সতীশচন্দ্র মিত্র
প্রতাপাদিত্য যে বিশেষভাবে রাজনীতি-বিশারদ ছিলেন, তাঁহার দুর্গসংস্থান দেখিলে উহা সকলেরই সহজে বোধগম্য হয়। প্রতাপ রাজত্ব করিতে করিতে সময় ও প্রয়োজন বুঝিয়া নানাস্থানে দুর্গ নির্ম্মাণ করেন। প্রথমতঃ, সমস্ত দুর্গ নির্ম্মাণ করিবার পরই যে তিনি স্বাধীনতা প্রচার বা শত্রুর সহিত যুদ্ধারম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা নহে। দুর্গগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। কখন কোনটি বা কোনটির পর কোনটি নির্ম্মিত হয়, তাহা ঠিকভাবে নির্দ্ধারণ করিবার উপায় নাই। আবার, দুর্গগুলির বিষয় আনুমানিক সময়ানুযায়ী বিভিন্ন স্থানে নানাজাতীয় ঘটনার মধ্যে পৃথক্ পৃথক্ ভাবে বর্ণিত হইলে, প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধনীতি জ্ঞানের কোন সজীব আভাস পাওয়া যাইবে না। এজন্য আমরা এখানে একই স্থলে সকল দুর্গের ও তৎসংশ্লিষ্ট নৌবাহিনী প্রভৃতির প্রধান প্রধান আড্ডাগুলির একটি সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত গ্রন্থিত করিলাম। দুর্গগুলির প্রয়োজনীয়তা ঘটনাবলীর সহিত যথাস্থানে উল্লিখিত হইবে।
১. যশোহর দুর্গ॥ আমরা পূর্ব্বে বিশদভাবে দেখিয়াছি যে, যশোর-রাজ্যের প্রথম রাজধানী মুকুন্দপুরে ছিল; তথায় প্রথম দুর্গ নির্মিত হয়। রাজধানীর নাম যশোহর হইয়াছিল বলিয়া তথাকার দুর্গকে আমরা যশোহর-দুর্গ বলিয়াছি।[১]
২. ধুমঘাট দুর্গ॥ পরে প্রতাপাদিত্য নিজে যমুনা-ইছামতীর সঙ্গমে ধুমঘাটে নূতন রাজধানী স্থাপন করিলে, সে সহরের নাম পরে যশোহর হইয়াছিল বটে, কিন্তু দুর্গটিকে আমরা ধুমঘাট দুর্গ বলতে পারি। ইহাই রাজ্যমধ্যে সর্ব্বপ্রধান এবং সর্ব্বাপেক্ষা সুরক্ষিত দুর্গ। প্রতাপের রাজত্বের শেষভাগে প্রথম রাজধানী নগণ্য হইয়া পড়ে এবং তখন ধুমঘাটকেই যশোহর সহর বলিত; এমন কি, বসন্তপুর হইতে ঈশ্বরীপুর পর্য্যন্ত সমস্ত স্থানটিরই সাধারণ নাম যশোহর হইয়াছিল। এই সময়ে মুকুন্দপুরের পৃথক্-নামকরণ হয়; নতুবা পূর্ব্বে তাহার নাম যশোহরই ছিল। মুকুন্দপুর ও ধুমঘাট এই দুইটি দুর্গের বিশেষ বিবরণ আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি। এখন অন্যান্য দুর্গের কথা বলিব।
৩. রায়গড় দুর্গ॥ বিক্রমাদিত্যের জীবদ্দশায় যশোহর-রাজ্য দ্বিধা বিভক্ত হয়; পূর্ব্বদিকের ১০ আনা অংশ প্রতাপাদিত্য পান ও পশ্চিমভাগের।[৬] আনা অংশ বসন্ত রায় ও তাঁহার পুত্রগণের সম্পত্তি হয়। প্রতাপ ধুমঘাটে রাজধানী স্থাপন করিলে, বসন্ত রায় কিছুদিন প্রাচীন রাজধানীতে থাকিয়া স্বীয় রাজ্যাংশের পরিচালনা করেন। কিন্তু তাহাতে সুবিধা বোধ করিলেন না; কারণ, পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রতাপের সহিত বসন্ত রায়ের পুত্রগণের কোন সদ্ভাব ছিল না। নিকটে থাকিলে উভয় পক্ষের জ্ঞাতিবিদ্বেষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধ পাইবে, এই আশঙ্কায় এবং রাজ্য পরিচালনার সুবিধার জন্য বসন্ত রায় রাজধানী স্থানান্তরিত করিতে উদ্যোগী হইলেন। পশ্চিম সীমায় গঙ্গাতীরে কোথায়ও রাজধানী হইলে শাসনের সুব্যবস্থা হয়, সঙ্গে সঙ্গে ধৰ্ম্মনিষ্ঠ বসন্ত রায়ের পক্ষে বৃদ্ধবয়সে গঙ্গাবাসের সুযোগ ঘটে। তখন কালীঘাটের সন্নিকটে বেহালা-বড়িষা প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধ সমাজ-পল্লী ছিল; তিনি এই স্থানে রাজধানীর স্থান নির্ব্বাচন করিলেন। বসন্ত রায় এ অঞ্চলে পরিচিত ছিলেন; তিনিই প্রথম কালীঘাটের মায়ের মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন; সেই সূত্রে মায়ের সেবক যোগসিদ্ধ ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারীর সহিত বিশেষ পরিচিত ছিলেন। খুব সম্ভবতঃ ব্রহ্মচারীই তাঁহাকে কালীঘাটের সন্নিকটে রাজধানী স্থাপন করিবার আদর্শ দেন। তখন তিনি বেহালা ও বড়িষা উভয়ের মধ্যে সরশুনা গ্রামের উত্তরাংশে রাজধানীর স্থান নির্দেশ করেন। ঐ স্থানে যে দুর্গ নিৰ্ম্মিত হয়, তাহার নাম— রায়গড় দুর্গ। দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখন বিশেষ কিছু নাই; কেবল স্থানে স্থানে ইষ্টক ও পরিখার চিহ্ন বর্ত্তমান। আর সেই দুর্গের পার্শ্বে যে বিস্তীর্ণ দীর্ঘিকা খনিত হয়, তাহা এখনও ‘রায়দীঘি’ বলিয়া খ্যাত।[২] উহা প্রায় ষাট বিঘা জলাশয়, দৈর্ঘ্যপ্রস্থে ১৫০০ × ৬০০ ফুট হইতে পারে। বেহালার শেষ সীমায় চৌমাথা হইতে পশ্চিমমুখে বজ্জ্ পর্য্যন্ত যে পাকা রাস্তা গিয়াছে, উহারই পার্শ্বে বাসুদেবপুর গ্রামের সীমায় এবং সরশুনার উত্তর গায়ে এই দীঘি অবস্থিত। উক্ত চৌমাথা হইতে পূৰ্ব্বমুখে এক ক্রোশ দূরে আদিগঙ্গার ঘাট, ঐ স্থানে এক সময় করুণাময়ী কালীমাতার মন্দির ছিল। এখনও উহা ‘করুণাময়ীর ঘাট’ বলিয়া পরিচিত। রায়দীঘি হইতে এখন গঙ্গার দূরত্ব প্রায় তিন মাইল; পূর্ব্বে এত দূর ছিল না, গঙ্গা মজিয়া চড়া পড়িয়া যাওয়ায় রায়গড়ের ভদ্রাসন এত দূরবর্ত্তী হইয়া পড়িয়াছে। সরশুনা গ্রাম হইতে আদিগঙ্গার তীর পর্য্যন্ত একটি প্রশস্ত রাজপথের নিদর্শন পাওয়া যায়; ইহাকে লোকে ‘দ্বারির জাঙ্গাল’ বলে।[৩] গঙ্গা পার হইয়াও এই জাঙ্গাল পূর্ব্বমুখে বহুদূর পর্য্যন্ত গিয়াছিল। এখনও অনেক স্থলে উহার উচ্চ ঢিপি দেখিতে পাওয়া যায়। এমন কি, বসন্তপুরের পর পারে কালিন্দীর তীর পর্য্যন্ত উচ্চ গড় বা জাঙ্গাল ছিল বলিয়া বুঝা যায়। এই গড়ের উপর দিয়া রায়গড় হইতে ধুমঘাট যাতায়াত করিবার সুবিধা ছিল। এখনও বর্তমান হিঙ্গুলগঞ্জের হাটের উত্তরধারে পশ্চিমুখে বহুদূর পর্য্যন্ত উচ্চ গড়ের চিহ্ন দেখা যায়। এখন উহার নিকট দিয়া হাসনাবাদের খাল খনিত হইয়াছে। প্রকৃত কথা, রায়গড়ের সহিত যশোহর দুর্গের সম্বন্ধ ছিল, যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল, এখনও তাহার অস্পষ্ট প্রমাণ আছে। রায়গড়ও একসময়ে সুরক্ষিত সুন্দর দুর্গ ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাহার বিপুল ঐশ্বর্য্যের কোন নিদর্শন নাই। স্বর্গীয় প্রতাপচন্দ্র ঘোষ সত্যই লিখিয়া গিয়াছেন, ‘রায়গড়ের বর্ত্তমান অবস্থা দেখিলে এখন তাল পুকুরের তালের ন্যায় বোধ হয়। যেরূপ জাঙ্গালের কথা বলা হইল, নিম্নবঙ্গে তেমন পুরাতন জাঙ্গাল অনেক দেখিতে পাওয়া যায় এবং এখনও লোকে উহা নির্ম্মাণ করে। উহার সাধারণ নাম গড়। এখনও লোকে গড় তুলিয়া বাড়ী করে; সাধারণ প্রজারা নিজের জমির সীমা দিয়া যে পগার কাটে তাহাকে গড় বলে এবং উহার মাটী তুলিয়া ঢিপি করিয়া যে প্রাচীর তৈয়ার করে, তাহাকেও গড় বলে। প্রকৃতপক্ষে পগারের নাম গড়খাই বা পরিখা এবং উপরের প্রাচীরের নাম গড়। প্রতাপাদিত্যের সময়ে এই গড়ে অনেক উদ্দেশ্য সাধন করিত; ইহার জন্য বানবন্যায় নদীর জল গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিত না; ইহার উপর দিয়া স্বচ্ছন্দে যাতায়াত এবং পণ্য বা রসদ প্রেরণ করা চলিত; ইহার উপরে বা পশ্চাতে সৈন্য রাখিয়া শত্রুর গতিরোধ করা হইত। প্রতাপাদিত্য প্রধানতঃ এই শেষোক্ত উদ্দেশ্যে তাঁহার রাজধানীর দূর সীমান্তে এইরূপ গড় রচনা করিয়াছিলেন।
৪. কমলপুর দুর্গ॥ আমরা রায়গড় হইতে পূৰ্ব্বমুখে যমুনা পৰ্য্যন্ত এইরূপ গড়ের চিহ্ন পাইয়াছি। বৰ্ত্তমান কালীগঞ্জের[৫] নিকট যমুনা পার হইয়া এই গড় পুনরায় পূর্ব্বমুখে রহিমপুর, মহব্বৎপুর, শ্রীপুর প্রভৃতি গ্রামের মধ্য দিয়া খোলপেটুয়া নদী পৰ্য্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। যমুনা কূল হইতে শ্রীপুর পর্য্যন্ত তিন চারি মাইল স্থানে এই গড় খুব উচ্চ এবং প্রশস্ত আছে। কোন কোন স্থানে ইহার উচ্চতা ষোল-সতর ফুট পর্যন্ত হইবে এবং ইহার উপর দিয়া দুইজন অশ্বারোহী স্বচ্ছন্দে পাশাপাশি চলিয়া যাইতে পারিত। এই গড়ের দক্ষিণে স্থানে স্থানে বড় বড় দীঘি আছে।[৬] এই গড়ের উপর মধ্যে মধ্যে বুরুজ ছিল; তথায় প্রকাণ্ড কামান সকল পাতা থাকিত। পঞ্চাশ ষাট বৎসর পূর্ব্বেও মহব্বৎপুরের গড়ে দুইটি প্রকাণ্ড কামান ছিল।[৭] কালীগঞ্জ হইতে ৫ মাইল উত্তর-পূর্ব্ব কোণে তারালি নামক স্থানে[৮] আর একটি এক মাইল দীর্ঘ গড় দেখিতে পাওয়া যায়, উহার প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝা যায় না। ঐ গড়ের উপর একস্থানে যে হাট বসে, তাহাকে ‘গড়ের হাট’ বলে।
মহব্বতপুরের গড়টি খোলপেটুয়া নদী পর্য্যন্ত গিয়াছিল। তখন খোলপেটুয়া এখনকার মত বড় নদী ছিল না। সম্ভবতঃ সেতু দ্বারা নদী পার হওয়ার ব্যবস্থা ছিল। নদীর পর পার হইতে সমুচ্চ প্রকাণ্ড গড় পুনরায় প্রায় ৩ মাইল দূরবর্তী কপোতাক্ষী নদী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পূর্ণ দুই মাইল পৰ্য্যন্ত এই গড় বেশ ভাল অবস্থায় বর্ত্তমান আছে। এই গড়ের উত্তর পার্শ্বে প্রতাপাদিত্যের নামানুসারে প্রতাপনগর গ্রাম এবং দক্ষিণ ধারে গড়- কমলপুর। কমলখোজা নামে প্রতাপের যে একজন বিশ্বস্ত প্রধান সেনাপতি ছিলেন, তাঁহার নামানুসারে এই দুর্গের নাম কমলপুর দুর্গ। ইহাকে সাধারণতঃ কপোতাক্ষী দুর্গ বলা হইত এবং ইহা পূর্ব্বদেশীয় বা ভৈরব ও কপোতাক্ষী পথে আগত শত্রু নিবারণের জন্য একটি প্রধান বহির্ব্বল ছিল। এই দুর্গ খোলপেটুয়া হইতে কপোতাক্ষী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত; ইহার উত্তর সীমায় গড় ও দক্ষিণ সীমায় একটি পরিখা ছিল। সে পরিখা এক্ষণে খালে পরিণত হইয়াছে। খালের দক্ষিণে একটি সুপেয় সলিলপূর্ণ পুষ্করিণী এখনও বিদ্যমান আছে। দুর্গের পূর্ব্বভাগে কপোতাক্ষীর পূর্ব্বধারে যেখানে এক্ষণে ভীষণ জঙ্গল রহিয়াছে, তথায় দমদমা ও গাদিগুমা নামক স্থানে এই দুর্গের ব্যবহারোপযোগী গোলাগুলি প্রস্তুত হইত।
৫. বেদকাশী দুর্গ॥ গড় কমলপুর হইতে কপোতাক্ষী দিয়া একটু দক্ষিণদিকে আসিলে কপোতাক্ষী ও খোলপেটুয়ার মোহানায় পড়া যায়। সেখান হইতে যুক্তনদী আড়পাঙ্গাসিয়া নামে সমুদ্রগামী হইয়াছে। এ মোহানা হইতে গোলখালি দিয়া শাঁখবাড়িয়ায় পড়িতে হয়; সে নদীতে জোয়ার দিয়া উত্তরমুখে গেলে নদীর পশ্চিমপারে বিখ্যাত বেদকাশী নামক স্থান।[১০] তথায় প্রতাপাদিত্যের বেদকাশী দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনও বৰ্ত্তমান আছে। স্থানীয় লোকে এই দুর্গকে ‘বড় বাড়ী’ বলে; উহার ইষ্টক গ্রথিত বহিঃপ্রাচীরের ভগ্নাংশ এখনও আছে। স্থানে স্থানে উচ্চ গৃহগুলির ভগ্নস্তূপ একতালা বাড়ীর মত উচ্চ রহিয়াছে। দুর্গটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ, উহার পরিমাণ ১৫০০X৮০০ হাত হইবে। দুর্গের চারিপাশে এখনও পরিখা আছে, তাহার বিস্তৃতি ৬০ ফুটের কম নহে। দুর্গের মধ্যে ২/৩টি পুকুর আছে, একটির নাম শীলপুকুর; সেটি সম্ভবতঃ পোস্তবাঁধা ছিল। দুর্গের মধ্যে সর্ব্বত্র রাশি রাশি ইষ্টক এখনও আছে; অনেক লোকে এই ইট কুড়াইয়া লইয়া কাদার গাঁথুনি করিয়া ঘর প্রস্তুত করিয়া বাস করিতেছে। দুর্গের বাহিরে বসন্ত রায়ের প্রতিষ্ঠিত উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গের মন্দির ও অন্যান্য মন্দির ছিল। সে কথা পরে বলিব।
৬. শিবসা দুর্গ। বেদকাশী হইতে বজ্ৰজে নদী দিয়া আড়ুয়া-শিবসা নদীতে পড়িতে হয়, অনতিদূরে এই আড়ুয়া-শিবসা এবং মূল শিবসা মিশিয়া প্রকাণ্ড ত্রিমোহানা হইয়াছে, উহাকে ‘রূপসার দহ’ বলে; এই স্থান হইতে যুক্তনদী মর্জ্জাল নামে সমুদ্রে পড়িয়াছে। মোহানার নিকট মর্জ্জালের পূর্ব্বপারে সুন্দরবনের আধুনিক ২৩৩ নং লাট; উহাকে সাধারণতঃ ‘সেখের টেক’ বলে। এই স্থানে প্রতাপাদিত্য পূৰ্ব্বদেশীয় শত্রু বা দস্যুর হস্ত হইতে রাজ্যরক্ষা করিবার জন্য একটি দুর্ভেদ্য ইষ্টকদুর্গ নির্মাণ করেন। উহাকে আমরা শিবসা দুর্গ বলিয়া পরিচিত করিব। পূর্ব্বে সেখের খাল, দক্ষিণে কালীর খাল, পশ্চিমে মর্জ্জাল বা মার্জ্জার নদী এবং উত্তরে শিবসার মোহানা, এই সন্ধিস্থানে এই দুর্গ নির্মিত হয়। এই দুর্গের বিশেষ বিবরণ ত দূরের কথা, অস্তিত্বের সংবাদও বিশেষ ভাবে সাধারণ্যে প্রচারিত হয় নাই।[১১] দুর্গের বেষ্টন প্রাচীর সর্ব্বত্র ইষ্টক-রচিত, উহার বেধ ৫ ফুট। দুর্গের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছি, কোন কোন ঘরের ভিতর দেওয়াল অনেকটা ঠিক আছে, এমন কি দেওয়ালের গায়ে কুলুঙ্গ বর্ত্তমান রহিয়াছে। সম্ভবতঃ পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিকে দুর্গের তোরণদ্বার ছিল। ইহার চতুঃপার্শ্বে পরিখার চিহ্ন আছে এবং বাহিরে একটি প্রকাণ্ড দীঘির খাত রহিয়াছে। দুর্গটির বাহিরে ঈশান কোণে একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে; উহা শিব-মন্দির বলিয়া অনুমান হয়। দক্ষিণ-পূৰ্ব্বদিকে কালীর খালের কূলে প্রতাপাদিত্যের যে কালীর মন্দির এখনও একপ্রকার অভগ্ন অবস্থায় আত্মরক্ষা করিতেছে, উহার বিশেষ বিবরণ সুন্দরবনের ইতিহাসে দিয়াছি (১ম খণ্ড, ৪১-৪৬ পৃ)।
৭. জগদ্দল দুর্গ॥ মোগলদিগের সহিত প্রতাপাদিত্যের রীতিমত সংঘর্ষ আরম্ভ হইলে, রায়গড় হইতে আরও উত্তরদিকে, বর্ত্তমান কাঁকনাড়া ও ভট্টপল্লীর সন্নিকটে জগদ্দল নামক স্থানে আর একটি দুর্গ নির্ম্মিত হয়; উহারই নাম জগদ্দল দুর্গ। ইহা গঙ্গার ঠিক পূৰ্ব্বতীরে অবস্থিত; তিন দিকে বিস্তৃত পরিখা ছিল; কেবল মাত্র পশ্চিমদিকে ভাগীরথী দ্বারা পরিখার কার্য্য হইত। কেহ কেহ অনুমান করেন, প্রতাপের পূর্ব-বিভাগের সৰ্ব্বপ্রধান কর্তা জগৎসহায় দত্তের নামানুসারে জগদ্দল নাম হইয়াছে; উহা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারি না, কারণ জগদ্দল নাম পূর্ব্বেও ছিল।[১২] যদিও নানা কলকারখানায় জগদ্দলের অধিকাংশ ব্যাপিয়া রহিয়াছে, তথাপি তথাকার দুর্গচিহ্ন বিলুপ্ত হয় নাই। পরিখাগুলি সুস্পষ্ট আছে, স্থানে স্থানে উহার খাত পুষ্করিণীতে পরিণত করিয়া লওয়া হইয়াছে। ইহার উপর দিয়া সদর রাস্তা চালাইবার জন্য রীতিমত পুল করিতে হইয়াছে। দুর্গের মাঝখানে এখনও একটি বাঁধা ঘাটওয়ালা পুষ্করিণী ‘রাজপুষ্করিণী’ নামে কীর্তিত হয়। ভাগীরথীর উপর যেখানে দুর্ভেদ্য প্রাকার-বেষ্টিত রাজবাটী ছিল, তথায় কতজনে গঙ্গাবাসের জন্য বাড়ী করিয়া লইয়াছেন। প্রতাপাদিত্যের সময়ে জগদ্দল দুর্গ রাজপরিবারের গঙ্গাবাসের জন্য ব্যবহৃত হইত। বসন্ত রায়ের সহিত রাজ্য বিভাগের পর তিনি যেমন অধিকাংশ সময় সপরিবারে রায়গড়ে বাস করিতেন, প্রতাপও সেইরূপ কখনও কখনও জগদ্দল থাকিতেন।[১৩]
৮. সালিখা দুর্গ॥ প্রতাপাদিত্যের আর একটি দুর্গের নাম সালিকা দুর্গ। এই সালিখা দুর্গ কোথায়, তাহা লইয়া মতভেদ আছে। রাজবংশীয়দের বংশগত প্রবাদ হইতে জানা যায়, সালিখা নামে প্রতাপের একটি দুর্গ ছিল। কাটুনিয়ার রাজা যতীন্দ্রমোহন রায় বলেন, বর্তমান কলিকাতার অপর পারে হাওড়ায় যে সালখিয়া আছে, সেখানেই প্রতাপের দুর্গ ছিল এবং এই স্থানে ভাগীরথী-বাণিজ্যের শুল্ক আদায় হইত। রেলওয়ে কোম্পানিগুলির কার্য্যের উৎপাতে হাওড়া সহরের এত পরিবর্তন হইয়াছে যে, কোন প্রাচীন কীর্ত্তির চিহ্ন, কিছুই উদ্ধার করিবার উপায় নাই। রামরাম বসুও বলেন, সালকিয়া থানায় প্রতাপের সহিত মোগলদিগের শেষবার যুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু সে সালখা হাওড়ার সালখিয়া বলিয়া বোধ হয় না। ‘বহারিস্তান’ নামক পারসিক গ্রন্থ হইতে জানিতে পারি, শেষবার সাখায় মোগলের সহিত প্রথম নৌযুদ্ধ হয় এবং উহা যশোর রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত।[১৪] আরও জানিতে পারি, ঐ যুদ্ধের পরদিন কুচ (march) করিয়া মোগল সৈন্য বুধন বা বুড়ন দুর্গে পৌঁছিয়াছিল। এই বুড়ন প্রতাপের রাজধানী হইতে অধিক দূরবর্তী নহে, কারণ তিনি একটি খাল দিয়া সহজে সেখানে পৌঁছিয়াছিলেন। এই খালটি বোধ হয় এখনকার কালিন্দী নদী। হাসনাবাদের দক্ষিণে বুড়নহাটি নামক যে স্থান আছে, খুব সম্ভবতঃ উহাকেই মোগলেরা বুড়ন দুর্গ বলিয়াছেন। ঐ স্থানে প্রতাপাদিত্যের সৈন্যসামন্তের সাময়িক ছাউনী পড়িত, কোন সুরক্ষিত দুর্গ ছিল না। ঐস্থান হইতে উত্তরদিকে ১০/১২ মাইল দূরে ইছামতীর কূলে সাখা হইতে পারে। আমাদের মনে হয়, যমুনা ও ইছামতী যে টিবির মোহানায় মিশিয়াছে, তাহারই সান্নিধ্যে কোথায়ও সাল্খা থানা ছিল; ঐ মোহানার নিকটে সাখি বলিয়া একটি নদী ইছামতীতে মিশিয়াছিল। রেণেলের প্রাচীন ম্যাপে সে নদী আছে,[১৫] কিন্তু আধুনিক ম্যাপে নাই। সম্ভবতঃ নদীটি মজিয়া বিলুপ্ত হইয়াছে। এই নদীর মোহনায় সাল্খা থানা হওয়া খুব সম্ভবপর। কারণ, এই স্থানে পৰ্য্যাপ্ত নৌবাহিনী লইয়া দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান থাকিতে পারিলে উত্তরদিকের শত্রু ভাগীরথী-যমুনা বা ভৈরব- ইছামতী যে পথেই আসুক না কেন, তাহার গতিরোধ করা যায়। সম্ভবতঃ এইস্থানে মোগলের সহিত প্রথম নৌযুদ্ধ আরম্ভ হইয়া সে যুদ্ধ কয়েকদিন চলিয়াছিল (রামরাম বসুর মতে যুদ্ধ সাতদিন চলিয়াছিল); এই কয়েক দিন মোগলেরা যেমন অগ্রসর হইতেছিল, প্রতাপের সৈন্যদল তেমনি হটিয়া যাইতেছিল, পরে কয়েকদিন পরে যেখানে যুদ্ধ শেষ হইল, সেখান হইতে বুড়ন ১০/১২ মাইল বা একদিনের দূরবর্ত্তী হইতে পারে। মোটকথা, ইছামতীর কূলবর্তী টাকি প্রভৃতি স্থান হইতে টিবির মোহানা পৰ্য্যন্ত যে স্থানে সাল্খা ছিল সেখানে প্রতাপের জ্যেষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্য যথাসম্ভব সত্বরতার সহিত একটি মৃন্ময় দুর্গ রচনা করিয়া লইয়াছিলেন।
যে কয়েকটি দুর্গ বর্ণিত হইল, তাহা হইতে বুঝা যাইবে যে, উত্তর দিক হইতে শত্রু (অর্থাৎ মোগল শত্রু) আসিলে, তাহাকে বাধা দিবার জন্য প্রতাপাদিত্যের কি ব্যবস্থা ছিল। শত্রু প্রধানতঃ ভাগীরথী দিয়াই আসিবার কথা; সে পথে আসিয়া শত্রু যদি ত্রিবেণী হইতে যমুনাতে প্রবেশ করিত, তাহা হইলে তাহাকে তৎক্ষণাৎ বাধা দেওয়া হইত না; শত্রুকে সাহসে ভর করিয়া যমুনাপথে অনেকদূর যাইতে হইত। দৈবক্রমে ভৈরব ও ইছামতী দিয়া শত্রু আসিলেও ঐ একই কথা, যমুনা-ইছামতীর সঙ্গমের পূর্ব্বে তাহাকে বাধা দেওয়া হইত না। প্রয়োজন হইলে সেই সঙ্গমস্থলে, অর্থাৎ টিবির মোহানায় (সম্ভবতঃ এইস্থানেরই নাম ছিল সালখা) নৌবাহিনী দ্বারা শত্রুকে প্রতিনিবৃত্ত করিবার চেষ্টা হইত। নতুবা তাহাকে প্রলুব্ধ করিয়া তরঙ্গসঙ্কুল বন্য নদীপথে আরও অগ্রসর হইতে দেওয়া হইত। কালিন্দী ও যমুনার সঙ্গমস্থলে, বসন্তপুরের নিকটে আসিয়া শত্রুবাহিনী দেখিত প্রতাপের অসংখ্য রণতরী কামান সজ্জিত করিয়া বিপক্ষের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত। এক পারে বুড়নে সৈন্য-শিবির, অপর পারে দমদমার গুলি- বারুদখানা। সেখান হইতে একটু অগ্রসর হইলে, দক্ষিণ দিকে মুকুন্দপুর দুর্গ এবং মহব্বৎপুরের গড়ের অসংখ্য অগ্নিবর্ষী তোপ সজ্জীভূত। সে সব স্থানেও যদি যুদ্ধজয় করিয়া বা অন্য কোন উপায়ে যমুনা বাহিয়া আরও অগ্রবর্ত্তী হইতে বিপক্ষের পক্ষে সুযোগ হইত, তাহা হইলে যমুনা ও ইছামতীর যুক্ত সঙ্গমে যশোহরের দুরাক্রম্য দুর্গের ভীষণ বুরুজখানা তাহার সর্ব্বনাশ সাধন করিতে উদ্যত হইত। শত্রু যদি যমুনা বা ইছামতী দিয়া না আসিয়া ভৈরব পথে কপোতাক্ষ দিয়া আসিত, তাহা হইলে তাহার অভ্যর্থনার জন্য কমলপুরের কপোতাক্ষদুর্গ এবং আরও পূর্ব্বদিকে যদি শিবসা বাহিয়া আসিত, তবে শিবসা দুর্গ প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হইত। কিন্তু উত্তর দেশীয় শত্রুর পক্ষে শিবসা পথে আসা সহজ বা সুবিধাজনক ছিল না। এজন্য শিবসা ও বেদকাশী দুর্গ সাধারণতঃ পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দেশীয় শত্রুকেই বাধা দিত।
শত্রু-সৈন্য যদি ভাগীরথী হইতে যমুনায় প্রবেশ না করিয়া আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইত, তাহা হইলে প্রথমতঃ জগদ্দলে পরে রায়গড় হইতে তাহাদের গতিরোধ করিবার চেষ্টা হইত। তখন খিদিরপুর হইতে খনিত খালে ভাগীরথীর সহিত সরস্বতী বা রূপনারায়ণের সংযোগ হয় নাই, তখন আদিগঙ্গা পথেই বাণিজ্য পথ ছিল। সে পথে গেলে বিদ্যাধরী নদী দিয়া বৰ্ত্তমান মাতলার কাছে পৌঁছিতে হয়। সেখানে প্রতাপের একটি দুর্গ ছিল। বিদ্যাধরীতে না পড়িয়া গঙ্গার পথে গেলে গঙ্গার সাগরসঙ্গমে সগরদ্বীপ; সেই স্থানে একটি দুর্গ ও নৌবাহিনীর পর্যাপ্ত সমাবেশ ছিল। উত্তরদিশ্বর্ত্তী শত্রুর কখনও নানা বাধা অতিক্রম করিয়া সমুদ্রে পড়িবার সাধ থাকিত না। মাতলা বা সগর দুর্গ প্রধানতঃ মগ ও ফিরিঙ্গি প্রভৃতি সামুদ্রিক দস্যুদিগের জন্যই নির্ম্মিত হইয়াছিল। কিন্তু শুধু এই দুইটি দুর্গ নহে, দক্ষিণ দিকেও শ্রেণীবদ্ধ ভাবে কতকগুলি নৌদুর্গ ছিল। তাহারই কথা এখন বলিব। উত্তর সীমায় যেমন শিবসা হইতে রায়গড় পৰ্য্যন্ত ৫/৬ টি দুর্গ ছিল এবং এই সকল স্থানে যেমন স্থল-যুদ্ধের উপাদানই প্রধানতঃ সজ্জীভূত থাকিত, দক্ষিণ দিকের মগ, ফিরিঙ্গি প্রভৃতি শত্রুর জন্য সেইরূপ ধুমঘাট হইতে মাতলা পৰ্য্যন্ত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নদীমোহানায় এক শ্রেণী দুর্গ ছিল এবং সেই সকল দুর্গে জলযুদ্ধের জন্য সুসজ্জিত রণ-তরীসমূহ সৰ্ব্বদা প্রস্তুত থাকিত। প্রথমোক্ত দুর্গশ্রেণীতে রসদাদি ও লোকজনের যাতায়াত জন্য যেরূপ উচ্চ মৃন্ময় গড় প্রস্তুত হইয়াছিল, দক্ষিণ দিকের দুর্গশ্রেণীর জন্যও সেইরূপ স্থানে স্থানে খনিত খাল দ্বারা নদীপথে যাতায়াতের জন্য সোজা পথ আবিষ্কৃত ও সুরক্ষিত হইয়াছিল। মানচিত্র হইতে ইহা সহজে বোধগম্য হইবে।
৯. মাতলা দুর্গঃ কপোতাক্ষ দুর্গ হইতে দক্ষিণ দিকে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষী নদী মিশিয়া আড়পাঙ্গাসিয়া নাম ধারণ করে। আবার ধুমঘাটের নিম্নে ইছামতী নদী যমুনা হইতে বিমুক্ত হইয়া উক্ত পত্তনের পূর্ব্বসীমায় কদমতলী নাম ধারণ করে এবং পরে দক্ষিণদিকে আসিয়া মালঞ্চ হয়। বহু দক্ষিণে আসিয়া এই মালঞ্চ আবার আড়পাঙ্গাসিয়ার সহিত মিশিয়া সমুদ্রে পড়িয়াছে। ধুমঘাট পত্তনের দক্ষিণে মালঞ্চ ও আড়পাঙ্গাসিয়ার মধ্যে সামান্য ব্যবধান ছিল। প্রতাপাদিত্যের সময়ে এক খনিত খাতের দ্বারা এই ব্যবধান বিলুপ্ত হয়। এই খাতের নাম ‘আড়াইবাকীর দোয়ানিয়া’[১৬] কারণ উহা মাত্র আড়াই বাঁক দীর্ঘ। আড়াইবাঁকীর নয়নাভিরাম মোহানা হইতে একটু দক্ষিণে গেলে মালঞ্চ ও যমুনার মধ্যে সামান্য ব্যবধান ছিল, প্রতাপের পর্তুগীজ সেনাপতির ব্যবস্থায় আর একটি খনিত খাত দ্বারা উভয়ের সংক্ষিপ্ত সংযোগ সাধিত হয়; এই খাতকে এখনও ফিরিঙ্গির দোয়ানিয়া’ বলে। এই দোয়ানিয়ার মুখ হইতে যমুনা পথে একটি শাখানদী দিয়া রায়মঙ্গলে পড়িতে হয়;[১৭] রায়মঙ্গল বাহিয়া আরও উত্তরদিকে আসিয়া বড় কলাগাছিয়া ও আঠারবাঁকী নদী দিয়া অবশেষে মাতলার কাছে বিদ্যাধরীতে মিশিতে হইত; মাতলার নিকট সেই মোহানায় একটি দুর্গ ছিল। ইহাকে মাতলাদু বলে; প্রতাপের বিখ্যাত সেনাপতি হায়দর মানক্বী এই দুর্গের অধ্যক্ষ ছিলেন বলিয়া ইহার নাম হইয়াছিল— হায়দরগড়।[১৮]
১০. আড়াইবাঁকী দুর্গ॥ আড়পাঙ্গাসিয়া ও মালঞ্চের মধ্যবর্তীস্থানে পূর্ব্বোক্ত আড়াইবাকীর খনিত খালের উত্তরাংশে একটি দুর্গ ও নৌবাহিনীর প্রধান আড্ডা ছিল। অগাষ্টাস্ পেড্রো নামক একজন বিখ্যাত পর্তুগীজ নৌ-সেনাপাতি এই স্থানের অধ্যক্ষ ছিলেন। এই দুর্গকে আড়াইবাকীর দুর্গ বা ফিরিঙ্গি দুর্গ বলা যাইতে পারে।[১৯] দুর্গের নিম্নে নৌবহর রাখিবারও ব্যবস্থা ছিল। একটু পূর্ব্বদিকে বংশ-কঞ্চিকার মত অর্দ্ধচন্দ্রাকারে একটি খাল খনিত হয়। ইহাকে কঞ্চিকার খাল বলিত।[২০] ঝটিকাদির সময়ে সমস্ত জাহাজ ও নৌকা নিরাপদে এই খালের মধ্যে রাখা হইত। ধুমঘাট দুর্গ হইতে মাতলা দুর্গ পর্য্যন্ত সমস্ত জলপথের রক্ষণাবেক্ষণ কার্য্য ফিরিঙ্গি সেনাপতি দ্বারা সাধিত হইত; এজন্য এই দীর্ঘ জলপথকে ‘ফিরিঙ্গি ফাঁড়ি’ বলিত, ইহা ফিরিঙ্গি জাতীয় নাবিক প্রহরী দ্বারা রক্ষিত কর্ম্মক্ষেত্র। শত্রুর গতিবিধি দেখিবার জন্য এই পথে সৰ্ব্বদা চৌকি-নৌকা বা রণতরী চলাফেরা করিত এবং মোহানায় মোহানায় সাহায্যকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহর সজ্জিত থাকিত। এই বহরের অধ্যক্ষদিগকে মীরবহর বলিত। আমরা পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে বিশদভাবে দেখাইয়াছি, আরাকানী মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুরা কিরূপে বঙ্গোপসাগর হইতে নদীপথে দেশের ভিতর প্রবেশ করিয়া শান্ত পল্লীবাসীর ধনপ্রাণ ও মানসম্ভ্রমের উপর অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছিল। মহারাজ প্রতাপাদিত্য এই ফিরিঙ্গি ফাঁড়ির সুরক্ষণ ও সুব্যবস্থা করিয়া এই দস্যুদলকে বারংবার পর্যুদস্ত করিয়াছিলেন এবং তাহাদের দৌরাত্ম্য হইতে দেশরক্ষা করিয়া বহুদিন পর্য্যন্ত সৰ্ব্বজাতীয় প্রজাবর্গের প্রীতিভাজন হইয়াছিলেন। সুন্দরবনের নদীপথে যখন তখন যে সব খণ্ড-যুদ্ধ হইত, তাহার কোন বিবরণী নাই। কিন্তু যে সুন্দরবনে কোন কালে লোকের বসতি ছিল কিনা বলিয়া কতজনের সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে, প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে সে সুন্দরবনের জনবহুলতা এবং বিপুল সৈন্যবল সংগ্রহের কথা দেশের এক নূতন অবস্থার কথা বিজ্ঞাপিত করে। এখন হয়ত কোন ফিরিঙ্গি দস্যুর হত্যার জন্য প্রতাপাদিত্যের চরিত্রে কালিমা অর্পণ করিবার জন্য আমরা মহাব্যস্ত, কিন্তু সে হত্যার পশ্চাতে দস্যু কর্তৃক আমাদের স্বজাতীয় ও স্বদেশীয়দিগের হত্যার কি শোণিত-স্রোত প্রবাহিত ছিল, তাহার আমরা সন্ধান রাখিব না! এই সকল দস্যুগণ শুধু দেশের মধ্যে নহে, দেশীয়দিগের রাজনৈতিক বিবাদ-বিসম্বাদের মধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক কত ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি করিয়া স্বাধীনতা প্রয়াসী প্রতাপের রাজনৈতিক জীবনকে কত বিড়ম্বিত করিয়াছিল, তাহা ভাবিয়া দেখিবার উপযুক্ত বিষয়। এই দস্যুদলের জন্য তাঁহাকে পর্যাপ্ত যুদ্ধায়োজন করিতে হইয়াছিল এবং তাঁহার নৌ-সেনানীদিগকে পাশ্চাত্য প্রণালীতে কামান সাজাইয়া সৰ্ব্বদা সতর্ক হইয়া থাকিতে হইত। এই একাগ্র চেষ্টার ফলে ভাগীরথীর মোহানা হইতে মধুমতীর মোহানা পর্য্যন্ত সমগ্র যশোর রাজ্যের দক্ষিণভাগ এমন সুন্দরভাবে সুরক্ষিত হইয়াছিল যে, তাহা ভাবিলেও বিস্ময়ান্বিত হইতে হয়। এই সকল স্থানে প্রত্যেক বড় নদীর মোহানায় বা নদী-সঙ্গমে দুর্গ বা নৌ-সেনা রাখিবার ব্যবস্থা ছিল। হয়ত সকল সন্ধান আমরা দিতে পারিলাম না এবং পারিবারও সম্ভব না কম। কিন্তু আমরাই বহু সন্ধানের ফলে যে সংবাদ দিতেছি, তাহাতেই প্রকৃত অবস্থার একটা মোটামুটি আভাস পাওয়া যাইবে। পশ্চিম প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা নদীপথে দেশ রক্ষার প্রণালীটি দেখাইতে চেষ্টা করিলাম।
১১. সগর দুর্গ ভাগীরথীর মুখে সগরদ্বীপে একটি প্রধান দুর্গ ও নৌসংস্থান ছিল। কেহ কেহ অনুমান করিয়াছিলেন যে, সগরে প্রতাপাদিত্যের প্রধান রাজধানীই ছিল, সে মতের প্রতিবাদ কল্পে আমাদের যাহা বলিবার ছিল, পূর্ব্বে বলিয়াছি এবং সেই প্রসঙ্গে সগর দুর্গের পার্শ্ববর্ত্তী স্থানে যে সমস্ত প্রাচীন ভগ্নাবশেষ দেখা দিয়াছে, তাহারও বিবরণ দিয়াছি। সুতরাং এখানে সগর দুর্গ সম্বন্ধে পুনরায় কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই।
১২. মণি দুর্গ। ভাগীরথী হইতে পূর্ব্বদিকে প্রধান মোহানা জামিরা নদীর। সে নদী দিয়া শত্রু আসিয়া ঠাকুরাণী নদীতে পড়িলে, উহার শাখা মণি নদীর পার্শ্বে একটি দুর্গ ছিল। এই স্থান এক্ষণে ২৬ ও ১১৬ নং লাটের মধ্যে। এই দুর্গকে মণি দুর্গ বলিতে পারি; কারণ ইহা মণি নদীর পার্শ্বে এবং স্থানটিকে এখনও মণির টাট বলে। এ দুর্গকে জয়নগর দুর্গও বলা যায়, কারণ ইহার পার্শ্বে ১১৭, ১১৮, ১১৯, ১২০ এই সব লাটগুলি একত্র যোগে জয়নগর বলিয়া চিহ্নিত হয় এবং মণির টাটের মধ্য দিয়া প্রবাহিত একটি খালকে এখনও জয়রাম হাতীর গড় বলে। ‘হাতী’ কৈবর্ত্তদিগের একটি উপাধি। কৈবর্ত্তবংশীয় জয়রাম মণি দুর্গের অধ্যক্ষ থাকা বিচিত্র নহে এবং তাঁহার নাম হইতে পার্শ্ববর্ত্তী বিস্তীর্ণ ভূভাগের নাম জয়নগর হইতে পারে। মণির টাটে মৃন্ময় প্রাচীরের চিহ্ন আছে এবং পার্শ্বস্থ রায়দীঘি ও কঙ্কণদীঘি নামক দুইটি বৃহৎ জলাশয় রায়গড় দুর্গপতির সহিত সম্বন্ধ বুঝাইয়া দিতেছে। দুর্গের বাহিরে মণি নদীর মোহানার কাছে একটি উত্তুঙ্গ মন্দির আছে, উহাকে ‘জটার দেউল’ বলে। বহুদূর হইতে এই দেউল দেখা যায়; উহার উচ্চতা ৬০/৭০ ফুটের কম হইবে না। সম্ভবতঃ ইহা একটি বিজয়-স্তম্ভ।[২১] ইহার বয়স ৪/৫ শত বৎসর বলিয়া অনুমিত হইয়াছে। সুতরাং উহা প্রতাপাদিত্যের আমলের বিজয়স্তম্ভ হওয়া বিচিত্র নহে। কথিত আছে, ইহারই নিকটবর্ত্তী বিদ্যাধরী নদীর এক মোহানায় প্রতাপ সেনানী রুডা একটি নৌযুদ্ধে মোগলদিগকে পরাজিত করেন (Bengal, Past and present, Vol. II, p. 259)। জটাল দেউল একটি মৃত্তিকা স্তূপের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাহিরের মাপ ৩০′-৯′′ ×৩০′-৯′′, ভিতর ১০′-৯′′ ×১০′-৯′′ এবং ভিত্তি ১০ ফুট। উচ্চতা প্রায় ৭০ ফুট। পূর্ব্বদিকে একটি মাত্র প্রবেশ পথ, উহা ৯′-৬′′ বিস্তৃত। দেউলটি পাতলা ইটের গাঁথুনি, আগাগোড়া সুন্দর কারুকার্য্যমণ্ডিত, শুধু নিম্নের ১৮ ফুট মধ্যে বাহিরের ইট ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় শিল্পকলা বিলুপ্ত হইয়াছে। গভর্ণমেন্ট হইতে ইহার সংস্কারের আয়োজন চলিতেছে। জামিরার পূর্ব্বভাগ মাতলা নদী দিয়া শত্রু আসিলে, তাহাদিগকে প্রসিদ্ধ মাতলা বা হায়দর দুর্গে প্রতিরোধ করিত। এখান হইতে ধুমঘাট বা যশোহর যাইতে পূর্ব্বোক্ত ফিরিঙ্গি ফাঁড়ি দিয়া সোজা পথ ছিল বলিয়া এ দুর্গ এত উত্তরদিকে সংস্থাপন করা হয়।
১৩. রায়মঙ্গল দুর্গ॥ মাতলার পূর্ব্বে রায়মঙ্গলের মোহানাই প্রধান এবং উহা একটি ভীষণ সঙ্কটময় স্থান। রায়মঙ্গলের পথে শত্রু আসিলে রায়মঙ্গল ও কলাগাছিয়ার সঙ্গমস্থলে বৰ্ত্তমান ১৪৬ নং লাটে একটি দুর্গ ছিল, উহার নাম রায়মঙ্গল দুর্গ।[২২] কথিত আছে, ইহার আশ্রয়ে প্রতাপাদিত্যের টঙ্কশালা (টাকশাল) এবং মহাপরাধীদিগকে নির্ব্বাসন দিবার জন্য কারাগার ছিল। এখানে ইষ্টকন্তূপাদি আবিষ্কৃত হইয়াছিল।[২৩] রায়মঙ্গলের পূর্ব্ববর্ত্তী মালঞ্চের মোহানা দিয়া শত্রু আসিলে সমগ্র ফিরিঙ্গি ফাঁড়ির শাসনদণ্ড এবং রাজধানীর সর্ব্বপ্রধান নৌ-দুর্গ তাহাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইত। ইহা ব্যতীত আড়পাঙ্গাসিয়া যেখানে মালঞ্চে মিশিয়াছে, সেখানে, ১৮৮ নং লাটের পশ্চিম সীমানায় একটি স্থানে অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। ১৭৯ নং লাটে হরিখালি নামক সুদীর্ঘ খালের একটি পাশখালির কূলে একটি বড় ইষ্টকগৃহের ভগ্নাবশেষ আছে। এ সকল স্থানে রীতিমত দুর্গ প্রতিষ্ঠা কঠিন ব্যাপার, বিশেষতঃ পূর্ব্বোক্ত লাট সমুদ্রের অতি সন্নিকটে। আরও পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইলে মর্জ্জালের মোহানা। এই মর্জ্জালের উপরই শিবসা দুর্গ, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। মর্জ্জালের পূর্ব্বদিকে পশরের মোহানা। ঐ পশর ও পানকুশী নদীর সঙ্গমস্থলে ঝাপা নামক শাখানদীর উত্তরভাগে ইষ্টকগৃহাদির ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হয়। এই অংশ এখন এমন নিবিড় জঙ্গল সমাচ্ছন্ন যে, ইহা এখনও ফরেষ্ট বা বন-বিভাগের শাসনাধীন হয় নাই।[২৪] পশরের পরে বিখ্যাত বলেশ্বর বা মধুমতীর মোহানা— উহার নাম হরিণঘাটা। এখানে সম্ভবতঃ কোন বিখ্যাত বন্দর ছিল, তাহা এক্ষণে বিনষ্ট হইয়াছে।[২৫]
১৪. চকশ্রী দুর্গা যশোর-রাজ্যের পূর্ব্বদিক হইতে শত্রুর আগমনের সম্ভাবনা অল্প। এজন্য এদিকে অধিক সংখ্যক দুর্গ নাই। চকশ্ৰী বা চাকশিরি দুর্গই এ দিকের প্রধান দুর্গ ও নৌসেনা-নিবাস। চাকশিরি লইয়া প্রতাপাদিত্যের সহিত তাঁহার খুল্লতাত রাজা বসন্ত রায়ের যে বিষম বিবাদ হয়, তাহা ইতিহাস প্রসিদ্ধ হইয়াছে। সুতরাং চাকশিরির অবস্থানের যে একটা বিশেষত্ব ছিল, তাহা সহজে অনুমেয়। এই চাকশিরি কোথায়, এই বিষয় লইয়া লেখকদিগের মধ্য নানা মতভেদ দৃষ্ট হয়, কারণ তাঁহারা কেহই স্থানটি চক্ষে দেখিয়া লিখেন নাই। শুধু ইতিহাসের খাতিরে নহে, চাকশিরির নদী-দৃশ্য একটি দেখিবার জিনিষ।
খুলনা জেলার বাগেরহাট হইতে ছয় মাইল পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে এবং রামপাল থানার ছয় সাত মাইল পূর্ব্বোত্তরে বর্ত্তমান চকশ্রী অবস্থিত। পশ্চিম ও উত্তরে ধৌতখালি এবং পূর্ব্ব ও দক্ষিণে কুমারখালি নামক দুইটি শাখা নদী এই চককে বেষ্টন করিয়া রামপালের সন্নিকটে উভয়ে মিলিত হইয়াছে এবং তথা হইতে ‘মঙ্গলা’ নাম ধারণ করিয়া পশরে গিয়া পড়িয়াছে। পূৰ্ব্বকালে ধৌতখালি হইতে রামপাল পর্য্যন্ত সমস্ত স্থানটির নাম ছিল চকশ্রী।[২৬] কারণ এই স্থানের নবোত্থিত আবাদ শস্য-প্রাচুর্য্যে সমস্ত চকের শ্রী-সম্পাদন করিয়াছিল। এখন চাকশিরিরর মধ্যে অনেকগুলি গ্রাম হইয়াছে। পূর্ব্বে ভৈরব হইতে পশর পর্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগ জলাকীর্ণ ছিল। উহার মধ্যে রঙ্গদ্বীপ (রাঙ্গদিয়া), মধুদ্বীপ (মধুদিয়া), পরবর্তী মধুদ্বীপ (পারমধুদিয়া) প্রভৃতি দ্বীপের উন্মেষ হইলেও সমস্ত স্থানের মাঝে মাঝে বহু বিস্তৃত বিল ছিল। সুতরাং মধুমতী বা ভৈরব নদ হইতে পশ্চিম-দক্ষিণমুখে সুন্দরবনের দিকে অগ্রসর হইতে হইলে, চকশ্রীর পথে আসিতে হইত এবং ঐ স্থলে সুদৃঢ় সৈন্যাবাস বা নৌ-বাহিনী থাকিলে, শত্রুর গতি প্রতিহত করা যাইত। বিশেষতঃ চারিদিকে চক্রাকারে নদী থাকাতে জাহাজ ও নৌকা প্রভৃতি নিরাপদে রাখা চলিত 1 চাকশিরির এই অবস্থান-কৌশলের জন্যই প্রতাপাদিত্য এই স্থানে একটি প্রধান নৌ-সেনার আড্ডা করিতে সঙ্কল্প করেন। রাজ্য রক্ষার জন্য সে সংকল্প এত প্রয়োজনীয় যে, তজ্জন্য তিনি অবশেষে পিতৃব্যের সহিত বিবাদ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। সে বিবাদের বিবরণ পরে দিব।
চকের উত্তর সীমায় ধৌতখালির দক্ষিণ কূলে যেখানে এখন চাকশিরির হাট বসে, তাহাই দুর্গের স্থান। ধৌতখালির উত্তর পার হইতে উহার ফটো লওয়া হইয়াছিল। এই চাকশিরির নিকটবর্ত্তী কালীগঞ্জ, চণ্ডীতলা, কালিকাতলা, দুর্গাপুর প্রভৃতি এই স্থানে হিন্দু প্রাধান্যের পরিচয় দিতেছে। হাটের দক্ষিণাংশে একটি কালীমন্দিরের ভগ্নাবশেষ এখনও আছে এবং প্রাচীন একটি পুকুরও তাহার পার্শ্বে রহিয়াছে। পার্শ্ববর্তী একব্বরিয়া গ্রামের পূর্ব্বভাগে একটি প্রকাণ্ড দীঘি আছে, উহা উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। সম্ভবতঃ দীঘিটি প্রতাপাদিত্যের সময়ে খনিত এবং উহার সন্নিকটে দুর্গাধ্যক্ষের আবাস গৃহাদি ছিল। এখন কিন্তু লোকে তাহা বিশ্বাস করিতে চায় না; বড় দীঘি দেখিলেই লোক বলে, তাহা খাপ্পাই কীৰ্ত্তি, অর্থাৎ খাঁ জাহান কর্তৃক খনিত দীঘি। সে কথার কোন মূল্য নাই, কারণ পুরাতন অধিবাসীর কোন বংশধর এখানে বাস করিতেছেন না। এখন চাকশিরির কিছুই নাই; আছে মাত্র প্রাচীন নাম আর আছে মাত্র এখানকার হাট, উহা মঙ্গল ও শুক্রবারে লাগে। ইহাকে এ অঞ্চলে কাটিকাটা হাট বা সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন হাট বলে; এবং সুন্দরবনের পূর্ব্বভাগের আবাদের বহুলোক এখানে আসিয়া হাট করে।
উপরিভাগে প্রতাপাদিত্যের যে ১৪টি প্রধান দুর্গের কথা বলা হইল, তদ্ব্যতীত আরও কতকগুলি ছোট ছোট দুর্গের সন্ধান পাওয়া যায়।[২৭] কেহ কেহ বলেন, সুদূর পূর্ব্ব কোণে মেঘনা নদীর মোহানার নিকট কোন স্থানে একটি দুর্গ ছিল; পূর্ব্বদেশীয় সৈন্যের অধিপতি রঘু নামক সেনানী সেখানে অধ্যক্ষ থাকিতেন। ঘটককারিকাতেও ‘প্রাচ্যপতি রঘু’ একজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন বলিয়া বর্ণিত আছে। কিন্তু দুর্গের কোন বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায় না এবং ইহার অস্তিত্ব সম্বন্ধেও সন্দেহ করি। উত্তরভাগে আধুনিক যশোহর সহরের সন্নিকটে মুড়লীতে প্রতাপাদিত্যের একটি সৈন্যাবাস ছিল; চাঁচড়া রাজবংশের পূর্ব্বপুরুষ ভবেশ্বর রায় ইহার কিলাদার বা দুর্গাধ্যক্ষ ছিলেন বলিয়া প্রবাদ আছে। এই তথ্যের সত্যাসত্য আমরা পরে বিচার করিব। মোগলের সহিত প্রতাপের বিশেষ ভাবে সংঘর্ষ উপস্থিত হইল, ধুমঘাটের ৫/৬ মাইল উত্তরে মৌতলায় একটি দুর্গ নির্ম্মিত হয়। ইহারই পার্শ্বে জাহাজঘাটা বা নৌ-বাহিনী সংস্কার ও নির্মাণ করিবার জন্য প্রধান কৰ্ম্মশালা ছিল। এখানে অনেক নাব-সৈন্য থাকিত এবং গুলিবারুদ প্রস্তুত হইত। এই স্থানে একজন ফিরিঙ্গি অধ্যক্ষ ছিলেন এবং তাঁহারই বাসের জন্য জাহাজঘাটায় প্রশস্ত বাসগৃহ ছিল। রাজা বসন্ত রায়ের পুত্র চাঁদ রায় বা চন্দ্রশেখর রায় এই সকল ব্যাপারের সহকারী ছিলেন।
পাদটীকা :
১. [পরে ইহা ‘মুকুন্দপুর দুর্গ” বলিয়াও উল্লেখিত হইয়াছে।— শি মি
২. দীঘিটি এখনও অত্যন্ত গভীর; উহাতে বারমাস জল থাকে। ৫০ বৎসর পূর্ব্বে ইহা দামদলে একেবারে ঢাকা ছিল, এখন অনেকটা পরিষ্কৃত হইয়াছে। তবুও কূলের দিকে হোগলা ও নল নটা যথেষ্ট আছে। কেহ কেহ উহার কতকাংশ ঘিরিয়া লইয়া আপন আপন পুকুর করিয়া লইয়াছেন। উত্তর পাহাড়ে পুষ্প ব্যবসায়ী কৈবর্ত্তদিগের বাস। তাঁহাদের একজন বাঁধ দিয়া দীঘির যে অংশ নিজস্ব করিয়া লইয়াছেন, তাহার উত্তর কূলে একটি পুরাতন পাকা ঘাট আছে। দীঘিটি এখন বামাচরণ রায় মহাশয়ের জমার অধীন; দীঘিতে অনেক মৎস্য আছে, তজ্জন্য উহার জলকর আছে এবং তজ্জন্যই হয়ত ২/১টি মেছকুমীর জুটিয়াছে।
৩. ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়ে’র গ্রন্থকার প্রতাপচন্দ্র ঘোষ বলেন, বর্দ্ধমানাধিপের এক রাজধানী এক সময়ে এই স্থানে ছিল। দ্বারি নামক তাঁহারই কোন মহিলার অর্থে এই জাঙ্গাল নির্ম্মিত হয়। সেই রাজারই বাইমহল এখন বেহালা নামে পরিচিত। এখনও বেহালার দক্ষিণসীমায় সখের বাজার আছে। দ্বারির জাঙ্গাল নামের উৎপত্তি এইভাবে হইতে পারে; কিন্তু বসন্ত রায়ের সময়ে সে জাঙ্গাল সংস্কৃত ও প্রলম্বিত হইয়া দীর্ঘ গড়ে পরিণত হইয়াছিল, ইহা অসম্ভব নহে।
৪. প্রতাপচন্দ্র ঘোষ সরশুনার ঘোষবংশীয় স্বনামধন্য পুরুষ। তিনি এসিয়াটিক সোসাইটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন; সোসাইটির ইতিহাস ও সুন্দরবন সম্বন্ধে বহু তথ্য আবিষ্কার করেন। (See, Proceedings of the Asiatic Society for December, 1868) রায়দীঘির দক্ষিণভাগে তাঁহার আবাস বাটী ছিল। এখনও তথায় তাঁহাদের কাছারী বাড়ী আছে। ১২৭৫ সালে যখন তিনি ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়ে’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত করেন, তখন রায়গড়ে বিজন জঙ্গল ছিল। উক্ত পুস্তকে ঐ সময়ে ও ২০ বৎসর পূর্ব্বের ফটোগ্রাফ হইতে কয়েকখানি চিত্র দেওয়া হয়। তাহাতে রায়গড়ের দুর্গের একটি সুরঙ্গ ও রায়দীঘির চিত্র আছে।
৫. কালীগঞ্জ নাম আধুনিক। প্রতাপের পতনের পর বাজিতপুর পরগণা নদীয়ার রাজার হস্তগত হয়। চাঁচড়ার রাজা কৃষ্ণরাম (১৭০৫-১৭২৯) ঐ পরগণা খরিদ করেন। কালক্রমে তাহা কলিকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের হস্তে যায়। তদ্বংশীয় কানাইলাল ঠাকুর নারায়ণপুরে কালী প্রতিষ্ঠা করেন। তজ্জন্য কালীগঞ্জ নাম হয়। ঠাকুরবাবুরা বাজিতপুর Mr. Archibald Grant-এর নিকট বন্ধক রাখেন। গ্রান্টের
৬. উত্তরাধিকারিগণের নিকট হইতে খরিদাসূত্রে উহার বার আনা অংশ এক্ষণে সাতক্ষীরার জমিদারদিগের সম্পত্তি হইয়াছে। See Westland – Jessore, p. 59.
৭. গড়ের আধ মাইল দক্ষিণে শ্রীকলা গ্রামে একটি প্রকাণ্ড জলাশয়ের নাম ‘বাসুদেব রায়ের দীঘি।’ উহার পাহাড়ের উপর ঘোড়ানাল ফকিরের আস্তানা ছিল।
উহার একটি কামান যমুনার পাহাড় ভাঙ্গিয়া পড়ায় নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়। অপরটি একজন ইংরাজ কর্মচারী আসিয়া লইয়া যান। কালীগঞ্জ নিবাসী রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছেন এবং তিনি এখনও জীবিত আছেন।
৮. রাম গোস্বামী নামক একজন প্রসিদ্ধ সাধকপুরুষ উত্তরশ্রীপুরে বাস করিতেন। তিনি তারালি, মাঘুরালি এবং লক্ষ্মীনাথপুর, এই তিন স্থানে তিনটি কালীবাড়ী ও সাধনপীঠ স্থাপন করেন। কথিত আছে, তিনি প্রত্যহ এই তিনটি পরস্পর দূরবর্তী স্থানে মায়ের পূজা করিতেন। একদা তিনি শুভক্ষণে সিদ্ধিলাভ করেন। প্রথমতঃ তিনি নলতার পার্শ্ববর্ত্তী কালীবাটীতে সাধনা করেন, কিন্তু মা সেখানে তাঁহাকে দর্শন দিলেন না, তাই তিনি বলিয়াছিলেন, মা! ঘুরালি’ অর্থাৎ আমাকে দেখা দিলি না; তাই সে স্থানের নাম হইল ‘মাঘুরালি’। পরবর্ত্তী সাধনপীঠে তারা মা তাঁহাকে দেখা দিলেন, তখন তিনি পূর্ণানন্দে চীৎকার করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তারা! এলি’–তাই সে স্থানের নাম হইল ‘তারালি’। তিনটি স্থানেই মায়ের মূর্তি নাই, ঘটে পূজা হয়। মাঘুরালিতে একখানি প্রস্তরময় যোনিপীঠে পূজা হইত, সে পীঠ আছে এবং মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠাও হইয়াছে। সেখানকার মন্দিরটি বেশ উচ্চ, উহার গর্ভমন্দিরটির পরিমাণ ১৬′-২′′ ×১৬′-২′′; ঈশান কোণে একটি শিবমন্দির ছিল, উহা ভগ্ন হওয়ায় লিঙ্গটি মায়ের মন্দিরে আনীত হইয়াছে।
৯. এই গড়ের বিস্তৃতি ১৬০ ফুট হইতে ২২৫ ফুট পর্যন্ত দেখিয়াছি এবং স্থানে স্থানে ৮/১০ ফুট উচ্চ আছে। কপোতাক্ষীর নিকটবর্ত্তী আধ মাইল স্থানে গড়টি নদীর সহিত সমতল হইয়া গিয়াছে। সম্ভবতঃ কপোতাক্ষী নদী মজিয়া যাওয়ায় এই আধ মাইল স্থান চড়া পড়িয়াছে। লোকে বলে এসব দেবতার কীর্তি, এক রাত্রিতে এই প্রাচীর গঠিত হয়; রাত্রি শেষ হইলে খনকেরা ঝুড়ি ফেলিয়া চলিয়া যায়। এখনও একটা স্থানকে ‘ঝুড়িঝাড়া’ বলে। খুলনা জেলায় এমন প্রবাদ অনেক স্থানের সম্বন্ধে আছে; তালার নিকট ‘আগড়ঝাড়া’র স্তূপ, আগরহাটির নিকট ‘ডালিঝাড়া’ নামক ভিটা দৃষ্টান্তস্থল (১ম খণ্ড, ১৩৩-১৪৫ পৃ)। এই গড়ের মুখে গোলপেটুয়ার সন্নিকটে একটি ভাল পুষ্করিণী আছে, উহার জল সুমিষ্ট এবং বহুদূর হইতে লোকে আসিয়া তথাকার জল লইয়া যায়। এই সুবিস্তৃত গড় একটি সম্পত্তিবিশেষ। বহুলোকে গড়ের উপরে ও পার্শ্বে বাড়ী করিয়া গড়টিকে একটি গ্রাম করিয়াছে এবং গড়গ্রামে তাহাদের বাড়ী বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। পুষ্করিণীটির দক্ষিণ পারে যে হাট হয়, তাহার নাম গড়ের-হাট এবং পূর্ব্ব পারে জমিদারী কাছারী। চকগড়ে ২৫ হাজার বিঘা জমিতে ২০,০০০ টাকা হস্তবুদ আছে; অবশ্য গড় ও নিকটবর্ত্তী আবাদ লইয়া চকগড় হইয়াছে। ঢাকা নিবাসী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ মহাশয় এই সম্পত্তির মালিক।
১০. প্রতাপনগরের সমসূত্রে কপোতাক্ষী পার হইলে মদিনার আবাদে (২১২ নং লাট) আট্রা গ্রামের মধ্য দিয়া শাঁখবাড়িয়া পৰ্যন্ত সোজা রাস্তা ছিল। তখন নদীপথে ঘুরিয়া বেদকাশীতে যাইতে হইত না। উক্ত রাস্তার চিহ্ন এখনও আছে।
১১. বনবিভাগীয় বিবরণী হইতে সরকারী রিপোর্ট অতি অল্পদিন হইল লিখিত হইয়াছে : ‘On the east bank of the Marjal river, are the ruins of what appears to have been a fort, enclosed court-yard or square, built of burnt country bricks, and enclosing a tank about 120 feet square. This is situated about 500 yards from the Marjal river in allotment No. 233’-Khulna Gazetteer, p. 50.’ আমরা বহুকষ্টে এই ভীষণ অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করিয়া উহার বিবরণ ও চিত্র সংগ্রহ করিয়াছি, ফটো লইবার সময়েও কিভাবে ব্যাঘ্রের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য কয়েকজনকে বন্দুকহস্তে সতর্ক থাকিতে হইয়াছিল, মন্দিরের ছবিতে তাহার পরিচয় আছে। (১ম খণ্ড, ৪১-৫৬ পৃ)। স্থানটি নিকটবর্ত্তী জঙ্গলের জমি অপেক্ষা অনেক উচ্চ। দুর্গের ভিতরে ও বাহিরে নিবিড় অরণ্য। গাবগাছ, বটজাতীয় বড় গাছ, জিওলগাছ, শটীগাছ প্রভৃতি পূৰ্ব্ববর্ত্তী মনুষ্যাবাসের পরিচয় দেয়। দুর্গের উত্তরদিকের প্রাচীরের ফটো লওয়া হইল। উহাতে যে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ শায়িত দেখা যাইতেছে, তাহা একটি গাবগাছ। আর যে একটি গাবগাছ দণ্ডায়মান রহিয়াছে, উহার বেষ্টন ১৩ ফুট।
১২. প্রতাপাদিত্যের পূর্ব্বেও জগদ্দল ছিল। বঙ্গদেশের একটি বৌদ্ধ মহাবিহারের নাম ছিল, জগদ্দল। কিন্তু সে জগদ্দল এখানে কিনা, বলা যায় না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয়ের মতে সে জগদ্দল পূর্ব্ববঙ্গে রামপালের নিকট ছিল। মালদহে জগদ্দল নামে দুইটি প্রাচীন স্থান বাহির হইয়াছে। উহার কোন একটি জগদ্দল মহাবিহার হইতে পারে বলিয়া কেহ কেহ অনুমান করেন (আর্য্যাবর্ত্ত, কাৰ্ত্তিক, ১৩১৮, ৪৯২ পৃ)। এখানেও যে গঙ্গাতীরে সেই মহাবিহার থাকিতে পারে না, তাহা নহে। হয়ত তাহার চিহ্নাদি দেখিয়াই প্রতাপ এ স্থানে দুর্গ স্থাপনের মত করেন এবং হয়ত নামের মিল দেখিয়া জগৎসহায় দত্তেরও এখানে দুর্গনির্ম্মাণের উদ্যোগ হয়। ১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে সমাপ্ত কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ধনপতি সদাগরের সিংহল যাত্রার বর্ণনায় জগদ্দলের উল্লেখ আছে :
‘গারিফা ছাড়িয়া ডিঙ্গী গেল গোন্দলপাড়া,
জগদ্দল এড়াইয়া গেলেন নপাড়া।’
এই ১৫৭৭ খৃষ্টাব্দ বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকাল। নিশ্চয়ই তাহার অনেক পরে এখানে দুর্গ নির্ম্মিত হয়।
১৩. প্রতাপের সঙ্গে যশোহর হইতে বৈদিক ব্রাহ্মণ ও বঙ্গজ কায়স্থগণ উঠিয়া আসিয়া জগদ্দলে বাস করিয়াছিলেন। ভাটপাড়ার বশিষ্ঠ গোত্রীয় বৈদিক ভট্টাচার্য্যগণের আদিপুরুষ নারায়ণ ভট্ট তাঁহার শ্বশুর যশোহর-পরমানন্দকাটি নিবাসী রামভদ্র ভট্টাচার্য্যের নিকট হইতে সিদ্ধমন্ত্র লাভ করিয়া তথা হইতে আসিয়া জগদ্দলের পার্শ্বে যেখানে বাস করেন তাহারই নাম হয় ভট্টপল্লী বা ভাটপাড়া। যে সব বঙ্গজ কায়স্থগণ আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের ২/১ ঘর এখনও আছেন, কিন্তু তাঁহারা সামাজিক সুবিধার জন্য দক্ষিণরাঢ়ী কায়স্থ হইয়া গিয়াছেন।
১৪. ‘প্রবসী’, ১৩২৭ কার্ত্তিক, ৩-৪ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র. —শি মি]
১৫. Rennel – Bengal Atlas, Map No. 1.
১৬. যে নদী বা খালের দুই দিক হইতে জোয়ার ভাটা চলে তাহাকে দোয়ানিয়া বলে; অসংখ্য প্রশস্ত নদী থাকার জন্য সুন্দরবনের অধিকাংশ খালই দোয়ানিয়া বা দ্বিমুখী। ১ম খণ্ডে সুন্দরবনের বিবরণ দ্রষ্টব্য।
১৭. এই শাখা নদী এক্ষণে ১৭৬ নং লাটের দক্ষিণ দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। কালিন্দী শাখাই নিম্নে আসিয়া রায়মঙ্গলে মিশিয়া সমুদ্রে পড়িয়াছে।
১৮. এই দুর্গের স্থান বর্ত্তমান মাতলা বা ক্যানিং সহরের উত্তরাংশে অবস্থিত। এস্থানে এখনও বুরুজখানা প্রভৃতি উঁচু ঢিপি দেখিতে পাওয়া যায়; নিকটে প্রতাপনগর নামক গ্রাম, কুঠি বাড়ী, রাজার কাল, হায়দর আবাদ এখনও অনেক প্রাচীন কথা মনে করাইয়া দেয়। এই হায়দর আবাদ এক্ষণে সুন্দরবনের ৫৭ নং লাটের অন্তর্গত। ইহাকে সাধারণ লোকে হেদে বলে।
১৯. এই দুর্গ ১৭৩ নং লাটের অন্তর্গত। ইহাকে নৌদুর্গ বলা যাইতে পারে; নদীর মধ্যে রণতরী প্রভৃতি রাখিবার ভাল ব্যবস্থা ছিল। উপরে সাধারণ দুর্গের মধ্যে অধ্যক্ষ অগাষ্টাস্ পেড্রোর কুঠি ছিল। যেখানে তাহার সামান্য ভগ্নাবশেষ আছে, তাহাকে লোকে ‘বড় কুঠি’ বলে।
২০. কঞ্চীর দোয়ানিয়া এখনও আছে। সরকারী ম্যাপেও উহা কুঞ্চি (Koomchee) নামে লিখিত হইয়াছে। এই কঞ্চী এক্ষণে ২০২ নং লাটের পূর্ব্ব বেষ্টন হইয়াছে।
২১. জটার দেউল ১১৬ নং লাটের অন্তর্গত। ম্যাপে ইহাকে প্যাগোডা (Pagoda) বা (বৌদ্ধ) মন্দির বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের এসিয়াটিক সোসাইটির কার্য্যবিবরণী হইতে জানিতে পারি— Mr. Swinhoe has published a figure of the ruins lately discovered in Lot 116. The temple is of the Buddhist type of architecture! Rev. J. Long বোধ হয় এই দেউল দেখিয়াই ‘a fine Hindu temple two centuries old’ বলিয়া গিয়াছেন। মেজর স্মিথ (Smyth) বলেন যে, এই স্থানে একটি মন্দিরে ৮ বৎসর বালকের আকার বিশিষ্ট একটি প্রস্তরমূর্তি ছিল। — Hunter, Statistical Accounts, Vol. I, p. 88; 24-Parganas Gazetteer, p 29.
২২. সুন্দরবন অঞ্চলে ব্যাঘ্র-ভীতি নিবারক ‘দক্ষিণ রায়’ নামক এক গ্রাম্য দেবতার পূজা হইয়া থাকে। আমরা প্রথম খণ্ডে ইহার বিশেষ বিবরণ দিয়াছি (২৭০-২৭৮ পৃ)। সম্ভবতঃ এই ‘রায়’ হইতে ‘রায়মঙ্গল’ নাম হইয়া থাকিবে। কৃষ্ণরাম দাস নামক একজন প্রাচীন কায়স্থ কবি এই দক্ষিণ রায়ের পাঁচালী রচনা করেন, তাহার নাম ‘রায়মঙ্গল’। প্রাচীনকালে এইরূপ অনেক ‘মঙ্গল’ লেখা হইত; নদীর নামে পাঁচালীর নাম হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না।’সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’, ১৩০৩; দীনেশচন্দ্র সেন, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ৮৬ পৃ [৮ম সং, ৬৯ পৃ-শি মি]।
২৩. এসিয়াটিক সোসাইটির কার্যবিবরণী (১৮৬৮) হইতে জানিতে পারি, ‘In lot No, 146 there are brick ruins with terracotta ornaments.’ [Proc. Asiatic Soc., 1868, p. 271-শি মি [কেহ কেহ বলেন, রায়মঙ্গল ও কলাগাছিয়ার মোহানাকে লক্ষ্মীনারায়ণের মোহানা বা সংক্ষেপতঃ “ল’য়ের মোহানা” বলে, নাবিকেরা উহার অপভ্রংশে “ন’র মোহানা” করিয়া লইয়াছে; অন্যমতে নই নদী ও কলাগাছিয়ার সঙ্গমে অর্থাৎ ১০৯ নং লাটের পার্শ্বে ন’র মোহানা ছিল; কিন্তু সে স্থল আমরা স্বচক্ষে ঘুরিয়া দেখিয়া কোন ভগ্নাবশেষ পাই নাই। ১৪৬নং লাটই দুর্গস্থান বলিয়া বোধ হয়। এস্থলে টাঁকশাল থাকিবার কথা আমরা পরে আলোচনা করিব। রায়মঙ্গলের নাম শুনিলে লোকে ভয় পায় এবং লোককে রায়মঙ্গল পাঠাইবার কথা বলিয়া ভয় দেখান হয়। সম্ভবতঃ ইহার কয়েকটি কারণ আছে : প্রথমতঃ, এখন যেমন কোন অপরাধীকে নিৰ্ব্বাসন দণ্ড দিয়া আন্দামান দ্বীপে পাঠান হয়, প্রতাপাদিত্যের সময় সেইরূপ রায়মঙ্গল দুর্গে পাঠান হইত। দ্বিতীয়তঃ, রায়মঙ্গল বড় বিস্তৃত প্রবল নদী, ইহার সন্নিকটে বঙ্গোপসাগরের অতলস্পর্শ, নাবিকেরা ভয়ে এ পথে যাইতে চাহে না।
২৪. কোন বনবিভাগীয় বা সরকারী বিবরণী হইতে এ সম্বন্ধে কিছু মাত্র জানিবার উপায় নাই। যাহারা স্বচক্ষে দেখিয়াছে আমরা তাহাদেরই মুখে এ স্থানের তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি। বর্ত্তমান চাঁদপাই ফরেষ্ট ষ্টেশন হইতে এই স্থানের অনুসন্ধান চলিতে পারে।
২৫. De Barros এবং Van den Broucke প্রভৃতির ম্যাপে সুন্দরবনের যে পাঁচটি বিনষ্ট নগরীর উল্লেখ আছে, তন্মধ্যে নদি (Noldy) নামক নগর এই স্থানের নিকট ছিল বলিয়া অনুমান করা যায়। [বর্তমান গ্রন্থের ১ম খণ্ড, ২৯৩ পৃ (পরিশিষ্ট ক) দ্রষ্টব্য—শি মি]
২৬. প্রাচীন দলিলাদিতেও এই স্থান চকশ্রী নামে অভিহিত। একব্বরিয়া, ঝালবুনিয়া, তালবুনিয়া, বড়দিয়া, আঙ্গারিয়া, চণ্ডীপুর, দুর্গাপুর প্রভৃতি স্থানগুলি এই চকের অন্তর্গত। বেলফুলিয়া নিবাসী রাখালদাস সিংহ মহাশয় প্রভৃতির পূর্ব্বপুরুষগণ চকশ্রীর চারি আনা অংশ খরিদ করিয়া বাটোয়ারাসূত্রে তালবুনিয়া মৌজা পাইয়াছিলেন। তাঁহাদের গৃহে রক্ষিত প্রাচীন খতিয়ান (৫০ হইতে ৫৪ পৃষ্ঠা) এই বিবরণ আছে। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর সুন্দরবনের অন্যান্য অংশের মত চকশ্রীও ভীষণ জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়ে। বহুকাল পরে অন্যান্য বিভাগের ন্যায় এ স্থানও উচ্চ হইয়া আবাদে পরিণত হয়। ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে বদন হাওলাদার নামক এক সওদাগর নবাবের কার্যোপলক্ষে পূৰ্ব্বাঞ্চল হইতে এখানে আসেন। তৎপুত্র সেখ কালাই মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে সনন্দ পাইয়া সমস্ত চকশ্রী দখল করিয়া এই স্থানে বাস করেন। সেই সময় তিনি একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ ও ‘বড়পুকুর’ নামক একটি জলাশয় খনন করেন। উভয় কীর্তিই বৰ্ত্তমান। মসজিদটি মোগল স্থাপত্যানুযায়ী গঠিত; উহার বাহিরের মাপ ২২x২২” ভিতরে ১৫ ×১৫, ভিত্তি ৩-৬; উহাতে একটি মাত্র গুম্বজ এবং ৪টি মিনার আছে, মিনারের উচ্চতা ১৫ ফুট। স্থানীয় লোক এই স্থানে নেমাজ করেন। সেখ কালাইএর বাড়ীতে একটি পাকা কবর ও দরগা আছে। সেখ কালাই-এর দুই পুত্র ছিলেন- সুমুজ উদ্দীন ও মইবুল্যা। সুমুজ উদ্দীনের পুত্র নুর উদ্দীন রাজা বিবিকে বিবাহ করেন এবং নিজে নিঃসন্তান বলিয়া সমস্ত সম্পত্তি স্ত্রীর নামে উইল করিয়া দেন। এজন্য মইবুল্যার পুত্র জমিরতুল্যার সহিত বিবাদ চলিতে থাকে। সেই বিবাদ-সূত্রে নানাস্থানীয় জমিদারগণ প্রবেশ করিয়া ক্রমে ক্রমে সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করেন। কাড়াপাড়ায় রায়চৌধুরীগণ, বেলফুলিয়ার সিংহ, নওয়াপাড়ার ঘোষ ও সারসার মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বংশীয় ধনী ব্যক্তিবর্গ সমগ্র প্রাচীন চাকশিরি বণ্টন করিয়া লইয়াছেন।
২৭. কেহ কেহ বলেন বর্তমান কলিকাতার চারিদিকে প্রতাপাদিত্যের সাতটি দুর্গ ছিল : মাতলা, রায়গড়, টানা, বেহালা, সালখিয়া, চিৎপুর ও আটপুর (মূলাজোড়), এই সাতটি স্থানে এই সকল দুর্গের স্থান নির্দ্দিষ্ট ছিল। ইহার মধ্যে মাতলা ও রায়গড়ের বিবরণ দিয়াছি। রায়গড় ও বেহালার দুর্গ বোধ হয় অভিন্ন। মূলাজোড়ের পার্শ্বে যে দুর্গ আছে, তাহা বর্গীর হাঙ্গামার সময়ে বর্দ্ধমানাধিপতির বাসের জন্য নির্মিত হয়; সামনে (সম্মুখে) গড় ছিল বলিয়া নিকটবর্ত্তী ষ্টেসনের নাম হইয়াছে শ্যামনগর। — হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা – সেকালের ও একালের, ৪৩ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন