সতীশচন্দ্র মিত্র
সুলেমানের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসন লইয়া যে বিভ্রাট উপস্থিত হয়, তাহার বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি। প্রবীণ সেনাপতি লোদীখার চেষ্টায় সুলেমানের কনিষ্ঠ পুত্র দায়ুদ সিংহাসনে উপবিষ্ট হন (১৫৭৩)। তখনই তিনি পুরাতন বন্ধু ও বয়স্য শ্রীহরি ও জানকীবল্লভকে স্বীয় অমাত্যপদে বরিত করেন। তিনি শ্রীহরিকে ‘বিক্রমাদিত্য’ এবং জানকীবল্লভকে ‘বসন্তরায়’ উপাধি দেন।[১] অতঃপর তাঁহারা এই উপাধিতেই সকলের নিকট পরিচিত হন। সম্ভবতঃ এই সময় হইতে প্রতাপের নাম প্রতাপাদিত্য হয়। বিক্রমাদিত্য প্রধানমন্ত্রী এবং বসন্তরায় খালিসা বিভাগের কর্তা ও কোষাধ্যক্ষ হন।[২] কিন্তু লোদীখাঁই রাজ্যমধ্যে সর্ব্বপ্রধান ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁহারই বুদ্ধিবলে রাজ্য শাসিত হইত।[৩]
দায়ুদ দৈবাৎ পিতৃ-রাজ্যলাভে আত্মহারা হইয়া উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন। তিনি যখন দেখিলেন যে ১,৪০,০০০ পদাতিক, ৪০,০০০ সুসজ্জিত অশ্বারোহী, ৩,৩০০ হস্তী, ২০,০০০ বন্দুক ও কামান এবং বহুশত রণতরী তাঁহার করায়ত্ত আছে, তখনই তিনি উদ্ধত হইয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন।[৪] মোগলদিগকে দেশ হইতে বিতাড়িত করাই তাঁহার উদ্দেশ্য হইল। দায়ুদ কতলু খাঁকে পুরীর শাসনকর্তা করিয়া পাঠাইলেন; পরে লোদীখাঁর পরামর্শে জৌনপুরে জমানিয়ার[৫] মোগল দুর্গ আক্রমণ করিলেন। বাদশাহ আকবর সুলেমানের গতিবিধি লক্ষ্য করিবার জন্য সুযোগ্য সেনাপতি মুনেমখাঁকে জৌনপুরে রাখিয়াছিলেন। দায়ুদের আকস্মিক আক্রমণে মুনেম পরাজিত হইয়া বঙ্গেশ্বরের নিকট পর্য্যন্ত সাহায্য চাহিয়া পাঠাইলেন। তখন আকবর বঙ্গের পাঠান বিদ্রোহের গুরুত্ব বুঝিয়া, মুনেমের সাহায্য জন্য অগণ্য সৈন্য সহ স্বয়ং বঙ্গাভিমুখে যাত্রা করিলেন। ইতিমধ্যে লোদীখাঁ দুইলক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হইয়া মুনেমের সহিত সন্ধি করিলেন। সুলেমানের সহিত মুনেমের বন্ধুত্ব ছিল বলিয়া, এই সন্ধির পথ সহজ হইয়াছিল। কিন্তু লোদীর পূর্ব্বশত্রু কতলুখাঁর পরামর্শে, দায়ুদ তাহার চরিত্রে সন্দেহ করিয়া বিশ্বাসঘাতকের মত লোদীর প্রাণ সংহার করিয়া নিজের সর্ব্বনাশ নিজেই সাধন করেন।[৬] এদিকে সন্ধির প্রস্তাবে অসন্তুষ্ট হইয়া বাদশাহ টোডরমল্লকে। মুনেমের পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠান; সেই সংবাদ পাইয়া এবং লোদীর মৃত্যুতে আশ্বস্ত হইয়া মুনেম গৌড়জয় করিবার জন্য সদর্পে পাটনা অবরোধ করেন। তখন শোণ নদের মোহানায় এক যুদ্ধে পরাজিত হইয়া, দায়ুদ পাটনা দুর্গে আশ্রয় লইতে বাধ্য হন (১৫৭৪)।
এদিকে দূরদর্শী ভবানন্দ মোগলের বিক্রম এবং আকবরের রাষ্ট্রজয়ের সংবাদ জানিতেন। সুলেমানের মৃত্যুর পর যখন রাজতক্ত লইয়া নানা ষড়যন্ত্র চলিতেছিল, তখনই তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, আত্মকলহে লিপ্ত দৃপ্ত পাঠান কখনও মোগলবীরের মুখে দাঁড়াইতে পারিবে না; আজ হউক, কাল হউক, এক ভীষণ দুঃখময় সময় আসিবে; এখনও একটু মাথা রাখিবার স্থান রাখা প্রয়োজনীয়। তখন পরিবারস্থ সকলে পরামর্শ স্থির করিলেন। গুণানন্দ পূৰ্ব্বেই কালপ্রাপ্ত হইয়াছেন; কৰ্ম্মনিষ্ঠ শিবানন্দ এ সব কার্য্যে উদাসীন। ভবানন্দ জানিতেন, দক্ষিণবঙ্গে যমুনার পূর্ব্বপারে সমুদ্রকূল পর্য্যন্ত এক বিস্তৃত ভূভাগ ছিল; প্রাচীন যশোর রাজ্যের অন্তর্গত এই ভূভাগ চাঁদ খাঁ মছন্দরী নামক এক ভূস্বামীর জায়গীরভুক্ত।[৮]
চাঁদ খাঁ নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুমুখে পড়ায় এ প্রদেশের কেহ উত্তরাধিকারী ছিল না। উহা এক নদীবহুল বনাকীর্ণ প্রদেশে অবস্থিত, সুতরাং সহজে দুর্গম। ভবানন্দ এই সন্ধান বাহির করিয়া, উহাই তাহাদের ভবিষ্যৎ ভাগ্যক্ষেত্র বলিয়া স্থির করিলেন। বিক্রমাদিত্য উহা দায়ুদের নিকট যে প্রার্থনামাত্রই পাইলেন, সে কথা বলাই বাহুল্য; সঙ্গে সঙ্গে যশোহর-রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হইতে চলিল। রাজ্য পাইবামাত্র বিলম্ব করিবার উপায় নাই, কারণ মোগল-পাঠানে ভীষণ যুদ্ধ চলিতেছে এবং নিত্য নূতন দুর্ঘটনার সংবাদ আসিতেছে।
ভবানন্দ প্রভৃতি পরামর্শ করিয়া তাহাদের মধ্যে সর্ব্বোপেক্ষা উদ্যমী ও কর্ম্মক্ষম বসন্ত রায়কে চাঁদ খাঁ জায়গীরে পাঠাইলেন। তিনি গঙ্গা হইতে হুগলী-ত্রিবেণীর সন্নিকটে যমুনাতে প্রবেশ করিলেন। তখনকার যমুনা এখনকার যমুনার মত শীর্ণা, ক্ষীণা, শৈবালমণ্ডিতা ক্ষুদ্র নদী নহে; তখন যমুনা প্রবল তরঙ্গশালিনী ক্রমবর্দ্ধিতায়তনী সমুদ্রগামিনী প্রচণ্ড নদী। এখন গোবরডাঙ্গা রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকটে যে ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীর উপর রেলওয়ে পুল রহিয়াছে, তাহাকে যমুনা বলিয়া মনে করা কঠিন হয়; তবে লক্ষ্য করিয়া দেখিলে, সেখানেও যমুনা এক সময়ে একমাইলের অধিক প্রশস্ত ছিল, তাহা বুঝিতে বাকী থাকে না। ক্রমে ঐ নদী দক্ষিণে গিয়া ইচ্ছামতীর প্রবাহ লইয়া আরও প্রবল ও প্রশস্ত হইয়াছে। এখনও হাসনাবাদ প্রভৃতিস্থানে এই যুক্ত-প্রবাহের বিস্তৃতি প্রায় দুই মাইল হইবে। বসন্ত রায় বহুসংখ্যক নৌকা, রসদ এবং লোকজন লইয়া এই যমুনা-পথে চাঁদখা চকে আসিলেন; জঙ্গল কাটিয়া এক নূতন রাজ্য পত্তন করিলেন; কোন প্রকারে গড়বেষ্টিত স্থানে উচ্চভূমির উপর যথাসম্ভব সত্তুরতার সঙ্গে গৃহাদি নিৰ্ম্মাণ করিয়া পরিবারবর্গ তথায় লইয়া আসিলেন। প্রাণের দায়ে এবং অর্থের বাহুল্যে অনেক অসম্ভব সম্ভব হয়; ভবানন্দের পরামর্শে এবং বসন্ত রায়ের কার্য্যদক্ষতায় যাহা সম্ভব, তাহা সুন্দর হইল; আত্মরক্ষার সুন্দর ব্যবস্থা হইল; ভবানন্দ পরিবারবর্গের অভিভাবক হইয়া থাকিলেন; শিবানন্দ এ অঞ্চলে আসিতেই চাহিলেন না। তিনি পূৰ্ব্বনিবাস বালায় গিয়া বসতি নির্দ্দেশ করিলেন।
এদিকে প্রবল মোগল শত্রু দলে দলে, জলে স্থলে অগ্রসর হইতে লাগিল। তখন দায়ুদের ভবিষ্যৎ বুঝিতে বাকী রহিল না। এক সহস্র রণতরী লইয়া সম্রাট আকবর স্বয়ং পাটনায় পৌঁছিলেন গঙ্গার অপর পারে হাজিপুরে আলম খাঁ গিয়া দুর্গ আক্রমণ করিলেন। এ যুদ্ধে স্বয়ং আকবর ও উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধে মোগলেরা জয়লাভ করিল। দুর্গাধ্যক্ষ ও সেনানীগণের ছিন্নশির মোগলেরা নৌকা বোঝাই করিয়া দায়ুদের নিকট পাঠাইয়া দিল। তখন দায়ুদের ভয়ার্ত্ত আমীরগণ মহা গণ্ডগোল তুলিলেন। তাহাদের পরামর্শে পলায়ন বা আত্মসমর্পণই একমাত্র উপায় বলিয়া স্থির হইল। দায়ুদ তাহাতে স্বীকৃত হইলেন না; তিনি বুঝিলেন, ঔদ্ধত্যের ফল ফলিয়াছে; কিন্তু যখন জীবন-নাট্টের শেষাভিনয় নিকটবর্তী, তখন বীরের মত আত্মোৎসর্গই শ্রেয়ঃ। আমীরেরা তাহা বুঝিলেন না; কতলু খাঁ দায়ুদকে মাদক-সেবনে হতজ্ঞান করিয়া তাঁহাকে লইয়া নৌকাপথে পলায়ন করিলেন।[৯] তখন বিক্রমাদিত্য তাঁহার ধনসম্পত্তি নৌকায় বোঝাই করিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনুবর্ত্তন করিলেন।[১০]
বিক্রমাদিত্য পূৰ্ব্বেই নিজ সম্পত্তি এবং পরিজনবর্গ যশোরে পাঠাইয়া ছিলেন। এখন দায়ুদের ধনরত্ন অঙ্কগত হইল। পলায়িত দায়ুদের জ্ঞান হইলে, এ সম্বন্ধে বিক্রমাদিত্যের সহিত তাঁহার অনেক কথা হইল। পলায়ন-পথে সে দুর্ব্বহ ধনভার লইয়া লাভ নাই, কারণ হয়ত তাহা মোগলেরা লুটিয়া লইবে। সুতরাং সমস্ত ধনরত্ন তিনি মন্ত্রী বিক্রমাদিত্যের নিকট এই বলিয়া গচ্ছিত রাখিলেন যে, যদি কখনও মোগলের হাত হইতে বঙ্গদেশ তাহার করায়ত্ত হয়, তবে উহা গ্রহণ করিবেন, নতুবা উহা বিক্রমাদিত্যেরই থাকিল। তবে তাঁহাকে এই বলিয়া প্রতিজ্ঞা করান হইল যে, তিনি কখনও মোগলের পক্ষভুক্ত হইয়া পাঠানের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইতে পারিবেন না এবং এই অর্থভার বঙ্গের স্বাধীনতা এবং পাঠানের প্রভুত্ব রক্ষার জন্যই ব্যয় করিবেন। দায়ুদের তখন মনের ভীষণ অবস্থা; কোথায় তিনি প্রবল যুদ্ধে হারাইয়া মোগলকে তাড়াইয়া দিবেন, আর কোথায় আজ তিনি পরাজিত, লাঞ্ছিত এবং পলায়িত। উড়িষ্যা হইতে পাঠান সৈন্য আসিবার কথা ছিল, দায়ুদ সেই দিকে ছুটিলেন। বিক্রমাদিত্য নৌকাযোগে ধনভার যশোরে পাঠাইলেন
দায়ুদের পলায়নের সংবাদ পরদিন প্রাতে আকবরের নিকট পৌঁছিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ পাটনা দুর্গ অধিকার এবং নগরী লুণ্ঠন করিয়া লইলেন। দায়ুদের সেনাপতি গুজর খাঁ কতকগুলি হস্তিপৃষ্ঠে দ্রব্যাদি দিয়া নিজে দুর্গের পশ্চাদ্ভাগ দিয়া প্রস্থান করিলেন। আকবর মুনেম খাঁকে বাদশাহী সৈন্যের সেনাপতি রাখিয়া স্বয়ং গুজরের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এবং দারিয়াপুরের[১১] সন্নিকটে প্রায় ৪০০ হস্তী হস্তগত করিয়া লইলেন। মুনেম খাঁকে ‘খাঁ খানান্’ উপাধিসহ বাঙ্গালার নবাব করিয়া আকবর শীঘ্রই আগ্রায় প্রত্যাগত হইলেন।
দায়ুদ তাণ্ডায় আসিলেন। তখনও তাঁহার উড়িষ্যার সৈন্য আসে নাই, অথচ মুনেম খাঁ নিকটবর্ত্তী। সুতরাং তিনি আবার উড়িষ্যার দিকে পলায়ন করিলেন; তাণ্ডা বিনা রক্তপাতে মোগলের করায়ত্ত হইল। টোডরমল্ল দায়ুদের পশ্চাতে চলিলেন। উড়িষ্যায় যে পাঠান বল ছিল, তাহা লইয়া জুনেদ খাঁ[১২] টোডরমল্লের দুই দল সৈন্যকে পরাজিত করিলেন। তখন সাহায্যার্থ মুনেম খাঁ আসিলেন এবং জলেশ্বরের নিকটবর্ত্তী মোগলমারী বা তুকারই নামক স্থানে এক ভীষণ যুদ্ধ হইল। এ যুদ্ধে পাঠানবীর গুজর খাঁ অমানুষিক বীরত্ব দেখাইয়াছিলেন; সে বীরত্বের ফলে মুনেম পরাজিত ও আহত হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পাঠান সেনা তাহার অনুসরণ করিতে পারিল না। তখন মুনেম মহাকৌশলে পুনরায় সেনা সমাবেশ করিলে, হঠাৎ তীরের আঘাতে গুজর নিহত হইলেন; দায়ুদের পরাজয় হইল, তিনি আবার পলায়ন করিলেন। এবার টোডরমল্ল তাঁহাকে সবেগে সমুদ্র পর্য্যন্ত অনুসরণ করিয়াছিলেন। তখন দায়ুদ অনন্যোপায়; তিনি মোগলের বশ্যতা স্বীকার করিয়া মুনেমের সহিত এক সন্ধি করিলেন।[১৩] উড়িষ্যা দায়ুদকে দেওয়া হইল; মুনেম আসিয়া বঙ্গবিহারের কর্ত্তা হইয়া গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করিলেন।
কিন্তু সে গৌড় আর নাই। বহুকাল হইতে বাঙ্গালার রাজধানীরূপে মনুষ্যাবাসের ঘনসন্নিবেশবশতঃ গৌড় নানা ব্যাধির আকর-স্থল হইয়াছিল। এজন্যই সের খাঁ বা সুলেমান উহা পরিত্যাগ করেন। মুনেমের সেদিকে লক্ষ্য ছিল না। ফলে অচিরকাল মধ্যে গৌড়ে এক ভীষণ মহামারী উপস্থিত হইল। উহাতে সে প্রাচীন নগরী একেবারে জনশূন্য হইয়া গেল। মুনেম খাঁ স্বয়ং সে করাল ব্যাধিতে প্রাণত্যাগ করিলেন। সংবাদ আকবরের নিকট পৌঁছিলে, তিনি ব্যস্ত হইয়া হুসেনকুলি খাঁকে ‘খাঁ জাহান’ উপাধি দিয়া বঙ্গেশ্বর করিয়া পাঠাইলেন (১৫৭৫); কিন্তু লাহোর হইতে সৈন্য লইয়া খাঁ জাহানের বঙ্গে পৌঁছিতে একটু বিলম্ব হইল। ইত্যবসরে দায়ুদ উড়িষ্যা ও বঙ্গের সামন্তরাজগণের সাহায্যে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া পুনরায় অস্ত্র ধারণ করেন এবং প্রবল বেগে আসিয়া তাণ্ডা অধিকার করিয়া লন। অবশেষে খাঁ জাহান বহু সৈন্য লইয়া বঙ্গে আসিলে, আকমহলের সন্নিকটে উভয়দলে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রক্রীড়া হয়। এই যুদ্ধে দায়ুদের দুই পার্শ্বে কালাপাহাড় ও জুনেদ খাঁ অসাধারণ বীরত্ব দেখাইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। সম্ভবতঃ বসন্ত রায় এ যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন। দায়ুদ প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াও ভাগ্যদোষে পরাজিত হইলেন;[১৪] জলাভূমিতে তাঁহার অশ্বের ক্ষুর ভূমিপ্রোথিত হওয়ায় তিনি ধৃত হন।[১৫] খাঁ জাহানের আদেশে তাঁহাকে হত্যা করা হইল এবং তাহার ছিন্ন মুণ্ড সম্রাটের নিকট প্রেরিত হইল।[১৬] এখানেই বঙ্গের পাঠান রাজত্বের অবসান।
পাদটীকা :
১. সম্ভবতঃ দায়ুদ প্রথমে তাহাদিগকে ‘বিক্রমাদিত্য’ ও ‘বসন্ত রায়’ উপাধি দেন। পরে তাহারা যখন যশোর রাজ্য লাভ করেন, তখন তাহাদের যথাক্রমে মহারাজা ও রাজা উপাধি হইতে পারে। ঘটকেরা লিখিয়াছেন:
‘বসন্তরায়-সংজ্ঞাঞ্চ রাজোপাধিং তথৈব চ
প্রাপুয়াৎ স নরশ্রেষ্ঠঃ সর্ব্বশাস্ত্র-বিশারদঃ।
‘বিশ্বকোষে’র মতে উহারা রাজোপাধি টোডরমল্লের চেষ্টায় বাদশাহের নিকট হইতে পান। নিখিলনাথ বলেন, উহা দায়ূদই দিয়াছিলেন—’প্রতাপাদিত্য’ ৮২ পৃ ও টিপ্পনী ১১, ২১। রামরাম বসুরও ঐ মত। সম্ভবতঃ দায়ুদের প্রদত্ত উপাধি টোডরমল্ল বহাল রাখিয়াছিলেন। [তবকত্-ই-আকবরীতেও দায়ুদের নিকট হইতে ‘রাজা বিক্রমজিত’ উপাধি প্রাপ্তির কথা আছে— Sridhar the Bengali, who was Daud’s great supporter, and to whom he had given the title of Raja Bikramajit… Tabakat-i-Akbart (Elliot ), 1874, Vol. V, p. 373–শি মি]
২. বভুব খালিশাধীশঃ গৌড়কোষাধিপস্তথা’— ঘটককারিকা।
৩. ‘(Ludi khan) was the rational spirt of the eastern provinces and was helpful in promoting the cause of the Afghans’ – Akbarnama (Beveridge), III, p. 97.
৪. Riaz-us-Salatin pp 154-5.
৫. জমানিয়া দুর্গ বা প্রাচীন জমদগ্নি মুনির আশ্রম। উহা এক্ষণে গাজীপুর জেলায় অবস্থিত।
৬. Riaz, p. 156; Tarikh-i-Badauni (Elliot ) . V. p. 512, Tabakat (Elliot ), V. p. 373. রিয়াজের মতে শুধু কতলুর পরামর্শে এবং নিজামউদ্দীনের মতে কতলু ও বিক্রমাদিত্য উভয়ের পরামর্শে দায়ুদ লোদীকে হত্যা করেন। শেষোক্ত মতে লোদীর প্রতি কতলু ও বিক্রমাদিত্য উভয়ের বিদ্বেষ ছিল। যাহাই থাকুক, অন্যায়রূপে লোদীকে হত্যা করা অত্যন্ত অধর্ম্ম ও মূর্খতার কার্য্য হইয়াছিল। লোদীই দায়ুদকে সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন। এই পরামর্শের জন্য বিক্রমাদিত্যের চরিত্র কলঙ্কিত হইয়াছে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রত্যাশায় প্রভুর সর্ব্বনাশ সাধনের মত পাপ আর নাই।
৭. টোডরমল্লের নামের বহুবিধ বানান দেখিতে পাওয়া যায়, – টোডরমল্ল, তোড়লমল্ল, তোডরমল্ল, তোদরমল প্রভৃতি। কিন্তু ‘টোডরানন্দ’ বলিয়া তাঁহার একখানি প্রকাণ্ড সংস্কৃত গ্রন্থ আছে। উহাতে তিনি নিজ নাম টোডরমল্ল বলিয়াই লিখিয়াছেন।—’বিশ্বকোষ’; ৭ম, ৪০৩ পৃ।
৮. ‘দক্ষিণদেশে যশহর নামে এক স্থান বেওয়ারিস জমিদারী দক্ষিণ সমুদ্র সান্নিধ্য চাঁদ খাঁ মছন্দরির জমিদারি ছিল, সে নিঃসন্তান মরিয়াছে…’—রামরাম বসু। মহামতি বিভারিজ অনুমান করিয়াছিলেন,… Chand khan may well have been one of Khanja Ali’s descendants’ (Bakarganj p. 177); কিন্তু হয়ত তিনি জানিতেন না যে, বাগেরহাটের খাঁ জাহান স্বয়ং খোজা বা নপুংসক ছিলেন এবং তিনি নিঃসন্তান। তবে তাঁহার বহু অনুচর বা শিষ্য ছিল। তাঁহার অধিকৃত রাজ্য যে শিষ্য-পরস্পরায় ক্রমে হস্তগত হইতেছিল, তাহা অনুমান করা যায়। যদিও খাঁ জাহানের মৃত্যুর শতাধিক বর্ষ পরে এই চাঁদ খাঁর আবির্ভাব দেখা যায়, তবুও কোন না কোন সূত্রে খাঁ জাহানের সহিত তাহার সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নহে। চাঁদ খাঁ চক্ সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, উহার অধিকাংশ জঙ্গলময়। এই চাঁদ খাঁ নাম হইতেই ভবিষ্যতে প্রতাপাদিত্যের রাজ্যকে বৈদেশিকেরা Chandican বা Ciandecan বলিতেন। সে কথা পরে বলিব। জঙ্গলাকীর্ণ চকের উত্তরাংশ বর্ত্তমান সাতক্ষীরা সহরের কিছু উত্তর দিকে এখনও চাঁদ খাঁ মছন্দরীর বসতি বাটীর নিদর্শন পাওয়া যায়।
৯. ‘At last Katlu gave him (Daud) some narcotic draught, put him in a boat and escaped with him on the river Ganges.’-Twarik-i-Daudi (Elliot). Vol. IV, p. 512. See also, the accoun of Daud in Makhzan-i- Afghnni and Twarikh-i-khan Jahan Lodi. ‘Dawood Khan… embarked in a boat at the water gate after it was dark and retreated towards Bengal’ – Ferishta ( Briggs), Vol. II, p. 245; Dow- Indostan. Vol. II, p. 250. 10.
১০. ‘Sridhar the Bengali who was Daud’s great supporter… placed his valuables and treasure in a boat and followed him.’-Tabakat-i-Akbari (Elliot ), Vol. V. p. 378. ‘Srihari who was Daud’s rational soul was going off rapidly to the country of Catar (Jessore)’-Akbarnama, (Beveridge), Vol. III, p. 172. See also, Al-Badaoni (Lowe). Vol. II. p. 184. ‘গৌড়েশ্বরের সোণারূপা পিত্তল কাঁসা যত কিছু মূল্যবান দ্রব্য ছিল, সমস্তই সহস্রাধিক নৌকা বোঝাই করিয়া দুর্ভেদ্য ও নির্জ্জন যশোহর নামক স্থানে আনিয়া রাখা হইল’–’বিশ্বকোষ’, ১৮শ খণ্ড, ৪৯৩ পৃ। এই সকল উক্তিতে অতিরঞ্জন থাকিতে পারে, কিন্তু ইহা একেবারে অমূলক নহে। প্রবাদের সহিত ঐতিহাসিকের সাক্ষ্যও প্রবল। এ প্রসঙ্গে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (রাখালদাস), ২য় খণ্ড, ৩৭৭ পৃ দ্রষ্টব্য।
১১. বৰ্ত্তমান মোকামাঘাট ষ্টেশনের এক ক্রোশ দক্ষিণে।
১২. ঐতিহাসিক নিজামউদ্দীনের মতে (Elliot, Vol. V. p. 385 ) দায়ুদের খুল্লতাত পুত্র এবং ফেরিস্তার মতে তাঁহার নিজের পুত্র জনৈদ খাঁ।
১৩. Daud was acknowledged as king of Orissa and he gladly exchanged the throne of Bengal for the province of Orissa as a fief of the Moghul Emperor. ‘ — Hunter, Orissa, Vol. II. p. 14. Akbarnama ( Beveridge) III p. 185-5.
১৪. কেহ কেহ বলেন কতলু খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় দায়ুদের পরাজয় ঘটে, Makhzani-i-Afghani (Elliot), IV. p. 513 note.
১৫. Badaoni (Lowe), Vol II, p. 245; Akbarnama, Vol. III, p. 255.
১৬. বাদাউনী বলেন, দায়ুদ বড় সুপুরুষ ছিলেন, তাঁহাকে হত্যা করিতে খাঁ জাহানের ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু আমীরগণের প্ররোচনায় অবশেষে তাঁহাকে হত্যার আদেশ দিতে হইল। — Bad., II, p. 245.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন