অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
আমরা বক্সা গিয়েছিলাম প্রায় অচেনা রাস্তায় ৷ আসামগামী জাতীয় সড়কে শামুকতলা ৷ তার পাশেই শ্রীনাথপুর চা-বাগান হয়ে যাওয়া সেই রাস্তা অনেক বেশি অরণ্যময় ৷ গতানুগতিক রাস্তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ৷
শিলিগুড়ি থেকে রওনা হতেই দেরি হয়েছিল ৷ ভাঙাচোরা জাতীয় সড়ক বেয়ে দমনপুর মোড়ে পৌঁছতেই বেলা গড়াল ৷ ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে বীরপাড়া জলদাপাড়ার প্রবেশদ্বার মাদারিহাট ও হাসিমারা পার হয়ে দমনপুর মোড় ৷ সেখান থেকে ডাইনে গিয়েছে আলিপুরদুয়ারের রাস্তা ৷ বাঁয়ে রাজাভাতখাওয়া হয়ে বক্সা পাহাড়ের পদতলে সান্ত্রাবাড়ি ৷ আলিপুরদুয়ারে বাজারহাট সেরে বনদপ্তরের অফিস থেকে বুকিংয়ের কাগজ নিয়ে দমনপুর চৌরাস্তায় এসে উত্তরে রাজাভাতখাওয়ার বদলে আমরা রওনা হলাম পূর্বে শামুকতলার দিকে ৷ জাতীয় সড়ক গিয়েছে বক্সা সংরক্ষিত অরণ্যের সীমান্ত ছুঁয়ে ৷ তবে এখানে জঙ্গল তেমন ঘন নয় ৷ শামুকতলা, বারোবিশার রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে আমাদের গাড়ি জাতীয় সড়ক পিছনে ফেলে বাঁয়ে ঘুরল ৷ এখন পিচরাস্তা সরু হয়ে এসেছে ৷ বিচ্ছিন্ন জঙ্গলের মাঝে মাঝে ধান, ভুট্টার খেত ৷ উত্তরে কিছুদূরেই ঘনসন্নিবিষ্ট অরণ্যরেখা ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে চেকো বীটের চেকনাকা পেরিয়ে আমরা জঙ্গলে প্রবিষ্ট হলাম ৷ তারপর উত্তর থেকে ফের পুবমুখো হলাম গদাধর বীটের উদ্দেশে ৷ পিচরাস্তার দুপাশেই এখন গহন জঙ্গল ৷ মাথার ওপরেও অরণ্যের শামিয়ানা ৷ কিছুটা যেতেই পথে পড়ল বালা নদী ৷ নিঝুম নিঃসীম অরণ্যে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে শঙ্খিনী নদীটি ৷ তার ওপর কাঠের তক্তা পাতা সঙ্কীর্ণ সেতু ৷ উত্তরে জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে ভুটান পাহাড়ের নীলাভ তরঙ্গ ৷
নদী পেরিয়ে জঙ্গল মাড়িয়ে আরও কিলোমিটার দুয়েক যাওয়ার পরেই পাওয়া গেল গদাধর বিট অফিস ৷ অফিসের এ পাশে জঙ্গল শেষ ৷ ও প্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে শ্রীনাথপুরের আদিগন্ত চা-বাগান ৷ সেই বাগানের পূর্বের সীমানা এঁকেছে রায়ডাক নদী, উত্তরের দিগন্তে কৃষ্ণনীল পর্বতশ্রেণীর আবছা অবয়ব ৷
বিট অফিসে যাত্রাপথের হদিশ জেনে নিয়ে এবার আমরা চললাম জয়ন্তীর পথে ৷ এখন জঙ্গল আরও ঘন ৷ শতাব্দী-প্রাচীন মহীরুহের জটলা আর নিচে ঝোপঝাড়ের ভিড়ে জঙ্গলের ভেতর বেশি দূর দৃষ্টি চলে না ৷ রাস্তাও আর মসৃণ নয় ৷ মাঝে মাঝেই পাথর বিছানো কজওয়ের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনার স্রোত ৷ জয়ন্তীর কিছুটা আগেই পথে পড়ল বিশালাকার এক ওয়াচটাওয়ার ৷ ‘২৩ মাইল’ নামের সেই ওয়াচটাওয়ারের আগাগোড়াই অরণ্যের রঙে চিত্রিত ৷ দোতলা টাওয়ারের একতলায় বনরক্ষীদের সাময়িক বসবাসের বন্দোবস্ত ৷ ওপরে বসার ব্যবস্থা ৷ চারপাশে ঝিমঝিম করছে বক্সার জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জঙ্গলমহল ৷
উত্তরবঙ্গের একমাত্র ও রাজ্যের দ্বিতীয় টাইগার রিজার্ভ বক্সা অরণ্যের আয়তন ৭৫৮.৮২ বর্গ কিলোমিটার ৷ পাহাড় ও পাহাড়তলিতে বিছিয়ে থাকা এই নিবিড় অরণ্যে ৩৩টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও রয়েছে হাতি হরিণ চিতাবাঘ গোল্ডেন ক্যাট হিমালয়ান জায়ান্ট স্কুইরেলের মতো বিরল প্রাণীকুল এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখি ৷ আছে একশো ঊনপঞ্চাশ প্রজাতির বৃক্ষ, প্রায় সওয়া দুশো প্রজাতির লতাগুল্ম, শ-খানেক প্রজাতির ঘাস, আট রকমের বেত, ছয় রকমের বাঁশ ও একশো বত্রিশ প্রজাতির অর্কিড ৷ তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটিকে আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি পুষ্পিত হতে, প্রাচীন বৃক্ষের মস আচ্ছাদিত কাণ্ড থেকে ঝুলে থাকতে ৷
২৩ মাইল ওয়াচটাওয়ার পিছনে ফেলে জয়ন্তী ও বক্সা মোড় হয়ে গাড়ি যখন সান্ত্রাবাড়িতে পৌঁছে যাত্রায় খান্তি দিল সূর্যদেব তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই অস্তাচলে গিয়েছেন ৷ আসন্ন সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে পাহাড় অরণ্য আরও রহস্যময় লাগছে ৷ বনদপ্তরের অফিসকাছারি আর গোটা বিশেক কাঠের কুঁড়ে নিয়ে সান্ত্রাবাড়ির পরিসর বেশ ছোট্ট ৷ বনদপ্তরের কাজকর্ম আর অল্পস্বল্প চাষবাস করেই স্থানীয় ডুকপা ভুটিয়া ও রাজবংশীরা জীবিকা নির্বাহ করেন ৷ তবে এই শান্ত কোলাহলহীন বনবস্তিটিরই চরিত্র একেবারে বদলে যায় কমলালেবুর মরসুমে ৷ তখন সংলগ্ন ভুটানের বিভিন্ন বাগান থেকে টন টন কমলালেবু এনে জমা করা হয় সান্ত্রাবাড়ির বস্তিতে ৷ অরণ্যের সীমান্তেই বসে যায় অস্থায়ী আড়ৎ, হাটবাজার ৷ ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যাপারী আর কমলা বেচতে নামা পাহাড়িয়াদের দরদামে সরগরম হয়ে ওঠে নিঝুম জনপদটি ৷
ছোট্ট বিট অফিসের ঠিক পিছন থেকেই বক্সা পাহাড়ের উত্থান শুরু ৷ ওই পাহাড়ের গা বেয়েই উঠে গিয়েছে আমাদের গন্তব্য বক্সাদুয়ারের পাকদণ্ডী ৷ পাহাড়ে ইতিমধ্যেই অন্ধকার ছেয়েছে ৷ পথ অরণ্যসঙ্কুল, অচেনাও ৷ তাই বিট অফিসারই উদ্যোগ নিয়ে দুজন স্থানীয় তরুণকে আমাদের সঙ্গে দিলেন ৷ রাস্তা দেখানোর দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি তারা পিঠে বাঁধা বেতের ডোকোয় আমাদের মালপত্রও ভরে ফেলল ৷
শ-পাঁচেক ফুট উচ্চতার সান্ত্রাবাড়ি থেকে আড়াই হাজার ফুট উচ্চতার বক্সাদুয়ারের দূরত্ব চার কিলোমিটার ৷ পথ আগাগোড়াই চড়াই ৷ কোথাও কোথাও সেই চড়াইয়ের মাত্রা বেশ দুরূহ ৷ পাহাড় বেয়ে নেমে আসা একের পর এক লাগামহীন ঝোরা রাস্তা ভেঙেচুড়ে বক্সা-যাত্রা আরও শক্ত করে তুলছিল ৷ তবে, ইতিমধ্যে পুবের আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ উদ্ভাসিত হয়েছে ৷ মিশ্র পার্বত্য অরণ্যের চন্দ্রাতপের ফাঁকফোকর বেয়ে চুঁইয়ে নামছে চন্দ্রালোকের রুপোলি স্রোত ৷ বাতাস মুখর হয়ে রয়েছে বিভিন্ন রাতচরা পাখির ডাক আর ঝিঁঝির নিরবচ্ছিন্ন ঐকতানে ৷
গায়ে জ্যোৎস্না মেখে পাখির ডাকে কান ভরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সদরবাজার গ্রামে পৌঁছলাম ৷ পাহাড়ের কাঁধে স্লেটের চাল আর পাথরের দেওয়াল গাঁথা দশ-বারো ঘরের ছোট্ট গ্রাম ৷ সন্ধ্যা সাতটা নাগাদই সেখানে ঘুম নেমেছে ৷ গ্রাম ছাড়িয়ে পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই সামনে উদ্ভাসিত হল ইতিহাসগন্ধী বক্সা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ৷ তিনদিক ঘন অরণ্যাবৃত পাহাড়শ্রেণীতে ঘেরা এক চিলতে সমতলের ওপর ছড়িয়ে থাকা দুর্গের কঙ্কালটিকে সেই চন্দ্রালোকিত শরৎ-সন্ধ্যায় বড় মায়াময় দেখাচ্ছিল ৷
জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর-পূর্বে ভুটান ও আসামের সীমান্তে সিনচু লা পাহাড় ৷ সেই পাহাড়ের দক্ষিণে বক্সা এলাকা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ভুটানরাজদেরই দখলে ছিল ৷ ১৮৬৪ সালের ৭ ডিসেম্বর, দ্বিতীয় ভুটান যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী বক্সা দুর্গের দখল নেয় ৷ দুর্গ বলতে তখন ছিল গাছের গুঁড়ি দিয়ে ঘেরা এক চৌহদ্দি ও একটি সেকেলে চিনা কামান ৷ ভুটানিরা সে সবই ফেলে পুনাখা রোড দিয়ে পালিয়েছিল ৷ পরের বছর ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ভুটানের ‘সিনচু লা চুক্তি’ হওয়ার পরে পার্বত্য এলাকা আগলাতে বক্সাদুয়ারে স্থায়ী সেনানিবাস গড়ে তোলেন ইংরেজরা ৷ দুর্গ ঘিরে থাকা তিনদিকের পাহাড়ে বসানো হয় নর্থ-ইস্ট পিকেট, ম্যাগডালা পিকেট ও কনিকাল হিল পিকেট নামের তিনটি সেনাচৌকি ৷ বাহিনীর প্রয়োজনে ব্যারাক ছাড়াও গড়ে তোলা হয় অফিসারদের পরিদর্শন বাংলো ‘লাল বাংলা’, ডাকঘর, স্কুল ইত্যাদি ৷ দুর্গ সীমান্তের বাইরে বসে সদরবাজার ৷ দুর্গের সামনে দিয়ে প্রবাহিত বক্সা ঝোরার দুটি প্রবাহই তখন জলের প্রয়োজন মেটাত ৷ সেই জলধারা একইভাবে বইছে, বাকি সবটাই স্মৃতি ৷
১৯৩০ সালে দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার জেরে বিপ্লবীদের কারারুদ্ধ রাখার জন্য সেনানিবাসটি সংস্কার করে ডিটেনশন ক্যাম্প খোলা হয় ৷ সেই সময় অনুশীলন সমিতির ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, যুগান্তর দলের সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের হেমচন্দ্র ঘোষ সহ অনেকেরই ঠিকানা হয়েছিল বক্সার বন্দীনিবাস ৷ স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জেরে ফের বক্সায় আটক হয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পরভেজ শাহিদি এবং আরও অনেকে ৷ ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সেনানিবাসটি ব্যবহৃত হয়েছিল চিনের তিব্বত দখলের জেরে দেশ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তুদের শিবির হিসাবে ৷ এরপর থেকেই অরক্ষিত সেনানিবাসটির টিনের চাল, অন্যান্য আসবাবপত্র, জলের পাইপ ইত্যাদি লুটপাট হয়ে যায় ১৯৭৭ সালে ৷ ১৯৮১ সালের ১১ মে বক্সা দুর্গের ধ্বংসাবশেষকে ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের মর্যাদা দেন সরকার ৷
রোদ ঝকঝকে সকালে ঘুম ভেঙে বক্সার অরণ্যময় রূপ আবার নতুন করে মনকে বিবশ করল ৷ আমরা রয়েছি বনবিভাগের ডর্মিটরিতে ৷ আদতে এটা ছিল বক্সা জেলের ডেপুটি জেলারের আবাস ৷ আমাদের ডাইনে পাহাড়ের ঢালে কাঁটাতারে ঘেরা বিশাল চত্বরে বক্সার বনবাংলো ৷ অবিকল গরুমারা চাপড়ামারির বনবিশ্রামাগারের আদলে তৈরি কাঠের বারান্দায় ঘেরা, দোতলা ৷ ঢালু টিনের চাল ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে সিটিং রুমের ফায়ারপ্লেসের চিমনি ৷ ডর্মিটরিটি সাদামাটা, বাহুল্যবর্জিত ৷ তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের গুণে বাংলোর চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে ৷
সাহেবি আমলের মোটা দেওয়াল, অ্যাসবেস্টসের চালের একতলা ডর্মিটরির সামনে সবুজ ঘাসে ছাওয়া এক টুকরো সমতলভূমি ৷ কিছুটা নিচে বক্সা ঝোরার জলতরঙ্গ ৷ পিছনে অরণ্যের ঠাসবুনোট ৷ বাঁয়ে কিছুটা দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুর্গের পাথুরে অবশেষ ৷ তার পায়ের কাছেই বেশ বড়সড় একটি মাঠ ৷ চতুর্দিকে পাহাড়ের দেওয়াল তোলা ডিম্বাকৃতি মাঠটি প্রথম দর্শনেই কোনও প্রাচীন অ্যাম্পিথিয়েটারকে মনে পড়িয়ে দেয় ৷ মাঠ পেরিয়ে দুর্গের মাথা ছাড়িয়ে দক্ষিণে দৃষ্টিগোচর হয় ডুয়ার্সের দিগন্ত বিস্তৃত সমতলভূমি ৷ কালচে সবুজ অরণ্যের মাঝে অজস্র নদীরেখার গেরুয়া আঁকিবুঁকি ৷
মাঠটি থেকেই দুর্গের সিঁড়ি উঠেছে ৷ সিঁড়ির পাশেই ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সুদৃশ্য স্মারকস্তম্ভ ৷ তার ওপরে খোদিত বক্সায় কারারুদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দেশে ১৯৩৯ সালে কবিগুরুর লেখা ‘প্রত্যাভিনন্দন’ কবিতাটি ৷ দুর্গের চত্বরে পা ফেলতেই অতীতের মুখোমুখি হওয়ার রোমাঞ্চে গা শিরশিরিয়ে উঠল ৷ আয়তক্ষেত্রাকার সমতলের ওপর ছাদহীন সার-সার ঘর দাঁড়িয়ে ৷ নীল নির্মেঘ আকাশ আর সবুজ অরণ্যের পটভূমিকায় যেন একদল গেরুয়া বসনধারী সন্ন্যাসী ৷ নোনা ধরে, বট-অশ্বত্থের চারা গজিয়ে অধিকাংশ ঘরের দেওয়ালও আর অক্ষত নেই ৷ শুধু আট নম্বর সেলটি এখনও প্রায় অবিকৃত ৷ সেই সেলের ফায়ারপ্লেসে শেষ কবে আগুন জ্বলেছিল কে জানে!
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন