সতীশচন্দ্র মিত্র
প্রতাপাদিত্য আগ্রা হইতে যে সৈন্যদল সঙ্গে আনিয়াছিলেন তাহার অধিনায়ক ছিলেন এক তীক্ষ্ণবুদ্ধি পাঠান বীর— কমল খোজা। ইঁহার সম্পূর্ণ নাম খোজা কামাল বা কামালউদ্দীন হইতে পারে; কিন্তু তিনি সাধারণতঃ হিন্দু ভাবাপন্ন কমল নামেই পরিচিত। প্রথমতঃ তিনি প্রতাপের শরীররক্ষী সেনার অধিনায়ক ছিলেন; পরে ক্রমশঃ তাঁহাকে আরও দায়িত্বপূর্ণ উচ্চপদে উন্নীত করা হয়। প্রায়ই তাঁহাকে এক একটি প্রধান দুর্গে অধীশ্বর করিয়া রাখা হইত। আমরা পরে দেখিতে পাইব, তাঁহার নামানুসারে একটি প্রসিদ্ধ দুর্গের নাম হইয়াছিল— গড় কমলপুর। তাঁহার উপর প্রতাপের অগাধ বিশ্বাস ছিল এবং তিনিও চিরদিন সে বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। রাজ্যারোহণের পর প্রতাপাদিত্য যখন ধুমঘাটে নূতন দুর্গ নির্ম্মাণ করিলেন, তখন তাহার প্রধান ভার কমল খোজার উপর অর্পিত হইল।[১]
যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গম স্থলের দক্ষিণ দিকে অনতিদূরে এই বিস্তীর্ণ মৃন্ময় দুর্গ নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। যমুনা ও ইছামতী উহার উত্তর ও পূর্ব্বদিক বেষ্টন করিয়া থাকিল এবং দক্ষিণ দিকে ইছামতী হইতে হানরখালি নামে একটি খাল খনিত হইল এবং পশ্চিমদিকে হানরখালি হইতে কামারখালি নামক অন্য একটি খনিত খাল বাহির হইয়া যমুনায় মিশিল। এইভাবে ইহার বাহিরের গড়খাই হইল। ভিতরে চারিদিকে বিস্তৃত পরিখা কাটিয়া মৃত্তিকা স্তূপীকৃত করিয়া বেষ্টন প্রাচীর প্রস্তুত হইল; উহারই মধ্যে সৈন্যাবাসের জন্য ইষ্টক ও কাষ্ঠনির্মিত গৃহসকল প্রস্তুত করা হইল। পূর্ব্বদিকে উহার সদর তোরণ হইল। সেই দ্বারের পার্শ্বে দুর্গাধ্যক্ষের আবাস স্থান ছিল। কমল খোজা দিবারাত্রি সেইস্থানে থাকিয়া দুর্গ নির্মাণের তত্ত্বাবধান করিতেন। গভীর নিশীথেও তিনি প্রহরীর মত এই পূর্ব্বদ্বারে বসিয়া থাকিতেন। সেস্থান হইতে দক্ষিণ দিকে তখনও ভীষণ অরণ্য ছিল। প্রবাদ এই, ঐ অরণ্যের মধ্যে গভীর তমসাচ্ছন্ন রাত্রিতে তিনি এক স্থান হইতে অগ্নিশিখা উঠিতেছে দেখিতে পাইতেন। দুর্গের পূর্ব্বোত্তর কোণে ইছামতী বা কদমতলীর উপর একটি খেয়াঘাট হইয়াছিল। সেই ঘাটের মালিক যশা পাটনীও রাত্রিকালে জঙ্গলের মধ্যে ঐরূপ অগ্নিশিখা দেখিত। ক্রমে এই কথা যখন প্রতাপের কর্ণে উঠিল, তখন তিনি জঙ্গল কাটিয়া উহার কারণ অনুসন্ধান করিবার আদেশ দিলেন। এই অগ্নিশিখায় কেহ বিশ্বাস করুন বা না করুন, দুর্গের সান্নিধ্যে রাজধানীর সহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হইয়াছিল। জঙ্গল কাটিয়া স্থান পরিষ্কত হইলে, তন্মধ্যে স্তূপীকৃত ইষ্টকাদির ভগ্নাবশেষের নিম্নে যশোরেশ্বরী দেবীর পাষাণময়ী মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইল। পরিষ্কৃত হইলে দেখা গেল, সে অতীব কৃষ্ণবর্ণ বা কষ্টিপাথরে নির্মিত ভয়ঙ্করী কালীমূৰ্ত্তি। বাস্তবিকই ভয়ঙ্করী মূর্তি। মূর্ত্তি অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু এমন বিভীষিকাময়ী মৃত্যু-মূৰ্ত্তি আর দেখি নাই।[২] সেই অতি বিস্তার বদনা জিহ্বাললন-দশনা ভীষণা মূর্ত্তি দর্শন করিলে, মানব মাত্রেরই আতঙ্কের সঞ্চার হয়; কিন্তু এক অপূৰ্ব্ব বিশেষত্ব এই, সে ভীতির সঙ্গে ভক্তি বিজড়িত থাকে; ভীতির পদার্থ হইতে মানুষে সরিয়া যাইতে চায়, কিন্তু হিন্দুরা প্রাণ লইয়া কেহ সে মূৰ্ত্তি দেখিবার বেলায় নেত্র নির্মীলিত করিতে চায় না। আতঙ্কে রোমাঞ্চিত হইতে হয় সত্য, কিন্তু উহা ভক্তিতে পুলকিত হইবার নিদর্শন কিনা, তাহা স্থির করা যায় না। বাহ্যদৃষ্টিতে যাহা মৃত্যু-মূৰ্ত্তি, প্রকৃতপক্ষেই তাহা বিশ্বমাতার শ্রীমূর্তি। প্রথম আবিষ্কারের সময় ভারতীয় ভাস্কর্য্যের এই অপূর্ব্ব রচনা— করুণাময়ীর শ্রীমূর্ত্তি যিনি দর্শন করিলেন, তিনিই ভক্তিতে বিগলিত হইয়া গেলেন।
এ মূর্ত্তি যে পীঠমূর্ত্তি তাহা বুঝিতে বাকী থাকিল না। মহাপ্রাণ বসন্ত রায়, যিনি কালীঘাটের পীঠমূর্তির জন্য মন্দির নির্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন, তিনি চিনিলেন। তান্ত্রিক সাধক তর্কপঞ্চানন আসিয়া তন্ত্রোক্ত শ্লোক উদ্ধার করিয়া স্থির করিয়া দিলেন, ইনি একান্নপীঠের অন্যতম যশোরের পীঠ-দেবতা— অতএব ইঁহার নাম মাতা যশোরেশ্বরী :
‘যশোরে পাণিপদ্মঞ্চ দেবতা যশোরেশ্বরী
চণ্ডচভৈরবস্তুত্র যত্র সিদ্ধিমবাপুয়াৎ’ –তন্ত্রচূড়ামণি
তবে ত যশোর-রাজ্যের ইহাই পীঠস্থান, ইহাই শীর্ষস্থান, যশোর নাম ত ইহারই হওয়া উচিত। পূর্ব্বে বসন্ত রায় যে নূতন সহরকে যশোহর বলিয়াছিলেন, তাহা ত ঠিক হয় নাই। প্রতাপ বাস্তবিকই রাজধানী করিবার জন্য ভাগ্যক্রমে প্রকৃত স্থানই বাছিয়া বাহির করিয়াছেন। এতদিন ধুমঘাটের সীমান্ত পর্য্যন্ত যশোহর নাম বিস্তৃত হইয়াছিল; এখন ধুমঘাট সে নামের অন্তর্ভুক্ত হইল। ক্রমে ধুমঘাটের রাজধানী যত দক্ষিণে পূৰ্ব্বে বিস্তৃত হইতে লাগিল, উত্তরদিকের প্রাচীন সহর তত নগণ্য ও দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইতে লাগিল এবং তাহার যশোহর নাম অবশেষে যমুনা পার হইয়া ধুমঘাটে সংলগ্ন হইল। যে স্থানে যশোরেশ্বরী দেবীর মূর্ত্তি আবিষ্কৃত হইল, তাহার নাম হইল যশোরেশ্বরীপুর, উহাই সংক্ষিপ্ত হইয়া হইল ঈশ্বরীপুর। ঈশ্বরীপুর বলিলে প্রতাপাদিত্যের ধুমঘাট- যশোরের একাংশকে বুঝাইত। এখনও তাহাই বুঝায়; এখনও দক্ষিণাঞ্চলের কোন লোক ঈশ্বরীপুর বা নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে যাইবার সময় ‘যশোর যাইতেছে’ বলিয়া পরিচয় দেয়। সে অঞ্চলে এখনও ‘যশোর’ বলিলে ইংরাজ আমলের আধুনিক জেলা যশোহর বুঝায় না। একস্থানের যশঃ হরণ করিয়া অন্যস্থানে লইতে লইতে যশোহর নাম যে কত স্থানই ভ্রমণ করিল! কিন্তু যেখানেই গিয়াছে, যশঃ রক্ষা করিতেছে, এখন শেষ রক্ষা করিতে পারিলে হয়।
যশোরেশ্বরী মূর্তির আবির্ভাব হওয়া মাত্র প্রতাপ ভক্তি-বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। অচিরে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল বহুদূর পর্য্যন্ত পরিষ্কৃত হইল; স্তূপীকৃত ইষ্টক সরাইয়া ফেলা হইল; প্রতাপাদিত্য মায়ের শ্রীমন্দির নির্মাণের জন্য উপযুক্ত আদেশ দিলেন। পীঠস্থানের সন্নিকটে তিনি দুর্গের স্থান নির্ণয় করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার আনন্দ আর ধরে না। দুর্গ, সহর ও মন্দিরের গঠনকার্য্য পূর্ণবলে চলিতে লাগিল। তন্মধ্যে মন্দিরের কর্ম যাহাতে যথাসম্ভব সত্বরতার সহিত সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, তাহারই চেষ্টা করিতে লাগিলেন। মন্দিরের ভিত্তি খনন কালে মৃত্তিকার নিম্নে যে কত ইট কাঠ বাহির হইতে লাগিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। মায়ের মূর্ত্তিও নূতন নহে; মন্দিরও কতবার পড়িয়াছে, কতবার গড়িয়াছে, তাহা বলা যায় না। কাল তাহার একমাত্র সাক্ষী।
প্রাচীন যশোর একটি প্রসিদ্ধ পীঠস্থান। ভবিষ্যপুরাণ হইতে দেখিতে পাই, এখানে সতীদেহ হইতে বাহু ও পদ পতিত হয়। কবিরাম কৃত ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ নামক প্রাচীন গ্রন্থ হইতে জানা যায়, পূর্ব্বকালে অনরি নামক একজন ব্রাহ্মণ দেবীর জন্য এখানে শতদ্বারযুক্ত এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করেন। পুনরায় ধেনুকর্ণ নামক এক ক্ষত্রিয় নৃপতি তীর্থদর্শনে আসিয়া মায়ের ভগ্নমন্দির স্থলে এক নূতন মন্দির প্রস্তুত করিয়া দেন। সুন্দরবনের ইতিহাসে দেখিয়াছি যে, সুন্দরবন বহুবার উঠিয়াছে, পড়িয়াছে। কখনও এখানে জন কোলাহলময় লোকালয় ছিল; কখন তাহা উৎসন্ন হইয়া মনুষ্যশূন্য হইয়াছে। একে প্রস্তরশূন্য বঙ্গদেশ, তাহাতে লবণাক্ত বায়ু প্রবাহ, উভয় কারণে প্রাচীন অট্টালিকা বিনষ্ট হয়। যশোরেশ্বরীর মন্দিরও এইভাবে কতবার নষ্ট হইয়াছে। মন্দির যাইতে পারে, কিন্তু যে অপূর্ব্ব কষ্টিপাথরে এই পীঠমূর্তি নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহার বিনাশ বা ক্ষয় নাই। এবার মা যেমন উঠিলেন, সেই প্রস্তরের কালিমার মধ্য হইতে কালী মায়ের আভা ফুটিল। মূৰ্ত্তি যেখানে উঠিলেন, সেইখানেই রহিলেন; কারণ সে বিরাট প্রতিমা অচল অটল, যেন পাহাড়ের মত ভারী। যে ভাবে উঠিয়াছিলেন, এখনও সেই ভাবেই আছেন। দেহের যতটুকু অংশ মেজের উপর আছে, ততোধিক এবং স্থূলতর অংশ ভূপ্রোথিত রহিয়াছে। এই অচলা মূর্ত্তির চারিধারে বেড়িয়া মন্দির উঠিল। প্রবাদ এই, মায়ের জ্বালাময়ী মূর্ত্তি বলিয়া উহার মস্তকোপরি ছাদ থাকিত না, ফাটিয়া ভাঙ্গিয়া জ্বালা নির্গমনো পথ হইত; তদবধি সেইস্থানে চিীর মত গাথিয়া ফাঁক্ করিয়া দেওয়া হয়। এ মূর্ত্তি পরে মানসিংহ লইয়া গিয়াছেন বলিয়া যে প্রবাদ আছে, তাহা সত্য নহে। আমরা পরে তাহা দেখাইব। যশোরেশ্বরী দেবী এখনও নিত্য পূজিত হন, শনি মঙ্গল বারে সেখানে লোকারণ্য হয়। কালীঘাটের মত ঈশ্বরীপুরও জাগ্ৰত পীঠ।
মন্দিরের কার্য্য শেষ হইলে, তান্ত্রিক বিধানে মহাসমারোহে মায়ের মূর্ত্তির অঙ্গরাগ ও অভিষেকাদি করিয়া পূজার সুব্যবস্থা করা হইল। এ সকল কার্য্য রাজগুরু তর্কপঞ্চানন ও তাঁহার পুত্রগণের সাহায্যে সুসম্পন্ন হইল। সম্ভবতঃ কালীঘাট হইতে ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারীও এই সময়ে যশোহরে আগমন করিয়াছিলেন। মায়ের আবির্ভাবে প্রতাপেরও জীবন-স্রোত সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গেল। বৈষ্ণব কুলে তাঁহার জন্ম; রামচন্দ্র নিয়োগী হইতে তদ্বংশীয়েরা সকলেই বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত; তন্মধ্যে আবার বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় বৈষ্ণব-চূড়ামণি। প্রতাপও বাল্যকাল হইতে, এমন কি রাজা হইবার পরও কিছুদিন বৈষ্ণব মতের পক্ষপাতী ছিলেন, গোবিন্দ দাসের প্রতি ভক্তিমান ছিলেন। কিন্তু তাঁহার ধর্মের কোন অনুষ্ঠান ছিল না, যোদ্ধৃ জীবনের মধ্যে তাঁহার কোন অবসরও ছিল না। তিনি ধর্মের ভাব দেখাইতেন, কিন্তু ধৰ্ম্ম তাঁহাকে অধিকৃত করিতে পারে নাই। এইবার সে ভাব চলিয়া গেল; মায়ের আবির্ভাবে প্রতাপের মতি গতি ফিরিয়া গেল। তিনি নূতন ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া তর্কপঞ্চাননের নিকট শাক্তমন্ত্রে তান্ত্রিক দীক্ষা গ্রহণ করিলেন। শক্তির উপাসক এবার নিজে মহাশক্তির পূজা করিতে লাগিলেন। অরণ্যে লোকারণ্য হইল, অসংখ্য লোকে মায়ের দুয়ারে পূজা দিতে আসিতে লাগিল। চতুর্দ্দিকে প্রচারিত হইল যে, প্রতাপের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া দেবী স্বয়ং আবির্ভূত হইয়াছেন। লোকে বলিতে লাগিল, প্রতাপাদিত্য দেবী ভবানীর বরপুত্র।
তাই কবিবর ভারতচন্দ্র তাঁহার সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন— ‘বরপুত্র ভবানীর, প্রিয়তম পৃথিবীর।’ ধর্ম্মকে ধরিতে পারিলে জীবনের একটা লক্ষ্য স্থির হয়; তখন লোকমত আসিয়া ধর্মনিষ্ঠকে আশ্রয় করে। লোকে শুনিল, প্রতাপাদিত্য এক স্বপ্ন দেখিয়াছেন যে, দেবী যুদ্ধে বা রাজ্য শাসনে চিরকাল তাঁহার সহায় থাকিবেন; তিনি স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচার না করিলে বা রাজলক্ষ্মীকে নিজে দূরীভূত না করিলে, যশোরেশ্বরী মাতা কখনও তাঁহার প্রতি বিমুখী হইবেন না। এ স্বপ্ন বৃত্তান্তের মূল কোথায়, তাহা জানা যায় না; তবে অচিরে একথা চারিদিকে প্রচারিত হইয়া পড়িল। সেইরূপ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে দেবানুগৃহীত মানব বলিয়া প্রতাপের প্রতিপত্তি সর্ব্বত্র সু- প্রতিষ্ঠিত হইল। তেজঃসম্পন্ন সুন্দর মূর্ত্তি, অসাধারণ কার্য্যদক্ষতা ও অদ্ভূত বীরত্ব খ্যাতি মানবমাত্রকেই লোকপ্রিয় করিয়া থাকে। তাহার সঙ্গে সঙ্গে লোকে যদি শুনে, দেবী কালিকা স্বয়ং তাঁহার সহায়, তাহা হইলে আর কথা থাকে না। সাধারণ লোকে তাঁহাকে একেবারে দেবতা বলিয়াই মানে এবং বনে জঙ্গলে ভীষণ বিপদে যেখানে ইচ্ছা সেইস্থানেই লোকে তাঁহার পদানুসরণ করিয়া অসম্ভবকে সম্ভব করিয়া তুলে। রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে ধনবল প্রতাপের করায়ত্ত হইয়াছে; এতদিনে দেববলে বলীয়ান হওয়ায় লোকবলও তাঁহার হস্তগত হইতে চলিল। বনান্ত ও নদীবহুল যশোর-রাজ্য সহজে দুর্গম এবং নবাগত মোগলের প্রতি তখনও লোকে অতীব সন্দিগ্ধ এবং ভক্তিশূন্য; সুতরাং দেশ ও কাল উভয়েই তাঁহার সহায়; স্বাধীনতা লাভের জন্য কোন চেষ্টা করিতে হইলে, ইহাই তাহার উপযুক্ত সময়। প্রতাপ সময় বুঝিয়া যথোচিত আয়োজন করিতে লাগিলেন সে আয়োজনের পরিচয় আমরা পরে দিতেছি; আপাততঃ যশোরেশ্বরীর সহিত সম্বন্ধযুক্ত অন্যান্য বিগ্রহের পরিচয় দিয়া লইব।
প্রত্যেক পীঠদেবতারই এক একটি ভৈরব থাকে, যশোরেশ্বরীর ভৈরবের নাম চণ্ডভৈরব। অতি প্রাচীনকাল হইতে তাঁহার জন্য একটি পৃথক মন্দির ছিল, এ মন্দিরও কতবার ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, কে জানে? কথিত আছে গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেন এই চণ্ডভৈরবের জন্য একটি মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু প্রতাপ যখন ভৈরবটি পাইলেন, তখন তাঁহার মন্দির বিলুপ্ত হইয়াছিল। তিনি উঁহার জন্য একটি ত্রিকোণ মন্দির গঠন করিলেন; বারংবার সংস্কারের পর সে ত্রিকোণ মন্দির এখনও দণ্ডায়মান আছে। তাহার দরজাগুলি নাই, ভিতরও জঙ্গলাকীর্ণ হইতেছে; পুনরায় উহার সংস্কার প্রয়োজনীয়। চণ্ডভৈরব এখন মায়ের মন্দিরে পূজিত হইতেছেন। প্রতাপ ও চণ্ডের সব অংশ পান নাই, উহা একটি বড় বাণলিঙ্গ; প্রতাপ উহার উর্দ্ধভাগ অর্থাৎ লিঙ্গাংশটুকু আবৰ্জ্জনার মধ্যে পাইয়াছিলেন। এ অংশ শ্বেত মর্ম্মর প্রস্তরে গঠিত; তিনি উহার নিম্নবর্ত্তি গৌরী পট্টের পরিবর্তে একখানি শ্বেত প্রস্তরের ত্রিকোণ পীঠ প্রস্তুত করিয়াছিলেন। উহাতে পঞ্চমুণ্ডী আসন কল্পনা করা হইয়াছিল। একখানি চৌকির উপর এই ত্রিকোণ পীঠ পাতিয়া তন্মধ্যস্থ গর্তমধ্যে শিবলিঙ্গটি বসাইয়া পূজা করা হয়। সেই ভাবেই উহার ফটো লওয়া হইল।
যশোরেশ্বরীর মন্দির মধ্যে আর একখানি অতি সুন্দর পাষাণ প্রতিমা আছেন। উহা অন্নপূর্ণা মূর্ত্তি বলিয়া পূজিত ও পরিচিত হন বটে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উহা গঙ্গামূর্তি। উহার বিশেষ বিবরণ ও ছবি প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছিল;৩ দেবী মকরবাহনা নানালঙ্কার-ভূষিতা হইয়া ঈষৎ বঙ্কিমভাবে দাঁড়াইয়া আছেন এবং তাঁহার মুখচ্ছবি হইতে দিব্যপ্রভা বিকীর্ণ হইতেছে। এই প্রতিমা যশোরেশ্বরী-মূর্ত্তির সহিত একই সময়ে আবিষ্কৃত হইয়াছিল কিনা সন্দেহ। আমরা পূর্ব্বখণ্ডে দেখাইয়াছি যে, প্রায় শতবর্ষপূর্ব্ববর্তী একটি মোকদ্দমার বর্ণনা হইতে জানা যায়, যশোরেশ্বরী দেবী সত্যযুগ হইতে প্রকাশিত আছেন; আর প্রতাপাদিত্যের সময় হইতে শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা ঠাকুরাণীর নিষ্কর বৃত্তি চলিয়া আসিতেছে। ইহা হইতে বুঝা যায়, প্রতাপাদিত্য এই মূর্ত্তি আনিয়া দেবীর মন্দির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন এবং উহার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দেন। অন্নপূর্ণা সত্যযুগ হইতে থাকিলে, যশোরেশ্বরীর সহিত একসঙ্গে সেরূপ উল্লেখ থাকিত। নিশ্চয়ই প্রতাপাদিত্য অন্যত্র হইতে এ মূর্ত্তি সংগ্রহ করেন এবং ইহার অপূর্ব্ব ভাস্কর্যে মুগ্ধ হইয়া ইহার প্রতিষ্ঠা করেন। গঙ্গামূৰ্ত্তি গঙ্গাতীরবর্ত্তী তীর্থক্ষেত্রে ভিন্ন অন্যত্র দেখা যায় না; কাশীধামের অপর পারে রামনগরে গঙ্গার গর্ভ হইতে উত্থিত এক মন্দিরে গঙ্গাদেবীর যে অপূর্ব্ব মর্ম্মর প্রতিমা দেখিয়াছি, তেমন সুন্দর জীবন্তমূর্ত্তি বোধ হয় জগতে আর নাই। কাশী যেমন এক গঙ্গাতীর্থ, সগরদ্বীপও তাহাই। অনুমান করি, প্রতাপাদিত্য যখন সগরদ্বীপ জয় করিয়াছিলেন, তখন তথায় এই গঙ্গামূর্ত্তি পান এবং উহা নিজ রাজধানীতে স্থানান্তরিত করেন। আমরা দেখাইয়াছি, ইহা সেন রাজগণের আমলের ভাস্কর্য্যের নিদর্শন। প্রতাপাদিত্যের সময়ে এ মূর্ত্তি চিনিতে ভুল হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। হয়ত চাঁদরায় বা অন্য কোন পরবর্ত্তী রাজার আমলে ইহার বৃত্তি ব্যবস্থার সময় গঙ্গামূর্ত্তি ভ্রান্তিবশতঃ অন্নপূর্ণা নামে উল্লেখিত হন।
দীক্ষার পর প্রতাপাদিত্য রীতিমত তান্ত্রিক আচারানুষ্ঠান দ্বারা সাধন আরম্ভ করেন। এইরূপ পূজাদির সময় তিনি সুরাপান করিতেন। সাধন-মার্গে সুরাপানের গুণভাগ যাহাই থাকুক, উহার দোষভাগও প্রতাপের চরিত্রে বিশেষভাবে বর্ত্তিয়াছিল। তিনি মত্তাবস্থায় কয়েকটি ঘোর নিদয়তার কার্য্য করিয়া নিজের চরিত্র কলঙ্কিত করিয়া গিয়াছেন। তিনি শুধু পূজা বা সুরাপান নহে, কার্য্যকর্ম্মে এবং মন্দিরাদি নির্মাণেও তান্ত্রিকতা দেখাইতেন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যশোরেশ্বরীর মন্দিরের ঈশানকোণে চণ্ডভৈরবের যে মন্দির প্রস্তুত হয়, উহা ত্রিকোণাকৃতি। তিনটি প্রাচীরের মন্দির আমরা আর দেখি নাই। পূজার পর মায়ের নির্ম্মাল্যাদি রাখিবার জন্য মন্দিরের দক্ষিণে ত্রিকোণ করিয়া ইষ্টক গ্রথিত পুষ্পাধার প্রস্তুত করেন। ছাগাদি বলি দিলে, তাহা হইতে রক্ত বহিয়া গিয়া পূৰ্ব্বপার্শ্বে একটি ছোট পুষ্করিণীতে পড়িত, উহার নাম ‘খর্পর পুষ্করিণী’; উহাও ত্রিকোণাকৃতি। প্রতাপের প্রচলিত তাঁহার স্বীয় নামাঙ্কিত মুদ্রাও ত্রিকোণাকৃতি ছিল বলিয়া কথিত আছে। আমরা পরে দেখাইব, প্রতাপ মুসলমানদিগের জন্য একটি মসজিদ ও খৃষ্টানদিগের জন্য একটি গির্জ্জা নির্ম্মাণ করিয়া দেন; মায়ের মন্দির, মসজিদ ও গির্জ্জা, এই তিন জাতির তিনটি উপাসনালয় এমন ভাবে স্থাপিত হইয়াছিল, যেন একটি ত্রিভুজের তিন কোণে পড়ে।
প্রতাপ এই সময় হইতে নিত্য তান্ত্রিক পূজাদি করিতেন। এ বিষয়ে একটি প্রবাদ আছে। গোবরডাঙ্গার নিকট ইছাপুরে রাঘব সিদ্ধান্তবাগীশ নামক একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও নিষ্ঠাবান তান্ত্রিক ছিলেন। গল্প আছে, তিনি নাকি বাটী হইতে ৮ ক্রোশ দূরে গিয়া নিত্য গঙ্গাস্নান করিয়া আসিতেন। তাঁহার কিছু ভূসম্পত্তিও ছিল। এক সময়ে তিনি প্রতাপকে রাজস্ব দিতে অস্বীকৃত হওয়াতেই হউক বা অন্য কোন কারণে প্রতাপের বিরাগ-ভাজন হন। তখন প্রতাপ সসৈন্য আসিয়া বর্ত্তমান গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে যমুনার কূলে ছাউনী করেন। সিদ্ধান্তবাগীশ স্নানান্তে দৈবশক্তিবলে প্রতাপাদিত্যের শিবিরে প্রবেশ করেন এবং প্রতাপের ভৃত্যের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া স্বহস্তে রাজার পূজার আয়োজন করিয়া রাখেন। প্রতাপ সে আয়োজন প্রণালী দেখিয়া চমকিত হন এবং কে করিয়াছে জিজ্ঞাসা করেন। তখন সিদ্ধান্তবাগীশ আত্মপরিচয় দেন। প্রতাপ তাঁহার সহিত আলাপে ও তাঁহার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হইয়া তখনই তাঁহার সহিত সদ্ভাব স্থাপন করেন। তখন রাঘব রাজকে আতিথ্য গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। প্রতাপ তখন উত্তর করেন, তিনি পরের রাজ্যে অন্যের অনুগ্রহণ করেন না। বাস্তবিকই ছাউনী স্থানটি সিদ্ধান্তবাগীশের দখলে ছিল। তখন তিনি উহা তৎক্ষণাৎ দলিল লিখিয়া প্রতাপাদিত্যকে অর্পণ করেন এবং প্রতাপকে সমাদরে অনুদানে অভ্যর্থনা করেন। তদবধি ঐ স্থানটির নাম হয় প্রতাপপুর। গোবরডাঙ্গার সন্নিকটে রেলওয়ে পুলের একটু দক্ষিণদিকে যমুনার কূলে উচ্চভূমিতে প্রতাপপুর এখনও আছে।[৪]
যশোরেশ্বরী দেবী পশ্চিমবাহিনী। এখন চকমিলানো বাড়ীর পূর্ব্বপোতায় মায়ের মন্দির রহিয়াছে। আধুনিক লোকের মুখে প্রবাদ এই, প্রতাপাদিত্যের প্রতি বিমুখী হইয়া দেবী মন্দিরসমেত পশ্চিমবাহিনী হইয়াছিলেন।[৫] ভারত-চন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে আছে :
‘শিলাময়ী নামে, ছিলা তাঁর ধামে, অভয়া যশোরেশ্বরী।
পাপেতে ফিরিয়া, বসিলা রুষিয়া, তাহারে অকৃপা করি।।’
এ কথা বিশ্বাস করিতে পারি না। দেবী প্রতাপের প্রতি বিরক্ত হইয়া কাজের বেলায় বিমুখী হইতে পারেন, কিন্তু শরীরের বেলায় সম্ভবতঃ পূর্ব্ববৎই ছিলেন। এদেশে সাধারণতঃ দক্ষিণমুখী করিয়া দেবতা প্রতিষ্ঠা করা হয়, কিন্তু যশোরেশ্বরীর আবিষ্কারের সময় হইতে তাঁহাকে পশ্চিমমুখী দেখা গিয়াছিল। তাই সাধারণতঃ লোকে যে কৈফিয়ৎ দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিল, কবি তাহা দিয়াছেন। আর সে কবির কাব্য আধুনিক হইলে কি হয়,[৬] যখন কবির ভাষায় আছে, তখন তাহাই সকলে ঐতিহাসিক তত্ত্বের মত ধরিয়া বসিয়াছেন। মা ত বিমুখী বহু লোকের ভাগ্যে হইয়া থাকেন, কিন্তু ফিরিয়া দাঁড়াইবার বা পোতা সমেত মন্দির উল্টাইবার গল্প ত আর কোথায়ও শুনি না। পশ্চিম অঞ্চলে সব দিকে ফিরানো দেবতা-মূর্ত্তি দেখা যায়; আমাদের এই দেশেই মা শুধু এক দিকে ফিরিয়া থাকিতে বাধ্য হন। যাহা হউক, আমাদের বিশ্বাস, পশ্চিমমুখী হইয়াই মাতা আবিষ্কৃত হইয়াছিলেন; সেইভাবে তাঁহার মন্দির চকমিলান বাড়ী, পশ্চিম দিকে তোরণ ও তাহারই সম্মুখে পুষ্করিণী প্রভৃতি হয়। শেষে প্রতাপাদিত্যের পতনের পর, সুন্দরবনের সাময়িক নিমজ্জন বশতঃ মন্দিরের পার্শ্ববর্ত্তী স্থান জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া শ্বাপদসঙ্কুল হয়। কিছুদিন পূজা এক প্রকার বন্ধই ছিল। পরে বর্তমান অধিকারীদিগের পূর্ব্বপুরুষ আসিয়া পুনরায় পূজার ব্যবস্থা করেন। তদ্বংশীয়দিগের সময়ে মন্দিরাদির সংস্কার ও নূতন গৃহাদি নিৰ্ম্মিত হইয়াছে। সে বিবরণ আমরা পরে দিব। এই দ্বিতীয় বার আবির্ভাবের পর দেবীর পশ্চিমবাহিনী মূর্তি ও দেশের পতন অবস্থা, এই উভয় মনে করিয়া লোকে দেবীর মুখ ফিরাইবার প্রবাদ গড়িয়াছিল। আর যে দোষের জন্য দেবী মুখ ফিরাইলেন, তাহাও প্রতাপের নিজের দোষ নহে; আমরা পরে দেখাইব যে পরের জন্য কল্পিত গল্প প্রতাপের স্কন্ধে আরোপিত হইয়াছে।[৭]
মায়ের বাড়ীর প্রকৃত তোরণ পশ্চিমদিকে হইলেও উত্তরদিকে সদর দরজা ছিল; অদূরবর্ত্তী বারদুয়ারী গৃহে যখন প্রতাপ দরবারে বসিতেন, তখন সেখান হইতে মায়ের বাড়ীর সদর দ্বার দেখিবেন বলিয়াই এই দ্বার নির্ম্মিত হইয়াছিল। মাকে যদি স্থানচ্যুত করাই যাইত, তবে দক্ষিণ পোতায় মন্দির করিয়া উত্তর-বাহিনী মাকে দেখা চলিত। কিন্তু মা যে অচলা; তিনি পশ্চিমবাহিনীই আছেন এবং এখনও সদর দরজা উত্তরদিকে রহিয়াছে। প্রতাপাদিত্যের পশ্চিমবাহিনী কালী ছিলেন বলিয়া একটি জনশ্রুতিই আছে।
যশোরেশ্বরী দেবীকে এইভাবে পশ্চিমমুখী অবস্থায় পাইবার পর, প্রতাপাদিত্য যেখানে যখন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, প্রায় সর্ব্বত্রই পশ্চিমমুখ করিয়া দেবতা প্রতিষ্ঠা ও মন্দির নির্মাণ করেন। সুন্দরবনের ২৩৩ নং লাটে, শিবসা নদীর সঙ্গমের সন্নিকটে, সেখের টেক নামক স্থানে কালীর খালের কূলে, আমরা প্রতাপাদিত্যের যে কালী-মন্দিরের বিবরণ প্রথম খণ্ডে দিয়াছি, তাহাও পশ্চিমদ্বারী। সে মন্দির এখনও অনেকটা অভগ্ন অবস্থায় বৰ্ত্তমান আছে এবং তাহা দেখিবার যোগ্য।[৮] এ কথা অনেকেই জানেন যে, প্রতাপাদিত্য কাশীধামে চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরের নিকটবর্ত্তী গঙ্গার ঘাট পাষাণনির্ম্মিত করিয়া দেন। সে ঘাট এখনও আছে এবং প্রতাপাদিত্যের মহিমা ঘোষণা করিতেছে। চৌষট্টি যোগিনী কাশীক্ষেত্রের আদি দেবতা বলিয়া বিদিত। প্ৰতাপ শুধু তাঁহার ঘাট বাঁধিয়া দেন নাই, তিনি পরে সেই দেবী-মন্দিরের ঠিক সম্মুখে একটি পশ্চিমদ্বারী গৃহে পশ্চিমমুখী করিয়া ভদ্রকালীর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সে দেবীমূর্ত্তি এখনও আছেন। শুধু দেবীমূর্ত্তির বেলায় নহে, তাঁহার সময়ে যেখানে যেখানে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, সব মন্দিরগুলিই বোধ হয় পশ্চিমদ্বারী হইয়াছিল। গোপালপুরের যে প্রসিদ্ধ গোবিন্দদেব বিগ্রহের কথা আমরা পরে বলিব, সে মন্দিরও পশ্চিমদ্বারী। বেদকাশীতে যে শিব মন্দিরের রাশীকৃত ইষ্টক ও প্রস্তর স্তূপ দেখিয়াছিলাম, তাহাও পশ্চিমদ্বারী বলিয়া অনুমান করিয়াছিলাম।
সাধারণ গল্পগুলি হইতে শুনি, দেবী বিমুখী হইয়া পশ্চিমবাহিনী হইবার অল্পকাল পরে প্রতাপাদিত্যের পতন হয়। কিন্তু উল্লিখিত ভদ্রকালীর মূর্ত্তি বা গোবিন্দদেব বিগ্রহাদির প্রতিষ্ঠা যে পতনের বহু পূর্ব্বে হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সুতরাং আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি, মাতা যশোরেশ্বরী দেবী যে স্থানে যে ভাবে আবিষ্কৃত হইয়াছিলেন, ঠিক তেমন ভাবেই আছেন। তিনি বিরূপা হইলেই যে দেহরূপের ব্যতিক্রম হওয়া দরকার, তাহা নহে, অন্য নানাভাবে তিনি পাপীর শাস্তি দিয়া থাকেন। প্রতাপাদিত্য এই ভাগ্যদেবতা পাইয়া, যতদূর সম্ভব সুন্দরভাবে, তাহার বসন – ভূষণ ও পূজায়োজনের সুব্যবস্থা করিয়াছিলেন। সে রত্নালঙ্কারের কিছুই এখন নাই।[১০]
মাতা যশোরেশ্বরী ভীষণা কালীমূর্তি। তাঁহার মুখমণ্ডল মাত্র সম্বল। হস্ত পদাদি কিছুই নাই।[১১] কণ্ঠ হইতে সমস্ত নিম্নাংশ প্রলম্বিত রক্তবস্ত্রের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত থাকে। বাহির হইতে ঐ অংশ প্রকাণ্ড প্রস্তরপিণ্ডবৎ বোধ হয়। অধিকারিগণ ভিন্ন অন্য কাহারও সে অংশ দেখিবার সাধ্য নাই; তাঁহারাও বস্ত্র পরিবর্তনের সময় ভিন্ন অন্য সময়ে দেখিতে পান না। এ সম্বন্ধে বিশ্বস্তসূত্রে যে বিবরণ পাইয়াছি, তাহা হইতে উদ্ধৃত করিতেছি :
শ্রী শ্রী মাতা যশোরেশ্বরী দেবীর শ্রীমূর্তি কেবল প্রস্তরময় মুখমণ্ডল মাত্র জানিবেন। কণ্ঠের নিম্নাংশে হস্তপদাদি আর কিছুই নাই। একটি প্রস্তরময় প্রায় সমচতুষ্কোণ বেদীর উপর এই কৃষ্ণপ্রস্তরের নির্ম্মিত মুখমণ্ডলটি দৃঢ়রূপে বসান; ঠিক যেন জগজ্জননীরূপে বসিয়া রহিয়াছেন বলিয়া সাধারণের ভ্রম হয়। প্রথমতঃ ঐ সমচতুষ্কোণ উৎকৃষ্ট প্রস্তর নির্ম্মিত বেদিটি প্রায় এক হস্ত পৰ্য্যন্ত চতুৰ্দ্দিকে উচ্চ হইয়া তথা হইতে ক্রমশঃ সরু হইয়া কণ্ঠদেশে গিয়া মিশিয়াছে। কিন্তু এই দৃঢ় প্রস্তরাবরণের মধ্যে যে কণ্ঠের নিম্নভাগ কি প্রকার, তাহা দেখিবার বা জানিবার কোনও উপায় নাই; ঐ প্রস্তরাবরণ অতিশয় দৃঢ়রূপে বেমালুম জোড়া, তাহা খোলা বা ভাঙ্গা সম্পূর্ণ অসাধ্য! দেখিলে অনুমান হয় যে, মুখমণ্ডল আকারে যেরূপ বড় সেই অনুযায়ী যদি শ্রীদেহ ও হস্তপদাদি থাকে, তবে তাহা এত অনুচ্চ হইতেই পারে না। সুতরাং নিশ্চয়ই মৃত্তিকা মধ্যে (যদি হস্তপদাদি থাকে) কতকাংশ প্রোথিত আছে। মায়ের পশ্চিমবাহিনী হওয়া, হয় কবি কল্পনা, আর না হয় প্রথমে দক্ষিণবাহিনী ছিলেন, পরে মানসিংহের যুদ্ধ জয়ের পর হয়তঃ ঐ মূৰ্ত্তি উঠাইয়া লওয়ার চেষ্টা করায় হস্তপদাদির কোন হানি হইতে পারে, এজন্য কিংবা সেবাইতগণের বিনয়ানুরোধে লইয়া যাওয়া আর আবশ্যক মনে করেন নাই, তৎপরে কণ্ঠের নিম্নাংশ ঐ কঠিন প্রস্তরাবরণে চিরকালের মত আচ্ছাদিত করিয়া প্রতাপাদিত্যের প্রতি বিমুখী হওয়ার চিহ্নস্বরূপ পশ্চিমবাহিনী করিয়া বসান হইয়াছিল।
আমরাও পূর্ব্বে বলিয়াছি মায়ের পশ্চিমবাহিনী হওয়া কবিকল্পনা মাত্র। এমন কি বিমুখী হওয়ার কথাটাই প্রতাপের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত নহে। মানসিংহ এতবড় বিরাট প্রস্তরমূর্ত্তি লইয়া যাইবার কল্পনা করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। মায়ের মূর্তি পূর্ব্বে কেমন ছিল বা কোন পরিবর্ত্তন হইয়াছে কিনা, কেহই তাহার সাক্ষ্য দিতে পারেন না। আমার বোধ হয়, মা যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন। অনেক স্থানেই পীঠমূর্ত্তির মুখমণ্ডল বা দেহাংশবিশেষমাত্র সম্বল থাকে। যশোহরেও তাহাই। মায়ের ভয়ঙ্করী মূর্ত্তির অন্তরালে করুণাময়ীর প্রতিভা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে।
পাদটীকা :
১. ১৯শ এবং ৩৩শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য — শি মি
২. মাতা যশোরেশ্বরী সত্যযুগ হইতে বৰ্ত্তমান আছেন। সে প্রমাণ আমরা প্রথম খণ্ডে দিয়াছি। এ মূর্ত্তির নিৰ্ম্মাণপ্রণালী আদি হিন্দুযুগের পদ্ধতির অনুযায়ী। এজন্য আমরা ইহার ভাস্কর্য্যের পরিচয় প্ৰথম খণ্ডে (১০০-১১৩ পৃ) দিয়াছি। এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে দেবীর পূর্ব্বতন মন্দিরাদি সম্বন্ধে কিছু পুনরুক্তি না করিলে সঙ্গতি রক্ষা হয় না।
৩. প্রথম খণ্ড, ১৪৬-১৬২ পৃ। আমার গৃহীত ফটো দেখিয়া মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও বন্ধুবর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয় প্রভৃতি বিশেষজ্ঞগণ প্রতিমার ভাব ও ভাস্কর্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং উহা যে গঙ্গামূর্ত্তি সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বঙ্গে যে একটি বিশিষ্ট ভাস্কর্য্য প্রণালী ছিল এ মূর্ত্তি তাহারই প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
৪. প্রতাপপুর এখনও সুন্দর স্থান। উহার পূর্ব্বদিকে কণকণার বাওড়, দক্ষিণদিকে রত্নখালি ও পশ্চিমে ও দক্ষিণে যমুনা। প্রতাপপুরে এক সময়ে নীলকুঠি বসিয়াছিল। উহা এক্ষণে কুশদহের জমিদার মণীন্দ্রনাথ বসু মল্লিক মহাশয়ের অধীন। রাঘব সিদ্ধান্তবাগীশ ইছাপুরের বড় চৌধুরী; রাঘবের পৌত্র রঘুনাথ কৃতী পুরুষ ছিলেন; তাঁহারই সময়ে ইছাপুরে বিখ্যাত নবরত্ন মঠমন্দির ও অন্যান্য সৌধাবলী নিৰ্ম্মিত হয়। স্থানান্তরে মঠমন্দিরের পরিচয় দিব।—’খাটুয়ার ইতিহাস’, ১৪৭-৯ পৃ। এই সিদ্ধান্তবাগীশ প্রতাপের পতনের পর মানসিংহের সভায় সমাদরে সৎকৃত হন। তদুপলক্ষে রচিত শ্লোকের অর্দ্ধাংশ এই :
‘সংখ্যাবান সাংখ্যতকাগমনিগম বিচারেষু-বিশ্বপ্রকাশি।
সুশ্ৰীমান মানসিংহ প্রভৃতি নৃপতিভিঃ সৎকৃতোহয়ং সভায়াং।।
—বঙ্গীয় সমাজ, ১৮৪ পৃ।
৫. ‘…she caused the temple he had built towards the West to be changed from its orignal position on the South’—Smyth, Ralph, Report of 24-Pergannahs; নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৩৭৮ পৃ।
৬. অন্নদামঙ্গলের প্রথম সংস্করণ কলিকাতায় ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে ছাপা হয়। অর্থাৎ প্রতাপাদিত্যের পতনের অন্ততঃ ১৬০ বৎসর পর।
৭. বিক্রমপুরের কেদার রায়ের ইষ্টদেবীর নাম শিলাময়ী; মানসিংহ তাঁহাকে লইয়া যান। এখনও তিনি অম্বরে আছেন, তাঁহার নাম সল্লা দেবী বা শিলা দেবী। সেই দেবী কন্যারূপে কেদার রায়কে ছলনা করিলে তিনি তাহাকে তাড়াইয়া দেন, এজন্য শিলাময়ী কেদারের প্রতি বিমুখী হন। প্রতাপের ভাগ্যদোষে কবির লেখনী সেই গল্প আনিয়া তাঁহার স্কন্ধে চাপাইয়াছে। এ বিষয় আমরা পরে বিশেষ বিচার করিব।
৮. বর্তমান গ্রন্থের প্রথম খণ্ড, ৪৯-৫০ পৃঃ। মন্দিরের বাহিরের মাপ প্রতি দিকে ২১-৩ ́ ভিত্তি ৫-৩ এবং ভিতরের উচ্চতা ২৫-র্ড বাহিরের ইটে বিশেষতঃ পশ্চিম দিকে সুন্দর কারুকার্য্য ছিল। জঙ্গলের মধ্যে এমন সুন্দর মন্দির আর নাই। আমরা উহার সংবাদ ও ছবি প্রকাশিত করিয়াছি।
৯. শাস্ত্রী মহাশয় বলেন, প্রতাপাদিত্য আগ্রা হইতে প্রত্যাবর্তনকালে কাশীধামে আসিয়া চৌষট্টি যোগিনীর ঘাট বাঁধিয়া দেন। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। কারণ তিনি এখনও বৈষ্ণব, এবং তান্ত্রিকমতে দীক্ষিত হন নাই। বহুলোকের সুবিধার জন্য একটি প্রসিদ্ধ মন্দিরের সন্নিকটে ঘাট বাঁধিয়া দেওয়া সম্ভবপর হইলেও, তখন যে ভদ্রকালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন নাই, তাহা নিশ্চিত। যশোরেশ্বরীর আবির্ভাবের পর তিনি নিজে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া এই পশ্চিমমুখী কালীমূর্ত্তি স্থাপন করেন, ইহাই সম্ভবপর।
১০. এখন থাকিবার মধ্যে স্বর্ণজিহ্বা ও মুকুটে সামান্য সৌন্দর্য্য আছে। নকীপুরের জমিদার হরিচরণ চৌধুরী মহোদয় যে মুণ্ডমালা গড়িয়া দিয়াছিলেন, তাহার মূল্য বড় বেশী নহে এবং তাহা চৌধুরী মহাশয়ের দানের মত হয় নাই। অবশ্য মূর্তির গায়ে অলঙ্কার দিবার বেশী স্থান নাই, সবই প্রায় বস্ত্রে ঢাকা। কিন্তু মাকে দিবার শক্তি বা ইচ্ছা থাকিলে, তাহার সদ্ব্যবহার করিবার পন্থা এখনও আছে। মায়ের পূজার জন্য প্রতাপের আমলের একজোড়া রৌপ্যনির্ম্মিত ভারী কোশাকুশি ও রৌপ্যকুণ্ড ছিল; কালক্রমে কোন এক ব্যক্তি কর্তৃক উহা স্থানান্তরিত হইয়া টাকীতে হরিচরণ দাসের নিকট বন্ধক পড়িয়াছিল। টাকীর স্বনামধন্য জমিদার রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী মহাশয় উহা ১৩০ টাকা ব্যয়ে উদ্ধার করিয়া দিয়াছেন। কোশার উপর ‘শ্রীকালী’ লেখা আছে। মন্দিরে প্রাচীনকালের একটি তাম্র ঘট আছে, উহা অত্যন্ত ভারী। কেহ কেহ অন্য ধাতু নির্ম্মিত বলিয়া সন্দেহ করেন। আমরা ১ খণ্ডে গঙ্গামূর্তির ছবির সঙ্গে উহার ছবি দিয়াছি।
১১. ‘বিশ্বকোষে’ (১ম, ৪৯৭ পৃ) কিন্তু যশোরেশ্বরীর এক অদ্ভুত ছবি দেওয়া হইয়াছে। দেবীকে অষ্টভুজা মহিষমর্দ্দিনী করা হইয়াছে। যশোরেশ্বরী দেবী পূৰ্ব্ববৎ এখনও আছেন, যথাস্থানেই আছেন, তাঁহার কিন্তু হস্তপদ নাই। না দেখিয়া শুনিয়া বিশ্বকোষে’র মত প্রামাণিক অভিধানে কাল্পনিক ছবি প্রকাশিত করা যে কত অন্যায় এবং তাহাতে গ্রন্থের মূল্য কত কমে, তাহা সহজেই অনুমেয়। গ্রন্থকারগণ ধরিয়া লইয়াছেন, মানসিংহ যশোরেশ্বরী দেবী লইয়া গিয়াছিলেন, সে মূৰ্ত্তি অষ্টভূজা, সুতরাং একটি অষ্টভুজা মূৰ্ত্তিই মুদ্রিত হইয়াছে। কিন্তু অষ্টভুজা মহিষমৰ্দ্দিনী মূৰ্ত্তি— দুর্গা মূর্ত্তি এবং প্রতাপাদিত্যের আরাধ্য দেবী আদ্যা বা কালীমূর্তি, সে হিসাব করা হয় নাই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন