অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
খাদের ধার ধরে তরতর করে উঠে চলেছে নাসি ৷ পিছন থেকে বাবা ডেকেছে ‘আস্তে চলো নাসি, চোখের বাইরে যেও না’, নাসির বিকার নেই ৷ না থেমেই বলল, ‘আমি ফার্স্ট হব ৷’ বেগতিক দেখে বললাম, ‘নাসি, যারা ফার্স্ট হয় তারা পিছনের লোকেদের পথ দেখিয়ে চলে ৷ তুমি চলে গেলে আমাদের গাইড করবে কে?’ এবারে কাজ হল কিছুটা ৷ নেপোলিয়ানের মতো পিছনে হাত দুটো জড়ো করে নাসি ঘুরে দাঁড়াল ৷ বলল, ‘আমি সামনের গাইড, বাবা পিছনের গাইড’ ৷ যা বলে তাই সই, কিন্তু ওই একরত্তি মেয়ের খাদের ধারে ধারে মেঘের মতো গা ভাসিয়ে চলা, পা ফসকালে কম করেও এক-দেড়শো ফুট ৷ আসলে নাসির ধৈর্যহানির কারণ আছে কিছুটা ৷ টিফিন দাঁড়ার মাথায় উঠতে গাঁয়ের লোকেরা যে পথটা ব্যবহার করে, সেটা প্রায় সরাসরি মইয়ের মতো ওপরে গেছে ৷ আমরা শহরের লোক, পাকদণ্ডীর পথে ঘুরে ঘুরে হেঁটে চলেছি ৷ সামনে ছ বছরের নাসি ওরফে অহনা পাল আর পিছনে তার বাবা ৷ নাসি পর্বতকন্যা, রিশপ গ্রামের মেয়ে ৷ অতটা গড়িমসি আর দুপা গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের নামে হাঁফ ছাড়া তার সইবে কেন!
নাসি বা তার বাবা, খুব স্বাভাবিকভাবেই কেউই আদতে গাইড নয়, ওর বাবা বরং পথিকৃৎ ৷ ১৯৯৮ সালের নাম না-জানা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম রিশপে যখন প্রথম ট্যুরিস্টের পা পড়ে, তারা আশ্রয় পেয়েছিল পালবাবুরই জমিতে দুটো অস্থায়ী তাঁবুতে ৷ ডুয়ার্সের নতুন আকর্ষণ লাভা তখন সবে সেজে উঠেছে ৷ পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের থাকার জায়গাগুলো ছাড়া উঁকি মেরেছে হাতে গোনা কিছু বেসরকারি হোটেল ৷ পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে দিনকে দিন ৷ কিন্তু একটা সফল পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট যোগ্যতা সত্বেও একটা বিষয়ে লাভার সামান্য একটু অভাব ছিল ৷ লাভার জনবসতির মধ্যে থেকে দার্জিলিং জেলার পর্যটনের যেটা অমোঘ আকর্ষণ সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না ৷ অবশ্য লাভা থেকে সামান্য পুবদিকে সরতে থাকলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা সবান্ধবে একটু একটু করে ধরা দিতে থাকে, তবু ঘরের জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালে বা চৌকাঠ পেরোলেই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে হাতের সামনে পাওয়ার যে পূর্ণতা, সেটুকু বিলোতে লাভা বরাবরই অক্ষম ৷ যাদের পায়ে কিছুটা জোর আছে, তাদের আরেকটা উপায় ছিল লাভা থেকে সাড়ে তিন-চার কিলোমিটার হাঁটাপথে টিফিন দাঁড়ার মাথায় চড়া, যদিও কম লোকেই সে পথে পা বাড়াত ৷
নাসির বাবা পালবাবু তখন লাভায় একটা গেস্টহাউস চালান ৷ শিলিগুড়ির পর্যটন সংস্থা হেল্প ট্যুরিজম-এর উৎসাহ আর আগ্রহে ওই সংস্থারই সঞ্জীব সাহার সঙ্গে একদিন ভরা বাদলের মরসুমে দুজনে গিয়ে হাজির হলেন টিফিন দাঁড়ার উত্তর-উত্তর পূর্ব ঢালের ছোট গ্রাম রিশপে ৷ রিশপের ওপারে তখন সাদায় সাদা, ঘন মেঘে কাঞ্চনজঙ্ঘা তো দূরে থাক সামনের গ্রামগুলো পর্যন্ত ভালোমতো চোখে পড়ে না ৷ তবু জায়গাটা মনে ধরল দুজনেরই ৷ বিদ্যুৎ নেই, জলও পর্যাপ্ত নয় ৷ যেটা ছিল তা হল মেঘ কাটলেই কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিপূর্ণ আশ্বাস, যে মুখে একবার তাকালে অতি বড় যাযাবরেরও সর্বশান্তি ৷ তখন ১৯৯৮ সালের বর্ষার মাঝামাঝি ৷ দু-তিন মাসের মধ্যেই তাঁবু ফেলার বন্দোবস্ত হল পালবাবুর টুকরো জমিতে ৷ পুজো নাগাদ প্রথম ট্যুরিস্টের দল দুদিনের সংসার পাতল রিশপে ৷ দেখাদেখি এগিয়ে এলেন গ্রামের অন্যান্য লোকেরা ৷ পরের বছরের মধ্যেই গড়ে উঠল তিনটে স্থায়ী আস্তানা, পালবাবুর গা ঘেঁসে সুনাখারে, সামান্য নিচে নেমে কাঞ্চনভিউ ট্যুরিস্ট লজ আর পালবাবুর নতুন দুটো ছোট্ট বাড়ি ৷ গ্রামে ইকো ট্যুরিজম কমিটি হল, এই নতুন জীবিকার সঙ্গে ভালোভাবে গ্রামের জীবনযাত্রাকে জড়িয়ে নিতে ৷ ২০০১ সালের মধ্যে যোগ হল আরও দুটো নতুন রিসর্ট-লাভা অঞ্চলের গাবলু শেরপা আর পাসাং ওংমু-র উদ্যোগে নেওড়া ভ্যালি রিসর্ট, আর দ্বিতীয়টা কাঞ্চনভিউ-এর মালিক তরন গুরুং-এর ছোট ছেলের নিজস্ব হোটেল হেমলক ৷ হেল্প ট্যুরিজম-এর সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে বাণিজ্যিক সহায়তার হাত বাড়াল লিঙ্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস, খোরলো ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস, অন্বেষা গেস্টহাউস আর ‘সবুজের সন্ধানে’র মতো কিছু পর্যটন সংস্থা ৷ সবাই সম্মিলিতভাবে না চললেও, উদ্দেশ্যটা মোটামুটি একই পথে চলেছে ৷ এর মধ্যে থেকে ইকো ট্যুরিজমটা বড় হয়ে উঠবে তখনই যখন রিশপের ভাবী উন্নতির সিংহভাগটা গ্রামবাসীদের সংসারেই যাবে, আর সেটা পরিবেশের কোনওরকম অতিরিক্ত ক্ষতিসাধন না করেই ৷
নাসি এখনও বকবক করতে করতে আগে আগেই চলেছে ৷ টিফিন দাঁড়ায় ওঠার জন্য গ্রামের লোকেরা তাদের নিজস্ব পথে ২০-২৫ মিনিট সময় নেয় ৷ আমাদের মতো শহুরে পায়ে ঘুরপথে সেটা এক ঘণ্টা ৷ এই সংক্ষিপ্ত ট্রেক রুটটায় বেশ জংলী জংলী ভাব আছে ৷ প্রথম অংশটায় পাঁচমিশেলি পাহাড়ি জঙ্গল, দ্বিতীয় ভাগটায় ধুপিগাছের বনসৃজন ৷ ধুপি জঙ্গল আমাদের দেশের নিজস্বতা নয়, কিন্তু দেখতে বড় সুন্দর ৷ যে কোনও একটা গাছকে আলাদা করে দেখলে, ঘোর গ্রীষ্মকালেও ক্রিসমাসের কথাই মনে পড়বে ৷ ধুপি জঙ্গলের একটা বিশেষ চরিত্র হল নিচটা প্রায় পরিষ্কার, আর ছায়া ছায়া অন্ধকার ৷ দ্বিতীয় বিশেষত্বটা হল, গাছের জীবনীশক্তির তারতম্যে রঙের প্রভেদ ৷ একরাশ সবুজ গাছের পটভূমিতে দু-চারটে আধমরা গাছ জঙ্গলটাকে পুরো ক্যানভাস বানিয়ে রাখে ৷ নিতান্ত খিদেতেষ্টার মুখে বা পায়ে ফোস্কা না পড়লে ধুপি জঙ্গলে হেঁটে বেড়ানোটা বেশ সুন্দর অভিজ্ঞতা ৷ টিফিন দাঁড়ার চুড়োর চারপাশটা ঘিরে থাকা এই ধুপিবনটুকু পেরিয়ে হঠাৎই একটা দেড়মানুষ উঁচু চারচৌকো বাঁধানো চত্বর ৷ সেখানে দাঁড়িয়ে মুখ তুললে পায়ের কাছে আধখানা সিকিম আর দুচোখের সোজাসুজি কাঞ্চনজঙ্ঘার আকাশভরা লাবণ্য ৷ ব্রেকফাস্ট সেরে ওইটুকু উঠতে যেহেতু প্রায় দুপুর করেছি, কাঞ্চনজঙ্ঘা ইতিমধ্যেই প্রায় আধখানা ঘোমটা টেনে ঘুরে বসেছে ৷ দিনটা পয়লা জানুয়ারি, তাই আশপাশের গ্রাম থেকে বেশ কিছু ছোট ছোট দলে তরুণ-তরুণীরা কোঁচড়ে টিফিন বেঁধে সময় কাটাতে ওপরে এসেছে ৷ ঠিক এই কারণেই জায়গাটার নাম টিফিন দাঁড়া কিনা, সেটা প্রশ্ন করেও সদুত্তর পাইনি ৷ এরকমও হতে পারে হয়তো সঠিক লোককে জিজ্ঞাসা করিনি ৷
রিশপ শব্দটার মানে সম্বন্ধে কিন্তু স্থানীয় একজন কিছুটা আভাস দিয়েছেন ৷ এখানকার ভাষায় ‘রি’ অর্থে পাহাড়ের চূড়া আর ‘শপ’ মানে প্রাচীন গাছ ৷ সব মিলিয়ে বড় বড় পুরনো গাছে ঘেরা পাহাড়ের চূড়া ৷ সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে পারিনি, কিন্তু বিশ্বাস করে আশপাশের চেহারা থেকে বেশ সমর্থন পেলাম ৷ এই অঞ্চলটা এখনও অনেকটাই অস্পৃষ্ট নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে আছে ৷ রিশপের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বদিকের পাহাড়গুলো প্রায় পুরোপুরি জঙ্গলে ঢাকা ৷ আশপাশেও বসতির ফাঁকে ফাঁকে গভীর জঙ্গল-কোথাও প্রাকৃতিক স্বাভাবিক বন, কোথাও বা মানুষের হাতে তৈরি ছকে বাঁধা সরলবর্গীয় অরণ্য ৷ দার্জিলিং অঞ্চলের মতো বেশিরভাগটাই প্রায় নেড়া পাহাড় নয়, এখানে জঙ্গলটাই এখনও বলবান ৷ তবে উত্তরের নিচু পাহাড়গুলোতে আবার শুধুই জনবসতি, পেডং আর রেনকের পরিচ্ছন্ন প্রতিচ্ছবি ৷ পিছনে আরও দূরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সিকিমের ভূখণ্ড, পিছোতে পিছোতে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছে সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার পদপ্রান্তে ৷ উত্তর-পূর্বদিকে চোখে পড়ে নাথুলার প্রবাদপ্রতিম গিরিবর্ত্মের খাঁজ, তারও ডাইনে জেলেপলা ৷ আর ওরই সামান্য তলায় যেখানে গোলমতো পাহাড়টার মাথায় একটা পতাকা পতপত করে উড়ছে, ওখানে পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম আর ভুটান, এই তিন ভূখণ্ডের ত্রিবেণী ৷ তারই গা ঘেঁসে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের শীর্ষবিন্দু, রেচিলা ডান্ডার গর্বোদ্ধত শিখর যা ওই দুর্গম মহারণ্যের জাগ্রত প্রহরী ৷
রিশপ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বদিকের একটা ফাঁক দিয়ে লাভার গুম্ভাটা চোখে পড়ে ৷ লাভার উচ্চতা ২,১৮৪ মিটার, মানে সাত হাজার দুশো ফুটের সামান্য কম ৷ রিশপ আরও অন্তত পাঁচ-ছশো ফুট ওপরে ৷ লাভা থেকে রিশপ আসার হাঁটাপথটা ৪ কিলোমিটার মতো ৷ কিন্তু গাড়িতে আসতে গেলে আসতে হয় কালিম্পংয়ের পথে ছ মাইল ঘুরে মোট ১১ কিলোমিটার পথ ৷ এই গাড়ির রাস্তাটা যেখানে রিশপে ঢুকেছে সেখানে পরপর পাঁচটা রিসর্ট আর তার মালিকদের বসবাসের বাড়ি ছাড়া আর প্রায় কিছুই নেই ৷ গ্রামের অন্যান্য বাড়িগুলো পাহাড়ের গায়ে অনেকটা ওপরে নিচে দূরে দূরে ছড়ানো ৷ গ্রামের মধ্যে গাড়ি চলার রাস্তা নেই, শুধুই হাঁটাপথ ৷ শান্ত গ্রাম, গ্রামের গরুগুলো পর্যন্ত অচেনা মানুষ দেখলে ভয়ে ভয়ে খাদের ধারে নেমে গিয়ে পাশ দিয়ে দেয় ৷ গ্রামের জমিতে ধাপচাষ, কখনও ভুট্টা কখনও আলু কি অন্যান্য সবজি ৷ কোথাও বা দু-চারটে শীর্ণ আপেল কি নাসপাতি গাছ ৷ অসংখ্য ছোট ছোট পাখি ৷ গ্রামে কোলাহল বলতে ভোরবেলায় তাদের কলকাকলি, সেও ৩০-৪০ ফুট গাছের মাথা থেকে ৷
রিশপের সময়মতো চলতে গেলে রাতের খাওয়াটা আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে চুকে যায় ৷ বাইরে এসে বসলে দুরন্ত হিম ৷ এই জানুয়ারির শুরুতে রাতের শিশির জমে যায় ঘাসপাতায় ৷ সকালে যেখানে সূর্যের আলো পড়ে না, সেখানে গুঁড়ো ময়দার মতো অনেকক্ষণ ছড়িয়ে থাকে মাটিতে, কখনও বা আবার সন্ধে পর্যন্ত ৷ রাতের আকাশ মোহময় পরিষ্কার ৷ সিকিমের লোকালয়ে ঝলমল করে বিদ্যুতের বিন্দু বিন্দু আলো ৷ মনে হয় যেন আকাশ জোড়া ছায়াপথের ছায়া পড়েছে উত্তরের পাহাড় ঘেঁসা এক অলীক জলাশয়ে ৷ রেচিলার জঙ্গল উজিয়ে থালার মতো চাঁদ ওঠে আদিগন্ত প্লাবিত করে ৷ নতুন সাজে সেজে ওঠে তাপসী রিশপ-নির্জনতাই যার একমাত্র বিনোদন ৷
ভ্রমণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন