৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী

সতীশচন্দ্র মিত্র

দ্বিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী

জমিদাররূপে যখন সীতারামের বিপুল প্রতিপত্তি, তখনই অল্পদিন অগ্রপশ্চাৎ তাঁহার পিতামাতা উভয়ে পরলোক গমন করেন। সীতারাম মহাসমারোহে তাঁহাদের দানসাগর শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করিয়াছিলেন।[১] এতদুপলক্ষে দূরদেশ হইতে বহু অধ্যাপক পণ্ডিত নিমন্ত্রিত হইয়া আসেন এবং বহুসহস্র ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধদিনে তাঁহার গৃহে ভোজ্য ও দক্ষিণা গ্রহণ করিয়া পরম পরিতোষ লাভ করেন। শুনিতে পাওয়া যায়, ভূষণা অঞ্চলে পূর্ব্বে শ্রাদ্ধদিনে ব্রাহ্মণ-ভোজনের রীতি ছিল না, সীতারামের সময়ে উহা প্রথম প্রবর্তিত হয়।

সীতারামের সহিত তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মীনারায়ণের বিশেষ সৌহার্দ্দ ছিল এবং তিনিও বিষয়কার্য পরিচালনায় অত্যন্ত সুদক্ষ ছিলেন। পিতৃশ্রাদ্ধের বৎসরাধিক পরে সীতারাম লক্ষ্মীনারায়ণের উপর জমিদারীর ভার দিয়া মুনিরাম ও রামরূপকে সঙ্গে লইয়া তীর্থ ভ্রমণে বহির্গত হন। কথিত আছে, তিনি গয়াক্ষেত্রে পিণ্ডদানের পর বহুবিধ উপহার দ্রব্যসহ রাজধানী দিল্লীতে উপনীত হন। নবাব সায়েস্তা খাঁ তাঁহাকে ভালবাসিতেন এবং জায়গীরদাররূপে তাঁহার কৃতিত্বের সংবাদ বহুপূর্ব্বে বাদশাহ-দরবারে পৌঁছিয়াছিল। তিনি যে দক্ষিণবঙ্গে দস্যু দুৰ্ব্বত্তের বিদ্রোহশান্তি করিয়া নিয়মমত শাসন ঠিক রাখিতে সমর্থ, তাহা প্রতিপন্ন করিবার বিশেষ প্রয়োজন হইল না। যেটুকু বা বাকী ছিল, তাহা মুনিরামের বাক্-কৌশলে সম্পূর্ণ হইল। এ সময়ে বাদশাহ আওরঙ্গজেব দিল্লীতে ছিলেন না, কারণ তিনি ১৬৮৩ খৃষ্টাব্দে শেষবার দিল্লী পরিত্যাগ করিয়া যান এবং ঘটনা তাহার ২/৩ বৎসর পরে হওয়া সম্ভবপর। এ সকল ক্ষুদ্র বিষয়ে বাদশাহ সাধারণতঃ ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর অভিমত অনুসারে কার্য্য করিতেন এবং সায়েস্তা খাঁর প্রশংসাবাদে সে অভিমত দৃঢ় করিয়াছিল। যাহা হউক, যথাসময়ে সীতারামের প্রার্থনামত তাঁহাকে ‘রাজা’ উপাধির পাঞ্জাসহি ফারমাণ এবং দক্ষিণবঙ্গের আবাদী সনন্দ প্রদত্ত হইল। এই জাতীয় সনন্দ পাইলে রাজাকে কিছুকাল রাজস্ব দিতে হইত না, ততদিন তাঁহাকে আবাদ মহলে প্রজাপত্তন করিয়া তাহাদিগকে রীতিমত শাসনতলে আনিতে হইত। এই সকল রাজারা মনসবদারের মত প্রত্যন্ত রক্ষার ভার পাইতেন এবং সামন্ত নৃপতি বলিয়া গৃহীত হইতেন। সীতারাম ফারমাণ লইয়া সৰ্ব্বপ্রথম ঢাকায় গিয়া নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।[২] নবাব ইহাতে বরং সন্তুষ্টই হইলেন এবং বাদশাহী সনন্দে স্বাক্ষর করিয়া সুবাদারের সম্মতি দান করিলেন।

এই রাজোপাধির সনন্দ লইয়া যেদিন সীতারাম স্বদেশে ফিরিয়া আসিলেন, তখন হইতে হরিহরনগরে এক অপূৰ্ব্ব আনন্দোৎসব চলিল। তিনি রাণী কমলার সহিত রাজতক্তে বসিলেন, শাস্ত্রীয় বিধানে যজ্ঞানুষ্ঠান হইল। পানভোজন ও আমোদ-প্রমোদের বিরাট আয়োজনে অর্থরাশি উড়িয়া গেল। উৎসব উপশান্ত হইলে, সীতারামের মনে সমস্যা উঠিল, তিনি রাজা হইলেন বটে, কিন্তু তাঁহার রাজ্য বা রাজধানী কই? নন্দী ও সা-তৈরের জমিদারী তাঁহার করায়ত্ত ছিল, এবং সে জমিদারী তিনি চারিদিকে কিছু বাড়াইয়া লইয়াছিলেন; এখন আবার নূতন আবাদী সনন্দের বলে ভাটিরাজ্য নিজবলে অধিকার করিয়া লইতে পারিলে রাজোপযোগী রাজ্য হইতে পারে। কিন্তু সর্ব্বাগ্রে রাজাধানী চাই; কারণ উপযুক্তস্থানে রাজধানী স্থাপন করিয়া তন্মধ্যে সুদৃঢ় দুর্গে সৈন্য সংগ্রহ করতঃ আত্মরক্ষা বা পররাজ্যজয়ের সুব্যবস্থা করিতে না পারিলে, রাজনামেও যেমন কলঙ্ক হয়, অরাজক দেশে রাজত্বও বেশী দিন চলে না। তাই সীতারাম রাজধানীর উপযুক্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন।

ভূষণায় ফৌজদারের বাস; হরিহরনগর সেই ভূষণার নিকটবর্ত্তী বলিয়া সেখানে তাঁহার পছন্দ হইল না; সূর্য্যকুণ্ডে পুরাতন কাছারী ছিল, অবস্থানের হিসাবে সে স্থানও তিনি মনোনীত করিলেন না; অনেক বিবেচনা করিয়া তিনি সূর্য্যকুণ্ডের সন্নিকটে বাগ্‌জানি মৌজায় স্থান নির্বাচন করিলেন। উহারই পার্শ্বে এখনও নারায়ণপুর গ্রাম আছে; হয়ত সেই নামই তাঁহার প্রিয় ছিল, কিন্তু কার্য্যতঃ তিনি রাজধানীর নাম রাখিলেন— মহম্মদপুর। এখন দুইটি প্রশ্ন স্বতঃই মনে উঠিতে পারে। সেখানে তিনি স্থান নির্বাচন করিলেন কেন এবং হিন্দুর রাজধানীর নূতন নামই বা মহম্মদপুর হইল কেন? বহুমতের সমন্বয় করিয়া আমি এই উভয় প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করিতেছি।

স্থান নিৰ্ব্বাচন প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা যায়। প্রথমতঃ, মহম্মদপুরের অবস্থান অতি সুন্দর। উহার তিন দিকে বিল, একদিকে নদী, মধ্যস্থানে উচ্চ স্থল। ভূষণার দিকে অর্থাৎ প্রধানতঃ যেদিক হইতে শত্রু আসিবার সম্ভাবনা, সেই পূৰ্ব্বদিকেই নদী। কৃত্রিম পরিখা দ্বারা দক্ষিণদিক দুষ্প্রবেশ্য করা যায়। অপর দুইদিকে দূরবিস্তৃত বিল, কিছুই করিবার আবশ্যক নাই। দ্বিতীয়তঃ, স্থানটি নদীর পুরাতন কাছারী সূর্য্যকুণ্ডের নিকটবর্ত্তী এবং পূর্ব্ব হইতে এখানে সৈন্যাবাস ছিল। তৃতীয়তঃ, এইস্থানে একটি ভগ্নমন্দিরে সীতারামের ভাগ্যদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ শিলা আবিষ্কৃত হন। এই আবিষ্কার সম্বন্ধে অনেক মত আছে; কেহ বলেন, সীতারাম যখন জায়গীরদার, তখন একদিন অশ্বারোহণে এই স্থান দিয়া যাইবার সময় সহসা তাঁহার অশ্ব-ক্ষুর মাটিতে প্রোথিত হয় এবং তিনি পরীক্ষা করিয়া দেখেন একটি চক্র বা ত্রিশূল অশ্ব-ক্ষুরে ফুটিয়া গিয়াছে, তখন সেইস্থান খুঁড়িয়া ক্রমে ভগ্নমন্দির বা শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়। আবার কেহ বলেন, এই ঘটনা সীতারামের আমলে না হইয়া, তাহার বহু পূর্ব্বে যখন তাঁহার পিতা সাজোয়াল হইয়া আসেন, তখন ঘটিয়াছিল। সম্ভবতঃ এই মতই ঠিক; উদয়নারায়ণই এইস্থান দিয়া ভ্রমণকালে দৈবক্রমে ভগ্নমন্দিরে এক শালগ্রাম শিলা পান এবং পরীক্ষায় স্থির হয় উহা লক্ষ্মীনারায়ণ চক্র। ক্রমে তাঁহার চাকরীতে উন্নতি হওয়ায় তিনি ঐ শিলাকে ভাগ্যদেবতা স্থির করিয়া হরিহরনগরে প্রতিষ্ঠিত করেন; হয়ত সেই সময়ে তাঁহার দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম হওয়ায় সে পুত্রের নাম রাখিয়াছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ উক্ত চক্র সীতারামের পিতা পাইয়াছিলেন বলিয়া মনে করিবার আরও কারণ আছে। রাজধানী স্থাপনের কয়েক বৎসর পরে সীতারাম এই শিলা হরিহরনগর হইতে আনিয়া৩ নূতন অষ্টকোণ মন্দিরে উহার প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাহাতে লিখিয়া রাখেন :

‘লক্ষ্মীনারায়ণস্থিত্যৈ তর্কাক্ষিরসভূশকে।
নিৰ্ম্মিতং পিতৃপুণ্যার্থং সীতারামেণ মন্দিরম্॥’

[তর্ক=৬, অক্ষি=২, রস=৬, ভূ=১; অঙ্কের বামাগতিতে ১৬২৬ শক বা ১৭০৪ খৃঃ অব্দ।] অর্থাৎ সীতারাম ১৭০৪ খৃঃ অব্দে পিতৃপুণ্যের জন্য লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতিষ্ঠাকল্পে এই মন্দির নির্ম্মাণ করেন। পিতৃদেবের সহিত এই বিগ্রহের বিশেষ কোন সম্বন্ধ না থাকিলে, তিনি ‘পিতৃপুণ্যার্থং’ কথা বলিতেন না। আবার লক্ষ্মীনারায়ণ যদি তাঁহার নিজেরই আবিষ্কৃত ভাগ্যদেবতা হইতেন, তাহা হইলে রাজধানী প্রতিষ্ঠার সময় সর্ব্বাগ্রে সে মন্দির নির্ম্মিত হইত এবং কানাইনগরের ‘হরেকৃষ্ণ’ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা লিপিতে যেরূপ প্রাণ খুলিয়া আন্তরিক ভক্তির ভাষা ব্যক্ত করিয়াছেন, এ মন্দিরের লিপিতেও তেমন কিছু কথা থাকিত। আমরা দেখিব ১৬৯৯ খৃঃ অব্দে দশভুজার মন্দির ও ১৭০৩ অব্দে কানাইনগরের বহু শিল্পকলা-সমন্বিত পঞ্চরত্ন মন্দির নির্মিত হয়, এবং তাহারও পরে ১৭০৪ অব্দে কারুকার্য্য-বর্জ্জিত লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছিল। সুতরাং লক্ষ্মীনারায়ণের সহিত রাজধানীর সম্পর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু তদপেক্ষা অবস্থান কৌশলের জন্যই প্রধানতঃ স্থান নির্বাচন করা হইয়াছিল, ইহাই আমাদের বিশ্বাস।

এখন আমরা মহম্মদপুর নামের কথা বিচার করিব। এ বিষয়ে সাধারণ মত এই, সীতারাম যখন স্থান মনোনীত করেন, তখন এ স্থলে মহম্মদ আলি বা মহম্মদ শাহ নামে এক ফকির বাস করিতেন। সীতারাম তাঁহাকে স্থান ত্যাগ করিয়া যাইতে বলেন, কিন্তু তিনি তাহাতে সম্মত হন না। অবশেষে অগত্যা তাঁহার নামে রাজধানীর নামকরণ করিলে তিনি স্থান ত্যাগ করিতে পারেন এইরূপ বলেন; সীতারাম যে প্রস্তাবে সম্মত হন। বঙ্কিমচন্দ্র এই মত গ্রহণ করিয়াছেন, গল্পটিও সেইজন্য বদ্ধমূল হইয়াছে। এমন কি, মহম্মদপুর দুর্গে প্রবেশ পথের বামদিকে পদ্মপুকুরের কূলে একস্থানে মহম্মদ শাহের আস্তানা ছিল বলিয়া প্রদর্শিত হয়। কিন্তু সেখানে সীতারামের প্রতিষ্ঠিত কোন ইমারত বা মজিদ নাই। একজন সাধু ফকিরের আস্তানা সেখানে থাকিলে বা তাঁহার জন্য একটি মসজিদ গঠিত হইলে, তাহাতে কি ক্ষতি হইত, তাহা বুঝিয়া পাই না। বিশেষতঃ যখন সীতারামেরও রাজনৈতিক তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখি এবং তিনি প্রতাপাদিত্যের মত হিন্দু-মুসলমানকে মিলাইয়া মিশাইয়া লইয়া স্বকার্য্য সাধনে তৎপর হইয়াছিলেন, তখন মনে হয় না যে, মুসলমান ফকিরকে স্থানান্তরিত করিবার জন্যই তিনি বাধ্য হইয়া মহম্মদপুর নাম রাখিয়াছিলেন। কোন একজন মুসলমান ফকির সেখানে থাকিতে পারেন, কিন্তু শুধু তাঁহার সন্তুষ্টির জন্য বা বিরাগের ভয়ে নহে, পার্শ্ববর্ত্তী সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের সহানুভূতির প্রত্যাশায় এবং হিন্দু-মুসলমানের প্রীতি বন্ধন করিবার উদ্দেশ্যে সীতারাম মহম্মদপুর নাম রাখেন, ইহাই আমার নিকট সমীচীন বলিয়া বোধ হয়। শতাধিক বর্ষকাল মোগলশাসন চলিলেও পাঠানগণ তখনও শান্ত হন নাই; সাধ্যপক্ষে যেখানে সেখানে তাঁহারা বিদ্রোহী হইতেন; সা-তৈরে সীতারাম যে করিম খাঁর বিদ্রোহ দমন করেন, তিনিও পাঠান; সীতারাম যখন ক্ষমতাপন্ন রাজা হইয়া বসিলেন, তখন পাঠানেরা তাঁহার দিকে চাহিতেছিলেন; মোগলের কঠোর শাসন হইতে দেশরক্ষা করা, যেটুকু স্থানে সাধ্য, দেশীয় শাসন প্রবর্তিত করা যে সীতারামের গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল, তাহা অস্বীকার করা যায় না। সেই দুরভিসন্ধি সম্মুখে রাখিয়া, সীতারাম অনেক পাঠানকে সৈন্যদলে আশ্রয় দিয়াছিলেন, অনেকে সাধিয়া আসিয়া তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছিলেন। তাঁহাদের সকলের সহানুভূতি দৃঢ়ভাবে আকর্ষণ করিবার জন্য, তিনি মোল্যাদিগের পরামর্শে রাজধানীর নাম হজরতের নামানুসারে মহম্মদপুর রাখিয়াছিলেন। সীতারাম তাঁহার মুসলমান সেনাপতিদিগের সহিত ভ্রাতৃসম্বন্ধ স্থাপন করিতেন, তাঁহাদিগকে ‘ভাই’ বলিয়া ডাকিতেন। হিন্দু-মুসলমান প্রজার মধ্যে মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করিবার জন্য তিনি সৰ্ব্বদা উপদেশ দিতেন। সে সব উপদেশ-বাণী লোকমুখে ও ভিক্ষুকের গানে দেশময় প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল।[৪] গ্রাম্য কবিরা সত্যের অপলাপ করিতে জানিতেন না।

যাহা হউক, এইভাবে স্থান নির্দ্দেশ ও নামকরণের পর সীতারাম রাজধানী মহম্মদপুরে একটি মৃন্ময় দুর্গ নির্মাণ করেন। শুধু দুর্গ নহে, কয়েকটি সুপ্রশস্ত জলাশয়, সুন্দর মন্দির ও আবাসগৃহ, এই নব প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর শোভাবর্দ্ধন করিয়াছিল। আমরা অগ্রে দুর্গের কথা বলিয়া পরে জলাশয় ও মন্দিরের কথা তুলিব।

মহম্মদপুর-দুর্গের নির্ম্মাণ-কৌশল পৰ্যালোচনা করিলে সীতারামের যুদ্ধনীতির পরিচয় পাওয়া যায়। দুর্গটি প্রায় সমচতুষ্কোণ, পূর্ব্বদিকে উহার সদর প্রবেশ দ্বার। দুর্গটির প্রত্যেক দিকের দৈর্ঘ্য সিকি মাইলের অধিক, সুতরাং সম্পূর্ণ বেষ্টন এক মাইলের বেশী। উহা চতুৰ্দ্দিকে বিস্তীর্ণ পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল, এখনও কোন কোন স্থানের পরিখায় বার মাস জল থাকে। উত্তর ও পশ্চিম দিকের পরিখা এবং উহার প্রান্তবর্তী স্থান এমন ভীষণ জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে যে, সুন্দরবনের মত তাহা ভীতি-সঙ্কুল। পরিখার মাটি দ্বারা চতুর্দ্দিকে মৃন্ময় প্রাচীর রচিত হইয়াছিল, এখনও উহার অনেক ঢিপি আছে; ভিতরের খনিত পুকুরের মাটি দিয়া সবস্থানটা কিছু উচ্চ করা হইয়াছিল। উক্ত পরিখা ব্যতীত বাহিরে আরও কৃত্রিম বা স্বাভাবিক পরিখা ছিল। পূর্ব্ব ও উত্তর দিকে জঙ্গলের মধ্যদিয়া কালীগঙ্গা নামক মরা নদী প্রবাহিত ছিল। পশ্চিম দিকে বিল এবং ছত্রাবতী নদীর নিশানা এখনও পাওয়া যায়। শুধু দক্ষিণ দিকে এমন কিছু জল প্রবাহ ছিল না; এজন্য সীতারাম সেদিকে পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে এক মাইল দীর্ঘ একটি বিস্তৃত ও গভীর গড়খাই খনন করেন।[৫] উহার বিস্তৃতি প্রায় ২০০ ফুট। এই নদীর মত পরিখা পার্শ্ববর্তী লোকের জলকষ্ট নিবারণ করিতেছে।

মহম্মদপুরের পূর্ব্ব প্রান্তে প্রবল নদী মধুমতী ভূষণা প্রদেশ হইতে উহাকে পৃথক করিয়া রাখিয়াছে। উত্তর বা পশ্চিম দিক হইতে কোন শত্রু সৈন্য আসিবার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল না এবং সেদিকে চলাচলের পথবিহীন বহুবিস্তৃত বিল ছিল। শত্রু আসিতে হইলে, ভূষণা অঞ্চল হইতে বারাসিয়া বা মধুমতী নদী পার হইয়া, পূর্ব্ব বা দক্ষিণ দিক দিয়া দুর্গাক্রমণ করিতে হইত। দক্ষিণ দিক হইতে প্রবেশ করিবার পথে সীতারামের প্রশান্ত জলাশয় রামসাগর। উহার উত্তর প্রান্তে প্ৰথম বাধা দিবার স্থান। সেখান হইতে শত্রুসৈন্য অবাধে অগ্রসর হইলে, উত্তর মুখে আসিয়া ঠিক দুর্গের সম্মুখে পড়ে, ঐ পথের ডানদিকে বাহিরের পরিখা বিস্তৃত ছিল। দুর্গের সম্মুখে সেনা নিবাস ছিল এবং পূর্ব্বোক্ত রাজপথ পশ্চিম মুখে গিয়া ভিতর দুর্গের দ্বারে পৌঁছিয়াছিল। বাঁকের মুখে শত্রুর সৎকারের জন্য সারি সারি কামান পাতা থাকিত; যদি তাহাতেও তৃপ্ত না হইয়া কাহারও অগ্রসর হইবার সামর্থ্য থাকে, তবে দুর্গের সদর তোরণে অর্গলবদ্ধ দ্বারের সম্মুখে ভীষণ সংঘর্ষ বাধিত।

এখন দুর্গাভ্যন্তরের ভগ্ন গৃহাদি দেখিয়া ভিতরের অবস্থা যাহা অনুমান করিতে পারি, তাহা বলিতেছি। মানচিত্র হইতে উহা সহজে বুঝা যাইবে। শ্মশানের অস্থিখণ্ড হইতে জীবন্ত মনুষ্যের অনুমান করার ন্যায় ভগ্ন স্তূপাদি হইতে সৌধ-সৌন্দর্য্য বুঝিয়া লইতে হইবে। প্রথম তোরণ দিয়া ইষ্টক প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিলে, ডানদিকে পুণ্যাহ ঘর ও পশ্চাতে কারাগার এবং বামে শরীররক্ষী সৈন্যের আড্ডা ছিল। সীতারামের পতনের পর শেষোক্ত স্থানে নন্দী জমিদারীর কাছারী বসিয়াছিল। আর একটু অগ্রসর হইলে, ডান দিকে মালখানা ও কানুনগো কাছারী এবং বামভাগে সুবিস্তৃত গোলাবাড়ী দৃষ্টিপথে পড়িত। পরবর্ত্তী অর্থাৎ তৃতীয় চত্বরে উত্তরদিকে দশভুজার মন্দির, পশ্চিমে কৃষ্ণজীর অশেষ কারুকার্য খচিত অপূর্ব্ব মন্দির এবং দক্ষিণে নহবৎখানা ছিল। কৃষ্ণজীর মন্দিরের দক্ষিণ দিয়া সদর পথে অগ্রসর হইলে, বামে শিবমন্দির থাকিত। পরবর্ত্তী অর্থাৎ চতুর্থ প্রাঙ্গণে উত্তরে লক্ষ্মীনারায়ণের অষ্টকোণ দোতালা মন্দির, পশ্চিমে তোষাখানা[৬] ও অন্যান্য গৃহ, এবং দক্ষিণের পোতায় রাজার খাস বৈঠকখানা ছিল! পরবর্ত্তী চত্বরই অন্দর মহল, উহার এখন কিছুই নাই। কেবল তাহার পশ্চাতে সাধুখাঁর পুকুর নামে একটি সুদীর্ঘ খাত আছে।[৭] অন্দর মহলে প্রবেশের বামভাগে একটি ঢিপিকে লোকে ‘সবিলা বেওয়ার ভিট্টা’ বলে। পাঠান সৈন্যগণ সীতারামের দক্ষিণ হস্তস্বরূপ ছিলেন; তিনি বাছিয়া বাছিয়া উঁহাদের মধ্য হইতে শরীররক্ষী সৈন্য লন, উঁহারা দুর্গমধ্যে বাস করিতেন। এমন কি, অন্তঃপুরের পরিরক্ষণ কার্য্যেও তিনি পাঠান সেনানীকে ভার দিয়াছিলেন। সবিলা বেওয়া ঐরূপ কোন দ্বাররক্ষকের উত্তরাধিকারিণী হইতে পারেন। হয়ত ইহা হইতেই ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেব অনুমান করিয়াছেন যে, সীতারামের অন্তঃপুরমধ্যে গণিকাদিগের বাস ছিল। সে অনুমান অমূলক।[৮]

দশভুজার মন্দিরের উত্তরদিকে একটি সুন্দর ছোট পুকুর আছে, উহার চারিপাশ এবং তলদেশ সানবান্ধা। ঐ তলদেশে ৭/৮টি চাড়িবসান কূপ ছিল, উহা হইতে জল বাহির হইয়া পুষ্করিণীটিকে পূর্ণ করিয়া রাখিত। এই পুকুরকে লক্ষ্মীনারায়ণের পুকুর বা ধনাগার পুকুর বলে, কারণ প্রবাদ আছে, এই পুকুরের মাঝে সীতারামের ধনরাশি বিভিন্ন পাত্রে জলমগ্ন থাকিত। প্রবাদ অবিশ্বাস্য নহে, অনেকে বহুদিন পরেও এখানে ধনলাভ করিয়াছেন, এবং কাহারও বা বিপুল চেষ্টা বিফল হইয়াছে।[৯] এই ধনাগার পুকুরের পশ্চিম পারে এখনও একটি দোতালা অট্টালিকা ভগ্নাবস্থায় দাঁড়াইয়া আছে, লোকে বলে উহাই ছিল রাজা সীতারামের খাস বাসগৃহ।[১০] উহারই সম্মুখে পশ্চিমদিকে একটি গোলাকার ইষ্টকস্তূপ নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে লুক্কায়িত আছে, উহাকে তাঁহার বিলাসগৃহ বলিয়া ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু সে নর্ম্ম-গৃহে একদিন বিলাসের কি সরঞ্জাম ছিল, তাহা কল্পনা-নেত্রে দেখিয়া লইতে হয়। ঐ স্তূপেরই শীর্ষদেশে দাঁড়াইয়া, যখন একদিন অপরাহ্নে সীতারামের আবাসবাটিকার ফটো তুলিতেছিলাম, তখনই পশ্চাৎ হইতে এক বন্য বরাহ দ্বারা আক্রান্ত হইয়া আমার জীবনান্ত হওয়ার উপক্রম হইয়াছিল। অন্দর মহলের উত্তরদিকে একটি স্থানকে নয়াবাড়ী বলে; হয়ত সেখানে কোন নূতন রাণীর নূতন বাড়ী ও পুকুর ছিল। সীতারামের পতনের পর সেখানে নড়াইলের কাছারী বসিয়াছিল; এখন তাহা গভীর জঙ্গলের কুক্ষিগত হইয়া পড়িয়াছে।

দুর্গ-পরিখার উত্তরে প্রীতরাম সরকারের পুকুর ও মন্দির ছিল। পুকুরকে দেওয়ানের পুকুর বলে। সরকার মহাশয় সম্ভবতঃ নায়েব দেওয়ান ছিলেন। সরকারের বাটীর উত্তর দিকে নারায়ণপুর গ্রাম; তথায় দেওয়ান যদুনাথ মজুমদারের বাটীর ভগ্নাবশেষ জঙ্গলমধ্যে আবিষ্কার করা যায়। মন্দিরের উপর বটবৃক্ষ জন্মিয়া কালে এত বড় হইয়াছে, যে মন্দিরের ভগ্নাংশ এক্ষণে বৃক্ষশীর্ষে দোদুল্যমান হইয়া রহিয়াছে। দেওয়ান বাটীর পূর্ব্বদিকে কামারপাড়া ছিল। তাঁহারা সীতারামের অস্ত্রনির্ম্মাণ করিতেন। কামার বাড়ীর অনেক ভগ্নগৃহ এখনও জঙ্গলের মধ্যে আবিষ্কার করা যায়। সে জঙ্গলে শুধু ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ইষ্টকরাশি প্রাচীন কাহিনীর বার্তাবহ হইয়া রহিয়াছে।

দুর্গের সিংহদ্বারের সম্মুখে পূৰ্ব্বদিকে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে সীতারামের ইষ্টক রচিত দোলমঞ্চ ছিল; এখন উন্মুক্ত প্রান্তর জঙ্গলাবৃত হইয়াছে, কিন্তু দোলমঞ্চ আছে এবং নাটোরের আমলে একবার সংস্কৃত হইয়াছিল বলিয়া এখনও ভাল অবস্থায় আছে। এক সময়ে পরিখা বেষ্টিত এই প্রাঙ্গণের পূর্ব্ব ও উত্তর ধারে সেনা-নিবাস ছিল এবং মধ্যস্থলে কুচ্-কাওয়াজ্ হইত। দোলমঞ্চের দক্ষিণ-দিকে রামচন্দ্র বিগ্রহের বাটী। এই বাটীটি প্রাচীর বেষ্টিত চক, উহার কতকাংশ দোতালা। উত্তরদিকে নিম্নতল দিয়া সদর পথ, পশ্চিমের পোতায় রামচন্দ্র, সীতা, লক্ষ্মণ ও হনুমানজীর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত, পূর্ব্বপোতায় কাছারীঘর এবং দক্ষিণদিকের একপার্শ্বে লোকজনের বাসগৃহ ও অন্যদিকে ভোগমন্দিরাদি ছিল। পশ্চাৎ দিকে একটি পুকুর আছে। এই বাটী সীতারামের সময়ের নহে; তাঁহার রাজ্য যখন নাটোররাজ্যের অধিকৃত হয়, তখনই কাছারী বা কর্মচারীদের বাস-গৃহের জন্য রাজপুরীর মালমসল্যা দিয়া এই বাটী গঠিত হয়। শুনিতে পাওয়া যায়, রাণী ভবানীর সময়ে তাঁহার বিধবা কন্যা অপূর্ব্ব রূপবতী তারাদেবী সিরাজউদ্দৌলার অত্যাচার ভয়ে কিছুকাল গুপ্তভাবে এইস্থানে বাস করিয়াছিলেন।[১১] তাঁহার স্বামীর নাম—রঘুনাথ লাহিড়ী। এইজন্য তিনি বহুস্থানে রঘুনাথ বা রামচন্দ্র বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। মহম্মদপুরে বাস করিবার সময় তিনি এই কাছারী বাটীতে উক্ত বিগ্রহগুলি স্থাপনা করিয়া উহার বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। রামসাগরের জলকর ও অন্য কয়েকটি তালুক এই বৃত্তির মহল ভুক্ত ছিল, পরে উহা গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।

দুর্গের বাহিরে পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিকে বাজার ছিল। রামসাগরের উত্তর প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া দুর্গদ্বার পর্য্যন্ত চাঁদনী চকের মত নানাজাতীয় বিপণিমালায় পরিশোভিত ছিল। দক্ষিণদিকের যে এক মাইল দীর্ঘ বাহিরের পরিখার কথা বলিয়াছি, তাহার উত্তর ধারেও বাজার ছিল, এখন উহার একটা স্থানকে ‘বাজার রাধানগর’ বলে। বিশেষত্ব এই ছিল যে, এই বাজারের এক এক অংশ এক এক প্রকার দ্রব্যের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। উহাকে এক একটি পটী বলিত; যেমন কাইয়া পটী, কামার পটী ও কাষ্ঠঘর পাড়া প্রভৃতি। এখন দোকানপাটের চিহ্ন নাই, কিন্তু লোকমুখে নামের খবর আছে। সীতারামের সৌভাগ্যরবি সমুদিত হইলে, ভূষণাসহরকে নিষ্প্রভ করিয়া মহম্মদপুরে বাণিজ্য-কেন্দ্র হইয়াছিল। সেই বাণিজ্যলোভে বা রাজসরকারে চাকরির খাতিরে বহু বৈদেশিক জাতি আসিয়া জুটিয়াছিলেন। কাইয়া বা মাড়োয়ারিয়া ব্যবসা করিতে আসিয়াছিলেন, পাঞ্জাবীরা সৈন্যদলে ঢুকিয়াছিলেন। এখনও কাষ্ঠঘর পাড়ায় দুই একটি নিঃস্ব হিন্দুস্থানী পরিবার কোনরূপে দিনপাত করিতেছেন; এখনও দশভুজার পূজক তেওয়ারি ব্রাহ্মণেরা দুর্গমধ্যে বসতি করিতেছেন। হিন্দুস্থানীরা রাজধানী মহম্মদপুরে, কোড়কদির নিকটবর্ত্তী গন্ধখালিতে, এবং অন্যান্য নানা মোকামে বসতি করিয়া এখন স্থানীয় বাসিন্দা হইয়া গিয়াছেন। এখনও আমাদের দেশের প্রায় সকল জমিদার-গৃহে হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়গণ বল ও বিশ্বাস উভয়ের ষোলআনা পরিচয় দিয়া অর্থ ও যশঃ উভয়ই অর্জ্জন করিতেছেন।

সীতারামের রাজধানীতে তাঁহার ইষ্টকগৃহসমূহ অপেক্ষা জলাশয়গুলি অধিকতর স্থায়ী এবং শোভাময়। তাঁহাকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যস্ততার সঙ্গে রাজধানীর গৃহ ও মন্দিরাদি নির্ম্মাণ করিতে হইয়াছিল; এজন্য তাহার অধিকাংশে শিল্পকলার পরিচয় নাই। উৎকৃষ্ট মালমসল্যার পৰ্য্যাপ্ত সংস্থান ছিল না বলিয়া লবণাক্ত দেশের দোষে সৌধগুলি অচিরে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। সে ভগ্নপ্রায় ইষ্টকগৃহ শুধু হিংস্রের আবাস-ভূমি হইতেছে; কিন্তু তাঁহার দীর্ঘিকাগুলি সুদীর্ঘকাল ধরিয়া তাঁহার জলদান পুণ্যের জীবন্ত সাক্ষী রহিয়াছে; এই ‘সাগরগুলির’ মধ্যে রামসাগরই সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ, সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর ও সুপেয় সলিলপূর্ণ। আমাদের দেশে সকল বড় জিনিষকে রামনামে আখ্যাত করা হয় (যেমন রাম দাও, বা রাম ছাগল); তেমনি ভাবে ইহার নাম হইয়াছিল রামসাগর।[১২] কেহ কেহ বলেন এই নামের সঙ্গে সীতারামের নিজ নাম বা রামরূপের রামনামের সংস্রব ছিল। এ সম্বন্ধে একটা কিংবদন্তী আছে। ঐ দীঘির উত্তর ধারে এক বৃদ্ধ রমণী ও সীতারাম নামে তাহার এক দরিদ্র পুত্র বাস করিত। একদিন যখন বুড়ী নিজপুত্র সীতারামকে নাম ধরিয়া ডাকিতেছিল, তখন রাজা সীতারাম সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। একটা খেয়াল হইল, রাজা বুড়ীর বাড়ীতে গিয়া তাঁহাকে ডাকিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। বুড়ী ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে উত্তর করিল, সে রাজাকে ডাকে নাই পুত্রকে ডাকিয়াছে; তবু রাজা ছাড়িলেন না, রাজার আগমন ব্যর্থ হইতে পারে না, সুতরাং বুড়ীর যদি কিছু অভাব থাকে তাহা জানাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করা হইল। অবশেষে বৃদ্ধা তাহার জলকষ্টের কথা বলিল। তখন বুড়ির জন্য একটি কূপ খনন করিয়া দিবার আদেশ হইল। আদেশের সঙ্গে সঙ্গে কার্য্যারম্ভ হইল, কিন্তু গল্প এখানে শেষ হইল না। বৃদ্ধার লাউ গাছের তলায় কূপ খনন কালে ভূগর্ভে যথেষ্ট অর্থভাণ্ডার পাওয়া গেল। তখন রাজা আদেশ দিলেন, ঐখানে দাঁড়াইয়া তাঁহার সেনাপতি মেনাহাতী দক্ষিণ মুখে আকর্ণ সন্ধানে তীর নিক্ষেপ করিলে, তাহা যতদূর গিয়া পড়িবে, ততদূর পর্য্যন্ত একটি দীঘি কাটিয়া দেওয়া হইবে।[১৩] মেনাহাতীর তীর বহুদূরে নৈহাটি গ্রামের কাছে মধুমতীর তীরে পড়িল; উহার অভ্যন্তরে বহু ব্রাহ্মণের নিষ্কর ও কর্মচারীদিগের বাড়ীঘর পড়িয়া গেল। ধর্মপ্রাণ সীতারাম সে সব ব্রাহ্মণের অনুরোধ এড়াইতে পারিলেন না, তাই দীঘির দৈর্ঘ্য কমিয়া গেল। তবুও যাহা থাকিল, তেমন জলাশয়, শুধু এ জেলায় কেন, সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গে আর নাই।[১৪]

রামসাগরের বিশেষত্ব এই যে, আজ ২২৫ বৎসর মধ্যেও ইহার জল সমান আছে, দামদল শৈবালের চিহ্ন মাত্র নাই, বিস্তীর্ণ হ্রদের বক্ষে স্বচ্ছ সলিলে লহরী দেখিলে চিত্ত বিগলিত হইয়া যায়। ইহারই উত্তরের উচ্চ পাহাড়ের উপর এক্ষণে মহম্মদপুরের গ্রাম্য পোষ্ট অফিস অবস্থিত। একদিন মনে আছে, পোষ্ট অফিসের কক্ষে বসিয়া যখন রামসাগরের বক্ষে ক্ষুদ্র বীচি-বিক্ষোভ দেখিতে দেখিতে শীকর-সিক্ত সমীর সেবন করিতেছিলাম, তখন গ্রাম্য পোষ্ট মাষ্টারের সহিত ভাগ্য-বিনিময় করিবার সাধ হইতেছিল। এখনকার ডিগ্রীক্ট বোর্ডের ক্ষুদ্রকায় জলাশয় সমূহ দুই বৎসরে বিশুষ্ক হইয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত দরিদ্র দেশে ‘জলদুর্ভিক্ষের’ সৃষ্টি করে, বিশখানি গ্রামের মধ্যেও একটি সুজলা সরসী দেখা যায় না; আর দ্বিশত বৎসর পূর্ব্বের একটি রাজার জলদানকীর্ত্তি তাঁহার জনহিতৈষণার কথা ব্যক্ত করিতেছে। রামসাগরের জলাশয়-ক্ষেত্র পূৰ্ব্বাপেক্ষা সঙ্কীর্ণ হইলে ও এখনও ১৬০০ হাত দীর্ঘ এবং ৬০০ হাত প্রশস্ত আছে। পাহাড় লইয়া ইহার বেষ্টন ৬০০০ হাতের কম হইবে না, অর্থাৎ পরিমাণফল অন্যূন ২০০ বিঘা। জলের গভীরতা অন্যূন ১২/১৪ হাত; একবার চৈত্র মাসে যখন নৌকা লইয়া সমস্ত জলাশয়ের জল মাপিয়া দেখিয়াছিলাম, কোথায় ও ৮/৯ হাতের কম ছিল না।

রামসাগরের পশ্চিমদিকে বিলের মধ্যে আর একটি জলাশয় দেখা যায়, উহার নাম সুখসাগর। ইহাকে দীর্ঘিকা বলা চলে না, কারণ ইহার দৈর্ঘ্য প্রস্থ প্রায় সমান, প্রত্যেক দিকে ২৫০ হাত হইবে। ইহার মধ্যস্থলে একটি দ্বীপের উপর এক প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ এক্ষণে জঙ্গলাবৃত হইয়া বিষধর সর্পের আশ্রয়স্থল হইয়াছে। শুনিতে পাওয়া যায়, ঐ স্থানে এক সুন্দর ত্রিতল গৃহ সীতারামের গ্রীষ্মাবাস ও আরামের স্থান ছিল। এই জন্যই ইহার সুখসাগর নাম হইয়াছে। সেখানে নাকি সীতারাম শত যুবতী সঙ্গে বিলাস-ব্যসনের চূড়ান্ত করিতেন। স্থানান্তরে আমরা এ গল্পের যৌক্তিকতা বিচার করিব। সুখসাগরে ময়ুর পঙ্খী নৌকা সজ্জিত থাকিত। বাহিরের দীর্ঘ গড়ের পশ্চিম প্রান্তে কানাইনগর গ্রাম; সেখানে সীতারাম ‘হরেকৃষ্ণ’ বিগ্রহের জন্য অতুলনীয় পঞ্চরত্ন মন্দির নির্ম্মাণ করেন; সীতারামের মন্দিরের মধ্যে সেইটিই সর্ব্বোৎকৃষ্ট, উহার বিশেষ বিবরণ পরে দিব। কানাইনগরেও মন্দির সংলগ্ন দুইটি পুষ্করিণী আছে। ঐ স্থান হইতে একটু পশ্চিমদিকে অগ্রসর হইলে, হরেকৃষ্ণপুর গ্রাম। সেখানে কৃষ্ণসাগর নামে একটি অতি সুন্দর দীঘি আছে; এখন উহার জলাশয়ের পরিমাণ ১০০০ × ৩৫০ ফুট। জল অতি পরিষ্কৃত, ঈষৎ কৃষ্ণাভ, হয়ত সেইজন্যই ইহার নাম কৃষ্ণসাগর। কেহ কেহ বলেন, ইহার জল রামসাগর অপেক্ষাও ভাল। ‘সীতারাম কৃষ্ণসাগর খনন করাইয়া তাহার মৃত্তিকা রাশি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইবার অবসর দেন নাই; তাহা সরোবর তীর হইতে প্রতি দিকে প্রায় এক বিঘা দূরে আনিয়া চারিদিকে প্রাচীরের ন্যায় সাজাইয়া রাখিয়া গিয়াছেন। ইহাতে ফল এই হইয়াছে যে, সমতল ক্ষেত্র প্লাবিত করিয়া যে পঙ্কিল সলিলস্রোত প্রত্যেক সরোবরকেই বর্ষাকালে আবৰ্জ্জনায় পূর্ণ করিয়া ফেলে, তাহা আর কৃষ্ণসাগরের সীমাস্পর্শ করিতে পারে নাই; তাহার জল এখনও ঝক্ ঝক্ তক্ তক্ করিতেছে।[১৫] ওয়েষ্টল্যাণ্ড বলেন, সকল পুষ্করিণী খনন কালে এই প্রণালী অবলম্বন করা কর্ত্তব্য।[১৬]

সীতারামের রাজধানীর মোটামুটি একটা আভাস দেওয়া গেল। রাজধানীর শ্রীবৃদ্ধি জন্য আয়বৃদ্ধির প্রয়োজন; রাজ্য ব্যতীত আয়বৃদ্ধি হয় না। আবার রাজ্য-বিস্তার করিতে গেলেই মোগল-সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী; কারণ, দেশীয় রাজা বা জমিদার মোগলের হস্তে যতই অত্যাচারিত হউক না কেন, তাহাদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ হইবা মাত্র তাহারা যে মোগলের পক্ষভুক্ত হইবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রজার মুখের দিকে চাহিলে, সে কথা মনে থাকে না; প্রজাবর্গকে রক্ষা করাই সীতারামের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি সেই উদ্দেশ্য মনে রাখিয়া রাজধানীতে অর্থসঞ্চয়, অস্ত্রসংগ্রহ ও সৈন্যবৃদ্ধি করিতেছিলেন। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, নিয়মিত বেতনের লোভ দেখাইতে পারিলে, সৈন্য-সংগ্রহে কোন অসুবিধা ছিল না। দস্যুতার পথ বন্ধ হওয়াতে অনেকের জীবনোপায় নষ্ট হইয়াছিল; চাষ ব্যবসায়ে তাহাদের আভাস বা লোভ ছিল না। তাহারা সৈন্যদলে ঢুকিবার জন্যই চেষ্টা করিত। সাধিয়া আসিয়া ইহারা অনেকে সীতারামের সৈন্যশ্রেণী পুষ্ট করিল। বেতনের সঙ্গে লুণ্ঠনের লোভ যে ছিল না, তাহা বলিতে পারি না।

অন্য প্রদেশ হইতে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া আনিতে হইলে, নবাব বা ফৌজদারের দৃষ্টিপথে পড়িতে হয়, আর সর্ব্বদা পরমুখাপেক্ষী থাকিতে হয়; সীতারাম তাহা করিলেন না। তিনি নিজের রাজধানীতে বাণিজ্য ব্যবসায়ের উন্নতি করিবার জন্য জমকাইয়া বাজার বসাইলেন; সেখানে আসিয়া ব্যবসায় খুলিবার জন্য নানাদেশের লোককে ডাকিয়া আনিলেন। তন্মধ্যে ভূষণা ও ঢাকা হইতে যে ব্যবসায়ীরা আসিলেন, তাঁহারাই প্রধান। উভয় সহরই তখন পূর্ব্ব বঙ্গের মধ্যে প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। সূক্ষ্মবস্ত্র ও সোণারূপার কারুশিল্পের ত কথাই নাই, এই দুইস্থানে অন্য শিল্পেরও যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। ভূষণার কথা বিশেষভাবে পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। ঢাকা ও ভূষণার শিল্পী আসিয়া মহম্মদপুরকে বিখ্যাত করিয়াছিলেন। শিল্পীকে উৎসাহ দান রাজাদিগের প্রধান কাৰ্য্য ছিল। এখনও আমাদের দেশে যেখানে কোন প্রাচীন রাজার বাসস্থানের চিহ্ন আছে, তাহারই পার্শ্বে এখনও নানাবিধ শিল্পসামগ্রী উৎপন্ন হইয়া থাকে। কোন কোন বিশেষ শিল্পের জন্য এখনও কোন কোন স্থান বিখ্যাত আছে, একটু খুঁজিয়া দেখিলে উহারই পার্শ্বে উৎসাহদাতা কোন পুরাতন রাজা বা জমিদারের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রতাদিত্যের যশোহর আজ শ্মশানে পরিণত হইয়াছে, কিন্তু উহার নিকটবর্ত্তী কালীগঞ্জের কর্ম্মকারগণ এখনও সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র নির্মাণের জন্য দেশবিখ্যাত। তবে এখন তাঁহারা সুধার তরবারি বা সুদীর্ঘ বন্দুকের নল না গড়িয়া, ছুরি কাঁচি জাঁতি, বড় জোর রাম দা ও খাঁড়া গড়িয়া দিন কাটাইতেছেন; মুকুন্দপুরের খণ্ডিকারগণ এখন আর পর্য্যাপ্ত হাতীর দাঁত পান না, তবুও হরিণ বা মহিষের শিং দিয়া নানাবিধ সুন্দর আসবাব দ্রব্য তৈয়ার করেন। সীতারাম ঢাকা হইতে কামারগণ আনিয়া দুর্গের পাশে বসতি করাইয়াছিলেন, তাঁহারা ত সাধারণ যন্ত্রাদি বা অস্ত্রশস্ত্র গড়িতেনই, তদ্ভিন্ন রাজার ফরমাইজ মত যে বড় বড় কামান, গুলিগোলা ও সুতীক্ষ্ণ তরবারি গড়িয়াছিলেন, উহার ব্যবহার দেখিয়া মোগলেরাও স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলেন। এখনও মহম্মদপুরে কামারদিগের বাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে; তাঁহাদের বংশধরগণ জঙ্গল হইতে সরিয়া গিয়া বাজারের কাছে বাস করিতেছেন এবং এখনও তাঁহারা নানাবিধ গৃহাস্ত্র গড়িয়া খ্যাতি লাভ করিয়া থাকেন। শুধু কামার নহে, নানাজাতীয় কারিকরগণ মহম্মদপুরে ব্যবসা খুলিয়া লাভবান হইতে লাগিলেন। ‘কেহ বস্ত্রবয়ন করিতে আরম্ভ করিল, কেহ চরুশিল্পের আলোচনায় নিযুক্ত হইল, কেহ বা যুদ্ধোপযোগী বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রশস্ত্র নির্ম্মাণ করিতে শিক্ষা করিল। অল্পদিনের মধ্যে সীতারামের বাজার আর সামান্য বাজার বলিয়া মনে হইল না, শিল্পপ্রদর্শনীর সুবৃহৎ শিল্পাগার হইয়া উঠিল।[১৭]

বাঙ্গালী কর্ম্মকারেরা কেমন করিয়া কামান নির্ম্মাণ করিতেন, এখনও তাহার নিদর্শন অপ্রতুল নহে। মুর্শিদাবাদে নবাব বাড়ীর সম্মুখে একটি সুবৃহৎ কামান পড়িয়া আছে, উহা বাঙ্গালীর হাতে গড়া। উহার নাম ‘জাহান কোষা’ বা জগজ্জয়ী, দৈর্ঘ্য ১২ হাত, বেড় ৩ হাত, মুখের বেড় এক হস্তের উপর, ওজন ২১২ মণ, উহাতে প্রতিবারে ২৮ সের বারুদ লাগিত। কামান-গাত্রে পিত্তল ফলকে লেখা আছে, উহা ১০৪৭ হিজরী বা ১৬৩৭ খৃঃ অব্দে ঢাকা নগরে জনাৰ্দ্দন কর্ম্মকার কর্তৃক গঠিত হয়। দেশের মধ্যে এমন কত জনাৰ্দ্দন যেখানে সেখানে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। আরও ৫০ বৎসর পরে রাজা সীতারামের সময় এমন কোন কোন জনাৰ্দ্দন এইরূপ কত জনাৰ্দ্দন বা জনধ্বংসী কামান নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। বিপ্লবের পর বিপ্লবে, ম্যাক্সিম কামানের আবির্ভাবের পূর্ব্বেই তাহারা ভূগর্ভে বা অন্যভাবে বিলয়প্রাপ্ত হইয়াছে। সীতারামের দুইটি প্রধান কামানের নাম ছিল, কালে খাঁ ও ঝুঝুম্ খাঁ।[১৮] দুইটির এইরূপ বিশেষ নাম থাকিতে পারে, কিন্তু তাঁহার আরও বহুসংখ্যক ছোটবড় কামান ছিল; নিকটবর্ত্তী রাজা বা জমিদারেরা উহার ভয়ে ব্যাকুল হইতেন। মহম্মদপুরের যে মালাকরগণ রাশি রাশি বারুদ প্রস্তুত করিয়া এই সকল কামানের বৃকোদর পূর্ণ করিবার খাদ্য জুটাইতেন, এখন তাঁহারা নলদী, কুলসুর, বাটাজোড় প্রভৃতি নানাস্থানে উঠিয়া গিয়া বারুদের আতস বাজী, শোলার খেলনা ও ডাকের সাজ প্রস্তুত করিয়া জীবন ধারণ করিতেছেন।

সীতারাম জমিদারীর সময় হইতে দস্যু ডাকাইতদিগকে দেশান্তরিত করিয়া শান্তিসংস্থাপন করিয়াছিলেন। শাসনহীন দেশে সুশাসন প্রবর্তিত করিয়া, ন্যায় বিচারকে করুণার্দ্র করিয়া রাজা সীতারাম প্রজাবর্গের নিকট প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন। তাঁহার শাসনতলে নিরাপদে স্বচ্ছন্দে বাস করিবার আশায় পার্শ্ববর্তী জমিদারী হইতে প্রজাবর্গ যখন দলে দলে তাঁহার এলেকায় আসিতেছিলেন, তাঁহার লোকজনেরা উহাদিগকে যত্ন করিয়া চাষবাসের জমি দিয়া উপযুক্ত স্থানে বসতি করাইতেছিলেন। তখন দেশের কপাল পুড়ে নাই; ম্যালেরিয়া রাক্ষসী মহম্মদপুরকে গ্রাস করিয়া বসে নাই। এক ধারে নবগঙ্গা ও অন্যদিকে মধুমতী, উভয়ের স্বচ্ছস্নিগ্ধ মিষ্ট সলিলের কূলে বাস করা যে কি সুখের ছিল, তাহা কল্পনা করা যায় না। উত্তরাধিকারীর অভাবে বা অন্য অসুবিধায় নিকটবর্ত্তী যে সকল জমিদারী বিশৃঙ্খল হইতেছিল, উহার তত্ত্বাবধানের ভার সহজে আসিয়া সীতারামের হাতে পড়িল। কঠোর শাসনের ফলে যে সব জমিদারীর প্রজারা বিদ্রোহী হইয়া সীতারামকে জানাইলেন, তিনি সসৈন্যে গিয়া সহজে সে সকল স্থান অধিকার করিয়া বসিলেন। তিনি যে আবাদী সনন্দ পাইয়াছিলেন তাহাতে সুন্দরবন প্রদেশের বিশেষ কোন সীমা দেওয়া ছিল না; নবাবানুগৃহীত অন্য কোন প্রবল জমিদারের সঙ্গে বিবাদ না করিয়া তিনি যতদূর পর্য্যন্ত রাজ্যবিস্তার করিতে পারেন, তাহার বাধা ছিল না। এইরূপ নানা কারণে তাঁহার জমিদারী দ্রুতবেগে বাড়িয়া যাইতে লাগিল। সকল ঘটনা সময়ানুক্রমে সংগ্রহ করিয়া দেওয়া সুকঠিন। আমরা সীতারামের রাজ্যবিস্তারের কথঞ্চিৎ আভাস দিবার জন্য কয়েকটিমাত্র অভিযানের উল্লেখ করিতেছি।

সর্ব্বারম্ভে পশ্চিমদিকেই সীতারামের নজর পড়ে। নবগঙ্গার তীর পর্য্যন্ত তাঁহার অধিকৃত ছিল এবং বিনোদপুর তাঁহার একটি আবাস-গৃহ ছিল। সেই বিনোদপুরের অপর পারে সত্রাজিৎপুর। আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, ভূষণায় বিখ্যাত ভুঞা মুকুন্দরামের পুত্র সত্রাজিৎ এইস্থান প্রতিষ্ঠা করিয়া বাস করেন। ঢাকায় তাঁহার প্রাণদণ্ডের পর (১৬৩৬) তাঁহার রাজবংশ নিষ্প্রভ হয় (৩৪শ পরিচ্ছেদ)। তৎপুত্র কালীনারায়ণ চাকলা ভূষণার অন্তর্গত রূপাপাত পোকতানি, রকনপুর প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র পরগণা এবং নলদীর অন্তর্গত তরফ কচুবাড়িয়ার জমিদার ছিলেন। কালীনারায়ণের পৌত্র কৃষ্ণপ্রসাদের মৃত্যুর পর তাঁহার নাবালক পুত্রগণ সীতারামের সময় এ জমিদারীর অধিকারী ছিলেন। সীতারাম উহা নিজ রাজ্যভুক্ত করিয়া লন। ইহাতে নাবালকেরা জমিদারীর উপস্বত্বে বঞ্চিত হয় নাই, বরং সীতারামকে অভিভাবক স্বরূপ পাইয়াছিল। নবাবকে রাজস্ব না দিয়া সীতারামকে দিতে হইত। এই বংশের বিশেষ বিবরণ পরে দিব।

সত্রাজিৎপুরের পশ্চিমদিকেই মামুদশাহী পরগণা, উহা নলডাঙ্গার রাজার জমিদারী, তখন রাজা ছিলেন রামদেব। সেনাপতি মেনাহাতী গিয়া তাঁহার রাজ্যের পূর্ব্বভাগ আক্রমণ করেন। রামদেব যুদ্ধ করিতে সাহসী হন নাই, পূৰ্ব্বাংশ সীতারামকে ছাড়িয়া দিয়া সন্ধি করেন। সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি (৩৭শ পরিচ্ছেদ)। সীতারামের অধিকৃত অংশ পরে নাটোরের অধিকৃত হয়। এখনও সেইরূপ আছে।

উত্তর দিকে মাগুরার নিকটবর্ত্তী নান্দুয়ালীতে শচীপতি মজুমদার নামক একজন বৈদ্য জমিদার প্রবল হইয়া উঠেন। নলডাঙ্গার রাজা সুরনারায়ণের সময় উহা তাঁহার রাজ্যভুক্ত ছিল। শচীপতি রাজা রামদেবের অধীনতা অস্বীকার করিয়া নিজে রাজা বলিয়া প্রচারিত হন। সীতারাম শচীপতির বিদ্রোহিতার সহায় হইয়া তাঁহার সহিত সন্ধি করেন; কারণ ভেদ-নীতির কৌশলে পার্শ্ববর্ত্তী প্রবল জমিদারদিগকে নিজ করতলে রাখাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সীতারামের পতনের পূর্ব্বেই রাজা শচীপতির সকল গর্ব্ব নষ্ট হয়। এখনও নবগঙ্গার অনতিদূরে তাঁহার বাটীর ভগ্নাবশেষকে ‘মঠবাড়ী’ এবং নদীর ঘাটকে ‘রাজবাড়ীর ঘাট’ বলে।[১৯]

উত্তরদিকে পদ্মা পর্য্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারীগুলি অধিকাংশই সীতারামের হস্তে আসে। এমন কি পদ্মার অপর পারে বর্ত্তমান পাবনা জেলার কিয়দংশও তাঁহার অধিকার ভুক্ত ছিল, এরূপ প্রমাণ আছে। বর্তমান পাসি রেল ষ্টেশনের সন্নিকটে পাসিয়া, পালাখালি প্রভৃতি গ্রামে মোট ৮২ বিঘা ১৭ কাঠা জমি সীতারাম তাঁহার দৌহিত্রদিগের গৃহে নিজ প্রতিষ্ঠিত কতকগুলি দেববিগ্রহের জন্য দেবোত্তর দিয়াছিলেন।[২০]

সীতারাম যেমন দস্যু দুর্বৃত্ত দমন করিয়া নবাবের প্রিয়পাত্র হন, তেমনি নিকটবর্ত্তী পাঠান বিদ্রোহীদিগকে নিৰ্জ্জিত করিয়া মোগল-শাসকের সহায়ক হইয়াছিলেন। এইজন্য তাঁহার রাজ্যারম্ভ হইতে তিনি পরগণার পর পরগণা অধিকার করিয়া লইয়া নবাব সরকারে সেই সকল অরাজক প্রদেশের রাজস্ব না পাঠাইলেও নবাব বিচলিত হইতেন না। এইজন্যই ফৌজদারের হত্যার পূৰ্ব্বে স্বাধীনতা প্রয়াসী সীতারামের বিরুদ্ধে নবাব কিছুই করেন নাই। পাঠান-শত্রু এমনভাবে দেশ মধ্যে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন ও তাঁহাদের সহযোগে দেশমধ্যে এত ষড়যন্ত্র চলিতেছিল যে, মোগল শাসনকৰ্ত্তাদিগকে সর্ব্বদাই উঁহাদের জন্য উৎকর্ণ হইয়া থাকিতে হইত, উঁহাদের পরাজয়ের সংবাদ পাইলে তাঁহারা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিতেন। মহম্মদপুরের উত্তর দিকে পদ্মা পৰ্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগ এক প্রকার পাঠানদিগেরই হস্তগত ছিল। ঐ প্রদেশের দক্ষিণাংশে সা-তৈর পরগণা, সেখানে করিম খাঁ বিদ্রোহী হইলে, সীতারাম কিরূপে তাঁহাকে পর্যুদস্ত করেন, তাহা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি।[২১] সা-তৈরের উত্তরে দৌলত খাঁ নামক একজন পরাক্রান্ত পাঠান পশ্চিমে গড়ই হইতে পদ্মা পৰ্য্যন্ত বিস্তীর্ণ স্থানের মালিক ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তৎপুত্র নসিব ও নসরৎ খাঁর নামানুসারে সেই প্রদেশ নসীবশাহী ও নসরৎশাহী নামক দুই পরগণায় বিভক্ত হয় এবং পরে উহা হইতে মহিমশাহী ও বেলগাছী নামক আরও দুইটি পরগণা বাহির হয়। এই সকল পরগণা এক্ষণে যশোহর ও ফরিদপুর উভয় জেলার মধ্যে পড়িয়াছে।[২২] এই সকল পরগণার অধিকার লইয়া যখন পুত্রগণের মধ্যে বিবাদ হয়, তখন সেই সুযোগে উহাদিগকে দমন করিবার জন্য সীতারামের উপর ভার অর্পিত হইয়াছিল এবং এইরূপে সীতারামের অধিকাংশ রাজ্যজয় মোগলের জ্ঞাতসারেই হইয়াছিল। নসীবশাহী জয় করিবার জন্য সৈন্য সামন্ত লইয়া তিনি পদ্মার কূলে উপনীত হইয়া কয়েক স্থানে দুর্গ সংস্থাপন করেন এবং ক্রমাগত যুদ্ধ চলিতে থাকে। বর্তমান পাংসা রেল ষ্টেশনের ৩ মাইল দক্ষিণে মালঞ্চীগ্রামে একটি সুবিস্তীর্ণ ভগ্ন স্তূপকে এখনও লোকে ‘সীতারামের গড়’ বলিয়া থাকে।[২৩] পাংসার পূর্ব্বগায়ে কালিকাপুরেও তাঁহার একটি দুর্গ ছিল এবং সে দুর্গের সন্নিকটে পাঠানদিগের সহিত তাঁহার এক খণ্ডযুদ্ধ হইয়াছিল। এমন কত দিন ধরিয়া কত যুদ্ধ চলিয়াছিল, এখন তাহা নির্ণয় করা যায় না। দেশের মধ্যে কত বিপর্য্যয়, কত ডাকাইতি ও গৃহদাহ ঘটিয়াছে যে, যদি কেহ কোন বিবরণী লিখিয়া রাখিয়া থাকেন, তাহাও বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। মোট কথা, দীর্ঘ চেষ্টার ফলে নসীবশাহী প্রভৃতি সব কয়েকটি পরগণা সীতারামের হস্তগত হইয়াছিল।

সম্ভবতঃ এই সকল ঘটনা সীতারামের রাজত্বের প্রথমে ১৭০২-০৪ খৃষ্টাব্দে ঘটিয়াছিল। যখন সীতারাম দীর্ঘকাল রাজধানী ছাড়িয়া নসীবশাহী পরগণায় ছিলেন, তখনই চাঁড়ার রাজা মনোহর রায় মীর্জানগরের ফৌজদার নুরউল্যা খাঁর সাহায্যে সীতারামের রাজ্য আক্রমণ করিবার জন্য সদলবলে মহম্মদপুরের দিকে অগ্রসর হন।[২৪] মুড়লী হইতে সাখিয়া, বুনাগাতি দিয়া পলিতা পর্য্যন্ত রাস্তা ছিল; সেই স্থানে নবগঙ্গা পার হইয়া নহাটা দিয়া মহম্মদপুর যাইবার সোজা পথ। মনোহর নিজে কখনও যুদ্ধ করেন নাই, কৌশলে পরের জমিদারী গ্রাস করিয়াছেন মাত্র। তাঁহার পৃষ্ঠপোষক নুরউল্যা একই রকম বীর সেনাপতি, তিনি শুধু বিলাসে ব্যবসায়ে আত্মসমর্পণ করিয়া নবাবী দর্পে পরকে চমকিত করিতেন। এই সময়ে সীতারাম মনোহরের নবার্জ্জিত ইশফপুর পরগণার জন্য রাজস্ব দাবি করিয়াছিলেন। উহা অসহ্য হওয়াতে মনোহরের একবার যুদ্ধ করিবার সাধ হইল। কিন্তু তিনি সীতারামের আয়োজনের পরিমাণ জানিতেন না; মহম্মদপুরের বড় বড় কামান কিভাবে যুদ্ধের প্রকৃতি বদলাইয়া দিতেছিল সে জ্ঞান তাঁহার হয় নাই। তিনি নুরউল্যার ফৌজদারী ফৌজ এবং নিজের লাঠিয়াল সৈন্য লইয়া ভৈরব পার হইলেন। এই সময়ে সীতারামের অনুপস্থিতি কালে রাজধানীর সকল ভার সুযোগ্য দেওয়ান যদুনাথ মজুমদারের উপর ন্যস্ত ছিল। তিনি মনোহরের গতিবিধির সংবাদ পাইয়া ব্যস্ত হইলেন। মেনাহাতী প্রভৃতি প্রধান সেনাপতি কেহই মহম্মদপুরে ছিলেন না। যদুনাথ তাঁহাদের অপেক্ষা না করিয়া, রাজধানী রক্ষার সুব্যবস্থা করিয়া, নিজে কয়েকদল সৈন্য কতকগুলি ছোট বড় কামান লইয়া, নবগঙ্গা পার হইয়া কুল্লে- কুচিয়ামোড়ার কাছে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, তাঁহার বামদিকে চিত্রানদী কিছুদূরে দক্ষিণ মুখে বাঁকিয়া গিয়াছে এবং ডানদিকে ফটকী নদী উত্তরবাহিনী হইয়াছিল। উভয় বাঁকের মধ্যবর্তী স্থান দিয়া অবাধে শত্রুসৈন্য পদব্রজে নবগঙ্গার কূলে উপনীত হইতে পারিত, কিন্তু সেদিকে তাহাদিগকে অগ্রসর হইতে দিলে, রাজধানীর কোন আশঙ্কা হউক বা না হউক, মামুদশাহী পরগণা রক্ষা করা যায় না; সে দিকেও যে মনোহরের নজর ছিল না, তাহা নহে। এজন্য যদুনাথ চিত্রা ও ফটকীর উক্ত দুই বাঁক সংযুক্ত করিয়া দিয়া একটি খাল কাটিলেন, উহার নাম হইল ‘যদুখালি’; এখন তাহা সুন্দর নদীরূপে পরিণত হইয়াছে। খাল সম্পূর্ণ হইতে না হইতে মনোহর রায় বুনাগাতির দক্ষিণ দিকে এক বিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে ছাউনী করিয়া বসিলেন, ঐ স্থানকে এখনও স্থানীয় লোকে ‘গড়ের মাঠ’ বলে, কারণ মনোহর রায় সেখানে চারিধারে গড় কাটিয়া মধ্যস্থানে উচ্চ ঢিপির উপর সৈন্যাবাস স্থাপন করিয়াছিলেন। সে গড়ের চিহ্ন এবং ঢিপির কতকাংশ আছে, তবে ভূতের ভয়ে সে উচ্চস্থানে এখনও লোকে বাস করিতে চায় না। সারি সারি কামানের ভয়ে চাঁচড়ার সেনা সরশুনা বা সুরসেনা গ্রামের উত্তরে অগ্রসর হইল না। স্থানটিকে কে সুরসেনা (Sursena) নাম দিল, জানি না।

ছাউনী করিয়া থাকিবার সময়ে যে উভয় সৈন্যের অগ্রবর্ত্তী দলের মধ্যে দুই একটি ক্ষুদ্র সংঘর্ষ হয় নাই, তাহা বলিতে পারি না। বরং মনে হয়, হইয়াছিল এবং তাহাতেই মনোহরের দিব্যজ্ঞান আসিয়াছিল। তবে যাহাকে প্রকৃত যুদ্ধ বলে, তাহা হয় নাই। যদুখালিতে পথ বন্ধ, অপর পারে কামান সজ্জিত, সীতারামের সৈন্যসংখ্যা ক্রমেই বৰ্দ্ধিত হইতেছিল—এই সব দেখিয়া মনোহর দেওয়ানের সঙ্গে একটা মিটমাট করতঃ রাত্রিযোগে সদলবলে প্রত্যাবর্তন করিলেন। হয়ত, উহার পর গতানুশোচনা ভুলাইবার উদ্দেশ্যে, সীতারামের সঙ্গে কিছু অন্তরঙ্গতা দেখাইবার ছলে কন্যার বিবাহ উপলক্ষে তাঁহাকে চাঁচড়ার বাড়ীতে পদার্পণ করিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। সীতারাম তখনও রাজধানীতে অপস্থিত, সুতরাং নির্দ্দিষ্ট দিনে আসিলেন না বা কোন উত্তরও দিলেন না। যখন রাজধানীতে ফিরিয়া সকল অবস্থা স্বকর্ণে শুনিলেন, তখন মনোহরের দর্প চূর্ণ করিবার জন্য ক্রোধাদ্ধ হইলেন। এই সময়ে তিনি কিরূপে সসৈন্যে ভৈরবকূলে বর্তমান নীলগঞ্জের অপর পারে ঝুমঝুপুরে উপনীত হইয়া মনোহরের নিকট সংবাদ পাঠান, কি ভাবে তাঁহার প্রেরিত লোকের সহিত কঠোর ব্যবহার করেন এবং অবশেষে মনোহর বশ্যতা স্বীকার করিলে কিরূপে সন্ধি হইয়াছিল, তাহা আমরা পূর্ব্বে বর্ণনা করিয়াছি (৩৮শ পরিচ্ছেদ)। সীতারাম সে সময়ে যেখানে আসিয়া ছাউনী করেন, এখনও ঝুঝুম্পুরের সে অংশকে ‘কেল্লার মাঠ’ বলে।[২৫]

সীতারাম বহু পূর্ব্বে সুন্দরবনের আবাদী সনন্দ পাইয়াছিলেন। উহার জন্য তাঁহাকে যেমন কয়েক বৎসর কোন রাজস্ব দিতে হয় নাই, তেমনি সে মহল হইতে আয়ও বিশেষ কিছু হয় নাই। কারণ সে অঞ্চল শাসনে রাখা সহজ নহে। কোন স্থানে প্রজা বিদ্রোহী হইলে, দূর হইতে সৈন্যদল লইয়া গিয়া শাসন করিয়া আসিতে হইত; জলের রেখার মত সে শাসনের চিহ্ন বেশী দিন থাকিত না। সুন্দরবনের মধ্যে শিবসা নদীর পশ্চিমাংশ যশোহরের ফৌজদারের শাসনাধীন ছিল; সীতারাম কেবল মাত্র উহার পূৰ্ব্বাংশে অর্থাৎ বর্ত্তমান বাগেরহাটের দক্ষিণ ভাগে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। সে দিকে সমুব্বর আবাদসমূহের মধ্যে অবস্থিত রামপাল একটি প্রধান স্থান। ১১১৭ সালের (১৭১০ খৃঃ) প্রারম্ভে সীতারাম সংবাদ পাইলেন যে, ঐ স্থানের প্রজাবর্গ স্থানীয় জমিদারবর্গের চক্রান্তে পড়িয়া বিদ্রোহ উপস্থিত করিয়াছে। উহাদিগকে সময়মত সমুচিত শাস্তি না দিলে, শাসন রক্ষা করা যাইবে না, ইহাই ভাবিয়া সীতারাম রণ-বাহিনী লইয়া প্রস্তুত হইলেন। বর্ষান্তে এই অভিযানের জন্য মধুমতী নদী-বক্ষে বহু সংখ্যক দ্রুতগামী সুদীর্ঘ সিপ্, সৈদপুরী বড় বড় পাসী ও ঢাকাই পলওয়ার, সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদাদি লইয়া প্রস্তুত হইল।[২৬] সীতারাম সোজাসুজি মধুমতী নদী দিয়া দক্ষিণমুখে যাত্রা করিলেন। প্রথমত নন্দী, তেলিহাটি ও মকিমপুর তাঁহার অধিকারভুক্ত প্রদেশ। উহা পার হইলে বামে দক্ষিণে দুই দিকে সুলতানপুর-খড়রিয়া নামক বিস্তৃত পরগণা। উহার অধিকাংশই জলা ভূমি, তাহাতে শস্যাদি বড় কম হয়। শুধু নদীর কূলে কিছুদূর পর্য্যন্ত লোকের বসতি, তন্মধ্যেও ভদ্রলোকের সংখ্যা অল্প। এই পরগণার জমিদারী সনন্দ মহারাজ প্রতাপাদিত্য জানকীবল্লভ বিশ্বাস মজুমদার নামক তাঁহার একজন বিশ্বস্ত বৈদ্য কর্মচারীকে দিয়াছিলেন।[২৭] তিনি আসিয়া পরগণার দক্ষিণাংশে ভৈরব নদের কূলে মুলঘর নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। প্রতাপের পতনের পর সে জমিদারী সনন্দ নবাব কর্তৃক স্বীকৃত হয়। জানকীবল্লভের পৌত্র হরিনাথ সকল সরিককে বঞ্চনা করিয়া সমস্ত জমিদারী দখল করিয়া লন এবং নবাব সরকার হইতে রাজোপাধি পান। তিনি এক কুল-যজ্ঞের অনুসন্ধান করেন বটে, কিন্তু তাঁহার প্রপীড়িত জ্ঞাতিগণ বিরুদ্ধ হওয়ায় তাঁহার সকল চেষ্টা বিফল হয় এবং তিনিও ভগ্নাংশ হইয়া অল্পদিন মধ্যে গতাসু হন। তৎপরে তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা রামরাম রায় তাঁহারই মত অন্য সকলের দাবি উপেক্ষা করিয়া জমিদারীর বৃহত্তর অংশ ভোগ করেন। তিনি জগদেক নাথ বিগ্রহের জন্য যে সুন্দর জোড়বাঙ্গালা মন্দির নির্ম্মাণ করেন, উহার গাত্রলিপি হইতে ১৫৯৩ শক বা ১৬৭১ খৃষ্টাব্দ পাই। কিছুদিন পরে তাঁহার মৃত্যুর পর, জমিদারী তৎপুত্র কৃষ্ণকান্ত ও রামকেশব শিরোমণির হস্তে আসে। ইঁহাদেরই সময়ে সীতারাম খড়রিয়া পরগণার রাজস্ব দাবি করেন। উঁহারা দুইজনে এবং কাজুলিয়ার সরিকগণ সীতারামের বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হন বটে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাঁহার সরকারে রাজস্ব সরবরাহ করিয়াছিলেন কিনা, তাহা ঠিক ভাবে জানা যায় না।

তদনন্তর সীতারাম বাগেরহাটের পথে রামপালে উপনীত হইয়া বিদ্রোহীদিগকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। যুদ্ধ হইয়াছিল সত্য, নতুবা তিনি স্বপ্রদত্ত সনন্দে ‘রামপাল জয়’ করিবার কথা উল্লেখ করিতেন না। কিন্তু সে যুদ্ধ কোথায় কি ভাবে হইয়াছিল, তাহা ঠিক জানা যায় না। পারমধুদিয়ার কাছে ‘রণভূম’ বা ‘রণের মাঠের’ সঙ্গে ঐ সংঘর্ষের কোন সম্পর্ক আছে কিনা, জানি না। তবে যুদ্ধ যেখানেই হউক, উহার ফলে যে সীতারাম নিকটবর্ত্তী চিরুলিয়া, মধুদিয়া প্রভৃতি পরগণার জমিদারীর স্বামিত্বলাভ করিয়াছিলেন, ইহা সত্য কথা। যদুনাথের পুস্তক হইতে জানিতে পারি, এই সময়ে চিরুলিয়া জমিদারীর অংশভাগী দেবকীনন্দন বসু চিরুলিয়া ত্যাগ করিয়া মহম্মদপুরে যান এবং তাঁহার বংশধরগণ এখনও তন্নিকটবর্ত্তী ধুলজুড়ী গ্রামে বাস করিতেছেন।

এইভাবে আমরা দেখিতে পারি, সীতারামের রাজ্য পদ্মার উত্তর পার হইতে আরম্ভ করিয়া বঙ্গোপসাগরের প্রান্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে পূর্ব্বদিকে সে রাজ্য সুন্দরবন পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইলেও পশ্চিমাংশে তাহা ভৈরবের দক্ষিণে যায় নাই। তাঁহার রাজ্যকে মোটামুটি উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভাগ করা যায়। উত্তরের ভাগ জনপদাংশ; উহা উত্তরে পাবনা হইতে দক্ষিণে ভৈরব নদ এবং পশ্চিমে মামুদশাহী পরগণা হইতে পূৰ্ব্বদিকে মধুমতী পারে তেলিহাটি পরগণার শেষ পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত। দক্ষিণভাগ সুন্দরবনের ক্ষণস্থায়ী আবাদমহল; উহা উত্তরে ভৈরবনদ হইতে আবাদের দক্ষিণ সীমা পর্যন্ত এবং পশ্চিমদিকে পশরনদ হইতে পূর্ব্বদিকে বলেশ্বর পারে বরিশালের কিয়দ্দূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত। কেহ কেহ বলেন, তাঁহার রাজ্য ৪৪টি পরগণা লইয়া গঠিত এবং উহার হস্তবুদ্ আয় কোটি টাকার উপর। নাটোর রাজ্য সাধারণতঃ ৫২ লক্ষ ৫৩ হাজারের জমিদারী বলিয়া খ্যাত। মধুসূদন সরকার মহাশয় স্থির করিয়াছিলেন যে, সীতারামের জমিদারী নাটোর রাজ্যের ৩ এর ২ অংশ ছিল। সুতরাং রাজস্ব ৩৫ লক্ষ টাকা। আর সীতারামের অর্দ্ধাংশ মাত্র জমিদারী নাটোরের গ্রাসে পড়ে, অবশিষ্টাংশ অন্যের সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়। সুতরাং সীতারামের জমিদারীর রাজস্ব ৭০ লক্ষ টাকার কম নহে। নবাবের রাজস্ব কখনও হস্তবুদ আদায়ের ৩ এর ২ অংশের অধিক হইত না। মোট কথা, গঠনের সঙ্গে সঙ্গে যাহার পতন হয়, তাহার আকারের পরিমাণ স্থির করা যায় না। রাজ্যের আয় হইতে তাঁহার সমৃদ্ধি স্বল্পকালের জন্য যতই বৃদ্ধি পাউক, তাহা অচিরে ছিন্নভিন্ন ও উৎসন্ন হইয়া গিয়াছিল। উহার উত্থান পতন উল্কার মত আকস্মিক এবং তাঁহার রাজ্য-সৌধ তাসের ঘরের মত ক্ষণিক।

.

পাদটীকা :

১. দেওয়ান যদুনাথ মজুমদারের গৃহে রক্ষিত ফদ হইতে জানা গিয়াছে যে, সীতারামের পিতৃশ্রাদ্ধে ২৮,৯৭২ টাকা ব্যয় হয়। এখনকার দিনে উহা অন্যূন দুইলক্ষ টাকার সমান।—যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ৫ম সং, ২৩৭ পৃ।

২. যদুনাথ বলেন, সীতারাম দিল্লী হইতে মুর্শিদাবাদে আসিয়া মুর্শিদকুলি খাঁর অনুগ্রহ লাভ করেন। ১৭০৪ খৃঃ অব্দে মুর্শিদাবাদে রাজধানী হয় এবং ১৭০৭ অব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু ঘটে। সুতরাং স্বীকার করিতে হয়, সীতারামের রাজোপাধি ১৭০৪-০৭ মধ্যে হইয়াছিল। কিন্তু আমরা সনন্দ ও শিলালিপি হইতে দেখিতে পাই, সীতারাম উহার পূর্ব্বে মহম্মদপুরে রাজধানী করিয়া তথায় ১৬৯৯ অব্দে দশভুজার মন্দির, ১৭০৩ অব্দে কানাইনগরের মন্দির নির্ম্মাণ করেন এবং ১৬৯৬ অব্দে গুরুপুত্রকে সনন্দ দান করেন। রাজা হইবার পূর্ব্বে এ সব ঘটনা হয় নাই। আমাদের মনে হয়, ১৬৮৭-৮ খৃষ্টাব্দে সীতারাম রাজোপাধি পান, তখন তাঁহার বয়স প্রায় ৩০ বৎসর। তখনও সায়েস্তা খাঁ ঢাকায় নবাব ছিলেন।

৩. হরিহরনগর হইতে লক্ষ্মীনারায়ণ শিলা লইয়া আসিবার সময় সেখানে উহার বদলে শ্রীধর চক্র প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছিল, তাঁহার কিছু দেবোত্তরও ছিল; সে শিলা এখনও সেখানে আছেন।

৪. এখনও সে সব গান দুষ্প্রাপ্য নহে। যদুনাথ স্বীয় পুস্তকে উহার ২/১টি সংগ্রহ করিয়া দিয়া সকলের ধন্যবাদার্হ হইয়াছেন। মাগুরাঞ্চলে এই জাতীয় কবিতা খুব বেশী পাওয়া যায়, কারণ তথায় বহু নিরক্ষর কবির আবির্ভাব হইয়াছিল। ইদু বিশ্বাস ও পাগলা কানাই-এর কথা আমরা পরে বলিব। সীতারামের সময়ে প্রচারিত একটি ধুয়া এই :

“শুন সবে ভক্তিভাবে করি নিবেদন। দেশ গায়েতে যা হইল শুন দিয়া মন।।
রাজাদেশে হিন্দু বলে মুসলমানে ভাই। কাজে লড়াই কাটাকাটির নাহিক বালাই।।
হিন্দু বাড়ীর পিঠে কাশন মুসলমানে খায়। মুসলমানের নস (রস) পাটালী হিন্দুর বাড়ী যায়।।
রাজা বলে আল্লাহরি নহে দুইজন। ভজন পূজন যেমন ইচ্ছা করুকগে তেমন।।
মিলেমিশে থাকা সুখ, তাতে বাড়ে বল। ডরেতে পলায় মগ ফিরিঙ্গিরা খল।।
চুলে ধরি নারী ল’য়ে চড়তে নারে নায়। সীতারামের নাম শুনিয়া পলাইয়া যায়।।” —যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ৫ম সং, ১১২ পৃ।

৫. পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ জলাশয়ের জল হিন্দুরা নিত্যনৈমিত্তিক কার্য্যে ব্যবহার করেন না বলিয়া সীতারাম এই বাহিরের পরিখাটির পূর্ব্বসীমার উত্তর মুখে এবং পশ্চিমপ্রান্তে দক্ষিণ মুখে পরিখাটিকে একটু দূর পর্য্যন্ত খনিত করিয়া জলাশয়টি উৎসর্গ করিয়াছিলেন।

৬. তোষাখানার অট্টালিকাটি সম্পূর্ণ খিলানে গঠিত জোড়-বাঙ্গলা। মোট ৪টি গৃহে বিভক্ত; দক্ষিণ দিকের দুইটি ঘর বড়, উহার প্রত্যেকটি ৩২’-৪’’ ×৮’-১০’’। উত্তরদিকের ঘর দুইটি ছোট, উহার প্রত্যেকটি ১৪’-৯’’ ×৭’-৩’’। প্রস্তুদিকের ছাদের খিলানের উচ্চতা— ১১’-৩’’ ইঞ্চি।

৭. কথিত আছে, যে বৎসর সীতারামের ভগিনীর সহিত গোপেশ্বর খাঁ ঘোষের বিবাহ হয়, সেই বৎসর এই পুকুর খনিত হয়। গোপেশ্বরের অন্য নাম সাধু খাঁ। তজ্জন্য অন্দরের স্ত্রীগণ এই পুকুরকে সাধুখাঁর পুকুর বলিতেন।—যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ১৩৮ পৃ।

৮. Westland, Jessore; p. 30; যদুনাথ, ৫২১ পৃ।

৯. এই পুকুরে এক সময়ে নলদীর নায়েবের পাচক একটি বাক্সে ৫০০ সুবর্ণ মোহর পায়। এইরূপ আরও অনেকে অর্থ পাইয়াছে। কিন্তু নড়াইলের বাবুরা …… made diligent search in the tank to find any stray treasure which might be in it.’-Westland, Jessore, p. 31.

১০. গৃহটি দোতালা; পশ্চিমদিকে সদর, সেইদিক হইতে ফটো লওয়া হয়। নিম্নতলে সম্পূর্ণ গৃহটি তিনটি কামরা ও একটি দরদালানে বিভক্ত। পার্শ্বের দুইটি ঘর প্রত্যেকটি ২১’-৯’’ × ৮’-৯’’, মধ্যের ঘরটি ২৫’-৬’’ × ৮’-১০’’ এবং দরদালান ২৫’-৬’’ × ৮’-১০’’; উপরের তলেও এইরূপ ছিল।

১১. রাজসাহীর অন্তর্গত খাজুরাগ্রাম নিবাসী রঘুনাথ লাহিড়ীর সহিত তারাদেবীর বিবাহ হয়। বিবাহের অল্পদিন পরে রঘুনাথের মৃত্যু ঘটে। যৌবনে তারা অসামান্য রূপলাবণ্যে, শিক্ষাগৌরবে ও চরিত্রগুণে খ্যাত হন। তিনি প্রাতঃস্মরণীয় রাণী ভবানীর উপযুক্ত কন্যা এবং একমাত্র সন্তান। কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেন, রাণী ভবানী সিরাজের ভয়ে ব্যাকুল হইয়া তারাকে লইয়া বারাণসীধামে পলায়ন করেন।— Calcutta Review, Vol. LVI, 1873, p. 12. অক্ষরকুমার মৈত্রেয় মহাশয় বলেন, কলঙ্কভয়ে রাণী নিজ কন্যার মৃত্যু রটনা করিয়া দিয়াছিলেন।—’রাজসাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, ১৭১ পৃ। মহম্মদপুরে তারার গুপ্ত-বাসের প্রবাদ এত প্রচলিত এবং রামচন্দ্র প্রভৃতি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ঐ প্রবাদকে এত সমর্থন করে যে, কাশীধামে যাওয়ার পূর্ব্বে তারার কিছুদিনের জন্য মহম্মদপুরে বাস করিবার কথা সত্য বলিয়া বোধ হয়।

১২. Sen. Ram Sankar, Report, p. liii.

১৩. বাগেরহাটে খাঁ জাহান আলির খনিত একটি দীঘির নাম ঘোড়াদীঘি। প্রথম খণ্ডে উহার বিবরণ দিয়াছি। ঘোড়াদৌড়ের জন্য ঘোড়াদীঘির মত রামসাগরের নাম তীরদীঘি হইতে পারিত। রামরূপের তীর বলিয়া দীঘির নাম রামসাগর হওয়া বিচিত্র নহে।

১৪. ‘It is the noblest reservoir of water in the district. It is the greatest single work that Sitaram has behind him.’-Westland. Jessore, p. 9; Hunter; Jessore, p. 214; Jessore Gazetteer, p. 161 আকারে আজিমগঞ্জের নিকটবর্ত্তী সাগরদীঘির সহিত ইহার তুলনা হইতে পারে, কিন্তু সাগরদীঘি মজিয়া গিয়াছে, রামসাগর মজে নাই। রামসাগরের জলে শৈবালাদি জমিতে না পারে, এজন্য সীতারাম নাকি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তাম্রখণ্ড এবং পারদপূর্ণ করিয়া গাছের গুঁড়ি ইহার জলে নামাইয়া দিয়াছিলেন। কিছুদিন পূর্ব্বে ইহা পরীক্ষিত হইয়াছিল।

১৫. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘সীতারাম’, ৪৮ পৃ।

১৬. Westland, Jessore, p. 37.

১৭. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘সীতারাম,’ ৫১ পৃ।

১৮. বাগেরহাটের সন্নিকটে খাঁ জাহানের দীঘিতে বা অন্যত্র বড় বড় কুমীরের এই সব নাম ছিল। কামানগুলিও কুমীরের মত দেখাইত বলিয়া সীতারাম তাহাদের ঐরূপ নাকরণ করেন। খাঁ উপাধি তখন হিন্দু মুসলমান অনেকের ছিল, কামানের থাকিবে না কেন?

১৯. এখন এই ঘাটে বিজয়ার দিন সকল বাড়ীর প্রতিমার ঘট বিসর্জ্জন হয়। রাজবাটীর মন্দিরে যে সকল বিগ্রহ ছিলেন, তন্মধ্যে তিনটি এখনও বর্তমান। শ্যামরায় নান্দুয়ালী নিবাসী তারক চন্দ্র সেন মহাশয়ের বাটীতে এবং কৃষ্ণরায় ও লক্ষ্মী দেবী ঐ গ্রামের প্রতাপচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের বাটীতে পূজিত হইতেছেন। শচীপতির পুত্র কুশলরাম ও তৎপুত্র নারায়ণের নাম পাওয়া যায়। নলডাঙ্গার রাজা নান্দুয়ালী পরগণা দখল করিয়া লইয়া রাজবাটীর জমি রামকুমার ও ব্রজকুমার রায়কে নিষ্কর দেন। উঁহারা উভয়ে নির্ব্বংশ। তাঁহাদের অংশ জগৎমোহন ও প্যারিমোহন মজুমদার প্রাপ্ত হন। প্যারিমোহন বিখ্যাত কবিরাজ ছিলেন। তৎপুত্র তারকনাথ কলিকাতা কর্পোরেশনের উচ্চ কর্মচারী এবং তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার M. A., P. RS. S., প্রাচীন ভারতেতিহাসের প্রখ্যাত অধ্যাপক ও যশোহরের গৌরবস্থল।

২০. কালাচাঁদ, রাধামাধব, রাধিকা, লক্ষ্মী জনাৰ্দ্দন, গণেশ, দশভুজা ও সৰ্ব্বমঙ্গলা— এই কয়েকটি দেব বিগ্রহের জন্য রাজা সীতারাম পরগণে নাজিরপুরে পাসিয়া গ্রামে ১৭ বিঘা ১১ কাঠা, পালাখালী গ্রামে ৪৫ বিঘা ১ গণ্ডা এবং অন্য কয়েকটি গ্রামে ২০ বিঘা ৬ কাঠা একুনে ৮২ বিঘা ১৭ কাঠা জমি নিষ্কর দেন। ১২২৫ সালে তাঁহার দৌহিত্র ভৈরবচন্দ্র ও গৌরচন্দ্র সেন সেবার জন্য বিগ্রহগুলি এবং উক্ত দেবোত্তর সম্পত্তি সীতারামের পূর্ব্বতন গুরুবংশীয় কোড়কদি নিবাসী গৌরমোহন ভট্টাচার্য্যকে সমৰ্পণ করেন। গৌরমোহনের দুই পুত্র, ভগবান্ ও কালাচাঁদ। ভগবান নিঃসন্তান; কালাচাঁদের দৌহিত্র ফরিদপুর-রুকুনী নিবাসী কুঞ্জলাল মৈত্র মহাশয় এক্ষণে ঐ সম্পত্তির অধিকারী, তাঁহার নিকট সনন্দখানি আছে। পাবনার খ্যাতনামা উকীল রায় সাহেব তারকনাথ মৈত্রেয় মহাশয়ের চেষ্টায় আমি সেই জীর্ণ দলিলের প্রতিলিপি সংগ্রহ করিয়াছি। সীতারামের বিগ্রহগুলির মধ্যে কালাচাঁদ শিলামাত্র আছেন এবং তাহাও এক্ষণে কুঞ্জলালের পুরোহিত রুকুনী নিবাসী মধুসূদন ভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে রহিয়াছেন। নিষ্কর সম্পত্তি থাকিতেও যে বিগ্রহের সেবা হয় না, ইহাই দুঃখের বিষয়।

২১. বোয়ালমারী হইতে ৭ মাইল দূরে, সা-তৈরের কেন্দ্রস্থলে, খোপাঘাটা নামক স্থানে করিম খাঁর বাড়ী ছিল। এখনও সেই আমলের একটি সুন্দর মসজিদ এবং বাৎসরিক মেলা এ স্থানকে বিখ্যাত করিয়াছে। মজিদটি পাঠান স্থাপত্যানুসারে গঠিত, মধ্যস্থলে ৪টি পাথরের থামের উপর ৯টি গুম্বুজ, চারি কোণে চারিটি গাত্রসংলগ্ন মিনার। বাহিরে দেখিতে বাগেরহাটের ষাট গুম্বুজের মত, তবে তদপেক্ষা অনেক ছোট, মজিদকুড়ের মসজিদ অপেক্ষা অনেক বড়। ভিতরের মাপ ৪৫’x৪৫’ এবং বাহির ৫৫’-৬’’ × ৫৫’-৬’’; ভিত্তি ৫’-৩’’। এখনও ভাল অবস্থায় আছে।

২২. Hunter, Jessore, pp. 321 5. Faridpur, pp. 354-5.

২৩. ঐ গ্রামে চক্রবর্ত্তী মহাশয় দিগের বাটীতে যে বৃন্দাবনচন্দ্র বিগ্রহ আছেন, তাঁহার জন্য সীতারাম রাধামোহন চক্রবর্ত্তীর নামে মালঞ্চী গ্রামে ১৯/বিঘা নিষ্কর দেবোত্তর দিয়াছিলেন। এখনও সে সনন্দ রাধামোহনের বৃদ্ধ প্রপৌত্র রাসমোহন চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের গৃহে আছে। ৩০/৪০ বৎসর পূর্ব্বে রাসমোহন চক্রবর্ত্তী মহাশয় নিজেই সীতারামের দুর্গের ইট লইয়া নিজ বাটীতে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির ও অন্য গৃহ নির্ম্মাণ করেন। ঐ বাটী পূর্ব্বে পরিখা বেষ্টিত ছিল।

২৪. “যদুনাথ ভট্টাচার্য্য বলেন, সীতারাম যখন রামপাল জয় করিতে যান, সেই সময়ে মনোহরের আক্রমণ হয়। ইহা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। ১৭০৫ খৃষ্টাব্দে মনোহরের মৃত্যু ঘটে। উহার দুই এক বৎসর পূর্ব্বে এই ঘটনা হওয়া সম্ভব। রামপাল জয়ের সময়ে রসদ সরবরাহ করিবার জন্য ১১১৭ সালে বা ১৭১১ খৃষ্টাব্দে সীতারাম যে সনন্দ দেন, যদুনাথের পুস্তক হইতে আমরা তাহা উদ্ধৃত করিতেছি। সদাশয় নৃপতিরা গুণগ্রাহিতার পরিচয় দিতে বিলম্ব করিতেন না। রামপাল জয়ের অব্যবহিত পরেই ঐ সনন্দ প্রদত্ত হয় বলিয়া বিশ্বাস করি। তখন মনোহর জীবিত ছিলেন না।

২৫. যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ৫ম সং, ৯৯, ২৪১ পৃ।

২৬. মহম্মদপুরের উত্তরে কুমরুল গ্রাম মধুমতী হইতে বেশী দূরবর্তী নহে। তথাকার রামনারায়ণ দত্ত সীতারামের একজন প্রধান কর্মচারী ছিলেন। তিনি এই অভিযানের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রসদ সংগ্রহ করিয়া দিয়া সীতারামের তুষ্টি সাধন করেন। তাহার ফলে সীতারাম তাঁহাকে যে নিষ্কর সনন্দ দান করেন, তাহার প্রতিলিপি এই : ‘রামপাল জয় কালে তুমি খাদ্যের সরবরাহ করায় তোমার দেল পূজার জন্য তোমাকে পরগণে সা-তৈরের কুমরুল, দিঘা, বাসো, নাগরিপাড়া, হাটবাড়িয়া গ্রামহারে ৯৮ অষ্টনব্বই পাখি নিষ্কর শিবোত্তর দিলাম। তুমি পুরুষানুক্রমে সেবাইত রূপে দেল পূজার জন্য জমিতে দখিলকার থাকহ। ইতি সন ১১১৭ সাল ফাল্গুন।’—ইহাতে সীতারামের মোহর ও ‘আসল সনন্দ ভোগ দখল করহ’ এইরূপ স্বাক্ষর আছে।

২৭. জানকীবল্লভ বিষ্ণুদাশবংশীয় কুলীন বৈদ্য। প্রতাপের পতনের প্রাক্কালে জানকীবল্লভ যশোহর রাজধানী হইতে লক্ষ্মীনারায়ণ ও রাজরাজেশ্বর শিলা লইয়া মূলঘরে আসেন। তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে জমিদারী বিভক্ত হয়। জ্যেষ্ঠের সন্তানগণ ২/১ পুরুষ পরে এই পরগণার উত্তর-পূর্ব্ব সীমান্তে বর্তমান ফরিদপুরের অন্তর্গত কাজুলিয়া গ্রামে বাস করেন। তথায় রাজরাজেশ্বর শিলা এখনও পূজিত হইতেছেন এবং লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও মূলঘরে ‘বড় বাড়ী’র বৈদ্য চৌধুরীগণের কুলদেবতা হইয়া আছেন। সবিশেষ বংশ বিবরণ পরে দিব। বৈদ্যকুলে ইহা অতি প্রসিদ্ধ বংশ।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন