আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বিয়াস খুব বড় নদী ৷ হিমাচল প্রদেশের রোটাং পাস থেকে এর উৎপত্তি ৷ ইচ্ছে করলে সে পর্যন্ত গিয়েও দেখে আসা যায় ৷ পাহাড়ি খাত ধরে ঝরনার মতো নেমে এসেছে অনেকখানি ৷ মানালি, কুলু, মাণ্ডি শহরগুলোর ধারে ধারে ঝরনার বদলে নদী নদী ভাব, তাও শীতকালে জলের বদলে পাথরই দেখা যায় বেশি ৷

বিয়াস নামটির তাৎপর্য এখন অনেকটা বদলে গেছে ৷ এখন অনেকের ধারণা, মহাভারতের স্রষ্টা ব্যাসদেবের নাম থেকেই এই নদীর নাম ৷ পৌরাণিক কাহিনীটি অবশ্য অন্য ৷ সেকালের মুনি-ঋষিদের নানা রকমের তেজ এবং নারীঘটিত কীর্তির কথা আছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, গভীর এবং নিষ্কলঙ্ক ছিলেন বশিষ্ঠ ৷ সেই নিরীহ ঋষিরও একশোটি পুত্রকে হত্যা করে কল্মাষপাদ রাক্ষস ৷ নিদারুণ শোকে বশিষ্ঠ ঋষি প্রাণ বিসর্জনের সংকল্প নিয়েছিলেন ৷ হঠাৎ লাফ দিলেন উঁচু পাহাড় থেকে, কিন্তু তাতেও তাঁর পুণ্য শরীর অক্ষত রয়ে গেল ৷ তবু সংকল্প থেকে বিরত হলেন না বশিষ্ঠ, শক্ত দড়িতে নিজের হাত-পা বেঁধে ঝাঁপ দিলেন তাঁর আশ্রমের সামনের নদীতে ৷ কিন্তু স্বয়ং প্রকৃতি এই মহাত্মার মৃত্যু চান না, তাই নদীর স্রোতে আপনা আপনি তাঁর বন্ধন খুলে গেল ৷ বশিষ্ঠ আবার উদ্বুদ্ধ হলেন বেঁচে থাকার মন্ত্রে ৷ এই নদী তাঁকে শাপ মুক্ত করেছে বলে, তিনি এর নাম দিলেন বিপাশা ৷ সেই বিপাশা এখন বিয়াস ৷ অবশ্য ব্যাসদেবের সঙ্গেও এই নদীর সংস্রব আছে, এর তীরেই নাকি ছিল ব্যাসদেবের আশ্রম ৷ রোটাং পাসে যেখানে এই নদীর উৎস, সেই জায়গাটির নাম বিয়াসকুণ্ড ৷

কুলু-মানালির সৌন্দর্য বিখ্যাত এবং সেই খ্যাতির টানেও সারা বছরই বড় ভিড় ৷ এমনকী শীতকালেও পর্যটকদের স্রোত অব্যাহত ৷ যারা কুড়ি বছর আগে মানালি গেছে, তারা এখন ওই জায়গায় গেলে চিনতেই পারবে না ৷ যেমন স্বাতী পারেনি ৷ আগেরবার এসে কোথায় ছিল, সে জায়গাটা খুঁজেই পায় না, আমাদের কাছে যা বর্ণনা দিয়েছিল, তা মেলে না কিছুই ৷ ফাঁকা জায়গা একটুও নেই, হোটেলে-হোটেলে ধুল পরিমাণ ৷ কী সব বড় বড় হোটেল, দেখলে তাক লেগে যায় ৷ কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি এবং নিরাপত্তার অভাবের জন্য এখন ভ্রমণকারীরা দল বেঁধে আসে কুলু-মানালিতে ৷ মধুর অভাবে গুড় যেমন ৷ তা মধুর চেয়েও নতুন ওঠা ঝোলা গুড় কম সুস্বাদু নয় ৷ কাশ্মীরের মতো বড় বড় হ্রদ এখানে নেই, অত উচ্চ গিরিচূড়াও নেই, কিন্তু কুলু-মানালিতে যেন হিমালয়ের বুকের ওপর বসে থাকার মতো অনুভূতি হয় ৷ কাশ্মীরের সঙ্গে এ জায়গার তুলনা টানা ঠিক নয়, দুটি জায়গা দুরকম, নিজস্ব ভাবে আকর্ষণীয় ৷

আমরা ঠিক করেছিলাম নিরিবিলিতে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকব ৷ যে জায়গার নাম ট্যুরিস্ট ম্যাপে নেই, যেখানে কন্ডাক্টেড ট্যুর যায় না, যেটা তীর্থস্থান নয় ৷ মাণ্ডির ডিভিশনাল কমিশনার সুদৃপ্ত রায় আমার বন্ধু ভাস্করের ভাগ্নে, সে-ই সুপারিশ করল, আপনারা কসোল-এ যান ৷

প্রথমে বুঝতে পারিনি ৷ কসৌলি তো বিখ্যাত জায়গা ৷ ধরমপুর থেকে যেতে হয় ৷ সেখানে পাবলিক স্কুল আছে, হাসপাতাল আছে, হিমালয় প্রেমিকদের অবশ্য দ্রষ্টব্য একটি স্থান ৷ সেখানে তো ভিড় লেগে থাকবেই ৷ তাছাড়া, কসৌলি এখান থেকে অনেক দূরে ৷

সুদৃপ্ত হেসে বুঝিয়ে দিল, কসৌলি নয়, কসোল, এর নাম বিশেষ কেউ জানে না, আমাদের রুচি বুঝেই সে বলেছে, সেখানে একটিমাত্র হোটেল ও কিছু গেস্টহাউস আছে ৷ কোনওরকম উত্তেজনা নেই, আওয়াজ নেই ৷ সুদৃপ্তর ব্যবস্থাপনায় পরদিন সকালেই আমরা রওনা দিলাম সেদিকে ৷

মাণ্ডি থেকে কুলু-মানালির দিকে একটিই মাত্র পথ ৷ বিপাশা নদীর পাশে পাশে ৷ কখনও নদীর এপারে, কখনও ওপারে ৷ মাঝে মাঝে যেমন ছোট ছোট উপনদী-শাখা নদী আছে, সেইরকম ছোট ছোট রাস্তাও বেরিয়ে গেছে এদিকে-ওদিকে ৷ কুলু পৌঁছনোর আগেই আমরা সেরকম একটা পথে বেঁকে গেলাম ডানদিকে ৷

মাঝে মাঝে রাস্তাটি বেশ সরু, রোমাঞ্চকর বলা যেতে পারে, হঠাৎ দুদিক থেকে দুটি গাড়ি এসে পড়লে বুক দুরু দুরু করে ৷ এইসব রাস্তায় বাস উল্টে পড়ার দৃশ্য একবার না একবার চোখে পড়বেই ৷

এই রাস্তার পাশে পাশেও একটি নদী ৷ নাম জানা গেল, পার্বতী ৷ বেশ সরল, সুন্দর নাম ৷ চওড়া বেশি নয়, তাই জলের তোড় টের পাওয়া যায় ৷

কসোল-এ পৌঁছবার আগে রাস্তায় যেসব মানুষজন দেখা গেল, তাদের মধ্যে বিদেশিই বেশি ৷ পরে শুনেছিলাম, যে-কোনও কারণেই হোক, ইতালিয়ানদের কাছে এই ক্ষুদ্রস্থানটি বেশ জনপ্রিয় ৷

হোটেলটিতে পৌঁছে আমরা আশ্বস্ত হলাম ৷

পুরো হোটেলটিতে আমরা ছাড়া আর লোকই নেই বলতে গেলে ৷ এটা হোটেলের মালিকের পক্ষে দুঃখের বিষয় হলেও আমাদের বেশ ভালো লাগল ৷ একটু পরেই জানা গেল, এত যে সাহেব-মেম আসে, তারা সাধারণত হোটেলে ওঠে না, তারা দু-তিন মাসের জন্য গ্রামের মধ্যে বাড়ি ভাড়া নেয়, নিজেরা রান্না করে খায় ৷ সেই জন্যই অনেক সুন্দর সুন্দর কটেজ তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলে ৷

আমরা মোট চারজন, কিন্তু আমাদের তিনটি ঘর লাগে ৷ স্বামী-স্ত্রীর একটি, পয়সা বাঁচানো গেলেও ভাস্কর ও অসীম কিছুতেই এক ঘরে শুতে রাজি নয় ৷ অসীমের ধারণা, ভাস্করের খুব জোরে নাক ডাকে, তাই এক ঘরে থাকলে সে রাতে ঘুমোতে পারবে না ৷ ভাস্করের জোরে নাক ডাকে ঠিকই, যেমন আমারও রীতিমতো নাসিকা গর্জন হয়, সেটা স্বাতীর সহ্য হয়ে গেছে, কিন্তু অসীমের নিজেরও যে নাক ডাকে, তা সে জানে না ৷ বিয়ে তো করল না, না-হলে তার স্ত্রীই জানিয়ে দিত ৷

পাশাপাশি তিনটি ঘর পাওয়া গেল সহজেই ৷ ডাকলেই বেয়ারারা ছুটে আসে, অন্য কোনও কাজ নেই তো! হোটেলটার চারদিকে যেন ঘিরে আছে পাহাড়, কয়েকটি চূড়া বরফমণ্ডিত ৷ পাহাড়গুলির গায়ে নিবিড় জঙ্গল ৷ আর হোটেলের পিছন দিকে, অদূরে পার্বতী নদী ৷

নদীর ধারে ধারে আপেল-বাগান ৷ এই অঞ্চলের আপেল বিখ্যাত ৷ আপেল আর পর্যটন, এই দুটি কারণে এখানকার মানুষদের দারিদ্র্য বেশ কম ৷

সন্ধেবেলা আড্ডা হয় ভাস্করের ঘরে ৷ ফেব্রুয়ারি মাস, দিনেরবেলাতেই বেশ শীত, সূর্যাস্তের পর বাইরে বেরতেই ভয় করে ৷ ভাস্কর আর অসীম তিন যুগ ধরে আছে লন্ডন ও প্যারিসে, কিন্তু ঘরের মধ্যে বসেও ভাস্করের বেশি শীত করে ৷ গায়ে জড়িয়েছে চাদর, পায়ের কাছে জ্বলন্ত হিটার ৷ সেই তুলনায় অসীমের শীতবোধ কম ৷

যখন আমরা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাই, ভাস্কর অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়ে আসে ৷ প্রচুর কাজু বাদাম, নানা রকম বিস্কুট, চানাচুর, এমনকি জোয়ান-এলাচ মেশানো মশলা পর্যন্ত ৷ নানাবিধ উত্তম পানীয় তো থাকবেই, এবং অবশ্যই অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট ডজন ডজন ৷ জীবনের আর সবক্ষেত্রে ভাস্করের স্বভাব এলোমেলো ও ভুলোমনা, শুধু ভ্রমণের ব্যাপারেই তার পরিকল্পনা নিখুঁত ৷

প্রথমে চা দিয়ে শুরু হয়, তারপর কড়া পানীয়, আড্ডার ঝোঁকে রাত গভীর হয়ে যায় ৷ আমাদের মধ্যে একমাত্র স্বাতীই আগে দুবার কুলু-মানালি ঘুরে গেছে, অনেকদিন আগে অবশ্য, সেই জন্য এবারে এদিকে আসার ব্যাপারে তার প্রাথমিক আপত্তি ছিল ৷ কিন্তু কসোল তার পছন্দ হয়ে গেল ৷ এখানকার নিস্তব্ধতা, আবার পাহাড়ের গম্ভীর উপস্থিতি ৷ দুটি মিলিয়ে বিচিত্র অনুভূতি হয় ৷

ভাস্কর ঘুম-কাতুরে, জাগে অনেক দেরিতে ৷ স্বাতী উঠে পড়লেও তার বাইরে বেরবার জন্য প্রস্তুত হতে সময় লাগে ৷ অসীমের স্বভাবে কৌতূহলবৃত্তি প্রবল, যে-কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে সে চতুর্দিক ঘুরে দেখে নিতে চায় ৷ তাছাড়া তার ফটোগ্রাফির ঝোঁক, ক্যামেরার ব্যাগ তার কাঁধে ঝোলানো থাকে সব সময়, তাতে তিন-চার রকম ক্যামেরা, পাঁচ-ছরকম লেন্স ৷ সকাল সকাল অসীম বেরিয়ে পড়তেই আমি হলাম তার সঙ্গী ৷

আপেল বাগানের একেকজন মালিকের সীমানা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, তাই প্রথমে নদীর ধারে পৌঁছবার রাস্তাটা খুঁজে পাইনা ৷ হোটেলের সামনের রাস্তাটা চলে গেছে মণিকরণের দিকে ৷ সেটা ধরে খানিকটা এগোতেই একটা সরু পথ চোখে পড়ল নদীর দিকে ৷ পথ মানে বড় বড় পাথর ফেলা, যেতে হয় ডিঙিয়ে ৷ আমাদের বাংলা-বিহারে যে-কোনও লোকালয়ের নদীর ধারে সকালবেলা না যাওয়াই ভালো, গেলে অনেক পুরুষের বসে থাকা উন্মুক্ত পশ্চাৎ দৃশ্য দেখতে হয় ৷ এখানে কেউ নদীকে সেভাবে ব্যবহার করে না ৷ তাছাড়া এই শীতে বরফ-গলা নদীর জল ছোঁবে কে?

উঁচুর দিক থেকে নেমে আসছে পার্বতী নদী, ধাপে ধাপে, তাই তার স্রোতে মৃদু কুলুকুলু ধ্বনি আছে ৷ মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ভাঙা ডালপালা ৷ নামের জন্যই নদীটিকে মনে হয় সুন্দরী রমণী, সে যেন আপনমনে গান গাইতে গাইতে চলেছে ৷

জলের মধ্যে একটি আধো-ডোবা পাথরে একটি ফড়িং একেকবার বসছে আর উড়ে যাচ্ছে ৷ ঠিক মুহূর্তে ফড়িংটিকে ধরবার জন্য ক্যামেরা তাক করে আছে অসীম, মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে ৷ ভালো ছবি তুলতে ধৈর্য লাগে ৷ আন্তর্জাতিক দুয়েকটি প্রতিযোগিতাতেও অসীম তার ছবি পাঠায় ৷ ফড়িং-মাকড়সা-গুবড়ে পোকা, এইসবের ছবিই নাকি বেশি পুরস্কারযোগ্য ৷ আমার অত ধৈর্য নেই ৷ আমি ফড়িংকে ছেড়ে দেখতে থাকি নদীর ওপারের বনরাজি ৷ মনে হয়, হঠাৎ যেন ওর মধ্য থেকে হরিণ বেরিয়ে আসবে ৷ আমি সুন্দরবনে গিয়ে কখনও বাঘ দেখিনি, কিন্তু ভোরবেলা লঞ্চের ছাদ থেকে দেখেছি জঙ্গলের প্রান্তে এক পাল হরিণ ৷

জঙ্গলের ওপাশে পাহাড়ের চূড়া, প্রথম সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে বরফ ৷ স্বর্ণকিরীট একেই বলা যায় ৷ অসীমকে বললাম, এই পাহাড়ের ছবি তুলবে না? দ্যাখো, দ্যাখো-

মনঃসংযোগ নষ্ট হওয়ায় বিরক্তভাবে ভুরু কুঁচকে বলল, ওতে নতুনত্ব কী আছে?

পাহাড়ের তুলনায় একটি ফড়িং-এর ওড়াউড়িতে কী এমন নতুনত্ব থাকতে পারে, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় ৷ বুঝলে তো আমিও ফটোগ্রাফার হতাম ৷

একটু পরে অসীম বললে, চলো, নদীটার ধার দিয়ে দিয়ে খানিকটা এগোই ৷

বেশি দূর যাওয়া গেল না অবশ্য ৷ নদীর কিনারে কোনও রাস্তাই নেই, অনবরত পাথর ডিঙোতে হয়, কোথাও ডিঙোনোও যায় না ৷ পার্বতী নিরিবিলিতে থাকতে চায় ৷

দুপুরবেলা আমরা এগোলাম পাকা রাস্তা ধরে, গাড়ি নিয়ে ৷ কিছু দূরেই মণিকরণ, একটি তীর্থক্ষেত্র ৷ হিন্দু এবং শিখ, দুই ধর্মেরই তীর্থ বলে সারা বছরই এখানে জনসমাগম লেগে থাকে ৷

মণিকরণের কাছাকাছি এসে পার্বতী নদীর এমন একটা রূপ চোখে পড়ে, যার তুলনা পাওয়া ভার ৷ নদীর জল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে!

এদিককার কোনও পাহাড়ের হিমবাহ থেকেই এই নদীর উৎপত্তি ৷ বরফ-গলা জল নিশ্চিত ঠান্ডা হবার কথা ৷ কিন্তু এই অঞ্চলে যত্রতত্র উষ্ণপ্রস্রবণ ৷ নদীর ধার ঘেঁসেও কোথাও কোথাও মাটি ফুঁড়ে উষ্ণপ্রস্রবণ বেরিয়ে আসছে, সে জল এমনই গরম যে নদীকেও তপ্ত করে তুলেছে ৷

একদিকে গাড়ি রেখে, একটা কাঠের সেতু পেরিয়ে মণিকরণে যেতে হয় ৷ সেতুর নিচে দেখি, এক জায়গায় পার্বতী নদী টগবগ করে ফুটছে ৷ এরকম দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি ৷

গুরু নানক নাকি মণিকরণে এসেছিলেন, তাই শিখদের কাছে এই স্থানটি খুব পবিত্র ৷ একটা প্রকাণ্ড ধর্মশালা রয়েছে ৷ আর সব উষ্ণপ্রস্রবণকেই হিন্দুরা তীর্থস্থান মনে করে ৷ একটি বড় রামমন্দির আছে, আরও অনেক মন্দির ৷ কয়েক জায়গায় প্রকৃতির গরম জলে স্নান করার ব্যবস্থা ৷

অনেক শ্বেতাঙ্গ সেখানে দিব্যি কালো মানুষদের সঙ্গে স্নান করছে ৷ কয়েকটি হোটেলেও ওইরকম স্নানের ব্যবস্থা আছে, হোটেলের বাথরুমে উষ্ণপ্রস্রবণের জল ৷

তীর্থস্থান মানেই প্রচুর টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান, আর রেস্টুরেন্ট ৷ এক জায়গায় দেখি, বাংলায় লেখা, ‘বউদির দোকান’ ৷ সেখানে নিশ্চিত ভাত-মাছের ঝোল পাওয়া যায় ৷ আমি প্রবাসে গিয়ে বাঙালি খাওয়া একেবারে পছন্দ করি না ৷ নিত্যি তিরিশ দিন বাড়িতে যা খাচ্ছি, প্রবাসে বেড়াতে গিয়েও তা খাব কেন? প্যারিসে আমাদের এক বাঙালি বন্ধুর স্ত্রী ফরাসিনী ৷ তাঁদের বাড়িতে গেলেই বন্ধুর স্ত্রী আমাদের ভাত-ডাল-তরকারি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন ৷ তাঁর অপটু হাতের রান্নায় ডাল-তরকারির চেয়ে ফরাসি খাদ্যদ্রব্য পেলে যে আমরা অনেক বেশি প্রীত হতাম, তা তাঁকে বোঝানো যায় না ৷

মণিকরণ একটি উপত্যকার মধ্যে ৷ চতুর্দিকের দৃশ্য ভারি মনোরম ৷ ভাস্কর বলল, আগে এই জায়গাটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর ছিল, এখন এত বাড়ি-ঘর উঠে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে ৷ আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত, আমি এখানে এত বাড়ি বানানো নিষিদ্ধ করে দিতাম!

অসীম বলল, ওটাই তো এ দেশের দোষ ৷ কেউ কিছু চিন্তা করে না, সুন্দর জায়গাকে সুন্দর রাখতে জানে না ৷

অসীম ও ভাস্কর দুজনেই বিদেশে থাকে, ওদের পাসপোর্টও ভারতীয় নয়, কিন্তু অসীম এ দেশের নিন্দে শুরু করলেই ভাস্কর তার বিপক্ষে চলে যায় ৷ স্বাতীও তখন ভাস্করের সঙ্গে যোগ দিয়ে অসীমকে বকাবকি শুরু করে ৷ আমি অধিকাংশ সময়েই নিরপেক্ষ শ্রোতা ৷

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর স্বাতী বলল, এখানে একদিন থেকে গেলে হয় না?

তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন পুরুষ একমত হয়ে জানালাম যে, না, তা হতেই পারে না ৷ ভিড়ের জায়গায় থাকব না ঠিক করেই এসেছি, এর চেয়ে কসোল অনেক ভালো ৷

আমি মন্দির-মসজিদ-গির্জা বাইরে থেকেই দেখা পছন্দ করি ৷ স্বাতী ভেতরেও যেতে চায় ৷ এখানকার মন্দিরগুলিতে ভাস্কর্য-স্থাপত্যের কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তাই কাছে গিয়েও দেখার মতো কিছু নয় ৷ কিন্তু স্বাতী দুয়েকটি মন্দিরের ভেতরে যাবেই ঠিক করেছে ৷ ভাস্কর শিভালরি দেখিয়ে সঙ্গ দেয় স্বাতীকে ৷

অসীম ছবি তোলার জন্য বিষয় খুঁজতে চলে যায় এদিক ওদিক ৷ আমি বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করি একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে ৷

চা অত্যন্ত বিস্বাদ, দুধে ফোটানো, বেশি চিনি ৷ কম চিনির ব্যাপারটা এরা বোঝেই না ৷ আজকাল ট্রেনের চাওয়ালারাও আগে থেকে মিষ্টি মিশিয়ে রাখে, তাতে বাইরে চা খাওয়ার আনন্দটাই চলে গেছে! মাটির ভাঁড়ও নেই, সেই সোঁদা গন্ধ মেশানো চায়ের জন্য মন কেমন করে ৷

সিগারেট টানতে টানতে উল্টোদিকের বাড়ির দেওয়ালে একটা বড় পোস্টার চোখে পড়ল ৷ মাঝখানে একটি যুবকের ছবি, তার তলায় লেখা, দশ হাজার ডলার পুরস্কার ৷

উঠে গিয়ে ইংরিজিতে লেখা পোস্টারটি ভালো করে পড়লাম ৷

খুব মর্মস্পর্শী ব্যাপার ৷ কানাডার এক মহিলা সেই পোস্টারটি লাগিয়ে গেছেন ৷ ছবিটি তাঁর একমাত্র ছেলের, সে নিরুদ্দেশ ৷ দুমাস আগে সেই ছেলেটি এই মণিকরণ থেকে তার মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিল, তারপর থেকে আর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না ৷ ভদ্রমহিলা নিজে এখানে এসেছিলেন খোঁজ করার জন্য ৷ এই পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে পোস্টার লাগিয়ে গেছেন অনেক জায়গায় ৷

ফিরে এসে দোকানদারটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই নিরুদ্দিষ্ট ছেলেটির বিষয়ে কিছু জানেন নাকি?

দোকানদারটি বললেন, ওই বিদেশি যুবকটিকে তিনি চিনতেন ৷ মণিকরণে থেকেছে অনেকদিন ৷ এই দোকানে চা খেতেও আসত ৷ একদিন সে পার্বতী নদীর উৎস সন্ধান করতে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে একা চলে গিয়েছিল পাহাড়ে ৷ আর ফিরে আসেনি ৷ পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথায় সে হারিয়ে গেছে, কী করে আর জানা যাবে!

আমি পার্বতী নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷

যুবকটি কি শেষ পর্যন্ত পার্বতীর উৎসমুখে পৌঁছতে পেরেছিল? কত দূর থেকে এসেছিল সে, একা একা কেন গেল ওই দুর্গম পাহাড়ে ৷

সে বোধহয় এই নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল ৷ নদী তাকে বুকে টেনে নিয়েছে?

ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৯

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন