সতীশচন্দ্র মিত্র
কৃষ্ণণগর রাজবংশ॥ ভবানন্দ মজুমদার এই প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইনি শাণ্ডিল্যগোত্রজ ভট্টনারায়ণের ২০শ অধস্তন বংশধর এবং কেশরকুনী গাঁঞিভুক্ত সিদ্ধ শ্রোত্রিয়। ১৬০৬ খৃষ্টাব্দে মানসিংহের নিকট হইতে ১৪ পরগণার সনন্দ প্রাপ্তির পর, ভবানন্দ বাগোয়ান- বল্লভপুর হইতে মাটিয়ারিতে প্রাসাদতুল্য আবাসবাটি নির্ম্মাণ করিয়া বাস করেন।[১] মৃত্যুকালে তিনি মধ্যম পুত্র গোপালকে উত্তরাধিকারী করিয়া যান। গোপালের সময় শান্তিপুর, শাহাপুর, ভালুকা, কুশদহ, উখড়া প্রভৃতি কয়েকটি নূতন পরগণা অর্জিত হয়। গোপালের পুত্র রাজা রাঘব মাটিয়ারি হইতে জলঙ্গী কূলবর্ত্তী রেউই নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা রাঘবের পুত্র রাজা রুদ্ররায় রেউই নাম পরিবর্তন করিয়া কৃষ্ণনগর করেন, কারণ ঐস্থানে বহু সংখ্যক কৃষ্ণোপাসক গোপের বাস ছিল। রুদ্ররায়ের সময় জমিদারী হইতে প্রভূত আয় হইত। তিনি বাদশাহকে ২০ লক্ষ টাকা কর দিতেন। তাঁহারই সময়ে কাঙ্গড়া শোভিত বর্ত্তমান রাজপ্রাসাদ, সুন্দর চক ও নহবৎখানা প্রস্তুত হয়। রুদ্ররায় প্রসিদ্ধ সিদ্ধশ্রোত্রিয় কাঞ্জারী বংশীয় কুমুদ ন্যায়ালঙ্কারের পুত্র রঘুনাথ সিদ্ধান্তবাগীশকে ইষ্টগুরু নির্ব্বাচন করেন। রঘুনাথের পূর্ব্বনিবাস ছিল যশোহরের অন্তর্গত সারলগ্রামে।[২] সারলের কাঞ্জারীগণ পাণ্ডিত্য গৌরবে ও ধর্মসাধনায় বঙ্গের সর্ব্বত্র সম্মানিত। রুদ্ররায়ের পর তৎপুত্র রামজীবন ও রামকৃষ্ণ ক্রমান্বয়ে রাজত্ব করেন। রামকৃষ্ণই সভাসিংহের বিদ্রোহ জন্য বর্দ্ধমান রাজকুমার জগত্রায়কে আশ্রয় দেন। ইহার পর রামজীবনের পুত্র রঘুরাম কিছুকাল রাজত্ব করিয়া পরলোকগত হইলে, তৎপুত্র সুবিখ্যাত কৃষ্ণচন্দ্ৰ রাজ্যলাভ করেন (১৭২৮), ইনি দিল্লীর বাদশাহের নিকট হইতে ‘রাজরাজেন্দ্র বাহাদুর’ উপাধি পান। ভবানন্দের সময় হইতে তাঁহার রাজ্য ক্রমশঃ বাড়িতে বাড়িতে কৃষ্ণচন্দ্রের সময় সর্ব্বাপেক্ষা বিস্তৃতি লাভ করে। এই সময় রাজ্যের উত্তর সীমা মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ সীমা গঙ্গাসাগর, পশ্চিম সীমা ভাগীরথী নদী এবং পূর্ব্ব সীমা বলেশ্বরের পারে ধুলিয়াপুর।[৩] সে রাজ্যের পরিমাণ ফল ৩৮৫০ বর্গ-ক্রোশ। যশোহর-খুলনার অধিকাংশ উহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর (১৭৮২), তৎপুত্র শিবচন্দ্রের সময় হইতে নদীয়া-রাজ্য ক্রমশঃ সংকীর্ণ হইয়া শিবপৌত্র গিরিশচন্দ্রের সময়ে জমিদারীর পরিমাণ ৮৪ পরগণা স্থলে ৫/৭ খানি পরগণা দাঁড়ায়। গিরিশচন্দ্রের পুত্রসন্তান ছিল না, শ্রীশচন্দ্র তাঁহার দত্তক পুত্র। তিনি ইংরাজ-গবর্নমেন্টের নিকট হইতে ‘মহারাজ’ উপাধি লাভ করেন। ১৮/১৯ বৎসর রাজত্বের পর তাঁহার মৃত্যু হইলে, তৎপুত্র রাজা সতীশচন্দ্র কিছুকাল রাজত্ব করেন। ইনি পানাসক্ত, অকৰ্ম্মণ্য শাসক কিন্তু তাঁহার দত্তক পুত্র ক্ষিতীশচন্দ্র বুদ্ধিমান ও সুশাসক বলিয়া খ্যাত। তিনি দীর্ঘকাল রাজতক্তে থাকিয়া পরলোকগত হইলে, তৎপুত্র সৰ্ব্বজনপ্রিয় কৃতবিদ্যা মহারাজ ক্ষৌণীশচন্দ্র রাজ্যলাভ করেন (১৯১১)। দিল্লী- দরবার হইতে তাঁহাকে ‘মহারাজ’ উপাধি প্ৰদত্ত হয়।
বাঙ্গালার ইতিহাসের সহিত এই রাজবংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ভবানন্দ যেমন হিন্দুর নিকট হইতে মোগলের হাতে স্বদেশকে অর্পণ করিবার সহায়তা করিয়াছিলেন, তাঁহার অধস্তন বংশধর কৃষ্ণচন্দ্রও তেমনি, মোগলের হস্ত হইতে রাজ্য কাড়িয়া লইয়া, বৈদেশিক ইংরাজকে দিবার জন্য যে ষড়যন্ত্র হয়, তাহার অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন। ভবানন্দের কার্য্যের পুরস্কার তাঁহার ফরমাণে পাওয়া যায়, তাঁহার ১৪ পরগণা লাভের এবং কানুনগো পদ প্রাপ্তির সনন্দ এখনও কৃষ্ণনগর রাজবাটীতে জীর্ণ অবস্থায় রক্ষিত হইতেছে; আর চক্রান্তকারী কৃষ্ণচন্দ্রের পুরস্কার চিহ্ন কৃষ্ণনগর রাজবাটীতে সদর্পে প্রদর্শিত হইতেছে। সিংহদ্বার দিয়া প্রবেশ করিবামাত্র দেখা যায়, সম্মুখে একটি প্রকাণ্ড পুরাতন কামান সযত্নে রক্ষিত হইতেছে; উহার পার্শ্বে লেখা আছে :
‘Plassey Gun Presented by Lord Clive, 1757’. দেশদ্রোহী ভবানন্দ যে রাজ্য পত্তন করেন, তাঁহার উপযুক্ত বংশধর কৃষ্ণচন্দ্রের সময় তাহার চরমোন্নতি হয়। তদবধি, কি জানি কিসের ফলে, ক্রমেই সে রাজ্যের পতন হইতেছে; কোথায় পরিণতি, কে জানে? অর্জ্জন করিবার বেলায় অতি কম রাজ্যই খাঁটি ধর্ম্ম উপায়ে উপার্জ্জিত হয়, শুধু নদীয়া রাজ্যের কথা নহে। কিন্তু আনন্দের বিষয়, এই রাজ্যের রাজ্যাধিকারিগণ অধিকাংশেই অজস্র দানে, ধর্মানুষ্ঠানে এবং শিল্প- সাহিত্যের সমুন্নতি কল্পে মুক্তহস্ত ছিলেন। তন্মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য রাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁহার সুন্দর সুস্পষ্ট স্বাক্ষর সম্বলিত দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর ও মহাত্রাণের অসংখ্য সনন্দ, শুধু নদীয়া জেলায় নহে, যশোহর-খুলনার বহুস্থানে বহুগৃহে এখনও সযত্নে রক্ষিত হইতেছে।[৪] আমি স্বচক্ষে এরূপ বহু দলিল দেখিয়াছি। শান্তিপুরের সূক্ষ্মবস্ত্র[৫] এবং কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল দেশের মধ্যে অতুলনীয়। ভারতচন্দ্রের কবিতা, রামপ্রসাদের গান ও রসসাগরের সরসভাষা বঙ্গে অসামান্য প্রসারলাভ করিয়াছে। শিল্প-সাহিত্যে, পাণ্ডিত্যে, স্থাপত্যে এবং এমন কি, কথোপকথনের ভাষার সুরভঙ্গিতে, নদীয়া এখন পর্য্যন্ত যশোহর-খুলনা প্রভৃতি জেলার আদর্শ স্থানীয় হইয়াছে।
বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী বংশ। মানসিংহের আক্রমণের পর তাঁহার অনুগৃহীত ‘তিন মজুমদারের’ বঙ্গ ভাগ করিয়া লওয়ার একটা গল্প আছে। এই তিন মজুমদার—ভবানন্দ, জয়ানন্দ ও লক্ষ্মীকান্ত। ভবানন্দ মজুমদারের কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি; জয়ানন্দ মজুমদার হুগলী জেলার বাঁশবাড়িয়ার ‘মহাশয়’ উপাধিধারী রাজবংশের আদিপুরুষ, তাঁহার সহিত আমাদের ইতিহাসের বিশেষ সম্বন্ধ নাই। লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার প্রতাপাদিত্যের দেওয়ানী বিভাগের প্রধান কর্মচারী ছিলেন, সে পরিচয় পূর্ব্বে দিয়াছি (২১শ পরিচ্ছেদ)। ইনি সাবর্ণ গোত্রজ কনৌজাগত বেদগর্ভের বংশে ১৮শ পুরুষ। হুগলী জেলার উত্তরাংশে গোঘাটা-গোপালপুরে লক্ষ্মীকান্তের পিতা কামদেব গঙ্গোপাধ্যায় (বা ঘটকদিগের ভাষায় ‘জীয়ো’ গাঙ্গুলী) বাস করিতেন। একমাত্র পত্নী ভিন্ন তাঁহার সংসারে আর কেহ ছিল না। গার্হস্থ্য আশ্রমে থাকিয়াও তিনি সন্ন্যাসীর মত অনাসক্ত ছিলেন এবং সর্ব্বদা তীর্থভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেন। কথিত আছে, তিনি পত্নী পদ্মাবতীকে সঙ্গে লইয়া ব্রহ্মচারী বেশে বর্ত্তমান কালীঘাটের সন্নিকটে[৬] এক আশ্রম নির্ম্মাণ করিয়া তথায় ইষ্টসাধনায় নিযুক্ত ছিলেন। এমন সময়ে রুগণ শয্যায় শায়িত তৎপত্নী পদ্মাবতী তাঁহাদের একমাত্র সন্তান—এক সুলক্ষণযুক্ত পুত্র প্রসব করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। ব্রহ্মচারী পত্নীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন করিয়া ভাবিতেছিলেন, তিনি সংসার ছাড়িবার পথ খুঁজেন, সংসার যে তাঁহাকে ছাড়ে না, তিনি এখন কেমন করিয়া এই সদ্যঃপ্রসূত সন্তানের লালন করিবেন। এমন সময়ে দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে একটি টিকটিকির ডিম্ব উপর হইতে পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গেল, উহা হইতে লালাজড়িত এক শাবক বাহির হইয়া নিশ্চল হইয়া রহিল; এমন সময় কোথা হইতে এক মক্ষিকা আসিয়া সেই লালা ভক্ষণ করিতে লাগিল; অমনি শাবকটি মুক্ত হইবামাত্র মক্ষিকাটিকে ধরিয়া উদরসাৎ করিয়া ফেলিল। এ দৃশ্য দেখিয়া বৈরাগ্য-বিহ্বল কামদেবের দিব্যজ্ঞান জন্মিল; তখন ‘নারদপঞ্চরাত্র’ নামক প্রসিদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থের একটি শ্লোক তাঁহার মনে পড়িয়া গেল :
‘কাকঃ কৃষ্ণীকৃতো যেন হংসশ্চ ধবলীকৃতঃ।
ময়ূরশ্চিত্রিতো যেন, তেন রক্ষা ভবিষ্যতি।।’
অর্থাৎ যিনি কাককে কৃষ্ণবর্ণ, হংসকে ধবল এবং ময়ূরকে নানাবর্ণে চিত্রিত করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনিই রক্ষা করিবেন। প্রবাদ এই, ব্রহ্মচারী সদ্যঃপ্রসূত সন্তানের রক্ষার ভার শ্রীভগবানের উপর সমর্পণ করিলেন, একটু কাগজে উক্ত শ্লোকটি লিখিয়া নিদ্রিত শিশুর বুকের উপর রাখিলেন, এবং সজল নেত্রে উত্তরীয় মাত্র সম্বল করিয়া গৃহত্যাগ করিলেন। তিনি কাশীধামে গিয়া দণ্ডী সন্ন্যাসী হইয়াছিলেন। মানসিংহ যখন সসৈন্যে বঙ্গে আসিবার পথে কাশীধামে কয়েকদিন ছিলেন, তখন দৈবাৎ একদা তেজঃপ্ৰদীপ্ত কামদেব ব্রহ্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ হয় এবং পরে তিনি তাঁহার নিকট শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হন। গুরুদেবের সহিত কথা প্রসঙ্গে তিনি বঙ্গদেশ সম্বন্ধে অনেক সংবাদ পান এবং গুরুর অনুরোধে তাঁহার পুত্রের সন্ধান করিবার জন্য স্বীকৃত হন।
এদিকে লক্ষ্মীকান্ত প্রতিবেশীদিগের যত্নে প্রতিপালিত হইয়া বয়স্ক হইলে, বসন্ত রায়ের সহিত কালীঘাটের সম্বন্ধসূত্রে প্রতাপাদিত্যের রাজসরকারে প্রবেশ করেন। ১৫৭০ খৃঃ অব্দে লক্ষ্মীকান্তের জন্ম হয়[৮], তাহা হইলে মানসিংহের আক্রমণ কালে তাঁহার বয়স ৩৩ বৎসর। তিনি ৮/১০ বৎসর পূর্ব্বে রাজসরকারে কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়া ক্ৰমে অসামান্য প্রতিভাবলে দেওয়ানের পদ লাভ করেন। মানসিংহের সহিত গুপ্তভাবে পরিচিত হইয়া তিনি প্রতাপের সহিত যুদ্ধকালে সিংহরাজাকে কি সাহায্য করিয়াছিলেন তাহা জানিবার উপায় নাই। তবে কার্যক্ষেত্রে দেখিতে পাই, প্রতাপের পতনের পর লক্ষ্মীকান্ত একজন প্রধান ভূস্বামী হন। মানসিংহ তাঁহাকে জাহাঙ্গীর বাদশাহের নিকট হইতে মাগুরা, খাসপুর, কলিকাতা, পাইকান ও আনোয়ারপুর এই পাঁচ পরগণা এবং হাতিয়াগড় পরগণার কতকাংশের সনন্দ আনিয়া দেন।[৯] এ সনন্দ ১৬১০ খৃঃ অব্দের পূর্ব্বে প্রদত্ত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। সনন্দ পাইলেও সমস্ত জমিদারী স্ববলে আনিতে প্রায় দুইপুরুষ লাগিয়াছিল। লক্ষ্মীকান্ত গোপালপুরে বাস করেন; তৎপুত্র গৌরহরি নিমতা-বিরাটি বাসস্থান নির্দ্দেশ করেন। তাঁহার পৌত্র কেশবচন্দ্র মজুমদার মুর্শিদকুলি খাঁর সময় বাঙ্গালার দক্ষিণ চাকলার রাজস্ব আদায়ের কর্মচারী (জমিদার) ছিলেন এবং রায়চৌধুরী উপাধি পান। জমিদারীর সুবন্দোবস্তের জন্য তিনি উহার কেন্দ্রস্থলে বড়িশায় আসিয়া বাস করেন। তদবধি এই বংশ বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী নামে খ্যাত হইয়াছে। কেশবের পুত্র শিবদেব বিখ্যাত ব্যক্তি; তিনি অত্যন্ত দানশীল, সদাশয় ও ধৰ্ম্মনিষ্ঠ। যে কেহ তাঁহার নিকট প্রার্থী হইলে, কখনও প্রত্যাখ্যাত হইত না। এইরূপে তিনি সকলের সন্তোষ বিধান করিয়া সন্তোষ রায় নামে সুপরিচিত হন। তিনি চারিমেলের বিশিষ্ট কুলীন ব্রাহ্মণদিগকে ভূসম্পত্তি দিয়া বড়িশায় বসতি করান, এবং কলিকাতা অঞ্চলে তিনিই সমাজপতি ছিলেন। কথিত আছে, তিনি লক্ষ বিঘা জমি দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর দিয়াছিলেন। পূর্ব্বে বলিয়াছি (৮ম পরিচ্ছেদ) বসন্ত রায় কালীঘাটে মায়ের জন্য একটি ক্ষুদ্র মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন, সন্তোষ রায় শেষ জীবনের ঐ মন্দির ভাঙ্গিয়া বর্ত্তমান বিরাট মন্দিরের কার্য্যারম্ভ করেন এবং তাঁহার মৃত্যুর কয়েক বৎসর পরে উহার কার্য্য শেষ হয় (১৮০৯)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আওরঙ্গজেবের পৌত্র বঙ্গাধিপ আজিম উশ্বানকে ১৬০০০ টাকা নজর দিয়া যে আদেশ পান, তদনুসারে সাবর্ণ- চৌধুরীবংশীয় রামচাঁদ, মনোহর ও রামভদ্র রায় চৌধুরীর নিকট হইতে কলিকাতা ক্রয় করেন। এই বংশীয়গণ এক্ষণে একপ্রকার হীনভাবে কলিকাতার নিকটবর্ত্তী বড়িশা গ্রামে বাস করিতেছেন।
শঙ্কর চক্রবর্ত্তীর বংশ ॥ প্রতাপাদিত্যের মহামন্ত্রী ও সুহৃদ্বর শঙ্কর কাশ্যপগোত্রীয় দক্ষ হইতে ১৮শ পুরুষ। দক্ষ হইতে ১১শ ধনঞ্জয়ের বংশ বলিয়া ইহাদিগকে ‘ধনের চাটুতি’ এবং ধনঞ্জয়ের বৃদ্ধ প্রপৌত্র দেবাই-এর ধারা বলিয়া ইহাদিগকে ‘দেবাই গোষ্ঠী’ বলে। দেবীবরের বিভাগ অনুসারে ইহারা পণ্ডিতরত্ন মেল। দক্ষ হইতে ধারা এইরূপ : ১ দক্ষ- সুলোচন— বাসুদেব— মহাদেব— মহানন্দ— সামন্ত— লৌকিক— অরবিন্দ (বল্লালসেনের প্রতিষ্ঠিত কুলীন),— তৎসুত আহিত— দ্যাকর—১১ ধনঞ্জয়— রঘুপতি— সিদ্ধেশ্বর— সর্ব্বানন্দ- ১৫ দেবাই— ভবানীদাস— ১৭ গোপাল। দেবাই বা দেবনাথ চট্টের পৌত্র গোপাল চক্রবর্ত্তী বারাসাতে বাস করিতেন। তাঁহার ছয়টি পুত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, তন্মধ্যে শঙ্কর সর্ব্বজ্যেষ্ঠ শঙ্কর যে নিতান্ত নিরাশ্রয় ব্রাহ্মণ যুবকের মত যশোহরে গিয়াছিলেন, এমন বোধ হয় না। পাঠানের পতন ও মোগলের উত্থান এই সন্ধিকালে দেশের সর্ব্বত্র যখন অরাজকতা উপস্থিত হয়, তখন তিনি স্বদেশের স্বাধীনতার মন্ত্রণা লইয়া প্রতাপাদিত্যের সহচর হন এবং পরে তাঁহাকে উদ্রিক্ত করিয়া তুলেন। মানসিংহের সহিত যুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের পরাজয় কালে শঙ্কর বন্দী হন। পরে মানসিংহ যখন প্রতাপের সহিত সন্ধি ও সদ্ভাব স্থাপন করেন, তখন শঙ্কর মুক্ত হইয়া প্রতাপের কার্য্যত্যাগ করিতে বাধ্য হন। কথিত আছে, তখন তিনি মানসিংহের অনুগ্রহে ভূমিবৃত্তি লাভ করিয়া বৃদ্ধকালে বারাসাতে আসিয়া নিরাশ জীবন অতিবাহিত করেন। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী প্রতাপাদিত্য অপেক্ষা বয়সে বড় ছিলেন, সুতরাং বারাসাতে ফিরিয়া আসিবার কালে তাঁহার বয়স ৫০ বৎসরের কম নহে। প্রভাবতী প্রভৃতি নানা কাল্পনিক নামে শঙ্করের বীরপত্নীর শৌর্য্য-খ্যাতি বহু আধুনিক কাব্যোপন্যাস হইতে বঙ্গীয় পাঠককে চমকিত করিয়াছে। সেই পত্নীর গর্ভে তাঁহার তিনটি পুত্র হয়— রামভট্ট বা রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য, মধুসূদন ও বাসুদেব। ক্রমে তাঁহাদের বংশ বৃদ্ধি হইতে থাকে এবং অনেকে বারাসাতের পৈতৃক বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণেশ্বর, বালী, হাওড়া, বেলঘরিয়া, মহেশতলা, মানকর ও কৃষ্ণনগর প্রভৃতি নানাস্থানে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহাদের বিস্তৃত বংশাবলী আমার নিকট থাকিলেও তাহা প্রকাশ করিবার স্থান নাই। সংক্ষিপ্ত কয়েকটি ধারা মাত্র দেখাইতেছি। শঙ্করের অধস্তন দশম পুরুষে পরমশ্রদ্ধেয় সত্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয় জীবিত আছেন। আধুনিক সময়ে তিনিই সর্ব্বপ্রথম প্রতাপাদিত্যের জীবনবৃত্ত সঙ্কলন করেন; তাই তাঁহার ভ্রান্ত ও অভ্রান্ত বহুমত এক্ষণে বঙ্গেতিহাসের পৃষ্ঠা পূর্ণ করিয়াছে। শুধু প্রতাপ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ নহে, তিনি শিবাজী, ক্লাইভ, আলেকজাণ্ডার প্রভৃতির জীবনী লিখিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। কিছুদিন হইল এই বংশোজ্জ্বলকারী ব্রাহ্মণবীর ব্রাহ্মণোচিত তেজস্বিতা, আচারনিষ্ঠা এবং পাশ্চাত্য পণ্ডিতের মত অনুসন্ধিৎসা লইয়া ব্রহ্মদেশ, যবদ্বীপ ও শ্যাম প্রভৃতি পূৰ্ব্বদেশ সমূহ পরিদর্শন পূর্ব্বক বঙ্গদেশে ঐতিহাসিকের জন্য এক নব যুগের অবতারণা করিয়াছেন। শাস্ত্ৰী মহাশয় দক্ষিণেশ্বরবাসী। বারাসাতেও শঙ্করের বংশীয়েরা বাস করিতেছেন, তন্মধ্যে শঙ্কর হইতে ৮ পুরুষ নারায়ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের নাম উল্লেখযোগ্য।[১০] তাঁহার নিকট হইতে জানিতে পারি যে, তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণ প্রায় সকলেই অসাধারণ বলশালী ছিলেন এবং যে কার্য্যে গিয়াছেন, তাহাতেই তাঁহার প্রতিভা এবং একাগ্রতার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।
কালিদাস রায় চৌধুরী ॥ প্রতাপাদিত্যের ঢালী সর্দ্দার কালিদাস রায়ের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি (২১শ পরিচ্ছেদ)। প্রতাপের ঢালী সৈন্যের সংখ্যা সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ছিল এবং এই জাতীয় পদাতিক সৈন্যই তাঁহার প্রধান অবলম্বন ছিল। প্রায় প্রত্যেক রণস্থলে কালিদাস কখনও মদনমল্লের সহকারীরূপে, কখনও প্রধান সামন্তের মত প্রাণপণ যুদ্ধ করিতেন। সেইজন্য তিনি প্রভুর প্রিয়পাত্র ছিলেন। এমন কি, ভারতচন্দ্রের কবিতায় যে ‘যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী’ বলিয়া বর্ণনা আছে, সেখানে কালিকাদেবীকে না বুঝাইয়া এই সেনাপতি কালিদাস রায়ের কথা বলা হইয়াছে, কোথায়ও কোথায়ও লোকে এমনও অর্থ করিয়া থাকেন।[১১] অবশ্য সে অর্থের কোন সার্থকতা নাই। তবে কালিদাস একজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন, একথা সত্য। কথিত আছে, মানসিংহের আক্রমণ কালে তিনি যশোহর-দুর্গ-রক্ষার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। প্রতাপের পতনের পরও তিনি জীবিত ছিলেন, এবং যখন দেখিলেন বঙ্গীয় সৈন্যরা বিনষ্ট ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল, সৰ্ব্বত্র মোগলেরা ঘোর অত্যাচার করিয়া দখল করিয়া লইল, তখন কালিদাস যশোহর পরিত্যাগ পূর্ব্বক জন্মভূমি সেখহাটি গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন।
অতি প্রাচীনকাল হইতে সেখহাটি একটি বিখ্যাত স্থান। ইহার বিশেষ পরিচয় আমরা এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে সেন রাজত্বের ইতিহাস প্রসঙ্গে দিয়াছি।[১২] সেখহাটি বর্তমান যশোহর জেলার অন্তর্গত এবং সিঙ্গিয়া রেলওয়ে স্টেশন হইতে প্রায় ৩ মাইল দূরে অবস্থিত। কালিদাসের উর্দ্ধতন বংশীয়গণ কয়েকপুরুষ ধরিয়া এই সেখহাটিতে বাস করিতেছিলেন। তিনি দক্ষিণ রাঢ়ীয় দত্তবংশীয় মৌলিক কায়স্থ। সিদ্ধমৌলিকগণের যে ত্রিশটি প্রধান সমাজ আছে, তন্মধ্যে বিঘাটিয়া অন্যতম; এখানকার কল্কীশ গোত্রীয় দত্তগণ প্রসিদ্ধ।[১৩] বিশ্বেশ্বর দত্ত এই বিঘাটিয়ার দত্তগণের বীজপুরুষ বলিয়া উক্ত হন। বিশ্বেশ্বর হইতে ৮ম পুরুষ জনাৰ্দ্দনের দুই পুত্র ছিলেন, শ্রীরাম ও কানাইদাস। শ্রীরাম চেঙ্গুটিয়া পরগণার জমিদার হন, তখন তাঁহার রায় চৌধুরী উপাধি হয়। তিনি তাঁহার ভ্রাতা কানাইদাসকে জমিদারীর অংশ দেন নাই। কানাইদাস বাদশাহ হুসেন শাহের আমলে তহশীলদারের কার্য্য করিয়া মজুমদার উপাধি পান। কালিদাস এই কানাইদাস মজুমদারের পুত্র দুর্গাদাসের কনিষ্ঠ সন্তান।[১৪]
কালিদাস আজীবন সৈনিক পুরুষ। শিশুকালে তিনি অত্যন্ত বলশালী ছিলেন। তখন লেখনী অপেক্ষা বংশযষ্ঠি পরিচালনাই তাঁহার অধিকতর প্রিয় ছিল। প্রাচীন বঙ্গে লাঠিই আত্মরক্ষা বা পরপীড়নের প্রধান সম্বল ছিল। এখন যেমন লাঠি ‘ছড়িত্ব প্রাপ্ত হইয়া শৃগাল-কুকুরভীত বাবুবর্গের হস্তের শোভা বর্দ্ধন করে এবং কুকুর ডাকিলেই সে ননীর হস্তগুলি হইতে খসিয়া পড়ে’,[১৫] পূৰ্ব্বে সেরূপ ছিল না। তখন ইহারই বলে গৃহস্থের মানমর্যাদা ও ধনধান্য রক্ষিত হইত। দেশ ও সমাজ উভয়েরই শাসন ভার লাঠির উপর ন্যস্ত ছিল। ক্ষুদ্র লাঠিয়ালদলের সর্দ্দার কালিদাস লাঠির শাস্ত্রে পারদর্শী হইয়া বিখ্যাত হন। কিন্তু তাঁহার সামর্থ্যে কুলায় নাই; চেঙ্গুটিয়া, ইশফপুর প্রভৃতি পরগণাগুলি সকলই প্রতাপাদিত্যের করতলগত হইয়াছিল। হয়তঃ সেই সময়ে প্রতাপ কালিদাসের খ্যাতি শুনিয়া গুণীর মর্যাদা রক্ষা করিয়া, তাঁহাকে স্বকীয় ঢালী সৈন্যের একজন প্রধান অধিনায়ক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কালিদাস চিরদিন বিশ্বস্ত ভক্তের মত তাঁহার অধীন থাকিয়া, বহু যুদ্ধে স্বীয় অসামান্য বলবীর্য্যের পরিচয় দিয়াছিলেন। সে বীর্য্যবত্তার বিশেষ গল্পকাহিনী সেখহাটি অঞ্চলে প্রচলিত নাই, কারণ তাঁহার যোদ্ধৃজীবন সে স্থান হইতে বহু দূরে সমাহিত হইয়াছিল।
প্রতাপের পতনের পর কালিদাসের ঢালী সৈন্য কতক তখনও অবশিষ্ট ছিল; তিনি তন্মধ্য হইতে কিয়দংশ লইয়া আসিয়া, সেই বিপ্লবের যুগে বিস্তীর্ণ ইশফপুর পরগণা দখল করিয়া বসেন। এই পরগণা তখন ফতেহাবাদ সরকারের অন্তর্গত এবং ইহার রাজস্ব ২,৫৮,০২৫ দাম বা ৬,৪৫০ টাকা।[১৬] বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ইহার আয়ও পরে বর্দ্ধিত হয়। চাঁচড়ার রাজা মহাতাবরাম রায় বহুবার তাঁহার হস্ত হইতে এই পরগণা কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করেন; কিন্তু কালিদাস তাঁহার সকল আক্রমণ নিরাকৃত করিয়া দিয়াছিলেন। অবশেষে তিনি ঢাকার সুবাদার কাশিম খাঁর নিকট বহুমূল্য উপহার প্রেরণ করেন এবং তাঁহার সন্তুষ্টিসাধন করিয়া বাদশাহ জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষর সম্বলিত ইশফপুর পরগণার সনন্দ লাভ করেন। এই সময় হইতে তাঁহার ‘রায় চৌধুরী’ উপাধি হয় এবং সাধারণের নিকট তিনি রাজা বলিয়া পরিচিত হন। সনন্দ গ্রহণের পর কালিদাসের জীবদ্দশায় চাঁচড়ারাজ ইশফপুর লাভের জন্য আর কোনও চেষ্টা করেন নাই। মহাতাবের পুত্র কন্দর্পের সময় (১৬১৯-১৬৪৯) ইশফপুর কালিদাসের বংশীয়গণের করায়ত্ত ছিল। বহুদিন পরে কন্দৰ্পপুত্র মনোহর রায় উহা অধিকার করিয়া লন।[১৭]
পরগণা দখল করিয়া কালিদাস রায় তদন্তর্গত ভৈরব-তীরবর্ত্তী বিভাগদি গ্রামে আবাসস্থান নির্দ্দেশ করেন। কেশব সেনের ইদিলপুর তাম্রশাসনে এই বিভাগদি গ্রামের নামোল্লেখ আছে, সুতরাং ইহা অতি প্রাচীন গ্রাম। কালিদাস এই স্থানে আসিয়া গড়কাটা বাড়ী, বাসোপযোগী অট্টালিকা এবং মঠ মন্দিরাদি নির্ম্মাণ করিয়া উহা রাজধানীর মত করিয়া লন। তাঁহার বংশধরগণ এখনও এখানে হীনভাবে বাস করিলেও তাঁহার বাসভূমি জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। তাহার মধ্যে যদিও কোন মন্দির বা অট্টালিকা দণ্ডায়মান নাই, তবু নানাস্থানে রাশি রাশি ইষ্টকন্তূপ, মন্দিরের ভগ্নাবশেষ ও গড়ের চিহ্ন পূর্ব্বগৌরব স্মরণ করাইয়া দেয়। তাঁহার খনিত প্রাচীন জলাশয় এখনও ‘মঠবাড়ীর দীঘি’ বলিয়া খ্যাত। বিভাগদি হইতে পূৰ্ব্ব নিবাস সেখহাটি যাইবার জন্য তিনি জলপ্লাবিত প্রান্তরের মধ্য দিয়া যে দশ বার মাইল দীর্ঘ উন্নত রাস্তা প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তাহা এখনও বৰ্ত্তমান আছে। সেখহাটির সহিত কালিদাসের বিশেষ সম্বন্ধ ছিল, তথায় তাঁহার জ্ঞাতিবর্গ তখনও বাস করিতেন। তাঁহারই সময়ে পুষ্করিণী খননকালে তথায় ভুবনেশ্বরী দেবীর অপূৰ্ব্ব পাষাণ-প্রতিমার আবিষ্কার হয় এবং কালিদাসই তাঁহার প্রথম মন্দির নির্ম্মাণ ও পূজার ব্যবস্থা করিয়া দেন।[১৮] সেখহাটি এক্ষণে নড়াইলের জমিদারের হস্তগত হইলেও ভুবনেশ্বরী দেবীর পূজার সংকল্প কালিদাসের বংশীয়গণের নামে হয়।
কালিদাস রায়ের দুই বিবাহ, প্রথম পক্ষে রামবল্লভ প্রভৃতি পাঁচ পুত্র ও বাণী নামক এক কন্যা এবং দ্বিতীয় পক্ষে রামনারায়ণ প্রভৃতি ছয় পুত্র এ কন্যা। এই সকল পুত্রকন্যাগণের বিবাহ দ্বারা তিনি নানাশ্রেণীর প্রধান প্রধান কুলীনের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া ‘গোষ্ঠীপতি’ আখ্যা পান বালী সমাজের[১৯] পর্য্যায়স্থ প্রকৃত মুখ্য গোস্বামী বা গোসাঞিদাস ঘোষ ইছাপুর হইতে আসিয়া দাঁতিয়া পরগণার জমিদার কুমিরা নিবাসী প্রথিত নামা রুক্মিণীকান্ত মিত্রচৌধুরীর কন্যা বিবাহ করিয়া উক্ত কুমিরায় বাস করিতেছিলেন। কালিদাস স্বীয় জ্যেষ্ঠা কন্যা বাণীসুন্দরীকে উক্ত গোসাঞিদাসের জ্যেষ্ঠ পৌত্র প্রকৃত মুখ্য রামদেব ঘোষের সহিত বিবাহ দিয়া তাঁহাদিগকে সপরিবারে আনিয়া পার্শ্ববর্ত্তী বাঘুটিয়া গ্রামে বসতি করান এবং মৌজে বাণীপুর (কন্যার নামানুসারে) ও মৌজে হরিশপুর মৌরসী মোকররী গাতি যৌতুক দেন।[১৯] এই রামদেব বাঘুটিয়ার প্রসিদ্ধ ঘোষ বংশের আদি পুরুষ। তাঁহার বংশধরগণ এক্ষণে প্রায় শতাধিক ঘর হইয়া সুপ্রশস্ত বাঘুটিয়ার বিভিন্ন পাড়ায় বাস করিতেছেন। দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থ সমাজে বাঘুটিয়ার ঘোষ মহাশয়দিগের সম্মান ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত অধিক। তাঁহাদের মধ্যে চণ্ডীচরণ প্রভৃতি দেশমান্য মহাত্মগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।[২০] আমরা পরে এই বংশের বিশেষ বিবরণ দিব। রাজা কালিদাসই এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং উক্ত ঘোষ বংশীয়গণ আজিও তৎপ্রদত্ত যৌতুকসম্পত্তি খারিজা তালুকের উপস্বত্ব ভোগ করিতেছেন।
কালিদাস স্বীয় কনিষ্ঠ কন্যাকে মাহিনগর সমাজের ২১ পর্য্যায়স্থ কোমল মুখ্য রামদেব বসু মহাশয়ের সহিত বিবাহ এবং নিয়মিত বৃত্তি দান করিয়া বিভাগদি গ্রামে তাঁহার বসতি নির্দ্দেশ করিয়া দেন। বর্ত্তমান সময়ে বিভাগদির বসুগণ উক্ত রামদেব বসুর অধস্তন বংশধর।[২১] কালিদাস পৌত্রীর সহিত বাগাণ্ডা সমাজের প্রকৃত মুখ্য ২১ পর্যায়স্থ যাদবেন্দ্র বসুর বিবাহ হয়। তিনি উহাকে বাসের জন্য জঙ্গলবাধাল গ্রামে ও ইশফপুর পরগণার অন্তর্গত তেঘরি নামক একখানি গ্রাম ভোগোত্তর স্বরূপ নিষ্কর দান করেন। যাদবেন্দ্র ও তাঁহার সহোদরগণের বংশ হইতে জঙ্গলবাধালের স্বনামখ্যাত বসু মহাশয়েরা প্রায় ৪০ ঘর দাঁড়াইয়াছেন এবং তাঁহারা সাত আট পুরুষ তথায় বাস করিতেছেন। বিভাগদি ও জঙ্গলবাধালের বসুগণ অনেকেই এখনও কালিদাস প্রদত্ত বৃত্তি ভোগ করিতেছেন। তিনি অন্যান্য স্থানের কায়স্থদিগকেও মহাত্রাণ দিয়াছিলেন।
কালিদাস অত্যন্ত ব্রাহ্মণ-ভক্ত ও স্বধর্ম্মনিষ্ঠ ছিলেন; নিকটবর্ত্তী বড়গাতি, শিঙ্গিয়া, সেখহাটি, দেয়াপাড়া, ভুগিলহাট ও শোলপুর প্রভৃতি ২৭ খানি গ্রামের অনেক উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ-পরিবার এখনও কালিদাস প্রদত্ত ব্রহ্মোত্তর জমি ভোগদখল করিতেছেন। বড়গাতির জনৈক বিখ্যাত পণ্ডিত কালিদাস রায়ের সভাপণ্ডিত ছিলেন; পরে তাঁহারই বংশধরগণ বাঘুটিয়ার ঘোষ বংশের গুরুকুল। কালিদাস অত্যন্ত দাতা বলিয়া খ্যাত; তিনি যাগযজ্ঞ উপলক্ষে দীনদুঃখীদিগকে অজস্র দান করিতেন। মানুষ থাকে না, কিন্তু তাঁহার কীর্তি থাকে, কালিদাস নাই, কিন্তু তাঁহার কীর্তি-কাহিনী এখনও বিলুপ্ত হয় নাই।
বিজয়রাম ভঞ্জ চৌধুরী ॥ বিজয়রাম মহাবীর এবং প্রতাপাদিত্যের একজন সেনাপতি বলিয়া ভঞ্জ-বংশ এ অঞ্চলে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এ অতি পুরাতন বংশ। এরূপও কথিত আছে যে, ভঞ্জদিগের আদি স্থান রাজপুতানায়, তথা হইতে তাঁহারা উড়িষ্যায় ও পরে ময়ূরভঞ্জে রাজার মত বাস করেন। সেখান হইতে কে কখন বঙ্গদেশে আসেন, তাহা জানা যায় নাই, তবে মুসলমান বিজয়ের প্রায় শতবর্ষ পরে কুবের ভঞ্জ দক্ষিণবঙ্গে হাতিয়গড়ের অন্তর্গত বহড় গ্রামে বাস করেন, এরূপ জানা যায়। কুবেরের পুত্র কাকুৎস্থ, তৎপুত্র হরিহর, তৎপুত্রদ্বয় মকরন্দ ও বিদ্যাধর। মকরন্দের কোন অধস্তন বংশধর কলাধর ও মালাধর দুই ভ্রাতায় খড়রিয়া, সুলতানপুর প্রভৃতি পরগণার জমিদারী পাইয়া প্রথমতঃ মৌভোগ গ্রামে ও পরে তাঁহাদের বংশধরগণ নলধায় বাস করেন। সে ইতিহাস পরগণার বিবরণী প্রসঙ্গে পরে দিব। বিদ্যাধরের প্রপৌত্র বা তাঁহার অধস্তন কোন বংশধর হাওড়া জেলার কাইতি-শ্রীরামপুর (সম্ভবতঃ শ্রীরামপুর কায়স্থপাড়া) হইতে উঠিয়া আসিয়া খাঞ্জে গ্রামের অপর পারে বর্ত্তমান হাসনাবাদের সন্নিকটে বোলতলা নামক স্থানে বাস করেন। তদ্বংশীয় হরিহর ভঞ্জ বিশেষ প্রতিপত্তিশালী হইয়াছিলেন। হরিহরের পুত্র যাদবেন্দ্র বিক্রমাদিত্যের সময় রাজসরকারে প্রবেশ করেন এবং পরে প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে তিনি তাঁহার কোষাধ্যক্ষ বা রাজস্ববিভাগীয় দ্বিতীয় মন্ত্রীর পদে সমাসীন হন। তখন তিনি বোলতলা ত্যাগ করিয়া ইচ্ছামতীর পূর্ব্বপারে বর্ত্তমান কালীগঞ্জের চারি মাইল উত্তরে নলতা গ্রামে বসতি করেন।
যাদবেন্দ্র এই স্থানে আসিয়া দীর্ঘিকা খনন ও প্রাচীর বেষ্টিত আবাস-বাটিকা নির্মাণ করেন। এখন অসংখ্য পুরাতন ভগ্ন অট্টালিকা ও সিংহদ্বারের তোরণপ্রাচীর তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। যাদবেন্দ্ৰ কৃষ্ণভক্ত ও ধার্ম্মিক ছিলেন; তিনি শ্রীশ্রীকৃষ্ণদেব রায় বিগ্রহের জন্য নিজ বাটীতে যে সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেন, উহার পোতা পর্যন্ত মৃত্তিকা নিম্নে বসিয়া গেলেও মন্দিরটি দুইবার বজ্রাঘাত সহ্য করিয়া এখনও দণ্ডায়মান আছে এবং তন্মধ্যে শ্রীবিগ্রহের নিত্য পূজা হইতেছে। ঐ পূজা নির্ব্বাহের জন্য ৩০০ বিঘা নিষ্কর দেবোত্তর আছে; বৈশাখ, কার্ত্তিক ও মাঘ মাসে নিত্য কীৰ্ত্তন হয়। সে সম্পত্তির আদায়ের ব্যবস্থাদি পুরোহিতগণই করেন। কৃষ্ণদেব রায়ের মন্দিরটি দোতালা; উহার নিম্নতলার বাহিরের মাপ ৩০’-৬’’ × ২৬’’ ফুট এবং দোতালার গর্ভমন্দির ১৪’-৫’’ × ১৪’-৫’’। এখনও মন্দিরটি রীতিমত মেরামত না করিলে আর দীর্ঘস্থায়ী হইবে না। কৃষ্ণদেবের দোল উৎসবের জন্য যে সুন্দর দোলমঞ্চ নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা এখনও আছে। ভঞ্জগণ জামদগ্ন্য গোত্রীয় এবং ভট্টপল্লীর বৈদিক ভট্টাচাৰ্য্যগণ তাঁহাদের গুরু।
যাদবেন্দ্রের পুত্র বিজয়রাম বিপুল বপু এবং অদ্ভুত দৈহিক বলের পরীক্ষা দিয়া প্রতাপের শরীররক্ষী সৈন্যদলের সর্দ্দার হইয়াছিলেন। (২২শ পরিচ্ছেদ)। তিনি দশ সহস্র সৈন্যের অধিনায়ক ছিলেন বলিয়া শুনা যায়। বিজয়রাম শেষ যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতাপ-সৈন্যের অগ্রণী হইয়া যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কোষাধ্যক্ষ বা তাঁহার পুত্র কখনও কোন প্রকার বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দেন নাই। দিলে প্রবাদ তাঁহাকে অব্যহতি দিত না; আজ যে বিজয়রামের বীরত্ব-খ্যাতি যশোহর অঞ্চলে গৃহে গৃহে ধ্বনিত হইতেছে, তাহা হইত না। প্রতাপের পতনের পর, বিজয়রাম চতুঃপার্শ্বস্থ বাজিতপুর পরগণা দখল করিয়া বসেন এবং পরে নবাব সরকার হইতে উহার জমিদারী সনন্দ এবং বংশানুক্রমিক চৌধুরী খেতাব লাভ করেন। বিজয়রাম হইতে ভঞ্জচৌধুরীগণ সাত আট পুরুষ নতায় বাস করিতেছেন এবং তাঁহারা স্বশ্রেণীস্থ প্রধান প্রধান কুলীন কায়স্থ এবং ব্রাহ্মণগণকে ভূমি-বৃত্তি দিয়া তথায় বাস করাইয়াছেন। কালে গোষ্ঠীবৃদ্ধি ও জ্ঞাতি-বিরোধবশতঃ ভঞ্জ জমিদারগণ হীনপ্রভ হইয়া পড়িয়াছেন। সমগ্র বাজিতপুর পরগণার মাত্র তিন আনা অংশ এক্ষণে
রঘুনাথ রায় ॥ ঘটকারিকায় যে ‘প্রচলিত রঘু’[২২] নামক প্রতাপাদিত্যের সেনাপতির কথা আছে, তিনি পূৰ্ব্বাঞ্চল হইতে আসেন নাই।[২৩] তাঁহার নিবাস ছিল, যশোহর জেলার অন্তর্গত শৈলকূপায়। তিনি সৌপায়ন গৌত্রীয় নাগবংশীয় বারেন্দ্র কায়স্থ। এই নাগ বংশ খুব পুরাতন। কান্যকুব্জান্তর্গত কোলাঞ্চনগর হইতে আগত শৈলকূপার বারেন্দ্র নাগ-বংশ অতি প্রাচীন কাল হইতে প্রসিদ্ধ। যদুনন্দন কৃত ‘ঢাকুরী’ হইতে জানা যায়, শিবরায় নাগ শৈলকূপার অধিবাসী।
তৎপুত্র কর্কট ও জটাধর নাগ বল্লাল সেনের সমসাময়িক ও সমাজবন্ধনে তাঁহার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। কর্কট তারাউজলিয়া[২৪] পরগণার অধীশ্বর হইয়া শৈলকূপায় ছিলেন, এবং তাঁহার ভ্রাতা জটাধর সোণাবাজ পরগণা পাইয়া বরেন্দ্রভূমিতে স্বরগ্রামে উঠিয়া যান। কথিত আছে, বল্লালের প্রতি বিরক্ত হইয়া নন্দী, চাকী, দাস কুলীনেরা শৈলকূপায় নাগরাজগণের আশ্রয়ে আসিয়া বারেন্দ্র কায়স্থগণের কুলবিধি প্রণয়ন করেন।[২৫] রাজা কর্কট নাগ হইতে বংশধারা এইরূপ : ১ কর্কট— ২ সতী— ৩ বসুধারা- ৪ বিভা— ৫ শুল্কাম্বর ও শুভঙ্কর, শুল্কাম্বর শৈলকূপায় থাকেন এবং শুভঙ্কর পার্শ্ববর্তী নাগপাড়ায় উঠিয়া যান,–৬ শুল্কাম্বরের পুত্র গরুড়ধ্বজ,-৭ তৎপুত্র কালিদাস রায়,-৮ তৎপুত্র রাজা রাজবল্লভ। ইনি মুসলমান রাজসরকার হইতে জায়গীর ও রাজোপাধি লাভ করেন। যদুনন্দনের ‘ঢাকুরী’তে আছে :
‘কালিদাস পুত্র রাজা রাজবল্লভ হইল
মুনসেফ জানিয়া পাত্সা রাজ-টীকা দিল।’
[মুনসেফ অর্থ- জায়গীর]
এই রাজবল্লভের পৌত্র রঘুনাথ রায় প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ছিলেন। তিনি পূৰ্ব্বদেশীয় সৈন্যদলের অধিনায়ক ও দুর্গাধ্যক্ষ ছিলেন (১৯শ পরিচ্ছেদ)।
প্রতাপ আদিত্য রাজা বঙ্গ-অধিপতি।
পূর্ব্ব খণ্ডে ছিলেন তাঁর রঘু সেনাপতি।।
মানসিংহ হস্তে যদা প্ৰতাপ পড়িল।
মহাযুদ্ধে রঘুবীর প্রাণ বিসর্জ্জিল।।
বিষয় বিভব মঠ পর হস্তগত।
দেবালয় মসজিদে হৈল পরিণত॥[২৬]
রঘুবীরের মৃত্যুর পর তাঁহার জমিদারী পর্য্যন্ত বাজেয়াপ্ত করা মানসিংহের সময়ে হয় নাই— সম্ভবতঃ ঐ কাৰ্য্য ইসলাম খাঁর সেনানী ইনায়েৎ খাঁর আদেশে সাধিত হয়। তখন রঘুর পুত্র ‘রাজ্যহীন রায়’ রামনারায়ণ শৈলকূপা পরিত্যাগ করিয়া বাগ্দুলী গ্রামে (বর্তমান ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার অন্তর্গত) গিয়া বাস করেন। তথা হইতে ক্রমে এই বংশ (রঙ্গপুর) কাকিনা, (পাবনা) ঘুড়কা, (নদীয়া) বালিয়াপাড়া, (যশোহর) উদিঘড়ী বা উদাস প্রভৃতি নানা স্থানে বহুবিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে। বালিয়াপাড়ার ধারায় রঘুবীর হইতে ৮ম পুরুষে কায়স্থকুলগৌরব রায়বাহাদুর বিশ্বম্বর রায় জীবিত আছেন। ইনি স্বজাতির উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন এবং জরাগ্রস্ত হইলেও নড়াইল হাটবাড়িয়ায় কায়স্থ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করিয়াছিলেন। ইঁহার পৌত্র ধরিলে, রঘু হইতে দশ পুরুষ হইয়াছে। রায়বাহাদুর এক্ষণে নদীয়া ডিস্ট্রীক্টবোর্ডের চেয়ারম্যান এবং কৃষ্ণনগরের স্বনামধন্য গবর্ণমেন্ট উকীল।
সবাই ঢালী ও সুন্দর মল্ল ॥ সে এক যুগ ছিল, যখন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণগণও ঢালী বা মল্ল প্রভৃতি খেতাবে অস্ত্রশস্ত্রধারী হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে শ্লাঘা বোধ করিতেন। সবাই এবং সুন্দর যে উভয়ে সহোদর এবং বন্দ্যঘাটী বংশীয় ১৭শ প্রসিদ্ধ কুলীন চতুর্ভূজের পুত্র, তাহা আমরা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি (২১শ পরচ্ছেদ)। সবাই যশোহর জেলার আল্লাপোলের বাঁড়ুয্যে বংশের আদি পুরুষ; তাঁহার একটি বংশধারাও আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি (২৩শ পরিচ্ছেদ)। সবাই-এর প্রপৌত্র মথুরেশের এক পুত্র নন্দকিশোরের ধারা আমরা কতক দেখাইয়াছি; মথুরেশের অন্য পুত্র শ্রীরামের ধারা এই :
২২ শ্রীরাম— ২৩ গোপাল— ২৪ রাধাকান্ত— ২৫ রামবিধি— ২৬ রামনারায়ণ— ২৭ রামচাঁদ— ২৮ শিবচন্দ্র— ২৯ প্রফুল্লচন্দ্র বন্দ্যোপধ্যায়, এম, এ, ইনি ‘গ্রীক ও হিন্দু’ প্রভৃতি কয়েকখানি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের লেখক, প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও সম্মানিত উচ্চ রাজকর্মচারী।
সবাই বাঁড়ুয্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুন্দর মল্ল প্রতাপাদিত্যের একজন সেনানী। সম্ভবতঃ আমরা তাঁহার তীরন্দাজ সৈন্যের অধিনায়ক যে সুন্দরের কথা বলিয়াছি (২১শ পরিচ্ছেদ), তিনি ও সুন্দর মল্ল অভিন্ন ব্যক্তি। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর সুন্দর বা তাঁহার পুত্র বিষ্ণুচরণ সিদ্ধান্ত ভৈরবকূলে সেনহাটি আসিয়া বাস করেন। কাঞ্জারি ও কাটানি বংশের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ-সূত্রই তাঁহাদের সেনহাটি আসিবার কারণ। বিষ্ণুচরণ সিদ্ধান্তের সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি হইলে, যে পাড়ায় তাঁহারা বাস করেন, তাহার নাম হইয়াছে ‘সিদ্ধান্তপাড়া’। পূৰ্ব্ব হইতেই তাঁহারা মুকুন্দপুরের রায় মহাশয়দিগের গুরু; তাঁহারা যে এক সময়ে যশোহর রাজধানীর সন্নিকটে বাস করিতেন, ইহা দ্বারা উহা প্রমাণ করে। সেনহাটির সিদ্ধান্ত-বংশ আদ্যোপান্ত পণ্ডিতের বংশ এবং বহু কায়স্থ ও ব্রাহ্মণ পরিবারের গুরুবংশ। বিষ্ণুচরণের পৌত্র নারায়ণ তর্কালঙ্কার প্রখ্যাতনামা পণ্ডিত ছিলেন। নারায়ণের পৌত্র কৃষ্ণদেবের সময় মুকুন্দপুর রায়বংশীয় জনৈক শিষ্য কর্তৃক ১৬৫৭ শকে (১৭৩৫ খৃঃ অঃ) যে শিব-মন্দির নির্ম্মিত ও পুষ্করিণী খনিত হয়, উহা এখনও আছে। উহার সংস্কারাদির ব্যয় সেই বংশীয় লক্ষ্মণচন্দ্র রায় মহাশয় প্রভৃতি এখনও বহন করিয়া থাকেন। কৃষ্ণদেবের বৃদ্ধ প্রপৌত্র হরনাথ বেদান্তবাগীশ অসাধারণ পাণ্ডিত্যশালী হইয়া বর্দ্ধমানরাজের বিজয়চতুষ্পাঠীর প্রধান অধ্যাপক পদে সমাসীন ছিলেন। আমরা তাঁহাকে বিশেষভাবে জানিতাম এবং তাঁহার স্নেহের গুণে ও চরিত্রমাধুর্য্যে একান্ত আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। তিনি সুন্দরের বংশধারা পবিত্র করিয়া গিয়াছেন। বেদান্তবাগীশ মহাশয় স্বীয় বংশ-গৌরব সম্বন্ধে ‘সুন্দরঃ সিদ্ধান্তশ্রেষ্ঠঃ খ্যাতো বংশো বলিগণৈঃ’ এইরূপ একটি শ্লোকাংশ আবৃত্তি করিতেন, এখন আর তাহা উদ্ধারের পন্থা নাই।
পাদটীকা :
১. ভবানন্দ অন্নপূর্ণার উপাসক ছিলেন। তিনি কাশীধামে অন্নপূর্ণার মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন বলিয়া প্রবাদ আছে।— উপেন্দ্ৰচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ‘চরিতাভিধান’, ৩২৪ পৃ।
২. সারল বা সারুলিয়া গ্রাম যশোহর জেলায় নলদীর নিকটবর্ত্তী এবং নবগঙ্গার উপর অবস্থিত। ইহা কাঞ্জারী বংশের আদিস্থান। ‘বাচস্পত্য-অভিধান’ প্রণেতা তারানাথ তর্কবাচস্পতির পিতামহ এই সারল পরিত্যাগ করিয়া অম্বিকা-কালনায় বসতি স্থাপন করেন। রঘুনাথ সিদ্ধান্তবাগীশও রুদ্ররায়কে শিষ্য করিয়া নদীয়ার অন্তর্গত কাঁদবিলায় বাস করেন। তথা হইতে তাঁহার বংশধরেরা এক্ষণে ধর্ম্মদহ, বাহিরগাঁছি, বাগআঁচড়া ও সিমলা প্রভৃতি গ্রামে বাস করিতেছেন।
৩. ‘রাজ্যের উত্তর সীমা মুর্শিদাবাদ।
পশ্চিম সীমা গঙ্গা ভাগীরথী খাদ।।
দক্ষিণের সীমা গঙ্গাসাগরের ধার।
পূর্ব্ব সীমা ধুল্যাপুর বড় গঙ্গা পার॥’—ভারতচন্দ্ৰ, ‘কালিকামঙ্গল’
এখানে বলেশ্বর নদীকেই বড়গঙ্গা বলা হইয়াছে।-’সম্বন্ধ নির্ণয়’, ৭২৩-২৪ পৃ।
৪. ‘নবদ্বীপাধিপতির রাজ্যে যে ব্রাহ্মণ রাজদত্ত ব্রহ্মত্র ভূমি প্রাপ্ত হয়েন নাই, তিনি ব্রাহ্মণ বলিয়াই গণ্য নহেন। রাজজ্ঞাতিগণও সুব্রাহ্মণদিগকে ভূসম্পত্তি দান করিয়াছেন।’— লালমোহন বিদ্যানিধি, সম্বন্ধ নিৰ্ণয়’, ৫৭৩ পৃ।
৫. Imperial Gazetteer হইতে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কেবল মাত্র শান্তিপুর হইতে প্রায় বিশ লক্ষ টাকার (১৫০,০০০ পাউণ্ড) সূক্ষ্মবস্ত্র বিলাতে প্রেরিত হইত।—’নদীয়া কাহিনী’, ৭১ পৃ।
৬. ঐস্থানকে সেকালে ‘ফকিরের ডাঙ্গা’ বলিত।
৭. সূক্ষ্মানুসন্ধিৎসু সুলেখক হরিসাধন মুখোপাধ্যায় মহাশয় তৎপ্রণীত ‘কলিকাতা, সেকালের ও একালের’ নামক বিরাট গ্রন্থে (৬৫ পৃ) লিখিয়াছেন যে, তিনি কামদেবের বংশীয় বড়িশা নিবাসী হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরীর পুত্র সতীশচন্দ্র রায়চৌধুরীর নিকট প্রাপ্ত কামদেবের স্বহস্তলিখিত আত্মবিবরণী সম্বলিত একখানি জীর্ণলিপি প্রকাশ করিয়াছেন। উহা হইতে এই সার সংগ্রহ করিলাম।
৮. ‘বঙ্গীয় জাতীয় ইতিহাস’, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ২৬৪ পৃ; হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, ১৫২ পৃ।
৯. ‘কালীক্ষেত্র দীপিকা’, ৭৮ পৃ।
১০. ইনি রাঁচি Secretariat-এ একজন প্রধান কর্ম্মচারী। চিরদিন বিদেশে থাকিলেও বংশ গৌরবের জন্য তাঁহার প্রবল আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়। ইনিই আমাকে অতি বিস্তীর্ণ বংশতালিকা প্রেরণ করিয়াছেন। তাহা সম্পূর্ণ প্রকশ করিতে পারিলাম না বলিয়া দুঃখিত হইলাম। যশোহরের ইতিহাসের সঙ্গে শঙ্করের অতীব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকিলেও তাঁহার বংশীয়গণের কাহিনী আমার বিষয়ীভূত নহে।
১১. এই সম্বন্ধীয় কিম্বদন্তী অবলম্বন করিয়া ১৩১০ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকার পৌষসংখ্যায় ‘সেনাপতি কালী’ শীর্ষক যে প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম, তাহা দ্রষ্টব্য। প্রতাপের পতনের ১৫০ বৎসর পরে লিখিত ভারতচন্দ্রের কবিতায় আছে : ‘যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী’; ঘটক-কারিকায় দেখিতে পাই : ‘সেনাধিপতিরূপা সা যশোহর-সুরক্ষকা’; সারতত্ত্বতরঙ্গিণী’তে লিখিত হইয়াছিল : ‘যুদ্ধে যার সেনাপতি আপনি কালিকে’–এই সব উক্তি একত্র করিয়া দেখিলে কালী বলিতে মাতা কালিকাদেবীকেই বুঝাইতেছে। কিন্তু কালিদাসের বাসস্থান বিভাগদি প্রভৃতি স্থানে এবং বড়গাতির গুরু-ভট্টাচার্য্য মহাশয়দিগের মুখে শুনিয়াছিলাম যে, ঐ ভারতচন্দ্রের কবিতায় সেনাপতি কালিদাসেরই কথা বলা হইয়াছে। ইহা অতিরিক্ত স্তাবকতা মাত্র— সত্য বলিয়া ধরিতে পারি না।
১২. ১ম খণ্ড, ১৪৬-১৬২ পৃ।
১৩. ‘কায়স্থ-কারিকা’, উপক্রমণিকা, ১৬ পৃ।
১৪. এই দত্তবংশ চিরদিনই বংশমর্য্যাদায় উচ্চ। তাঁহারা কুলীনের সঙ্গে ব্যতীত বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করিতেন না। নড়াইলের নিকটবর্ত্তী উজিরপুরের রাজা কেশব ঘোষ শ্রীরাম রায় চৌধুরীর সমসাময়িক। তিনি সম্পদে প্রবল ও গর্বিত হইলেও বংশ গৌরবে হীন ছিলেন, তিনি শ্রীরামের কন্যা বিবাহ করিবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহান্বিত হন; যখন তাঁহাকে কিছুতেই নিবৃত্ত করা গেল না, তখন তাঁহাকে অপ্রতিভ করিবার জন্য শ্রীরামের পক্ষীয় লোকে এক কৌশল অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে সম্মতি দেন। তখন সেই ‘আশমানী কুদ্রতী (অর্থাৎ অত্যধিক অহঙ্কারী) রাজা কেশব ঘোষ’ অসংখ্য লোক লস্কর সহ মহাসমারোহ করিয়া সেখহাটি আগমন করেন। শ্রীরাম রায় একটি পুরুষ ছেলেকে স্ত্রীবেশে সাজাইয়া তাঁহার সহিত বিবাহ দিয়া দেন। ক্রোধান্ধ কেশব বহুবার এই অপমানের প্রতিশোধ লইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু লাঠিয়ালের বলে চেঙ্গুটিয়ার জমিদার প্রতিবারই তাঁহাকে পরাস্ত ও নিরস্ত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
১৫. বঙ্কিমচন্দ্ৰ, ‘দেবী চৌধুরাণী’. ১৫৮ পৃ।
১৬. Ain-i-Akbari ( Jarrett ), Vol. 11, p. 132.
১৭. Westland, Jessore, pp. 45-6.
১৮. ভুবনেশ্বরীমূর্তির বিশেষ বিবরণ ১ম খণ্ডে (১৪৬-১৬২ পৃ) দেওয়া হইয়াছে। এমন সুন্দর দেববিগ্রহ বোধ হয় যশোহর খুলনায় আর নাই। ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহাসিক, প্রসিদ্ধ ডাঃ ভিনসেন্ট স্মিথ এই মূর্তির ছবি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন।
১৯. ইশফপুর পরগণার সঙ্গে এই সম্পত্তি চাঁচড়া রাজের হস্তগত হয়। কিন্তু ইংরাজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় উহা খারিজা তালুক বলিয়া বন্দোবস্ত হয়। উহা যশোহর কালেক্টারীর ২০নং তৌজিভুক্ত। তালুকের রাজস্ব ২১৯ টাকা হইতে এক্ষণে ২৩৪ টাকা ২ আনা ২ পয়সা দাঁড়াইয়াছে। এই বাণীপুর তালুকের মধ্যে কিসমৎ বাঘুটিয়া (মৌজে বাঘুটিয়া ব্যতীত), কন্দনপুর (বিভাগদির প্রকৃত নাম), মধ্যপুর, সিঙ্গেড়ী, বিছালী ও মাদারবেড় ছিল।
২০. রামদেব হইতে প্রবল মুখ্যের প্রধান ধারা এইরূপ : ১৯ গোস্বামী—২০ ভরত—২১ রামদেব–২২ রামেশ্বর–২৩ হরেকৃষ্ণ—২৪ ব্রজকিশোর—২৫ চণ্ডীচরণ—২৬ কৃষ্ণচরণ—২৭ হরিচরণ প্রিয়নাথ ও রাজেন্দ্রকুমার। হরিচরণ ও প্রিয়নাথের বংশ নাই। রাজেন্দ্রের পুত্র অমরেন্দ্র প্রভৃতি। হরেকৃষ্ণের ২য় পুত্র রাজকিশোর—২৫ বাঞ্ছারাম—২৬ দুর্গাচরণ— ২৭ কালীপ্রসন্ন—২৮ দেবপ্রসন্ন প্রভৃতি। চণ্ডীচরণ প্রবল প্রতাপান্বিত রাজার মত সম্মানিত হইতেন।
২১. এই বংশের একটি ধারা এইরূপ : কোমলমুখ্য ২১ রামদেব—২২ নিধিরাম–২৩ রামরাম—২৪ গোরাচাঁদ— ২৫ কো-মু-গদাধর—২৬ শশিভূষণ (রায়সাহেব)— ২৭ যতীন্দ্ৰ, খগেন্দ্ৰ, বিনয় I
২২. ‘সেনানী সূর্য্যকান্তশ্চ রঘুঃ প্রাচ্যপতিস্তথা।’
—ঘটককারিকা, নিখিলনাথ, মূল ৩১৪ পৃ।
২৩. এই পুস্তকের (২২শ পরিচ্ছেদ) রঘু পূৰ্ব্বদেশ হইতে আসিয়াছিলেন বলিয়া যে অনুমান করিয়াছিলাম, তাহা সত্য নহে। পূর্ব্বে এ সংবাদ জানিতে পারি নাই।
২৪. Ain-i-Akbari (Jarrett ), Vol. II, p. 133 তারাউজলিয়া, Taraojiyal পরগণা মামুদাবাদ সরকারের অন্তর্ভুক্ত, উহার রাজস্ব ছিল ৩৯১, ৩৬৫ দাম। এই পরগণার কতকাংশ অন্য পরগণার সামিল হইয়া গিয়াছে, কতক এই নামে বর্তমান যশোহর, নদীয়া ও পাবনা জেলার সীমাভুক্ত রহিয়াছে।
২৫. কালীপ্রসন্ন সরকার, ‘কায়স্থ-তত্ত্ব,’ ৯৫ পৃ; ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, রাজন্য কাণ্ড, ২৪৩-৪৫ পৃ।
২৬. বিশ্বম্ভর রায় (রায়বাহাদুর), ‘নাগবংশ, ঢাকুর’, ১৪-১৫ পৃ।
২৭. ইনি এখন কাশিবাসী। মোক্ষদাচরণ ‘যশোহর-কাহিনী’ সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টিত ছিলেন। এজন্য তিনি অনুসন্ধিৎসা লইয়া নানাস্থানে ভ্রমণও করিয়াছিলেন। সে অসম্বদ্ধ ও অনিয়মিত চেষ্টায় বিশেষ ফল হয় নাই। তাঁহার সংগ্রহের কতক খাতাপত্র আমাকে দিয়াছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রমাণাভাবে আমি তাহার প্রায় কিছুই ব্যবহার করিতে পারি নাই। তবুও আমি তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ এবং তাঁহার উদ্যম সর্ব্বদা প্রশংসনীয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন