সতীশচন্দ্র মিত্র
একক কেহ কখনও কোন কার্য্য করিতে পারে না; বড় কার্য্যে অন্যের সহায়াতা চাই। সেই সহায়তার সদ্ব্যবহার করাই ব্যক্তি-বিশেষের কৃতিত্বের পরিচায়ক। সৈন্যগণের দেহ রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধে জয়লাভ হয় বটে, কিন্তু যশস্বী হন সেনাপতি। তবে সৈনিকের প্রাণপণ বিক্ৰম প্রদর্শিত না হইলে, সেনাপতিত্ব বিফল হয়। যে সব রাষ্ট্র-বিজয়ী বীর জগতের ইতিহাসে কীৰ্ত্তি-মণ্ডিত হইয়াছেন, তাঁহাদিগকে নিজ অপেক্ষা সহকারী সৈন্য ও সেনানীবর্গের উপর অধিকতর নির্ভর করিতে হইয়াছিল। দেশে যখন একটা নূতন আন্দোলন উঠে, নূতন বিপ্লব জাগে, পূৰ্ব্ব হইতে কেমন এক প্রাকৃতিক নিয়মে তাহার আয়োজন হইতে থাকে। সেই আন্দোলনের স্রোতের মুখে তাহারই আনুকূল্যের জন্য যখন একজন বুক পাতিয়া দাঁড়ায়, তখন অলক্ষিত ও অতর্কিত ভাবে শতজন আসিয়া তাঁহার পৃষ্ঠপোষণ করে; তখন ভগবানের ব্যবস্থায় পূর্ব্ব হইতে যে সমস্তই প্রস্তুত ছিল, তাহা দেখিয়া সকলে অবাক হয়। বিধি-নিৰ্দ্দেশ ব্যতীত কোন বড় কাৰ্য্য হয় না; এবং তাহা যখন হয়, এই ভাবেই হইয়া থাকে।
একবার কর্মী হইয়া দণ্ডায়মান হইতে পারিলে, সহকারীর অভাব হয় না; কিন্তু সে কর্মীর কোন অমানুষিক শক্তি এবং নির্বাচন কৌশল চাই। কৃতী পুরুষের ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে প্রয়োজন মত এমন সব লোক নিৰ্ব্বাচন করিয়াছিলেন যে, সহকারিগণের স্বকীয় ক্ষমতা অপেক্ষা তাঁহার নির্বাচন কৌশলের অধিক প্রশংসা না করিয়া পারা যায় না। প্রতাপাদিত্যের লোক বাছিয়া লইবার প্রণালী অতি সুন্দর ছিল; তাঁহার জীবনব্যাপী চেষ্টায় যদি কিছু সাফল্য হইয়া থাকে, তবে ইহাই তাহার মূলীভূত। তাঁহার সহকারী কর্ম্মাধ্যক্ষগণের কার্য্যবিভাগ সমালোচনা করিলে, এ কথা স্পষ্ট বুঝা যাইবে। এই কর্মচারিগণের কোন লিখিত তালিকা নাই; সমসাময়িক ‘বহারিস্তান’ প্রভৃতি গ্রন্থে দুই একটি নাম পাওয়া যায়; বহুদিন পরে লিখিত ঘটকের পুঁথিতে কতকগুলি নাম দৃষ্ট হয়, কোন সমসাময়িক স্মারক-লিপি তাহার ভিত্তি হইতে পারে। ইহা ব্যতীত দেশের নানাস্থানে এই সকল কর্ম্মাধ্যক্ষগণের বংশ ছড়াইয়া পড়িয়াছে; সে বংশের উত্তরাধিকারিগণের গৃহ রক্ষিত কোন বংশ-তালিকা হইতে বা বংশগত প্রচলিত প্রবাদ হইতে কতক সংবাদ সংগ্রহ করা যায়। সকল তথ্যের সমাবেশ করিয়া আমরা বিভাগ অনুসারে যে তালিকা করিয়াছি, এখানে তাহারই আলোচনা করিতেছি। প্রত্যেকের কার্য্যকাল নির্ণয় করা সম্ভবপর হইবে না।
গৌড় নগরী লুণ্ঠিত ও মহামারিতে উৎসন্ন হইলে, যাঁহারা নবপ্রতিষ্ঠিত যশোহরে আসিয়াছিলেন, তন্মধ্যে এক হিন্দু জমিদার-বংশীয় কায়স্থ-তনয় ছিলেন, তাঁহার নাম সূর্য্যকান্ত গুহ। তিনি গৌড়ে বিক্রমাদিত্যের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন এবং বাল্যকাল হইতে প্রতাপের সহিত তাঁহার এক অকৃত্রিম বন্ধুত্ব সংগঠিত হয়।[১] কয়েক বৎসর পর যখন প্রতাপের বয়স ১৪/১৫ বৎসর, তখন শঙ্কর চক্রবর্ত্তী নামক এক ব্রাহ্মণ-তনয় যশোহরে আসিয়া প্রতাপের আশ্রয় লন। অতি অল্পকাল মধ্যে এই ব্রাহ্মণ যুবক তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে প্রতাপের চিত্তে অসাধারণ আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী প্রতাপ বা সূর্য্যকান্ত অপেক্ষা বয়সে কিছু বড়। বঙ্গে স্বাধীনতার উন্মেষই প্রতাপের সাধনা, সে কল্পনা গৌড়ে থাকিতেই জাগিয়াছিল; সকলেরই বাল্যজীবন ভবিষ্যতের সূচনা দেখাইয়া থাকে। শঙ্করও বাল্য হইতে সেই একই চিন্তায় আত্মসমর্পণ করেন। প্রতাপ যাহা চান, শঙ্করে তাহা মিলিল; প্রবৃত্তির মিলনে অচিরে উভয়ের মনোমিলন হইল; সে বন্ধুত্ব এ জীবনে কখনও ছিন্ন হয় নাই। ইয়োরোপে ম্যাসিনির চিন্তা ও মন্ত্রণা যেমন গ্যারীবডির কার্য্যকারিতায় প্রকাশিত হইয়া, ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে ইটালীর স্বাধীনতার গাথা লিখিয়া রাখিয়াছে, শঙ্করের ধ্যান-জ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা, প্রতাপের অসীম সাহস, বীরত্ব ও কার্যকারিতাকে সম্পোষণ করিয়া বঙ্গেতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত অধ্যায়কে গৌরবময় করিয়া রাখিয়াছে। ভারতে চিরানুগত প্রথায় ব্রাহ্মণের মন্ত্রিত্বই ক্ষত্রিয়ের রাজত্বকে উদ্ভাসিত করিয়া থাকে; এক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছিল। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী[২] ছিলেন মন্ত্রী এবং প্রতাপাদিত্য ছিলেন কর্মী; আর সে কর্ম্মের সহায়ক ছিলেন, বীরবর সূর্য্যকান্ত। এই তিন জনের অপূর্ব সম্মিলনে মধুর ফল ফলিয়াছিল। তিন জনের হৃদয় ও উদ্দেশ্য এক হইলেও কার্য্য বিভাগানুসারে কর্ম্মক্ষেত্র ও প্রণালী বিভিন্ন ছিল।
প্রতাপাদিত্য রাজা; শঙ্কর ও সূর্য্যকান্ত তাঁহার প্রধান সহচর ও সহকারী। দুই জন দুই বিভাগের কর্তা। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী সুপণ্ডিত, ধীর স্থির, কর্তব্যকঠোর এবং ব্রাহ্মণোচিত প্রতিভা-সম্পন্ন। রাজ্যশাসন, রাজস্ব-সংগ্রহ ও আয়-ব্যয় প্রভৃতি প্রধান ভার তাঁহার উপর। অন্যদিকে সূর্য্যকান্ত অসমসাহসী, মহাযোদ্ধা, সর্ব্বশাস্ত্র-বিশারদ এবং লোক-পরিচালনে অদ্বিতীয় ক্ষমতাশালী। রাজত্বের প্রথমভাগে তিনিই ছিলেন রাজ্যের প্রধান সেনাপতি; সৈন্যরক্ষণ, যুদ্ধ-ব্যবস্থা এবং বলসঞ্চয়ের জন্য প্রধান দায়িত্ব তাঁহার। শঙ্কর দেওয়ানী ও মন্ত্রণা বিভাগের কর্ত্তা এবং সূর্য্যকান্ত সৈন্য-বিভাগের অধ্যক্ষ। প্রত্যেক বিভাগে ইঁহাদের সহকারী ছিলেন। দেওয়ানী বিভাগে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, রূপরাম বা রূপবসু এই দুই জন শঙ্করের প্রধান কর্মচারী ছিলেন। পিতৃমাতৃহীন ব্রাহ্মণ বালক লক্ষ্মীকান্ত রাজ সরকারে আশ্রয় লইয়া ক্রমে সদ্গুণ ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে উন্নতি লাভ করিয়া প্রধান দেওয়ানের পদ পান।[৩] তিনি রাজস্ব বিভাগে সৰ্ব্বময় কৰ্ত্তা ছিলেন। এমন কি, প্রতাপাদিত্য ও শঙ্কর প্রভৃতি যখন যুদ্ধাদি জন্য স্থানান্তরে যাইতেন, তখন লক্ষ্মীকান্তের উপর রাজ-প্রতিনিধির ভার অর্পিত হইত।
দেওয়ানী বিভাগে আরও অনেক কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। প্রবাদ আছে বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে দুর্গাদাস সমাদ্দার নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক যশোহর রাজ-সরকারে প্রবেশ করেন এবং কার্য্যদক্ষতায় রাজস্ব বিভাগের একজন প্রধান কর্ম্মচারী হন। ভবিষ্যতে ইহারই নাম হইয়াছিল ভবানন্দ মজুমদার এবং তিনি নদীয়ার কেশরকোনী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।[৪] শঙ্করের সহকারী আর একজন বিশিষ্ট কৰ্ম্মাধ্যক্ষ ছিলেন, রূপরাম বা রূপ বসু। ইনি বসন্ত রায়ের জামাতা। পদোন্নতিতে তিনি প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের প্রথম ভাগে সমর-সচিব হইয়াছিলেন। যুদ্ধের পরামর্শ এবং যুদ্ধাদির আয়ব্যয় নির্দ্ধারণ ও সামরিক ব্যবস্থা তাঁহার প্রধান কার্য্য ছিল। রূপ বসুর তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও সূক্ষ্ম ব্যবস্থা বহুক্ষেত্রে প্রতাপের প্রধান সহায় হইয়াছিল। বংশীপুরে যশোহর-দুর্গের দক্ষিণে ‘রূপরামের দীঘি’ তাঁহার কীর্ত্তিচিহ্ন রাখিয়াছে।[৫] বসন্ত রায়ের হত্যার পর এই রূপরাম শত্রু হইয়া তাঁহার সর্ব্বনাশের পথ প্রস্তুত করেন। অন্য কর্মচারিগণের মধ্যে শ্রীপতি গুহ, বয়াজিৎ হাজারি ও জগৎসহায় দত্ত বিশেষ বিখ্যাত। শ্রীপতি গুহ[৬] স্বরাজ্য মধ্যে রসদ সংগ্রহ করিয়া উহার ব্যয়ের ব্যবস্থা করিতেন। বয়াজিৎ হাজারি[৭] পররাজ্যে যাইবার জন্য রসদ সংগ্রহের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। জগৎসহায় দত্ত[৮] পূর্তবিভাগের প্রধান কর্তা বা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কেহ কেহ বলেন তাঁহারই নামানুসারে জগদ্দল দুর্গের নামকরণ হইয়াছিল। এই স্থলে আরও কয়েকজন নিম্ন কর্মচারীর নাম করা যায় : আমীন ও রাজস্ব সংগ্রাহক কালনীর দত্ত, কারকুণ গোবিন্দ প্রসাদ এবং কানুনগো জানকীবল্লভ।[৯] ইঁহারা প্রত্যেকেই নিজ যোগ্যতার গুণে যথেষ্ট সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি অর্জন করিয়াছিলেন।
শাসন ও সমর বিভাগে স্বয়ং প্রতাপাদিত্য সূর্যকান্তের সাহায্যে যাবতীয় বিধি ব্যবস্থা ও নিয়োগাদি করিতেন। যাঁহারা কোন দুর্গের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হইতেন, তাঁহারা যুদ্ধসম্বন্ধীয় সকল ব্যবস্থা করিতেন, অধিকন্তু প্রাদেশিক শাসনভারও তাঁহাদের হস্তে ছিল। এই স্থানে কয়েকজন দুর্গাধ্যক্ষের নাম করিতে পারি : সগর ও মেঘনা দুর্গের কর্তা–পুরুষোত্তম রায় চৌধুরী[১০] এবং তাঁহার অধীনে ছিলেন রঘু। কপোতাক্ষ দুর্গের অধ্যক্ষ—কমলখোজা; মাতলা দুর্গের অধ্যক্ষ—হায়দর মানকী[১১] এবং চকশ্রী দুর্গাধ্যক্ষ—মুয়াজিম বেগ ও তাঁহার সহকারী মধুসূদন মীরবহর।[১২] প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতিগণের মধ্যে সূর্য্যকান্ত, কমলখোজা, জমাল খাঁ, যুবরাজ উদয়াদিত্য এবং ফিরিঙ্গি রুডা, এই কয়েকজনের নামই সমধিক উল্লেখযোগ্য। ইহার মধ্যে ‘বহারিস্তানে’ সূর্যকান্তের নাম নাই; সম্ভবতঃ তিনি মানসিংহের নিকট প্রতাপাদিত্যের পরাজয় কালে যুদ্ধে নিহত হন বা তৎপরে কার্য্য ত্যাগ করেন। খোজা কমল, জমাল খাঁ এবং উদয়াদিত্যের কথা বহারিস্তানে স্পষ্টতঃ উল্লেখিত আছে। কমল প্রভুভক্ত বীরের মত শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধ করিয়া রণক্ষেত্রে তনুত্যাগ করেন। জমাল খাঁ উড়িষ্যার শাসনকর্তা ইতিহাস প্রসিদ্ধ কতলু খাঁর তৃতীয় পুত্র।[১৩] মোগলদিগের সহিত শেষ সংঘর্ষকালে যখন সালখিয়ার সন্নিকটস্থ নৌ-যুদ্ধে খোজা কমল নিহত ও উদয়াদিত্য পলায়িত হন, তখনও জমাল খাঁ তীর হইতে অনেকক্ষণ যুদ্ধ চালাইয়া অবশেষে পরাজিত হন।
প্রতাপাদিত্যের সমস্ত সৈন্য ৯ ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রধান সেনাপতির অধীন ইহার প্রত্যেক বিভাগে পৃথক পৃথক সেনানী ছিলেন। সৈন্য বিভাগের নামের সঙ্গে সেনানীবর্গের নামোল্লেখ করিতেছি :
১. ঢালী বা পদাতিক সৈন্য : এ বিভাগে অধ্যক্ষ মদন মল্ল[১৪] এবং সহকারী কালিদাস রায়,[১৫] সবাই বাঁড়ুয্যে[১৬] প্রভৃতি।
২. অশ্বারোহী সৈন্য : অধ্যক্ষ প্রতাপ সিংহ দত্ত’[১৭] এবং সহকারী মাহী উদ্দীন, বৃদ্ধ নুর উল্লা প্রভৃতি।[১৮]
৩. তীরন্দাজ সৈন্য : এই বিভাগের অধ্যক্ষদিগের মধ্যে সুন্দর, ধুলিয়ান বেগ প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়।[১৯]
৪. গোলন্দাজ সৈন্য : অধ্যক্ষ ফেরঙ্গ জাতীয় ফ্রান্সিস্কো রুডা বা রডা।[২০]
৫. নৌ-সেনা বিভাগ : সৰ্ব্বাধ্যক্ষ অগষ্টাস্ পেড্রো (Augustus Pedro); ইঁহার অধীন আরও কয়েকজন পর্তুগীজ সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের নাম পাওয়া যায় না। সময় সময় চকশ্রী দুর্গের অধ্যক্ষ মুয়াজিমম বেগ তাঁহার সাহায্যার্থ আসিতেন। এই নৌ-সেনাপতি বা মীরবহর পেড্রোর তত্ত্বাবধানে পোতাশ্রয় (Haven) এবং পোত- নিৰ্ম্মাণ স্থান (Dock) সকল রক্ষিত হইত। ফ্রেডারিক ডুড্লি পোতসংস্কারের প্রধান কর্তা ছিলেন, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি; ডুলির অধীন খাজা আব্বাচ নামক এব ব্যক্তি ডকের জাহাজগুলির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ডকের পার্শ্বে এখনও একটি স্থান তাঁহার নামানুসারে খাজাবাড়িয়া বলিয়া কথিত হয়।
৬. গুপ্তসৈন্য : বিপক্ষের গতিবিধি ও অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য যেমন নদীপথে ফিরিঙ্গি ফাঁড়িতে রণতরী চলাচলের ব্যবস্থা ছিল, স্থলপথেও সেইরূপ কয়েকদল সৈন্য সৰ্ব্বদা গুপ্তভাবে নানাদিকে ভ্রমণ করিত। চার-চক্ষু না হইলে রাজার রাজ্য চলে না। কথিত আছে, সুখা নামক এক জন দুঃসাহসিক বীর গুপ্তসৈন্য দলের অধিনায়ক ছিলেন।[২১]
৭. রক্ষিসৈন্য : স্বয়ং প্রতাপাদিত্য, তাঁহার পরিবারবর্গ, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতির দেহরক্ষার জন্য কয়েকদল সুগঠিত শরীর-রক্ষী সৈন্য ছিল। উহার পরিচালকদিগের মধ্যে বিজয়রাম ভঞ্জচৌধুরী, রত্নেশ্বর বা যজ্ঞেশ্বর রায় প্রভৃতির নাম পাওয়া যায়।[২২]
৮. হস্তিসৈন্য : এ বিভাগের কোন চিহ্নিত অধ্যক্ষের নাম পাওয়া যায় না।
৯. পাৰ্ব্বত্য কুকি-সৈন্য : ইহার অধ্যক্ষ রঘু। তাঁহার কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি।
পাদটীকা :
১. সূর্যকান্তের পূর্ব্ব পরিচয় সম্বন্ধে নানা জনে নানা মত ব্যক্ত করিয়াছেন। ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়ে’ সূর্য্যকান্তকে ‘সূর্য্যকুমার’ করা হইয়াছে এবং তিনি জয়ন্তীরাজ শিবচন্দ্রের পুত্র বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। এ তথ্যের মূল পাই নাই। আধুনিক নাটকে তাঁহাকে শঙ্করের শিষ্য ও অনুচর-একজন সাধারণ লোক বলিয়া চিত্রিত করা হইয়াছে। ঘটকদিগের মতে তিনি গুহ বংশীয় বঙ্গজ কায়স্থ এবং প্রতাপাদিত্যের জ্ঞাতি।
‘সূর্য্যকান্তঃ মহাশূরঃ গুহকুলস্য ভূষণং।
প্রতাপাদিত্যসেনানী হয়গ্রীবোপমঃ কিল॥’
‘বঙ্গাধিপ পরাজয়ে’ আছে, যুদ্ধাবসানে সূর্য্যকুমার প্রতাপের কন্যাকে বিবাহ করেন। সূর্য্যকান্ত রাজজ্ঞাতি হইলে সে বিবাহ হইতে পারে না। আমরা ঘটককারিকা হইতে দেখাইয়াছি, রাজা রামচন্দ্র ব্যতীত প্রতাপের অন্য জামাতার নাম রাজবল্লভ রায়। ঘটকগণ সৰ্ব্বত্রই সূর্য্যকান্তকে মহাশূর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, যথা : ‘সূর্য্যকান্তঃ মহাশূর : সর্ব্বশস্ত্র-বিশারদঃ।’ অন্যত্র প্রতাপ স্বয়ং বলিতেছেন, ‘শৃণু সূৰ্য্য মহাশূর যশোহরপ্রদীপক’। [নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৩০৮, ৩১৬ এবং ৩৩৭ পৃ।— শি মি] কাশ্যপ গোত্রে দক্ষবংশে বর্তমান ২৪-পরগণার অন্তর্গত বারাসাতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে শঙ্কর চক্রবর্ত্তী জন্মগ্রহণ করেন; বর্তমান ঈশ্বরীপুরের ৫/৬ মাইল উত্তর-পূর্ব্ব কোণে এখনও শঙ্করহাটি বা শঙ্করকাটি বলিয়া একটি গ্রাম আছে; যশোহর বাসকালে শঙ্করের তথায় বাসাবাটি ছিল। প্রতাপের পতনের পর তিনি পুনরায় বারাসাতে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। ৩৩শ পরিচ্ছেদের শেষাংশে তাঁহার বংশের বিশেষ বিবরণ প্রদত্ত হইবে।
৩. ইনি বর্তমান বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরিগণের আদিপুরুষ। ইঁহার বাল্যজীবন উপন্যাসের মত রহস্যময়, কৰ্ম্মজীবন কৃতিত্বে উদ্ভাসিত এবং শেষ জীবন ঐশ্বর্য্যে বিলসিত। কিন্তু প্রভু প্রতাপাদিত্যের প্রতি কৃতঘ্নতার জন্য তাঁহার সকল মাহাত্ম্য মলিন করিয়া রাখিয়াছে। আমরা ৩৩শ পরিচ্ছেদের শেষাংশে ইঁহার জীবনী ও বংশ বিবরণের আলোচনা করিব।
৪. ইনি মানসিংহের আক্রমণ কালে মোগল পক্ষে সাহায্য করেন বলিয়া ১৪ পরগণার জমিদারী, মোগল সরকারের কানুনগো চাকরি এবং মজুমদার উপাধি পান। তিনি যে প্রতাপাদিত্যের সরকারে চাকরি করেন, তাহার বিশিষ্ট লিখিত প্রমাণ বৰ্ত্তমান নাই। কিন্তু প্রবাদ শতমুখে তাঁহাকে কনৌজাধিপতি জয়চন্দ্রের মত দেশদ্রোহী বলিয়া অখ্যাত করিতেছে। মানসিংহের আক্রমণ প্রসঙ্গে যখন ভবানন্দের কথা বলিতে হইবে, তখন এই প্রবাদের সত্যাসত্য বিচার করিব।
৫. ইঁহাদের আদিম বাস ঢাকার অন্তর্গত মালখানগর। তথাকার পৃথ্বীধর বসু বংশে যদুনন্দন বিখ্যাত কুলীন ছিলেন। তৎপুত্র রূপরাম বসন্ত রায়ের কন্যা বিবাহ করেন। রাজবৈবাহিক যদুনন্দন প্রভূত বৃত্তি পাইয়া আঁধারমাণিকের নিকটবর্ত্তী মালঙ্গপাড়ায় আসিয়া বাস করেন এবং রূপরাম যশোহরে রাজকার্য্যে নিযুক্ত হন। পরে তাঁহার পদোন্নতি হইলে লক্ষ্মণকাটি নামক স্থান বৃত্তি পাইয়া যশোহরে বসতি করেন। তাঁহার বংশীয়গণ এখনও টাকীর নিকটবর্ত্তী সৈদপুরে বাস করিতেছেন।
৬. শ্রীপতি গুহ শ্রীপুরের ‘রায়’ উপাধিধারী বঙ্গজ কায়স্থগণের পূর্ব্বপুরুষ।
৭. ইঁহারই নামানুসারে প্রাচীন যশোহরের সন্নিকটে বিস্তৃত বাজিতপুর পরগণা; সম্ভবতঃ উঁহা তিনি প্রতাপের নিকট হইতে জায়গীর স্বরূপ পাইয়াছিলেন।
৮. ইনি শ্রীহট্টবাসী কায়স্থ; কি সূত্রে তিনি প্রতাপের দৃষ্টিপথে পড়িয়াছিলেন, তাহা নির্দ্ধারণ করিতে পারা যায় নাই।
৯. কালনীর দত্ত বর্ত্তমান বনগ্রামের দত্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা। বাগ্আচড়া গ্রামে তাঁহার বসতি ছিল; তথা হইতে তদ্বংশীয়গণ প্রথমতঃ সুখপুকুরিয়ায় ও পরে বনগ্রামে বাস করেন। এই বংশীয় স্বরূপ নারায়ণ টাকীর জমিদারগণের খ্যাতনামা আমীন ছিলেন। তৎপুত্র বিষ্ণুচরণ ইংরাজ আমলে ডেপুটী পোষ্টমাষ্টার জেনারেল হইয়া ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব পান (১৮৯২)। কারকুণ গোবিন্দ প্রসাদ ‘রায়’ উপাধিযুক্ত মুখোপাধ্যায়। ইহার বংশধরেরা বোধখানা, বানা, নিমটা প্রভৃতি স্থানে বাস করিতেছেন। বানা নিবাসী তারকচন্দ্র রায় মহাশয় ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট; তিনি এক্ষণে ‘রায় সাহেব’ উপাধিযুক্ত এবং বঙ্গীয় কো- অপারেটিভ বিভাগের জয়েন্ট রেজিষ্ট্রার। তিনি ঐতিহাসিক চর্চ্চায়ও পরমোৎসাহী; তিনিই সীতাহাটি হইতে বল্লালসেনের তাম্রশাসন আবিষ্কার করেন। জানকীবল্লভের বংশধরগণ এক সময়ে খড়রিয়া ও বেলফুলিয়া পরগণার জমিদার ছিলেন; এই বংশীয় রায়চৌধুরীগণ মূলগড়ে ও ফরিদপুরের অন্তর্গত কাজুলিয়ায় বাস করিতেছেন।
১০. বরিশালে পুরুষোত্তমের পূর্ব্বনিবাস ছিল; ইনি বসন্তরায়ের মাতুল। রাজকার্য্য উপলক্ষে যশোহরে অবস্থান কালে যেখানে বাসাবাটী ছিল, উহাকে এখনও পুরুষোত্তমপুর বলে। প্রাচ্যপতি রঘুর কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি।
১১. সুলেমান ও বাবুই মানক্বী দুই ভাই। তাঁহারা উভয়ে দায়ুদ শাহের সেনাপতি।—Ain. (Blochmann), pp. 70, 473. বাবুই মানক্বী কতলু খাঁর ভগিনীপতি। বাবুই মানক্লীর পুত্রের নাম হায়দর। তাঁহারই নামানুসারে মাতলা দুর্গের নাম হায়দর গড়।
১২. মধুসূদন মাইনগরের বসু বংশীয় দক্ষিণরাঢ়ীয় কুলীন কায়স্থ। চাকশিরি দুর্গের মীরবহর বা নাবাধ্যক্ষ ছিলেন। সেই সময়ে তিনি পার্শ্ববর্তী পারমধুদিয়ায় বাস করেন। এখনও পারমধুদিয়া প্রভৃতি স্থানের ‘মীরবহর’ বসুরা বিশেষ সম্ভ্রান্ত কুলীন। দৌলতপুর কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল শ্রীমান্ সুরেন্দ্রনাথ বসু এম, এ, চরিত্রগুণে এই বংশের নাম উজ্জ্বল করিয়াছেন।
১৩. Ain. (Blochmann), p. 520; Baharistan, Bab/, Dastan 10, 49 a. সম্ভবতঃ ১৫৯২ খৃষ্টাব্দে মোগল কর্তৃক উড়িষ্যার পাঠানদিগের পরাজয়ের পর জমাল খাঁ প্রতাপের সৈন্যদলভুক্ত হন। খাজা কমলের কথা ৩৩শ পরিচ্ছেদে আলোচিত হইবে।
১৪. ঘটককারিকায় আছে : ‘সামন্তো মদনশ্চৈব ঢালীনাং পতি মল্লজঃ।’ ঘটকদিগের বর্ণনা হইতে জানা যায়, মানসিংহের সহিত যুদ্ধকালে তিনি অসীম বীরত্ব দেখাইয়াছিলেন। কথিত আছে, এই মদন মল্লের পূর্ণনাম মদন মোহন মিত্র এবং তিনি যশোহর-চাঁচড়ার নিকটবর্ত্তী মিত্রসিঙ্গা গ্রামের প্রসিদ্ধ কায়স্থ মিত্রবংশের জনৈক পূৰ্ব্বপুরুষ। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৩ পৰ্য্যায়ভুক্ত প্রসিদ্ধ কুলীন শুক্লাম্বর মিত্র এই মিত্ৰসিঙ্গায় প্রথম বসতি করেন। সম্ভবতঃ মদন মোহন শুক্লাম্বরের প্রপৌত্র। তিনি নিজে সম্ভবতঃ নিঃসন্তান, এজন্য কারিকায় তাঁহার নিজ ধারা উল্লেখ নাই। মিত্রসিঙ্গার মিত্রগণ বহুদিন হইতে চাঁচড়া রাজ সরকারে দেওয়ানী প্রভৃতি চাকরি করিয়াছেন। দেওয়ান স্বরূপচন্দ্রের বংশীয়গণ এক্ষণে রাজঘাটে বাস করিতেছেন।
১৫. ইনি বিভাগদি ও সেখহাটির কল্কীশগোত্রীয় রায়চৌধুরিগণের পূর্ব্বপুরুষ। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর চেঙ্গুটিয়া পরগণার জমিদার ছিলেন। ইহার কথা ৩৩শ পরিচ্ছেদের শেষাংশে আলোচনা করিব।
১৬. সবাই বা সৰ্ব্বানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় যশোহরের অন্তর্গত আলতাপোলের বিখ্যাত বাঁড়ুয্যে বংশের পূর্ব্বপুরুষ। ইনি শাণ্ডিল্য বন্দ্যঘটীবংশীয় মকরন্দের ৮ম অধস্তন বংশধর এবং কুলীনশ্রেষ্ঠ চতুর্ভুজের পুত্র। চতুর্ভুজের তিন পুত্র ‘লোহাই, সবাই, সুন্দ’ মধ্যে সবাই এবং সুন্দ বা সুন্দরমল্ল প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ছিলেন। সেনহাটির সিদ্ধান্তবংশীয়েরা সুন্দরমল্লের বংশধর। এমনও দিন ছিল যখন প্রসিদ্ধ কুলীন ব্রাহ্মণেরাও যুদ্ধব্রতে লিপ্ত হইয়া মল্ল বলিয়া পরিচিত হওয়া অগৌরবের বিষয় মনে করিতেন না। সবাই ও সুন্দরের কথা স্থানান্তরে বর্ণিত হইবে।
১৭. ‘দত্তঃ প্ৰতাপসিংহশ্চ মহারথিগণাধিপ’—ঘটককারিকা। এই প্রতাপসিংহের অন্য কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই।
১৮. মাহী উদ্দীনের নামে প্রসিদ্ধ মাইহাটি পরাগণা। প্রতাপের পতনের পর এই পরগণা রাজা চাঁদ রায় কর্তৃক টাকী-শ্রীপুরের রায় চৌধুরীদিগকে বৃত্তিস্বরূপ প্রদত্ত হয়। উঁহারা এখনও তাহা ভোগ করিতেছেন। রাজা যতীন্দ্রমোহন রায় বলেন, প্রতাপের সেনাপতি এই নুর উল্যার নামানুসারে নুরনগর গ্রাম হয়। ইনি যশোহরের ফৌজদার নুর উল্যা নহেন। কিন্তু নুরনগরের নাম ফৌজদার নুর উল্যার নামে হওয়াই সম্ভব বলিয়া বোধ হয়।—ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন’, ২য় খণ্ড, ৩২৮-৩৩ এবং ৪৯৫-৮ পৃ দ্রষ্টব্য।
১৯. ধূলিয়ান বেগের নামে সম্ভবতঃ প্রাচীন যশোহরের সন্নিকটে ধূলিয়াপুর পরগণা হয়। এই ধূলিয়ান বেগ চকশ্ৰী দুর্গাধ্যক্ষ মুয়াজিম বেগের পিতা। উঁহারা উজবেগ জাতীয়।
২০. ফেরঙ্গপতি রুডা একজন বিখ্যাত যোদ্ধা। তিনি মোগল সংঘর্ষকালে কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন। See, 24-Parganas Gazetteer, p. 29; Bengal Past and Present, Vol. II, p. 259.
২১. ‘গুপ্ত সেনাপতিশ্চাপি সুখাখ্যো ভীমবিক্রমঃ’—ঘটককারিকা। সুখা যে কোন্ দেশ হইতে আসিয়াছিলেন, তাহা জানিবার উপায় নাই।
২২. ইনি নলতার বিখ্যাত ভঞ্জচৌধুরীগণের পূর্ব্বপুরুষ। বিজয়রামের পিতা যাদবেন্দ্র প্রতাপের রাজ-সরকারে উচ্চপদ পাইয়া খাঞ্জের নিকটবর্ত্তী নতায় বাস করেন। বিজয়রাম বিখ্যাত বীর ছিলেন। প্রতাপের পতনের পর তিনি নবাব-সরকার হইতে বাজিতপুর পরগণা বন্দোবস্ত করিয়া লন। উহার তিন আনা অংশ এখনও ভঞ্জচৌধুরীগণ ভোগ করিতেছেন। রত্নেশ্বর রায়ের ইতিহাস চাঁচড়া-প্রসঙ্গে পৃথক পরিচ্ছেদে বিবৃত করিব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন