অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
অন্য সব লেখালেখির বেলায় আমার যে কলমটার পায়ে ঘোড়ার কদম, ভ্রমণকাহিনী লিখতে বললেই সে ব্যাটা হয়ে যায় ধোপার বাড়ির গাধা ৷ যেন পিঠে চেপেছে এমনই গুরুভার যে পা আর নড়ে না ৷
একেবারেই যে ভ্রমণকাহিনী লিখিনি তা নয় ৷ কিন্তু লিখতে বসলেই দেখি, ভুবন উধাও ৷ তার বদলে স্মৃতির কৌটোয় যা পড়ে আছে, সেটা ভবন ৷ অর্থাৎ কিছু বাড়িঘর ৷ মানে মিউজিয়াম আর গ্যালারি ৷
৮৬-তে লন্ডন থেকে ফিরেই যা একটা মোটামুটি বড় লেখা ৷ সেও শুধু লন্ডনকে নিয়েই ৷ সেবারেই ফ্লোরেন্স, রোম আর ভেনিস ৷ রোম তেমন পছন্দ হয়নি ৷ কিন্তু ফ্লোরেন্স আর ভেনিসকে নিয়ে লেখবার জন্য মনের ডানায় ছটফটানি ৷ তবু লেখা হয় না ৷ লিখতে গেলে পড়তে হয় ৷ না পড়লে চোখের দেখাটা হয়ে যায় কেবল রূপে ভোলা ৷
রোমের সিসটাইম চ্যাপেলটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যখন, চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করেনি আপনার, কপালে সৌভাগ্যের এমন চন্দনটিপের ছোঁয়ায়? নিজেকে মনে হচ্ছিল না সেই আলিবাবার মতো, চিচিং ফাঁক বলার পরেই যার সামনে খুলে গিয়েছিল ধন-দৌলতের এক অবিশ্বাস্য সাম্রাজ্য! মুগ্ধ হয়ে, পরম পরিতৃপ্তির সুবাতাসে বুকের পাঁজরটাকে নৌকার পালের মতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, যেন একটা আস্ত স্বর্গ কেনা হয়ে গিয়ে এখন পকেটে রুমালের ভাঁজের ভেতর, এমনই এক অনুভবে পা-টলমল আপনি বেরিয়ে এলেন বাইরে ৷ এরপর দিন যায় ৷ দিন যায় আর আপনার ভেতরে টুপ-টাপ করে ফুটতে থাকে সন্ধের আকাশের নক্ষত্ররা ৷ আসলে নক্ষত্র নয়, প্রশ্ন ৷ জানবার ইচ্ছে ৷ কবে তৈরি হয়েছিল এই সিসটাইন চ্যাপেল? কারা তৈরি করতে চেয়েছিল? মাইকেল এঞ্জেলো একে সাজানোর দায়িত্ব পেলেন কীভাবে? কতদিন লেগেছিল তাঁর এই বিশাল চিত্রমালাটি আঁকতে? কেমন করে এঁকেছিলেন? একাই, না সহযোগিতা ছিল অনেক সহকারীর? এমনই সব প্রশ্ন ৷ যতক্ষণ না জানা হচ্ছে এর উত্তর, আপনার চেতনার ভেতরে আবছা হয়ে যাচ্ছে প্রথম দেখার অমন আলোকিত সৌভাগ্য, অমন আলোড়িত উচ্ছ্বাস ৷
ফ্লোরেন্সে দেখার কত কী ৷ ছোট্ট শহর ৷ তবুও তার যেখানে পা ফেলবেন, ইতিহাস ৷ যেদিকে তাকাবেন, শিল্প ৷ যেখানে গিয়ে দাঁড়াবেন, পাশেই কোনও-না-কোনও লোভনীয় ভাস্কর্য ৷ কিন্তু কী আছে ভেনিসে? জলের তৈরি রাজপথ ৷ জলের অলিগলি, বিস্তর সেতু, তারচেয়েও বিস্তর গণ্ডোলা, সেন্ট মার্ক স্কোয়্যার, সেন্ট মার্ক গির্জা, রাজপ্রাসাদ, ঘড়িঘর, সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা, শয়ে শয়ে ট্যুরিস্ট, আর সেন্ট মার্ক স্কোয়্যারের চত্বরে বুঝি বা লাখখানেক সাদা পায়রার ওড়াওড়ি-এই দেখলেই তো ফুরিয়ে গেল সব ৷
কিন্তু হায় রে, এ মনমোহিনীর খপ্পরে একবার পড়লে আর রক্ষে নেই ৷ কিছু না পরেই এ যেন সালঙ্কারা ৷ কিছু না সেজেই যেন ভুবনেশ্বরী ৷ তাই আজ নয়, ইতিহাসের সেই কোন অতীতকাল থেকেই এই যাদুকরীর প্রেমে সবাই হাবুডুবু ৷ দান্তে থেকে গ্যেটে, শিলার, শেক্সপীয়ার, শেলি, টার্নার মায় নেপোলিয়ান বা নেপলিয়ঁ পর্যন্ত মহাপুরুষেরা কাত ৷
ভেনিস নিয়ে লিখব লিখব করেও লিখে উঠতে পারলাম না আজও ৷ পারলাম না যে ব্যামোটার জন্য, সেটা ওই আরও জানার ইচ্ছে ৷ পৃথিবীর মোট কতজন বিখ্যাত কথাশিল্পী আর চিত্রশিল্পীকে সে নিজের মায়াবী-হাতছানিতে টেনে এনেছে বুকের কাছে, তার তত্ব-তল্লাস করতে গিয়ে থৈ পাই না আর ৷ লেখা তাই শেষ হল না আজও ৷
সেই কবে ৮৯-তে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কৃষ্ণকলি মেয়েটি ‘কথোপকথন’-এর বিমুগ্ধা পাঠিকারূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আত্মনিবেদনের ভঙ্গিতে, এখনও মনে আছে তার নাম ৷ প্যাঁচ ঘোরালেই যেমন বেসিনের কলে জলের তোড়, সেভাবেই স্মৃতির কোনও একটা চ্যানেলের ‘নব’ টিপেই পেয়ে যেতে পারি তার সঙ্গে আলাপচারিতার চিত্রমালা ৷ অথচ এই সেদিন, গত বছর অর্থাৎ ৯২-এর সেপ্টেম্বরের তিন তারিখ থেকে আট পর্যন্ত যে মহিলার সঙ্গে আমি অথবা যে-মহিলা আমার সঙ্গে গায়ে গায়ে সর্বক্ষণই প্রায়, কিছুতেই নামটা মনে করতে পারছি না ৷ মনে থেকে যাবে ভেবে নিয়ে লিখে রাখিনি ৷
যাকে সঙ্গে নিয়ে উঠছি-বসছি, হাঁটছি, সিনেমা কিংবা শহর দেখছি, আমি যে তার ভাষা বুঝিনে ৷ সে ফরাসি ছাড়া জানে না অন্য ভাষা ৷ ফরাসি ভাষার এক বর্ণ বোঝার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি নেই আমার মগজে ৷ তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ৷ ধন্যবাদ এই কারণে যে, মানুষ নামক এই ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন দ্বিপদ মানুষটি ইচ্ছে করলেই হয়ে যেতে পারে চতুষ্পদ প্রাণীদের জাতভাই ৷ তখন দেখা যায় মুখের উচ্চারিত ভাষা ছাড়াও সে কথা বলতে পারছে অন্যভাবে ৷ তার কথা বলার জন্য রয়েছে দুহাতের দশটা আঙুল, দু-দুটো দপদপে চোখ, নাক-ঠোঁট-ভুরু ইত্যাদি নিয়ে একটা আস্ত মুখমণ্ডল ৷ তদুপরি এমনই ছন্দমাখানো একটা গোটা শরীর, যার কাছে পয়ার ত্রিপদী কিংবা মন্দাক্রান্তাও পেয়ে যেতে পারে লজ্জা ৷
যার কথা বলছি অর্থাৎ কথা না-বোঝার কথা, আমি সেইভাবেই বুঝতাম তার ভাষা ৷ সে আমার ৷ ভাববেন না, শোনাচ্ছি আজগুবি কিছু ৷ এমন ঘটনা ঘটে ৷ চ্যাপলিন আর ককতো-র আলাপটা হয়েছিল ওইভাবেই ৷ চ্যাপলিন জানেন না ফরাসি ৷ ককতো জানেন না ইংরিজি ৷
ব্যাপারটা গোড়া থেকেই শুরু করা যাক ৷ ৯২-এর আগস্টে আচমকা ব্রাসেলস থেকে আমন্ত্রণপত্র ৷ ওখানকার ‘লিয়েজ’ নামের একটা জায়গায় দুবছর অন্তর বসে আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব ৷ দিন পাঁচেকের অনুষ্ঠান ৷ এবারে ৩ সেপ্টেম্বর ৷ ৮-এ শেষ ৷ আমন্ত্রণ সেখানে যোগ দেওয়ার ৷ খেতে দেবে ৷ থাকতে দেবে ৷ কিন্তু গাড়িভাড়া দেবে না ৷ গাড়ি মানে এক্ষেত্রে বিমান ৷ সর্বনাশ, বিমানভাড়া মানে তো এক রাশ টাকা ৷ টাকা ছাড়াও সমস্যা ছিল আরও ৷ এদিকে প্যারিসের যে বন্ধুটি ব্রাসেলস কমিটির কাছে সুপারিশ করেছেন আমার নাম, তাঁর দিক থেকে নিয়মিত তাড়া ৷ চিঠিতে এবং টেলিফোনে ৷
শেষ পর্যন্ত অনেক সাত-পাঁচ ভেবে জানিয়ে দিই সম্মতি ৷ পয়সা বাঁচাতে বেছে নিয়েছি বাংলাদেশ বিমান ৷ কিন্তু বিপদ একটাই ৷ তাদের প্লেন প্যারিসে পাড়ি দেয় সপ্তাহে একদিন ৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, আমি ব্রাসেলসের অনুষ্ঠানের প্রায় পাঁচ-ছদিন আগে পৌঁছে যাচ্ছি প্যারিসে ৷ থাকব কোথায়! প্যারিসের বন্ধুটি ব্যবস্থা করে দিলেন তারও ৷ জানালেন, দুর্দান্ত একটা ঘরের ব্যবস্থা করেছেন আমার জন্য ৷ ইচ্ছে করলে ওখানে বসে কবিতা তো লিখতে পারিই এমনকী এঁকে ফেলতে পারি ছবির পর ছবি ৷
প্যারিসে গিয়ে দেখি সেটা একটা সাময়িক পান্থশালা ৷ দৈনিক ভাড়া ৯৫ ফ্রাঁ ৷ চারতলার ওপরে একখানা ঘর ৷ কোনওমতে একটা বিছানা ৷ আরেকটা নড়বড়ে এলেবেলে টেবিল ৷ না ওয়ার্ডরোব, না আলনা, না লাগোয়া বাথরুম এমনকী না একটা জলের গেলাস ৷ বাথরুম কোথায়? ঘরের বাইরের করিডরের বাঁ-ধারে ৷ তিন প্যাঁচ চাবি ঘোরালে খোলে তবে দরজার লক ৷ আবার উল্টো তিন প্যাঁচ ঘোরালে বন্ধ ৷ চলো বাথরুমে ৷ ওইখানেই হাতে তেলো পেতে খেয়ে নাও জল ৷ ফোন করতে হবে একে-ওকে-তাকে ৷ ফোন কোথায়? নিচে, গ্রাউন্ড ফ্লোরে ৷ আবার তিন প্যাঁচ ঘুরিয়ে লক বন্ধ ৷ নামো লিফটে করে নিচে তরতরিয়ে ৷ ফোন কর নগদ কড়ি ফেলে ৷ ফোন না হয় হল ৷ যাকে ফোন করছি, ধরা যাক সে বাড়িতে নেই ৷ তাহলে কি হবে ৷ মেসেজ না হয় দেওয়া রইল ৷ কিন্তু আমাকে ফোন করলে পাব কী করে? পাব না ৷ পেতে গেলে আমাকেই আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন করতে হবে তাকে ৷ অর্থাৎ ওই ফোনের জন্যই তোমার নড়ন-চড়ন বন্ধ ৷
দ্বিতীয় দিন বেলা তিনটেয় এক দেবদূত এসে হাজির ৷ নাম আমীরুল আরহাম ৷ বাংলাদেশের ছেলে প্যারিসে থাকে ৷ এখানেই তালিম নিয়েছে সিনেমার কলাকৌশলে ৷ ছোট মাপের ছবি বানিয়েছে কয়েকটা ৷ এখন পূর্ণ দৈর্ঘ্যে র ছবির ভাবনা ঘুরছে মাথায় ৷ মুহূর্তে সে হয়ে গেল যেন কতকালের চেনা আপনজন ৷ একটুখানি আলাপের পরই বললে, চলুন বেরোই ৷ সাঁজালিজের দিকে ঘুরি ৷ তারপর আপনাকে নিয়ে যাব একজন শিল্পীর বাড়িতে ৷ কী নাম শিল্পীর? বললে সাহাবুদ্দিন ৷ জানালাম, শিল্পীকে দেখিনি কখনও কিন্তু ওঁর কাজের সঙ্গে পরিচয় ৷ খুব ফোর্সফুল, দুর্বার গতির মানুষ আঁকেন না? হ্যাঁ ৷ আজ ওর বড় মেয়ের জন্মদিন ৷ তাই? তাহলে তো ওকে দেওয়ার মতো কিছু নিতে হয় সঙ্গে ৷ স্যুটকেশ খুলে বের করি, ‘আমার ছেলেবেলা’ ৷ ছড়ার বই ৷ নিজেরই লেখা ৷ জন্মদিনের আসরে গিয়ে পেয়ে গেলাম এক আশ্চর্য দম্পতিকে ৷ আনা আর সাহাবুদ্দিন ৷ সাহাবুদ্দিন অতটা চিনতেন না আমাকে ৷ আনার পড়া ছিল আমার লেখা ৷ আর দেখা ছিল ‘স্ত্রীর পত্র’ ৷ ফলে ওই এক রাতেই হয়ে গেলাম ঘরের লোক ৷ যেহেতু পান-ভোজনের আসর চলেছিল অনেকটা রাত পর্যন্ত, তাই রাতটা ওখানেই কাটানো ৷ আবার, সকাল হতেই, আমার জন্য নির্ধারিত নির্বাসন-কক্ষে ফিরে যাওয়ার জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছি, ব্রেকফাস্টের খাবারে বসিয়ে আনা আর সাহাবুদ্দিন দুজনেরই অনুরোধ-যেখানে উঠেছেন, জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসুন এখানে ৷ এলে তো বেঁচে যাই ৷ কিন্তু পুরো পাঁচদিনের পাওনা টাকাটা তো মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে আগে ৷ অগত্যা ঠিক হয়, দু-তারিখ বিকেলে চলে আসব এখানে ৷ পরদিন এখান থেকেই পাড়ি দেব ব্রাসেলসে ৷
৩ সেপ্টেম্বর ৷ প্যারিস থেকে ট্রেনে ব্রাসেলস ৷ ব্রাসেলস থেকে পুনরায় ট্রেন বদলিয়ে লিয়েজ ৷ লিয়েজ-এর স্টেশনেই দেশ-বিদেশের অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে হাজির দুই মহিলা ৷ একজন কুমারী ৷ অন্যজন বিবাহিতা ৷ কিঞ্চিৎ বয়স্কা ৷ তবে রূপে-গুণে-গড়নে দুখ-জাগানিয়াও বলতে পারেন অথবা ঘুম-ভাঙানিয়া ৷ স্টেশনে থেকে অতিথিদের জন্য বরাদ্দ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে গাড়ির খানিকটা ঘাটতি ৷ তাই স্টেশনেই চুপচাপ বসে থাকতে হয়েছিল কিছুক্ষণ ৷ তখনই চোখে চোখে আলাপ বয়স্কাটির সঙ্গে ৷ পরদিন সকাল থেকেই তার প্রিয়-বান্ধবীতে রূপান্তর ৷ কী করে ঘটল? ধৈর্য ধরুন, সেটাই তো বলছি ৷
নামে কীবা আসে যায়? শেক্সপীয়ার তো বলেই দিয়েছেন, যে নামেই ডাকা হোক না গোলাপকে, সুগন্ধ বিলোবে একই ৷ তাই ধরে নেওয়া যাক, তার নাম ভিকতোরিয়া ৷ লিয়েজ-এর ‘প্যালেস দ্য কংগ্রেস’ নামের এক অতি আধুনিক স্থাপত্যের অভ্যন্তর ওই কবি উৎসবের জন্য নির্ধারিত স্থান ৷ সেখানে ঢুকতেই এক বৃদ্ধা মহিলা নিজের থেকেই এগিয়ে এলেন আলাপ করতে ৷ আমার চেহারা রং-ঢং দেখেই সম্ভবত বুঝে গেছেন, তৃতীয় বিশ্বের কালা আদমী ৷ ইংরিজি জানেন বেশ পরিষ্কার ৷ ফলে জমে উঠল আলাপ ৷ কথায় কথায় বলে ফেলেছি যে, আমি একজন আর্টিস্টও ৷ বৃদ্ধা চমকে উঠলেন উল্লাসে ৷ অ্যাঁ, তুমি একজন আর্টিস্টও? এই বৃদ্ধা অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে রয়েছেন উৎসবের সঙ্গে ৷ ইউনেস্কো ছাড়া আরও যেসব সরকারি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান সাহায্য করছে এই উৎসবকে, তার মধ্যে রয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৷ ইনি ওই ইন্টারন্যাশনালের একজন প্রতিনিধি ৷ প্রথম আলাপের মুহূর্তেই জানিয়েছিলেন, একটা ইন্টারভিউ নেবেন আমার ৷ আর প্রথম আলাপের কথাটা রটিয়ে বেড়াতে লাগলেন বেশ-জানাদের মধ্যে ৷ সেই বেশ-জানাদের মধ্যে একজন ভিকতোরিয়া ৷ সেও এখানকার উৎসব-কমিটির অভ্যর্থনা সমিতির একজন ৷ ঘুরে ঘুরে পাঁচকান হতে হতে, কথাটা কানে পৌঁছল তারও ৷ স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে জমাল আলাপ ৷ অন্ধ যেভাবে অন্ধকার হাতড়ে ঠিকঠাক এগোয় গন্তব্যের দিকে, সেভাবেই এগোই তার না-বোঝা ভাষার সিঁড়ি ভেঙে, তার অকপট আন্তরিক বন্ধুত্ব ঘোষণার অন্দরমহলে ৷ এই শুরু ৷ পরদিন সকালেই সামনে মেলে ধরল ছোট্ট একটা খাতা ৷ ইশারায় জানাল, ছবি এঁকে দিতে হবে ৷ আঁকলাম ৷
প্রথমটা হয়ে গেল খানিকটা মাতিস-মার্কা ৷ সে তো মুগ্ধ ৷ কিন্তু আমি নই, ভাবলাম এ আঁকা দেখলে কেউ কেউ হয়তো ভাববে আমরা আমাদের নিজস্বতার শিকড় হারিয়ে হয়ে গেছি ইওরোপীয় শিল্পের গাছপালাকে জড়ানো স্বর্ণলতা ৷ মানে পরগাছা ৷ তাই আরও একটা ছবি আঁকি ৷ ভারতীয় দৃশ্য ৷ গাছপালাময় ৷ দ্বিতীয়টা পেয়ে লাফিয়ে উঠল সে ৷ পরে ইংরিজি-জানা বৃদ্ধাদের মুখে শুনেছি, ওর নাকি ভীষণ বাগানের শখ ৷ গাছপালার ওপর গভীর টান ৷
ব্যস, ওই ছবিই হয়ে গেল আমাদের বন্ধুত্বের পুরোহিত ৷ আর এর পরেই ভিকতোরিয়া স্বেচ্ছায় বেছে নিলে আমার প্রতিভার পয়লা নম্বর প্রচারকের দায়িত্ব ৷ ডেকে ডেকে লোককে দেখিয়ে বেড়ায় নিজের খাতা ৷ দূর থেকে দেখতে পাই তার খুশি-ছলকানো মুখ ৷ কী যেন বলে চলেছে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ৷ মাঝে মাঝে একে-ওকে টেনে আনে আমার কাছে ৷ ছবি এঁকে দিতে হবে ৷
কংগ্রেস প্যালেস স্থাপত্যের দোতলায় একটা অংশ যেন জাহাজের ডেক ৷ নিচে খালের জল, বোট, নৌকা ৷ কনকনে হাওয়া থেকে থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আর শীত বেশ জাঁকালো ৷ আমার মতো শীতকাতুরে তাই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না সেখানে ৷ সামনেই বসবার জন্য গদি পাতা ৷ ভিকতোরিয়া চায়ের কাউন্টার থেকে চা এনে সামনে রাখে ৷ আর ছবি আঁকার সাদা কাগজ ৷ এঁকে যাই ৷
যারা পায় তারা প্রশংসা ছোড়ে ৷ ইংরিজিতে বললে বুঝি ৷ ফরাসি বললে, না বুঝেও মুখে ফুটিয়ে রাখি সৌজন্যের হাসি ৷ কিন্তু প্রশংসার সোনাদানার সবটা আমার কাছে পৌঁছয় না ৷ অর্ধেকটা চলে যায় ভিকতোরিয়ার মুঠোয় ৷ যেন আমার কৃতিত্বের সেও সমান অংশীদার ৷ দুজনে মিলে পার্টনারশিপের ব্যবসা যেন ৷ আমি যেন তারই এক মহার্ঘ প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কার, মুখমণ্ডলের চালচিত্রে সেভাবেই জ্বলছে নিভছে জ্বলছে যেন এক গর্বিত নিয়ন সাইন ৷
অতঃপর বেশ একটা কেউকেটা মনে হতে থাকে নিজেকে ৷ ভাষা না জানার ফলে নিজেকে গুটিয়ে শামুকের মতো খোলের মধ্যে পুরে রেখেছিলাম এ কদিন ৷ এবার খোলের ভেতর থেকে মুখ বাড়াই ৷ মুখ বাড়াবার ফলেই আলাপ হয়ে যায় মার্কের সঙ্গে ৷ পুরো নাম, মার্ক ইমব্রেখটস ৷ নিজে কবি ৷ তদুপরি প্রকাশক ৷ বের করে লিটল ম্যাগাজিন ৷ আর ছোট ছোট সংকলন গল্প-কবিতার ৷ চেহারা-চরিত্র, ভাব-ভঙ্গি এমনই যে ফরাসি বা বেলজিয়ামের বদলে বাংলাটা বলতে পারত যদি, হুবহু কলকাতার ছেলে ৷ কলকাতার বইমেলায় মাঠের কোনও একটা প্রান্তে চিলতেখানেক স্টল নিয়ে গোছা গোছা হালকা, পাতলা, ছিপছিপে, রোগা ছনছনে, ঝকঝকে, লিটল ম্যাগাজিন, কিংবা এক ফর্মা-দুফর্মার কবিতা সংকলন বেচতে বসে যায় যারা, মার্ক যদি কোনওদিন তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াত, স্বচ্ছন্দে মানিয়ে যেত অন্যদের সঙ্গে ৷ যৎসামান্য আলাপের পরই মার্ককে যখন বললাম, আমার সঙ্গে কিছু ছবি আছে ৷ আমারই আঁকা আর সিল্ক স্ক্রিনে মনোকালারে ছাপা ৷ তোমার স্টলে টাঙিয়ে রাখতে রাজি থাকলে নিয়ে আসব কাল ৷ যদি বিক্রি হয় তুমি কেটে নেবে তোমার প্রাপ্য কমিশন ৷ মার্ক এককথায় রাজি ৷ পরদিন গুনে গুনে মাত্র তিনটে ছবি এনে তুলে দিই ওর হাতে ৷ ও একটা টাঙিয়ে বাকি দুটো গুটিয়ে রাখে ওর নিজের বইপত্রের ভেতরে ৷
ওর ছোট্ট স্টলটা সম্মেলনের ভোজনালয়ে ঢোকার মুখে ডানদিকে ৷ লাঞ্চে ঢুকেছিলাম দল বেঁধে ৷ বেরিয়েই শুনি একটা নয়, তিন-তিনটে ছবিই বিক্রি ৷ বলে কী ছোকরা? সত্যি? সত্যি ৷ এই নাও তোমার পাওনা ৷ হায় আল্লা ৷ যেখানে থাকতে দিয়েছে সেটা শহরের একটা প্রান্তে ৷ দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসব আরও কয়েকটা ছবি, তার উপায় নেই ৷ মনকে সান্ত্বনা দিই তখন, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট ৷ বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে যেটুকু দই, তাতেই তুষ্ট থাকা শ্রেয় ৷ তখন কি আর জানি ছবি কিনেছেন কে বা কারা ৷
ডিনারের আগে প্রভূত রঙিন পানীয়ের ব্যবস্থা প্রত্যেকটা দিনই ৷ এবং একেকদিন একেকটা বিশেষ রাজকীয় স্থাপত্যের অন্দরমহলে ৷ সেদিন সেখানেই ভিকতোরিয়া আলাপ করিয়ে দিল যে বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে, দেখলেই বোঝা যায় বেশ দাপটের কেউ ৷ দৈর্ঘ্যে -প্রস্থে প্রায় সমান সমান ৷ অর্থাৎ পিপেসদৃশ ৷ মাথার চুল মেহেদি-লাল ৷ কিন্তু সাজে-সজ্জায় মার্জিত ৷ আর চোখে-মুখে ব্যক্তিত্ব-পাণ্ডিত্য, মোটরগাড়ির হেডলাইটের মতো দপদপে ৷ অনুগ্রহ করে নাম জিজ্ঞেস করবেন না ৷ এঁরও নাম-ঠিকানা লেখা কাগজখানা খুঁজে পাচ্ছি না আর ৷ মোটমাট জেনে রাখুন, তিনি ওখানকার মানে ব্রাসেলস-এর সংস্কৃতিজগতের পুপুল জয়কার-এর মতোই অনেকটা ৷ তাঁর মুখে আমার ছবির প্রশংসা শুনে তো আমি থ ৷ নগদ দাম দিয়ে একটি কিনেছেন তিনি ৷ আলাপ জমে ওঠে বেশ ৷ যেহেতু ইংরিজি জানেন ৷ তবে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ধ্যানধারণাটা খুবই সীমাবদ্ধ ৷ টাগোর আর গানডি ছাড়া আর কারও নাম জানেন না ৷ এমনকী সত্যজিৎ রায়েরও নয় ৷
সুসময় ছপ্পর ফুঁড়ে আসে ৷ দৈবক্রমে ওখানেই আলাপ এক জ্বলন্ত মোমবাতিসদৃশ যুবকের সঙ্গে ৷ নাম, মিচেল ক্লিকে ৷ কবি ৷ বই বেরিয়েছে মাত্র একটা ৷ নামটাকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় জ্বলন্ত মোমবাতির দুটো দিক ৷ মানে দুদিকেই জ্বলছে মোমবাতিটা ৷ কলকাতার কবিতা নিয়ে ভাসা-ভাসা কিছু কথাবার্তা হতে হতেই ঘন বন্ধুত্ব ৷ এখানকার কবিতা-উৎসব শেষ হলে কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করতেই বলি, ব্রাসেলসে ৷ তখুনি তার প্রস্তাব, তাহলে চলো আমার সঙ্গে ৷
গাড়ির চালক তার কোনও এক বান্ধবীই হয়তো ৷ ঠিকঠাক জানার উপায় নেই ৷ ৮ তারিখে লাঞ্চের পরই উৎসব শেষ ৷ ঘড়ির কাঁটায় সেটা শেষ হওয়ার অনেক আগেই তল্পিতল্পা নিয়ে চেপে বসি মিচেলের বান্ধবীর গাড়িতে ৷
ব্রাসেলসে থাকার জায়গা ছিল ৷ টেলিফোনে ব্যবস্থা করে দিয়েছিল প্যারিসের আনা আর সাহাবুদ্দিন ৷ মিচেল বলল, ঠিক আছে, সেখানেই যাবে ৷ আগে তো আমার বাড়িতে ওঠো ৷
গাড়ি ছুটল ব্রাসেলস-এর দিকে ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন