৬. নব্য জমিদারগণ

সতীশচন্দ্র মিত্র

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – নব্য জমিদারগণ

চাঁড়া, নলডাঙ্গা, সৈয়দপুর ও সীতারামের ইতিহাস প্রসঙ্গে আমরা অনেকগুলি পরগণার শাসন ও অবস্থা পরিবর্তনের বিবরণ দিয়াছি। পরে রায়েরকাঠি, কাড়াপাড়া, নড়াইল প্রভৃতি জমিদার বংশের পৃথক্ পৃথক্ পরিচয় দিতে গিয়া কতকগুলি পরগণার অধিকার নির্দ্দেশ করিয়াছি। যশোহর-খুলনার মধ্যে আর কয়েকটি প্রধান পরগণার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এস্থলে দিব। এখানে শুধু জমিদারীর বৃত্তান্ত লিখিব এবং সেই সম্পর্কে যশোহরের যেটুকু বংশ-পরিচয় দিবার আবশ্যক হয়, তাহাই দিব । পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে অধিবাসী নব্য জমিদারগণের মধ্যে যাঁহারা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, সেই নড়াইল বংশের কথা বলিয়াছি। খুলনার অধিবাসী জমিদারগণের মধ্যে যাঁহারা সর্ব্ব প্রধান, এখানে সেই সাতক্ষীরা- জমিদার বংশের কথা সৰ্ব্বাগ্রে বলিয়া লইব।

সাতক্ষীরা জমিদার বংশ।। প্রাচীন ঘটককারিকা হইতে দেখা যায়, যে সকল প্রাচীন সপ্তশতী ব্রাহ্মণ-বংশ বহুকাল হইতে রাঢ়ীয় সমাজ-ভুক্ত হইয়া গিয়াছেন তন্মধ্যে কাটানি-গাঞি বলিয়া চিহ্নিত খুলনা জেলার অন্তর্গত সেনহাটি গ্রামের চক্রবর্ত্তী-বংশ কুলক্রিয়া দ্বারা বিখ্যাত।[১] এই বংশীয় বিষ্ণুরাম চক্রবর্ত্তী নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অধীন কর্ম্মচারী ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর (১৭৮২), যখন তাঁহার অধিকৃত পরগণাগুলি বিক্রীত হইতেছিল, তখন বিষ্ণুরাম বুড়ন পরগণা নিলাম খরিদ করিয়া, তদন্তর্গত সাতঘরিয়া বা সাতক্ষীরায় আসিয়া বাস করেন ও রায়চৌধুরী উপাধিধারী হন। তিনি পরে তালা, খাজা প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র সম্পত্তি অর্জ্জন করেন। বিষ্ণুরামের দুই পুত্র, রাধানাথ ও প্রাণনাথ; তন্মধ্যে প্রাণনাথ কৃতী পুরুষ। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যুগে নিলামাদি দ্বারা মলই, ভেরচি, শ্রীপদহা, মগুলঘাট, বালাণ্ডা উখড়া ও জয়পুর (অর্দ্ধাংশ) খরিদ করেন। ইহার মধ্যে মলই প্রভৃতি পরগণা লইয়া চাঁড়ার রাজাদের সঙ্গে প্রাণনাথ রায়ের দীর্ঘকাল ধরিয়া মোকদ্দমা চলিয়াছিল; অবশেষে ১৮৪৮ অব্দে, উহাতে প্রাণনাথই জয়লাভ করেন। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর বাজিতপুর পরগণা নতার ভঞ্জচৌধুরীদিগের হস্তগত হয়, তাঁহাদের অবস্থা মন্দ হইলে ঐ পরগণার ১২ আনা অংশ প্রাণনাথ খরিদ করেন। প্রাণনাথের সময়েই প্রাণসায়র নামক কৃত্রিম খাল খনিত করিয়। সাতক্ষীরা সহরের সহিত বেতনা নদীর সংযোগ করা হয়। রাধানাথের মৃত্যুর পর তাঁহার পঞ্চপুত্র ‘পঞ্চনাথ কমিটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করিয়া পৈতৃক সম্পত্তির পর্যবেক্ষণ করিতেন। এই পঞ্চনাথের মধ্যম দেবনাথ রায় স্বধৰ্ম্মনিষ্ঠ, দেবদ্বিজভক্ত, দেব-চরিত্র লোক ছিলেন।[২] তিনি খুল্লতাত প্রাণনাথের একান্ত প্রিয়পাত্র এবং দক্ষিণহস্ত স্বরূপ ছিলেন। প্রাণনাথের সময়ে তাঁহারই তত্ত্বাবধানে সাতক্ষীরার বাটীতে অন্নপূর্ণা, আনন্দময়ী ও গোবিন্দদেব এবং কালভৈরব প্রভৃতি বিগ্রহের জন্য সুন্দর সুন্দর দেবমন্দির ও রাসমঞ্চ নির্ম্মিত হয়। অন্নপূর্ণার মন্দির দেশপ্রসিদ্ধ। দেবনাথই সাতক্ষীরা সহরের সৌষ্ঠব বৃদ্ধির জন্য ছায়াবৃক্ষ সমন্বিত রাস্তা প্রস্তুত করেন, দীর্ঘিকা খনন করাইয়া তাহার কূলে দোলমঞ্চ, টাউনহল ও অতিথিশালা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সকল গৃহে এক্ষণে ‘প্রাণনাথ হাই স্কুল’ চলিতেছে। দেবনাথের মৃত্যুর পর পঞ্চনাথ কোম্পানির বিষয়াংশ যখন ব্যবস্থাদোষে বিক্রীত হইতে থাকে, তখন উহার কতকাংশ মহারাজ দুর্গাচরণ লাহা, রাজা দিগম্বর মিত্র ও দিঘাপাতিয়ার রাজার হস্তগত হয়, কতকাংশ প্রাণনাথের পৌত্র গিরিজানাথ ক্রয় করেন। গিরিজানাথ ও তাঁহার ভ্রাতা সতীন্দ্রনাথের জমিদারী একত্রযোগে সংরক্ষিত হইতেছে এবং তাহার ম্যানেজার আছেন মুকুন্দপুর নিবাসী লক্ষ্মণচন্দ্র রায় (১ম অংশ, ১৬শ পরিচ্ছেদ)। এই সম্পত্তির হস্তবুদ প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। গিরিজানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র শৈলজানাথ কৃতবিদ্যা, অধ্যবসায়ী, উন্নতমনা জমিদার; তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হইয়া দেশের সেবা করিতেছেন।

সাতক্ষীরা জমিদার বংশ

 ১. হোগলা পরগণা

লপুরের কাশ্যপ চৌধুরী-বংশ ॥ খুলনা জেলার পূর্ব্বাংশে হোগ্‌লা একটি বিস্তীর্ণ পরগণা। ইহাও সুন্দরবনের একাংশে অবস্থিত; লোনা মুল্লুকে নদী বা খালের কূলে যেখানে সেখানে হোলা গাছের অত্যধিক প্রাদুর্ভাব বশতঃ এই পরগণার হোগলা নাম হইয়াছে। খাঁ জাহান আলির আমলে এই পরগণার যতখানি আবাদ হইয়াছিল, তিনি তাহা দখল করেন। তাঁর মৃত্যুর (১৪৫৯ খৃঃ) পর উহা কাহার অধিকারে আসে, জানা যায় না। পরে সম্ভবতঃ হুসেন সাহের রাজত্বের প্রারম্ভে (আনুমানিক ১৫০০ খৃষ্টাব্দে) রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ সুরেশ্বর চট্টোপাধ্যায় হোলা, নিকলাপুর ও জয়পুর পরগণার জমিদার হইয়া হোলার অন্তর্গত লখপুর গ্রামে আসিয়া বাস করেন। তখন তাঁহার ‘রায় চৌধুরী’ খেতাব হয় এবং সাধারণ লোকে তাঁহাকে ‘মহারাজ’ সুরেশ্বর বলিয়া জানিত। উপাধিটি লৌকিক মাত্র, উহা গৌড়াধিপ কর্তৃক প্রদত্ত নহে। সুরেশ্বরের বংশধরগণ হোলার বা ‘লপুরের কাশ্যপ চৌধুরী’ বলিয়া খ্যাত। এই বংশীয়েরা সকলেই ধর্ম্মানুষ্ঠানে, বিদ্যোৎসাহিতার জন্য এবং জনহিতকর সৎকর্মে অবস্থার অতিরিক্ত অর্থব্যয় করিয়া স্বজাতি সমাজে অশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন। সুরেশ্বরের অধস্তন ৭ম পুরুষ রাজবল্লভ রায় চৌধুরী সর্ব্বশাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন, এজন্য তাঁহার নাম হয় বিদ্যাধর। অতিরিক্ত বিদ্যাচর্চ্চার জন্য বিষয়-বিভ্রমেই হউক, বা যে কোন কারণে হউক, তাঁহার জমিদারীর রাজস্ব বাকী পড়ে। তখন সম্ভবতঃ মুর্শিদকুলি খাঁ বঙ্গের সুবাদার; তিনি কি ভাবে কড়াকড়ি করিয়া রাজস্ব সংগ্রহ করিতেন, তাহা সকলে জানেন। বিদ্যাধর মুর্শিদাবাদে নীত হইয়া তখনকার রীতি অনুসারে শাস্তি ভোগ করেন। গল্প আছে, তাঁহাকে প্রচণ্ড রৌদ্রে দণ্ডায়মান করিয়া রাখা হয়; কিন্তু হয়ত তাঁহার ভক্তি-মাহাত্ম্যে আকাশ অকস্মাৎ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া তাঁহাকে ছায়াদান করে। মুর্শিদকুলি খাঁ উহা দেখিয়া তাঁহাকে নিষ্কৃতি ত দিলেনই, অধিকন্তু তাঁহার ধর্মনিষ্ঠার পুরস্কার স্বরূপ হোগলা পরগণা হইতে একটি পৃথক্ তালুক সৃষ্টি করিয়া তাঁহাকে প্রদত্ত হইল। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ প্রতিগ্রহে অসম্মত হইলে, ঐ তালুক সামান্য করে তাঁহার সহিত বন্দোবস্ত হইল। ঐ তালুকের নাম ‘ছায়াপতি তালুক’, এখনও উহা লপুরের চৌধুরীগণ ভোগ করিতেছেন।[৩]

বিদ্যাধরের পুত্র রাজারাম ও মহাদেবের মধ্যে সম্পত্তি ১০ আনা ও ৬ আনায় বিভক্ত হয়। পার্শ্ববর্ত্তী বল্লভপুর নিবাসী পরশুরাম বসু উহাদের দুই ভ্রাতার পক্ষে মুর্শিদাবাদ নবাব সরকারে মোক্তার ছিলেন; কথিত আছে, তিনি প্রেরিত রাজস্ব সময়মত জমা না দিয়া নিজ নামে হোগলা পরগণা বন্দোবস্ত করিয়া লন। তাঁহার পৌত্র কল্যাণ ও কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্দান্ত অত্যাচারে চৌধুরীগণ লঙ্গুর হইতে বিতাড়িত হইয়া নিকটবর্ত্তী জাড়িয়া গ্রামে বাস করেন; তথায় এখনও তাঁহাদের বাড়ী ও দেবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। কিন্তু অত্যাচারের ফল বেশী দিন বিলম্বিত হয় নাই। কল্যাণনারায়ণের জীবদ্দশাই বাকী করের জন্য হোগলা জমিদারী হস্তচ্যুত হইয়া যায়। তখন কাশ্যপ চৌধুরী-বংশীয় রাজারামের পুত্র কেশবরাম ও মহাদেবের পুত্র অনন্তরাম এই দুইজনে বহু চেষ্টার পর (আঃ ১৭৫৮ খৃঃ) হোলার অর্দ্ধাংশ মাত্র পুনরায় বন্দোবস্ত করিয়া লইতে পারিয়াছিলেন; অপর অর্দ্ধেক বেলফুলিয়া পরগণার তদানীন্তন ক্ষত্রিয় জমিদার কৃষ্ণসিংহ রায়ের নামে বন্দোবস্ত হয়। কেশবরামকে নষ্ট পরগণা দখল করিবার জন্য যথেষ্ট গণ্ডগোলে পড়িতে হইয়াছিল, বসুচৌধুরীগণ সহজে দখল দেন নাই। এই কারণে যে অতিরিক্ত অর্থব্যয় হয়, তজ্জন্য কেশবরাম প্রভৃতি নিজের অর্দ্ধাংশ অর্থাৎ সমগ্র পরগণার সিকি অংশ উক্ত কৃষ্ণসিংহ রায়ের জনৈক জ্ঞাতি মুড়াগাছার অন্তর্গত পাটদহ নিবাসী জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ রায়কে বিক্রয় করেন। যে সিকি অংশ অবশিষ্ট ছিল, তাহাও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বাকী করে নিলাম হওয়ায় ভূকৈলাসের রাজা বাহাদুর, কালীশঙ্কর ঘোষাল খরিদ করেন। তাঁহার নিকট হইতে ঐ চতুর্থাংশ রেণী সাহেবের হাতে আসে এবং পরে সম্প্রতি নড়াইলের বাবুরা উহার মালিক হইয়াছেন। সেকথা পরে বলিতেছি।

লখপুর চৌধুরী-বংশের দুই একটি ধারা

[“মহারাজ] সুরেশ্বর চট্টোপাধ্যায়-পশুপতি-বেদগর্ভ-রামচন্দ্র-মহেন্দ্রদেব-কমলাকান্ত-রাজবল্লভ (বিদ্যাধর) রায়চৌধুরী।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী

পীলজঙ্গের বসু চৌধুরী ॥ দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ, মাহিনগরে বসুবংশীয় ১৯ পৰ্যায়ভুক্ত কুলীন পরশুরাম বসু কাশ্যপ চৌধুরীগণের চাকরীসূত্রে লপুরের পার্শ্বস্থ বল্লভপুর গ্রামে বাস করেন, তথায় তাহার বাটীর ভগ্নাবশেষ আছে। পরশুরাম কিরূপে হোগলা পরগণা পান, তাহা বলিয়াছি। এইরূপে বাজিতপুর পরগণারও কতকাংশ তাঁহার হস্তগত হয়। এই দুই সম্পত্তি তিনি দুই পুত্রের মধ্যে বণ্টন করেন। দেবী প্রসাদ বাজিতপুরের অংশভাগী হইয়া সেখানে যান এবং রামপ্রসাদ তাঁহার দুই স্ত্রীর জন্য বল্লভপুর ও পীলজঙ্গে দুই বাড়ী নিৰ্ম্মাণ করেন। এক স্ত্রীর গর্ভজাত রামচন্দ্র (অন্য নাম কল্যাণনারায়ণ) ও উদয়নারায়ণ পীলজঙ্গে ছিলেন এবং তাঁহাদের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কৃষ্ণচন্দ্র ও জয়চন্দ্র বল্লভপুরের বাটীতে থাকিতেন। তথায় তাঁহাদের শিবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। কল্যাণনারায়ণ ও কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত অত্যাচারী ছিলেন; কিন্তু অল্পদিন মধ্যেই তাঁহাদের ভাগ্য বিপর্য্যয় হয়, সে কথা বলিয়াছি। কল্যাণনারায়ণ ১১৬৫ সালে (১৭৫৮ খৃঃ) শিব-প্রতিষ্ঠার জন্য যে সুন্দর মন্দির নির্ম্মাণ করেন, তাহা এখনও আছে। শিব-প্রতিষ্ঠা হয় নাই, এই সময়েই তাঁহাদের জমিদারী যায়। রাজারাম ও মুনিরাম নামে পরশুরামের আরও দুই ভ্রাতা ছিলেন; তাঁহারা হোগলা জমিদারীর অংশ পান নাই। উঁহারা পূর্ব্বেই বল্লভপুর হইতে নওয়াপাড়ায় আসিয়া বাস করেন। রাজারামের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ বসু পিপুলবুনিয়া তালুক (খুলনার ৪৫৬ নং তৌজি) খরিদ করেন। তদবধি এই বংশীয়েরা ‘তালুকদার বসু’ বলিয়া খ্যাত; পীলজঙ্গশাখার মত ইঁহাদের রায়চৌধুরী উপাধি নাই।

পরশুরাম বসু

ক্ষত্রিয় জমিদার বংশ।। বেলফুলিয়া পরগণার জমিদার কৃষ্ণসিংহ রায়চৌধুরী হোগলার অর্দ্ধাংশ খরিদ করেন, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। তাঁহারই সহিত ঐ অংশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। তাঁহার মৃত্যুর পর ঐ জমিদারী তদ্বংশীয় গঙ্গানারায়ণ রায়ের হস্তে আসে। ইনি মুড়াগাছা হইতে কলিকাতায় ভবানীপুরে বাস করিতেছিলেন। এখনও মুড়াগাছায় এই জমিদারদিগের বাড়ী ঘর আছে এবং পৰ্ব্বানুষ্ঠান হয়। গঙ্গানারায়ণ তাঁহার দুইপুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্গাপ্রসাদকে ১০ আনা ও কনিষ্ঠ তারাপ্রসাদকে ৬ আনা অংশ দিয়া যান। তারাপ্রসাদের পুত্র হরপ্রসাদ ও পরে তৎপুত্র বরদাপ্রসাদ ৬ আনা অংশ ভোগ করিতেছেন। দুর্গাপ্রসাদের ১০ আনা অংশ তাঁহার তিন পুত্রের মধ্যে সমভাগে বিভক্ত হয়, তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ শ্যামাপ্রসাদের পুত্র রমাপ্রসাদ ৩ আনা ৪ গণ্ডা অংশভাগী আছেন; উঁহার অংশকে হোলার বড়-জিলা বলে। দ্বিতীয় পুত্র হরিপ্রসাদ জীবিত আছেন, কিন্তু তিনি তাঁহার অংশ বরদাপ্রসাদকে পত্তনী দিয়াছেন। তৃতীয় পুত্র কালীপ্রসাদের অংশ কলিকাতা নিবাসী দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায় খরিদ করেন ও তিনি সে সম্পত্তি হরপ্রসাদকে পত্তনী দেন। সুতরাং বরদাপ্রসাদ পৈতৃক ৬ আনা বাদে পত্তনী ৬ আনা ৮ পাই অংশেরও অধিকারী আছেন। বরদাপ্রসাদের অংশকে হোলার ছোট-জিলা বলে। ইঁহাদের উভয় সরিকের কাছারী বাটী পূৰ্ব্বে পাঁচআনী গ্রামে ছিল, এখন উহা মানসায় আসিয়াছে। সমগ্র হোগলা পরগণার অর্দ্ধাংশ লইয়া বড়-জিলা ও ছোট-জিলা গঠিত। অপর ৪ আনা অংশ রামনগর নিবাসী ঘোষ চৌধুরীদিগের সম্পত্তি। তাঁহাদেরও কাছারী মানসায় আছে, তাহাকে হোগলার মেজ-জিলা বলে।

রামনগরের ঘোষ চৌধুরী বংশ। উত্তর রাঢ়ীয় কুলীন কায়স্থ সৌকালীন গোত্রীয় কৃষ্ণদুলাল ঘোষ বৰ্দ্ধমান জেলায় দাঁইহাটের নিকটবর্ত্তী জগদানন্দপুরে বাস করিতেন। তাঁহার কন্যার সহিত চাঁড়ার রাজা শ্রীকণ্ঠ রায়ের বিবাহ হয়। সেই সূত্রে তিনি চাঁড়ার সন্নিকটে ভৈরব-তীরে রামনগরে আসিয়া বাস করেন এবং রাজারা ইমাদপুর পরগণার মধ্য হইতে রামনগর, বলরামনগর, তালবেড়িয়া প্রভৃতি খারিজা তালুক সৃষ্টি করিয়া কৃষ্ণদুলালের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেন। কৃষ্ণদুলাল যশোহর-কালেক্টরীর সেরেস্তাদার ছিলেন এবং পরে তৎপুত্র রাধামোহন ঐ চাকরী পান। তখন এ সকল চাকরীতে ‘দু-পয়সা’ ঘরে আসিত, পিতাপুত্রে যে অর্থ সঞ্চয় করেন, তদ্বারা সুযোগমত সম্পত্তি ক্রয় করিয়াছিলেন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি; হোগলা পরগণার চতুর্থাংশ কাশ্যপ চৌধুরীদিগের নিকট হইতে মুড়াগাছার জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ রায় খরিদ করেন; তৎপুত্র বৈদ্যনাথ রায় (১২০১ সালে) একখানি কবচপত্র দ্বারা ঐ সম্পত্তি রাধামোহন ঘোষচৌধুরীকে হস্তান্তর করেন। এইরূপে বেলফুলিয়া পরগণার ৪ আনা অংশ এবং ইশপপুর পরগণার তরফ সেনহাটি প্রভৃতি ইঁহাদের হস্তে আসে। রাধামোহনের ছয় পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ গোবিন্দসেবক নিঃসন্তান মারা যান; অপর পাঁচ পুত্রের মধ্যে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি সমভাবে বিভক্ত হয়। চতুর্থ নৃসিংহদেবের একমাত্র পুত্র বলহরি ঘোষচৌধুরী ক্ষমতাশালী জমিদার ছিলেন, তাঁহারই সময়ে বর্তমান রামনগরের সুন্দর অট্টালিকা নির্মিত হয়। এখন তাঁহার দত্তক পুত্র গোপালহরি জীবিত আছেন। তিনিও বৎসরের অধিকাংশ সময়ে কলিকাতায় বাস করেন। ম্যালেরিয়া জর্জরিত রামনগরের রম্য হৰ্ম্মাদি জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িতেছে। রাধামোহনের সময় যে রাধাগোবিন্দ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয়, রামনগরের বাড়ীতে উহার নিত্য ভোগরাগ চলিতেছে। সম্পত্তির অধিকারী পাঁচ পুত্রের বংশধরদিগের মধ্যে গোপালহরি হোগলা পরগণায় তাঁহার পৈতৃক ৩ আনা ৪ গণ্ডা ব্যতীত অন্য সরিকদিগের একজনের জমিদারীর ১৬ গণ্ডা এবং অপর দুইজনের পত্তনী ১ আনা ১৭ গণ্ডা ১ কড়া ১ ক্রান্তি অংশ ভোগ করিতেছেন। অর্থাৎ তাঁহার অংশে মোট ৫ আনা ১৭ গণ্ডা ১ কড়া ১ ক্রান্তি দাঁড়াইয়াছে। কনিষ্ঠ পুত্র রামকৃষ্ণের পুত্রবধূ ব্রজভামিনী ৩ আনা ৪ গণ্ডা অংশ পৃথক্ আদায় করেন। অপর সরিকগণের ৬ আনা ২ গণ্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্তি অংশ ঘাটভোগ নিবাসী শ্ৰীমন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং ১৬ গণ্ডা অংশ ত্রৈলোক্যনাথ চট্টোপাধ্যায় খরিদ করিয়াছেন।

হরিপ্রসাদ ঘোষ

রেণী সাহেব ॥ হোলার চতুর্থাংশ ভূকৈলাসের রাজা, কালীশঙ্কর ঘোষাল খরিদ করেন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বরিশালে গুরুধামে উহাদের কাছারী ছিল (৪৭শ পরিচ্ছেদ)। এই স্থানে এক সময়ে কামরুল (Camarul) সাহেব ম্যানেজার হইয়া আসেন। তিনি পূর্ব্বে কলিকাতায় গবর্ণমেণ্ট আফিসে কেরাণী ছিলেন, তাঁহাকে সাধারণতঃ কামরুল কেরাণী বলা হয়। ইঁহার স্ত্রীর নাম মারগারেট্ ও একমাত্র সন্তান, পরমাসুন্দরী কন্যার নাম বারবারা (Miss Barbara), উহার সহিত রেণীসাহেব (William Henry Sneyd Rainey) নামক একজন সৈনিকের বিবাহ হয়। গুরুধামে আসিবার পর বিবি মারগারেটের সহিত প্রণয়সূত্রে রাজা কালীশঙ্কর নিজ সম্পত্তি হোগলা পরগণার ৪ আনা অংশ উহাকে খোস কোবালায় লিখিয়া দেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বারবারা ঐ সম্পত্তি পান এবং রেণী তাহার ট্রাষ্টী হন। এই সময়ে রেণী লখপুর ও রামনগরের জমিদারগণের নিকট হইতে কয়েকটি পত্তনী বন্দোবস্ত করিয়া লইয়া তালিবপুরে আসিয়া বাস করেন এবং নীল ও চিনির ব্যবসায়ে নিযুক্ত হন। সে কথা পরে বলিব; এখানে শুধু তাঁহার সম্পত্তির পরিণতির কথা লিখিতেছি। বিবি বারবারার গর্ভে রেণী সাহেবের ৩টি পুত্র (John Rod. Henry James ও William Arthur Rainey) এবং ৩টি কন্যা (Ellen Margaret, Emilie Barbara এবং Isabella Mat:lda Rainey) হয়। ইহার মধ্যে মধ্যম পুত্র বা মেজ সাহেব হেরী জেমস্ রেণী বিখ্যাত লেখক ও শিকারী ছিলেন। সুন্দরবনের প্রকৃতি ও ভূবৃত্তান্ত তাঁহার জানা ছিল। এ দেশের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে তাঁহার যে অধিকার ছিল, ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রের বহু গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধে তিনি তাহার পরিচয় দিয়াছেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জ্যন চরিত্রবান লোক ছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তিনিই সম্পত্তির ট্রাষ্টী হন। তাঁহার বিশেষ পরামর্শে এবং গরিব হইয়া যাইবার আশঙ্কায়, ভ্রাতা ভগিনীগণের মধ্যে কেহই বিবাহ করেন নাই। ১৮৮২ অব্দে জ্যন ও হেরী এই মৰ্ম্মে প্রত্যেকে উইল করেন যে, একজন মারা গেলে অন্যে তাঁহার সম্পত্তি পাইবেন, উভয়ে মারা গেলে গবর্ণমেণ্টের পক্ষ (Administrator General of Bengal) হইতে দখল লইয়া ৬ এবং ৫ অংশ উঁহাদের ভগিনীদিগকে দিয়া অবশিষ্ট ৬ এর ১ অংশ জনহিতকর কার্য্যের জন্য Calcutta District Charity Society নামক সমিতিকে দিবেন। সর্ব্বাগ্রে হেনরী ও পরে এমিলি ও ইসাবেলা মারা গেলেন। শীঘ্র জ্যনও তাঁহাদের অনুবর্ত্তন করিলেন। থাকিলেন মাত্র উইলিয়ম ও এলেন। জ্যনের মৃত্যুর পর খুলনার জজ্ ও ম্যাজিষ্ট্রেট গবর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে সম্পত্তি গ্রহণ করিলেন। উইলিয়ম তখন অনন্যোপায় হইয়া মোকদ্দামা করিয়া দুই ভ্রাতা ভগিনীতে তুল্যাংশে সম্পত্তির ১৫ এর ৮ অংশ পাইলেন, অবশিষ্ট ১৫ এর ৭ অংশ গবর্ণমেন্টের হাতে গেল। মোকদ্দমাকালে উইলিয়ম গতাসু হওয়ায় উভয়ের অংশ এলেন পাইলেন এবং তিনি উহা ৮০,০০০ টাকা মূল্যে এবং তাঁহার জীবদ্দশায় ২০০ টাকা মাসহারা পাইবার সর্ত্তে নড়াইলের জমিদার রায় বাহাদুর কিরণচন্দ্র রায় এবং বাবু ভবেন্দ্রচন্দ্র রায়দিগকে বিক্রয় করিয়াছেন। উক্ত বাবুরা গবর্ণমেন্টের হস্তন্যস্ত অপরাংশও পরে ৭০,০০০ টাকা পণে খরিদ করিয়াছেন। এই উভয় পণসমষ্টি ১,৫০,০০০ টাকার সুদ হইতে গবর্ণমেণ্ট এক্ষণে চেরিটি সোসাইটিকে সাহায্য করিতেছেন। রেণী সাহেবের যাহাই অকীৰ্ত্তি থাকুক, তাঁহার পুত্রকন্যাদিগের এই জন-হিতৈষণার সুকীর্ত্তি চিরকাল ঘোষিত হইবে।

২. সুলতানপুর-খড়রিয়া পরগণা

এই পরগণা কিরূপে প্রতাপাদিত্যের সময় বৈদ্যবংশীয় জানকীবল্লভ মজুমদারকে প্রদত্ত হয় ও পরে তাঁহার অধস্তন ৭ম পুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রভৃতি জমিদারদিগের সময় বাকী খাজনার জন্য ঐ পরগণা গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়া কাশীনাথ দত্তচৌধুরীর সহিত বন্দোবস্ত হয়, সে কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (৪৭শ পরিচ্ছেদ)। এই কৃষ্ণচন্দ্র উত্তরাধিকারসূত্রে ১০ আনা অংশী ছিলেন; অপর ৬ আনা অংশী হরিপ্রসাদের পুত্রদ্বয়ের একজনের ৩ আনা অংশও কৃষ্ণচন্দ্রের অধিকৃত হয়। অপর পুত্র ভৈরবচন্দ্র অবশিষ্ট ৩ আনা অংশীদার হন। ১১৭৫ সালের ২৬শে অগ্রহায়ণ তারিখে (১৭৬৮ খৃঃ) কৃষ্ণচন্দ্র ও ভৈরবচন্দ্র রায় আপোষে এক একরার-নামা দ্বারা ১৩ আনা ও ৩ আনা অংশ বাটোয়ারা করিয়া লন। ঐ দলিলে নলধানিবাসী শিবরাম ভঞ্জ সাক্ষী ছিলেন। জমির অবস্থা ভাল ছিল না, তাহাতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য অজন্মা দোষে প্রজার খাজানা আদায় না হওয়ায় জমিদারের রাজস্ব বাকী পড়ে। তখন যশোহরের কালেক্টর মালিকের বিরুদ্ধে রেভেনিউ বোর্ডের নিকট রিপোর্ট করেন। তখন কলিকাতা-হাটখোলানিবাসী কাশীনাথ দত্তচৌধুরী প্রথমতঃ দুই বৎসরের বাকী খাজানা গছানি দিয়া ১৭৭৪, ১৬ই মে তারিখে ওয়ারেন হেষ্টিংসের নিকট হইতে এই পরগণা বন্দোবস্ত করিয়া লইবার হুকুম পান। ৩ আনা অংশের মালিক ভৈরবচন্দ্রের সম্পত্তি আপোষে পৃথক্ হইলেও কোম্পানি ১৬ আনা কাশীনাথের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেন। ১৭৮৯ পর্যন্ত মেয়াদী বন্দোবস্ত চলিয়া পরে কাশীনাথের নামেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়।

নলধার ভঞ্জচৌধুরীগণ।। পূর্ব্বে নতার বিজয়রাম ভঞ্জচৌধুরীর বিবরণ প্রসঙ্গে আমরা দক্ষিণ রাঢ়ীর মৌলিক কায়স্থ ‘ভঞ্জ’ গণের পূৰ্ব্ববৃত্তান্ত লিখিয়াছি (৩৪শ পরিচ্ছেদ)। ঐ বংশের প্রাচীন প্রবাদ হইতে শুনা যায়, পাঠান রাজত্বের শেষভাগে কলাধর ও মালাধর নামক দুই ভ্রাতা সুলতানপুর, খড়রিয়া প্রভৃতি ৭টি পরগণার জমিদারী পাইয়া মৌভোগ গ্রামে বাস করেন।[৪] প্রবাদ ভিন্ন ইহার কোন প্রমাণ পাই নাই। কয়েক পুরুষ পরে ঐ সকল পরগণা প্রতাপাদিত্যের হস্তে যায় এবং তখন বৈদ্য-চৌধুরীগণের জমিদারী হয়। মালাধরের প্রপৌত্র রামকৃষ্ণ মৌভোগ হইতে নন্ধায় এক গড়কাটা বাড়ীতে বাস করেন। সে বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এখনও ভঞ্জচৌধুরীদিগের অধিকারে আছে। গল্প আছে, রামকৃষ্ণের পৌত্র লক্ষ্মীনারায়ণ নবাব মীরজাফরকে সঙ্গীতে মোহিত করিয়া তাঁহার কৃপাপ্রার্থী হন। তিনি বলেন, মূলঘরের চৌধুরীগণ পরগণার বহির্ভূত গুয়াধনা, লালুয়া, কোদ্‌লা প্রভৃতি কতকগুলি মৌজা গোপনে ভোগদখল করিতেছেন। সম্ভবতঃ কৃষ্ণচন্দ্র রায় নিজ পৈতৃক ১০ আনা অংশ ছাড়া যে অতিরিক্ত ৩ আনা অংশে ভৈরবচন্দ্রের সহযোগে আপোষে দখল করিতেন, উক্ত মৌজাগুলি তাহারই এলেকাধীন ছিল। লক্ষ্মীনারায়ণের নামে নবাব ‘গুয়াধনা ওগয়রহ’ তালুক নামে তিন আনা জমিদারীর সনন্দ দেন। লক্ষ্মীনারায়ণ দেশে আসিয়া দেবিদাস দে সরকার নামক একজন দুৰ্দ্দান্ত কায়স্থকে নিজের দেওয়ান নিযুক্ত করিয়া উক্ত তালুকগুলি দুইচারি বর্ষকাল জোর দখল করিয়া লন। তখন বৈদ্য-চৌধুরীদিগের দেওয়ান কৃপারাম ঘোষ জমিদারী রক্ষার জন্য উক্ত দেবী দেওয়ানের সহিত মিত্রতা করেন। কোলার এক পার্শ্বে ‘দেবী- বাজার’ নামক একটি হাট এখনও দেবী দেওয়ানের স্মৃতি বহন করিতেছে। নবাব বন্দোবস্ত করিতে না করিতে যখন বাঙ্গালার দেওয়ানী ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হস্তে যায়, তখন জমিদারীর দখলাদি লইয়া অত্যন্ত গোলমাল চলিতে থাকে। লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্র শিবরাম উক্ত গুয়াধনা, উজলপুর প্রভৃতি তালুক দখল করিতে থাকেন। এমন সময় কাশীনাথ দত্তচৌধুরীর সঙ্গে বন্দোবস্ত হইয়া যায়। তিনি ১৬ আনাই দখল করিয়া বসেন। শিবরাম রেভেনিউ বোর্ডের নিকট বারংবার দরখাস্ত করিয়াও বিশেষ কোন ফল পান নাই।[৫] তবে জমিদারী কাগজ পত্র হইতে এইটুকু জানা যায় যে, কাশীনাথ দত্তচৌধুরী উজলপুর তালুকের দাবী ত্যাগ করিয়া এবং নলধা গ্রামের খানাবাড়ী প্রভৃতি সমেত ৫০ বিঘার মহাত্রাণ সনন্দ দিয়া এই গোলযোগ নিষ্পত্তি করেন।[৬] ঐ সনন্দের তারিখ ১২৯৩ সাল বা ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দ। সেই বৎসরেই যশোহর জেলা হয়

হাটখোলার দত্তচৌধুরী বংশ।। কাশীনাথ দত্ত যে বংশীয় তাহারা ভরদ্বাজ গোত্রীয়, বালীর দত্ত, দক্ষিণ রাঢ়ীয় বিশিষ্ট মৌলিক কায়স্থ। হাটখোলার দত্তদিগের পূর্ব্বপুরুষ গোবিন্দশরণ বাদশাহী জায়গীর পাইয়া আন্দুল হইতে গোবিন্দপুরে আসেন। তাঁহার পৌত্র রামচন্দ্র ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে গোবিন্দপুরের জমি বদল করিয়া হাটখোলায় আসিয়া বাস করেন। রামচন্দ্রের পৌত্র মদনমোহন বিখ্যাত দানশীল স্বনামধন্য পুরুষ। তাঁহার খুল্লতাত ভ্রাতা জগত্রাম কোম্পানির পক্ষে পাটনার দেওয়ান ছিলেন এবং বহু কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন। জগত্রামের তিন পুত্র কাশীনাথ, রামজয় ও হরসুন্দর। কাশীনাথ সুলতানপুর-খড়রিয়া ব্যতীত বেলফুলিয়া পরগণার ৬ আনা অংশ এবং অন্যান্য সম্পত্তি খরিদ করেন। তন্মধ্যে সুলতানপুর-খড়রিয়ার ১৩ আনা ও বেলফুলিয়া ৬ আনা একত্র এক হিসাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়াছিল। ইহাই যশোহর কালেক্টরীর ২৫৪ নং এবং খুলনার ১৭১ নং তৌজির মহল। গুয়াধনা প্রভৃতি তালুক লইয়া গঠিত সুলতানপুর খড়রিয়ায় ৩ আনা অংশ যশোহরের ২৫৫ নং এবং খুলনার ১৭২ নং তৌজি। কাশীনাথ ভ্রাতৃদ্বয়ের সহিত একান্নভুক্ত ছিলেন। ভবিষ্যতের গোলযোগ নিবারণার্থ ইহারা ১২২৩ সালে আপোষে সমস্ত সম্পত্তি তিন অংশে বিভাগ করিয়া লন। ইহাই খড়রিয়ার বড়-জিলা, মেজ-জিলা ও ছোট-জিলা নামে পরিচিত। কাশীনাথের নিজ ধারায় বড়-জিলার জমিদার মনুজেন্দ্রনাথ দত্তচৌধুরী বর্ত্তমান আছেন।

মধ্যম ভ্রাতা রামজয় দত্তচৌধুরীর দিন দিন বংশবৃদ্ধি হইতে থাকায় সম্পত্তি সুচারুরূপে পরিচালনার্থ উক্ত বংশের কৃতী পুরুষ, কলিকাতা হাইকোর্টের এটর্ণী স্বনামধন্য সদাশয় কুমারকৃষ্ণ দত্তচৌধুরী[৭] মহাশয়ের বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রমে এবং অন্যান্য সরিকগণের সহযোগিতায় ১৯০১, ১৩ই জুন তারিখে একটি লিখিত একরার-নামা দ্বারা গবর্ণমেণ্টের আইনানুসারে খড়রিয়া মেজ-জিলা জমিদারী সিণ্ডিকেট (the Khararia Mejo Zillah Zemindari Syndicate Ltd.) নামক এক কোম্পানি গঠিত করিয়াছেন। উক্ত কোম্পানি ১৯০১ অব্দে খড়রিয়া মেজ-জিলার সম্পত্তি ৯৯ বৎসরের জন্য মেয়াদী পত্তনী লইয়াছেন। তৎপর খড়রিয়া বড়-জিলার চারি আনা অংশ চিরস্থায়ী পত্তনী বন্দোবস্ত লইয়াছেন। কোম্পানির কার্য্য অতি সুচারুরূপে নির্ব্বাহিত হইতেছে। খড়রিয়া বড়-জিলার বাকী বার আনা অংশ মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে শরৎচন্দ্র বসু। পাঁচ আনা, মনুজেন্দ্রনাথ দত্তচৌধুরী চারি আনা ও কৃষ্ণবিহারী দত্তচৌধুরীদিগের তিন আনা অংশের ভোগ দখল চলিতেছে। হরসুন্দর দত্তচৌধুরীর ছোট-জিলার ১৬ গণ্ডা অংশে জমিদারী স্বত্বে এবং ৪ গণ্ডা অংশে পত্তনী স্বত্বে সুবিখ্যাত “মোহিনীমোহন রায়চৌধুরীর পুত্র ভবানীপুর নিবাসী প্যারীমোহন রায়চৌধুরী দখিলকার আছেন।

৩. বেলফুলিয়া পরগণা

বেলফুলিয়া বসু-চৌধুরী বংশ। বেলফুলিয়া অতি প্রাচীন স্থান। ইহার অন্তর্গত ভৈরব কূলবর্তী সেনেরবাজার অতি প্রাচীন কাল হইতে একটি প্রধান বাণিজ্য-কেন্দ্র বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। সেনবংশীয় কে কখন এই বাজার বসাইয়া ছিলেন, তাহা রহস্য-জড়িত। স্থানান্তরে উহার আলোচনা করিব। পাঠান আমলে বেলফুলিয়া পরগণা ফতেহাবাদ সরকারের অন্তর্গত ছিল।[৮] প্রাচীন দলিলাদিতে উহার ঐরূপ উল্লেখ আছে। গৌড়াধিপ হুসেন শাহের সহিত খুলনা জেলার যে সম্পর্ক ছিল, তাহা আমরা প্রথম খণ্ডে বিবৃত করিয়াছি (২৩৫-২৪০ পৃ)। তিনি প্রথম জীবনে যে আলাইপুরের কাজিদিগের গৃহে প্রতিপালিত হন, তাঁহার নাম যুক্ত সেই আলাইপুর ও নিকটবর্ত্তী হুসেনপুর উভয়ই বেলফুলিয়া পরগণার অন্তর্গত। গৌড়েশ্বর হইবার পর তিনি যখন এই প্রদেশে ভ্রমণ করিতে আসেন, তখন হুসেনপুর প্রভৃতি অধুনা-নগণ্য গ্রামপার্শ্বে তাঁহার তরণী লাগিয়াছিল। উহারই নিকটবর্ত্তী ভদ্রগাতিতে চতুরঙ্গ ভদ্র নামক একজন কর্মদক্ষ বলশালী প্রিয়দর্শন মৌলিক কায়স্থ বাস করিতেন। হুসেন-পুত্র নসরৎ শাহ বাগেরহাটে আসিয়া কিছুকাল স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিয়াছিলেন, সেখানে তাঁহার মসজিদ নির্ম্মিত ও নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচারিত হয়, সে কথাও পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। চতুরঙ্গ ভদ্র কোন শুভমুহূর্তে নিজের দেশেই পিতাপুত্রের দর্শন লাভ করিয়া আলাইপুরের কাজিদিগের ন্যায় গৌড়ের রাজসরকারে গিয়া চাকরী করিতেন। সে চাকরীর জন্য তিনি প্রভূত ধন সম্পত্তি লাভ করেন। তিনি তখন বল-কৌশলে দক্ষিণরাঢ়ীয় মাহিনগর সমাজের একজন প্রধান কুলীনের জ্যেষ্ঠপুত্র চণ্ডীবর বসুকে কন্যা সম্প্রদান করেন; উহার ফলে চণ্ডীবরকে কুলভ্রষ্ট হইয়া মাহিনগরে পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করিয়া শ্বশুরের আশ্রয় লইতে হয়। চতুরঙ্গ তাঁহাকে নিজ অধিকারভুক্ত শ্রীফলতলা গ্রামে কিছু মহাত্ৰাণ জমি দিয়া বাস করাইয়াছিলেন।[৯] এখনও যজ্ঞেশ্বর রায়চৌধুরী প্রভৃতি চণ্ডীবরের বংশধরগণ সেই বাটীতে বাস করিতেছেন। চণ্ডীবর মাহিনগরের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ ধারায় ১৪ পর্য্যায়-ভুক্ত। সে ধারা এই : ৫ মুক্তি ১৪ চণ্ডীবর বসুরায় (মাহিনগর)—দামোদর—অনন্ত—গুণাকর—মাধব—লক্ষ্মণ—মহীপতি—সুরেশ্বর—১৩ বিশ্বনাথ, লোকনাথ ও কাকুৎস্থ; এই কাকুৎস্থের পুত্র চণ্ডীবর।[১০] বিশ্বনাথ পর্য্যন্ত সকলেই প্রবলমুখ্য, লোকনাথ কনিষ্ঠ কুলীন, এবং কাকুৎস্থ নিজ জ্যেষ্ঠপুত্র চণ্ডীবরের কুলনাশের জন্য নিজে নিঙ্কুলীন।

চণ্ডীবর বসুরায়

চণ্ডীবর অতি অল্প বয়সে গৌড় রাজসরকারে চাকরী করিতে যান, তখন চতুরঙ্গের সহিত পরিচয় এবং উক্ত বিবাহ ঘটে। শ্রীফলতলায় বাস করিবার পরও তিনি গৌড়ে চাকরী করিতেন এবং তখন সুযোগমত বেলফুলিয়া পরগণার জমিদারী সনন্দ লাভ করেন। তাঁহার জ্ঞাতি খুল্লতাত ১৩ পৰ্য্যায়ভুক্ত গোপীনাথ বসু বা পুনন্দর খাঁ সুলতান হুসেন শাহের উজীর ছিলেন; শুধু শ্বশুরের চেষ্টা নহে, এ সম্পর্কও তাঁহার জমিদারী প্রাপ্তির হেতু হইয়াছিল। চতুরঙ্গ শেষ জীবনে মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া শুনা যায়; তখন হইতে তাঁহার সহিত জামাতার সকল সম্বন্ধ রহিত হয়।[১১] চণ্ডীবরের পর তৎপুত্র শ্রীনাথ এবং পৌত্র হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরী জমিদারী ভোগ করেন। হরিশ্চন্দ্র প্রতাপাদিত্যের দিগ্বিজয়ী পতাকার নিম্নে বশ্যতা স্বীকার করেন। প্রতাপের পতনের পর, যখন ইসলাম খাঁ নবাব হইয়া ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন, তখন কোন কারণে এই জমিদারী বাজেয়াপ্ত হয়। সেই জন্যই হরিশ্চন্দ্রের পুত্র জগদানন্দ প্রভৃতি এই পরগণার মধ্যবর্তী কতকগুলি ক্ষুদ্র তালুকের অধিকারী হইয়া শ্রীফলতলা হইতে নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহে উঠিয়া আসিয়া বাস করেন এবং নানা শাখায় বিভক্ত হইয়া পড়েন। জগদানন্দের বৃদ্ধ প্রপৌত্র লক্ষ্মণ রায় নবাব আলিবর্দীর সময়ে বেলফুলিয়া ও হোগলা পরগণার মধ্যে কয়েকটি তালুক পান। সেই সম্পত্তি উঁহার পুত্রদিগের মধ্যে সাতআনী, পাঁচআনী ও সিকি এই ভাবে তিনটি পৃথক্ বাড়ীর সৃষ্টি করে, উহা এখনও আছে।[১২] হরিশ্চন্দ্রের অধস্তন বসুচৌধুরিগণ যিনি যেখানেই বাস করিয়াছেন, বেলফুলিয়ার কায়স্থ সমাজে তাঁহাদের অবাধ প্রতিপত্তি চিরকাল চলিয়া আসিতেছে, তাঁহাদেরই সম্পর্কে বেলফুলিয়ায় স্থানে স্থানে বহু কুলীনের বসতি হইয়াছে। বসুচৌধুরীগণের জমিদারী যাওয়ার পর বেলফুলিয়া পরগণা পরবর্ত্তী শত বৎসরকালে দূরবর্ত্তী স্থানীয় বহু জমিদারের হাত বদলাইয়া ছিল। উহার ধারাবাহিক কাহিনী জানিতে পারি নাই। নবাব সুজাউদ্দীনের সময়ে আনুমানিক ১৭৩৫ খৃষ্টাব্দে বেলফুলিয়া পরগণা নিলাম হইলে, হাতিয়াগড়ের দত্ত-বংশীয় রামসন্তোষ ও রামগোপাল দত্ত উহা খরিদ করিয়া মৌভোগে আসিয়া বাস করেন।

মৌভোগের দত্তচৌধুরী বংশ।। ইঁহারা ভরদ্বাজ গোত্রীয়, বালীর দত্ত নামে পরিচিত। নড়াইল-জমিদারের বংশপ্রসঙ্গে এই দত্ত-শাখার পরিচয় দিয়াছি। বালী হইতে রামসন্তোষের পূর্ব্বপুরুষ কখন এবং কেন হাতিয়াগড়ে যান, তাহা জানি না। তবে তাঁহারা যে বাণিজ্য-বলে অর্থশালী হইয়াছিলেন। এবং তাঁহাদের বাণিজ্য-পোত সপ্তগ্রাম হইতে চট্টগ্রাম যাতায়াত করিত, তাহা শুনিয়াছি। জমিদারী প্রাপ্তির পর রামসন্তোষ ও রামগোপাল পরিবারবর্গসহ পরগণার পূর্ব্ব সীমায় মৌভোগ গ্রামে পাকাবাড়ী নির্ম্মাণ করিয়া বাস করেন।[১৩ তাঁহাদের সুরম্য বাড়ী ও কারুকার্য্যযুক্ত মন্দিরের কিছু কিছু ভগ্নাবশেষ এখনও আছে। এই দত্তচৌধুরীরা অত্যন্ত অর্থশালী ছিলেন, তৎসম্বন্ধে একটা গল্প আছে। পার্শ্ববর্ত্তী বারুইপাড়া গ্রামের হাটে একখানি সামান্য কুলার মূল্য লইয়া অন্য এক জমিদারের লোকের সহিত একদিন উহাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘটে, উভয়পক্ষ ঐ সামান্য দ্রব্যের দরবৃদ্ধি করিতে করিতে অবশেষে দত্তপক্ষ দুই হাজার টাকায় উহা খরিদ করিয়া জিদ্ বজায় রাখেন; তদবধি নাকি বারুইপাড়া নাম পরিবর্তিত হইয়া ‘দোহাজারী’ হইয়াছে। এ গল্পে কেহ বিশ্বাস না করিলে আপত্তি নাই, তবে দত্তচৌধুরীদিগের যে অর্থ ছিল এবং উন্মুক্ত হস্তে উহার সদ্ব্যয় করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ আছে। মৌভোগ হইতে আজগড়া পর্য্যন্ত কয়েকটি গ্রামের বহু সংখ্যক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে তাঁহারা যে নিষ্কর ভূমিদান করিয়াছিলেন, তাহার শত শত সনন্দ এখনও দেখিতে পাওয়া যায়, উহার কতকগুলি আমি নিজেই দেখিয়া পরীক্ষা করিয়াছি। এই সকল নিষ্করের লোভে বহু ব্রাহ্মণ আসিয়া মৌভোগে বাস করেন এবং উহা একটি বিদ্যাচর্চ্চার প্রধান স্থান হয়। ১১৩৮ হইতে ১১৬৩ পৰ্য্যন্ত সনন্দের তারিখ দেখিয়াছি। ১১৬৩ সালে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দ হয়; সুতরাং সে পর্য্যন্ত জমিদারী দত্তচৌধুরীদিগের হস্তে ছিল, অনুমান করিতে পারি। এখন জমিদারী নাই বটে, কিন্তু রায়চৌধুরী উপাধিধারী মৌভোগের দত্তগণ স্বস্থানে ও সমাজে বিশেষ সম্মানিত।

১১৬৭ সালে (১৭৬০ খৃঃ) যখন ‘অন্যে পরে কা কথা’, স্বয়ং মীরজাফরেরই নবাবী লইয়া টানাটানি চলিতেছে, তখন দেখি, বেলফুলিয়া পরগণা মুড়াগাছার ক্ষত্রিয় জমিদার কৃষ্ণসিংহ রায় (ওরফে সীতারাম রায়) ও ব্রজলাল রায়ের করগত হইয়া পড়িয়াছে। তখন কৃষ্ণসিংহ রায় বেলফুলিয়ার পূর্ব্ব সীমান্তে জয়পুর নামক গ্রামে আসিয়া বসতি করেন। বর্তমান খড়রিয়া জমিদারী কাছারীর পূর্ব্বভাগে যেখানে একটি পুরাতন বৃহৎ দীর্ঘিকা আছে এবং পুরাতন বাটীর ভগ্নাবশেষ ‘কোঠাবাড়ী’ নামে পরিচিত, উহাই কৃষ্ণসিংহের বাটী। তাহারই পার্শ্বে খড়রিয়া পরগণার সীমা ছিল। অল্পদিন মধ্যে কৃষ্ণসিংহ রায় হোগলা পরগণার অর্দ্ধাংশ খরিদ করেন, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। কিন্তু তিনি অধিকদিন জমিদারী ভোগ করিতে পারেন নাই। উঁহাদের মধ্যে জ্ঞাতিবিরোধ বশতঃ হোগলার অংশ গঙ্গানারায়ণ রায়ের হস্তে যায় এবং বেলফুলিয়ার অধিকার কোম্পানি কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বেলফুলিয়া পরগণা গবর্ণমেণ্টের খাস ছিল। ১৭৯৯ অব্দে দেখা যায়, উহা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিক্রীত হইতেছে।[১৪ কালক্রমে সেই সকল খণ্ড একত্র করিয়া হাটখোলার দত্তচৌধুরিগণ ৪ আনা, গঙ্গানারায়ণের পুত্র দুর্গাপ্রসাদ রায় ৬ আনা ও রামনগরের ঘোষ চৌধুরিগণ ৪ আনা অংশের মালিক হন। এখনও সেইরূপ আছে। বেলফুলিয়া পরগণায় পৃথক্ তৌজি নাই, উহার অংশত্রয় খড়রিয়া ও হোলার তৌজিভুক্ত হইয়া গিয়াছে।

৪. চিরুলিয়া, মধুদিয়া ও রাঙ্গদিয়া

গোবর ডাঙ্গার জমিদারগণ ॥ যশোহরের অন্তর্গত সারষার প্রসিদ্ধ কুলীন শ্যামরাম মুখোপাধ্যায় একদা গঙ্গাস্নান উপলক্ষে ইচ্ছাপুর গিয়া তথাকার হোড়চৌধুরীদিগের কন্যা বিবাহ করেন, সেই দোষে তিনি নিজগৃহ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া ইচ্ছাপুরে বাস করেন। তাঁহার দুইটি পুত্র ছিল, জগন্নাথ ও খেলারাম; খেলারাম সামান্য লেখাপড়া শিখিয়া সৌভাগ্যযোগে যশোহর- কালেক্টরীর সেরিস্তাদার হন এবং কালেক্টর সাহেবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন। তিনি যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করতঃ ক্রমে ক্রমে গোবরডাঙ্গা তালুক, চিরুলিয়া ও মধুদিয়া পরগণা এবং শাহউজিয়াল পরগণার অন্তর্গত ডিহি আড়পাড়া প্রভৃতি সম্পত্তি নিলাম খরিদ করেন এবং পরে বিখ্যাত দুলাল সরকারের নিকট হইতে রাঙ্গদিয়া পরগণা পত্তনী লন। খেলারামের কালীপ্রসন্ন ও বৈদ্যনাথ নামে দুই পুত্র ছিলেন, তন্মধ্যে বৈদ্যনাথ নিঃসন্তান। কালীপ্রসন্ন অত্যন্ত দুর্দান্ত ও প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার, তাঁহার সময়ে তাঁহার পৈতৃকসম্পত্তিগুলি সবলে অধিকৃত ও উহাদের “আয়বৃদ্ধি হয়। তিনিই গোবরডাঙ্গায় যমুনা কূলে ‘প্রসন্নভবন’ অট্টালিকা ও দ্বাদশ লিঙ্গসহ আনন্দময়ীর বাটী প্রস্তুত করেন। ১৮৪৪ অব্দে তাঁহার মৃত্যুকালে সারদাপ্রসন্ন ও তারাপ্রসন্ন নামে তাঁহার দুই নাবালক পুত্র ছিল, উহার মধ্যে তারাপ্রসন্ন নিঃসন্তান। সুতরাং ১৮৬৯ অব্দে অল্প বয়সে সারদাপ্রসন্নের মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি গিরিজাপ্রসন্ন, অন্নদাপ্রসন্ন, জ্ঞানদাপ্রসন্ন ও প্রমদাপ্রসন্ন—তাঁহার এই চারি পুত্রের মধ্যে বিভক্ত হইয়াছে। খুলনা জেলার মধ্যে মধুদিয়া, রাঙ্গদিয়া ও চিরুলিয়া নামক তিনটি পরগণা যথাক্রমে জ্যেষ্ঠ তিন ভ্রাতার সম্পত্তি এবং ঘোষের- হাট, যাত্রাপুর ও পাণিঘাটে যথাক্রমে উহাদের তহশীলের কাছারী রহিয়াছে।

পাদটীকা :

যশোহর-খুলনার ইতিহাস

১. লালমোহন, ‘সম্বন্ধনির্ণয়’, ৪২৫ পৃ; ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, ব্রাহ্মণ কাণ্ড, ১০১ পৃ।

২. দামোদর ভট্টাচার্য্য কৃত ‘দেবনাথচরিতম্’ নামে এক সুদীর্ঘ সংস্কৃত মহাকাব্য আছে; সে কাব্যে শুধু স্তাবকতা ও বাক্‌চাপল্যই আছে, কোন প্রকৃত চরিত্র-চিত্র বা ঐতিহাসিক কথা নাই।

৩. Calcutta Review, 1874, P. 430-’Jessore’ by H. J. Rainey.

৪. আদিপুরুষ কুবের ভঞ্জ হইতে সংক্ষিপ্ত বংশধারা এই : ১ কুবের—কাকুৎস্থ—হরিহর—মকরন্দ-বিনায়ক— গোপাল—পরমেশ্বর—রাঘব-কানাই— দৈত্যারি—নিশাপতি-১২ চক্রপাণি—১৩ গন্ধৰ্ব্ব খাঁ ও রামচন্দ্র; রামচন্দ্র—কেশবচন্দ্র—কাশীনাথ—১৬ মালাধর (মৌভোগ)—বাণীনাথ—কমলাকান্ত- রামকৃষ্ণ (নদ্ধা) — রাজা — রাম – লক্ষ্মীনারায়ণ— শিবরাম, ভোলানাথ ও গঙ্গাপ্রসাদ; শিবরাম—রামনারায়ণ—বিশ্বম্ভর— ২৩ আশুতোষ বেণী ও অশ্বিনী (পোষ্টাল ইনস্পেক্টর)।

৫. ১৭৮৬, ৯ই মার্চ তারিখের ১১৭২ নং এবং ১৭৮৭, ২৪শে এপ্রিলের ১২৭৮ নং দরখাস্ত। Hunter, Bengal Ms. Records, Vol. I. pp. 132, 141. One entry runs thus : ‘Petition from Sibram Bhanj complaining of dispossession of Taluk Gudna by one Kashi Nath Dutta.

৬. এই মহাত্রাণ সনন্দের অবিকল নকল এই : ‘স্বস্তি সকল মঙ্গলালয় শ্রীভোলানাথ ভঞ্জ ও শ্রীরামনারায়ণ ভঞ্জ ও শ্রীগঙ্গাপ্রসাদ ভঞ্জ সদুদার চরিতেষু—মহাত্রাণ জমী পত্রমিদং কার্য্য্যাঞ্চাগে আমার জমিদারী পরগণে শুলতানপুর খড়রিয়া ওগয়রহের মধ্যে উটীতের লায়েক পতিত খামারের অন্দরে (৫০) পঞ্চাশ বিঘা জমী তোমারদিগের খোরোপোস কারণ মহাত্রাণ দিলাম। জাত মাফিক চিহ্নিত করিয়া লইয়া পুত্র পৌত্রাদীক্রমে পরম শুখে ভোগ করিতে রহো ইহার রাজস্ব সহিত দায় নাই এতদার্থে মহাত্ৰাণ সনন্দ দিলাম ইতি সন ১১৯৩ তারিখে ২৭শে অগ্রহায়ণ শ্রীকাশীনাথ দত্তস্য। জাত জমা নলধারায় গড়বাটী ১০ সোতাল ১০ হিজলা ২৫ মৌজে কাথুলী ৫=৫০ বিঘা মাত্র।’

৭. দত্তচৌধুরী বংশের বংশধারা এই : গোবিন্দশরণ—রাণেশ্বর—রামচন্দ্র—কৃষ্ণচন্দ্র ও মাণিক্যচন্দ্র; কৃষ্ণচন্দ্ৰ — মদনমোহন। মাণিক্যচন্দ্র – জগত্রাম – কাশীনাথ, রামজয় G হরসুন্দর; রামজয়—কালীচরণ—নীলমণি—গোপাল—কুমারকৃষ্ণ প্রভৃতি।

৮. আবুলফজল সম্ভবতঃ এই বেলফুলিয়াকে উল্টাইয়া ‘ভুলিয়াবেল’ বা ‘ফুলিয়াবেল’ করিয়াছেন। Cf. Bholiyabel in Ain., (Jarrett), Vol. II, p. 132. উহার অনুবাদে ‘ফুলবৈল’ আছে (আইন-ই-আকবরী’, বসুমতী সংস্করণ, ৮৫ পৃ)। কেহ কেহ উহাকে ‘বেলফুলি’ করিয়াছেন (‘গৌড়ের ইতিহাস’, ২য় খণ্ড, ২১০ পৃ)। এই পরগণার রাজস্ব ছিল; ৩,৮৪,৪৫২ দাম বা ৯,৬১১ রূপৈয়া।

৯. একখানি প্রাচীন ভূমি বিক্রয় দলিলের কতকাংশ এই : ‘লিখিতং শ্রীবিষ্ণুরাম বসুরায়*** সাকীন শ্রীফলতলা পরগণে বেলফুলিয়া সন ১২৩২ সালাব্দে নাখেরাজ জমি বিক্রয় কবলা লিখনং কাৰ্য্যাঞ্চাগে পরগণা মজকুরের শ্রীফলতলা গ্রামের মধ্যে আমার পৈতৃক খানাবাটী মহত্রাণ জমি দত্তা চতুরঙ্গ ভদ্র গ্রীহিতা চণ্ডীবর রায় সেই খানাবাটী’—ইত্যাদি।

১০. ‘কায়স্থ কারিকা’, মাহিনগর বংশ-লতিকা।

১১. কথিত আছে, চণ্ডীবরকে কন্যাদানের বহুপরে চতুরঙ্গ গৌড়ে এক মুসলমান বান্দীর প্রেমমুগ্ধ হওয়ায় কাজির বিচারে মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া ‘পঞ্চরঙ্গ খাঁ’ হন। তখন কত লোক এমনভাবে মুসলমান হইয়া যাইতেন। তিনি বেলফুলিয়ার আইচগাতি গ্রামে ভৈরবের অনতিদূরে ৪১ বিঘার সনন্দ পাইয়া তথায় এক গড়কাটা বাড়ী নির্মাণ করতঃ মুসলমান রমণীসহ বাস করেন। সেই পত্নীর গর্ভে তাঁহার সুবি খাঁ ও বুচি খাঁ নামক দুইপুত্র হয়। পঞ্চরঙ্গও শেষ জীবনে কাজিগিরি চাকরী পান, তাঁহার পুত্রগণও কাজি হন। এখনও প্রশস্ত কাজির রাস্তা, কাজির দেউড়ী, কাজির বাড়ী ও গড়, সুবি খাঁর কবর প্রভৃতি পুরাতন নিদর্শন আছে। এই কাজি বংশীয়গণ বহু পুরুষ ধরিয়া হিন্দুর মত আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন।

১২. হরিশ্চন্দ্র হইতে ২/১টি ধারা এই: ১৬ হরিশ্চন্দ্র — জগদানন্দ—দুর্লভ—বিশ্বনাথ— রামগোবিন্দ—লক্ষ্মণ—কৃপানাথ (পাঁচআরী)–গোপী— তিলক—বিশ্বম্ভর—শশী—যতীন্দ্রবি, এল; ১৭ রাঘব—দুর্লভ—বিশ্বেশ্বর— রামকৃষ্ণ (দেয়াড়া)—রামপ্রসাদ—রামকিঙ্কর—রামগোবিন্দ—ফটিক—২৫ অক্ষয়কুমার; ১৭ রাগভ— জানকীবল্লভ (আইগাতি)—নরোত্তম—কৃষ্ণরাম—শ্যামসুন্দর- কমলাকান্ত— গৌরীকান্ত—২৪ যোগেন্দ্রকুমার।

১৩. রামসন্তোষ দত্ত বীজী পুরুষোত্তম দত্ত হইতে ১৯শ পৰ্য্যায়ভুক্ত। তদ্বংশীয়েরা মৌভোগে ৭/৮ পুরুষ বাস করিতেছেন। একটি বংশধারা এই: ১৯ রামসন্তোষ—রামকৃষ্ণ—রাজবল্লভ—জয়নারায়ণ— তারাচাঁদ—দ্বারকানাথ—বসন্তকুমার–বিজয়, নেপাল (M.Sc.) এবং ভূপাল।

১৪. Westland. Jessore, PP. 50, 151 ( ed. 1871. pp. 130.194 – [শি মি]।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন