সতীশচন্দ্র মিত্র
সীতারামের বাল্যজীবনের কথা কেহ লিখিয়া রাখে নাই; তহশীলদারের পুত্রের কপালে যে রাজটীকা ছিল তাহা লোকে দেখে নাই। তাঁহার জীবনের প্রথম কয়েক বৎসর কাল কাটোয়া অঞ্চলে মাতুলালয়ে কাটিয়া যায়। তখন তিনি চতুষ্পাঠীতে কিছু সংস্কৃত পড়িয়াছিলেন। নিয়মমত বাঙ্গালা সাহিত্যের পঠন-পাঠনের রীতি তখন ছিল না, তবুও লোকে সংস্কৃতের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালা শিখিত। সীতারামও বেশ বাঙ্গালা জানিতেন, জয়দেব ও চণ্ডীদাস প্রভৃতি কবির পদাবলীর সুন্দর আবৃত্তি করিতে পারিতেন। তাঁহার হস্তাক্ষর অতি সুন্দর ছিল, বহু সনন্দে তাঁহার স্বাক্ষর আছে। দেশের রেওয়াজ অনুসারে তিনি আরবী ফারসীও শিখিয়াছিলেন। উহা তখনকার রাজভাষা, রাজদরবারে কোন কার্য্য সিদ্ধি করিতে হইলে, ফারসী বা উর্দুতে দখল থাকা দরকার হইত। সীতারামের তাহা ছিল। কাটোয়া হইতে ভূষণায় আসিয়া বহু সম্পর্কে মুসলমানের সহিত মিলিয়া মিশিয়া তিনি উর্দুতে সুন্দরভাবে কথোপকথন করা শিখিয়া লইয়াছিলেন।
তবে সুকুমার শাস্ত্র অপেক্ষা অস্ত্রশস্ত্রের শাস্ত্রে তাঁহার অধিকতর দখল দাঁড়াইয়াছিল। লাঠি তখন বঙ্গদেশে ধন-মান-প্রাণ রক্ষার প্রধান অবলম্বন ছিল; সে লাঠির শাস্ত্রে সীতারাম পরম পণ্ডিত ছিলেন তাঁহার স্বাভাবিকী প্রতিভা সেই দিকে খুলিয়াছিল। ভূষণায় আসিবার পর হইতে অশ্বারোহণে এবং অস্ত্রচালনায় তিনি রীতিমত শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। তিনি যখন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক, তখন ঢাকায় রাজদরবারে আনাগণা করিতেন। গুণগ্রাহী সায়েস্তা খাঁ নানা প্রসঙ্গে তাঁহার অস্ত্রশিক্ষা ও সাহসিকতার পরিচয় পাইয়া তুষ্ট হইয়াছিলেন। শুনিতে পাওয়া যায়, ভূষণার নিকটে সা-তৈর পরগণায় করিম খাঁ নামক একজন পাঠান বীর বিদ্রোহী হইলে যখন ফৌজদারও তাহার দমনের জন্য সৈন্য পাঠাইয়া কয়েকবার বিফল মনোরথ হইলেন, তখন সায়েস্তা খাঁ সে সংবাদ পাইয়া কাহাকে পাঠাইবেন ভাবিতেছিলেন। সীতারাম তখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই দুঃসাহসিক কার্য্যে যাইবার জন্য আগ্রহ জানাইলেন। প্রতিভার পথ সহজে উন্মুক্ত হয়। নবাব তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন এবং কয়েক সহস্র পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য দিয়া তাঁহাকেই এই দুরূহ কার্য্যে পাঠাইলেন। ইহাই তাঁহার জীবনের প্রথম পরীক্ষা; ভাগ্যগুণে সীতারাম এ পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হইলেন। করিম খাঁ পরাজিত ও নিহত হইলেন; যুদ্ধ-বিজয়ী সীতারাম ঢাকায় গিয়া নবাবের নিকট প্রশংসা ও অনুগ্রহ লাভ করিলেন। দস্যুদুর্বৃত্তের দমনের জন্য নবাব তাঁহাকে ভূষণার অন্তর্গত নদী পরগণা জায়গীর দিলেন।
শুধু যে পাঠানেরা শেষ বার মাথা তুলিবার চেষ্টা করিতে গিয়া স্থানে স্থানে বিদ্রোহ-বহ্নি প্রজ্জ্বলিত করিতেছিলেন, তাহা নহে; দস্যু-দুৰ্ব্বত্ত ও চোর ডাকাইতের উৎপাতে তখন যশোহর- খুলনার লোক বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। মগের অত্যাচার তখনও ছিল; এমন কি, দক্ষিণদিকের সুন্দরবন বা নিকটবর্ত্তী স্থানের ত কথাই নাই, উত্তর দিকেও তাহারা মধুমতী প্রভৃতি নদীপথে প্রবেশ করিয়া যেখানে সেখানে আড্ডা করিত, এবং গ্রামবাসীকে অস্থির করিয়া তুলিত। আমরা পূর্ব্বে ইহার বিশেষ বিবরণ দিয়াছি (১৮শ পরিচ্ছেদ)। মাগুরা অঞ্চলে কত পরিবারের যে সামাজিক সৰ্ব্বনাশ ঘটিয়াছিল, তাহা বলিবার নহে। এমন কি, ধর্ম্মদাস নামক মগ আরাকান হইতে সসৈন্যে আসিয়া গৌরী বা গড়ই নদীর কূলে খুলুমবাড়ী প্রভৃতি কয়েকখানি মৌজা দখল করিয়া স্থায়ীভাবে জায়গীর ভোগ করিতেছিল। উহাকে ‘মগ-জায়গীর’ বলা হইত। আওরঙ্গজেবের সময় ধৰ্ম্মদাস ধৃত হইয়া মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়।
কেবল পাঠান-বিদ্রোহ বা মগের অত্যাচার নহে, সুশাসনের অভাবে দেশের মধ্যে চোর ডাকাইতের অত্যধিক উৎপাত হইয়াছিল। একাদোকা দূরপথে তীর্থধর্ম্মাদি করিতে কেহ যাইত না; সন্ধ্যার প্রাক্কালেই পথিকেরা গৃহস্থবাড়ীতে অতিথি হইয়া প্রাণ বাঁচাইত; তরফের কাছারী হইতে জমিদারের বাড়ীতে খাজনা ইরশাল করাও আশঙ্কার ব্যাপার ছিল। সাধারণ গৃহস্থেরা যাহা কিছু অর্থ- সঞ্চয় করিতে পারিত, তাহাদ্বারা সোণারূপার অলঙ্কার গড়াইয়া স্ত্রীলোকের গায়ে পরাইত, আর সন্ধ্যার পর বাসনবাটী তৈজসপত্র সিন্ধুকে বা মেঝের মধ্যে মাটির গর্ভে পুরিয়া তাহার উপর বিছানা পাতিয়া নিদ্রা যাইত, সকলের শিয়রে লাটিসোটাই আত্মরক্ষার প্রধান প্রধান ছিল। এই জাতীয় দুর্বৃত্তদিগের নৃশংস অত্যাচার হইতে ভূষণা অঞ্চল রক্ষা করিবার স্বীকারোক্তিতে সীতারাম নবাবের নিকট হইতে নদী পরগণা জায়গীর পাইলেন। নদী পরগণার অনেক লোক দেশ ছাড়িয়া গিয়াছিল, অরাজক দেশ হইতে নবাব সরকারের বিশেষ কিছু আয়ত্ত ছিল না। তবুও নদী একটা প্রকাণ্ড পরগণা এবং উদীয়মান যুবকের সাহস ছিল, তিনি অচিরে এ পরগণা শাসন তলে আনিতে পারিবেন।
সীতারাম জায়গীর ত পাইলেনই, ঢাকা হইতে তিনি আরও দুইটি রত্ন পাইয়া ছিলেন। এ দুইটি মনুষ্য-রত্ন চিরকাল তাঁহার কর্ম্মের সহায় ও প্রাণের বন্ধু ছিলেন। একজন মস্তিষ্কের শক্তি দিয়া এবং অন্যজন দৈহিক শক্তি দিয়া আমরণ তাঁহার সাহায্য করেন। দুইজনই তাঁহার স্বজাতীয় কায়স্থ কিন্তু তাঁহার স্বশ্রেণিস্থ নহেন। উভয়ই চাকরীর অন্বেষণে ঢাকায় গিয়াছিলেন, তথায় তাঁহাদের সহিত সীতারামের পরিচয় ও সদ্ভাব হয়। তিনি জায়গীর পাইবার পর উহাদিগকে নিজের জমিদারী সংক্রান্ত উচ্চ কার্য্য দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া দেশে লইয়া আসেন।
সীতারামের এই মন্ত্রণাদাতা বন্ধুর নাম মুনিরাম রায় এবং অপর বীরপুরুষের নাম রঘুরাম বা রামরূপ ঘোষ।[৩] উভয় ঘোষবংশীয় এবং সীতারামকে ধরিলে তিনজনের নামই রাম-সংযুক্ত। মুনিরাম কার্ণ-ঘোষবংশীয় বঙ্গজ কায়স্থ, তাঁহার পিতৃ-নিবাস খুলনা জেলার অন্তর্গত শ্রীপুর অঞ্চলে, সেখানে এখনও তাঁহার জ্ঞাতিরা বাস করিতেছেন। রামরূপ দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ, আকনা সমাজভুক্ত বংশজ ঘোষ; তিনি নবগঙ্গাতীরবর্ত্তী রায় গ্রামের ঘোষবংশীয়দিগের পূর্ব্ব-পুরুষ। এখনও তাঁহার জ্ঞাতিগণ রায়গ্রাম, আউড়িয়া প্রভৃতি স্থানে বাস করিতেছেন। উভয়েরই বিশিষ্ট বংশ— বিবরণ আমরা পরে দিতেছি। রামরূপ শিশুকাল হইতেই অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও অসাধারণ শক্তিশালী ছিলেন। তখন জমিদার প্রভৃতি অবস্থাপন্ন লোকের গৃহে হিন্দুস্থানী পলোয়ান থাকিতেন রামরূপেরও পৈতৃক অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল। তিনি শিশুকাল হইতে নানাস্থানে পালোয়ানের নিকট কুস্তী, লাঠিখেলা প্রভৃতি উত্তমরূপে শিক্ষা করিয়াছিলেন। যৌবন দশায় উপনীত হইলে তাঁহার দীর্ঘোত বিপুল বপু দেখিলে লোকে চমকিত হইত। তিনি তখনকার লম্বা লোক অপেক্ষা ও পূর্ণ এক হাত অধিক উচ্চ ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহার দেহের পরিমাণ পুরা পাঁচ হাত এবং তদনুযায়ী মাংসল ও দৃঢ়। তিনি যখন সীতারামের সেনা বিভাগে প্রবেশ করেন, তখন তাঁহাকে সাধারণ লোকে মেনাহাতী বলিত। ক্ষুদ্রাকৃতি এবং ক্ষুদ্রদন্ত স্ত্রী-হস্তীকেই মেনাহাতী বলে। রামরূপকেও সেইরূপ ছোট-খাট হাতীর মত দেখা যাইত বলিয়া তাঁহারও নাম হইয়াছিল মেনাহাতী এবং এই নাম সর্ব্বসাধারণের নিকট এমন সুপরিচিত হইয়াছিল যে, তাঁহার প্রকৃত নাম লোকে জানিত না। তাই তাঁহার নাম খুঁজিয়া পাওয়া দায় হইয়াছে। বিশেষতঃ তিনি চিরজীবন অকৃতদার এবং নিঃসন্তান, সুতরাং তাঁহার নিজের বংশ ধারা নাই। এজন্য তাঁহার পরিচয়-সূত্র এমন বিলুপ্ত হইয়া পড়িয়াছে যে, তিনি হিন্দু কি মুসলমান ছিলেন, ইহাই লইয়া লেখকদিগের মধ্যে বাদানুবাদ চলিয়াছিল। আমাদের দেশের ইতিহাসের এই দুর্দ্দশা দেখিলে ব্যক্তিমাত্রকেই ব্যথিত হইতে হয়।
সীতারামের ঢাকায় যাওয়ার পূর্ব্বে রামরূপ তথায় গিয়া নবাবী ফৌজে চাকরীর চেষ্টা করেন। করিম খাঁর বিদ্রোহ দমন জন্য সীতারামের অধীন যে সৈন্য প্রেরিত হয়, সম্ভবতঃ তাহার জনৈক সেনানী ছিলেন রামরূপ এবং সেই প্রসঙ্গে তাঁহার বীরত্বের চাক্ষুষ পরিচয় পাইয়া সীতারাম তৎপ্রতি আকৃষ্ট হন। সীতারাম যে নদী পরগণার জায়গীর পাইলেন, তন্মধ্যেই রামরূপের বাড়ী, সুতরাং তিনি স্বচ্ছন্দচিত্তে সীতারামের সহচর হইলেন। ক্রমে তাঁহার বক্তার খাঁ ও আমল বেগ নামক আরও দুইজন মুসলমান সেনানী জুটিয়া যায়। গল্প আছে, বক্তার খাঁ একজন বিখ্যাত ডাকাইত ছিলেন; সীতারাম রামরূপের সঙ্গে ঢাকা হইতে প্রত্যাগমন কালে একস্থানে নৌকা লাগাইয়া রাত্রিযাপন করিতেছিলেন। এমন সময়ে অদূরে গ্রামের ভিতর ডাকাইতি হইবার শব্দ শুনিলেন; অমনি তিনি ও রামরূপ উভয়ে অসিহস্তে দৌড়িয়া গিয়া ডাকাইতদিগকে আক্রমণ করেন; তখন দস্যুদলপতি বক্তারের সহিত সীতারামের ঘোর যুদ্ধ বাধিল। সে যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করিয়া বক্তার সীতারামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজে ডাকাইত বলিয়া ডাকাইত দলের সন্ধি-কৌশল জানিতেন, এজন্য তাহার সাহায্যে দস্যুদলন কাৰ্য্য সহজ হইয়াছিল। আমল বেগ একজন মোগল, তিনি সম্ভবতঃ নবাবী ফৌজে কার্য্য করিতেন, সীতারামের পরামর্শে তাঁহার দলভুক্ত হন। তাঁহার বিশেষ পরিচয় জানা যায় না। তবে তিনি শত্রুসৈন্য আক্রমণকালে বড় দুর্দ্ধর্ষ ছিলেন; এজন্য লোকে তাহাকে আমল বেগ না বলিয়া ‘হাম্লা বাঘা’ বলিত। সীতারামের দলে যখন মেনাহাতীই ছিল, তখন বাঘ থাকিবে না কেন?
সীতারামের আরও দুইজন সেনানী ছিলেন, তাঁহারা নিম্ন জাতীয়, এই সময়ে নিম্নশ্রেণীর লোকেরাই লাঠি, শড়কী প্রভৃতি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হইতেন। ঐ দুই জনের নাম রূপচাঁদ ঢালী ও ফকিরা মাছকাটা। রূপচাঁদ নমঃশূদ্র জাতীয় এবং ফকিরচাঁদ মৎস্য-বিক্রেতা নিকারী ছিলেন। তখন যশোহর-খুলনায় ম্যালেরিয়া প্রবেশ করে নাই; সকল লোকে স্বাস্থ্যবলে শক্তিশালী ছিল, প্রত্যেকে যথেষ্ট আহার করিত, যথেষ্ট শ্রম করিতে বা পথ হাটিতে পারিত, তাহারা চা-কুইনাইনের অপব্যবহারে পাকস্থলীকে জ্বালাতন করিত না। তখন দেশময় যুদ্ধবিদ্যার আলোচনা ও শিক্ষা চলিত। কেহ সে বিদ্যা শিখিয়া প্রশংসা অর্জ্জনের সুযোগ সন্ধান করিত, কেহ দেশ-বিদেশে নানা স্থানে গিয়া রাজাদিগের সৈন্যদলে চাকরী লইত, আর কেহ দস্যু-ডাক ইতরূপে পরস্বাপহরণ করতঃ ঐশ্বৰ্য্যশালী হইয়া জীবন যাপন করিত। ডাকাইত দলের মধ্যেও অনেক সৎপ্রবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যাইত; কেহ বা সবলের সম্পদ লুটিয়া লইয়া দুর্ব্বল ও দুঃস্থকে বিলাইয়া দিত, কেহ বা কৃপণের অর্থ করায়ত্ত করিয়া দানধ্যানে সদনুষ্ঠানে ব্যয়িত করিত। ধর্ম্ম বিশ্বাস ইহার মূলীভূত কারণ। ভারতীয় লোক-সমাজের নিম্নস্তরও ধর্মভাববর্জ্জিত নহে। এদেশের দস্যুদুর্বৃত্তেরা নীতিবর্জ্জিত উন্মার্গগামী হইলেও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বা ভক্তিবিহীন নহে। এজন্য ডাকাইতেরও ইষ্টপূজা আছে, তাহারা কালীপূজা না করিয়া ডাকাইতি করিতে যাইত না। রামা-শ্যামা ডাকাইত কিরূপে ভূষণার অন্তর্গত কয়ড়ার কালীবাড়ীতে সিদ্ধিলাভ করিয়া ছিলেন, সে গল্প সে দেশের লোকে করিয়া থাকে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভবানী পাঠককে দস্যু বলিয়া ঘৃণা করিব, কি দানবীর বলিয়া ভক্তি করিব, তাহা বুঝিয়া পাই না। এমন গল্প যশোহর-খুলনায়ও অনেক আছে, তাহা প্রকাশের স্থান নাই।
দেশে যখন অরাজকতা আসে বা কু-শাসন প্রবর্তিত হয়, তখন সবলের কবল হইতে দুর্ব্বলকে রক্ষার চেষ্টা বহুজনে করিয়া থাকে। সেই সঙ্গে যদি নিজের কিছু ধনদৌলত বা প্রতিপত্তি বাড়ে, অথবা অন্ততঃ বীরত্বের খ্যাতি রটে, সকলেরই সেদিকে নজর পড়ে। স্বার্থ-নির্মুক্ত পরোপকার উচ্চস্তরের ধর্ম; সাধারণ লোকের কাছে তাহা প্রত্যাশা করা চলে না। এই ভাবে যাহারা পাশ্চাত্ত্য ‘নাইটের’ (Knight) মত বীর-ব্রতে দীক্ষিত হইত, তাহারা কেহ দস্যু ডাকাইত বলিয়া উপেক্ষিত হইত, আর কেহ হয়ত রাজা বা জমিদার বলিয়া প্রখ্যাত হইত। অনেক সময়ে ছোট আর বড় এইটুকু ভিন্ন দস্যুতে ও রাজাতে অন্য বিশেষ কিছু পার্থক্য দেখা যাইত না। সীতারামের সময় ভূষণা ও মহম্মদপুর অঞ্চলে এমন অনেক দস্যু ছিল। যদুনাথ এমন অন্ততঃ বারজন দস্যুর নামোল্লেখ করিয়াছেন।[৪] আরও কত নগণ্য অগণ্য দুর্বৃত্ত যে দেশের লোককে সৰ্ব্বদা প্রাণভয়ে কম্পান্বিত করিয়াছিল, ইতিহাসে তাহাদের তালিকা নাই। আমরা শুধু তাহাদের অপভ্রংশ নামের সঙ্গে তাহাদের অপকারের কথাই জানি, তাহাদের ধর্মভাব ও সুকীর্তি-কাহিনী আমাদের চক্ষুর অন্তরালে পড়িয়া গিয়াছে। ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকিলেও ঐতিহাসিকের পক্ষে তাহার পুনরুদ্ধার অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। যে দল বা বলের প্রয়োগ করিয়া দস্যুরা প্রবল হইয়াছিল, সীতারামও সেইরূপ দলবল জুটাইয়া ঐ সকল দস্যুদলন করিয়া আত্মপ্রাধান্য স্থাপনে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি দেশে শান্তি সংস্থাপন করতঃ প্রজাবৎসল রাজার মত সুশাসন প্ৰবৰ্ত্তন করিয়াছিলেন; তাই আমরা সেই স্বদেশীয় বীরকে এত ভক্তি করি, প্রীতি-পুষ্পাঞ্জলি দিয়া থাকি; কিন্তু তিনি যাহাদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করিয়া শত্রুরূপে দাঁড়াইয়াছিলেন, সেই মোগল শাসকেরা সীতারামকে দস্যুরূপেই ব্যবহার করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের স্বজাতীয় ঐতিহাসিকেরা সীতারামকে দস্যু বলিয়াই অখ্যাত করিয়াছেন। স্টুয়ার্ট প্রভৃতি তর্জ্জমাকারী ইংরাজ লেখক সেই কথারই পুনরুক্তি করিয়াছেন মাত্র।[৫]
সীতারাম কিছুদিন পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া রুদ্রমূর্ত্তিতে দস্যুদলন করিয়াছিলেন। এজন্য তাঁহাকে অনেক সময়ে সশস্ত্র সৈন্যসহ রাত্রিকালে গুপ্তভাবে নৌকাযোগে বিচরণ করিতে হইত। বক্তার খাঁ প্রভৃতি সেনানীগণ তাঁহাকে অনেক গুপ্তসন্ধান দিতেন ও বীরের মত সাহায্য করিতেন; তাহার ফলে দস্যুগণ সুদূর সুন্দরবন পর্য্যন্ত পলায়ন করিয়াও নিস্তার পাইত না। তাঁহার চরগণ সর্ব্বত্র ঘুরিয়া গুপ্ত খবর আনিত, বিপন্ন গৃহস্থ তাঁহাকে একমাত্র শরণ্য জানিয়া সকল সংবাদ দিত। সেকালে দস্যুরা পূর্ব্বাহ্নে পত্র দ্বারা সংবাদ দিয়া নিৰ্দ্দিষ্ট দিনে গৃহস্থ-ভবনে ডাকাইতি করিতে আসিত। সে বার্তা কোনও প্রকারে সীতারামের লোকের কর্ণে পৌঁছিলে, তাহারা যথাসময়ে আসিয়া দস্যুদিগকে আক্রমণ করিয়া বিনষ্ট করিত। এইরূপ নিশাক্রমণের জন্য সে সময় সীতারামকে গ্রাম্য দেবতা নিশানাথ ঠাকুরের সহিত তুলনা করা হইয়াছিল।[৬] এবং নিশানাথের পার্শ্বচরের মত তাঁহার সেনানীদিগকেও মোচড়া সিং, গাবুর ডালন প্রভৃতি নাম দেওয়া হইত। এই সকল ছদ্ম নামের জন্য এখন অনেককে চিনিয়া লওয়া দুষ্কর হইয়াছে।
এইভাবে সীতারামের প্রাণপণ চেষ্টার ফলে যশোহর খুলনার অনেক স্থল দস্যু দুর্বৃত্তের হাত হইতে নিস্তার পাইল। তাহার বিস্তৃত বিবরণ অনাবশ্যক; এবং আবশ্যক হইলেও তাহা কল্পনা- বিজড়িত না হইয়া পারে না। এইরূপে মগদস্যুরা দেশ ত্যাগ করিল, দুই একজন মাত্র এদেশীয় লোকের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া রহিয়া গেল। দেশীয় ডাকাইতেরা কতক হত এবং কতক বন্দী হইয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইল, কতক বা দুর্বৃত্তি ত্যাগ করিয়া শান্ত গৃহস্থ হইল। দেশ আবার শান্তির মুখ দেখিল, আত্মীয়স্বজন নির্ভয়ে পরস্পরের বাড়ীতে যাতায়াত করিতে লাগিল, শ্রান্তপথিক স্বচ্ছন্দে দীর্ঘপথ বাহন করিয়া গৃহস্থ-গৃহে অতিথি হইতে লাগিল। স্তব্ধ নিশীথে নদীপথে আবার সারীগান উঠিল, আবার পল্লীতে পল্লীতে স্বচ্ছন্দ-জীবিকার আনন্দ-লহরী ছুটিল। হুসেন শাহের আমলে বঙ্গের লোকে বহুকাল পরে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখিয়ে হুসেনী যুগকে স্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে, সীতারামের আমলেও ভূষণা অঞ্চলে প্রজাবর্গ ‘সীতারামী সুখ’ সম্ভোগ করিতে লাগিল। গ্রাম্য কবিরা গান রচনা করিলেন :
“ধন্য রাজা সীতারাম বাঙ্গালা বাহাদুর
যা’র বলেতে চুরী ডাকাতি হ’য়ে গেল দূর।
(এখন) বাঘ মানুষে একই ঘাটে সুখে জল খাবে,
(এখন) রামী শ্যামী পোলা বেঁধে গঙ্গা স্নানে যাবে।”
অল্প কথায় অবস্থার আভাস দেওয়াই যদি কবিতার কৌশল হয়, তবে এ অতি সুন্দর কবিতা শেষোক্ত দুইটি পংক্তিতে এদেশের অবস্থা অতি সুন্দর ফুটিয়াছে। প্রকৃতই প্রতি পদক্ষেপে লোকের বাঘের ভয় ছিল; মোগলের কঠোর শাসন, জমিদারের পীড়ন, জায়গীরদারের জুলুম, মুকদ্দাম, পাটোয়ার বা সাজোয়াল প্রভৃতি করসংগ্রাহক কর্মচারীর রাজস্ব ছাড়া বহুবিধ আবওয়াব বা বাজে শুল্ক আদায়ের জন্য প্রজাদিগকে নিংড়াইয়া রক্তশোষণ— এ সব ত প্রাত্যহিক কার্য্য! ইহার উপর দস্যু- দুর্বৃত্তের আকস্মিক অত্যাচার নিরীহ পল্লীবাসীকে সর্ব্বদা রোমাঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিল। হিন্দুর পক্ষে তীর্থ-ধৰ্ম্ম অসাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল; ধনীরা বহু অর্থ ব্যয়ে সাজ সরঞ্জাম গুছাইয়া দলবল সহ নৌকা পথে তীর্থযাত্রা করিতেন বটে, কিন্তু গরিবের পক্ষে তাহা সম্ভবপর হইত না। কিন্তু এখন রামী শ্যামী প্রভৃতি সাধারণ নিঃস্ব স্ত্রীলোকেরাও পোটলা বাঁধিয়া পদব্রজে গঙ্গাস্নানে যাইতে লাগিল
এইভাবে শান্তির মুখ দেখিয়া, নলদী পরগণার প্রজাবর্গ সীতারামের প্রতি সমাসক্ত হইল এবং পরগণার আয় বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাইল। সীতারাম রীতিমত জমিদার হইয়া বসিলেন। কিছুদিন পূর্ব্বে তিনি ভূষণার অন্তর্গত সা-তৈর পরগণার কতকাংশ তালুক বন্দোবস্ত করিয়া লইয়া ছিলেন, শাসন কৌশলে তাহারও আয় বাড়িল। বর্ত্তমান মহম্মদপুরের নিকটবর্ত্তী সূর্য্যকুণ্ড গ্রামে পূৰ্ব্ব হইতে নদী পরগণার যে কাছারী বাটী ছিল, সেখানে তিনি মনোমত অট্টালিকা দ্বারা আবাসবাটী সুশোভিত করিলেন; এখনও তাহার ভগ্নাবশেষ আছে। সূর্য্যকুণ্ড ও হরিহর নগর এই উভয়স্থানেই তিনি সৈন্যসামন্ত সংগ্রহ করিতে লাগিলেন, উভয়স্থানে গড়বেষ্টিত বাড়ী ও সৈন্যাবাস স্থাপিত হইল। যুদ্ধবিদ্যা তখন সাধারণ লোকের এমন রুচিগত সহজ সম্পত্তি হইয়া গিয়াছিল যে, একবার বিশ্বস্ত সেনাপতি হইয়া দাঁড়াইতে পারিলে, দলে দলে সৈন্য আসিয়া জুটিত। সীতারামের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
সীতারামের পিতৃকূল শক্তি-মন্ত্রে দীক্ষিত, তিনিও প্রথম জীবনে শাক্ত ছিলেন। পরে তাঁহার বৈষ্ণব-দীক্ষা হইলেও তখন তাঁহার শাক্ত-বিদ্বেষ ছিল না; রাজধানী স্থাপন করিয়া তিনি সৰ্ব্বাগ্রে দশভুজার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিষ্ঠাবান হিন্দু। হরিহর নগরে তাঁহাদের বাড়ী হইলেও তাঁহার পিতা কার্য্যোপলক্ষে ভূষণাতেই থাকেন, তথায় তাঁহাদের বাসা ‘বাটী ছিল, সীতারাম সেখানে থাকিয়া লেখাপড়া করিতেন, যুদ্ধবিদ্যা শিখিতেন, জমিদারী পাইবার পরও তিনি সৰ্ব্বদা সেখানে যাইতেন। ভূষণা হরিহর নগর হইতে বেশী দূরবর্তী নহে। বিশেষতঃ আধুনিক বঙ্গের কলিকাতা বা ঢাকার মত সে অঞ্চলে ভূষণাই ছিল প্রধান সহর-সভ্যতার কেন্দ্র এবং বাণিজ্যের স্থান।[৭] মুকুন্দরাম রায়ের সময়ে এই সহরের চরমোন্নতি সাধিত হয়। এখন ত ভূষণা শ্মশান! তাহার অসংখ্য কীর্ত্তি-চিহ্ন ভীষণ জঙ্গলের অন্তরালে লুক্কায়িত হইয়া পড়িয়াছে। এখনও সেখানে রণরঙ্গিনী দেবীর মন্দির এবং গোপীনাথ জীউর আখড়া বাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে। সীতারাম প্রথম জীবন হইতে এখানে আসিয়া আনন্দোৎসব করিতেন। গোসাঁই গোরাচাঁদের গ্রন্থে আছে :
‘শ্রীরণরঙ্গিনী মাই, সীতারাম যাকে পাই,
হইল দেখ রাজা রাজ্যেশ্বর।’
এই গোসাঁই সীতারামের সমসাময়িক। তাঁহার ‘শ্রীশ্রীসংকীর্তন বন্দনা’ নামক পাঁচালী পুঁথি ‘সন ১১৩২ সাল, মাহে বৈশাখ, মোকাম ভূষণা’ নগরে সমাপ্ত হয়। তাহা হইলে ১৭২৬ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ সীতারামের পতনের ১২ বৎসর পরে উক্ত পাঁচালীর লেখা শেষ হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিখ্যাত সাধক কামদেব তার্কিক ও তাঁহার উত্তর সাধক যাদবেন্দ্র ঘোষ ভূষণায় আগমন করেন এবং প্রথমেই তাঁহারা রণরঙ্গিনী মন্দিরে উপস্থিত হন। গোরাচাঁদের গ্রন্থে দেখিতে পাই :
‘কামদেব যাদবেন্দ্র দুই মহাজন—
শুভক্ষণে ভূষণায় হইল আগমন,
শ্রীরণরঙ্গিনী মাই মন্দিরে বসিল,
একসঙ্গে চন্দ্র সূর্য্য উদিত হইল।
ধাওয়াধাই আইল লোক দেখিবার তরে
রূপদেখি নয়ন ফিরাইতে কেহ নারে।
সংবাদ শুনিয়া আইল রাজা সীতারাম
যাদবেন্দ্র গান করে হরেকৃষ্ণ নাম।’
সম্ভবতঃ এ সময়ে সীতারাম জমিদার মাত্র, তিনি তখনও রাজা হন নাই, লোকে সেই জমিদারকেই রাজা বলিয়া সম্বোধন করিত। কামদেব ও যাদবেন্দ্র ভূষণার নিকটবর্ত্তী চম্পকদহের তীরে নানাস্থানে সাধনাসন পাতিয়া বহুবৎসর তপস্যা করিয়াছিলেন। তখন মাধব বিশ্বাস নামক একজন মৌলিক কায়স্থ সংগ্রাম সাহের সময় হইতে নওয়ারা মহলের একজন ক্ষুদ্র জায়গীরদার বা জমিদার ছিলেন। চম্পকদহ হ্রদের সহিত পদ্মার সংযোগ ছিল; উহার মধ্যে তাঁহার নওয়ারা থাকিত, পার্শ্ববর্ত্তী নওয়ারাপাড়া নামক গ্রামে তাঁহার নিবাস ছিল, এখনও সে গ্রাম আছে। মাধব বিশ্বাস যাদবেন্দ্রকে ডাকিয়া আনিয়া একপ্রকার জোর করিয়া তাঁহাকে নিজ কন্যা ভগবতীকে সম্প্রদান করেন।[৯] মাধবের গুরু কালীশরণ ভট্টাচার্য্যের কন্যা রঙ্গিনী দেবীর সহিত মাধবের একান্ত অনুরোধ ক্রমে একইভাবে কামদেবের বিবাহ হয়।[১০] তাহার বংশধরগণ এক্ষণে মহীশালা ও কুমারখালি প্রভৃতি স্থানে বাস করিতেছেন। কামদেব কুমার নদের তীরবর্ত্তী কয়ড়ার কালীবাড়ীতে সিদ্ধিলাভ করেন; পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এই সাধনপীঠে রামা শ্যামার সিদ্ধি লাভ ঘটিয়াছিল। শেষ বয়সে কামদেব যখন জীবনের সাধনা শেষ হইয়াছে বলিয়া বুঝিলেন, তখন সহস্র লোকের সম্মুখে জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করিয়া ধরাধাম ত্যাগ করিলেন। কুমারের তুঙ্গ পাহাড়ের উপর কয়ড়ার কালীবাড়ী অতি অপূৰ্ব্ব স্থান।[১১] সেখানে যাইবা মাত্র প্রত্যেকের মনে এক অনির্ব্বচনীয় ভক্তিভাবের সঞ্চার হয়। উহারই অদূরে কামদেবের চিতা-স্থান প্রদর্শিত হয়। কামদেবের স্বর্গারোহণের পরও যাদবেন্দ্র অনেকদিন জীবিত ছিলেন। গোসাঁই গোরাচাঁদ তাঁহার শিষ্য হন এবং গোসাঁইজী পরে ভূষণার গোপীনাথের আখড়ার মোহন্ত হইয়াছিলেন।[১২] তখন সীতারাম গোপীনাথের মন্দিরে আসিতেন এবং হরিনাম-রসে মজিয়া যাইতেন। ক্রমে তিনি বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হন এবং রাজা হইবার পর মুর্শিদাবাদের টেয়া গ্রাম নিবাসী কৃষ্ণবল্লভ গোস্বামীর নিকট বৈষ্ণব-দীক্ষা গ্রহণ করেন। কৃষ্ণবল্লবের বংশধরেরা এখনও মহম্মদপুরে নিকট ঘুল্লিয়া গ্রামে বাস করিতেছেন। বংশ কথা পরে বলিব। পূর্ব্বেই বলিয়াছি সীতারাম বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষিত হইলে কি হয়, কখনও কোন হিন্দুদেবদেবীর প্রতি তাঁহার বিদ্বেষ ছিল না। তিনি সাৰ্ব্বজনীন হিন্দু। অন্য প্রসঙ্গে তাহার ব্যাখ্যা করিব।
সীতারামের তিনটি বিবাহের বিশেষ উল্লেখ দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রও প্রবাদ ঠিক রাখিয়া তাঁহার তিন মহিষীর চরিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। অতি অল্প বয়সে সীতারামের সহিত ভূষণার অন্তর্গত ইদিলপুর-নিবাসী এক মৌলিক কায়স্থের কন্যার বিবাহ হইয়াছিল। এ পত্নীর কোন সন্তানাদি হয় নাই। সম্ভবতঃ ইহাকেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘শ্রী’ নামে কীর্তিত করিয়া তাঁহার উপন্যাসের সৌষ্ঠব সাধন করিয়াছেন। সীতারাম নলদী পরগণা জায়গীর পাওয়ার পর অকস্মাৎ তাঁহাদের অবস্থা উন্নত হইয়া পড়ে। তখন তিনি বীরভূম জেলার অন্তর্গত দাস-পশা গ্রামে সৌকালীন গোত্রীয় প্রসিদ্ধ কুলীন সরল খাঁ ঘোষের কন্যা কমলাকে বিবাহ করেন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মুর্শিদাবাদ জেলার ফতেসিংহ পরগণা উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থের একটি প্রধান স্থান। এই ফতেসিংহের কতকাংশ বীরভূম ও বর্দ্ধমান জেলার মধ্যে পড়িয়াছে। যে অংশ বীরভূমে পড়িয়াছে, তন্মধ্যে দাস-পল্শা গ্রাম অবস্থিত। সরল খাঁ তথাকার সর্ব্বাগ্রগণ্য কুলীন। সীতারামের পিতা মৌলিক কায়স্থ এবং আভিজাত্যে নিম্ন। এই জন্যই অবস্থা ফিরিবামাত্র উদয়নারায়ণ সীতারামের সহিত প্রসিদ্ধ কুলীনের কন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন। এই সরল খাঁ কন্যা সম্প্রদানকালে কমলাকে ওজন করিয়া পণের টাকা লইয়াছিলেন।[১৩] রাণী কমলাই হইয়াছিলেন সীতারামের প্রধানা মহিষী এবং তাঁহার গর্ভে সীতারামের প্রধান দুই পুত্র শ্যামসুন্দর ও সুরনারায়ণের জন্ম হয়। কমলাকে বঙ্কিমচন্দ্রের নন্দা বলা যাইতে পারে।
সীতারাম তৃতীয়বার বর্দ্ধমানের অন্তর্গত পাটুলী গ্রামে বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর নাম বা অন্য পরিচয় জানা যায় নাই। শুনা যায়, উহার গর্ভে বামদেব ও জয়দেব নামক দুই পুত্রের জন্ম হইয়াছিল। জয়দেব নাম যে সীতারামের প্রিয়কবি কেন্দুবিল্বের কবি-কোকিলের নামে হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় উক্ত দুই পুত্রই অকালে মৃত্যুমুখে পড়ে। সুতরাং তাহাদের বংশ নাই। কালে জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্যামসুন্দরেরও বংশলোপ ঘটিয়াছিল। কেবল মাত্র সুরনারায়ণের পৌত্র রাধাকান্তের ধারায় কয়েকজন জীবিত আছেন এবং সীতারামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মীনারায়ণের অধস্তন বংশধর দেবনাথ রায় মহাশয় প্রভৃতি কয়েকজন এখনও হরিহরনগরে বাস করিতেছেন। এই তিন বিবাহ ব্যতীত সীতারামের অন্য বিবাহ হইয়াছিল কিনা, ঠিক জানা যায় না; সম্ভবতঃ হইয়াছিল, কারণ বীরপুর গ্রামে তাঁহার নওয়ারাণীর বাটীর উল্লেখ আছে। যাহা হউক, এ সব বিবাহ উল্লেখযোগ্য নহে এবং সেই মোগল যুগে মুসলমান বা হিন্দুরাজন্যবর্গের বিবাহসংখ্যা ঠিক করিয়া বলিতে যাওয়াই বাতুলতা। জেনানা মহলের পরিসর বৃদ্ধি যেন তখনকার রাজাদের ক্ষমতার নিদর্শন ছিল। সীতারামের প্রবাদে এ জাতীয় অপবদের অভাব নাই। কিন্তু প্রমাণের অভাবে আমরা সেদিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিব না।
.
পাদটীকা :
১. এইরূপ আবৃত্তি করিবার শক্তি তাঁহার জীবনের শেষ পর্যন্ত ছিল এবং এ বিষয়ে তিনি অন্যের সহিত প্রতিযোগিতা করিতে গৌরব অনুভব করিতেন। এইরূপ এক প্রতিযোগিতায় নিজে পরাজিত হইয়া তিনি জগন্নাথ চক্রবর্ত্তী নামক এক ব্রাহ্মণকে যে নিষ্কর ভূমিদান করিয়াছিলেন, তাহার সনন্দ পাওয়া গিয়াছে। উহার প্রতিলিপি এই ‘পরম পূজনীয় শ্রীযুক্ত জগন্নাথ চক্রবর্ত্তী শ্রীচরণেষু। আমার জমিদারী পরগণে মহিম সাহীর হোগল ডাঙ্গা ও কল্যাণপুর গ্রামে বারপাখী ও পরগণে নদীর নারায়ণপুর ও নহাটা গ্রামে আটপাখী জমি আপনার চণ্ডীদাস ও জয়দেবের মুখস্থ কবিতা শুনিবার জন্য ব্রহ্মোত্তর দিলাম আপনি পুরুষানুক্রমে আশীর্ব্বাদ করিয়া ভোগ দখল করুন সন ১১১৩ সাল তাং ৫ই বৈশাখ।’ [ইহাতে খৃষ্টীয় ১৭০৭ অব্দ বুঝা গেল]— যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ২৩৭ পৃ।
২. ‘The Jaygir was originally granted to a Mugh Rajah, named Dharm Das of Mulkh Rakhang (Arrakan) who was found in rebellion and brought a captive in the reign of Aurangzeb, who converted him to Islamism and gave him the name of Nizam Shah’,–Sen, Ram Sanker, Report. p. iii. তারাউজলিয়া পরগণার একটি ক্ষুদ্র অংশ লইয়া এই ‘মগ জায়গীর’ নামক পরগণার সৃষ্টি হয়। উহার মধ্যে বয়ড়া, চামতালপাড়া ও খুলুমবাড়িয়া প্রভৃতি যশোহরের মধ্যে এবং অন্য ৬ খানি মৌজা ফরিদপুরের মধ্যে পড়িয়াছে। আইন আকবরীতে তারাউজলিয়ার উল্লেখ আছে।— Ain. Vol. II. p. 133. এই পুস্তকের ৩৪শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
৩. রায় গ্রামের ঘোষ মহাশয়দিগের বংশ-লতিকায় এই ব্যক্তির এই উভয় নাম পাইয়াছি। রঘুরামেরই নামান্তর রামরূপ, অথবা তাঁহারা দুই ভ্রাতা, ইহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। যদুনাথ প্রভৃতি লেখকগণ সকলই রামরূপ নাম ধরিয়াছেন, আমরাও তাহাই ধরিলাম। মেনাহাতীর নামের মূল্য নাই, তাহার বীরত্ব ও প্রভুভক্তি অমূল্য পদার্থ। উহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামশঙ্কর বর্তমান রায়গ্রামী ঘোষদিগের আদি পুরুষ। সেখানে তৎপ্রতিষ্ঠিত মন্দির ও জোড়-বাঙ্গালা আছে।
৪. “রঘো, রামা, শ্যামা, শুম্ভো, বিশে, হরে, নিমে, কালা, দিনে, ভুলো, জগা ও যেদো, এই বার জন দস্যু বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছিল।”—’সীতারাম,’ ৪৮ পৃ। বারভুঞার দেশে যে দস্যুর তালিকায়ও বার সংখ্যা পুরাইতে হইবে, এমন কথা নাই। বিশেষতঃ ইহারা সকলেই সীতারামের সমসাময়িক নহে। রামা, শ্যামা যে সীতারামের বহু পূর্ব্বের লোক তাহা বলিয়াছি, রঘো ও বিশে বিখ্যাত ডাকাইত। উক্ত বারজন সকলেই হিন্দু, কিন্তু অনেক মুসলমানও বিখ্যাত ডাকাইত ছিল।
৫. ‘A refracory Zemindar, named Sitaram, who kept in his pay a band of robbers with whom he used to infest the roads and plunder the boats on the rivers and even carry off the cattle from the villages, setting at defiance the power of the Fouzdar’.-Sewart. History of Bengal, pp. 432-3.
৬. এখনও অনেক পল্লীগ্রামে এই নিশানাথ ঠাকুরের আস্তানা বা বটতলা আছে; ইনি মহাদেবের কতকটা রূপান্তর, সেই ভাবে শনি মঙ্গলবারে ইহার পূজা হয়। নহাটা, নড়াইল, গঙ্গারামপুর, বেন্দা, রায়গ্রাম প্রভৃতি স্থানে নিশানাথের বটতলা আছে। কাশীর কালভৈরবের মত ইনি গ্রামের রক্ষাকর্তা। মোচড়াসিংহ প্রভৃতি তাহার আরও একাদশ ভ্রাতা এবং রণরঙ্গিনী নামে ভগিনী ছিল। ভূষণায় যে তথাকার অধিষ্ঠাত্রী দেবতার মন্দির আছে, তাঁহারও নাম রণরঙ্গিনী। সীতারাম তাঁহার সেনানীদিগকে ভ্রাতার মত দেখিতেন, “ভাই” বলিয়া ডাকিতেন, এজন্য নিশানাথের সঙ্গে তাঁহার মিল ছিল।
৭. প্রাচীন কাল হইতে ভূষণা নানাবিধ সূক্ষ্মবস্ত্র (ধুতি চাদর), কাগজ, গালা, মোম, তামা, পিতল ও কাঁসার জিনিস এবং সোনারূপার কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। ভূষণাই খাসা বস্ত্র প্রসিদ্ধ। রামপ্রসাদ লিখিয়া গিয়াছেন— ‘বনাত মখমল পটু ভুষণাই খাসা। বুটাদার ঢাকাইয়া দেখিতে তামাসা।’ (বিদ্যাসুন্দর) ৪০ বৎসর পূর্ব্বেও যশোহরের উত্তরাংশে যাহা কিছু লেখাপড়া সব ভূষণাই কাগজে হইত। এখনও গড়বেষ্টিত ভূষণা নগরীর জঙ্গলের মধ্যে বেড়াইতে বেড়াইতে কতকগুলি স্থানকে বাজারের নামে অভিহিত করিতে শুনিয়াছি। একটি স্থানকে বড়বাজার বলে; সেখানে এখনও কামার ও কাচারু নামক (কাচের চুড়ী প্রস্তুতকারী অনাচরণীয়) একজাতীয় কয়েক ঘর লোক বাস করিতেছেন। তাঁহাদের প্রধান ব্যবসায় রাশিরাশি তামার মাদুলী প্রস্তুত করিয়া গৃহাগত ব্যাপারীর নিকট বিক্রয় করা। মুকুন্দরামের সময় ভূষণা সর্ব্বশ্রেণীর লোকের একটি প্রধান সমাজ হইয়াছিল। এখনও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ এবং তেলি, মালী, কামার প্রভৃতি নবশাখগণের এক এক সম্প্রদায়কে ভূষণাই পটী বা থাক্ বলে।
৮. গোরাচাঁদের ‘সংকীর্ত্তন বন্দনা’ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অপূর্ব্ব ভক্তিগ্রন্থ। উহাতে ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুরের জন্মস্থান ও জীবন-লীলার সুন্দর বিবরণ আছে। উহা হইতে হরিদাসের সম্বন্ধে অনেক নূতন তথ্য জানিতে পারিয়াছি। খুলনা জেলার সোনাই নদীর কূলে কলাগাছি বা কেড়াগাছি গ্রামে ব্রাহ্মণকূলে যে তাঁহার জন্ম, তদ্বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ পাইয়াছি। ঐ সম্বন্ধে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ মৎ-সম্পাদিত ‘দেবায়তন’ পত্রে প্রকাশিত করিয়াছিলাম। তাহার সারাংশ এই পুস্তকের প্রথম খণ্ডের পুনঃ সংস্করণে গ্রন্থিত করিব। [ইহা করা হইয়াছে— শি মি]
৯. যাদবেন্দ্র দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ। তিনি পূর্ব্বে কুলীন ছিলেন, মাধবের কন্যা বিবাহে কুল হারাইয়া বংশজ হইয়াছিলেন। যাদবেন্দ্রের বংশধরগণ নিকটবর্ত্তী ঘোষপুরে বাস করিতেছেন। বিখ্যাত অবধূত সাধক, ‘কালীকুলকুণ্ডলিনীর’ গ্রন্থাকার ভুলুয়া বাবা (কালিদাস ঘোষ) এই যাদবেন্দ্রের উপযুক্ত বংশধর। যশোহরের বিখ্যাত উকীল উমেশচন্দ্র ঘোষ এই ঘোষপুরের ঘোষ বংশীয়। ইহারা আনা সমাজের ঘোষ। বংশধারা এইরূপ : জনাৰ্দ্দন (আনা)—নৃসিংহ—কামদেব—রূপনারায়ণ—কৃষ্ণবল্লভ—যাদবেন্দ্র (যাদবানন্দ অবধূত)। মাধব বিশ্বাসের কন্যা বিবাহ করিয়া উহার কুল ভঙ্গ হয়। যাদবেন্দ্র—রামকৃষ্ণ—রামচন্দ্র—কৃপারাম— গোলকচন্দ্র— নীলমণি— কালিদাস (ভুলুয়া বাবা), ভুবন, ব্রজেন্দ্র, মনোরঞ্জন, সাং ঘোষপুর।
১০. কামদেবের এই বিবাহে শ্রীকান্ত (বিদ্যাবাগীশ) ও গঙ্গাধর (ন্যায়বাগীশ) নামক দুই পুত্রের জন্ম হয়। শ্রীকান্তের ধারা ঘোষপুরের নিকট মহীশালা গ্রামে এবং গঙ্গাধরের ধারা কুষ্টিয়ার নিকটবর্ত্তী কুমারখালিতে আছেন। সাধককুল-গৌরব, ‘তন্ত্র-তত্ত্বাদি’ গ্রন্থের প্রসিদ্ধ লেখক, অসাধারণ পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব মহোদয় উক্ত গঙ্গাধরের কুলপাবন বংশধর।
১১. কয়ড়া প্রভৃতি স্থান পূর্ব্বে যশোহর জেলার মধ্যে ছিল, এখন ফরিদপুরে পড়িয়াছে। কামদেবের বংশীয়েরা কয়েক পুরুষ এই কালীবাড়ীর অধিকারী ছিলেন; এখন সে সম্বন্ধ নাই। শ্রীকান্তের প্রপৌত্র রামজীবন কয়ড়ার চক্রবর্ত্তীদিগকে কালীবাড়ী দিয়া যান। সেই বংশীয় প্রতাপচন্দ্র চক্রবর্ত্তী এখন উহার সেবায়ৎ।
১২. গোঁসাই গোরাচাঁদ নিজে লিখিয়া গিয়াছেন, ‘মদগুরু শ্রীজগদ্গুরু শ্রীযাদবানন্দ।’ যাদবেন্দ্র ও যাদবানন্দ নাম অভিন্ন। যাদবেন্দ্ৰই গোপীনাথের মন্দিরের কর্তা ছিলেন, তিনি উহা গোরাচাঁদকে দেন। গোরাচাঁদের নিজ কথা এই : ‘দয়া করি তেঁহ মোরে, কৃষ্ণনাম দিল করে, দিল গোপীনাথের মন্দির।’ ভূষণা হইতে দেড় মাইল উত্তর-পশ্চিম কোণে ঘোপের ঘাট গ্রামে গোরাচাঁদের নিবাস ছিল। তিনি অদ্বৈত-বংশীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। মাতুলালয়সূত্রে এদেশে আসেন। তাঁহারা বংশ নাই।
১৩. শুধু পণের টাকা নহে; সীতারাম রাজা হওয়ার পর আপন শ্বশুর সরল খাঁ ঘোষ ও আরও কয়েকজন সম্ভ্রান্ত উত্তররাঢ়ীয় কায়স্থকে ফতেসিংহ পরগণা হইতে উঠাইয়া আনিয়া তাঁহাদিগকে যথেষ্ট ভূমিবৃত্তি দিয়া রাজধানীর সন্নিকটে ঘুল্লিয়া গ্রামে বাস করাইয়াছিলেন। সেখানে এখনও সরল খাঁর বাটীর ভগ্নাবশেষ ও দুইটি দীঘি আছে। কথিত আছে, সরল খাঁর এক জ্ঞাতি ভ্রাতুষ্পুত্র গোপেশ্বর খাঁ ঘোষের সহিত সীতারামের কনিষ্ঠ ভগিনী রাইরঙ্গিনীর বিবাহ হইয়াছিল।— যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ১৩৮ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন