অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বছর দশ-বারো আগে আমাকে যেতে হয়েছিল রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমায় ৷ অযোধ্যা থেকে শুরু করে দুই পর্যায়ে আমি ধনুষ্কোটি পর্যন্ত গিয়েছিলাম ৷
সাধারণ ভাবে ঘুরে বেড়াতে আমার যে খুব ভালো লাগে তা নয় ৷ ঘুরে বেড়াবার নেশা যাকে বলে, তেমন কোনও নেশা আমার নেই ৷ তবে, বিভিন্ন কাজে আমাকে বহু জায়গাতেই যেতে হয়েছে এবং সেই যাওয়া যে খুব খারাপ লেগেছে এমনও নয় ৷ বনবাসে বিসর্জিত হবার পর রামচন্দ্র যে দীর্ঘপথ অতিক্রম করেছিলেন-চিহ্ন ধরে ধরে আবার সেই পথটিকে পুনরাবিষ্কার -এই কাজটির মধ্যে রোমাঞ্চ ছিল, কিছু অ্যাডভেঞ্চারও ছিল ৷
মুশকিল হল, রামচন্দ্র বলে সত্যিই কেউ ছিলেন কি না, তিনি সত্যিই বনবাসে গিয়েছিলেন কি না, কোন পথে গিয়েছিলেন, এ সমস্ত নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে ৷ বাস্তবে কী ঘটেছিল তা তো আমার জানা নেই ৷ তবে, এই পথ পরিক্রমায় বেরনোর আগে আমাকে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করতে হয়েছিল ৷
যাত্রা শুরু করেছিলাম অযোধ্যা থেকে ৷ এখন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খারাপ লাগছে না কিন্তু তখন মনে হয়েছিল অযোধ্যাবাস খুব সুখের হবে না ৷ একেই তো শহরটা ভীষণ ঘিঞ্জি ৷ তার ওপর সেদিন রামনবমীর জন্য অসম্ভব ভিড় ৷ আমি এক সাধুর আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলাম ৷ হোটেল টোটেল ইত্যাদির ভালো ব্যবস্থা অযোধ্যায় ছিল না কাজেই সাধুর আশ্রমটি খুব ভালো না হলেও চলে গিয়েছিল ৷ অযোধ্যা থেকে শুরু করে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম -অর্থাৎ এলাহাবাদে, তারপর চিত্রকূট, মধ্যপ্রদেশের খানিকটা অঞ্চল -আমার প্রথম পর্যায়ের পরিক্রমা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ৷
আজকে পিছনে তাকিয়ে যখন ভাবি, মনে হয়, এই পরিক্রমণের মধ্যে একটা অন্য মাত্রা যোগ হয়েছিল ৷ নিছক ভ্রমণ তো এটা নয়, জায়গা দেখা নয়, একটা উদ্দেশ্যমূলক অনুসন্ধান ৷ এবং সেটা করতে গিয়ে আমার মধ্যে অন্যরকম একটা কিছুর সঞ্চার হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই ৷ আমি প্রথম আবিষ্কার করি, হিন্দিবলয়ের একটা বিশাল অংশ রামচন্দ্রকে যে এত জানে, কথায় কথায় রামচন্দ্রের এত উল্লেখ করে, এর পিছনে একজন কবির একটা মস্ত অবদান আছে ৷ তিনি কবি হিসাবে কত বড় সেটা বড় কথা নয় ৷ বড় কথা হচ্ছে, তুলসীদাস একজন ভক্ত এবং কবি ৷ রামচন্দ্রকে নয়, এই পরিভ্রমণে বেরিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম তুলসীদাসকে ৷
আমার আরেক মস্ত লাভ বিভিন্ন ধরনের মানুষের সান্নিধ্যলাভ ৷ সাধারণ মানুষ সবাই ৷ ছোট হোটেলওয়ালা, রিকশাওয়ালা, টাঙাওয়ালা, হোটেলের বয়-বেয়ারা-বাবুর্চি, এরকম আরও বহু মানুষ, যাদের সঙ্গে আমাকে যেচে আলাপ করতে হয়েছিল আমার পরিক্রমা সংক্রান্ত তথ্যের প্রয়োজনে ৷ আমার জীবনে এই সফরটাতে আমি পেয়েছি যাকে বলা যায় সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ ৷ আমার নিজের ভেতরে যে কতকগুলো অজ্ঞানতা ছিল, সেই অজ্ঞানতাও কেটেছে এই অভিজ্ঞতার ফলে ৷
গুহক রাজার রাজধানী শৃঙ্গবেরপুরে গিয়েছিলেন রামচন্দ্র ৷ কথা হল এই শৃঙ্গবেরপুরটা কোথায়! এলাহাবাদে আমি বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও জানতে পারলাম না ৷ কিন্তু ইউ পি ট্যুরিজমের একটি মেয়ে আমাকে শেষ পর্যন্ত একটা সন্ধান দিল ৷ এটা এলাহাবাদ থেকে ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরে ৷ বলল, কছৈড়ি থেকে বাস ছাড়ে ৷ সেখান থেকে লালগোপালপুরের বাসে চলে যান ৷ শৃঙ্গবেরপুর পথেই পড়বে ৷ বাসরাস্তা থেকে হাঁটাপথ ৷ টাঙাও পাবেন ৷
টাঙা অবশ্য ছিল না ৷ দীর্ঘপথ রোদের মধ্যে হেঁটে পৌঁছলাম শৃঙ্গবেরপুরে ৷ এত ক্লান্ত হয়েছিলাম যে ওখানে পৌঁছে প্রায় শুয়ে পড়ার মতো অবস্থা ৷ উত্তরপ্রদেশের মানুষরা অতি সরল এবং অতিথিবৎসল ৷ পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই ফল-টল পানীয় ইত্যাদি নিয়ে এল কয়েকটি ছেলে ৷
শৃঙ্গবেরপুরে নদী আছে-গঙ্গা, কিন্তু এই শৃঙ্গবেরপুরেই রামচন্দ্র এসেছিলেন কি না তা আমি জানি না ৷ নদী তার খাত বদল করে সরে আসতে পারে ৷ ঘাট আছে ৷ মন্দির আছে, ভালোই বসতি আছে ৷ সেখানে একটা খননকার্য চলছিল ৷ কুষাণ আমলের বা ওই সময়কার বহু নিদর্শন মাটি খুঁড়ে পাওয়া যাচ্ছে ৷ কিন্তু সেটা গুহক রাজার রাজধানী কি না সেটা তো বলার কোনও উপায় নেই ৷ ওখানে রামচন্দ্রের খড়ম আছে, মন্দির তৈরি আছে ৷ শৃঙ্গবেরপুর একটা তীর্থক্ষেত্রও হয়ে উঠেছে ৷ ভালোই লাগবে, তবু একটা খটকা থেকেই যায় যে সেটাই আসল শৃঙ্গবেরপুর কি না ৷
অযোধ্যাও তাই ৷ যে অযোধ্যাকে নিয়ে এত বিবাদ বিসম্বাদ সেই অযোধ্যাই যে আসল অযোধ্যা এ-কথা কে বলবে ৷ একটা কিংবদন্তী আছে যে সম্রাট বিক্রমাদিত্য অযোধ্যাকে পুনরাবিষ্কার করেন ৷ বিক্রমাদিত্য নাকি শিকারে গিয়েছিলেন, হঠাৎ দেখেন সরযূর ওপারে একজন কালো মানুষ কালো ঘোড়ায় চেপে নদীতে নামছে ৷ নদীতে নেমে সে ডুবে গেল, এপারে যখন উঠল তখন সেও সাদা তার ঘোড়াও সাদা ৷ তখন বিক্রমাদিত্য খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? সেই লোকটি উত্তর করল, আমি প্রয়াগরাজ ৷ মানে, প্রয়াগের দেবতা ৷ যত পাপীতাপী প্রয়াগের জলে স্নান করে, তাদের কলুষে আমি কালো হয়ে যাই ৷ সেটা পরিষ্কার করার জন্যই আমি সরযূতে ডুব দিই ৷ এরপর প্রয়াগরাজ বিক্রমাদিত্যকে বললেন, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, এটাই হচ্ছে পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের রাজধানী অযোধ্যা ৷ তুমি এই নগরীকে পুনরুদ্ধার করবে ৷ কপিলা গাই বা ওরকমই স্বর্গের কোনও গাভী যেখানে যেখানে দাঁড়াবে এবং তার বাঁট থেকে দুধ ঝরে পড়বে বুঝবে সেখানেই প্রাচীন অযোধ্যার কোনও না কোনও চিহ্ন রয়েছে ৷ মজা হল, বিক্রমাদিত্য নিজেই এমন একটা চরিত্র যে মিথলজিতে তাকে যেমন ভাবে খুশি ব্যবহার করা হয়েছে ৷ সেই অর্থে রামচন্দ্রের বনবাসের পথটাও অনেকাংশে মিথ ৷ আমি সেই মিথকেই, মায়ামারীচকেই অনুসরণ করে গেছি ৷
তবে হ্যাঁ, চিত্রকূটে সেই পাহাড়টা তো আছে, যেখানে উনি বসবাস করতেন ৷ চিত্রকূট থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল বিশাল দণ্ডকারণ্য ৷ সে-সব গাছ সাফ হয়ে গেছে, অরণ্য নির্মূল হতে হতে ওড়িশার এক কোণে সামান্য কিছু জায়গায় টিকে আছে ৷ চিত্রকূট থেকে অবশ্য আর কিছু প্রামাণ্য নিদর্শন পাওয়া যায় না, আসলে চিত্রকূটে তেমন কোনও বসতি ছিলও না ৷
পঞ্চবটী, মানে নাসিকে সীতাগুম্ভা রয়েছে ৷ সেখান থেকেই নাকি সীতাহরণ হয়েছিল ৷ সেগুলো যদিও বিশ্বাসযোগ্য নয় ৷ তবে, নাসিকের তীর্থক্ষেত্র হিসাবে প্রসিদ্ধি রয়েছে, কারণ ওখানে কুম্ভমেলা হয় ৷ কিন্তু জলের অভাব ৷ শিপ্রা নদী একটা শুকনো নালার মতো বয়ে যাচ্ছে ৷ একটা বেসিন করে রাখা আছে ৷ লোকজন সেখানেই স্নান করে ৷
নাসিকে আরও একটা জিনিস দেখেছিলাম ওরা বলে পাণ্ডব গুম্ভা ৷ আসলে বৌদ্ধ শ্রমণদের গুহা ৷ পাহাড়ের ওপরে প্রায় হাজার খানেক ফুট ওপরে ৷ শ্রমণরা বেশ কষ্ট করেই থাকতেন সেখানে ৷ জলের অভাব ছিল ৷ বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য পাথরের চৌবাচ্চা তৈরি করে রাখা হয়েছিল ৷ বৌদ্ধরা চলে যাওয়ার পর এটাকে পাণ্ডবগুম্ভা নাম দিয়ে প্রচার করা হয় যে পাণ্ডবরা এখানে ছিলেন অজ্ঞাতবাসের সময় ৷ এইরকম বহু মিথ আমরা অল্প অনুসন্ধান করেই বাতিল করে দিতে পারি ৷ কিন্তু এটা বোঝা যায় যে ওই মিথগুলোর একটা প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর প্রবলভাবে রয়েছে ৷
তুঙ্গভদ্রার তীরে যেখানে এখন তুঙ্গভদ্রা বাঁধ তৈরি হয়েছে, সেখানে ছিল বিজয়নগর বাহমনি রাজ্য ৷ ও জায়গাটা এমনিতেই ভ্রমণকারীদের কাছে খুব প্রিয় ৷ বিজয়নগর-বাহমনি রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ ওখানে আছে ৷ দুর্লভ পাথর দিয়ে তৈরি নানারকম কনস্ট্রাকশন সেখানে রয়েছে ৷ অন্য একটা পাথর দিয়ে টোকা দিলে কোনওটা থেকে বাঁশির আওয়াজ হয়, কোনওটা থেকে মৃদঙ্গের আওয়াজ হয় ৷ একটা আস্ত পাথর কেটে রথ তৈরি করা আছে ৷ এখানেও মিথ আছে যে, সীতাহরণের সময় ওইখানেই রাবণের সঙ্গে জটায়ুর লড়াই হয়েছিল ৷ ওখানকার লোকেরা পাথরের দুটো দাগ দেখায়-একটা সোনালি দাগ একটা রুপোলি দাগ ৷ টানা চলে গেছে বহুদূর পর্যন্ত ৷ সে দুটো দাগ অবশ্য সত্যিই আছে ৷ জটায়ু রাবণকে আক্রমণ করলে রাবণ সীতাকে রথ থেকে নামিয়ে একটা গুহায় আটকে রেখেছিল ৷ সীতাকে টেনে আনার সময় গয়নার ঘষায় ওই সোনালি দাগটা পড়ে ৷ আর রুপোলি দাগটা পড়ে তাঁর শাড়ির ঘষায় ৷
এই জায়গাটাকে আমরা বলতে পারি কিষ্কিন্ধ্যা ৷ সেখানেই রাবণের সঙ্গে জটায়ুর লড়াই হয়েছিল এবং এখান থেকেই রামচন্দ্র বানরসেনা সংগ্রহ করেছিলেন ৷ কিন্তু এরপর থেকে রামচন্দ্রের পথের কোনও দিকনির্দেশ পাওয়া দুরূহ ৷ আর কোনও তীর্থক্ষেত্র পাওয়া যাবে না, যেখানে রামচন্দ্র বসবাস করেছিলেন বলে মিথ চালু আছে ৷
ধনুষ্কোটি-এখনকার রামেশ্বরমের কাছে ৷ এখান থেকেই রামচন্দ্র সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয় ৷ এখানে রামচন্দ্রের বসবাসের কিছু নিদর্শন দেখানো হয় ৷ ধনুষ্কোটি পর্যন্ত আগে ট্রেন যেত ৷ আমরা সে অবধি যেতে পারিনি ৷ কারণ ঝড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৷ রামেশ্বরম পর্যন্ত গিয়েছিলাম ৷
উত্তর ভারতে রামচন্দ্রের যে প্রভাব দক্ষিণ ভারতে তা কিন্তু নেই ৷ এই পরিক্রমায় আমি বেরিয়েছিলাম সম্পূর্ণ একা ৷ নিজের মালপত্র নিজেকেই বইতে হত ৷ খাওয়ার কষ্টও ছিল বেশ কিছু জায়গায় ৷ তবুও এটা আমার কাছে বেশ মনোরম স্মৃতি হয়ে আছে ৷
ভ্রমণ শারদীয় সংকলন, ১৯৯২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন