সতীশচন্দ্র মিত্র
আমরা পূর্ব্বে দেখিয়াছি, ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা টোডরমল্ল মোগলাধিকৃত বঙ্গরাজ্যের হিসাব প্রস্তুত করিয়া এবং শাসনের কতক ব্যবস্থা করিয়া এ দেশ হইতে চলিয়া যান। তিনি আর কখন বঙ্গদেশ শাসন করিতে আসেন নাই। বঙ্গের বিদ্রোহ কিন্তু তাঁহার যাওয়ার পর শান্ত হয় নাই। এই বিদ্রোহ- বহ্নি বহুস্থানে নানা আকারে বহুকাল পর্য্যন্ত জ্বলিয়াছিল, ইহার প্রশমন করিবার জন্য শাসনকৰ্ত্তাদিগকে বহুকাল ধরিয়া বিড়ম্বিত হইতে হইয়াছিল। বঙ্গের রাজনৈতিক আকাশের সে অবস্থা আমরা পূর্ব্বে বর্ণনা করিয়াছি।
টোডরমল্লের পর আকবর আর একজন প্রধান সেনাপতিকে বঙ্গে পাঠাইয়া দেন। ইঁহার নাম মীর্জা আজিজ কোকা; ইনি বাদশাহের ধাত্রীপুত্র; সুতরাং ইঁহার প্রতি তিনি আজীবন বিশেষ সদয় ও স্নেহযুক্ত ছিলেন।[১] বঙ্গে আসিবার কালে ইঁনি পাঁচ-হাজারী মন্সবদার পদে উন্নীত হন, তখন ইঁহার নাম হয় খান্-ই-আজম্। সাধারণতঃ ইঁহাকে আজম্ খাঁ-ই বলা হয়। আজম্ খাঁ এক বৎসরের কিছু অধিক কাল বঙ্গে ছিলেন। ইঁহার আগমনের প্রাক্কালে প্রতাপাদিত্য নিজ নামে যশোহর-রাজ্যের সনন্দ লইয়া দেশে ফিরিয়াছিলেন। ঘটককারিকা হইতে জানিতে পারা যায় যে, এই খাঁ আজমের সহিত প্রতাপাদিত্যের প্রথম সংঘর্ষ হয়।[২] এ কথা বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া বোধ হয় না। কারণ এই সময়ে প্রতাপাদিত্য পিতার মৃত্যু, রাজ্যের বিভাগ, নূতন রাজধানী প্রতিষ্ঠা, সৈন্যগঠন ও অন্যান্য ব্যাপারে এরূপভাবে লিপ্ত ছিলেন যে, প্রথম কয়েক বৎসরের মধ্যে তিনি মোগলের বিরুদ্ধাচারণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না।
ভবেশ্বর রায় নামক একজন ক্ষত্রিয় সেনানী খাঁন আজমের কর্ম্মচারী ছিলেন। ইনি চাঁচড়া রাজবংশের আদি পুরুষ। উক্ত রাজ পরিবারের বংশগত প্রবাদ[৩] হইতে জানা যায়, ভবেশ্বর রায় খাঁ আজমের নিকট সৈয়দপুর, ইমাদপুর, মুড়াগাছা ও মল্লিকপুর, এই চারি পরগণার সনন্দ পাইয়াছিলেন (১৫৮৪) এবং এই সম্পত্তি তিনি মৃত্যুকাল পর্যন্ত ভোগ করেন (১৫৮৮)। কেহ কেহ বলিয়াছেন, খাঁ আজম্ এই চারিটি পরগণা প্রতাপের রাজ্য হইতে বাহির করিয়া ভবেশ্বরকে প্রদান করেন।[৪] প্রতাপের সহিত যে আজমের বিরোধ হইয়াছিল এই ঘটনা হইতে তাহা অনুমিত হইতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তাহা নহে। কবিরাম কৃত ‘দ্বিগ্বিজয়-প্রকাশ’ হইতে জানিতে পারি, ভদ্রতীরবর্ত্তী কেশবপুরই প্রতাপের যশোর-রাজ্যের উত্তর সীমা ছিল। উক্ত চারটি পরগণাই ভদ্রনদীর অপর পারে, কেশবপুরের উত্তরাংশে বর্ত্তমান যশোর সহরের পার্শ্বে অবস্থিত। সুতরাং উক্ত পরগণাগুলি প্রতাপাদিত্যের সনন্দের অন্তর্ভুক্ত ছিল না; এবং তাহা ভবেশ্বরকে প্রদান করা হইলে প্রতাপের প্রকাশ্যে আপত্তি করিবার কিছু ছিল না। সে সব পরগণার উপর তাঁহার লোলুপ দৃষ্টি থাকিতে পারে, কিন্তু তখন তিনি এমন ভাবে নিজের রাজ্য-ব্যবস্থা লইয়া ব্যস্ত যে, এই কয়েকটি ক্ষুদ্র পরগণার জন্য অপ্রস্তুত অবস্থায় মোগলের সহিত বিরোধ করিতে আসা তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয় না। অপর পক্ষে, বিদ্রোহ দমন করিতেই আজমের আগমন; অথচ তিনি প্রতাপের পথ আগুলিয়া অস্বাস্থ্যকর নিম্নবঙ্গে বসিয়া থাকিতে পারেন না। সুতরাং তিনি প্রতাপের মত দুর্দান্ত জমিদারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য ভবেশ্বরকে থানাদার করিয়া, যশোর-রাজ্যের ঠিক উত্তর সীমায় ছাউনি করিয়া থাকিতে আদেশ দিলেন এবং সৈন্যবর্গের ব্যয় নির্ব্বাহের জায়গীর স্বরূপ উক্ত চারি পরগণার সনন্দ দিলেন। কেশবপুরের নিকট ভদ্রনদীর অপর পারে যেখানে ভবেশ্বরের প্রথম ছাউনি হয়, সেখানে হাট বসিল; ভবেশ্বরের নামে হাটের নাম হইল ভবহাটি এবং দুই মাইল উত্তরে যেখানে মাটীর গড় করিয়া ভবেশ্বর প্রথম আবাসস্থান স্থাপন করিলেন, তাহারই নাম হইল মূলগ্রাম।[৫] ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ভবেশ্বরের মৃত্যু হয়। তাহার পর উক্ত পরগণাগুলি তৎপুত্র মহতাবরাম রায়ের হস্তগত হয়। সম্ভবতঃ তিনি প্রতাপাদিত্যের সহিত সদ্ভাব স্থাপন করিয়া চলিতেন।
রামরাম বসু বলেন, বাদশাহ আকবর সর্ব্বপ্রথম আবরাম খাঁকে প্রতাপের বিরুদ্ধে পাঠান এবং তিনি সেই যুদ্ধে নিহত হন। ফতেপুর-শিকরীর সেখ সেলিমের ভ্রাতুষ্পুত্র সেই ইব্রাহিম খাঁ আজমের শাসনকালে বঙ্গ বিহারে ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি প্রতাপের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না এবং তাঁহার মৃত্যুও ১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে আগ্রায় হইয়াছিল।[৬] নিখিলনাথ রায় মহোদয় ঘটককারিকা ও বসু মহাশয়ের উক্তির কতকটা সমন্বয় করিতে গিয়া উহার অনৈতিহাসিক অংশ বাদ দিয়া অনুমান করিয়াছেন যে, খাঁ আজমের সহিত বিরোধ উপস্থিত হইলে, প্রথম ইব্রাহিম সৈন্য লইয়া যান, এবং তিনি পরাজিত হইয়া প্রত্যাগমন করিলে পরে আজম্ গিয়া প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করেন। কেহ কেহ বলেন, খাঁ আজম্ই পরাজিত হইয়াছিল, এবং বসিরহাটের সন্নিকটবর্ত্তী সংগ্রামপুরে যুদ্ধ হয়। কিন্তু এ বিষয় আমরা নিঃসন্দেহ নহি। তবে ঘটককারিকার কথা পরিত্যাগ করিলেও বসু মহাশয়ের উক্তি একেবারে পরিত্যাজ্য নহে। তিনি পারসীক ভাষায় লিখিত বিবরণী দেখিয়া পুস্তক লিখিয়াছেন, এইরূপই স্বীকার করিয়াছেন। বিশেষতঃ আজম ও ইব্রাহিমের সহিত যুদ্ধের কথা লোক পরম্পরায় চলিয়া না আসিলে, ঘটকেরাই বা কোথায় পাইলেন? সুতরাং যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব নহে এবং সংগ্রামপুর স্থানের নামটিও তাহার ইঙ্গিত করে। তবে যুদ্ধ হইয়া থাকিলেও যে পরে উভয় পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হইয়াছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কারণ ইহার পরেও অনেক দিন পর্যন্ত প্রতাপাদিত্য যে মোগলের বশ্যতা স্বীকার করিতেন, তাহার প্রমাণ আছে। আমাদের বিশ্বাস, ধুমঘাটে নূতন রাজধানী করিয়া শাসন করিবার সময়ও তিনি সামন্ত রাজা ছিলেন এবং তদনুসারে রাজসরকারে কিছু কিছু পেস্ বা উপহার প্রেরণ করিতেন। কিন্তু সে শুধু বাহ্য নিদর্শন মাত্র, রাজ্য মধ্যে তিনি স্বাধীন রাজার মতই চলিতেন।
এমন সময়ে (১৫৯১) উড়িষ্যার পাঠানগণ পুনরায় বিদ্রোহী হন। তাঁহারা জগন্নাথের মন্দির অধিকার করিয়া লইয়া ক্রমে কটক ও জলেশ্বরের দিকে অগ্রসর হইতে থাকেন এবং অবশেষে বিষ্ণুপুরের ভুঞা হাম্বীর মল্লের রাজ্য আক্রমণ করিয়া বসেন।[৭] শুধু আক্রমণ নহে, এমনভাবে গ্রামের পর গ্রাম লুণ্ঠন করিয়া দেশ ছারখার করিতে থাকেন যে, প্রজাকুল একান্ত ব্যাকুল হইয়া হাম্বীরের কৃপাপ্রার্থী হন। তখন মানসিংহ বঙ্গের শাসনকর্তা; কিন্তু তিনি এদেশের আবহাওয়ার প্রতি এতই বীতশ্রদ্ধ যে, নিজে বিহারেই থাকিতেন, সৈয়দ খাঁ রাজধানী তাণ্ডায় থাকিয়া তাঁহার সহকারীস্বরূপ বঙ্গ শাসন করিতেন।[৮] হাম্বীর মল্ল সর্ব্বপ্রথমে পাঠান বিদ্রোহের কথা মানসিংহ ও সৈয়দ খাঁকে জানাইলেন। মানসিংহ হাম্বীরের প্রতি সদয় ছিলেন। কারণ, হাম্বীর বহুকাল পৰ্য্যন্ত আকবরের অনুরক্ত সামন্ত রাজ ছিলেন। বিশেষতঃ কয়েক বৎসর পূর্ব্বে যখন কতলু খাঁর সৈন্যদল মানসিংহের জ্যেষ্ঠপুত্র জগৎসিংহকে পরাজিত ও আহত করেন, তখন হাম্বীর মল্লই তাঁহাকে বিষ্ণুপুর লইয়া আশ্রয় দেন, তাঁহার প্রাণ রক্ষা করেন।[৯] সে কথা মানসিংহের মনে ছিল। তিনি সত্বর বাদশাহের অনুমতি লইয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন এবং সৈয়দ খাঁর উপর এই মর্ম্মে হুকুম জারি করিলেন যে, তিনি যেন স্বয়ং এবং সমস্ত সামন্ত রাজগণের সৈন্য লইয়া যুদ্ধার্থ অগ্রসর হন। সৈয়দ খাঁ এই সময়ে খুব অসুস্থ ছিলেন, তবুও আয়োজন করিতে বিরত হইলেন না। তিনি অন্যান্য সামন্ত রাজাদিগকে যেমন লিখিলেন, তেমনি যশোরাধিপ প্রতাপাদিত্যকেও লিখিয়াছিলেন।[১০ অন্যদিকে হাম্বীর মল্লও এ বিষয়ে বিশেষ অনুরোধ করিয়া প্রতাপাদিত্যের নিকট লোক প্রেরণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়।
কয়েকটি কারণে প্রতাপাদিত্য এই উপলক্ষে মোগলপক্ষে যুদ্ধ করিতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। প্রথমতঃ মনে মনে যাহাই থাকুক, প্রকাশ্যভাবে তিনি মোগলের বিপক্ষাচরণ করিতে পারেন না, সৈন্য দিয়া বাদশাহকে সাহায্য করা প্রত্যেক সামন্ত নৃপতির অবশ্য কর্তব্য; পূর্ব্ববার পাঠানের সহিত সন্ধি করিয়া মানসিংহ বাদশাহের নিকট দুর্বুদ্ধিতার জন্য তিরস্কৃত হইয়াছিল। এ জন্য এবার তিনি কেবলমাত্র বঙ্গ বিহারের সৈন্য লইয়া উড়িষ্যা জয় করিবার জন্য কৃতসঙ্কল্প;[১১] সুতরাং সকল সামন্ত রাজদিগকে সৈন্য লইয়া আসিতেই হইবে এবং সৈয়দ খাঁর অসুখ থাকিলে কি হয়, তাঁহাকে যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইতেই হইবে, এইরূপ হুকুম আসিল। এরূপ অবস্থায় বাদশাহী আদেশ কিছুতেই অমান্য করা সঙ্গত নহে। দ্বিতীয়তঃ সুবেদারের আদেশ অমান্য করিলেও হিন্দু ভুঞাদিগের মধ্যে অন্যতম হাম্বীর মল্লের অনুরোধ উপেক্ষণীয় নহে। তৃতীয়তঃ, আফগানেরা জগন্নাথের পুরী লুণ্ঠন করিয়া এবং পূজা বন্ধ করিয়া দিয়া, সর্ব্বজাতীয় হিন্দুর বিরাগভাজন হইয়াছিলেন। একবার বিক্রমাদিত্যই জগন্নাথ দেবের মূর্ত্তি রক্ষা করিয়াছিলেন, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি[১২] এবার তাঁহার পুত্র সেই উদ্দেশ্যে অগ্রসর হইবেন, ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কি? চতুর্থতঃ, বীরমাত্রেই বীরত্বের পরিচয় দিবার জন্য উদ্যোগী হন, তাহার এই সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। বিশেষতঃ এমন একটা বিরাট অভিযানে শিক্ষা করিবার অনেক বিষয় থাকিতে পারে। এ জন্য প্রতাপ এ সুযোগ পরিত্যাগ করিলেন না। তিনি কতকগুলি বাছা বাছা সৈন্য লইয়া উড়িষ্যার যুদ্ধে যাইবার জন্য সুসজ্জিত হইলেন। বসন্ত রায়ও এ অভিযানে তাঁহাকে বাধা দেন নাই; কারণ মোগলের আনুগত্য, হাম্বীরের সাহায্য এবং জগন্নাথ উদ্ধার, ইহার কোনটিই তিনি ত্যাগ করিতে পারেন না। ঈশা খাঁর সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব ছিল বটে, কিন্তু ঈশা এবার এই সন্ধি ভঙ্গ করার ব্যাপারে অত্যন্ত অসুন্তুষ্ট হন; তিনি তখন জীবিত ছিলেন বটে; কিন্তু জরাজীর্ণ অবস্থায় হিজলীতে বাস করিতেছিলেন।[১৩] বিদায়কালে যখন প্রতাপ খুল্লতাতের পদধূলি লইতে গেলেন, তখন বসন্ত রায় প্রাণ ভরিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন এবং উড়িষ্যা হইতে তাঁহার জন্য একটি শ্রীবিগ্রহ সংগ্রহ করিয়া আনিবার জন্য বিশেষ করিয়া বলিয়া দিলেন।
মানসিংহ নিজে কতকগুলি উৎকৃষ্ট সৈন্যদল লইয়া গঙ্গাপথে অগ্রসর হইলেন; এবং বিহারের সৈন্য সমূহকে ইউসুফ খাঁর অধীন হইয়া ঝাড়খণ্ডের মধ্যে দিয়া মেদিনীপুর যাত্রা করিতে আদেশ দিলেন। এ দিকে সৈয়দ খাঁ কোন প্রকারে রোগশয্যা হইতে উঠিয়া মসুম খাঁ, পাহাড় খাঁ, তাহির খাঁ ও বাবুই মানুকী প্রভৃতি সেনানীবর্গ লইয়া মেদিনীপুর আসিয়া মিশিলেন। প্রতাপাদিত্যও তথায় আসিয়া বঙ্গীয় সেনার দলপুষ্টি করিলেন। তথা হইতে সমগ্র বাদশাহী সৈন্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়া জলেশ্বরের দিকে চলিল। অপর পক্ষে পাঠান সৈন্যও জলেশ্বর ডান দিকে রাখিয়া তথা হইতে সুবর্ণরেখা নদীর কূলে কূলে আরও উত্তরদিকে অগ্রসর হইল; এবং বনপুর[১৪] নামক স্থানে উভয় সৈন্য পরস্পর সম্মুখীন হইয়া সুবর্ণরেখার দুই পারে দাঁড়াইল। কয়েকদিন পরে মানসিংহ তথায় একটি দুর্গ নির্মাণের চেষ্টা করিলে, একদিন পাঠান সৈন্য সুবর্ণরেখা পার হইয়া মোগলদিগকে ভীম বেগে আক্রমণ করিল 1
সম্মুখে ৭৫টি হস্তী ও ৮৪০০ অশ্বারোহী লইয়া কতলু খাঁর দুই পুত্র নসিব ও জমাল খাঁ এবং পশ্চাতে ৮০টি হস্তী ও ১২০০ অশ্বারোহী সহ ঈশা খাঁর পুত্রদ্বয় সুলেমান ও ওসমান যুদ্ধার্থ দণ্ডায়মান। অপর পক্ষে মানসিংহ স্বয়ং মধ্যস্থলে এবং বিহারী সৈন্য লইয়া দক্ষিণ ভাগে রায় ভোজ, রাজা সংগ্রাম ও বাকির খাঁ এবং বামভাগে তোলক খাঁ, ফরাক খাঁ প্রভৃতি সেনানীবর্গ ভীষণ যুদ্ধ করিলেন। মোগলের কামান সমূহ সর্ব্বাগ্রে থাকায় গোলাঘাতে হস্তী সমূহ ব্যাকুল হইয়া পড়িল। বাবুই মানুকী ও পাহাড় খাঁ প্রভৃতি বঙ্গীয় সেনানীগণ হঠাৎ অগ্রবর্ত্তী হইয়া পাঠান দলের দক্ষিণাংশের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।[১৫] প্রতাপাদিত্য এই বাবুই মানুকীর পার্শ্ববর্তী হইয়া অমানুষিক বীরত্ব প্রদর্শন করিলেন। বৃদ্ধ পাহাড় খাঁ প্রভৃতি তাঁহার সে বীর্য্যপ্রভা দেখিয়া চমকিত হইয়াছিলেন। অবশেষে আফগানেরা পরাজিত হইলেন এবং তিন শত সৈন্যকে শবরূপে রণক্ষেত্রে রাখিয়া পলায়ন করিলেন।
পরদিন মোগলেরা আরও অগ্রসর হইয়া জলেশ্বর দখল করিয়া লইলেন। সৈয়দ খাঁ রুগণদেহ লইয়া আর অগ্রসর হইতে স্বীকৃত না হইয়া এই স্থান হইতে বঙ্গের দিকে ফিরিলেন। কিন্তু মানসিংহ এবার শত্রুদিগকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত না করিয়া নিবৃত্ত হইবেন না। পাহাড় খাঁ ও বাবুই মারী রাজারই অনুবর্ত্তন করিলেন। প্রতাপাদিত্য সেই সঙ্গে ছিলেন। তিনি এবার উড়িষ্যার তীর্থ দর্শন করিবেন খুল্লতাতের জন্য শ্রীবিগ্রহ সংগ্রহ করিবেন।
মানসিংহ ভদ্রকে আসিয়া শুনিলেন, পাঠান সেনানীবর্গ কটকের নিকটবর্ত্তী সরণগড় দুর্গে এবং কতক সমুদ্র সান্নিধ্যে আলদুর্গে আশ্রয় লইয়াছে। দুৰ্জ্জন সিংহ প্রভৃতি আলদুর্গ দখল করিতে প্রেরিত হইলেন। মানসিংহ স্বয়ং কটকে পৌঁছিয়া সরণগড় অবরোধ করিলেন। তিনি এইবার ইউসফ খাঁর উপর ভারার্পণ করিয়া স্বয়ং পুরীতে গিয়া জগন্নাথ দর্শন করিয়া আসিলেন। প্রতাপাদিত্যও তাঁহার সহযাত্রী হইয়া তীর্থ দর্শন করিলেন। এই সময়ে রামচন্দ্র খুরদা ও পুরীর অধীশ্বর; সরণগড় তাঁহারই অধিকারভুক্ত। মানসিংহ ভাবিলেন, রামচন্দ্র নিশ্চিতই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। কিন্তু তাহা করিলেন না; তিনিও পাঠানদিগের সহিত উপযোগী হইয়া মোগলের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। কিন্তু টোডরমল্লের সময় হইতে তিনিই মোগলের সামন্তরাজ ছিলেন। মানসিংহ তাঁহার বিরুদ্ধ স্বভাব দেখিয়া পূৰ্ব্ব কথা বিস্মৃত হইলেন এবং জগৎ সিংহ প্রভৃতি সেনানীবর্গকে রামচন্দ্রের রাজ্য আক্রমণ করিবার আদেশ দিলেন। রামচন্দ্র তখন দুর্ভেদ্য খুরদা দুর্গে আশ্রয় লইলেন, মোগল সৈন্যরা মহোল্লাসে তাঁহার রাজ্যের সর্ব্বত্র লুটপাঠ করিতে লাগিল। সম্ভবতঃ এই সময়ে প্রতাপাদিত্য পুরী বা তন্নিকটবর্ত্তী কোন স্থান হইতে গোবিন্দদেবের অপূর্ব্ব শ্রীবিগ্রহ সুন্দর একটি শিবলিঙ্গ সংগ্রহ করিলেন।
বাদশাহ আকবর কিন্তু মানসিংহের এই নূতন নীতির অনুমোদন করিলেন না। পুরাতন ভূম্যধিকারী হিন্দু-রাজন্যের সহিত বিবাদ করা তাঁহার অভিপ্রেত ছিল না। হিন্দুর সহিত মিত্রতা করিয়া পাঠানদিগকে পর্যুদস্ত করাই তখনকার সমীচীন উদ্দেশ্য। মানসিংহ বাদশাহের পত্র পাইয়া মত পরিবর্ত্তন করিলেন। বিপন্ন রাচন্দ্রও সময় বুঝিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। অবশেষে তাঁহার সহিত সন্ধি হইল। পাঠানের পক্ষ ত্যাগ করিবার সর্ভে সমস্ত উড়িষ্যারাজ্য তাঁহাকে প্রত্যার্পিত হইল। সুবর্ণরেখা নদী তাঁহার রাজ্যের সীমা হইল। অবশেষে পাঠানগণও সরণগড় এবং আলদুর্গে আত্মসমর্পণ করিয়া সন্ধি করিলেন, তাঁহারা সুবর্ণরেখা পার হইয়া উড়িষ্যায় প্রবেশ করিতে পারিবেন না, ইহাই স্থির হইল। এই সময় হিজলী তাঁহাদের প্রধান কেন্দ্র হইল। পাঠানদিগকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিবার নিমিত্ত মানসিংহ তাঁহাদের প্রধান দলপতিকে বঙ্গের নানা স্থানে জায়গীর দিয়াছিলেন। কথিত আছে, মানসিংহ খাজা সুলেমান, ওসমান, শের খাঁ ও হৈবৎ খাঁকে খলিফতাবাদে জায়গীর দেন এবং তাহির খাঁ ও বাকির খাঁ তাঁহাদের অনুবর্ত্তী হইয়াছিলেন।[১৬] এই খলিফাতাবাদ যে বর্তমান খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট প্রভৃতি স্থান, তাহা আমরা প্রথম খণ্ডে দেখাইয়াছি। মোগল আমলে খলিফাতাবাদ একটি সরকার ছিল এবং উহা এখনকার যশোহর ও খুলনা জেলার অন্তর্গত। এই সরকারের মধ্যে বাগমারা, যশোর, চিরুলিয়া, দাঁতিয়া, সলিমাবাদ, সাহস, মুড়াগাছা এবং হাবেলী খালিফাতাবাদ, এই ৮টি পরগণায় আফগানদিগের বসতি হইয়াছিল।[১৭] এখনও এ সব স্থানে তাঁহাদের বংশ আছে এবং বৰ্ত্তমান সময়ে সেই সকল বংশীয়েরা এতদঞ্চলে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চপদস্থ বলিয়া খ্যাত। পূর্ব্বোক্ত বাকির খাঁ সম্ভবতঃ বর্তমান বাগেরহাটের নিকটবর্ত্তী বাগমারা বা হাবেলীতে আসিয়াছিলেন এবং তাঁহার নাম হইতে বাগেরহাটের নাম হওয়া বিচিত্র নয়। আবুল ফজল লিখিয়াছেন, দুষ্ট লোকের পরামর্শে মানসিংহ পরে সুলেমান, ওসমান প্রভৃতির জায়গীর বাজেয়াপ্ত করেন এবং তখন হইতে তাঁহারা ঘোর বিদ্রোহ উপস্থিত করেন। সে বিদ্রোহ দমন করিতে বহু বৎসর লাগিয়াছিল। আমাদের মনে হয়, সন্ধি ভঙ্গ করিয়া যাহারা পরে বিদ্রোহী হয়, তাহাদিগেরই জায়গীর বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। আকবর নামাতেই দেখিতে পাই, আকবরের রাজত্বের ৩৮শ বৎসরের শেষ ভাগে অর্থাৎ ১৫৯৪ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে, উড়িষ্যা বিজয়ের পর মানসিংহ প্রথম আসিয়া বাদশাহের সহিত সাক্ষাৎ করেন ও সম্মানিত হন। এই সময়ে তাঁহার সহিত কতলু খাঁর তিন পুত্র, নসিব খা, লোদি খাঁ এবং জামাল খাঁ মানসিংহ কর্তৃক বাদশাহের নিকট পরিচিত হন।[১৮] সুতরাং এ তিন জন যে বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। পরে তাহাদিগকে আর বিদ্রোহিরূপে দেখিতে পাই না এবং ‘বহারিস্তান’ হইতে জানিতে পারিয়াছি, কতলুর তৃতীয় পুত্র জমাল খাঁর প্রতাপাদিত্যের একজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন। উড়িষ্যা যুদ্ধকালেই জমাল খাঁর সহিত প্রতাপাদিত্যের পরিচয় হইয়াছিল এবং মোগলের সহিত সন্ধি হওয়ার পর হয়ত মোগলপক্ষের জ্ঞাতসারেই জমাল খাঁ যশোহর সরকারে কার্য্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। এখনও প্রতাপের সহিত মোগলের প্রকাশ্য বিবাদ হয় নাই।
১৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমভাগে প্রতাপাদিত্য বিগ্রহদ্বয় লইয়া বন্ধুবর্গ সহ যশোহরে পৌঁছিলেন। অর্থ দিয়া সেবাইতদিগকে প্রলুব্ধ করিয়া অথবা বল প্রয়োগ করিয়া, কিভাবে তিনি বিগ্রহ সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন, তাহা জানিবার উপায় নাই। এমন সুন্দর গোবিন্দদেব বিগ্রহ যে কেহ অর্থের লোভে সহজে হস্তচ্যুত করিয়াছিল, এমন বোধ হয় না। তবে বিগ্রহের সেবার জন্য তিনি বল্লভাচাৰ্য্য নামক একজন উড়িয়া ব্রাহ্মণকে যে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। হয়ত বিগ্রহটি কোন প্রসিদ্ধ রাজা বা জমিদারের ছিল, প্রতাপাদিত্য বলপ্রয়োগে উহা হস্তগত করিয়া, পরে অর্থ দিয়া উহারই সেবাইতকে প্রলুব্ধ করিয়া সঙ্গে আনিয়াছিলেন। বসন্ত রায় গোবিন্দদেব বিগ্রহ দেখিয়া আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। বাস্তবিকই এমন শ্রীবিগ্রহ অতীব দুৰ্ল্লভ পদার্থ। বিগ্রহ অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু এমন সৌষ্ঠব, এমন দিব্যোজ্জ্বল নয়নভঙ্গি আর দেখি নাই। অনতিবিলম্বে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপুল আয়োজন চলিতে লাগিল। অচিরে উড়িষ্যার যুদ্ধ-বিগ্রহ, অপেক্ষা এই দেব-বিগ্রহের খ্যাতি দেশময় মণ্ডিত হইয়া পড়িল। ‘সারতত্ত্ব তরঙ্গিনীতে’ আছে :
‘নীলাচল হইতে গোবিন্দকে আনি
রাখিলেন কীৰ্ত্তি যশঃ ঘোষয়ে ধরণী॥’
আমরা এ স্থলে অগ্রে গোবিন্দদেব বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা, মন্দির ও তাঁহার বর্তমান অবস্থার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়া পরে শিবলিঙ্গের কথা বলিব। এক স্থানে ধারাবাহিক বিবরণী থাকিলে পাঠকের বুঝিবার পক্ষে সুবিধা হইবে।
ধুমঘাট দুর্গ হইতে তিন মাইল উত্তরে দক্ষিণ-বাহিনী যমুনার পশ্চিম কূলে গোপালপুর নামক স্থানে গোবিন্দদেব বিগ্রহের জন্য মন্দির নির্ম্মিত হয়। মন্দির একটি নহে, চত্বরের চারিধারে চারিটি উচ্চ মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছিল; উহার মধ্যে কেবল মাত্র পূর্ব্ব পোতার মন্দিরটি ভগ্নাবস্থায় ‘দণ্ডায়মান আছে, অপর তিন পোতার মন্দিরগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িয়া প্রাঙ্গণ জুড়িয়া স্তূপীকৃত হইয়াছে। সে তিনটি মন্দিরে অন্য কোন বিগ্রহ ছিল কি না, বা তাহা কি কার্য্যে ব্যবহৃত হইত, তাহা জানিবার উপায় নাই। সম্ভবতঃ উত্তর ও দক্ষিণ পোতার মন্দিরে অন্য বিগ্রহ থাকিতেন এবং পশ্চিম দিকে সাধু সন্ন্যাসীর আশ্রম গৃহ ছিল। যে মন্দিরটি দণ্ডায়মান আছে, তাহার চূড়া নাই; উহার গম্বুজ বা চূড়া ছিল কি না, তাহাও বলা যায় না। তবে মন্দিরটি দোতালা; নিম্ন তালায় পূজাগৃহ ও তাহার পার্শ্ব দিয়া সিঁড়ি আছে; উপর তালায় ঠাকুরের শয়নগৃহ ছিল। এখনও মন্দিরের যতটুকু খাড়া আছে, তাহার উচ্চতা ৩০ ফুট হইবে। মন্দিরের ভিতরের মাপ ১৬’-৬’’ × ১৬’-৬’’ ইঞ্চি; ভিত্তি ৮’-৯’’; দরজার খিলান ৬’-৭’’ × ৫’’ ফুট। পশ্চিম দিকে সদর দুয়ার; দক্ষিণ ও পূর্ব্ব দিকেও দরজা আছে কিন্তু উত্তর দিকে কোন দ্বার নাই। মন্দিরের গায়ে দেবদেবীর মূর্ত্তি ও কারুকার্য্যের পরিচয় এখনও আছে। কোন শিলা বা ইষ্টক-লিপি নাই, হয়ত যাহা ছিল, তাহা নষ্ট বা অপহৃত হইয়াছে।
মন্দিরগুলির পশ্চিম দিকে প্রকাণ্ড দোল-মঞ্চের ভগ্নাবশেষ এখনও বর্ত্তমান রহিয়াছে।[১৯] এবং মন্দিরের ৮/১০ রশি উত্তরে প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা। যশোহরপুরীকে কাশীর সহিত তুলনা করিতে গিয়া পণ্ডিতপ্রবর যে শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে এই দীর্ঘিকাই মণিকর্ণিকার মত তীর্থ সরোবরের সহিত তুলিত হইয়াছে। বাস্তবিকই ইহা একটি সুবিস্তীর্ণ জলাশয়, ইহার জলাশয়েরই পরিমাণ ৯৯ বিঘা; তাহা ব্যতীত পাহাড় লইয়া দীর্ঘিকার বিস্তৃতি আরও অধিক।[২০] এই সুন্দর জলাশয় মহারাজ প্রতাপাদিত্যের জলদান পুণ্যের পরিচয় দিতেছে। যশোহর-খুলনায় ইহার সহিত মাত্র খাঁ জাহানালির ঘোড়াদীঘি ও সীতারামের রামসাগর দীঘির তুলনা হইতে পারে।
গোপালপুরের নূতন মন্দিরে গোবিন্দদেব বিগ্রহের প্রতিষ্ঠার সময় এক বিরাট মহোৎসব অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, দেশ দেশান্তরের পণ্ডিত ও সাধু সন্ন্যাসীর সমাগমে এবং যজ্ঞানুষ্ঠানের সমারোহে বিস্তীর্ণ যশোহরপুরী বহুদিন ধরিয়া আনন্দ কোলাহলে প্রমত্ত হইয়াছিল। কথিত আছে, এতদুপলক্ষে লক্ষ ব্রাহ্মণভোজন করাইয়া দক্ষিণা প্রদত্ত হয় এবং তাঁহাদের পদধূলি সংগৃহীত হইয়াছিল। এই সময়ে একদিন চাঁচড়ার পূর্ব্বপুরুষ যজ্ঞেশ্বর রায় ব্রাহ্মণভোজন কালে হঠাৎ ঝড় উঠিলে, বীরবিক্রমে যজ্ঞরক্ষা করিয়া প্রতাপের তুষ্টিসাধন করিয়াছিলেন। সে কথা আমরা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি।
পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে, বল্লভাচার্য্য উড়িষ্যা হইতে বিগ্রহের সঙ্গে আসেন এবং সেবায়েৎ নিযুক্ত হইয়া অধিকারী উপাধিতে পরিচিত হন। অধিকারী মহাশয়কে পুরুষানুক্রমে এ দেশে বাস করিতে হইলে, সামাজিক বিপত্তি উপস্থিত হইবে বলিয়া প্রতাপাদিত্য এদেশীয় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণের সহিত তাঁহার বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটাইয়া দেন এবং তাহার ফলে অধিকারিগণ ক্রমে এদেশীয় সমাজভুক্ত হইয়া গিয়াছেন। প্রতাপের জীবদ্দশায় বল্লভাচার্য্য ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র নৃসিংহদেব চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়। ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপের পতনের পর যখন বসন্ত রায়ের পুত্র চাঁদ রায় পৈতৃক রাজ্য লাভ করেন, তখন তিনি বল্লভাচার্য্যের কনিষ্ঠ পুত্র রাঘবেন্দ্র অধিকারীকে যে সনন্দ দিয়াছিলেন, তাহা এখনও অধিকারী মহাশয়দিগকে গৃহে আছে। উহার অবিকল প্রতিলিপি এই :
শ্ৰীশ্ৰীকৃষ্ণ শরণং রাজশ্রীচাঁদরায়স্য গোবিন্দ দেব
স্বস্তি পূজ্যতম শ্রীযুক্ত রাঘবেন্দ্র অধিকারী ও শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্র অধিকারী চরণেষু
রাজশ্রীচাঁদ রায়স্য
(স্বাক্ষর) রাজশ্রীচাঁদ রায়স্য
প্রণামা বিজ্ঞাপনঞ্চ বিশেষ আমার অধিকার চালা ধূলিয়াপুরের গ্রামহায়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরের সেবার্থে অজবঞ্জর খারিজ জমা ২৮৬ দুইসত ছেয়াসি বিঘা ভূমি মাফিক তপশিল দেবত্তর দিলাম। অতএব তোমরা ঐ ভূমি উত্থিত করিয়া উহার উপস্বত্ত লইয়া শ্রীশ্রী সেবা করিয়া পুত্র পৌত্রাদিক্রমে পরম সুখে ভোগ করিবে। ইতি সন ১০১৬ দশ শত সোলো সাল তারিখ….. ২১ চৈত্ৰ …
তপশীল ভূমি… ২৮৬
জায়
গোপালপুর … ১০১/
দুর্গাপুর … ২/
শ্রীরামপুর … ৪/
অনন্তপুর … ২৯/
হাসনকাটি … ৪/
ভুরলিয়া … ৭/
বিষ্ণুপুরা … ৪/
সোণামারী … ৭/
কাছিমপুর … ১৩/
হাসনকাটির পূর্ব্ব মদমনার মধ্যে চর … ১১১/
ধলবাড়িয়া … ১/
খানপুর … ১/
গোপালপুরে যেখানে এক্ষণে গদাধর ঘোষের বাড়ী রহিয়াছে, ঐ স্থানে অধিকারী মহাশয়দিগের বসতি বাড়ী ছিল। প্রতাপের পতনে পর যশোহর রাজধানী শ্রীভ্রষ্ট হয় এবং অল্পকাল মধ্যেই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্রমে জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়ে। ক্রমে গোপালপুরেরও সেই দশা হয়। তখন অধিকারীরা ঠাকুর লইয়া পরমানন্দকাটিতে আসিয়া বাস করেন। চাঁদরায়ের পৌত্র রাজা শ্যামসুন্দরের সাহায্যে সেখানেও গোবিন্দদেবের জন্য মন্দির ও দোলমঞ্চ নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। উহার ভগ্নাবশেষ এখনও আছে। গোবিন্দদেব শতাধিক বর্ষ কাল পরমাকন্দকাটিতে ছিলেন। পরে যখন বাজিতপুর পরগণা কলিকাতার পাথুরিয়াঘাটা নিবাসী লাডিডমোহন ও গোপীমোহন ঠাকুর খরিদ করেন, তখন পরমানন্দকাটি উক্ত পরগণার অন্তর্ভুক্ত বলিয়া তাঁহারা গোবিন্দদেব বিগ্রহের মালিক হইতে ইচ্ছা করেন। সেই উদ্দেশ্যে গোবিন্দদেবের পূজার সংকল্প তাঁহাদের নামে করাইবার জন্য অধিকারীদিগকে আদেশ দেন। কিন্তু উঁহারা কিছুতেই পীরালি সংস্রব-দুষ্ট ঠাকুর ববুদের নামে পূজার সংকল্প করিতে সম্মত হইলেন না। তাহার ফলে অধিকারীদিগের উপর অত্যাচার আরম্ভ হইল। তখন ১২০৩ সালে (১৭৯৭ খৃঃ) অধিকারীরা ঠাকুর লইয়া পুনরায় গোপালপুরে আসিয়া বাস করেন; চাঁদ রায়ের বংশীয় রাজাগণ ঐ সময়ে নুরনগরের অন্তর্গত রামজীবনপুর বাস করিতেছিলেন। ঠাকুরবাবুরা গোপালপুর হইতে জোর করিয়া ঠাকুর দখল করিবার চেষ্টা করিলে, অধিকারীরা গোবিন্দদেবকে রামজীবনপুরে রাজবাড়ীতে গুপ্তভাবে রক্ষা করেন। তখন ঠাকুর বাবুদের পক্ষ হইতে রামদুলাল ও রামচাঁদ অধিকারীর নামে ঠাকুর চুরির মোকদ্দমা হয়।[২১] ১২০৪ সালের ৩০ শে মাঘ (৯ই ফেব্রুয়ারি, ১৭৯৮) তারিখে যশোহর ফৌজদারী আদালতে এই মোকদ্দমার যে বিচার হয়, তাহার রায় হইতে জানিতে পারি যে, ঠাকুরের উপর অধিকারীদের স্বামিত্বই স্থিরীকৃত হয় এবং ঠাকুর বাবুরা হারিয়া গিয়া মোকদ্দমার খরচার দায়িক হন। অবশেষে ১২৩৫ সালে রামদুলাল অধিকারীর পুত্র ও জ্ঞাতি ভ্রাতুষ্পুত্রগণ রামপুর গ্রাম পত্তনী লইয়া তথায় আসিয়া বাস করেন। গোবিন্দদেব তখন রামজীবনপুরে ছিলেন; অধিকারীরা ঠাকুরকে রায়পুরে আনিবার প্রস্তাব করিলে রাজারা ঠাকুর আনিতে দিতে চাহেন না। তখন অধিকারীদের সহিত রাজাদের ফৌজদারী মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে অক্টোবর তারিখে বিচার হইয়া স্থির হয় যে, ঠাকুর অতি পূর্ব্বকাল হইতে অধিকারীদের দখলে আছেন, তাহাই থাকিবে, রাজারা ইচ্ছা করিলে স্বত্বের মোকদ্দমা করিতে পারেন।[২২] প্রকৃতপক্ষে আর মোকদ্দমা হয় না। আপোষ মীমাংসায় স্থির হয়, মূলে রাজারা ঠাকুরের মালিক হইলেও অধিকারীরা বংশানুক্রমে সেবায়ৎ এবং দেবোত্তর সম্পত্তির অধিকারী। তদবধি প্রতি বৎসর গোবিন্দদেবকে নুরনগর রাজবাটীতে আনিয়া মহাসমারোহে দোলের উৎসব অনুষ্ঠিত হইত। নুরনগর দোল একটি বিখ্যাত উৎসব এবং তদুপলক্ষে সেখানে প্রতিবৎসর বহুসহস্র লোকের সমাগম হইত। এইভাবে ঠাকুরের সহিত দৈন্যগ্রস্ত রাজবংশীয়দিগের সম্বন্ধ স্থাপিত ছিল; দোলের সময়ে ঠাকুরকে পাইয়া তাঁহারা গৌরবে দৃপ্ত এবং আনন্দে অধীর হইতেন। রায়পুরে অধিকারীদিগের বাড়িতে গোবিন্দদেবের সুন্দর মন্দির আছে।
কয়েক বৎসর হইল, টাকীর সুবিখ্যাত মুন্সীবংশীয় জমিদার রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী মহোদয় ধুমঘাট-বংশীপুরের স্বত্বাধিকারী হন। গত ১৩১০ সালে তিনি অধিকারীদিগের নিকট হইতে গোবিন্দদেব বিগ্রহ চাহিয়া লইয়া টাকীর নিজ বাটীতে রাসোৎসব সম্পন্ন করেন। নুরনগর ও কাটুনিয়ার রাজবংশীয়েরা পূর্ব্বক্ষণে এই সংবাদ জানিতে পারিয়া অধিকারীদিগকে নিষেধ করেন; কিন্তু তাঁহারা নিষেধ না মানিয়া, নিজের ঠাকুর তাঁহারা যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে পারেন, একভাবে ইহাই প্রমাণিত করিবার ছলে এবং রায় যতীন্দ্রনাথের সাহায্য ও উৎসাহের বলে গোবিন্দদেব বিগ্রহকে টাকীতে প্রেরণ করিয়াছিলেন। টাকীর মুন্সীবাবুরা রাজবংশীয়দিগের জ্ঞাতি ও আত্মীয় ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের বৈষয়িক অবস্থা যতই উন্নত হইক না কেন, রাজবংশীয়েরা বংশগৌরবে কোন দিনই তাঁহাদের নিকট মাথা হেঁট করিতে রাজী নহেন। অধিকারীরা রাজবংশের পূর্ব্বগৌরবের একমাত্র জীবন্ত নিদর্শন শ্রীবিগ্রহকে পরাশ্রয়ে প্রেরণ করিলে চিরদিনের মত প্রতাপাদিত্যের বংশধরগণের মাথা নীচ হইয়া যাইবে, এ জন্য এই ব্যাপারে তাঁহারা অত্যন্ত অপমানিত ও মর্মাহত হইলেন। কমল নারায়ণ অধিকারী মহাশয় প্রকৃত অবস্থার গুরুত্ব না বুঝিতে পারিয়া, অকৃতজ্ঞের মত রাজবংশীয়দের মুখে যে কালিমা লেপন করিয়া দিলেন, তাহার ফলে কয়েক বৎসর ধরিয়া বিবাদ বিদ্বেষের প্রবল বহ্নি জ্বলিয়া উঠিল 1
এই সময়ে নুরনগরে ও পার্শ্ববর্ত্তী কার্টুনিয়ায় রাজবংশীয়দিগের মধ্যে যাঁহারা বাস করিতেন, তন্মধ্যে কাটুনিয়ার রাজা যতীন্দ্রমোহন রায় বয়সে সর্ব্বাপেক্ষা প্রবীণ না হইলেও বিদ্যাবুদ্ধি ও বংশোচিত তেজস্বিতায় সকলের অগ্রগণ্য। তিনি রাজা অন্নদাতনয়ের পুত্রগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বলিয়া লোকে তাঁহাকে ‘বড় রাজা’ বলিয়া ডাকে; কিন্তু শুধু নামে নহে, কার্য্যেও তিনি বড় রাজা। তাঁহার ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা ও কার্যপ্রণালীর মধ্যে রাজোচিত উদারতা ও বীরোচিত কঠোরতা ও কার্য্যতৎপরতা দেখিতে পাওয়া যায়। লোকে তাঁহাকে রাজার মত ভক্তি করে, বীরের মত ভয় করে, আর আশ্রিতের প্রতি তাঁহার দয়া দেখিয়া নিঃস্ব প্রজা তাঁহাকে অন্তরের সহিত শ্রদ্ধা করে। যিনি তাঁহাকে ভাল করিয়া জানেন, তিনিই স্বীকার করিবেন যে, কোন স্বাধীন দেশে তাঁহার জন্ম হইলে, তাঁহার যোদ্ধজীবন সেনাপতির উচ্চাসন অলঙ্কৃত করিত। তিনি শুধু কৃতবিদ্যা নহেন, তিনি চিন্তাশীল, সুলেখক ও সুবক্তা; তিনি শুধু উদার নহেন, তিনি সরল, অমায়িক ও অতিথিবৎসল। বহুজনে তাহাকে আপন জনের মত জানে; নিজের বংশগৌরব রক্ষার জন্য তিনি সতত চেষ্টিত এবং একমাত্র তাঁহারই নিকট হইতে রাজবংশের বহু পুরাতন কাহিনী জানিতে পারা যায়। বঙ্গেশ্বর লর্ড কারমাইকেলের সময়ে যখন খুলনায় তাঁহার দরবার বসিয়াছিল, তখন রাজা যতীন্দ্রমোহনকেই এই জেলার প্রথম আসন প্রদত্ত হয়।[২৩]
“গোবিন্দদেব বিগ্রহ সম্পর্কে যাঁহারা অধিকারীদিগের সহিত বিবাদ করিতে উদ্যোগী হন, তন্মধ্যে রাজা যতীন্দ্রমোহনই প্রধান। কিন্তু পরিণামে যখন অবস্থা বিপদ-সঙ্কুল হইয়া দাঁড়াইল এবং মোকদ্দমাদিতে অতিরিক্ত ব্যয় হইতে লাগিল, তখন একমাত্র যতীন্দ্রমোহনই বংশগৌরব রক্ষার জন্য সর্ব্বস্ব পণ করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছিলেন। বহুদিন ধরিয়া ঘোর বিবাদ চলিয়াছিল; বহু মামলা মোকদ্দমা হইল; বহুবার জোর করিয়া রায়পুর হইতে বিগ্রহ লইয়া যাইবার চেষ্টা চলিল; কিন্তু তাহাতে সুবিধা হইল না। অবশেষে অধিকারীদিগের বাড়ীতে গোবিন্দ দেবকে রক্ষা করিবার জন্য গবর্ণমেন্ট হইতে পুলিশ পাহারা বসিল। তাহাতেও কিছু ফল হইল না। শুনিয়াছি, সেই পাহারা থাকিতে থাকিতে গোবিন্দদেব ও শ্রীরাধিকা দুইটি অপহৃত হইলেন। কে কোথায় লইয়া গেল জানা যায় নাই; কিছুদিনের মধ্যে পুলিশের চেষ্টায়ও তাহার সন্ধান হইল না। অবশেষে শুনা গেল, সেই বিগ্রহই রাজা যতীন্দ্রমোহনের হস্তগত হইয়াছে। তিনি তাঁহাকে গোবিন্দদেব বলিয়া প্রচার না করিলেও লোকে সে অপূৰ্ব্ব শ্রীমূর্তি চিনিত; যে ভাবেই হউক, প্রকৃত গোবিন্দদেবই যে রাজামহাশয়ের হস্তগত হইয়াছেন, লোকের তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। শ্রীপুরনিবাসী বঙ্গজকুল-প্রদীপ সতীশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় কৃপাপূর্ব্বক শ্রীবিগ্রহের মন্দির নির্মাণের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করিয়া অর্থের সদ্ব্যবহার করিলেন। রাজা যতীন্দ্রমোহনের নিজ বাটীতেই অচিরে সুদৃঢ় প্রকাণ্ড মন্দির নির্ম্মিত হইল এবং তথায় মহাড়ম্বরে গোবিন্দদেবের প্রতিষ্ঠা হইল। রাজার ধন রাজার হাতে ফিরিয়া আসিলে, সে বৎসরের দোলের সময়ে বহুদূর হইতে দলে দলে লোক আসিয়া এক বিরাট শোভাযাত্রার সৃষ্টি করিয়াছিল।[২৪] তদবধি প্রতি বৎসর দোলের সময় কার্টুনিয়ায় প্রায় বিশ হাজার লোকের সমাগম হয়, রাজবাটীর সম্মুখে বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে কয়েকদিন ধরিয়া প্রকাণ্ড মেলা বসে। বর্তমান সময়ে কার্টুনিয়ার দোলোৎসবের মত বিরাট উৎসব বোধ হয় খুলনা জেলার আর কোথাও হয় না। প্রতাপাদিত্যের গোবিন্দদেব দেখিতে হইলে কাটুনিয়ার রাজবাটীতেই দেখিতে হইবে।[২৫] অধিকারী মহাশয়েরা উক্ত ঘটনার পর, ১৩১৬ সালে পণ্ডিতবর্গের পরামর্শ লইয়া নতুন গোবিন্দদেব ও রাধিকা মূর্ত্তি প্রস্তুত করাইয়া পূর্ব্ব মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁহারা প্রকৃত গোবিন্দদেবের কতকগুলি বৃত্তিমহলের উপস্বত্ব হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন; অথচ কে সে উপস্বত্ব পাইবে, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। এ সম্বন্ধে অনেক মোকদ্দমা হইয়া গিয়াছে। অনেক স্থলে প্রজারাই নিষ্কর ভোগ করিতেছেন।
প্রতাপাদিত্য যখন উৎকল দেশ হইতে গোবিন্দদেব বিগ্রহ আনয়ন করেন, তখন তৎসঙ্গে রাধিকা মূর্ত্তি ছিল না। কথিত আছে, ঐ মূর্ত্তি নাকি সুবর্ণরেখা নদীর মধ্যে পতিত হয় এবং বহু চেষ্টায়ও তাহার উদ্ধার সাধন হয় না। বসন্ত রায় শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পূর্ব্বে নিজের পছন্দ মত পিত্তল নির্ম্মিত রাধিকা মূর্ত্তি গঠন করিয়া লন। প্রথম গঠিত দুই একটি মূর্ত্তি তাঁহার মনোনীত না হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়; প্রবাদ এই যে, বসন্ত রায় স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া জানিতে পারেন, উক্ত মূৰ্ত্তি গোবিন্দদেবের মনঃপূত হয় নাই তখন ঐ সকল পরিত্যক্ত মূর্তির জন্য নূতন কৃষ্ণমূর্ত্তি গঠন করাইয়া, প্রতাপাদিত্য তাঁহার রাজ্যমধ্যে নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। সত্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয় লিখিয়াছেন, ‘বেহালা প্রভৃতি স্থানে প্রতাপ স্থাপিত প্রতিমূর্ত্তি এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। শঙ্করের নিকটও ঐ মূর্ত্তি ছিল, এক্ষণে উহা বারাসাতে আছে। ইহার শ্রীকৃষ্ণ লাবণ্যবতীতে নিমগ্ন হন; এক্ষণে উক্ত রাধিকা বিধবা ব্রাহ্মণী নামে অভিহিত হন।’[২৬]
গোবিন্দদেব বিগ্রহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্য যে একটি শিবলিঙ্গ আনিয়াছিলেন, উৎকল দেশ হইতে আনীত বলিয়া উহার নাম উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ। এই লিঙ্গ বসন্ত রায় বেদকাশী নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। ঐ স্থানে যে দুর্গের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহার বাহিরে উত্তর দিকে বাঁশীর খালের পার্শ্বে একস্থানে উৎকলেশ্বর শিবমন্দিরের প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ রহিয়াছে। ঐ স্থানে একখানি গোলাকার প্রস্তর-ফলকে একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়; উহা এই :
‘নিৰ্ম্মৰ্মে বিশ্বকৰ্ম্মা যৎ পদ্মযোনি-প্রতিষ্ঠিতং
উৎকলেশ্বরসংজ্ঞঞ্চ শিবলিঙ্গমনুত্তমম্।
প্রতাপাদিত্যভূপেনানীতমুৎকলদেশতঃ
ততো বসন্তরায়েন স্থাপিতং সেবিতঞ্চ তৎ।।’
এই শিলালিপিখানি কাটুনিয়ার রাজবংশীয় রাজা রমেশচন্দ্র রায় মহাশয়ের নিকট ছিল।[২৭] প্রতাপাদিত্য ও বসন্ত রায়ের নাম সংযুক্ত শিলালিপি আর পাওয়া যাই নাই; উহাতে কোন তারিখাদি না থাকিলেও ঐতিহাসিকের নিকট ইহার মূল্য বেশী; কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্যক্রমে ইহাও অযত্নে অপহৃত হইয়াছে। লিপিতে আছে যে শিবলিঙ্গ বিশ্বকৰ্ম্মা বিনির্ম্মিত, সুতরাং উহা যে সুন্দর ও বিরাট তাহাতে সন্দেহ নাই। বেদকাশীর কাছারী বাটীতে যে দুইখানি ভগ্ন প্রস্তর আছে, তাহা উক্ত শিবলিঙ্গের গৌরীপীঠের অংশ বলিয়া অনুমান করিয়াছিলাম। সম্ভবতঃ একমাত্র শিবমন্দির নহে, উহার পার্শ্বে একই প্রাঙ্গণে আরও কয়েকটি মন্দির থাকিতে পারে। হয়ত উহার একটিতে যে চতুর্ভুজ বাসুদেব মূৰ্ত্তি ছিল তাহার নিম্নাংশ ভগ্নাবস্থায় কাছারী বাটীতে বৃক্ষতলে পতিত ছিল; আমি উহা আনিয়া দৌলতপুর কলেজ লাইব্রেরীতে সযত্নে রক্ষা করিয়াছি। বেদকাশীতে শিবমন্দিরও যে খুব বড় এবং সুদৃঢ় ছিল, তাহার নিদর্শন আছে। ঐ মন্দিরের ভগ্নাবশেষের সন্নিকটে কতকগুলি প্রস্তরস্তম্ভ এবং কয়েকখানি প্রকাণ্ড পাথর পড়িয়া আছে। মাটীর উপর যেগুলি আছে, তাহাই আমরা দেখিতে পাইয়াছিলাম। আরও কত পাথর মাটীর নিম্নে বিলুপ্ত আছে বা অন্য লোক দ্বারা স্থানান্তরে নীত হইয়াছে, তাহা জানি না।[২৮] সম্ভবতঃ শিবমন্দিরটি ইষ্টক-গ্রথিতই ছিল এবং উহার স্থানে স্থানে ও বারান্দার থামে সুদৃঢ় কষ্টিপাথরের ব্যবহার হইয়াছিল। গোবিন্দদেবের মন্দিরের মত বেদকাশীর শিবমন্দিরটিও যে বসন্ত রায় নয়নাভিরাম করিয়া গঠন করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। রাজধানী যশোহর যখন কাশীর সহিত তুলিত হয়, তখন তিনি বেদকাশী নাম দিয়া কপোতাক্ষীর অপর পারে এই নূতন সহর রচনা করেন, ও তাহার নামকরণ করেন।[২৯] গোপালপুরে যেমন বিস্তীর্ণ দীর্ঘিকা ছিল, এখানেও বসন্ত রায় একটি সুপেয় সলিলপূর্ণ এক সুন্দর দীর্ঘিকা খনন করেন। উহার জলাশয় ১১৫০’ × ৮০০’ ফুট। কিন্তু উহার মিষ্ট জল আর নাই, দীঘিতে লোণা ঢুকিয়া উহার জল লোণা করিয়া দিয়াছে, এই জন্যই বসন্ত রায়ের দীঘির বর্ত্তমান নাম ‘লোণা দীঘি’। উহা খালাস-খাঁ দীঘি অপেক্ষা বড় ও স্বতন্ত্র। খালাস-খাঁ দীঘির কথা আমরা প্রথমে খণ্ডে আলোচনা করিয়াছি।[৩০]
পাদটীকা :
১. “Though offended by his (Aziz) boldness. Akbar would but rarely punish him; he used to say : ‘Between me and Aziz is a river of milk which I cannot cross.” – Ain (Blochmann), p. 325; কারণ উভয়েই এক মায়ের স্তন্য পান করিয়াছিলেন।
২. ঘটক কারিকায় আছে :
‘সম্বাদমশিবং শ্রুত্বা জাহাঙ্গীরো মহীপতিঃ।
প্রেষয়ামাস সেনানী আজিম খান সংজ্ঞকঃ।।
* * *
আজিমং পাওয়ামাস তীব্রঘাতেন ভূতলে।
—[নিখিলনাথ, মূল ৩০৬ পৃ—শি মি]
কিন্তু জাহাঙ্গীর আজমকে প্রেরণ করেন এবং তিনি প্রতাপের সহিত যুদ্ধে নিহত হন, এই উভয় উক্তিই ভুল। আজম্ আকবরের শাসনকালে ১৫৮২ হইতে ১৫৮৪ পর্যন্ত বঙ্গে ছিলেন, পরে বঙ্গে আসেন নাই, বরং তিনি ১৬২৩-২৪ খৃষ্টাব্দে পরলোক গত হন।—Ain. (Blochmann), p. 327.
৩. গত ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে জ্ঞানদাকণ্ঠ রায়বাহাদুর গভর্ণমেন্টের নিকট যে বর্ণনা দাখিল করেন তাহাতে ছিল : ‘As far as I can gather from the coincidence of historical facts and from traditions and family records in my sherista, this Hindu general was Raja Bhabeswar Roy, a well-to-do and influen- tial man of Oudh and the founder of the Jessors Raj family who, in obedience to an order from the Emperor. took upon himself the arduous duty of coming to Bengal and quelling the insur- rection in co-operation with Azim khan.’ কিন্তু প্রকৃত ঘটনা আমরা যেরূপ জানিতে পারিয়াছি তাহাতে ভবেশ্বরের পূর্ব্ব পুরুষই অযোধ্যা প্রদেশ হইতে বঙ্গে আসিয়া, মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত জেমো নামক স্থানে বাস করেন এবং পরে তাঁহারা এদেশীয় সমাজভুক্ত হন। সবিশেষ বিবরণ পরে দিব।
৪. Westland. Jessore, p. 45; Khulna Gazetteer, p 36. 7.
৫. বর্তমান কেশবপুরের দুই মাইল উত্তরে এখনও মূলগ্রাম আছে। সেখানে ভবেশ্বর সিংহের গড়কাটা বাড়ীর চিহ্ন আছে। এক্ষণে বহুসংখ্যক সমৃদ্ধ কাঁসারি পরিবার ইহার অধিবাসী। তাঁহারা সকলেই কাঁসা পিত্তলাদি ধাতুদ্রব্যের ব্যবসায়ী।
৬. Ain (Blochmann), p. 403; নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ১৩৪-৫ পৃ।
৭. Akbarnama (Beveridge), Vol. III. p. 934.
৮. Stewart, History of Bengal (Bangabasi Edition). p. 205.
৯. Akbarnama (Beveridge). Vol. III p. 879; Elliot. Vol. VI. p. 86.
১০. বঙ্গের বিদ্রোহ দমন জন্য প্রত্যেকবারই সামন্ত রাজগণের উপর এইরূপ আদেশ হইত। একবার খিজিরপুরের ঈশা খাঁর বিদ্রোহ কালে, ‘An order was issued to Said K. and other fief holders of Bengal and Behar to act in unity and to exert themselves to punish the landholder (Isa).’ – Akbarnama, Vol III p. 660. এবারও … When Said k got well he joined with … Babui Mankli… and other fief-holders of that country together with 6000 men and 500 horse. – Ibid. III. P. 935. প্রতাপাদিত্য তখনও নগণ্য ব্যক্তি, আবুল ফজল এস্থলে তাঁহার নাম না করিলেও তিনি যে উক্ত সামন্ত রাজগণের (fief-holders) মধ্যে ছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
১১. ‘Rajah Man Singh. who repented of the peach he had made, resolved to conquer the country and obtained leave from the court. He chose the soldiers of Bhhar and Bengal for this enter- prise.’ — Akbarnama. III. p. 934.
১২. বৰ্ত্তমান খণ্ড, ১ম অংশ, ৫ম পরিচ্ছেদ।
১৩. বৰ্ত্তমান খণ্ড, ১ম অংশ, ৩য় পরিচ্ছেদ ৩৬ নং পাদটীকা।
১৪. The India office Mss seem to have Binapur; Elliot, VI. p. 89 has Midnapur, Beames in J.A.S.B. (1883). p. 236 says the battle was fought on the N. Bank. Subarnarekha. See, Akbarnama (Beveridge), III. p. 932 note. “Great battle at Banapur’- Hunter. Orissa, Vol. II. Appendix p. 195. (Sarkar. J.N.- Benapur, 10 or 12 miles from Jaleshwar. Hist. of Bengal (Dacca), II, p. 209 note. -শি. মি.
১৫. Akbarnama, III, pp. 935-6. জলেশ্বরের সন্নিকটে যে যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা এদেশে প্রচলিত প্রবাদে এবং রামগোপাল রায় কৃত ‘সারতত্ত্ব তরঙ্গিনী’তে আছে— ‘জলেশ্বর পাটনায় হইল সংগ্রাম,’ এখানে ‘পাটনা’ বলিতে পত্তন বুঝাইতেছে।— নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ২৮২ পৃ.
১৬. ‘When rebels of Orissa submitted the Rajah visely gave khwaja Sulaiman khwaja Usman. Sher kh. and Baibat Kh. fiefs in Khalifahbad and selected Tahir k., khwaja Baqir Ansari to accompany them’.- Akbarnama (Beveridge), III, p. 963.
১৭. Khalifatabad was a sarker or Division of Mughal Empire which corresponds. with our modern jessor, and the descendants of the afghans still survive there. The principal Paraganas of Fiscal Divisions in which they settled were the eight following: ( 1 ) Bagmari; (2) Jessor (3) Chirolih; (4) Datiah; (5) Salimabad; (6) Shabosh; (7) Mungatch; ( 8 ) Haveli khalifatabad.’ – Blochmann. Mss; Hunter. Orissa. Vol. III Ip. 19.
১৮. Akbarnama ( Beveridge). Vol. III. p. 997.
১৯. গোপালপুরের মন্দিরের পশ্চিম ধারে নকিপুর নিবাসী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় নিজ বাগানবাটীতে ১৩২১ সালে একটি পুষ্করিণী খনন কালে মৃত্তিকার নিম্নে কয়েক স্থানে ইষ্টকগ্রথিত সিঁড়ি, ভগ্ন কৃষ্ণমূর্তি, কতকগুলি মাটীর আতরদান এবং একটি প্রকাণ্ড কাঁসার বাটি পাইয়াছেন।
২০. ‘It was a magnificent reservoir at one time but at present it is overgrown with weeds and thorns’—Ancient Monuments. p. 148. এই দীর্ঘিকাটি এক্ষণে কলিকাতা নিবাসী শ্রীনাথ দাস উকীল মহাশয়ের সম্পত্তিভুক্ত।
২১. অধিকারী মহাশয়দিগের বংশাবলী এইরূপ :
২২. Extracts from the judgment of J. H. Bariow. Joint Magistrate, Baraset, dated 29.10. 1830 : ‘It is clearly established that the said accused have been in possession from past times… it is ordered that the accused be acquitted from this charge without any slur on them and that the said Thakurs do remain in their possession… The said Rajahs, if they entertain any claim to the said Thakurs, are at liberty to sue in a civil court.’
২৩. রাজা বসন্ত রায়ের অধস্তন দশমপুরুষে রাজা যতীন্দ্রমোহন। সংক্ষেপতঃ তাঁহার বংশধারা এইরূপ : ১৪ বসন্তরায়— চাঁদরায়— রাজারাম— শ্যামসুন্দর— নন্দকিশোর— রাধানাথ— রামনারায়ণ— জয়নারায়ণ- অন্নদাতনয়- ২৩ যতীন্দ্র, মতীন্দ্র, শৈলেন্দ্র ও জ্ঞানেন্দ্র। নন্দকিশোর রামজীবনপুরে বাস করেন এবং রামনারায়ণের পুত্রগণের সময়ে কার্টুনিয়ায় রাজবাটী প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বংশের সম্পূর্ণ বংশলতিকা পরে প্রদত্ত হইবে।
২৪. এই সময়ে অধিকারীগণ তাঁহাদের উপর অত্যাচারের আশঙ্কা করিয়া খুলনার ম্যাজিষ্ট্রেট বাহাদুরের নিকট দরখাস্ত করায়, রাজা যতীন্দ্রমোহনকে দশ হাজার টাকার মুচ্লকা দিতে হইয়াছিল এবং সেই দোলের সময়ে তাঁহার বাটীতে কয়েক শত সশস্ত্র মিলিটারী পুলিশ বসিয়াছিল। উহাদের ব্যয়ভার রাজাকেই বহন করতে হইয়াছিল। কিন্তু যখন তদানীন্তন ম্যাজিষ্ট্রেট ব্রাড্লি-বার্ট সাহেবের সহিত কালীগঞ্জে দেখা করিয়া রাজা যতীন্দ্রমোহন অবিচলিতভাবে নিজের বংশগৌরব ও বর্তমান হাঙ্গামার প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করিয়া বলিলেন, তখন ইতিহাস-রসিক সহৃদয় সাহেব সকল কথা বুঝিলেন এবং স্বয়ং কার্টুনিয়া রাজবাটীতে গিয়া সমস্ত অবস্থা তদন্ত করিয়া মিলিটারী পুলিশ স্থানান্তরিত করিবার আদেশ দিলেন। সশস্ত্র পুলিশ দল রাজোচিত আতিথ্যে মুগ্ধ হইয়া গোবিন্দ-দোলের শোভাযাত্রার আরও শোভা বৃদ্ধি করিয়াছিল।
২৫. [এই বিগ্রহ বর্তমানে রাজা যতীন্দ্রমোহনের পুত্রগণ কৃর্তৃক বসিরহাটে আনীত হইয়াছে।— শি মি]
২৬. ‘প্রতাপাদিত্যের জীবন-চরিত’, ৬৪ পৃ।
২৭. রাজা রমেশচন্দ্র এখনও জীবিত। ইনি রাজা যতীন্দ্রমোহনের জ্ঞাতি খুল্লতাত। রাজা রমেশচন্দ্রের নিকট এই শিলালিপি ছিল; প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে যখন সত্যচরণ শাস্ত্রী মহোদয় প্রতাপাদিত্যের বিবরণী সংগ্রহ জন্য কাটুনিয়ায় আসেন, তখন তিনি স্বচক্ষে শিলালিপিখানির পাঠোদ্ধার করিয়া স্বীয় গ্রন্থমধ্যে সন্নিবেশিত করেন (১ম সংস্করণ, ৬৪ পৃ)। শাস্ত্রী মহাশয়ের গ্রন্থ হইতেই লিপিটি নিখিলনাথ রায় মহাশয়ের গ্রন্থে ও অন্যান্য স্থলে প্রকাশিত হয়। টাকী নিবাসী ফণিভূষণ বসু মহাশয় এক সময়ে প্রেসিডেন্সী ডিভিসনের স্কুল সমূহের অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর ছিলেন। তিনি রমেশচন্দ্রের ভগিনীপতি এবং শিক্ষিত সমাজে সুপরিচিত। রমেশচন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ ও অন্যান্য পণ্ডিত সমাজে দেখাইবার জন্য শিলালিপিখানি কলিকাতায় লইয়া যান; সকলকে দেখাইবার পর উহা ফণিভূষণ বসু মহাশয়ের কলিকাতার বাসাবাটীতে রাখিয়া আসেন। কিছুদিন পরে ফণিভূষণ বসু মহাশয়ের বাটী পরিবর্তন করিবার কালে (সম্ভবতঃ ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে) উহা অযত্নের ফলে বিলুপ্ত হয়। আর তাহার সন্ধান পাওয়া যায় নাই। উহার উদ্ধারের জন্য আমি রাজা রমেশচন্দ্রের পত্র লইয়া ফণিভূষণ বসু মহাশয়ের দ্বারস্থ হইয়াছিলাম, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। কিভাবে লিপিখানি পাইয়াছিলেন, উহাতে কি লিখিত ছিল এবং পরে উহা তাঁহার নিকট হইতে কি ভাবে বিনষ্ট হয়, তাহার সাক্ষ্য স্বরূপ তিনি আমাকে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন। যে দেশে ফণিভূষণ বসুর মত উচ্চাশিক্ষিত বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির অনবধানবশতঃ এমন একখানি মূল্যবান শিলালিপির বিলয় ঘটে, সে দেশের প্রাচীন ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা যে কত সুদূরপরাহত, তাহা সহজে অনুমেয়।
২৮. উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গের মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এক্ষণে নিবারণচন্দ্র গাইন ও মহাদেব মণ্ডল মহাশয়ের জমির অন্তর্ভুক্ত। নিকটবর্ত্তী জ্ঞান মণ্ডল মহাশয়ের বাড়ীর পার্শ্বে একটি নিম্ন স্থানে ৭টি প্রস্তর স্তম্ভ ছিল। সেগুলি তিন হাত দীর্ঘ। একটি স্তম্ভ একটু কম দীর্ঘ অর্থাৎ ৪ ফুট ছিল। সেইটি আমি লইয়া আসিয়া নিজ বাটীতে রক্ষা করিয়াছি; সুযোগ মত উহা বিশিষ্টভাবে রক্ষা করিবার কল্পনা আছে [উহা এক্ষণে দৌলতপুরে ব্রজমোহন কলেজ গৃহে রক্ষিত আছে— শি মি]। বেদকাশী ও পার্শ্ববর্ত্তী গাবুরা আবাদ এক্ষণে কলিকাতা নিবাসী শিবচন্দ্র মল্লিকের জমিদারীর অন্তর্গত। তথাকার ভূতপূর্ব্ব নায়েব বঙ্কবিহারী দত্ত মহাশয় বড় সদাশয় এবং বিদ্যোৎসাহী। তিনি আমাকে উক্ত স্তম্ভ ও বাসুদেব বিগ্রহের পাদাংশ আনিবার অনুমতি দেন এবং নিজে লোক দ্বারা উহা আমাদের নৌকায় পৌঁছাইয়া দিয়া কৃতজ্ঞতা-পাশে আবদ্ধ করেন। স্তম্ভের সন্নিকটে আমরা কদমের মধ্যে হইতে ৩ ́ × ২ ́-২ ́ ́ বিস্তৃত ও ৯ ́ ́ ইঞ্চি পুরু একখানি পাদপীঠও আবিষ্কার করিয়াছিলাম। ইহা ভিন্ন, জ্ঞান মণ্ডল তাঁহার বাড়ীতে গোলার পৈঠা করিবার জন্য কতকগুলি পাথর ব্যবহার করিতেছেন দেখিলাম। এমন পাথর কত জনে কোথায় লইয়া গিয়াছে, তাহা কে জানে!
২৯. কেহ কেহ এই স্থানের নামকে বেতকাশী বলিয়া বানান করেন, তাহা ঠিক নহে। যেমন বারাণসীর অপর পারে বেদকাশী, তেমনি কাশী তুল্য যশোহরপুরীর পূর্ব্বধারে বেদকাশী। পদকর্তা বসন্ত রায় যে সুকবি ছিলেন, তাহা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি।
৩০. ১ম খণ্ড, ৪১-৫৬ ও ২০২-২০৬ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন