অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৯৭৫ সালে কাঠমান্ডু থেকে পায়ে হেঁটে রাজদর্শন অর্থাৎ এভারেস্ট দর্শনে গিয়েছিলাম ৷ তখনই শেরপা অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের সম্বন্ধে জেনেছিলাম অনেক কিছু ৷ মহিমান্বিত এভারেস্ট শৃঙ্গকে খুব কাছ থেকে দেখা যায় ১৯,০০০ ফুট উঁচু ‘কালাপাত্থর’ থেকে ৷ কাঠমান্ডু থেকে সেখানে পৌঁছতে লাগে প্রায় পনেরো-ষোল দিন, অবশ্যই পায়ে হেঁটে ৷
কাঠমান্ডু থেকে লামাসাঙ্গু পর্যন্ত বাসে গিয়ে আমাদের হাঁটা শুরু হয় ৷ ফেরার পথে অবশ্য আমরা লুকলা বিমানক্ষেত্রে এসে আকাশপথে ফিরব কাঠমান্ডু ৷ আমাদের পথে দেখা হল ক্যালিফোর্নিয়ার ২৫ জনের এক দলের সঙ্গে ৷ তাঁরা জাপানে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে ফিরছেন ৷ দেশে ফেরার আগে হিমালয়ের কিছু অংশ দেখে যাচ্ছেন ৷ একসঙ্গে বেশ কিছুদিন পথচলা ও থাকার ফলে হৃদ্যতা জন্মে গিয়েছিল ৷ ওই দলের সঙ্গে ভালো ম্যাপ থাকায় আমরা বহু অপরিচিত শৃঙ্গ চিনেছিলাম ৷
আমরা লামাসাঙ্গু থেকে দক্ষিণের পথ ধরে উত্তরে যাব ৷ খাদ্যসামগ্রী ও মাল বহনের জন্য একজন তামাং ও একজন লিম্বুকে নেওয়া হল ৷ বেশি উচ্চতায় যাবার মতো জামাকাপড় ও জুতো এদের নেই, নামচেবাজারে গিয়ে এদের তাই ছেড়ে দিতে হবে ৷ রোজগারের আশায় এরা মাল বইছে ৷ লামাসাঙ্গু থেকে যাবার পথে ভগ্ন মণি দেওয়াল, ডাগোবা, চোর্তেন দেখা গেল ৷ হয়তো একসময় গ্রামগুলিতে বৌদ্ধদের প্রাধান্য ছিল, এখন হিন্দু নেপালিদের বাস সেখানে ৷ চারদিকে ধাপ চাষের খেত ৷ ধান, ভুট্টা, সরষে, আলু, স্কোয়্যাশ চাষ হচ্ছে ৷ গোর্খা সৈন্যদল থেকে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা এসব জমির মালিক ৷ তামাং, রাই, লিম্বু, মগরা এরা দরিদ্র ভাগচাষী মাত্র ৷ প্রথমদিন শিলডুঙ্গায় থাকা, দ্বিতীয়দিনে চর্ণাবতী পার হয়ে সেরেবংশী গ্রামে পৌঁছই ৷ বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম ৷ ইট বা পাথরের বাড়ি, চায়ের দোকান ও মন্দির আছে ৷ এক বাড়ির দোতলায় আশ্রয় পেলাম, যদিও সাত-আটজন থাকার তুলনায় ঘরটি ছোট ৷ সারারাত নিচের ঘরে জুয়াখেলা চলায় ভালো ঘুম হল না ৷ পরদিন তাম্রকোশী নদীর ধারে বুন্তীগ্রামে রাত কাটল ৷ গৃহস্বামী ও তাঁর পুত্র আদরযত্ন করে রাখলেন আমাদের ৷ তাঁদের কাছে জানতে পারলাম যে প্রতিবছর কয়েক হাজার বিদেশি পর্যটক আসেন; তাই গ্রামবাসীরা অতিথি আপ্যায়নে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন ৷
এরপর দশ হাজার ফুটের একটি চড়াই ও চিসাপানি গিরিপথ পার হয়ে ইয়ারসা গ্রামে এলাম ৷ বেশ ঠান্ডা ৷ এতদিন খাদ্যে স্কোয়্যাশ পাওয়া গেছে এবার সে পালা বন্ধ ৷ আলু ও রাই শাকসেদ্ধ-সাহেবদের মতো স্টু খেতে হবে ৷ এরপর বর্ধিষ্ণু গ্রাম থোসে ও দেওরালি গিরিপথপার হয়ে ভাড়ারে গ্রামে রাতের আশ্রয় মিলল এক গোশালায় ৷ গ্রামটিতে পনির কেন্দ্র আছে ৷ বাসিন্দাদের অনেকেরই গরু-মোষ আছে ৷ আমাদের গৃহকর্তাও বেশ সম্পন্ন, আহারাদির ব্যবস্থাও বেশ ভালো হয়েছিল ৷ কিন্তু সন্ধের মুখে গরুর পাল তাদের চিরাচরিত আশ্রয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতেই মুশকিল হল ৷ অনেক রাত হয়ে গেল তাদের বিতাড়ন পর্ব সারতে ৷
আকাশ মেঘমুক্ত থাকবে এবং হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গগুলিকে ভালোভাবে দেখতে পাব সেই আশাতেই প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে এই অক্টোবর মাসের শেষে এখানে আসা ৷ পরদিন সকালে রৌলিং হিমলের গৌরীশঙ্কর (২৩,৪০০ ফুট) ও মনলুংসা (২৩,৬৫০ ফুট) শৃঙ্গগুলির দর্শন মিলল ৷ এই শেষোক্ত শৃঙ্গে যাবার সময় এক গিরিপথের (১৯,০০০ ফুট) পশ্চিমে বিখ্যাত পর্বতারোহী এরিক শিপটন ১৯৫১ সালে ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখেছিলেন ৷ তিনি এভারেস্টে ওঠার পথের সন্ধানে ওই পথে এসেছিলেন এবং তাঁর ধারণা হয়েছিল যে নেপালের দিক থেকে সাউথ কল দিয়ে এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠা সম্ভব হবে, ততদিন পর্যন্ত তিব্বতের দিক থেকে নর্থ কল দিয়ে ওঠার চেষ্টাই হয়েছে ৷ ইয়েতি নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে ৷ চিন এবছরও ইয়েতির সন্ধানে একদল অভিযাত্রী পাঠাচ্ছে ৷ তিব্বতী ও শেরপা মহলে ইয়েতির অস্তিত্ব বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ৷
‘থোসে’ থেকে বৌদ্ধ শেরপা বসতি শুরু হল ৷ শেরপাদের বাস সোলো কুম্ভ অঞ্চলে ৷ দক্ষিণ ভাগ সোলু-থোসে থেকেই শুরু মনে হয় ৷ এদিককার গ্রামে প্রবেশপথে দেখা যায় স্তূপ বা চোর্তেন, মন্দিরের ওপর ত্রিশূল-তিব্বতীতে যাকে বলা হয় খাতাম ৷
শেরপা বসতিগুলিতে মহিলারাই প্রধানত গৃহে থেকে গৃহকর্ম, হোটেল ব্যবসা, খেতখামারে কাজ করে ৷ পুরুষরা বাইরে ঘোরে নানা কাজের সন্ধানে ৷ স্ত্রী স্বাধীনতা নিয়ে মাথা ঘামানো নেই, কারণ জীবনযাত্রা এতই কঠিন যে স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয় ৷ ৯ দিনের দিন খারি খোলা নদীর ধারে ফসলে ভরা সমৃদ্ধ গ্রাম জুবিং পার হতে হল ৷ এরপর লামজুর গিরিপথ (১২,১২০ ফুট) পার হবার সময় নিদারুণ দৃশ্য দেখলাম ৷ ভূ-আলোড়ন ও ভূমিকম্পের ফলে প্রস্তর মাটি ওপরে উঠে এসেছে, এক মহা ধ্বংসের ছবি ৷ যেন রূপকথার কোনও দৈত্য এসে বেগুনি রঙের পাথরগুলিকে বিশাল প্রান্তর জুড়ে উল্টোপাল্টা করে ছড়িয়ে দিয়েছে ৷ বেলা ৯টায় পথের ওপর ‘ওঁ মণি পদ্মে হুঁ’ লেখা দেখে বুঝলাম যে উচ্চতা শেষ হল ৷ দম নিলাম, তারপর নামা শুরু ৷ দুপুরে চতুর্দিকে অপরূপ দৃশ্য-শীতের শুরুতে পাতা ঝরে যাবার আগে রডোডেনড্রন গাছগুলির পাতার রং লাল হতে শুরু করেছে ৷ আমেরিকা বা বিলেতের ‘ফল’ বা শেষ শরতের মতো নয়নাভিরাম দৃশ্যপট ৷
বিকেলের মধ্যেই ‘জুনবেশী’ গ্রামে পৌঁছলাম ৷ বোঝা গেল বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান-অফিস, বাড়ি ও মঠ রয়েছে ৷ ধর্মে নিংমাপা সম্প্রদায়ের বা মহাযানী তান্ত্রিকমতাবলম্বী-যাঁদের গুরু হলেন ‘পদ্মসম্ভব’ ৷ বেশ বড় একটি বৌদ্ধমঠ, দুজন বিদেশি রয়েছেন অতিথিশালায় ৷ আমরা রইলাম কিরপা শেরপা নামে এক সম্পন্ন চাষীর ঘরে ৷ বিকেলে পৌঁছে গেছি, অনেক সময় রয়েছে হাতে ৷ ওই সুযোগে সুনীতি পাঠকের দেওয়া প্রশ্নাবলী নিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে অনেক আলোচনার সময় পাওয়া গেল ৷ কিরপা শেরপা শিলিগুড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন তাই হিন্দি ভালোই জানেন ৷ জানতে পারলাম শেরপারা তিব্বতী ঘেঁসা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করলেও নেপালি ভাষা জানে ও বোঝে ৷ আরও জানা গেল যে এরা তিব্বতের দক্ষিণ রং বুক গিরিপথের নিকটের কোনও স্থান থেকে বহু শতাব্দী আগে এসেছেন, ধর্মে আচারে-ব্যবহারে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন ৷ তিব্বতের মতো বহুপতি প্রথার চল প্রায় নেই ৷ লামা ধর্ম প্রচলিত ৷ কিরপার ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক স্কুলে পড়ে ৷ নিজেরা চাষবাস করে, দোকান চালায়, কাঠের বিস্তৃত ঘরগুলিতে অতিথিদের আশ্রয় দেয় ফলে কিছু রোজগারও হয় ৷
এরপর সবই শেরপাদের গ্রাম ৷ জুনবেশীর পর তাকসিন্ধু, চৌরিখড়ক ৷ জুবিংঘাট পার হয়ে কয়েকবার নদী এপার ওপার করে জোড়সেল গ্রামে রাত্রিবাস করলাম ৷ পথে এক স্থানে স্টিভেনসন স্ক্রিন দেখে প্রশ্ন করে জানলাম যে জরিপের কাজে একটি দল এসেছিলেন তাঁরাই এটি ব্যবহার করতেন ৷ একটি পাহাড়ের ওপর বৌদ্ধমঠ, সেখানে এক তিব্বতী লামা থাকতেন ৷ এসব গ্রামেই অতিথিশালা বা হোটেল আছে, শেরপানি গৃহকর্ত্রী তদারকি করেন ৷ হলের মতো বড় ঘরে পর পর খাটিয়া পাতা, রাতে গৃহকর্ত্রী নিজে খাবার এনে দিলেন ৷ কিন্তু সারারাত নাচ, গান, পান, ভোজন, হৈ হল্লা শুরু হল-ঘুম হল না ৷ নেপালে ভ্রমণকালে দেখেছি প্রায় সব বাড়িতেই মদ-চোলাইয়ের ব্যবস্থা আছে, অতিথি আপ্যায়ন হয় তাই দিয়েই ৷ সঙ্গে শুকনো মাংস রামেরও বেশ চল আছে ৷ শীতের দেশে এছাড়া গরম থাকার উপায় কী?
জোড়সেলের পর চড়াই ৷ এখান থেকেই উঠতে হবে নামচেবাজারে ৷ নামচেবাজারে কুলি বদল হল ৷ শেরপা দুই ভাইকে নেওয়া হল-একজন তাদের মধ্যে কিশোর ৷ তারা নিজেদের গরম কাপড় ও খাদ্যবস্তু বইবার জন্য ১৪ বছরের বোনকে সঙ্গে নিল, সে-ই তাদের রান্নাবান্না করবে ৷ এখানে বহু ভালো হোটেল আছে, বড় জনবসতি ৷ এটি একটি ট্র্যানসিট পয়েন্ট-কম্বল, পোশাক ইত্যাদি ভাড়া পাওয়া যায় ৷ থেংবোচে যাবার পথে সুন্দরী আমাডাবলাম শৃঙ্গ মহিমান্বিত রানির মতো আসীন দেখলাম ৷ ১৯২০ সালে খুমজুং গ্রামের গুলু লামা থেংবোচের গুম্ভাটি তৈরি করেন ৷ দুই-তিন বার পুড়ে গেলেও নতুন করে আবার তৈরি করা হয়েছে ৷ নামচে অর্থাৎ ব্যবসার কেন্দ্র (শেরপা ভাষায় ‘লাউঝে’) থেকে থেংবোচে (এই উচ্চারণ এভারেস্ট নামে বিখ্যাত গ্রন্থটিতে হিলারির দ্বারা গৃহীত হয়েছে) যাবার পথে বেশ কয়েকটি পর্বত শৃঙ্গ দেখা যায় ৷ থেংবোচের উন্মুক্ত ময়দানে বসে দ্বিপ্রহরে সেইসব শৃঙ্গ দেখি, কুলিরা নাম বলে দেয় ৷ সবচেয়ে সুন্দর লেগেছিল আমাডাবলাম শৃঙ্গের মনোমুগ্ধকর রূপ ৷ তাছাড়া তামাশেরকু, কানটেগা, তাওচে-যেখানে হিলারির কয়েকজন সঙ্গী উঠতে গিয়ে ব্যর্থ হন ৷ দূরে এভারেস্টকে কত ছোট দেখাচ্ছে ৷ থেংবোচেতে অতিথিশালা ভগ্ন ৷ অতএব আরও ওপরে যেতে হবে ৷
প্যাংবোচেতে সবচেয়ে প্রাচীন গুম্ভা রয়েছে ৷ রংবুক গুম্ভার লামা সাঙ্গে দোরজে কয়েকশো বছর আগে এসে ওই মঠটি স্থাপন করেন ৷ স্থাপয়িতা সাঙ্গে দোরজেকে মনে করা হয় পদ্মসম্ভবের অবতার ৷ স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস যে পদ্মসম্ভব যখন অলৌকিক শক্তিবলে দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়ে আসছিলেন তখন এখানে পথে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নেন ৷ তাঁর পদচিহ্ন এখানকার পর্বতে ও মঠে রেখে গেছেন ৷ ওই মঠে একটি ইয়েতির মাথার খুলি রক্ষিত আছে ৷ সাঙ্গে দোরজে ওই চিত্রকরা খুলিটিকে নিজের বশে এনে নানাপ্রকার অলৌকিক শক্তি ও ক্রিয়াকলাপ দেখাতেন তালবেতালের মতো ৷ একটি শুকনো কুয়ো দেখলাম ৷ এখান থেকে নাকি তিনি জল তুলতেন ৷ চতুর্দিকে যে অর্ধচন্দ্রকার বৃক্ষরাজি আছে তা তার মুণ্ডন করা কেশ থেকে জাত বলে বিশ্বাস করে সকলে ৷ মঠের মধ্যে একটি বন্ধ বাক্সে তাঁর চোখ, জিভ ও হৃদপিণ্ড রক্ষিত আছে যা তার শরীর, বাক্য ও মনের প্রতীক ৷ পদ্মসম্ভবের পদচিহ্ন যেখানে পড়েছিল সেখানেই বিখ্যাত থেংবোচে গুম্ভাটি তৈরি হয়েছে-এই কাহিনীই সমধিক পরিচিত ৷ থেংবোচের মঠাধ্যক্ষ কখনও কখনও তিনদিনের দূরত্বে তাকসিন্ধুতে গিয়ে পাহাড়ের ওপর ধ্যান করতেন, শিষ্যরাও সঙ্গে যেতেন ৷ তাকসিন্ধুতে পাহাড়ের ওপর সুন্দর একটি মঠ বা গুম্ভা বানিয়ে দিয়েছে ভক্ত গ্রামবাসীরা ৷ এই কুম্ভ এলাকায় দক্ষিণে সোলু এলাকাতেও শেরপারা থাকে ৷ সেখানে পাপলুনে ‘জিয়ং’ গুম্ভাও বিখ্যাত ৷ গুম্ভাটি সাঙ্গে দোরজে তৈরি করিয়েছিলেন ৷
এখন আমরা নিচের সোলু এলাকা থেকে খুম্বু এলাকায় প্রবেশ করব ৷ নামচেবাজার থেংবোচের মাঝে মহালঙ্গুর হিমাল ৷ কিন্তু পথে একটিও হনুমান বা বাঁদর দেখিনি ৷ আমাদের সঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্কের এক অভিযাত্রী দলের দেখা হয় ৷ এঁরা আসছেন ওখালডুঙ্গা বা দক্ষিণ থেকে ৷ স্থানটি গুরুত্ব বহন করে, সরকারি দপ্তর আছে ৷ সোলো কুম্ভ অঞ্চল নেপালের শাসনে থাকলেও এদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুবই গণতান্ত্রিক ৷ খাজনা ইত্যাদি যা নেপাল সরকারকে দিতে হয় এ অঞ্চল থেকে তা ওখালডুঙ্গার কাছারিতে জমা নেওয়া হয় ৷ অন্যান্য পারিবারিক, সম্পত্তি বিষয়ক বা চাষবাস সম্পর্কিত মামলা পঞ্চায়েতের নির্বাচিত লোকজনই নিষ্পত্তি করেন ৷
থেংবোচের পর উচ্চতা শুরু হল ৷ তৃণাচ্ছাদিত পাহাড়ে ধরবার কিছু নেই, পাহাড়ি পথও নেই ৷ ট্রিলাইন শেষ হলে কেবল ঘাস ও ইতস্তত ছড়ানো প্রস্তরখণ্ড ৷ তবে আমাদের লিডার মাঝে মাঝেই থেমে কফির ব্যবস্থা করাতে ক্লান্তি দূর হচ্ছিল ৷ কোনওমতে সন্ধের অন্ধকারে প্রবল শীতের মধ্যে ফেরিচে পৌঁছলাম ও রান্নাঘরে আশ্রয় নিলাম ৷ সঙ্গীরা যে যেখানে পারলেন শুলেন ৷ আমরা দুজন কুলিসহ রান্না শেষ হবার পর সেই ঘরের মেঝেতেই শুলাম ৷ বেশ আরাম হল ৷ আধুনিককালে সেখান বেশ কয়েকটি হোটেল হয়েছে বলে শুনেছি, আমাদের যাত্রার সময় তা ছিল না ৷
সেদিনই সকালে ফেরিচে স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে এক আমেরিকান ডাক্তারের তত্বাবধানে ৷ খুব শীতের সময় ছাড়া ডাক্তাররা পালা করে থাকবেন এক বছর ৷ সেদিন ওই কেন্দ্র খোলাতে ফেরিচেতে বেশ ভিড় ছিল ৷ এখানে ইয়াক প্রজননের জন্য পাথর ঘেরা কয়েকটি ঘর আছে, স্থানীয় অনেককেই দেখলাম কম্বল মুড়ি দিয়ে বাইরে শুয়ে আছে এই অক্টোবরের শেষে ৷ দেখে তো আমরা তাজ্জব বনে গেলাম ৷ জানা গেল, বরফ পড়া শুরু হলে ইয়াক সহ চালকগণ নিচে নেমে যায় ৷ আসার পথে ওই ধরনের কাঠের বাড়ি দেখেছি কয়েকটা ৷
ওপরের দিকে পথচলা বেশ কষ্টসাধ্য ৷ হিমবাহের গ্রাবরেখার চতুর্দিকে আলগা পাথর ছড়িয়ে আছে ৷ দুধকোশী নদীর পাশ দিয়ে সেই পাথরের মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে, পাথরের ওপর পাথর রেখে যে স্তূপ তা দেখেই পথের হদিশ করতে হচ্ছে ৷ দুধকোশী নদীর জল ঝকঝকে রোদে উজ্জ্বল ৷ চুনাপাথরের আধারে ও মিশ্রণে রয়েছে তাই যেমন রং নামও তেমন ৷ যত ওপরে যাওয়া হচ্ছে খাদ্যের অভাব বাড়ছে ৷ ফেরিচেতে এক দুপুরে এক প্লেট আলুসেদ্ধ খেয়েই থাকতে হল তবে পেট ভরে ছিল ৷ পথে আমাদের নিজস্ব খাবার মুসুর ডালসিদ্ধর জল, কফি ও বিস্কুট খাওয়া হত ৷
প্যাংবোচের গুম্ভা ও ইয়েতির মাথার খুলি দেখে স্থানীয় সম্পন্ন এক গৃহস্থর বাড়ির দোতলায় ছিলাম ৷ জল অনেক নিচ থেকে বয়ে আনতে হয় তাই সীমিত পরিমাণ জল আমাদের দেওয়া হল ৷ একটি ছিদ্র করা লোহার পাত্রে আলু ঘষে নির্যাস বার করে তা দিয়ে মোটা রুটি (অনেকটা আমাদের চিতুই পিঠের মতো) তৈরি হল, আলুর ঝোল দিয়ে খেলাম ৷ এত ভারি রুটি যে কোনওমতে এক-চতুর্থাংশ খাওয়া গেল ৷ পেট ভরল খুব ৷ আমাদের সঙ্গে সয়াবিনের পিণ্ড ছিল তা গৃহস্থকে দেওয়া হল ৷ থেংবোচে ও প্যাংবোচের মাঝে দেবুজেতে ভিক্ষুণীদের এক মঠ আছে ৷
পরদিন সন্ধের আগেই লোবুজ পৌঁছলাম, একটিমাত্র দোকানঘর ৷ সেখানেই থাকতে হবে ৷ কেউ টিনের বাক্সর ওপর শুল, আমি গ্রাউন্ড শীট বিছিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম ৷ স্থির হল পরদিন খুম্বু হিমবাহর একাংশ পেরিয়ে গোরকশেপ গিয়ে বিকেলের মধ্যেই লোবুজে ফেরা হবে কারণ সেখানে থাকার জায়গা নেই, আর আমাদের সঙ্গে তাঁবুও নেই ৷ গোরকশেপ থেকেই কালাপাত্থর যেতে হয়, এভারেস্ট বেসক্যাম্প তার কাছেই ৷ কিন্তু ওই স্থান থেকে এভারেস্ট গোষ্ঠীকে দেখা যায় না ৷ বিকেলের শেষে ওপর থেকে তিনজন বিদেশি অভিযাত্রী নেমে এলেন ৷ একজন জার্মান ভূতত্ববিদ, একজন ব্রিটিশ ভূ-বিদ্যার অধ্যাপক, একজন সুইডেনের ৷ লোবুজের ওই ছোট ঘরে থাকা ছাড়া উপায় নেই ৷ তাঁদের সঙ্গে সলিড ফুয়েল ও ডিমের গুঁড়ো ছিল ৷ সেই সঙ্গে তাঁরা কফি খেলেন ৷ আমাদের খাওয়া পূর্ববৎ-মুসুরির ডালের স্যুপ, দুয়েকটা আলুসেদ্ধ ও কফি ৷
রাতে খুবই অসুবিধাজনক অবস্থার মধ্যে শুতে হল, ভালো ঘুম হল না ৷ নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ ৷ এয়ার ম্যাট্রেস ও স্লিপিং ব্যাগ থাকা সত্বেও প্রবল শীত অনুভব করছিলাম ৷ কিন্তু সব দুঃখেরই অবসান আছে ৷ পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাঁর সভাসদ নিয়ে রাজমহিমায় আসীন-তাঁকে দর্শন করলাম পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, রাতে চন্দ্রালোকে তারপর উজ্জ্বল তারার আলোয় আর খুব ভোরে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে বরফাবৃত রূপ ৷ ভোরে উদীয়মান সূর্যের ছটায় তাঁর মহিমান্বিত রূপ দেখে সব কষ্ট গ্লানি দূর হয়ে গেল ৷ আমাদের দীর্ঘ পথ চলা সার্থক হল ৷
এবার ফেরার পালা ৷ লুকলাতে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিমান ধরতে হবে ৷ মেঘে ঢাকা আকাশ থাকলে ওই ছোট এয়ারস্টপে বিমান নামতে উঠতে পারে না ৷ বেলা বারোটার পর বিমান চলে না-যাত্রীদের ভিড় থাকে, থাকার জায়গা নেই লুকলায় ৷ সেই সব চিন্তা করে থেংবোচের কাছে সেয়ামবোচে গ্রামের বিমানঘাঁটিতে যাওয়া ঠিক হল ৷ সেখানে এক শেরপানির হোটেলে আশ্রয় পাওয়া গেল, খাদ্যও মিলল কিন্তু প্লেনের টিকিট মিলল না ৷ কোনওমতে রাত কাটিয়ে খুব সকালেই পাকদণ্ডী বেয়ে নামচেবাজার নামার পথে প্রবাদপুরুষ এডমন্ড হিলারির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা-পিছনে এক শেরপা সর্দার ৷ দিনটা আমাদের পক্ষে শুভদিন ছিল বলতে হবে ৷ নামচেতে এক পশুচিকিৎসালয় তৈরি হয়েছে, সেদিন তার উদ্বোধন ৷ তিনি চলেছেন সেখানে ৷ অল্প কিছুদিন আগেই লুকলা থেকে কাঠমান্ডু যাবার সময় বিমান দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও কন্যাকে হারিয়েছেন তিনি, কিন্তু কর্তব্যে অটল ৷ একটু হয়তো বিষণ্ণ ৷ নমস্কার ও শুভেচ্ছা বিনিময় হল তারপর যে যার পথে চলা ৷
লুকলায় এসে বিমানে জায়গা পাওয়া গেল পালাক্রমে ৷ উনিশ দিনের হাঁটাপথ আধঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে কাঠমান্ডু পৌঁছনো গেল ৷
এবার এখানকার অধিবাসী শেরপা বা পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের সম্বন্ধে কিছু বলা যাক ৷ কয়েক শতাব্দী আগে তিব্বতের টিংরি জেলা থেকে নাংপা পাস দিয়ে শেরপাদের পূর্বপুরুষরা এই পূর্বাঞ্চলে আসেন ৷ অন্যত্রও এখন কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে খুম্বু অঞ্চলের বাসিন্দা ৷ খুম্বু নামটি এসেছে কুণ্ডে গ্রামের পিছনে যে উঁচু পর্বত খুম্ভিলা (১৯,০০০ ফুট) মনে হয় একটা অখণ্ড গ্র্যানাইট শিলা ৷ সেটাই এদের দেবতা-যাঁর উদ্দেশে নিয়মিত পশু বলি দেওয়া হয় ও সারাদেশের মানুষ অর্থাৎ শেরপারা এঁকেই দেবতাজ্ঞানে পুজো করেন ৷ এদের সঙ্গে তিব্বতের খাম্বা বা খাম্পা গোষ্ঠীর লোকেরাও আসেন ৷ এদের এখন তিব্বতী নেপালি গোষ্ঠী বলা হয় ৷ শিশুকাল থেকেই এরা বারো-তেরো হাজার ফুটে বাস করার ফলে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী, কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী ৷ এখানে স্ত্রী, পুরুষ, বালক সকলকেই পরিশ্রম করতে হয় ৷ যক্ষ্মা রোগের হারও ছিল বেশি ৷ এখন কিছু কমেছে ৷ পাহাড়ের ঢালে গ্রীষ্মের সময় যব, গম, শাক এবং বাইরের জগতের সংস্পর্শে এসে আলুর চাষ প্রতি জমিতেই হচ্ছে বলে বসতির সংখ্যা বাড়ছে ৷ হাইমেন ড্রফের মতে, আলু এদের জীবনে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে ৷ যেটা আরেক বৌদ্ধ পাহাড়ি অঞ্চল সিদকে করা যায়নি সহজে ৷ তবে চাষের সময় তো অল্পকাল, কাজেই এদের অন্য বৃত্তি হচ্ছে পশুপালন ও সঙ্কর প্রজনন ৷ ঝব্বু হল ইয়াক-গরুর মিশ্রণ ৷ এটি এদের পক্ষে লাভজনক, দুধ, মাখন, মাংস সবই পাওয়া যায় ৷ ইয়াকের লেজ, লোম ইত্যাদির চাহিদা সর্বত্র ৷ জন্তুগুলিও ভালো দামে বিক্রি হয় ৷ মাল বহনের জন্য ইয়াকের তুলনা নেই, অনেক উচ্চতায় ভারী মাল অক্লেশে বহন করতে পারে ৷ তাছাড়া তিব্বতের ভেড়ার লোম, পশমিনা-বোরাক্স সোনার সাদা সীমার বদলে খাদ্যদ্রব্য, পশমের দ্রব্যাদির ব্যবসাতে উভয়পক্ষেরই লাভ হত, সেটা বেশ কিছুদিন বন্ধ, দলাই লামার আসার পর থেকে ৷ বর্তমানে তো উচ্চ পর্বতারোহণে এমন সঙ্গী পাওয়া সৌভাগ্যের কথা-তাতেও এরা বেশ উপার্জন করে এবং বাইরের জগতের সঙ্গেও পরিচিত হয় ৷ উচ্চস্থানের শেরপাদেরই বেশি চাহিদা ৷ সামাজিক ব্যবস্থাও উন্নত ৷ জমি, চারণক্ষেত্র সব বিষয়ে পঞ্চায়েতের নির্দেশ আছে, গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভাবও বেশ ৷ গ্রামবাসীরাই পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচন করে ৷ নেপাল সরকারকে এরাই চুক্তিমতো কর বা খাজনা নির্দিষ্ট সময়ে ওখালডুঙ্গাতে জমা করে দেয় ৷ গ্রামীণ ব্যবস্থা, জমি বা পারিবারিক বিষয় পঞ্চায়েতই ঠিক করে, বিচারও করে ৷ সাধারণত ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতে, অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে ও তাদের দেখাশোনা করে ৷ ছেলেরা আলাদা সংসার পাতার সময় পৈতৃক সম্পত্তির কিছু অংশ পায় ৷ মেয়েরা বিয়ে করে তাদের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে যায়-আবার ঘরজামাই প্রথাও আছে ৷ বহুপতি প্রথার চল নেই বললেই চলে ৷ বহুপত্নী প্রথাও নেই ৷ প্রাক-বিবাহ যুগে অবাধ মেলামেশার সুযোগ যথেষ্ট, বিবাহ নিজেরাই ঠিক করে বা পিতামাতার ওপর ছেড়ে দেয় ৷ তবে বিবাহের খরচ খুব বেশি বলে আনুষ্ঠানিক বিবাহ হতে দেরি হয়, তবে ইতিমধ্যে এরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করে ৷ ব্যভিচারের কঠিন শাস্তি হয়-পঞ্চায়েতই এসব বিচার করে ৷ এখন কয়েক স্থানে শেরপা ক্লাব তৈরি হয়েছে-এরা বিমান-ঘাঁটি পনির কেন্দ্র, স্কুল ইত্যাদি দেখাশোনা করে, পর্বতারোহণের মজুরি প্রভৃতি ঠিক করে ৷ সচ্ছল ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা-এদের ক্ষতিপূরণ অর্থাৎ টাকা দিয়ে অনেক অপরাধের মার্জনা হয়, তবে সকলেই বৌদ্ধ বা মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মভীরু ৷ ধর্ম এদের দৈনন্দিন জীবনকে বেশ নিয়ন্ত্রিত করে ৷ লামারা বিবাহ করতে পারেন ৷ একদিন এদের সঙ্গে মেশার ফলে বেশ ভালো লেগেছিল ৷ শেরপাদের নাম এখন জগদ্বিখ্যাত ৷ নেপালের পর্বতারোহণের তাগিদে এরা উচ্চ অঞ্চলের বাসিন্দা বলে এদের চাহিদাও খুব ৷ এরা বিশ্বাসীও বটে ৷
ভ্রমণ জুলাই, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন