অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
পঞ্চকেদারের মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম দ্বিতীয় এবং চতুর্থ কেদার অর্থাৎ যথাক্রমে মদমহেশ্বর এবং রুদ্রনাথ ৷ দুর্গম এই পাঁচ শৈবতীর্থে যেহেতু শীতকালে ভারি তুষারপাত হয় তাই মহাদেবের এই পঞ্চ রূপের শীতকালীন আবাস অপেক্ষাকৃত নিচের বিভিন্ন মন্দিরে ৷ সাধারণভাবে দীপাবলি থেকে অক্ষয় তৃতীয়া শীতের এই ছমাস কেদারনাথ এবং মদমহেশ্বর পূজিত হন উখিমঠে ৷ পাঁচটি কেদার প্রতি বছরে অক্ষয় তৃতীয়ার পরে তিথি অনুযায়ী পূর্বঘোষিত বিভিন্ন দিনে ডোলিতে চেপে গ্রীষ্মকালীন আবাসে পৌঁছে যান ৷ ডোলির বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করা জীবনের এক পরমপ্রাপ্তি ৷ পঞ্জিকা মতে, অক্ষয় তৃতীয়ার কয়েকদিন পরে দুটি তিথি অনুযায়ী দিন ধার্য থাকে শিব প্রতিষ্ঠার ৷ এর মধ্যে প্রথমটিতে কেদারনাথ এবং দ্বিতীয়টিতে মদমহেশ্বর খোলে ৷ এই বছরে মদমহেশ্বরের আরোহণপর্বের ডোলিযাত্রা উখিমঠ থেকে শুরু হয় ২২ মে ৷ মদমহেশ্বর মন্দিরে দেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় ২৪ মে ৷ সরকারিভাবে ওইদিন থেকেই মন্দির সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ৷ তার আগে এই বছর কেদারনাথের মন্দির খুলে যায় ১৭ মে ৷
২০ মে হৃষীকেশ থেকে সকাল আটটায় রুদ্রপ্রয়াগগামী বাসে চেপে শিবপুরী, বিয়াসি, দেবপ্রয়াগ, শ্রীনগর হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে যাই ঘণ্টাছয়েকে ৷ সবুজহীন আঁকাবাঁকা পাহাড়িপথে বাস চলতে থাকে ৷ দেবপ্রয়াগে ভাগীরথী এবং অলকানন্দা নদী মিলিত হয়ে গঙ্গার সৃষ্টি করেছে ৷ দেবপ্রয়াগের পর রাস্তা অলকানন্দার ধার ধরে এগিয়েছে ৷ রুদ্রপ্রয়াগে মন্দাকিনী এসে আছড়ে পড়ছে অলকানন্দার বুকে ৷ আধুনিক রুদ্রপ্রয়াগে একটা রাত কাটিয়ে, পরদিন সাতসকালে ভাড়া করা জিপে উখিমঠের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি ৷ উদ্দেশ্য মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রায় অংশগ্রহণ করা ৷
রুদ্রপ্রয়াগে অলকানন্দার ব্রিজ পার হয়ে মন্দাকিনীর ধার ধরে রাস্তা ৷ মস্ত বড় একটা টানেল পার হয়ে চওড়া মসৃণ রাস্তা সোজা চলে গেছে গৌরীকুণ্ডের দিকে ৷ সেখান থেকে কেদারনাথের যাত্রা শুরু হয় ৷ আমাদের গন্তব্য ভিন্ন ৷ আমরা একে একে অগস্ত্ব্যমুনি, সিয়ালসোর পেরিয়ে গুপ্তকাশীর কিছুটা আগে কুণ্ড থেকে মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের সুদীর্ঘ মহীরুহের ছায়াঘেরা পাকারাস্তা ধরে আরও পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে সটান পৌঁছে যাই উখিমঠের ভারত সেবাশ্রম সংঘের অতিথি আবাসগৃহের দোরগোড়ায় ৷ অগ্রিম সংরক্ষণ কলকাতা থেকেই করা ছিল ৷ জগন্নাথ মহারাজের আন্তরিকতায় বরাদ্দ হল বেশ বড়সড় একটা আরামদায়ক ঘর ৷ বর্তমানে উখিমঠে থাকার জন্য ভারত সেবাশ্রম সংঘের অতিথিশালার দ্বিতীয় কোনও বিকল্প পাওয়া যাবে না ৷ ঝকঝকে সাততলা সুবিশাল অতিথিশালাটি এককথায় অনবদ্য ৷ অন্তত শদুয়েক লোক থাকতে পারে ৷ প্রবেশপথ ছয়তলা দিয়ে, মন্দির চারতলায় ৷ ক্যান্টিন তিনতলায় ৷ ঘরের সামনের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হিমালয়ের দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি বহু নিচে সরু ফিতের মতো পুণ্যতোয়া মন্দাকিনী বয়ে চলেছে ৷ ঠিক তার গা ঘেঁসে পুল পেরিয়ে গৌরীকুণ্ডের দিকে রাস্তা চলে গেছে ৷ উখিমঠে ভারত সেবাশ্রম সংঘের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো ৷ সংঘের স্কুলে প্রচুর স্থানীয় ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে ৷ এছাড়াও নিষ্পাপ, হতদরিদ্র গাড়োয়ালি মানুষগুলোকে সাধ্যমতো সাহায্য করছেন ওঁরা ৷ সন্ধ্যায় সংঘের মন্দিরে গেলাম আরতি দেখতে ৷ কাঁসর-ঘণ্টা, ঢাকের বাজনায় মহারাজ নিজে আরতি করে ভজন গান করলেন ৷ মনটা ভরে উঠল ৷
মন্দাকিনীর দুদিকে পর্বতশিরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে দুটি জনপদ ৷ উখিমঠ এবং গুপ্তকাশী ৷ হাজার চারেক ফুট উচ্চতায় উখিমঠের পৌরাণিক নাম শোনিতপুর ৷ ক্রমে শোনিতপুরের নাম বদলে হয় ঊষামঠ ৷ কালক্রমে উচ্চারণভেদে ঊষামঠ হয় উখিমঠ ৷ শোনিতপুরের মঠে অর্থাৎ শিবমন্দিরেই বর্তমানে শীতকালে কেদারনাথ এবং মদমহেশ্বরের পুজো হয় ৷ বদ্রীনাথ-কেদারনাথ মন্দির সমিতির প্রধান কার্যালয়ও এই উখিমঠের মূল মন্দিরে ৷ সুবিশাল চত্বরে পাথরের তৈরি মন্দিরটি অতি সুন্দর ৷ মূল মন্দিরে শিবলিঙ্গ রয়েছে ৷ এছাড়াও ঊষা সহ বিভিন্ন দেবদেবীর অধিষ্ঠান এখানে ৷ পরদিন মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা শুরু হবে তাই সাজো সাজো রব ৷ কেদারনাথ আগেই চলে গেছেন ৷ মদমহেশ্বরের যাত্রী শুনে আনন্দিত পূজারী তৎক্ষণাৎ আমন্ত্রণ জানালেন ডোলিযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য ৷ আমরাও সানন্দে রাজি ৷
আগেরদিনই উখিমঠ বাজারের জিপস্ট্যান্ডে একটা জিপ ঠিক করে রাখা ছিল ৷ সকালবেলায় সময়মতো সেও হাজির ৷ দিন ছয়েকের মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাকি মালপত্র সংঘের ক্লোকরুমে রেখে পরম নিশ্চিন্তে রওনা দিলাম ৷ প্রথমেই গেলাম উখিমঠের মন্দিরে ৷ দেখি দেবতার পাল্কিবাহকেরা সুসজ্জিত হয়ে দেবতাকে ডোলিতে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত ৷ মাঙ্গলিক পূজার্চনার শেষে দেবতার ডোলিযাত্রা শুরু হয় ৷ ঢাকঢোল, কাঁসরঘণ্টা, শিঙা-সানাই বাজিয়ে ভগবান মদমহেশ্বর যাত্রা শুরু করলেন গ্রীষ্মাবাসের দিকে ৷ ফুলের মালা ও চন্দনে ডোলি সুসজ্জিত করা হল ৷ ডোলি যাবে একটু ঘুর পথে সব গ্রাম ঘুরে রাওলেঙ্খ হয়ে রাঁসি ৷ প্রথমদিনের গন্তব্যস্থল ৷ ডোলিযাত্রার সূচনা হতেই আমরা জিপে চেপে বসলাম ৷ জিপ ছুটল মনসুনা হয়ে যোগাসুর দিকে ৷ উখিমঠ বাজার পার হয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাকারাস্তা ৷ মনসুনা ছোট্ট একটা পাহাড়ি জনপদ ৷ দোকানপাট, হাটবাজার, বিদ্যুৎ সবই আছে ৷ মনসুনার পরে কাঁচারাস্তায় আরও পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে জিপ থামল একেবারে মদমহেশ্বর গঙ্গার ধারে ৷ এরপরে আপাতত যান চলাচলের উপযোগী কোনও রাস্তা নেই ৷ সামনেই মদমহেশ্বর গঙ্গা প্রবল গর্জনে বয়ে চলেছে ৷ নদীর ওপারে বাঁদিকে বহু উঁচুতে রাওলেঙ্খ ৷ নদী পার হয়ে সামনের ডানদিকে সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়েই পথ গিয়েছে মদমহেশ্বরের দিকে ৷ যোগাসু থেকে যাতায়াতে ন্যূনতম চারদিন আর সর্বাধিক ছয়দিন লাগে ৷ কঠিন চড়াইপথে পথচলার ক্ষমতার ওপরে যাত্রার দিনসংখ্যা নির্ভর করে ৷ পথে পড়বে উনিয়ানা, রাঁসি, আখতোলি, গোণ্ডার, বানতোলি, খাড়ারা, নানু, মাখামা প্রভৃতি গ্রাম ৷ ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসে প্রবল বর্ষণ এবং ভূকম্পনে যোগাসু এবং রাওলেঙ্খ গ্রামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ৷ মধ্যরাতের প্রবল ভূকম্পনে একটা আস্ত পাহাড় ভেঙে পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মদমহেশ্বর গঙ্গা বেশ কয়েকদিনের জন্য ৷ সৃষ্টি হয় সুবিশাল এক হ্রদের ৷ পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে যায় অজস্র ঘরবাড়ি, চাষের খেত, গবাদি পশু এবং অর্ধশতাধিক মানুষ ৷ এখন অবশ্য সেই হ্রদের কোনও অস্তিত্ব নেই ৷ নদী তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেয়েছে আবার ৷ এখন মদমহেশ্বর গঙ্গার ওপরে মস্ত বড় লোহার ব্রিজ তৈরি হচ্ছে ৷ বিপরীত দিকে জিপ চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি হচ্ছে রাঁসি পর্যন্ত ৷ আর কয়েক বছরের মধ্যেই যোগাসুর ব্রিজ পার হয়ে জিপ চলে যাবে রাঁসি পর্যন্ত ৷ ওপাশে গুপ্তকাশী থেকে কালীমঠ হয়ে রাওলেঙ্খে পথ এসেছে ৷ তবে দূরত্ব বেশি পড়ে বলে যোগাসুই প্রথম পছন্দ ৷ জিপ থেকে নেমেই দেখা হয়ে গেল রাওলেঙ্খের রাজিন্দর সিংয়ের সঙ্গে ৷ দৈনিক দেড়শো টাকার চুক্তিতে সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ ৷ এই পথে ঘোড়া-খচ্চর কিছুই পাওয়া যায় না ৷ বিশেষত মে-জুন মাসে ৷ যদিও বা কারও কাছে ঘোড়া থাকে এই সময়ে সেসব চলে গেছে গৌরীকুণ্ডে ৷
মদমহেশ্বর গঙ্গার ওপরে কাঠের গুঁড়ি ফেলা পায়ে চলা দুটি সাঁকো পার হয়ে বিস্তৃত পাথুরে অঞ্চল ৷ পাকদণ্ডীপথে রাস্তা ক্রমশ ওপরে উঠে গেছে ৷ ডানদিকে চৌখাম্বা দৃশ্যমান ৷ ঘণ্টাখানেকের কঠিন চড়াই ভেঙে রাওলেঙ্খ-রাঁসি মূলসড়কে উঠে আসি ৷ ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা পথ ৷ ওপর থেকে বহু নিচে তাকিয়ে দেখি মদমহেশ্বরের সুসজ্জিত রঙিন ডোলি যোগাসুর ব্রিজ পার হচ্ছে ৷ ডোলির জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি ৷ এক সময়ে শিঙা ফুকিয়ে, কাঁসর-ঢোল বাজিয়ে, রুপোর ধর্মদণ্ডে লাল-হলুদ পতাকা লাগিয়ে ডোলি এসে পড়ল ৷ সামনে ধ্বজাধারীর দল, দ্বিতীয় সারিতে ভগবানের ডোলি, পিছনে ঘোড়সওয়ার লাল ধুতি গেরুয়া জোব্বা পরিহিত প্রধান পূজারী ৷ পূজারী কর্নাটকের ব্রাহ্মণ ৷ নাম শ্রীরাজশেখরলিং ৷ সবার পিছনে অগণিত ভক্ত, স্থানীয় পুণ্যকামী মানুষ, পুলিশ, সাংবাদিক, মোটবাহক ৷ সব মিলিয়ে হৈহৈ ব্যাপার ৷ দ্রিমি দ্রিমি বাজনায় আমরাও পা মেলালাম ৷ আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠলাম ৷ হেলে দুলে ডোলি এগিয়ে চলে ৷ মূল বিগ্রহ সোনালি রঙের পাল্কিতে লাল-হলুদ সিল্কের কাপড়ে ঢাকা ৷ পাল্কির মাথায় রুপোর ছাতা ৷ ছাতার ওপরে রুপোর ছোট পতাকা ৷ একটি বেতের ডোলিতে বাঘছালে রাখা পুজোর উপকরণ ৷
পথ চলেছি আশি বছরের যুবক ত্রিলোক সিংজির সঙ্গে ৷ গোণ্ডারের লোক ৷ সুঠাম চেহারার একদা মেষপালক আমুদে ত্রিলোকজির জীবনে একটাই গর্ব যে উনি কোনওদিন ‘নোকরি’ করেননি ৷ তাঁর এক ছেলে বর্তমানে ভেড়বখরির দেখাশোনা করে এবং আরেকজন রাকেশ মদমহেশ্বরে চটির হোটেল চালায় ৷ ত্রিলোকজি খালি পায়ে হাঁটছেন ৷ অফুরন্ত দম ৷ মহারাষ্ট্রের এক প্রৌঢ় দম্পতি চলেছেন ডোলিযাত্রায় ৷ ওঁরা একযোগে পঞ্চকেদার পরিক্রমায় বেরিয়েছেন ৷ জিজ্ঞাসা করি, কেদারনাথ ছাড়াও যে আরও চারটে কেদার আছে সে খোঁজ পেলেন কোথা থেকে? আমার ভুল ভাঙিয়ে বেশ অবাক করে দিয়েই বললেন যে ওঁরা শ্রদ্ধেয় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন, কিন্তু ওঁর লেখা কোনও বই পড়েননি ৷ তবে ভারতবর্ষে বাঙালিদের পরে একমাত্র মহারাষ্ট্রের লোকেরাই বেশিমাত্রায় পঞ্চকেদার যাত্রা করেন বলেও জানালেন ৷ উত্তরাঞ্চলের গৌচরের দুই ছাত্র চলেছে ডোলিযাত্রায় ৷ তারা জানাল যে পাহাড়ের লোক হলেও এই পথে প্রথম আসছে তারা ৷ হঠাৎই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রায় যোগ দেবে বলে ৷ দেরাদুনের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি অফিসার উধম সিং নেগি একাই খালি পায়ে পথ চলছেন একেবারে ফৌজি মেজাজে ৷ উনি জানালেন, তাঁর বহুদিনের সাধ পূরণ হতে চলেছে ৷ ডোলি পৌঁছল উনিয়ানা গ্রামে ৷ গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা বরণ করে নিল দেবতাকে ৷ দেবতাও প্রত্যেকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দর্শন দিলেন ৷ উনিয়ানার বেশ কিছু লোক যোগ দিলেন মদমহেশ্বরের ডোলির শোভাযাত্রায় ৷ এই ফাঁকে আমরাও তাড়াতাড়ি চা-পান পর্ব চুকিয়ে নিলাম ৷ রাঁসি পর্যন্ত রাস্তা হালকা চড়াই ৷ প্রথমদিনের ট্রেক, তাই গতি বৃদ্ধি করতে অসুবিধা হচ্ছে ৷ ডোলির সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন ৷
আজ ২২ মে ৷ ডোলি যাবে রাঁসিগ্রাম পর্যন্ত ৷ ওখানে রাকেশ্বরীমাতার মন্দিরে ভগবান নিশিযাপন করবেন ৷ আমরা দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম ৷ একটা ধসপ্রবণ এলাকা সাবধানে পার হয়ে এগোতে থাকি চড়াইপথে ৷ ডোলি তখন কিছুটা পিছনে ৷ ডানদিকে অনেকটা নিচ দিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে খরস্রোতে মদমহেশ্বর গঙ্গা বয়ে চলেছে ৷ গাছপালা কেটে রাস্তায় পাথর ফেলে জিপ চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি হচ্ছে ৷ ঠিকাদারের লোক জানাল, আর বছর দুয়েকের মধ্যেই রাঁসিগ্রাম পর্যন্ত জিপ চলে যাবে ৷ তখন সর্বসাধারণের জন্য মদমহেশ্বর অনেকটাই সুগম হয়ে উঠবে ৷ রাঁসিতে প্রবেশের প্রথমেই বাঁদিকে মহেশ সিং বিস্ট-এর চৌখাম্বা হোটেল এবং লজ ৷ মালপত্র কোনওমতে নামিয়ে রেখে ক্যামেরা নিয়ে দৌড় দিলাম মূল গ্রামে ৷ আজ যেহেতু ভগবান এখানেই থাকবেন তাই সমগ্র গ্রামে উৎসবের মেজাজ ৷ শান্ত নিরিবিলি কৃষিনির্ভর রাঁসিগ্রাম যথেষ্টই বর্ধিষ্ণু ৷ পাহাড়ি সৌন্দর্যের মাঝে সুপ্রাচীন রাকেশ্বরী দেবীর মন্দিরের ভাবগম্ভীর পরিবেশে অগণিত স্থানীয় মানুষের ভিড় ৷ যথাসময়ে ভগবানের ডোলির শিঙার ধ্বনি ৷ গৃহবধূরা সেজেগুজে নতুন শাড়ি পরে যে যার দরজায় কুলোয় যব ও ধান নিয়ে এসে দাঁড়ায় ৷ দুর্গম পাহাড়ের অন্তঃপুরে সত্যিই এঁরা যেন ভগবানের আশীর্বাদে বেঁচে আছে ৷ মহাসমারোহে মদমহেশ্বরের ডোলি এসে দাঁড়ায় গৃহস্থের দুয়ারে ৷ গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি চলমান ডোলি হেলেদুলে নুয়ে পড়ছে মানুষ ভগবানের দিকে ৷ দুহাত ভরে ধানের অঞ্জলিতে মদমহেশ্বরকে ভরিয়ে দিচ্ছে গৃহবধূরা ৷ কোনও লোক মাথা নত করছে না, ভগবানই যেন মাথা পেতে মানুষের আশীর্বাদ নিচ্ছে ৷ ভগবানের এহেন জনমুখী কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হয়ে যাই ৷ সমগ্র গ্রামটি পরিক্রমা করে সকলের দুয়ারে দাঁড়িয়ে প্রতিটি গৃহস্থের অঞ্জলি গ্রহণ করে মদমহেশ্বরের ডোলি রাকেশ্বরী মন্দিরে প্রবেশ করে ৷ হেলেদুলে একাধিকবার মন্দির পরিক্রমান্তে ডোলিবাহকরা ভগবানকে মাটিতে নামিয়ে রাখে ৷ শুরু হয় পূজাপাঠ-হোমযজ্ঞ ৷ এ যেন দীপাবলি! গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে থালায় করে ধান, ফুল, তেল-হলুদ, সিঁদুর, চাল এবং ঘিয়ের প্রদীপ এসেছে ৷ মন্দিরের চত্বরে অগণিত অর্ঘে ঝিকমিক করে জ্বলছে প্রদীপ ৷ পূজারী রাজশেখরলিং ঘণ্টা বাজিয়ে শুরু করলেন আরতি ৷ ধূপের সুগন্ধে এবং ঘণ্টাধ্বনিতে চারদিক ভরে উঠল ৷ মন্দির চত্বরে তখন তিলধারণের জায়গা নেই ৷ ছোট ছেলেমেয়েরা রঙিন নতুন পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে পুজো দেখছে ৷ মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা উপলক্ষে তাদের কদিন স্কুল ছুটি ৷ রাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পূজারী জনার্দন ভট্ট বর্তমানে প্রয়াত ৷ তাঁর পুত্র ঈশ্বরীপ্রসাদ ভট্ট এখন একটি দোকান এবং হোটেল চালায় ৷
চৌখাম্বা লজের দোতলায় একটি ঘরে আশ্রয় মিলল ৷ খাওয়াদাওয়া ওখানেই ৷ সন্ধেবেলায় ত্রিলোকজি এলেন খবর নিতে ৷ খুললেন গল্পের ঝোলা ৷ খাঁটি পাহাড়ি মানুষটি খুব সহজেই আমাদের আপন করে নিলেন ৷ পেশাগত কারণে উপরি মদমহেশ্বর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি পথই ওঁর নখদর্পণে ৷ সন্ধে নামতেই ঠান্ডা বাড়তে থাকল এবং সেই সঙ্গে একরাশ মেঘ রাঁসিগ্রামকে (৬,৮৮০ ফুট) আচ্ছন্ন করল ৷ হ্যারিকেনের স্বল্প আলোতে ত্রিলোকজি শোনালেন বহুকাল আগে পানপাতিয়া হিমবাহ অঞ্চলে এক বাঙালি অভিযাত্রীর মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কাহিনী এবং আরেকবার নিজের ভেড়ার পাল রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রাতভর একটি চিতাবাঘের সঙ্গে মোকাবিলা করার গল্প ৷ উপস্থিত গ্রামবাসী সকলেই ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানিয়ে বললেন, যুবা বয়সে মনসুনার ওপরে ত্রিলোকজিই ছিলেন সবচেয়ে বড় কুস্তিগীর ৷ এখন বার্ধক্যজনিত কারণে রাতে চোখে একটু কম দেখেন ৷ পরদিন ডোলি যাবে সাত কিলোমিটার দূরে গোণ্ডার গ্রাম পর্যন্ত ৷ সেখানে ভগবান রাত্রিবাস করবেন ক্ষেত্রপালের মন্দিরে ৷ পরদিন আমরা যাব নানু পর্যন্ত ৷ রাঁসি থেকে নানুর দূরত্ব তেরো কিলোমিটার ৷
২৩ মে ২০০২, রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে ঢাকঢোল বাজিয়ে, শিঙা ফুঁকিয়ে আবার শুরু হল মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা ৷ রাঁসিগ্রামকে পিছনে ফেলে উতরাই পথে দ্রুত নামতে থাকি ৷ আখতোলি গ্রামের সবুজ খামারের মধ্য দিয়ে মসৃণ পথ ৷ সামনেই ওপরে সোজা দেখা যায় বরফাবৃত পাণ্ডুসেরা এবং নন্দীকুণ্ড ৷ শুরু হয় ঘন জঙ্গল ৷ আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি ৷ ডোলিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিই ৷ কারণ কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজে পাখির ডাক চাপা পড়ে যাচ্ছে ৷ পঞ্চকেদারের একমাত্র কেদারনাথ বাদ দিয়ে বাকি চারটি কেদারের মন্দির কেদারনাথ ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারির মধ্যে ৷ উখিমঠ থেকে যোশিমঠ পর্যন্ত উচ্চ হিমালয়ের প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে এর বিস্তৃতি ৷ চিরহরিৎ এই অরণ্যে বাঘ, চিতাবাঘ, ভালুক, হায়না ছাড়াও প্রচুর বারশিঙ্গা এবং কস্তুরীমৃগ রয়েছে ৷ মদমহেশ্বরের রাস্তায় মাঝে মাঝে বনবিভাগের চেকপোস্ট আছে ৷ বনকর্মীরা রাতে পাহারা দেয় ৷ কারণ কস্তুরীমৃগের জন্য ওই অঞ্চলে অবাধ চোরাশিকার চলে ৷ এই জঙ্গলের আরেক সম্পদ ভেষজ উদ্ভিদ এবং বিরল প্রজাতির পাখি ৷ চোরাশিকারীদের কাছে এর মূল্যও কম নয় ৷ ১৯৭২ সালে এই জঙ্গল অভয়ারণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পায় ৷
ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঝরাপাতায় ঢাকা সঙ্কীর্ণ উতরাই পথে নিচে নামতে থাকি ৷ গাছের ফাঁক দিয়ে বহু নিচে মদমহেশ্বর গঙ্গার সফেন জলরাশি চোখে পড়ছে ৷ স্যাঁতসেঁতে ঘন জঙ্গলের ছায়াঘেরা মোড়ে ভিমসি ঝরনার ওপরে কাঠের পুলে এসে পড়ি ৷ কয়েকশো ফুট ওপর থেকে বাঁদিকে সগর্জনে আছড়ে পড়ছে বহু নিচে শ্যাওলা সবুজ কুণ্ডে ৷ অপরূপ সেই দৃশ্য ৷ এগিয়ে চলার পথে জঙ্গল হয়ে ওঠে গভীর থেকে গভীরতর ৷ একটানা ঝিঁঝির ডাকের মাঝে হঠাৎ দেখি একটা স্কারলেট মিনিভেট পাখি ৷ উজ্জ্বল লাল ও কালো রঙে বাহারই তার আলাদা ৷ পথ চলতে চলতে হিমালয়ান ডিপার, লংটেল, ছোট ছোট ফ্লাইক্যাচার প্রভৃতি অজস্র পাখি চোখে পড়ে ৷ নিঃঝুম অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ চলার অনুভূতি অন্যরকম ৷ যেহেতু এই পথে লোকজন খুবই কম আসে তাই নেই কোনও হট্টগোল ৷ বেশ আরামে হেঁটে ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাই গোণ্ডারে (৬,০০০ ফুট) ৷ মদমহেশ্বর গঙ্গার একেবারে কোল ঘেঁসে গোণ্ডার এক প্রাচীন, শান্ত এবং বর্ধিষ্ণু গ্রাম ৷ গ্রামে ঢোকার মুখেই বাঁদিকে রমেশ পাঁওয়ারের কৈলাস ট্যুরিস্ট লজ ৷ প্রাতরাশের পর্ব চুকিয়ে ক্ষেত্রপালের মন্দিরে যাই ৷ মন্দিরটি কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িতে ৷ ভগবান মদমহেশ্বরকে ডোলি থেকে নামিয়ে পুজোপাঠ চলছে ৷ প্রধান পূজারী হাতে প্রসাদ তুলে দিলেন ৷ এদিকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হল ৷ বেগতিক দেখে লটবহর উঠিয়ে হাঁটা শুরু করি ৷ অল্প সময়েই এসে পড়ি বানতোলিতে (৬,১০০ ফুট) মার্কণ্ডেয় গঙ্গার ওপরের ব্রিজে ৷ চৌখাম্বা গিরিশৃঙ্গমালা ও তার আশপাশের শৃঙ্গের হিমবাহগলা জলে পুষ্ট উপরি গান্ধারপোঙ্গী বা মার্কণ্ডেয় গঙ্গা উপত্যকায় অবস্থিত সুজল সরোবর থেকেই মার্কণ্ডেয় গঙ্গার উৎপত্তি ৷ মার্কণ্ডেয় গঙ্গা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে উপরি মদমহেশ্বর অঞ্চলের পাণ্ডুসেরা, নন্দীকুণ্ড, কাচনি অঞ্চল থেকে বরফগলা জলে সৃষ্ট মদমহেশ্বর গঙ্গায় এসে মিলিত হয়েছে এই বানতোলিতে ৷ মার্কণ্ডেয় গঙ্গা এবং মদমহেশ্বর গঙ্গার সঙ্গমে অবস্থিত বানতোলি গ্রামটি সুন্দর ৷ এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা আছে ৷ এক সময়ে প্রখ্যাত পর্বতপ্রেমী, লেখক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বানতোলির রূপ এবং সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একটি গৃহ নির্মাণ করেন এখানে ৷ অকৃতদার উমাপ্রসাদ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর পরমবন্ধু তুলা সিংকে ৷ তুলা সিং বর্তমানে মৃত ৷ তুলা সিংয়ের উত্তরসূরি বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ৷ বাড়িটি বর্তমানে জীর্ণ, রাত্রিবাসের অনুপযুক্ত ৷ যাইহোক বানতোলির পরেই শুরু হল মদমহেশ্বরের প্রকৃত চড়াই পথ ৷ ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে মন্দাক্রান্তা ছন্দে ওপরে উঠে চলা ৷ পাইন, বাঁশ, দেবদারু, রডোডেনড্রনের ঘন জঙ্গল ৷ গাছের গুঁড়িতে ঘন শ্যাওলার প্রলেপ ৷ পাথরের গায়ে অজস্র ফার্ন ও অর্কিডের সমারোহ ৷ গাইড রাজিন্দার সিং মালপত্র নিয়ে অনেকটাই আগে ফতে সিংয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে খাড়ারা খালের দিকে এগিয়েছে ৷ ফতে সিং গোণ্ডারে রমেশ পাঁওয়ারের দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনে নিয়ে ওপরে উঠছে ৷ খাড়ারায় সে আজ তার চটির হোটেল খুলবে ৷ একদা মদমহেশ্বর গঙ্গা উপত্যকার শ্রেষ্ঠ ছাত্র বর্তমানে সংসার ছেড়ে বিবাগী ফতে সিং এখন কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ৷ ফলে তার দোকানে চা খেয়ে, ঘরে বসে আরাম করলেও সহজে তার চটির হোটেলে কেউ রাত কাটাতে চায় না ৷ খাড়ারায় উঠেই ডানদিকে বেশ সাজানো-গোছানো তার চটির হোটেল ৷ ফতে সিং নিজের হাতে চা বানিয়ে এনে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল ৷ মানুষটি বেশ ভালো ৷ খাড়ারায় কয়েক ঘর বসতি এবং একটি বনবাংলো আছে ৷ খাড়ারার দুর্দান্ত ল্যান্ডস্কেপ উপভোগ করতে করতেই বজ্রবিদ্যুৎ সহ তুমুল বৃষ্টি শুরু হল ৷ তীব্র ঠান্ডা হাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যে হাঁটা শুরু করলাম নানুর (৮,০০০ ফুট) উদ্দেশে ৷ প্রবল বৃষ্টির মাঝে শুরু হল দুর্দান্ত চড়াইপথে আরোহণ ৷ পথ যেন আর শেষ হতে চায় না ৷ ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে নানুতে এসে পৌঁছলাম পড়ন্ত বিকেলে ৷ নানুতে চটির হোটেলে স্থান বাড়ন্ত ৷ কারণ দুটি দল ওখানে দুদিন ধরে অপেক্ষা করছে ৷ নিয়ম অনুযায়ী মদমহেশ্বর মন্দিরে ডোলিতে ভগবান না পৌঁছলে জনসাধারণকে নানুর পরে আর এগোতে দেওয়া হয় না ৷ এই বিষয়ে ওখানে যথেষ্টই কড়া ৷ ত্রিলোক সিংজির বোনের বাড়ি নানুতে ৷ তাঁরই বদান্যতায় এবং গাইড রাজিন্দারের ব্যবস্থাপনায় ‘বহিনজি’ তাঁর সুসজ্জিত শোবার ঘরটি আমাদের ছেড়ে দিয়ে শিশুপুত্র-কন্যা সহ হাসিমুখে চলে গেলেন রান্নাঘরে ৷ বহিনজির ছোট কন্যা গোণ্ডারের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ফুটফুটে গঙ্গা ব্যস্ত হয়ে পড়ল অতিথি আপ্যায়নে ৷ সন্ধে নাগাদ বৃষ্টি থামল ৷ দিনভর পথচলার ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর ৷ মনে উৎসাহ জোগাতে ত্রিলোকজি আবার খুললেন তাঁর গল্পের ঝুলি ৷ জিজ্ঞাসা করলাম, সর্বসাধারণকে কেন ডোলি পৌঁছনোর আগের দিন পর্যন্ত মদমহেশ্বরে যেতে দেওয়া হয় না? উত্তরে জানালেন, মদমহেশ্বরের নাকি অনেক সম্পত্তি এবং গুপ্তধন আছে ৷ সেই গুপ্তধনের সন্ধান জানে নাকি গোণ্ডার গ্রামের মাত্র দুজন লোক ৷ তারা ছাড়া নাকি আর কেউ তার হদিশ জানে না এবং জানতেও দেওয়া হয় না ৷ তাই গোণ্ডারের ওই দুজন নাকি প্রতিবছরে দুয়েকদিন আগে মন্দিরে পৌঁছে সবকিছু বাইরে বার করে ভগবানের তরফে হিসাবনিকাশ করে ৷ তারপরে আবার যথাস্থানে রেখে দেয় ৷ দেবাদিদেব মদমহেশ্বর নাকি তাদেরই মাধ্যমে সবকিছু হিসাব বুঝে নিয়ে তবেই মন্দিরে পদার্পণ করেন ৷ ত্রিলোকজি আরও বলেন যে একবার সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে মন্দিরের গুপ্তকক্ষে যে সব সোনা-মণিমাণিক্য রয়েছে তার অডিট হবে ৷ কিন্তু দেখা যায়, যে সরকারি কর্মচারীই আসুন না কেন রাত পোহালেই পালিয়ে যায় ৷ সবশেষে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে প্রতি রাতে নাকি রাগী মহাদেব ত্রিশূল নিয়ে আসেন ৷ এই ঘটনার পরে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে আর হিসাব করার চেষ্টা করা হয়নি ৷
২৪ মে ২০০২ সাল ৷ হিমালয়ের অন্তঃপুরে একটা সুন্দর সকাল ৷ চারদিকে রোদ ঝলমল করছে ৷ স্বচ্ছ আবহাওয়ায় বহুদূরে গুপ্তকাশী স্পষ্ট দৃশ্যমান ৷ মদমহেশ্বরের মন্দির আজ খুলবে ৷ সাতসকালেই ডোলি রওনা হয়েছে গোণ্ডার থেকে ৷ আমরা ডোলিতে যোগ দেব মাঝপথে ৷ নানুর বেশিরভাগ মানুষই আজ মদমহেশ্বরের ডোলির সঙ্গে যাবে ৷ ছোট্ট গঙ্গাও তার দিদি আরতির সঙ্গে ডোলিযাত্রায় যাবে ৷ আমার ছোট্ট পুত্র সুমনকে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে ৷ নানুর লোকজন সবকটি পুণ্যার্থী দলকে বিদায় জানাতে ভিড় করেছে ৷ ত্রিলোক সিংজি একটি দুধেল গাভী ও তার বাছুরকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে রওনা হলেন মদমহেশ্বরের উদ্দেশে ৷ ওঁর দায়িত্ব পড়েছে মন্দিরের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মে যে দুধ লাগে তার জন্য গাভী পৌঁছে দেওয়ার ৷ ভারি আমুদে বৃদ্ধ মানুষটি খুব সহজেই আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে ওপরে উঠতে থাকলেন ৷ তখন আমরা প্রায় মাখামাগ্রামের কাছে, আবার সেই ঢাকঢোলের দ্রিমি দ্রিমি শব্দ ৷ মাখামাতে যোগ দিই ডোলিতে ৷ ‘জয় মদমহেশ্বর’ বলে জয়ধ্বনি দিয়ে পা মেলাই মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রায় ৷ গহন অরণ্যপথে কঠিন চড়াই ভেঙে এক সময়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তৃত সমতল, সবুজ বুগিয়ালের মধ্যে মদমহেশ্বরের মন্দির এবং সংলগ্ন দোকানপাট ৷ ডানদিকে তুষারাবৃত কাচনিখাল, পানপাতিয়া হিমবাহ অঞ্চল ৷ দক্ষিণ-পূর্বে বিসুরিটপ, বামদিকে বুড়ামদমহেশ্বরের সবুজ পাহাড়ি ঢাল ৷ পাথরের তৈরি সুপ্রাচীন মন্দিরের স্থাপত্য কেদারনাথের মতোই ৷ তবে একান্তভাবেই শান্ত ও নির্জন ৷ ডোলি এসে মন্দির থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়ে পড়ল ৷ অপেক্ষা, প্রথা অনুযায়ী মন্দির থেকে শাঁখ বাজিয়ে আবাহন সংকেত পাঠানো হবে ৷ অবশেষে শঙ্খধ্বনি শোনা গেল এবং ভগবান মদমহেশ্বর হেলেদুলে মন্দির প্রদক্ষিণ করে ভেতরে প্রবেশ করলেন ৷ উপস্থিত পুণ্যার্থীরা মদমহেশ্বরের জয়ধ্বনি দিয়ে পাহাড়ের অন্তঃপুর আলোড়িত করল ৷ পলকেই দোকানপাট খুলে গেল, শুরু হয়ে গেল কর্মব্যস্ততা ৷ পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করার মতো ৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবতাকে আসনে বসিয়ে শুরু হল পূজার্চনা ৷
আমরা স্থান করে নিলাম মন্দির-সমিতির অতিথিশালায় ৷ কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি ৷ ব্যবস্থা মন্দ নয় ৷ বিছানাপত্র আছে ৷ অতিরিক্ত লেপ-কম্বল চাহিদা অনুযায়ী মেলে ৷ তবে তার জন্য আলাদা মূল্য দিতে হয় ৷ ত্রিলোক সিংজি পুজোপাঠ সেরে আমাদের কুশল জেনে ফিরে গেলেন নানুর উদ্দেশে ৷ ধীরে ধীরে স্থানীয়রা সকলেই নিচে চলে গেল ৷ ভিড় কাটতে আমরা বেরিয়ে পড়ি মন্দির চত্বরে ৷ মন্দিরের সামনে দুটি ঝরনাধারা নালা কেটে নিয়ে আসা হয়েছে ৷ এটিই এখানকার একমাত্র পানীয় ও ব্যবহারের উপযোগী জল ৷ মদমহেশ্বর মন্দিরের পিছনদিকে উত্তর-পূর্ব কোণে দুটি ছোট মন্দির এবং একটি কুণ্ড আছে ৷ একটি পার্বতীর এবং অপরটি হরপার্বতীর ৷ কালো কষ্টিপাথরের তৈরি হরপার্বতী মূর্তিটি চতুর্ভুজ শিবের ৷ শিব প্রধান হাত দুটিতে একটি বীণা ধরে আছেন ৷ অপর দুটির ডানহাতে ত্রিশূল এবং বামকর দেবী পার্বতীর অঙ্গে ৷ উৎকুটিকাসনে বদ্ধ শিবের ডান পা ৷ দক্ষিণা মূর্তি শিবের বামকোলে পার্বতী ৷ হরপার্বতী উভয়েরই জটামুকুট ৷ পার্বতীর বাঁহাতে দর্পণ এবং ডানহাত শিবের কণ্ঠলগ্ন ৷ দেবীর অঙ্গে অলঙ্কার এবং মহাদেবের সর্পভূষণ ৷ শিবের পায়ের কাছে বৃষ এবং পার্বতীর বাহন সিংহ ৷ দক্ষিণ কোণে গণেশমূর্তি এবং বামকোণে কার্ত্তিকেয়র মূর্তি ৷ সুবিশাল বাঁধানো চত্বরের কেন্দ্রবিন্দুতে মূল মন্দিরটি ৷ অবশেষে প্রবেশ করি মন্দিরে ৷ গর্ভগৃহ কেদারনাথের মতো অবারিত নয় ৷ গর্ভগৃহের বাইরে থেকে পুজো দিতে হয় ৷ মূল বিগ্রহটি অষ্টধাতুর তৈরি পঞ্চমুখী শিবের ৷ চোখ দুটি অসম্ভব উজ্জ্বল ৷ মস্তকে রৌপ্যমুকুট ৷ ফুল ও চন্দনে নিপুণভাবে সজ্জিত ৷ মদমহেশ্বরের মন্দির এগারো হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত ৷
পরদিন খুব ভোরে যাত্রা শুরু করি বুড়ামদমহেশ্বরের পথে ৷ মন্দিরের পাশ দিয়ে ঘন সবুজ পাহাড়ের ঢালে দেড় কিলোমিটারের চড়াইপথ ৷ ছোট ছোট হলুদ ফুল ফুটে আছে চারদিকে ৷ প্রায় বারো হাজার ফুট উচ্চতায় এক বিস্তীর্ণ সবুজ বুগিয়ালের মধ্যে পাথর দিয়ে সাজানো ছোট মন্দিরে মদমহেশ্বরের মূল শিবলিঙ্গটির অধিষ্ঠান ৷ সামনেই ভৈঁষকুণ্ড ৷ এই সময়ে কোনও জল নেই কুণ্ডে ৷ অনিন্দ্যসুন্দর এই বুড়ামদমহেশ্বরে দাঁড়িয়ে খুবই সামনে থেকে দেখা গেল সুবিশাল চৌখাম্বা পর্বতশৃঙ্গমালা ৷ তার বাঁদিকে মান্দানি এবং ইয়াংবুককলের সাদা একটা ফালি ৷ একেবারে ডানদিকে কাচনি অঞ্চল ৷ বর্ষার পরে ভৈঁষকুণ্ডে জল থাকলে চৌখাম্বার পূর্ণ প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় ৷ তখন তার সৌন্দর্যই আলাদা ৷ সঙ্গে আনা ধূপ আর বুনো ফুল দিয়ে বুড়ামদমহেশ্বরের পুজোপাঠ সমাপ্ত হয় ৷ বুড়ামদমহেশ্বরের শিবলিঙ্গটিই আসলে প্রকৃত মদমহেশ্বরের শিবলিঙ্গ ৷ শিবলিঙ্গটি ভাঙা এবং একদিকে হেলানো ৷ কথিত, তিব্বতের রাজার গাভী নাকি এখানে চরতে আসত ৷ একবার দেখা গেল যে সবচেয়ে ভালো গাভীটির দুধ থাকে না ৷ রাজা চললেন সরেজমিনে দেখতে ৷ গিয়ে দেখলেন গাভীটি মদমহেশ্বরের শিবলিঙ্গের মাথায় অঝোরে দুগ্ধ বর্ষিত করছে ৷ তিব্বতরাজ রাগের চোটে লাঠি দিয়ে সাধারণ পাথর মনে করে সজোরে আঘাত করেন ৷ শিবলিঙ্গটি ফেটে গিয়ে একদিকে হেলে পড়ে ৷ স্বপ্নাদিষ্ট হন তিব্বতরাজ এবং মহাদেব মদমহেশ্বরের নির্দেশেই অপেক্ষাকৃত নিচে আজকের এই মন্দির নির্মাণ করে দেন প্রায় হাজার বছর আগে ৷ তিব্বতরাজের সেই দুগ্ধবতী গাভীর পায়ের খুরের চিহ্ন আজও দৃশ্যমান মন্দিরের পিছনের পাথরে, হরপার্বতী মূর্তিটির সামনে ৷ বুড়ামদমহেশ্বর দর্শন করে নেমে আসি নিচে ৷ আবহাওয়া হঠাৎ খারাপ হতে থাকে ৷ ত্রিলোকজির ছেলে রাকেশের দোকান থেকে পুজোর ডালি কিনে মদমহেশ্বরের পুজোপাঠ সেরে যখন বেলা দশটা নাগাদ যাত্রা শুরু করি তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ৷ তুমুল বৃষ্টির মাঝে পিচ্ছিল উতরাই পথে দিনভর হেঁটে বিকেল নাগাদ গোণ্ডারে নেমে আসি ৷ রমেশ পাঁওয়ারের কৈলাস ট্যুরিস্ট লজের দোতলায় একটা আরামদায়ক ঘরে ঠাঁই মেলে ৷ সারারাত চলে প্রবল বর্ষণের তাণ্ডব ৷ পরদিন নেমে আসি রাঁসিতে ৷ আবহাওয়ার সামান্য উন্নতি হয় ৷ সূর্যাস্তে চৌখাম্বা লজের দোতলার বারান্দায় বসে দেখি আগুনরঙা নন্দীকুণ্ড এবং পাণ্ডুসেরা ৷ ক্রমে নেমে আসে রাত ৷ নিচে মহেশ বিস্টের দোকানে রেডিওতে মিহিসুরে গাড়োয়ালি সঙ্গীত বাজছে ৷ এক বর্ণও বুঝি না তার, কিন্তু সুরের মাদকতা মনকে আচ্ছন্ন করে ৷
২৭ মে, বর্ষণসিক্ত রোদ ঝলমলে সকাল ৷ দ্রুত পায়ে নেমে আসি যোগাসুতে ৷ ঝকঝকে নীল আকাশে চৌখাম্বা তখন নিজেকে জাহির করছে ৷ সেই চেনা পথে মনসুনা হয়ে উখিমঠে পৌঁছে যাই ভারত সেবাশ্রম সংঘে ৷ নীল আকাশের বুকে কেদারনাথ, কেদারডোম, কীর্তিস্তম্ভ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ৷ সংঘের অতিথিশালার সেই টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি আলুলায়িত কুন্তলের মতো থাক থাক নেমে যাওয়া উখিমঠের সবুজ শ্যামলিমার দিকে ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন