সতীশচন্দ্র মিত্র
একটি সমগ্র পরণার অধিকারকেই জমিদারী বলে। উহার ষোলআনার বা অংশ বিশেষের অধিকারীকে জমিদার কহে। ইংরাজ গবর্ণমেন্টের অধীন জমিদারই ভূসম্পত্তি সম্বন্ধে সর্ব্বাপেক্ষা উচ্চ এবং প্রথম শ্রেণীর স্বত্বাধিকারী। তাঁহাদিগেরই সঙ্গে সর্বপ্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয় এবং গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদিগের নিকট হইতেই প্রধানতঃ রাজস্ব গ্রহণ করেন। জমিদারের নিম্নস্থ অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর ভূম্যধিকারীদিগকে তালুকদার কহে। তালুক চারি প্রকার : খারিজা, বাজেয়াপ্তী, সামিলাৎ এবং পাট্টাই বা পত্তনী তালুক। তন্মধ্যে খারিজা ও বাজেয়াপ্তী তালুকের অধিকারিগণ গবর্ণমেণ্টের তৌজি হিসাব- ভুক্ত হইয়া নিজ নিজ নামে স্বতন্ত্রভাবে কালেক্টরীতে রাজস্ব দাখিল করেন; সামিলা এবং পাট্টাই বা পত্তনী তালুকের খাজানা জমিদরের হস্তে আদায় হয়। মুসলমান আমলের নওয়ারা এবং জায়গীর মহল বাবদ বা অন্যভাবে পরগণার অংশসমূহ রাজস্বের অনাদায়ে দায়গ্রস্ত হইলে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে গবর্ণমেণ্ট উহার রাজস্ব তত্তৎ জমিদারী হইতে খারিজ করিয়া পৃথক ভাবে লইতে স্বীকৃত হন, এজন্য উহার নাম খারিজা তালুক। ১৮১৯ অব্দের দুয়েম কানুন বা ২ আইন (Regulation II of 1819) অনুসারে যে সব নিষ্কর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ায় নূতন মালিকের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা হয়, তাহাই বাজেয়াপ্তী তালুক। দৈব কারণে বা মালেকের ইচ্ছানুসারে গবর্ণমেণ্টের সেরেস্তাভুক্ত যে সব চিহ্নিত তালুক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে কোন জমিদারীর সামিল করিয়া দেওয়া হয়, তাহাকে বলে সামিলাৎ তালুক। ইহা ভিন্ন জমিদারেরা নিজ নিজ জমিদারীর যে সকল ক্ষুদ্রাংশ পাট্টা সাহায্যে বিলি করেন বা পত্তনী দেন, তাহাই পাট্টাই বা পত্তনী তালুক। সামিলাতে সঙ্গে এই জাতীয় তালুকের প্রভেদ এই যে জমিদারের স্বত্ব নষ্ট হইলে পাট্টাই বা পত্তনী তালুকের স্বত্ব যায়, কিন্তু সামিলাতের স্বত্ব নষ্ট হয় না। পত্তনীদারেরা মৌরসী স্বত্বে যে সব বিলি ব্যবস্থা করেন, তাহার নাম দর-পত্তনী; পত্তনী তালুকের নিলামে উহার উচ্ছেদ হইতে পারে এবং উহার করও সব সময়ে নির্দ্দিষ্ট থাকে না। দর-পত্তনীর নিম্নস্থ স্বত্বের নাম সে-পত্তনী বা তৃতীয় পত্তনী।
যশোহর-খুলনার বিভিন্ন স্থানে তৃতীয় শ্রেণীর স্বত্বাধিকারীদিগের বিভিন্ন নাম আছে, যেমন মামুদশাহী পরগণায় বা যশোহরের উত্তরাংশে উহাদের নাম জোতদার, যশোহরের দক্ষিণভাগে ও খুলনার পশ্চিমাংশে উহাদের নাম গাঁতিদার এবং খুলনার পূর্ব্বাংশ বা বাগেরহাট অঞ্চলে উহাদের নাম হাওয়ালাদার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহুপূর্ব্ব হইতে এই স্বত্বের সৃষ্টি হইয়াছিল এবং প্রারম্ভে এই স্বত্বাধিকারিগণ আবাদকারী প্রজাই ছিলেন। দীর্ঘকালের অধিকারের ফলে ও দেশীয় প্রথানুসারে ইঁহাদের অধিকার কায়েমী এবং হস্তান্তরযোগ্য বা গর-গায়েমী হইয়াছে। হাওয়ালার প্রথা বাখরগঞ্জ হইতেই খুলনায় আসিয়াছে; প্রকৃত অর্থ ধরিতে গেলে, বিশ্বস্তসূত্রে যে জমি বিলি করা হয় তাহার নামই হাওয়ালা। জমির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে গাঁতিদার, জোতদার বা হাওয়ালাদারগণ অবস্থাপন্ন হইয়া তালুকদার প্রভৃতির ন্যায় সম্মানিত হইয়া বসেন। হাওয়ালার নিম্নে নিম-হাওয়ালা এবং ওসত-হাওয়ালা প্রভৃতি নিম্নস্বত্বের আবির্ভাব হইয়াছে। জোতদারের অধীন যাহারা জমা রাখে, তাহাদিগকে কফা বা কোলজানা প্রজা বলে। যাহারা কোন জোতদার বা গাতিদারের খামার জমি চাষ-আবাদ করিয়া মজুরীর জন্য সাধারণতঃ ধান্যের অর্দ্ধেক ভাগ পায়, তাহারা বর্গাজোতদার বা বর্গাইত।
সুন্দরবনের মধ্যে একটু নিয়মের ব্যতিক্রম আছে। সেখানে আবাদ করিবার জন্য যিনিই গবর্ণমেন্টের নিকট হইতে জমি বন্দোবস্ত করিয়া লন, তিনিই তালুকদার এবং প্রয়োজনানুসারে তিনি নিজের রাইয়ত বা প্রজাবিলি করিতে পারেন। মোরেলগঞ্জের মোরেল সাহেব এই সকল ‘সুন্দরবন তালুকদারগণের’ মধ্যে সর্বাগ্রণী। উঁহাদের বিবরণ পরে দিব।
চতুর্থ শ্রেণীর জমিস্বত্বের নাম মৌরসী মোকররী। মৌরসী শব্দে পুরুষানুক্রমিক এবং মোকররী শব্দে খাজানার হার নির্দ্দিষ্ট বুঝায়। সুতরাং তালুকাদির ন্যায় এই স্বত্ব পুরুষানুক্রমে ভোগদখলযোগ্য অর্থাৎ কায়েমী এবং দান বিক্রয় হস্তান্তরের উপযুক্ত। ইহার আরও প্রকারভেদ আছে, সে সব স্থলে জমা কায়েমী হইলেও তাহার খাজানা হ্রাসবৃদ্ধিসাপেক্ষ হইতে পারে। পত্তনীদারের মত মোকররীদারগণও দর-মৌরসী বা সে-মৌরসী দিতে পারেন এবং মেয়াদী বা হস্তান্তরের অযোগ্য স্বত্বে জমিবিলি করিতে পারেন।
এই সকল ভিন্ন আর এক প্রকার স্বত্বাধিকারী আছেন, তাঁহারা ইজারাদার। উঁহারা জমিদার বা তালুকদারের নিকট হইতে বিস্তৃত সম্পত্তি নির্দ্দিষ্ট কালের জন্য বন্দোবস্ত করিয়া লইয়া চুক্তি অনুসারে পূর্ব্ববর্ত্তী মালেকের স্বত্বস্বামিত্ব ভোগদখল বা হস্তান্তর করিতে পারেন। ‘দায়সুদী’ বা ‘পচানী’ ইজারাদারেরা মালেককে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়া যে পৰ্য্যন্ত ঐ টাকা সুদে আসলে শোধ না হয়, সে পর্য্যন্ত ইজারার উপস্বত্ব ভোগ করেন।
অবশিষ্ট যে সকল সম্পত্তি রহিল, তাহা লা-খেরাজ বা নিষ্কর সম্পত্তি। ১৭৬৫ অব্দে ইংরাজ- কোম্পানি বাদশাহের নিকট হইতে দেওয়ানী গ্রহণ করেন। উহার পূর্ব্বে হিন্দু মুসলমান প্রধান ব্যক্তিদিগের দ্বারা সনন্দ বা তাম্রশাসনাদি সূত্রে যে সকল নিষ্কর প্রদত্ত হইয়াছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় গবর্ণমেণ্ট তাহা স্বীকার করিয়া লন। কিন্তু সনন্দাদি নষ্ট হওয়ায় বা অন্য কারণে যাহারা অধিকার প্রতিপন্ন করিতে না পারিয়া নিষ্কর হইতে বঞ্চিত হয়, তাহারা নানা প্রকারে গোলযোগ উপস্থিত করে। তজ্জন্য গবর্ণমেণ্টকে ১৮১৯ অব্দের ২ আইন করিয়া সকল লা-খেরাজের স্বত্ব পরীক্ষা করিতে হয়। ইহাকে সাধারণ লোকে দুয়েম কানুন বলে। ১৮৩০ অব্দের পূর্ব্বে তদনুসারে কার্য্যারম্ভ হয় নাই। যে সব পুরাতন নিষ্করের স্বত্ব সপ্রমাণ হয় নাই, তাহাই নির্দ্দিষ্ট রাজস্বে বাজেয়াপ্তী তালুকে পরিণত হয়, সে কথা বলিয়াছি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় (১৭৯৩) হইতে ১৮০০ পৰ্য্যন্ত লা-খেরাজের দলিলাদির প্রথম পরীক্ষা হয়; ঐ পরীক্ষার পর যাহারা উদ্ধার পায়, গবর্ণমেণ্ট ১৮০২ অব্দে তাহাদিগকে নিঙ্করের বহালী তায়দাদ দিয়াছিলেন। ইহাকেই সাধারণতঃ ১২০৯ সালের তায়দাদ বলে। উহাতেই পূৰ্ব্ববর্ত্তী সনন্দাদি যাহা কিছু প্রমাণ গবর্ণমেন্ট কর্তৃক স্বীকৃত হয়, তাহার উল্লেখ ছিল। এই ১২০৯ সালের তায়দাদ নিষ্কর সম্পত্তির প্রধান দলিল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ১৮৩০ অব্দের পর দুয়েম কানুনানুসারে পরীক্ষা করিয়া পুনরায় তায়দাদ দেওয়া হইয়াছিল। এখন যে সব নিষ্কর বহাল আছে, তাহাকে আমরা সাধারণতঃ নিম্নলিখিত কয়েক শ্রেণীতে বিভাগ করিতে পারি : (১) দেবোত্তর—দেবতার উদ্দেশ্যে হিন্দুদিগের দ্বারা যে সম্পত্তি উৎসৃষ্ট হয়। (২) ব্রহ্মোত্তর—ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা ব্রাহ্মণদিগকে যে সব ভূমিদান করেন। (৩) ভোগোত্তর – গুরু পুরোহিতের ভোগের জন্য যে সব জমি নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয়। (৪) মহাত্রাণ—কোন ব্রাহ্মণেতর জাতীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে তাহার কার্য্যদক্ষতা বা সৎকার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ যে ভূমি প্রদত্ত হয়। (৫) চেরাগী—কোন মুসলমানের কবরের উপর বাতি দিবার ব্যয়নিৰ্ব্বাহ জন্য যে জমি দেওয়া হয়। (৬) পীরোত্তর—মুসলমান সাধু বা পীরের স্মৃতিরক্ষাকল্পে যে সম্পত্তি উৎসর্গ করা হয়।
এতদ্ব্যতীত কোন সম্পত্তির উপস্বত্ব ধর্ম্ম বা জনহিতকর কার্য্যে উৎসর্গ করিয়া ওয়াক্ফ বা ট্রাষ্ট সম্পত্তির সৃষ্ট হইয়াছে। সৈদপুর ট্রাষ্ট ষ্টেটের কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। আর এক প্রকার উৎসৃষ্ট সম্পত্তিকে ‘চাকরাণ’ বলে। কোন ব্যক্তিবিশেষে গৃহকর্ম্ম সুনিয়মে সম্পাদনের জন্য বা পূৰ্ব্বকালে শান্তি রক্ষার জন্য যে জমি ব্যক্তিবিশেষের জীবনকালের জন্য বা পুরুষানুক্রমে নির্দিষ্ট ছিল, তাহাকেই চাকরাণ বলে। কিন্তু ইহা চুক্তিমূলক, নিৰ্দ্দিষ্ট কাৰ্য্য সম্পন্ন না করিলে, ইহা বাজেয়াপ্ত করিয়া লওয়া যায়।
.
পাদটীকা :
1. Hunter, Statistical Account of Jessore. p. 264.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন