ে চার ঘণ্টায় ৷ আগের দল অবশ্য ঘণ্টাখানেক আগেই পৌঁছে রান্নাবাটি শুরু করে দিয়েছে ৷ ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে লেপের তলায় পা গরম করলাম ৷ আজকের পথ বড় কষ্টের ৷ বড় রুক্ষ ৷ বৃষ্টির জল ছাড়া কোনও জলরেখা দেখলাম না ৷
ভেবেছিলাম রাতে পায়ে আর পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা হবে ৷ সকালে দেখি শরীর বেশ ঝরঝরে ৷ একঘুমে সব মেরামত ৷ ঠিক করেছিলাম, ট্রেকিং আর জীবনে নয় ৷ কিন্তু এখন হার মানতে রাজি নই ৷ সাড়ে আটটায় আবার রওনা, হাল্কা জলখাবার খেয়ে ৷ কালকের ভিজে গেঞ্জি-মোজা-জামা পরেই ৷ সোয়েটার ইত্যাদির বোঝা পিঠের রুকস্যাকে ৷ ইতিমধ্যে দলে কিছু শৃঙ্খলা তৈরি করে নেওয়া হল ৷ যারা আগে থাকবে তারা চলার পথে রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে দেখলে চিহ্ন রেখে যাবে ৷ আর, পথ জানা লোক থাকবে পিছনের দলের সঙ্গে ৷ আজ উত্তরে ৯ কিলোমিটার রাস্তা ৷ সেমনাক যাব ৷ ইনস্পেকশন বাংলোর বাঁয়ে পঁচিশ-ত্রিশ গজ নেমে বাঁয়েই সোজা হাঁটা ৷ এই পথেই কাল এসেছিলাম পিছন থেকে ৷ থেম্বাংয়ের মানুষজনের পরিচয় রয়ে গেল রাতের সেই আলো-অন্ধকারেই যা কিছু ৷
পথ অনেকটা সমতল ৷ কোথাও অল্প চড়াই-উতরাই ৷ পৌনে একঘণ্টার মতো চলার পর শুরু হল জঙ্গলের মধ্যে ঘুরেফিরে কাদার বিড়ম্বনা ৷ আগের দিনের বর্ষার ফলে ৷ কোথাও অবস্থা এতই সঙ্গিন যে ঝরনার ধসে একহাঁটু কাদার মধ্যে পাথর ফেলে চলতে হচ্ছে ৷ হাত ধরাধরি করে পেরোতে হয়েছে ভাঙা রাস্তার খাদ ৷ এমনিতেই আজকের প্রায় অর্ধেক পথে কাদাটা একটু বেশি নরম ও গভীর ৷ এরই মধ্যে একসময় দ্বিতীয় দলের থেকে একটু এগিয়ে গেছি ৷ হঠাৎ সামনে বেড়া ৷ আর কোনও পথ নেই ৷ পথ একমাত্র ওই বেড়ার গেটের ওপরে দেখা যাচ্ছে ৷ অগত্যা ঢুকে গেলাম গেট খুলেই ৷ বন্ধ করবে পিছনের শেষ দলের লোকেরা ৷ এই পথেই গেছে আগের দলের লোকের পায়ের ছাপ ৷ নিশ্চিন্ত ৷ আরও প্রায় আধঘণ্টা চলার পর জলকাদার বুনো ভাব কাটল ৷ রাস্তাও অনেক সমতল ৷ সামনে পাংমা গ্রাম ৷ কাছাকাছি আরও দুটো গ্রাম-গুন্ধু, সামনাং ৷ তিন গ্রামের মাঝামাঝি চোখজুড়নো সমতল সবুজ প্রান্তর ৷ অরণ্যের ঘেরাটোপ থেকে কিছুক্ষণ খোলা আকাশের নিচে ৷ মন ভরে যায় ৷ বসে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতেই হয় ৷ বসলাম ৷ চারপাশে শাকসবজি-ভুট্টার খেত ৷ সামনে প্রায় আড়াইশো গজ দূরে নিচের জমিতে আদিবাসীদের কয়েকটা কুঁড়ে ৷ বাঁশ-কাঠ-বেড়ার ছাউনি ৷ একটির চালে উঠে একজন কী বিছোচ্ছিল আর কাকে কী বলছিল ৷ এখান থেকে শোনা যায় ৷ পাহাড়ি অ্যাকসেন্টে ভরা সে বাক্যালাপ আমাদের কানে বকাঝকার মতো ৷ দাজু (দাদা) বলে হেঁকে সেমনাকের পথ জানতে চাইলে সে আমাদের দিকে তাকাল, কিন্তু উত্তর দিল না ৷ বোধহয় হিন্দি বোঝে না ৷ বোধহয় সে ‘দাজু’ নয়, দিদি ৷
বাঁদিকের খেতের মধ্য দিয়ে গাঁয়ে ফিরছিলেন এক বৃদ্ধ, সঙ্গে তরুণী কন্যা নাকি ভার্যাই ৷ বৃদ্ধের বয়স সত্তরের ওপর ৷ চাষআবাদ করেন ৷ জানালেন, আমাদের আগের দলের লোকদের তিনি দেখেছেন ৷ সামনেই আমাদের রাস্তা ৷ উতরাইয়ের পথ ৷ তবে একটু বাঁপাশের রাস্তায় ঘুরে গেলে কষ্ট কম হবে, নাহলে আবার কষ্টের চড়াই ৷ রওনা দিলাম ৷ উতরাইয়ের শেষে ঝরনার ছোট সাঁকো পেরিয়ে আবার চড়াই ৷ হঠাৎ দূরে পিছনের দলের লোকেদের সাড়া পেলাম ঝোপের আড়াল থেকে ৷ জবাবে পথের জানান দিলাম ৷
অল্প কিছুটা চড়াই ভেঙে আবার সমতল ৷ আরও এগিয়ে একটা কাঠ-বাঁশের ছাউনি দেওয়া মাচা ৷ এরকম জায়গায় একটু বসে জিরনোর লোভ সামলানো যায় না ৷ জোঁকের উপদ্রব আজকের জঙ্গলের পথে ও এই মাচাতেও কম নয় ৷ জামাকাপড় ঝেড়েঝুড়ে নিলাম ৷ আবার রওনা ৷ পথে আবার উতরাই, ঝরনা, চার ঝরনার সঙ্গম, ছোট সাঁকো ৷ সারা পথে মাঝেমধ্যেই লোকালয়ের কাছাকাছি রয়েছে দুয়েকটি করে ‘মানি’-বৌদ্ধদের একরকম ধর্মীয় স্তম্ভ ৷ ছোট পাঁচিলের মতো ৷ পোর্টাররা তার ওপাশ দিয়ে ঘুরে যায়, গাঁথনির খাঁজে খাঁজে জমা গুল্ম উপড়ে ফেলে ৷ এটি এখানকার একটি পথকল্যাণ আচার ৷ আমাদের দ্বিতীয় দিনের যাত্রা শেষ হল এরকম পাশাপাশি তিনটি ও আরেকটু এগিয়ে আরও কয়েকটি মানির কাছে ৷ মোট ৯ কিলোমিটার পেরোতে আজ আমার সময় লাগল প্রায় চারঘণ্টা ৷ আজও প্রথম দল পৌঁছেছে একঘণ্টা আগে ৷
গাঁওবুড়ার সম্মতিতে থাকার ব্যবস্থা হল পাশের গুম্ভায়, রান্নার জন্য এক গ্রামবাসীর হেঁসেল একটু নিচে ৷ গুম্ভায় রান্না খাওয়া নিষেধ ৷ রাতে খাওয়া-থাকার এই ব্যবস্থায় অসুবিধা হতে পারে ভেবে পঁচিশ-ত্রিশ মিটার ওপরে সেমনাক প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাইকে ধরা হল ৷ স্কুলে পুজোর ছুটি, অতএব থাকার জায়গা দিতে তাঁর আপত্তি নেই, বরং অতিথিসঙ্গ পেতে তিনি আগ্রহীই ৷ রান্নার জন্যও তাঁর হেঁসেলই ব্যবহার করা যেতে পারে ৷ স্কুলই তাঁর ঘরবাড়ি ৷ সেমনাকে ভোটার সংখ্যা ৫২ ৷ ভোটের সময় বাবুরা এসে দানখয়রাতি করেন ৷ এই প্রাইমারি স্কুলের একই ঘরে চার ক্লাস ৷ কাছাকাছি একটি সেকেন্ডারি স্কুল আছে ৭৫ সাল থেকে, সে স্কুলের কেউ আজ পর্যন্ত সেকেন্ডারি পাশ করেনি ৷ এসব স্কুলে মাস্টারমশাইদের নিয়োগ হয় সারা দেশ থেকে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ৷ প্রায় নির্বাসিত জীবন ৷ কাটাতে হয় অনেকটা আদিবাসীদের মতোই ৷ অত্যাবশ্যকের বাইরে কিছু জোটানো বিলাসিতার স্বপ্নমাত্র ৷ কিছু কিনতে হলে হাঁটতে হবে পনেরো-বিশ কিলোমিটার রাস্তা ৷ মুনা ক্যাম্পের বাজারে ৷ চাল-ডাল-আটাও কিনে আনতে হয় সেখান থেকে, মাসে একবার বা দুবার ৷ সওদা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দোকানিই পাঠিয়ে দেয় ৷ ঘোড়া ভাড়া অন্তত একশো টাকা ৷ এখানকার আদিবাসীদের প্রধান খাদ্য ভুট্টা-মকাই ৷ ভাতও খায় ৷ শস্য, আটা এমনকী স্থানীয় বিয়ার ‘ছাং’ বা ‘রকসি’ ওই মকাই থেকেই ৷ মেয়েরা মকাই আনে দূরের জঙ্গলে গিয়ে ৷ তাদের ফেরার পথে পিঠের টোকরায় তাজা মকাইয়ের ছড়ায় কাঁচা সোনার রং ভারি লোভনীয় দেখায় ৷ টোকরা পিঠে ফুটফুটে মেয়েদের সারিই এক নিসর্গ দৃশ্য ৷ এখানকার জীবনযাত্রায় এই পাহাড়-কন্যাদের দেখলে বোঝা যায় অর্জুন বা অন্যান্য রাজাবাদশারা কেন এখানে-ওখানে গেলে দুয়েকটা বিয়ে করে বসতেন ৷
গ্রামের মানুষের সবই নিজেদের ব্যবহারের জন্য ৷ অরুণাচলের সব গ্রামেই ৷ মকাই, সবজি, ডিম, মুরগি-যেখানে যা পাওয়া যায় কেউ বিক্রি করতে রাজি নয় ৷ ঘরের অতিথিকে অবশ্য এরা আপ্যায়ন করে অকৃপণভাবে ৷ কিন্তু পয়সার বিনিময়ে বা ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য একদম নয় ৷ তবে রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ কেউ কেউ বিক্রি করে ৷ এখানকার মানুষদের প্রধান স্টোর সম্ভবত ওই কাঠই ৷ রোদজলের মধ্যে থাকে-থাকে উঁচু করে সাজানো ৷ সেমনাকে আমাদের রান্নার জন্য কাঠ কিনতে সাহায্য করেছিল ১৭-১৮ বছরের একটি ছেলে শামসিং ৷ ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইয়ের প্রজেক্টে কাজ করে, মাইনে ৬৬০ টাকা ৷ অরুণাচলের পোর্টারদেরও সরকার ওই মাইনে দেন ৷ ট্রেকার-পর্যটকদের প্রয়োজনে এইসব পোর্টার বরাদ্দ করেন ডেপুটি কমিশনার ৷ ভাড়ার মূল্য পোর্টারপ্রতি দিনে একশো টাকা ৷ শামসিং পরে লাগাম পর্যন্ত আমাদের পথপ্রদর্শক হয়েছিল ৷
সেমনাকে কুয়াশা জমতে থাকল বেলা চারটে থেকেই ৷ পাঁচটার মধ্যে নিচের গুম্ভা, তার নিচে গ্রাম, সামনের পাহাড়ের সারি-সব অদৃশ্য ৷ কুয়াশা পরে আবার কমছে ৷ আমাদের দলের অনেকেই সন্ধে পর্যন্ত নিচের গ্রামে কাটিয়েছে ৷ মাস্টারমশাই বলেছিলেন, আমরা চাইলে গাঁওবুড়া আদিবাসী নাচের ব্যবস্থা করে দেবেন ৷ তারজন্য অবশ্য পয়সা খরচ হতে পারে ৷ এরকম জায়গায় এই সন্ধ্যায় আদিবাসী নাচ ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে ৷ শেষপর্যন্ত অবশ্য গাঁওবুড়ার কাছে অনুরোধটা জানানো হয়নি ৷
সকালে রোদ ৷ এতদিনে এই প্রথম ৷ ভিজে জামাকাপড় শুকিয়ে নেবার জন্য মেলে দিলাম ৷ কিন্তু সময় কই? কাল বিকেলেও শুকোতে দিয়েছিলাম ৷ তাতে যত না শুকিয়েছে তার চেয়ে বেশি ভিজেছে কুয়াশায় ৷ জুতোজোড়া রাতে উনুনের পাশে দিয়েছিলাম ৷ এই সুযোগগুলো কুড়িয়ে নেওয়া দরকার ৷
রওনা হলাম আটটায় ৷ আধঘণ্টার মতো উতরাই ভেঙে আবার চড়াই ৷ বাঁপাশের পাহাড়ের কোলে-কোলে এগিয়ে বাঁদিকে চলে গেলাম ওই পাহাড় ও সামনের সংযোগপথে ৷ জোঁকের কামড় আমরা প্রায় সকলেই খেয়েছি সেমনাকে আসার পথে ৷ এবার তাই জুতো-মোজায় আচ্ছা করে সবাই নুন মেখে নিলাম, নুনগোলা জলে জুতো ধুয়ে ৷ উইন্ডচিটারের পা তো মোজার মধ্যে ঢোকানো ছিলই, গেঞ্জিও ভালো করে প্যান্টের মধ্যে গুঁজে জামার চেন টেনে দিলাম ৷ জোঁক ঢোকার পথ গলা পর্যন্তই বন্ধ ৷ সেমনাকে আমায় জোঁকে ধরেছিল পুরো প্যান্ট-জামা বেয়ে গেঞ্জির গলা দিয়ে ঢুকে ৷ সরু জোঁক নাভির কাছে কামড়ে লেগে ছিল ৷ নধরকান্তি বীভৎস দৃশ্য ৷ ছাড়িয়ে দেওয়ার পরেও টপটপ করে রক্ত পড়ে বহুক্ষণ ৷ এই জোঁকের রাজ্যেও এখানকার মেয়েরা জঙ্গলে যায় হাওয়াই বা সস্তা চপ্পল পরে বা খালি পায়েই ৷ ছেলেদের পায়ে সাধারণত গামবুট জাতীয় জুতো থাকে ৷ মেয়েদের জন্য যত্নআত্তি এখানেও কম ৷ পুরুষদের রোজগার সাধারণত দিনমজুরির কাজে ৷
আজকের পথ সবচেয়ে বেশি খাড়াই হবে বলে শুনেছিলাম ৷ ১০ কিলোমিটার পথ, উঠতে হবে আরও দুহাজার ফুট উঁচুতে, মোট ৮,৯০০ ফুট উচ্চতায় ৷ উত্তরদিকে ৷ সবাই একসঙ্গেই রওনা দিয়েছিলাম, ক্রমশ দল কয়েক টুকরো হয়ে গেল গতির বেশি-কমে ৷ আমি হয়ে পড়লাম একা দ্বিতীয় দল ৷ পিছনের লোকদের জন্য রেখে যাচ্ছি পায়ের ছাপ, যদিও বেশিরভাগ পথই শুকনো ৷ পা পিছলনোর ভয় কম, তবে জোঁকের ভয় আছে ৷ তাছাড়া খাড়াই পথে উঠতে কষ্ট ও সময় বেশি লাগলেও ওঠা যায় কম সতর্ক হয়ে ৷ পাহাড়ের এই এক মজা ৷ খুব খাড়াই পথেও ওঠার সময়ে প্রতি পদক্ষেপকে সে বুক পেতে আগলাবে, কিন্তু নামার পথে একটু অসাবধান হলেই পদস্খলনের ভয় ৷
আজ প্রথম দেড়ঘণ্টায় একদম থামিনি বলা যায় ৷ কিন্তু ফুসফুস ক্রমশ হাপর হয়ে উঠছে ৷ ফেটে না যায় ৷ গলা শুকিয়ে কাঠ ৷ সঙ্গে ঠান্ডা সরবৎ আছে, কিন্তু এত গলদঘর্ম অবস্থায় খেতে সাহস হল না ৷ লজেন্স-চিউইংগাম ছিল, মুখে পুরে দিলাম ৷ লজেন্সের মোড়ক অবশ্য পকেটেই রেখে দিলাম, কারণ পর্যটনপথে এসব ফেলা উচিত নয় ৷ প্রকৃতির বুকে দূষণ এড়ানোর জন্য ৷ প্লাস্টিক, রাংতা ইত্যাদি যেহেতু আগুন ছাড়া আর কিছুতেই নষ্ট হয় না, এসব পুড়িয়ে ফেলাই শ্রেয় ৷
ইতিমধ্যে স্লো বাট স্টেডির একটা কৌশল আমি ছকে নিয়েছি ৷ ক্লান্তির শাসনে আর বিশ্রাম নয়, এখন বিশ্রাম নেব নিজের পরিকল্পনার মতো ৷ খাড়াই পথে গড়ে ৮৫-৯০ ফুট চলার পর আধমিনিট বিশ্রাম অর্থাৎ উল্টোমুখে হাঁটুতে ঝুঁকে শ্বাসপ্রশ্বাস ৷ তারপর আবার হাঁটা ৷ সমতল পেলে সেটুকু পথও বিশ্রামের মতো কাজে লাগানো যায়, পিঠ সোজা করে আরামসে হেঁটে ৷ সময়ের ঝুঁটিও তো এভাবেই ধরা যায় পরিকল্পনা করে ৷ পথ তো সময়েরই একটা রূপ ৷
আজ ঘুরপ্যাঁচ একটু বেশি ৷ কয়েক জায়গায় লুপওয়ের মতো ৷ একজায়গায় অর্ধগুহা ৷ আশপাশে এমন দুয়েকটা পথও বেরিয়ে গেছে আগের দিনগুলিতেও দেখেছি, যাতে শুধু ঘোড়ার খুরের ছাপ ৷ স্থানীয়দের কাছে জেনেছি, ঘোড়ারা ওই পথে চরতে যায় ৷ মানুষের গন্তব্যে ওপথে যাওয়া যাবে না, চলাও কষ্টকর ও বিপজ্জনক ৷ পথে একটা মিথুন ৷ ঝোপের মধ্যে ৷ লাজুক জীব, দাঁড়িয়েছিল একটু আড়ালে ৷ একটা কুকুরও হঠাৎ কোথা থেকে এল, আমায় দেখে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল ৷ আর, এক জায়গায় দেখেছিলাম একপাল হিং-দাড়িওলা ছাগল ৷ হাতে লাঠি নিলাম, তারা পালিয়ে বাঁচল ৷
প্রায় আড়াইঘণ্টা চলার পর একটু ফাঁকা মাঠের মতো ৷ তারপর বিশেষ পথচিহ্ন দেখা যায় না ৷ এখানে বসতে হল ৷ কারণ রুকস্যাকের পিঠের বেল্ট ছিঁড়ে গেছে ৷ সঙ্গে দড়ি নেই, সুঁচসুতো নেই, এই বোঝা এবার কী করে বইব? অনেক চেষ্টাচরিত্রে সমস্যার সামাল দেওয়া গেল, বেল্টকে ঢাকনার নিচে দিয়ে গলিয়ে ৷ তারপর সামনে উঁচুতে পথ ঠাউরে হাঁটা দিলাম ঝোপের মধ্যে ৷ অর্থাৎ ঝোপে-ঝোপে চড়াই অব্যাহত ৷ ঘুরেফিরে উঠছি আর ফেলে আসা ফাঁকা জায়গাটায় চোখ রাখছি ৷ পিছনের দলের কেউ যদি ওখানে আমার মতো ধাঁধায় পড়ে ৷ একসময় দূর থেকে রূপজ্যোতিকে দেখে হাত নাড়লাম ৷
আরও ঘণ্টাখানেক পাকদণ্ডীর পর মানুষের অস্তিত্ব টের পেলাম ৷ কোথা থেকে একটা নিয়মিত আঘাতের আওয়াজ আসছে ৷ আলাদা করে শব্দ অনুসরণ করতে হল না, পথই নিয়ে গেল সেদিকে ৷ পঁচিশ-ত্রিশ ফুট ওপরে একজন কাঠ কাটছে ৷ এরকম ধরাশায়ী মড়া গাছ এযাত্রায় বেশ কয়েক জায়গায় দেখেছি ৷ সন্দেহ হল, বিষ দিয়ে মারা হয়েছে ৷ গোড়ার দিকে খানিকটা ছাল চৌকো করে তুলে নিয়ে সেখানেই ঢালা হয়েছিল মারণবস্তু ৷ এই কাঠুরে অবশ্য জ্বালানির কাঠ কাটছিল ৷ জিজ্ঞাসা করলাম লাগাম কোথায়, কতদূর ৷ ও যা বলল, বুঝলাম এসে গেছি ৷ লাগামের আস্তানায় পৌঁছলাম আধঘণ্টার মধ্যেই ৷ মোট চারঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার ৷ পর্বতারোহী ওনিয়ম, সেমনাকের শামসিং আর দুই পোর্টার মিলে প্রথম দল পৌঁছেছে একঘণ্টা আগে ৷ এটি সেমনাকের মতোই পাহাড়ে ঘেরা গ্রাম, তবে লম্বায় অনেক বড় ৷ আমরা উঠলাম একেবারে শেষপ্রান্তে ৷ এখান থেকে ডানদিকে মুখ করে হাঁক পাড়লে দূরের অন্য পাহাড় থেকে মৃদু প্রতিধ্বনি ফিরে আসি ৷
আশ্রয়দাত্রী বৃদ্ধা ৷ মুখে বয়সের আঁকিবুঁকি, কিন্তু ঋজু শরীর, চলাফেরায় সমান ক্ষিপ্রতা ৷ আদিবাসী-আভিজাত্যের ছাপ আছে ৷ শীতবস্ত্র কোমরে বেল্ট দিয়ে বাঁধা, নিচে মেখলা ৷ অলঙ্কারও দর্শনীয় ৷ সুপুরির মতো মোটা রঙিন পুতির মালা মাথার দুপাশ থেকে নেমে এসেছে কোমরের বেল্ট পর্যন্ত ৷ মাথায় তা আটকানো ছোট পুতির মালায়, গলায়ও ওরকম ছোট পুতির কয়েকছড়া মালা ৷ পায়ে গামবুটের মতো জুতো ৷ ফটো তুলতে দিতে চান না, তুললে বকশিস চান সলজ্জ ঠাট্টার ভঙ্গিতে ৷ হিন্দি বলতে পারেন না ৷ সিগারেট দেখে চাইলেন, পরে ঘরের মধ্যে জ্বলন্ত উনুনে ধরিয়ে সুখটান ৷ ট্রেকিংয়ের শুরু থেকেই দেখছি, এই উনুন ব্যাপারটা অনেকটা প্রতীক হয়ে উঠেছে ৷ রুম হিটারের মতো জ্বলে চলেছে, ঘর ধোঁয়ায় ভরা, তারই মধ্যে সংসারযাত্রা ৷ শহরজীবনে হলে দুদিনেই ফুসফুসের রোগ অবধারিত ৷ রাহুংয়ে দেখেছি, সেমনাকে দেখেছি, পরে ছান্দেরেও-অতিথি-আগন্তুকের জন্যও উনুন অবারিত ৷ সেখানেই আমরা রান্নাবাটি সারছি, ব্যবহার করছি তাঁদের রান্নার তৈজসপত্র, পুরো দলের লোক সেই ঘরের মধ্যে বসছি, খাওয়া-দাওয়া সারছি, গৃহকর্ত্রী হয়তো সেই ধোঁয়ার মধ্যেই নির্বিকারচিত্তে বসে বা শুয়ে দিনাতিপাত করছেন ৷ খাটপালঙ্ক বা কোনও আসবাব নেই ৷ কাঠ-বাঁশের তৈরি আস্তানায় নিরুপকরণ জীবনযাত্রার সে চেহারা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ৷ এত দারিদ্রের মধ্যেও এইসব উপকারের বিনিময়ে এঁরা কোনও মূল্য দাবি করেন না ৷ এঁরা বিশ্বাসী, পরিশ্রমী, প্রাণোচ্ছল, সাহায্যে তৎপর ও অকপট ৷ এই দেবদুর্লভ গুণের সরল মানুষগুলিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য হাজারও ট্রেকিংয়ের কষ্টও সার্থক ৷ এঁদের মুখে হাসির আলোও কি কোনওদিন ভুলব ৷ পৃথিবীর মধ্যেই এ এক গ্রহান্তর ৷ জামাকাপড়, জুতো, টিনের কৌটো-এসব কিছু-কিছু জিনিস ব্যবহার করলেও সভ্য জগতের থেকে এঁরা বহু যোজন দূরে ৷ হ্যাঁ, এঁদের ছেলেপুলেরাও লেখাপড়া শিখছে, এই গ্রামেও স্কুল চালু হয়েছে পাঁচবছর হল, কিন্তু পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক ওই স্কুলেই যা কিছু ৷ বৃদ্ধার এক ছেলে চুন্ডু, আর আছে একটা ঘোড়া ৷ ছেলে মিতভাষী, পড়াশোনা করেনি ৷ গুম্ভার দেখভাল করে, সকালে সন্ধ্যায় আলো-জল-বাতি দিয়ে আরাধনা ৷ এখানকার লাগোয়া গুম্ভায়, আরও কয়েকটি গ্রামের গুম্ভায় এই কাজ ৷ বদলে রেশন পায় গাঁওবুড়াদের থেকে ৷ এখানকার গাঁওবুড়িকে বলে সে লাগোয়া গুম্ভায় আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ৷ গুম্ভার দায়িত্বে আছে বলে চুন্ডু বিয়ে করেনি, করতে পারবেও না ৷ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, যদিও প্যান্ট-শার্ট-জুতো পরে ৷ গুম্ভায় রাত্রিবাস অবশ্য সুখের হয়নি, তার ব্যবস্থাপত্র হতেও সারাটা দিন কেটেছে বাইরে, বৃদ্ধার উঠোনে ৷
পরদিন সকালে এযাত্রার প্রথম ন্যাচারাল টয়লেট ৷ জোঁকে-কাদায় ভরা জঙ্গলের মধ্যে ৷ জোঁকই এখানকার ছারপোকা-বিছে-পাখির ইয়ে ৷ এতসব আতঙ্ক ও অস্বস্তির মধ্যেও প্রকৃতির ডাক বড় ডাক ৷
লাগামে লালরঙের মাশরুম খেলাম তরকারি করে ৷ দলের লোকেরাই জঙ্গল থেকে তুলে এনেছে ৷ অনেকটা আচারের স্বাদ ৷
এবার উত্তর-পশ্চিমে ছান্দের যাত্রা ৷ রওনা দিলাম সকাল আটটায় ৷ প্রথম একশো মিটার চড়াই, তারপর দশ কিলোমিটার প্রায় আগাগোড়া সমতল রাস্তা ৷ কিছুটা চওড়াও ৷ উঠে মনে পড়ল আগের দিনের রাত্রিবাসের সমস্যা ও তার জন্য অহেতুক সারাটা দিন নষ্ট হওয়ার কথা ৷ অথচ এই প্রশস্ত রাস্তার পাশে চমৎকার তাঁবু খাটানো যেত, চোখের সামনেই ঝরনা, ফলে সকালের কাজকর্ম থেকে শুরু করে আরও বহু সমস্যারও সহজ সমাধান হত ৷ এই জায়গা থেকে খাড়া ওপরে উঠলে অজেয় গোরিচেন শৃঙ্গের বেসক্যাম্প দূর থেকে দেখে আসা যায় ৷ সময়াভাবে সেপথে যাওয়া হল না ৷ আমরা ছান্দের যাওয়ার সিধে রাস্তা ধরলাম ৷ এরাস্তায় গাড়িও যেতে পারে, যদিও গাড়ি চলার কোনও চিহ্ন কোথাও দেখলাম না ৷ মাঝেমধ্যেই দেখেছি রাস্তার সংস্কার চলছে, মোটরেবল করার জন্য ৷ প্রথমদিকে মিনিটদুয়েক পরপরই ঝরনা ৷ আর দেখবার মতো মাঝেমধ্যে রকমারি কাটা পাহাড়ের বিশাল ভঙ্গিমা ও রং ৷ এভাবে পাহাড় কেটেই রাস্তা বানানো হয়েছে ৷ এক জায়গায় মস্ত গাছ আমূল উপড়ে পড়ে আছে পথের বাধা হয়ে ৷ রাস্তার বিদ্যুতের তার জড়িয়ে ছিঁড়ে গেছে ৷ দুয়েক জায়গায় ছোটখাটো ধসও দেখা গেল-ওপর থেকে বহু নিচে পর্যন্ত নেমে গেছে ৷ দু জায়গায় রাস্তা মেরামতি ও নর্দমা পরিষ্কারের কাজ চলছে ৷ পুরুষ-মহিলা মজুররা মিলে ৷ এই সমতল রাস্তায় চলার কষ্ট কম, কিন্তু পথ দীর্ঘ ৷ ছোট্ট মাঠের মতো এক জায়গায় পৌঁছে পথ খুঁজে নিতে হল ডাইনে দশ-পনেরো ফুট নেমে ৷ ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছি চমরি গাইয়ের মুলুকে ৷ কয়েক পাল চমরি চরতে দেখা গেছে এখানে-ওখানে ৷ দেখেছি ভেড়া চরানোও ৷ আড়াই ঘণ্টা মতো পার হয়ে এসে বিরল দৃশ্য ৷ বরফে ঢাকা কাংটো শৃঙ্গ ৷ ডানদিকের পাহাড়শ্রেণীর পিছনে ৷ আমাদের সামনে নিচে ছোট গ্রাম ৷ চমরি চরছে রাস্তার পাশেই ৷ ওই রাস্তার দিনমজুররা ছাড়া এরপর আর জনমনুষ্যের দেখা মেলেনি ৷ সর্পিল নিশ্চিত পথে আবার আমি একা ৷ ঘণ্টাখানেক পর সামনে বাঁপাশের রাস্তা থেকে কারা হেঁকে ইশারা করছে ৷ সেখানে যাওয়ার নির্দেশ ৷ একটু পরে চিনতে পারি, ওরা আমাদেরই পোর্টাররা ৷ আমার থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েও ওরা আগে পৌঁছে গেছে অন্য শর্টকাট রাস্তায় ৷ আমিও সামনের পথটুকু শর্টকাট করলাম বাঁদিকে সামান্য চড়াইয়ের জমির মধ্য দিয়ে ৷ এটিই ছান্দের ৷ থুংরি মালভূমির লাগোয়া একটি গ্রাম ৷ উচ্চতায় ‘পৃথিবীর ছাদ’ পামির মালভূমির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ হলেও এটিও হাজারদশেক ফুট উঁচুতে পাহাড়ের একটি ছাদ ৷ অতএব অবাধ কুলকুল হাওয়া, ঠান্ডা ৷ সামনে অনেক নিচে সরু রুপোলি রেখার লাগোয়া একফালি সবুজ ৷ পরদিন ওখানে পৌঁছতে আমার সময় লেগেছিল পাক্কা সাড়ে পাঁচঘণ্টা ৷ ওটিই আমাদের ট্রেকিংয়ের সমাপ্তিস্থল-সাংতি ৷
ছান্দেরে রাস্তার বাঁদিকে মিনিট-দশেক এগোলেই গাঁওবুড়ার বাড়ি ৷ কাঠ-পাথর বাঁধানো পাকা দোতলা ৷ হেঁসেল আলাদা ৷ বেশ অবস্থাপন্ন ৷ ছেলের মোটর সাইকেল আছে ৷ সে শহরে কাঠের কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা করে ৷ এ অঞ্চলে আগে টেলিফোনের ডোমেস্টিক লাইন ছিল, কেটে নেওয়া হয়েছে চিনা আক্রমণের সময় থেকে ৷
একটা লোভ হয়েছিল আজকের পথের শুরু থেকেই ৷ চমরির দুধ খাব ৷ গাঁওবুড়ার সুন্দরী পুত্রবধূর কাছে জানতে চাইলাম আশপাশে কেউ দুধ বেচে কিনা ৷ বলল, কেউ বেচে না ৷ বাড়তি দুধ দিয়ে মাখন, চিজ তৈরি করে ৷ চমরির চামড়ার আধারে জমিয়ে ৷ আমার মনোবাসনা জানতে পেরে ঘর থেকে এককাপ দুধ এনে দিল ৷ অপূর্ব স্বাদ ৷ ঘরেপাতা দই একটু নষ্ট হলে যেমন লাগে, গন্ধ অনেকটা সেইরকম ৷ চিজও খেয়েছি ৷ কিনতে পেলে কিছুটা নিয়ে যেতাম ৷ এখানে একটা মুরগিও কেউ বিক্রি করে না ৷ ঘরে ঘরে চেষ্টা করেও একটা কিনতে পাইনি আমরা ৷ আসলে এসব জায়গায় মানুষের ভরণপোষণ তো এই পশুপাখি শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলের ওপর নির্ভর করেই ৷ স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাত্রা ৷ কিছু কিনতে হলে ছুটতে হবে সেই মুন্না ক্যাম্পে ৷
কথা ছিল, এখান থেকে তিন হাজার ফুট নিচে নাম-সু গ্রামের পথ ধরব খাওয়াদাওয়ার পর ৷ রান্নাবান্নার আয়োজনও তাই শুরু হয়েছে গাঁওবুড়ার হেঁসেলেই ৷ কিন্তু প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের ছাদের ওপর বিকেল ও রাত কাটানোর মায়া ত্যাগ করা অসম্ভব ৷ কলকাতায় আজ ষষ্ঠীর দুর্গাপুজো ৷ নাম-সু যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হল ৷ এখানে একটাই বড় সমস্যা, খাবার জল আনতে হয় প্রায় আধ কিলোমিটার দূর থেকে ৷ তা, জলবাহক হতেও আমরা রাজি, যত দূরই হোক ৷ থাকার ব্যবস্থা করে দিল গাঁওবুড়ার ছেলে, এখানকার স্কুলবাড়িতে ৷ সামনে বেড়াঘেরা বিরাট মাঠ-চমরি-ছাগল-মুরগির চারণভূমি ৷ এমন স্থান-কাল-পরিবেশ, অতএব সন্ধেয় মজলিস বসতে বাধ্য ৷ পাহাড়ের ছাদে বাংলা, হিন্দি, নেপালি, অসমিয়া ও মণিপুরী গানে, আবৃত্তিতে এক বিরল সমারোহ ৷ সঙ্গে স্থানীয় ছাং, দুরমের-একটিতে চমরির মাখন ও মশলা মেশানো, অন্যটিতে অন্য মশলা ৷
এখানে গ্যাসলাইটার সহজে জ্বলে না, বাতাসে অক্সিজেন কম বলে ৷ বিকেল আড়াইটে-তিনটে থেকে কুয়াশা জমছিল ৷ নিশ্বাসে মেঘ বুকে নিচ্ছি ৷ হু হু হাওয়ায় এই প্রথম উদ্যোগ করে গরম পোশাক পরতে হল ৷ স্কুলের চত্বরে তখনও কয়েকটি চমরি, ঘোড়া আর পাহাড়ি কুকুর ৷ আমাদের শহরে মানুষের কাছে মহার্ঘ এইসব স্ট্রিট ডগ ৷ স্কুলবাড়ি দখল হওয়ায় এরা আজ বাস্তুহারা ৷ রাত আড়াইটেয় উঠেও চমরিগুলোকে ফোঁস ফোঁস করতে দেখেছি, একটা কুকুর ঠান্ডায় চিৎকার করছিল ৷
ভোরে আবার প্রাকৃতিক প্রাতঃকৃত্য ৷ তারপর চা-পর্ব সেরে হঠাৎ স্কুলবাড়ির পিছনে আকাশজুড়ে গোরিচেন-কাংটোর হীরের মুকুট ৷ আরও পরিষ্কার ও পুরোপুরি দেখার জন্য ক্যামেরা নিয়ে উঁচু জমির দিকে ছুটতেই হল ৷ বাঁয়ে কাংটো, ডাইনে গোরিচেন হাত ধরাধরি করে ৷ দুচোখ ভরে দেখা গেল অনেকক্ষণ ৷ তারপর মেঘের স্বর্গজয় ৷ আমাদের সামনের মাঠে ভেড়ার পাল ৷ পথের পাশে গ্রামবাসী চমরির দুধ দোয়াচ্ছে ৷ কামধেনুর ফল্গুধারা ৷ দুধের স্বাদ মেটানোর অধিক সে দৃশ্য ৷
এবার স্বর্গ থেকে অবতরণ ৷ সত্যিই তাই ৷ স্বপ্নের ছান্দের ছেড়ে চলে আসতে মনের কষ্টকে ছাপিয়ে গেছে পথের কষ্ট ৷ পথ যতটা সুখের মনে হয়েছিল, আদৌ তা নয় ৷ নেমে যাওয়ার একটু পরেই ছান্দেরও চোখের আড়ালে ৷ সবই যেন মায়া ৷ সাধনমার্গ বুঝি এরকমই হয় ৷
রওনা দিয়েছিলাম সকাল সাড়ে আটটায় ৷ গন্তব্য তো ঘুরেফিরে চোখেই দেখা যাচ্ছে-নিচে ছোট্ট সবুজের দ্বীপ ৷ এখান থেকে মনে হয় কোনও পার্ক বা ছোট চাষির একফালি ধানখেত ৷ তার মাপ যে কত বড়, পাশের রুপোলি রেখাটা যে একটা প্রমাণসই নদী তা ক্রমশ উদ্ভাসিত হল সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার উতরাইয়ের পথে ৷ কখনও জঙ্গলের আড়ালে, কখনও ঘুরপথে তার লুকোচুরি মরীচিকার মতো ৷ মরীচিকাই বটে ৷ চেনা-অচেনা গাছের এই অরণ্য, সবুজ প্রান্তর ও পাহাড়ের রাজ্যেও ক্লান্তি জাগছিল ৷ দুটো কারণে ৷ এক, প্রায় শুকনো ঢালু পথে চোরা কাদার প্রবঞ্চক স্তর-খাঁজ খুঁজে-খুঁজে এগোতে হয় অবিশ্বাসী পায়ে, না হলে পদস্খলন অবধারিত ৷ দুই, সঙ্গীরা অনেকটা এগিয়ে-পিছিয়ে পড়ায় দুবার পথভুলে সময় ও শক্তিক্ষয় হয়েছে যথেষ্ট-একবার ভুট্টাখেত-সবজিখেত পেরিয়ে বাঁদিকের বদলে ডানদিকে পনেরো মিনিট নেমে গিয়ে, পরেরবার খালিবোক গ্রাম ছাড়িয়ে আরেকটা ছোট গ্রামের এপথ-ওপথ-সেপথে ঘোরাঘুরি করে ৷ অতিবৃদ্ধ এক গ্রামবাসীকে পথ জিজ্ঞাসা করে লাভ হল না-হয় তিনি হিন্দি বোঝেন না, নয়তো কানে কম শোনেন ৷
সব মিলিয়ে আজ পাহাড় থেকে নেমে যাওয়ার পথই যাকে বলে সবসে খতরনাক সবচেয়ে ডিস্টার্বিং মনে হল ৷ অবশ্য এখানে-ওখানে ডাইনে-বাঁয়ে পথের সামান্য আভাস পেলেই হুটহাট শর্টকাটে নেমে গেছি ৷ অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার সে এক অন্য ফুর্তি ৷ আজকের পথের হাল্কা ঝরনাগুলোর মতো ৷ এদেরও লক্ষ্য কি সাংতি নদী? এই ধারণায় কখনও ঝরনা ধরেও কিছুটা বেয়ে গেছি ৷ আজও পথে একটা গেট পড়েছে আড়াই-তিনঘণ্টা হাঁটার পর ৷ খুলে ঢুকতে এবার আর দ্বিধা করিনি ৷ এত করেও সময় নষ্ট হল সম্ভবত পথভ্রম সন্দেহে দুবার থেমে পড়ার জন্যই ৷ এগোলে অন্তত হতাশা ও মানসিক ক্লান্তি জাগত না ৷ এখানেই আমি ঝরনার কাছে হেরে গেছি ৷
এক সময় মরীচিকা মরূদ্যান হল ৷ ঘন জঙ্গল থেকে খাড়া পঞ্চাশ মিটারের মতো নিচে ৷ নগরসভ্যতার লোকালয় ৷ মিনিট পাঁচেক ভুট্টাখেতের ধার দিয়ে এগোলেই নদীর সেতু ৷ পেরিয়ে, ওপারের রাস্তায় আমাদের জন্য বাস অপেক্ষা করছে ৷ পিছনের লোকেদের আসতে বেশ দেরি হবে বুঝে মনের বাকি স্বাদ মেটালাম-ডুব দিলাম সাংতির টলটলে জলে ৷ উইন্ডচিটার আর জুতোর কাদা-ময়লা নিমেষে ধুয়ে গেল ৷ যা কখনও ধোবার নয় তা হল পেরিয়ে আসা পাঁচটা দিন ৷ সাধ আরেকটু বাকি ছিল ৷ তাঁবুতে রাত কাটানো ও ক্যাম্পফায়ার ৷ তাঁবু এতদিন কোথাও খাটানো হয়নি, লোভনীয় সুযোগ থাকা সত্বেও ৷ ট্রেকিং শেষে আজ ঘাটতিটুকু মেটালাম দিরাংয়ে পৌঁছে ৷ ট্যুরিস্ট লজের লনে তাঁবুতে রাত্রিবাস করে ৷
ভ্রমণ ডিসেম্বর, ১৯৯৫
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন