অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
উনিশ শতকের শেষের দিক ৷ জার্মানির কাইজার একদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখলেন যে তিনি যতদিন ইউরোপের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, ততদিনে বজ্জাত ইংরেজ আর মিচকে শয়তান ফরাসিগুলো একটা পুরো মহাদেশ দখল করে বসেছে ৷ ইংরেজের চামচা পর্তুগিজগুলোও বাদ পড়েনি ৷ এখন কী করা? নানা রকম ম্যাপ দেখে পণ্ডিতরা ঠিক করলেন যে সব এখনও যায়নি ৷ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে কেনিয়ার তলায় এবং রোডেশিয়ার ওপরে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে ৷ আবার পশ্চিম উপকূলে, সাউথ আফ্রিকার উত্তরে অনেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে ৷ ব্যস, হয়ে গেল ৷ জার্মানি ওই দুটি অঞ্চলে ঝাণ্ডা গাড়লেন ৷ শুরু হল জার্মান ইস্ট এবং ওয়েস্ট আফ্রিকা ৷
দখল করার পরে অবশ্য কাইজার ইংরেজ আর ফরাসিদের পুরো বজ্জাতিটা টের পেলেন ৷ তিনি দেখলেন যে পশ্চিম আফ্রিকার দখলি দেশটার প্রায় সবটাই মরুভূমি ৷ চাষবাসের কোনও সুযোগ নেই ৷ নামিবিয়ার (স্বাধীন জার্মান ওয়েস্ট আফ্রিকার নতুন নাম) হীরে এবং সোনার খনির কথা তখনও কেউ জানত না ৷ এদিকে পূর্ব আফ্রিকার সবটাই মালভূমি ৷ গড়পড়তা উচ্চতা সাড়ে চার হাজার ফুটের মতো ৷ সেখানে বন জঙ্গল প্রচুর থাকলেও বন্ধ্যা কাঁকুরে জমি চাষের উপযুক্ত নয় ৷ এই জন্যই ইংরেজ আর ফরাসিগুলো এই অঞ্চলদুটোয় হাত বাড়ায়নি ৷ কিন্তু তখন আর উপায় নেই ৷ দেশ একটা দখল করা সোজা কিন্তু ছেড়ে দিয়ে কেটে পড়া অনেক বেশি দুরূহ ৷ যাই হোক জার্মানিকে এই ঝক্কি বেশি দিন সামলাতে হয়নি ৷ প্রথম মহাযুদ্ধের পর, ক্ষতিপূরণ হিসাবে দুটো দেশই মিত্রশক্তির হাতে এল ৷ পূর্ব উপকূলের অংশটার নতুন নাম হল টাঙানিইকা ৷ ব্রিটিশ কলোনি ৷ পশ্চিমে নাম জার্মান ওয়েস্ট আফ্রিকাই রইল কিন্তু শাসনভার এল সাউথ আফ্রিকার হাতে-লিগ অব নেশনসের প্রতিভূ হিসাবে ৷
টাঙানিইকা এখনকার তানজানিয়া ৷ লন্ডন থেকে এক দৌড়ে দার এস সালাম হয়ে জাঞ্জিবার ৷ ওখানে তিন রাত কাটিয়ে ছোট প্রোপেলার প্লেনে আরূষা, যাকে তানজানিয়ার সাফারি রাজধানী বলা হয় ৷ সওয়া ঘণ্টার উড়ান বেশ কাটল ১০-১২,০০০ ফুট নিচে জঙ্গল বন পাহাড় দেখতে দেখতে ৷ এক জায়গায় বিরাট এক পাহাড়ের পাশে বিশাল এক ক্রেটার চোখে পড়ল ৷ পরে জেনেছিলাম যে ইনি হলেন মাউন্ট মেরুর নঙরডোটো ক্রেটার ৷
আরূষাতে অভ্যর্থনা করলেন আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্টের তরফ থেকে জেন বলে মেয়েটি ৷ তানজানিয়ান ক্রিশ্চান ৷ চটপটে কাজের মানুষ ৷ হয়তো একটু খরখরি ৷ আমাদের বললে, এখানে যে ড্রাইভার আর গাড়ি তোমাদের দেব, সেই একই ব্যক্তি আগামী সাতদিন তোমাদের সঙ্গে থাকবে ৷ ভ্রমণ শেষে ওকে একটু ভালো করে বকশিশ দিও ৷ বলতে বলতেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির হল ৷ তানজানিয়ান মুসলমান ৷ হাসিমুখ মোটাসোটা দোহারা চেহারা ৷ বয়স গোটা চল্লিশ হবে ৷ ইংরিজি ভালোই বলে ৷ ফিদালি একাধারে ড্রাইভার এবং গাইড ৷ পরে দেখেছিলাম যে জঙ্গল এবং জন্তু সম্বন্ধে ওর বেশ জ্ঞান আছে ৷ গাড়িটা টাটা সুমো জাতীয় ৷ ডিজেল ৷ ফোর হুইল ড্রাইভ ৷ তফাতের মধ্যে গাড়ির মাঝখানে ছাদের একটা অংশ এক ফুট ওপরে তোলা যায় ৷ তাতে করে গাড়ির মেঝেতে দাঁড়িয়ে চারদিকের দৃশ্য আরও ভালো করে দেখা যায় ৷
পনেরো কিলোমিটার দূরে মাউন্ট মেরু গেম স্যাঙ্কচুয়ারিতে পৌঁছতে আধঘণ্টার মতো লাগল ৷ এখানে আমরা দুরাত কাটাব, আরূষা তানজানিয়ার বড় শহর হলেও (লোকসংখ্যা দশ লক্ষের ওপর) কোনও ছিরিছাঁদ নেই ৷ এবড়োখেবড়ো রাস্তা ৷ এখানে একটা গম ভাঙার কল ওদিকে কয়েকটা চুন সুরকির দোকান, ইটের পাঁজা ৷ খাপরার চালের পাশেই এক মেটে দোতলা বাড়ি, হলদে রং ৷ ঠিক যেন পূর্ব বিহারের কোনও মফস্বল শহর ৷ এসব পেরিয়ে শহরের সীমানায় এক ঝাঁ চকচকে পেট্রল পাম্পে গাড়ি থামল ৷ পাম্পের সঙ্গেই বিলাতি কেতায় ছিমছাম প্রভিশন স্টোর ৷ সেখানে কিছু সওদা করা গেল ৷ ফিদালি বললে, এই যে রাস্তা দেখছ এমন সুন্দর মসৃণ রাস্তা সারা তানজানিয়াতে আরও গোটা দুই-তিন আছে ৷ বাকি সবই খানা-খন্দওয়ালা কাঁচা রাস্তা ৷ এই রাস্তাটা ওদিকে দার এস সালাম পর্যন্ত চলে গেছে ৷ আরূষা থেকে বাস যায় আট ঘণ্টায় ৷
তেত্রিশ একর জমি নিয়ে মাউন্ট মেরু গেম পার্ক প্রায় ঋষির তপোবন, তবে এই তপোবনে ঠান্ডা গরম জলের কল, ফ্লাশ টয়লেট প্রভৃতি সবরকম আধুনিক সুখ-সুবিধার বন্দোবস্ত আছে ৷ পার্কের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে অতিথিদের ছোট ছোট কটেজ ৷ খাবার ঘর, বার, লাইব্রেরি, মাঝখানে বিশাল সব প্রাচীন গাছের তলায় পাথর বাঁধানো চাতালে টেবিল চেয়ার পেতে বসা এবং টুকটাক খাওয়ার বন্দোবস্ত ৷ চাতাল থেকে একটা শুঁড়িরাস্তা ধরে বেড়ার ওপারে গেলে ওদের নিজস্ব একটা চিড়িয়াখানা ৷ নানারকম খাঁচার ভেতরে বেবুন, সজারু, খেঁকশিয়াল, বনবিড়াল প্রভৃতি প্রাণীরা ঘোরাফেরা করছে ৷ খাঁচাগুলোর এক পাশে একটা বেড়া দেওয়া খোলা জায়াগায় বিরাট এক স্থলচর পাখি ৷ স্লেট রঙের পাখির মাথায় লাল ঝুঁটি ৷ চিড়িয়াখানার কর্মচারী বললে ‘ক্রেস্টেড ক্রেন’ উগান্ডার লোক ৷ আমাদের দেখে পাখিটা কিছুটা গাধার মতো হনক হনক করে চেঁচাতে লাগল ৷ লোকটি বললে, ও ওই রকমই চেঁচিয়ে যাবে যতক্ষণ না ওকে কিছু খেতে দেওয়া হয় ৷
ক্যাম্পের বাকি দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে বিল, ঘাসবন, গাছ এবং সেখানে পরিখার ওপারে অনেক জন্তু ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ হরিণ, মোষ, উটপাখি, জেব্রা নানারকমের জলচর প্রাণী ৷ বিকেলবেলা আমাদের কটেজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি খোলা জায়গার জন্তুগুলোর মধ্যে হুটোপাটি চেঁচামেচি ৷ পরিখার ধারে গিয়ে দেখি ওপারে একটা লোক দুটো বালতি হাতে করে এসে দাঁড়িয়েছে ৷ খাদ্য ৷ একটা বালতি থেকে ছোট ছোট মাছ ছুড়ে দিচ্ছে জলে, পাখিগুলো কপাকপ খাচ্ছে ৷ অন্য বালতিতে ছোলা মটর মুলো প্রভৃতি সবজি ৷ তারও খদ্দের প্রচুর ৷ সকলের মাথা টপকে উটপাখি ছোলা মটর খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে ৷ জেব্রা বা হরিণদের এদিকে মন নেই ৷ ওরা ঘাস, জলজ পাতা খেয়ে চলেছে ৷ এইসব জন্তুদের অনেকে আহত অবস্থায় এখানে আশ্রয় পেয়েছে ৷ কেউ কেউ বা অনাথ-জঙ্গলে থাকলে অন্য জন্তুরা ওদের খেয়ে ফেলবে তাই জায়গাটাকে গেম স্যাঙ্কচুয়ারি বলা হয় ৷
আমাদের কটেজের সামনে এক সারি ঝাঁপাল গাছ ৷ এর ডালের সঙ্গে ওর পাতার মেশামিশি ৷ গাছের সারির শেষে অল্প ফাঁকা জায়গা, তার পরেই খাবার ঘরের লাল টালির ছাদ ৷ চেয়ে দেখি শেষ গাছটার মাথা থেকে খাবার ঘরের ছাদ অবধি একটা দড়ি খাটানো ৷ ভাবলাম টিভির তার-টার হবে ৷ একটু পরে দেখি যে গাছের সারির শেষ গাছটা ধরে, কে বা কারা যেন ঝাঁকি দিচ্ছে ৷ ও হরি, এক দল ছোট ছোট বাঁদর, কারোর আবার পেটের সঙ্গে একটা বাচ্চা জড়ানো ৷ এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে পড়ছে ৷ শেষ গাছটায় পৌঁছে ওরা সেই দড়িটা ধরে খাবার ঘরের ছাদে উঠে গেল ৷ ক্যাম্পের একজন বললে যে এই বাঁদরগুলো সারাজীবন গাছের ওপরেই কাটায় ৷ তাই ওদের যাতায়াতের জন্য সারা ক্যাম্প জুড়ে দড়ি ফেলা আছে ৷ হঠাৎ কর্কশ কেকাধ্বনি ৷ একটা ময়ূর লম্বা ল্যাজ দুলিয়ে ত্রস্তপদে উঠোন দিয়ে চলে গেল ৷ পিছনে আরেকটা ময়ূর ধপধপে সাদা ৷ সন্ধ্যাবেলাটা ক্যাম্পেই কাটল ৷
পরদিন সকাল নটায় ফিদালি গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়াল ৷ চলো মাউন্ট মেরু ন্যাশনাল পার্ক দেখিয়ে আনি ৷ মাউন্ট মেরু হল আফ্রিকার পঞ্চম উচ্চতম পাহাড় (৪,৫৬৬ মিটার) কিন্তু এমন মেঘ যে একমাত্র এরোপ্লেন থেকেই ওর মাথাটা চোখে পড়েছিল ৷ আফ্রিকার অন্য অনেক পাহাড়ের মতো দুটি আগ্নেয়গিরি এবং বহুকাল আগে পাহাড়ের একদিক ধসে গিয়ে এক ক্রেটার সৃষ্টি হয়েছিল ৷
এই পাহাড়েরই ঢালুতে ১৬৭ স্কোয়্যার কিলোমিটার জমিতে মাউন্ট মেরু ন্যাশনাল পার্ক ৷ জঙ্গলের গেটে ঢোকবার মুখে ছোট্ট একটা মিউজিয়াম ৷ সেখানে মাউন্ট মেরুর ভূ, প্রাণী এবং বৃক্ষতত্ব নিয়ে অনেক ছবি এবং লেখা আছে ৷ দুপুরে বাড়ি ফিরে খাওয়া, নিদ্রা ৷ বিকেলে ক্যাম্পের মধ্যে পায়চারি ৷ জায়গাটা যেন ফুলে ফলে রঙে, রসে টইটম্বুর ৷ কত রকমের পাখি ৷ মৌটুসি, সূর্যসখা আর অনেক ওপরে কালো ক্রসের মতো চিল ৷
পরদিন ফিদালি সেই সকাল ৯টায় গাড়ি নিয়ে হাজির ৷ বাক্স পেঁটরা বেঁধে গাড়িতে উঠলাম ৷ গন্তব্য নগোরোংগোরো ক্রেটার ৷ ১৮০ কিলোমিটার ৷ ফিদালি বললে যে অর্ধেক পথ মানে মাকুইনি গ্রাম পর্যন্ত এই রকম সুন্দর রাস্তা ৷ তারপরে তানজানিয়ার হাড় ঠোকাঠুকি কাঁচাপথ ৷ এবারে তানজানিয়ার মালভূমি চিরে গাড়ি চলেছে ৷ দুদিকে বর্ধমানের মতো আকাশ জোড়া মাঠ, ধানখেতের বদলে ঘাসের বন ৷ এখন শেষ গ্রীষ্মের প্রভাবে বিবর্ণ রং ৷ দূরে দূরে হরিণের পাল ৷ ফিদালি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, ইমপালা, থমসনস গেজেল, টোপি, স্পটেড ডিয়ার ৷ হঠাৎ একটা কেরানি পাখি লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে এগিয়ে এল ৷ চট করে একটা ছবি তুলে নিলাম ৷
মাকুইনি গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি কাঁচা রাস্তা ধরল ৷ এখানে নগোরোংগোরো ক্রেটারের সংরক্ষিত জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে ৷ ৮,৩০০, স্কোয়্যার কিলোমিটার ৷ আগে এ সমস্তই সেরেঙ্গেটির অংশ ছিল ৷ এখন নগোরোংগোরোকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ৷ জঙ্গল বটে তবে গভীর নয় ৷ বুশল্যান্ড, ঝোপঝাড়, আগাছা মাঝে মাঝে কাঁটাওয়ালা আকাসিয়া গাছ ৷ একটা মোড় ঘুরে দেখি যে টিলার পাশে একটা বাওবাব গাছে থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটে রয়েছে ৷ জন্তু-জানোয়ার এখানে আগের চেয়ে বেশি কিন্তু এত বিশাল জায়গায় সব ছড়ানো ছিটানো ৷ হরিণ, জেব্রা কখনও বা একটা জিরাফ ৷ গাড়ি বাঁদিকে বেঁকে আরেকটা কাঁচা রাস্তা ধরল ৷ লেক মানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক দেখে যাব ৷ এখানেও নানা জন্তু আছে কিন্তু পৃথিবীবিখ্যাত হল এখানকার গাছে চড়া সিংহ ৷ দেখলাম জমি থেকে প্রায় কুড়ি ফুট ওপরে একটা মোটা ডালের ওপর শুয়ে দুই সিংহী রোদ পোয়াচ্ছে ৷ আমাদের দেখে একজন আড়ামোড়া দিয়ে উঠে বসলেন ৷ ওখান থেকে লেকের ধারে যাত্রীদের বিশ্রামস্থল ৷ বেঞ্চিতে বসে সঙ্গে আনা প্যাকড লাঞ্চ খেলাম ৷ খেতে খেতে ফিদালি একটা গল্প বললে ৷ লেক মানিয়ারাতে লোক রাত্রিবাসও করে ৷ ভালো হোটেল আছে ৷ বছর দুই আগে ফিদালি এক বয়স্ক সাহেব-মেমকে নিয়ে লেক মানিয়ারা এসেছিল ৷ লেকের ধারে জায়গাটা সাহেব-মেমের এমন পছন্দ হল যে ওঁরা ঠিক করলেন যে পরদিন ওইখানে বসে ওঁরা প্রাতরাশ করবেন ৷ জায়গাটায় পৌঁছে দেখেন যে দুই কোনায় এক জোড়া করে সিংহ বসে আছে ৷ ওরাও বোধহয় ব্রেকফাস্ট করতে এসেছে ৷ সাহেবদের ব্রেকফাস্ট সেদিন গাড়িতে বসেই খেতে হল ৷
সিংহীদের রোদ পোয়াবার কথায় বলি যে আমরা তো বিষুব রেখা থেকে তিন ডিগ্রি দক্ষিণে আছি ৷ কিন্তু কোথায় সেই বিষুব রেখায় দীর্ণ দগ্ধ আফ্রিকা? এই উত্তর তানজানিয়ার মালভূমিতে রোদটাই যা গরম ৷ ছায়ায় দাঁড়ালেই গা শিরশির করে ৷
ফিদালি একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললে, ওপর দিকে চেয়ে দেখ ৷ দেখি এক বিরাট প্যাঁচা গাছের ডালে বসে গোল গোল চোখে আমাদের দেখছে ৷ হুতুম প্যাঁচা ৷ আমরা যতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম ও অনড় অবস্থায় আমাদের দিকে চেয়ে রইল ৷ লেক মানিয়ারা ছাড়িয়ে চলেছি তো চলেছি ৷ পথ আর ফুরোয় না ৷ মাকুইনিতে সল্টেড চিনাবাদাম কিনেছিলাম ৷ তাই একটা দুটো করে চিবোচ্ছি ৷ ক্রেটার পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ৷ রিমের মাথায় বৃত্তাকারে ৭৫টা কামরা ৷ প্রত্যেক ঘর থেকেই ৬০০ মিটার নিচে ক্রেটারের জঙ্গল চোখে পড়ে ৷ দিনেরবেলা সেখানে ছাগল ভেড়ার মতো জন্তু চরে বেড়াচ্ছে দেখা যায় ৷ দূরবীন লাগালে বোঝা যায় যে কে হাতি আর কে মোষ ৷ কামরাগুলোর আগে বিরাট রিসেপশন এরিয়া ৷ দোতলায় লাউঞ্জ, তিনতলায় খানা কামরা, সমস্ত কাঠের তৈরি এবং সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড, মানে গরম হাওয়া ৷ সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে বাইরে বেশ ঠান্ডা ৷ সুইমিং পুলটাই যা নেই ৷ না হলে সেরেনা লজকে পাঁচতারার হোটেল বলা চলে ৷ হোটেলের সঙ্গে আমাদের আরেকটা সম্বন্ধ আছে ৷ তানজানিয়ার সর্বত্র সেরেনা লজগুলো আগা খাঁর ট্রাস্ট প্রপাটি ৷ নগোরোংগোরোতে ম্যানেজার এক পাঞ্জাবি ছোকরা ৷ বয়স গোটা ত্রিশ ৷ ফর্সা ধারালো মুখ ৷ একহারা শরীর ৷
পরদিন সকালে দুশো মিটার নিচে নগোরোংগোরো ক্রেটারে নামলাম ৷ সরু একহারা রাস্তা ৷ একদিক দিয়ে নামা ৷ অন্যদিকে ওঠা ৷ ক্রেটারের আয়তন ২৬০ বর্গ কিলোমিটার ৷ এরমধ্যে বিস্তৃত জলাশয়, ঘাসবন, আকাসিয়ার জঙ্গল মরুভূমি সব আছে ৷ পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রেটার এটা ৷ বহু জন্তুর বাস এখানে ৷ তার মধ্যে আফ্রিকার কালো গণ্ডার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ৷ বড় বদরাগী জানোয়ার এটি ৷ আমাদের কপালে অবশ্য গণ্ডার ছিল না ৷ জলাশয়ের ওপারে বহুদূরে ছায়ামূর্তির মতো কী একটা চলে গেল ৷ ফিদালি বলল, ওই গণ্ডার যাচ্ছে ৷ সিংহ, নেকড়ে, চিতাবাঘ সবই আছে কিন্তু কেউ বেরোল না ৷ অবশ্য ওদের দিনদুপুরে বেরোবার কথাও নয় ৷ হরিণ, জেব্রা, জিরাফ প্রচুর ৷ ক্রেটারের চারদিকে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল থাকলেও তৃণভোজী জন্তুরা পাহাড় টপকে বাইরে যাতায়াত করে ৷ মাংসভোজীদের কোথাও যেতে হয় না ৷ তাদের খাদ্য ক্রেটারের মধ্যেই বেশি ৷ হাতির সংখ্যা কম ৷ গোনাগুনতি ত্রিশটা ৷ সব মদ্দা হাতি ৷ মেয়ে হাতিরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাইরে থাকে ৷ ক্রেটারে খাদ্যাভাব ৷
ক্রেটারের জঙ্গল ঘুরে এক লেকের ধারে গাড়ি থামল ৷ আরও অনেক গাড়ি সেখানে ৷ সবাই প্যাকড লাঞ্চ খুলে খাওয়াদাওয়া সারবে ৷ ওপরে চক্রকারে চিল ঘুরে বেড়াচ্ছে, ফিদালি বললে, খাওয়া গাড়ির মধ্যে সারুন ৷ বাইরে চিল ছোঁ মারবে ৷ খাওয়া সেরে গাড়ি থেকে নেমে দেখি একজোড়া সাহেব-মেম বাইরে বেশ টেবিল চেয়ার পেতে খাচ্ছে আর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আর্দালি উইন্ডমিলের মতো দু হাত নেড়ে চিল তাড়াচ্ছে ৷ আরেকটা গাড়ি থেকে সাহেব নেমে একটা পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওপরে ছুড়ে দিচ্ছে চিল ছোঁ মারছে বটে, কিন্তু ধরতে পারছে না ৷ সাহেবকে বললাম যে এসব আফ্রিকান চিল রাগবি খেলতে অভ্যস্ত ৷ ক্রিকেট শেখেনি ৷ একধারে এক বিরাট হাতি, সত্যিই অত বড় হাতি আমি আর কোথাও দেখিনি ৷ তার হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে লেকের তলা থেকে জলজ ঘাস তুলছে আর খেয়ে যাচ্ছে ৷ লোকে যাচ্ছে দাঁড়াচ্ছে, দেখছে, ফটো তুলছে, ওর দৃকপাত নেই ৷ মাঝে মাঝে পিটপিট করে দুপেয়েগুলোকে দেখে আর খেয়ে যায় ৷ ফিদালির কাছে হস্তিতত্ব সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান লাভ হল ৷ হস্তি দুই প্রকার ৷ এক হল সাভানা এলিফ্যান্ট যাদের প্রধান খাদ্য ঘাস ৷ এরা আকৃতিতে বিরাট হয় ৷ ওজন ৫ থেকে ৬ টন ৷ জঙ্গলের হাতি, যারা গাছের ডালপালা খায় তাদের ওজন অনেক কম ৷ তিন সাড়ে তিন টনের মধ্যে ৷ ভাগ্যিস এরা এত ছোট, না হলে ওদের শুঁড়েই জঙ্গল সাফ হয়ে যেত ৷
পরদিন সকালে আবার যাত্রা ৷ এবার সেরেঙ্গেটি ৷ পথে ওলডুভাইয়ের খাত দেখে যাব ৷ ফিদালি শুভ সংবাদটা দিল ৷ সেরেঙ্গেটিতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ৷ তার মানে এবার ওয়াইল্ডবিস্টরা কেনিয়ার মাসাইমারা পাহাড় থেকে সেরেঙ্গেটির উপত্যকায় নেমে আসবে ৷ ওখানে পৃথিবীর বুক শস্যশ্যামল হয়ে উঠেছে ৷ আবার সেই জঙ্গল ৷ মাঝে মাঝে পাহাড়ের ঢালুতে মাসাইদের ছোট ছোট গ্রাম ৷ সারা নগোরোংগোরো সেরেঙ্গেটি অঞ্চল সংরক্ষিত বন ৷ এখানে মনুষ্য বসবাস, খেতিবাড়ি বা পশুপালনের হুকুম নেই ৷ কেবল মাসাইরা এ হুকুমের বাইরে ৷ মাসাইরা এখানকার ভূমিপুত্র নয় ৷ ওরা নীলোটিক, মানে নীল নদের আশপাশে ওদের দেশ ৷ দু-তিনশো বছর আগে ওদের একটা দল সুদান থেকে দক্ষিণে নেমে আসে এবং উত্তর কেনিয়ার লেক তুরকানা থেকে তানজানিয়ার নগোরোংগোরো পর্যন্ত অর্থাৎ আফ্রিকার গ্রেট রিফট ভ্যালির মধ্যে এবং দুপাশে বসবাস শুরু করে ৷
মাসাইরা চাষবাষের ধার ধারে না ৷ গোপালন এবং শিকারই ওদের জীবিকা ৷ তিনশো বছরে আফ্রিকায় কত পরিবর্তন হল ৷ ট্রাইবাল চিফদের তাড়িয়ে ইউরোপিয়ানরা জেঁকে বসল ৷ তাদের সঙ্গে এল মিশনারিরা ৷ এক সময় ইউরোপিয়ানরা চলে গেল ৷ আফ্রিকার দেশগুলো একে একে স্বাধীন হল ৷ রেলগাড়ি বসল ৷ কলের জাহাজ, মোটরগাড়ি মায় এরোপ্লেন পর্যন্ত চালু হল ৷ কিন্তু এসব কিছুই মাসাইদের স্পর্শ করেনি ৷ ওরা ক্রিশ্চানও নয় মুসলমানও নয় ৷ ওরা নিজেদের আটবিক ধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত ৷ সভ্যতার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক, হাতের বল্লমে ইস্পাতের ফলা ৷ ইস্পাতের ছুরি ৷ আর টকটকে লাল মোটা সুতির চাদর ৷ যেটা ওদের পুরুষেরা জড়ায় ৷ মেয়েদেরও ওই একই চাদর তবে লালের বদলে লাল আর নীলের চৌখুপি ৷
নগোরোংগোরো ছাড়িয়ে আধঘণ্টাও হয়নি ৷ পটাং করে গাড়ির তলায় একটা ধাতব আওয়াজ হল ৷ ফিদালি গাড়ি একপাশ করে থামিয়ে নেমে পড়ল ৷ গাড়ির তলায় অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে আমাদের বলল, বিপদ হয়েছে ৷ কী একটা যন্ত্রাংশ ভেঙে গেছে ৷ এখন সেই স্পেয়্যার পার্টসটি এবং একজন মেকানিক চাই ৷ নগোরোংগোরোতে দুইই পাওয়া যেতে পারে, না হলে মাকুইনি থেকে নিয়ে আসতে হবে ৷ এখন উপায়? ফিদালি ততক্ষণে রেডিও টেলিফোনে ওদের আরূষা অফিসের সঙ্গে কথা বলছে ৷ তারা বলল, দাঁড়াও নগোরোংগোরোতে খবর নিই যে ওখান থেকেই বন্দোবস্ত হবে কিনা, না হলে মাকুইনি বা আরূষা থেকে অন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেব ৷ চার থেকে ছ ঘণ্টার ব্যাপার ৷ তবে চিন্তার কারণ নেই ৷ সঙ্গে প্যাকড লাঞ্চ এবং জলও আছে ৷
গাড়ি থেকে নেমে পথের ধারে একটা পাথরে রোদে বসলাম ৷ কিছুক্ষণ খাতায় সে দিনের কথা লিখলাম ৷ গৃহিণী গাড়িতে বসে ইংরিজি এক নভেল পড়ছেন ৷ ফিদালি জানাল যে নগোরোংগোরোতেই সব পাওয়া গেছে ৷ মেকানিক পথচলতি একটা গাড়ি ধরে এসে পড়ল বলে ৷ পথপানে চেয়ে বসে আছি ৷ কিন্তু মেকানিক আর আসে না ৷ আরূষা থেকে ফোনে খবর এল যে মেকানিক তৈরি হয়ে বসে আছে কিন্তু কোনও গাড়ি পাচ্ছে না ৷ ইতিমধ্যে হুস হুস করে সব গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে ৷ কেউ থামে না ৷ জিজ্ঞাসা করে না যে আমরা পথের ধারে বসে আছি কেন? পরে শুনেছিলাম যে যাত্রীদের বলা আছে যে রাস্তায় কোনও কারণে কদাপি থামবে না বা গাড়ি থেকে নামবে না ৷ এদিকে দশটা বেজে গেছে ৷ এমন সময় একটা গাড়ি থেমে পড়ল ৷ ফিদালির মুখে এক গাল হাসি ৷ দেখ এ আমাদের কোম্পানির গাড়ি ৷ অন্য গাড়ি থেকে এক জোড়া সাহেব-মেম নামলেন ৷ পরে জেনেছিলাম যে এঁরা তানজানিয়া এসেছেন মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে ৷ দুই ড্রাইভারে কথাবার্তা হল ৷ তারপর নবদম্পতির অনুমোদন নিয়ে অন্য গাড়ি চলে গেল নগোরোংগোরো ৷ মেকানিক নিয়ে আসতে প্রায় চল্লিশ মিনিট ৷ ততক্ষণ সাহেব যুগল অপেক্ষা করলেন ৷ গাড়ি সারিয়ে আমাদের বেরোতে বেরোতে বারোটা বেজে গেল ৷
তারপর দৌড় দৌড়, পৌনে দুটোর সময় গাড়ি ওলডুভাই খাতের কিনারায় এসে দাঁড়াল ৷ ওলডুভাই পৃথিবীখ্যাত ৷ এখানে ওপর ওপর পাঁচটা স্তরে ৩৫ লক্ষ বছরের মনুষ্য বিবর্তনের ইতিহাস লেখা আছে ৷ আদি মানবের অন্যতম জন্মস্থান এটা ৷ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ৷ ইউ এন-এর আনুকূল্যে খোঁড়াখুঁড়ি এখনও চলছে ৷ টিনের চালার তলায় প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে বসা গেল ৷ আরও কয়েকটি দল ছিল ৷ আমরা বসতে না বসতে ওখানকার পুরাতত্ব বিভাগের এক তানজানিয়ান ভদ্রলোক ওলডুভাই খাত সম্বন্ধে দশ মিনিটের এক বক্তৃতা দিলেন ইংরিজিতে ৷ তিনি চলে যাবার পর আমরা খেয়ে নিলাম ৷ আমার ইচ্ছে ছিল যে খাতের নিচে নেমে আদিম গুহামানবের পায়ের ছাপ দেখে আসব কিন্তু ফিদালি বললে সময় নেই ৷ সন্ধ্যা ছটার মধ্যে সেরেঙ্গেটি না পৌঁছতে পারলে গেট বন্ধ হয়ে যাবে ৷ সকাল ছটার আগে সে গেট খুলবে না ৷
তানজানিয়ার জঙ্গলে আইনকানুন খুব কড়া ৷ সন্ধ্যা ছটা থেকে সকাল ছটা পর্যন্ত বিশেষ অনুমতি ব্যতীত জঙ্গলে ঢোকবার নিয়ম নেই ৷ সে অনুমতি সাতদিন আগে নিতে হয় ৷ কোন রাস্তায় যাবে তার ম্যাপ দিয়ে ৷ বিনা অনুমতিতে জঙ্গলে ঢুকলে বনবিভাগের লোকেদের ওপর ঢালাও হুকুম দেওয়া আছে যে আগে গুলি করে পরে প্রশ্ন করবে-কে? কেন? ইত্যাদি ৷
সেরেঙ্গেটির দরজায় পৌঁছলাম সাড়ে পাঁচটায় ৷ তখন সন্ধ্যার ঘোর লেগেছে ৷ আমাদের গন্তব্যস্থল মাইগ্রেশন ক্যাম্প তখনও পাঁচ-ছ মাইল ৷ ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম তখন আলো জ্বলে উঠেছে ৷ ক্যাম্পের দরজায় অভ্যর্থনা জানালেন সুমুখী আমেরিকান মেয়েটি ৷ নাম ল্যারি ৷ তারপর আমাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে নিয়ে চললেন ৷ সঙ্গে একজন আর্দালি মালপত্রের ভার নিল ৷ মাইগ্রেশন ক্যাম্প সত্যি সত্যিই ক্যাম্প ৷ উঁচু পাথরের ভিত ৷ পাথরের মেঝে তার ওপর শতরঞ্চি ৷ ওপরের অংশটা অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমে ক্যানভাস মোড়া, গোলক বসানো পর্দার দরজা, জানলা ৷ সামনের দিকে শোয়া বসার বন্দোবস্ত, পিছনে আরেক প্রস্থ পর্দার আড়ালে শাওয়ার, টয়লেট প্রভৃতি ৷ ঠান্ডা গরম জলের কল, ফ্লাশ টয়লেট-অনুষ্ঠানের কোনও ত্রুটি নেই ৷
আর্দালি আমাদের মালপত্র গুছিয়ে রাখছে ৷ ল্যারি পরিচয় করাচ্ছে ৷ এই যে আমাদের মাইগ্রেশন ক্যাম্প-এর চারদিকে কোনও বেড়া নেই ৷ চারদিকে জঙ্গল এবং বুনো জন্তুরা ক্যাম্পে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ বিশেষ করে রাতে ৷ সকালের আগে এবং সন্ধ্যার পরে ঘর থেকে বেরিয়ো না ৷ যদি বেরোতে হয় যেমন খানা কামরায় যাবার জন্য, তখন এই বাঁশিটা বাজাবে-টেবিলের ওপরে পুলিশের হুইসেলের মতো একটা বাঁশি দেখালেন-আমাদের সশস্ত্র আসকারি এসে তোমাদের নিয়ে যাবে ৷ অস্ত্র বলতে তীর ধনুক কিন্তু পোশাক পুরো মিলিটারি ৷ পুরো মাইগ্রেশন ক্যাম্পটা একটা টিলার ধার বেয়ে তিন থাকে তৈরি ৷ প্রথম থাকে অফিস, রিসেপশন, বার, লাইব্রেরি-লাইব্রেরির সামনে প্রশস্ত কাঠের পাটাতনে বসলে জঙ্গলে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় ৷ দ্বিতীয় থাকে খানা কামরা, রান্নাঘর ৷ তৃতীয় থাকে মানে টিলার তলায় একদিকে ২১টি ক্যাম্প অতিথিদের জন্য ৷ অন্যদিকে কর্মীদের বাড়ি ব্যারাক এবং সকলের শেষে একটি ছোট বাংলো যেখানে ল্যারি এবং তার বালকবন্ধু ইয়েন থাকে ৷ ইয়েন জাম্বিয়ার ইংরেজ ৷ ইয়েনের বন এবং বন্যজন্তুদের সম্বন্ধে প্রগাঢ় জ্ঞান আছে ৷ এছাড়া স্থায়ী বাসিন্দা হল সামনে ক্ষীণতোয়া গ্রুমেতি নদীর জলাধারে দু-তিনটে হিপো, সারারাত ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ করে ৷ আর ল্যারিদের বাংলোর ওপারে একটা জিরাফ ৷ তাকে সকালের দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে ক্যাম্পের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ৷ ল্যারি বলে, জিরাফটা মনে করে যে ক্যাম্পটা ওরই বাড়ি ৷ ল্যারিরা ওর আশ্রয়ে আছে ৷ পরে শুনেছিলাম যে নদীর ওপারে একটা কুমির প্রায়ই রোদ পোহায় ৷
মাইগ্রেশন ক্যাম্পে ফোন নেই, টিভি নেই, খবরের কাগজ নেই, পোস্ট অফিস মাকুইনি ৷ বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগ কেবলমাত্র রেডিও টেলিফোনে ৷ ইলেক্ট্রিসিটি ওদের নিজেদের জেনারেটরে ৷ কিন্তু রাত এগারোটা থেকে সকাল ছটা পর্যন্ত সেটা বন্ধ থাকে ৷ তখন ক্যাম্পের মধ্যে টর্চলাইট ভরসা ৷ এদের খাদ্য, পানীয়, জেনারেটরের জন্য ডিজেল সব আসে আরূষা থেকে ৷ রাত আটটা নাগাদ আসকারিকে নিয়ে আড়াইশো মিটারের মতো পথ হেঁটে খানা কামরায় পৌঁছলাম ৷ এখানে ইয়েনের সঙ্গে পরিচয় হল ৷ সদালাপী মিষ্টভাষী লোকটি ৷ সতেরো বছর এই হোটেল লাইনেই আছে ৷ আফ্রিকার নানা দেশ, নানা জঙ্গল ঘুরেছে ৷ মাইগ্রেশন ক্যাম্প সভ্য জগতের এতটা বাইরে হলেও, বারে মদ্যাদি কম নয় ৷ খাওয়াও বেশ ভালো ৷ মোটামুটি কন্টিনেন্টাল খাওয়া তার সঙ্গে কিছুটা সাউথ আফ্রিকাও মিশে আছে ৷ আসলে এই ক্যাম্পের মালিক হল সাউথ আফ্রিকার BLUES রেস্টুরেন্ট গ্রুপ ৷ এখানকার প্রধান পাচক কেপটাউনে BLUES রেস্টুরেন্টে শিক্ষানবিসি করেছে ৷ খানা কামরা জমজমাট ৷ অন্তত কুড়ি-বাইশ জন পুরুষ মেয়ে বিভিন্ন দলে বসে খাচ্ছে ৷ তার মধ্যে চার জোড়া হনিমুন দম্পতি ৷ খুব ফুর্তি হৈ হল্লা চলছে ৷
পরদিন সকাল নটায় ব্রেকফাস্ট খেতে এসে দেখি ফিদালি এক ধারে বসে ওর অন্য ড্রাইভার বন্ধুদের সঙ্গে খাচ্ছে ৷ আমাদের দেখে বলল, আমি রেডি, চল বেরিয়ে পড়ি ৷ তানজানিয়ার সীমানায় মাসাইমারা পর্যন্ত যাব ৷ মাইগ্রেশন ক্যাম্প থেকে বেরোতেই বাঁদিকে চেয়ে ফিদালি বলল, সিংহ একটা জানোয়ার মেরেছে দেখছি ৷ কাল অনেক রাতে ওর তর্জন গর্জন শুনেছিলাম ৷ দেখলাম একটু দূরে ঢিপির মতো কী একটা পড়ে আছে ৷ সিংহটাকেও প্রায় রাস্তার ওপরে একটা গাছের ছায়ায় শুয়ে ঝিমোতে দেখা গেল ৷ বিরাট সিংহ ৷ আমাদের দেখে নড়েচড়ে আমাদের দিকে মুখ করে বসল ৷ ফিদালি বললে, ও এখন কোনওদিকে দৃকপাত করবে না ৷ রাতে মহাভোজের পর ওর এখন ঘুমোবার সময় ৷
সেরেঙ্গেটির জঙ্গল শুরু হল ৷ এর আগে জিম্বাবোয়ের হোয়াঙ্গে ন্যাশনাল পার্কে গেছি ৷ সাউথ আফ্রিকার ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক দেখেছি কিন্তু সেরেঙ্গেটির সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না ৷ প্রথমত আয়তন ৷ হোয়াঙ্গে ১৪,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এবং ক্রুগারের যে অংশে আমরা গিয়েছিলাম সেটি মোটে বারো হাজার হেক্টর ৷ সেখানে সেরেঙ্গেটি পনেরো হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং ওর সঙ্গে লাগোয়া জঙ্গলগুলি আরও পনেরো হাজার ৷ মোট ত্রিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন ৷ তার ওপরে হোয়াঙ্গের চার ভাগের তিন ভাগ কালাহারি মরুভূমি ৷ সর্বত্র জলাভাব ৷ জঙ্গল রক্ষীরা তাই জঙ্গলের কিনারায় জায়গায় জায়গায় ওয়াটার হোল বসিয়েছে ৷ ডিপ টিউবওয়েলে জল তুলে ডোবা ভর্তি করে ৷ জন্তুরা সেখানে ভিড় করে জল খেতে আসে ৷ তখন যত খুশি দেখো ৷ ক্রুগারের ওইটুকু জায়গায় জন্তুর ঘেঁসাঘেঁসি ৷ সিংহগুলো কুকুরের মতো রাস্তায় বসে আছে ৷ সেখানে জন্তু দেখা যেন চিড়িয়াখানায় যাওয়া ৷ তফাত এই যে জঙ্গলে আমরা গাড়ির খাঁচার মধ্যে বসে আছি ৷ জন্তুগুলো বাইরে ছাড়া আছে ৷ সেরেঙ্গেটির ব্যাপার একেবারে আলাদা ৷ এখানে বর্ধমানের ধানখেতের মতো আকাশজোড়া মাঠ ৷ কেবল ধানের বদলে ঘাসের বন, ঝোপঝাড়, মাঝে মাঝে কাঁটাওয়ালা আকাসিয়া গাছ ৷ তারই মধ্যে কাছে দূরে নানারকম জন্তুর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘাস খাচ্ছে ৷ কত রকমের হরিণ, জেব্রা, জিরাফ, বেবুনের দঙ্গল ৷ ওরা, আমরা, ঘাস, গাছেরা সব মিলিয়ে যেন একটা ঐকতান বাদন ৷
হঠাৎ ফিদালি বলল, ওই দেখ ওয়াইল্ডবিস্টের দল চলেছে ৷ দল না বলে তাকে ঢল বলা উচিত ৷ পাশাপাশি আটটা কি দশটা করে জানোয়ার লাইন করে রাস্তা পেরোচ্ছে ৷ সে লাইনের শুরু বা শেষ নেই ৷ প্রায় আট কিলোমিটার সে লাইন আমাদের গাড়ির সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় চলল, তারপর বেঁকে দিগন্ত রেখায় মিশে গেল ৷ ওয়াইল্ডবিস্ট অদ্ভুতাকৃতি জানোয়ার ৷ অন্য নাম ন্যু ৷ আকারে একটা ছোটখাটো ঘোড়ার মতো, তৃণভোজী ৷ মুখটা গরুর মতো, শরীর হরিণের মতো আবার রামছাগলের মতো দাড়ি এবং বেঁটে বেঁটে শিং আছে ৷ ব্যবহার কলকাতার মিছিলের চেয়ে অনেক ভালো ৷ আমাদের গাড়ি আসতে দেখে কেউ এগিয়ে কেউ পিছিয়ে আমাদের রাস্তা করে দিল ৷ আমরা চলে যেতেই লাইন আবার বেমালুম জুড়ে গেল ৷
ওয়াইল্ডবিস্টরা শীতকালটা মানে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কেনিয়ার মাসাইমারা পাহাড়ের জঙ্গলে কাটায় ৷ তখন সেরেঙ্গেটির ঘাস জলের অভাবে পুড়ে হলদে, বাদামি হয়ে গেছে ৷ অক্টোবরের শেষে ওখানে বৃষ্টি শুরু হয় ৷ ওরা বলে ছোট বৃষ্টি ৷ মানে দিনে তিন-চার ঘণ্টা বৃষ্টি হয় ৷ তখন দু-তিনদিনের মধ্যে সেরেঙ্গেটিতে ঘাস গজিয়ে ওঠে ৷ ঘাসের ফুল হাওয়ায় দোলে ৷ সেই ঘাস খেতে ওয়াইল্ডবিস্টরা মাসাইমারা থেকে দলে দলে নেমে আসে সেরেঙ্গেটিতে ৷ ছোট বৃষ্টির পরে বড় বৃষ্টি, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত ৷ তখন ঘাস আরও বড় হয়েছে ৷ কাঁটাওয়ালা আকাসিয়া গাছে সবুজ পাতা ৷ ওয়াইল্ডবিস্টরা মনের আনন্দে চরে বেড়ায় ৷ আর শুধু কি ওয়াইল্ডবিস্ট! ওদের সঙ্গে থাকে জেব্রা, বুনো মোষ, কয়েকটা করে জিরাফ-আর তাদের পিছনে আসে সিংহ, চিতা, হায়না প্রভৃতি মাংসাশী জন্তু এবং আকাশে শকুনের পাল ৷ ওয়াইল্ডবিস্টদের সঙ্গে জেব্রাদের খুব ভাব ৷ সিমবায়োটিক সম্বন্ধ ওদের ৷ জেব্রারা জানে কোথায় জল পাওয়া যাবে ৷ আর ওয়াইল্ডবিস্ট ঘাসের গন্ধ পায় ৷ মে মাসের শেষে এই দঙ্গল আবার মাসাইমারা ফিরে যাবে সেই অক্টোবর পর্যন্ত ৷ প্রায় দশ লক্ষ জন্তু এইভাবে বছরের পর বছর মাসাইমারা আর সেরেঙ্গেটির মধ্যে আনাগোনা করে ৷
ওয়াইল্ডবিস্টদের আরেকটা মজা আছে ৷ ওদের সকলেরই বাচ্চা হয় ডিসেম্বর মাসে ৷ মানে সেরেঙ্গেটির জঙ্গলে যখন প্রচুর খাবার ৷
ওয়াইল্ডবিস্টদের ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছি ৷ হঠাৎ দেখি প্রায় রাস্তার ওপরে এক দল স্পটেড হায়না কী একটা জন্তুর মৃতদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে ৷ হাড় চিবোচ্ছে ৷ দূরে চক্রাকারে বসে এক দল শকুনি ৷ সত্যিই দিনে দুপুরে এত হায়না আর কোথাও দেখিনি ৷ আরেকটু দূরে ফিদালি গাড়ি থামিয়ে বললে, নিচের দিকে চেয়ে দেখ ৷ দেখি মাটির চাপড়ার মতো এক কচ্ছপ খোলার মধ্যে মাথা লুকিয়ে নট নড়ন চড়ন হয়ে আছে ৷ তার খোলা জুড়ে চিতাবাঘের মতো ছাপ ৷ ফিদালি বললে, ইনি হলেন চিতাবাঘ-কচ্ছপ ৷ আমরা একটু স্থির হয়ে দাঁড়াতেই তিনি খোলা থেকে মুখ বার করে চারদিকে দেখে নিলেন এবং গুড়ি গুড়ি রাস্তার পাশে নালার দিকে এগোলেন ৷
আরও কিছু পরে দূরে একটা পাহাড়ের রেখা দেখে গেল ৷ ফিদালি বলল, ওই হল কেনিয়ার মাসাইমারা ৷ আগে এই রাস্তা সোজা কেনিয়ার মধ্য দিয়ে নাইরোবি পর্যন্ত যেত ৷ রাস্তা এখনও আছে কিন্তু গরিব তানজানিয়ার লোকেরা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কেনিয়ায় গিয়ে ভিড় জমায় বলে কেনিয়ানরা রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে ৷
আধঘণ্টার মধ্যে গাড়ি তানজানিয়ার সীমান্তে পৌঁছল ৷ এরপরে দশ কিলোমিটার নো ম্যানস ল্যান্ড ৷ ওপারে কেনিয়ার সীমান্তরক্ষীরা ৷ তানজানিয়ার দিকে কোনও রক্ষীটক্ষি নেই ৷ ছোট একটা বাংলো বাড়ির মতো ৷ তার একটা ঘরে ইমিগ্রেশন ৷ আরেকটা ঘরে কাস্টমসের অফিস ৷ এখন সব তালা বন্ধ ৷ বাংলোর কম্পাউন্ডে একটা আকাসিয়া গাছের তলায় শতরঞ্চি বিছিয়ে আহারাদির বন্দোবস্ত হল ৷ প্যাকড লাঞ্চ ৷ তা মাইগ্রেশন ক্যাম্প থেকে খাবার খুব ভালো দিয়েছিল ৷ খাওয়াদাওয়ার পরে আবার সেই জঙ্গল ফুঁড়ে মাইগ্রেশন ক্যাম্পে যখন ফিরলাম তখন বেলা চারটে ৷
পরদিন সকাল নটায় বেরোনো ৷ এদিন উল্টোদিকে যাওয়া গেল ৷ সেরেঙ্গেটির বনাঞ্চলে অনেকগুলো বিভাগ আছে ৷ তার মধ্যে সেরিনারার স্থান সকলের ওপরে ৷ এখানে জন্তু জানোয়ার নানা রকমের তো আছেই ৷ তার ওপরে চিতা নামে দুষ্প্রাপ্য প্রাণীটিকে দেখা যায় ৷
চিতা, বিড়াল আর কুকুর মেশানো জন্তু ৷ ওজন চিতাবাঘের চেয়ে কম ৷ চোখের দুপাশে দুটো গভীর খাঁজ থাকায় দূর থেকে কুকুরের মতো দেখায় ৷ চিতা-বিড়ালবংশীয় হলেও, পায়ের নখ লুকোতে পারে না এবং কুকুরের মতোই পিছনের পা দুটো মুড়ে বসে সামনের পায়ের ওপর ভর দেয় ৷ পৃথিবীর দ্রুততম জানোয়ার চিতা ৷ শিকার ধরার সময় ওদের গতিবেগ ঘণ্টায় সত্তর কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছয় ৷ তবে এই বেগ তিনশো মিটারের বেশি রাখতে পারে না ৷ ওই তিনশো মিটারের মধ্যে শিকার ধরল তো ধরল, না হলে ছেড়ে দিয়ে অন্য শিকারের সন্ধানে যাবে ৷
চিতার দেখা পাওয়া গেল না ৷ ফিদালি বলল, চিতা কি এরকম হুটপাট করে দেখা যায়? সারাদিন এবং কখনও কখনও কয়েকদিন জঙ্গলে ঘুরলে যদি ওদের দর্শন পাওয়া যায় ৷ বাড়ি ফেরার পথে নতুন কিছু আর দেখা হল না ৷ মাইগ্রেশন ক্যাম্পে ঢোকবার আগেই দেখি রাস্তায় একটা সাপ লম্বা হয়ে মরে পড়ে আছে ৷ এক নজর দেখে ফিদালি বলল, বাবা এ যে কালো মাম্বা ৷ কোদালের ফলার মতো চ্যাপ্টা মাথা ৷ তবে প্রমাণ সাইজের নয় ৷ বড় পাজি সাপ ৷ তেড়ে এসে কামড়ায় আর সে কামড় একেবারে যমের পরোয়ানা ৷ কিন্তু এটাকে মারল কে? গাড়ি চাপা পড়েনি ৷ তাহলে থেঁতলো ভেতলো হয়ে যেত ৷ বেজিও নয় ৷ হয়তো কোনও পাখি মেরেছে কিন্তু তুলে নিয়ে যেতে পারেনি ৷
ক্যাম্পে ঢুকে দেখলাম আরও কয়েকজন ড্রাইভার দাঁড়িয়ে গল্প করছে ৷ ওদের সঙ্গে একটু কথা বলছি হঠাৎ একজন আমার ঘাড়ে চটাস করে চড় মারল ৷ অবাক হয়ে তাকাতেই ও বলল, সেৎসে মাছি ৷ তোমার গায়ে বসেছিল ৷ আমি জিজ্ঞাসা করি, কামড়ায়নি তো? ও বলল, সেৎসে কামড়ালে এতক্ষণে তুমি তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে ৷ ও মাছির কামড় বোলতার হুলের মতো ৷ আমি প্রশ্ন করি, সেৎসে মাছি চিনি কি করে? ওরা বললে মাছিগুলো আকারে সামান্য বড় হয়, রংটাও আলাদা, তবে অভিজ্ঞতা না থাকলে তুমি বুঝতে পারবে না কোনটা সেৎসে আর কোনটা সাধারণ মাছি ৷ তাহলে উপায়? নিদালি ব্যাধি তো শুনেছি বড় কঠিন ব্যাধি ৷ ওরা বলল, ঘাবড়াবার দরকার নেই ৷ পনেরো লক্ষ মাছির ভেতরে একটা মাছির মুখে ব্যাধির বিষ থাকে ৷ তবে মাছির গায়ে তো লেখা থাকে না কে বিষাক্ত আর কে বিষাক্ত নয় ৷ তাই গায়ে কোনও মাছিই বসতে দেবে না ৷
ক্যাম্পে খাওয়াদাওয়া করে গাছের ছায়ায় ডেকচেয়ার পেতে বেশ একটা নিটোল নিদ্রা হল ৷ বিকেলে উঠে দেখি যে পাঁচ-ছ হাত দূরে এক জানোয়ার বসে আছে ৷ খরগোশের চেয়ে সামান্য ছোট ৷ মেটে মেটে রং ৷ কাঠবেড়ালির মতো সামনের দু পায়ে বাদামের মতো একটা ছোট ফল ধরে কুট কুট করে খাচ্ছে ৷ লেজ নেই ৷ আমাকে আড়ামোড়া ভেঙে উঠতে দেখে পিট পিট করে তাকাল তারপর তার কাজ সে করে যেতে লাগল ৷ চা নিয়ে যে ওয়েটার আসছিল তাকে জিজ্ঞাসা করি, ইনি কে? সে বলল, পাহাড়ে হাইর্যাকস ৷ ওদের একটা দল এই টিলার গর্তে থাকে আর দিনেরবেলা গাছে গাছে ঘুরে ফল পাকড় খায় ৷
সেদিন রাতে লোক কম ৷ সেই চারটি হনিমুন কাপল, এক আমেরিকান ভদ্রলোক এবং ইয়েন ল্যারি আর আমরা দুজন ৷ একটা লম্বা টেবিলে এক সঙ্গে বসে খাওয়া হল ৷ কে কি জন্তু দেখেছে তার গল্প ৷ দুটি হনিমুন কাপল চিতার দেখা পেয়েছে ৷ তবে ওরা সেই সকাল আটটায় বেরিয়ে সন্ধ্যা পাঁচটায় ক্যাম্পে ফিরেছে ৷
সে রাতে আমাদের ক্যাম্পের আশপাশে যেন জন্তুদের হাট বসল ৷ হিপোর ঘোঁৎ ঘোঁৎ তো আছেই, জানলার পাশ দিয়ে দুটো হরিণ দৌড়ে গেল ৷ ওদের কিছুতে তাড়া করেছে কি? এক সময়ে জানলায় চোখ লাগিয়ে দেখি অন্ধকারে দুটো বড় বড় চোখ জ্বলছে ৷ কি জন্তু ওটা? দুটো বড় বড় ছায়া হেলতে হেলতে চলে গেল ৷ হাতি ৷ পরদিন সকাল বৃষ্টিভেজা মাটিতে নানা পায়ের দাগ ৷ আসকারি পরিচয় দিচ্ছে ৷ এই বড় বড় ছাপগুলো বন্য মহিষ ৷ ছোট ছাপগুলো জিরাফ ৷ ওমা এই যে দুটো হাতি ৷ হরিণ ওয়াইল্ডবিস্ট আর জেব্রার তো কথাই নেই ৷
সেরেঙ্গেটি এবং নগোরোংগোরোর জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার ছাড়াও কত রকমের যে পাখি ৷ রংবেরঙের পাখি ৷ ছোট্ট সানবার্ড থেকে ঈগল অবধি ৷
বিলগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে ফ্লেমিঙ্গো জলে ভাসছে ৷ খুঁটে খুঁটে পোকামাকড় খাচ্ছে ৷ একটা বন্দুকের আওয়াজ করলে (যদিও সংরক্ষিত জঙ্গলে বন্দুক বারণ) সেই পাখির দল আকাশে উঠবে ৷ ওদের ডানায় লালচে গোলাপি রং চমকায় ৷ জলচর পাখিও অনেক ৷ টিল, করমোর্যান্ট, বিরাট ঠোঁটওয়ালা পেলিক্যান, স্টর্ক, পেন্টেড ক্রেন ৷
পরদিন সকালে রওনা ৷ নাইরোবি হয়ে লন্ডন ৷ বেশ গেঁটে যাত্রা ৷ প্রথমে মোটরে সেরেনারা এয়ারস্ট্রিপ ৷ সেখানে ছোট্ট এক ইঞ্জিন প্রোপেলার প্লেনে আরূষা ৷ চল্লিশ মিনিট এয়ারস্ট্রিপে সাতদিনের বন্ধু ফিদালি বিদায় নিল ৷ যাবার সময় আমাদের দুটি লাঞ্চ প্যাকেট দিয়ে গেল ৷ ভাগ্যিস দিয়েছিল, না হলে ওদিন আমাদের দুপুরের খাওয়া জুটত না ৷ তার আগে যখন ক্যাম্প থেকে বেরোই আমাদের রুম বেয়ারা এডওয়ার্ডের চোখে জল ৷ বলে, আমার এই ক্যাম্পে পাঁচ বছর হল কিন্তু তোমাদের মতো ভালো লোক কখনওই দেখিনি ৷ আর তোমরা কত দূর দেশে থাক ৷ আরূষা হলেও আমি মাঝে মাঝে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে আসতাম ৷
ভ্রমণ ফেব্রুয়ারি, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন