অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৯৯৮ থেকে খাণ্ডালা-লোনাভালা-পুনে অন্তত বিশবার আপ-ডাউন করেছি ৷ চিনতেই পারি না ৷ ১৯৫০-এর দশকের খাণ্ডালা কোনও শহরই ছিল না ৷ পশ্চিমঘাটের কোলে কিছু বিচ্ছিন্ন বাংলো ৷ রীতিমতো সাহেবি আমলের বাংলো, টালির ঢালু চাল, চওড়া ঢাকা বারান্দা, বড় বড় ঘর ৷
গ্রামবাসীদের বস্তি দূরে দূরে ৷ ‘ডেকান কুইন’ যখন দাঁড়াত (স্মৃতি থেকে লিখছি), তখন আদিবাসী মেয়েরা পাতার ঠোঙায় বুনো জাম, টকমিষ্টি করঞ্জা ফল জলের দামে বেচত ৷ খাণ্ডালায় কোথাও সেদিনের অভিনেত্রী নিরূপা রায়ের বাংলো ছিল ৷ সে সময়ে উনি সিনেমায় দুর্গা, লক্ষ্মী, মহালক্ষ্মী, কালী-এসব সাজতেন ৷ উনি বম্বে থেকে আসতেন একটু জুড়োতে ৷ আর হাঁটতে বেরোলেই কাছা দিয়ে রঙিন কাপড় পরা গ্রামের মেয়েরা ওঁর পায়ের কাছে নারকোল বা ফুল বা ফল রেখে প্রণাম করত ৷
আজকের খাণ্ডালা আর সেদিনের খাণ্ডালার আকাশপাতাল তফাত ৷ সে তো আজকের কলকাতা আর আমার ছোটবেলার কলকাতাও অন্য রকম ৷ এ শহরে আমার চেনাজানা কী বা আছে!
১৯৯৮ থেকে মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে অন্য কাজের জন্য বেজায় ঘুরেছি, বছরে আট মাস ৷ গেছি তো দূরদূরান্তের গ্রামে-জঙ্গলে-পাহাড়ে ৷ সে সব অন্য কখনও বলা যাবে ৷
বেড়াবার জন্য বেড়ানো যদি বল, তাও ঘুরেছি অনেক একদা ৷ তবে একটা সময় ছিল, বেরিয়ে পড়াটাই আনন্দের ৷ কোথায় যাচ্ছি, তাতে কী! সে ছিলেন আমার মা ৷ ‘চলো যাই’ বলে বেরিয়ে পড়লেই হল ৷ বেরিয়েছ, সেটাই তো আনন্দের ৷ জায়গাটা কি নাম করা? প্লেনে যাচ্ছ, না ট্রেনে? হোটেলে থাকছ, না অন্য কোথাও?
বড় ভালো কেটেছে সে সব দিন ৷ ১৯৪৪ সালে মা বললেন, চল আমরা বাদকুল্লা যাই ৷
বাদকুল্লা কেন? আমার বাবা মণীশ ঘটক, কার যেন বুদ্ধিতে বাদকুল্লায় ৪০ বিঘা ধানজমি, আর ১ বিঘা বসতজমি কেনেন ৷ টাকা দিয়েই খালাস ৷ জায়গাটা কোথায়, কীভাবে যাব, সে সব নিয়ে চিন্তা নেই ৷
মা তো ছিলেন দুর্ধর্ষ সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী ৷ বাবা যেই রংপুরে বদলি হলেন, মা আমাদের আট ভাইবোনকে নিয়ে চললেন বাদকুল্লা, সুরভিস্থান-এ ৷ গরুর গাড়িতে ধানখেতের মধ্য দিয়ে পৌঁছলাম ৷ পাকা ধানের সুগন্ধ, আর তেমনই শীত ৷ বিশাল উঁচু এক খড়ের ঘর, তাতে বড় বড় তক্তপোশ ৷
সুরভিস্থান ফার্মের লোকজনের কী যত্ন, কী সেবা! ফার্মের গরুর দুধ এক বালতি আর গরম রসগোল্লা এক বালতি নিয়ে এলেন ৷ সামনে তিরতিরে অঞ্জনা নদী ৷ সেখানে হাত মুখ ধুই, স্নান করি কি না, মনে নেই ৷ দুবেলা সুরভিস্থানের কিচেন থেকে আসে ওখানকার লাল চালের ভাত, ঘন মুসুর ডাল, সব একেক বালতি, আরেক বালতি বাগানের নানা সবজির ঘণ্ট ৷ সারাদিন খেল, বেড়াও, ছোটগুলোকে সামলাও ৷
মাঝে মাঝে গ্রামের লোকদের কাছ থেকে মা কেনেন চিংড়ি আর চুনো মাছ ৷ মাটির কড়াইয়ে রাঁধেন, তার স্বাদ কী অপূর্ব! সকাল-বিকেল দুধ আর রসগোল্লা তো থাকেই ৷
সাতটা দিন যেন ‘সব পেয়েছির দেশ’-এ ছিলাম ৷ অবশ্যই ‘সুরভিস্থান’-এর পরের খবর জানি না ৷ বাবার সে ধানজমি আর বাস্তুজমিও আর দেখিনি ৷ কিন্তু ঘর ছেড়ে অজানা জায়গায় যাবার যে আনন্দ, সে তো তুলনাহীন ৷
১৯৮৫ থেকে বেশ কবার বিদেশ গেছি ৷ যথেষ্ট ঘুরেছি ৷ কিন্তু পৃথিবীবিখ্যাত সৌধ, মিউজিয়াম, জলপ্রপাত দেখার সময়ে অল্প বয়সের মনটাই নেই, স্মৃতিতে তারা ঝাপসা ৷
অল্পবয়সের মন ব্লটিং কাগজের মতো ৷ যা পারে, শুষে নেয় ৷ কাদের বলি এ সব কথা! ব্লটিং কাগজ কি, তা আজ কে বুঝবে!
বেরিয়ে পড়াটাই আনন্দের ৷
এক সময়ে পালামৌ-এর জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কতদূর চলে যাই! সেদিনের পালামৌ-এ বাঘ, চিতাবাঘ, বুনো শুয়োর, কী ছিল না?
শাড়ি এবং কেডস পরে, জুন মাসে যখন বরফ গলছে, তখন সেই নরম বরফ দিয়ে হেঁটে রোটাং পাসে যাওয়া সে কি ভুলে যাব? সত্যি বলতে কী, রোটাংয়ের নরম বরফে আমাদের তলিয়ে যাওয়ারই কথা!
মন যখন বলছে, চল যাই!
যাওয়াটাই আনন্দের ৷ আর কত যে ভ্রমণ ম্যাডভেঞ্চার, তা বলতে গেলে শেষ হবে না ৷
‘ভ্রমণ’ আমার প্রিয় কাগজ ৷ এ কাগজের পাঠক-পাঠিকাদের জন্য সেসব ভ্রমণকথা বলতে পারলে খুশি হতাম ৷ শরীরের অবস্থার জন্য এবার তা সম্ভব হল না ৷ কোনওদিন বলব ৷
দেওজীরার গহন জঙ্গলে ফরেস্ট বাংলোর কথা বলব ৷ যার অর্ধেকটা শাল গাছের পুরু তক্তায় গাঁথা ৷
-কেন?
চৌকিদারের সস্নেহ জবাব, ‘ওদিকে বাঘ এসে শোয় মাঝে মাঝে ৷ আমরা এদিকে থাকি ৷’
এ তো ১৯৯৮ জুলাইয়ের কথা, অথবা এ বছর মার্চ মাসের ৷
‘ভ্রমণ’ বলতে আমি বুঝি মনের খুশি ৷ ধানের শিষে শিশির দেখেই খুশি থাকি, বলতে পার ৷
সেইসব ভ্রমণের কথাই মনে পড়ে, যতবার পিছনে ফিরে তাকাই ৷ এমন একটা পরিবার আমাদের, এমন স্বভাব আমারও, যে যত ম্যাডভেঞ্চার, আমাদের বাড়িতেই হত ৷ যেমন, ১৯৪৫ সালে শান্তিনিকেতন থেকে বহরমপুরে যাওয়া ৷
১৯৪৪ সালের শেষে বাবা রংপুরে ৷ তখন যুদ্ধের সময়, ঠিক হল আমি শান্তিনিকেতনে গিয়ে থার্ড ইয়ারে ভর্তি হব ৷ বয়স তখন সবে আঠারো ৷ রংপুর থেকে কলকাতা ৷ কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন, বাবা ‘তুই পারবি’ বলে আমাকে ট্রেনে তুলে দিলেন ৷ আজ ভেবে পাই না ৷ কী করে পেরেছিলাম ৷ যা আরও ভেবে পাই না, বাবা মা আমার বিষয়ে অত ভরসা কেন পেতেন ৷
তা শান্তিনিকেতনে পড়ছি ৷ চিঠিতে জানলাম, বাবা বদলি হয়ে বহরমপুরে এসেছেন ৷ চিঠি পেয়েই আমার বেজায় মন কেমন করল ৷ লিখলাম, আমি দোলের ছুটিতে বহরমপুর যাব ৷ কেমন করে, কোন পথে যাব ৷ তা কিন্তু বাবা কিছুই জানাননি ৷ খুকু যখন লিখছে, ও চলেই আসবে, এইরকম একটা ভাব ৷
অনেক খোঁজ নিয়ে বোলপুর থেকে আমেদপুর এলাম ৷ শেষে বোলপুর-আমেদপুর, আমেদপুর-কাটোয়া, কাটোয়া-বারহারোয়া লাইনের ট্রেনে এলাম খাগড়াঘাট ৷ দোলপূর্ণিমার রাত ৷ সময় সাড়ে দশটা হবে ৷ নেমে দেখি সব শুনশান ৷ স্টেশন মাস্টার, সুটকেস হাতে আমাকে নামতে দেখে বেজায় অসন্তুষ্ট ৷ যা জানা গেল, আশপাশে কেউ নেই ৷ খাগড়াঘাট থেকে ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ে রাধারঘাট পৌঁছতে হবে ৷ নদী পেরোতে হবে হেঁটে, অবশ্য জল তেমন নেই ৷ ওপার থেকে লালদিঘি, হেঁটেই যেতে হবে ৷
যে সময়ের কথা লিখছি, তখন মফস্বলে যানবাহন বলতে ঘোড়ার গাড়ি ৷ সাইকেল-রিকশা তখন অজানা বস্তু ৷ এ তো চুয়ান্ন বছর আগেকার কথা!
স্টেশনমাস্টার আমাকে যথেষ্ট বকলেন ৷ যুদ্ধের সময় ৷ রোজ এ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায় না ৷ নামলাম, তো এত রাতে থাকব কোথায়? এই ছোট্ট স্টেশনে কোনও ব্যবস্থাই নেই ৷
সেদিনের খাগড়াঘাট ছোট্ট স্টেশন, দুপাশ বনজঙ্গলে ঢাকা, তার মাঝে না-কাঁচা, না-পাকা, বলতে পার আধপাকা রাস্তা ৷ স্টেশনমাস্টার ঘর বন্ধ করে লণ্ঠন হাতে বাড়ি রওনা হচ্ছেন ৷ আমি বললাম, বেশ! সুটকেস নিয়ে একাই যাব ৷
এই সময়ে, অন্ধকারের র্যাপার মুড়ি দিয়ে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন ৷ পরে জেনেছি, তাঁর নাম মণিপাঁচু, পদবি ভুলে গেছি ৷ ওঁর পরিবারের সকলের নামের পর ‘চন্দ্র’ বা ‘নাথ’ বা ‘কুমার’-এর বদলে পাঁচু যুক্ত হত ৷ বহরমপুরের ব্যাপারই আলাদা ৷ আমরা যাঁকে ‘কাকা’ বলতাম, তার নাম ছিল অশোক উপেন্দ্র মল্লিক ৷ অর্থাৎ মধ্যবর্তী ব্যাপারটা ‘উপেন্দ্র’ ৷
যাক, এ ভদ্রলোক বোধহয় স্টেশনেই রাত কাটাতেন ৷ বললেন, মণীশবাবুর বাড়ি তো? চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি ৷
দোলের রাতেও তীব্র শীত ৷ সেদিনের বহরমপুর-কৃষ্ণনগর-শান্তিপুর, শাল-সেগুনের জঙ্গল ছিল ৷ আমিও, তখন ভাবতে পারতাম না, আমার কোনও বিপদ হবে, আজও তেমন গোঁয়ার-নির্বোধ রয়ে গেছি বলতে পার ৷ যাক, ১৯৪৫ সালে ফিরে যাই ৷ ভদ্রলোক আমার সুটকেসটা নিলেন, আমিও, যাঁকে চিনি না-জানি না, তাঁর সঙ্গে রওনা হলাম ৷
যেমন শীত, তেমন জঙ্গল, দুপাশে ৷ কখন বোলপুর থেকে ট্রেনে উঠেছি, এখন রাত এগারোটা বেজে গেছে, আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি ৷ ভদ্রলোক বললেন, পথটা তো ভালো নয়, আপনি একলা যাবেন… ৷
না, সেদিন চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ইত্যাদির ভয় ছিল না ৷ ছিল চিতাবাঘের ভয় ৷ সে সময়ে বহরমপুরে জজকোর্টে, স্টেশনের কুলিবস্তিতে চিতাবাঘ হানা দিত, মারাও পড়ত ৷ আমাদের লালদিঘিতেও তারা ঘুরে যেত ৷
এই ভদ্রলোকের মতো মানুষ আরও দেখেছি ৷ এঁরা মানুষকে সাহায্য করতে সদাই তৎপর ৷ এঁর বাড়ি তো খাগড়া, আমরা থাকি লালদিঘি, মাঝে নিশ্চয় দুই বা তিন মাইল পথ ৷ আমাকে পৌঁছে উনি ফিরবেন হেঁটে হেঁটে ৷ এসব কথা তখন ভাবিনি ৷
চাঁদের আলো পথে পড়ে না যেন ৷ দুপাশে জঙ্গল ৷ মাঝরাত পেরিয়ে নদীর ঘাটে পৌঁছলাম ৷ নদীর ওপারে পথে গ্যাসের আলো, কী যেন মেলা হচ্ছে ৷ এবার হাঁটু অবধি কাপড় তুলে ভাগীরথীতে নামলাম ৷ বালি ঠেলে ঠেলে ওপারে উঠলাম ৷ শুনলাম, লালদিঘি না কি এক ক্রোশ, অর্থাৎ দুমাইল ৷ আবার হাঁটো, আবার চলো ৷ আমার, বলতে নেই, বাড়াবাড়ি রকম শক্তিসামর্থ্য ছিল ৷ ক্লান্তি জানতাম না ৷ তখন কিন্তু আর যেন পারছি না ৷
লালদিঘি তখন এত্তটুকু জায়গা ৷ বাঁদিকে দুটো একতলা বাড়ি, ডানদিকে দুটো ৷ বাঁদিকে প্রথম বাড়ির কড়া নাড়লাম ৷ রাত তখন দুটোই হবে ৷ তখন তো জানি না ওটা কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়ি ৷ আর ওঁর গলাও বেশ ভারি ৷ কড়া নাড়তেই উনি বললেন, কে?
আমি ধাক্কা দিচ্ছি আর বলছি, তুতুল! আমি! শীগগির দরজা খোলো ৷
রাত দুটোয় একটা মেয়ের গলা? তখনি শুনলাম, না না, এখানে কোনও তুতুল নেই ৷-ওঁর বা দোষ কী? সে সময়ে এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড হতই না ৷
অগত্যা পাশের বাড়িতে ধাক্কা ৷ তুতুলই দরজা খুললেন ৷ খুলেই বললেন, এসে গেছিস?
তারপর মণিবাবুর সঙ্গে একটু কথা বললেন ৷ আমাদের বাড়ি কী সৃষ্টিছাড়া তাই ভাবি ৷ তুতুল বা মা একটুও অবাক হলেন না ৷ নতুন শহরে, রাত দুটোয় কেমন করে এলাম, ট্রেন বদল করতে করতে, কখন বেরিয়েছি, কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা নেই ৷ আহা আহা তো একদম নেই ৷ মা বললেন, পা ধুয়ে ভাইবোনদের বিছানায় ঢুকে যা ৷
পরের দিন প্রতিবেশীরা এ হেন দজ্জাল মেয়ের কাণ্ড নিয়ে অনেক বলেছিলেন ৷
তুতুল বললেন, বেশ করেছিস!
চুয়ান্ন বছর কেটে গেছে ৷ সেদিনের কোনও কিছুই আগের মতো নেই ৷ আমার প্রথম বহরমপুরে অবতরণ এরকমই ৷ অনেক ভ্রমণের মতো ম্যাডভেঞ্চার ৷
এখন তেমন যাত্রা করাই যাবে না ৷ ভূগোলই পাল্টে গেছে ৷ আজ এই পর্যন্ত ৷ এমন ম্যাডভেঞ্চার অনেক করেছি, আর এখনও বিশ্বাস করি, ‘এলেম নতুন দেশে’, এরকম মন নিয়ে যদি হাটবহিরগাছিও যাও (আমি গিয়েছি), ভ্রমণের আনন্দ পাবেই পাবে ৷ আনন্দ তো মনের ব্যাপার, আর তৃষ্ণার্ত চোখে দেখার ব্যাপার ৷ কাছে, না দূরে, তাতে কি আসে যায় বল?
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন