অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বিয়াস খুব বড় নদী ৷ হিমাচল প্রদেশের রোটাং পাস থেকে এর উৎপত্তি ৷ ইচ্ছে করলে সে পর্যন্ত গিয়েও দেখে আসা যায় ৷ পাহাড়ি খাত ধরে ঝরনার মতো নেমে এসেছে অনেকখানি ৷ মানালি, কুলু, মাণ্ডি শহরগুলোর ধারে ধারে ঝরনার বদলে নদী নদী ভাব, তাও শীতকালে জলের বদলে পাথরই দেখা যায় বেশি ৷
বিয়াস নামটির তাৎপর্য এখন অনেকটা বদলে গেছে ৷ এখন অনেকের ধারণা, মহাভারতের স্রষ্টা ব্যাসদেবের নাম থেকেই এই নদীর নাম ৷ পৌরাণিক কাহিনীটি অবশ্য অন্য ৷ সেকালের মুনি-ঋষিদের নানা রকমের তেজ এবং নারীঘটিত কীর্তির কথা আছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, গভীর এবং নিষ্কলঙ্ক ছিলেন বশিষ্ঠ ৷ সেই নিরীহ ঋষিরও একশোটি পুত্রকে হত্যা করে কল্মাষপাদ রাক্ষস ৷ নিদারুণ শোকে বশিষ্ঠ ঋষি প্রাণ বিসর্জনের সংকল্প নিয়েছিলেন ৷ হঠাৎ লাফ দিলেন উঁচু পাহাড় থেকে, কিন্তু তাতেও তাঁর পুণ্য শরীর অক্ষত রয়ে গেল ৷ তবু সংকল্প থেকে বিরত হলেন না বশিষ্ঠ, শক্ত দড়িতে নিজের হাত-পা বেঁধে ঝাঁপ দিলেন তাঁর আশ্রমের সামনের নদীতে ৷ কিন্তু স্বয়ং প্রকৃতি এই মহাত্মার মৃত্যু চান না, তাই নদীর স্রোতে আপনা আপনি তাঁর বন্ধন খুলে গেল ৷ বশিষ্ঠ আবার উদ্বুদ্ধ হলেন বেঁচে থাকার মন্ত্রে ৷ এই নদী তাঁকে শাপ মুক্ত করেছে বলে, তিনি এর নাম দিলেন বিপাশা ৷ সেই বিপাশা এখন বিয়াস ৷ অবশ্য ব্যাসদেবের সঙ্গেও এই নদীর সংস্রব আছে, এর তীরেই নাকি ছিল ব্যাসদেবের আশ্রম ৷ রোটাং পাসে যেখানে এই নদীর উৎস, সেই জায়গাটির নাম বিয়াসকুণ্ড ৷
কুলু-মানালির সৌন্দর্য বিখ্যাত এবং সেই খ্যাতির টানেও সারা বছরই বড় ভিড় ৷ এমনকী শীতকালেও পর্যটকদের স্রোত অব্যাহত ৷ যারা কুড়ি বছর আগে মানালি গেছে, তারা এখন ওই জায়গায় গেলে চিনতেই পারবে না ৷ যেমন স্বাতী পারেনি ৷ আগেরবার এসে কোথায় ছিল, সে জায়গাটা খুঁজেই পায় না, আমাদের কাছে যা বর্ণনা দিয়েছিল, তা মেলে না কিছুই ৷ ফাঁকা জায়গা একটুও নেই, হোটেলে-হোটেলে ধুল পরিমাণ ৷ কী সব বড় বড় হোটেল, দেখলে তাক লেগে যায় ৷ কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি এবং নিরাপত্তার অভাবের জন্য এখন ভ্রমণকারীরা দল বেঁধে আসে কুলু-মানালিতে ৷ মধুর অভাবে গুড় যেমন ৷ তা মধুর চেয়েও নতুন ওঠা ঝোলা গুড় কম সুস্বাদু নয় ৷ কাশ্মীরের মতো বড় বড় হ্রদ এখানে নেই, অত উচ্চ গিরিচূড়াও নেই, কিন্তু কুলু-মানালিতে যেন হিমালয়ের বুকের ওপর বসে থাকার মতো অনুভূতি হয় ৷ কাশ্মীরের সঙ্গে এ জায়গার তুলনা টানা ঠিক নয়, দুটি জায়গা দুরকম, নিজস্ব ভাবে আকর্ষণীয় ৷
আমরা ঠিক করেছিলাম নিরিবিলিতে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকব ৷ যে জায়গার নাম ট্যুরিস্ট ম্যাপে নেই, যেখানে কন্ডাক্টেড ট্যুর যায় না, যেটা তীর্থস্থান নয় ৷ মাণ্ডির ডিভিশনাল কমিশনার সুদৃপ্ত রায় আমার বন্ধু ভাস্করের ভাগ্নে, সে-ই সুপারিশ করল, আপনারা কসোল-এ যান ৷
প্রথমে বুঝতে পারিনি ৷ কসৌলি তো বিখ্যাত জায়গা ৷ ধরমপুর থেকে যেতে হয় ৷ সেখানে পাবলিক স্কুল আছে, হাসপাতাল আছে, হিমালয় প্রেমিকদের অবশ্য দ্রষ্টব্য একটি স্থান ৷ সেখানে তো ভিড় লেগে থাকবেই ৷ তাছাড়া, কসৌলি এখান থেকে অনেক দূরে ৷
সুদৃপ্ত হেসে বুঝিয়ে দিল, কসৌলি নয়, কসোল, এর নাম বিশেষ কেউ জানে না, আমাদের রুচি বুঝেই সে বলেছে, সেখানে একটিমাত্র হোটেল ও কিছু গেস্টহাউস আছে ৷ কোনওরকম উত্তেজনা নেই, আওয়াজ নেই ৷ সুদৃপ্তর ব্যবস্থাপনায় পরদিন সকালেই আমরা রওনা দিলাম সেদিকে ৷
মাণ্ডি থেকে কুলু-মানালির দিকে একটিই মাত্র পথ ৷ বিপাশা নদীর পাশে পাশে ৷ কখনও নদীর এপারে, কখনও ওপারে ৷ মাঝে মাঝে যেমন ছোট ছোট উপনদী-শাখা নদী আছে, সেইরকম ছোট ছোট রাস্তাও বেরিয়ে গেছে এদিকে-ওদিকে ৷ কুলু পৌঁছনোর আগেই আমরা সেরকম একটা পথে বেঁকে গেলাম ডানদিকে ৷
মাঝে মাঝে রাস্তাটি বেশ সরু, রোমাঞ্চকর বলা যেতে পারে, হঠাৎ দুদিক থেকে দুটি গাড়ি এসে পড়লে বুক দুরু দুরু করে ৷ এইসব রাস্তায় বাস উল্টে পড়ার দৃশ্য একবার না একবার চোখে পড়বেই ৷
এই রাস্তার পাশে পাশেও একটি নদী ৷ নাম জানা গেল, পার্বতী ৷ বেশ সরল, সুন্দর নাম ৷ চওড়া বেশি নয়, তাই জলের তোড় টের পাওয়া যায় ৷
কসোল-এ পৌঁছবার আগে রাস্তায় যেসব মানুষজন দেখা গেল, তাদের মধ্যে বিদেশিই বেশি ৷ পরে শুনেছিলাম, যে-কোনও কারণেই হোক, ইতালিয়ানদের কাছে এই ক্ষুদ্রস্থানটি বেশ জনপ্রিয় ৷
হোটেলটিতে পৌঁছে আমরা আশ্বস্ত হলাম ৷
পুরো হোটেলটিতে আমরা ছাড়া আর লোকই নেই বলতে গেলে ৷ এটা হোটেলের মালিকের পক্ষে দুঃখের বিষয় হলেও আমাদের বেশ ভালো লাগল ৷ একটু পরেই জানা গেল, এত যে সাহেব-মেম আসে, তারা সাধারণত হোটেলে ওঠে না, তারা দু-তিন মাসের জন্য গ্রামের মধ্যে বাড়ি ভাড়া নেয়, নিজেরা রান্না করে খায় ৷ সেই জন্যই অনেক সুন্দর সুন্দর কটেজ তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলে ৷
আমরা মোট চারজন, কিন্তু আমাদের তিনটি ঘর লাগে ৷ স্বামী-স্ত্রীর একটি, পয়সা বাঁচানো গেলেও ভাস্কর ও অসীম কিছুতেই এক ঘরে শুতে রাজি নয় ৷ অসীমের ধারণা, ভাস্করের খুব জোরে নাক ডাকে, তাই এক ঘরে থাকলে সে রাতে ঘুমোতে পারবে না ৷ ভাস্করের জোরে নাক ডাকে ঠিকই, যেমন আমারও রীতিমতো নাসিকা গর্জন হয়, সেটা স্বাতীর সহ্য হয়ে গেছে, কিন্তু অসীমের নিজেরও যে নাক ডাকে, তা সে জানে না ৷ বিয়ে তো করল না, না-হলে তার স্ত্রীই জানিয়ে দিত ৷
পাশাপাশি তিনটি ঘর পাওয়া গেল সহজেই ৷ ডাকলেই বেয়ারারা ছুটে আসে, অন্য কোনও কাজ নেই তো! হোটেলটার চারদিকে যেন ঘিরে আছে পাহাড়, কয়েকটি চূড়া বরফমণ্ডিত ৷ পাহাড়গুলির গায়ে নিবিড় জঙ্গল ৷ আর হোটেলের পিছন দিকে, অদূরে পার্বতী নদী ৷
নদীর ধারে ধারে আপেল-বাগান ৷ এই অঞ্চলের আপেল বিখ্যাত ৷ আপেল আর পর্যটন, এই দুটি কারণে এখানকার মানুষদের দারিদ্র্য বেশ কম ৷
সন্ধেবেলা আড্ডা হয় ভাস্করের ঘরে ৷ ফেব্রুয়ারি মাস, দিনেরবেলাতেই বেশ শীত, সূর্যাস্তের পর বাইরে বেরতেই ভয় করে ৷ ভাস্কর আর অসীম তিন যুগ ধরে আছে লন্ডন ও প্যারিসে, কিন্তু ঘরের মধ্যে বসেও ভাস্করের বেশি শীত করে ৷ গায়ে জড়িয়েছে চাদর, পায়ের কাছে জ্বলন্ত হিটার ৷ সেই তুলনায় অসীমের শীতবোধ কম ৷
যখন আমরা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাই, ভাস্কর অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়ে আসে ৷ প্রচুর কাজু বাদাম, নানা রকম বিস্কুট, চানাচুর, এমনকি জোয়ান-এলাচ মেশানো মশলা পর্যন্ত ৷ নানাবিধ উত্তম পানীয় তো থাকবেই, এবং অবশ্যই অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট ডজন ডজন ৷ জীবনের আর সবক্ষেত্রে ভাস্করের স্বভাব এলোমেলো ও ভুলোমনা, শুধু ভ্রমণের ব্যাপারেই তার পরিকল্পনা নিখুঁত ৷
প্রথমে চা দিয়ে শুরু হয়, তারপর কড়া পানীয়, আড্ডার ঝোঁকে রাত গভীর হয়ে যায় ৷ আমাদের মধ্যে একমাত্র স্বাতীই আগে দুবার কুলু-মানালি ঘুরে গেছে, অনেকদিন আগে অবশ্য, সেই জন্য এবারে এদিকে আসার ব্যাপারে তার প্রাথমিক আপত্তি ছিল ৷ কিন্তু কসোল তার পছন্দ হয়ে গেল ৷ এখানকার নিস্তব্ধতা, আবার পাহাড়ের গম্ভীর উপস্থিতি ৷ দুটি মিলিয়ে বিচিত্র অনুভূতি হয় ৷
ভাস্কর ঘুম-কাতুরে, জাগে অনেক দেরিতে ৷ স্বাতী উঠে পড়লেও তার বাইরে বেরবার জন্য প্রস্তুত হতে সময় লাগে ৷ অসীমের স্বভাবে কৌতূহলবৃত্তি প্রবল, যে-কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে সে চতুর্দিক ঘুরে দেখে নিতে চায় ৷ তাছাড়া তার ফটোগ্রাফির ঝোঁক, ক্যামেরার ব্যাগ তার কাঁধে ঝোলানো থাকে সব সময়, তাতে তিন-চার রকম ক্যামেরা, পাঁচ-ছরকম লেন্স ৷ সকাল সকাল অসীম বেরিয়ে পড়তেই আমি হলাম তার সঙ্গী ৷
আপেল বাগানের একেকজন মালিকের সীমানা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, তাই প্রথমে নদীর ধারে পৌঁছবার রাস্তাটা খুঁজে পাইনা ৷ হোটেলের সামনের রাস্তাটা চলে গেছে মণিকরণের দিকে ৷ সেটা ধরে খানিকটা এগোতেই একটা সরু পথ চোখে পড়ল নদীর দিকে ৷ পথ মানে বড় বড় পাথর ফেলা, যেতে হয় ডিঙিয়ে ৷ আমাদের বাংলা-বিহারে যে-কোনও লোকালয়ের নদীর ধারে সকালবেলা না যাওয়াই ভালো, গেলে অনেক পুরুষের বসে থাকা উন্মুক্ত পশ্চাৎ দৃশ্য দেখতে হয় ৷ এখানে কেউ নদীকে সেভাবে ব্যবহার করে না ৷ তাছাড়া এই শীতে বরফ-গলা নদীর জল ছোঁবে কে?
উঁচুর দিক থেকে নেমে আসছে পার্বতী নদী, ধাপে ধাপে, তাই তার স্রোতে মৃদু কুলুকুলু ধ্বনি আছে ৷ মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ভাঙা ডালপালা ৷ নামের জন্যই নদীটিকে মনে হয় সুন্দরী রমণী, সে যেন আপনমনে গান গাইতে গাইতে চলেছে ৷
জলের মধ্যে একটি আধো-ডোবা পাথরে একটি ফড়িং একেকবার বসছে আর উড়ে যাচ্ছে ৷ ঠিক মুহূর্তে ফড়িংটিকে ধরবার জন্য ক্যামেরা তাক করে আছে অসীম, মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে ৷ ভালো ছবি তুলতে ধৈর্য লাগে ৷ আন্তর্জাতিক দুয়েকটি প্রতিযোগিতাতেও অসীম তার ছবি পাঠায় ৷ ফড়িং-মাকড়সা-গুবড়ে পোকা, এইসবের ছবিই নাকি বেশি পুরস্কারযোগ্য ৷ আমার অত ধৈর্য নেই ৷ আমি ফড়িংকে ছেড়ে দেখতে থাকি নদীর ওপারের বনরাজি ৷ মনে হয়, হঠাৎ যেন ওর মধ্য থেকে হরিণ বেরিয়ে আসবে ৷ আমি সুন্দরবনে গিয়ে কখনও বাঘ দেখিনি, কিন্তু ভোরবেলা লঞ্চের ছাদ থেকে দেখেছি জঙ্গলের প্রান্তে এক পাল হরিণ ৷
জঙ্গলের ওপাশে পাহাড়ের চূড়া, প্রথম সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে বরফ ৷ স্বর্ণকিরীট একেই বলা যায় ৷ অসীমকে বললাম, এই পাহাড়ের ছবি তুলবে না? দ্যাখো, দ্যাখো-
মনঃসংযোগ নষ্ট হওয়ায় বিরক্তভাবে ভুরু কুঁচকে বলল, ওতে নতুনত্ব কী আছে?
পাহাড়ের তুলনায় একটি ফড়িং-এর ওড়াউড়িতে কী এমন নতুনত্ব থাকতে পারে, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় ৷ বুঝলে তো আমিও ফটোগ্রাফার হতাম ৷
একটু পরে অসীম বললে, চলো, নদীটার ধার দিয়ে দিয়ে খানিকটা এগোই ৷
বেশি দূর যাওয়া গেল না অবশ্য ৷ নদীর কিনারে কোনও রাস্তাই নেই, অনবরত পাথর ডিঙোতে হয়, কোথাও ডিঙোনোও যায় না ৷ পার্বতী নিরিবিলিতে থাকতে চায় ৷
দুপুরবেলা আমরা এগোলাম পাকা রাস্তা ধরে, গাড়ি নিয়ে ৷ কিছু দূরেই মণিকরণ, একটি তীর্থক্ষেত্র ৷ হিন্দু এবং শিখ, দুই ধর্মেরই তীর্থ বলে সারা বছরই এখানে জনসমাগম লেগে থাকে ৷
মণিকরণের কাছাকাছি এসে পার্বতী নদীর এমন একটা রূপ চোখে পড়ে, যার তুলনা পাওয়া ভার ৷ নদীর জল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে!
এদিককার কোনও পাহাড়ের হিমবাহ থেকেই এই নদীর উৎপত্তি ৷ বরফ-গলা জল নিশ্চিত ঠান্ডা হবার কথা ৷ কিন্তু এই অঞ্চলে যত্রতত্র উষ্ণপ্রস্রবণ ৷ নদীর ধার ঘেঁসেও কোথাও কোথাও মাটি ফুঁড়ে উষ্ণপ্রস্রবণ বেরিয়ে আসছে, সে জল এমনই গরম যে নদীকেও তপ্ত করে তুলেছে ৷
একদিকে গাড়ি রেখে, একটা কাঠের সেতু পেরিয়ে মণিকরণে যেতে হয় ৷ সেতুর নিচে দেখি, এক জায়গায় পার্বতী নদী টগবগ করে ফুটছে ৷ এরকম দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি ৷
গুরু নানক নাকি মণিকরণে এসেছিলেন, তাই শিখদের কাছে এই স্থানটি খুব পবিত্র ৷ একটা প্রকাণ্ড ধর্মশালা রয়েছে ৷ আর সব উষ্ণপ্রস্রবণকেই হিন্দুরা তীর্থস্থান মনে করে ৷ একটি বড় রামমন্দির আছে, আরও অনেক মন্দির ৷ কয়েক জায়গায় প্রকৃতির গরম জলে স্নান করার ব্যবস্থা ৷
অনেক শ্বেতাঙ্গ সেখানে দিব্যি কালো মানুষদের সঙ্গে স্নান করছে ৷ কয়েকটি হোটেলেও ওইরকম স্নানের ব্যবস্থা আছে, হোটেলের বাথরুমে উষ্ণপ্রস্রবণের জল ৷
তীর্থস্থান মানেই প্রচুর টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান, আর রেস্টুরেন্ট ৷ এক জায়গায় দেখি, বাংলায় লেখা, ‘বউদির দোকান’ ৷ সেখানে নিশ্চিত ভাত-মাছের ঝোল পাওয়া যায় ৷ আমি প্রবাসে গিয়ে বাঙালি খাওয়া একেবারে পছন্দ করি না ৷ নিত্যি তিরিশ দিন বাড়িতে যা খাচ্ছি, প্রবাসে বেড়াতে গিয়েও তা খাব কেন? প্যারিসে আমাদের এক বাঙালি বন্ধুর স্ত্রী ফরাসিনী ৷ তাঁদের বাড়িতে গেলেই বন্ধুর স্ত্রী আমাদের ভাত-ডাল-তরকারি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন ৷ তাঁর অপটু হাতের রান্নায় ডাল-তরকারির চেয়ে ফরাসি খাদ্যদ্রব্য পেলে যে আমরা অনেক বেশি প্রীত হতাম, তা তাঁকে বোঝানো যায় না ৷
মণিকরণ একটি উপত্যকার মধ্যে ৷ চতুর্দিকের দৃশ্য ভারি মনোরম ৷ ভাস্কর বলল, আগে এই জায়গাটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর ছিল, এখন এত বাড়ি-ঘর উঠে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে ৷ আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত, আমি এখানে এত বাড়ি বানানো নিষিদ্ধ করে দিতাম!
অসীম বলল, ওটাই তো এ দেশের দোষ ৷ কেউ কিছু চিন্তা করে না, সুন্দর জায়গাকে সুন্দর রাখতে জানে না ৷
অসীম ও ভাস্কর দুজনেই বিদেশে থাকে, ওদের পাসপোর্টও ভারতীয় নয়, কিন্তু অসীম এ দেশের নিন্দে শুরু করলেই ভাস্কর তার বিপক্ষে চলে যায় ৷ স্বাতীও তখন ভাস্করের সঙ্গে যোগ দিয়ে অসীমকে বকাবকি শুরু করে ৷ আমি অধিকাংশ সময়েই নিরপেক্ষ শ্রোতা ৷
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর স্বাতী বলল, এখানে একদিন থেকে গেলে হয় না?
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন পুরুষ একমত হয়ে জানালাম যে, না, তা হতেই পারে না ৷ ভিড়ের জায়গায় থাকব না ঠিক করেই এসেছি, এর চেয়ে কসোল অনেক ভালো ৷
আমি মন্দির-মসজিদ-গির্জা বাইরে থেকেই দেখা পছন্দ করি ৷ স্বাতী ভেতরেও যেতে চায় ৷ এখানকার মন্দিরগুলিতে ভাস্কর্য-স্থাপত্যের কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তাই কাছে গিয়েও দেখার মতো কিছু নয় ৷ কিন্তু স্বাতী দুয়েকটি মন্দিরের ভেতরে যাবেই ঠিক করেছে ৷ ভাস্কর শিভালরি দেখিয়ে সঙ্গ দেয় স্বাতীকে ৷
অসীম ছবি তোলার জন্য বিষয় খুঁজতে চলে যায় এদিক ওদিক ৷ আমি বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করি একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে ৷
চা অত্যন্ত বিস্বাদ, দুধে ফোটানো, বেশি চিনি ৷ কম চিনির ব্যাপারটা এরা বোঝেই না ৷ আজকাল ট্রেনের চাওয়ালারাও আগে থেকে মিষ্টি মিশিয়ে রাখে, তাতে বাইরে চা খাওয়ার আনন্দটাই চলে গেছে! মাটির ভাঁড়ও নেই, সেই সোঁদা গন্ধ মেশানো চায়ের জন্য মন কেমন করে ৷
সিগারেট টানতে টানতে উল্টোদিকের বাড়ির দেওয়ালে একটা বড় পোস্টার চোখে পড়ল ৷ মাঝখানে একটি যুবকের ছবি, তার তলায় লেখা, দশ হাজার ডলার পুরস্কার ৷
উঠে গিয়ে ইংরিজিতে লেখা পোস্টারটি ভালো করে পড়লাম ৷
খুব মর্মস্পর্শী ব্যাপার ৷ কানাডার এক মহিলা সেই পোস্টারটি লাগিয়ে গেছেন ৷ ছবিটি তাঁর একমাত্র ছেলের, সে নিরুদ্দেশ ৷ দুমাস আগে সেই ছেলেটি এই মণিকরণ থেকে তার মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিল, তারপর থেকে আর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না ৷ ভদ্রমহিলা নিজে এখানে এসেছিলেন খোঁজ করার জন্য ৷ এই পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে পোস্টার লাগিয়ে গেছেন অনেক জায়গায় ৷
ফিরে এসে দোকানদারটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই নিরুদ্দিষ্ট ছেলেটির বিষয়ে কিছু জানেন নাকি?
দোকানদারটি বললেন, ওই বিদেশি যুবকটিকে তিনি চিনতেন ৷ মণিকরণে থেকেছে অনেকদিন ৷ এই দোকানে চা খেতেও আসত ৷ একদিন সে পার্বতী নদীর উৎস সন্ধান করতে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে একা চলে গিয়েছিল পাহাড়ে ৷ আর ফিরে আসেনি ৷ পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথায় সে হারিয়ে গেছে, কী করে আর জানা যাবে!
আমি পার্বতী নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷
যুবকটি কি শেষ পর্যন্ত পার্বতীর উৎসমুখে পৌঁছতে পেরেছিল? কত দূর থেকে এসেছিল সে, একা একা কেন গেল ওই দুর্গম পাহাড়ে ৷
সে বোধহয় এই নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল ৷ নদী তাকে বুকে টেনে নিয়েছে?
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন