৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন

সতীশচন্দ্র মিত্র

ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শেষ যুদ্ধ ও পতন

প্রতাপাদিত্যের শেষ পতন যে ইসলাম খাঁর সময়ে হয়, মানসিংহের হস্তে নহে, ‘বহারিস্তান তাহা সপ্রমাণ করিয়া দিয়াছে। ১২০ বৎসর পূর্ব্বে লিখিত রামরাম বসুর বিবরণীও বহারিস্তানের বৃত্তান্তের অনুগামী। বসু মহাশয় প্রচলিত প্রবাদ এবং পুরাতন পারসীক গ্রন্থ হইতে নিজের পুস্তক লিখেন। তিনি যে বহারিস্তানেরই সন্ধান পাইয়াছিলেন, এমন কোন কথা নাই। হয়ত ‘রাজনামা’ প্রভৃতি অন্য পারসীক গ্রন্থও ছিল, এবং দৈবক্রমে উহা পুনরায় বহারিস্তানের মত ঐতিহাসিকের গবেষণার গণ্ডীতে পড়িতে পারে। যাহা হউক, রামরাম বসুর মোটামুটি সমর্থনে বহারিস্তানের প্ৰামাণিকতা বাড়াইয়া দিয়াছে। বসু মহাশয়ের গ্রন্থে ইসলাম খাঁ প্রসঙ্গে যাহা আছে, তাহা এই : ‘কতক কাল পরে সিংহরাজা পুনরায় হেন্দোস্থানে গতি করিলে কাশি পৌঁছিয়া তাহার পরলোক হইল।[১] এ সমাচার দিল্লী পৌঁছিলে আপনে ওজির এছলাম খাঁ চিস্তি প্রতাপাদিত্যের বিপরীতে বাঙ্গালায় সাজনি করিয়া হেন্দোস্থানের তিন হিসা ফৌজ সাতে লইয়া থানাবথানা মারপিট করিয়া সরবসর আসিয়া সালিখার থানায় পৌঁছিলে রাজার প্রধান সেনাপতি কমল খোজা মুহমেল দিয়া সাত দিন পর্য্যন্তক অনাহারে দিবারাত্রি লড়াই করিতেছিল। ইতি মধ্যে একদিন কমল খোজার মরণের খবর পৌঁছিয়াছে, ইহাতে রাজা ব্যস্ত ছিলেন।[২] ইসলাম খাঁ স্বয়ং আসিয়া প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করেন কি না, এখানে তাহার স্পষ্ট উল্লেখ না থাকিলেও, তাঁহার হস্তে যে প্রতাপের শেষ পতন ঘটে তাহা বেশ বুঝা যায়। আর খোজা কমল যে প্রাণান্ত পর্য্যন্ত কেমন যুদ্ধ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার মৃত্যুই কিরূপে প্রথম যুদ্ধের পরাজয়ের কারণ, তাহারও আভাস এখান হইতে পাই। সুতরাং বহারিস্তানের বিবরণীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায়। উহাতে মোগল সৈন্যের সহিত প্রতাপ-সৈন্যের যুদ্ধবৃত্তান্ত যেরূপ খুঁটিনাটির সহিত বর্ণিত হইয়াছে, তাহাতে উহার বঙ্গানুবাদ হইতে যুদ্ধবিবরণী উদ্ধৃত করিলেই চলিবে। শুধু স্থানের বা লোকের পরিচয় দিবার জন্য স্থানে স্থানে টিপ্পনী সংযুক্ত করা আবশ্যক হইতে পারে। বলা বাহুল্য, উদ্ধৃত অংশগুলি অধ্যাপক সরকার মহোদয়ের বঙ্গভাষায় লিখিত বহারিস্তানের সারসংগ্রহ হইতে গৃহীত হইল।[৩]

যখন ৮০ খানি রণপোত লইয়া প্রতাপাদিত্যের তৃতীয় পুত্র সংগ্রামাদিত্য ঘোড়াঘাটে গিয়া ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করেন, তখন নবাব ক্রোধান্ধ হইয়া যশোহর আক্রমণের জন্য ইনাএৎ খাঁকে হুকুম দিলেন, ইহা আমরা জানিয়াছি কিন্তু তৎপরে সংগ্রামাদিত্যের কি দশা হইল, তাহা জানিতে পারি নাই। সংগ্রাম বয়সে বালক এবং দূতের মত সংবাদ-বাহক, সুতরাং তাঁহাকে যে বন্দী করিয়া রাখা হইয়াছিল, এমন মনে হয় না। তাঁহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইলে, তাঁহার মুখেই প্রতাপের কাছে মোগল আক্রমণের সংবাদ পৌঁছিয়াছিল। যে ভাবে হউক, মোগল-সৈন্য পদ্মা পার হইবামাত্র, প্রতাপাদিত্য খবর পাইয়া প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। পদ্মা হইতে জলঙ্গীতে পড়িলে মোগল-বাহিনীর যশোহরে আসিবার দুইটি পথ ছিল; প্রথম, জলঙ্গী হইতে ভাগীরথীতে পড়িয়া পরে ত্রিবেণীর নিকট যমুনায় প্রবেশ করিয়া অগ্রসর হওয়া যাইত; দ্বিতীয়, জলঙ্গী হইতে ভৈরব ও মাথাভাঙ্গা বাহিয়া কৃষ্ণগঞ্জের কাছে ইচ্ছামতীতে প্রবেশ করা যাইত; পূৰ্ব্বে বলিয়াছি, মোগল সৈন্য দ্বিতীয় পথে আসিতেছিল। কিন্তু যে পথেই আসিত, যমুনা ও ইচ্ছামতীর সঙ্গমস্থল দিয়া যাইতে হইতই। এজন্য উহারই সন্নিকটে প্রতাপের পক্ষ হইতে নূতন দুর্গ রচিত হইল। ঐ সঙ্গমস্থলকে ‘টিবির মোহানা’ বলে, উহার একটু উত্তর দিকে সাখী নামক একটি নদী ইচ্ছামতী হইতে বাহির হইয়া গিয়া পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ মুখে কপোতাক্ষীতে পড়িতেছিল। রেণেলের প্রাচীন ম্যাপে উহার গতি দেখান আছে। এ নদী এক্ষণে ইচ্ছামতীর কাছে মজিয়া গেলেও কপোতাক্ষীর মোহানা হইতে অনেক দূর পর্যন্ত বেগবতী আছে। সে মোহানার অপর পারে কাটিপাড়া গ্রাম, আধুনিক ম্যাপে উহার নাম Chalkia Gang. কিন্তু সাধারণ সকল লোকে সাখী বলিয়া জানে। ইচ্ছামতীর সহিত সাখীসঙ্গমকে মুসলমান লেখক সাখাথানা বলিয়াছেন। সেই স্থানে মোগল- সৈন্যের সহিত বঙ্গীয় সেনার প্রথম সংঘর্ষ হয়।

প্রতাপাদিত্য মোগল পক্ষের যুদ্ধযাত্রার সংবাদ পাইবামাত্র নিজের সমগ্র রণবাহিনীকে প্রধানতঃ দুই ভাগে বিভক্ত করিলেন। এক ভাগ লইয়া স্বয়ং রাজধানীর রক্ষার্থ ধুমঘাট দুর্গে রহিলেন, অপরভাগ লইয়া জ্যৈষ্ঠ পুত্র উদয়াদিত্যকে অগ্রবর্ত্তী হইয়া সাখার থানার কাছে শত্রু- পথে বাধা দিবার জন্য পাঠাইয়া দিলেন। উদয়াদিত্যের অধীন ৫০০ রণতরী, ৪০টি হস্তী, এক সহস্র অশ্বারোহী এবং কয়েক সহস্র ঢালী বা পদাতিক সৈন্য সাখার মোহানায় পৌঁছিল। এই সময়ে যুবরাজ উদয়াদিত্য বয়স্ক যুবক (তাঁহার বয়স ২২/২৩), এবং তিনি চরিত্রগুণে সৰ্ব্বজনপ্রিয়। অজানিত অগণিত শত্রুসেনাকে পথের মাঝে প্রথম বাধা দেওয়াই কৃতিত্ব এবং সাহসিকতার পরিচায়ক। প্রতাপাদিত্য অপাত্রে বিশ্বাস বিন্যস্ত করিয়া নিজের পথ কণ্টকিত করেন নাই। উদয়াদিত্য যে প্রধান সেনাপতি হইয়া অগ্রসর হইলেন, বহারিস্তান তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। তাঁহার দুইজন প্রধান সহকারী ছিলেন, দুইজনই প্রসিদ্ধ বীর; খোজা কমল হইলেন নৌ-সেনার অধিনায়ক এবং কতলু খাঁর পুত্র জমাল খাঁ অশ্বারোহী ও পদাতিক প্রভৃতি স্থল-সৈন্যের ভারপ্রাপ্ত হইলেন। রণতরী সমূহ ফিরিঙ্গি ও পাঠান জাতীয় গোলন্দাজদিগের তত্ত্বাবধানে অনলবর্ষী তোপমালায় সজ্জিত ছিল। প্রতাপাদিত্য স্বয়ং অবশিষ্ট কয়েক শত রণতরী ও নানাজাতীয় সৈন্যদল লইয়া যশোহর দুর্গে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কালিদাস রায়, বিজয়রাম ভঞ্জ, বীরবল্লভ বসু প্রভৃতি সেনানীবর্গ তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। ইহা ব্যতীত কতক নৌ-বল পূৰ্ব্বদেশীয় আক্রমণ নিবারণের জন্য চাকশিরি ও কপোতাক্ষকূলে ছিল।

উদয়াদিত্য টিবির মোহানার একটু দক্ষিণ দিকে, চারঘাটের দক্ষিণে, ইচ্ছামতীর পশ্চিম পারে, ‘একটি উঁচু দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়া তাহার চারিদিকে জল দিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছিলেন।’ উহার পূৰ্ব্বপার্শ্বে ইচ্ছামতী নদী, দক্ষিণে একটি প্রশস্ত খাল এবং উত্তর পশ্চিমে ‘গভীর পরিখা কাটিয়া তাহা ঐ নদী ও খালের সঙ্গে যোগ করিয়া জলে পূর্ণ করা হইয়াছিল। প্রতাপের [উদয়ের] সৈন্য দুর্গে এবং নৌকাগুলি ইচ্ছামতীর নদীতে আশ্রয় লইয়াছিল।’[৫]

মোগলেরা সাখাতে আসিয়া যখন অদূরে প্রতাপাদিত্যের অসংখ্য রণতরণী দেখিতে পাইলেন এবং উদয়ের দুর্গ নির্মাণের সংবাদ পাইলেন, তখন অনতিবিলম্বে যুদ্ধ প্রণালী স্থির করিয়া লইলেন। “এইরূপ স্থির হইল যে, মুঘল সৈন্য নদীর দুই পাড় দিয়া কুচ করিয়া শত্রু দুর্গের দিকে অগ্রসর হইবে, মধ্যে নদী বাহিয়া নওয়ারা চলিবে এবং তীরের বন্দুক ও তোপ হইতে সাহায্য পাইবে। প্রথম দল এই পারে [ইচ্ছামতীর পূর্ব্বকূলে] প্রধান সেনাপতি ইনাএৎ খাঁর অধীনে রহিল। দ্বিতীয় দল মির্জা নথনের অধীনে রাতারাতি অপর পাড়ে (অর্থাৎ [ইচ্ছামতীর পশ্চিমতীরবর্ত্তী] দুর্গের দিকে) পার হইয়া গেল। প্রত্যেক দলের সহিত অর্থাৎ তাহা নিকটবর্ত্তী পাড় ঘেষিয়া, নওয়ারার এক এক অংশও চলিতে থাকিবে।

“পরদিন কুচ আরম্ভ হইল। কিন্তু উদয়াদিত্য যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হইলেন না। মুঘল সেনাপতিদ্বয় প্রত্যেকে দশখানা নৌকা পাহারার জন্য অগ্রে রাখিয়া, অপর নৌকাগুলোর মাল্লাদিগকে হুকুম দিলেন যে, তাহারা নামিয়া শত্রু দুর্গের পাশে [ইচ্ছামতীর পূর্ব্ব ও পশ্চিম তীরে] দুইটি দুর্গ নির্মাণ করুক। এই কাজ অর্দ্ধেক হইয়াছে, এমন সময়ে উদয়াদিত্য হঠাৎ নৌ-বল লইয়া বাহির হইয়া আসিয়া আক্রমণ করিলেন। খোজা কমল তাঁহার অগ্রবর্ত্তী বিভাগের সেনাপতি, এবং ঐ খোজার সঙ্গে অনেক বেপারি, কোশা, ভলিয়া,[৬] পাল, ঘুরাব (floating battery, gun-boat), মাচোয়া, পশতা ও জলিয়া (galliot) জাতীয় নৌকা ছিল। [আমরা এই সকল নৌকার যথা সম্ভব বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি, ২০শ পরিচ্ছেদ। এখানে শুধু তৎকালের সৰ্ব্বপ্রধান যুদ্ধ জাহাজ ঘুরাব এবং দ্রুতগামী ‘বলিয়া’ বা ভাউলিয়া জাতীয় ক্ষুদ্র তরণীর ছবি দেওয়া গেল।] অপর নৌকাগুলো কেন্দ্রে উদয়ের অধীনে চলিল। জমাল খাঁ পদাতিক ও হাতী লইয়া দুর্গ রক্ষা করিতে থাকিলেন।[৭] মহাশব্দে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অপর মুঘল নৌকা সাজিতে ও আসিতে দেরি হইল। ইতিমধ্যে সমস্ত শত্রু-আক্রমণের চাপ ঐ বিশখানি বাদশাহী নৌকার উপর পড়িল। কিন্তু তাহারা জীবন তুচ্ছ করিয়া যুঝিল, মুখ ফিরাইল না।”

“খোজা কমলের ঘুরাবগুলি এবং ২ খানা ‘পিয়ারা’ নৌকা [২০শ পরিচ্ছেদ] মিলিয়া দশ খানা বাদশাহী নৌকাকে ঘিরিয়া ইনাএৎ খাঁর দিকে [ইচ্ছামতীর পূর্ব্বতীরে] যে দুর্গ তৈয়ারি হইতেছিল, তাহার পাড়ের নীচে তাড়াইয়া[৮] লইয়া গেল। তীরস্থ মুঘল সৈন্য ঘোড়া হইতে নামিয়া তীর মারিয়া শত্রুকে দুর্ব্বল করিয়া, একখানা ‘ঘুরাব’ ও একখানা ‘পিয়ারা’ কাড়িয়া লইল। যুবরাজের সৈন্য ও মাল্লাগণ নিজ ঘুরাবগুলি নঙ্গর করিয়াছিল, এজন্য[৯] তাহাদের লইয়া পলাইতে পারিল না। এখন মুঘল তীরন্দাজগণের ভীষণ আক্রমণ সহ্য করিতে না পারিয়া তাহারা নৌকা ছাড়িয়া জলে ঝাঁপ দিয়া প্রাণ বাঁচাইল (অর্থাৎ এই জলযুদ্ধ স্থলসৈন্যের দ্বারা নিষ্পত্তি হইল)। নদীর অপর পাশে [পশ্চিম কূলে] মির্জা নথনের দশখানি অগ্রগামী নৌকাও শত্রুরা ঘিরিয়া ফেলিয়াছিল, কিন্তু তীর হইতে মির্জা, লক্ষ্মী রাজপুত,[১০] শাহবেগ[১১] এবং অপর নেতারা নিজ নিজ অনুচরসহ তীর চালাইয়া শত্ৰু মাল্লাদিগকে বাধা দিতে এবং পশ্চাদ্ধাবন করিতে লাগিলেন।”

“এইরূপ অগ্রসর হইয়া মির্জা নথন এরূপ স্থলে আসিয়া পৌঁছিলেন যে, খোজা কমলের নৌ- বল তাঁহার পিছনে এবং উদয়াদিত্যের নৌ-বল তাঁহার অগ্রে ও পাশে রহিল; সুতরাং অল্পক্ষণ যুদ্ধের পরই যশোহরের নওয়ারা বিশৃঙ্খল এবং মালাগণ হতভম্ব হইয়া পড়িল। যখন উদয়াদিত্যের নৌ-বাহিনীতে এই বিশৃঙ্খলা, শত্রুকে আক্রমণ করিবার এমন কি আত্মরক্ষা করিবারও শক্তি নাই, তখন এক বন্দুকের গুলিতে খোজা [ কমল] মারা গেলেন। তখন আর যুদ্ধ করিবার সাহস কাহারও রহিল না। জমাল খাঁ [তখনও] তীর হইতে নিকটবর্ত্তী মুঘলদের উপর তীর ও কামান চালাইতে লাগিলেন বটে, কিন্তু উদয় পলাইলেন।’[১৩]

এইস্থানে প্রথম যুদ্ধ শেষ হইল। অধ্যাপক সরকার মহাশয় যেরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন, গ্রীসদেশীয় ইতিহাসের সালামিশের যুদ্ধে[১৪] পারসীক নৌ-বলের মত, বাস্তবিকই যশোহরের নৌ-বাহিনীর অত্যধিক সংখ্যাই তাহার বিশৃঙ্খলা এবং পরাজয়ের কারণ হইয়াছিল। সঙ্কীর্ণ নদীর উভয় পার্শ্বস্থ উচ্চ তীরভূমি হইতে মোগল তীরন্দাজ ও বন্দুকধারিগণের অব্যর্থ লক্ষ্য বাছিয়া বাছিয়া প্রতাপের সেনানীবর্গকে শমনসদনে পাঠাইতেছিল। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি (২৭শ পরিচ্ছেদ) মোগলেরা স্থলে যেমন বলী, জলে তেমন কৌশলী নহে। সাখার যুদ্ধ নামে জলযুদ্ধ হইলে ও তাহা স্থলেই মিটিয়াছিল। স্থানের সঙ্কীর্ণতার জন্য কোন পক্ষের জলযানই নাবিকতার বাহাদুরি দেখাইতে পারে নাই। বিস্তীর্ণ নদীর প্রসারিত বক্ষে যদি বাস্তবিকই উভয় পক্ষে নৌ-যুদ্ধ হইত, তাহা হইলে মোগল পক্ষীয়েরা কিছুতেই জয়লাভ করিতে পারিত না। সর্ব্বোপরি, সেনাপতি কমল খোজার পতনে সকল আশা বিনষ্ট হইয়াছিল। তাঁহার আকস্মিক মৃত্যুই যে প্রথম যুদ্ধের পরাজয়ের কারণ, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এই নিৰ্ভীক বিমল চরিত্র পাঠান[১৫] সেনাপতি বিগত ২৫/২৬ বৎসর কাল একান্ত বিশ্বস্ত ভৃত্যের মত প্রাণপণে প্রতাপাদিত্যের সেবা করিয়াছেন। ধুমঘাট দুর্গের তিনিই প্রথম দুর্গাধ্যক্ষ, তাঁহারই নামানুসারে কপোতাক্ষী দুর্গের নাম হইয়াছিল— গড় কমলপুর। এখনও প্রতাপনগরের পার্শ্বে গড় কমলপুর নামক স্থান প্রতাপ ও কমলের অচ্ছেদ্য বন্ধনের স্মৃতি রক্ষা করিতেছে। যে কোন গুরুতর কার্য্যে কমল খোজা গিয়াছেন, তাহাতেই তিনি প্রাণান্ত পরিচ্ছেদ করিয়া জয়যুক্ত হইতেন।[১৬] কোন প্রকার স্বার্থ পিপাসা, কাপুরুষতা বা সত্যাপলাপ তাঁহার পবিত্র চরিত্রকে কলঙ্কিত করে নাই। তাঁহারই পতনে প্রতাপাদিত্যের পরাজয় হইল, যুদ্ধের সংবাদ অপেক্ষা কমলের মৃত্যুবার্তা প্রতাপের হৃদয়ে অধিকতর ব্যথা দিয়াছিল। তিনি একান্ত বিচলিত হইয়া পড়িলেন। আমরা দেখাইয়াছি, যশোরেশ্বরীর আবির্ভাবের মূল কারণ কমল খোজা। আবার রামরাম বসু প্রভৃতি তাঁহার মৃত্যু প্রসঙ্গে যশোর-রাজলক্ষ্মীর অন্তর্ধান বিষয়ক গল্পের অবতারণা করিয়াছেন।[১৭] সে গল্পের কোন মূল্য নাই থাকুক, কমলের মরণের সঙ্গে সঙ্গে যশোর-রাজ্যের শেষ পতনের পথ প্রস্তুত হইয়া রহিল।

যুদ্ধে পরাজয় হইলে এবং পরাজিত উদয় পলায়নপর হইলেও যে যুদ্ধ থামিয়া গেল, তাহা নহে। আরও কয়েক ঘণ্টা ধরিয়া পলায়নপর যশোহরের নওয়ারা এবং পশ্চাদ্ধাবনকারী মোগলদিগের নওয়ারা ও স্থল-সৈন্যের মধ্যে বিষম যুদ্ধ চলিয়াছিল। এই স্থলে বহারিস্তানের বর্ণনা হইতে সংক্ষেপ করিয়া কতকাংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“শত্রু নৌ-বলের পরাজয়ের পর সমস্ত বাদশাহী ও বাধ্য জমিদারদের নওয়ারা যশোহর- নওয়ারা লুঠ করিতে লাগিয়া গেল, আর কোন দিকে দৃষ্টি নাই, সেনাপতির কথা কেহ শুনে না। শুধু ৪ খানি কোসা ও ২ খানি অপর নৌকা উদয়ের পিছনে তাড়া করিল। উদয়ের নৌকার সঙ্গে সঙ্গে পলাইয়া যাইতেছিল এমন একখানি ‘পিয়ারা’, ৪ খানি ‘ঘুরাব’ এবং ফিরিঙ্গিপূর্ণ একখানি ‘মাচোয়া’– এই ৬ খানি নৌকা প্রভুভক্তি দেখাইয়া নঙ্গর ফেলিল এবং বাদশাহী নৌকার পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইল।… পরে যখন পাড় দিয়া মির্জা নখন ও অন্যান্য সৈন্য নিকটে পৌঁছিল এবং এই শত্রু নৌকাগুলিকে তীর চালাইয়া পরাস্ত করিল, তখন বাদশাহী পশ্চাদ্ধাবনকারী নৌকার মধ্যে ৪ খানি উহাদের লুট করিতে ব্যস্ত হইল। দুই খানি মাত্র ‘কোসা’– (মির্জা নথনের নিজস্ব নৌকা, তাহার একখানিতে মহমুদ খাঁ পানী, অপরখানিতে মির মুহম্মদ লোদী মির-বহর নেতা) – মির্জাকে দেখিয়া লজ্জার খাতিরে উদয়ের নৌকার পিছু পিছু চলিতে লাগিল। নদীকূল দিয়া মির্জা ও তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্য উদয়কে ধরিবার আশায় দৌড়াইতে লাগিলেন। শত্রু নৌকা সকলও পিছনে গুলি চালাইতে চালাইতে পলাইতে লাগিল।”

ক্রমে নদীর এক সংকীর্ণ অংশে[১৮] যখন উদয়াদিত্যের মহলগিরি তরণী প্রায় ধরা পড়িবার উপক্রম হইল, তখন তিনি উহা পরিত্যাগ করিয়া একখানি দ্রুতগামী কোসার উপর লাফাইয়া পড়িলেন[১৯] এবং কোসার প্রভুভক্ত মাল্লারা বায়ুবেগে নৌকা চালাইল। মোগল সৈন্য যুবরাজের অতুল সম্পত্তিশালিনী মহলগিরি লুঠ করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। সেই অবসরে উদয়ের প্রাণরক্ষা হইল। “মির্জা নথন দুঃখে নিজ হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে পাড় বহিয়া আরও কিছুদূর ছুটিলেন, কিন্তু সঙ্গে তাঁহার কোসা নাই, কোনই ফল হইল না। যশোহরের নৌ-বলের মধ্যে ৪২ খানি নৌকামাত্র পলাইয়া গেল, অপর সবগুলি (তোপসহ) ধরা পড়িল। উদয়ের পরাজয় দেখিয়া জমাল খাঁ হাতীগুলি সঙ্গে লইয়া দুর্গ হইতে পলাইয়া গেলেন। মির্জা নথন পরিখা পার হইয়া দুর্গে ঢুকিয়া বিজয়ের ভেরী বাজাইলেন। মুঘলগণ সেইখানেই রাত কাটাইল।”

পরদিন সেখান হইতে কুচ করিয়া ইনায়েৎ খাঁ (কয়েকদিন মধ্যে)[২০] বুড়ন দুর্গে পৌঁছিলেন। বর্তমান হাসনাবাদের দক্ষিণে যেখানে বুড়নহাটি (রেণেলের পুরাতন ১ নং ম্যাপে (Burronhutty) নামক স্থান আছে, উহাই বুড়ন দুর্গ। এখন সেখানে কোন দুর্গচিহ্ন নাই এবং সুন্দরবন প্রদেশে মৃন্ময় দুর্গের চিহ্ন বেশী দিন থাকে না। বিশেষতঃ এই স্থানে নীলকরদিগের একটি কুঠি স্থাপিত হইয়াছিল বলিয়া পুরাতন সকল নিদর্শন বিলুপ্ত হইয়াছে। যুদ্ধের পর মীর্জা নথন অসুস্থ হইয়া রণতরীতে শায়িত ছিলেন। তাঁহার স্থলসৈন্যগণ কুচ করিয়া পূর্ব্বেই বুড়নে পৌঁছিয়াছিল। তাঁহার পৌঁছিবার পূর্ব্বে ঐ সকল সৈন্যেরা “বুড়নে গিয়া পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি আক্রমণ করিয়া সেখান হইতে চারি হাজার কৃষক-স্ত্রী ধরিয়া আনিয়া তাহাদের দাসী করিল।”[২১] তাহাদের উপর আরও কি পাশবিক অত্যাচার করিয়াছিল, তাহা স্পষ্টতঃ বর্ণিত না হইলেও অনুমেয়। মোগল সৈন্যের গতিপথের দুইধারে এইরূপ অত্যাচারে সকল লোকে একেবারে উৎসন্ন হইয়া যাইত। এই অত্যাচার হইতে দেশের নিরীহ প্রজাকে রক্ষা করিবার জন্য প্রতাপাদিত্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন। আশ্চর্য্যের বিষয়, শুধু যে সাধারণ সৈনিকেরা সেনাপতির অজ্ঞাতসারে এইরূপ কার্য্য করিত, তাহা নহে; অনেক সময় সেনাপতিরাও অংশভাগী হইতেন। ইনায়েৎ খাঁ বাগোয়ান পৌঁছিবার সময়ে একদল সৈন্য পাঠাইয়া বাঘাগ্রাম লুঠ করাইয়াছিলেন। “বিজয়ী মোগল সেনাপতি এইস্থান হইতে কতকগুলি সুন্দরী স্ত্রীলোক ধরিয়া আনিয়া বাঁদীতে পরিণত করিল।[২২] যশোহরেও মোগলের এমন অত্যাচারের কথা আমাদিগকে পুনরায় বর্ণনা করিতে হইবে। যাহা হউক, এবার মীর্জা নথন বুড়নে পৌঁছিয়া যখন ব্যাপারটা জানিতে পারিলেন, তখন “হতভাগিনীদিগকে সেনা নিবাস হইতে খুঁজিয়া বাহির করিয়া মুক্তি দিলেন এবং যথাসাধ্য অর্থ ও বস্ত্রের সাহায্য করিয়া নিজ নিজ গ্রামে পাঠাইয়া দিলেন।”[২৩] এ ব্যবস্থা শুধু শাসন-নীতির সমর্থক নহে, ইহা মীর্জা নথনের মহত্ত্বের পরিচায়ক।

পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে, বাক্লার অধিপতি রামচন্দ্রের রাজ্য আক্রমণ করিবার জন্য সৈয়দ হকিমকে পাঠন হইয়াছিল। “তাঁহার সীমান্তের দুর্গ মুঘলেরা জয় করিয়া যখন দেশমধ্যে প্রবেশ করিল, তখন রাজমাতা পুত্রকে বলিলেন, “যদি তুই সন্ধি না করিস, আমি বিষ খাইয়া মরিব। তখন রামচন্দ্র মুঘল সেনানীর সহিত দেখা করিয়া বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ইসলাম খাঁ এই জয়- সংবাদ পাইয়া রামচন্দ্রকে ঢাকা লইয়া গিয়া নজরবন্দ করিয়া রাখিলেন এবং সৈয়দ হকিমকে হুকুম দিলেন যে, দক্ষিণ হইতে যশোহর আক্রমণ করিয়া ইনাএৎ খাঁর সাহায্য করুক। শত্রুজিৎ রামচন্দ্রকে ঢাকায় পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া যশোহর-অভিযানে যোগ দিলেন।”[২৪] সম্ভবতঃ রামচন্দ্র প্রতাপাদিত্যের জামাতা, এই কথা জানিয়া, তিনি কিছুতেই শ্বশুরকে কোন সাহায্য না করিতে পারেন, এইজন্য প্রতাপের পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত তাঁহাকে ঢাকায় আটক রাখিয়াছিলেন। তাঁহার প্রতি আর কোনও অপব্যবহার করা হয় নাই, ইহা সত্য কথা। রামচন্দ্র শীঘ্র স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া বহুদিন পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে রাজত্ব করিয়াছিলেন।

এইবার প্রতাপাদিত্য বিশেষ বিপন্ন। প্রথম যুদ্ধে তাঁহার সর্ব্বপ্রধান সেনাপতি খোজা কমল মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন; জ্যেষ্ঠ পুত্র পরাজিত হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন; তাঁহার নৌ-বলের অর্দ্ধেকের অধিক নষ্ট হইয়াছে। জমাল খাঁ যুদ্ধান্তে হস্তী ও পদাতিক সৈন্য লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন বটে, কিন্তু কতলু খাঁর বিলাসী পুত্রকে বিশ্বাস নাই। মোগল পক্ষের প্রধান সেনাপতিরা অক্ষত দেহে প্রবল সৈন্যদল ও বহুসংখ্যক রণ-তরণী লইয়া পঞ্চক্রোশী যশোহর নগরীর দ্বারদেশে দণ্ডায়মান। আবার বাকলা-বিজয়ী সৈয়দ হকিম বাহিরের পথে আসিয়া রাজধানীর পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণ হইতে শীঘ্রই আক্রমণ করিতে পারেন। শুধু তাহাই নহে, বাঙ্গালার যে সকল ভুঞা রাজার একনিষ্ঠ মাতৃভক্তির উপর নির্ভর করিয়া তিনি বঙ্গের স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাঁহারাও একে একে পরাজিত ও পদানত হইয়া পার্শ্ব পরিবর্তন পূর্ব্বক শত্রুপক্ষের বলবৃদ্ধি করিতেছেন। একক তাঁহাকে সকলের বিপক্ষে যুঝিতে হইবে। তাহা কি সম্ভবপর? অসাধ্য সাধন করিবার বয়স বা উদ্যম আর নাই। জ্ঞাতি-বিরোধ তাঁহাকে দুর্ব্বল করিয়াছে, গৃহ-শত্রুতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা তাঁহার অস্থিপঞ্জর ভাঙ্গিয়া দিতেছে। প্রচণ্ড মোগল শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিয়া আর কি তিনি জয়লাভ করিতে পারিবেন? অল্প বল লইয়া অসংখ্য শত্রু-সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে গেলে রণ-নীতি বদলাইতে হয়। তখন অব্যবস্থিত সমর-প্রণালী (Guerilla Warfare) ভিন্ন উপায়ান্তর থাকে না। কিন্তু তজ্জন্য পাৰ্ব্বত্যপ্রদেশ চাই, নিম্নবঙ্গে সুন্দরবনে তাহা হয় না। তবে উপায় কি? সময় পাইলে প্রতাপ আরও দক্ষিণে একটা স্থানে অন্য একটি দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়া সুন্দরবনের দুর্গম বনান্তরালে নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া কোন প্রকারে জীবনের অবশিষ্ট কাল যাপন করিবেন।[২৫] এজন্য কৌশলে শত্রুর সহিত সন্ধি করিয়া অন্ততঃ কিছু সময়ের ব্যবস্থা করিতে হয়। প্রতাপ তাহারও চেষ্টা করিলেন, তিনি স্বয়ং বুড়নে গিয়া ইনায়েতের নিকট সে প্রস্তাব করিলেন। মীর্জা নথনের পিতা ইত্তামাম্ খাঁর সহিত তাঁহার পূর্ব্ব পরিচয় ছিল। সে পরিচয় দিয়া মীর্জার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রস্তাব করিতেও সঙ্কুচিত হইলেন না। কিন্তু ধূর্ত মোগল সেনাপতি তাঁহার অবস্থা ও উদ্দেশ্যর গুপ্ত সংবাদ লইয়া সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিলেন। মোগল সৈন্য কুচ আরম্ভ করিল এবং “তিন দিন পরে খরাওন্যাট পৌঁছিল।” এই খরাওঘাট কোথায়?

হাসনাবাদ হইতে আরম্ভ করিয়া ঈশ্বরীপুর পর্যন্ত এখন কোন স্থানে খরাওন্যাট দেখি না। ইহা যমুনার উপর কোন পারঘাটা বা খেয়াঘাট হইতে পারে। বুড়ন দুর্গ হইতে কুচ করিয়া নিশ্চয়ই ইনায়েতের সৈন্য বসন্তপুরের অপর পারে পৌঁছিয়াছিল। পূর্ব্বে বলিয়াছি, তখনও কালিন্দী ক্ষুদ্র খাল বা সংকীর্ণ নদী মাত্র। উহা পার হইতে বিশেষ কষ্ট হয় নাই, বিশেষতঃ নওয়ারা সঙ্গেই ছিল। পরে মোগল-সৈন্য বসন্তপুর, শীতলপুর, গণপতি প্রভৃতি স্থান, অর্থাৎ মানসিংহের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে দিয়া যমুনার পশ্চিম পারে পৌঁছিল। ইহারই অপর পার হইতে মহব্বৎপুরের গড় আরম্ভ হইয়াছে (১৯শ পরিচ্ছেদ)। এই স্থানে যমুনা বাঁক ফিরিয়া ঠিক দক্ষিণ বাহিনী হইয়াছে। এই স্থানে পারের জন্য খেয়াঘাট ছিল, তাহাই বোধ হয় খরাওনঘাট।

এই স্থানে আমরা বহারিস্তানের অনুবাদের ভাষা অবিকল উদ্ধৃত না করিয়া পাঠকবর্গের বুঝিবার সুবিধার জন্য স্থানের নামগুলি আধুনিক নামের সহিত মিলাইয়া লইব। মোট বিষয়টি ঠিক মূলানুগত থাকিবে। এই প্রসঙ্গে দুই একটি কথা বলিয়া রাখা দরকার। প্রথমতঃ, মীর্জা নথন বোধ হয় নদীর বাম ও দক্ষিণ ভাগ উল্টা করিয়া লিখিয়াছেন। নদীর গতি সমুদ্রের দিকে ধরিয়া আমরা নদীর বাম দক্ষিণ ঠিক করি, কিন্তু বহারিস্তানে তাহা করা হয় নাই। হয়ত গ্রন্থকার দুর্গ হইতে উত্তরমুখী হইয়া দেখিবার বেলায় যেমন দেখিয়াছেন, সেইভাবে লিখিয়াছেন। দ্বিতীয়তঃ ধুমঘাটের নিম্নে প্রবাহিত যমুনাকে বহারিস্তানে ভাগীরথী বলা হইয়াছে এবং পূৰ্ব্বমুখে প্রবাহিত ইচ্ছামতীর বিমুক্ত ধারাকে কাগরঘাটা (রেণেলের ম্যাপে Cogregot) বলা হইয়াছে। কাগরঘাটা খাগড়াঘাট হইবে। তৃতীয়তঃ পাঠকদিগের মনে রাখিতে হইবে, টিবির মোহানায় যমুনা ও ইচ্ছামতী মিশিয়াছে এবং ধুমঘাটের নিম্নে বিমুক্ত হইয়াছে। পথে টিবি হইতে বসন্তপুর পর্যন্ত নদীর নাম ইছামতী, বসন্তপুর হইতে ধুমঘাট পর্যন্ত সেই ধারার নাম যমুনা। ‘যমুনেচ্ছা প্রসঙ্গমে’ ধুমঘাট দুর্গ স্থাপিত হয়। সেখানে যমুনা শাখা পশ্চিমমুখে এবং ইচ্ছামতী পূৰ্ব্ব মুখে গিয়া উভয়ে পরে দক্ষিণ-বাহিনী হইয়া সমুদ্রে পড়িয়াছে। রেণেলের প্রাচীন ম্যাপে (১নং) দেখিতে পাই, এই সঙ্গম স্থানের পূর্ব্বকূলে, ইচ্ছামতী নদীর উত্তর পাড়ে কাগরঘাট বা খাড়াঘাট নামক স্থান ছিল। বহারিস্তানে ইহারই নামানুসারে ইচ্ছামতীকেই ‘খাগড়াঘাটের খাল’ বলা হইয়াছে। এখন খাড়াঘাট আর একটু পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ কোণে সরিয়াছে, কিন্তু খাড়াঘাট আছে এবং তাহা “যশোরেশ্বরীর বৃত্তির অন্তর্ভূত। কিন্তু তখন নকীপুরের দক্ষিণে খাড়াঘাট ছিল।

প্রতাপাদিত্য যখন দেখিলেন, এবার মানসিংহের মত হিন্দুরাজা আসেন নাই যে তাঁহার সহিত সৌহৃদ্য হইবে; এবার আসিয়াছেন যে মোগল সেনাপতি তাঁহার সহিত কোন সন্ধির সম্ভাবনা নাই, তখন তিনি ধুমঘাটেই যুদ্ধ হইবে বলিয়া প্রস্তুত হইলেন। সন্ধির প্রস্তাবকালে ইনায়েৎ তাঁহাকে বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “আমি কুচ আরম্ভ করিয়া যশোহরে যাইব এবং তোমার অতিথি হইব। সেখানে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে।” প্রতাপ এই অতিথির সৎকারের জন্য যথাসাধ্য আয়োজন করিয়া রাখিলেন। তাঁহার দুর্গ-প্রাকারের উপর সারি সারি কামান ছিল; পরিখার বাহিরে নদী সঙ্গমের উপর প্রকাণ্ড উচ্চ বুরুজখানায় কয়েকটি প্রকাণ্ড তোপ প্রতিষ্ঠিত থাকিত, সম্মুখে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ নদীর উন্মুক্ত বক্ষ ঐ তোপ শ্রেণী অনল-বর্ষণের ক্রীড়াক্ষেত্র ছিল। ইহারই নিম্নে নদীবক্ষে কামানযুক্ত অসংখ্য রণতরী সজ্জিত হইল। ইহা ব্যতীত দুর্গমধ্যে যথেষ্ট হস্তী, পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য রহিল। এবার প্রতাপ জীবনের শেষ চেষ্টা করিবেন। সেইভাবে সৈন্য ও সেনানীবর্গকে নব বলে উৎসাহিত করিলেন। একমাত্র কথা, সকলেই যেন প্রাণপণে চেষ্টা করে, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’ ইহাই একমাত্র লক্ষ্য। ফল মানুষের হস্তে নহে। সত্যই যদি রাজ্যলক্ষ্মী যশোরেশ্বরী দেবী সন্তানের প্রতি অকৃপা করিয়া অন্তর্ধান হন, তবে রাজ্যেরই বা প্রয়োজন কি?[২৬]

তখন বৈশাখ মাস (এপ্রিল, ১৬১০) ইনায়েৎ খাঁ বুড়ন হইতে কুচ করিয়া আসিয়া দক্ষিণবাহিনী যমুনার ডান পাড়ে অর্থাৎ পশ্চিম তীরে ছিলেন। তিনি সেখান হইতে নদীতীর দিয়া দক্ষিণ মুখে সসৈন্যে কুচ আরম্ভ করিলেন। মীর্জা নথন রাত্রিতে ঝড় বৃষ্টি ও শিলা পতন অগ্রাহ্য করিয়া যমুনা পার হইয়া উহার পূর্ব্বতীরে অর্থাৎ বাম পাড়ে পৌঁছিলেন। “পরদিন প্রাতে দুই দল শত্রু-দুর্গের দিকে অগ্রসর হইল; মধ্যে বাদশাহী নওয়ারা চলিতে লাগিল। যমুনার মোহানায় যে স্থানে প্রতাপের নৌ-বল খাঁড়া ছিল, তাহারা বাদশাহী নওয়ারা ও ডাঙ্গার সৈন্যদলের গোলাগুলি সহ্য করিতে না পারিয়া দুর্গের পাশে গিয়া আশ্রয় লইল। বাদশাহী নওয়ারা মোহানা পর্যন্ত পৌঁছিয়া আর আগাইতে পারিল না, কারণ দুর্গ [ও বুরুজখানা] হইতে অজস্র অগ্নি বৰ্ষণ হইতেছিল। [যমুনার পশ্চিমবাহিনী শাখা] নদী সম্মুখে পড়ায় ইনায়েৎ খাঁ আর অগ্রসর হইতে পারিলেন না। কিন্তু মির্জা নথন, লক্ষ্মীরাজপুত ও অন্যান্য সেনানীরা [যমুনার বাম পাড় অর্থাৎ পূৰ্ব্বকূল বাহিয়া মোহানার কাছে ইচ্ছামতীর পূর্ব্বমুখী শাখা অর্থাৎ বহারিস্তানের খাগড়াঘাটের খালের] কাগরাঘাটার খালের ধার পর্যন্ত পৌঁছিয়া ঘোর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। সঙ্গে শুধু ৪০ জন অশ্বারোহী এবং ১০টি হাতী। দুর্গ হইতে গোলা বর্ষণ হইতে লাগিল; অনেক মুঘল সৈন্য মরিল কিন্তু মির্জা নথন হাতীর উপর লোহার বর্ম্ম আচ্ছাদনরূপে ফেলিয়া,[২৭] জনকত অতি সাহসী ও ভক্ত অনুচরসহ হাতীকে খালের মধ্যে নামাইয়া দিলেন। দুর্গরক্ষকগণ তাহার দিকে কামান ফিরাইল আর, সেই অবসরে মির্জা নথনের পূর্ব্ব আদেশ মত, বাদশাহী নওয়ারাও অবাধে বা অল্প বাধায় জোর করিয়া মোহানা পার হইয়া [যমুনা] নদীতে ঢুকিল এবং দুর্গের দিকে অগ্রসর হইল। শত্রু-পক্ষ দুই দিকে মন দিতে পারিল না। [বিষম যুদ্ধ বাধিল; বহুক্ষণ যুদ্ধের পর] প্রতাপের নওয়ারাও বাদশাহী নৌকার কাছে পরাস্ত হইল এবং মির্জা নথনও খাল পার হইয়া শক্ত জমিতে পৌঁছিয়া হাতী ছুটাইয়া দুর্গাদ্বারের দিকে গেলেন। বাদশাহী নৌ-বলের মধ্যভাগও সেখানে আসিয়া পৌঁছিল। মহাযুদ্ধ চলিল; হতাহতে স্তূপ গঠিত হইতে লাগিল।”[২৮] বঙ্গীয় সৈন্য বহু মূল্যে জীবন বিক্রয় করিল; যাহারা স্বচক্ষে প্রতাপের সমর-ক্রীড়া দেখিয়াছিলেন, তাহারাও বিস্ময়বিমুগ্ধ হইয়া তাঁহারা প্রশংসা করিতেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না, প্রতাপ রণভঙ্গ দিয়া দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। মীর্জা নথন তখন যুদ্ধ জয় করিয়াছেন বলিয়া নকারা ও ভেরী বাজাইলেন। যশোহরের বীর্য্য-প্রতিভা নিষ্প্রভ হইল; এইখানেই প্রতাপের রণ-নাট্যের শেষ যবনিকা পতন

পরাজিত পিতা পুত্র যশোহর-দুর্গে মিলিত হইয়া পরামর্শ করিলেন। তখন মোগলের অত্যাচার ভয়ে চারিদিকে ভীষণ হাহাকার ধ্বনি উঠিয়াছে। মাতা যশোরেশ্বরী অন্তর্ধান করিয়াছেন বলিয়া গুজব রটিয়াছে। এমন সময়ে দুৰ্দ্দৈব দেখিয়া জমাল খাঁ প্রতাপকে ছাড়িয়া খাড়াঘাটে মোগল পক্ষে যোগ দিলেন। বিশ্বাসঘাতকতার সে শেষ নির্মম দৃশ্য প্রতাপ দেখিলেন। তিনি পাঠানদিগেরই স্বত্বের দাবি লইয়া বিংশাধিক বর্ষকাল যুদ্ধ করিয়াছেন। ভাবিয়া আসিয়াছেন, মহাবীর ওসমানের মত জমাল খাঁও বুঝি পাঠানের মুখ রক্ষা করিবেন, কিন্তু সে আশাও গেল। এদিকে বালা হইতে সৈয়দ হকিমের মোগল-বাহিনী নিকটে আসিয়া পৌঁছিল। আর যুদ্ধ করিতে গেলে প্রজা রক্ষা হইবে না, সব যাইবে। সুতরাং সকলের পরামর্শ মত প্রতাপাদিত্য “আত্মসমর্পণ করাই স্থির করিলেন; নচেৎ বৃথা সৈন্য বধ হইবে এবং সমস্ত রাজ্য লুঠ হত্যা ও অত্যাচারে ছারখার হইবে।” তিনি আকবরী নীতির সহিত পরিচিত ছিলেন; বশ্যতা স্বীকার করিলে সন্ধি হইবে, ইহা নিশ্চিত জানিতেন। কিন্তু শত্রুদিগকে ছলে বলে কৌশলে যে কোন রূপে সমূলে উৎখাত করিবার যে নূতন নীতি ইসলাম খাঁ প্রবর্তিত করিতেছিলেন, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই। তাই আত্মসমর্পণের মন্ত্রণা স্থির করিলেন। যুদ্ধান্তে মোগল সৈন্যসমূহ ইচ্ছামতীর অপর পারে খাড়াঘাটে ছাউনী করিয়া রহিল। “প্রতাপ একখানি কোসায় চড়িয়া তথায় পৌঁছিলেন, সঙ্গে দুইজন মন্ত্রী। তিনি বিনীত ভাবে ইনাএৎ খাঁর তাম্বুর বাহিরে দাঁড়াইয়া সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলেন। খাঁ তাঁহাকে মান্য করিয়া ভিতরে লইয়া গেলেন এবং যথাসম্ভব ভদ্রতা করিলেন।”[২৯] এমন প্রবল শত্রুকে হস্তগত করিতে পারিলে, তাঁহার যে উন্নতির পথ সোজা হইবে, তাহা বলাই বাহুল্য।

“স্থির হইল যে বাদশাহী সৈন্য খাড়াঘাটে থাকিবে এবং ইনাএৎ খাঁ প্রতাপকে ঢাকায় সুবাদারের নিকট লইয়া যাইবেন এবং পরে তাঁহার যেরূপ আজ্ঞা, তাহাই করা যাইবে।” যাহাতে পুনরায় সন্ধি হয়, ইনায়েৎ তাহাই করিয়া দিবেন বলিয়া আশ্বাস দিলেন, নতুবা প্রতাপ সহজে দেশত্যাগ করিয়া যাইতেন না। “চতুর্থ দিবসে ৪০ খানা নৌকা লইয়া ইনাএৎ ও প্রতাপ ঢাকা রওনা হইলেন।” ইনায়েৎ প্রতাপাদিত্যের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখাইয়া উপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম সহ তাঁহাকে ঢাকায় লইয়া গেলেন। সঙ্গে আর কে কে গিয়াছিল, তাহার উল্লেখ নাই।

এদিকে জ্যৈষ্ঠমাস আসিল; বর্ষা আগতপ্রায়। এজন্য মোগল সৈন্যরা খাড়াঘাটে ইচ্ছামতীর কূল দিয়া খড়ের ও গোলপাতার বাঙ্গালা ঘর বাঁধিয়া বাস করিল। কারণ ঢাকা হইতে ইনায়েৎ খাঁ স্বয়ং বা অন্যদ্বারা সংবাদ আসিতে আসিতে বর্ষা আসিয়া পড়িবে, তখন স্থান ত্যাগ করিবার সময় থাকিবে না, অথচ এদেশে বাস করিতে হইলেও ঘরগুলি বাসোপযোগী ভাল হওয়া চাই। এজন্য সৈন্যাবাসগুলি মনোরম করিয়া প্রস্তুত করা হইল। ইনায়েৎ খাঁর অনুপস্থিতিকালে মীর্জা নথনই প্রধান সেনানী হইয়া রহিলেন। সম্ভবতঃ এই সময়েই তিনি বহারিস্তানে যুদ্ধ-বিবরণী লিখিয়াছিলেন।

প্রতাপাদিত্য ঢাকা যাইবার কালে, জ্যেষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্যকে সর্ব্বময় কর্তা করিয়া রাখিয়া গেলেন। ইসলাম খাঁ তাঁহার উপর কি ব্যবহার করিবেন তাহা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এজন্য তিনি সকলের নিকট বিদায় লইয়া গেলেন। পরিবারবর্গের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া মায়ের মন্দিরে পূজা প্রার্থনা করিলেন। সে করুণ দৃশ্য সহজে অনুমেয়, বর্ণনার আবশ্যক নাই। যদি ভাগ্যবশে তিনি না ফিরেন, তবে পরিবারবর্গের কি দশা হইবে, তাহাও যে চিন্তা করা হইল না, এমন নহে। তবে উদয়াদিত্য সকল ব্যবস্থা করিতে পারিবেন, এরূপ আশা ছিল।

যথাসময়ে ইনায়েৎ খাঁর সঙ্গে প্রতাপ ঢাকায় গিয়া পৌঁছিলেন; যথাসময়ে ইনায়েৎ খাঁর সঙ্গে গিয়া প্রতাপ নবাব ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ইনায়েতের সহিত অন্তরালে কথাবার্তা হইল, সম্ভবতঃ তিনি পূর্ব্ব প্রতিশ্রুতি মত প্রতাপের জন্য অনুরোধও করিলেন; সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধজয় প্রসঙ্গে নিজের ক্ষমতা দেখাইতে গিয়া ইনায়েৎ প্রতাপাদিত্যের অদ্ভূত রণ-কৌশলের ভূয়সী প্রশংসা না করিয়া পারিলেন না; কিন্তু তাহাতেই হয়ত কুফল হইল। নবাব কিছুতেই সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। জয়সিংহের কথামত শিবাজী যেমন আওরঙ্গজেবের আগ্রা-দরবারে গিয়া অপমানিত হইয়াছিলেন, প্রতাপের দশাও সেইরূপ হইল। “ইসলাম খাঁ প্রতাপকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখিলেন।[৩০] এবং যশোহর প্রদেশ বাদশাহী রাজ্যভুক্ত করিয়া লইলেন।[৩১] ইনাএৎ খাঁ ইহার প্রথম শাসনকর্তা হইলেন এবং বাদশাহী দেওয়ান পাঠাইয়া অনুসন্ধান করা হইল যে, প্রজাদের কষ্ট না দিয়া যশোহর হইতে কত খাজনা আদায় করা যাইতে পারে।”[৩২]

প্রতাপাদিত্য ঢাকায় যাওয়ার পর বাদশাহী সৈন্যগণ যশোহরের উপকণ্ঠে যেখানে সেখানে পড়িয়া সময় সময় প্রজাদের ঘরবাড়ী লুঠপাঠ ও সর্ব্বনাশ সাধন করিত। ভয়ে প্রজাবর্গ দেশ ছাড়িয়া যে যেখানে পারিল পলাইতেছিল। উদয়াদিত্য বড় বিপদে পড়িলেন। পিতার প্রত্যাগমন পর্যন্ত কোন প্রকারে মোগল সৈন্যদলকে নিরস্ত ও শান্ত করিয়া রাখিবার জন্য তিনি সৰ্ব্বদা চেষ্টা করিতেন। এমন কি, এজন্য তিনি অর্থ দিয়া দুর্বৃত্ত সেনানীদিগকে সন্তুষ্ট রাখিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। এই সময়ে, মোগল পক্ষীয় জনৈক সেনানী, মীর্জা মকীর সহিত যুবরাজের সদ্ভাব স্থাপিত হইয়াছিল। তাহাতে মীর্জা নথন ঈর্ষানলে জ্বলিয়া উঠিলেন। যাহা করিলেন, তাহার বর্ণনা বহারিস্তানের অনুবাদ হইতে দিতেছি; “সেই সময়ে উদয়াদিত্যের দূতগণ সন্ধি করিবার জন্য মির্জা নথনের নিকট যাতায়াত করিত। একদিন মির্জা নথন তাহাদিগকে বলিলেন, ‘তোমরা মির্জা মকীকে থলিয়া থলিয়া টাকা মোহর এবং রত্ন ও বহুমূল্য দ্রব্য উহার দিতেছ, আর আমাকে আম ও কাঁঠালের ডালি দিয়াও পুছ না! আমি কি কেহ নই? তোমাদের দেখাইতেছি আমি কে।’ সেই দিন দুপুর রাতে মির্জা নথন নিজ সৈন্য লইয়া বাহির হইলেন এবং আশপাশের গ্রামগুলিতে এইরূপ লুঠ এবং স্ত্রীলোকদিগের উপর অত্যাচার করিলেন যে যশোহর আক্রমণের প্রথম হইতে এ পর্যন্ত ইহার সমান কিছুই হয় নাই।” [বহারিস্তান, ৫৭ ক পৃষ্ঠার অনুবাদ] ইহা মীর্জা নথনের নিজের লেখা।[৩৩] এইভাবে নিরীহ প্রজার উপর, বিশেষতঃ স্ত্রীলোকের উপর যিনি বিনা কারণে অত্যাচার করিয়া সেই কথা নিজের লেখনীমুখে লোক-সমাজে ব্যক্ত করিতে পারেন, তাঁহাকে শুধু নৃশংস বলিলে চলে না। তিনি নিজের বাহাদুরী দেখাইতে গিয়া স্বজাতির মুখে কালিমা লেপন করিয়া দিয়াছেন। যাঁহার ঈর্ষা, দ্বেষ বা ক্রোধ এত অসংযত, তাঁহার লিখিত বিবরণী যে পক্ষপাতদুষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় অন্য চাক্ষুষ প্রমাণের অভাবে আমাদিগকে এ অংশে তাঁহারই উপর নির্ভর করিতে হইতেছে। তবে এমন ক্রোধান্ধ লোকের কলমে প্রতাপাদিত্যের চরিত্র বা নীতির বিরুদ্ধে একটি কথাও লিখিত হয় নাই। ইহাও প্রতাপচরিত্রের গৌরবের পূর্ণ পরিচয় দিতেছে।

অধ্যাপক সরকার মহাশয় লিখিয়াছেন, মীর্জা নথন প্রজাবর্গের প্রতি যে ভীষণ অত্যাচার করিলেন, সম্ভবতঃ তাহার ফলে “উদয়াদিত্য নিজের ও প্রজাদিগের প্রাণ ও মান বাঁচাইবার জন্য আবার অস্ত্র ধরিয়াছিলেন।” ঐতিহাসিকের এই অনুমানই সমীচীন বলিয়া বোধ হয়। নকীপুরের উত্তর দিকে ও মৌতলার পূর্ব্বভাগে একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তরের নাম কুশলীর মাঠ।[৩৪] ঐস্থানে মোগল সৈন্যের সহিত তুমুল সংগ্রাম হইয়াছিল বলিয়া প্রবাদ আছে, এবং সেই যুদ্ধে নাকি উদয়াদিত্যের মৃত্যু হয়। কুশলীর মাঠ বহু পল্লীর মধ্যস্থানে অবস্থিত। হয়ত একদা যখন ঐ সকল পল্লীর উপর মোগল সৈন্যদল লুটপাট করিতেছিল, তখনই উদয়াদিত্য প্রজাবর্গের জাতিমান রক্ষার জন্য শত্রুদিগকে ভীমবেগে আক্রমণ করেন; তখন উক্ত কুশলী ক্ষেত্রে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়, তাহাতে তিনি জীবনাহুতি দিয়া বীর কুলের গৌরব রক্ষা করিয়াছিলেন। এই অল্প বয়স্ক যুবক স্ত্রীজাতির উপর অত্যাচার নিবারণ জন্য রণক্ষেত্রে আত্মোৎসর্গ করিয়া যে মহাপ্রাণতার পরিচয় দিয়াছেন, তাহার কোন স্মারক-লিপি থাকুক বা না থাকুক, প্রবাদপুঞ্জ চিরদিনই তাহার কল্পান্তস্থায়িনী কীৰ্ত্তির সংবাদ বহন করিবে। সত্যই কি অধঃপতিত বঙ্গদেশ প্রকৃত বীরের মহিমা কীৰ্ত্তিত ও সুরক্ষিত করিতে জানে না?[৩৫]

প্রতাপাদিত্য যে ঢাকা নগরীতে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়াছেন এবং তাঁহার উদ্ধারের আর কোন সম্ভাবনা নাই, এই নিদারুণ সংবাদ যশোহরে পৌঁছিতে না পৌঁছিতে উদয়াদিত্য চণ্ডমূর্তি ধরিয়া মোগলের উপর পতিত হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। যখন তিনি আর ফিলিলেন না, তখন যশোহর-দুর্গে হাহাকার পড়িয়া গেল। উদয়ই একমাত্র আশা ভরসা স্থল; অন্য পুত্রগুলির মধ্যে অনন্ত রায়ই একমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক। কখন কিভাবে অনন্তের জীবনান্ত হয়, জানি না; তবে মৃত্যুকালে তাঁহার একটি শিশুপুত্র মাতুলালয়ে ছিল। অন্য পুত্রগণের মধ্যে এই সময়ে কয়জন জীবিত ছিলেন, তাহা জানিবার উপায় নাই। যাহা হউক, উদয়ের মৃত্যুসংবাদ আসিবামাত্র দুর্গমধ্যে ক্রন্দনের রোল উঠিল। এইবার মোগল সৈন্য দুর্গ আক্রমণ করিয়া দখল করিয়া লইবে, লুঠপাট করিবে, আরও কত কি অত্যাচার করিবে, বলা যায় না। বিশেষতঃ শেষকালে উদয়াদিত্য যেভাবে অসংখ্য সৈন্য অসিমুখে নিক্ষেপ করিয়া গিয়াছেন, তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য যে মীর্জা নথন প্রভৃতি নৃশংসতার চরম সীমা দেখাইবেন, তাহা ভাবিয়া সকলেই ব্যাকুল হইল। কেবল প্রতাপ-মহিষী শরৎকুমারী পূর্ব্বের অভিসন্ধি অনুসারে বিপদকালে কর্তব্য স্থির করিয়া লইলেন। দুর্গের ভিতরের পরিখায় (১৬শ পরিচ্ছেদ) পূৰ্ব্ব হইতে একখানি আবৃত নৌকা প্রস্তুত ছিল। মহারাণী অন্যান্য স্ত্রী- পরিবার ও শিশু-সন্তানসহ সেই নৌকায় আরোহণ করিলেন। দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণে যেখানে ঐ খাল বাহির হইয়া গিয়াছিল, তথায় একটি গুপ্তদ্বার ছিল। উহা খুলিয়া দিলে নৌকাপথে পলায়ন করা যাইত। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ঐ ভিতরের খাল গিয়া বাহিরের যে বিস্তীর্ণ পরিখায় মিশিয়াছিল, তাহার নাম কামারখালি; উহা অল্প দূরে গিয়া যমুনায় মিশিয়াছিল। যমুনা-প্রবাহের প্রবল উচ্ছ্বাসে কামারখালি তখন প্রশস্ত নদীতে পরিণত হইয়াছিল। এখনও তাহার খাত বর্ত্তমান যমুনার খাত অপেক্ষাও প্রশস্ত আছে।

অবিলম্বে গুপ্তদ্বার উন্মোচিত হইল। রাজপরিবারবর্গের জীবনবাহিনী তরণী সেইপথে বাহিত হইয়া বাহিরে কামারখালিতে পড়িল। সেইখানে তরণীর তল-দেশ বিদীর্ণ করিয়া ডুবাইয়া দেওয়া হইল। পরিবারবর্গ ও শিশু-সন্তানসহ যশোহরের মহারাণী জাতি-মান রক্ষা করিয়া জলমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। মোগলের হস্তে সতীত্ব-ধর্ম্ম জলাঞ্জলি না দিয়া, প্রকৃত রাজপুত-ললনার মত যশোহর-পুরীর কুল-লক্ষ্মীগণ যমুনাজলে জীবনাঞ্জলী দিলেন। এইবার যশোর-রাজলক্ষ্মী প্রকৃতভাবে অন্তর্হিত হইলেন। ধুমঘাট দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণে জহর-ব্রতের চিতাচুল্লীর মত সেইস্থান এখনও প্রদর্শিত হয়। মহারাণী শরৎকুমারীর নামে এখনও তাহার নাম ‘শরৎখানর দহ’।[৩৬]

একদিক হইতে মহারাণীর তরণী বাহির হইয়া গেল, অন্যদিক হইতে অনতিবিলম্বে হল্লারবে মোগলেরা দুর্গাক্রমণ করিলেন। বিশিষ্ট বীরগণের মধ্যে যাঁহারা দুই একজন অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁহারা সে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু আর সকলেই ছিলেন প্রাণ বা ধনরত্ন লইয়া পলায়নের জন্য ব্যস্ত। সুতরাং বীরগণের স্বল্প চেষ্টায় কোন ফল হইল না। প্রবাদ আছে, গুপ্তজয় নামক প্রতাপের এক ভাগিনেয় শেষ পর্যন্ত দুর্গ রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।[৩৭] মোগলেরা দুর্গ লুণ্ঠন করিয়া তাহার অধিকাংশ ভূমিসাৎ করিলেন; যাহা অবশিষ্ট ছিল, পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক অবনমনের ফলে তাহা সব ভূগর্ভস্থ হইয়াছে, এই রূপই আমাদের বিশ্বাস। সেনানীবৃন্দের মধ্যে যাঁহারা শেষ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন, তাঁহারা ধনরত্ন বা দেববিগ্রহ যে যাহা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা লইয়া যশোহরের শ্মশান-ভূমি পরিত্যাগ করিলেন, এবং অরাজক দেশের নানাস্থানে গিয়া পরগণা দখল করিয়া বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের বংশের সহিত প্রতাপের সম্বন্ধ স্থাপিত করিতে পারিলে, দেশ যে কেমন করিয়া ‘প্রতাপময়’ হইয়াছিল, তাহা আমরা দেখিতে পারিব।

আর প্রতাপ? তিনি অনেকদিন পর্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় জাহাঙ্গীরনগরের কঠোর কারাগারের অঙ্গপুষ্টি করিয়াছিলেন। তিনি মোগলের প্রবল শত্রু এবং সে শত্রু দমন করিতে মোগলকে বহুকাল ধরিয়া বিড়ম্বিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইয়াছে— এ কথা সত্য। কিন্তু তাই বলিয়া যে বীর একজন প্রধান সেনাপতির অমায়িক ব্যবহারে ও আশ্বাস-বাক্যে প্রলুব্ধ হইয়া সন্ধির প্রত্যাশায় নিজে ঢাকা পর্যন্ত আসিয়া নবাবের সমক্ষে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন, তাঁহাকে হাতে পাইবামাত্র অবিচারে কারাগারে নিক্ষেপ করা যে ইসলাম খাঁর পক্ষে কোন ক্রমেই সমীচীন হয় নাই, তাহা সকলেই স্বীকার করিবেন। কিন্তু ইসলাম খাঁর তখন ‘মারি অরি যে প্রকারে’- নীতির অনুসরণ করিয়া আগ্রা-দরবারে খ্যাতিলাভ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। বাদশাহ জাহাঙ্গীর তখন নূরজাহানের প্রেম-লালসায় অন্য সকলদিকে নজরশূন্য; বিশেষতঃ আবুল ফজলের ভগিনীপতি ইসলাম খাঁর কার্যপ্রণালীর বিচারকও কেহ তাঁহার দরবারে ছিল না। প্রতাপকে কিছুদিন কারাগারে রাখিয়া ইসলাম খাঁ তাঁহাকে লৌহ-পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া ঢাকা হইতে নৌকা যোগে আগ্রায় প্রেরণ করিয়াছিলেন।[৩৮] কিন্তু সেখানে তিনি পৌঁছান নাই, পৌঁছিলে সে কথা ‘তুজুকে’ বা জাহাঙ্গীরের আত্মবিবরণীতে স্থান পাইত। কিন্তু তাহা নাই। সুতরাং পথে কোথায়ও প্রতাপের পরলোকপ্রাপ্তি হইয়াছিল। বিভিন্ন প্রবাদ এবং এপর্যন্ত প্রকাশিত সকল গ্রন্থ একবাক্যে সাক্ষ্য দিতেছে যে, পথে যাইতে কাশীধামে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল।[৩৯] তাহাই স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। প্রতাপের কাশীপ্রাপ্তি সম্বন্ধে কোন মতদ্বৈধ নাই। হিন্দুর চক্ষে ইহাও তাঁহার ভক্তিসাধনা ও ধর্মপ্রাণতার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সকলের ভাগ্যে কাশীতে মৃত্যু ঘটে না। কথিত হয়, তিনি নিজেই যে চৌষট্টি-যোগীনীর ঘাট বাঁধাইয়া দিয়াছিলেন, সেই ঘাটে গিয়া তাঁহার গঙ্গাস্নান করিবার প্রার্থনা মঞ্জুর হয় এবং তিনি গঙ্গাজলে দাঁড়াইয়া বা তীরে উঠিয়া ভক্ত সাধকের মত প্রাণত্যাগ করিয়া স্বর্গধামের অধিকারী হন।[৪০] এই ঘাটের উপরই তাঁহার স্বপ্রতিষ্ঠিত কালিকামূৰ্ত্তি এখনও বৰ্ত্তমান আছেন। তাঁহার পিতার প্রতিষ্ঠিত উত্তুঙ্গ দেবমন্দির তখনও কাশীর শোভাবর্দ্ধন করিতেছিল।[৪১] বিক্রমাদিত্যের পরিকল্পনায় প্রথম যশোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতাপাদিত্যের বিক্রমেই উহার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতাপের সঙ্গে সঙ্গে সে রাজ্যের বিলয় হইলেও সে বীর-পুত্রের রণ-প্রতাপের প্রতিষ্ঠা চিরকাল অক্ষুণ্ণ রহিবে। প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুতে বঙ্গাদিত্য অস্তমিত হইল। তিনিই বঙ্গের শেষ বীর।[৪২]

প্রতাপাদিত্যের চরিত্র ও উদ্দেশ্য আমরা নানা প্রসঙ্গে স্থানে স্থানে সমালোচনা করিয়াছি।[৪৩] এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। সংক্ষেপতঃ মাত্র দুই একটি কথা বলিব। প্রতাপ রাজনৈতিক জীবনে বিদ্রোহী বলিয়া ব্যাখ্যাত হন। কিন্তু অরাজকতার যুগে বিদ্রোহী কাহাকে বলিব? দেশবাসী রাজন্যবর্গ যখন আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র দণ্ডায়মান, তাহারা বিদ্রোহী, না যাহাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই এবং যাহারা পররাজ্য স্ববলে অধিকার করিবার জন্য চেষ্টিত, সেই মোগলেরা বিদ্রোহী? আত্ম-রক্ষায় প্রতাপের জীবনের আরম্ভ লবণের মর্যাদা রক্ষার জন্য পাঠানের পক্ষ সমর্থন করা সেই জীবনের পরবর্ত্তী সাধনা। দেশ তখন শতধা বিচ্ছিন্ন, মাৎস্য-ন্যায় সর্ব্বত্র বিরাজিত; তজ্জন্য শান্তি বা মতের ঐক্য কোথায়ও ছিল না। প্রতাপ বুঝিয়াছিলেন যে, আত্ম-প্রাধান্য বা একাধিপত্য স্থাপন করিতে না পারিলে শান্তি ফিরিয়া আসিবে না। এক্ষেত্রে তাঁহার বুদ্ধির ভুল হইয়াছিল কিনা, তাহা বিচারের বিষয়। তাঁহার ধারণা হইয়াছিল যে, প্রজার বলে এবং ভৌমিকগণের রাজকোষের সাহায্য-ফলে তৎকালীন দেশের শত্রু মোগলকে পরাস্ত ও দূরীভূত করিয়া স্বাধীনতা স্থাপন করা চাই।[৪৪] সেই উদ্দেশ্যে সাধন করিতে গিয়া তিনি পদে পদে অনেক ভুল করিয়াছিলেন। তেমন ভুল অনেকের হয়, সকল দেশের ইতিহাস তাহার জ্বলন্ত সাক্ষী। সেই সকল ভুল তাঁহার ধ্বংসের পথ প্রস্তুত করিয়াছিল। বসন্ত রায়ের হত্যা এই জাতীয় একটি প্রধান ভুল; তদ্দ্বারা তাঁহার চরিত্র কলঙ্কিত হইয়াছিল। ইহা হইতেই জ্ঞাতিবিরোধ ও আত্মকলহের সৃষ্টি। ‘ছিদ্রেষু অনর্থা বহুলীভবন্তি।’ যাহাদিগকে তিনি বিশ্বাস করিয়াছিলেন, সেই অনুগতদিগের বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বদেশদ্রোহিতা তাঁহাকে দুর্ব্বল করিয়া তাঁহার পতনের পথ প্রশস্ত করিয়া দিল। কারণ, তিনি যে স্বাধীনতা লাভের নতুন মন্ত্র প্রচারিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, দেশ তাহার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাঁহার সাধনার ফল চতুর্দ্দিকে বিসর্পিত হইলেও, কোথায়ও স্থায়ী হইতে পারে নাই, দেশ, কাল ও পাত্র তাঁহার আদর্শের মর্ম্ম না বুঝিয়া তাঁহার জীবনব্যাপী সাধনাকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল। মহারাষ্ট্রবীর শিবাজীর মুখে কবি বলাইয়াছেন :

“নহে বহুদিন গত, শুনি, বঙ্গদেশে
প্রতাপ আদিত্য নামে জন্মেছিল বীর,
তেজস্বী, স্বধর্ম্মনিষ্ঠ, করিলা প্রয়াস
 স্থাপিতে স্বাধীন-রাজ্য। বিপুল বিক্রমে
পরাজিল বাদশাহী সেনা বহুবার।
বিজিত বিধ্বস্ত কিন্তু হল অবশেষে;
রাজ্য-সংস্থাপন হল আকাশ-কুসুম।”[৪৫]

ইহাই প্রতাপের সংক্ষিপ্ত জীবন-কথা। তেজস্বিতা, স্বধর্ম্মনিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা স্থাপনের চেষ্টা তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু তাঁহার পতন হইল কেন, তাহাই প্রশ্ন। গুরুদেব রামদাস স্বামী তাহার উত্তর দিয়াছেন :

“বলিলে যে বঙ্গদেশী প্রতাপের কথা,
শুন গূঢ়তত্ত্ব তার। তেজোবীৰ্য্যগুণে
প্রতাপ প্রস্তুত ছিল স্বাধীনতা লাভে,
কিন্তু তা’র জাতি, দেশ না ছিল প্রস্তুত;
জ্ঞাতিবন্ধু বহু তা’র ছিল প্রতিকূল,
তাই হ’ল ব্যর্থ চেষ্টা। মূঢ় সেই নর,
দেশ, কাল, পাত্র মনে না করি’ বিচার,
একা যে ছুটিতে চায়; চরণস্খলনে
নাহি রহে কেহ ধরি’ উঠাইতে তারে॥”[৪৬]

ভাগ্যদোষে প্রতাপের চরণ স্খলিত হইয়াছিল এবং তাঁহার চেষ্টা সফল হয় নাই। চেষ্টাতেই মানুষের পুরুষকার, ফল সৰ্ব্বত্রই ভাগ্যায়ত্ত। তিনশত বর্ষ পূৰ্ব্বে প্রতাপ যে নূতন মন্ত্র উদগীত করিয়াছিলেন, এবং তাহার উদ্‌যাপনে নিজের অধঃপতিত দেশ ও জাতিকে যে বীর-ব্রতে দীক্ষিত করিয়াছেন, তজ্জন্য তাঁহার কীর্ত্তি চিরস্থায়িনী হইয়াছে। দেশবাসী তাঁহাকে চিনিবে কি?

প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত সময়ের নির্ঘণ্ট

১৫৫৬-১৬০৫ বাদশাহ আকবরের রাজত্ব।

১৫৬৩-১৫৭২ সুলেমান কররাণী বঙ্গের শাসনকৰ্ত্তা

১৫৬০-৬১ গৌড়ে প্রতাপাদিত্যের জন্ম।

১৫৭২-৭৬ দায়ুদ খাঁ রাজা ছিলেন। ১৫৭৬, আকমহল যুদ্ধ ও দায়ুদের মৃত্যু।

১৫৭৪ যশোর-রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। ১৫৭৫, গৌড়ের ধ্বংস।

১৫৭৭ যশোর রাজ্যের প্রথম সনন্দ ও বিক্রমাদিত্যের রাজত্বারম্ভ।

১৫৭৬-৭৯ হোসেনকুলি খাঁ বঙ্গের মোগল সুবাদার।

১৫৭৮ প্রতাপাদিত্যের আগ্রা গমন। ১৫৭৭-৯, টোডরমল্ল সাম্রাজ্যের উজীর।

১৫৮০ বঙ্গে জায়গীরদারদিগের বিদ্রোহ।

১৫৮০-৮২ টোডরমল্ল বঙ্গের সুবাদার। ১৫৮২, রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত।

১৫৮২ যশোর-রাজ্যের সনন্দ লইয়া প্রতাপাদিত্যের প্রত্যাগমন।

১৫৮২-৮৪ খাঁ আজম্ বঙ্গের সুবাদার।

১৫৮৩ বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু।

১৫৮৪ প্রতাপের রাজ্যাভিষেক I

১৫৮৪-৮৭ শাহবাজ খাঁ বঙ্গের সুবাদার।

১৫৮৭ ধুমঘাটে দুর্গ নির্ম্মাণ, যশোরেশ্বরীর আবির্ভাব ও উদয়াদিত্যের জন্ম।

১৫৮৯-৯৮ মানসিংহ বঙ্গের সুবাদার। ১৫৯৫, রাজমহলে রাজধানী

১৫৯২-৯৩ প্রতাপাদিত্যের উড়িষ্যাভিযান ও গোবিন্দদেব বিগ্রহাদি লইয়া প্রত্যাগমন।

১৫৯৫ বসন্ত রায় ও গোবিন্দ রায়ের হত্যা এবং হিজলী বিজয়।

১৫৯৬ বাক্‌লার কন্দর্পনারায়ণের সহিত প্রতাপাদিত্যের সন্ধি, হোসেনপুরের যুদ্ধে পাঠানের পরাজয় এবং কন্দর্পের মৃত্যু।

১৫৯৮-৯৯ মানসিংহের দাক্ষিণাত্য গমন। জগৎসিংহের মৃত্যু, বালক মহাসিংহ বঙ্গের সুবাদার।

১৫৯৯ প্রতাপাদিত্যের স্বাধীনতা ঘোষণা। খৃষ্টান পাদরীগণের আগমন। বঙ্গের প্রথম গীর্জ্জা নির্ম্মাণ। মানসিংহের প্রত্যাগমন ও সেরপুরের যুদ্ধে ওসমানের পরাজয়।

১৬০০ মানসিংহ আগ্রায় গিয়া সাত-হাজারী মন্সবদার হন এবং বহু সৈন্য লইয়া রাজমহলে আসেন।

১৬০২ রামচন্দ্রের সহিত প্রতাপ-কন্যার বিবাহ ও রামচন্দ্রের পলায়ন। কার্ভালো কর্তৃক সন্দ্বীপ অধিকার এবং দ্বিতীয় যুদ্ধে আরাকাণ রাজের পরাজয়।

১৬০৩-০৪ মানসিংহের যশোহর আক্রমণ, প্রতাপের সহিত যুদ্ধ ও সন্ধি। কেদার রায়ের হস্তে মোগল সেনানী মন্দারায় ও কিমকের পরাজয়। মানসিংহের শ্রীপুর যাত্রা। কেদারের পরাজয় ও হত্যা। সুবাদারী ত্যাগ করিয়া মানসিংহের আগ্রায় প্রত্যাগমন।

১৬০৫ আকবরের মৃত্যু ও জাহাঙ্গীরের সিংহাসন আরোহণ।

১৬০৫-০৬ আটমাসের জন্য মানসিংহ বঙ্গে পুনঃপ্রেরিত হন।

১৬০৬-০৭ কুতউদ্দীন বঙ্গের সুবাদার।

১৬০৭-০৮ জাহাঙ্গীর কুলি খাঁ বঙ্গের সুবাদার।

১৬০৮-১৩ ইসলাম খাঁ বঙ্গের সুবাদার।

১৬০৮ প্রতাপাদিত্যের সহিত ইসলাম খাঁর বজ্রপুরে সাক্ষাৎ ও সন্ধি ।

১৬০৯ ঢাকায় রাজধানী স্থাপন।

১৬০৯-১০ মোগল সেনানী ইনায়েৎ খাঁ ও মীর্জা নথন প্রতাপের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন। সালিখার যুদ্ধে উদয়াদিত্যের পরাজয় ও খোজা কমলের মৃত্যু। ধুমঘাটের নৌ-যুদ্ধে প্রতাপের পরাজয় ও ঢাকায় গমন।

১৬১০-১১ ঢাকায় বন্দী থাকিবার কিছুদিন পরে প্রতাপ পিঞ্জরাবদ্ধ হইয়া আগ্রায় প্রেরিত হন। পথে বারাণসীতে মৃত্যু। বয়স ৫০ বৎসর।

১৬১২ ওসমান খাঁর পরাজয় ও মৃত্যু।

১৬১৩ ইসলাম খাঁর মৃত্যু।

পাদটীকা :

১. ১৬০৬ খৃঃ অব্দে শেষবার মানসিংহ বঙ্গে আসিয়া যে কাশীতে পরলোকগত হইয়াছিলেন, সে কথা সত্য নহে। তাঁহার মৃত্যু আরও ৫/৭ বৎসর পরে দাক্ষিণাত্যে ঘটিয়াছিল।

২. রামরাম বসুর গ্রন্থ, ১ম সংস্করণ (১৮০১), ১৪৮-৯ পৃ; নিখিলনাথ, মূল ৬২ পৃ।

৩. ‘প্রবাসী’, ১৩২৭, কার্ত্তিক, ১-৮ পৃ; [এবং ‘শনিবারের চিঠি’, ১৩৫৫, জ্যৈষ্ঠ, ১২৭-১৪২ পৃ। এই উদ্ধৃতিতে ‘সহন’-কে ‘নথন’ করা হইল এবং অধ্যাপক সরকারের প্রথম পাঠোদ্ধারের পরিবর্তিত অংশগুলি পাদটীকায় উল্লিখিত হইল। গ্রন্থকার সতীশচন্দ্রের টিপ্পনীগুলি বড় তৃতীয় বন্ধনীতে দেওয়া হইল। পরিশিষ্ট দ্র. শি মি]

৪. সাঁইহাটির নিকটবর্ত্তী শোভনালী গ্রামে সেনাপতি বীরবল্লভের গড়কাটা বাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে। উঁহার বংশীয় বসুগণ এক্ষণে শোভনালী এবং চাঁপাফুল গ্রামে বাস করিতেছেন।

৫. এই খাল ও পরিখার খাতচিহ্ন এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। স্থানটির ‘বড়গড়িয়া’ নাম দুর্গের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়।

৬. [অধ্যাপক সরকার প্রথম (১৩২৭) পাঠে ‘বলিয়া’ উল্লেখ করেন।—শি মি]

৭. ‘প্রবাসী’র প্রবন্ধে অনেক স্থলে হয়ত অনবধানতা বশতঃ একই ব্যক্তির সম্বন্ধে ‘করিল’ ও ‘করিলেন’ এই দুই প্রকার ক্রিয়ার প্রয়োগ হইয়াছে। আমি উদ্ধৃত অংশে একটু পরিবর্তন করা সম্মানাত্মক ক্রিয়াপদই দিয়াছি।

৮. [‘তাড়াইয়া’ কথাটি প্রথম পাঠে ছিল না।—শি মি]

৯. [‘এজন্য’ কথাটি প্রথম পাঠে ছিল না।— শি মি]

১০. লক্ষ্মী রাজপুত কে, তাহা জানা যায় না। ইনি রাজপুত বংশীয় কি না, সন্দেহ স্থল। সম্ভবতঃ কুচবেহারে যে লক্ষ্মীনারায়ণ মানসিংহের সময়ে বশ্যতা স্বীকার করেন, তিনিই প্রতাপের বিপক্ষে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিলেন।

১১. শাহবেগ সম্ভবতঃ আলি খাঁ কোলাবীর পুত্র। আলি খাঁ মুনেম খাঁর অধীন সেনানী ছিলেন। See. Ain. (Blochmann), pp. 438, 442.

১২. [অধ্যাপক সরকার দ্বিতীয় পাঠে ‘ভলিয়া’ বলিয়াছেন।—শি মি

১৩. ‘প্রবাসী’, ১৩২৭, কার্ত্তিক, ৩-৪ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র.—শি মি]

১৪. এই যুদ্ধ পারস্যাধিপতি জারাক্সিসের সহিত গ্রীকদিগের হয় (৪৮০ খৃঃ পূঃ); ইহাতে গ্রীক সেনানীগণের যুদ্ধ-কৌশলে পারস্যাধিপের পরাজয় ঘটে।

১৫. ইঁহার কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি।- ১৫শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

১৬. রামরাম বসু লিখিয়াছেন, ‘প্রধান সেনাপতি কমল খোজা মুহমেল দিয়া ৭ দিন পর্য্যন্ত অনাহারে দিবারাত্রি লড়াই করিতেছিল।’ উহাতে প্রাণপণে যুদ্ধ করিবার কথাই বুঝা যায়। তবে প্রথম যুদ্ধ ৭ দিন ধরিয়া হইয়াছে কিনা সন্দেহ স্থল।- [প্রতাপাদিত্য, মূল ৬২ পৃ–শি মি]

১৭. রামরাম বসু, ১ম সং, ১৪৯-৫০ পৃ; [নিখিলনাথ, মূল ৬২-৩ পৃ। —শি মি]

১৮. [‘যে স্থলে পলায়নপর নৌকাগুলির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হইয়া পড়ে।’- Baharistan-i-Ghaubi (Borah), Vol. I, p. 129-শি মি]

১৯. বহারিস্তানের বর্ণনায় পাই যে, ‘উদয় দুই স্ত্রীর হাত ধরিয়া মহলগিরি হইতে নিজ কোসার উপর লাফাইয়া পড়িলেন।’ যদি কথা সত্য হয় (এবং অবিশ্বাস করিবারও কারণ দেখি না), তবে এই দুইটি স্ত্রী কাহারা? তাহারা কি উদয়ের বিবাহিতা স্ত্রী? তাহা বিশ্বাস হয় না। প্রথমতঃ উদয়ের দুই স্ত্রী ছিল কিনা সন্দেহ স্থল; থাকিলেও প্রতাপাদিত্যের নবযুবতী পুত্রবধূরা যে ২২ বৎসর বয়স্ক যুবক স্বামীর সহিত রণক্ষেত্রে আসিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন, ইহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। তবে এই দুই রমণী কি তাঁহার রক্ষিতা উপপত্নী? বিচিত্র নহে। তখনকার দিনে ঐশ্বর্যমণ্ডিত যোদ্ধৃ জীবনে ইহা অসম্ভব নহে। হয়ত প্রতাপ ইহার কোন সংবাদই রাখিতেন না। উপন্যাসে কিন্তু উদয়কে একটি স্ত্রৈণ যুবক বলিয়াই চিত্রিত করা হইয়াছে। যাহা হউক, চরিত্রের অধঃপতন যে রাজনৈতিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ, তাহা অস্বীকার করা যায় না।

২০. বুড়ন দুর্গ ও তাহার অবস্থান সম্বন্ধে ১৯শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। বহারিস্তানের হস্তলিখিত পুঁথিতে এই দুর্গের নাম বুড়ন ও বুধন উভয়ই পড়া যায়।

২১. [প্রথম বার অধ্যাপক সরকার ‘দাসী’র স্থলে ‘বিবস্ত্র’ লিখিয়াছিলেন। পরবর্ত্তী পাঠে (১৩৫৫) উহা ‘দাসী’ বলিয়াই নির্দ্দিষ্ট করেন। কিন্তু বহারিস্তানের পরবর্ত্তী পংক্তিতে আছে, ‘The un-godly soldiers had stripped these helpless people of all their clothings.’ – Baharistan-i-Ghaybi (Borah ), Vol. I, pp.. 130-31. —fat fal

২২. [Baharistan (Borah), Vol. I, pp. 125; ‘শনিবারের চিঠি’, ১৩৫৫, জ্যৈষ্ঠ— শি মি]

২৩. [এমন কি, মীর্জা নথন নিজস্ব বস্ত্রাদি দিয়া সাহায্য করিয়াছিলেন : ‘An no other kind of cloth was available there, Mirza Nathan gave all of them according to their need, wrappers, drawers, bed- sheets and similar wearing apparel of his own.’-Baharistan. (Borah), Vol. I, p. 131—শি মি]

২৪. ‘প্রবাসী’, ১৩২৭, কার্ত্তিক, ৫ পৃ [শনিবারের চিঠি’, ১৩৫৫, জ্যৈষ্ঠ—শি মি]। ভূষণার মুকুন্দরাম ও তৎপুত্র সত্রাজিৎ সৰ্ব্বদাই মোগল শাসকের সহিত শঠতা করিয়া নিজ নিজ ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখিতেন। শক্ত দেখিলেই পদানত হইতেন এবং ফাঁক পাইলেই মাথা তুলিতেন। এ বিদ্যায় পুত্র পিতাকে পরাজিত করিয়াছিলেন। আবদুল লতীফের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে দেখিতে পাই, সত্রাজিৎকে ‘ওরফে শাহজাদা রায়’ বলা হইয়াছে (‘প্রবাসী’, ১৩২৬, আশ্বিন, ৫৫২ পৃ)। উহা হইতে বুঝা যায়, তিনি কিরূপে মোগল প্রভুর পাদসেবী হইয়া নাম কিনিয়াছিলেন। তাঁহারই ভ্রাতা ইসলাম খাঁর নিকট প্রতাপের দরখাস্ত পেশ করিয়াছিলেন (প্রবাসী, ঐ)। তিনিই আবার রামচন্দ্রকে ঢাকায় লইয়া নবাবের নজরবন্দ রাখিয়া আসিয়া, প্রতাপের বিরুদ্ধে যশোহর যাত্রা করিলেন। এই বিষম দেশদ্রোহিতার চরম ফল পিতা পুত্র উভয়ে ভোগ করিয়াছিলেন। সত্রাজিৎই যশোহরের অন্তর্গত নবগঙ্গাতীরবর্ত্তী সত্রাজিৎপুরের ও তথাকার সিংহ-বংশের প্রতিষ্ঠাতা। স্থানান্তরে সে বংশের বিবরণ দিব।

২৫. আড়াইবাঁকীর দোয়ানিয়ার উত্তর ভাগে আধুনিক ১৭৩ নং লাটে যেখানে নৌ-সেনানীর আড্ডা ছিল (১৯শ পরিচ্ছেদ) সেইখানে প্রতাপাদিত্য নূতন দুর্গের স্থান নির্বাচন করিয়াছিলেন।

২৬. অবিলম্ব সরস্বতী মায়ের বাড়ীতে নিত্য চণ্ডী পাঠ করিতেন, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি (২৪শ পরিচ্ছেদ)। এই সময়ে একদিন চণ্ডী পাঠ কালে পর পর তিন বার দুষ্ট পাঠ মুখ হইতে বাহির হওয়ায়, তিনি প্রমাদ গণিয়া চণ্ডীপাঠ বন্ধ করিয়া উঠিলেন। স্থির করিলেন, মাতা বিমুখী হইয়াছেন, প্রতাপের আর রক্ষা নাই। তখন মায়ের অকৃপার কারণ পরীক্ষা করিবার জন্য হাত চালক দিয়া একটি শ্লোক বাহির হইল :

‘স্তম্ভস্ত্রিলোকবিজয়ী নিহতো নিশুম্ভঃ।
সংগ্রামমূৰ্দ্ধনি ময়া মহিষাসুরোঽপি।।
‘সাহহং সুরাসুরনরার্চিত পাদপদ্মা।
কীটোপমেন মনুজেন কৃতাপমানা।।

—নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৩৬৯ পৃ

কীটসম তুচ্ছ নর অর্থাৎ প্রতাপাদিত্য স্ত্রীলোকের অবমাননা করিয়া (বৃদ্ধার স্তনকর্ত্তন করিয়া) মাতাকে রুষ্ট করিয়াছিলেন। এই মাতার অকৃপাই প্রতাপের পতনের কারণ বলিয়া অনুমিত হইল।

২৭. [অধ্যাপক সরকারের দ্বিতীয় পাঠোদ্ধারে ‘হাতীর উপর লোহার বর্ম্ম আচ্ছাদনরূপে ফেলিয়া’, এই কথাগুলি নাই। মুদ্রণ প্রমাদেও ইহা বাদ পড়িতে পারে; কারণ, নদী পার হইবার বর্ণনায় ইহার উল্লেখ না থাকিলেও ঠিক তাহার পূৰ্ব্বেই আছে : “….he (Nathan) thus instructed his own fleets : ‘When I cross the canal on the back of the elephants by covering them with steel armour, you all shoot forth with your boats into the river’…’-Baharistan (Borah), Vol, I. p. 125. ইহার টিপ্পনীতে M. I. Borah লিখিয়াছেন : ‘The word in the Ms. is written hila, but the proper reading is Chilta which means a coat of mail or any armed cover- ing.’—Same, vol. II, p 822. ‘80’ স্থলে ‘২০০’ অশ্বারোহীর কথাও লিখিয়াছেন। —শি মি]

২৮. ‘প্রবাসী’, ১৩২৭ কার্ত্তিক, ৬-৭ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র. শি মি]

২৯. ‘প্রবাসী’, ঐ, ৭ পৃ।

৩০. আমরা এই স্থলে প্রমাণ স্বরূপ। ‘বহারিস্তান-ই-ঘাইবী’র প্যারি নগরে রক্ষিত পারসিক হস্তলিপির ৫৭খ পৃষ্ঠার অবিকল প্রতিকৃতি প্রকাশ করিলাম। এই পৃষ্ঠার প্রথমে, রাজা টোডর মল্লের পুত্র রাজা কল্যাণকে উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করা—কাশিম খাঁকে তথা হইতে বাদশাহের দরবারে ফিরিয়া আসিবার আজ্ঞা আছে। তাহার পর, ষষ্ঠ পংক্তি হইতে মূল ফারসীর অনুবাদ এইরূপ :

‘এখন ঘিয়াস (ইনাএৎ) খাঁর কার্য্য কলাপ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ লিখিতেছি। যশোহর হইতে রওনা হইয়া এবং পথ বিভাগগুলি দ্রুত অতিক্রম করিয়া, অতি অল্প সময়ে তিনি জাহাঙ্গীর নগর পৌঁছিয়া নিজে ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, এবং রাজা প্রতাপাদিত্যকে পদচুম্বন করাইলেন। ইসলাম খাঁ প্রতাপাদিত্যকে শৃঙ্খলের আজ্ঞা দিয়া, যশোহর দেশের নেতৃত্ব ইনাএৎ খাঁর হস্তে অর্পণ করিলেন এবং যশোহরে নিযুক্ত ওমরাহদিগকে লিখিলেন।’ [অর্থাৎ কর্ম্মচারিগণকে স্থান পরিবর্ত্তনাদির হুকুম দিলেন।]— অধ্যাপক যদুনাথ সরকার কৃত অনুবাদ। [See also, Baharistan (Borah ), Vol. I. p. 143-শি মি]

৩১. প্রতাপের দশ আনা অংশই বাদশাহী রাজ্য ভুক্ত হয়। অবশিষ্ট ছয় আনা অংশের মালিক ছিলেন, রাঘব রায় ও তাঁহার ভ্রাতা চাঁদ রায়।

৩২. ‘প্রবাসী’, কাৰ্ত্তিক, ১৩২৭, ৭ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র.―শি মি]

৩৩. [Baharistan (Borah), Vol. I, P. 142 –শি মি]

৩৪. কুশলী ক্ষেত্রে যে বহুবার রণক্রীড়া হইয়াছিল, তাহার পরিচয় আছে। ঐ মাঠে এখনও কৃষকেরা ক্ষেত্র কর্ষণ কালে গোলাগুলি পাইয়া থাকে। উহার কয়েকটি শ্রীশচন্দ্র অধিকারী মহাশয় ‘সাহিত্য পরিষদে’ উপহার দিয়াছিলেন।

৩৫. যশোহর রাজবংশীয় কেহ কেহ কুশলী ক্ষেত্রের মাঠে উদয়াদিত্যের নামে একটি স্মারক স্তম্ভ নির্ম্মাণ করিবার জন্য ইচ্ছুক আছেন। আশা করি শীঘ্রই তাঁহারা সে বিষয়ে উদ্যোগী হইয়া অগ্রসর হইবেন। পাশ্চাত্য স্বজাতি-প্রেমিকের চেষ্টায় অজ্ঞাতনামা কারাবন্দীদিগেরও জন্য গগনস্পর্শী কীৰ্ত্তিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত হয়, দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের দেশের বাদল, পুত্ত বা উদয়াদিত্যের মত বীরপুত্রের স্মৃতি রক্ষা কল্পে কোন প্রস্তর-লিপি পর্য্যন্ত নাই।

৩৬. মুসলমানেরা সম্মানিত ব্যক্তিকে যেমন খাঁ বা খান্ বলেন, সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোককে তেমনি ‘খানা’ উপাধি দেন। মহারাণী শরৎকুমারীকে মোগলেরাই সম্ভবতঃ শরৎখানা বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন।

৩৭. ‘বিশ্বকোষ’, ১২শ খণ্ড, ২৭৫ পৃ। যশোহর দুর্গের পতনের পর গুপ্তজয় নাকি পাগল অবধূতের মত দেশে দেশে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেন এবং লোকে তাঁহার উদাস প্রাণের মাতৃসঙ্গীত শুনিয়া চমকিত হইত। ‘নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, মাতুল আশ্রয়, তাহাতেও মা, করিলে নিরাশ্রয়’—ইত্যাদি দুই একটি গানের উল্লেখ এখনও লোকে করিয়া থাকে।

৩৮. ১৬১৩ খৃষ্টাব্দে ইসলাম খাঁর পুত্র হুসঙ্গ নানাজাতীয় বন্দী ও লুটের সামগ্রী লইয়া আগ্রায় আসেন, সে সঙ্গে প্রতাপ ছিলেন না।— Iqbalnama, p. 69 Tuzuk, Vol. 1, p. 269; Riaz, p. 179: ‘প্রবাসী’ ১৩২৭, কার্ত্তিক, ৭ পৃ; [পরিশিষ্ট দ্র.—শি মি]। সম্ভবতঃ প্রতাপ ১৬১১ অব্দে অন্য কাহারও সঙ্গে প্রেরিত হন। প্ৰতাপ পথে অনাহারে মরিলে ‘ঘৃতে ভাজি মানসিংহ লইল তাহারে’—ভারতচন্দ্রের ঐ উক্তি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।

৩৯. ‘অথ বৃদ্ধস্য পথিগচ্ছতঃ প্রতাপাদিত্যস্য বারাণস্যাং পঞ্চত্বমভবৎ’– ‘ক্ষিতীশবংশাবলী চরিত’।

৪০. কেহ কেহ বলেন ‘প্রতাপাদিত্য গরলগর্ভ অঙ্গুরীর লেহনে পথিমধ্যে কাশীতে আত্মহত্যা করেন।’—’কলকাতা, সেকালের ও একালের’, ৮৬ পৃ।

৪১. প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত ভদ্রকালীর কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (১৫শ পরিচ্ছেদ)। পূর্বোল্লিখিত আবদুল লতীফের ভ্রমণ কাহিনী হইতে জানিতে পারি, ‘প্রতাপাদিত্যের পিতা রাজা শ্রীহরি কাশীতে একটি অতি উচ্চ মন্দির নির্ম্মাণ করেন, উহা রাজা মানসিংহের মন্দির অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। জাহাঙ্গীর যুবরাজ অবস্থায় উহা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হুকুম দেন, কিন্তু মানসিংহের মিনতিতে মন্দিরটি রক্ষা পায়।’— ‘প্রবাসী’, ১৩২৬, আশ্বিন, ৫৫৩ পৃ [পরিশিষ্ট দ্র.-শি মি]। অধ্যাপক সরকার মহোদয় প্রতাপের পিতার নাম প্রথমে পৃথ্বী বা ভারতী পড়িয়াছিলেন, পরে আমার পত্রোত্তরে জানাইয়াছেন যে উহা ‘শ্রীহরি’ বলিয়াও পড়া যায় এবং তাহাই ঠিক। শ্রীহরির নামের পাঠান্তর সম্বন্ধে ৫ম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

৪২. প্রতাপাদিত্য, কেদার রায় ও ওসমান খাঁ এই তিন জন ভুঞাই দেশের স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধ করেন। তন্মধ্যে প্রতাপের পরাজয়ের ৬ বৎসর পূর্ব্বে কেদার রায়ের এবং তিন বৎসর পরে ওসমানের পতন হয়। ওসমানের শেষ পরাজয় পূর্ব্ববঙ্গে হইলেও তাঁহাকে উড়িষ্যার ভুঞা বলিয়া ধরাই সঙ্গত। তাহা হইলে প্রতাপাদিত্যই বঙ্গের শেষ বীর। হারাণচন্দ্র রক্ষিত প্রণীত ‘বঙ্গের শেষ বীর’, যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রণীত ‘বঙ্গের বীর পুত্র’ উভয় গ্রন্থই প্রতাপাদিত্য-বিষয়ক।

৪৩. ১৭শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

৪৪. ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’, ৫৩০-৩১ পৃ।

৪৫. কবিভূষণ যোগীন্দ্রনাথ বসু প্রণীত ‘শিবাজী’ মহাকাব্য, ১৫০ পৃ।

৪৬. ঐ, ১৬২ পৃ; এই প্রসঙ্গে আমি অন্যত্র যাহা লিখিয়াছিলাম, তাহা এস্থলে উদ্ধৃত হইবার অনুপযুক্ত নহে। ‘He ( Pratap ) began his career as a rebel, who fought for his own aggrandisement; but when he was backed by the cause of the Pathans and their military servives, he inaugurated a patriotic movement that helped him on to be the master of the situation, but the country was not ripe for such an enterprise. Pratap flourished in a rude age and had to raise up a backward people. A hard task indeed! Besides, being maddened by temporary success, he could not form any clear idea of the heavy responsibilities of the leader of a commonwealth. He committed political blunders that hastened his fall. So he failed and his cause failed too, never to rise again But the noble and unselfish aims of a patriotic leader invest his achievements with the halo of undying glory and renown.’ – [Pratapaditya, the cause he fought for, in ‘The Student’, Sept., 1915.—শি মি] কিন্তু বৈদেশিক লেখক এ কথার সমর্থন করিতে না পারিয়া লিখিয়াছিলেন : ‘He was a brave man, that is certain sure, but in my considered opinion he was a buccaneer on filibustering intent rather than a patrior actuated by motives disinterestedly pure.’ (Mr. P. Leo Faulkner in ‘Calcutta Review,’ 1920 p. 188). এই প্রশ্নের সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্যই আমার বহুবর্ষব্যাপী সন্ধানের ফল এই গ্রন্থে প্রকটিত করিয়াছি। সম্ভবতঃ অনুকূল বা বিরুদ্ধ কোন বিশিষ্ট মতই বিচার করিতে বাদ পড়ে নাই। আদ্যোপান্ত পাঠের পর পাঠকবর্গ স্বীয় স্বীয় মত স্থির করিয়া লইবেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন