সতীশচন্দ্র মিত্র
প্রতাপাদিত্যের রাজধানী কোথায় ছিল, ইহা একটি প্রশ্নের বিষয়। এই সদুত্তর দিবার জন্য বহুবার সুন্দরবন ও তৎসান্নিধ্যে ভ্রমণ করিয়াছি, বহুবর্ষ ধরিয়া সন্ধান লইয়াছি। সে চেষ্টা ও সাধনার ফল এই স্থানে প্রকটিত করিব। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হইলে, সঙ্গে সঙ্গে বিচার করিতে হইবে, বিক্রমাদিত্যের রাজধানীর অবস্থান কোথায়। বিক্রমাদিত্যের রাজধানীকে আমরা যশোরের প্রথম বা পুরাতন রাজধানী বলিব এবং প্রতাপের রাজধানীকে দ্বিতীয় বা নূতন রাজধানী বলিয়া উল্লেখ করিব। ধুমঘাট সুন্দরবনের একটি পত্তন, উহা আধুনিক ম্যাপে ১৬৫ নং ধুমঘাট বা বংশীপুর লাট বলিয়া খ্যাত। গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে টিবির মোহানায় যমুনা ও ইছামতী দুই নদী মিশিয়াছিল; পরে ধুমঘাট লাটের উত্তরাংশে পুনরায় উহারা বিযুক্ত হইয়া দুইদিকে গিয়াছিল। এই মোহানার সন্নিকটে উক্ত ধুমঘাটের মধ্যে একটি দুর্গের ভগ্নাবশেষ আছে। এই দুর্গ হইতে পূৰ্ব্বদিকে ঈশ্বরীপুর। ঈশ্বরীপুরের পার্শ্ববর্ত্তী স্থানের সাধারণ নাম যশোহর। কিন্তু যশোহর বলিতে কোন নির্দিষ্ট স্থানকে বুঝায় না। যশোহর এক সময় বহুবিস্তৃত সহর ছিল; ঈশ্বরীপুর উহার একাংশ মাত্র। সে সহরের অন্যান্য অংশ এখন তত খ্যাত নহে বলিয়া, যশোহর বলিতে এখন সাধারণতঃ ঈশ্বরীপুর অঞ্চলকেই বুঝায় পূর্ব্বোক্ত নূতন ও পুরাতন রাজধানী সম্বন্ধে কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার জন্য আমাদিগকে অন্ততঃ ৫টি বিভিন্ন মতের সমালোচনা করিতে হইবে :
১. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধুমঘাটের উত্তরাংশে ছিল; কিন্তু বিক্রমাদিত্যের রাজধানী কোথায় ছিল, তাহা ঠিক নাই। মহামতি বিভারিজ প্রভৃতি পাশ্চাত্য লেখকেরা এই মতাবলম্বী।
২. বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উক্ত ধুমঘাটের উত্তরাংশে ছিল এবং প্রতাপের রাজধানী আধুনিক ধুমঘাটের দক্ষিণভাগে অবস্থিত, কিন্তু সে স্থান এক্ষণে ঘোর জঙ্গলাকীর্ণ। সাধারণ শিক্ষিত সম্প্রদায় এই মতাবলম্বী I
৩. বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উক্ত উত্তরাংশে বা ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে ছিল; কিন্তু প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল গঙ্গার মোহনায় সগরদ্বীপ। এই দ্বীপের অন্য নাম চ্যাণ্ডিকান দ্বীপ। নিখিলনাথ রায় মহোদয় এই মতের প্রবর্তক।
৪. বিক্রমাদিত্যের রাজধানী তেরকাটিতে বা ১৬৯ নং লাটে ছিল; উহা এক্ষণে ঘোর অরণ্য মধ্যে অবস্থিত। প্রতাপের নূতন রাজধানী ঈশ্বরীপুরের কাছে ছিল। কেহ বা বলেন, পুরাতন রাজধানী ঈশ্বরীপুরে এবং নূতন রাজধানী তেরকাটিতে ছিল। এই মতের পরিপোষক বহু লোক নহেন। তবে তেরকাটিতে যে মনুষ্যাবাস ছিল, তাহা অনেকেই বিশ্বাস করেন।
৫. প্রাচীন রাজধানী মুকুন্দপুর অঞ্চলে এবং নূতন বা ধুমঘাট দুর্গ ঈশ্বরীপুরের সন্নিকটে অবস্থিত।
শেষোক্ত মতই আমাদের নিজমত এবং এই মত স্থাপনের জন্য আমরা নিয়মিতভাবে অপর মতগুলির খণ্ডন করিতে চেষ্টা করিব :
১।। বিভারিজ বলেন,[১] প্রথমতঃ, চাঁদ খাঁর নামীয় জায়গীর পাইয়া বিক্রমাদিত্য যে রাজধানী স্থাপন করেন, তাহার নাম যশোহর। চাঁদ খাঁ চক হইতেই পাশ্চাত্যেরা রাজ্যটির নাম চ্যাণ্ডিকান করিয়াছেন। প্রতাপ পিতার রাজধানী ত্যাগ করিয়া, ধুমঘাটে নূতন রাজধানী করেন। তাহাও চাঁদ খাঁ জায়গীরের রাজধানী, এজন্য উহাও চ্যাণ্ডিকান বলিয়া কথিত হয়। (প্রতাপ কার্ভালো নামক এক পর্তুগীজ সেনানীর হত্যাসাধন করেন বলিয়া প্রবাদ আছে; আমরা পরে উহার সত্যাসত্য বিচার করিব। আপাততঃ তর্কের জন্য উহা সত্য বলিয়া ধরিয়া লইলাম)। দ্বিতীয়তঃ কার্ভালোকে চ্যাণ্ডিকান হইতে যশোরে ডাকিয়া লইয়া প্রতাপ কার্ভালোকে হত্যা করেন; সে সংবাদ পরদিন রাত্রিতে চ্যাণ্ডিকানে (খৃষ্টানদিগের নিকট) পৌঁছে। সুতরাং যশোহর সহর চ্যাণ্ডিকান হইতে দূরে। কিন্তু তাহা কোথায়, বিভারিজ তাহা ঠিক করেন নাই। তবে আমরা এইটুকু পাইলাম যে, ঈশ্বরীপুরের সন্নিকটে ধুমঘাট রাজধানী এবং উহাই চ্যাণ্ডিকান। তবে কালে বিক্রম ও প্রতাপের রাজধানী যে পরস্পর মিশিয়া এক হইয়াছিল, তাহা ফার প্রভৃতি বৈদেশিক অনুসন্ধিৎসু লেখকও স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।[২]
২॥ যাঁহারা বলেন, ঈশ্বরীপুরের সন্নিকটে বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল এবং উহার দক্ষিণে ৮/১০ মাইল দূরে প্রতাপ নূতন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন, কয়েকটি কারণে তাঁহাদের কথা বিশ্বাস করিতে পারি না। প্রথমতঃ, তাহা হইলে প্রতাপের নূতন দুর্গদ্বার হইতে অদূরে যশোরেশ্বরী দেবীর মূর্তি বাহির হইবার প্রবাদ একেবারে পরিত্যাগ করিতে হয়। দ্বিতীয়তঃ, ঈশ্বরীপুর হইতে দক্ষিণে ৮/১০ মাইল পর্যন্ত পরিষ্কৃত হইয়া আবাদ হইয়াছে। উহার অধিকাংশই নকীপুরের হরিচরণ চৌধুরী মহাশয়ের এলেকাধীন। ঐস্থানে তাঁহার হরিনগর কাছারী আছে। তাহার পূর্ব্ব পার্শ্বে ধুমঘাট নদী। কাছারীর উত্তর-পশ্চিমে, ঈশ্বরীপুর পর্য্যন্ত সবস্থানই এক্ষণে আবাদ হইয়াছে; কিন্তু কোন স্থানে কোন ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায় নাই। ধুমঘাট নদী ও কদমতলীর মোহানা হইতে সিঙ্গুড়তলী চুণকুড়ি ও ঘজিখালি নদীপথে পশ্চিমমুখে যমুনাতে পড়িতে হয়; এই পথের উত্তরে আবাদ ও দক্ষিণে নিবিড় জঙ্গল। জঙ্গলে কোন মনুষ্যাবাসের সংবাদ পাই নাই। যমুনা হইতে পূৰ্ব্ব দক্ষিণ মুখে আইবুড়ীর দোয়ানিয়া ও মঠের খাল দিয়া ভিতরে প্রবেশ করা যায় বটে, কিন্তু তথায় রমজাননগর নামক হাল আবাদে দুই একটি পুকুর, কতকগুলি বেলগাছ এবং সামান্য ইষ্টকাদি ভিন্ন প্রকাণ্ড দুর্গ বা রাজধানীর কোন চিহ্ন নাই। প্রায় ২৫ বৎসর কাল প্রতাপাদিত্যের মত পরাক্রান্ত ভূপতি যেখানে রাজাসন পাতিয়া শাসন করিয়াছিলেন, তাহার নিকট কোন কীর্ত্তি-চিহ্ন নাই, অথচ তাহার বহুদূর দক্ষিণে মালঞ্চ হইতে বহির্গত হরিখালি নদীর পার্শ্বে ভগ্ন ইষ্টকালয় এখনও বৰ্ত্তমান আছে এবং তাহারও দক্ষিণে কোন কোন স্থানে ইষ্টক চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। এমন কি, ঈশ্বরীপুর হইতে দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব কোণে ১৭৩ নং লাটে ইচ্ছামতী ও আড়পাঙ্গাসিয়ার মধ্যবর্তী আড়াইবাঁকীর দোয়ানিয়ার উত্তরাংশে প্রতাপের একটি নৌসেনা নিবাস ছিল, কিন্তু তথায় দুর্গের কোন পরিচয় নাই। এ সকল দূরে বসিয়া কল্পনা নহে, প্রাণ হাতে করিয়া বনে বনে ঘুরিয়া চাক্ষুষ প্রমাণে প্রতিপন্ন করিয়াছি, ঈশ্বরীপুরের দক্ষিণে ২০ মাইলের মধ্যে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল না। তৃতীয়তঃ, ধুমঘাট সম্বন্ধে ভবিষ্যপুরাণে আছে :
‘যশোর-দেশ বিষয়ে যমুনেচ্ছাপ্রসঙ্গমে।
ধুমঘট্টপত্তনে চ ভবিষ্যন্তি ন সংশয়ং।’
অর্থাৎ যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলে ধুমঘাট পত্তন ছিল; সেখানেই প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। কিন্তু ঈশ্বরীপুর হইতে দক্ষিণে গিয়া আর কোথায়ও যমুনা ও ইচ্ছামতীর প্রত্যক্ষ মিলন হয় নাই। সুতরাং ঈশ্বরীপুরের দক্ষিণে প্রতাপের রাজধানী ছিল না।
৩।। নিখিলনাথ রায় মহোদয় বলেন, প্রতাপের রাজধানী সগরদ্বীপে ছিল।[৩] নিজের মত স্থাপন জন্য তিনি প্রধানতঃ দুইটি প্রমাণ উপস্থিত করিয়াছেন। প্রথমতঃ, তিনি ধরিয়া লইয়াছেন যশোর ও ধুমঘাট সংলগ্ন স্থান। সুতরাং যশোর হইতে কার্ভালোর হত্যার সংবাদ চ্যাণ্ডিকানে পৌঁছিতে এক দিনেরও অধিক সময় লাগিতে পারে, অতএব চ্যাণ্ডিকান যশোর হইতে খুব দূরে অবস্থিত। ইহার উত্তরে এই বলা যায়, প্রতাপাদিত্য কর্তৃক বা তাঁহার জ্ঞাতসারে কার্ভালোর হত্যা যদি সত্যই হইয়াছিল ধরিয়া লই, তাহা হইলেও সে সংবাদ ধুমঘাটস্থ মিশনরীগণকে না জানাইয়া যতক্ষণ চাপিয়া রাখা যায়, তাহার চেষ্টা হইতে পারে; তজ্জন্য সংবাদ পৌঁছিতে বিলম্ব হওয়া সম্ভব। নিখিলনাথ সগরদ্বীপকে চ্যাণ্ডিকান ধরিয়া লইয়া বলেন, যশোর হইতে সগর দ্বীপ বহু দূরবর্ত্তী বলিয়া এরূপ বিলম্ব হইয়াছিল। কিন্তু যত সময় লাগিয়াছিল, এখনও তদপেক্ষা বেশী সময় লাগে। কিন্তু ‘সে সময়ে দ্রুত জলযানযোগে সর্ব্বদা যেরূপ গতায়াত হইত’ বলিয়া তিনি যে কৈফিয়ৎ দিয়াছেন, তাহা মানিয়া লওয়া যায় না।[৪] দ্বিতীয়তঃ, তাঁহার অন্য প্রমাণ এই যে, বিভারিজ প্রভৃতি লেখকগণ কোন ম্যাপে চ্যাণ্ডিকানের উল্লেখ না দেখিলেও তিনি ১৯০৫ অব্দে প্রকাশিত সার টমাস্ রো’র মানচিত্রে ‘Ile de Chandeican’ বা চ্যাণ্ডিকান দ্বীপের অবস্থান আছে দেখিয়াছিলেন।[৫] এবং রামরাম বসুর গ্রন্থে ও অন্যান্য বহুস্থলে প্রতাপাদিত্যকে সগরদ্বীপের শেষ রাজা বলিয়া আখ্যাত করা হইয়াছে।[৬] প্রতাপাদিত্য যে চ্যাণ্ডিকানের রাজা, তাহা জেসুইটি মিশনরীগণের বিবরণী হইতে জানা গিয়াছে। ইহা হইতে নিখিলনাথের বিচারপ্রণালী এইরূপ দাঁড়াইতেছে : প্রতাপ চ্যাণ্ডিকানের রাজা, প্রতাপ সগরদ্বীপের রাজা, অতএব সগরদ্বীপই চ্যাণ্ডিকান। তর্কবিজ্ঞানের বিচারে ইহার মধ্যে কতকগুলি ভ্রান্তবাদ থাকিয়া যাইতে পারে, তাহা হয়ত তিনি লক্ষ্য করেন নাই। বিশেষতঃ সার টমাস রো’র ম্যাপের উপর তিনি অতিরিক্ত নির্ভর করিয়াছেন; সার টমাস্ ভৌগোলিক নহেন এবং তাঁহার ম্যাপে যে ভাবে চ্যাণ্ডিকান দ্বীপের পূর্ব্বদিকে ঢাকার সন্নিকটে সাতগাঁ নগরীর স্থান দেখান হইয়াছে, তাহাতে সে ম্যাপের কিছুই বিশ্বাস করা চলে না। ‘পরবর্ত্তী কালে কেং কেহ সপ্তগ্রাম প্রদেশকেও চ্যাণ্ডিকান’ বলিতেন, এ কথা নিখিলনাথই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।[৭] প্রকৃতপক্ষে সগরদ্বীপ চ্যাণ্ডিকান রাজ্যের একাংশ মাত্র, এবং প্রতাপ চ্যাণ্ডিকানের রাজা হইয়াও সগরদ্বীপের রাজা ছিলেন। তাহা হইলে সগরদ্বীপই চ্যাণ্ডিকান রাজ্যের রাজধানী হইতে পারে না। ১৫৯৬ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত পাশ্চাত্য ভ্রমণকারীর গ্রন্থে স্পষ্টতঃ লিখিত আছে যে, তখন হুগলী বা গঙ্গানদীর পূর্ব্বদিগ্বর্ত্তী প্রদেশ চ্যাণ্ডিকান বলিয়া বিদিত ছিল; সগরদ্বীপের নিকটবর্ত্তী গঙ্গার প্রবাহকে চ্যাণ্ডিকান নদী বলা হইত; এমন কি, ১৬০৪ অব্দে হুগলী অঞ্চলকে চ্যাণ্ডিকান প্রদেশ বলিত।” সুতরাং সার টমাস্ রো’র ম্যাপে সগরদ্বীপের চ্যাণ্ডিকান নাম হওয়া বিচিত্র নহে। চ্যাণ্ডিকান নামে একটা রাজ্য ছিল, এবং সে রাজ্যের রাজধানী সগরে ছিল বলিয়া মনে করি না।
এইরূপ মনে করিবার হেতুও আছে; সগরদ্বীপে রাজধানীর মত কোন নিদর্শন নাই। কেহ কেহ বলিতে পারেন, যে-দক্ষিণাংশে সমুদ্রতীরে প্রধান সহর ছিল, তাহা এক্ষণে সমুদ্রগর্ভে গিয়াছে। বাস্তবিকই দ্বীপের কতকাংশ বিলুপ্ত হইয়াছে। পূৰ্ব্বে কপিল মুনির মন্দির ছিল; এখন মন্দির নাই, মূর্ত্তি আছে। প্রতিবৎসর পৌষসংক্রান্তির সময়ে লক্ষ লোকে আসিয়া তাঁহার পূজা করে; সমস্ত বৎসর ভরিয়া ২/১ জন মাত্র লোক সে মূর্ত্তির প্রহরীস্বরূপ থাকে। ১৬৮৮ খৃষ্টাব্দের ভীষণ প্লাবনে দ্বীপের এই দশা হইয়াছে, তৎপূর্ব্বে এখানে দুই লক্ষ লোকের বাস ছিল।[৯] আমরা এই দ্বীপের বর্তমান অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়া আসিয়াছি এবং এই দ্বীপে বা নিকটবৰ্ত্তীস্থানে কোন প্রাচীন কীর্তির চিহ্ন আছে কিনা বিশেষভাবে তাহার সন্ধান লইয়া আসিয়াছি। যতদূর জানিয়াছি, তাহাতে দ্বীপের দক্ষিণাংশ সমুদ্রগর্ভে গেলেও খুব বেশীদূর যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নাই, তাহা সত্য কথা। এমন সমুদ্রকূলবর্ত্তী স্থানে কেহ রাজধানী স্থাপন করিলে তাহা সমুদ্রসৈকত হইতে একটু দূরে করাই সম্ভব। তাহা হইলে যতটুকু ভাঙ্গিয়াছে, তাহাতেই রাজধানীর চিহ্ন বিলুপ্ত হইত না। এখনও দ্বীপটি ১৬৫ বর্গ মাইল। ইহার কোথায়ও কোন দুর্গ বা বিস্তীর্ণ রাজপ্রাসাদের নিদর্শন পাই না। পৌষ সংক্রান্তিতে যেখানে মেলা বসে, তাহার উত্তরাংশে জঙ্গলের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ইষ্টকালয়, কয়েক মাইল দূরে উত্তরদিকে বামুনখালি নামক স্থানে একটি মন্দির এবং উত্তরভাগে অর্থাৎ সগরেরই এক অংশ মনসাদ্বীপে মৃত্তিকা নিম্নে ইষ্টক প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে।[১০] মোট কথা, এখানে রাজধানী ছিল না; তবে সমুদ্রপথে হিজলীর দিক হইতে কোন শত্রু আসিয়া রাজ্যাক্রমণ করিতে না পারে, এজন্য প্রতাপাদিত্যের সময়ে এখানে একটি প্রধান নৌবাহিনীর আড্ডা ছিল। সেইজন্য বন্দর বা নৌসেনার নিবাসগুলি যাহা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা কতক ভগ্ন হইয়া সমুদ্রগর্ভে এবং কতক ভীষণ প্লাবনে বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। নিখিলনাথও এ কথা স্বীকার করিতে গিয়া লিখিয়াছেন : ‘প্রতাপাদিত্য ইহাকে নৌ-বাহিনীর প্রধান স্থান করিয়াছিলেন বলিয়া, ইহা তাঁহার রাজধানী যশোর অপেক্ষা ইউরোপীয়দিগের নিকট সুপরিচিত ছিল।’[১১] আর এই রাজধানী যশোর বলিতে ধুমঘাটের নূতন রাজধানী বুঝিলে সকল গোলমাল চুকিয়া যাইত এবং অনেককে গতানুগতিকের মত ভুল ধারণা পোষণ করিতে হইত না।[১২]
৪॥ এক্ষণে আমরা চতুর্থ মতের বিচার করিব। কেহ কেহ বলেন, বিক্রমাদিত্যের রাজধানী তেরকাটি বা তিওরকাটি জঙ্গলে ছিল। এই স্থান এখন সুন্দরবনের ১৬৯ নং লাটের অন্তর্গত এবং ঈশ্বরীপুর হইতে ৭/৮ মাইল পূৰ্ব্বদক্ষিণে অবস্থিত। তেরকাটি গভর্ণমেন্টের খাস জঙ্গল (Reserve Forest); উহা এখন বেশ উচ্চ ভূমি; এজন্য শীঘ্র আবাদী বন্দোবস্ত হইবার কথা চলিতেছে। ইহা যে এক সময়ে মনুষ্যের আবাসভূমি ছিল, তাহা অনেকে জানিত; এজন্য ইহার পত্তন ও অধিবাসী সম্বন্ধে নানা জল্পনা চলিয়াছে। তবে ইহা যে বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল না, তাহাই আমাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের প্রথম কারণ এই, গৌড় হইতে গঙ্গাপথে আসিতে গেলে যমুনা দিয়া হাসনাবাদ অঞ্চলে আসাই সহজ; এবং সেখানে বসন্ত রায়ের পত্তন স্থান এখনও বসন্তপুর নামে খ্যাত। তেরকাটিতে আসিবার বেলায় ভৈরব-কপোতাক্ষীর পথে বহু ঘুরিয়া আসিতে হয়, এবং ততদূর না আসিয়াও আবাদী অঞ্চলে প্রথম পত্তন হইতে পারিত। যমুনা ঘুরিয়া তেরকাটি যাইতে হইলে, ধুমঘাট ছাড়িয়া তথায় যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। দ্বিতীয় কারণ, তেরকাটিতে দুর্গ বা রাজধানীর কোন চিহ্ন নাই। আমরা তিনদিক হইতে তেরকাটির খালে প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছি। পূর্ব্বদিকে চুনার নদী হইতে তেরকাটির খালে প্রবেশ করিয়া ৭/৮ আইট্ বা পুরাতন বাটীর চিহ্ন এবং বহু গ্রাম্য বৃক্ষলতা দেখিয়াছিলাম। পরে নৈহাটির খাল ও নৈহাটির দোয়ানিয়া দিয়া প্রবেশ করিয়া নানা মনুষ্যাবাসের নিদর্শন, ইষ্টক, পুষ্করিণী এবং গাব প্রভৃতি গ্রাম্যতরু দেখিয়াছিলাম। এমন কি, একস্থানে বকুল বৃক্ষ ও দুর্ব্বাক্ষেত্র দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলাম। পশ্চিমদিক হইতেও এইরূপ মালঞ্চ নদী হইতে টাটের খাল দিয়া কলাগাছি নদীতে পড়িলাম; বগিদোয়ানী, কেয়া ও তেরকাটির খাল— কলাগাছিয়া হইতে উঠিয়াছে। উহারই একটির কূলে ভীষণ ঘোষড় বনের মধ্যে কতকগুলি আইট্ পাইলাম। এখানে ভিটা, গাবগাছ ও নানা স্থানে ইট আছে। একজন বলিয়াছিলেন, একটি মসজিদ্ আছে, কিন্তু অনেক খুঁজিয়াও তাহা দেখিতে পাই নাই। কোথায়ও বিস্তীর্ণ দুর্গ, স্থায়ী দেবালয় বা রাজপ্রাসাদাদির ভগ্নাবশেষ আমাদের নয়ন-পথে পড়ে নাই। ইহা দ্বারা স্থির হয় তেরকাটিতে প্রাচীন বা নূতন কোন রাজধানী ছিল না।
ধুমঘাটে নূতন রাজধানী স্থাপিত হওয়ার পর সে সহর উত্তরদিকে প্রাচীন যশোহরের সহিত মিশিয়া গিয়াছিল এবং পূর্ব্বে ও দক্ষিণে ক্রমে বহুদূর বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল। উচ্চপদস্থ ধনী বা ভদ্রলোকের বসতি ঈশ্বরীপুরে বা তাহার উত্তর দিকে হইয়াছিল, কিন্তু নিম্নশ্রেণীর বা ব্যবসায়ী লোকের বসতি একটু দূরে দূরে তেরকাটি অঞ্চলে বা ধুমঘাট নদীর পশ্চিমকূলে হইয়াছিল। তেরকাটি নামটি হইতেও তাহা অনুমিত হয়। তেরকাটি বা তিওরকাটি অর্থাৎ যেখানে তিওর বা মৎস্যজীবীগণ জঙ্গল কাটিয়া বসতি করিয়াছিলেন। উহার মধ্যবর্তী মোড়লখালি, পোদখালি প্রভৃতি খালের কূলেও ঐরূপ নিম্নশ্রেণীর লোকের বসতি ছিল বলিয়া বোধ হয়; উঁহারা প্রকাণ্ড সহরের লোকের খাদ্যসরঞ্জামাদি সরবরাহ করিতেন। এখনও কলিকাতার উপকণ্ঠে বহুদূরবর্তী স্থান হইতেও ব্যবসায়ীরা মৎস্য তরকারী প্রভৃতি দ্রব্যজাত লইয়া গিয়া অতি প্রত্যুষ হইতে সহরের জনতা বৃদ্ধি করেন। সেইরূপ তেরকাটির লোকের যাতায়াতের জন্যও ধুমঘাট পর্য্যন্ত যে সোজা রাস্তা ছিল, তাহার চিহ্ন এখনও আছে, উহার পাশে পাশে অসংখ্য ভিটা এখনও পড়িয়া আছে; পূর্ব্বে ধুমঘাটের সহিত তেরকাটি সংলগ্ন গ্রাম ছিল, এখন একটি নদী দ্বারা পৃথক হইয়া পড়িয়াছে।[১৩]
৫॥ এতক্ষণ আমরা প্রথম চারিটি মতের খণ্ডন করিয়াছি; এখন আমরা পঞ্চম মত বা আমাদের নিজ মতের সমর্থন করিব। অন্য মতের নিরসন করাতেই এক প্রকার স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, ধুমঘাটে বা ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল; এবং আমরা অনুমান করিয়াছি, এখন যে স্থানকে মুকুন্দপুর বলে, সেখানেই প্রথম বা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তাহার নাম ছিল— যশোহর। পরে প্রতাপের ধুমঘাট রাজধানী সমৃদ্ধিশালিনী হইলে, তাহারও নাম হয়— যশোহর। ক্রমে কীৰ্ত্তিমণ্ডিত এই উভয় রাজধানী পরস্পর মিশিয়া গিয়াছিল এবং আট দশ মাইল লইয়া সমস্ত স্থানটাই যশোহর এই সাধারণ নামে পরিচিত হইল। নতুবা যশোহর নামে কোন চিহ্নিত গ্রাম নাই। যাহা হউক, আমরা এক্ষণে সংক্ষেপতঃ মুকুন্দপুর ও ঈশ্বরীপুরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও কীর্তিরাজির বিচার করিয়া আমাদের মত স্থাপন করিব।
মুকুন্দপুরে বিস্তীর্ণ দুর্গ ছিল, তাহা এখনও বেশ বুঝা যায়। উহার তিন পাশের পরিখাতে এখনও প্রায় বারমাস জল থাকে। ইহার নাম মুকুন্দপুর হইল কেন, তাহা ঠিক জানা যায় না। তবে নামটির কিছু ইতিহাস আছে, মনে হয়। এক্ষণে মুকুন্দপুরের গড়ের মধ্যে জয়রাম রায় ও লক্ষ্মণচন্দ্র রায় ভ্রাতৃদ্বয় রামলক্ষ্মণের মত সৌহৃদ্যে সুখে বাস করিতেছেন।[১৪] ইঁহাদের পূর্ব্ব নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদে। তথায় লক্ষ্মণচন্দ্র রায়ের প্রপিতামহ রামচন্দ্র রায় আলিবর্দ্দী খাঁর শাসনকালে নদীয়ার রাজার উকীল ছিলেন। তখন ধুলিয়াপুর নদীয়ারাজের প্রধান পরগণা। সেই সূত্রে রামচন্দ্র স্বীয় কার্যদক্ষতার পুরষ্কারস্বরূপ প্রভূত ব্রহ্মোত্তর পাইয়া এই মুকুন্দপুরে আসিয়া বাস করেন। তদবধি এই পাঁচ পুরুষ অর্থাৎ আনুমানিক ১৫০ বৎসর তাঁহারা এখানে বাস করিতেছেন। তাহা হইলে প্রতাপাদিত্যের পতনের প্রায় ১৫০ বৎসর পরে রামচন্দ্র মুকুন্দপুরে আসেন। সেই দীর্ঘকাল প্রাচীন যশোহরের কত কীৰ্ত্তিচিহ্ন বিলুপ্ত হইয়াছিল, তাহা কে জানে?
দুই শত বৎসর পূর্ব্বে দুর্গের অবস্থা কি ছিল, এখন তাহা বলিবার উপায় নাই; তবে এখনও গড়ের মধ্যে প্রায় ১৫০ বিঘা জমি আছে ও তাহাতে যেখানে সেখানে ইষ্টক চিহ্ন আছে; সে সব স্থানে রাজবাটী নির্ম্মিত হইয়াছিল। বসন্ত রায় প্রথমতঃ বসন্তপুর হইতে জঙ্গল পরিষ্কার করিতে করিতে অনতিদূরে মুকুন্দপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। উহার চারিধারে আত্মীয়স্বজন, ব্রাহ্মণপণ্ডিত ও সামাজিকদিগের বসতির ব্যবস্থা হয়। ধলবাড়িয়া, মুকুন্দপুর, দেবনগর ও পরমানন্দকাটি প্রভৃতি গ্রামে অধ্যাপক, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণবর্গের বাস হয়। কালিন্দী তখন ক্ষুদ্র স্রোতমাত্র; তাহার অপর পারে বাঙ্গালপাড়া, বাঁকড়া প্রভৃতি স্থানে রাজজ্ঞাতিগণের বসতি নির্দ্দিষ্ট হয়। নিকটবর্ত্তী পরবাজপুর, বারকপুর[১৫] প্রভৃতি স্থানে সেনানিবাস ছিল। পাঠান সৈন্যের উপাসনার জন্য পরবাজপুরে যে সুন্দর মসজিদ নির্মিত হয়, তাহার বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি। বসন্তপুরের অপর পারে দম্দমা নামক স্থানে গুলি বারুদ প্রস্তুত হইত।[১৬] বিক্রমাদিত্যের সময়েই গোপালপুরের উত্তরাংশে এক প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা খনিত হয়; উহার জলাশয়ের পরিমাণই ৯৯ বিঘা। যশোহর সহরকে কাশীধামের সহিত তুলনা করিতে গিয়া ইহাকেই মণিকণিকা দীর্ঘিকা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছিল। ডামরেলীর সমাজমন্দির এই মুকুন্দপুরের সান্নিধ্যে ছিল; অতি অল্পকাল পূর্ব্বে যে উহার জঙ্গল পরিষ্কৃত হইয়াছিল, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। গৌড়ের যশোহরণকারী সহরের সৌষ্ঠববৃদ্ধির জন্য যে সব শিল্পীর সমাগম হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে খণ্ডিকার, কর্মকার প্রভৃতি কতকের বাস এখনও আছে। এই সকল তথ্য একত্র মিলাইয়া দেখিলে সহজে অনুমিত হইবে যে, বিক্রমাদিত্যের রাজধানী মুকুন্দপুরে ছিল।
এই মুকুন্দপুর হইতে ৮/১০ মাইল দক্ষিণে যেখানে যমুনা ও ইচ্ছামতীর সম্মিলিত প্রবাহ দ্বিধা বিভক্ত হইয়া দুইদিকে গিয়াছে, সেই ‘যমুনেচ্ছাপ্রসঙ্গমে’র দক্ষিণ পারে প্রতাপাদিত্যের ধুমঘাট দুর্গ নির্ম্মিত হইয়াছিল। সেই দুর্গের অনতিদূরে জঙ্গলের মধ্যে যশোরেশ্বরী দেবীর পীঠমূর্ত্তি আবিষ্কৃত হয়। যেখানে ক্রোশৈক বিস্তৃত যুক্তনদী যমুনা ৪/৫ মাইল সোজা দক্ষিণ মুখে আসিয়া মুক্ত হইয়া পড়িয়াছে, সেইস্থানে প্রতাপাদিত্যের প্রকাণ্ড বুরুজখানা। উহার মৃত্তিকার ঢিপি এখনও রহিয়াছে, তাহা প্রায় ১০/১২ হাত উচ্চ। ইহার উপর নদীমুখ করিয়া প্রকাণ্ড কামান সজ্জীভূত থাকিত, তাহাতে যখন অনল উদ্গদ্গীরিত হইত, তখন নদীবক্ষে বহুদূরেও শত্রু-তরণী তিষ্ঠিতে পারিত না। আর এই প্রধান বুরুজের দুইপার্শ্বে উভয় নদীর কূলে কূলে পূর্ব পশ্চিমে বহুদূর পর্য্যন্ত, মাটীর প্রাচীরের উপর সারি সারি বুরুজ ছিল, প্রত্যেকটির উপর কামান থাকিত। এখনও তাহার অসংখ্য ঢিপি বৰ্ত্তমান আছে। ইহারই কাছে যেখানে সেখানে মাটীর মধ্যে কামানের গোলা পাওয়া গিয়াছে।
প্রধান বুরুজ হইতে শতাধিক হস্ত দক্ষিণে ধুমঘাট দুর্গের বেষ্টন-পরিখা। উহা দুর্গটির চারিধার ঘিরিয়া আছে; এক একটি নদীর মত প্রশস্ত; এখনও তাহাতে জল থাকে। এই পরিখার বাহিরে কিছুদূরে বাহিরের পরিখা ছিল; উত্তর ও পূর্ব্বদিকে যমুনা ও ইচ্ছামতী নদীদ্বারা এবং অন্য দুইদিকে দুইটি খনিত খাল দ্বারা দুর্গটি বেষ্টিত হইয়াছিল। পশ্চিমের খালটির নাম কামারখালি; উহার কূলে কূলে গোলাগুলি ও অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণকারী কামারদিগের বসতি ছিল। দক্ষিণের খালের নাম হাবরের খাল বা হানরখালি। কামারখালি উত্তরদিকে গিয়া যুমনায় এবং হানরখালি খাল বা হানরখালি। কামারখালি উত্তরদিকে গিয়া যমুনায় এবং হানরখালি পূৰ্ব্বমুখে গিয়া ইচ্ছামতীতে মিশিয়া ছিল। কামারখালি বেশ প্রশস্ত; তাহা দিয়া পাথর ও লৌহ বোঝাই জাহাজ আসিত এখনও ঐ খালের কূলে ও দুর্গপ্রাচীরের পার্শ্বে রাস্তার ধারে রাশি রাশি লৌহমণ্ডূর বা লোহার গুজ পাওয়া যায়। পাথরের গোলকের উপর লৌহের আবরণ দিয়া কামানের গোলা হইত।[১৭]
ভিতরের যে বেষ্টন-পরিখার কথা বলিলাম, তাহারই মধ্যে ছিল মৃন্ময় দুর্গ। তাঁহার দীর্ঘায়ত মৃত্তিকা-প্রাচীর কতকাল ধরিয়া ক্ষয়িত হইয়া এখনও পাহাড়ের মত উচ্চ রহিয়াছে এবং উহার উপর প্রকাণ্ড বৃক্ষ এবং কত কত লোকের বসতি হইয়াছে। উহারই মধ্যবর্তী সমতল ভূমির উপর সৈন্যাবাস প্রভৃতি রচিত হইয়াছিল। এই প্রায় সমচতুষ্কোণ ভূমির পরিমাণ ২১৪ বিঘা ১৪ কাঠা, উহার দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ প্রত্যেকদিকে ১২/১৩ শত হাত হইবে। এই মৃন্ময় দুর্গের১৮ ভিতরেও সম্ভবতঃ প্রাচীরের পার্শ্ব দিয়া ঘুরাইয়া অপ্রশস্ত খাল ছিল এবং উত্তর-পশ্চিম কোণ হইতে উহা বাহিরে গিয়া দূরবর্তী কামারখালিতে মিশিয়াছিল। সেই খাল এখনও আছে এবং কামারখালির সহিত উহার মিলনস্থানকে ‘শরৎখানার দহ’ বলে। আধুনিক সকল দুর্গেই এরূপ পলায়নের গুপ্ত পথ থাকে এবং তাহাকে Water gate বা জলপথ বলে।
প্রতাপাদিত্যের পতনের অব্যবহিত পরে সুন্দরবনের স্বাভাবিক প্রকৃতি অনুসারে অকস্মাৎ এই দুর্গ ও রাজধানী অবনমিত হইয়া বহুকাল জলাকীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়ে। তখন দুর্গপ্রাচীরের মধ্যবর্ত্তী স্থান অনেকাল ধরিয়া ডুবিয়া থাকে এবং সমস্ত গৃহাদি বিনষ্ট হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়ে। ক্রমে তাহার উপর উচ্চ পাহাড়ের মাটি ধুইয়া পলিস্তর জমিয়া যায় এবং অট্টালিকাদি সমস্ত ভূগর্ভস্থ হয়। সেই মাটীর স্তরে অবশেষে সুন্দরী প্রভৃতি বন্য বৃক্ষ জন্মিয়া ভীষণ অরণ্য হইয়া যায়। বহুকাল পরে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অর্থাৎ প্রায় ১৭৫ বৎসর পরে, যখন উহার নিকটবর্ত্তী স্থান বাসের উপযোগী হইয়া উঠে, তখন দূর স্থান হইতে লোক আসিয়া ধনধান্যের লোভে এই প্রদেশে বাস করে এবং তাহারাই উক্ত দুর্গ মধ্যস্থ জঙ্গল কাটিয়া আবাদ পত্তন করে। চারিপার্শ্বে প্ৰকাণ্ড মাটীর ঢিপি, এবং মধ্যস্থান নিম্ন দেখিয়া, তাহারা উহাকে প্রাচীন কালের কোন এক প্রকাণ্ড দীঘি বলিয়া অনুমান করে। লোকে শুনিয়াছে, প্রতাপের পর একসময়ে চাঁদ রায় কিছুকাল এই প্রদেশে রাজত্ব করেন; তাঁহার স্বাক্ষরযুক্ত সনন্দ এখনও দেখা যায়। এইজন্য তাহারা উক্ত প্রাচীন দুর্গকে দুর্গ না বলিয়া ‘চাঁদরায়ের দীঘি’ বলিয়া কীর্ত্তিত করে। এখনও সাধারণ লোকে মধ্যবর্তী স্থানকে ‘দীঘির বিল’ বলে। কিন্তু প্রাচীন ম্যাপ ও অন্যান্য বিবরণীতে প্রাচীন দুর্গ বলিয়াই উল্লিখিত হইয়াছে।[১৯]
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উহা দীঘি নহে। যদি উহা দীঘিই হইত, তাহা হইলে উহার মধ্যস্থলে প্রকাণ্ড সুন্দরী বৃক্ষ জন্মিত না। এখনও ২/১ হাত মাটীর নিম্নে সুন্দরী প্রভৃতি বৃক্ষের গুঁড়ি পাওয়া যায়। জলাশয় হইলে তাহার গর্ভে জোব মাটি জমিত; প্রকাণ্ড বৃক্ষ মাথা তুলিতে পারিত না এবং উহার মধ্যেও পাহাড়ের মাটীর মত সুন্দর রক্তাভ মাটী হইত না। পাহাড়ের উপর ও পার্শ্বে খুঁড়িলে যেখানে সেখানে ইষ্টকরাশি বাহির হইত না।[২০]
দুর্গের পূর্ব্বদিকে পরিখার বাহিরে একটি স্থানকে এখনও রাজবাড়ী বলে ঐ স্থানে কয়েকটি পুকুর ও স্থানে স্থানে যথেষ্ট ইষ্টক পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ এইস্থানে রাজপ্রাসাদ ছিল এবং তাহা পূর্ব্বমুখী করিয়া নির্ম্মিত হয়। রাজবাটীর সিংহদ্বার হইতে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি রাস্তা দক্ষিণমুখে গিয়া যশোরেশ্বরী বাড়ীর সদর দরজায় মিশিয়াছে। রাস্তাটি এখনও আছে। সেই রাস্তার অপর পারে ঠিক রাজবাটীর সম্মুখে বারদুয়ারী গৃহের ভগ্নাবশেষ এখনও রহিয়াছে। ইহা অতি সুন্দর কারুকার্যখচিত সুদৃঢ় অট্টালিকা ছিল। মোগলদিগের ভাষায় ইহাই প্রতাপাদিত্যের দেওয়ানী-আম বা সাধারণ দরবার গৃহ।[২১] কথিত আছে, প্রতাপ এই পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ গৃহে দক্ষিণমুখী হইয়া দরবারে বসিলে মায়ের মন্দিরের সদর দ্বার দেখিতে পাইতেন, এখনও তাহা দেখা যায়। বারদ্বারীর সম্মুখে পদ্মপুকুর। উহারই দক্ষিণে আসিয়া যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির। উহা একটি চকমিলান বাড়ী। উত্তরদিকে সদর দ্বার, তাহার দুই পার্শ্বে সারি সারি কয়েকটি ঘর। পূর্ব্ব পোতায় মন্দির এবং মায়ের মূর্ত্তির সম্মুখে পশ্চিম পোতায় তাহার একটি তোরণ এবং উহার দুই পার্শ্বে ও দ্বিতলে কয়েকটি বাসের গৃহ। দক্ষিণেও সারি সারি পাকা ঘর। মধ্যস্থলে আধুনিক নাটমন্দির, পূর্ব্বে কি ছিল জানা যায় না। মায়ের বাড়ীর পশ্চিমদিকে একটি সদর পুষ্করিণী এবং পূর্ব্বদিকে খর্পরপুকুর ও উত্তর-পূর্ব্ব অর্থাৎ ঈশান কোণে চণ্ডভৈরব মহাদেবের ত্রিকোণ মন্দির মায়ের বাড়ী ত্যাগ করিয়া আরও দক্ষিণদিকে অগ্রসর হইলে একটি প্রাচীন অট্টালিকা দেখিতে পাওয়া যায়, উহাকে লোকে সাধারণতঃ হাবসিখানা বলে। ইহা অতি সুন্দর শক্ত ইমারত ছিল, এখন অনেকটা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। উহার মধ্যে একপার্শ্বে একটি কূপ দেখিয়া লোকে বলিত, এই স্থানে কয়েদীদিগকে হাজতে বা বন্দী করিয়া রাখা হইত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা একটি স্নানাগার মাত্র; কূপ হইতে জল তুলিয়া নলসংযোগে উহা গৃহান্তরে নীত হইত এবং সেখানে সম্ভবতঃ গরম ও ঠাণ্ডা উভয় প্রকার জলের ব্যবস্থা হইত; কোন উচ্চপদস্থ আমীর তথায় উন্মুক্তদেহে দ্বারবদ্ধ ঘরে স্নান করিতে পারিতেন।[২২] পার্শ্বে সংলগ্ন কয়েকটি গৃহ আছে এবং দ্বিতলেও থাকিবার ঘর ছিল, তাহা এখন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সম্ভবতঃ প্রতাপাদিত্য এই গৃহটি অভ্যাগত আমীর ওমারহগণের অভ্যর্থনার জন্য নির্ম্মাণ করেন এবং তাঁহার পতনের পর মোগল ফৌজদারের ধুমঘাটে অবস্থানের সময় তিনি এই গৃহেই বাস করিতেন।[২৩] দুর্গের পাঁচ মাইল উত্তরে জাহাজঘাটায় এবং মোগল ফৌজদারের পরবর্ত্তী শাসনকেন্দ্র ত্রিমোহানীতে এইরূপ হামামখানা সম্বলিত বাসগৃহ আছে। যথাস্থানে উহার উল্লেখ করিব। সম্প্রতি ‘প্রাচীন কীর্তি রক্ষার’ আইন অনুসারে ঈশ্বরীপুরের হামামখানা গভর্ণমেন্টের ব্যয়ে সংস্কৃত ও রক্ষিত হইবে বলিয়া স্থির হইয়াছে।
হামামখানা ছাড়িয়া আর একটু দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে অগ্রসর হইলে এক প্রকাণ্ড পুরাতন মসজিদ দেখিতে পাওয়া যায়। সরকারী রিপোর্টে উহাকে টেঙ্গা মসজিদ বলা হইয়াছে;[২৪] ‘টেঙ্গা’ নামের উৎপত্তির কোন কারণ জানা যায় না। ইহা যে প্রতাপাদিত্যের নূতন রাজধানীতে অবস্থিত মুসলমান সৈন্য ও রাজকর্মচারিগণের উপাসনা-গৃহ বলিয়া নিৰ্ম্মিত, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। পুরাতন রাজধানীর পার্শ্বে যেমন পরবাজপুরের সুন্দর মসজিদ তেমনি ধুমঘাটের নূতন রাজধানীতে এই পঞ্চগুম্বজযুক্ত প্রকাণ্ড উপাসনালয়। মজিদটি এক শ্রেণীতে পাঁচটি ঘরে বিভক্ত, প্ৰত্যেক ঘরের উপর একটি গুম্বুজ। মসজিদের বাহির পরিমাণ ১৩৬′′ ×৩৩′, মধ্যস্থলের ঘরটির ভিতরের মাপ ২০′-৯′′ × ২০′-৯′′ এবং পার্শ্ববর্ত্তী অন্য চারিটির প্রত্যেকটি ১৮′-৭′′ × ১৮′-৭′′ ইঞ্চি। মেজে হইতে গুম্বুজের উচ্চতা ৩৬′। মসজিদটি অন্ততঃ পাঁচ ছয় ফুট বসিয়া গিয়াছে; কারণ, উহার মেজে প্রথম সময়ে যদি মাটী হইতে ৩ ফুট উচ্চ ধরা যায়, তাহা হইলে এখন দেখা যাইতেছে যে, সেই মেজেই তিন ফুট মাটীর নিম্নে বসিয়া গিয়াছে। মধ্য ঘরের দরজার খিলান ৭′-৩′′ প্রশস্ত এবং অন্য ঘরগুলির দরজার খিলান ৬′-৩′′ প্রশস্ত। ভিত্তি সৰ্ব্বত্রই ৭ ফুট। বাগেরহাটে খাঁ জাহান আলির সমাধিমন্দিরাদি ব্যতীত এরূপ শক্ত মসজিদ এ প্রদেশে বড় কম দেখিতে পাওয়া যায়। মসজিদের পূর্ব্বদিকে তিনদিকে প্রাচীর বেষ্টিত একটি চত্বর ছিল এবং মসজিদের দরজা হইতে পূর্ব্বদিকের সদর ফটক ৮৬ ফুট দূরবর্ত্তী ছিল। এই চত্বরের উত্তর গায়ে সারি সারি কয়েকটি সমাধি ছিল, দেখিতে পাওয়া যায়। সেগুলি ‘বার ওমরার কবর’ বলিয়া খ্যাত। কথিত আছে, এক সময়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে যে বারজন মোগল ওমরাহ প্রেরিত হন, তাঁহাদের সকলেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হইলে, প্রতাপের সুব্যবস্থায় তাঁহাদের মৃতদেহ এই স্থানে আনিয়া কবর দেওয়া হয়। ইহা একপক্ষে যেমন হিন্দুবীরের বিজয়স্তম্ভ, অন্যপক্ষে মৃতশরীরের প্রতি তাঁহার সদন্তঃকরণের পরিচায়ক।
টেঙ্গা মজিদের উত্তরাংশে আর একটি অষ্টকোণ গুম্বজওয়ালা ইষ্টকালয়ের ভগ্নাবশেষ এক্ষণে প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের কোটরস্থ আছে। হিন্দুরা বলেন উহা লক্ষ্মীদেবীর মন্দির এবং মুসলমান মৌলবীদিগের মতে উহা ‘বিবির আস্তান’ অর্থাৎ মুসলমান রমণীগণের নেমাজ করিবার ঘর। এই শেষোক্ত মতই সমীচীন বলিয়া বোধ হয়; প্রধান প্রধান জুম্মামজিদের একাংশে স্ত্রীলোকদিগের নেমাজের ব্যবস্থা দিল্লী আগ্রায়ও দেখিতে পাওয়া যায়। প্রতাপাদিত্যের জনবহুল যশোহর নগরীতে রমণীবর্গের জন্য এইরূপ রাজোচিত বিশেষ ব্যবস্থা যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনই প্ৰশংসনীয়।
যশোহরের জুম্মামজিদ হইতে উত্তরদিকে বহুদূর অগ্রসর হইলে, ইছামতীর কূলে খৃষ্টানদিগের জন্য গীর্জ্জা নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল; সে গীর্জ্জার ভগ্নাবশেষ ও সংশ্লিষ্ট কবরখানা এখনও আছে। সে গীর্জ্জা চ্যাণ্ডিকানেই ছিল বলিয়া বিবরণ আছে।[২৫] সুতরাং ইহা হইতেও সপ্রমাণ হয় যে, ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে অর্থাৎ যশোহরেই চ্যাণ্ডিকান; অর্থাৎ যশোহর ও চ্যাণ্ডিকান অভিন্ন এবং এই স্থানেই প্রতাপাদিত্যের লোকবিশ্রুত রাজধানী।
আর একটি কথা বলা হইলেই আমাদের এ প্রসঙ্গ শেষ হয়। ‘বহারিস্তান’ হইতে জানিতে পারিতেছি, প্রতাপের শেষ পরাজয়ের প্রাক্কালে মোগল সেনাপতি ইনায়েৎ খাঁ এবং মীর্জ্জা সহন২৬ যখন প্রতাপের অনলবর্ষী কামানের মুখে অতি কষ্টে যমুনা ইচ্ছামতীর সঙ্গমস্থল পার হইয়া পূৰ্ব্বদিকে ইছামতীতে প্রবেশ করেন, তখন ইনায়েৎ কাগরঘাট নামক স্থানে আসিয়া বাম পারে ছাউনী করে এবং মীর্জ্জা বীরবিক্রমে নদী পার হইয়া পূর্ব্বদিক হইতে দুর্গদ্বার আক্রমণ করেন।[২৭] এই কাগরঘাটই খাগড়াঘাট; উহা এখনও ইচ্ছামতীর পরপারে বর্ত্তমান আছে। খাগড়াঘাট গ্রামের পশ্চিমার্দ্ধ মাতা যশোরেশ্বরী দেবীর দেবোত্তর সম্পত্তি, এখনও উহার আয় মাতার সেবায় ব্যয়িত হইতেছে। সুতরাং খাগড়াঘাটের অবস্থান হইতেও প্রতাপাদিত্যের রাজধানীর স্থান নির্দ্দেশ করা যায়। আশা করি, এই বিস্তৃত আলোচনার পর প্রতাপের রাজধানী সম্বন্ধে আর কাহারও কোন সন্দেহ থাকিবে না।
পাদটীকা :
১. Beveridge, District of Bakarganj, pp. 176-9; J. A. S. B., 1876., pp. 71-6. Mr. H. J. Rainey বিভারিজের কথায় আস্থা না করিয়া বলেশ্বর নদীর হরিণঘাটা নামক মোহানার সন্নিকটে চণ্ডীশ্বর নামক স্থানে ধুমঘাট রাজধানী ছিল বলিয়া কল্পনা করেন (Calcutta Review, 1877, Vol. 65. p. 266.), কিন্তু সেখানে রাজধানীর চিহ্ন নাই; সম্ভবতঃ প্রাচীনকালে একটি বন্দর ছিল। বর্তমান গ্রন্থের ১ম খণ্ড, ৪১-৫৬ পৃ।
২. ‘There is certainly much to be said in favour of this (Beveridge’s) theory, and it is reasonable to assume the Bikram’s headquarters and pratap’s new capital, which were so close to each other, would be amalgammated when Pratapaditya took the reins of government into his own hands’-Faulkner, Leo p., ‘Where Partapaditya Reigned’. Calcutta Review, 1920, p. 183.
৩. ‘প্রতাপাদিত্য’, ১৩৩-৪৫ পৃ।
৪. ‘প্রতাপাদিত্য’, ১৪৩ পৃ।
৫. ১৯০৫ অব্দে ‘Glasgow’ হইতে purchas, ‘pilgrimes’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে এই মানচিত্রকে Sir Thomas Roe’s map বলিয়া উল্লিখিত আছে।— ‘প্রতাপাদিত্য’, ১৪০ পৃ।
৬. List of Ancient Monuments in Bengal, p. 146; J. A. S. B., Dec. 1868.
৭. Bernmilli; Tean, Description Historique, Vol. II part 2. p. 408-as quoted by Nikhil Nath Roy (‘প্রতাপাদিত্য’, ১৪৩ পৃ)।
৮. ‘Before 1596, when earliest edition of Van Linschoten’s work was published, the country to the East of the Hugli river was known as the country of Chandecan. One of the channels of the Hugli near Saugor Island, if not the Hugli itself, was then called the river of Chandecan. In 1604, the Jesuit Residence at Hugli was designated as situated in the Chandecan district. ‘ — J. A. S. B., 1913, No. 10, p. 441; 1911, p. 16. Cf. Van Linschoten – Itinerario, part II, Amsterdam, 1596, Ch. xi.
৯. বিশেষ বিবরণ বর্তমান গ্রন্থের ১ম খণ্ড ১০০-১১৩ পৃ দ্রষ্টব্য।
১০. সগরদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিখ্যাত Light House বা আলোকমঞ্চ আছে। উহার যিনি বৰ্ত্তমান তত্ত্বাবধায়ক, তাঁহার নাম Mr. A. J. Manuel, ইনি বিশিষ্ট সজ্জন; আমি তাঁহার নিকট তত্ত্বজিজ্ঞাসু হইলে তিনি লিখিয়াছেন যে, কিছুদিন পূর্ব্বে মৃত্তিকার নিম্নে একটি সুবর্ণ অঙ্গুরীয়ক পাইয়াছিলেন; উহার উপর একটি ছোট মনুষ্য-মূৰ্ত্তি অঙ্কিত আছে বলিয়া বোধ হয়। পত্রের উপর তিনি অঙ্গুরীয়কটির সুস্পষ্ট ছাপ দিয়া পাঠাইয়াছিলেন। আলোকমঞ্চের নিকট একস্থান খনন করিতে মাটীর নিম্নে কতকগুলি কূয়া দেখিতে পাওয়া গিয়াছে; উহার সহিত কোন সময়ের কোন লবণের কারখানার কিছু সম্বন্ধ ছিল বলিয়া বোধ হয় না। সগরদ্বীপের নিকটবর্ত্তী চন্দনপীড়ি নামক গবর্ণমেন্টের খাস জঙ্গলে একটি মন্দির এখনও ভগ্নাবস্থায় আছে। টাকীর জমিদার যতীন্দ্রনাথ চৌধুরীর বুড়বুড়ীর তট নামক আবাদে G Plot এর 2nd Portion এ একটি মন্দির দণ্ডায়মান আছে। উহা প্রাচীন বিশালাক্ষীর মন্দির ছিল বলিয়া কেহ কেহ অনুমান করেন।
১১. ‘প্রতাপাদিত্য’, ১৪৪-৫ পৃ।—শি মি
১২. Mukherjee, Radha Kumud – History of Indian Shipping, p. 216.
১৩. এ সম্বন্ধে আমি একজন অভিজ্ঞ পদস্থ বৃদ্ধের পত্র হইতে কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছি : ‘তেরকাটি জঙ্গলটি চণ্ডীপুর জঙ্গলের লপ্ত ছিল। সুন্দরবনের কমিশনার যখন জমিদারী জঙ্গল ও গবর্ণমেন্টের খাস জঙ্গলের সীমা ঠিক করেন, তৎকালীন সুন্দরবন কমিশনার রস্ সাহেব চণ্ডীপুর ও তেরকাটির মধ্যবর্ত্তী সীমানা ঠিক করিয়া এক মাটির পিল্পা দেন। ঐ সময়ে বংশীপুরের জঙ্গল ইজারাদার শ্রীক্ষীরোদচন্দ্র রায় কদমতলী নদী হইতে চুনার নদীতে সহজে যাইবার জন্য উপরোক্ত পিপার পাশ দিয়া লম্বে পনর কাঠা এবং প্রস্থে ৫ হাত একটি খাল কাটান, ঐ খালের বর্ত্তমান নাম ‘কাটা দৈইনা’ (দোয়ানিয়া)। উহা মুন্সীগঞ্জের হাটখোলার সম্মুখে অবস্থিত। বর্তমানে ঐ খাল খুব প্রব হইয়াছে এবং জমিদারী জঙ্গল ও গবর্ণমেন্টের জঙ্গল সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া রাখিয়াছে। চণ্ডীপুর যাহা জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, তাহা মনুষ্যালয়ে পরিণত হইয়াছে। ইহাতে অনুমান করা যায় ঐ খাল বিস্তীর্ণ হওয়ার প্রধান কারণ অপর পার হইতে কোন বন্য জন্তু আসিয়া চণ্ডীপুর পারের মনুষ্যালয়ের কোন ক্ষতি না করে। ঐ খাল কাটার পূর্ব্বে যখন আমি চণ্ডীপুর আবাদে আবাদ করিতে প্রবৃত্ত হই, তখন চণ্ডীপুরের পশ্চিমাংশ অর্থাৎ যশোহরের দিক হইতে একটি রাস্তা চণ্ডীপুরের উপর দিয়া তেরকাটি অভিমুখে গিয়াছে, অনুমান হইত। ঐ রাস্তার উত্তরাংশে বড় বড় ভিট্টা এবং কোন কোন স্থানে দক্ষিণাংশে বড় বড় ভিট্টা ও পুকুরের চিহ্ন এবং গ্রাম্য গাছ গাছালি থাকায় স্পষ্টই প্রতীয়মান হইত পূৰ্ব্বে ঐ স্থান সমৃদ্ধিশালী ছিল। আমি সর্ব্বদাই বনের দৃশ্য এবং পুরাকালের ভিট্টা পুকুর গাছগাছালি বনের মধ্যে দেখিয়া অত্যন্ত আহলাদিত হইতাম। তৎকালে ঐ চণ্ডীপুরে ব্যাঘ্র গণ্ডার নানাবিধ হিংস্র জন্তুর বাস ছিল। অনেকের ধারণা সুন্দরবন জঙ্গলে গণ্ডার থাকিতে পারে না। কিন্তু গণ্ডার আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি।’—শ্রীপুর-নিবাসী কালীপদ বসু মহাশয়ের পত্র।
১৪. লক্ষণচন্দ্র রায় সাতক্ষীরা ষ্টেটের ম্যানেজার, খুলনা ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বর এবং কৃতী ও মিষ্টভাষী সহৃয় ব্যক্তি বলিয়া যশস্বী। ইহারা ভরদ্বাজ গোত্রীয়, মুখোপাধ্যায়। রামচন্দ্রের সময় হইতে রায় উপাধি হয়। রামচন্দ্র ফুলিয়ামেলের প্রধান কুলীন কেশব চক্রবর্ত্তীর পৌত্রকে কন্যাদান করিয়া সম্মানিত হন। তিনি মুকুন্দপুরে আসিয়া এক প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা খনন ও মন্দির নির্ম্মাণ করেন। ঐ মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ এবং নন্দদুলাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার সময়ে নির্ম্মিত, কাঁটালের কাঠে প্রস্তুত সুন্দর পুতুল ও কারুকার্য্য-যুক্ত একখানি রঙ্গমহল ঘর এখনও আছে। বংশাবলী এই : রামচন্দ্র—দুর্গাপ্রসাদ, যদুনাথ ও গৌরীপ্রসাদ; যদুনাথ— বৈদ্যানাথ, শ্রীনাথ ও নন্দকুমার; নন্দকুমার— জয়রাম ও লক্ষ্মণচন্দ্ৰ; জয়রাম— সত্যেন্দ্র, শৈলেন্দ্র ও নরেন্দ্র; লক্ষ্মণচন্দ্র—শৌরীন্দ্র ও জ্যোতিরিন্দ্র।
১৫. বারক শব্দে অশ্ব বুঝায়। অশ্ব রাখিবার স্থান বলিয়া ইহার নাম বারকপুর হইতে পারে। ইংরাজী Barrack (বারাক) শব্দ হইতে যে বাঙ্গালা এক বারিক শব্দ হইয়াছে, তাহাতে সৈন্যাবাস বুঝায়। কিন্তু সে শব্দ ষোড়শ শতাব্দীতে এদেশে আসে নাই। ইংরাজ আমলে সুন্দরবনে সৈন্য রাখিয়া সে স্থানের নাম বারাকপুর রাখিবার কথা শুনা যায় নাই। কলিকাতার সন্নিকটে ইংরাজ দিগের একটি সৈন্যাবাস হয় এবং সে স্থানের নামও বারাকপুর বটে। কিন্তু খুলনা জেলায় যে কয়েক স্থানে বারকপুর গ্রাম আছে, তাহার সহিত ইংরাজ সৈন্যের কোন সম্বন্ধ ছিল বলিয়া মনে করি না। সম্ভবতঃ এই সকল স্থান হাতিবেড়, হাতিরডাঙ্গা বা হাতিয়া প্রভৃতি স্থানের মত অশ্বের নামে প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।
১৬. দমদমায় গুলি বারুদ প্রস্তুত হইত এবং এখানকার কামানের দমাদম্ শব্দে লোকে ভয় পাইত, এই জন্য ইহার নাম দমদমা। কলিকাতার সন্নিকটে যেরূপ দমদমা ও বারাকপুর বলিয়া দুইটি স্থান আছে, বসন্তপুরের সন্নিকটেও দমদমা ও বারকপুর আছে। প্রতাপাদিত্যের কপোতাক্ষা দুর্গের সন্নিকটেও দম্দমা এবং গাদিগুমা বলিয়া দুইটি গুলিবারুদের আড্ডা ছিল। সে স্থান এক্ষণে কাশী আবাদ ফরেষ্ট ষ্টেশনের দক্ষিণে ঘোর অরণ্যানীর মধ্যে পড়িয়াছে। সম্ভবতঃ ইংরাজেরা বাঙ্গালীর সেই পুরাতন দমদমা নাম গ্রহণ করিয়াছেন। নৈহাটির কাছে গঙ্গাতীরে জগদ্দলে প্রতাপের যে দুর্গ ছিল, উহারই সহিত সম্বন্ধযুক্ত ভাবে পুরাতন বারাকপুর ও দমদমা থাকা বিচিত্র নহে। ‘The name Dum Dum is a corruption of Dam-Dama meaning a raised mound or battery — Gazetteer, 24 Parganas O’Malley), p. 232.
১৭. এখনও দুর্গের পার্শ্বে যেখানে সেখানে পাথর পাওয়া যায়। উহা কুড়াইয়া লইয়া কলুগণ ঘানি গাছের ভার দিবার জন্য ব্যবহার করিতেছে, দেখিয়াছি। করিম কলু গড়ের দক্ষিণ পাড়ে নিজের বাড়ীর বেড় কাটিবার সময় একপ্রস্ত সুন্দর পাথরের বাসন পাইয়াছিলেন। দরিদ্র লোক, দুর্ভিক্ষের বৎসরে উহা বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন। বংশীপুরের নায়েব নলতা নিবাসী হরিশ্চন্দ্র ঘোষ উহার অধিকাংশ ক্রয় করিয়া লন। গড়ের দক্ষিণ দিকে রমজান গাজির বাড়ীর পার্শ্বে গর্ত কাটিতে গিয়া কয়েক বৎসর পূর্ব্বে রাশি রাশি শঙ্খ বাহির হয়। বাছিয়া উহার ৫/৬ শত বংশীপুরের নায়েব মন্মথ নাথ চট্টোপাধ্যায় লইয়া যান। উহার ২/৩টি আমিও দৌলতপুরে লইয়া আসিয়াছিলাম। এসব শঙ্খে উৎকৃষ্ট শাখা হইতে পারিত; কিন্তু আমার অনুমান হয়, অট্টালিকার গাথুনির চুণের জন্যই সমুদ্রকূল হইতে ভারে ভারে শঙ্খ আসিত। উত্তর দিকে যমুনার পুরাতন খাতে একস্থানে স্তূপীকৃত পাথরখণ্ড পাওয়া গিয়াছিল। সে সব পাথর গোলা প্ৰস্তুত করিবার জন্যই আসিয়াছিল।
১৮. হিন্দু শাস্ত্রে প্রস্তর ও ইষ্টকাদি নির্ম্মিত মহীদুর্গের কথা আছে (মনুসংহিতা, ৭ম-৭০)। কিন্তু নিম্নবঙ্গে প্রস্তরদুর্গ অসম্ভব; ইষ্টকদুর্গ নির্ম্মাণ করাও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং কামানের মুখে তাহাও নিরাপদ নহে। উৎকৃষ্ট প্রণালীতে নির্ম্মিত হইলে মৃণ্ময় দুর্গই সৰ্ব্বাপেক্ষা দুর্ভেদ্য। কলিকাতার ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ ইহার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থল।
১৯. এই ‘দীঘির বিলের’ জমি খুব উর্ব্বরা এবং তাহাতে বেশ ভাল সুপুষ্ট ধান্য হয়। সে ধানে চিটা হয় না। ঐ জমি আড়াই বা তিন টাকা বিঘায় জমা বিলি হয়। এখনও দীঘির বিলের ধানের একটা খ্যাতি আছে; লোকে যত্ন করিয়া বেশী মূল্যে সে ধান খরিদ করিতে ভালবাসে।
২০. কত শত ইষ্টকগৃহ যে ইহার মধ্যে প্রোথিত রহিয়াছে, তাহা বলা যায় না। গবর্ণমেন্টের তত্ত্বাবধানে সারনাথ, তক্ষশিলা প্রভৃতি স্থানে খনন কার্য্য দ্বারা যেরূপ বিস্ময়কর সৌধমালা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, এখানেও সেইরূপ কতগুলি ইষ্টকগৃহ পাওয়া যাইতে পারে।
২১. বারদ্বারী শব্দের অর্থ বার বা দ্বাদশটি দ্বারযুক্ত গৃহ নহে। ‘What was once a large building with 12 entrance gates (baradwari ) – List of ancient Monuments, p. 146. বস্তুতঃ বার’ শব্দ ‘দরবার’ শব্দের সংক্ষিপ্ত অংশ, ইহার অর্থ সভা। বারদ্বারী বলিতে প্রকাশ্য সভাগৃহই বুঝায়, উহাতে দ্বাদশটি দ্বার থাকিতে হইবে, এমন কোন কথা নাই।
২২. ‘It was more probably a Hummamkhana or bathing place of some Nawab with a well in the building for the supply of water’ – List of ancient Monuments, p. 146. কিন্তু গত ২৪/১১/২০ তারিখের কলিকাতা গেজেটে (২১৮৬ পৃ) ইহাকে হামামখানা বা হাবসিখানা না বলিয়া Hofiz Khan’s বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
২৩. আমরা ‘বাহারিস্তান’ হইতে জানিতে পারি, পুরীর অধীশ্বর কতলু খাঁর পুত্র জামাল খাঁ প্রতাপাদিত্যের অধীনে একজন সেনাপতি ছিলেন। এইরূপ সম্মানিত বংশীয় ব্যক্তিগণ সময় সময় এই গৃহে বাস করিতেন। ‘প্রবাসী’, কার্তিক, ১৩২৭, ৩ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য—শি মি]
২৪. List of ancient Monuments, p. 146; Hunter, Statistical Accounts, 24 – Pergunnahs, p. 118. ২৫. ইহাই বঙ্গদেশের প্রথম খৃষ্টীয় গীর্জ্জা (‘la premiere Eglise’) – Du Jarric, Peirre, ‘Histoire..des Indes Orientales’, Chapitre XXX; নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৪১২ ও ৪৪৮ পূ; Beveridge, Bakarganj, p 176. এই গীর্জ্জা নির্মাণের বিশেষ বিবরণ পরে দিব।
২৬. নূতন পাঠোদ্ধারে অধ্যাপক যদুনাথ সরকার ‘সহন’ স্থলে ‘নথন্’ পাঠ গ্রহণ করিয়াছেন—‘শনিবারের চিঠি’, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৫। শি মি
২৭. প্রবাসী, ১৩২৭, কার্ত্তিক, ৬ পৃ; [পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য — শি মি]; Rennel’s map No. 1-’Cogregot’; ইহাই খাগড়াঘাট। এই স্থান তালা-খাজরা পরগণার একটি ছিটমহল। খাগড়াঘাটার পূর্ব্বার্দ্ধ এক্ষণে সাতক্ষীরার স্বনামখ্যাত জমিদার মহাশয়দের এলেকাধীন। যেখানে ইনায়েৎ খাঁর ছাউনী হইয়াছিল, তাহার অধিকাংশই এক্ষণে নিম্নভূমি, ধানের ক্ষেত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন