সতীশচন্দ্র মিত্র
এইবার আমরা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের কথা বলিব। সময়ানুক্রমে তাঁহার জীবনের ঘটনাবলী বিবৃত করা যায় না; কারণ, সমসাময়িক বা বিশ্বাসযোগ্য লিখিত বিবরণী না থাকিলে, ঘটনার পৌর্ব্বাপর্য্য স্থির রাখা সম্ভব নহে। পূর্ব্বে আমরা কয়েকটি পরিচ্ছেদে তাঁহার যুদ্ধাদির আয়োজনের পরিচয় দিয়াছি। বর্ণিত সকল ঘটনাই যে রাজ্যারম্ভেই হইয়াছিল, এমন কথা নহে; ততগুলি দুর্গ বা নৌ-বাহিনী নিৰ্ম্মাণ বা লোক সংগ্রহ অল্প দিনে হয় না; তবে কখন কোন্ ঘটনা হইয়াছিল, তাহা যখন নির্দ্ধারিত করিয়া বলিবার উপায় নাই, তখন একজাতীয় ঘটনাগুলি একত্র প্রকাশিত করাই ভাল। সেরূপভাবে শ্রেণীবিভাগ করিলে প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝিবার পক্ষে সহজ হয়। আমরাও তাহাই করিয়াছি।
যতদূর বুঝিতে পারা যায়, প্রতাপাদিত্য ১৫৮৭ খৃষ্টাব্দ হইতে রীতিমত স্বহস্তে রাজকার্য্য পরিচালনা করিতে থাকেন। এই বৎসরই তাঁহার ধুমঘাটের দুর্গ নির্ম্মিত হইতেছিল; তাহা অচিরে সম্পন্ন হইল। এই বৎসরই মাতা যশোরেশ্বরীর আবির্ভাব হইল এবং তাঁহার মন্দির নিৰ্ম্মিত হইল। সেই পীঠমূর্তি আবির্ভাবের ফলে তিনি দেবানুগৃহীত বলিয়া আখ্যাত হইলেন। এই দৈব কারণে তাঁহার নিজেরও চরিত্রোন্নতি হইল। তিনি গুরুদেবের নিকট নিয়মমত পূর্ণাভিষিক্ত হইলেন এবং রীতিমত তান্ত্রিক পূজা ও ক্রিয়ানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। এই বৎসরই মহারাণী শরৎকুমারীর গর্ভে তাঁহার প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। মায়ের আবির্ভাবে যে ভাগ্যোদয় হইয়াছিল, তাহার স্মৃতিরক্ষার জন্য তিনি পুত্রের নাম রাখিলেন—উদয়াদিত্য। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, প্রতাপাদিত্যের পূর্ব্বনাম ছিল গোপীনাথ; ভক্ত বসন্ত রায় গোপীনাথের প্রথম পুত্রের নাম রাখিলেন জগন্নাথ। আমরা পরে দেখিব, স্বদেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়া এই পুত্র যথার্থই বংশের নাম উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। নূতন দুর্গ, নুতন ইষ্টদেবতা এবং নবকুমার লাভ এই তিনটি ঘটনার জন্য এই বৎসরটি বিখ্যাত হইয়া থাকিল।
বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু হইতে গত কয়েক বৎসর যাবৎ প্রতাপ ও বসন্ত রায় প্রাচীন রাজধানীতেই বাস করিতেছিলেন। ১৫৮৭ অব্দে ধুমঘাট দুর্গ ও তৎসংলগ্ন আবাসবাটিকাদি নিৰ্ম্মিত হইলে, প্রতাপ সপরিবারে তথায় স্থানান্তরিত হইলেন এবং বসন্ত রায়ের উৎসাহে ও সুব্যবস্থায় তথায় তাঁহার পুনরভিষেক ক্রিয়া সুসম্পন্ন হইল। এই উপলক্ষ্যে বঙ্গদেশের সর্বত্র হইতে ভুঞারাজগণ নূতন রাজধানীতে সমাগত হইলেন। তাঁহাদের অভ্যর্থনার জন্য মহা ধুমধাম হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে ধুমঘাটের নাম দেশে বিদেশে বিজ্ঞাপিত হইয়া থাকিল। প্রতাপ এই সকল ভুঞা- নৃপতিগণের সহিত নূতন রাজনীতির আলোচনা করিতে লাগিলেন; কিরূপে সকলে সমবেত হইলে সকলের সাধারণ শত্রু মোগলকে দেশ হইতে বিতাড়িত করা যায়, ইহাই তাঁহাদের মন্ত্রণার প্রধান বিষয় ছিল। অবশ্য পক্ষভুক্ত পাঠান সর্দারেরা এ বিষয়ে তাঁহাদিগকে যথেষ্ট আশ্বাস ও উৎসাহ দিতেছিলেন। ইহাতে যে শুধু দেশ-মাতৃকার সেবা হইবে, তাহা নহে, স্বকীয় স্বার্থ ও দেশের উন্নতির পন্থাও উদ্ভাবিত হইবে। এ কল্পনায় প্রতাপই নিজের অত্যধিক আগ্রহের পরিচয় দিলেন, কে কে অগ্রণী হইবেন, কোন্ দেশ হইতে কোন্ প্রকার সৈন্য সংগৃহীত হইবে এবং কি ভাবে সমবেতভাবে কাৰ্য্য চলিবে, ইহাই বিষম বিতর্কের বিষয় হইল। কেহ সমুদ্দেশ্য বুঝিয়া সম্মতি দিলেন, কেহ ইহাকে প্রতাপের আত্মা-প্রাধান্য স্থাপনের কৌশল মনে করিয়া স্পষ্ট ভাবে মতামত দিলেন না। যাহা স্থির হইল, তাহা আপাততঃ অপ্রকাশ্য রাখা হইবে, এবং উপযুক্ত আয়োজন করিয়া ভবিষ্যতে দূতের সাহায্যে কার্যপ্রণালী নির্দ্ধারণ করিয়া লওয়া হইবে। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী এই সকল কূটমন্ত্রণায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখাইলেন। তবে বসন্ত রায় এই ব্যাপারে যোগদান করিলেন না; মোগলের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হওয়া তাঁহার অভিপ্রেত ছিল না, কারণ তিনি দেশীয় লোকের শক্তি ও প্রকৃতি বুঝিতেন। প্রতাপ বা তাঁহার সহিত সখ্য-সূত্রে আবদ্ধ দুই এক জনের মনে স্বাধীনতার উন্মেষ হইতে পারে, কিন্তু সমগ্র দেশ না জাগিলে তাহা বিফল হইবে এবং অসময়ে চেষ্টা করিয়া বিফলতা লাভ করিলে ভবিষ্যতের আশাও কিছু থাকিবে না, প্রতাপকে তিনি তাহা বুঝাইলেন, কিন্তু তিনি বুঝিলেন না, বরং খুল্লতাতের প্রতি এই বিরুদ্ধ মতের জন্য আন্তরিক অসন্তুষ্ট হইয়া রহিলেন। বসন্ত রায়ও প্রতাপের ভবিষ্যৎ বিপদ-সঙ্কুল মনে করিয়া নিজে পৃথক হইয়া থাকিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। প্রকাশ্যে কেহ বিশেষ কিছু বলিলেন না, কিন্তু মেঘ ক্রমেই ঘনীভূত হইতে লাগিল। প্রতাপ ধুমঘাটে রাজত্ব আরম্ভ করিলে, বসন্ত রায় গঙ্গাতীরে রায়গড় দুর্গে পরিবারবর্গ স্থানান্তরিত করিয়া, অধিকাংশ সময় তথা হইতেই যশোর রাজ্যের ৬ আনা অংশের শাসনকাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। উৎসবাদি উপলক্ষ্যে কখনও কখনও তিনি যশোহরে আসিতেন।
যুদ্ধ বা রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রতাপাদিত্যের যে চণ্ডমূৰ্ত্তি দেখি, শাসনকালে তাহা ছিল না। তাঁহার মূর্তিতে যে কঠোর ভাব ছিল, তাহা অস্বীকার করা যায় না, সকল যোদ্ধারই তাহা থাকে; আলেকজেণ্ডার, নেপোলিয়ন, প্রতাপসিংহ বা শিবাজী সকলেরই এক কঠোরভাবে ছিল, উহা বীৰ্য্য- প্রতিভার অঙ্গস্বরূপ। দেশের শাসক বীরপুরুষের মুখে যদি স্ত্রীজনোচিত কোমল ভাব বা মধুর ভাষা শুনিতে চাই, অনেক স্থলে তাহাতে নিরাশ হইতে হয়। প্রতাপাদিত্যের কঠোরতার অন্তরালে হৃদয়ের অন্তস্তলে এক অপূর্ব্ব কোমলতা ও মহাপ্রাণতা ছিল; বাহিরে তাহা ন্যায় বিচারে, উদার ব্যবহারে এবং দয়াদাক্ষিণ্যে প্রকাশিত হইয়া পড়িত। বসন্ত রায়ও শিষ্টের পালনে ও প্রজারঞ্জনে দক্ষ ছিলেন, দুষ্টের দমনেও তাঁহার আগ্রহ ছিল, তিনি মিতব্যয়ী, মিতাচারী এবং সহৃদয় ব্যক্তি; ধীর স্থিরভাবে সুবিবেচনায় যাহা করা যায়, তাহা তিনি করিতেন। কিন্তু প্রতাপের প্রতিভা অন্যরূপ; তাঁহার যোদ্ধৃজনসুলভ কঠোর প্রকৃতি মানুষকে শঙ্কান্বিত করিত, তাঁহার শাসন হয়ত কোন কোন স্থলে বড় কঠোর হইয়া যাইত; কিন্তু বহুক্ষেত্রে তাঁহার অসাধারণ উদারতা দেখিয়া লোকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইত। লোকে তাঁহাকে ভয় করিত সত্য, কিন্তু আবার তাঁহার দয়াদাক্ষিণ্যের জীবন্ত দৃষ্টান্ত দেখিলে সকল ভয়, সকল নিন্দা ভাসিয়া যাইত। তাঁহার এই সকল গুণের বহু গল্প এখনও প্রদেশে প্রচলিত আছে। কোন্ সময়ে কোন্ ঘটনা হইয়াছিল, আমরা তাহার আনুপূর্ব্বিকতার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কয়েকটি গল্প এখানে প্রকাশ করিতেছি। এ সকল গল্প অল্পবিস্তর অতিরঞ্জিত হওয়া অসম্ভব নহে; কিন্তু ইহা একেবারে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। দেব-চরিত্রের পরিচয় পাইলেই মানুষে তাহা লোক-শিক্ষার জন্য সম্পত্তির মত ব্যবহার করে এবং উত্তরাধিকার স্বরূপ পরবংশীয়গণের জন্য রাখিয়া যায়। পুরুষ পরম্পরায় উহা উপদেশ দিবার জন্য আলোচনার বিষয় হইয়া থাকে।
অভিষেক বা অন্য কোন উৎসব উপলক্ষে একদিন প্রতাপাদিত্য মহারাণীর সহিত সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকিয়া সমাগত ব্ৰাহ্মণ ভিক্ষুকে স্বর্ণমুদ্রা দান করিতেছিলেন। প্রতাপাদিত্যের নির্দেশ মত মহারাণীই হাতে করিয়া মুদ্রা দিতেছিলেন। দৈবাৎ এক ব্রাহ্মণকে দিবার সময় মহারাণীর হস্ত হইতে দানের মুদ্রা একটি নিম্নস্থ পাত্রে পড়িয়া যায়; তিনি তৎক্ষণাৎ হাত দিয়া পাত্র হইতে একটি মুদ্রা উঠাইয়া দিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে প্রতাপ জিজ্ঞাসা করিলেন, ঠিক যে মুদ্রাটি হস্তস্খলিত হইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক সেইটিই কি তিনি তুলিতে পারিয়াছেন? মহারাণী ইহা নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারিলেন না। তখন প্রতাপ বলিলেন, ‘ব্রাহ্মণকে দিবার জন্য যাহা হাতে করিয়া উঠান হইয়াছিল, তাহা দেওয়াই হইয়াছিল বলিয়া ধরিতে হইবে; যখন তাহা হইতে হস্তচ্যুত মুদ্রাটি খুঁজিয়া পাওয়া গেল না, তখন তিনি কিছুতেই দত্তাপহারী হইতে পারেন না।’ মহারাজ তখন অম্লান বদনে হুকুম দিলেন, ‘পাত্রস্থ সমস্ত মুদ্রা ব্রাহ্মণকে দান কর’। ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের ভাগ্য খুলিয়া চিরদরিদ্রতা ঘুচিল। ব্রাহ্মণ দুই হস্তে আশীর্ব্বাদ করিয়া প্রস্থান করিলেন I
প্রবাদ আছে, দিল্লী বা আগ্রা হইতে এক ভাট কবি ভিক্ষার জন্য যশোহরে আসেন। রাজধানী হইতে প্রতাপের অনুপস্থিতি বশতঃ কিছু দিন অপেক্ষা করিয়া পরে একদা স্থানান্তরে প্রতাপের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া প্রার্থনা জানাইলেন। মহারাজ তাঁহাকে রাজসভায় উপস্থিত হইতে বলিলেন, কিন্তু তিনি আর অধিক দিন বিলম্ব করিতে সম্মত না হওয়ায় অবশেষে তাঁহাকে একটি অশ্ব ও সহস্র মুদ্রা পুরস্কার দিবার আদেশ দেন। ভাট কবি অবাক হইয়া গেলেন, অবশেষে মুক্তকণ্ঠে বলিলেন, ভারতের কোন স্থানে তিনি এমন দানশীলতা দেখেন নাই। সেই অবধি আমাদের দেশে একটা প্রবাদ চলিয়া আসিতেছে, ‘না চাহিতে ঘোড়াটা হল, চাহিলে হাতিটা পেতাম’।[১]
আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বন্দ্যঘটী-বংশীয় কুলীনশ্রেষ্ঠ চতুর্ভুজের পুত্র সবাই ও সুন্দর প্রতাপাদিত্যের সেনানী ছিলেন। সবাই বা সৰ্ব্বানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকগুলি বিবাহ করিয়া বহু কুলীনের কুলরক্ষার হেতু হইয়াছিলেন। সবাই ছিলেন ঢালী সর্দ্দার এবং বিবাহ ব্যাপারে তাঁহার ‘ঢাল মাপা খাই ছিল’, অর্থাৎ তিনি একখানি ঢাল পরিপূর্ণ করিয়া কড়ি না লইয়া কাহারও কন্যার পাণিপীড়ন করিতেন না। তাঁহার ঢাল খানিতে অন্যূন ৯৫০ টাকার কড়ি ধরিত; তিনি বিবাহের পূর্ব্বে এমন বহুজনের নিকট হইতে ৯৫০ টাকা খাইয়া বসিতেন।[২] একদা এক কুলীন ব্রাহ্মণ প্রতাপাদিত্যের রাজসভায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘সবাইকে কন্যা সম্প্রদান না করিলে তাঁহার কুল থাকে না, তিনি উহাকে সম্মত করাইতে না পারিলে রাজবাটীতে জলগ্রহণ করিবেন না।’ প্রতাপাদিত্য তৎক্ষণাৎ সবাইকে ঢাল মাপিয়া টাকা দিয়া সম্মত করিলেন। তখন উপবাসী ব্রাহ্মণ অন্নজল গ্রহণ করিলেন। প্রতাপের দানশীলতা দেশে বিদেশে বিঘোষিত হইল।
প্রবাদ আছে, চাঁচড়ার রাজবংশের পূর্ব্বপুরুষ রত্নেশ্বর প্রতাপাদিত্যের রক্ষিসৈন্য দলের কর্তা ছিলেন। অত্যন্ত বলবান বলিয়া তাঁহার খ্যাতি ছিল। গোপালপুরের মন্দির প্রতিষ্ঠার পর তথায় বহু সহস্র ব্রাহ্মণকে পংক্তি ভোজন করান হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি প্রকাণ্ড খুঁটির উপর সামিয়ানা টাঙ্গান ছিল; এক দিন উহার নিম্নে যখন বহু ব্রাহ্মণ পংক্তি-ভোজনে রসনার সাধ মিটাইতেছিলেন, তখন হঠাৎ দমকা বাতাসে খুঁটিটি ইতস্ততঃ সঞ্চালিত হইতে থাকায় ব্রাহ্মণভোজন বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছিল। রত্নেশ্বর পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি উহা দেখিয়া মহাবিক্রমে খুঁটিটি বুকে জড়াইয়া ধরিয়া অটল হইয়া দাঁড়াইলেন এবং ঝড়ের সহিত যুদ্ধ করিয়া মহারাজের যজ্ঞ রক্ষা করিলেন। প্রতাপ তৎক্ষণাৎ অনুগত বীর সেনানীর কর্তব্যপরায়ণতায় মুগ্ধ হইয়া, রত্নেশ্বরের নাম রাখিলেন— যজ্ঞেশ্বর এবং তাঁহাকে যথেষ্ট পুরস্কার প্রদান করিলেন।[৩]
প্রতাপাদিত্যের কল্পতরু হওয়ার গল্প লোকমুখে শুনিতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ ১৫৯৯ খৃষ্টাব্দে যখন তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখনই এই দানযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তিনি অনেক বিষয়ে প্রাচীন হিন্দু রাজগণের অনুবর্তন করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। সেদিন প্রতাপ ও তাঁহার মহিষী মুক্তহস্তে দান করিতেছিলেন। প্রার্থিগণ যে যাহা চাহিল, তাহাই পাইল। অর্থের ত কথাই নাই, বসন ভূষণ, স্বর্ণ রৌপ্য, ভূমি বা সামগ্রী, হাতি ঘোড়া, যান বাহন, যে যাহা চাহিল, সকলই অকাতরে বিলাইয়া দেওয়া হইল। এমন সময়ে এক ব্রাহ্মণ প্রতাপাদিত্যের দানশীলতার শেষ পরীক্ষা করিবার জন্য মহারাজের নিকট তাঁহার মহিষীকে প্রার্থনা করিলেন। আজ দৌৰ্দ্দণ্ড প্রতাপশালী প্রত্যাপাদিত্য সৰ্ব্বসমক্ষে দান-শৌণ্ডিকতার পরীক্ষা দিবার জন্য দণ্ডায়মান, হিন্দু- নৃপতির নিকট সে পরীক্ষাক্ষেত্র তখন ধর্ম্মক্ষেত্রে পরিণত; ব্রাহ্মণের প্রগল্ভ প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করিবার উপায় নাই; তাহা হইলে যে মহারাজকে নিরয়গামী হইতে হইবে। ক্ষণবিলম্ব না করিয়া প্রতাপ সত্যপালন করিবার জন্য উদ্যত হইলেন। মহিষীও তাঁহার সতী সাধ্বী, প্রকৃত সহধৰ্ম্মিণী; তিনি মহারাজের মুখের পানে চাহিয়া ইঙ্গিত মাত্র ভিখারী ব্রাহ্মণের সমীপবর্ত্তী হইলেন। সমবেত লোক সকল অবাক হইয়া সেই কাণ্ড দেখিতেছিল। এবার ব্রাহ্মণ বড় বিপন্ন হইয়া পড়িলেন, তিনি করযোড়ে নিবেদন করিলেন, ‘মহারাজের দানশক্তি বুঝিবার জন্য আমি এরূপ অসঙ্গত প্রার্থনা করিয়াছিলাম, মহিষী আমার কন্যাস্থানীয়া, আমি পুনরায় মহারাজকে দান করিতেছি। যখন আপনি রাজা, তখন আমার দান গ্রহণ করিতেও আপনি ন্যায়তঃ ধৰ্ম্মতঃ বাধ্য।[৪] প্রতাপ প্ৰথমতঃ সে প্রস্তাব কিছুতেই স্বীকৃত হন নাই; শেষে সভাসদবর্গের শাস্ত্রের ব্যবস্থা মত মহিষীর ভারানুরূপ অর্থ ব্রাহ্মণকে দান করিয়া মহারাণীকে পূর্নগ্রহণ করিলেন। অচিরে এই সকল দানের কাহিনী যশোহর রাজ্যের সর্ব্বত্র লোকসমাজে প্রচারিত হইল। তখনই ভাটমুখে কবিতা রচিত হইয়াছিল :
‘স্বর্গে ইন্দ্র দেবরাজ, বাসুকী পাতালে
প্রতাপ আদিত্য রায় অবনীমণ্ডলে।’[৫]
এই গল্পের কতটুকু সত্য বা অসত্য, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই। তবে এইটুকু বলা যাইতে পারে যে, এমন কবিতা অকারণে রচিত হয় না; তাহা যদি হইত, তবে দেশে অনেক খ্যাতিসম্পন্ন রাজাও আছেন, তাঁহাদের অনেকের নামে এমন কবিতা রচিত হইত। যতদিন এই কাহিনী প্রবাদবাক্যে রক্ষিত হইবে, ততদিন প্রতাপাদিত্যের দানের মহিমা নিষ্প্রভ হইবে না। এই দান শুধু সাধারণ দান নহে, এই দানশীলতার অন্তরালে সেই বঙ্গীয় নৃপতির যে মহাপ্রাণতা এবং কঠোর ধর্ম্মনিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা সকলেরই লক্ষ্য করিবার বিষয়।
এইরূপে যখন প্রতাপাদিত্যের যশোপ্রভা চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইতেছিল, তখন ক্রমে ক্রমে কত পণ্ডিত ও গুণিজন তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছিলেন। তিনিও তাঁহাদের আশ্রয় দান করিতেন এবং যথোচিত বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দিয়া বিদ্যোৎসাহিতার পরিচয় দিতেন। বাদশাহ দরবারে প্রতাপ নিজেই কিরূপে সমস্যা পূরণ করিয়াছিলেন, সে গল্প পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। তাঁহার নিজের রাজসভায় সেইরূপ সমাগত পণ্ডিতেরা সমস্যা পূরণ ও নানাবিধ দার্শনিক তর্ক করিতেন। গুরুদেব কলমনয়ন তর্কপঞ্চানন ইঁহাদের সকলের অগ্রণী ছিলেন; তিনিই সাধারণতঃ দুই পক্ষের শাস্ত্র বিচারে মধ্যস্থতা করিতেন। তবে তিনি অধিক দিন জীবিত ছিলেন না। সম্ভবতঃ ১৫৯৯ খৃঃ অব্দের পূর্ব্বেই তাঁহার মৃত্যু ঘটে। অন্যান্য সভাপণ্ডিতগণের মধ্যে অবিলম্ব সরস্বতী ও কবি ডিমডিম্ সরস্বতী নামক দুই ভ্রাতার কথা শুনিতে পাওয়া যায়। উভয়ই অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। তন্মধ্যে একজন মুখে মুখে বড় দ্রুত কবিতা রচনা করিতে পারিতেন, এজন্য তাঁহার উপাধি হয়— অবিলম্ব সরস্বতী। অন্য জন দর্শনশাস্ত্রে আরও বড় পণ্ডিত হইলেও শ্লোক-রচনার বেলায় ভ্রাতার মত দ্রুত কবি ছিলেন না, এজন্য তাঁহাকে লোক বলিত কবি মিডডিম। এ দুইটি, উপাধি মাত্র, তাঁহাদের প্রকৃত নাম জানা যায় নাই। সরস্বতী উপাধি তাঁহাদের কয়েক পুরুষ হইতে চলিয়া আসিতেছিল।
প্রতাপাদিত্যের যশোকীৰ্ত্তনে মুগ্ধ হইয়া দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট অবিলম্ব সরস্বতী একদিন রাজমণ্ডপে উপস্থিত হইয়া বলিয়াছিলেন :
‘প্রতাপাদিত্য ভূপাল ভালং মম নিভালয়।
স্বেদেন প্রোঞ্ছিতা সন্তু বিধেদুলেখ-পংক্তয়ঃ॥’
হে মহারাজ প্রতাপাদিত্য, একবার আমার কপালের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তুমি আদিত্যস্বরূপ, তোমার দৃষ্টিমাত্র কপালে দর দর ধারায় ঘর্ম্ম বহিবে এবং উহা দ্বারা আমার পোড়া কপালের বিধিলিপি ধুইয়া মুছিয়া যাইবে, অর্থাৎ মহারাজ আপনার কৃপাদৃষ্টি পাইলে আমার দুরদৃষ্ট ঘুচিবে। প্রতাপকে এইরূপে আদিত্য বা সূর্য্য কল্পনা করিয়া তিনি অন্য সময়ে আরও অনেক কবিতা রচনা করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে কবিকলা-কৌশলের গুণে একটি কবিতা এখনও সুধী-সমাজে আত্মরক্ষা করিয়াছে। তাহা এই :
‘দানাম্বুসেক-শীতার্ত্তা যশোবসনবেষ্টিতা
ত্রিলোকী তে প্রতাপার্কং প্রতাপাদিত্য সেবতে।।’
হে প্রতাপাদিত্য, তোমার দানরাশি জলধারাতুল্য শীতল, তাহার সিঞ্চনে ত্রিলোকের লোক শীতার্ত হইয়াছে, এবং শীত নিবারণ জন্য তাহারা তোমার যশোরূপ বস্ত্রদ্বারা গাত্র আবৃত করিয়াছে; অবশেষে তাহাতেও শীত না যাওয়ায়, তুমি প্রতাপ-বলে সূৰ্য্যতুল্য বলিয়া তোমার সেবা করিতেছে। অর্থাৎ তোমার দানশীলতার কীর্তি-কাহিনীতে সমাকৃষ্ট হইয়া সকল লোকে তোমার আশ্রয় লইতে আসিতেছে। বৃত্তিভুক্ পণ্ডিতেরা স্তাবকতা অনেক করিয়া থাকেন, কিন্তু এমন সুকৌশলে কবিতা গ্রথিত করিয়া অতি অল্প কবিই দুই একটি মাত্র শ্লোক দ্বারা প্রসিদ্ধি লাভ করিতে পারেন। যশোহরের কবিচন্দ্র এইরূপ স্বভাব-কবি ছিলেন, অন্যত্র আমরা তাঁহার কথা বলিব। বর্তমান যুগে নবদ্বীপের মহামহোপাধ্যায় অজিতনাথ ন্যায়রত্ন এইরূপ সকল সুন্দর দ্রুত কবিত্বের জন্য খ্যাতি-মণ্ডিত। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, অবিলম্ব সরস্বতীর মত কবির মুখে অজস্র উদ্গীরিত কবিতারাজি একেবারে বিলুপ্ত ও বিস্মৃত হইয়া গিয়াছে। হয়ত তাহার অনেকগুলি উদ্ভটকবিতায় আছে, কিন্তু কোন ভণিতা নাই বলিয়া চিনিতে পারা যায় না। প্রতাপাদিত্যের নাম-সংযোগে এই দুইটি শ্লোক বিশিষ্টতা লাভ করিয়াছে।[৬]
প্রতাপাদিত্য অবিলম্ব ও তাঁহার ভ্রাতার জন্য বৃত্তি নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেন। অবিলম্ব সরস্বতী শুধু কবি নহেন, তিনি পরম ভক্ত ও সাধক এবং সিদ্ধকুলে তাঁহার জন্ম। কথিত আছে, মহাপ্ৰভু চৈতন্যদেবের গুরু কেশব ভারতীর বংশে এই দুই ভ্রাতার জন্ম হয়। প্রতাপের ব্যবস্থামত অবিলম্ব সরস্বতীর প্রধান কাজ ছিল, মাতা যশোরেশ্বরীর মন্দিরে নিত্য চণ্ডীপাঠ। যে কেহ চণ্ডীপাঠ করিতে পারেন না; পাঠের সময় একটি বর্ণাশুদ্ধি বা উচ্চারণ-দুষ্টি ঘটিলে, চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হয় এবং পুনরায় সংকল্প করিয়া আদ্যোপান্ত পাঠ শেষ করিতে হয়। আমরা পরে দেখিব, প্রতাপের পতনের প্রাক্কাল পর্যন্ত এই চণ্ডীপাঠ কার্য্য শুদ্ধ ও শাস্ত্রসঙ্গত ভাবে চালিয়াছিল। যে দিন অবিলম্বের মুখে চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হইল, বারংবার চেষ্টায়ও শুদ্ধপাঠ মুখ নিঃসৃত হইল না, সেই দিন সরস্বতী চণ্ডী বন্ধ করিয়া মায়ের মন্দির পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্ত প্রতাপ নিজের ভাগ্য বুঝিয়া লইলেন এবং অনতিবিলম্বে অখণ্ডনীয় কৰ্ম্মফলে স্বীয় কৰ্ম্ম-জীবনের পরিসমাপ্তি দেখিলেন। সে কথা পরে হইবে, আপাততঃ আমরা সরস্বতী ভ্রাতৃদ্বয়ের বংশ পরিচয় দিবার চেষ্টা করিতেছি।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে কেশব ভারতী নামক এক সন্ন্যাসী কাটোয়ায় বাস করিতেন। ইনি কাশ্যপ গোত্রীয়, সিমলাই গাঞি সিদ্ধ শ্রেত্রিয়। আদি নিবাস হুগলীর অন্তর্গত বৈঁচির নিকটবর্ত্তী সিমলা গ্রাম। মহাপ্রভু ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্রহণ করেন। যতদূর জানিতে পারিয়াছি। কেশব ভারতীর দুই পুত্র ছিলেন— ছাত্রভারতী ও নন্দকিশোর। সম্ভবতঃ নন্দকিশোর অসামান্য মেধার ফলে শতাবধানী উপাধি পান। নন্দকিশোরের রামানন্দ ও রামগোবিন্দ নামে দুই পুত্র হয়। রামগোবিন্দ হুগলীর অন্তর্গত শ্রীবরা গ্রামে বাস করেন; তথাকার ভট্টাচার্য্য্যগণ এবং নদীয়ার সরকার গোষ্ঠী এই বংশীয়। প্রাতঃস্মরণীয় শ্যামাচরণ সরকার ব্যবস্থা- দর্শন প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। রামানন্দের পুত্রের নাম মুকুন্দরাম সরস্বতী। সম্ভবতঃ ইনি বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে যশোহরে আসেন এবং বৃত্তিভোগী হইয়া বর্ত্তমান কালীগঞ্জের উত্তরাংশে নলতার নিকটবর্ত্তী খলসিয়ানী গ্রামে বাস করেন। বিক্রমাত্যি এই মুকুন্দরামকে বিশেষ ভক্তি করিতেন। ইঁহারই নামানুসারে মুকুন্দপুর নাম হইয়াছিল কিনা, তাহা বলিতে পারি না। মুকুন্দরামের পুত্রদ্বয়ের নাম অবিলম্ব সরস্বতী ও কবি ডিমডিম সরস্বতী। প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে অবিলম্ব সরস্বতী অল্পবয়স্ক যুবক ছিলেন এবং তাঁহার পতনের পর তিনি কপোতাক্ষী তীরে সাগরদাঁড়িতে বাস করেন। রায়েরকাঠি প্রভৃতি স্থানের বাসুকী গোত্রীয় রাজবংশের বিবরণী হইতে জানিতে পারি :
‘চৈতন্য দেবের সন্ন্যাস-মন্ত্রদাতা,
কেশব ভারতী ছিল ঠিক যেন ধাতা।
সাগরদাঁড়ি বাসী বটে শ্রোত্রিয় প্রধান,
ব্রাহ্মণ কুলেতে জন্ম সিমলাই গাঞি হন।
সে কেশব ভারতীয় সন্তান সুন্দর
সিদ্ধ পুরুষ অবিলম্ব সরস্বতীবর।
সে মহাত্মার কাছে রাজা রুদ্রনারায়ণ
ভক্তিভরে ইষ্টমন্ত্র করেন গ্রহণ।’[৮]
অবিলম্ব সরস্বতী রুদ্রনারায়ণের পিতৃগুরু ছিলেন। রুদ্রনারায়ণ ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সিদ্ধেশ্বরী কালী প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং উহার পূর্ব্বেই রুদ্রনারায়ণের দীক্ষা হয়। ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতাপের পতনের পর অবিলম্ব সরস্বতী সাগরদাঁড়িতে বাস করেন। এখনও তথায় তাঁহার বাড়ি, সাধন- কালীতলা এবং বুড়া শিব নামক ক্ষুদ্র শিবলিঙ্গ আছে এবং এখনও পার্শ্ববর্তী কপোতাক্ষীর ঘাট বুড়া শিবের ঘাট বলিয়া বিদিত। লোকে বুড়া শিবের মানসা করে এবং প্রবাদ আছে তাঁহার ঘাটে কখনও কুমীর দেখা যায় না। ভারতীবংশীয় কয়েক ঘর এখনও এই গ্রামে বাস করিতেছেন বটে, কিন্তু সিদ্ধপুরুষের গৃহদেবতা বুড়া শিবের পূজাদির যাহা দুর্গতি দেখিলাম, তাহাতে অশ্রু সম্বরণ করা যায় না।[৯] অবিলম্বের কত প্রসঙ্গ যশোহর-খুলনার কত স্থানে শুনিতে পাওয়া যায়। বাগেরহাটের নিকটবর্তী মসিদপুর গ্রামের প্রান্তে ভৈরবকূলে একস্থানে তাঁহার সাধনাসন দেখিতে পাওয়া যায়, উহাকে এখনও ‘অবিলম্ব সরস্বতীর বটতলা’ বলে; গুল্ম-বিজড়িত বৃক্ষ-স্তবকের ঘনচ্ছায়া এখনও সেই নিৰ্জ্জন স্থানটিকে ভীতি সঙ্কুল করিয়া রাখিয়াছে। নিকটবর্ত্তী ব্রাহ্মণ- রাঙ্গদিয়ার একটি গ্রাম্য রাস্তাকে ‘অবিলম্ব সরস্বতীর জাঙ্গাল’ বলে এবং বাজুয়া গ্রামে তাঁহার ভিট্টাও দেখান হয়।[১০]
সাগরদাঁড়ি হইতে অবিলম্বের বংশধর ষষ্ঠীদাস বিদ্যালঙ্কার রায়েরকাঠিতে উঠিয়া যান। ষষ্ঠীদাসের সন্তানগণ রায়েরকাঠি হইতে সাগরদাঁড়ির সম্পত্তির অংশভাগী ছিলেন।[১১]
প্রতাপের পরলোক গমনের পর যখন চাঁচড়া রাজগণ যশোহররাজ বলিয়া পরিকীর্তিত হন, তখন তদ্বংশীয়েরা অবিলম্ব সরস্বতীর বংশধরগণকে গুরুরূপে গ্রহণ করেন। এই সময়ে ভারতীবংশীয়েরা প্রতাপকাটি ও কামালপুর প্রভৃতি স্থানে বসতি করেন। কবি ডিমডিমের বংশধরগণ প্রাচীন খলসিয়ানী ক্রমে পার্শ্ববর্তী চাঁপাফুল প্রভৃতি গ্রামে ও পরে বর্তমান হাওড়া জেলার অন্তর্গত সাখে, চাতরা প্রভৃতি স্থানে বিস্তৃত হইয়া পড়েন।[১২]
পাদটীকা :
১. ‘বিশ্বকোষ’, ১২শ খণ্ড, ২৬৯ পৃ।
২. ভট্টানারায়ণ হইতে ১৭শ পুরুষে চতুভুজ বিখ্যাত কুলীন : তৎপুত্র ১৮ সবাই, লোহাই, সুন্দর। সবাই হইতে ধারা এইরূপ : ১৮ সবাই ― ১৯ কেশব ― ২০ হরিনারায়ণ — ২১ মথুরেশ — ২২ নন্দকিশোর — ২৫ কৃপারাম — ২৩ রত্নেশ্বর — ২৪ নীলকণ্ঠ — ২৬ মুক্তরাম সাং চালিতাবাড়িয়া— ২৭ রামকুমার, ইনি ১২১৭ সালে আলতাপোলে বসতি করেন। তৎপুত্র মৃত্যুঞ্জয় (রায়বাহাদুর), জগজ্জয় প্রভৃতি। ২৮ জগজ্জয় – ২৯ কুঞ্জবিহারী — ৩০ উপেন্দ্র — ৩১ গুরুদাস, পঞ্চানন প্রভৃতি। সবাই বাঁড়ুয্যের ৯৫০ টাকা খাওয়ার প্রবাদ এখনও চলিয়া আসিতেছে। কোন কার্য্যের পূর্ব্বে কেহ বাধ্যবাধকতা করিয়া না ফেলিলে বলিয়া থাকে, ‘আমি কি তোমার ৯৫০ খাইয়াছি যে এই কার্য করিব?’
৩. এই স্থানে যজ্ঞেশ্বর রায়কে পরগণা দানের কথা আছে। তদ্বিষয় আমরা চাঁচড়া বংশের ইতিহাস প্রসঙ্গে বিচার করিব। তবে প্রতাপাদিত্য যে যজ্ঞেশ্বরকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন তাহার প্রমাণ আছে। যশোহর কালেক্টরীর ৩২৪ নং সিদ্ধ নিষ্কর তায়দাদ দেখিলে জানা যায়, রাজা প্রতাপাদিত্য চাঁচড়া বংশের পূর্ব্বপুরুষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে শ্যামরায় ঠাকুরের সেবার্থ ১২৩২৫ বিঘা জমি নিষ্কর দেন। উহা ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব্ববর্ত্তী নিষ্কর বলিয়া দশশালা বন্দোবস্তের সময় বহাল থাকে। মলই, রামচন্দ্রপুর, সৈয়দপুর প্রভৃতি পরগণায় উক্ত নিষ্কর জমি আছে। শ্যামরায় বিগ্রহ এখনও আছেন। চাঁচড়া বাটীতে তাঁহার যে সুন্দর জোড় বাঙ্গালা ছিল, তাহা ভগ্ন হইয়া প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছে, শুধু সম্মুখের একটি মাত্র প্রাচীর আছে। পূর্ব্বপোতার নূতন গৃহে এক্ষণে শ্যামরায়ের পূজা হয়।
৪. ‘বিশ্বকোষ’, ‘২শ গ্ৰন্থ, ‘প্রতাপাদিত্য’ প্রবন্ধ (চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়), ২৬৯ পৃ: রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য’ (মূলগ্রন্থ) ১২৭ পৃ. নিখিলনাথের টিপ্পনী, ১১৫ খৃ।
৫. এই কবিতাটি আগ্রা হইতে আগত জনৈক ভাটের মুখে ব্যক্ত হইয়াছে। বসু মহাশয় ভাটের গল্পটা বড় বেশী অতিরঞ্জিত করিয়া ফেলিয়াছেন। হিন্দুস্তানী ভাটের পক্ষে বাঙ্গলা কবিতা রচনা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। বোধ হয় কোন দেশীয় ভাট বা কবি ইহা রচনা করেন এবং দানশীলতার গল্পের সঙ্গে সর্ব্বত্র প্রচারিত হয়।
৬. বন্ধুবর পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর মহোদয় স্বকীয় ‘উদ্ভট’-সমুদ্র’ নামক সংগ্রহগ্রন্থে অবিলম্ব সরস্বতীর স্বরচিত এই দুইটি মাত্র শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। তবে তাঁহার সংগ্রহসাগরের অন্য রত্নগুলির মধ্যে এই সরস্বতীর সম্পত্তি আর কিছু নাই, এমন কথাও বলিতে পারা যায় না। দুঃখের বিষয়, পূর্ণচন্দ্রের গ্রন্থে অবিলম্বের কোন পরিচয় দেওয়া হয় নাই।
৭. অবিলম্ব সরস্বতীর বংশ বিবরণ সংগ্রহের জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছি। যেখানে তাঁহার বংশীয়গণের সন্ধান পাইয়াছি, সেখানেই নিজে গিয়া বা পত্রদ্বারা বারংবার প্রার্থনা জানাইয়াছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আশানুরূপ সদুত্তর পাই নাই। যশোহর-প্রতাপকাঠি নিবাসী কেদারনাথ ভারতী সাংখ্যাতীর্থ মহাশয় এই বংশীয়। তাঁহার নিকট হইতে বংশবিবরণ পাইবার জন্য বহু চেষ্টা করিয়াও তাঁহার আলস্য ত্যাগ করাইতে পারি নাই। এ দুঃখ রাখিবার স্থান নাই। তিনি একটু চেষ্টা করলে সকল শাখার বিবরণ একত্র করিয়া দিতে পারিতেন। অগত্যা আমার চেষ্টার ফলে যাহা পাইয়াছি তাহার সত্যতা উপযুক্তভাবে পরীক্ষা করিতে না পরিয়াই প্রকাশ করিলাম। যিনি সত্য উদ্ধার করিয়া আমার কোন ভ্রম সংশোধন করিয়া দিবেন, তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞ রহিব।
৮. ‘বাসুকি-কুল গাথা’, ‘বাকলার ইতিহাস’, ২৩৩ পৃ।
৯. ভারতবংশীয় যাঁহারা এক্ষণে সাগরদাঁড়িতে আছেন, তন্মধ্যে ললিতমোহন ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় প্রধান। বুড়া শিবটি কিন্তু দৌহিত্রবংশীয় এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের (যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) গৃহে হীনভাবে পালিত হইতেছেন। সাগরদাঁড়ি কবিবর মাইকেলের জন্মভূমি; তাঁহার স্মৃতিসৌধের নিকটে অবিলম্ব সরস্বতীর বাসভূমিতে তাঁহার বুড়াশিবের জন্য একটি ক্ষুদ্র মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইলে গ্রামের গৌরব বাড়িবে বই কমিবে না।
১০. ভৈরবের অপর পারে কোঁড়ামারা গ্রামে এখন ভারতীবংশীয়েরা বাস করিতেছেন। তন্মধ্যে অক্ষয়কুমার ভারতী মহাশয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। কিন্তু তাঁহার নিজ বংশের ইতিহাসে সম্পূর্ণ উদাসীন।
১১. যশোহর কালেক্টরীর ১২০৯ সালের ১৯৩২৮ নং তায়দাদ হইতে দেখা যায়, ওধনকাটি ডাকনাম রায়েরকাঠি নিবাসী রামজয়, রামলোচন ও মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যদিকের পূর্ব্বাধিকারী প্রপিতামহ কেশবানন্দ সরস্বতীর নামে নেহালপুর সাগরদাঁড়িগ্রামে ৫১ বিঘা নিষ্কর ছিল। উহার অর্দ্ধাংশ এক্ষণে সাগরদাঁড়ির ত্ৰৈলোকানাথ ঘোষ মহাশয় খরিদ করিয়াছেন। সম্ভবতঃ অবিলম্ব-সরস্বতীর প্রপৌত্রের নাম কেশবানন্দ, এবং চাঁচড়ার মনোহর রায়ই কেশবানন্দকে উক্ত নিষ্কর দিয়াছিলেন।
১২. সম্ভবতঃ অবিলম্বের পৌত্র সর্ব্বানন্দ কবিকণ্ঠাভরণ প্রতাপকাটি আসেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র রূপরাম, তৎপুত্র গৌরীকান্ত ও নীলকান্ত। গৌরীকান্ত বিদ্যালঙ্কারের পুত্র রামচন্দ্র শিরোমণি, তৎপুত্র গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন স্বনাম-প্রসিদ্ধ পণ্ডিত কেদারনাথ সাংখ্যবেদান্ততীর্থের পিতা। ইহা আদ্যোপান্ত পণ্ডিতের বংশ। কবি ডিমডিমের ধারায় চাঁপাফুলে রামচন্দ্র তর্কতীর্থ খ্যাতনামা পণ্ডিত। কবি ডিমডিমের একটি ধারা এইরূপ : তৎপুত্র প্রসন্ন সরস্বতী— রামভদ্র— ঘনশ্যাম, কৃষ্ণকিঙ্কর – কাশীনাথ— দুর্গাপ্রসাদ, বিষ্ণুপ্রসাদ; দুর্গাপ্রসাদ— কামাখ্যানাথ, সাং— চাতরা; বিষ্ণুপ্রসাদের বর্ত্তমান নিবাস সালখা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন