অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
‘আল মাগ্রীব আল আকসা ৷’ ঘাবড়ে যাবেন না ৷ নতুন কোনও ধর্ম বা তন্ত্রধ্বজী স্লোগানের আমদানি করছি না ৷ বয়েৎটি নতুনও নয় ৷ বরং বেশ পুরনো ৷ বারোশো বছর আগে শহর বোগদাদের বিদ্বৎজনেরা আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম কোণে হেঁড়ে মাথার খুলির ওপর টুপির মতো তেরচাভাবে বসানো দেশটির এই নামকরণ করেছিলেন ৷ মানে হল ‘দূর পশ্চিম’ ৷ ফার ইস্টের বদলে ফার ওয়েস্ট ৷ শুধু দূরই নয়, দেশটা তখনকার সমতল পৃথিবীর একেবারে কিনারায় ৷ এর পরেই পায়ের তলার শক্ত মাটি সমুদ্রে লাফিয়ে পড়েছে ৷ তাই তো ৬৮৩ সালে কাইরুয়ানের (বহু প্রাচীন শহর, আধুনিক টিউনিসিয়ার মধ্যে) আরব শাসনকর্তা উকবা ইবন নাকি মরোক্কো জয় করে বলেছিলেন যে, পৃথিবীর শেষ সীমানা পর্যন্ত ইসলামের জয়পতাকা পুঁতে এলাম ৷ এলাম-বললেন বটে, কিন্তু কাইরুয়ানে তিনি আর ফিরে আসতে পারেননি ৷ পথে দেশজ বারবারদের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর প্রাণ যায় ৷ উকবার প্রাণদান কিন্তু নিষ্ফল হয়নি ৷ আরব তথা ইসলামের জয়পতাকা মরোক্কোতে আজও সমান বিক্রমে উড়ছে ৷ আরবরাই মরোক্কোতে প্রথম আগন্তুক নয় ৷ ওদের বহু আগে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী থেকে ফোনেসিয়ান নাবিকরা ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ কূল ধরে জিব্রাল্টার পেরিয়ে উত্তর ইউরোপ ইস্তক ইংল্যান্ড পর্যন্ত যাতায়াত করত ৷ ওরা দেশটার নাম দিয়েছিল মরিটানিয়া ৷ আরব অভিযান পর্যন্ত ওই নামটাই চালু ছিল ৷ মরোক্কো নাম এই সেদিন হল, মরোক্কোর তখনকার রাজধানী মারাকেশের ফরাসি অপভ্রংশ হিসেবে ৷ ফরাসিরা বললেন মারোক ৷ ইংরেজরা সেই শুনে গাঁক গাঁক করে উঠলেন ‘মরোক্কো’ ৷
একটা মজার জিনিস লক্ষ করলেন? দেশটার নাম সর্বদাই বিদেশীরা দিয়েছেন ৷ দিশি নাম একটা হালে হয়েছে ৷ আল মামলাখ আল মাখ্রিবিয়া ৷ মানে উত্তর আফ্রিকার রাজত্ব ৷ কিন্তু কলকাতার নব নামাঙ্কিত রাস্তার মতোই এই নামটা এখনও খাতাপত্রেই আছে ৷ দেশের নামকরণ হচ্ছে বিদেশীদের হাতে-কেন, দেশে কি কোনও লোক ছিল না? ছিল বৈকী ৷ আটলাস পাহাড়ের পরতে পরতে এবং সমুদ্দুরের কূল ধরে (বাকি দেশটা তো মরুভূমি) সেই আদ্দিকাল থেকে বারবারদের বাস ৷ বারবার নামটাও রোমানরা দিয়েছিল, এদের জংলি ভূত বিবেচনা করে (ল্যাটিন বারবারিসমো) ৷ আকৃতিতে বারবার-রা একেবারে সায়েব ৷ ফর্সা রং, সুগঠিত নাক, চিবুক ৷ কটা চুল, কটা চোখ, নীল চোখও বেশ দেখা যায় ৷ পাহাড়ি ঝরনার পাথরবাঁধানো চৌবাচ্চাকূপ আলো করে বারবার-দুহিতা যখন কাঠের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে কাপড় কাচেন তখন স্বভাবতই কাশ্মীরের কথা মনে পড়ে যায় ৷ প্রকৃতিতেও এরা ইউরোপীয়দের মতো স্বনির্ভর, পরিশ্রমী ৷ এখনকার আরবদের (এবং আমাদের) মতো শ্রমবিমুখ, নিরুৎসাহী নয় ৷ এত রূপ গুণ থাকা সত্বেও বারবার-রা পৃথিবীর সভ্যতার বাজারে অধমর্ণ হয়ে রইল ৷ ওরা নিজেদের কোনও ঐতিহ্য, শিল্প, কৃষ্টি তৈরি করতে পারল না ৷ ওদের ভাষা একটা আছে বটে কিন্তু লেখবার অক্ষর হয়নি ৷ ধর্ম বলতে গাছ, পাথর পূজা, পরে মারাবুটিজম ৷ মারাবুট বলা হয় এক ধরনের সর্বত্যাগী সাধু-ফকিরকে, যাঁদের কেন্দ্র করে ইসলাম আসবার আগে মরোক্কোর ধর্মজীবন গড়ে উঠেছিল ৷ ইসলামের পরে, মারাবুটরা তাদের চেলাচামুণ্ডা দলবল নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন, কিন্তু তাদের আশ্রম সংগঠন আগের মতোই রয়ে গেল ৷ এরা যে শুধু ধর্মগুরু ছিলেন তা নয়, প্রয়োজনে এঁরা সশস্ত্র সংগ্রামেও নামতেন ৷ খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে এঁদেরই একজন, আলমোরাভিদ বংশের অনাচার এবং ভ্রষ্টাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের পতন ঘটান এবং আলমোহাদ বংশীয় আবদ আল মুমিনকে সিংহাসনে বসান ৷ চাণক্যের কথা মনে পড়ছে নাকি!
অক্ষরের অভাবে ওদের ধর্মশাস্ত্র গড়ে উঠতে পারেনি ৷ তৈরি হয়নি শাস্ত্র পুরাণ, দর্শন ৷ অথচ আধার হিসেবে এরা অতুলনীয় ৷ হাজার-হাজার বছর ধরে আদিম জীবনযাপন করলেও পৃথিবীর অন্যান্য আদিম অধিবাসীদের মতো এদের বুদ্ধিবৃত্তি জমে পাথর হয়ে যায়নি ৷ যখন যে সভ্যতার বীজ এদের মধ্যে এসে পড়েছে তার কয়েকটি অন্তত অঙ্কুরিত হয়েছে মহীরুহে ৷ ফোনেসিয়ানরা এদের নিয়েই কার্থেজ তৈরি করেছিল, যে কার্থেজ একদা রোমের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ৷ অগাস্টাস সিজারের স্বহস্তে লালিত বারবার রাজকুমার দ্বিতীয় জুবা বিয়ে করলেন অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রার মেয়ে ক্লিওপেট্রা সেলিনাকে, যাঁর পাণিগ্রহণের জন্য রোমের তাবৎ সম্ভ্রান্তবংশীয় যুবকরা লাইন দিয়েছিলেন ৷ দ্বিতীয় জুবা রোমের মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে পঞ্চাশ বছর মরিটানিয়ায় রাজত্ব করেন ৷ দুশো বছর পরে এঁদেরই এক যোদ্ধা সেন্টিমাস সেভিনাস রোমের সম্রাট মনোনীত হন ৷ রোমের প্রতাপ কমে যাবার পর যখন খ্রিস্টানরা এদেশে গেড়ে বসল তখন এই মাটিতেই জন্মালেন চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমভাগে খ্রিস্টানদের সুবিখ্যাত চিন্তানায়ক সেন্ট অগাস্টিন ৷
খ্রিস্টধর্ম কিন্ত এদেশে বেশিদিন টিকল না ৷ সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে ইসলামের ষাঁড়াষাঁড়ি বাণে খ্রিস্টধর্ম ভেসে গেল ৷ বারবার-রা একযোগে মুসলমান হল মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে ৷ কাইরুয়ানের নতুন মুসলমান শাসনকর্তা মুসা ইবন নুসাইল, টানজিয়ারস থেকে স্পেন আক্রমণ করলেন ৷ পত্তন হল আন্দালুসিয়া, গ্রানাডা, আলহামব্রার ৷ সেই আক্রমণের নেতা ছিলেন এক পুরুষে মুসলমান বারবার-সন্তান তারিক ইবন জিয়াদ ৷ মরোক্কোর ইতিহাসের পাতায় পাতায় বারবারদের কাহিনী স্বর্ণাক্ষরে এবং রক্তাক্ষরে লেখা আছে ৷ অথচ বারবার-রা কোন জাতির কোন শাখা বা প্রশাখা, তারা কোথা থেকে উত্তর আফ্রিকায় এল অথবা তারা কি বরাবরই এদেশে ছিল, এদের ভাষাটা কোন শ্রেণীর ভেতরে পড়ে-এসব নিয়ে পণ্ডিতদের ভেতরে মতদ্বৈধতার অন্ত নেই ৷ এদের আসল পরিচয় এখনও কুয়াশায় ঢাকা ৷
বারবারদের সম্বন্ধে এত কথা বললাম এই জন্য যে, এরাই হল মরোক্কোর আদি বাসিন্দা ৷ বাকি সবাই ফোনেসিয়ান, গ্রিক, রোমান, ভ্যান্ডাল, বাইজানটাইন, আরব, ইহুদি, স্পেন আর পর্তুগালের লোক ৷ সুদান এবং পশ্চিম আফ্রিকার কালো মানুষরা সব বাইরে থেকে এসেছে ৷ এসেছে এবং থেকে গেছে ৷ মরোক্কোর ‘মহামানবের সাগরতীরে’ বহু জাতি, বহু রক্ত মিশে তৈরি হয়েছে আধুনিক মরোক্কো ৷ তবুও আজকের সাধারণ মুর প্রধানত বারবার এবং আরবের সংমিশ্রণ ৷ নিজেরা পুরোপুরি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করলেও এবং আরবদের সঙ্গে লেনদেন, বিয়ে-শাদি প্রায় বারোশো বছর ধরে চালু থাকলেও বারবাররা তাদের উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে, বিশেষ করে তাদের খাস মোকাম আটলাস পাহাড় এবং তার দক্ষিণ অঞ্চলে ৷ উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি যে, কট্টর মুসলমান হলেও বারবার সুন্দরীরা বোরখায় তাদের মুখ ঢেকে রাখেন না ৷ ভাগ্যিস! তা না-হলে আটলাস পাহাড়ের অর্ধেক আলো ফিউজ হয়ে যেত ৷ বাকি অর্ধেক কী বলুন তো? পাহাড়ি ফুল ৷ দুপাশের নীল জঙ্গলে যেন রঙিন তারা ফুটে আছে ৷ মরোক্কোর জাতি মিশ্রণ প্রসঙ্গে একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি ৷ সবাই সবাইয়ের সঙ্গে মেশে বটে, কেবল ইহুদিরা (অল্পই অবশিষ্ট আছে এখন) উন্নাসিকভাবে নিজেদের ফারাক রাখেন ৷ আর কালো মানুষগুলোকে বাকি সবাই কিছুটা কৃপার চোখে দেখেন ৷
ইতিহাসচর্চা যথেষ্ট হল ৷ এখন একটু ভূগোল আলোচনা করা যাক ৷ কর্মব্যস্ত পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ভ্রমণকাহিনীর ভেতরে আবার এত ইতিহাস-ভূগোল কেন? এ যে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ ৷ আমি বলি, ধান ভানার মতো ক্লান্তিকর কাজকে মনোরম করার জন্যই শিবের গীত গাইতে হয় ৷ যে দেশটা দেখতে যাব তার সম্বন্ধে একটু জানাশোনা না থাকলে গিয়ে কী দেখব ৷ আগেই বলেছি যে, আকৃতিতে মরোক্কো দেশটা আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম কোণে তেরচা করে বসানো একটি সমান চতুর্ভুজ ৷ উত্তর এবং পশ্চিম ভুজে যথাক্রমে ভূমধ্য এবং আটলান্টিক সমুদ্র, দক্ষিণে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের বেড়া (আটলাস পর্বতশ্রেণী) ৷ তার পরের অংশটুকু সাহারা মরুভূমির গোড়ার দিক ৷ পূর্বেও নিচু পাহাড়ের গাঁট, যার মাঝে মাঝে সঙ্কীর্ণ উপত্যকা-পথে যাতায়াত চলে ৷ সমস্ত দেশের ওপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত কোনাকুনিভাবে চারটি শৈলশ্রেণী চলে গেছে ৷ ভূমধ্যসাগরের কূল ঘেঁসে প্রথম শ্রেণী হল ‘রিফ মাউন্টেন’ ৷ পশ্চিমঘাটের মতো অনুচ্চ পর্বতমালা, পশ্চিমঘাটের মতোই সমুদ্রোপকূল থেকে খাড়া উঠে গেছে ৷ সর্বোচ্চশিখর জেবেল টিডিরিন ৮২৮৬ ফুট উঁচু ৷ সমুদ্রের দিকে পাহাড়ের গা কেটে বসানো রাস্তার নাম কর্নিস ৷ সমুদ্দুরের ওপারে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েবাতে ওই এক নামই চলে ৷ ভূ-প্রকৃতিও একইপ্রকার ৷ রিফের পরে বিস্তৃত স্যুশ উপত্যকা ৷ মরোক্কোর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ৷ ধান, গম, ভুট্টা থেকে কফি, কড়াইশুঁটি, গাজর, টমেটো, আঙুর, ডালিম, আপেল, লিচু এমনকী আমাদের কলা, মুলো, শশা, পেঁপে পর্যন্ত কিছুর অভাব নেই ৷ আবার এরই মধ্যে পাহাড়ের একদিকে চাষবাস, অন্যদিকে বালিয়াড়ি ৷ ঢেউখেলানো নয়, বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের মাথায় উঠে যেন আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে ৷ সালভাডোর ডালির সুররিয়ালিস্টিক ছবির মতো ৷ স্যুশ উপত্যকার পরেই শুরু হল আটলাস পাহাড়, তিন সারিতে ৷ প্রথম সারি মিডল আটলাস অপেক্ষাকৃত নিচু ৷ সর্বোচ্চ শিখর ‘জেবেল সায়াচি’ ১২৪৮৭ ফুট ৷ মিডল আটলাস সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনীয় ৷ তবে আরও বন্য ৷ আরও অকৃত্রিম ৷ সুইজারল্যান্ডের চেয়ে ঠান্ডাও কম ৷ মিডল আটলাসের পিছনে সমস্ত দক্ষিণ দিকটা আড়াল করে হাই আটলাস ৷ উচ্চতম শিখর জেবেল তুকবাল (১৩৮৩৫ ফুট), শীতকালে বরফে ঢাকা পড়ে ৷ স্কি খেলার জন্য সারা পৃথিবীর লোক জড়ো হয় ৷ গ্রীষ্মে উপেক্ষিতা ৷ হাই আটলাস পেরোলেই হাওয়া বদলে গেল ৷ শুরু হল অ্যান্টি-আটলাস পর্বতশ্রেণী ৷ সাহারার অববাহিকা ৷ তারপর ধু-ধু মরু ৷
মরোক্কোভ্রমণে যাওয়ার বিশেষ কোনও সময়-অসময় নেই ৷ মরুভূমির দেশ হলেও সমুদ্রের দক্ষিণে আটলাসের এপারে তাপমাত্রা জুলাই-আগস্ট মাসেও ৩৭০-৩৮০ সেন্টিগ্রেডের ওপরে ওঠে না ৷ সমুদ্রের ধারে তাপমান বিশ-ত্রিশ ডিগ্রি কম তবে হাওয়া আর্দ্রতায় ভরপুর ৷ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সব জায়গাতেই তাপমাত্রা ১৫০-১৬০ সেন্টিগ্রেডে নেমে যায় ৷ সাধে কী মরোক্কোর অন্যতম বিশিষ্ট গুণগ্রাহী চার্চিল বলেছিলেন যে, মরোক্কো হল ‘গরম সূর্যওয়ালা ঠান্ডা দেশ’ ৷ বৃষ্টি মরোক্কোতে খুব বেশি হয় না, তবে হলে একবার হয় জুন-জুলাই মাসে, আরেকবার ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ৷ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই কখনও-কখনও আটলান্টিক থেকে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া চালু হয়, যাকে ফরাসিদের অনুকরণে এরাও বলে মিস্ট্রাল ৷ মোটামুটি বলা যায়, মরোক্কোতে সব সময়ই প্রশস্ত সময় ৷ তবে যাঁরা পাহাড়ে স্কি খেলতে না চান, তাঁদের পক্ষে এপ্রিল-মে আর ওদিকে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরই সবচেয়ে ভালো সময় ৷ আমাদের হিমালয়ের মতো আটলাস হল মরোক্কোর প্রাণপুরুষ ৷ একদিকে ঠেকিয়ে রাখে সুদান সাহারা থেকে আসা বুক পুড়িয়ে দেওয়া গরম হাওয়া ৷ অন্যদিকে আটকে দেয় আটলান্টিক থেকে ওঠা জলকণাবাহী বাতাস যা মেঘ হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে ফুল, ফল, ফসল ফলায় মরোক্কোর মরুভূমির মতো জমিতে ৷ সব মিলিয়ে বিচিত্র রঙের খেলা ৷ নীল আকাশ, নীল-সবুজ সমুদ্র ৷ গেরিমাটি রংয়ের বালি, কাঁকর, পাথরবিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ক্ষীণকায় নদীর ধারা আর তাকে ঘিরে সবুজ মরকত মণির মতো উজ্জ্বল জনপদগুলি ৷ দূরে পাহাড় বনরাজি নীলা ৷
মরোক্কো তো মুজতবা আলি সাহেবের কাইরো নয় যে, সুয়েজ বন্দরে নেমে একটা রোঁদ দিয়ে আবার সেই জাহাজেই ওঠা যাবে পোর্সুই বা পোর্টসৈয়দ-এ ৷ মরোক্কো যেতে হলে আলাদা করে কাঠ-খড় পোড়াতে হয় ৷ প্রথমেই ভারত থেকে লন্ডন ৷ লন্ডন এবং পশ্চিম ইউরোপের প্রধান শহরগুলির সঙ্গে মরোক্কোর বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে ৷ উড়ে তো যাওয়া যায়ই ৷ লন্ডন থেকে মরোক্কোর বৃহত্তম শহর, বন্দর এবং বাণিজ্যকেন্দ্র ক্যাসাব্লাঙ্কা আড়াই ঘণ্টার উড়ান ৷ যেন মুম্বই-কলকাতা ৷ এছাড়া প্যারিস থেকে সোজা ট্রেন আছে ৷ ইরুণ হয়ে স্পেনের দক্ষিণকূলে সালজেসিয়াস পর্যন্ত ৷ ৩৬ ঘণ্টার মতো লাগে ৷ লন্ডন থেকে চল্লিশ ঘণ্টা ৷ মোটর বা বাসেও যাওয়া যায়, অজস্র ট্যুরিস্ট বাস আছে ৷ প্যারিস, বিয়ারিটজ, বুর্গোস, মাদ্রিদ, মালগা হয়ে সেই সালজেসিয়াস ৷ সালজেসিয়াস জিব্রাল্টারের এপারে ৷ খাঁড়িটুকু পেরোলেই (মোটর, বাস সব এক জায়গাতেই খাঁড়ি পেরোয়) ট্যানজিয়ারস ৷ পৌঁছে গেলেন মরোক্কো ৷ ট্যানজিয়ারস থেকে ট্রেন মোটর বা বাসে করে সারা মরোক্কো ঘোরা যায় ৷ বড় বড় শহরের মধ্যে প্লেন চলাচল আছে ৷ দক্ষিণ ফ্রান্সের সেতে বন্দর থেকে একটা জাহাজও টানজিয়ারস যায় ৷ ৩৬ ঘণ্টা লাগে ৷ সময় এবং স্বাস্থ্য অনুকূল থাকলে স্থলপথ ভ্রমণটি যথেষ্ট আকর্ষণীয় ৷ কেমন লোম্বার্ডি ৷ গ্যাসকনের মধ্য দিয়ে পিরেনীজ পাহাড় পেরিয়ে, দুদিকে বাস্কদের দেশ দেখতে দেখতে মাদ্রিদ ৷ তারপর দৌড়! দৌড়! দুধারে লা মাঞ্চার দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল প্রান্তর (দূরে জীর্ণ-শীর্ণ কোনও অশ্বারোহী ততোধিক জীর্ণ-শীর্ণ ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে নাকি?) ৷ একদমে এসে পৌঁছলেন আন্দালুশিয়া ৷ মুরেরা নাম দিয়েছিল আল আন্দালুশ ৷ করডোবা, সেভিল, মালগা, গ্রানাডা ৷ ৮ম শতাব্দীর গোড়া থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আটশো বছর মুরেরা রাজত্ব করেছে এদেশে ৷ আন্দালুশিয়ার নাড়ির পাকে পাকে জড়িয়ে আছে আরবসভ্যতার অবদান ৷ তাই স্থলপথে গেলে মরোক্কোর ভোজের আগে আন্দালুশিয়াতেই তার কিছুটা স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যায় ৷ একদা এসব রাস্তায় ঘুরেছি কিন্তু এবার সাহস হল না ৷ ঠিক করলাম লন্ডন থেকে উড়ে যাব ৷
তারপরেই ঠিক করতে হয় যে, সীমিত সময়ের মধ্যে মরোক্কোর কোথায় যাব ৷ আয়তনে ৪৫৮৭৩০ বর্গ কিলোমিটার (লোকসংখ্যা ২৪০ লক্ষের মতো) ৷ ভারতের সাতভাগের এক ভাগ হলেও দেশটি ছোটখাটো নয় ৷ তারমধ্যে মরু, পাহাড়, সমুদ্র সবই আছে ৷ পাহাড় দেখতে হলে একদিকে যেতে হয়, সমুদ্র অন্যদিকে ৷ ‘মরোক্কোর কোথায়’ যদি বা স্থির হল, তখন ভাবতে হবে ‘মরোক্কোর কখন’ ৷ রিফ পর্বতমালার উত্তরে ভূমধ্যসাগরের ধার ঘেঁসে পুরাবৃত্ত ৷ ফোনেসিয়ান, রোমান, গ্রিক, বাইজান্টাইনদের আনাগোনা ৷ তার সঙ্গে আছে আধুনিককালের অবক্ষয় অশিক্ষা-দারিদ্র্য ৷ ইউরোপের ঝাঁট দেওয়া জঞ্জাল আর পাপ যার চরম পরিণতি হল ট্যানজিয়ারস ৷ রিফ আর আটলাসের মধ্যে ধরণী শস্যশ্যামলা ৷ ইসলামীয় সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ৷ নবম শতাব্দীর গোড়া থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মরোক্কোর রাজধানী এই অঞ্চলেরই বিভিন্ন স্থানে ছিল ৷ ফেজ, মেকনেস, মারাকেশ ৷ আটলাসের দক্ষিণে স্বচ্ছন্দচারী বারবার উপজাতিদের বাস ৷ যারা নিতান্ত সাময়িকভাবে ছাড়া কখনও উত্তরের আধিপত্য মেনে নেয়নি, বরং তারাই খেপে খেপে আটলাস পেরিয়ে এসে দখল করেছে মরোক্কোর সিংহাসন ৷ মরোক্কোর এখনকার রাজা হাসান (২)-এর আলওয়াইত বংশও এসেছিল আটলাসের ওপার থেকে ৷ এহেন মরোক্কোর কোথায় কী দেখতে যাব ৷ আমি পুরাতত্ববিদ নই, ইতিহাসবেত্তা নই ৷ ভূপর্যটকও নই, রামনাথ বিশ্বাস বা মুজতবা আলি সাহেবের মতো ৷ আমি চোখে যা পড়ে তাই দেখি ৷ খবরের কাগজে যা দেখি তাই পড়ি ৷ অতএব আমার যাওয়া উচিত মরোক্কোর সেই অংশে যেখানে ‘এখন’ ‘তখন’-এর সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেছে পশ্চাৎপটের ওপর ফুটিয়ে তোলা ছবির মতো ৷ অভিজ্ঞজনেরা বললেন, চোখ বুজে বেরিয়ে পড়ো ইসলাম মরোক্কোর উদ্দেশে ৷ ফেজ, মেকনেস, মারাকেশ ৷ পারো তো এখনকার রাজধানী রাবাতেও একবার যেও ৷ ওই ফেজ থেকে গাড়িতে ঘণ্টাচারেক লাগে ৷ না হলেও ক্ষতি নেই ৷ ক্যাসাব্ল্যাঙ্কা যাবার দরকার নেই ৷ মরোক্কোর বৃহত্তম শহর (লোকসংখ্যা ৩০ লক্ষ) হলেও ওটা নিতান্ত অর্বাচীন ৷ এই তো সেদিন ১৯৩০ সাল থেকে ফরাসিদের হাতে ওর বাড়বাড়ন্ত ৷ ট্যানজিয়ারসও না হয় পরের বারে যেও ৷
অবশ্য আটলান্টিক তটভূমিতে কয়েকটি দ্রষ্টব্য জায়গা আছে ৷ যেমন ট্যানজিয়ারসের অদূরে আসিলা ৷ জুলাই-আগস্ট মাসে এখানের চারুশিল্প মেলায় সারা পৃথিবীর লোক ভেঙে পড়ে ৷ তারপর সালে ৷ এক হাজার বছরের পুরনো শহর বহু মসজিদ, মাদ্রাসাভূষিত ৷ সালের পরে সাফি ৷ পর্তুগিজদের আস্তানা ছিল এই সেদিন পর্যন্ত ৷ সাফি ছাড়ালে ইসাউইরা ৷ আগের নাম মোগাডোর ৷ বহু প্রাচীন শহর ৷ অক্লেশে ২০০০ বছরের কথা বলতে পারে ৷ ইদানীংকালে মোগাডোরের প্রসিদ্ধি হল অরসন ওয়েলসকে নিয়ে ৷ তাঁর যুগ প্রবর্তক ছবি ওথেলোর চিত্রগ্রহণ এখানে হয়েছিল দেড় বছর ধরে ৷ এখনও মোগাডোরের কফি হাউসে বসে কোনও কোনও নগরবৃদ্ধ সেদিনের গল্প করেন ৷
মোগাডোরের দক্ষিণে আগাডির ৷ মরোক্কো বিজয়ী আরব সেনাপতি উকবা ইবন নাকি আগাডিরেই প্রথম কিংবদন্তীর নীল মানুষদের সম্মুখীন হন ৷ এরা বারবারদের একটি শাখা ৷ এদের পুরুষরা নীল পোশাক পরে ৷ মুখ নীল ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখে ৷ কেউ কেউ নাকি গায়ে নীল রং মাখে ৷ এরাই হল সাহারাখ্যাত টুয়ারেগ ৷ নির্মম যোদ্ধা, নির্বাক এই নীল মানুষদের উকবা ইবন ঘাঁটাননি ৷ পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন ৷ আগাডিরের আশপাশে মানুষরা আজও আছে ৷ তাদের প্রধান বৃত্তি হল ইউরোপ থেকে দলে দলে আসা সমুদ্রপ্রেমী ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জন ৷ সত্যিকারের রাজা যেন অবস্থা বিপাকে যাত্রাদলে রাজা সেজেছে ৷ আগাডির থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেঁসে শুরু হল সাহারা মরুভূমি ৷ হাই আটলাসের পিছনে ৷ তবে সমস্ত সাহারা একেবারে ধু-ধু মরুভূমি নয় ৷ মাঝে মাঝে মরূদ্যান আছে ৷ বাসে করে অ্যান্টি-আটলাস পেরিয়ে ড্রা নদীর উপত্যকা (নদীটি মরুপথেই ধারা হারিয়েছে ৷ আটলান্টিকে পৌঁছয়নি ৷) ধরে এগোলে মরোক্কোর দিকে শেষ শহর হল জাগোরা ৷ রক্তের মতো লাল বিপণীশ্রেণী ঘিরে সবুজ খেজুর গাছের সমারোহ ৷ জাগোরার প্রধান রাস্তা অ্যাভেনিউ মোহামেদ (৫) যে ধুলোমাখা গোল চত্বরে শেষ হয়েছে সেখানে রং ওঠা কাঠের ফলকে অস্পষ্ট ফরাসি অক্ষরে এখনও পড়া যায় ৷ ‘টিমবাক্টু, উটের পিঠে ৫২ দিন’ ৷ বড় সাধ ছিল এসব জায়গায় কিছুটা ঘুরি ৷ কিন্তু বন্ধুরা, শক্ত ঘাড় নাড়লেন ৷ পাগল! তোমার বয়সের কেউ ওসব শ্মশানে-মশানে যায়!
অতএব একদা সায়ংকালে লন্ডন বিমানবন্দর থেকে স-গৃহিণী যাত্রা করলাম ৷ লক্ষ্য মারাকেশ ৷ বিমানপথে কোনও ঘটনা নেই ৷ যদি কিছু ঘটে তবে সেটা দুর্ঘটনা ৷ আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল ৷ সাড়ে তিনঘণ্টা পরে (আসলে সাড়ে চারঘণ্টা ৷ মরোক্কোর ঘড়ি ইংল্যান্ডের থেকে একঘণ্টা এগিয়ে থাকে ৷) মারাকেশে অবতরণ ৷ ছোট্ট এয়ারপোর্ট ৷ আমাদের ভুবনেশ্বর বা বারাণসীর কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ ইমিগ্রেশন কাস্টমস সবাই বন্ধুভাবাপন্ন ৷ মধ্যপ্রাচ্য বা প্রতীচ্যের মতো ভারতীয় দেখলেই তারা মুখ বেঁকায় না বা বাক্স-প্যাঁটরার বিশেষ খানা-তল্লাসির বন্দোবস্ত করে না ৷ এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই হাসিমুখে এগিয়ে এল আজিজ ৷ হোটেল থেকে পাঠানো ট্যাক্সির চালক ৷ রাস্তায় কিছুটা আলাপ হল আজিজের চোস্ত ফ্রেঞ্চ এবং গৃহিণীর ভাঙা ফ্রেঞ্চের মাধ্যমে ৷ আজিজ বলল যে, ও ইংরিজিও জানে তবে বলার অভ্যাস নেই তো ৷ এখানে মরোক্কোর ভাষাতত্বের কথা একটু বলে রাখি ৷ বারোশো বছর আরবি ভাষা স্বাধীন রাজত্ব চালিয়ে ১৯১২ সালে মরোক্কো ফ্রেঞ্চ প্রোটেক্টরেট (বাংলায় কি রক্ষিতা বলব?) হল ৷ খোলনলচে, হুঁকো-গড়্গড়া সব বদলে গেল ৷ ফরাসি শাসকরা বললেন, ফরাসি ভাষা ছাড়া আধুনিক ন্যায়-নীতি, বিচার, প্রশাসন, শিল্প, বাণিজ্য কিছুই চলতে পারে না ৷ অতএব আরবি ভাষাকে সমূলে উৎপাটিত করে ফরাসির আসন করা হোক ৷ তবে আরবিকে পুরোপুরি নির্বাসন দেবার দরকার নেই ৷ দেশের ধর্মব্যবস্থা, মোল্লা, মসজিদ, ওইগুলোর চর্চা আরবিতেই চলতে পারে ৷ মরোক্কোতে ফরাসি শাসন মাত্র চুয়াল্লিশ বছর টিকেছিল ৷ ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে সুলতান মোহামেদ (৫) (এখনকার রাজার বাবা) রাবাতে বসে মরোক্কোর পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন ৷ সেইসঙ্গে আরবি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হল ৷ মোহামেদ অবশ্য ফরাসি ভাষাকে তাড়িয়ে দিলেন না ৷ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ওটা রয়ে গেল ৷ মরোক্কোর স্কুলে ছাত্ররা প্রথম পাঁচ বছর আরবি পড়ে, তারপর শেখে ফ্রেঞ্চ ৷ শিক্ষিত মরোক্কোবাসী মাত্রেই দ্বিভাষিক ৷ স্বাধীনতা পাবার পর শিক্ষার ব্যাপক প্রসার হয়েছে মরোক্কোতে ৷ শতকরা সত্তর জন সাক্ষর ৷ ফরাসি আমলে যেখানে বড়জোর পাঁচ লক্ষ শিশু স্কুলে যেত এখন সেখানে স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ ৷ এই একই সময়ের মধ্যে লোকসংখ্যা বেড়েছে মাত্র দেড় গুণ ৷ ১৬ কোটি থেকে ২৪ কোটি ৷ শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম নিদর্শন হল ডটপেনের চাহিদা ৷ শহরে-গ্রামে সব জায়গাতেই ছেলেবুড়ো সবাই বলবে-একটা বাইরো দেবে? এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবার সময় দেখবেন দলে দলে ছেলেরা ও মেয়েরা ব্যাগ ঝুলিয়ে, রোদ্দুরে মুখ রাঙা করে স্কুল যাচ্ছে বা স্কুল থেকে ফিরছে ৷ মোটরে গেলে আপনাকে থামতে বলবে ৷ কলকল করে উঠে আসবে গাড়িতে ৷ কম তো নয়; কেউ কেউ তিন-চার মাইল হেঁটে স্কুলে যায় ৷
হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটা হয়ে গেল ৷ খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া ৷ আজিজকে বলে রাখলাম যে, পরদিন সকালে আমাদের পুরনো শহর দেখাতে নিয়ে যাবে ৷ মরোক্কোর প্রায় সব শহরই প্রাক ফরাসিক এবং নতুন ও পুরনো দুটি আলাদা অংশে ভাগ করা ৷ মেদিনা বা পুরনো শহর চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ৷ মেদিনার সঙ্গে লাগোয়া থাকে একটি করে ‘কসবা’ দুর্গ বা সেনানিবাস ৷ (আমাদের কলকাতার কসবাতেও একদা সেনানিবাস ছিল ৷) অন্য অংশটি হল ‘ন্যুভেল ভিল বা নয়ানগর’ যেটি ফরাসিরা তৈরি করেছিল ৷ ভারতের প্রাক ব্রিটিশ শহরগুলোতেও এমনই দুটি অংশ থাকে ৷ গৃহিণী সকালে উঠে বললেন যে, উনি বিছানায় বসেই চা খাবেন ৷ দোষ দিই না ৷ বাড়িতে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ওঁকেই উঠে উনুনে আগুন দিতে হয় ৷ আমি নিচে নেমে হোটেলটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম ৷ চারদিকে মরোক্কোর দেশজ অলঙ্করণ, চারুশিল্পের ছাপ, ঐসলামিক আলেখ্যহীন নকশা মেঝেতে, দেওয়াল থেকে দেওয়াল পর্যন্ত পুরু কার্পেট ৷ অবাক হয়ে দেখি, সেই সাতসকালে বেশ কিছু স্ত্রী-পুরুষ মিলে বিরাটকায় কার্পেটগুলো উঠিয়ে, মেঝে লাঠির ডগায় লাগানো ভিজে নুটি দিয়ে মুছছে ৷ পরে দেখেছিলাম যে, এই মেঝে মোছাটি দৈনন্দিনের কাজ ৷ ইউরোপের কোনও হোটেলে এমন ব্যাপার দেখিনি ৷ এরা বোধহয় ইউরোপীয়দের মতো ধুলো-ময়লা কার্পেটের তলায় চালান দিতে অভ্যস্ত নয় ৷ হোটেলের বাইরে হোটেলের নিজস্ব কুড়ি একরব্যাপী বাগান ৷ হোটেলের প্রয়োজনমতো ফুল, ফল, সবজি-আনাজ এখান থেকেই পাওয়া যায় ৷ সবই ভালো ৷ হতাশ হলাম খালি দূরে মেঘের মতো হাই আটলাসের ছায়ামূর্তি দেখে ৷ উঁচুও তো এমন নয়, অথচ বলে কাক ওড়া রাস্তায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো ৷ হোটেল তত্বাবিধায়করা বললেন, হাওয়ায় বড্ড ধুলো আর এখন তো বরফ সব গলে গেছে ৷ শীতকালে এসো ৷ তখন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হাওয়ার মধ্য দিয়ে দেখবে বরফের টুপি পরা হাই আটলাসের শিখরশ্রেণী সকালের রোদ্দুরে ঝলমল করছে ৷
প্রাতরাশ সারতে সারতে দেখি দোরগোড়ায় আজিজের হাসিমুখ উঁকি দিচ্ছে ৷ ট্যাক্সি চড়বার আগে সুধী পাঠককে জানিয়ে রাখা ভালো যে, মারাকেশ কেন, মরোক্কোর কোনও শহরেই টুম্ব, মনুমেন্ট, ক্যাথিড্রাল প্যালেসের ছড়াছড়ি নেই ৷ দেখতে দেখতে পায়ের দড়ি ছিঁড়ে যায় না ৷ মসজিদ, দরগা, পীরের থান কিছু আছে বটে কিন্তু প্রায়শই সেসব জায়গায় অ-মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ ৷ অতএব দেখবার যা কিছু একবেলায় সেরে নিয়ে বাকি বেলাটা হোটেলে গিয়ে গড়ানো যায় বা কাফেতে বসে ‘স্বপ্নসম লোকযাত্রা’ দেখা যায় ৷ চারদিকে মুম্বই নির্মিত হিন্দি ফিল্মের ছড়াছড়ি ৷ যার যেদিকে অভিরুচি ঢুকে পড়লেই হল ৷ অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমামালিনী, রেখা বলতে ওরাও অজ্ঞান ৷ গাড়ি হোটেল-চৌহদ্দি ছেড়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল মারাকেশের বিখ্যাত পাঁচিল ৷ প্রায় তিন মানুষ উঁচু গিরিমাটি রঙের দেওয়াল, মাথায় বল্লমের মতো খাঁজকাটা ৷ সোজা বাঁদিক থেকে ডানদিকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে ৷ পাঁচিলের মাঝে মাঝে বুরুজ, তাতে সারি সারি চোখের ফোকর, সেকালের তীরন্দাজ, বন্দুকবাজদের জন্য ৷ চারদিকের মুক্তপ্রান্তর যেন থমকে দাঁড়িয়েছে পাঁচিলের সামনে ৷ প্রায় হাজার বছর আগে মরোক্কোর তখনকার রাজবংশ আলমোরাভিডরা পাঁচিলটা খাড়া করেছিল ৷ তখন পাঁচিলের পরিসীমা ছিল ১৬ কিলোমিটার ৷ এক-এক বাহু চার কিলোমিটার লম্বা ৷ তারমধ্যে মারাকেশের পুরনো শহর মেদিনা ৷ এখন পাঁচিল বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে ৷ বহু জায়গায় বহুবার মেরামত হয়েছে ৷ আলমোরাভিডদের সময়ে পাঁচিলে ২০টি গেট ছিল ৷ বিখ্যাত, কুখ্যাত, অখ্যাত, নানা কাজের নানা জায়গায় যাওয়ার জন্য ৷ পুরনো দিল্লির কথা স্মরণ করুন ৷ এখন সে রাম, সে অযোধ্যা কিছুই নেই ৷ শুধু পাল্লাহীন কতকগুলো গেট টিকে আছে ৷ আমরা যে গেট দিয়ে শহরে ঢুকলাম তার নাম বাব-এল-জেদিদ ৷ অখ্যাত গেটগুলোর অন্যতম ৷ অচিরে গাড়ি এসে থামল সাদীয়ান সমাধিক্ষেত্রের দরজায় ৷ ভিড় করে সাদা পোশাক (জেলেবায়া) পরা গাইডরা দাঁড়িয়ে আছে, যার যখন ডাক আসবে ৷ আমাদের কাছে এল এক মধ্যবয়স্ক দোহারা মূর্তি, কাঁচা-পাকা দাড়ি, ছাঁটা গোঁফ ৷ সাদীয়ান সমাধি দেখার জন্য গাইডের খুব দরকার ছিল না, কিন্তু গাইডের (সামনের দুটো দাঁত ভাঙা) ফোকলা হাসির আবেদন এড়াতে পারলাম না ৷ শুনলাম, সে নাকি ইংরিজি ভাষার হুনরী ৷ কাজের বেলায় সে ইংরিজির চেয়ে ফ্রেঞ্চ বরং ভালো, ফ্রেঞ্চটা অন্তত বোঝবার চেষ্টা করতে হয় না ৷
সাদীয়ান সমাধিক্ষেত্রের সঙ্গে কাব্যের কোনও সম্পর্ক নেই ৷ এ হল এক সাদী বংশের কথা যারা এখনকার আলওয়াইত রাজবংশের ঠিক আগে একশো বছর মরোক্কোতে রাজত্ব করেছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ৷ গিল্টির কাজ করা ক্যারারা মার্বেলের দেওয়াল, জালি, ঝরোকা ৷ মাঝে মাঝে আকাশের রঙে রং মেলানো নীল টালির (মরোক্কোর বিশেষত্ব) আস্তর ক্যালিগ্রাফিক আরবি অক্ষরে লেখা কোরানের বয়েৎ ৷ ওপরে সিডার কাঠের সিলিং ৷ মৃদু-কোমল উদ্ভিদজাত রঙে চিত্র-বিচিত্র ৷ স্যাফ্রন থেকে হলুদ ৷ হেনা থেকে লাল ৷ পুদিনা থেকে সবুজ ৷ আর বাগান, সে বাগান না দেখলে বোঝা যায় না ৷ একমাত্র গ্রানাডার (স্পেন) আলহামব্রায় এমন বাগান দেখেছি ৷ নিবিড় তরুলতার ফাঁক দিয়ে রৌদ্র-ছায়ার খেলা ৷ নিচে কতরকম ফুলের কেয়ারি ৷ তার চারপাশ ঘিরে সুঘ্রাণ লতাগুল্মের বেড়া ৷ রোজমেরী, মিন্ট, এলাচ ৷ চারদিকে ফোয়ারার জল বাতাসে উড়ে আসছে ৷ জলকণাবাহী বাতাস সত্যিই সুরভি মন্থর ৷ মাথা নত করে নতি জানালাম সাদী বংশীয় সর্বোত্তম নরপতি টিমবাক্টু বিজয়ী আহমদ আল মনসুরকে ৷ তাঁর যোগ্য সমাধিস্থান বটে ৷ মৌলে (মৌলে মানে হল নেতা) ইসমাইল কিন্তু তা ভাবেননি ৷ আলওয়াইত বংশীয় এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতান (বিক্রমে আল মনসুরের সমকক্ষ বলা যেতে পারে ৷) সাদীয়ান সমাধিক্ষেত্র দেখে হিংসায় ফেটে পড়ে, রাজমিস্ত্রি ডাকিয়ে টুম্বে ঢোকার পথ নিরেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন ৷ এ হল সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকের ঘটনা ৷ ক্রমে লোকে এই সমাধিক্ষেত্রের কথাই ভুলে গেল ৷ ১৯১৭ সালে ফরাসিরা এই নিরেট গাঁথনি কেটে সংকীর্ণ সুড়ঙ্গপথে কবরস্থানে ঢুকলেন ৷ সুড়ঙ্গপথটি আজও সেইভাবেই রাখা আছে ৷ পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ (বেশি মোটা না হলে) কোনওক্রমে আনাগোনা করতে পারে ৷ সাদীয়ান টুম্বের পাশেই আহমদ আল মনসুর তাঁর সাধের এল বাদি-প্রাসাদ গড়েছিলেন ৷ এল বাদি মানে অতুলনীয় ৷ মৌলে ইসমাইল সে প্রাসাদও ধ্বংস করলেন ৷ যা কিছু মূল্যবান জিনিস সোনা, রূপা, মার্বেল, নকশাকাটা সিডার কাঠের ছাদ নিয়ে গেলেন তাঁরা রাজধানী মেকনেসে ৷ যা নিতে পারলেন না ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে গেলেন ৷ এখন সেই ধ্বংসের চিহ্ন ছাড়া আর কিছু নেই ৷ এল বাদি থেকে এল বাহিয়া (বাহিয়া মানে চোখ ঝলসানো) ৷ এও এক প্রাসাদ, তবে মোটে একশো বছর আগে মরোক্কোর গ্র্যান্ড ডিজিয়ের সিমুসা এটা তৈরি করেছিলেন ৷ প্রায় ষাট একর জমি নিয়ে এলাহি ব্যাপার ৷ এখনও রাজবংশীয়রা মারাকেশে এলে এখানে থাকেন ৷ সেসময় সাধারণ লোকে প্রাসাদে ঢুকতে পারে না ৷ আমাদের ভাগ্য ভালো প্রাসাদ খালি ছিল ৷ এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয় ৷ এক জায়গায় এক বিরাট চবুতারা ঘিরে চব্বিশটি খুপরি খুপরি ঘর ৷ গাইড বলল, ঘরগুলি উজিরের চব্বিশটি উপপত্নীর জন্য ৷ পাশের মহলে শরিয়ৎ অনুমোদিত চারটি ধর্মপত্নীর জন্য অবশ্য বেশ বড় বড় ঘর ৷ গাইড ঘুরে ঘুরে সব দেখাল ৷ ‘উজির কোথায় থাকতেন?’ -এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর গাইড দিতে পারল না ৷ এত বুদ্ধি না হলে কি কেউ গ্র্যান্ড ডিজিয়ের হয় ৷ পত্নী এবং উপপত্নীদের ত্রিসীমানায় তিনি বাস করতেন বলে মনে হল না ৷ এল বাহিয়ার লাগোয়া একটি ছোট প্রাসাদ দার-এল-সৈদ ৷ এটা তৈরি করেছিলেন সি-মুসার কোনও কনিষ্ঠ ভ্রাতা, লোকে তাঁকে বলে আধপাগল ৷ পাগল হলেও তাঁর কাণ্ডজ্ঞান ছিল ৷ ছোটর ওপরে প্রাসাদটি বেশ ছিমছাম সুদৃশ্য ৷ এটি এখন মরোক্কান আর্টের মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার হয় ৷ আরও অনেক ছোটখাটো দেখবার জিনিস ছিল ৷ কিন্তু একবেলায় শরীর মন আর চোখ কত বা নিতে পারে ৷ হোটেলে ফিরে আহার এবং বিশ্রাম ৷
বিকেলের রাউন্ডে আর আজিজকে ডাকিনি ৷ হোটেল থেকে একটা ছোট ট্যাক্সি নিয়ে (আমাদের দুটি প্রাণীর জন্য বড় ট্যাক্সির বেশি ভাড়া গোনার কী দরকার) টুক করে চলে এলাম জেমা-এল-ফন ৷ মরোক্কো আসবার আগে বিলাতের বন্ধুরা প্রচুর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন এখানকার ট্যাক্সিওয়ালা, পোর্টার, বয়, বেয়ারাদের সম্বন্ধে ৷ এখন মনে হয় সে সতর্কতায় যথেষ্ট বাড়াবাড়ি ছিল ৷ ফেজ-এ একবার এক অসাধু গাইডের পাল্লায় পড়ে সামান্য কিছু অর্থক্ষয় ছাড়া আমাদের দশদিনের অভিজ্ঞতায় মরোক্কোতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি ৷ আসলে মরোক্কোর সাধারণ মানুষেরা বেশ হাসিখুশি, আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ ৷ ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে দুটো পয়সা পাবার প্রত্যাশা করতে পারে, কিন্তু চোটপাট, জোর-জবরদস্তি নেই ৷ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে কয়েক বছর আগে যখন মেক্সিকো গিয়েছিলাম তখনও শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা এমনই ভয় দেখিয়েছিলেন ৷ ফিরে এসে যেই বললাম যে, তাঁদের ভয় অমূলক, তাঁদের জবাব হল, অঃ তোমরা ভারতীয় বলেই (কালা আদমি আর মুখ ফুটে বললেন না) ওরা নিজমূর্তি ধরেনি ৷ মনে মনে ভাবি ঠিকই তো ৷ আমরা তো আর বছরের পর বছর ধরে ওদের বুকে বসে দাড়ি ওপড়াইনি যে আজ আমাদের দেখলেই ওরা জবাই করবার ছুরিতে শান দেবে ৷ যাক, যে কথা বলছিলাম, জেমা-এল-ফন মারাকেশের প্রাণ, মরোক্কোর আত্মা ৷ যদি একদিনের মধ্যে কেউ মরোক্কো দেখতে চায় তাকে সেই দিনটি কাটাতে বলব এই জেমা-এল-ফন-এ ৷ অথচ কথাটার মানে হল বিনাশিতদের জমায়েত ৷ একসময় মেদিনার ঠিক বাইরে এই প্রশস্ত প্রাঙ্গণে যুদ্ধে নিহত শত্রুদের ছিন্নমুণ্ড প্রদর্শিত হত ৷ কিন্তু সে অনেকদিন আগেকার কথা ৷ আরেকটা পুরনো কথা মনে পড়ে ৷ বহুকাল আগে দেখা হিচককের বিখ্যাত ছবি ‘যে মানুষটি বড্ড বেশি জানত ৷’ জেমস স্টুয়ার্ট ও ডোরিস ডে অভিনীত রুদ্ধশ্বাস ছবিটি ৷ মনমাতানো গান ‘কে সেরা, সেরা…’ ৷ ছবির অনেক দৃশ্য মরোক্কোতে তোলা ৷ বিশেষ করে প্রথম শট-‘জেমস স্টুয়ার্ট ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সাপ খেলানো দেখছে ৷ হঠাৎ কেন জানি ছুটতে শুরু করল ৷’ -এই জেমা-এল-ফনেতেই তোলা হয়েছিল ৷
জেমা-এল-ফনকে কী বলব? মেলা, হাট, কার্নিভাল, ফিয়েস্তা, ফ্লি মার্কেট, না একাধারে সব? যদি চার-পাঁচটা হাটের মধ্যে কয়েকটা মেলা ঢুকিয়ে একটা তালগোল পাকানো যায়, তার মাঝে থাকে সারি সারি খাবার স্টল, কোথাও বা বর্ণোজ্জ্বল পোশাক পরে কালো নাচিয়েরা ওত পেতে বসে আছে খদ্দেরের জন্য ৷ কেউ বা সাপ খেলাচ্ছে (ঠিক আমাদের দেশের মতো, তবে ওরা তুবড়ি বাঁশিটা ব্যবহার করে না), ওরই মধ্যে চলছে পুতুল নাচ, লাগ ভেলকি ভানুমতীর খেলা, দড়াবাজি (অ্যাক্রোব্যাটিক্স) নানারকম কৌশলের খেলা-টিপ করে বালাটা ফেলতে পারলেই জিনিসটা তোমার, চাঁদমারি আর বন্দুকের খেলা তো আছেই ৷ কী নেই! হ্যাঁ, ভিখারি নেই ৷ একটাও ভিখারি দেখলাম না ৷ দোকান-দোকান সার সার দোকান ৷ মাটিতে শতরঞ্চি পেতে, বেঞ্চের ওপর বাক্স সাজিয়ে, ঢাকনাওয়ালা ঠেলাগাড়ির ডালা খুলে বিচিত্র পণ্যসম্ভার ৷ নতুন এবং পুরনো ৷ এমনকী রদ্দি, ফেলে দেওয়া জিনিসেরও স্থান আছে ৷ এক জায়গায় ডাঁই করে রাখা পুরনো জুতো ৷ শুনলাম ওগুলো নাকি সব এক পাটি জুতো ৷ কেউ যদি জোড় মেলাবার জন্য কেনে ৷ ওরই মধ্যে বয়স্কা অপিচ তযঙ্গি এক রমণী এসে স্ত্রীর হাতে একটি রুপোর চুড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমাকে আমার বড় ভালো লেগেছে ৷ ওটা তোমায় দিলাম ৷’ ভালো লাগার মূল্য আমাদেরও কিছু দিতে হল ৷ বেশি নয় ৷ চুড়িটাও তো সত্যিই রুপোর নয় ৷ বেলা যত পড়ছে, ভিড় তত বাড়ছে ৷ ট্যুরিস্টের ভিড় নয় ৷ জেমা-এল-ফন হল মারাকেশের প্রাণস্পন্দন ৷ ট্যুরিস্টরা তার অংশ নিতে পারে কিন্তু এ হল প্রধানত মরোক্কোর লোকদের জন্য ৷
ভিড়ের ভিতর যখন আর দৃষ্টি চলে না তখন বেরিয়ে এসে উঠে যান চারপাশের কোনও কাফের খোলা ছাদে ৷ সেখানে বেঞ্চিতে বসে মিন্ট চা খান আর নিচে তাকিয়ে দেখুন জেমা-এল-ফনের বিশ্বরূপ ৷ বিরাট জনসমষ্টি চিনাদের কাগজের সাপের মতো হেলছে দুলছে ৷ সূর্যের পড়ন্ত আলোয় মেলার বিভিন্ন অংশ থেকে ছিটকে পড়ছে বিভিন্ন রং ৷ আলো কমে এল ৷ পিছনে মসজিদ থেকে আজান ধ্বনি উঠছে, ‘আল্লা-হো-আকবর, আশহাদো আল-লা এলাহা ইল্লাল্লাহ…’ (আল্লাই সর্বশ্রেষ্ঠ, আমি সাক্ষ্য প্রদান করিতেছি যে আল্লাহ ব্যতীত কেহই উপাস্য নাই… ৷) নামবার সময় সিঁড়ির মুখ থেকে চোখে পড়বে ২৩২ ফুট উঁচু কুতুবিয়া মিনারের নিঃশব্দ অঙ্গুলি নির্দেশ খোদাতালার আশমানের দিকে যেখানে, তখন কোণ ভাঙা কাঁসার থালার মতো প্রায় পূর্ণিমার চাঁদের পাশে একটি ক্ষীণকায় তারা ঝিকমিক করছে ৷ জেমা-এল-ফনের অনতিদূরে কুতুবিয়া মসজিদ এবং তার সুউচ্চ মিনার মারাকেশের অন্যতম স্থান নির্দেশক ৷ আলমোরাভিডরা প্রায় একশো বছর আগে শুরু করলেও, এ মিনার খাড়া করেছিলেন আলমোহাদ বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি ইয়াকুব-এল-মানসুর দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ৷ আমাদের কুতুবমিনারের সমসাময়িক বলা যায় ৷ প্রবাদ আছে যে, মিনারের ওপরে তিনটি সুবর্ণগোলক গড়া হয়েছিল ইয়াকুব আল মানসুরের কোনও বেগমের সমস্ত গহনা গালিয়ে ৷ বেগম পবিত্র রোজার সময় তিনটি আঙুর খেয়ে ফেলেছিলেন ৷ তাই তাঁর প্রতি এই দণ্ডাদেশ হয় ৷
নিচে নেমে দেখবেন জেমা-এল-ফনে সারি সারি আলো জ্বলে উঠেছে ৷ ওদিকে খোলা আগুনে বড় বড় লোহার পরাত পেতে তৈরি হচ্ছে নানারকমের কাবাব, বড় বড় দাগায় সেঁকা মাছ ৷ হাঁড়ি হাঁড়ি কুসকুস ৷ তার সঙ্গে মেখে খাওয়ার সুরুয়া টাজিন (একরকমের স্টু), বড় বড় ডেকচি করে ফুটছে মরোক্কোর সুপ হারিরা ৷ পিটা ব্রেড মানে হাতগড়া রুটি তো আছেই ৷ চওড়া টেবিলের একপাশে রান্না হচ্ছে ৷ পরিবেশন হচ্ছে টেবিল থেকে ৷ অন্য পাশে সারি সারি বেঞ্চি পেতে বসে ভোক্তারা ৷ দূর থেকে দেখবেন, ঝলসানো মাংস, ফুটন্ত সুপ সুরুয়ার ভাপ ওপরের ঠান্ডা হাওয়ায় জমে গিয়ে খাবার স্টলের দিকে একটা বাষ্পের চাঁদোয়া তৈরি করছে ৷ কয়লার ধোঁয়া নেই ৷ রান্না বেশিরভাগই গ্যাসের উনুনে ৷ কয়লা অল্প যা কিছু তা হল কাঠকয়লা ৷ বড় সাধ হল ওই খাওয়ার আসরে বসে যাই কিন্তু সাহস হল না ৷ অত ভিড়ভাড়াক্কার মধ্যেও কিন্তু বন্দেজ আছে ৷ প্রত্যেক স্টলের নম্বর দেওয়া আছে ৷ ফেরবার পথে যে স্টলে আমরা কিছু বাদাম ভাজা কিনলাম, তার কালো কোলো হাসিমুখ মালিক কাগজে সওদা মুড়তে মুড়তে (ওরা ঠোঙার ব্যবহার জানে না) বলল, ‘আবার এসো ৷ এই তো আমার ২৮নং স্টল’ ৷
পরের দিন বেশ বেলা করে নতুন শহর দেখতে যাব বলে বেরিয়েই শুভদৃষ্টি হল আহমেদ সাহেবের সঙ্গে ৷ চোস্ত, সুট, বুট, টাইপরা সুদৃশ্য যুবক ৷ বয়স গোটা পঁচিশ হবে ৷ ফর্সা রং, কালো চুল, দাড়ি কামানো, ছাঁটা গোঁফের তলায় একমুখ হাসি ৷ আদাব তসলিম দিয়ে পরিষ্কার ইংরিজিতে বললেন, ‘মারাকেশের বিখ্যাত স্যুক দেখতে যাবেন না, আর পুরনো শহর মেদিনার অলিগলি?’ আমাদের আগেই জানা ছিল যে, গোলকধাঁধার মতো স্যুক বা কাটরা দেখতে গেলে একজন গাইড নেওয়াই ভালো, না হলে হয়তো সারাদিন একই চত্বরে ঘুরতে হবে ৷ তাছাড়া পুরীর পাণ্ডার মতো সঙ্গে একজন না থাকলে অসংখ্য পাণ্ডার উৎপাত এড়াতে পারা যাবে না ৷ তবুও ইতস্তত করছি দেখে বললেন, ‘ভয় নেই, আমি সরকার অনুমোদিত গাইড ৷ আমার রেটের বেশি এক পয়সাও নেব না ৷ কোনও দোকানে কিছু কিনতে বলব না ৷’ আমরা বললাম, স্যুক দেখতে কাল যাব ৷ আজ নতুন শহর দেখে আসি ৷ হোটেলের ট্যাক্সির দাম বেশি, আমরা একটু পায়ে হেঁটেও চলতে চাই বলে দশ মিনিট হেঁটে এলাম ফাউন্টেনে যেখানে গোল চক্করে পাঁচটা বড় বড় রাস্তা এসে মিশেছে ৷ মুম্বইয়ের ফ্লোরা ফাউন্টেনের মতো তবে ওরকম ঘিঞ্জি নয় ৷ এইখান থেকেই নতুন শহর শুরু বলা যায় ৷ ফাউন্টেন এবং পুরনো মারাকেশের মধ্যের জায়গাটাও নতুন ৷ এটা হল হোটেল আর অফিস এলাকা ৷ সারি সারি বড় বড় হোটেল তাদের নিজস্ব বাগানের মধ্যে ৷ ফাউন্টেনের চারদিকে গোল করে এবং তার ধারে-কাছে বিরাট বিরাট বাড়ি (পাঁচ-ছতলার বেশি নয় ৷ স্থান সংক্ষেপ মারাকেশে এখনও হাইরাইজ শুরু করেনি) ৷ সরকারি, বেসরকারি অফিস, বড় বড় দোকান ৷ দুয়েকটা কাফিখানা ৷ পরিষ্কার চওড়া চওড়া রাস্তা, গাছপাতা, ফুলে-ফলে নয়নাভিরাম ৷ সরকারি নয়াদিল্লির কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ নয়াদিল্লির মতোই সকাল-বিকেল সাইকেলের ভিড় ৷ অফিসযাত্রীরা ৷ মাঝে-মাঝে মোটরাসীন অফিসারকুল ৷ অন্যসময় রাস্তা সুনসান ৷ কখনও ভোঁ করে একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল ৷ এছাড়া আছে আমাদের ফিটনের মতো ঘোড়ার গাড়ি ৷ দেশি নাম কালেচে ৷ গাড়ি এবং নাম দুই-ই ইউরোপ থেকে নেওয়া ৷ এগুলো ট্যুরিস্ট ধরবার ফাঁদ ৷ এদের ভাড়া ট্যাক্সির দু-তিনগুণ এবং সে ভাড়ার কোনও মা-বাপ নেই ৷ তবুও শ্বেতাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গিনীরা যুগলে কখনও বাচ্চাকাচ্চাসমেত ক্লিপেটি ক্লপ করে হাওয়া খেতে যান ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ৷ ভাড়া বেশি বটে কিন্তু ডলার, পাউন্ড, মার্ক দিয়ে মাপ করলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই ‘ড্যাঞ্চি’ ৷
ফাউন্টেন থেকে ট্যাক্সি ধরে চলে গেলাম নয়া শহরের যেটা কেন্দ্রস্থল, ব্যবসা-বাণিজ্যের আড্ডা, দোকান-পসার যেন আমাদের ধর্মতলা (বড়বাজার তো মেদিনার ভেতরে) সেই গেইলাতে ৷ রাস্তার দুধারে ঝুপি অলিভ গাছ ৷ কমলালেবুর গাছও আছে, কিন্তু সে ছোট ছোট লেবু খাবার নয় ৷ জোঁদা টক ৷ শহরের সর্বপ্রধান দুটি রাস্তা এভঃ মোহামেদ (৫) আর এভঃ ইয়াকুব এল মানসুর, যেখানে অসমকোণে মিশেছে সেখানে চারটি কোণা জুড়ে চারটি ফুটপাথে ছড়ানো কাফে ৷ খোঁজ নিয়ে জানলাম, এসব কাফে স্রেফ আড্ডা মারবার জন্য ৷ চা, কফি, বিয়ার, ওয়াইন, জিন, হুইস্কি সবই পাওয়া যাবে কেবল খাবার বেলায় ঢু-ঢু ৷ পাশেই এক রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসে কাফেতে ছড়িয়ে বসলাম ৷ এইখান থেকেই শহর দেখা যাক ৷ প্রায় তৎক্ষণাৎ এক ছোকরা এসে আমার ‘বুৎ বালিশ’ করতে লেগে গেল ৷ টকটকে ফর্সা রং, লাল চুল, পোশাক-পরিচ্ছদ পুরনো হলেও পরিপাটি ৷ বয়স ১৬-১৮ হবে ৷ সে বুরুশ ঘষে আর আড় চোখে আমার স্ত্রীর শাড়ি পরা মূর্তির দিকে তাকায় ৷ তারপর আরবী ভাষায় গড়্গড় করে কি বলে গেল ৷ আমরা কিছুই বুঝলাম না কিন্তু কলকাতার লোকের মতোই মরোক্কোবাসীরা বিদেশীকে সাহায্য করতে সর্বদাই উন্মুখ ৷ আমাদের পাশেই যে দুটি আরব ছোকরা বসে মিন্ট চা খাচ্ছিল তাদের একজন ভাঙা ফরাসিতে আমাদের বুঝিয়ে দিল যে বুৎ পালিশ ছেলেটি বলছে যে, ও ইন্ডিয়া ভীষণ পছন্দ করে, অনেক হিন্দি ছবি দেখে এবং আরেকটু বড় হলেই ও ইন্ডিয়াতে গিয়ে ইন্ডিয়ান মেয়ে বিয়ে করবে ৷ কত খরচ পড়বে ইন্ডিয়ান কনের জন্য ৷ আমার স্ত্রী তখন দোভাষীর মারফত তাকে জানালেন যে, ইন্ডিয়াতে বরপণ দিতে হয় কন্যাপণ নয় ৷ ওর মুখটা বেশ হাঁ হয়ে গেল ৷ একটা জিনিস লক্ষ করলাম, মরোক্কোতে আবালবৃদ্ধ (বনিতাদের কথা বলতে পারলাম না) দৃঢ় বিশ্বাস করে ইসলামাৎ পরতর নহি ৷ ফিল্ম স্টার ধর্মেন্দ্র মুসলমান নয় শুনে আমাদের ছেলেটি বেশ মর্মাহত হল ৷ সেকি? ওই যে অমুক ফিল্মে আকুলভাবে আকাশের দিকে হাত তুলে খোদাকে ডাকল ধর্মেন্দ্র ৷ আমাদের মারাকেশ ভ্রমণের ফলে ধর্মেন্দ্রর অন্তত একটি ভক্ত বোধহয় কমে গেল ৷ হিন্দি ফিল্ম সম্বন্ধে যে যাই বলুক তৃতীয় পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে আমার ধারণা হয়েছে যে, আমাদের সমমর্মী এই দেশগুলিতে অথবা ভারতের বাইরে ভারতীয় আবাসিকদের মধ্যে ভারতের সঙ্গে কৃষ্টিগত সংযোগ ও ভারতচেতনা বজায় রাখার ব্যাপারে এই ফিল্মগুলির দান অনস্বীকার্য ৷ সেইদিনই সন্ধেবেলায় পুরনো শহরের এক মরোক্কান রেস্টুরেন্টে যখন খেতে গেলাম তখন মালিক স্বয়ং এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে ভুল উচ্চারণে (কিন্তু ঠিক সুরে) হিন্দি ফিল্মের গান শুনিয়ে দিলেন ৷
পরের দিন সকালে আমরা মিঃ আহমেদের হাতে আমাদের সঁপে দিলাম ৷ মেদিনা এবং তার অন্তর্বর্তী স্যুক ৷ নতুন শহর যেমন নতুন দিল্লির কথা মনে করিয়ে দেয় মেদিনা তেমনই পুরনো দিল্লি ৷ গলিঘুঁজি কাশীতেও কিছু কম নেই, কিন্তু বোধহয় ইসলামীয় স্থাপত্যের জন্যই মেদিনা যেন আমাদের চাঁদনিচকের আশপাশ, দরিবা কালান, পরোটাওয়ালা গলি ৷ এর ইতিহাস অক্লেশে এক হাজার বছর চলে যায় ৷ তবে এখন যে শহর দেখছি, তা পুরনো দিল্লির মতোই চার-পাঁচশো বছরের ৷ টেরা-বাঁকা সরু রাস্তা, তার দুদিকে ইটের নয়, গিরিমাটির দেওয়াল, মাঝে মাঝে লম্বা খুপরিমতো যেখানে বেনে তার বেনেতি মশলা সাজিয়েছে নিচু পাটাতনের ওপর আধভর্তি গানিব্যাগে ৷ তারপাশেই একটা পেতল-কাঁসার দোকান ৷ হরদম সায়েব ঠকানো অ্যানটিক তৈরি করছে ৷ ছোট ছোট সিগারেটের খুপরি, সেখানে সিগারেট ছাড়াও নানারকম টুকিটাকি জিনিস পাওয়া যায় ৷ পান-দোক্তার চল একেবারেই নেই ৷ সেলুনে নাপিত চুল ছাঁটছে ৷ কটা কার্পেটের দোকান ৷ তারপরেই গাইড দাঁড়িয়ে গেল কারুকার্যমণ্ডিত বিরাট এক দরজার সামনে ৷ বেন ইউসুফ মেদ্রেসা ৷ ১৬শ শতাব্দীর বিখ্যাত ইসলামীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৷ এই সেদিনও চালু ছিল ৷ ফরাসি আমলে (বোধহয় ছাত্রাভাবে) বন্ধ হয়ে এখন মিউজিয়ামে পরিণত ৷ গলিঘুঁজি হলেও সব বেশ ছিমছাম সাফসুরৎ ৷ কারণ রাস্তা জুড়ে কেউ সবজি বেচছে না ৷ অথবা ‘চিরপরিচিত গদাইয়ের চায়ের দোকান’, ‘করিমের কাবাব স্টল’ নেই ৷ খাবার স্টল প্রচুর আছে এবং তার জন্য নির্দিষ্ট এলাকাও আছে ৷ সারা শহর জুড়ে শালপাতা, খাদ্যের অবশেষ, হাত ধোয়া এবং সবজি ধোয়া জলের নোংরামি নেই ৷ অথচ মেদিনার একতলাতেই শুধু দোকান ৷ দুতলা-তিনতলাতে পুরুষানুক্রমে বহু লোক বাস করে ৷ মেদিনা শেষ করে এবার বূহ্যের ভেতরে ব্যূহের মতো স্যুকে ঢুকলাম ৷ স্যুকের চারদিকেও দেওয়াল ঘেরা তবে নগর-প্রাকারের মতো উত্তুঙ্গ নয় ৷ দেওয়ালের মাঝে মাঝে গেট এবং সেসব গেটেরও নাম আছে স্যুকগুলির অবস্থান বোঝাবার জন্য ৷ স্যুকগুলি আর কিছুই নয়, এক-এক পণ্যের দোকান সমষ্টিমাত্র ৷ যেমন স্যুক আতরাইন মশলা গন্ধ দ্রব্যাদির স্যুক ৷ স্যুক আরাটিন যেখানে চামড়া, কাঠ এবং বহু ধাতুনির্মিত জিনিস বিক্রি হয় ৷ স্যুকেও বিজুতেরি গয়নার বাজার আরও কতরকমের স্যুক ৷ স্যুক আরব সভ্যতার একটি বিকাশ ৷ মধ্য এবং নিকট প্রাচ্যের সর্বত্র আছে ৷ কারণ সভ্যতার বহু কারণের মতো ধর্মভিত্তিক ৷ প্রত্যেক স্যুকের মাঝখানে তাদের নিজেদের মসজিদ থাকে যাতে করে প্রত্যেক দোকানি হাঁটাপথে নমাজ পড়তে যেতে পারে আজান শোনবার পর ৷ মেদিনা এবং স্যুকে এত ভিড়-ভাড়াক্কা, দোকান-পসার, কেনাবেচা হলেও চেঁচামেচি নেই ৷ এবিষয়ে মরোক্কোর লোকেরা আশ্চর্য শান্ত, মৃদুভাষী ৷ বাইরে গাড়ির হর্ন পর্যন্ত শোনা যায় না ৷ স্যুকের ভেতরে চলতে চলতে কানে আসবে দুটি আওয়াজ ৷ এক ‘পলেক পলেক’ ৷ পিঠে বিরাট বোঝা নিয়ে (মাথায় মোট নেওয়া ভারতের বাইরে কোথাও দেখিনি) মুটেরা সাবধান করছে তফাৎ যাও, তফাৎ যাও ৷ অন্যটি হল, মাঝে মাঝে সরব দীর্ঘশ্বাসের মতো ৷ আল্লা! ভগবানের দোহাই ৷ অন্ধ কৃপা ভিক্ষা করছে ৷ এর অদূরেই মরোক্কোর সন্ত সুফী সাধুদের পূজ্যতম সিদি বেল আব্বাসের দরগা ৷ লোকে বলে দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু এখনও প্রতি রাতে কুতুবিয়ার আশপাশে ঘুরে বেড়ান যতক্ষণ না মারাকেশের সমস্ত অন্ধ খেতে পায় ৷ গাইড আহমেদ সর্বদা আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং যত্ন করে সব দেখিয়েছেন ৷ তিনি মজুরি এবং ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের যে কথা দিয়েছিলেন তার বিন্দুমাত্র অন্যথা করেননি ৷ এমনকি ফেরবার সময় মাঝপথে ওকে ছেড়ে দিয়ে যখন আমরা মামুনিয়া হোটেল দেখতে গেলাম তখন তিনি নিজে হোটেলে ফিরে যাবার ভাড়াও চাননি ৷ ভদ্রলোক আর কাকে বলে ৷ আহমেদ এখনও অবিবাহিত ৷ তবে পাড়ার কোনও মেয়ের সঙ্গে পূর্বরাগ চলছে ৷ না, মরোক্কো মুসলিম হলেও পূর্বরাগে বাধা নেই ৷ ভোরবেলায় জেমা-এল-ফন-এ বসে কফি খেতে খেতে আমি দেখলাম হাসিমুখ নারী-পুরুষ (স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে হল) হাত ধরাধরি করে চলে গেল ৷
মারাকেশে দুটি সরকারি বাগান আছে ৷ মেনারা এবং আণ্ডয়াডাল ৷ আণ্ডয়াডাল আসলে একটি বিরাট সমচতুর্ভুজ দিঘি, যার চারদিকে বাগান ৷ শহরের জল সরবরাহ হয় এখান থেকে ৷ দুটি বাগানই তৈরি করেছিলেন সবুজপ্রেমী জলবিলাসী বারবার সুলতানরা দ্বাদশ শতাব্দীতে ৷ তখন হয়তো পুষ্প এবং বুলবুলিতে এদের ফিরদৌস বলা চলত ৷ এখন হৃত গৌরব ৷ আরেকটি পটে আঁকা বাগানবাড়ি আছে যার মালিক হলেন ইভস সেন্ট লরেন্ট (YVES ST LAURENT), প্যারিসের উচ্চ ফ্যাশনের গুরু এবং উদ্ভাবক ৷ বাড়িটি তাঁর ব্যক্তিগত হলেও বাগান এবং বাগানের অভ্যন্তরে তাঁর নিজস্ব শিল্প সংগ্রহশালা সামান্য পয়সা নিয়ে দেখতে দেয় ৷ বাগানটি দেখবার মতো ৷
মারাকেশ এলে মামুনিয়া হোটেলের কথা বলতেই হয় ৷ এটি একটি প্রতিষ্ঠান ৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হোটেলগুলির অন্যতম ৷ ঐশ্বর্য, বিলাস এবং মূল্যে ৷ মরোক্কোপ্রেমী চার্চিল এই হোটেলে বহুদিন ছিলেন ৷ তাঁর ব্যবহৃত স্যুইটটি এখনও সাজিয়ে রাখা হয়েছে দ্রষ্টব্য হিসেবে ৷ লোকমুখে এখানকার মরোক্কান খানার প্রচুর প্রশস্তি শুনছিলাম ৷ তাই স্যুক থেকে ফেরবার পথে দ্বিপ্রাহরিক আহারটা এখানে সারব ভেবেছিলাম, না হয় তারপর দুদিন ম্যাকডোনাল্ডে (তাও আছে) ক্ষুন্নিবৃত্তি করব ৷ কিন্তু হোটেলে গিয়ে শুনলাম হোটেলের নতুন মালিকরা দুপুরবেলা মরোক্কান রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখেন ৷ সেখানে কেবল নৈশাহার হতে পারে ৷ অতএব কাফেটরিয়ায় খেলাম ৷ তারও উদ্যোগ আয়োজন লিনেন ক্রকারি, কাটলারি অনেক ভালো রেস্টুরেন্টকে লজ্জা দিতে পারে ৷ উত্তম ফরাসি খাদ্য ৷ চার্চিল স্যুইট দেখা হল না কিন্তু একতলার বহু কক্ষ, বারান্দা, অলিন্দ ঘুরে ঘুরে দেখলাম ৷ একটি বিরাট ঢাকা বারান্দায় মনোমুগ্ধকর মুরালে মরোক্কোর নানা দৃশ্য আঁকা আছে ৷ বলে রাখি যে, সারা মরোক্কোর ভেতর এই একটি জায়গা যেখানে হোটেল কর্মচারীদের কেউ কেউ (সবাই নয়) আমাদের কালো বরণের দিকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ৷ হবে না ৷ চার্চিল সাহেবের হোটেল তো ৷ শোনা যায় যে, মামুনিয়ার গ্র্যান্ড ক্যাসিনো (অভিজাত জুয়াখেলার জায়গা) অর্থকৌলিন্যে এবং উত্তেজনায় মন্টি কার্লোর সঙ্গে তুলনীয় ৷
মারাকেশের মেয়াদ শেষ হয়ে এল ৷ আরেকটি দিন ৷ এই দিনটি আমরা ট্যুরিস্ট বাসে করে বেড়াতে গেলাম উরিকা ভ্যালি, মারাকেশ থেকে কমবেশি পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে আটলাসের পাহাড়তলিতে স্নিগ্ধ শ্যামবনানী গভীর উপত্যকা ৷ মাউন্ট তুকবাল পর্বতশ্রেণীর সমস্ত জল নামে এই উপত্যকা বেয়ে ঝরনা, নদী, প্রস্রবণ ৷ চারদিকে কুলকুল জলের আওয়াজ ৷ বিরাট বাস ৷ বিরাট দল ৷ আমরা দুটি ছাড়া সব সাহেব-মেম ৷ মরোক্কোর ট্যুরিজম এখনও বেশিরভাগই ইউরোপীয়দের দখলে ৷ ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটালিয়ান, স্প্যানিয়াডদের ছড়াছড়ি ৷ আমেরিকান অপেক্ষাকৃত কম ৷ জাপানি চোখেই পড়ে না ৷ আর আমাদের যে সর্বঘটে কাঁঠালি কলা সর্দারজি পুরো দশদিনে মাত্র একটি চোখে পড়েছিল ৷ মরোক্কোতে ভারতীয়দের সংখ্যা অত্যল্প ৷ ফিল্ম যতই থাক ভারতীয় রেস্টুরেন্ট তো দেখিনি ৷ বাস পিচের রাস্তা দিয়ে চলেছে ৷ একহারা রাস্তা কিন্তু বেশ মসৃণ ৷ খানাখন্দ নেই ৷ যান চলাচলও এমন বেশি নয় ৷ দুদিকে শস্যক্ষেত্র, ফলের বাগান, ছোট ছোট গ্রাম ৷ কাফিখানা ৷ মুদির দোকান ৷ অন্তত একটা মসজিদ, তার লাগোয়া স্কুল ৷ পাঠশালা বললেই হয় ৷ খোয়াই ভেঙে পাহাড়ি নদী ৷ মাটির রং লাল ৷ বাস চলছে প্রায় তীরের মতো সোজা হাই আটলাস লক্ষ্য করে ৷ চালকের পাশে বসে গাইড মাইক্রোফোনের সাহায্যে ক্রমাগত বস্তু এবং দৃশ্য পরিচিতি দিয়ে যাচ্ছেন শুদ্ধ ফরাসি ভাষায় ৷ কথা ছিল ভাষণটি ইংরিজিতেও হবে ৷ গাইড বার দুই চেষ্টাও করল ৷ ফরাসির বদলে ইংরিজি ৷ কিন্তু সে ইংরিজি আমাদের কাছে ফরাসির মতোই দুর্বোধ্য ৷ পাহাড়ের শুরুতেই টনাইন এল ৷ উরিকায় সোমবারের হাট ও অঞ্চলে বিখ্যাত ৷ আমাদের ট্যুরটাও ওইজন্য সোমবার করা হয় ৷ চারপাশের দশটা গাঁ থেকে মানুষজন আসে ৷ আসে পসারীরা তাদের ডেরা ডাণ্ডা, তাঁবু, শতরঞ্চি নিয়ে ৷ আনাজ, সবজি, মাছ, মাংস, ফল-পাকড়, চাল-ডাল, মশলা, কাপড়, বাসন, কাঁসা, কম্বল, খুরপি, শাবল, ছুরি, কাঁচি-সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় এই হাটে ৷ তার সঙ্গে খবর নেওয়া, খবর দেওয়া, গল্পগুজব, এ গ্রামের লোকের সঙ্গে ও গ্রামের দেখা-সাক্ষাৎ সব এই মেলায় ৷ সব পুরুষমানুষ, মেয়েরা হাটে আসে না ৷ তারা নিজের নিজের গ্রামে ঘরকন্নায় ব্যস্ত ৷ মেলার ডাঙা জমির একটু আগে নদীর ধারের নাবালে বিরাট পার্কিং লট ৷ সেখানে অন্তত পাঁচশো গাধা খোঁটায় বাঁধা আছে ৷ পাশেই ফুয়েল পাম্প ৷ ঘাস-খড়ের দোকান ৷ হাট দেখে আবার বাসে উঠলাম ৷ এবার সত্যি পাহাড় ৷ ঘুরে ঘুরে বাস উঠছে ৷ কখনও দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ৷ কখনও একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে নিচুতে সংকীর্ণ এক নদী ৷ নদীর কাছে কয়েকটা ঘর ৷ একচিলতে খেত ৷ এক জায়গায় রাস্তা সর্পজিহ্ব ৷ অন্য পথটি গেছে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে উকাইমেদেন ৷ জেবেলতুকবালের পায়ের গোড়ায় ছোট্ট শহরটি ৮৬০০ ফুট ৷ স্কি খেলার জন্য বিখ্যাত ৷ এখান থেকে স্কি লিফট করে ওঠা যায় জেবেল উকাইমেদেন ৷ প্রায় ১১০০০ ফুটে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম স্কি খেলার জায়গা ৷ আমরা অতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলাম না এবং অক্টোবর মাসে বরফও নেই, স্কি-ও নেই ৷ এর কিছুটা পরই রাস্তা চওড়া হয়েছে আর আধখানা রাস্তা জুড়ে সাইনবোর্ড-LA KASBAH DE L’OURIKA RESTAURANT BAV. SALON DE THE.
শুনলাম এই হল উরিকা ভ্যালিতে আমাদের গন্তব্যস্থল ৷ একসময়ে এটি দুর্গ ছিল ৷ দ্বিপ্রাহরিক আহার এখানেই হবে ৷ নেমে পড়লাম ৷ আহারাদির গল্প অন্য জায়গায় করব ৷ মরোক্কান খাওয়া ৷ বুফে স্টাইলে ৷ কেবল স্যুপ এবং সুরা পরিবেশিত হল ৷ তারপর হোটেলে ফেরা ৷ বাস সকলকে যে যার হোটেলে নামিয়ে দিল ৷
সেইদিন মানে মারাকেশের সেই শেষ সন্ধ্যায় এদেশীয় একটি ক্যাবারে দেখতে গেলাম ৷ এল-বাদিয়া নাম্নী নর্তকী প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আমাদের নানাবিধ নৃত্য দেখালেন ৷ অপারদর্শী আমার পক্ষে তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়, তবে বিদ্যুতের পায়ে ঘুঙুর লাগিয়ে দিলে হয়তো এইরকম দেখাত বা শোনাত ৷ বাদিয়া অবশ্য ঘুঙুর ব্যবহার করেননি ৷ তাঁর হাতে ছিল ক্যাসটানেট ৷ ধাতু এবং কাঠের তৈরি একরকম মন্দিরা বলা যায় ৷ পরে শুনেছিলাম যে, উনি হলেন মারাকেশের শ্রেষ্ঠ নর্তকী ৷ বয়স নাকি পঁয়তাল্লিশ ৷ এছাড়া বাজিকর, ম্যাজিক, সাপখেলানো ৷ নানারকমের যৌথনৃত্য ৷ আটলাসের ওপার থেকে নিয়ে আসা আওয়াস এবং গুয়েড্রা ৷ বাদ্যযন্ত্র বাঁশি (ফ্লুট), রুবাব, কাঠতরঙ্গ, হার্প, ভায়োলার মতো দেখতে একটা যন্ত্র কিন্তু হাঁটুর ওপরে রেখে বাজায়, আমাদের সবচেয়ে অবাক করল তলারদিকে সরু আর ওপরদিকে চওড়া খোলার ওপর চামড়া ঢাকা এক পটহ যেটার বাদ্যি ঠিক যেন আমাদের ডুগি তবলা ৷ শুনলাম বাজনাটির নাম ডারবুকা ৷ সঙ্গীতও ছিল ৷ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীত যেমন হয় ৷ আমাদের খেয়ালের বিস্তারের মতো ৷ সুরের ওঠানামা আছে, কিন্তু দুন-চৌদুন না থাকার দরুন আমাদের কানে একটু একঘেয়ে ঠেকে ৷ পরের দিন সকালে ফেজ পুরনো মরোক্কোর প্রধান নগরী ৷ মারাকেশ থেকে ওড়াপথে পঁয়ত্রিশ মিনিট ৷ সবসুদ্ধ হোটেল থেকে হোটেলে আড়াই ঘণ্টা ৷ এই সময়টা এয়ারপোর্ট বা এয়ার প্লেনে বসে না থেকে একটা আলোচনা করি মরোক্কোর আহারাদি, কেনাকাটা, রীতিনীতি বিষয়ে ৷
মরোক্কান খানার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল মাংস, বিশেষ করে চিকেন ও ফলের সংযোগ ৷ বিখ্যাত স্ট্রু-টজিন হল স্ট্রু করা মাংসের ওপরে প্রন, কমলা, এলমন্ডের আবরণ ৷ স্ট্রু করা মাংস আর সবজি ৷ স্যুপ বলতে হারিরা ৷ ঘন ডালের সঙ্গে মাংসের টুকরো, পেঁয়াজ, টমাটো প্রভৃতি দিয়ে ফোটানো ৷ এটা প্রধানত গরিবের খাবার, ফেজ-এল বালির রাস্তায়, প্রত্যুষে দলে দলে লোক সকালের জলপান সারে একবাটি হারিরা আরেকটা বান দিয়ে ৷ এরপরেই বলতে হয় বিসটিল্লার কথা ৷ নবাব বাদশার খাদ্য ৷ আগে থেকে বলে রাখলে কোনও কোনও পাঁচতারা হোটেলে পেতে পারেন ৷ নানাবিধ লতা-পাতা, শিকড়, মশলা সংযোগে গুমো আঁচে বহু ঘণ্টা ধরে পক্ক কপোত মাংস ৷ অন্যদিকে তৈরি হয় পাতলা পাতলা খাস্তা পরোটা ৷ সুপক্ক কপোত মাংসের সঙ্গে জাফরান, এলমন্ড, মধু ও শর্করা মিশিয়ে খাস্তা পরোটার ওপর পরতে পরতে বিছিয়ে দেওয়া ৷ খেতে কেমন লাগে ৷ কী করে বলব, খাইনি তো ৷ এখানে মাংসের সঙ্গে মধু ও বাদামের সংযোগ লক্ষ করুন ৷ বিসটিল্লা না খেলেও মরোক্কোর জাতীয় ডিস কুসকুস (ইউরোপীয়দের বিচারে) অনেক খেলাম ৷ কুসকুস হয়তো আপনারাও খেয়েছেন ৷ তবু বলে রাখি যে, মোটা দানার সেদ্ধ সুজি অল্প ভেজে, মাংস বা সবজির সুরুয়া দিয়ে মেখে খেতে হয় ৷ বেশ লাগে ৷ এছাড়া আছে নানারকমের কাবাব এবং কোফতা আমাদেরই মতো ৷ ছোট ছোট সসেজ (শুয়োরের মাংস নয়) ভাজা খুব চলে ৷ মরোক্কোর সুবিশাল সমুদ্রসৈকতে এবং পাহাড়ি ঝরনায় নানারকমের মাছ পাওয়া যায় ৷ মাছ ওরা খায়, তবে ঝোলঝাল অম্বল বানাতে জানে না ৷ আস্ত আস্ত মাছ বা বড় বড় দাগা সেঁকা, ভাজা, সেদ্ধ নানাভাবে খাওয়া হয় ৷ মরোক্কোতে ফল, সবজি, চিংড়ি, সার্ডিন ফিডাচিজ (ছাগলের দুধ থেকে তৈরি) সব মিশিয়ে যা স্যালাড করে, তা পিঠা (মধ্যপ্রাচ্যের হাতে গড়া রুটি) দিয়ে খেলে এক বেলার খাওয়া হয়ে যায় ৷ মিষ্টিমাষ্টার ব্যাপারে মরোক্কোর খুব প্রশংসা করতে পারছি না, যদিও দেশটা মধুর খনি ও চিনির রানি ৷ ভারতবর্ষের অনেক আগে থেকে মরোক্কো চিনি বানাচ্ছে এবং ষোড়শ, সপ্তদশ শতাব্দীতে সারা ইউরোপ মরোক্কোর চিনির প্রত্যাশায় বসে থাকত ৷ এর কারণ বোধহয় মিষ্টিতে দুধের ব্যবহার মরোক্কানরা শেখেনি ৷ অবশ্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত সর্বত্রই গরু তথা দুধের ব্যবহার কম ৷ উট, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, গাধা এই নিয়েই তাদের কারবার ৷ মিষ্টি সবই ময়দা, চিনি, মধুর সমন্বয় ৷ যেমন ব্রিউয়াত ৷ ছোট ছোট সামোসার ভেতরে মধু আর বাদামের পুর ৷ কিমা বা চালের পুর দিয়ে ব্রিউয়াতকেই আবার খাদ্যারম্ভে দেওয়া হয় ৷ ‘গ্রীয়ুশ’ মধু মেশানো ময়দার ছড়ির মতো পেস্ট্রির গায়ে তিল ছড়ানো ৷ আর আছে ‘কাব এল গেজলা’ বা গেজেলের শিং ৷ গেজলের শিংয়ের ডগার মতোই পাকানো পাকানো খাস্তা পেস্ট্রির মধ্যে মধু মেশানো বাদাম বাটা কমলালেবুর ফুলের গন্ধে সুবাসিত ৷ শুনতে যতটা, খেতে কিন্তু ততটা নয় ৷ খুব মিষ্টি কিছু চাইলে চিনি মেশানো বাদামের পুর ভরা খেজুর খেতে পারেন ৷
মরোক্কোর জাতীয় পানীয় হল মিন্ট টি বা পুদিনার চা ৷ প্রায় সমান পরিমাণ সবুজ চা আর শুকনো পুদিনা পাতা একসঙ্গে ফুটিয়ে মিন্ট টি তৈরি হয় ৷ চিনি অঢেল কিন্তু দুধ বারণ ৷ ছোট ছোট পল কাটা কাচের গ্লাসে আধ ভর্তি করে এই চা খাওয়া হয় ৷ আমরা বাঙালিরা দিনে আর ক’কাপ চা খাই ৷ মরোক্কোবাসীরা ওর থেকে অনেকবেশি গ্লাস মিন্ট টি খায় ৷ কফির চলও আছে, তবে ফরাসি কায়দায় ৷ গাঢ় কালো কফি ৷ চিনির ডেলাটা কফিতে না ফেলে দাঁতে কামড়ে রাখার নিয়ম ৷ আমাদের দুধ-চিনি মেশানো কালো চা একবারে অপাংক্তেয় ৷ বিদেশীরা যেসব জায়গায় আনাগোনা করে কেবল সেখানেই পাওয়া যায় ৷ ইসলাম মদ্যপান নিষিদ্ধ করলেও উত্তর আফ্রিকার এই অংশে (মরোক্কো, আলজেরিয়া, টিউনিস) আঙুরের চাষ বেশ হয় ৷ সেই সুযোগ নিয়ে ফরাসি আমলে মদ্য প্রস্তুত চালু হয় ৷ ফরাসিরা চলে যাওয়ার পরে উৎপাদন পরিমাণ কমে গেছে কিন্তু এখনও যা আছে তা দেশের পক্ষে যথেষ্ট ৷ কিছু রপ্তানিও হয় ৷ বড় বড় এমনকী মেজ-সেজ রেস্টুরেন্টেও এবং কফিখানাগুলোতে মরোক্কান ওয়াইন এবং বিয়ার পাওয়া যায় ৷ হুইস্কি, জিন প্রভৃতি উগ্র পানীয়ের অত চল নেই তবে পাওয়া যায় ৷ নানারকম অ-সুরাবাহী পানীয় যেমন কোকাকোলা, সোডা, লেমোনেড তো আছেই ৷
মরোক্কো লেদারের কথা আমরা সবাই শুনেছি এবং আমি বলব যে, আমাদের ভারতীয়দের পক্ষে সবচেয়ে ভালো খরিদ হল চামড়ার জিনিস ৷ কাপড়ের মতো নরম মরোক্কোর চামড়ার জিনিস নানারকম উদ্ভিদজাত রং-এ উজ্জ্বল ৷ সঙ্গের গাইড বললেন, চামড়া এত উজ্জ্বল এবং নরম কেননা এটি কিয়োর করা হয় গোমূত্রে ৷ কিন্তু এত গরু পায় কোথায়? তবে কি…? চামড়ার পরে সুতির জিনিস ৷ মরোক্কোর লম্বা আঁশ তুলা ইজিপ্টের সঙ্গে টেক্কা দেয় ৷ মরোক্কোর বিশেষ ধরনের নীল চিনামাটির কাজও খুব ভালো কিন্তু বিমানচারীদের পক্ষে বর্জনীয় ৷ এছাড়া কার্পেট, তামা-পিতলের জিনিস, রুপোর গয়না প্রভৃতি নানা মনোরঞ্জনকারী জিনিস আছে বটে কিন্তু আমরা যারা দিল্লির জনপথ বা মুম্বইয়ের চোরাবাজারে ঘুরেছি তাদের কাছে এমন কিছু নয় ৷ হ্যাঁ, কাশ্মীরে যেমন চাষারা পুরনো সামোভার বেচে নতুন কেটলি কিনে নিয়ে যায় আর আমরা ওই সামোভার নিয়ে এসে বাড়ি সাজাই, মরোক্কোতেও তেমনই বারবার-রা তাদের কারুকাজ করা টি-পট বদলে নতুন ধরনের সওদা নিয়ে যাচ্ছে ৷ ওইরকম একটা টি-পট আমরা কিনলাম ৷ মরোক্কোতে জিনিস কিনতে হলে, তা সে স্যুকেই হোক বা শহরের দোকানেই হোক দরদাম করতে পেছপা হলে চলবে না ৷ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াও মরোক্কোতে দাম কষাকষি ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে একটা বোঝাপড়ার খেলা ৷ দুপক্ষ সমান খেলোয়াড় হলে বেশ একটু মজার ব্যাপার হয় ৷ একটা উদাহরণ দিই ৷ শহরের এক দোকানে আমি একটি জেলেবায়া কিনতে চাইলাম ৷ দোকানদার আমাকে আগে জেলেবায়াটি পরাল, মাথায় একটা ফ্রেজ ট্রপী দিল, তারপর আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে, এদিকটা টেনে ওদিকটা সমান করে একমুখ হেসে বলল, ‘বাঃ, বেশ মানিয়েছে তো ৷ কে বলবে তুমি মরোক্কোর লোক নও ৷’ দাম? দাম একটা দিচ্ছি ৷ এইতো ৬৪০ দিরহাম (২৫৬০ টাকা) লেখা আছে ৷ তবে তুমি আমার ভারতীয় বন্ধু, তোমার জন্য ৫৫০ দিরহাম ৷ তার আগের সন্ধ্যায় গৃহিণী ওই একই জিনিসের একটি মহিলা সংস্করণ কিনেছেন ১০০ দিরহামে ৷ আমি মুখের ভাব অবিকৃত রেখে বললাম-অনেক ধন্যবাদ ৷ কিন্তু আমার কাছে যে এদিকে মেরেকেটে ১০০ দিরহামের বেশি নেই ৷ শেষপর্যন্ত ১২০ দিরহামে রফা হল ৷ আমরা দুজনেই খুব খুশি ৷ এই ঘটনাটা অবশ্য একটু অসাধারণ ৷ সাধারণভাবে চাওয়া দামের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেকের মধ্যে কিনতে পারলে দুপক্ষেরই জিত হল ৷ আবার অত্যাধুনিক এমন সব দোকানও আছে যেখানে একদাম ৷ কোথাও বা চাইলে শতকরা দশ থেকে কুড়ি শতাংশ ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ৷
আগেই বলে রাখি মরোক্কোর রীতিনীতি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান বিভিন্ন গাইড, হোটেল কর্মচারী, ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কাছ থেকে পাওয়া ৷ এগুলো সাধারণ লোকের বেলাতেই প্রযোজ্য ৷ বিশ-ত্রিশ বছর আগেও যৌথ পরিবার ছিল মরোক্কোর নিয়ম ৷ এখন নাগরিকজীবনের সংঘাতে বিশেষ করে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ছেলেরা বিয়ের পরে আলাদা বাসা করছে ৷ কিন্তু যৌথ দায়িত্ব এখনও স্বীকৃত ৷ আমার বাবা বা আমার ভাই না খেতে পেলে সে আমার লজ্জা ৷ মরোক্কো দরিদ্র দেশ হলেও কেউ না খেয়ে থাকে এমন হয় না ৷ এতদিন বাবা-মা দেখেশুনে বিয়ে দিত ৷ এখন স্বনির্বাচিত পাত্র-পাত্রীও চলে ৷ তবে দুপক্ষের বাবা-মার সম্মতি না থাকলে বিয়ে হওয়া মুশকিল ৷ মরোক্কোর মুসলমানেরা সুন্নী হলেও এদের সুর অনেক নরম ৷ বিধর্মীকে স্বধর্মে আনা এদের পবিত্র কর্তব্য ৷ কিন্তু যদি কেউ মুসলমান হতে না চায় তবে তাকে দীনজন হিসেবে ত্যাগ করলেই চলে ৷ বধ করবার দরকার নেই ৷ এখানে আলমোহাদ বংশের কুলপ্রদীপ সুলতান ইয়াকুব আল মানসুরের একটা গল্প বলি ৷ তখন পৃথিবীখ্যাত দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ইবন রুশদ কাইরুইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন ৷ গুজব রটল যে, ইবন রুশদ ইসলাম ধর্মসংক্রান্ত কোনও বইতে গ্রিক দেবী ভেনাসের উল্লেখ করেছেন ৷ ইসলামের এত বড় খেলাপ ফেজের মোল্লারা সহ্য করবেন কী করে ৷ তাঁরা ফতোয়া দিলেন যে, ওই লেখকের সমস্ত পুস্তক মায় লেখককেও প্রকাশ্যে পোড়ানো হোক ৷ কোতল কচ্ছলের অধিকার একমাত্র সুলতানের ৷ তাঁর কাছে এত্তালা গেল ৷ সুলতান ভেবেচিন্তে রায় দিলেন যে, খেলাপ নিশ্চয়ই হয়েছে এবং পুস্তক অচিরে ভস্মসাৎ করা হোক কিন্তু লেখককে পোড়াবার কী দরকার ৷ ওকে বরং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হোক ৷ আর পোড়ানো হোক ওই ধর্মপুস্তকখানি ৷ বাকি যা বই ও লিখেছে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে সেগুলো আর কী পাপ করল ৷ শোনা যায় যে, কয়েক বছর পরে সুলতান ইবন রুশদকে অন্য একটা ভালো কাজ জোগাড় করে দিয়েছিলেন ৷ আইনকানুনও সব শরিয়তি মতে চলে না ৷ বিবাহ, উত্তরাধিকার, সম্পত্তি বণ্টন প্রভৃতি বিষয়ে মুসলিম আইন চালু থাকলেও কেউ যদি সিভিল ল ব্যবহার করতে চায় তাতে আইনত বাধা নেই ৷ ফৌজদারি দণ্ডবিধি আধুনিক নিয়মে চলে ৷ হাত-পা কাটাকাটির ব্যাপার নেই ৷
নতর্কীর নূপুর নিক্কণে আপত্তি না থাকলেও মুসলিম সমাজ আমোদ-প্রমোদকে খুব প্রশ্রয় দেয় না ৷ তবুও মরোক্কানরা গোঁড়া মুসলিম নয় বলে এবং বারবারদের উপজাতীয় প্রভাবের ফলে মেয়ে-পুরুষের মিলিত লোকনৃত্য এবং সঙ্গীত চালু আছে ৷ সিনেমার কথা আগেই বলেছি, কিন্তু সে শহর অঞ্চলে ৷ যাদুবিদ্যা, সাপ খেলানো, জিমন্যাস্টিক্স প্রভৃতি সকল গ্রাম্য মেলাতেই দেখানো হয় ৷ এর ওপর যদি বিদেশী ট্যুরিস্টরা ‘নাইট লাইফ’ চান তাহলে বড় বড় শহরে, কিছু ক্যাবারে ও নাইট ক্লাব আছে, তবে মরোক্কোর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৃত্য বাদ দিলে এগুলো খুব উঁচু দরের নয় ৷
ঝরঝরে সকাল, ঝলমলে সকাল ৷ আল্লা তায়লার কৃপায় সকলের সর্বাঙ্গীণ কুশল, সমস্ত মঙ্গল ৷ হোটেলঘরের সংলগ্ন বারান্দায় পূর্বাস্য হয়ে বসে আছি ৷ হিন্দুর তো সর্বদাই পুবদিক ৷ এখানে মুসলমানও পুবদিকে মক্কার দিকে চেয়ে নামাজ পড়ে ৷ বসে বসে দেখছি প্রায় ২০০ ফুট নিচে ফেজ-এল-বালির ঘেঁসাঘেঁসি ছাদ ৷ একটার সঙ্গে আরেকটা ঠেকে ঢেউখেলানো টালির এক সুবিশাল চত্বর ৷ নিচে নেমে ওর ভেতরে ঢুকলে (যা গতকাল করেছিলাম) দেখা যায় যে দেওয়াল আর ছাদ ঘেঁসাঘেঁসি হলেও মেশামেশি নয় ৷ ওদের মাঝখানে এক গাধাপ্রমাণ পথ আছে ৷ বুঝলেন না তো! দুপাশের বস্তায় মালবোঝাই গাধা যদি দেওয়াল না ছুঁয়ে এগোতে পারে তাহলেই হল ৷ উল্টোমুখি গাধাকে রাস্তা দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে চৌক আছে গলির মোহনায় ৷ গাধাই হল এ গলির একমাত্র গতি ৷ ফেজ-এল-বালি তো ছোটখাটো ব্যাপার নয় ৷ প্রায় তিন লক্ষ লোকের বাস ৷ পুরো শহরের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ ৷ তার ওপরে বহুবিধ হস্তশিল্পের উৎপাদন কেন্দ্র ৷ সোনা, রূপা থেকে শুরু করে পেতল, তামা, চামড়া, কাপড় ব্রোকেড, কার্পেট, জুতো কী নেই বারোশো বছরের এই পুরনো শহরে ৷ এই জনজীবন এবং শিল্পোৎপাদনের জন্য যা কিছু কাঁচা বা পাকা মাল দরকার হয় তার পরিবহন ব্যবস্থা এই সেদিন পর্যন্ত গাধাদের পায়েই ছিল ৷ অধুনা কিছু খচ্চর আমদানি হয়েছে ৷ ফেজ-এল-বালির ভেতরেই ফেজের জগদ্বিখ্যাত স্যুক ৷ আলাদা করে তার কথা বলছি না ৷ মারাকেশের একটি বৃহত্তর সংস্করণ মনে করুন ৷ মারাকেশের সঙ্গে তফাৎ এই যে, ফেজ-এল-বালির চারদিকেই অনুচ্চ পাহাড়ের বেড়া ৷ যেন সমস্ত গোলকধাঁধাটা পাহাড়ের গা কেটে বসানো ৷ তার ভেতরে গলির তস্য গলি ৷ এমন গলির সংখ্যাও কম নয়, যেখানে একজন মানুষকে পাশ ফিরে চলতে হয় ৷
মারাকেশ যদি মরোক্কোর হৃদয় হয়, ফেজ হল তার মন আর বুদ্ধি ৷ ওই যে চত্বরের মাঝখানে পালিশ করা অনেকখানি সবুজ টাইলের ছাদ রোদ্দুরে চমকাচ্ছে, ওটাই হল সুবিশাল কাইরুইন মসজিদ ৷ কাইরুইন থেকে ধর্মগত গোষ্ঠীযুদ্ধে উৎখাত এক ধনী বিধবা তাঁর সমস্ত সম্পদ দিয়ে ৮৬২ সালে এটি তৈরি করেছিলেন ৷ মসজিদের ১৪টি দরজা ৷ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ২২০০০ লোক একসঙ্গে নমাজ পড়তে পারে ৷ অ-মুসলমানের প্রবেশ নিষেধ ৷ পাশেই কাইরুইন বিশ্ববিদ্যালয়, যে একদিন কাইরোর আল অজহরের সঙ্গে পাল্লা দিত ৷ সারা পৃথিবী থেকে ছাত্র আসত কাইরুইন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য ৷ পাঠ্যবিষয় ছিল দর্শনশাস্ত্র (জড়বিজ্ঞান তারই অন্তর্গত), ধর্মতত্ব ইতিহাস সমেত, কোরানিক আইন, গণিত এবং দ্যুলোকবিদ্যা ৷ ইবন রুশদের মতো দার্শনিক, ইবন খালদুনের মতো ঐতিহাসিক এখানে পড়িয়েছেন ৷ ইবন বতুতা এখানে লেখাপড়া শেষ করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন ৷ কাইরুইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা কিন্তু সোজা ছিল না ৷ রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হত ৷ আরেকটা নিয়ম ছিল যে, নিতান্ত মেধাবী না হলে কেবলমাত্র গরিব ছাত্রদেরই আবাসিক ছাত্র হিসেবে নেওয়া হত ৷ বলে রাখি যে, কাইরুইন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক ছাত্রদের ব্যয়ভার সরকার বহন করতেন ৷ কিন্তু যারা খুব মেধাবী বা যথেষ্ট গরিব নয় তারা কী করবে! তারা নিজেদের থাকা-খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা করে দৈনিক ছাত্র হিসেবে পড়ত ৷ কিছু অর্থগ্রাহী আবাসিক মাদ্রাসাও ছিল যেমন আতরাইন মাদ্রাসা ৷ কথাটা এসেছে আতর থেকে ৷ আতর-বিক্রেতাদের অর্থে তৈরি ৷ সুদৃশ্য সমচতুষ্কোণ গহনার বাক্সর মতো কাজ করা ইমারতটি আরবের চেয়েও পারস্যকে বেশি মনে করিয়ে দেয় ৷ ভেতরে অমনিই মিহি কাজ ৷ মাদ্রাসা এখন মিউজিয়াম ৷ অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে ফেজ-এল-বালির প্রতিষ্ঠাতা মৌলে ইদ্রিস ২-এর (এঁদের কথা স্থানান্তরে বলব) অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত সমাধিসৌধ গেটের বাইরে থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে হয় ৷ বিধর্মীর প্রবেশ বারণ ৷ ফেজ-এল-বালির আরেকটি দ্রষ্টব্য বিষয় হল, আগেকার দিনের ফুন্দুক বা দূরাগত বণিকদের আশ্রয়স্থল ৷ বিরাট দু-তিনতলা বাড়িগুলোর মাঝখানটা ফাঁকা ৷ ছাদের তলায় সেখানে থাকবে মাল এবং মালবাহী পশুরা ৷ চারদিকে দেওয়াল ঘেঁসে দুতলা, তিনতলার ঘর বণিকদের জন্য ৷ এখন ফুন্দুকগুলো মাল রাখার কাজেই ব্যবহার হয় ৷ কয়েকটি সুদৃশ্য ফুন্দুককে সাজিয়েগুজিয়ে মরোক্কান রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে ৷ বেশিরভাগই ট্যুরিস্টদের জন্য ৷
ফেজ-এল-বালি, আরব মরোক্কোর প্রাচীনতম রাজধানী ৷ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই এখানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না ৷ অবস্থা দেখে ১২৪৮ সালে মেরিনিড বংশীয় সুলতান আবু ইউসুফ এল-বালির বাইরে এক নতুন শহরের পত্তন করলেন ফেজ-এল-জদিদ ৷ এই নতুন শহর এখন ৭০০ বছরের প্রৌঢ়া রমণী ৷ বয়স হয়েছে তবে পুরনো ফেজের মতো চোখেমুখে বলিরেখা দেখা দেয়নি বা যেটুকু দেখা দিয়েছে সেটুকু ঢেকেঢুকে রাখবার প্রচেষ্টা এখনও আছে ৷ গলিঘুঁজি প্রচুর আবার চওড়া রাস্তাও কিছু আছে যেখানে মোটর চলতে পারে ৷ এরকম এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে চালক বেন শাকুন আমাদের বললেন, তোমরা ঘুরে ঘুরে দেখ, আমি গাড়িটা ওই হোথায় পার্ক করছি ৷ একদিকে আশি হেক্টরব্যাপী রাজপ্রাসাদ ৷ সে এক নগরের ভেতরে নগর ৷ সাধারণের প্রবেশ নিষেধ ৷ অন্যদিকে, মেললা বা ইহুদিদের এলাকা ৷ ক্রিশ্চানদের দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে ইহুদিরা দফায় দফায় মরোক্কোর আরব নৃপতিদের কাছে আশ্রয় চেয়েছে এবং পেয়েছে ৷ মরোক্কোর সব বড় বড় শহরেই তাই একটা করে মেললা গড়ে উঠেছিল ৷ পাশ্চাত্য সভ্যতাদর্পী আজকের ইহুদিরা সে কথা মনে রাখেনি ৷ নিজেদের ছাড়া কার কথাই বা ইহুদিরা ভাবে ৷ ইহুদি এলাকায় এখন আর বড় একটা ইহুদি নেই কিন্তু তাদের উপাসনা মন্দির বা সিনাগগ এখনও দাঁড়িয়ে আছে ৷ মেললার বাড়ির স্থাপত্য পেটা লোহার অলঙ্কৃত বারান্দা, আন্দালুশিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ ফেজের ইহুদিরা প্রধানত এখান থেকেই এসেছিল ৷ মেললা কথাটার উৎপত্তি বড় ভয়ঙ্কর ৷ তখনকার প্রথামতো সুলতান-শত্রুদের খণ্ডিত মস্তক লোহার শিকে বিঁধে প্রাসাদ প্রাচীরের ওপরে প্রদর্শিত হত ৷ তার আগে মস্তকটিকে নুন মাখিয়ে তৈরি করতে হত যাতে তাড়াতাড়ি পচে না যায় ৷ এই কাজটি করত ইহুদিরা ৷ তাদের পাড়ায় বড় বড় নুনের গোলা থাকত এবং ‘মেললা’ এই আরবী কথাটার মানে হল নুন ৷ এখন বুঝতে পারছেন তো যে, কেন ইহুদিদের এলাকাকে মেললা বলা হয় এবং কেনই বা মেললা রাজপ্রসাদের পাঁচিলের কাছাকাছি হত ৷
বিকেলবেলা এক চক্কর ঘুরে এলাম ৷ অন্যান্য নতুন শহরের মতোই ছিমছাম খোলামেলা ৷ দেখবার জিনিস বিশেষ কিছু নেই ৷ একটি সরকারি দোকান আছে আমাদের কটেজ এম্পোরিয়ামের মতো ৷ সেখানে মরোক্কোর বহুবিধ হস্তশিল্প উচিতমূল্যে পাওয়া যায় ৷ এক দাম ৷ দরাদরি নেই ৷ ফিরবার সময় বেন শাকুন আমাদের শহরের অন্যদিক দিয়ে নিয়ে এল যেখানে রইস ব্যক্তিদের বাস ৷ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বিরাট বিরাট বাগানের মধ্যে বাড়ি ৷ বাইরে থেকে বাগানের তরুশীর্ষ এবং পাঁচিলে ওঠানো বোগেনভেলিয়া ছাড়া আর কিছু দেখা না গেলেও মালিকের ঐশ্বর্যের পরিমাপ পাওয়া যায় ৷
ফেজের বাসিন্দাদের (ওরা বাকি মরোক্কো থেকে নিজেদের আলাদা করে ফাসি বলে) বেশ একটু ডাঁট আছে ৷ অতীত গৌরবের জীর্ণাবশেষের মধ্যে যারা বাস করে তারা বোধহয় এইরকমই হয় ৷ ‘আমি কারোর থেকে কম নই’ ৷ আমাদের বন্ধু, প্রদর্শক এবং চালক বেন শাকুন, সেই দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ ৷ অতিথির সুখ-সুবিধার দিকে সর্বদা নজর আছে ৷ অথচ গায়ে লেপ্টে থাকা নেই ৷ মেললা ভ্রমণের পরদিন আমরা সারাদিনের সফর করলাম ৷ ফেজ থেকে ভলিউ ব্লিস ৷ মৌলে ইদ্রিস হয়ে মেকনেস এবং প্রত্যাবর্তন ৷ সবসুদ্ধ ১৫০ কিলোমিটারের মতো ৷ দুপুরের খাওয়ার জন্য বেন শাকুন আমাদের নিয়ে গেলেন মেকনেসের অনতিদূরে নদীর ধারে (এখন জলহীন) এক সুরম্য বাগিচা খানা ঘরে ৷ আমাদের সঙ্গে খেতে বলতে হেসে বললেন যে, ড্রাইভারদের জন্য অতি উত্তম আলাদা খানার বন্দোবস্ত আছে অনেক সস্তায় ৷ আবার সফর সেরে যখন হোটেলে ফিরছি তখন জানালেন যে, আমরা ওঁর বাড়ির প্রায় পাশ দিয়েই যাব ৷ এক কাপ চা খেয়ে গেলে কেমন হয় ৷ গেলাম ৷ বাড়ি মানে ফ্ল্যাট ৷ অনেকটা দিল্লির ডি ডি এ (দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-সরকারি সংস্থা) ফ্ল্যাটের মতো ৷ দুটি শোবার ঘর ৷ বসবার ঘরটি বেশ বড় ৷ আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই কিন্তু আতিথেয়তায় সেটুকু পুষিয়ে যায় ৷ স্ত্রী তুরিয়ার সঙ্গে আলাপ হল ৷ পাঁচ বছরের ছেলে শাফিক টিভি দেখতে ব্যস্ত ৷ তবু এসে আমাদের অভিবাদন করল ৷ বাপের সঙ্গে একটু হুটোপুটি খেলাও হল ৷ মিন্ট চা এল আর ঘরে তৈরি বিস্কুট ৷ চা খেতে খেতে শাকুনসাহেবকে বললাম, বেশ বাড়িটি করেছেন তো ৷ উনি জবাব দিলেন, ‘আমি আবার কবে বাড়ি করলাম ৷ এ তো আমার শ্বশুরের বাড়ি ৷ আমাদের থাকতে দিয়েছেন ৷ মরোক্কোতে কি আমার মতো লোক বাড়ি করতে পারে ৷ পাঁচ থেকে দশ বছরের উপার্জন জড়ো করলে তবে যদি একটা ফ্ল্যাট হয় ৷ ভাড়া করলে মাইনের অর্ধেকের ওপর বাড়ি ভাড়াতেই যাবে ৷’ নিজের দেশের কথা মনে পড়ল ৷ কথায় কথায় জানলাম যে, বেন শাকুন ১৭ বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে ফেজ থেকে প্যারিস যান ৷ সেখানে বহু বছর কাটিয়ে (বোধহয় একটা বিয়েও করেছিলেন) এসে পড়েন ফ্রান্সের পশ্চিমঘেঁসা দক্ষিণ কূলে টুলুসে ৷ ওর শ্বশুর আরবী হলেও টুলুসের অধিবাসী ৷ মোটামুটি সম্পন্ন ব্যবসাদার ৷ টুলুসেই ওঁর আলাপ তুরিয়ার সঙ্গে ৷ তুরিয়ার বয়স মনে হল গোটা পঁচিশ ৷ বেন শাকুন চল্লিশ ছাড়িয়েছেন ৷ একটি ছেলেকে নিয়ে দুজনের সুখের সংসার ৷ আরেকটি আসছে ৷
এদিকের আকাশ থেকে ওদিকের আকাশছোঁয়া শস্যবহুল স্মশ উপত্যকা ৷ তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে ৷ ঝুপিঝুপি অলিভ গাছ ৷ আঙুরের খেত ৷ ফলের বাগান ৷ মাঝে মাাঝে বালিয়াড়ি ৷ নবম বালির পাহাড় ৷ উত্তুঙ্গ নয় ঘোরানো এলানো ৷ এ পাহাড় পুরুষ নয় ৷ রমণী ৷ এলোমেলো শাড়ি পরে রোদ্দুরে বুক দিয়ে শুয়ে আছে ৷ গাড়ি থামল ৷ বড় বড় ঝাঁকায় করে ডালিম বিক্রি হচ্ছে ৷ চিনির মতো মিষ্টি ৷ রসে টইটম্বুর দানাগুলি ৷ বীজ নেই বললেই হয় ৷ বেন শাকুন এক ঝাঁকা কিনলেন ৷ আমরাও একটা করে পেলাম ৷ রাস্তা থেকেই পাহাড় টপকে দেখা গেল উঁচু উঁচু থামের মতো ভলিউ ব্লিস ৷ দুহাজার বছর আগে রোমান মরোক্কোর রাজধানী ছিল ৷ কার্থেজ ধ্বংস হবার পর (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬) এই সমস্ত অঞ্চলটাতে রোমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল ৷ প্রথম একশো বছর রোমানরা স্থানীয় বারবার সর্দারদের মাধ্যমে দেশ শাসন করেছিলেন ৷ কিন্তু নানা ঝামেলার ফলে খ্রিস্টপূর্ব ২৫ সালে রোমানরা তাঁদের ‘আপনজন’ বারবার রাজকুমার জুবা ২-কে মরোক্কোর রাজা করে পাঠালেন ৷ সে কথা আগে বলেছি ৷ ভলিউ ব্লিস হল সেই জুবা ২-এর রাজধানী এবং প্রায় ২০০ বছর রোমানরা এই শহর থেকেই উত্তর আফ্রিকা শাসন করতেন ৷ এখন আর কিছু নেই ৷ শুধু এখানে-ওখানে ছড়ানো কতকগুলো ছাদহীন আয়োনিক কলাম ৷ একটু উঁচুতে পাথর বাঁধানো ফোরামের মেঝে ৷ একদিকে কিছুটা দেওয়াল ৷ শহরে ঢোকবার মুখে বিরাট ট্রায়ম্ভাল আর্চ এখনও দাঁড়িয়ে আছে ৷ সারা শহরে ছড়ানো পাথরের স্তূপ, ভাঙা বনেদ ৷ ছাদহীন দেওয়াল, বড় বড় স্নানের ঘর এবং তাতে গরম ও ঠান্ডা জল আনবার আলাদা পয়ঃপ্রণালী ৷ সবচেয়ে মজা লাগল রান্নাঘরে উনুনের বালিমাখা দেওয়ালে একটি ছোট কুলুঙ্গি ৷ রাঁধুনি তার অলিভ তেলের ল্যাম্পটি ওইখানে রাখত ৷ রইস ব্যক্তিদের বাড়ির মেঝেতে সেই দুহাজার বছরের পুরনো মোজাইকে কতরকম ছবি ৷ পুরনো গ্রিসের সুরগুরু অর্ফিয়াস বীণায় ঝংকার তুলছেন আর তাঁকে চক্রাকারে ঘিরে বনের পশুরা সেই সুরলহরী শুনছে ৷ জিয়াস পুত্র ব্যাকাস (ইনি আবার সুরার দেবতা) বাঘের রথে চড়ে বেড়াতে যাচ্ছেন ৷ আলো এবং তারুণ্যের দেবী ডায়ানা স্নানকক্ষে অসম্বৃতা অবস্থায় একটিয়নের (রোমানদের ডায়ানা হল গ্রিকদের আটেমিস ৷ গ্রিক পুরাণে বলে যে, দেবী আটেমিস যখন ঝরনার জলে স্নান করছিলেন তখন আধা-মানুষ আধা-দেবতা একটিয়ন সেই বনে শিকার করতে এসে তাঁকে দেখে ফেলে ৷ দেবী রেগেমেগে একটিয়নকে মৃগে রূপান্তরিত করেন আর একটিয়নের পঞ্চাশটি শিকারী কুকুর তাকে খেয়ে ফেলে ৷ আমাদের দেবীরা এতটা কাঁচাখেগো নন ৷) নজরে পড়ে গেছেন ইত্যাদি ৷ কবেকার রঙিন সিরামিকের টুকরোগুলি এখনও অপেক্ষাকৃত অম্লান, কিন্তু এদের বরাবরের জন্য রক্ষা করতে হলে কোনও বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে ৷ তবু ভলিউ ব্লিসের প্রধান পথ ডেকুমানুস ম্যাক্সিমাসের (দিল্লির রাজপথের মতোই তীরের মতো সোজা রাস্তা ট্রায়ম্ভাল আর্চ থেকে ফোরাম পর্যন্ত কমবেশি ৫০০ মিটার) ওপর দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ভাবা যায় সেদিনকার সেই সমারোহ, জাঁকজমকপূর্ণ শহর, যার লোকসংখ্যা কুড়ি হাজারে পৌঁছেছিল ৷ ইদানীংকালে ভলিউ ব্লিসের আরেকটা সুদিন এসেছিল যখন ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে মরোক্কোর প্রথম আরব সুলতান মৌলে ইদ্রিস (১) এখানে রাজধানী করেছিলেন ৷ সে কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের জন্য ৷ মৌলে ইদ্রিসের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মৌলে ইদ্রিস (২) রাজধানী ফেজে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ৷
ভলিউ ব্লিস থেকে মৌলে ইদ্রিস মোটে পাঁচ কিলোমিটার ৷ ইতিমধ্যে স্যুশ উপত্যকা থেকে জরহুন পর্বতপুঞ্জ বেয়ে আমরা অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি ৷ জরহুন যেখানে বুফক্রেন নদীর উপত্যকায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেই পর্বতপ্রপাতের খাঁজে খাঁজে সার দিয়ে নেমে এসেছে চুনকাম করা সাদা বাড়িগুলো ৷ পবিত্র মৌলে ইদ্রিস ৷ শহরের মাঝখানে চমকানো সবুজ টাইলের নিচে মৌলে ইদ্রিসের সমাধি এবং মসজিদ ৷ মহম্মদের বংশগত মৌলে ইদ্রিস বোগদাদের খালিফার সঙ্গে ধর্মগত মতানৈক্যের দরুন পৃথিবীর শেষ প্রান্ত এই মরোক্কোতে চলে আসেন কয়েকটি বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে ৷ তাঁর মধুর মূর্তি, সদয় ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে, দেশজ বারবাররা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মুসলমান হল এবং ক্রমে তাঁকে রাজপদে অভিষিক্ত করল ৷ মৌলে ইদ্রিসের প্রভাব-প্রতিপত্তির খবর যখন বোগদাদে পৌঁছল তখন খলিফ একজন গুপ্তঘাতককে মরোক্কো পাঠালেন মৌলে ইদ্রিসের প্রাণ নেবার জন্য ৷ ঘাতক ইদ্রিসের সভাসদ হিসাবে তাঁর বিশ্বাস অর্জন করে বিষপ্রয়োগে তাঁকে বধ করল ৷ এই খলিফটি আর কেউ নয় ৷ আমাদের বিশেষ পরিচিত এবং বিশ্ববিশ্রুত হারুন আল রশিদ ৷ মৌলে ইদ্রিসের সমাধিস্থানে পৌঁছলাম ঠিক বেলা বারোটার সময়ে ৷ বিরাট কারুকার্যমণ্ডিত দরজা পেরিয়ে একটা কাঠের পাটা ফেলা যার ওপারে অ-মুসলমানরা ঢুকতে পারে না ৷ সেইখানে দাঁড়িয়ে স্মরণ করলাম হাস্যমুখ প্রসন্ন প্রেমী মানুষটিকে, যিনি ভালোবাসার অস্ত্রে বন্য বারবারদের হৃদয় জয় করেছিলেন ৷ মসজিদের সুউচ্চ মিনার থেকে তখন আজান ঘোষণা হচ্ছে ৷ দ্বিপ্রাহরিক নমাজের জন্য ৷ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ৷ মৌলে ইদ্রিস বেশিদিন রাজত্ব ভোগ করেননি ৷ তাঁর মৃত্যুর পরে বারবার পত্নীর গর্ভে এক পুত্রসন্তান জন্মাল ৷ সময়ে তিনিই হলেন দ্বিতীয় সুলতান মৌলে ইদ্রিস ৷ মসোলিয়ামের বাইরে আর পাঁচটা পুরনো ধর্মীয় শহর যেমন হয় মৌলে ইদ্রিসও তাই ৷ তীর্থযাত্রীই প্রধান জীবিকা ৷ মেকনেসের পথে বাইরের ট্যুরিস্টও কিছু আসে ৷ গৃহিণী এখানে একটা কারুকার্য করা চশমার খাপ কিনলেন ৷ একটা জিনিস লক্ষ করলাম ৷ দরদাম এখানকার দোকানিও করে কিন্তু শহরের মতো উনোকে দুনো করে না ৷
মেকনেস বলতে মনে পড়ে একজন লোককে ৷ সুলতান মৌলে ইসমাইল যিনি একাদিক্রমে পঞ্চান্ন বছর (১৬৭২ থেকে ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্ব করেছিলেন ৷ মারাকেশের সাদীয়ান সমাধি প্রসঙ্গে এঁর উল্লেখ করেছি ৷ যেমন বিরাট চেহারা ছিল তাঁর, তেমনই বিরাট ছিল তার পরিকল্পনা ৷ ভার্সাই ও ফরাসি হর্ম্যমালার গল্প শুনে তিনি তৈরি করেছিলেন দার কেবিরা ৷ বাগান, চন্দ্রাতপ জলধার জলপ্রবাহ সমন্বিত চব্বিশটি প্রাসাদের এক বেষ্টনী ৷ সেসব এখন ধ্বংসস্তূপ কিন্তু তাঁর নিজ প্রাসাদ চত্বরে ঢোকার জন্য যে সুবিশাল গেট বাব-এল-মনসুর তা এখনও অক্ষত আছে ৷ আর আছে মোটা মোটা চৌরস থাম আর খিলানের তিন মানুষ উঁচু ছাদের তলায় মৌলে ইসমাইলের ঘোড়াশালা ৷ ১২০০০ ঘোড়া এখানে থাকত ৷ কালো প্যান্টের ওপরে গুলবাঘা ছাপের জামা পরা যে দশাশই মূর্তিটি আমাদের ঘোড়াশালা দেখাল তাকে এমনি রাস্তায় দেখলে সসম্মানে সরে দাঁড়ানোই যুক্তিযুক্ত হবে কিন্তু আসলে বেশ বশংবদ লোক ৷ ঘোড়াশালের মাঝে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটি গভীর কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে ৷ সে মেঝে থেকে একমুঠো কাঁকর নিয়ে কুয়োর ভেতরে ফেলল ৷ টগবগ আওয়াজ হল, ঠিক যেন একদল ঘোড়া ঘোড়াশালে ঢুকল ৷ সেই আমাদের বলল যে, ঘোড়াশালের শেষে ছাদের সঙ্গে লাগানো একটি বিরাট ট্যাঙ্ক (টালার ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বড়) আছে ৷ তার জল ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী দিয়ে ঘোড়াদের খাবার জন্য যেত ৷ কুয়োগুলো জলটাকে বাতাসের সংস্পর্শে রাখার জন্য ৷ ট্যাঙ্কটাও আমরা দেখলাম ৷ স্বতঃস্ফূর্ত ঝরনা থেকে তার জল আসে ৷ চারদিকে ফুলের বাগান ৷ এখন অনাদৃত ৷ অথচ এক সময়ে সবার অলক্ষ্যে এই ফুলবাগানে বেড়াতে যাবার জন্য মৌলে ইসমাইল দেওয়ালঘেরা বৃক্ষলতাশোভিত একটি অলিন্দ তৈরি করেছিলেন যার দৈর্ঘ্য ছিল তিন কিলোমিটার ৷ সে অলিন্দের কিছুটা এখনও আছে ৷ মৌলে ইসমাইল বলেছিলেন, আর কী? এই অলিন্দটাকে মারাকেশ পর্যন্ত (৭০০ কিলোমিটার) বাড়িয়ে দেব যাতে অন্ধরাও বিনা ক্লেশে মারাকেশে যেতে পারে ৷ অলিন্দটি তৈরি হয়নি বটে কিন্তু মৌলে ইদ্রিসের রাজত্বের শেষভাগে অন্ধ-আতুর-স্ত্রীলোক সবাই মরোক্কোর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিনা দ্বিধায় যাতায়াত করতে পারত ৷ এমনই ছিল মৌলে ইসমাইলের দাপট ৷ পূর্বে অটোমান তুর্কদের মওড়া নিলেন তিনি ৷ ট্যানজিয়ারস থেকে তাড়ালেন ইংরেজদের ৷ আসিলা থেকে হটালেন স্প্যানিয়ার্ডদের ৷ আসমুদ্র আটলাসকে এক সার্বভৌম রাজত্বে পরিণত করেছিলেন তিনি ৷ লোকে নিন্দাও প্রচুর করে ৷ বলে, সুলতান নিষ্ঠুর যথেচ্ছাচারী ছিলেন ৷ তাঁর পত্নী এবং উপপত্নীর সংখ্যা নাকি চার শতাধিক ছিল ৷ সহস্রাধিক সন্তানের জনক ছিলেন ৷ কিন্তু তার এসব ক্রিয়াকলাপের বিচার তখনকার রীতিনীতি মনন অনুযায়ী করতে হবে ৷ তাঁর সমসাময়িক চতুর্দশ লুই মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করেছেন ৷ আর রমণী বিলাস তো রাজাদের ভূষণ ছিল ৷ অন্যদিকে, মৌলে ইসমাইল নিজে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও ক্রিশ্চান যুদ্ধবন্দীদের পাদ্রী সন্দর্শনে বাধা দিতেন না ৷ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন তিনি ৷ তাঁর ঘোড়াশালে যে শুধু ১২০০০ ঘোড়া ছিল, তা নয় ৷ ১২০০০ পুস্তকসমন্বিত একটি পুস্তকশালাও তাঁর ছিল ৷ মৌলে ইসমাইল সম্বন্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর ছিদ্রান্বেষী কপটভাষী পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের বিবরণ পড়লে মনে হয় ‘বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলে করে পরিহাস অট্টহাস্য রবে/তব পুণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস এই জানে সবে ৷’
বাব-এল-মনসুর দিয়ে ঢুকলেই পড়বে মেচুয়ার প্যারেড গ্রাইন্ড ৷ এখানে সুলতান ইসমাইল তাঁর পার্শ্বরক্ষীদের পরিদর্শন করতেন ৷ ১৪০০০০ সেনার এই বাহিনীতে ৷ কেবলমাত্র আটলাস পারের কালো মানুষদের নেওয়া হত ৷ সুলতান বোধহয় কাছের মানুষদের অতটা বিশ্বাস করতে পারতেন না ৷ দুদিকের দোকান এবং কাফিখানার চাপে স্কোয়্যারটি এখন বেশ ছোট হয়ে এসেছে ৷ তবুও আমাদের এসপ্ল্যানেডের চারগুণ হবে এবং অনেক খোলামেলা ৷ পার্কিং লট, ফুড স্টল, নানারকম শহুরে আয়োজন ৷ মেচুয়ারের অন্য প্রান্তে সবুজ টালির ছাতওয়ালা কোনাচে বাড়িটা ছিল সুলতানের দেওয়ানি আম ৷ সিংহাসনে বসে তিনি দেশ-বিদেশের লোককে দর্শন দিতেন বা স্বাগত জানাতেন ৷ এর পরেই কতকগুলো ভূগর্ভস্থ কক্ষ আছে ৷ পাশ্চাত্য ভ্রমণকারীরা একসময় বলতেন যে, এগুলো ছিল সুলতানের ঠান্ডি গারদ ৷ ক্রিশ্চানদের জন্য ৷ এখন বোঝা যাচ্ছে তা নয় ৷ এগুলো সুলতানের শস্যাগার ৷ প্রত্যেকটি ঘরের ছাদের কাছে বাইরের চত্বরের সঙ্গে এক লেভেলে হেলান ফোকর কাটা আছে যা দিয়ে শস্য ভরা হত ৷ মেচুয়ারের আরেক পাশে সুলতান মৌলে ইসমাইলের সমাধি ৷ এই একটি জায়গায় অ-মুসলমানরাও ঢুকতে পারে যদি তার পোশাক সহবত অনুযায়ী হয় ৷ সে সহবতের বিচার করেন সমাধিদুয়ারে প্রহরীরা ৷ এইজন্য মাঝে মাঝে দেখা যায়, হাফপ্যান্ট পরা মেমসাহেব বা গেঞ্জি পরা সাহেব একাকিনী বা একাকী দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন ৷ দল ভেতরে গেছে কিন্তু প্রহরী তাদের আটকে দিয়েছে ৷ আমাদের ভাগ্য ভালো ৷ দুজনেই ঢুকলাম ৷ মার্বেল, প্লাস্টার, মোজাইক, টাইল সিডার কাঠের জমাটি আসর ৷ প্রধান কবরটিতে আছেন মৌলে ইসমাইল স্বয়ং ৷ তাঁর প্রধানা পত্নী এবং দুই ছেলে ৷ দুই কোনায় রয়েছে দুইটি পিতামহ ঘড়ি, যে দুটি ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই মৌলে ইসমাইলকে উপহার দেন ৷ ঘড়ি দুটি এখনও চলছে ৷ বইতে পড়েছিলাম যে সমাধির বাইরের প্রাঙ্গণে একটি সূর্যঘড়ি আজও অভ্রান্ত সময় দেখিয়ে যাচ্ছে ৷ কিন্তু সেটির খোঁজখবর পেলাম না ৷
মৌলে ইসমাইলের ইম্পিরিয়াল সিটির বাইরে আছে মেকনেসের পুরনো শহর মেদিনা এবং তার অন্তর্গত স্যুক ৷ ফরাসিদের তৈরি নয়ানগরও আছে ৷ কিন্তু সময়াভাবে সেগুলো আর দেখা হল না ৷ অবশ্য মারাকেশ এবং ফেজের পরে মেকনেসের মেদিনা বা নয়ানগরে নতুন কিছু দেখবার আশা করিনি ৷ ইতিহাস ছাড়াও মেকনেসের আরেকটা পরিচয় আছে ৷ স্যুশ উপত্যকার কৃষি সম্পদ এই মেকনেস বাজার হয়েই আনাগোনা করে ৷
শহর থেকে বেরোতে সিদি মহম্মদ ইবন আইসা সাহেবের দরগা ৷ পুরনো কবরখানার মধ্যে ৷ পীর মারা যান ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু তাঁর চেলাচামুণ্ডা বেড়েই চলেছে ৷ সুফি শ্রেণীভুক্ত এই সাধক সম্প্রদায় ঐহিক সুখাকাঙ্ক্ষাকে ঘৃণা করেন ৷ আত্মনিপীড়নেই এঁদের আগ্রহ ৷ খাদ্যাখাদ্য বিচার নেই ৷ এঁদের গুরু কণ্টক কঙ্করশয্যায় শুতেন ৷ পোকামাকড় এমনকী সাপ-ব্যাঙ-বিছে ধরে ধরে খেতেন ৷ গুরুর অনুকরণে এখনও এঁদের কেউ কেউ দরগার ফাটল থেকে কাঁকড়াবিছে ধরে খান ৷ পীরের কৃপায় দরগাতে কখনও কাঁকড়াবিছের অভাব হয়নি ৷ বেন শাকুন বললেন যে, আমরা দরগাটা দেখতে চাই কিনা ৷ গৃহিণী ঘন ঘন ঘাড় নাড়লেন ৷
ফেজের শেষদিনটি বেন শাকুনের গাড়ি চড়ে মিডল আটলাস বেড়াতে যাব ঠিক করা ছিল ৷ গৃহিণীর শরীরটা সেদিন পাথর-পাথর অথচ বেন শাকুন সাহেবের দিনটাও নষ্ট করা যায় না ৷ একাই রওনা দিলাম ৷ বেন শাকুন আমার একাকীত্ব দেখে তাঁর এক ইংরিজি জানা বন্ধুকে নিজের পাশে বসিয়ে নিলেন ৷ ‘ওকে কিছু দিতে হবে না ৷ ওর আজ অফিস ছুটি ৷ এমনি আমাদের সঙ্গে বেড়িয়ে আসবে ৷’ বন্ধু বেন শাকুনের পাশে বসে বোতলের পর বোতল বিয়ার খেতে লাগলেন ৷ ছুটির দিন ৷ তবে আমিও তাঁর কাছে মরোক্কো সম্বন্ধে অনেক কথা জানলাম ৷ বেন শাকুন যুবাকালে প্রচুর মদ্যপান করেছেন ৷ এখন আর খান না ৷ মিডল আটলাস দেখার ইচ্ছা আমার খুব ছিল, কিন্তু সময়টা অনুকূল ছিল না ৷ লোকে এসব জায়গায় আসে এক গরমকালে, ঠান্ডা হবার জন্য অথবা শীতকালে স্কি খেলবার জন্য ৷ অক্টোবর মাসে গ্রীষ্মতাড়িতরা নেমে গেছেন এবং স্কি-পীড়িতরা উঠে আসেননি ৷ সর্বত্রই ভাঙা হাট ৷ গৃহিণী না এসে ভালোই করেছেন ৷ তবু যা দেখলাম তাই বলি, ফেজ, সেফরু, ইমমুজের, ইরফান, আজরু ৷ পুরো চক্করটা ওই ১৫০ কিলোমিটারের মতো ৷ সেফরু গ্রাম পাহাড়ে ওঠবার আগেই একটি জলপ্রপাত আছে ৷ গাঁয়ের ঝরনাটি পাহাড়ের ধার থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ছে ৷ নিতান্ত আটপৌরে ব্যাপার, কিন্তু লক্ষ করতে হয় ঝরনার দুধারে প্রাকৃতিক গুহাগুলো ৷ ঘর ৷ ঘরের ভেতর ঘর ৷ স্পেনে এইরকম গুহায় আমি জিপসিদের বসবাস করতে দেখেছি ৷ গ্রিসে পার্থেননের তলায় এরকম গুহাবাস আছে ৷ সেফরুর গুহাগুলিতে কেউ থাকে না তবে পিকনিক করার চিহ্ন আছে ৷ গরমকালে সেফরু জলপ্রপাত ঘিরে মেলা বসে ৷ এখন জলপ্রপাতের ধারা যেখানে তোড়ে মোড় ঘুরছে, সেখানে একা একটি যুবক খরধার স্রোতের দিকে তাকিয়ে বসে আছে ৷ তারপরেই ছোট একটি গ্রাম ভালিল ৷ সকালবেলা গ্রামের লোকেরা যে যার ধান্দায় ব্যস্ত ৷ ওপর থেকে পাহাড় কেটে জল নিয়ে আসা হয়েছে, সেই জল রাস্তার দুধার দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ৷ খাও ৷ রান্না কর ৷ কাপড় কাচ ৷ বাগানে দাও যার যা খুশি ৷ জল নারায়ণ ৷ জলই জীবন ৷ গাড়ি পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে ৷ দুদিকে জঙ্গল ৷ অলিভ, অরেঞ্জ, আঙুরের বদলে সিডার চিনার নানারকম চওড়া পাতার জঙ্গুলে গাছ ৷ আরও ওপরে পাইন, ফার, বারচ ৷ গাড়ি ঘুরে ঘুরে উঠছে ৷ উল্টোদিক থেকে একখানা গাড়ি নিশান উড়িয়ে বেরিয়ে গেল ৷ ইরফানের রাজপ্রাসাদের গাড়ি ৷ বেন শাকুন আর তার বন্ধু দুজনই মাথানিচু করল ৷ এখনকার রাজা হাসান (২) এবং তাঁর বাবা মোহাম্মেদ (৫)-কে মরোক্কোবাসীরা সত্যিই শ্রদ্ধা করে ৷ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ফরাসিরা বারবার সে শ্রদ্ধার আসন টলাতে চেয়েছে ৷ পর্বতবাসী বারবারদের সমতলস্থ রাজার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে ৷ কিন্তু সফলকাম হয়নি ৷ হায়, সোনার অখণ্ড ভারত ৷ এই তো সেদিন ১৯৫৫ সালে ফরাসিদের চক্রান্তে নির্বাসিত রাজা মোহাম্মদ (৫)-কে যখন ফরাসিরাই ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হল রাজ্যভার নেবার জন্য, তখন প্যারিসের হোটেলে বিদ্রোহী বারবার নেতা মারাকেশের পাশ থামি এল গ্রাই রাজার মাটিতে লোটান গাত্রাবরণ চুম্বন করে ক্ষমা চেয়েছিল ৷ রাজা তাকে সসম্মানে উঠিয়ে বললেন, ‘অতীতের কথা আমায় বোলো না ৷ আসল কথা হল ভবিষ্যৎ ৷ তুমি ভবিষ্যতে কি করবে তাই দিয়েই তোমার বিচার হবে ৷’
ইমমুজের পৌঁছে গেলাম, ৪৪৬৫ ফুট ৷ শীতকালে প্রায়ই বরফ পড়ে তবে স্কি খেলার পক্ষে যথেষ্ট নয় ৷ একদম দেশী শহর ৷ লোকসংখ্যা ১৩২০০০ ৷ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া চলছে ৷ দোকানিরা জিনিসপত্র বাইরে থেকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে ৷ কাফিখানার সামনের ফুটপাথ ফাঁকা ৷ কাচের শার্সির পিছনে ঢাকা বারান্দায় বসে কয়েকজন ছাড়া ছাড়া লোক চা বা কফি খাচ্ছে ৷ দ্রুতবেগে খসে পড়ছে গাছের পাতা ৷ চারদিকে কেমন যেন একটা ত্রস্ত উৎকণ্ঠিত ভাব ৷ শীত আসছে ৷ ইমমুজেরের পরে ইরফান ৷ ৫৩১২ ফুট ৷ সুলতান হাসান (২) এবং মরোক্কোর বহু ধনী-মানী লোকের গ্রীষ্মাবাস ৷ সুইস শ্যালে ৷ ফ্রেঞ্চ শ্যাতো ৷ জার্মান ক্যাসলের ছড়াছড়ি ৷ ঠিক যেন আরব্য রজনীর কোনও দৈত্য সুইস আল্পস থেকে একটা শহরকে তুলে এনে মরোক্কোর পাহাড়ে বসিয়ে দিয়েছে ৷ তেমনই নির্মল, নির্ভেজাল, নৈর্ব্যক্তিক ৷ কিন্তু খাই কোথায় ৷ রাস্তার ওপর কোনও চৌক বা বাজার দেখলাম না ৷ পাঁচতারা হোটেল মিশলিফেনের খানা কামরা আড়াইশো চেয়ার-টেবিল, ছুরি, কাঁটা, প্লেট, ন্যাপকিন দিয়ে সুচারুরূপে সজ্জিত, কিন্তু একটা লোক নেই ৷ বেন শাকুন নিয়ে গেলেন নিচের একটা রেস্টুরেন্টে, যেখানে ইরফানের বাসিন্দারাও খায় ৷ সেখানে এই বেলা বারোটার সময় চেয়ারগুলো সব টেবিলের ওপর তোলা ৷ মুশকিল ৷ চলো পরের শহর আজরু সেখানে প্যানোরোমা হোটেল সারা বছর খোলা থাকে ৷ ওখানে খেয়ে ফিরব ৷ আজরুতে দেখার কিছু নেই ৷ তবে জায়গাটি মনোরম বলে যাত্রীরা কয়েকদিনের জন্য থাকতে আসে ৷ বেশ কয়েকটি অল্পমূল্যের হোটেল আছে ৷ আর আছে উটজ শিল্পীদের পরিচালিত একটি শিল্পাগার, যেখানে বারবার নির্মিত নানারূপ কারুকৃতি কিনতে পাওয়া যায় ৷ এছাড়া আজরু উত্তর মরোক্কো থেকে দক্ষিণে যাবার দুটি প্রধান রাস্তার মোহনায় ৷ নিকটেই আজরু পর্বতশিখরের মাথায় মৌলে ইসমাইল একটি দুর্গ বানিয়েছিলেন ৷ স্বার্থবাহ বণিকদের ওপর নজর রাখবার জন্য ৷ ফেরবার পথে ইমমুজেরের আট কিলোমিটার দক্ষিণে ‘শ্যালে (CHALET) দ্যু লাক’ হোটেলে চা খেলাম ৷ লাক অর্থে এখানকার বিস্তৃত অগভীর লেকটি যাঁকে সম্পূর্ণ ঘুরে এলে ষাট কিলোমিটার বেড় পড়ে ৷ বাড়ি এসে শুনলাম, গৃহিণী সারাদিন সুইমিং পুলের ধারে বসে এবং শুয়ে বই পড়েছেন ৷ এখন শরীর-মন দুই-ই প্রসন্ন ৷ ভালো ৷ তস্মিনতুষ্টে জগৎ তুষ্ট ৷
মরোক্কোর পালা শেষ হচ্ছে ৷ আর দুঘণ্টার মধ্যে ফেজ থেকে উড়ে যাব প্যারিস ৷ আড়াই ঘণ্টার রাস্তা ৷ হস্টেলের বারান্দায় বসে কদিনের কথা ভাবছি ৷ নিচে ফেজ-এল-বালির দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ৷ কাইরুইন মসজিদের সবুজ টালির ছাদ রোদে চমকাচ্ছে ৷ মারাকেশের জেমা-এল-ফন ৷ কুতুবিয়া মিনারের নিঃশব্দ অঙ্গুলি সংকেত ৷ আহমেদ আল মনসুরের সুরভিত মন্দির ৷ ভলিউ ব্লিস ৷ গ্রাম ছাড়া তালগাছের মতো আকাশমুখো থামগুলো ৷ মৌলে ইদ্রিসের প্রসন্ন প্রশান্তি ৷ মেকনেস ৷ বাব-এল-মনসুর ৷ আবেষ্টনী প্রাচীরের ভ্রূকুটি কুটিল ভঙ্গি ৷ কিন্তু সবার ওপরে মানুষ সত্য ৷ বেন শাকুন আর তাঁর সংসার ৷ মারাকেশের গাইড আহমদ ৷ বৃত্তির অভাবে সে বিয়ে করতে পারছে না ৷ ‘আমি ইংরিজি-ফরাসি দুটো ভাষায় গ্র্যাজুয়েট, কিন্তু একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছি না ৷ এই গাইডের কাজে কি চলে ৷ আমার বাকদত্তাও কাজ করে ৷ অফিসে স্বাগতভাষিণী ৷ কিন্তু আমার একটা নিয়মিত উপার্জন না হলে… ৷’ মরোক্কোতে খাবার-পরবার অভাব না থাকলেও বেকার সমস্যা কঠিন ৷ শহরে শিক্ষিত বেকার শতকরা কুড়িজন ৷ মনে পড়ছে সেই বুৎ পালিশ ছোকরাকে যে ভারতে গিয়ে ভারতীয় মেয়ে বিয়ে করবে ৷ সেফরুতে সকল লোকচক্ষের আড়ালে ঝরনার জলের দিকে চেয়ে যে ছেলেটি বসেছিল ৷ মারাকেশের সেই কালো কোলো ভেন্ডার ৷ কাগজ মুড়ে বাদামভাজা দিতে দিতে বলেছিল, ‘এই তো আমার আটাশ নম্বর স্টল ৷ আবার এসো’ ৷ আর যাওয়া হয়নি ৷ আজরুর সেই দীনতা নম্র ওয়েটারটি যত্ন করে খাওয়াল আমাকে ৷ সদা হাস্যমুখ আজিজ ৷ মরোক্কোতে আমাদের প্রথম বন্ধু ৷ সব মনে আছে ৷ সব মনে থাকবে ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন