সতীশচন্দ্র মিত্র
চাঁচড়ার রাজ-বংশীয়েরা বাৎস্য গোত্রীয় ‘সিংহ’ উপাধিধারী উত্তর রাঢ়ীয় কুলীন কায়স্থ। তাঁহারা মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জেমো-কান্দী হইতে এতদঞ্চলে আসেন। তাঁহাদের পূর্ব্ব ইতিহাস গৌরবময়। সংক্ষেপে সেই কথা অগ্রে বলিয়া লইব। উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থদিগের কুল-কারিকা হইতে জানা যায়, খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর শেষভাগে বাৎস্য গোত্রীয় অনাদিবর সিংহ অযোধ্যা হইতে আসিয়া উত্তর রাঢ়ের অন্তর্গত সিংহেশ্বর গ্রামে বাস করেন।[১] মোগল আমলে এই স্থান সরিফবাদ সরকারের অন্তর্ভুক্ত ফতেসিংহ পরগণা বলিয়া উল্লিখিত।[২] অনাদিবর অশেষ গুণান্বিত বলিয়া প্রশংসিত হইয়াছেন।[৩] অনাদিবর হইতে নবম পুরুষ ব্যাস সিংহ বল্লাল সেনের সহিত আহার- ব্যবহারে অস্বীকৃত হওয়ায় করাতের দ্বারা দ্বিখণ্ডিত হন। এজন্য তাঁহার নাম ‘করাতিয়া’ ব্যাস। তৎপুত্র বনমালী সিংহ বন কাটিয়া কান্দীতে বসতি করেন। বনমালীর পৌত্র বিনায়ক ঐ প্রদেশের রাজা হইয়াছিলেন। পরে রাজা বিনায়কের বংশীয় ছয় জন এবং ঘোষ বংশীয় ছয় জন, এই বার জন মাত্র উত্তর রাঢ়ীয় সমাজে মুখ্য কুলীন বলিয়া গণ্য হন। ক্রমে এই সব কুলীনগণ কান্দী, জেমো, পাঁচথুপী প্রভৃতি নানা স্থানে বিস্তৃত হইয়া পড়েন এবং এই সকল স্থান উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ সমাজের শীর্ষস্থান হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জিঝোতিয় ব্রাহ্মণ বংশীয় সবিতা রায় মানসিংহের সাহায্য জন্য পুত্রপৌত্রসহ বঙ্গে আসেন এবং কিছুদিন পরে এই ফতেসিংহ পরগণার রাজা হন।[৪] সবিতা রায় যে সকল হিন্দু মুসলমান জমিদারকে পরাজিত করিয়া ঐ পরগণা দখল করেন, তন্মধ্যে একজন কায়স্থ রাজার উল্লেখ আছে; তিনি সিংহ-বংশীয় কেহ হইতে পারেন। যাহা হউক, জেমো ও কান্দীতে সিংহবংশীয়দিগের প্রধান স্থান ছিল। পাইকপাড়ার রাজগণ কান্দীর সিংহবংশীয় এবং চাঁড়ার রাজারা জেমোর সিংহবংশীয়।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মাধো বা মাধব সিংহ জেমোতে বাস করিতেন। কথিত আছে, কয়েক বিবাহে তাঁহার ২৭ পুত্র হয়, তন্মধ্যে রাঘবরাম সিংহ একজন। রাঘবরামের দুই পুত্ৰ- জ্যেষ্ঠ যজ্ঞেশ্বর ও কনিষ্ঠ ভবেশ্বর। সম্ভবতঃ যজ্ঞেশ্বরের পূর্ব্বনাম রত্নেশ্বর। তিনি একদা কিরূপে প্রতাপাদিত্যের যজ্ঞ রক্ষা করিয়া যজ্ঞেশ্বর উপাধি পান, তাহা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (২৩ পরিচ্ছেদ)। সবিতা রায়ের ফতেসিংহ দখল করিয়া বাদশাহী সনন্দ পাইবার বহু পূর্ব্বে উভয় ভ্রাতায় চাকরীর অনুসন্ধানে বাহির হন। যজ্ঞেশ্বর বিক্রমাদিত্যের রাজসরকারে আমীন দপ্তরে মুহুরীগিরি কার্য্যারম্ভ করেন; পরে প্রতাপাদিত্যের সুনজরে পড়িয়া তাঁহার চাকরীর উন্নতি হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত প্রতাপের বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী ছিলেন। টোডরমল্লের পর যখন খাঁ আজম বঙ্গের সুবাদার হইয়া আসেন (১৮৫২), তখন ভবেশ্বর রায় বঙ্গীয় সেনা-বিভাগে কার্য্য করিতেন।[৫] খাঁ আজমের সহিত প্রতাপাদিত্যের প্রথম সংঘর্ষ হয় বলিয়া কথিত আছে; কেন হয়, তাহা জানা যায় না। ঐ সময়ে সম্ভবতঃ বসিরহাটের কাছে সংগ্রামপুরে এক যুদ্ধ হয়; সে যুদ্ধে ভবেশ্বর সিংহ বিশেষ বীরত্ব দেখাইয়া খাঁ আজমের মনস্তুষ্টি করিয়াছিলেন। খাঁ আজম সে যুদ্ধে নিহত হন – ঘটককারিকার এ উক্তি মিথ্যা। তিনি যুদ্ধের পর প্রতাপের সঙ্গে সন্ধি করেন এবং পরে বহু বর্ষ বাঁচিয়া ছিলেন। তবে বঙ্গের জলবায়ু সহ্য করিতে না পারিয়া, তিনি বৎসরাধিক কালের মধ্যে এ দেশ ত্যাগ করেন। প্রতাপাদিত্য যে ক্রমে শক্তিশালী হইয়া রাজ্যবিস্তার করিবেন, এবং সর্ব্বাগ্রে উত্তরদিকেই তাঁহার দৃষ্টি পড়িতে পারে, ইহা তিনি আশঙ্কা করিয়াছিলেন। এ নিমিত্ত তিনি প্রতাপের গতিবিধি লক্ষ্য করিবার জন্য, যশোর-রাজ্যের সীমান্তে কেশবপুরের উত্তরধারে ভবেশ্বর সিংহকে কিল্লাদার নিযুক্ত করিয়া বসাইলেন এবং ব্যয় নির্ব্বাহার্থ তাঁহাকে উহারই পার্শ্ববর্ত্তী সৈদপুর, ইমাদপুর, মুড়াগাছা ও মল্লিকপুর, এই চারিটি পরগণার জমিদারী জায়গীর স্বরূপ দিয়া বাদশাহের নিকট হইতে পরে উহার সনন্দ আনিয়া দেন (১৫৮৪)। ইহাই চাঁচড়া জমিদারীর ও ভিত্তি; তখন হইতে ভবেশ্বরের ‘মজুমদার’ উপাধি হয়। ঐ সময়ে ভবেশ্বর যেখানে আসিয়া ছাউনী করিলেন, তাহার নাম হইল— ভবহাটি, এবং যেখানে তিনি প্রথম বাস করিলেন, তাহার নাম হইল— মূলগ্রাম। এই স্থান সৈদপুর পরগণার অন্তর্গত। এখানে তাঁহার গড়কাটা বাড়ীর চিহ্ন এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। চারি বৎসর পরে এইস্থানে ভবেশ্বরের মৃত্যু হয়।
ভবেশ্বরের দুই পুত্র— মহতাবরাম বা মুকুট এবং বিনোদ সিংহ। মহতাব সাধারণতঃ মুকুটের অপভ্রংশে মটুক বলিয়া পরিচিত। পিতার মৃত্যুর পর মহতাবই কিল্লাদার হন। সুতরাং মজুমদার উপাধি ও জায়গীর তাঁহারই দখলে থাকে। বিনোদ জমিদারী পান না। তাঁহার বংশধরগণ নিকটবর্ত্তী দেবিদাসপুরে ও তথা হইতে সুখ-পুকুরিয়ার ধারে খড়িঞ্চা প্রভৃতি স্থানে বাস করেন।
প্রতাপাদিত্যের সহিত মোগল-সংঘর্ষ ক্রমে ঘনীভূত হইবার উপক্রম হইলে মহতাবরাম মূলগ্রাম ত্যাগ করিয়া ৮ মাইল উত্তরে খেদাপাড়া নামক স্থানে আসিয়া এক বিস্তীর্ণ বাওড়ের সন্নিকটে গড়-বেষ্টিত প্রকাণ্ড বাটী নির্ম্মাণ করিয়া বাস করেন। এখনও সেখানে রাজবাড়ীর ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান। মহতাবরাম সেইখানেই ছিলেন। তিনি উভয় পক্ষ ঠিক রাখিয়া চলিতেন; মোগলের জায়গীরদার হইলেও প্রতাপের সহিত তাঁহার সম্প্রীতি ছিল এবং সম্প্রীতির মূল তাঁহার জ্যেষ্ঠতাত যজ্ঞেশ্বর। যজ্ঞেশ্বর এই স্থানেই প্রথমে শ্যামরায় বিগ্রহ আনিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিগ্রহের সেবার জন্য প্রতাপ যে বিস্তীর্ণ দেবোত্তর সম্পত্তি দিয়াছিলেন, তাহা পূৰ্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে (২৩শ পরিচ্ছেদ)।
মানসিংহ যখন সসৈন্যে প্রতাপের বিরুদ্ধে আসেন, তখন মহতাবরাম তাঁহার অধিকাংশ সৈন্য লইয়া গিয়া তাঁহার সাহায্য করেন (৩০শ পরিচ্ছেদ)। মোগলের কর্মচারী হিসাবে ইহা তাঁহার কর্ত্তব্য ছিল; ভবানন্দের মত তাঁহার স্কন্ধে বিশ্বাসঘাতকতার দোষ চাপাইবার কিছুমাত্র কারণ নাই। প্রতাপের সহিত সন্ধি করিয়া যখন মানসিংহ প্রত্যাগমন করেন, সম্ভবতঃ তখনই মহতাব রাজোপাধি পান। বংশ-পরম্পরায় যেমন ক্রমে ক্রমে যশোর-রাজ্যের অধিকাংশ পরগণা মহতাবের বংশধরদিগের করায়ত্ত হইয়া পড়িতেছিল এবং নুরনগর রাজবংশের পতন হইয়া গেল, তখনই তাঁহারা ‘যশোহরের রাজা’ বলিয়া কীর্ত্তিত হইলেন। প্রতাপের পতনের পর ১৬১০ খৃষ্টাব্দে যখন ইনায়েৎ খাঁ যশোহর রাজ্যের প্রথম ফৌজদার নিযুক্ত হইলেন, তখন মহতাবরামের কিলাদার পদ আর রহিল না এবং তাঁহার নিষ্কর জায়গীরও বন্ধ হইল। তখন ইসলাম খাঁ মহতাবের জায়গীর প্রকৃতভাবে জমিদারীতে পরিণত করিয়া দিয়া তাহার রাজস্ব নির্দ্ধারিত করিয়া দিলেন। ৭ বৎসর এইভাবে রাজস্ব সরবরাহ করিয়া রাজত্ব করার পর মহতাব রায়ের মৃত্যু হয় (১৬১৯)।[৬] তিনি পৈতৃক ৪ পরগণার জমিদার ছিলেন।
মহতাব রায়ের কন্দর্প, গোপীনাথ, মধুসূদন, শ্রীরাম ও রাজারাম এই পাঁচ পুত্রের উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে কন্দর্প জ্যেষ্ঠ এবং তিনিই রাজ্যাধিকারী হন। অন্য পুত্রগণের সন্তান ছিল কিনা জানা যায় না। কন্দর্প রায় ১০২৭ হইতে ১০৬৫ সাল পর্য্যন্ত (১৬১৯-৫৮) ৩৯ বৎসর রাজত্ব করেন।[৭] তিনি পৈতৃক আমলের চারি পরগণা ব্যতীত আর পাঁচটি পরগণা নূতন লাভ করেন- দাঁতিয়া ও ইসলামাবাদ (১৬৪৩), খলিসাখালি (১৬৪৭), বাগমারা ও সাহাজাতপুর। সুতরাং তাঁহার মোট জমিদারী ৯ পরগণা। কন্দর্প রায় বাঙ্গালার সুবাদার শাহসুজার সহিত সাক্ষাৎ ও উপহার প্রদান করিয়া বর্দ্ধিত সম্পত্তির সনন্দ গ্রহণ করেন। সেই সময় হইতে নিয়ম হইয়াছিল যে, প্রত্যেক ক্ষুদ্র জমিদারকে পৃথকভাবে রাজস্ব প্রেরণ করিতে হইবে না; ঐ সকল জমিদারী নিকটবর্ত্তী একজন প্রবল জমিদারের সামিল করিয়া দেওয়া হইত, রাজস্ব তাঁহার হস্তে দিতে হইত এবং তিনি ঐ রাজস্ব নবাব সরকারে দিতেন। অনেক সময় ক্ষুদ্র জমিদারদিগের রাজস্ব বাকী পড়িলে, তিনি বাকী টাকার জন্য জমিদারী কোবলা করিয়া লইয়া নিজেই রাজস্বের সরবরাহ করিতেন। এইভাবে অনেক জমিদারী প্রবল জমিদারের হাতে আসিত। কন্দর্পের পাঁচ পরগণাও এইভাবে অর্জিত হয়।[৮]
রাজা কন্দর্প রায় খেদাপাড়া হইতে উঠিয়া আসিয়া ইমাদপুর পরগণার অন্তর্গত চাঁচড়া গ্রামে বসতি করেন। সুতরাং চাঁচড়া রাজধানীর তিনিই স্থাপয়িতা। কথিত আছে, তিনি স্বপ্নাদেশে এইস্থানে আসিয়া একটি প্রাচীন কালীতলার কাছে রাজধানীর স্থান নির্দ্ধারণ করেন।[৯] চাঁচড়া একটি সদর স্থান; উহার পার্শ্ববর্ত্তী মুড়লী প্রাচীনকাল হইতে বিখ্যাত সহর; ভৈরব তখন বেগবান প্রবল নদ; মুড়লী হইতেই খাজাহান আলির দুইটি রাস্তা পূর্ব্ব ও দক্ষিণ মুখে গিয়াছিল; এখনও চাঁচড়া হইতে খেদাপড়া দিয়া ত্রিমোহানী পর্য্যন্ত ঐ রাস্তা বর্ত্তমান আছে। ঐ রাস্তায় উত্তরমুখে আসিলে ভৈরবের অদূরে চাঁড়াই নির্ব্বাচন করিবার মত উপযুক্ত স্থান। কন্দর্প রায় যেখানে রাজধানী করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন, তাহার নিকটে চাঁদ খাঁ নামক এক মুসলমান তালুকদারের বিস্তৃত গড় বেষ্টিত বাড়ী ছিল; তিনি অবশ্য কন্দর্প রায়ের অধীন স্বত্বাধিকারী, কারণ ইমাদপুর পরগণা বহুদিন হইতে ভবেশ্বরের জমিদারীভুক্ত। কন্দর্প রায় চাঁদ খাঁকে স্থানান্তরিত করিয়া রাজধানী প্রতিষ্ঠা করিলেন। সে রাজবাটীর দৈর্ঘ্য প্রস্থ প্রত্যেক দিকে প্রায় সিকি মাইল হইবে। উহার চারি পার্শ্বে প্রায় ৫০/৬০ ফুট বিস্তৃত পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত হইল। তাহার কোন কোন অংশে এখনও জল থাকে। চাঁদ খাঁর গড়কাটা বাড়ী এখন ফলবৃক্ষের বাগান, উহার চারিধারে গড় এবং মৃত্তিকার উচ্চ ঢিপি রহিয়াছে।
প্রতাপের পতনের পর যজ্ঞেশ্বর আসিয়া মহতাবরামের সহিত যোগ দেন। তৎপূৰ্ব্বে শ্যামরায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁহার বৃত্তির মহল অধিকৃত হইয়াছিল। পূর্ব্বে বলিয়াছি, সৈদপুর প্রভৃতি চারিটি পরগণা চাকরীর জন্য ভবেশ্বরের জায়গীর; তাঁহার মৃত্যুর পর সে চাকরীতে তৎপুত্র মহতাবই বহাল হইয়াছিলেন, সুতরাং জায়গীরও তাঁহার হয়। ইসলাম খাঁ নবাবের সময় ঐ জায়গীরই জমিদারী স্বরূপ মহতাবের সম্পত্তি হইয়াছিল; সুতরাং এ সম্পত্তিতে যজ্ঞেশ্বরের কোন প্রাপ্য অংশ ছিল না। এজন্য তিনি বা তাঁহার পুত্র অংশ ভাগী হইতে পারেন নাই। তবে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রের সংসারভুক্ত ছিলেন এবং সম্ভবতঃ কন্দর্প রায় যখন চাঁড়ায় উঠিয়া আসেন, তখন যজ্ঞেশ্বর জীবিত ছিলেন। তিনি শেষ বয়সে চাঁড়া রাজবাটীতে কারুকার্য্যযুক্ত সুন্দর বাঙ্গালা মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া উহাতে তাঁহার ইষ্ট-দেবতা শ্যামরায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং জীবনের স্বল্পাবশিষ্ট কাল ধৰ্ম্মসাধনায় কাটাইয়া দেন।
এখনও শ্যামরায় বিগ্রহ আছেন, কিন্তু সে সুন্দর জোড় বাঙ্গালা নাই। বাড়ীতে পূর্ব্ব পোতার একটি আধুনিক মন্দিরে তাঁহার পূজা হয়। চাঁচড়া রাজবংশের অনেক জমিদারী হস্তচ্যুত হইয়াছে, কিন্তু প্রতাপাদিত্যের প্রদত্ত শ্যামরায়ের দেবোত্তর এখনও আছে এবং সিদ্ধ নিষ্কর স্বরূপ গভর্ণমেন্ট কর্তৃক স্বীকৃত হইয়াছে। শ্যামরায় কষ্টি পাথরের কৃষ্ণমূর্ত্তি, তৎসহ রাধিকা নাই। আজ চাঁড়া রাজবংশের হীনদশা হইলে কি হয়, শ্যামরায়ের সেবা রাজোচিত ভাবেই চলিতেছে।[১০] যজ্ঞেশ্বর এবং তাঁহার পুত্র ও পৌত্র চাঁড়াতে বাস করেন। তাঁহাদের বসতি বাটীর ভিট্টা এখনও আছে। যজ্ঞেশ্বরের প্রপৌত্র গোবিন্দ রায় চাঁচড়া ত্যাগ করিয়া লাউড়ী গ্রামে এবং তৎপুত্র রামেশ্বর সাঁড়াপোলে আসিয়া বাস করেন।[১১] যজ্ঞেশ্বরের বংশধরেরা এক্ষণে সাঁড়াপোল, খড়িঞ্চি, মগুলগাতি ও রূপদিয়া প্রভৃতি গ্রামে বাস করিতেছেন। রাজা কন্দর্প রায়ের মৃত্যুর পর, তাঁহার একমাত্র পুত্র মনোহর রায় রাজতক্তে বসেন। তিনি ১০৬৫ সাল হইতে ১১১২ সাল পৰ্য্যন্ত (১৬৫৮-১৭০৫ খৃঃ) ৪৭ বৎসর রাজত্ব করেন। তিনিই এই বংশের সর্ব্বপ্রধান ব্যক্তি, তাঁহার সময়ে এই রাজ্য উন্নতির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হয়। তিনি পৈতৃক আমলের ৯টি পরগণা ব্যতীত আর ১৫টি নূতন পরগণা অধিকৃত করেন। এই পনরটির মধ্যে রামচন্দ্রপুর (১৬৮২), চেঙ্গুটিয়া (১৬৯০), ইশপপুর (১৬৯৬) এবং মলই (১৬৯৯), এই চারিটি পরগণা খুব বড়, এবং কিসমৎ তালা, ভাটলা, শোভনা, ফলুয়া বা ফয়লা, ও শ্রীপতি কবিরাজ, এই ৫টি ক্ষুদ্র পরগণা। ইহা ছাড়া ১৬৮০ খৃষ্টাব্দে কিসমৎ কলিকাতা, পাইকান, মানপুর, শিলিমপুর, পানওয়ান বা পাওনগড় ও বোরৌ নামক ৬টি পরগণা কিছুদিনের জন্য তাঁহার হাতে আসিয়া পরে তাঁহার পুত্রের সময় বেদখল হইয়া যায়। মনোহর রায় সাবেক ৯ ও নূতন ১৫, এই মোট ২৪টি ছোট বড় পরগণার জমিদার ছিলেন। কেমন করিয়া তিনি এই সকল পরগণা হস্তগত করিলেন, তাহা বুঝিতে হইলে তাৎকালিক দেশের অবস্থার একটু পর্যালোচনা করিতে হইবে।
১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে নবাব সায়েস্তা খাঁ পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদিগকে পর্যুদস্ত ও উৎসন্ন করিয়া দেশে শান্তি আনিয়াছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বার ১৬৭৯ অব্দে ঢাকায় আসিয়া পুনরায় ১০ বৎসরকাল নির্বিবাদে শাসন করেন।
সে সময়ে দস্যুদুর্বৃত্ত কেহ মাথা উঁচু করে নাই; শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি হইয়াছিল; ঢাকার সূক্ষ্মবস্ত্র ও সায়েস্তাখানী স্থাপত্য খ্যাতিলাভ করিয়াছিল; সর্ব্বোপরি শস্যের মূল্য অত্যন্ত সুলভ হইয়াছিল, টাকায় আট মণ করিয়া চাউল বিক্রয় হইতেছিল। শান্তিসুখে ক্রীড়া কৌতুকে লোকে যুদ্ধ বিগ্রহ ভুলিয়া যাইতেছিল। ফৌজদার নুরউল্যা খাঁ কিরূপে সুখবিলাসে তৈলাক্ত নাসিকায় ঘুমাইতেছিলেন, তাহা আমরা পূর্ব্বে দেখিয়াছি। সভাসিংহের বিদ্রোহকালে স্বল্প সৈন্য সংগ্রহ করাও তাঁহার পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হইয়াছিল। ঐ নুরউল্যার সহিত মনোহর রায়ের বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল। শুধু যে মনোহরেরই সে বন্ধুত্বের প্রয়োজন, তাহা নহে; তাঁহার মত প্রবল জমিদারের সহিত সদ্ভাব না রাখিলে নুরউল্যারই তিষ্ঠিয়া থাকা দায় হইত। নুরউল্যার সাহায্যে ঢাকায় নবাব- দরবারেও মনোহরের প্রতিপত্তি হইল। নিকটবর্ত্তী সমস্ত জমিদারের মালগুজারি তাঁহার সামিল হইল। কন্দর্পের মত মনোহরও সেই সুবিধায় পরগণার পর পরগণা দখল করিতে লাগিলেন। ছোট বড় সকলকেই তাঁহার শরণাপন্ন হইতে হইত। যিনি রাজস্ব দিতে পারেন, ভালই, নতুবা মনোহর রায় ধার দিয়া সময় মত টাকা পাঠাইয়া নবাব সরকারে বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখিতেন। যাঁহারা টাকা দিতে পারিতেন না বা বিরোধ করিতেন, মনোহর নিজ হইতে তাঁহাদের টাকা দিয়া পরে নিজের নামে তাঁহাদের জমিদারীর সনন্দ লিখাইয়া লইতেন। সুতরাং যাঁহাদের সম্পত্তির উপর তাঁহার লোভ বা আক্রোশ হইত, গুপ্তভাবে তাঁহাদের সর্ব্বনাশ সাধন করাও তাঁহার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। মনোহর রায় যে সকল জমিদারী দখল করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে কোটি ন্যায়তঃ বা কোটি অন্যায় ভাবে অৰ্জ্জিত হইয়াছিল, তাহা এক্ষণে স্থির করিবার উপায় নাই। পরগণার প্রাচীন হিসাব খুলিলেই দেখা যায়, সমুদ্রে নদী পতনের মত জমিদারীগুলি মনোহরের করতলে পড়িয়াছিল। তিনিই চাঁচড়ার জমিদারীর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা।

মনোহর যেমন নানাভাবে জমিদারীর অসম্ভব আয়বৃদ্ধি করিয়াছিলেন, তেমনি রাজধানীর সৌষ্ঠববৃদ্ধি কার্য্যে, ধর্মানুষ্ঠানে এবং দানধ্যানে যথেষ্ট অর্থব্যয় করিতেন। তাঁহারই সময় হইতে মহাসমারোহে দুর্গোৎসবাদির অনুষ্ঠান আরব্ধ হয়। তিনি রাজবাটীর পার্শ্বে এক প্রকাণ্ড শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এবং উহার পার্শ্বে ‘শিবসাগর’ নামক দীঘি খনন করেন। মন্দিরটির সম্মুখভাগ প্রাচীন ধরনে নানা কারুকার্য্য-খচিত। পূর্ব্বদিকে উহার সদর, সেই দিকে দীঘি। সম্মুখে প্রাচীর গাত্রে উৎকীর্ণ আছে :
‘শাকে নাগ-শশাঙ্কর্যুস্মরে প্রাসাদ উত্তমঃ।
শ্রীমনোহর রায়েন নিরমায়ি পিণাকিনে।
শুভমস্তু শকাব্দা ১৬১৮।’
নাগ= ৮, শশাঙ্ক=১, ঋতু= ৬, স্মর (কামদেব) = ১; অঙ্কের বামা গতিতে ১৬১৮ শকাব্দা বা ১৬৯৬ খৃষ্টাব্দ হয়। এই বৎসর সর্ব্বাপেক্ষা বিস্তীর্ণ ইশপপুর পরগণা দখল করা হয়।[১২]
এই সময়ে মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায় প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠেন। যশোহর জেলার তখন তিনটি ভাগ ধরা যায় : দক্ষিণে চাঁচড়া রাজ্য, পশ্চিমে মামুদশাহী বা নলডাঙ্গা রাজ্য, উত্তর ও পূর্ব্বে ভূষণা রাজ্য, সে ভূষণার জমিদার সীতারাম, তাঁহার কথা পরে বলিব। ভৈরবনদের উত্তরাংশ প্রায় সকলই তিনি দখল করিয়া লন। সেদিকে মনোহরেরও জমিদারী ছিল; সীতারাম তাঁহার রাজস্বের দাবি করেন; চতুর মনোহর রায় উদীয়মান সীতারামের সহিত সদ্ভাব স্থাপন করেন এবং তাঁহার কন্যার বিবাহকালে সীতারামকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। উভয়েই উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ। ঐ সময়ে সীতারাম রাজ্যজয় কার্য্যে স্থানান্তরে ছিলেন এবং দুইমাস পরে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থ সসৈন্যে যশোহরের সন্নিকটে নীলগঞ্জে আসিয়া উপস্থিত হন। এই সময়কার একটি গল্প আছে। সীতারাম যখন শুনিলেন, সীতারামের আগমনের অপেক্ষা না করিয়া নির্দিষ্ট শুভদিনে বিবাহ হইয়া গিয়াছে, “তখন তিনি অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘শুভদিন! কিসের দিন আর ক্ষণ? যেদিন সীতারাম রায় পদার্পণ করিবেন, সেই দিন চাঁচড়ার শুভদিন বলিয়া গণ্য করা উচিত। ভদ্র লোককে নিমন্ত্রণ করিয়া অপমান! রাজাকে যাইয়া বল, আমাকে কর প্রদান করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করেন, নচেৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।’ চাঁড়াধিপ কর্মচারীর প্রমুখাৎ এই সংবাদ শুনিয়া কর প্রদান করিয়া সীতারামের ক্রোধাগ্নি হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন।”[১৩] এই গল্পের আবার রূপান্তরও আছে। কেহ বলেন, সীতারাম প্রবল হইয়া উঠিলে, একদা মহম্মদপুরে তাঁহার অনুপস্থিতির সুযোগ পাইয়া মনোহর ও নুরউল্যা এই দুই বন্ধুত্বে সৈন্য সহ বুনাগাতি পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হন, এবং সীতারামের দেওয়ান যদুনাথ মজুমদারের ব্যবস্থায় ব্যর্থ মনোরথ হইয়া রাত্রিযোগে পলায়ন করিয়া ফিরিয়া আসেন; তাহারই প্রতিশোধ লইবার জন্য সীতারাম ইশফপুর পরগণার কতকাংশ দখল করিয়া সসৈন্যে নীলগঞ্জে উপস্থিত হন এবং মনোহর খাজনা দিয়া বশ্যতা স্বীকার করিলে ফিরিয়া যান।[১৪] শেষোক্ত বিবরণই সত্য বলিয়া বোধ হয়, কারণ নুরউল্যার বীরত্বের কথা আমরা জানি, মনোহরের চতুরতা ভিন্ন বীরদর্পের কোন পরিচয় কখনও পাই নাই।
১৭০৫ খৃষ্টাব্দে রাজা মনোহর রায়ের মৃত্যু হয়। তাঁহার তিন পুত্র ছিল— কৃষ্ণরাম, শিবরাম ও শ্যামসুন্দর।[১৫] তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণরাম রাজ্যাধিকারী হন; শিবরাম অল্পদিন পরে অপুত্রক মারা যান; শ্যামসুন্দর রাজ্যাংশ পাইবার জন্য চেষ্টিত ছিলেন বটে, কিন্তু তখন কোন ফল হয় না। কৃষ্ণরাম পিতার মত পরাক্রান্ত এবং কৌশলী ছিলেন। তিনি ১১১৩ হইতে ১১৩৬ সাল পর্যন্ত (১৭০৫-১৭২৯ খৃঃ) ২৪ বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার সময়ে পূর্ব্বের ২৪ পরগণা ছিল এবং তিনি ২০টি নূতন পরগণা লাভ করেন।[১৬] এই মোট ৪৪ পরগণার মধ্যে ১৭১৫ হইতে ১৭২৯ খৃঃ মধ্যে ক্রমান্বয়ে কিসমত কলিকাতা, পাইকান প্রভৃতি ৬টি পরগণা বেদখল হইয়া যায়। সুতরাং অবশিষ্ট ৩৮ পরগণা তাঁহার দখলে ছিল। ইহাই রাজ্যবৃদ্ধির শেষ সীমা। মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭২২ খৃষ্টাব্দে কৃষ্ণরামকে ইশফপুর বা যশোহর জমিদারীর সনন্দ প্রদান করেন। সে সময় ২৩টি পরগণায় ১,৮৭,৭৫৪ টাকা জমা ধার্য্য হয়। কৃষ্ণরামের বাকী পরগণাগুলি ১৭২২ খৃষ্টাব্দের পর অধিকৃত হয় বলিয়া মনে করি।
রাজা কৃষ্ণরামের মৃত্যুর পর তৎপুত্র শুকদেব রায় রাজা হন (১৭২৯)। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামজীবন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। শুকদেব দুই বৎসর মাত্র ষোল আনা সম্পত্তি ভোগ করেন, পরে উহার বিভাগ হয়। মনোহর রায়ের বিধবা রাণী তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি কনিষ্ঠ পুত্র শ্যামসুন্দরের প্রতি পক্ষপাতিনী হইয়া তাঁহাকে চারি আনা সম্পত্তি দিবার জন্য শুকদেবকে বলেন, তিনি বৃদ্ধা পিতামহীর বাক্য উপেক্ষা করিতে পারিলেন না। সমস্ত সম্পত্তির বার আনা অংশ নিজের রাখিয়া অবশিষ্ট চারি আনা অংশ শ্যামসুন্দরকে প্রদান করেন। এই বার আনা অংশের ২৯ পরগণার জমিদারীর ইশফপুর বড় পরগণা বলিয়া বার আনা সম্পত্তির নামই ইশফপুর জমিদারী এবং চারি আনা অংশে সৈদপুর পরগণার প্রাধান্য অনুসারে উহাকে সৈদপুর জমিদারী বলে। শুকদেব রায় ২ বৎসর ষোল আনা এবং ১৪ বৎসর কাল বারো আনা জমিদারী ভোগ করিয়া ১৭৪৫ অব্দে পরলোকগত হন।[১৭] তখনও শ্যামসুন্দর রায় জীবিত ছিলেন। রাজা শুকদেব রায়ের রাজত্বকালে তাঁহারই আনুকূল্যে রাজবাটীর সন্নিকটে চাঁড়া-নিবাসী দুর্গারাম বা দুর্গানন্দ ব্রহ্মচারী কর্তৃক দশমহাবিদ্যা ও আরও কয়েকটি দেব বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা ও উহাদের জন্য মন্দির নিৰ্ম্মিত হয়। শুকদেব ও তাঁহার পৌত্র রাজা শ্রীকণ্ঠ রায় এই সকল দেবদেবীর সেবার জন্য যথেষ্ট নিষ্কর বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। সে কথা পরে বলিতেছি। যশোহরের সন্নিকটে এই দশমহাবিদ্যার বাটী একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান এবং ইহা হিন্দুর নিকট একটি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হইয়া রহিয়াছে।
শুকদেবের পর রাজা হন তৎপুত্র নীলকণ্ঠ। তিনি অবশ্য বার আনা সম্পত্তির মালিক। তাঁহার রাজত্বকাল ১৭৪৫-৬৪, অর্থাৎ ১৯ বৎসর। তাঁহার সময়ে শ্যামসুন্দর রায় আরও ৫ বৎসর কাল চারি আনা অংশ ভোগ করেন। ১৭৫০ অব্দে তাঁহার মৃত্যুর পর তৎপুত্র রামগোপাল রায় সম্পত্তির অধিকারী হন। তিনি আরও ৭ বৎসর কাল জীবিত থাকিয়া নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হন (১৭৫৭)। শ্যামসুন্দরের আমল হইতে এই সম্পত্তির রাজস্ব অনেক বাকী পড়ে। বর্গীর হাঙ্গামার সময়ে নবাব আলিবর্দী খাঁ সমস্ত জমিদারদিগের নিকট হইতে রাজস্ব বাদেও যুদ্ধের খরচ বাবদ যথেষ্ট টাকা আদায় করিয়া লইয়াছিলেন। এজন্য রামগোপালের ষ্টেট অত্যন্ত দায়িক হয়। তাঁহার সর্ব্বেসর্ব্বা নায়েব রঘুরাম ঘোষ উহার কোন কিনারা করিতে পারিতেছিলেন না। এই সময় বঙ্গদেশের বিষম বিপ্লবের যুগ। আলিবর্দীর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা তখন নবাব। তাঁহার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি হয়, উহা বঙ্গেতিহাসের প্রধান ঘটনা। উহারই ফলে পশালীর যুদ্ধে ইংরাজদিগের হস্তে তাঁহার পরাজয় ঘটে। তিনি রাজ্যচ্যুত হইয়া পলায়ন করিবার পর ধৃত ও নৃশংসরূপে নিহত হন। তখন মীর জাফর আলি খাঁ নবাবতক্তে বসিয়া পূর্ব্ব চক্রান্তের সর্ত্তানুসারে ইংরাজদিগের সহিত সন্ধি করেন এবং তাঁহাদিগকে তাঁহাদেরই নির্ব্বাচন মত কলিকাতার সন্নিকটবর্ত্তী ২৪টি পরগণার জমিদারী অর্পণ করেন (১৭৫৭, ২০ শে ডিসেম্বর)। ঐ সম্পত্তির মধ্যে কলিকাতার নিকটর্ত্তী কয়েকটি স্থানে হুগলীর ফৌজদার মীর্জা মহম্মদ সালাহ্-উদ্দীনের জায়গীর ছিল। সুতরাং তাঁহাকে উহার বদলে অন্যত্র সম্পত্তি দেওয়ার প্রয়োজন হইয়াছিল। এমন সময়ে রামগোপাল রায়ের মৃত্যুসংবাদ পাইয়া নবাব তাঁহার চারি আনার জমিদারী বাজেয়াপ্ত করিয়া লইয়া উহা সালাহ্-উদ্দীনের সম্পত্তিভুক্ত করিয়া দিলেন।[১৮] চাঁচড়াসংক্রান্ত প্রাচীন কাগজপত্র হইতে জানিতে পারি যে, রামগোপালের সম্পত্তির রাজস্ব ও অন্য দেনা অতিরিক্ত হইলে, তিনি ‘১১৬৪ সালে (১৭৫৭) নীলকণ্ঠ রায় মহাশয়ের নিকট ৮৭,৯৭২ টাকা ৭ আনা পণরাজী লইয়া বিক্রী কবলা করিয়া দেন। নীলকণ্ঠ রায় উক্ত ৮৭,৯৭২ টাকা ৭ আনা পণ ও ১০,০০০ টাকা সেলামি মোট ৯৭,৯৭২ টাকা ৭ আনা দিয়া উক্তি চারি আনা হিস্যা দখল করিয়া লন এবং ১১৬৫ সাল অগ্রহায়ণ মাস পর্য্যন্ত (১৭৫৭, ডিসেম্বর) তাহার দখলে ছিল। পরে হুগলীর ছলাউদ্দীন মহম্মদ খাঁ নবাব মীর জাফরআলি খাঁর আমলে উক্ত কিং পং সৈদপুর ওগয়রহ চারি আনা হিস্যা বেওয়ারিশ বলিয়া খেলাপ এজাহার করিয়া সন ১১৬৫ সালের পৌষ মাসে (১৭৫৮, জানুয়ারী) খামখা জবরদস্তি করিয়া দখল করিয়া লয়েন। সেই সময়ে উক্ত চারি আনা বাহির হইয়া যায়।’ এই বর্ণনার মধ্যে অবিশ্বাস করিবার বিশেষ কিছু নাই। সময়ের হিসাবও ঠিক আছে। সালাহ্-উদ্দীনের এই সম্পত্তির নাম সৈদপুর ষ্টেট এবং উত্তরকালে উহার মালিক হইয়াছিলেন হাজি মহম্মদ মোসীন। তিনি সমস্ত সম্পত্তি কিরূপে ধর্ম্মার্থ উৎসর্গ করিয়া অক্ষয় কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা আমরা পরবর্ত্তী পরিচ্ছেদে আলোচনা করিব।
রাজা নীলকণ্ঠের সময়ে ভাস্কর পণ্ডিত নামক দুর্দান্ত সেনানীর অধীন মারহাট্টা বা বর্গী সৈন্য বৰ্দ্ধমান অঞ্চল আক্রমণ করে। উহাকেই ‘বর্গীর হাঙ্গামা’ বলে। বর্গীর উৎপাতে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ উৎসন্ন যাইতে বসিয়াছিল। নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ প্রথমতঃ তাহাদের কিছুই করিতে পারিতে ছিলেন না। তখন ভয়ে পশ্চিম বঙ্গের সমস্ত রাজন্যবর্গ দেশ ছাড়িয়া যে যেখানে পারিলেন, পূর্ব্বাঞ্চলে আশ্রয় লইলেন। সে সময়ে বর্দ্ধমানের রাজা গঙ্গাপারে মূলাজোড়ের কাছে যেখানে গড়কাটা বাড়ী করিয়াছিলেন, তাহারই নিকটবর্ত্তী আধুনিক রেল ষ্টেশনের নাম সামনে গড় বা শ্যামনগর। শুধু সেখানে নহে, বর্দ্ধমানের রাজা নলডাঙ্গায় আসিয়া দীর্ঘকাল গড়বেষ্টিত বাটীতে বাস করিয়াছিলেন, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র কঙ্কণাকারে নদী বেষ্টিত করিয়া শিবনিবাসে দুর্গ ও বাসস্থান নির্মাণ করেন। এই সময়ে চাঁড়ার রাজা নীলকণ্ঠও আশ্রয়ের স্থান খুঁজিতেছিলেন। তখন তাঁহার দেওয়ান বাঘুটিয়া নিবাসী হরিরাম মিত্র স্বীয় কাৰ্যদক্ষতা ও চরিত্রগুণে রাজার প্রিয়পাত্র ছিলেন। রাজা তাঁহাকেই ভৈরবকূলে কোন দূরবর্তী স্থানে গড়বেষ্টিত রাজবাটী নির্ম্মাণ করিবার আদেশ দিলেন। হরিরামের নিজেরও কোন পাকা বসতিবাটী ছিল না। এজন্য রাজা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার নিজের জন্যও একটি বাড়ী প্রস্তুত করিতে বলিলেন। উভয় আদেশ সাতিশয় সত্বরতার সহিত প্রতিপালিত হইল। বাঘুটিয়ার কাছে বর্ত্তমান অভয়ানগরে হরিরামের নিজের বাড়ী এবং আরও দূরবর্তী ধুলগ্রামে সুন্দর এক রাজবাটী নির্ম্মিত হইল। সে এক যুগ ছিল; তখন দেব-মন্দিরই ছিল রাজবাটীর প্রধান সৌন্দর্য্য এবং দেব-বিগ্রহই ছিল তাহার প্রধান সম্পদ। ধুলগ্রামের বাটীতে নদীতীরে সারি সারি দ্বাদশটি শিবমন্দির এবং অভয়ানগরে নদীর অদূরে এক প্রাঙ্গণের চারিধার বেষ্টন করিয়া একাদশটি শিব-মন্দির নির্ম্মিত হইল। দেওয়ানের বাটি বলিয়া মন্দিরের সংখ্যা একটি কম। ধুলগ্রামের বাটীটি পাকা ও সুদৃঢ় প্রাচীরে বেষ্টিত; উহার সুন্দর তোরণ দ্বার এখনও বর্তমান আছে। অভয়ানগরের বাটীটির কাঁচা গাঁথুনি ছিল এবং উহা তেমন উচ্চ বা দৃঢ় প্রাচীরে বেষ্টিত ছিল না। উভয় বাটীই পরিখা-বেষ্টিত; একদিকে ভৈরব নদ ও অন্য তিন দিকে গড়খাই ছিল, এখনও তাহার খাত আছে। বাটী নির্মাণের শেষ সময়ে রাজা আসিয়া উভয় বাটী পরিদর্শন করিলেন এবং বলিয়া গেলেন যে, রাজাদিগের অস্থায়ী নিবাস তেমন ভাল হইবার প্রয়োজন নাই, অতএব দেওয়ান যেন ধুলগ্রামের বাটীতে স্থায়ীভাবে বসতি করেন এবং রাজাদিগের জন্য অভয়ানগরের বাটীই যথেষ্ট হইবে। দেশসুদ্ধ লোকে আশ্রিতপালক রাজা বাহাদুরের উদারতা দেখিয়া মোহিত হইল।[১৯]
বঙ্গের সেই ভীষণ বিপ্লব ও বিগ্রহের যুগে কোন প্রকারে আত্মরক্ষা করিয়া নীলকণ্ঠ ১৭৬৪ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর রাজা শ্রীকণ্ঠ রায় পৈতৃক রাজ্যের অধিকারী হইলেন। ইংরাজ রাজত্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় তিনিই যশোহর জেলার প্রায় এক-চতুর্থাংশের প্রধান জমিদার বলিয়া স্বীকৃত হন। আবার অল্পদিন মধ্যে তাঁহারই সময়ে সে জমিদারী বিলীন হইয়া যায়। এ দুরবস্থার কারণ কি, তাহাই আমরা সংক্ষেপে বিচার করিয়া লইব।
শুকদেব রায়ের সময় হইতে জমিদারীর আয় অপেক্ষা ব্যয় বাড়িয়াছিল। আলিবর্দ্দীর রাজত্বকালে মারহাট্টা যুদ্ধের চাঁদা ও অসংখ্য আবওয়াবের সৃষ্টি হওয়াতে রাজস্ব পরিশোধ করিতে সকল জমিদারদিগেরই প্রাণান্ত হইতেছিল। চারি আনি হিস্যার খরিদা দখল নবাব স্বীকার না করায় অনর্থক যথেষ্ট অর্থ নষ্ট হইল। জমিদারী ষোল আনা থাকিল না বটে, কিন্তু সাজসরঞ্জাম ও ধর্মানুষ্ঠানের অনেক ব্যয় পূর্ব্ববৎ চলিতেছিল। দুর্গোৎসবাদি বার মাসে তের পর্ব্ব পূর্ব্বাপেক্ষা ক্রমেই জাঁকজমকের সহিত অনুষ্ঠিত হইতেছিল। শুকদেব, নীলকণ্ঠ ও শ্রীকণ্ঠ তিনজনই অত্যন্ত ধৰ্ম্মপ্রাণ, দেবদ্বিজভক্ত ও নিষ্ঠাবান্ হিন্দু ছিলেন। তাঁহারা অসংখ্য ব্রাহ্মণ ও কর্মচারীবৃন্দকে নিষ্কর ভূমি দান, দেবমন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং তাহার সেবার জন্য যে ভাবে অপরিমিত দেবোত্তর উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন, তাহা শুনিলে বিস্মিত হইতে হয়। চাঁড়ার নিষ্কর ভোগ না করিলে ব্রাহ্মণ কিসের?—এইরূপ উক্তি ছিল। শুকদেবের সময় চাঁড়ার দশমহাবিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হন; নীলকণ্ঠের সময় অভয়ানগরের একাদশ মন্দিরের জন্য যথেষ্ট ভূমি বৃত্তি দেওয়া হয়; শ্রীকণ্ঠ দশমহাবিদ্যার সেবা ও অতিথি সৎকারের জন্য আট সহস্র টাকা আয়ের ভূসম্পত্তি দেবোত্তর করিয়া দেন; ইহা ব্যতীত বচরের রঘুনাথ ও জগন্নাথ এবং মুড়লীর রাজরাজেশ্বরী নামক কালী বিগ্রহের জন্য ৬২০০ বিঘা নিষ্কর দেওয়া হয়; ত্রিমোহানী, লাউজানি, মাগুরা, হরিহরনগর, মণিরামপুর, কালীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে মহাকালী মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা ও সেবার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা হয়।[২০] এই ভাবে অজস্র দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর ও মহাত্রাণ নিষ্কর দিতে দিতে জমিদারীর আয় অত্যন্ত কমিয়া গেল; তখনও রাজারা রাজোচিত উৎসব অনুষ্ঠান ও ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে গিয়া ক্রমে একেবারে ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়েন। ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে দেখা গেল, রাজা শ্রীকণ্ঠ রায়ের প্রকাশ্য ঋণের পরিমাণ ৩০,০০০ হাজার টাকা দাঁড়াইয়াছে। তবে যে রাজা বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা রাজস্ব দেন, তাঁহার পক্ষে এ ঋণ সামান্য বটে, কিন্তু পূর্ব্বোক্ত কারণে আয় সংক্ষেপ হওয়ায় সামান্য ঋণও ক্রমে বাড়িয়া চলিল। তিন বৎসর পরে যশোহরের কালেক্টরের রিপোর্ট হইতে জানা যায় যে জমিদারীর বেবন্দোবস্ত নিমিত্ত রাজা একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় পড়িয়াছেন। রাজা শ্রীকণ্ঠ রায় ‘কল্পতরু’ হইয়া রাজার রাজ্য লুটাইয়া দিয়াছিলেন।
এমন সময় লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্ত্তি হইল। উহাতে পুরাতন ভূম্যধিকারীর জমিদারী থাকুক বা না থাকুক, সে বিষয়ের কোন কথা নাই; রাজস্ব সংগ্রহের দিকেই প্রখর দৃষ্টি পড়িল। নব বিধানে নির্দিষ্ট দিনে কিস্তীমত খাজানা আদায় না করিলেই জমিদারী নীলামে উঠিতে লাগিল; এই ভাবে শ্রীকণ্ঠ রায়ের সম্পত্তি মধ্যে পরগণার পর পরগণা বিক্রীত হইয়া গেল। ১৭৯৬ অব্দে রাজস্ব বিভাগ হইতে মলই পরগণা বিক্রয় করিয়া বাকী ওয়াশীল করা হইল। দেনার দায়ে আদালত হইতে রসুলপুর পরগণা নীলাম হইল। পর বৎসর রাঙ্গদিয়া, রামচন্দ্রপুর, চেঙ্গুটিয়া, ইমাদপুর প্রভৃতি পরগণাগুলি বাকী খাজনায় নীলামে, সৈদপুর এবং ইশফপুরের কতকাংশ দেনার ডিক্রীতে এবং অবশেষে সাহস পরগণা খোস কোবালায় বিক্রীত হইয়া গেল। তখন রাজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া আত্মরক্ষার জন্য সদসৎ নানা উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন! তিনি ও তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোপীকণ্ঠ বা গোপীনাথ নিজেরা অবশিষ্ট কতক সম্পত্তি বাটোয়ারা করিয়া লইলেন এবং একজনের কোন অংশ বন্ধকসূত্রে বিক্রয়ের পথে উঠিলে, অন্য ভ্রাতা সরিকরূপে দাঁড়াইয়া নীলাম রদ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কতকগুলি তালুক সৃষ্টি করিয়া তাহা বন্দোবস্ত করিয়া কিছু টাকা পাইলেন এবং পরে দখল না দিয়া শেষে বাকী খাজনায় উহা বিক্রয় করিয়া লইতে লাগিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় গভর্ণমেন্ট অনেকগুলি বৃত্তি ও চাকরাণ মহল বাজেয়াপ্ত করেন; উহার জন্য গভর্ণমেন্টের নামে আদালতে নালিশ করিয়া পরাজিত হইলেন, আর লাভের মধ্যে যথোচিত অর্থদণ্ড হইল। কিন্তু মোট কথা, কোন উপায়ে কিছু রক্ষা হইল না; ১৭৯৮-৯ অব্দে সব সম্পত্তি নানা ভাবে হস্তচ্যুত হইয়া গেল।[২১] এমন সময়ে রাজা শ্রীকণ্ঠ একটি নাবালক পুত্র ও বিধবা রাখিয়া দেহত্যাগ করিলেন (১৮০২)।
তখন কোম্পানী বাহাদুর কালেক্টর সাহেবের অনুরোধে রাজপরিবারের জন্য মাসিক ২০০ টাকা বৃত্তি মঞ্জুর করিলেন। ১৮০৭ অব্দে রাণীর মৃত্যুর পর ঐ বৃত্তি ১৮৬ টাকা হইল। সে সময়ও নিঃসন্তান গোপীনাথ ভ্রাতুষ্পুত্র বাণীকণ্ঠের অভিভাবক স্বরূপে বিষয়ের তত্ত্বাবধান করিতেন। পরবৎসর সুপ্রীমকোর্টের মোকদ্দমার ফলে সৈদপুর পরগণার নীলাম রদ হওয়ায় বাণীকণ্ঠ জমিদার বলিয়া গণ্য হইলেন এবং সরকারী বৃত্তি বন্ধ হইল। কয়েক বৎসর পরে বিলাত পর্য্যন্ত আপীল করিয়া ইমাদপুর পরগণার উদ্ধার হইল। গোপীনাথ মৃত্যুর পূর্ব্বে তাঁহার সকল স্বত্ব ভ্রাতুষ্পুত্রকে লিখিয়া দিয়া যান। ১৮১৭ অব্দে তিন বৎসরের নাবালক পুত্র বরদাকণ্ঠকে রাখিয়া রাজা বাণীকণ্ঠ অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
এই সময়ে সদাশয় টুকার সাহেব (Mr. C. Tucker) যশোহরের কালেক্টর। তিনি চাঁচড়া রাজবংশের দুরবস্থা দেখিয়া বাস্তবিকই মৰ্ম্মব্যথিত হন এবং উহার কারণ নির্দ্দেশ করিতে গিয়া গভর্ণমেণ্টের শাসননীতির উপর কটাক্ষ করিতেও ছাড়েন নাই।[২২] যাহা হউক তাঁহারই চেষ্টার ফলে চাঁচড়া জমিদারী কোর্ট-অব-ওয়ার্ডসের হস্তে যায় এবং রাজপরিবারের বার্ষিক খরচের জন্য ৬,০০০ টাকা রাখিয়া অবশিষ্ট লভ্য হইতে দেনা শোধ ও জমিদারীর উন্নতিসাধনের সুব্যবস্থা হয় (১৮১৮)। কয়েক বৎসর পরে ১৮২৩ খৃষ্টাব্দে আমরা দেখিতে পাই গভর্ণর জেনারেল বাহাদুরের আদেশে ১৮১৯ অব্দের নববিধানানুসারে বে-আইনী নিলাম প্রমাণিত হওয়ায় সাহস পরগণার কতকাংশ রাজাকে প্রত্যর্পিত হয়। তদবধি পরগণা ইমাদপুর এবং সৈদপুর ও সাহসের কতকাংশ চাঁচড়া রাজের প্রধান সম্পত্তি রহিয়াছে। ১৮৩৪ অব্দে রাজা বরদাকণ্ঠ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া জমিদারী নিজ হস্তে গ্রহণ করেন এবং ৪৬ বৎসর কাল নিরুদ্বেগে সুশাসন করিয়া ১৮৮০ অব্দে পরলোক গমন করেন। রাজা বরদাকণ্ঠ সিপাহী-বিদ্রোহের সময় হস্তী ও নানাবিধ যানবাহনের সাহায্য দ্বারা রাজভক্তির পরিচয় দিয়া এবং বিভিন্ন সময়ে স্কুল, হাসপাতাল প্রভৃতি সরকারী সদনুষ্ঠানের সাহায্যকল্পে জমি ও অর্থ দান করিয়া গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে উচ্চ প্রশংসার সঙ্গে ঢাল তরবারি খেলাত এবং ‘রাজা বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেন (১৮৬৫)।[২৩]
রাজা বাহাদুরের মৃত্যুর পর তৎপুত্র রাজা জ্ঞানদাকণ্ঠ উত্তরাধিকারী হন। তিনি নিজে নিঃসন্তান। কিন্তু তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার মানদাকণ্ঠের চারি পুত্র ছিল : কুমার সতীশকণ্ঠ, যতীশকণ্ঠ, ক্ষিতীশকণ্ঠ এবং নৃপতীশকণ্ঠ। রাজা জ্ঞানদাকণ্ঠ তাঁহার জীবদ্দশায় তৃতীয় ভ্রাতুষ্পুত্র কুমার ক্ষিতীশকণ্ঠকে দত্তক পুত্র লন। রাজার মৃত্যুর পর ক্ষিতীশকণ্ঠই জমিদারীর অর্দ্ধাংশের মালিক হন এবং অপরার্দ্ধ তাঁহার অন্য তিন ভ্রাতার মধ্যে বিভক্ত হয়। এক্ষণে মাত্র জ্যেষ্ঠ রাজকুমার সতীশকণ্ঠ জীবিত আছেন। ইনি কৃতবিদ্য, সদাশয় এবং সকল সদনুষ্ঠানে উৎসাহশীল। তবে তিনিও বৎসরের অধিকাংশ সময় স্থানান্তরে বাস করেন বলিয়া চাঁড়ার রাজবাটী শ্রীভ্রষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে।
দশমহাবিদ্যা॥ দুর্গানন্দ ব্রহ্মচারীই চাঁচড়ার দশমহাবিদ্যাবাটীর মন্দির ও বিগ্রহ সমূহের প্রতিষ্ঠাতা, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। চাঁচড়া গ্রামেই রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজগোত্রীয় দুর্গারাম মুখোপাধ্যায়ের নিবাস ছিল, ব্রহ্মচারী হইলে তাঁহার নাম হয় দুর্গানন্দ। তিনি শিশুকাল হইতে ধর্মপ্রবণ ছিলেন; প্রবীণ বয়সে ব্রহ্মচারীর বেশে ভারতবর্ষের বহু তীর্থ ভ্রমণ করেন। কিন্তু কোথায়ও দেবী ভগবতীর দশবিধ মহামূর্ত্তির একত্র সমাবেশ দেখিতে পান না।[২৪] তাই তাঁহার প্রাণের এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা হয়, তাঁহার জীবনে এই সকল মহাবিদ্যার মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া যাইবেন। করুণাময়ীর কৃপাকটাক্ষে তাঁহার সাধুসংকল্প সিদ্ধ হইয়াছিল। কথিত আছে, স্বপ্নাদেশের বলে তিনি এই প্রস্তাব লইয়া মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দীন এবং চাঁড়ার রাজা শুকদেবের অনুগ্রহ লাভ করেন। একে শুকদেব ধৰ্ম্মনিষ্ঠ সদাশয় হিন্দু নৃপতি, তাহাতে নবাবের ইঙ্গিত, সুতরাং তিনি প্রতিষ্ঠার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। ব্রহ্মচারী উপযুক্ত সূত্রধর সংগ্রহ করিয়া নিজ বাটীর এক প্রকাণ্ড নিম্ব বৃক্ষের খণ্ড কাষ্ঠ হইতে বিগ্রহগুলি প্রস্তুত করাইলেন।
দশমহাবিদ্যার দশটি মাত্র বিগ্রহ নহে, মূর্ত্তির সংখ্যা তদপেক্ষা অধিক। উত্তরের পোতার প্রধান মন্দিরে পূর্ব্বদিক হইতে আরম্ভ করিয়া যথাক্রমে এই ষোলটি বিগ্রহ আছেন : গণেশ, সরস্বতী, কমলা, অন্নপূর্ণা, ভুবনেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, ষোড়শী, মহাদেব, কালী, তারা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা ও মাতঙ্গী এবং ভৈরব। পশ্চিমের মন্দিরে কৃষ্ণ, রাধিকা, রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, হনুমান এবং শীতলা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হইলেন। পূর্ব্ব পোতায় ভোগগৃহ এবং দক্ষিণে নহবৎখানা নির্ম্মিত হইল; নহবৎখানার নিম্ন দিয়া মন্দিরপ্রাঙ্গণে যাইবার সদর দ্বার। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সেবার ব্যবস্থাও হইল। শুকদেব ও শ্যামসুন্দর উভয়ে স্বীকৃত হইলেন যে, প্রত্যেকের অধিকারভুক্ত জমিদারীতে প্রত্যেক প্রজার নিকট হইতে বার্ষিক একসের চাউল ও ৫ গণ্ডা কড়ি হিসাবে আদায় করিয়া লইয়া দশমহাবিদ্যার সেবার জন্য দেওয়া হইবে। শ্যামসুন্দর ও তাঁহার পুত্রের মৃত্যুর পর চারি আনি অংশ মীর্জা সালাহ্ উদ্দীনের হস্তে গেলে, তিনিও অধিকদিন জীবিত ছিলেন না। তৎপত্নী মণুজান খানম্ সম্পত্তির অধিকারিণী হইলে, ১১৭৭ সালে তিনিও উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। চারি আনি অংশের দেয় বৃত্তি বার্ষিক ৩৫১ টাকা স্থির হয়; উহা ১২৪২ সাল পর্য্যন্ত অর্থাৎ ৬৫ বৎসর কাল রীতিমত পাওয়া গিয়াছিল। তৎপরে হুগলীর মোতউল্যার প্রস্তাবে উক্ত বৃত্তি গবর্ণমেন্টের রাজস্ব বিভাগ হইতে নামঞ্জুর হয়।[২৫] রাজা শ্রীকণ্ঠ রায়ের রাজত্বকালে ১১৮৮ সালে (১৭৮২ খৃঃ) তিনি চাউল পয়সা বৃত্তির বদলে ৬০০০ বিঘা জমির দেবোত্তর সনন্দ লিখিয়া দেন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর সে দেবোত্তর সম্পত্তিও গভর্ণমেন্ট কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।
দুর্গানন্দের মৃত্যুর পর তৎপুত্র যশোমন্ত এবং পরে যশোমন্তের দুই পুত্র হরিশ্চন্দ্র ও কৈলাসচন্দ্র ক্রমান্বয়ে সেবায়ৎ হন। কৈলাসচন্দ্রের সময়ে দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হইলে, তিনি গভর্ণমেণ্টের নিকট ঐ বৃত্তিমহল খারিজা তালুক স্বরূপ বন্দোবস্ত করিয়া লন। কিছুদিন পরে তাহাও বাকী খাজনায় নীলাম হইয়া গেলে, অর্দ্ধাংশ চাঁড়ার রাজা এবং অপরার্দ্ধ নরেন্দ্রপুরের ব্রাহ্মণ জমিদার মহিমচন্দ্র মজুমদার খরিদ করেন। তদবধি তাঁহারা সেবার জন্য কিছু কিছু মাসিক বৃত্তি দিতেন। মহিমচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁহার বৃত্তি বন্ধ হইয়াছে, এখন চাঁড়া রাজ সরকার হইতে সামান্য কিছু পাওয়া যায়।[২৬] কৈলাস ব্রহ্মচারী নিঃসন্তান; তাঁহার জীবদ্দশায় তাঁহার একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্র শশিভূষণের মৃত্যু ঘটিলে, কৈলাসচন্দ্র শেষ বয়সে যাবতীয় সম্পত্তি স্বীয় গুরুদেব চন্দনীমহল নিবাসী যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য্য মহোদয়কে লিখিয়া দেন। ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় এক্ষণে পরলোকগত। তাঁহার ভ্রাতারা এক্ষণে দশমহাবিদ্যার সেবায়ৎ আছেন। এখন নিষ্কর সম্পত্তি ও লোন্ আফিসের গচ্ছিত টাকার সুদ বাবদ মোট বার্ষিক ৫/৬ শত টাকা আয় আছে; উহা এবং সমাগত পূজার্থিগণের নিকট হইতে যাহা পাওয়া যায়, তদ্বারা কষ্টে বিগ্রহগণের সেবা ও অতিথি সৎকার চলিতেছে।
দুর্গোৎসবের সময় দশমহাবিদ্যার বাড়ীতে এবং চাঁড়ার রাজবাটীতে চণ্ডী মণ্ডপে প্রতিপাদি কল্পারম্ভ করিয়া সপ্তশতী চণ্ডীও যেমন পঠিত হয়, কবিকঙ্কণকৃত চণ্ডী পুঁথিও তেমনি পাঠ করা হইয়া থাকে। এইজন্য রাজা শ্রীকণ্ঠ রায়ের সময়ে কবিকঙ্কণ চণ্ডীর যে পুঁথি লিখিত হইয়াছিল, উহা এখনও দশমহাবিদ্যার বাড়ীতে আছে। পুঁথিখানি ১১৮৪ সালের ১৮ই বৈশাখ লিখিত হয়। আর একখানি পুঁথি সেখানে আছে, উহার নাম শীতলামঙ্গল। উহা পরগণে ইমাদপুরের অন্তর্গত আম্দাবাদ নিবাসী রামেশ্বর ঘোষ বিশ্বাস কর্তৃক কবিতাকারে রচিত। উহার শেষ ভাগে আছে :
‘বাণ বসু রস ইন্দু শক পরিমিত
হেনই সময় হৈল শীতলার গীত।’
অর্থাৎ ১৬৮৫ শক বা ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দে এই পুস্তক রচিত হয়। এ পুঁথিখানি এখনও মুদ্রিত হয় নাই। অভয়ানগর এই স্থানটি অভয়ানাম্নী বিধবা রাজকন্যার সম্পত্তিভুক্ত করিয়া দেওয়া হয় বলিয়া ইহার নাম অভয়ানগর। কথিত আছে, এখানকার একাদশটি শিবলিঙ্গের প্রত্যেকের নামে ১২০০/বিঘা নিষ্কর দেওয়া হয়। প্রতিদিন দেবসেবায় যাহা ভোজ্য উৎসৃষ্ট হইত, উহা পূজান্তে সিধা ভাগ করিয়া গ্রামস্থ প্রত্যেক ব্রাহ্মণ বাটীতে রীতিমত প্রেরিত হইত এবং তদ্বারা প্রায় ৩০ ঘর ব্রাহ্মণ পরিবারের সংসার নির্ব্বাহ হইত। এখনও অভয়ানগরে সে সকল ব্রাহ্মণ বাস করিতেছেন, কিন্তু নৈবেদ্য আর পান না। অভয়ানগরের রাজবাটী ভাঙ্গিয়া পড়িয়া বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছে। কিন্তু মন্দিরগুলি এখনও খাড়া আছে। ঐ প্রাঙ্গণে উত্তরের পোতার মন্দিরটি সর্ব্বাপেক্ষা বড়, তন্মধ্যে যে প্রকাণ্ড শিবলিঙ্গ ছিল, তাহার ভগ্নাংশগুলি এখনও আছে। পূৰ্ব্ব পশ্চিমে প্রত্যেকদিকে সারি সারি চারিটি ও সদর তোরণের দুইপার্শ্বে দুইটি— এই মোট একাদশটি মন্দির। অনেকগুলির মধ্যে শিবলিঙ্গ এখনও বৰ্ত্তমান; এবং ২/৩টির নিত্য পূজা হওয়ার কথা, ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু কাৰ্য্যতঃ নিত্যপূজা হয় না; বৃত্তির টাকা রাজসরকারে খরচ লেখা পড়ে এবং এখানকার বৃত্তিভুকগণ ফাঁকি দিয়া খায়। রাজসরকার হইতে এদিকে দৃষ্টি নাই। যাহা হউক, মন্দিরগুলি বেশ দৃঢ় এবং বড় মন্দিরটি বড় সুন্দর; এমন কারুকার্যখচিত সুন্দর মন্দির নিকটবর্ত্তী স্থানে আর নাই। মন্দিরটির বাহিরের মাপ ২৪ ́-৪ ́ ́ × ২২ ́-৩ ́ ́; ভিত্তি ৩ ́-৪ ́ ́; সম্মুখে সাধারণ পদ্ধতিমত তিনটি খিলানের পশ্চাতে একটি ৪ ́-৭ ́ ́ বিস্তৃত খোলা বারান্দা এবং ভিতরে গর্ভমন্দির, দুই পার্শ্বে ৩ ́-১০ ́ ́ বিস্তৃত আবৃত বারান্দা আছে। এই মন্দিরগুলির চতুষ্পার্শ্ব দিয়া প্রাচীর বেষ্টিত ছিল, উহার ভগ্নাবশেষ আছে। প্রাচীরের বাহিরে পশ্চিমোত্তর কোণে বিস্তীর্ণ পুকুর ছিল এবং পুকুরের দক্ষিণে অনেক দূর লইয়া রাজবাটীর ভগ্নাবশেষ কতকগুলি বরজ ও বাগানের মধ্যে বিলুপ্ত হইবার মত হইয়াছে। এখনও অনেক স্থানে স্তূপাকার ইট আছে, আরও অনেক ইট গ্রামবাসীরা কিনিয়া লইয়া নিজ বাটীতে গৃহ নির্ম্মাণ করিয়াছেন।
ধুলগ্রামে দেওয়ানের বাটী। নদীকূলে দ্বাদশটি শিবমন্দির ও উহার মধ্যস্থানে সদর দ্বার ও বাঁধা ঘাট ছিল। প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিলে উত্তরের পোতায় কালীমন্দির ও দক্ষিণে নহবৎখানা ছিল।[২৭] ঐ প্রাঙ্গণেরই পূর্ব্ব পোতায় পূর্ব্বদ্বারী জোড় বাঙ্গালায় গোপীনাথ ও রাধিকা বিগ্ৰহ ছিলেন। এই মন্দিরের মাত্র সম্মুখের একটি দীর্ঘ ও প্রস্থ দেওয়াল আছে, উহার পশ্চাতের সমস্ত অংশ, কালীমন্দির ও দ্বাদশটি শিবমন্দির সব নদীগর্ভে নিমজ্জিত হইয়া বিনষ্ট হইয়াছে। গোপীনাথের জোড়বাঙ্গালার প্রাঙ্গণে উত্তরদিকে একটি গৃহে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিগ্রহ ছিলেন, কিন্তু সে গৃহ এক্ষণে নাই। সেই দিকে একখানি খড়ের ঘরে কালীমূর্ত্তির পূজা হইতেছে। ঐ প্রাঙ্গণের দক্ষিণদিকে দোলমঞ্চ এবং একটি প্রাচীন তমালবৃক্ষ এখনও বৰ্ত্তমান আছে; পূর্ব্বপোতার বড় মন্দিরে রাম, সীতা ও হনুমান বিগ্রহ ছিলেন। এই বড় মন্দিরটিই এক্ষণে বিদ্যমান আছে এবং তাহারই ভিতর গোপীনাথ ও রাধিকা, এবং জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম ও অনেকগুলি শালগ্রাম নিত্য পূজিত হন। এই মন্দিরের বাহিরের মাপ ২৩ ́-৬ ́ ́ × ২১ ́-৪ ́ ́; সম্মুখে তিনটি খিলানের পশ্চাতে ১১ ́-৬ ́ ́ × ৪ ́-১ ́ ́ – পরিমিত একটি খোলা-বারান্দা আছে। গর্ভমন্দিরের সম্মুখের দেওয়ালে ইষ্টকে বহু কারুকার্য্য ও জীবজন্তুর ছবি আছে। উহা হইতে তৎকালিক অবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।[২৮] গোপীনাথের জোড়-বাঙ্গালার যে দেওয়াল এখনও দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে নিম্নলিখিত ইষ্টক-লিপি আছে :
‘ক্ষিতি মুনি রস চন্দ্রে শাকবর্ষেহতিভাগ্যাৎ
হরিহর পদযুগ্মং শ্রীযুতং স প্রণম্য।
বৃষগত দিননাথে মিত্র-বংশোদ্ভবোহন্ধো
রচয়তি হরিরামো গোপিকানাথমঞ্চম্॥‘’ শকাব্দা ১৬৭১/১১/২৩
ক্ষিতি=১, মুনি= ৭, রস=৬, চন্দ্র=১; অঙ্কের বামগতিতে ১৬৭১ শাক বা ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দ, অর্থাৎ ১৬৭১ শকাব্দের জ্যৈষ্ঠমাসে মিত্রবংশীয় অন্ধতুল্য হরিরাম সৌভাগ্যবশে শ্রীযুক্ত হরিহর পাদদ্বয়ে প্রণাম করিয়া গোপীনাথের এই মন্দির নির্ম্মাণ করেন। গোপীনাথ নামক শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের পদপ্রান্তে লিখিত আছে :
‘বাঞ্ছাপ্রদ গোপীনাথ ত্বয়ি যাচে।
চিত্তং হরিরামস্যাস্তাং তব পাদে।।’
এইরূপ রাধিকার পাদপদ্মে লিখিত আছে—‘যাচে তব পাদে ভক্তিং হরিরামঃ।’ হরিরামের ইষ্টমূর্ত্তিদ্বয় এখনও তাঁহার ভক্তির কাহিনী অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছেন।
হরিরামের বংশ দেওয়ান বংশ, পুরুষানুক্রমে তাঁহার বংশধরেরা চাঁচড়া সরকারে দেওয়ানী প্রভৃতি উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন; চাঁচ্ড়া-রাজের পতনকালেও শিবনাথের পুত্র দীননাথ পেশকার ছিলেন। দীননাথের তৃতীয় পুত্র খগেন্দ্রনাথ মিত্র এম, এ, প্রেসিডেন্সী কলেজের দর্শন শাস্ত্রের প্রধান অধ্যাপক, সাহিত্য পরিষদের প্রধান সেবক, ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য, নিজে যেমন সুলেখক, তেমনি সুরসিক ও সুগায়ক। বংশধারা এইরূপ :

পাদটীকা :
১. মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’ (নিখিলনাথ), ১৫১ পৃ।
২. Ain, (Jarret), Vol, II, p. 140.
৩. রাণা ভূপাল পুত্রশ্চ রাণা গোপাল সংজ্ঞকঃ। তস্যাত্মজোহনাদিবরসিংহ খ্যাতো মহাবলী॥ ধাৰ্ম্মিকঃ সত্যবাদী চ জিতেন্দ্রিয়ঃ সদাশয়ঃ। মহাধনুর্দ্ধবো বীরঃ কুলশ্রেষ্ঠঃ কুলাধিপঃ॥ রাজকার্য্যপরিজ্ঞাতা সর্ব্বকার্য্যবিশারদঃ।’—পঞ্চাননের কুল-কারিকা; ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, রাজন্যকাণ্ড, ১২৭ পৃ।
৪. ‘কায়স্থাবনিপালঃ শূরসয়িদান্ যুদ্ধে তথা হড্ডিপান্।
ফতোসিংহমুখক্ষিতারধিকৃতো জাতোহি জিত্বেব তান্।।’
—পুণ্ডরীক-কুলকীর্ত্তিপঞ্জিকা।
সাহিত্যরথী ঁরামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, এম. এ. মহোদয় জন্মলাভে এই জিঝোতিয় ব্রাহ্মণকুল উজ্জ্বল করিয়াছিলেন।
৫. চাঁচড়া সংক্রান্ত প্রাচীন কাগজপত্রে দেখা যায়, ভবেশ্বর মজুমদার ৯৭৫ সাল হইতে ৯৯৫ সাল পর্যন্ত (১৫৬৭-৮৮ খৃঃ) ২১ বৎসর জমিদারী করিয়াছিলেন। তাহা হইলে ধরিয়া লইতে হয় যে পাঠান আমল হইতে তিনি থানাদারী কার্য্য করিতেন এবং মোগল আমলে পুরাতন কর্মচারীকে পরিত্যাগ করা হয় নাই। এ কথার অন্য কোন প্রমাণ নাই। তবে তিনি যে অযোধ্যা হইতে খাঁ আজমের সঙ্গী হইয়া এদেশে আসনে নাই, তাহা সত্য। তাঁহার পূর্ব্বপুরুষেরা বহু শতাব্দী ধরিয়া এদেশে বাস করিয়াছেন এবং তিনিও হয়ত খাঁ আজমের আগমনের পূর্ব্বে মোগলদিগের কর্মচারী হইয়াছিলেন।
৬. During the last seven years of his tenure, it is recorded that he had to pay revenue on account of his lands, which apparently had no before been assessed. ‘ — Westland, Jessore, p. 45.
৭. ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেব কন্দর্পের রাজত্ব ১৬৪৯ খৃঃ পর্য্যন্ত ধরিয়াছেন, সম্ভবতঃ তিনি বাঙ্গালা ১০৬৫ সালকে ভ্রমক্রমে ১০৫৬ ধরিয়া লইয়াছিলেন। বহু প্রাচীন কাগজে কন্দর্প রায়ের রাজত্ব ৩৯ বৎসর বলিয়া লিখিত আছে।
৮. প্রাচীন কাগজপত্রে পরগণা দাঁতিয়ার ইতিবৃত্ত ঠিক এইরূপ লিখিত আছে : ‘সাবেক জমিদার আরজান উল্যা চৌধুরী (নগরঘাট) ১১ আনা অংশ, পরুষরাম মিত্র ৩ আনা ও রুক্মিনি কান্ত মিত্র ২ আনা মোট ষোল আনা এই ৩ জনের ছিল, কন্দর্প রায়ের সামিল ছিল পরে অনেক কর বাকি পড়িলে সরবরাহ করিতে না পারিলে বাকিতে কবলা লিখিয়া দিলেন ১০৪৯ সাল।’ অন্যান্য পরগণা দখলেও এইরূপ বিবরণ পাওয়া যায়, সবই একরকম, সুতরাং উদ্ধৃত করা অনাবশ্যক।
৯. এখনও সেই কালীতলার প্রকাণ্ড প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ সাক্ষিস্বরূপ দাঁড়াইয়া আছে। তেমন পুরাতন বৃক্ষ এ দেশে কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। উহারই পার্শ্বে রাস্তার গায়ে যে পুকুরটি আছে, তাহার নাম কালীসাগর। বটবৃক্ষের অনতিদূরে কন্দর্প রায়ের আমলের কালীমন্দির আছে, সেখানে দেবীমূর্তি না থাকিলেও ঘটে নিত্য পূজা হয়।
১০. “শ্যামরায়ের পূজায় প্রাতে ৩০ সের চাউলের নৈবেদ্য হয় এবং তদুপযোগী দ্রব্যাদি থাকে। পূজান্তে সে নৈবেদ্য ভাগ করিয়া নিকটবর্ত্তী ১০/১১ ঘর ব্রাহ্মণ বাড়ীতে বিতরিত হয়। বিকারে সাড়ে ৮ সের দুগ্ধ এবং সন্দেশাদি মিষ্টান্ন দিয়া ঠাকুরের বৈকালিক হয়, তাহাও অতিথি ও ব্রাহ্মণগণের ভোগে লাগে। মহারাজ প্রতাপাদিত্য শ্যামরায় বিগ্রহের জন্য যে দেবোত্তর দেন, চাঁড়াবংশের পরবর্ত্তী রাজগণ কর্তৃক তাহা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এখন সে দেবোত্তরের পরিমাণ ২৫০০০ (পঁচিশ হাজার) বিঘা। উহা এক্ষণে খুলনা কালেক্টরীর ৩২ বি তৌজিভুক্ত সিদ্ধ নিষ্কর।
১১. সাঁড়াপোল নিবাসী রামেশ্বরের ধারা এই : যজ্ঞেশ্বর হইতে গণনা করিয়া ৪র্থ পুরুষ রামেশ্বর-তৎপুত্র ৫ রামচরণ ও রামনারায়ণ—৬ রামকৃষ্ণ—৭ বিশ্বনাথ—৮ কীৰ্ত্তিচন্দ্র—৯ মণীন্দ্র— ১০ যতীন্দ্র প্রভৃতি এখনও সাঁড়াপোলে বাস করিতেছেন। ৫ রামনারায়ণ— ৬ পঞ্চানন — ৭ দুর্গাচরণ— ৮ ধৰ্ম্মনারায়ণ— ৯ কালীপ্রসন্ন—১০ সারদা প্রসন্ন।
১২. পুরাতন কাগজপত্রে ঈশপপুর জমীদারীর পতন প্রসঙ্গে অবিকল এইরূপ লিখিত আছে : ‘সাবেক জমিদার কালিদাস রায় ও পরমানন্দ রায় ও রামকৃষ্ণ দত্ত, রামনারায়ণ দত্ত, রামজীবন দত্ত ইহারা ছিল। মালগুজারি মনোহর রায়ের সামিল ছিল। পরে অনেক বাকী আটকিলে সরবরাহ করিতে না পারিয়া বাকিতে কবলা করিয়া দিলেক। সাবেক জমিদারের সন্তান বেবাকদী ও শেকাটী গ্রামে বর্তমান আছে।’ কালিদাস রায় প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ও ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তাঁহার প্রসঙ্গে পূর্ব্বে তাঁহার জমিদারীর কথা বলিয়াছি।
১৩. ‘বান্ধব’ পত্রে (জগদ্ববন্ধু ভদ্র লিখিত) “রাজা সীতারাম রায়’ প্রবন্ধ, ১২৮১, মাঘ, ১৯৭ পৃ ১৪. ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’ (বঙ্গভাষায় প্রকাশিত), ১২৭৫, ১১ই বৈশাখ; ‘মানসী ও মৰ্ম্মবাণী’, ১৩২৩, পৌষ, ৫৩৭ পৃ।
১৫. ওয়েষ্টল্যাণ্ড মহাশয় শ্যামসুন্দরকে কৃষ্ণরামের পুত্র এবং শুকদেব রায়ের ভ্রাতা বলিয়া উল্লেখ করিয়া একটি মস্ত ভুল করিয়াছেন।— Westland, Jessore, p. 46.
১৬. পুরাতন হিসাবপত্র হইতে এই নবলব্ধ ২০ পরগণার নাম যাহা পাইয়াছি, দখলের তারিখ সমেত তাহা দিতেছি : রাঙ্গদিয়া, রহিমাবাদ ও সৈয়দমামুদপুর (১৭১২); মাগুরা ঘোনা (১৭১৪); ভেরচি (১৭১৫); রায়মঙ্গল ও বন্দর মুকুন্দপুর (১৭১৬); শ্রীপদহা (১৭২০); হোসেনপুর, নুরনগর, সাহস, শোভনালি, বাজিতপুর, রহিমপুর, ইসলামাবাদ, রেকাব বাজা (?), ধুলিয়াপুর, সহরতপুর, শাহাপুর ও হোসেনপুর (১৭২৬)। ইহার মধ্যে বাজিতপুর পরগণা নদীয়া-রাজের নিকট হইতে খরিদাসূত্রে পাওয়া যায়। উপরি উক্ত কয়েকটি পরগণার বিশেষ পরিচয় জানা যায় না। তবে ‘আইন-ই-আকবরী’তে ফতেহাবাদ সরকারে ইশফপুর, খলিফাতাবাদে তালা, বাগমারা, শ্রীপতি কবিরাজ, রাঙ্গদিয়া, সাহস, ইমাদপুর ও মল্লিকপুর এবং সপ্তগ্রাম সরকারে পানওয়ান ও শিলিমপুর প্রভৃতি নামোল্লেখ আছে—Ain. Vol. II, pp. 134, 141.
১৭. খুলনা জেলায় পীরজঙ্গের দক্ষিণে একটি বিখ্যাত হাট আছে, উহার নাম ‘শুকদেব রায়ের হাট’। সাধারণ লোকে উহাই অপভ্রংশ করিয়া ‘শুকদাড়ার হাট’ করিয়া লইয়াছে। সর্ব্ববিধ গরুর ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য এই হাট খ্যাত।
১৮. “The East India Company received from the Nawab a grant of certain land near Calcutta and one of the Zemindars when the Nawab dispossessed in order to make this grant was named Sala Uddin Khan. His man representing that Shamsundar’s property had no heirs, requested its bestowal upon himself in requital for the loss of his former Zemindari, and the Nawab nt unwilling to give what was not his own bestowed upon him the four annas share of the Raja’s estates.”–Westland, Jessore, p. 46; Ascoli, Revenue History, p. 19.
১৯. এই দুইটি বাটীর বিশেষ বিবরণ পরে দিতেছি। অভয়ানগরে আসিবার জন্য যেখানে রাজা সদলবলে ভৈরব নদ পার হইয়াছিলেন, অপর পারে সেই স্থানের নাম রাজঘাট। পরবর্ত্তী সময়ে দেওয়ান স্বরূপচন্দ্ৰ মিত্র রাজঘাটে বাস করিয়াছিলেন।
২০. আতপুরের শিব ও চাঁড়ার ব্রহ্মময়ী ঠাকুরাণীর কোন নির্দ্দিষ্ট দেবোত্তর সম্পত্তি নাই। গঙ্গাতীরে আতপুরে চাঁড়ার রাজাদিগের গঙ্গাবাসের বাটী ছিল। সে সম্পত্তি সম্প্রতি হস্তচ্যুত হইয়া গিয়াছে। রাজরাজেশ্বরীর বিগ্রহ এখন জঙ্গলের মধ্যে পড়িয়া আছে। রাজা বরদাকণ্ঠের সময় চাঁড়ার যোগমায়া ঠাকুরাণী এবং যশোহরে কালীবাড়ী প্রতিষ্ঠিত হয়।
২১. Westland, Jessore, pp. 99-100.
২২. The family, from which the Raja is descended, is nearly as ancient as the district itself. At the time of the Decennial Settlement, they were possessed of nearly one-fourth of the district pay- ing upwards of three lacs of rupees of revenue per annum to the Government. It is not for me to attempt to trace the causes which have led to the disjunction of almost all the great families of Bengal in a comparatively short space of time; whether it be owing to the policy of the Government or to accidental causes, the effect is the same, and the large possessions of ancient families have been gradually decimated and lopped off till the name only of greatness remains, which, though still cherished with the fondness of past recollection, has only a shadow for its support.’ – Collector’s letter to the members of the Board of Revenue, dated 8th April, 1819.
২৩. জসিমুদ্দিন বিশ্বাস কর্তৃক ১৩০৪ সালে লিখিত ‘চাঁড়া-চন্দ্রিকা’ নামক ক্ষুদ্র কবিতা পুস্তকে রাজবংশের কিছু কিছু পুরাতন কিংবদন্তী এবং সৰ্ব্বজনপ্রিয় রাজা বরদাকণ্ঠের উচ্চ প্রশংসা গীতি লিপিবদ্ধ হইয়াছিল।
২৪. শাস্ত্রানুসারে দশমহাবিদ্যা এই :
‘কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধুমাবতী তথা॥
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতা দশমহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিতাঃ॥’—মুণ্ডমালাতন্ত্র
২৫. ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারীর পরওয়ানা দ্বারা উক্ত বৃত্তির টাকা নামঞ্জুর করা হয়।
২৬. ‘ভারতবর্ষ, ১৩২৬, শ্রাবণ, ২১১ পৃ (অশ্বিনীকুমার সেনের প্রবন্ধ)।
২৭. কালীমন্দির কিছুদিন পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। কথিত আছে, রাজা শ্রীকণ্ঠ রায়ের সময়ে যখন চাঁড়া রাজধানীতে ‘হিমসাগর’, নামক সুবিস্তীর্ণ দীঘি খনিত হয়, তখন মৃত্তিকার নিম্নে সুন্দর কালীমূর্তি পাওয়া যায়। শ্রীকণ্ঠ রায় সে মূৰ্ত্তি চাঁড়াতে প্রতিষ্ঠিত করিয়া পূজা করিতেন। কিন্তু শেষে নাকি স্বপ্নাদেশ হয় যে, দেবীমূর্ত্তি দেওয়ানের বাড়ীতে আসিতে চান। তখন রাজা নিজ ব্যয়ে মহাসমারোহে কালীমূর্তি আনিয়া ধুলগ্রামের বাটীতে নবনির্ম্মিত মন্দিরে স্থাপনা করেন। সে মূর্ত্তি এখনও আছেন, কিন্তু রাজা শ্রীকণ্ঠ বা হরিরাম কেহই নাই, সে মূর্ত্তির মর্ম্ম বুঝিবে কে?
২৮. মন্দিরের গায়ে একদিকে উষ্ট্র, পালকী, হস্তী ও হাওদা এবং অন্যদিকে বিতাড়িত হরিণের পালের পশ্চাতে বর্শা হস্তে অশ্বপৃষ্ঠে শিকারী ও তাহার পশ্চাতে কুকুর ছুটিতেছে। তাহার পশ্চাতে শিকারী পালকীতে এবং শিকারলব্ধ হরিণ বাঁধিয়া ঝুলাইয়া লইয়া চলিতেছে। সুন্দরবনের সান্নিধ্যের লোকে যে এভাবে শিকার করিতে ভালবাসিতেন, তাহা বিচিত্র নহে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন