অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
দিদি গাদিয়াড়া যাবেন?
‘আমরা ফিরব কবে?’
এ যেন অবিকল সেই প্রবাদপ্রতিম হাভাতেপনার উদাহরণ, ‘বাঙাল, ভাত খাবি?’
না, ‘আঁঁচাবো কোথায়?’
অনেকদিন ধরে মনটা পালাই পালাই করছে, আর দেহ বাধা দিচ্ছে ৷ রক্তচাপ রক্তচক্ষু করে শয্যাবন্দী রেখেছিল পুরো পুজোর ছুটিটা ৷ দুদিনের জন্য শুধু ছুটে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে-আত্মীয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে ৷ পুজোর ছুটি ফুরোতে চলল, হাতে কাজ জমে আছে অজস্র, বাড়িতে বিজয়ার ভিড়-যদিও খুব ভালো লাগছে ৷ ‘লোক, না লক্ষ্মী’ মা বলতেন, ‘যতদিন বাড়িতে লোকজন আসে, ততদিনই বাড়িতে লক্ষ্মী আছেন, জানবি ৷’ কিন্তু পরিশ্রমও হচ্ছে তো? আমাদের বাড়িতে অতিথি এলে যে একলা আমিই আছি সবার সঙ্গে গড়্গড় করে কথা বলবার জন্য ৷ তারই ভেতর নিজের লেখাপড়ার কাজ করতে খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু এগোচ্ছে শামুকের গতিতে ৷ মননে, শরীরে এত শ্রান্তি, মগজে না ঢুকছে কিছু, বেরচ্ছেও না কিছুই ৷ এমনই সময়ে ভ্রমণ-সম্পাদক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী ঠিক যেন দেবদূত হয়ে নেমন্তন্ন দিলেন ৷ ঠান্ডা গাড়িতে, ধুলো-ধোঁয়া বাঁচিয়ে সোজা নদীর হাওয়ায় ৷ আমি তো এক লাফে রাজি! দল বলতে আমি, অমরেন্দ্র, টুকু আর আমার দিদিভাই, বুলবুলি ৷ গাদিয়াড়ার রূপগুণের সুনাম শুনছি ইদানীং বেশ কিছুদিন ধরেই ৷ সেখানে নাকি ভাগীরথীর সঙ্গে রূপনারায়ণের জোড় বাঁধার খেলা চলছে ৷ সেই খেলাতে ওদের সঙ্গী ধানখেতের শান্ত সবুজ, আর খোলা আকাশের স্বচ্ছ নীল, আর সাক্ষী নদীর হাওয়ার ঝিরঝিরে আদর ৷ চোখের আরাম ৷ মনের বিশ্রাম ৷ আত্মার শান্তি ৷
জলের ধারে ঘর আমার চিরদিনের স্বপ্ন ৷ নদী আমার প্রেম ৷ একটা রাত্রি, দুটো দিন জলের ধারে নদীর কাছে মনপ্রাণ ছড়িয়ে শ্বাস নেব ৷ অক্টোবরের ১৪ তারিখ সকালে যাব ৷ ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় ফিরব ৷ শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ, সবকিছু ধুয়ে মুছে দেবে ভাগীরথী আর রূপনারায়ণ ৷
ঠিক হয়েছে সকাল সাতটায় বেরবো, যাতে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাই ৷ যতক্ষণ পারি থাকতে হবে তো নদীর ধারে? তাই সেই কোন ভোরে উঠে পড়েছি ৷ রাত থাকতে স্নান সারা, পুঁটলি বাঁধা, ওষুধপত্র খেয়ে একদম রেডি!
সাহেবদের মতো সাতটায় গাড়ি এসে হাজির ৷ গেটে ভৌ ভৌ করে কাতর গুডবাই জানাতে লাগল টুসুরানি আর রাকুন ৷ আর তাদের সামলে হাত নাড়তে থাকে কানাই, ‘ভালো করে ঘুরে আসুন দিদি!’
‘কাল সন্ধেবেলাই ফিরব!’
নতুন হাওড়ার ব্রিজে বিদ্যাসাগরের নামে গড় করে তো আমরা হাওড়ায় প্রবেশ করলাম ৷ টুকু সারথিকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘রাজীব গান্ধীর মূর্তি পেরিয়ে, বাঁদিকে ৷ মনে আছে তো? সেবারে যে গেলাম?’ কিন্তু রাজীব গান্ধীর স্ট্যাচু আর এল না ৷ পথে একটি হোটেল পড়ল, কবে নাকি একবার ঝাড়গ্রামের যাত্রাপথের বর্ণনায় হোটেলটির উল্লেখ ছিল ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায়, সেই থেকে অমরেন্দ্রর সেখানে স্ট্যান্ডিং চায়ের আমন্ত্রণ আছে ৷ তা, আমার প্রাণে একটু চা-টার লোভ জাগলেও, অমরেন্দ্র, দেখা গেল, নির্লোভ সম্পাদক ৷ কেরালা-ভ্রমণের এক উপাদেয় কাহিনী শোনাতে শোনাতে হোটেলের সামনেটা পার করে দিলেন ৷ অমরেন্দ্রর মুখে ফ্রান্সের সূর্যমুখী, ল্যাভেন্ডার আর আঙুরখেতের গল্প শুনছি আর মনে মনে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাচ্ছি, আর চলছি তো চলছিই ৷ রাজীব গান্ধীর সেই প্রতীক্ষিত মূর্তিটি কোথাও নেই!
এমন সময়ে আমরা এসে পড়লাম অপূর্ব এক কাশবনের আঁচলের আওতায় ৷ টুকু উছলে উঠে বললেন ‘বাঃ!’ তারপরেই-‘বাড়িতে ফেরার সময়ে কিছু কাশফুল নিয়ে যাব!’ অমরেন্দ্র তক্ষুণি গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিয়ে, নেমে পড়লেন ৷ না, পরে বুঝেছি ফুল তুলতে নয়, ফটো তুলতে ৷ আস্তে আস্তে কাশফুলের বনে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন ৷
আকাশটার রং টলটলে নীল ৷ রচনা বইতে শরৎকালের যেমন বর্ণনা থাকে, অবিকল তেমনই ৷ নীলের মধ্যে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘন কাশবনে হাওয়ার সাদা ঢেউ খেলে যাচ্ছে, সবুজ মাঠ বৃষ্টি ধোয়া ৷ অমরেন্দ্রর ছবি তোলা আর ফুরোয় না! গাড়িতে এসে তাঁর কেবল নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার বিস্ময়, ‘আকাশখানা দেখেছেন! কী অসাধারণ নীল!’
ইতিমধ্যে ড্রাইভার জানালেন রাজীব স্ট্যাচু লরির ধাক্কায় কাত ৷ এদিকে গাদিয়াড়ার পথও আমরা অনেক পিছনে ফেলে এসেছি ৷ অগত্যা অ্যাবাউট টার্ন করে ছুটলাম ৷ এবার পশ্চাদপসারণ ৷ বড় রাস্তা ছেড়ে গ্রাম্য রাস্তা ৷ কত বাজার, কত হাট, কত রেল লাইন, কত বাসস্ট্যান্ড, কত বাঁশবাগান, কত সবুজ পানাপুকুর, কত সবুজ ধানখেত ৷ বাতাসে শহরের ধোঁয়া নেই ৷ মানুষ দরিদ্র, কিন্তু হতদরিদ্র মনে হচ্ছে না ৷
একটা মোড়ে এসে আটকে যাই ৷ এখানে বাঁয়ে ঘুরতে হবে-গাদিয়াড়ার পথে ৷ চারটে ছেলে এসে কালীপুজোর চাঁদা চাইছে ৷ অমরেন্দ্র তাদের বললেন, ‘তোমরা কি জানো, এটা বেআইনি? আমি যদি পুলিশকে বলে দিই?’ বললেন বটে কিন্তু দিয়েও দিলেন পাঁচ টাকা ৷
গাদিয়াড়ার পথ আগলে দাবি-দাওয়া হল এমনই আরও তিনবার ৷ বাচ্চারা ছোট হলে অবশ্য দুটাকাতেই খুশি ৷ কোথাও পুজোর কোনও রকমের প্রস্তুতি অবশ্য দেখা গেল না ৷ তবে হ্যাঁ, একটি মোড়ের সিনেমা হল দেখলাম, তাতে ছবি চলছে, ‘বাবা কেন চাকর?’ বোধহয় স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে? সেখানে বেশ ভিড় ৷
রাস্তাটা এখানে দক্ষিণ ফ্রান্সের অ্যাভেনিউগুলিকে মনে পড়িয়ে দেবেই ৷ ছায়াময় পথ ৷ দুপাশে উঁচু গাছ গির্জার দেওয়ালের মতো খাড়া উঠে গেছে, আর করজোড়ের মতো মিলিত হয়েছে আকাশে ৷ আমাদের মাথার ওপরে গাছের ছাদ ৷ এ পথটুকু খুবই সুন্দর ৷ তারপর হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরেই সামনে ম্যাজিক-বিশাল জলরাশি! তাকে ঘিরে দূরে দেখা যাচ্ছে শ্যামল রেখা ৷ চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ নাড়িও যেন ধুকপুকুনি বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে, এক নিশ্বাসে সেই রূপটি অন্তরে গ্রহণ করি ৷ গাড়িতে ছোট্ট একটা শব্দ হল সেই সুখ-বিস্ময়ের শ্বাসটানার ৷
দূরে দুরকম রং দেখা যাচ্ছে, বাঁয়ে বিশাল গেরুয়া, ডাইনেও তাই, মাঝখানে হঠাৎ কিছুটা ঝিরঝিরে ঘননীল স্রোত ৷ সেটা কি মেঘের ছায়া? নাকি রূপনারায়ণের স্বাক্ষর? আকাশ তো ঝকঝকে নীল, সাদা মেঘের কি ওরকম ছায়া হবে? নিশ্চয় রূপনারায়ণ জানান দিচ্ছে ৷ ঠান্ডা গাড়ি, বন্ধ গাড়ি, তাতে নদীর হাওয়া ঢোকে না ৷ আমরা কাচ নামিয়ে ফেলি ৷
বাঁয়ে সরকারি অতিথিশালা, রূপনারায়ণের নামে তার নাম ৷ ভেতরে অনেকখানি সবুজ, একটি সুদৃশ্য কুটির আছে খড়ের ছাউনি দেওয়া, আহা, সেটি কি? সেটি কি? নাঃ, ওটা কোনও অফিস ৷ আরেকটি সুদৃশ্য পুরনোদিনের দোতলা কোঠাবাড়ি রয়েছে, একটু ভাঙাচোরা, একটু মলিন, বিস্মৃতি বিলগ্ন ৷ একেবারে নদীর ধারে ৷ বারান্দায় ডেকচেয়ার ৷ সেটি কি? সেটি কি? নাঃ সেটি কিছু নয় ৷ পুরনো অতিথিশালা ৷
তবে?
ভেতরে যান ৷
ভেতরে প্রথমেই চোখে পড়ে বোটিং-এর তীরচিহ্ন ৷ সেটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চকচকে পুকুর, সেখানে প্যাডল বোট চালিয়ে ফুর্তি করে যান কলকাতার লোকেরা ৷ নদী ফেলে ৷ নদীর বড় বড় নৌকা ফেলে ৷ স্টিমার ভুটভুটি ফেলে ৷ নদীর দিকে পিছন ফিরে ৷ পুকুরের এক ধারে অনেক রংচংয়ে বোট উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তাদের ভালোবেসে ধুয়ে মুছে রাখেনি কেউ, একমাত্র আদর করে জড়িয়ে রেখেছে ঘন মাকড়সার জাল ৷
দুটি এ সি ঘর ৷ একটিতে এ সি কাজ করে না ৷ নাকি গোড়া থেকেই ৷ শুধু শব্দ করে ৷ অমরেন্দ্র আমাদের অন্যটি দিলেন, যেখানে এ সি চলে ৷
(হ্যাঁ, চলত ৷ একটু পরেই বন্ধ হয়ে গেল ৷ আর দুদিনে চলল না ৷) আমরা দরজা-জানলা খুলে দিই, বারান্দায় নদী দেখতে দৌড়াই ৷ ও মা! সামনে যে ঝাঁকড়া গাছের দু-সারি পর্দা! ফাঁকে ফাঁকে নদীর গেরুয়া ৷ ফাঁকে ফাঁকে নৌকা বয়ে যায় ৷ কিন্তু ও কী? এ কোন আকাশ? অমরেন্দ্রর সেই শরৎ সুনীলের শোভা গেল কোথায়? এ যে নীল অঞ্জনঘনপুঞ্জ শোভায় সম্বৃত অম্বর! এ সংবরণ তো বেশিক্ষণের নয় ৷ এবারে বৃষ্টি নামবেই ৷ আকাশের রং কালো ৷ নদীতে তার গাঢ় ছায়া ৷
লাঞ্চ অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে ৷ ডাল, ইলিশ মাছ ভাজা, আলু-পটলের সব্জি, রুই মাছের ঝোল ৷ আমরা খেতে যাব একঘণ্টা পরে ৷ খেতে খেতেই আকাশ অসম্বৃত হয়ে পড়লেন!
খাবার পরে একটু বিশ্রাম করা নিয়ম ৷ দিদিভাই আর আমি তো বারান্দায় বৃষ্টির ছাটে ভিজতে ভিজতে বিশ্রাম করতে লাগলাম ৷ যেটুকু নদী পাওয়া যায়, ভেতরে ভরে নিই ৷ একটু পরে টুকু, অমরেন্দ্র হাজির ৷
‘চলুন, বৃষ্টিটা থেমেছে ৷ একটু ঘুরে আসি ৷’
‘এখুনি, এখুনি ৷’
বৃষ্টি কিন্তু থামেনি ৷ ধার করা ছাতা মাথায় দিয়ে আমরা স্টিমার ঘাটে যাই ৷
গেঁওখালি আর নূরপুর ৷ এই দুটো জায়গায় যায় স্টিমার ৷ দুটোই ওপারে ৷ ত্রিকোণ যাত্রা সম্ভব-গাদিয়াড়া-নূরপুর-গেঁওখালি-গাদিয়াড়া ৷ নতুবা যে কোনও ঘাট থেকে যে কোনও ঘাট ৷ চারজনের গাদিয়াড়া থেকে নূরপুর যাবার টিকিট চোদ্দ না পনেরো টাকা ৷ গেঁওখালির ভাড়া আরও কম ৷ নূরপুরের ভুটভুটি ছাড়ছে তিনটেয় ৷
ঘাট যেমন হয় ৷
ভুটভুটির ছাদে দাঁড়ানো আইনত নিষিদ্ধ ৷ ভুটভুটির পেটের মধ্যে ঢুকতে হবে ৷ ছাদে দাঁড়ালে বিশুদ্ধ নদীর হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়া যায়, আকাশ, আলো আর নদীর সঙ্গে গল্প করা যায় ৷ পেটের মধ্যে ঢুকলে আঁধার মনখারাপ, ভুটভুটির ভটর ভটর আর ডিজেলের বিষবাষ্পে নিশ্বাস নেওয়া ৷ সেটাই আইনত নিতে বাধ্য যাত্রীসকল ৷ ওপরে ছাদে কোনও রেলিং ঘেরা নেই ৷ যাত্রীদের নিরাপত্তা নেই ৷
বাচ্চারা বেঞ্চিতে হাঁটু গেড়ে জানলা দিয়ে নদী দেখছে ৷ বসে পড়লে গর্তে ঢুকে যাবে ৷ কিছুই দেখা যাবে না ৷ দিদি, টুকু আর আমিও তাই করি ৷ অমরেন্দ্র ক্যামেরা নিয়ে একটু দূরে দূরে ঘোরাঘুরি করছেন ওই খুপচির মধ্যে ৷ উদ্দেশ্য জানলা দিয়ে নদীর ছবি তোলা ৷ প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে ৷ যাত্রী কম ৷ হলদে প্লাস্টিকের পর্দাটা ফেলে দিলেন চালক ৷ সোনায় সোহাগা ৷ আমি তো জোর করে তুলে দিলাম, জল আসে আসুক, বিশুদ্ধ বাতাসটাও তো আসবে? এ যেন জলের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা নয়, বৃষ্টির সৈন্য ৷ নূরপুর এসে গেল ১৫ মিনিটে ৷ প্রচণ্ড বৃষ্টি, আর ঝোড়ো বাতাস ৷ মানুষের ছাতা উড়ে যাচ্ছে ৷ ভিজে কাপড় গায়ে লেপ্টে আছে ৷ তারই মধ্যে উঠছেন দুকোলে দুই বাচ্চা নিয়ে মা ৷ বালতি মাথায় দিয়ে স্বামী ৷ সাইকেল নিয়ে মানুষ ৷ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পরিবার ৷ নূরপুর থেকে ফিরলাম গাদিয়াড়া ৷ এবারে অমরেন্দ্র আর আমি সিঁড়িতে ৷ আমরা বড় ছাতাটা সিঁড়ির গর্তের মাথায় মেলে রেখেছি, বৃষ্টিতে ভিজছি না, কিন্তু টাটকা বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি ৷
কোনওরকমে গাদিয়াড়াতে নেমে, ফেরার টিকিটের পয়সা দিয়ে গাড়িতে চড়ে পালিয়ে বাঁচি ৷ কোথায় একটু ধাবায় বসে চা খাব, তা নয়!
চট করে অন্ধকার নেমেছে ৷ এবং লোডশেডিং ঘোরতর ৷ আমরা ঘরে মোমবাতি জ্বেলে, চা খেতে খেতে, অমরেন্দ্রর মুখে ছোটদের কবিতা শুনি ৷ সন্ধে গাঢ় হয় ৷ নরম মোমের আলোয় নরম শিশুদের ছড়া দিব্যি আবেশ তৈরি করেছে ৷ হঠাৎ আলো ফেরে ৷ পাখা চলে ৷
‘দেখি তো, টিভিটাও চলে কিনা?’ টিভিটা চালিয়ে দিতে অস্পষ্ট একটা ছায়া ভেসে উঠল ৷ অমিতা সেন ৷ ইনসেটে তাঁর পুত্র অমর্ত*্য সেনের ছবি ৷ আমি লাফিয়ে উঠি, ‘দিদিভাই! এবার তাহলে পেয়ে গেলেন! অবশেষে!’ কদিন ধরেই কাগজে নোবেলের খবর একটা একটা করে বেরোচ্ছে ৷ দিদি, অমরেন্দ্র, টুকু,-আমরা সেই সন্ধ্যা যে কী করে কাটালাম, সেই দূর গ্রামে, রূপনারাণের কূলে! তারই মধ্যে ম্যাজিক, আজকালের টেলিফোন-‘প্রতিক্রিয়া?’
পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ পরিষ্কার ৷ রাতে আমার ঘুম হয়নি ৷ নদীর ধারে হাঁটতে গেলাম চারজনে ৷ অমরেন্দ্র উধাও ৷ গ্রামের সরু পথে, কলাবাগানের, ধানখেতের মধ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি ৷
আমরা মনোরঞ্জনের সঙ্গে কথা বলি ৷ সে আমাদের নদীতে নিয়ে যাবে ৷ আমরা খগেনের সঙ্গেও কথা বলি ৷ সে আমাদের সাইকেলভ্যানে করে গ্রামে নিয়ে যাবে ৷ নদীর ধারের গাছগুলোর কেন যে জলে হাত ডোবাতে, আঙুল ছোঁয়াতে এত ইচ্ছে করে? নিচু হয়ে পড়েছে ৷
তারপরে মনোরঞ্জনের কাঠের নৌকা ৷ আসল তরণী বাওয়া ৷ একঘণ্টা ধরে ভাগীরথী থেকে রূপনারায়ণ হয়ে ফের ভাগীরথীতে ফেরা ৷ সূর্যোদয়, নদীর হাওয়া, নোবেল প্রাইজ ৷ আজ সন্ধ্যায় নয়, আমাদের এখুনি ফিরতে হবে কলকাতায় ৷ আজ তো কলকাতায় সাত-সমুদ্রের বাতাস লেগেছে ৷
ফিরতে সময় লাগল অনেক কম ৷ এসে দেখি কানাই আড়াইশো নাম লিখে রেখেছে ৷ ফোনের অতিথির ৷ বি বি সি, আজতক, দূরদর্শন, আকাশবাণী, আনন্দবাজার ইত্যাদি এবং অগণিত বন্ধুর নাম ৷
আমাদের স্মৃতিতে ভাগীরথীর বুকে লেগে থাকবে স্টকহলমের বাতাস ৷ গাদিয়াড়ার সেই মোমজ্বলা সন্ধ্যাটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটা নতুন সূর্য ওঠা সকাল হয়ে রইল ৷
ভ্রমণ জানুয়ারি, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন