৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

সতীশচন্দ্র মিত্র

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

১৭৮৬ অব্দে ওয়ারেণ হেষ্টিংসের পর লর্ড কর্ণওয়ালিস গবর্ণর-জেনারেল হইয়া আসেন। সামরিক অভিজ্ঞতা ব্যতীত রাজ্যশাসন সংক্রান্ত কোন মৌলিকতা তাঁহার ছিল না। তবে তিনি উন্নত-চরিত্র এবং কর্তব্যপরায়ণ লোক; বিলাতী ডিরেক্টর সভার অভীষ্ট যে তিনি একাগ্রভাবে পালন করিবেন, সে বিশ্বাস সকলের ছিল। বঙ্গীয় জমিদারদিগের সঙ্গে বাৎসরিক বা পাঁচ বৎসরের অস্থায়ী বন্দোবস্তে যে গোলযোগ হইতেছিল, তাহা জানিয়া ডিরেক্টরগণ উঁহাদের সহিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা এদেশে চিরশান্তি সংস্থাপনের জন্য লর্ড কর্ণওয়ালিসকে পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহাদের মত এই যে, অতিরিক্ত রাজস্বের নিয়মিত ও সময়ানুমত সংগ্রহে প্রজার চিরকল্যাণ সাধন করে।[১] পিটের ইণ্ডিয়া বিলই এই মতের প্রথম প্রবর্তক।

কর্ণওয়ালিস আসিয়া এই প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত করিবার পূর্ব্বে কোম্পানির অভিজ্ঞ কর্মচারীদিগের মতামত জিজ্ঞাসা করেন। তন্মধ্যে যশোহরের হেঙ্কেল সাহেব একজন। তাঁহার মত জানাইবার পূর্ব্বে এ বিষয়ে যে বিশিষ্ট দুইজনের বাদ-বিচার হইয়াছিল, সেই কথা অগ্রে বলিয়া লইতেছি। কোম্পানির সেরেস্তাদার জেমস্-গ্রাণ্ট বঙ্গীয় গবর্ণমেণ্টের রাজস্ব ও অর্থ-সমস্যা বিশ্লেষণ করিয়া দুইখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।[২] উহাতে তিনি দেখান যে, ১৭৬৫ হইতে ১৭৮৬ পর্য্যন্ত ২০ বৎসরে দেশীয় কর্মচারীরা মোগল আমলের হিসাবানুসারে রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া প্রায় দশ কোটি টাকা অর্থাৎ বৎসরে ৫০ হাজার টাকা করিয়া কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়াছে। জমির উৎপন্নের ৪ এর ১ অংশের মধ্যে সরঞ্জাম খরচ ১০ এর ১ অংশ বাদে অধিকাংশ জমিদারদিগের নিকট হইতে কোম্পানির প্রাপ্য। নবাবী আমালের আবওয়াবগুলি অন্যায় অত্যাচারের ফল বলিয়া বাদ দিয়াও গ্রাণ্ট বঙ্গের রাজস্ব তিন কোটির অধিক নির্দ্ধারণ করেন, উহা মোগল রাজস্বের শেষ সীমা হইতেও ৫৭ লক্ষ টাকা অধিক।

এই সময়ে স্যর জন শোর সুপ্রীম কৌন্সিলের সদস্য ছিলেন। তিনি গ্রান্ট সাহেবের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করিয়া এক বিখ্যাত নিবন্ধ রচনা করেন। তাহাতে দেখান যে, তিন প্রকারে বন্দোবস্ত হইতে পারে। প্রথমতঃ রাইয়তওয়ারী বন্দোবস্তে খাস আদায় করিতে গেলে, কালেক্টরের যে অভিজ্ঞতা চাই তাহা দুর্লভ। দ্বিতীয়তঃ, ইজারা বা নির্দ্দিষ্ট কালের জন্য খণ্ড খণ্ড বন্দোবস্তে সম্পত্তির উন্নতির দিকে কেহ দিক্‌পাত করে না। তৃতীয়তঃ, জমিদারের সহিত স্থায়ী বন্দোবস্ত, উহাই সমীচীন। জমিদারের যেমন জমির উপর স্বত্ব আছে, তেমনই শান্তিরক্ষা ও বিদ্রোহ- নিবারণের জন্য তাহারা সহায়ক হইতে পারেন। এজন্য শোর মহোদয় জমিদারের সঙ্গে বন্দোবস্তের পক্ষপাতী হন বটে, কিন্তু তিনি প্রথমতঃ দশশালা বন্দোবস্ত করিয়া অভিজ্ঞতা লাভের পরামর্শ দেন।

হেঙ্কেল সাহেবের মতে রাইয়তের সঙ্গে বন্দোবস্ত করাই ভাল। তিনি বলেন, জমিদারের স্বত্ব অধিকার করা যায় না বটে, কিন্তু তাহাদিগকে রাজস্ব-সংগ্রহ ব্যাপারে গবর্ণমেন্টের সাহায্যকারী ধরিয়া লওয়াই উচিত। প্রজারা উচ্চ হারে খাজনা দেয়, কিন্তু তাহারা অনেক বেশী দখল করে। এখন সেই অতিরিক্ত জমির পাট্টা দিলে, তাহাদের নিকট হইতে খাজনা-বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। নিষ্কর সম্বন্ধে হেঙ্কেল সাহেব বলেন যে, যশোহরের ৩,৫০,০০০ বিঘা অর্থাৎ ২০ এর ১ অংশ নিষ্কর। ১৭৬৫ অব্দের পূর্ব্ববর্ত্তী’ নিষ্কর বহাল রাখা উচিত। ১৭৭২ অব্দে নিষ্কর দেওয়া নিষিদ্ধ হয় বলিয়া, ১৭৬৫-৭২ পর্য্যন্ত যে সব নিষ্কর প্রদত্ত হয়, তাহাও বহাল না রাখিলে অত্যন্ত কঠোরতা করা হয়। উহা মঞ্জুর না করিলে দলিলের তারিখ বদলাইয়া জালজুয়াচুরি দ্বারা জমিদারের লোকেরা অতিরিক্ত ঘুষ খাইবে মাত্র। লর্ড কর্ণওয়ালিস এই সকল মতের সমন্বয় করিয়া ডিরেক্টরগণের আদেশ প্রতিপালন করিবার জন্য উদ্যোগী হইলেন।

জমিদার, নিরপেক্ষ তালুকদার, বা জমির প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদিগের সহিত বন্দোবস্ত করা হইল। আবওয়াব বা বাজে আদায় বাদ দিয়া, ১৭৬৫ অব্দের পূর্ব্ববর্ত্তী কালের বিশ্বাসযোগ্য লাখিরাজ স্বীকার করিয়া লইয়া, মোগল আমলের রাজস্ব-হার এবং আবাদী জমির আয়ের হিসাবের উপর নির্ভর করিয়া, বহু চেষ্টায় রাজস্ব ধার্য্য হইল। তদনুসারে ১৭৯০ অব্দের নিমিত্ত বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার করসমষ্টি ২,৬৮,০০,৯৮৯ টাকা স্থির হইল।[৩] ১৭৯৩ অব্দের ৮ম আইন (Regulation VIII of 1793,) দ্বারা ঐ দশশালা বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হইল। অবধারিত কর বৎসরের মধ্যে কিস্তীমত কয়েকটি নির্দ্দিষ্ট তারিখে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারী কালেক্টরীতে জমা দিতে হইবে। না দিলে জমিদারী বা তালুক উক্ত ৮ম আইন অনুসারে নিলামে বিক্রীত হইয়া যাইবে। উপরিস্থ মালিকের স্বত্ব এইভাবে বিনষ্ট হইলে, নিম্নবর্তীদিগের স্বত্বহানি হইবে। সুতরাং গবর্ণমেন্টের রাজস্বের জন্য জমিদারের নিম্নস্থ সকলেও পরোক্ষে দায়ী থাকিলেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে আওয়াব বা সায়র আদায়সমূহ বাদ দিয়া জমিদারদিগের রাজস্ব নির্দ্ধারিত হইল। হাট-বাজার হইতে দুই প্রকার কর ছিল; হাটের মধ্যে দোকানের জন্য স্থান অধিকার করিবার খাজনাকে ‘চাঁদনী’ বলে এবং হাটের দারগা বা ইজারাদার, ঝাড়ুদার প্রভৃতির পোষণার্থ যে শুল্ক কতক দ্রব্যাদিতে কতক নগদ পয়সায় তুলিয়া লওয়া হইত, তাহার নাম ‘তোলা’। বাণিজ্য-সৌকার্য্যার্থ এই দ্বিবিধ শুল্কের অর্থ জমিদারের রাজস্ব হইতে বাদ পড়িল বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে জমিদারগণ উহা আদায় করিতে ছাড়িলেন না। ইহাতে লাভ জমিদারেরই হইল; এজন্য এক যশোহর জেলাতেই গবর্ণমেন্টের ১০/১২ হাজার টাকা লোকসান পড়িল। আবার অপর পক্ষে যে সকল জায়গীর প্রভৃতি নবাব আমলের স্বীকৃত ছিল, তাহা গবর্ণমেণ্ট নিজের গায়ে লইয়া জমিদারের রাজস্ব সেই পরিমাণে বাড়াইয়া দিলেন। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি : মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের বহুবেগম৫ নামক এক মহিলা বাগেরহাট খলিফাতাবাদে ৬ আনা অংশ জায়গীর স্বরূপ পাইতেন। অবশিষ্ট দশ আনা পৃথক্ স্থানে আদায় হইত বলিয়া দশানি গ্রামের নামকরণ হইয়াছে। বেগমের পক্ষ হইতে এই লভ্যাংশ আদায় করিবার জন্য বাগেরহাটে কাছারী ও মালখানা প্রভৃতি ছিল, তাহার কিছু কিছু ভগ্নাবশেষ এখনও আছে। বাগেরহাটের মিঠাপুকুর প্রভৃতি সেই আমলের স্মৃতি রক্ষা করিতেছে। এই জায়গীরের হস্তবুদ ৯২০০ টাকা, তন্মধ্যে ২৯০০ টাকা অনাদায় ছিল। অবশিষ্ট ৬৩০০ টাকা গবর্ণমেণ্ট পরগণার রাজস্বে যোগ করিয়া দিয়া জমিদারের নিকট আদায় করিতে লাগিলেন এবং ঐ টাকা বেগমকে বৃত্তিস্বরূপ নগদ দিবার ব্যবস্তা করিলেন। ১৭৯৪ অব্দে বেগমের মৃত্যু হইলে, বৃত্তি দেওয়া বন্ধ হইল এবং গবর্ণমেণ্টের লভ্যাংশ চিরস্থায়ী হইয়া গেল।

চিরস্থায়ী ব্যবস্থার প্রাক্কালে অনেক জমিদার খাজনা কমাইয়া নগদ সেলামী বেশী লইয়া বহু তালুকের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। এখন উহাদের নিকট বেশী রাজক আদায় করিবার সম্ভাবনা না দেখিয়া গবর্ণমেণ্ট ঐ সকল তালুক স্বীকার করিয়া লইয়া, উহার কর জমিদারের রাজস্ব হইতে খারিজ করিয়া দিলেন। ইহারই নাম খারিজা তালুক। আইনে মালিকদিগকেই independent বা স্বাধীন তালুকদার বলিয়া উল্লেখিত হইয়াছে। এই ভাবে মোট রাজস্ব স্থির হইয়া গেল। সকল খুঁটিনাটিতে প্রবেশ করিবার আমাদের সময় নাই। একমাত্র যশোহর জেলার কথাই আমাদের আলোচ্য। তখনকার যশোহরে ১০৩ টি পরগণায় ৪৬০৪টি সম্পত্তির তৌজি হইয়াছিল; উহাদের পরিমাণ ফল ৪,২৬০ বর্গমাইল; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে মোট রাজস্ব ১১,২৩,৫১৭ টাকা। পরবর্ত্তী একশত বৎসর মধ্যে জেলা বিভাগ ও সীমা পরিবর্তনের জন্য হিসাবও পরিবর্তিত হইয়াছে। ১৯০০ খৃষ্টাব্দে যশোহরের রাজকর ৮,৫৯,৫৭২ টাকা এবং খুলনায় ৬,৬৭,৭০৩ টাকা, উভয় জেলায় মোট ১৫,২৭,২৭৫ টাকা হইয়াছে। ইহার সঙ্গে পথকর প্রভৃতি সেস্ আছে; তাহা যশোহরে ১৯০০ অব্দে ২,০২,৫০৩ টাকা এবং খুলনায় ১,৬৪,৪৬১ টাকা মোট ৩,৬৬,৯৬৪ টাকা। রাজস্ব সেস্ উভয় দফায় দুই জেলার মোট আদায় ১৮,৯৪,২৩৯ টাকা।[৬]

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল উভয়ই আছে; আমরা সংক্ষেপে উহার বিচার করিতেছি প্রথমতঃ বন্দোবস্তের ফলে দেশে একটা শান্তি ও স্বত্বাধিকারের স্থায়িত্ব সংস্থাপিত হইয়াছে :

১. ১৭৭২ অব্দের পর প্রায় বছর বছর বন্দোবস্ত হইত। সহজে রাজস্ব কমান হইত না; কখনও বা কিছু বৃদ্ধি করাও হইত। প্রতি-বৎসর কালেক্টরের সঙ্গে দর কষাকষি করিয়া জমিদারদিগেরই ক্ষতি হইত। তাঁহাদের সর্ব্বদা ঐ চিন্তাই প্রবল ছিল এবং তাঁহারা আত্মসম্মান বজায় রাখিয়া জমিদারী রক্ষা করিতে গিয়া ঋণগ্রস্ত হইতেন।[৭] দরে না বনিলে ভূম্যধিকারীরা সম্পত্তি ছাড়িয়া দিতে পারিতেন না, তাহা হইলে যে তাহাদের জীবনোপায়, পৈতৃক মানসম্ভ্রম ও ক্রিয়াকর্ম্ম বন্ধ হইয়া যায়! কর্ণওয়ালিসের ব্যবস্থায় এই চিন্তাক্লেশ হইতে জমিদারেরা নিষ্কৃতি পাইলেন।

২. চিরস্থায়ী ব্যবস্থার পূর্ব্বে জমিদার ও প্রজার সঙ্গে জমির কোন পাকাপাকি স্বত্ব-সম্বন্ধ ছিল না। জমিদার উদার-হৃদয় হইলে সে স্বতন্ত্র কথা, সাধারণতঃ সকলেই প্রজার নিকট হইতে যে যাহা পারিতেন, আদায় করিয়া লইতেন। তজ্জন্য প্রজারা পূর্ব্বে জমির আবাদ বা উন্নতির দিকে চাহিতেন না। এখন প্রজার একটা স্বত্ব-স্বামিত্ব স্থির হওয়ায় জমির প্রতি তাঁহাদের আসক্তি বাড়িল।

৩. পূর্ব্বে গবর্ণমেণ্ট, জমিদার বা প্রজা পরস্পর কাহারও মধ্যে বিশ্বাস ছিল না, তজ্জন্য জমিদারীর বা দেশের উন্নতির পথ রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। এখন নির্দ্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব দাখিল করিতে পারিলে জমিদার নিশ্চিন্ত, খাজানা দিয়া দাখিলা পাইলে প্রজা নিশ্চিন্ত; মৌরসী জমির উপর পাকাবাড়ী বা ভাল বাগান করিতে পারিলে, তাহা নিজ সন্তানগণের ভোগ্য হইবে, ইহা একটা কম সান্ত্বনার বিষয় ছিল না।

এক্ষণে আমরা কুফলের বিষয় আলোচনা করিব। এই নূতন ব্যবস্থার ফলে পুরাতন জমিদার বংশীয়গণ একে একে তাঁহাদের সম্পত্তি হারাইতে লাগিলেন। তজ্জন্য নূতন গবর্ণমেণ্টকে ভিন্ন অন্য কাহাকেও দায়ী করা যায় না।

১. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইন মত যে রাজস্ব ধার্য্য হইল, তাহা বড় অতিরিক্ত। ১৭৭২ অব্দ হইতে যে দাবি চলিতেছিল, তাহাই মোগল আমল অপেক্ষা বেশী, আবার অস্থায়ী বন্দোবস্তে যেরূপ ধার্য্য হইতেছিল, তদপেক্ষাও চিরস্থায়ীর হার অধিক দাঁড়াইল। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইশপপুরের রাজস্ব ৩,০২,৩৭২ টাকা ধার্য্য হইল, উহা পূর্ব্ব বৎসর অপেক্ষা ৫,০০০ টাকা বেশী; সৈয়দপুরের রাজস্ব ২,০০০ টাকা বাড়াইয়া ৯,৫৮৩ টাকা স্থির হইল; মামুদশাহীর ধ্বংসপ্রায় তের আনী অংশের জমিদারীতে পূর্ব্ব রাজস্ব ১,৩৪,৬৬৫ টাকার উপর ৫ বৎসরে মোট ১৫,৬৭৮ টাকা বৃদ্ধি করা হইল। এইরূপ অতিরিক্ত কর-বৃদ্ধি এই সকল জমিদারের পতনের হেতু। কারণ এই নূতন দাবি পূরণ করিবার জন্য তাঁহারা জমিদারীর মধ্যে কর বৃদ্ধি করিলে প্রজা বিদ্রোহী হইতেন এবং তখনকার আইনে উহাদের কিছু করিতে পারা যাইত না।

২. প্রজার নিকট হইতে জমিদারের যাবতীয় প্রাপ্য আদায় হইবে ধরিয়া লইয়াই এই নূতন ব্যবস্থা হইল; বাস্তবিক সেরূপ আদায় হইত না। প্রজাপীড়ন ভিন্ন আদায়ের সম্ভাবনা ছিল না। জমিদারেরা বিদ্রোহী প্রজাকে পীড়ন করিতে গেলে, নিজেদেরই সৰ্ব্বনাশ ঘটাইতেন।

৩. গবর্ণমেণ্ট নিৰ্দ্দিষ্ট তারিখে প্রাপ্য রাজকর কড়ায় গণ্ডায় আদায় করিয়া লইতে লাগিলেন। কিন্তু জমিদারের পক্ষে প্রজার নিকট হইতে কর-সংগ্রহের পন্থা যথেষ্ট বা ফলপ্রদ ছিল না। ‘লাটের কিস্তীর’ খাজনা না দিতে পারিলে, জমিদারী তৎক্ষণাৎ ‘লাটে’ নিলাম হইত; কিন্তু প্রজারা খাজানা না দিলে উহা আদায় করিবার জন্য জমিদারকে বহু খরচ ও সময়ক্ষেপ করতঃ মোকদ্দমা করিয়া সব সময় ফল হইত না, অনেক সময়ে খরচের টাকাও উঠিত না।

৪. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভূম্যধিকারীর দান-বিক্রয় বা হস্তান্তরের যোগ্য স্বত্ব বৰ্ত্তিল এজন্য পূর্ব্বে জমিদারেরা যে সব দেনা করিয়া বসিয়াছিলেন, তাঁহাদের উত্তমর্ণগণ এখন দায়িকের সম্পত্তি বিক্রয় করাইয়া পাওনা টাকা আদায় করিবার সুযোগ পাইলেন। প্রধানতঃ এই সকল কারণে প্রধান প্রধান জমিদারগণের সম্পত্তি ধ্বংস পাইতে লাগিল। প্রাচীন বংশ উৎখাত হইল, নূতন অর্থশালী বা কূটকৌশলী লোকদিগের মাথা তুলিবার সময় আসিল। প্রাচীন জমিদারগণ বংশগত গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্যই হউক, বা প্রকৃতিগত উদারতার জন্যই হউক, প্রজার উপর পীড়ন করিতে পারিতেন না। নবোথিত অপরিচিত ব্যক্তিরা অনেকে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিতে মনুষ্যত্ব বিক্রয় করিয়া কঠোরতার সহিত তহশীল কাৰ্য্য সম্পাদন পূর্ব্বক অর্থোপায় করিতে লাগিলেন; প্রাপ্য গণ্ডা বুঝিয়া পাইয়া গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের উপর তুষ্ট রহিলেন। দুর্ব্বল আইনে প্রজার স্বত্ব বা সম্মান রক্ষা করিতে পারিয়া উঠিল না।

পরবর্ত্তী একটি পরিচ্ছেদে আমরা এই নব্য জমিদারগণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিব।

.

পাদটীকা :

১. ‘…..a moderate Jumma if regularly and punctually collected unites the consideration of their interest, with the happiness of the natives and security of the landholders, more rationally than any imperfect collection of and exaggerated jumma to be enforced with severity and exaction.’- Fifth Report. 1812. p. 30 [1917, (Cambray), Vol. I. p. 31—শি মি]

২. ‘The Analysis of the Finances of Bengal’ 1786 and ‘The Historical and Comparative view of the Revenues of Bengal.’ 1788.

কর্ণওয়ালিস্ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আবিষ্কর্তা নহেন। Pitt’s India Act of 1784 হইতে কোম্পানির উপর আদেশ ছিল,… for setting and establishing upon principles of moderation and justice, accord- ing to the laws and constitution of India, the permanent rules by which their respective trib- utes, rents and services shall be in future rendered and paid’—ইহাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল হেতু। ‘…the popular idea that Cornwallis was the originator of the Parmanent Settlement is erroneous’ Hunter, Bengal Records. Vol. I, p. 25.

৩. Fifth Report p. 47. সঙ্গে সঙ্গে মনে করিতে হইবে যে, আবওয়াব ধরিয়াও কাশিম আলি খাঁর সর্ব্বোচ্চ তালিকায় ২,২৩,৮৩,০৯৫ টাকা ছিল। -Ascoli, Revenue History, p. 47.

৪. এই জন্যই গবর্ণমেণ্টের রাজস্বকে লোকে অষ্টমের খাজনা বলে এবং বাকী করের নিলামের নাম অষ্টমের নিলাম।

৫. Westland, Jessore, p. 88. এই বেগম মীরজাফর পত্নী বাবু বেগম হইতে পারেন। উঁহার গর্ভজাত পুত্ৰ মোবারকদ্দৌলা ১৭৭০-১৭৯৩ পৰ্য্যন্ত মুর্শিদাবাদের নবাব ছিলেন। উহার নাবালক অবস্থায় কেন যে বাব্বু বা বহু বেগমকে অভিভাবক না করিয়া মীরজাফরের বিমাতা মণিবেগমকে অভিভাবক করা হইয়াছিল, তাহা জানা যায় না। সম্ভবতঃ নবাব-জননীকে এই সময়ে যে সব বৃত্তি দেওয়া হয়, তন্মধ্যে খলিফাতাবাদের অংশ একটি। Masnad of Murshidabad, p. 42.

৬. Hunter, Jessore, Vol. II. p. 324; District Statistics, Khulna, p. 13; Jessore, p. 13.

৭. ‘The annual Revenue being, in fact, fixed on each Zemind without any detailedar assessment, but rather by a sort of haggling between the Collector and the Zemindars, the latter must go to the wall. That the Zemindars did go to the wall and they were irretrievably plunged in debt, is a fact’ – Westland, Jessore, 1871. p. 106.

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন