অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
অমরনাথের চিরাচরিত পথ এখনও কষ্টসাধ্য, কিন্তু সে পথে যাত্রীসাধারণের জন্য আয়োজনের ত্রুটি নেই ৷ শুনেছি সে পথ প্রকৃতি সৌন্দর্যে অবর্ণনীয় ৷ পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি, শেষনাগ, পঞ্চতরণী হয়ে সে পথে যাত্রীদের সঙ্গে ‘ছড়ি’ যাত্রায় নতুন মাত্রার অভিজ্ঞতা ৷ দশ হাজার যাত্রী একসঙ্গে চলেছে, ভাবলেই মনে শিহরণ ওঠে ৷ কিন্তু পহেলগাঁওয়ে ফিরে আসতে পাঁচদিন লাগে ৷ তার ওপর যাত্রাও হবে একটি বিশেষ দিনে যাতে শ্রাবণী পূর্ণিমার সকালে অমরনাথ পৌঁছনো যায় ৷
আমার আগ্রহ কম ছিল না, কিন্তু কিছুতেই যাত্রার দিনক্ষণের সঙ্গে আমার সুবিধা ও সামর্থের সংযোগ ঘটাতে পারিনি ৷ এমনি করে কয়েক বছর কেটে গিয়েছে, যেতে পারিনি কিন্তু যাবার আগ্রহ বছরে বছরে যেন আরও বেড়েছে ৷
তখন অমরনাথ যাবার দ্বিতীয় পথের কথা জানি না ৷ বস্তুত সরকারি পর্যটনবিভাগও এই পথের কোনও প্রচার করেন না, কেউ যেতে চাইলে বরং নিরুৎসাহ করেন ৷ বলেন, ওই পথে যাত্রীদের সুখ-সুবিধার কোনও আয়োজন নেই, পথ দুর্গম, বিপজ্জনক, ভঙ্গুর ৷
হঠাৎ এক অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কথায় কথায় অমরনাথের দ্বিতীয় পথের কথা শুনলাম ৷ তিনি স্বয়ং ওই পথে অমরনাথ দেখে এসেছেন ৷ শ্রীনগর থেকে একদিনে যাতায়াত করা যায় ৷ এত সহজ শুনে উল্লসিত হয়েছিলাম ৷ ভদ্রলোক নিরস্ত করলেন ৷ বললেন, পথ অতি দুর্গম, অতি পরিশ্রমের, রাস্তায় সামান্যমাত্র আশ্রয়ও নেই ৷ পাশে হাজার ফুটের খাদ, প্রায়ই মানুষ-ঘোড়া-খচ্চর পড়ে যাচ্ছে, প্রাণ হাতে নিয়ে যেতে হয় ৷
তখন কি জানি এপথ সত্যিই ভয়ঙ্কর ৷ আসলে অনেক জায়গায় পথই নেই ৷ তাই অল্প যাত্রীই এপথে যান ৷ দুর্ঘটনাও হয় প্রতি বছর ৷
অমরনাথকে স্মরণ করে শ্রাবণী পূর্ণিমার পরদিন আমরা পাঁচজন শ্রীনগর পৌঁছলাম ৷ আস্তানা নিলাম হাউসবোটে ৷ বোটের মালিক আমাদের অভীষ্ট শুনে বলল, আপনারা রাত দুটোয় রওনা হয়ে যান ৷ আমি ট্যাক্সি বলে রাখছি ৷
রাত দুটোয় কেন? আমরা যে শুনেছি শোনমার্গ হয়ে বালতাল পৌঁছতে দুঘণ্টা মতো লাগে? বোটওয়ালা বলল, সকাল-সকাল যাওয়া ভালো ৷ না হলে ঘোড়া পাবেন না ৷ অন্য যাত্রীরা নিয়ে চলে যাবে ৷
আমি বোটওয়ালাকে আদৌ আমল দিলাম না ৷ বললাম, আমরা ভোর চারটেয় রওনা হব ৷
অতএব আমরা ভোর চারটের সময় রওনা হলাম ৷ শোনমার্গ হয়ে বালতাল যাব ৷ বলা যায় বালতাল অমরনাথের বেসক্যাম্প ৷ ট্যাক্সি অনেক আগেই এসে গিয়েছিল ৷ ডাললেকের ওপার থেকে ট্যাক্সিওয়ালার চিৎকার নিশির ডাকের মতো ভেসে এল ৷ শিকারা তৈরি ছিল ৷ আমরা বোট থেকে শিকারায় ওপারে পৌঁছে ট্যাক্সিতে উঠলাম ৷ আকাশে কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ ৷ ডাললেক তরল রুপোর মতো ঝকঝক করছে ৷
বালতালে যখন পৌঁছলাম তখন সবে আলো ফুটছে ৷ নদীর ধারে ক্ষুদ্র জনপদ ৷ দুটো-তিনটে যাত্রীবাস, কয়েকটা তাঁবু ৷ অমরনাথ যাবার আর সেখান থেকে ফেরার পথে যাত্রীরা এখানে বিশ্রাম করে নেয় ৷ এখান থেকে অমরনাথ ষোল-সতেরো কিলোমিটার ৷ ক্রমে সকাল হল ৷ মানুষজনও কিছু দেখা গেল ৷ কিন্তু ঘোড়া কোথায়? একজন ঘোড়াওয়ালাকেও দেখতে পেলাম না ৷ খোঁজখবর নেব কার কাছ থেকে? এরা বেশিরভাগই যাত্রী ৷ স্থানীয় মানুষও দুয়েকজন ছিল ৷ তারা নানারকম খবর দিতে লাগল ৷ আমাদের এত উৎসাহ নিয়ে এত প্রত্যাশার সঙ্গে এখানে আসা-সব বৃথা হতে চলেছে? শোনা গেল, সব ঘোড়া রওনা হয়ে গিয়েছে ৷ এখন ওপর থেকে ঘোড়া না ফেরা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে হবে ৷ আরও শুনলাম, ঘোড়াওয়ালারা সব পুলিশের অত্যাচারে আশপাশের গ্রামে চলে গিয়েছে ৷ তারা আর আসবে না ৷ পুলিশ নাকি ঘোড়া নিজের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে ৷ ঘোড়াওয়ালাদের কোনও পারিশ্রমিক দিচ্ছে না ৷
এত খবর নিয়ে আমাদের কী হবে? ঘোড়া আদৌ পাওয়া যাবে কি না বুঝতে পারছি না ৷ একজন বলল, ঘোড়াওয়ালারা ৫০০ টাকার কমে যেতে রাজি নয়, যাত্রী পাচ্ছেও সেই দামে ৷ অথচ পুলিশ রেট বেঁধে দিয়েছে ১২৫ টাকা ৷ সেই জন্য ঘোড়াওয়ালারা আশপাশের গ্রামে চলে গিয়েছে ৷ এযাত্রায় আর আসবে না ৷
কোথাও এতটুকু আশার খবর শুনলাম না ৷ ইতিমধ্যে অমরনাথ থেকে ফেরা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে দেখা হল ৷ তাঁরা গতকাল সকালে গিয়েছিলেন ৷ সারারাত হেঁটে আজ সকালে বালতাল পৌঁছেছেন ৷ তাঁরা বললেন, ওপরে কয়েকটি ঘোড়া আছে বটে, আজ হয়তো যাত্রী নিয়ে নামবে ৷ এমন আশাভঙ্গ হতে পারে ভাবতেই পারিনি ৷ আমাদের কারও মুখে কথা নেই ৷ আমরা নীরবে ট্যাক্সির দিকে ফিরে গেলাম ৷ এগারোটার সময় শ্রীনগর ফেরত ৷
হাউসবোটওয়ালা বলল, আপনারা রওনা হতে বড় দেরি করে ফেলেছিলেন ৷ আরেকটু আগে গেলে ঘোড়া পেতেন ৷ শহরে গিয়ে কিছু খোঁজখবরের চেষ্টা করলাম ৷ কেউ কিছু জানে না, তবু খবর দেবার জন্য ব্যাকুল ৷ একজন খবর দিল, পুলিশ বালতালের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে ৷ কয়েকজন যাত্রী ও ঘোড়া খাদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে বলে ওপথে কাউকে আর যেতে দেওয়া হবে না ৷
আমরা নীরবে শুনছি ৷ সংকল্প করেছি, আরেকবার চেষ্টা করতে হবে ৷ আজ রাতেই ৷ ট্যাক্সি রাত দুটোয় ডাকা হল ৷ বোটওয়ালা এক বড় টিফিন ক্যারিয়ার ভরে গতরাতের মতো খাবার দিয়ে গেল ৷ কাল রাতের খাবার আর খোলা হয়নি ৷ আমাদের কারও খাবার মতো মনের অবস্থা ছিল না ৷
আবার চাঁদের আলোয় নিস্তব্ধ ডাল লেক পার হলাম ৷ ট্যাক্সিতে উঠলাম ৷ কেউ বিশেষ কথা বলছে না ৷ জানি সবার মনে একই প্রশ্ন ৷ আজ ঘোড়া পাওয়া যাবে তো? কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার ভরা জ্যোৎস্নায় শ্রীনগর ছেড়ে ছোট ছোট জনপদ পার হলাম ৷ দুয়েকটা কুকুর ছাড়া প্রাণের লক্ষণ নেই কোথাও ৷ সারা পৃথিবী যেন চাঁদের আলোর ইন্দ্রজালে অসাড়, মূর্চ্ছাবৃত ৷ একসময় শোনমার্গ পার হলাম ৷ তার একটু পরে রাস্তা চেন দিয়ে বন্ধ ৷ ট্যাক্সি ড্রাইভার কাকে ডেকে আনল, কে যেন সেই চেনের তালা খুলল, গাড়ি আবার চলতে শুরু করল ৷ লাদাখের রাস্তা বাঁদিকে রেখে যেখান থেকে নিচে নদীর ধারে বালতালে নামতে হয়, সেখানে আবার পথ বন্ধ ৷ উৎকণ্ঠায় আমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ৷ আবার ট্যাক্সি ড্রাইভার নেমে গেল ৷ কতক্ষণ পরে ফিরল কে বলবে ৷ আমাদের কোনও বোধ নেই ৷ ব্যর্থ হবার ভয়ে অসাড় হয়ে গিয়েছি ৷ আবার রাস্তার তালা খুলল ৷ আমরা বালতালে পৌঁছলাম ৷ তখনও সাড়ে চারটে বাজেনি ৷
আমরা নীরবে গাড়ির ভেতর বসে থাকলাম ৷ ক্রমে বালতাল জেগে উঠল ৷ কয়েকজন লোক এসে জিজ্ঞাসা করল আমাদের ঘোড়া চাই কিনা ৷ আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না ৷ এ কি স্বপ্ন, না মায়া? এরা কি দেবদূত? ঘোড়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল ৷ পাঁচশো টাকা করে ভাড়া ৷ ততক্ষণে কিছু লোকজন জমা হয়ে গিয়েছে ৷ তারা সবাই উপদেশ দিল রেট কিন্তু ১২৫ টাকা, আপনারা অমরনাথ থেকে ফিরে ১২৫ টাকা ধরিয়ে দেবেন ৷ পাহারাওয়ালাজির সামনে ১২৫ টাকা ধরিয়ে দিলে ঘোড়াওয়ালারা টুঁ শব্দও করতে পারবে না ৷ আমরা নীরবে সব শুনে গেলাম ৷ বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, শেষবারের মতো কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসেছেন, পাশ না করতে পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এমন সময় খবর এল আপনি প্রথম হয়েছেন ৷ আমরা সেই ধরনের এক অসাধারণ আনন্দে ভাসছি ৷ সবাই অনর্গল কথা বলছি ৷ চায়ের সন্ধানে গেলেন একজন ৷ টিফিন ক্যারিয়ার খোলার কথাও হল ৷ কিন্তু দেবদর্শনে অভুক্ত যাওয়া উচিত বলে টিফিন ক্যারিয়ার আর খোলা হল না ৷ আমরা ঘোড়া ছাড়া দুজন পিঠঠু নিয়েছি ৷ পিঠঠু মানে খিদমৎ করবার লোক ৷ তারা আমাদের জলের বোতল, টিফিন ক্যারিয়ার, ওভারকোট ইত্যাদি নিয়ে চলেছে সঙ্গে ৷ আমার পিঠঠুকে বলে রেখেছি, আমার ঘোড়া থেকে পড়ে যাবার প্রাণভয় আছে, সে যেন সর্বদা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে ৷ ইচ্ছা হলেও বলতে লজ্জা করল, যেন আমাকে একটু ধরে থাকে ৷
বেশ প্রশস্ত উপত্যকা দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল ৷ পাঁচ অশ্বারোহীর প্রসেশন ৷ দুকিলোমিটার পরে আরেকটি জনপদে পৌঁছলাম ৷ বড় একটা ধর্মশালা ৷ নদীর তীরে কিছু লোক, উনুনে আগুন পড়েছে, এবারে আমরা ধর্মশালাকে ডানদিকে রেখে পাহাড়ে চড়তে আরম্ভ করলাম ৷ রাস্তা ক্রমশ বেশ খাড়া হতে থাকল ৷ আশপাশে গাছপালার ফাঁক দিয়ে প্রত্যুষের সূর্যালোক এসে পড়েছে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছপালার জগৎ পিছনে ফেলে এলাম ৷ দুপাশে বৃক্ষহীন রিক্ত পাহাড় ৷ দুদিকের পাহাড়ের মাঝখানে অনেক নিচে নদীর ক্ষীণধারা ৷
ক্রমশ আরও উঁচুতে উঠতে লাগলাম ৷ কেমন যেন অবলম্বনহীন মনে হচ্ছে ৷ যেন শূন্যে ভাসছি ৷ পথে অন্য কোনও যাত্রী নেই ৷ চরাচর নিস্তব্ধ ৷ আমরা সার দিয়ে পরের পর চলেছি ৷ রাস্তা এত সঙ্কীর্ণ যে ওপাশ থেকে কোনও যাত্রী এলে সহজে পার হতে পারবে না ৷ আসলে রাস্তাই নয় ৷ পিছনে ফেলে আসা রাস্তা দেখলে মনে হচ্ছে রুক্ষ পাহাড়ে কে বুঝি নখের আঁচড় কেটেছে ৷ খুব ঘুরে ঘুরে উঠছি না ৷ সোজাসুজি যেন টাঙিয়ে ওপরে তুলে দিচ্ছে ৷ নদী আরও নিচে, অনেক নিচে, হয়তো দুহাজার ফুট হবে ৷ আমার মনে শান্তি নেই ৷ আমার ঘোড়ায় চড়তেই ভয় করে ৷ পড়ে যাবার ভয় ৷ পিঠঠু আমাকে বার বার বলছে নিচের দিকে তাকাবেন না, মাথা ঘুরবে ৷ কত যাত্রী নাকি নিচের গভীর খাদ দেখে ভয়ে মূর্চ্ছিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছে ৷ পিঠঠুকে কী করে বোঝাব, আমার সে ভয় আদৌ নেই, আমার ভয় আমি ঘোড়া থেকে পড়ে না যাই ৷ কত নিচে পড়ব জেনে বা দেখে আমার কোনও হেরফের হবে না ৷ ঘোড়ারও উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি ৷ তার পিঠ আর মাটির সঙ্গে সমান্তরাল নেই, পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে আছে, আমি জিন থেকে পড়ে যাবার আশঙ্কায় ঘোড়াকে প্রায় জড়িয়ে আছি, পিঠঠু আমাকে ধরেও রেখেছে ৷ খাদের ওপারে পাহাড়ের ঢালুতে ছোট-বড় হিমবাহ দেখতে পাচ্ছি ৷
মাঝে-মাঝে ছোট সাইনবোর্ড পড়ছে, পথ বিপজ্জনক, এগিয়ে যাও, থেমে থেকো না ৷ পিঠঠু বলল, এত বড় কাঁচা পাহাড়, ওপর থেকে প্রায়ই পাথর গড়িয়ে পড়ে ৷
আমি বুঝতে পারলাম না, আমার মতো ভীতু মানুষকে আর ভয় খাইয়ে লাভ কী? চলতে থাকলে পাথর পড়বে না, থেমে থাকলেই পাহাড় ভেঙে পাথর এসে পড়বে, এই বা কেমন যুক্তি ৷ সঙ্কীর্ণ রাস্তা, পাশে গভীর খাদ, তৃণগুল্মহীন পাহাড়, পদে পদে পাথর গড়িয়ে পড়বার আশঙ্কা, তার ওপর ঘোড়া থেকে পড়ে যাবার ভয় ৷ হেলমেট পরে আসা উচিত ছিল ৷ আকাশ পরিষ্কার নীল ৷ ঠান্ডা বাড়ছে ৷ ওভারকোট পরে নিয়েছি ৷ মনে মনে ভাবছি, বিশ্বকর্মার কন্ট্রাক্টরও তাহলে ঠকিয়েছে, নাহলে এমন পল্কা পাহাড় তৈরি হল কী করে, দুনম্বরী মাল দিয়ে?
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক চলার পর একটা মোড়ের মাথায় রাস্তা একটু চওড়া হল ৷ সেখানে একটা বড় পাথরের আশ্রয়ে একজন চায়ের দোকান খুলে বসেছে ৷ জায়গাটার নাম লেখা আছে ব্রারিবার্গ ৷ জনমানবহীন এই বৃক্ষহীন রুক্ষ পাহাড়ের মাঝে স্থানের নাম দেবার কী অর্থ জানি না ৷ বহুকষ্টে প্রায় পিঠঠুর গলা জড়িয়ে ধরে ঘোড়া থেকে নামলাম ৷ হাত-পা কেমন শক্ত হয়ে গিয়েছে ৷ জয়েন্টগুলো যেন কাজ করতে চায় না ৷ ওপাশ থেকে কয়েকজন যাত্রী এসে পৌঁছলেন পদব্রজে ৷ তাঁরা ভোরবেলা অমরনাথ ছেড়েছেন ৷ বললেন, এ আর কী দেখছেন, কঠিন চড়াই তো এর পরে ৷ আরও খবর দিলেন লিঙ্গ ছোট হয়ে গিয়েছে ৷ এবার শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনও নাকি পাঁচ ফুট উঁচু হয়নি ৷
আবার ঘোড়ায় উঠে পড়া ৷ পথ বুঝি এবার আকাশ ছুঁতে চাইছে ৷ বাঁকের মুখে পিছনে ফেলে আসা পথ যেন মনে হচ্ছে কোনওক্রমে পাহাড়কে আঁকড়ে আছে ৷ মাঝে মাঝে উতরাই আসছে, কিন্তু প্রধানত চড়াই ৷ ব্রারিমার্গ থেকে ঘণ্টাদেড়েক যাবার পর একটা উতরাইয়ের মুখে এসে ঘোড়াওয়ালা বলল, ঘোড়া থেকে নেমে পড়লে ভালো হয়, সওয়ারি নিয়ে ঘোড়া এত ঢালুতে নামতে গেলে পড়ে গিয়ে চোট পেতে পারে ৷ আমি নামতে রাজি হলাম না ৷ ঘোড়াওয়ালা লাগাম ধরে ৷ পিঠঠু ঘোড়ার লেজ ধরে ব্রেক কষতে কষতে নামতে লাগল ৷ আমরা ক্ষীণধারা অমরগঙ্গার ধারে এসে পৌঁছলাম ৷ এই নদী পার হবার জন্য নিচে নামতে হল ৷ একটা ছোটপুল পার হলাম ৷ নদী এবার আমাদের বাঁদিকে ৷ পুল পার হয়েই আবার চড়াই ৷ এইখানে পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথের রাস্তা এসে মিশেছে ৷ যাত্রীরা সব শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনই ফিরে গিয়েছে ৷ ওপথে আর কেউ আসছে না ৷ আমরা আবার নিরবচ্ছিন্ন চড়াই ভাঙতে লাগলাম ৷ কত উঁচুতে উঠলাম, কত বাঁক ঘুরলাম, তার আর হিসাব নেই ৷ দেখি সামনে আবার সেই নদী, আরও ক্ষীণ, অমরগঙ্গা, অনেকে অমরাবতী বলে ৷ মাঝে মাঝে বরফ জমে আছে, বরফের সেতু দিয়ে নদীর ওপারে গেলাম ৷ এখানে উপত্যকা বেশ প্রশস্ত হয়েছে ৷ নদী আবার আমাদের ডানদিকে, আমাদের সঙ্গে একস্তরে পাশাপাশি চলেছে ৷ কোথাও কোনও মানুষের বাস দেখিনি এখনও পর্যন্ত, এবার একটা-দুটো পাকাবাড়ি দেখতে পেলাম, ধর্মশালা ও সেখানের লোকজনের থাকবার ব্যবস্থা এবং লঙ্গর ৷ যত লোক আসে সবাইকে বিনামূল্যে খেতে দেওয়া হয় ৷ এখন ভাঙা হাট ৷ দু-চারজন মানুষ আছে মাত্র ৷ ইতস্তত অলস ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷
আমার সঙ্গীরা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ওই অমরনাথ দেখা যাচ্ছে ৷ আমি সঙ্গে সঙ্গে কিছু দেখতে পেলাম না ৷ শুধু দেখলাম অনতিদূরে একটা রুক্ষ বাদামি কর্কশ পাহাড় যেন ভ্রূকুটি করে দাঁড়িয়ে আছে ৷ কঠিন, নির্দয়, শীতল ৷ একটু পরেই পাহাড়ের গায়ে গুহামুখ দেখতে পেলাম ৷ অমরনাথ ৷ আমাদের অভীষ্ট ৷ সুদূরপরাহত সেই তীর্থে অবশেষে এসে গিয়েছি ৷
ক্লান্ত শরীরে যেন শক্তির জোয়ার এসে গেল ৷ বোধহয় আধমাইলও নয় ৷ আমরা দ্রুত চললাম ৷ শেষপর্বে ঘোড়া থেকে নেমে আবার খানিকটা উঁচুতে গুহামুখে পৌঁছতে হবে ৷ মনে হল মহাপ্রস্থানের এই শেষধাপে বুঝি আর উঠতে পারব না ৷ গুহামুখ পঞ্চাশ-ষাট ফুট চওড়া ৷ সেখানে পৌঁছেই মনে হল সমস্ত অবসাদ চলে গিয়েছে ৷ পাঁচঘণ্টা আগের অনিশ্চয়তা সংশয় উৎকণ্ঠা কাটিয়ে দেবস্থানে এসে পৌঁছেছি ৷ কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল ৷ কৃষ্ণা তৃতীয়াতে শিবলিঙ্গ ছোট হয়ে এসেছে ৷ আড়াই ফুট হবে ৷ পাশে আর দুই দেবতার প্রতীক দুটি বরফের গুহা ৷ ভেতরে আমরা ছাড়া আর চার-পাঁচজন মজুত ৷ পুণ্যার্থীরা দর্শনান্তে কদিন আগেই চলে গিয়েছেন ৷ এখন বালতালের পথের অবশিষ্ট কজন যাত্রী ৷
এবার ফেরার পালা ৷ পথের কথা মনে হতে শিউরে উঠলাম ৷ পথ দেখে বিস্মিত হলাম ৷ এই পথ পার হয়ে এসেছি, আমি? অশ্বপৃষ্ঠে? অমরগঙ্গার কাঠের পুলের আগে ঘোড়া থেকে নামতে হল ৷ অসম্ভব ঢালু ৷ তারওপর এখানে কন্ট্রাক্টর আরও ফাঁকি দিয়েছে মনে হল ৷ যেন ধুলোর তৈরি ৷ ঘোড়া থেকে নেমে আমি এক দৌড়ে পুলের কাছে এসে গেলাম ৷ সেই আমার কাল হল ৷ তেরো হাজার ফুট উঁচুতে হাওয়াতে অক্সিজেন কম ৷ সেখানে সামান্য পরিশ্রমের কাজ করেও শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে ৷ ওইটুকু দৌড়েই আমার শরীরে আর কোনও শক্তি ছিল না ৷ চ্যাংদোলা করে আমাকে ঘোড়ায় তোলা হল ৷ আমি গমের বস্তার মতো বসে রইলাম ৷
কখন ব্রারিমার্গ এসেছিল জানি না ৷ চায়ের দোকানি অনেক আগেই দোকানপাট তুলে নিয়ে বালতাল রওনা হয়ে গিয়েছে ৷ আকাশে মেঘ ঘনিয়ে উঠল ৷ দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ল ৷ এই নিষ্পাদপ রুক্ষ পরিবেশে কোথাও কোথাও আশ্রয়স্থান নেই ৷ বৃষ্টি পড়লে কী করব? ঘোড়া চলতে পারবে তো? কাঁচা পাহাড় থেকে জলধারায় কত না জানি পাথর গড়িয়ে পড়বে ৷ দ্রুত যাব সে ক্ষমতাও নেই ৷ ঘোড়াগুলো ক্লান্ত ৷ পিঠঠু অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছে ৷ কোনও ভয় নেই, এমেঘে বৃষ্টি হয় না ৷
পথে কোনও যাত্রীর সঙ্গে দেখা হল না ৷ শুধু দুজন ছাড়া ৷ স্বামী-স্ত্রী ৷ দর্শনান্তে অমরনাথে থেকে দুপুরে পথে বেরিয়েছেন নিচে নামবার জন্য ৷ বয়স্ক মানুষ ৷ স্ত্রীর হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে ৷ চলতে পারছেন না ৷ পথের ধারে বসে পড়েছেন ৷ নির্বান্ধব এই জনহীন বিপদসঙ্কুল স্থানে অসহায় দুটি মানুষকে ফেলে রেখে আমরা চলে এলাম ৷ আমাদের কিছু করবার সামর্থ ছিল না, কোনও ঔষধপত্রও ছিল না সঙ্গে ৷ নির্দয় পাহাড়ে ভাগ্যের আশ্রয়ে তাঁরা পড়ে থাকলেন ৷ আসবার সময় ভদ্রলোক শুধু বললেন, সব বাবা অমরনাথের ইচ্ছা ৷
বালতাল যখন পৌঁছলাম তখন সূর্যদেব অস্ত চলেছেন ৷ ঘোড়াওয়ালাদের বিনাবাক্যে পাঁচশো টাকা করে দিলাম ৷ মনে হয় তারা একটু অবাকই হল ৷ পিঠঠুর ষাট টাকার ওপরে আর দশ টাকা দিতে মানুষটি কৃতার্থ হয়ে গেল ৷ আমাকে দেখিয়ে বলল, সাহেবের খুব সাহস ৷ নিচের দিকে তাকিয়েও ভয় পাননি ৷
পিঠঠুকে কী করে বোঝাব, ঘোড়া থেকে পড়ে যাবার ছোট ভয় আমাকে এমন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, খাদে পড়ে যাবার বড় ভয় আমার মনেও আসেনি ৷
ভ্রমণ জুলাই, ১৯৯৪
১৯৯৪-এর মে-জুনে
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন