অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
গত বছর নভেম্বর মাসের প্রথমে গিয়েছিলাম উত্তর সিকিমের গুরুদোংমার ৷ আমরা পাঁচজন সমতলের বাসিন্দা, গাইড-বেঞ্জামিন গুরুং এবং গাড়ির চালক ছোকদুপ লাচেনপাকে (লাচেনপা কথার অর্থ লাচেনের ছেলে) সঙ্গী করে ইয়ুমথাং ইউমেসামডাং ঘুরে যাত্রা করি লাচেনের উদ্দেশে, লক্ষ্য ছোপতা উপত্যকা এবং গুরুদোংমার হ্রদ ৷
সকালে লাচুং থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম ঝকঝকে রোদ্দুর গায়ে মেখে আর লাচেন পৌঁছলাম তুষারপাতের মধ্যে ৷
৯,২০০ ফুট উচ্চতায় লাচেনে যখন পৌঁছলাম, তখন চারদিক মেঘে ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন ৷ তীব্র ঠান্ডা হাওয়া, সব নিস্তব্ধ নিঝুম ৷ রাস্তা বরফ ও কাদায় মাখামাখি ৷ কোথাও কোনও জনমানুষের চিহ্ন নেই ৷ কিছুদূর এগিয়ে আমাদের গাড়ি দাঁড়াতেই বিশাল বিশাল লোমওয়ালা কুকুর এগিয়ে এল ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করে, আর সেই শব্দে ইতিউতি মানুষের উঁকিঝুঁকি ৷ এমন সময় ওপর থেকে একটি মিলিটারি জিপ নেমে এল আমাদের অবাক করে-জিপের মাথায় অন্তত এক ফুট বরফ জমেছে ৷
আজকে আমাদের বিরতি লাচেনে-ছোকদুপের বাড়িতে ৷ গত তিনদিনের ভ্রমণে ছোকদুপ এখন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৷ সে স্থানীয় বাসিন্দা ৷ এখানে এবং থাঙ্গুতে তাদের একটি করে বাড়ি আছে ৷ থাঙ্গু হল তার মা-বাবার গ্রীষ্মকালীন আবাস ৷ লাচেনে চার-পাঁচটা থাকার জায়গা আছে কিন্তু ছোকদুপ আগেই আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিল তার মা-বাবা এখন থাঙ্গুতে, তাই বাড়ি ফাঁকা ৷ আমরা সানন্দে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম-এরকম একটা জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দার বাড়িতে থাকা এক সুন্দর অভিজ্ঞতা ৷
বেশ বড় চত্বর নিয়ে ওদের বাড়ি ৷ নিচের তলায় শীতের প্রস্তুতি হিসেবে জ্বালানি কাঠের ভাণ্ডার এবং পশুদের বাসস্থান ৷ কাঠের সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করলাম বৈঠকখানায়, এটাই ওদের রান্নাঘর, শীতে ঘর গরম রাখার জন্য এই ব্যবস্থা ৷ মেঝে জুড়ে সুদৃশ্য মোটা কার্পেট ৷ দেওয়ালের একদিকে টানা কার্পেটমোড়া সোফার মতো বসার জায়গা ৷ তিন দিকের দেওয়ালে তাকে রাখা ঝকঝকে বাসন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ৷ কিন্তু ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলো মুরগি এবং আস্ত দুটো ঠ্যাং চামড়া ছাড়িয়ে শুকনো অবস্থায় ঝোলানো ৷ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ঠ্যাং দুটি ইয়াকের এবং শীতের সময় খাওয়ার জন্য আরও সংগ্রহ করা হবে ৷ ছোকদুপ আমাদের চা খাইয়ে দুপুরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ৷
দুপুরে খাওয়ার সময় ছোকদুপের বাবা এসে হাজির থাঙ্গু থেকে, মিলিটারি ট্রাকে চেপে, জানালেন ওপরে ভীষণ তুষারপাত হচ্ছে ৷ তিনিও আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে যোগ দিলেন ৷ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতেই তাঁর নিচে আসা ৷ আমরা আগামীকাল গুরুদোংমার যাব জেনে খুশি হলেন এবং উনিও যদি আগামীকাল আমাদের সঙ্গে থাঙ্গু ফেরেন তাহলে আমাদের কোনও আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলেন ৷ আমরা শুনে অবাক, ওঁর বাড়িতে আমরা কোনও কিছু চিন্তা না করে দখল নিয়েছি, আর উনি নিজের ছেলের গাড়িতে থাঙ্গু যাবেন তার জন্য কত সাত-পাঁচ ভাবনা ৷
খাওয়ার পর ছোকদুপ ও তার বাবা বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে থাকায় দুপুর ও বিকেলে আমরা ঘরেই বন্দী হয়ে রইলাম ৷ লাচেনে কিছুই দেখা হল না ৷ ঘরে বসে আগামীকালের যাত্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম ৷ সন্ধের মুখে ওঁরা ফিরে এসে জানালেন এই আবহাওয়া হচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা, সকালে দেখবেন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে ৷ এরপর আমাদের নিয়ে ছোকদুপের বাবা গেলেন উপাসনাগৃহে-বুদ্ধমূর্তি পদ্মাসনে বসা, তার নিচে বিভিন্ন সময়ের লামার ছবি প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত ৷ ঘরের দেওয়ালে মুখোশনৃত্যে ব্যবহৃত কিছু মুখোশ এবং দেওয়াল চিত্রণ ও কিছু পুথি ৷ শান্ত, স্নিগ্ধ, গম্ভীর পরিবেশ ৷ আমাদের বসতে বলে নিষ্ঠার সঙ্গে নিচু স্বরে অনর্গল বৌদ্ধমন্ত্র উচ্চারণে মগ্ন হলেন ৷ মন্ত্রপাঠ শেষ হতে আমাদের দেখে স্মিত হেসে কফি পানের আমন্ত্রণ জানালেন ৷
আমাদের উপলক্ষ করেই জ্বালানো হয়েছে বড় উনুনটি, এতে ঘরটি খুবই আরামপ্রদ হয়েছে ৷ আমরা উনুনকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে কফি হাতে বসে গল্পে মেতে উঠলাম ৷ সে এক অদ্ভুত অনুভূতি-বাইরে নিকষ অন্ধকার, অবিরাম বৃষ্টি ও হাওয়ার শব্দ ৷ ভেতরে কজন উনুনের আগুনের আলোতেই উদ্দীপ্ত ৷ আমরা অবাক হয়ে শুনছিলাম ছোকদুপের বাবার জীবনসংগ্রামের কথা ৷ নানা লৌকিক ও অলৌকিক কাহিনী ৷ জানালেন, শীতের সময় লাচেন চলে যায় ৪-৫ ফুট বরফের নিচে, সেই বরফ থাকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৷ এখন ফৌজিদের আনাগোনায় রাস্তা পরিষ্কার থাকে ঠিকই কিন্তু ছোটবেলায় শীতে তাঁরা তুষারপাতে অবরুদ্ধ হয়ে যেতেন পুরোপুরি ৷ তখন পাকা সড়ক ছিল চুংথাং পর্যন্ত ৷ সেখান থেকে লাচেন হয়ে থাঙ্গু ছিল হাঁটাপথ ৷ জঙ্গল ছিল আরও ঘন ৷ তখন তিনি বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তেন সেই বিপদসঙ্কুল পথে ৷ তখন জীবনযাত্রা ছিল অন্যমাত্রার ৷ গল্পে গল্পে রাত হয়েছে বুঝতে পারলাম ছোকদুপের খাওয়ার তাড়ায় ৷ খাওয়া সেরে বাইরে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি দেখে আমরা ভীত হয়ে পড়লাম-তীব্র কনকনে ঠান্ডা আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ৷ আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি দেখে একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে শুতে গেলাম ৷
ঘুম ভাঙতেই টর্চের আলোয় সময় দেখলাম ভোর ৪টে, চারদিকে কল্পনাতীত নিস্তব্ধতা, আজই আমাদের গুরুদোংমার যাওয়ার কথা, একরাশ কৌতূহল নিয়ে চুপিসারে দরজা খুলে বেরতেই এক অবাক বিস্ময় ৷ আকাশ তারায় ভর্তি, বৃষ্টি থেমে গেছে ৷ কাল লাচেন পৌঁছে থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় কিছুই নজরে আসেনি, দেখি আশপাশের পাহাড়গুলো তুষারশুভ্র ৷ গাছের পাতায় পাতায় তুষার জমেছে ৷ সে এক অসাধারণ অনুভূতি ৷ তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷ এই অবস্থায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসতে চাইল না, মনে ভীষণ আনন্দ-গুরুদোংমারের পথের আবহাওয়াও নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে ৷ এপাশ ওপাশ করে আরও কিছু সময় কাটিয়ে বন্ধুদের সবাইকে ঘুম থেকে ওঠালাম ৷ বাইরে এসে সকলেই খুশি ৷ ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে ৷ সকাল ৬টার মধ্যে আমরা সবাই তৈরি হয়ে যাত্রা শুরু করলাম গুরুদোংমারের উদ্দেশে ৷ প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও ঝকঝকে সোনা রোদ্দুরে হাত পা ছড়িয়ে লাচেন গ্রাম, সকলেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে গতকালের জড়তা কাটিয়ে ৷
লাচেন থেকে কিছুটা এগিয়ে বেশ কিছু নিচে নেমে আমরা জেমু চু (চু মানে নদী) পার হলাম ৷ এই নদীর পার ধরেই বাঁদিক ঘেঁসে ঘুরে গেছে গ্রিনলেকের বিখ্যাত ট্রেকরুট ৷ নদী পার হয়েই গাড়ি উঠতে শুরু করল ৷ গতকালের বৃষ্টিতে সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার, তার ওপর শেষ রাতের বৃষ্টি ভোরের ঠান্ডায় তুষারে পরিণত হয়েছে ৷ যত ওপরে উঠছি পাহাড়ের চূড়াগুলো তত কাছে আসতে থাকে ৷ সবই তুষারপাতে সাদা ৷ ক্রমে আমরা ZEMA-1,2,3 অতিক্রম করলাম ৷ জায়গাটি অপেক্ষাকৃত সমতল এবং এগুলি মিলিটারিদের যাতায়াতের পথে থাকার জায়গা ৷ এরপর আমাদের গাড়ি ভয়ঙ্কর চড়াই ভাঙতে শুরু করল ৷ ছোকদুপের গাড়ি চালানোর পটুতায় আমরা মুগ্ধ ৷ প্রতিটি তীক্ষ্ম বাঁক যেন তার মুখস্থ ৷ প্রায় ১০ কিলোমিটার চড়াই ভাঙার পর এসে পৌঁছলাম সামাথাং গ্রামে ৷ এখানে দেখি সব কিছুই তুষারে মোড়া ৷ সামান্য একটু চা-পানের বিরতি ৷ ৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম ইয়াথাং-উচ্চতা ১২,২০০ ফুট ৷ ক্রমশ গাছপালা কমতে শুরু করেছে, আরও ৩ কিলোমিটার এগিয়ে কালেপ চু অতিক্রম করে পৌঁছলাম কালেপ গ্রামে ৷ সাদায় সাদা-যেদিকে তাকাই শুধুই সাদা ৷ যতগুলি গ্রাম পেরিয়ে এলাম, লক্ষ করলাম সকলেই প্রস্তুতি নিচ্ছে শীতের আগে নিচে নামার ৷ যাদের লাচেনে ঘরবাড়ি আছে তারা সেখানেই শীত কাটাবে আর যাদের নেই তারা আরও নিচে নেমে যাবে ৷ কালেপেও রয়েছে একটি মিলিটারি ছাউনি ৷ কালেপ ছাড়তেই আমাদের গাড়ি বরফে স্লিপ করতে শুরু করল ৷ আগের জমা বরফ তাই শক্ত হয়ে গেছে ৷ অতি উৎসাহী হয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুলতে গিয়ে আছাড় খেলাম ৷ এই হঠকারিতার জন্য বকুনিও খেলাম ছোকদুপের বাবার কাছ থেকে ৷ অতি সন্তর্পণে গাড়ি চালিয়ে ৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আমরা থাঙ্গু গ্রামে পৌঁছলাম ৷ গ্রামে ঢোকার আগে ছাউনি হেলিপ্যাড ৷ এখানেই ৩ বছর আগে হিমপ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বেশ কিছু ভারতীয় জওয়ান ৷ ডানদিকে রয়েছে তাঁদের উদ্দেশে স্মৃতিফলক ৷ সামরিক এলাকা শেষ হতেই শুরু হল গ্রাম ৷ প্রত্যেক বাড়ির ছাদ সাদা মুকুটে সজ্জিত হয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ৷ থাঙ্গুকে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম মনে হল ৷ গ্রামবাসীদের প্রায় প্রত্যেকেরই লাচেনে বাড়ি আছে ৷ থাঙ্গুতে তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস, উদ্দেশ্য চাষাবাদ ও ইয়াকের প্রতিপালন ৷
থাঙ্গু গ্রাম ছাড়িয়ে লাসা চু পার হয়ে কিছুটা দূরে ছোকদুপদের বাড়ি চেবুক উপত্যকায়, বেশ নির্জন জায়গায় কয়েকটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে বসতি ৷ ছোকদুপের মা ছেলেকে পেয়ে ভীষণ খুশি ৷ আমাদের আপ্যায়ন করে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন ৷ সকলের হাতে ধরিয়ে দিলেন বিস্কুট ও ধূমায়িত চা ৷ ছেলেকে পেটপুরে খাইয়ে আমাদের তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করিয়ে দিলেন গুরুদোংমার ঘুরে আসতে, কারণ বেলা বাড়লে আবহাওয়া খারাপ হতে পারে, গতকাল দুপুর থেকে সারা রাত এখানে তুষারপাত হয়েছে ৷ কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে রাস্তা উঠে গেছে ছোপতা উপত্যকায় ৷ আমরা এগিয়ে চললাম বরফের রাজ্যের বুক চিরে, পাশে বহমান নদীর গতি শ্লথ, আর কয়েকদিনের মধ্যেই জল জমে বরফ হয়ে যাবে, মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ ৷
থাঙ্গুর পর আর কোনও গ্রাম নেই, সবই সামরিক আওতায় ৷ ৬ কিলোমিটার চলার পরে এল ইয়ংডি, উচ্চতা ১৪,২০০ ফুট, মাল রাখার ছাউনি, গাড়ির গ্যারেজ আর একটি চেকপোস্ট ৷ থাঙ্গু পর্যন্ত পারমিট অতি সহজেই মেলে কিন্তু তার বেশি এগোতে গেলে প্রয়োজন বিশেষ অনুমতির, যা আমাদের গাইড গ্যাংটক থেকেই নিয়ে রেখেছিল ৷ পারমিট খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে আমাদের এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন ৷ পৌঁছলাম গোগং, সামরিক সূচনায় এই জায়গার নাম লগরেপ, উচ্চতা ১৫,০০০ ফুট, এখানেই এই পথের শেষ চেকপোস্ট যা আসাম রাইফেলস-এর তত্বাবধানে রয়েছে ৷ অফিসার দাঁড়িয়েই ছিলেন, আমাদের বাংলায় কথা বলতে শুনে দাসবাবু নিজের পরিচয় দিয়ে ভাব জমালেন ৷ তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে বললেন ৷ আবহাওয়া যে কোনও সময়ে খারাপ হতে পারে, তাই বিলম্ব নয় ৷
চেকপোস্ট পেরিয়ে ধীরগতিতে শুরু হল অন্তিম লক্ষ্যে যাত্রা ৷ বরফের মাত্রা কমতে থাকল ৷ ৪ কিলোমিটার দূরে পৌঁছলাম বরফহীন শুষ্কশীতল বালুকাময় প্রান্তরে ৷ দূরে একটি তুষারশুভ্র চূড়া দেখা যাচ্ছে আর আশপাশে দুয়েকটি টিলার মতো পাহাড়, বাকি সবই সমতল ৷ মনে হচ্ছে সব পাহাড় পেরিয়ে অন্য কোনও জগতে চলে এসেছি ৷ মাঝে মধ্যেই বিচ্ছিন্ন তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা জায়গা দেখে ছোকদুপকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলাম ওগুলি মাইন পোঁতা আছে ৷ যুদ্ধ লাগলে তারকাঁটাগুলো খুলে নেওয়া হবে ৷ এই অঞ্চলের ইয়াকদের বাঁচাবার জন্যই এই ব্যবস্থা ৷ দিগন্তবিস্তৃত শীতল মরুপ্রান্তরের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে ৷ রাস্তার নির্দিষ্ট কোনও সীমারেখা নেই ৷ পাকা রাস্তা বহু পূর্বেই শেষ করে এসেছি ৷ মেঠো পথের মতো একই রকম রাস্তা এদিকে ওদিকে অনেকগুলি চলে গেছে, ওগুলি জওয়ানদের ব্যবহৃত পথ বিভিন্ন পয়েন্টে যাওয়ার জন্য ৷ বিস্তীর্ণ সমতল অঞ্চল দিয়ে তিস্তা নদী চোলামো থেকে উৎপন্ন হয়ে ধীরগতিতে বয়ে চলেছে কুল কুল শব্দে ৷ এই নদীকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ইয়াক বিচরণক্ষেত্র ৷ অনিন্দ্যসুন্দর এই জায়গাটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে প্রায়শই, মরুঝড়ের সময় ইয়াক চরাতে আসা লোকজনদের তখন মাটিতে মুখ গুঁজে তুষার কণা ও নুড়িপাথর থেকে রক্ষা পেতে হয় ৷ বড় কঠিন এই শুষ্ক, শীতল ও নির্জন অঞ্চলের জীবনধারা ৷ আমরা গোগং থেকে যে তুষারশুভ্র পাহাড়চূড়া দেখেছিলাম অবশেষে পৌঁছলাম তার পাদদেশে ৷ ২২,০০০ ফুট উচ্চতার এই পাহাড়টির স্থানীয় নাম গেউখা-সিকিমবাসীদের কাছে খুবই পবিত্র স্থান ৷ আমরা দাঁড়িয়ে ১৭,০০০ ফুট উচ্চতার বালুকাময় প্রান্তরে, মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ তারই মাঝে দৃশ্যমান আপাদমস্তক বরফে আবৃত পাহাড়গুলি ৷ এই বিহ্বলতা কাটল ছোকদুপের ডাকে-আর দেরি নয়, এখনও ১০ কিলোমিটার পথ বাকি ৷
আমাদের গাড়ি এবার উত্তর থেকে পূর্বমুখী ৷ দূরে ডানদিকে সাদা বরফের পাহাড় নজরে এল, ওরই পাদদেশে আমাদের কাঙ্ক্ষিত হ্রদ গুরুদোংমার ৷ যতই কাছে যাচ্ছি ততই মনের ছটফটানি বাড়ছে-অবশেষে গাড়ি মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের পথ ধরল, সোজা পথ চলে গেছে চোলামো-তিস্তার উৎস ৷ কিছুটা চড়াই ভেঙে আমাদের গাড়ি থামল মন্দির প্রাঙ্গণে ৷ গাড়ি থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম, গাড়ি থেকে নেমে হ্রদের কিনারায় গেলাম, ত্রিকোণ আকৃতির ঘন নীল রঙের টলটলে জলের হ্রদ, হ্রদের পিছনে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে রুপোলি রঙের বরফাবৃত পাহাড় ৷ তাতে সূর্যের আলো পড়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত দ্যুতি ৷ ১৭,২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে ঈশ্বর যদি কোথাও থাকেন তবে এখানেই, বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় শাশ্বত শান্তির বাণী ৷
বিহ্বলতা কাটিয়ে গেলাম মন্দিরে, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মের পাশাপাশি অবস্থান ৷ মন্দিরে লামার সহযোগীর আতিথেয়তায় কিছু শুকনো খাবার সহযোগে চা পান ৷ সামান্য বিশ্রাম নিয়ে হ্রদের কিনারা বরাবর বোল্ডারের ওপর দিয়ে এগনোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু তীব্র ঠান্ডা হাওয়া ও উচ্চতায় হাঁফ ধরে আসছিল ৷ হ্রদ থেকে একটা ক্ষীণ ধারা ইয়ুম চু নাম নিয়ে গিয়ে মিশেছে তিস্তায় ৷ হাতে সময় ছিল, আবহাওয়াও অতি উত্তম ৷ ছোকদুপ আমাদের প্রস্তাব দিল চোলামো যাওয়ার জন্য, আমরা সানন্দে রাজি ৷ লামার সহকারীকে গাড়িতে চড়িয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল উত্তর-পূর্ব মুখে, কিছুটা দূর গিয়ে আবার দক্ষিণমুখী হলাম ৷ দিগন্তবিস্তৃত সমতল দেখে ভাবছিলাম পৃথিবীটা বোধহয় এখানেই শেষ ৷ সামরিক গাড়ির আনাগোনায় বুঝতে পারি চিন (তিব্বত) সীমান্ত এখান থেকে খুবই কাছে কিন্তু উত্তেজনা নেই ৷ বাঁদিকে রাস্তা গেছে বিখ্যাত সেসে-লার দিকে ৷ অবশেষে পৌঁছলাম চোলামো ৷ গুরুদোংমার থেকে অপেক্ষাকৃত বড় ডিম্বাকৃতির হ্রদ ৷ হ্রদ থেকে নীল জলের ধারা নির্গত হয়ে আপনমনে বয়ে চলেছে, এই হল তিস্তা নদী ৷ হ্রদের পিছন দিকে তুষারাবৃত পাহাড়শ্রেণী আগলে রেখেছে এই হ্রদ ৷ কিছুক্ষণ কাটিয়ে গুরুদোংমার ওই লামার সহকারীকে নামিয়ে দেবভূমিকে প্রণাম জানিয়ে শুরু হল ফেরার পালা ৷
ধীরে ধীরে গেউখাকে পিছনে ফেলে দুটি চেকপোস্ট পার করে পুনরায় আমরা প্রবেশ করলাম বরফের রাজ্যে ৷ চেবুক উপত্যকার কাছাকাছি এসে ডানদিকে ছোপতা উপত্যকার রাস্তা ধরলাম ৷ বেশ কিছুক্ষণ পর নজরে এল বিশাল এক বরফাবৃত সমতলক্ষেত্র-ছোপতা উপত্যকা ৷ এখানে রয়েছে ইয়াক প্রতিপালন ও প্রজননক্ষেত্র ৷ উপত্যকার গা বেয়ে এই রাস্তা চলে গেছে মুগুথাং-ছোকদুপের ভাষায় সে নাকি স্বর্গোদ্যান-হ্রদ, পাহাড়, নদী, উপত্যকা, বরফ, ফুল ইত্যাদি নিয়ে সে এক অসাধারণ জায়গা ৷ এই পথ ধরেই গাড়ির রাস্তা তৈরি হচ্ছে মুগুথাং যাওয়ার, বর্তমানে ট্রেক করে যাওয়া যায় তবে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন ৷ ভবিষ্যতে মুগুথাং যাওয়ার সুপ্ত বাসনাকে বুকে নিয়ে বিকেলের সোনালি রোদ গায়ে মেখে ফিরে এলাম চেবুক উপত্যকায় ছোকদুপের বাড়িতে ৷ আজ এখানেই আমাদের যাত্রার বিরতি ৷
ছোকদুপের মা আমাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন ৷ পৌঁছনো মাত্র সকলের হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন ৷ ধীরে ধীরে সন্ধে গড়িয়ে রাত নামল ৷ আকাশের তারাগুলিকে মনে হচ্ছে অনেক কাছে নেমে এসেছে ৷ বরফ থেকে এক অদ্ভুত দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়ে চারদিক উদ্ভাসিত করে রেখেছে ৷ আজ তার তুষারপাতের চিহ্নমাত্র নেই ৷ কিন্তু তীব্র ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকা গেল না ৷ স্বল্পপরিসর ঘরে টিনের মধ্যে কাঠকয়লা জ্বালিয়ে তাপ নেবার সুন্দর ব্যবস্থা ৷ ঠান্ডার কারণে রাতে ঠিকমতো ঘুম এল না ৷ আস্তে আস্তে ভোর হয়ে এল ৷ আবছা আলো আঁধারিতে তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতি দর্শনে ৷ হাতে বেশি সময় নেই, আজ সন্ধেবেলায় আমরা পৌঁছে যাব গ্যাংটকে ৷
গ্যাংটক থেকে স্থানীয় ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে এই ট্যুর হয়ে থাকে ৷ গুরুদোংমার যেতে হলে-দুরাত তিনদিনের প্যাকেজ, একই যাত্রায় ইয়ুমথাং গেলে-চাররাত পাঁচদিনের প্রয়োজন ৷ আমাদের পাঁচজনের দলে মাথাপিছু খরচ পড়েছিল ৪,৬০০ টাকা, আটজনের দল হলে খরচ কম ৷ এই খরচ গ্যাংটক থেকে গ্যাংটক ৷ গাড়িভাড়া, থাকা-খাওয়া সমেত ৷ অনেক খুঁজে তবেই বেঞ্জামিন গুরুংকে রাজি করাতে পেরেছিলাম গুরুদোংমার যাওয়ার জন্য ৷ এই পথে গাড়ির চালক লাচেনবাসী হলেই ভালো ৷
লাচুংয়ে বেশ কিছু ও লাচেনে চার-পাঁচটি থাকার জায়গা আছে ৷ আপনার ট্র্যাভেল এজেন্সি থাকার ব্যবস্থা করে দেবে, তবে থাঙ্গুতে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই ৷
যাবার সময়-এপ্রিল-জুন, যদি গুরুদোংমার যাওয়ার পথ বরফে বন্ধ না থাকে ৷ সেরা সময় শরৎকাল (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি) ৷
পারমিটের জন্য বিশদ জানতে যোগাযোগ করুন:
The Superintendent of Police
Check Post Division of the Sikkim Police Dept., Gangtok
আপনার পারমিট ট্র্যাভেল এজেন্সিই করিয়ে দেবে, তবে পরখ করে নেবেন ৷
আমাদের গাইড ও ড্রাইভারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন ৷
যোগাযোগের ঠিকানা:
গাইড: বেঞ্জামিন গুরুং, ফ্রেন্ডস ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস ডেভেলপমেন্ট এরিয়া
৯, শপিং কমপ্লেক্স, গ্যাংটক, সিকিম, %(০৩৫৯২) ২৭১১৮ (বাড়ি)
ড্রাইভার: ছোকদুপ লাচেনপা, প্রযত্নে, গিগডাল বিল্ডিং, আপার সিচে, গ্যাংটক
%(০৩৫৯২) ২৭৮০৬, ২৭৩২৫ (বাড়ি) ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন