২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম

সতীশচন্দ্র মিত্র

অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম

চট্টগ্রাম ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যস্থানে সন্দ্বীপ একটি প্রধান স্থান। উহার অবস্থান, সমৃদ্ধি ও ব্যবসায়ের কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (১৮শ পরিচ্ছেদ) ডু-জারিকের বিবরণী হইতে আমরা জানিতে পারি, ‘এই দ্বীপ কেদার রায় নামক একজন বঙ্গাধিপের অধিকারভুক্ত ছিল। কিন্তু কয়েক বৎসর পূর্ব্ব হইতে তাঁহার সে অধিকার ছিল না, কারণ মোগলেরা বলপূর্ব্বক উহা দখল করিয়া লইয়াছিল। কিন্তু যখন তিনি জানিলেন যে, পর্তুগীজেরা উহা দখল করিল, (সে কথা পরে বলিতেছি), তিনি উহা একান্ত ইচ্ছাপূর্ব্বকই তাহাদিগকে দিলেন এবং ঐ দ্বীপে তাঁহার যে কোন স্বত্ব থাকিতে পারিত, তাহা সমস্তই পর্তুগীজদিগকে ছাড়িয়া দিলেন।’[১] মোগলেরা সন্দ্বীপ হস্তগত করিবার পরও কেদার রায় দাবি ছাড়েন নাই। কার্ভালো তখন তাঁহার অধীন সেনাপতি, প্রধানতঃ নাববিভাগের জনৈক অধ্যক্ষ। সন্দ্বীপ দখল করিয়া তথায় পর্তুগীজদিগের বাসভূমি নির্দ্দেশ করিতে পারিলে, ভবিষ্যতে এই জাতির প্রতিপত্তিবৃদ্ধির অনেক পথ খুলিবে, কার্ভালো তাহা বুঝিতেন। এইজন্য তিনি ১৬০২ খৃষ্টাব্দে সুযোগ মত কেদার রায়ের অসংখ্য রণতরীর সাহায্যে ঐ দ্বীপ আক্রমণ করিয়া দখল করিলেন। যখন কেদার রায় উহা জানিতে পারিলেন,[২] তখন কার্ভালোর প্রার্থনামত স্বচ্ছন্দচিত্তে ঐ দ্বীপের শাসনভার তাঁহাকে প্রদান করিলেন। কার্ভালো দ্বীপটি দখল করিয়া বসিবামাত্র কেদার রায়ের সহিত একপ্রকার সম্বন্ধ রহিত করিলেনই; পরন্তু স্থানীয় প্রজার উপর অত্যাচার আরম্ভ করিলেন। দ্বীপবাসী মুসলমানেরা বিদ্রোহী হইয়া উঠিলেন। তখন কার্ভালো কেদার রায়ের নিকট সাহায্য চাহিতে না গিয়া, চট্টগ্রামের পর্তুগীজদিগের নিকট হইতে সাহায্য চাহিলেন। তত্রত্য পর্তুগীজ সেনাপতি ম্যানোয়েল ডি মাটোস্ (Manoel de Mattos) 800 সৈন্য লইয়া কার্ভালোর সাহায্যার্থ উপস্থিত হইলেন এবং শত্রুদিগকে পরাজিত করিয়া উভয়ে একযোগে সন্দ্বীপের মালিক হইয়া বসিলেন। এই কথা শুনিয়া মোগলেরা কেদার রায়ের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন, কারণ তাঁহারা ভাবিলেন কেদার রায় ভিন্ন এমন দুঃসাহসিক কাৰ্য্য কেহ করিতে পারে না। কার্ভালোর বীরত্ব-খ্যাতি তখনও চতুর্দ্দিকে পরিব্যাপ্ত হয় নাই। সুতরাং মোগল পক্ষ হইতে কেদার রায়ের বিপক্ষে সৈন্য প্রেরণ করিবার উদ্যোগ চলিতে লাগিল

এদিকে পর্টুগীজেরা অনেকদিন হইতেই আরাকাণী মগ ও বাঙ্গলার ভুঞাদিগের অধীন হইয়া বাস করিবার কালে, স্বাধীনভাবে দস্যুবৃত্তির পথ পাইতেছিল না। তাহারা সন্দ্বীপ অধিকার করিবার পর হইতে চারিদিকে অত্যাচার আরম্ভ করিল। এই সময়ে তাহারা নানা নদীপথে প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের দক্ষিণ ভাগে আসিতে লাগিল এবং সুন্দরবনের মধ্যে যেখানে লোকের বসতি পাইত, সেখানেই লুটপাট করিয়া ঘোর উৎপাত করিত। তাহাদের অত্যাচারের প্রণালী আমরা পূৰ্ব্বে বর্ণনা করিয়াছি। সন্দ্বীপ অঞ্চল হইতে প্রতাপের রাজ্যমধ্যে প্রবেশ করিতে হইলে সর্ব্বাগ্রে হরিণঘাটার মোহানা পথে বলেশ্বর নদে এবং পরবর্ত্তী মর্জ্জালের মোহানা দিয়া শিবসা নদীতে আসিতে হইত। ডু-জারিক প্রভৃতি ঐতিহাসিক পর্তুগীজদিগের সহিত রাজাদের যে সকল বড় যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহারই কতক আভাস দিয়াছেন, কিন্তু নদীপথে দস্যুদিগের সহিত প্রতাপের রণতরীসমূহের যে অবিরত কত যুদ্ধ হইত, তাহার কোন বিবরণী নাই। শুনা যায় মর্জ্জালের মধ্যে তিনি পর্তুগীজদিগকে এক প্রকার সমুচিত শিক্ষা দিয়াছিলেন। ঐ সময়ে শিবসার মোহানায় কালীর খালের কূলে প্রকাণ্ড শিবসা দুর্গ নির্মিত হয়; আমরা উহার বিশেষ বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি (১৯শ পরিচ্ছেদ)। পর্তুগীজদিগের অত্যাচারের সংবাদে শুধু প্রতাপ নহেন, শ্রীপুরের অধীশ্বর কেদার রায় এবং আরাকানরাজ মানরাজগিরি[৩] (পর্তুগীজদের ভাষায় Xilimxa বা সেলিম শা) একান্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। আরাকানরাজই সৰ্ব্বপ্রথমে পর্তুগীজদিগকে আশ্রয় দেন, উহারা তাঁহার আশ্রিত বা বাধ্য ইহাই তাঁহার ধারণা ছিল; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উহারা তাঁহার রাজ্যের উপরই অধিক অত্যাচার আরম্ভ করিল। শুধু তাহাই নহে, উত্তরে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণে পেণ্ড অঞ্চলে দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়া ফিরিঙ্গিরা বড়ই দুৰ্দ্দান্ত হইয়া উঠিয়াছিল এবং তাঁহার রাজ্য গ্রাস করিবার চেষ্টা করাও তাহাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। এইজন্য সর্ব্বাগ্রে বীরবর মানরাজই যুদ্ধক্ষেত্রে নামিলেন। তিনি এই জন্য জালিয়া, কার্ত্তুস[৪] প্রভৃতি নানা জাতীয় ১৫০ খানি যুদ্ধজাহাজ কামানাদি দ্বারা সজ্জিত করিয়া অগ্রসর হইলেন।

পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মগরাজের সহিত কেদার রায় ও প্রতাপাদিত্যের সন্ধি স্থাপিত হইয়াছিল। সন্দ্বীপ মোগলদিগের অধীন ফতেহাবাদ সরকার ভুক্ত ছিল বলিয়া, কেদারের সাহায্যে কার্ভালো কর্তৃক সে স্থান অধিকার করিবার কালে সে সন্ধি ভঙ্গ হয় নাই। দ্বীপ অধিকার করিয়া যখন কার্ভালো স্বতন্ত্রভাবে চারিধারে উৎপাত করিতে লাগিয়া একটি তৃতীয় পক্ষ হইয়া দাঁড়াইলেন, তখন দেশের শান্তিরক্ষার জন্য ভুঞাদিগের সহিত মগরাজার পূৰ্ব্বসন্ধি অক্ষুণ্ণ থাকিল। আরাকাণের অধিপতি সাহায্য চাহিবামাত্র কেদার রায় তাঁহার জন্য একশত খানি কোশা নৌকা সজ্জিত করিয়া শ্রীপুর হইতে প্রেরণ করিলেন।[৫] এ সময়ে প্রতাপাদিত্য কোন সাহায্য পাঠাইয়াছিলেন কিনা তাহার উল্লেখ নাই; তবে তাঁহার রাজ্য একটু দূরবর্ত্তী বলিয়া তিনি কোন সাহায্য পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেও তাহা আসিবার পূর্ব্বে কয়েকটি যুদ্ধ হইয়া গেল। আরাকাণী বহর অগ্রসর হইলে, ১৬০২ খৃষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর তারিখে ডিয়াঙ্গার সন্নিকটে এক জল-যুদ্ধ হইল। তাহাতে মাটোস্ আহত হইলেন এবং আরাকাণীরা জয় লাভ করিয়া কয়েকখানি শত্রুর জাহাজ ধরিয়া লইয়া গিয়া আনন্দে উন্মত্ত হইল। ইহাই প্রথম যুদ্ধ।

দুইদিন পরে কার্ভালো কতকগুলি জালিয়া, পশ্তা, কার্টুস প্রভৃতি যুদ্ধজাহাজ সহ মাটোসের সহিত মিলিত হইয়া, অকস্মাৎ প্রবল বেগে আরাকাণীদিগকে আক্রমণ করিলেন। সন্দ্বীপের নিকট সমুদ্রের জল রক্তাক্ত করিয়া যে ভীষণ যুদ্ধ হইল, তাহাতে অবশেষে পর্তুগীজেরা জয় লাভ করিল বহু মগ বীর নিহত হইল, তন্মধ্যে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা সিনাবাদী অন্যতম। তিনি মানরাজের পিতৃব্য। ফিরিঙ্গিদিগের ভয়ে মগেরা চারিদিকে পলায়ন করিতে লাগিল। তখন আরাকাণরাজ ক্রোধান্ধ হইয়া নিজরাজ্যবাসী পর্তুগীজ স্ত্রীপুরুষের উপর নির্মম শাস্তি বিধান করিলেন। তাঁহার প্রতিহিংসায় চট্টগ্রাম পর্য্যন্ত বিকম্পিত হইল। মগ-ফিরিঙ্গির এই দ্বিতীয় যুদ্ধ ১৬০২ খৃষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর তারিখে হইয়াছিল।

এতদিন জেসুইট পাদরীগণের প্রচার কার্য্য সুন্দরভাবে চলিতেছিল। এই গণ্ডগোলে তাঁহারা এবার বিপন্ন হইয়া পড়িলেন। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, ফাদার ফার্ণাণ্ডেজ যশোহর হইতে ফিরিয়া আসিয়া ডিয়াঙ্গাতে ছিলেন এবং তথায় জেসুইটদিগের একটি গীর্জ্জা নির্ম্মিত হইয়াছিল। উক্ত দ্বিতীয় যুদ্ধের পর আরাকাণীদিগের অত্যাচারকালে, তিনি কয়েকটি বিপন্ন বালক বালিকার জীবন রক্ষা করিতে গিয়া নিজে বিষমভাবে প্রহৃত হন এবং একটি চক্ষু হারাইলেন। উহারই ৩/৪ দিন পরে, ১৪ই নভেম্বর তারিখে কারাগারে তাঁহার মৃত্যু হইল। লোকসেবা-রত পুণ্যাত্মা ধর্ম্মযাজক অকালে দস্যু হস্তে প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার সহচর ফাদার বাউয়েসও কণ্ঠপদে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন। পাদরীগণের সাঙ্গপাঙ্গ কতক সন্দ্বীপে ও কতক শ্রীপুর, বালা ও যশোহরে পলাইয়া গেল।

আরাকাণ-রাজ পুনরায় প্রায় সহস্রখানি রণতরী সংগ্রহ করিয়া ভীমবেগে সন্দ্বীপ আক্রমণ করিলেন। কিন্তু এবারও তাঁহাকে পরাজিত হইতে হইল। মহাবীর কার্ভালো ১৬ খানি মাত্র জাহাজ কার্ভালো ও পাদরীগণের পরিণাম লইয়া সমগ্র আরাকাণী বহর ধ্বংস করিয়া দিলেন। রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া নিজের সেনাপতিদিগকে স্ত্রীলোকের বেশ পরাইয়া অপমানিত করিলেন।[৬] কিন্তু পর্টুগীজেরা যুদ্ধে জয়লাভ করিলে কি হয়, তাহাদের জাহাজগুলি ক্ষতবিক্ষত ও বিনষ্টপ্রায় হইয়াছিল। কার্ভালো দেখিলেন, সে জাহাজ লইয়া মগদিগের পুনরাক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হইবে না, কিন্তু তিনি যাইবেন কোথায়, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। তাঁহার পূর্বতন প্রভু কেদার রায় তাঁহার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন, গত যুদ্ধে তিনি আরাকাণের পক্ষেই সাহায্য করিয়াছেন, তিনি তাঁহাকে আশ্রয় দিবেন কিনা সন্দেহ। তবুও শ্রীপুর অতি নিকটে, এবং সেখানে জাহাজগুলি মেরামত করিবার সুযোগ হইতে পারে, এই আশায় তিনি শ্রীপুরেই আসিলেন। ইহা আশ্চর্য্যের বিষয়, সন্দেহ নাই। কার্ভালো দ্বীপ পরিত্যাগ করা মাত্র দলে দলে ফিরিঙ্গি ও অন্যান্য খৃষ্টান অধিবাসীরা সন্দ্বীপ পরিত্যাগ করিয়া বালা, শ্রীপুর ও যশোহর প্রভৃতি নানা স্থানে আশ্রয় লইতে চলিল এবং আরাকাণীরা আসিয়া দ্বীপ অধিকার করিয়া লইল। এই সময়ে ফাদার নূনেস্ (Father Blasio Nunes) ও আরও তিনজন পাদরী সন্দ্বীপে একটি গীর্জ্জা নির্ম্মাণ করিতেছিলেন, তাহা পরিত্যাগ করিয়া তাঁহারাও যশোহরে আসিলেন; কারণ ঐ স্থানে ভিন্ন অন্য সকল স্থানে তাঁহাদের আবাস বিনষ্ট হইয়াছিল।[৭] প্রতাপাদিত্য এখন পর্যন্তও ফিরিঙ্গি পাদরীদিগের প্রতি কোন অত্যাচার করেন নাই।

পূর্ব্বেই বলিয়াছি, কেদার রায়ের সেনানী কার্ভালো কর্তৃক সন্দ্বীপ অধিকারের সংবাদ বঙ্গের রাজধানী রাজমহলে পৌঁছিলে, কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের আয়োজন হইতেছিল। মানসিংহ তখন শুধু কেদার রায় নহেন প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধেও সৈন্য চালনার ব্যবস্থা করিতেছিলেন। কিন্তু আপাততঃ সন্দ্বীপ উপলক্ষ্য করিয়া অনতিবিলম্বে শ্রীপুর আক্রমণ না করিলে, ভুঞাগণ সম্মিলিত হইতে পারেন, এই আশঙ্কায় শীঘ্র মন্দা রায়কে একশত কোশা নৌকা বা রণতরী লইয়া অগ্রসর হইবার জন্য আদেশ দিলেন। সন্দ্বীপ ছাড়িয়া আসিয়া কার্ভালো যখন ত্রিশখানি জীর্ণ তরী সংস্কারের জন্য শ্রীপুরে অবস্থান করিতেছিলেন, তখনই মন্দা রায় আক্রমণ করিলেন। কেদার রায় উপস্থিত স্বকার্য্য উদ্ধারের জন্য কার্ভালোর অযাচিত সহায়তা পরিত্যাগ করা সমীচীন বোধ করিলেন না। তাঁহার যুদ্ধ-তরণী সমূহ কার্ভালোর সহিত যোগ দিল। শ্রীপুরের পথে কালীগঙ্গার মধ্যে মন্দা রায়ের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ হইল। মন্দা রায়ও বীরপুরুষ বলিয়া খ্যাত ছিলেন। ‘কার্ভালো প্রচণ্ড বেগে বিপক্ষগণকে আক্রমণ করিয়া তাহাদের জাহাজশ্রেণী ছিন্নভিন্ন করিয়া দেন এবং বহুসংখ্যক সৈন্য শমন-সদনে প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধে মন্দা রায়ও নিহত হন, তিনি গোলাদ্বারা আহত হইয়া জাহাজ হইতে নিপতিত হইয়াছিলেন। কার্ভালোও একটি তীর বিদ্ধ হইয়া আহত হন। কয়েক দিবস পরে আরোগ্য লাভ করিয়া কার্ভালো শ্রীপুর হইতে গোলি বা গুলু [হুগলী] নামক পৰ্টুগীজ দিগের উপনিবেশে গমন করেন।[৮]

এক্ষণে প্রশ্ন এই, কেদার রায় যে কার্ভালো দ্বারা এত উপকৃত হইলেন, তাঁহাকে তিনি সাহায্য দিলেন না কেন? সাহায্য পাইলে বা পাইবার আশা থাকিলে কি কার্ভালো অনিশ্চিত সাহায্যের প্রত্যাশায় হুগলীর মত দূরবর্ত্তী স্থানে যাইতেন? তখনও তাঁহার জীর্ণ তরণীগুলির সংস্কার কার্য্য সম্পূর্ণ হয় নাই। ইহার উত্তরে এই বলা যাইতে পারে যে, কেদার রায় প্রকাশ্যভাবে কার্ভালোকে আশ্রয় দিতে পারেন না, কারণ তাহা হইলে আরাকাণরাজের সহিত তাঁহার মিত্রতা অক্ষুণ্ণ থাকে না। তখনও উভয় পক্ষের সন্ধি অব্যাহত ছিল। তবে মোগলেরা উভয়েরই সাধারণ শত্রু, এজন্য মোগলের আক্রমণকালে কেদার, তাঁহার পূর্ব্বতন ভৃত্য কার্ভালো স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহাকে যে সাহায্য করিতেছিলেন, তাহা গ্রহণ না করিয়া পারেন না। বিশেষতঃ সন্দ্বীপের স্বত্ব লইয়া যখন মোগলের সহিত বিবাদ, সে সন্দ্বীপের সমস্ত স্বত্ব যখন কার্ভালোকে সমর্পিত হইয়াছিল, তখন মোগলশত্রুর বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া যুদ্ধ করিতে কার্ভালো ন্যায়তঃ ধর্ম্মতঃ বাধ্য। তিনি তাহাই করিয়াছিলেন। যুদ্ধ জয়ের পর আবার কেদার রায় তাঁহার সম্বন্ধে নিরপেক্ষ রহিলেন। কারণ মোগলেরা এবার পরাজিত হইয়া ছাড়িবে না, অচিরে পুনরাক্রমণ করিবে; সে অবস্থায় কার্ভালোকে আরও অধিক দিন আশ্রয় দিয়া, বাড়ীর নিকটবর্ত্তী সন্দ্বীপাধিপতি মগ-রাজের সহিত শত্রুতা করা কোন ক্রমে বুদ্ধিসঙ্গত নহে। তাই কার্ভালো হুগলী গেলেন, সেখানেও সাহায্য মিলিবে কি না স্থিরতা ছিল না।

হুগলীতে ব্যাণ্ডেল নামক স্থানেই পর্তুগীজদিগের উপনিবেশ। ব্যাণ্ডেল এখনও একটি প্রধান স্থান। সেখানে যাইতে হইলে হুগলীর নিকট দিয়া যাইতে হয়। তথায় মোগলের একটি নবগঠিত ক্ষুদ্র দুর্গ ও ৪০০ সৈন্য ছিল। ফিরিঙ্গি বা দেশীয় খৃষ্টানগণ নদীপথে যাইবারকালে এই মোগল সৈন্যেরা তাহাদের উপর অগণিত অত্যাচার করিত, তাহাদিগের নিকট হইতে নূতন এক প্রকার শুল্ক আদায় করিয়া লইত। কার্ভালো ৩০ খানি জালিয়া জাহাজ লইয়া গঙ্গাপথে যাইবার সময় মোগলেরা দুর্গস্থিত কামান হইতে তাহাদের উপর অনল বর্ষণ করিতে লাগিল। অবশেষে কার্ভালো অতিমাত্র ক্রুদ্ধ হইয়া ৮০ জন সৈন্যসহ জলে ঝাঁপাইয়া তীরে উঠিলেন এবং দুর্গ আক্রমণ করিয়া সমস্ত মোগলসৈন্য শমন ভবনে প্রেরণ করিলেন, কেবল একজন মাত্র লোক কোন প্রকারে পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইয়াছিল। এ সময়ে কার্ভালোর বীরত্ব-খ্যাতি সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাঁহার নাম শুনিলে লোক ভয়ে আতঙ্কিত হইত।

এই ঘটনার পর, কার্ভালো হুগলীতে বা ব্যাণ্ডেলে গিয়া কি করিলেন, কিছুই জানা যায় না। এমন সময়ে তিনি সংবাদ পাইলেন যে, প্রতাপাদিত্য তাঁহাকে যশোহরে যাইবার জন্য আহবান করিয়াছেন। ব্যাণ্ডেলে তখন পর্তুগীজ ও দেশীয় খৃষ্টানে পাঁচ হাজার লোক ছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধ করিতে পারে এমন যথেষ্ট সৈন্য বা জাহাজাদি বা প্রচুর যুদ্ধোপকরণ ছিল না। সুতরাং সেখানকার সাহায্যবলে সন্দ্বীপ পুনরুদ্ধার করিতে পারিবেন, এমন কল্পনা কার্ভালোর হইল না। এমন সময়ে যশোহরের নিমন্ত্রণ আসিল, নিরাশ্রয় উপায়ান্তর-বিহীন কার্ভালো তাহা পরিত্যাগ করিতে পারেন না, তাহাতে ভাগ্যে যাহাই থাকুক। আশানুরূপ কোন সুযোগ জুটিয়া যাওয়া বিচিত্র নহে। তাই তিনি যশোহরে আসিলেন Į

ইহারই কিছুদিন পূর্ব্বে চন্দ্রদ্বীপের রাজপুত্র রামচন্দ্রের সহিত প্রতাপাদিত্যের কন্যার প্রস্তাবিত বিবাহ সুসম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। তাহার বিশেষ বিবরণ আমরা পরবর্ত্তী পরিচ্ছেদে দিতেছি। সেখানে আমরা দেখাইব, কি ভাবে রামচন্দ্র শ্বশুরের প্রতি জাত-ক্রোধ হইয়া স্বদেশে প্রত্যাবৰ্ত্তন করেন এবং কি ভাবে তাঁহার উপর শত্রুতা সাধন করিবেন তাহারই উপায় চিন্তা করিতেছিলেন। আরাকাণের সহিত বালারই প্রথম সন্ধি হয়, সে কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। পরে প্রতাপাদিত্য ও কেদার রায় সেই সন্ধিতে যোগ দেন। ডু-জারিক হইতে জানিতে পারি যে, ‘মগরাজা সোন্দ্বীপ অধিকার করিবার পর বালা রাজ্যের কিছু দখল করিয়া চাঁদেকান রাজ্য [যশোহর] জয় কবিরার জন্য আয়োজন করিতে লাগিলেন।’[৯] সম্ভবতঃ আরাকাণরাজ কর্তৃক বাক্লার সমুদ্রকূলবর্তী কোন স্থান অধিকৃত হইবার পর, রামচন্দ্র পুনরায় তাঁহার সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন এবং তাহাকে যশোহররাজ্য আক্রমণ করিবার জন্য উদ্রিক্ত করেন। নতুবা নিকটবর্ত্তী শ্রীপুরের উপর কোন আক্রমণের কথা উঠিল না, বাক্লারও বেশী কিছু দখল করা হইল না, শুধু চাঁদেকানের উপর আক্রোশ পড়িল কেন? সন্দ্বীপের যুদ্ধে কেদার রায়ের মত প্রতাপাদিত্য কোন সাহায্য পাঠান নাই বলিয়াই কি এই আক্রোশ?

প্রতাপাদিত্যের এই সময়কার রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করা আবশ্যক। তিনি মোগলের বিপক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছেন; মানসিংহ সমর-বাহিনী লইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে আসিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। কেদার রায় আত্মরক্ষায় মহাব্যস্ত; তাঁহার নিকট হইতে কোন সাহায্যের প্রত্যাশা নাই। জামাতা রামচন্দ্র, তিনিও শত্রুরূপে পরিণত। এমন সময়ে বালার সাহায্যবলে বলী হইয়া, যদি সন্দ্বীপ-বিজয়ী মগরাজ দক্ষিণ দিক হইতে প্রতাপের রাজ্য আক্রমণ করেন, তবে রাজ্যরক্ষার উপায় কি? একদিকে মানরাজ ও অন্যদিকে মানসিংহ, উভয়ই দিগ্বিজয়ী মহাশত্রু, প্রতাপের মানরক্ষার উপায় কি? মোগলের সহিত সন্ধি হইতে পারে না; কারণ তাহা হইলে স্বাধীনতার ঘোষণা ও আত্মমর্য্যাদা-সকল গৌরব, সকল আশা—একেবারে মুছিয়া ফেলিতে হয়। তাহা কিছুতেই হইবে না। আবার আরাকাণরাজের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য অধিকাংশ নৌবহর দক্ষিণ দিকে প্রেরণ করিলে, উত্তর দিকের আক্রমণ নিবারণ করা যায় না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে পূৰ্ব্বতন মিত্র আরাকাণরাজের সহিত সন্ধি করাই একমাত্র কর্ত্তব্য। সন্দ্বীপ রক্ষা করাই মগরাজের প্রধান উদ্দেশ্য এবং তাহার প্রধান ভয় কার্ভালো হইতে। সে কার্ভালোকে কোন প্রকারে হস্তগত এবং অন্ততঃ কারারুদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিলে, আরাকাণের সহিত সন্ধি হইতে পারে। নতুবা সন্ধির প্রস্তাবও উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর নিতান্তই যদি আরাকাণরাজ আক্রমণ করিয়া বসেন, তাহা হইলেও কার্ভালো হাতে থাকিলে একটা গত্যন্তর হইতে পারে। আমাদের মনে হয়, এই বিপদসঙ্কুল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়িয়া, প্রতাপাদিত্য ন্যায়ান্যায় বিচারের অবসরমাত্র না পাইয়া কার্ভালোকে সংবাদ দিয়াছিলেন। তৎপরে যাহা ঘটিয়াছিল, ডু-জারিকের বিবরণীর অনুবাদ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি :

‘চাঁদেকানের রাজা (অর্থাৎ প্রতাপাদিত্য) দেখিলেন যে এত প্রবল শত্রুকে তিনি একলা বাধা দিতে পারিবেন না, এবং তজ্জন্য কুটিল নীতিদ্বারা নিজ বন্ধুদিগকে (অর্থাৎ পোর্তুগীজ) ধ্বংস করিয়া এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার পথ বাহির করিলেন। তিনি জানিতেন যে, আরাকাণের রাজা কার্ভালোর প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তিনি (অর্থাৎ প্রতাপ) নিজেও তাহাকে ভয় করিতেন, সুতরাং কার্ভালোকে বন্দী করিয়া তাহার মস্তক পাঠাইয়া মগ রাজাকে তুষ্ট করা এবং এই উপায়ে নিজ রাজ্য রক্ষা করিবার ফন্দি করিতে লাগিলেন। তিনি কার্ভালোর নিকট দূত পাঠাইয়া জানাইলেন যে, তাঁহার নিকট আসিয়া মগরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করিলে, তিনি তাহার অনেক সুবিধা করিয়া দিবেন।

‘কার্ভালো চাঁদেকানের রাজার কথায় বিশ্বাস করিয়া ভাবিল যে, এইরূপে তাঁহাকে সাহায্য করিলে, কৃতজ্ঞ রাজা তাহাকে সৈন্যবল দিয়া সোদ্বীপ উদ্ধারে সহায়তা করিবেন। তিনখান রণসজ্জায় পূর্ণ বড় জাহাজ, ছয়খান কাটার এবং পঞ্চাশখান জালিয়া ও একদল সাহসী সৈন্য সঙ্গে লইয়া সে চাঁদেকানে আসিল।

‘রাজা তাহাকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করিয়া, একটা জরীর পোষাক ও বহুমূল্য ঘোড়া উপহার দিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তিনদিনের মধ্যে মগরাজের বিরুদ্ধে যাত্রা করিবার জন্য আবশ্যক সব (দ্রব্য, সৈন্য ও নৌকা) দিবেন। কিন্তু ১৫ দিন পর্য্যন্ত ইহার কিছুই করিলেন না; অথচ গোপনে মগরাজের সহিত সন্ধি করিলেন যে, কার্ভালোর মাথা পাঠাইয়া দিবেন আর মগরাজ চাঁদেকান আক্রমণ হইতে বিরত হইবেন।

‘অপর পোর্তুগীজগণ, বিশেষতঃ পাদরীগণ রাজার বিশ্বাসঘাতকতা সন্দেহ করিয়া কার্ভালোকে কোন নিরাপদ স্থানে চলিয়া যাইতে উপদেশ দিল, যেখান হইতে সে রাজার প্রকৃত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিবে এবং তৃতীয় ব্যক্তি দ্বারা রাজার সহিত কথা চালাইতে পারিবে। স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যেও প্রবল জনরব উঠিল যে রাজা কার্ভালোকে হত্যা করিবেন। কিন্তু কার্ভালো এরূপ করিতে সম্মত না হইয়া, নিজের কয়েকজন কাপ্তেনকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য রাজাকে দেখিবার জন্য [যশোরে] গেল। তথায় তিন দিন পর্য্যন্ত রাজদর্শনের উপায় হইল না এবং নানারূপ বিশ্বাসের অযোগ্য ওজর শুনিতে পাইল। তিন দিন পরে রাজার চক্রান্ত কার্য্যে পরিণত করিবার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হইলে, কার্ভালোকে কয়েকজন পোর্তুগীজসহ রাজবাড়ীতে আসিতে দেওয়া হইল। যেই সে শেষ দরজা দিয়া ঢুকিয়াছে, অমনি সেই দরজা বন্ধ করিয়া তাহার অনুবর্ত্তী লোকদিগকে বাহিরে রাখা হইল। তাহাদিগকে বন্দী করিয়া, অস্ত্র ও পরিচ্ছদ কাড়িয়া লইয়া, অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও অপমানের সহিত তাহাদিগকে ঘুষি মারিয়া, পায়ে লোহার বেড়ী পরান হইল। তাহার পর রাজার আদেশে, কার্ভালোকে হাতীর পিঠে চড়াইয়া অন্য স্থানে লইয়া যাওয়া হইল; সঙ্গে রাজার একজন সেনানী ও চারি জন রক্ষী সৈন্য। তাহারা উচ্চ চীৎকার ও ব্যঙ্গ করিতে করিতে কার্ভালো ও অপর কয়েকজন পোর্তুগীজকে লইয়া চলিয়া গেল। এই বন্দিগণ মৃত্যুর পূর্ব্বে কি কি (অত্যাচার ও যন্ত্রণা) সহ্য করিতে বাধ্য হইয়াছিল এবং কতদিন বন্দিভাবে কাটাইয়াছিল, তাহা নিশ্চিত জানা যায় না। এই মাত্র নিশ্চয় যে তাহাদিগকে হত্যা করা হয়। (২য় অংশ, ১১শ পরিচ্ছেদ)।

‘তাহার পর চাঁদেকানের অপর পোর্তুগীজগণ এই সংবাদ পাইয়া কি প্রতীকার করিবে স্থির করিতে পারিল না; ভাবিল রাজা কার্ভালোর উপর চটিয়া আছেন, আমরা ত নির্দোষ, তিনি আমাদের কোন অনিষ্ট করিবেন না। কিন্তু স্থানীয় পোর্তুগীজ উপনিবেশের (সাধারণ নাম বান্দেল অর্থাৎ বন্দর) [অর্থাৎ ধুমঘাটস্থ গীর্জার পার্শ্ববর্ত্তী স্থান] নিকটবাসী মুসলমানগণ ফিরিঙ্গিগণের মহাশত্রু ছিল; তাহারা ঐ সংবাদ আসিবার রাত্রেই পোর্তুগীজদিগের বাড়ী ও সম্পত্তি লুট ও দগ্ধ করিতে লাগিল।…পরদিন রাজা কার্ভালো ও অন্যান্য পোর্তুগীজদিগের জাহাজগুলি অধিকার করিলেন এবং তাহাদিগকে কারাগারে ফেলিলেন, সেখানে তাহারা অশেষ দারিদ্র্য ও কষ্ট ভোগ করিল; তাহাদিগকে ধরিবার পরই দু’জনের মাথা কাটিয়া ফেলা হইল এবং আর দুজনকে বর্শার আঘাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হইল।

‘ফাদারদিগকে বন্দী করা হইল না বটে, কিন্তু তাঁহারাও কষ্ট ভোগ করিলেন। রাজা সন্দেহ করিলেন যে, কনফেশনের সময় তাঁহারা বন্দী পোর্তুগীজদিগকে গোপনে উপদেশ দিতেন যে, তাহারা যেন রাজাকে তাহাদের স্বাধীনতার মূল্য (ransom) না দেয়। এজন্য গুপ্তধন ও অস্ত্র অন্বেষণ করিতে আসিয়া, পাদরীদের বাড়ী উলটপালট করা হইল। অবশেষে রাজা রাগে বলিলেন যে, পাদরীরা সকলে (তখন চাঁদেকানে ৪ জন ফাদার ছিলেন) তাঁহার রাজ্য ত্যাগ করিয়া যাউক এবং ভবিষ্যতে তাহাদের কেহ যেন সেখানে না আসে।

‘এইরূপে একমাস কাটিল। অবশেষে বন্দী পোর্তুগীজগণ তিন সহস্র পার্দো (এগার হাজার টাকা) দণ্ড দিয়া খালাস পাইল। ফাদারেরা একেবারে বাঙ্গালা ত্যাগ করিয়া চীন-জাপানে গেলেন, এবং এখানে খৃষ্টধর্ম প্রায় লোপ পাইল।’ (২য় অংশ, ১১শ পরিচ্ছেদ)’[১০]

এই সময়ে বাঙ্গালার প্রথম গীর্জ্জা ও পর্তুগীজ দিগের আবাস গৃহ সকল অগ্নিদগ্ধ ও বিনষ্ট করিয়া ভূমিস্যাৎ করা হয়। সেই অবস্থায় উহাদের কতক ভগ্নাবশেষ এখনও আছে, সে কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। ডু-জারিকের বিবরণী হইতে দেখা গেল, কার্ভালো প্রতাপাদিত্য কর্তৃক বন্দী ও অপমানিত হইয়া কারাগারে আবদ্ধ হইলেন। তিনি ও তাঁহার সঙ্গীরা কতদিন কারাগারে ছিলেন, তাহা নিশ্চিত জানা যায় না। এই মাত্র নিশ্চয় যে তাহাদিগকে হত্যা করা হয়।’ ইহা পাদরীদিগের অনুমান মাত্র। বন্দীদিগের মধ্যে কেহ কেহ নিস্তার পাইয়াছিল, বা পলাইয়া গিয়াছিল কিনা অথবা সকলেই নিদয়রূপে নিহত হইয়াছিল কিনা, তাহা তাঁহারা বলিতে পারেন না। বিশেষতঃ অচিরে যখন পাদরীদিগকেও দেশত্যাগ করিয়া যাইতে হইয়াছিল, তখন কার্ভালো বা তাহার সঙ্গীদিগের শেষ দশা সম্বন্ধে তাঁহারা কোন সাক্ষ্যই দিতে পারেন না। সুতরাং কার্ভালোর হত্যা সম্বন্ধে তাহাদের অস্পষ্ট অনুমান কখনও প্রমাণ স্বরূপ গ্রহণ করিতে পারি না। বিশেষতঃ যখন এগার হাজার টাকা দণ্ড দিয়া পর্তুগীজ বন্দীরা খালাস পাইল দেখিতেছি, তখন সেই মুক্তিপ্রাপ্ত পর্তুগীজ দলে যে কার্ভালো ছিলেন না, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? প্রতাপাদিত্য নৃশংস বা রক্তপিপাসু হইতে পারেন; তাঁহার চরিত্রের সে অভিযোগ হইতে তাঁহাকে নিষ্কৃতি দিতে চাহি না। সেই বিষম সঙ্কটময় যুগে বিদ্রোহী রাজন্যগণের মধ্যে কে-ই-বা তেমন অভিযোগ হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছেন? তাঁহার জামাতা রামচন্দ্র স্বজাতীয় সমধর্মী বীরেন্দ্র লক্ষ্মণমাণিক্যকে কৌশলে বন্দী করিয়া আনিয়া নিজের বাটীতে কেমন করিয়া তাঁহাকে নৃশংসের মত হত্যা করিয়াছিলেন, ইতিহাস তাহার সাক্ষ্য দিবে। কিন্তু তবুও যদি প্রতাপাদিত্য কার্ভালোকে ডাকিয়া আনিয়া নিজের রাজধানীতে খুন করিয়া থাকেন, সে খুনের যতই রাজনৈতিক কারণ থাকুক, তজ্জন্য প্রতাপাদিত্যের চরিত্রের কলঙ্ক নিশ্চয়ই দুরপনেয়। তিনি যে শেষ জীবনে হতমান হইয়া বন্দী ও পিঞ্জরাবদ্ধ অবস্থায় অশেষ কষ্টভোগ করিয়া ছিলেন, সে কষ্ট যদি তাঁহার পিতৃব্য-হত্যা বা এই জাতীয় আশ্রিতের হত্যার প্রায়শ্চিত্য বলিয়া বিবেচিত হয়, তাহাতেও আমাদের কোন আপত্তি থাকিতে পারে না।[১১] তবে যতক্ষণ পর্য্যন্ত তৎকর্তৃক কার্ভালোর হত্যা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, ততক্ষণ পর্য্যন্ত সত্যের খাতিরে আমরা তাঁহাকে দোষী করিতে পারি না। যে ক্ষেত্রে দেশীয় প্রবাদ বা জনশ্রুতি এ বিষয়ে নানা মত পোষণ করে, সেখানে কার্ভালোর স্বজাতীয় লেখকের অনর্থক অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া প্রতাপাদিত্যের উপর নরহত্যার অপরাধ আরোপ করা সঙ্গত বলিয়া মনে করি না।

আরও কথা আছে। ঐতিহাসিক জগতে অধ্যাপক যদুনাথ সরকার মহোদয়ের সূক্ষ্মানুসন্ধিৎসা সৰ্ব্বত্র একবাক্যে প্রশংসিত। তিনি ফ্রান্স হইতে ‘বহারিস্তান’ নামক যে সমসাময়িক ঘটনা সম্বলিত হস্তলিখিত পারসীক পুঁথির সমস্ত পৃষ্ঠাগুলির আলোক-চিত্র হইতে অবিকল প্রতিলিপি সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা হইতে তিনি প্রতাপ-চরিত্রের এই অপবাদ সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন : ‘বহারিস্তানের পুঁথির ১৬৮খ পৃষ্ঠা স্পষ্টই প্রমাণ করিতেছে যে এই অপবাদ মিথ্যা। ঐ স্থলে লেখা আছে যে, ইসলাম খাঁ প্রতাপকে ঢাকায় বন্দী করার অনেক পরে কাশিম খাঁর সুবাদারীর প্রায় শেষাংশে[১২] মুঘলেরা যখন চাঁটগাঁয়ের মগরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে ভুলুয়া হইতে অগ্রসর হয়, তখন ঐ মগরাজা সমস্ত ফিরিঙ্গিদিগকে বন্দী ও হত করিতে চেষ্টা করেন এবং কাপ্তান ডোর-মশ কার্ভালোর অধীনে ফিরিঙ্গিগণ মগপক্ষ ত্যাগ করিয়া মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেয়। ডোরমশ শব্দকে ডো-আমো পড়া যাইতে পারে, ইহা (ডোমিঙ্গ) Portuguese, Domingos শব্দের ফার্সী অপভ্রংশ।’[১৩] আমরা যে কার্ভালোর কথা বলিতেছি, তাহারও নাম ডোমিঙ্গ। সুতরাং এক নামে দুই কার্ভালো না থাকিলে এবং দুইজনই উচ্চপদস্থ বা কাপ্তান জাতীয় না হইলে ঐতিহাসিকের এই নূতন তথ্য উড়াইয়া দেওয়া যায় না। কাজেই কার্ভালোকে যে প্রতাপাদিত্য হত্যা করিয়াছিলেন, এ কথা আমরা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি।

এতক্ষণ আমরা বৈদেশিক গ্রন্থকারের বর্ণনা হইতে তাহার স্বজাতীয় ফিরিঙ্গি সৈন্য, তাহাদের দলপতি এবং এমন কি পাদরীগণের উপর প্রতাপাদিত্য কিরূপ অত্যাচার করিয়াছিলেন, তাহা দেখিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও মনে রাখা উচিত যে, প্রতাপের সৈন্যদলে, গোলন্দাজ ও নৌ- বিভাগে অনেক পর্তুগীজ জাতীয় বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন, তাঁহারা সকলেই তাঁহার স্নেহ এবং অনুগ্রহের অংশভাগী হইয়াছিলেন, এবং এই অত্যাচারের সময়ে তাঁহাদের উপর প্রতাপ কিছুমাত্র বিরূপ হইয়াছিলেন, এমন প্রমাণ নাই। পাদরীগণও যখন প্রথম আগমন করেন, তখন প্রতাপ ও তাঁহার পুত্রগণ পরম সমাদরে তাঁহাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন, সৰ্ব্ববিধ উৎসাহ ও সাহায্য দিয়া তাহাদের দ্বারা গীর্জ্জা নির্মাণ করাইয়াছিলেন, এমন কি তদপেক্ষাও সুন্দর পাথরের গীর্জ্জা নির্ম্মাণ করাইবার জন্য পাদরীগণকে প্রণোদিত করিতে ত্রুটি করেন নাই। যখন এমন সদ্ভাব ও শান্তি স্থাপিত হইয়াছিল, তখন হঠাৎ একমাত্র আরাকাণের আক্রমণ ভয়ে, তাঁহার মত একেবারে পরিবর্তিত হইল, প্রকৃতি উল্টাইয়া গেল, তিনি অতিরিক্ত ভাবে উদ্ভিক্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া এই সকল আশ্রিত বৈদেশিকের উপর অমানুষিক ব্যবহার করিতে লাগিলেন, ইহা কি সম্ভবপর এমন করিয়া কি মানুষের চরিত্র পরিবর্তিত হয়, স্বাভাবিক উদারতা ভাসিয়া যায়? কখনই নহে। নিশ্চয়ই ইহার মধ্যে কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা হইয়াছিল। তাহা কি?

ফিরিঙ্গি দস্যুদলের অত্যাচার কাহিনী আমরা পূর্ব্বে বিবৃত করিয়াছি। তাহাদিগকে দমন করিবার জন্য প্রতাপকে অবিরত বিব্রত থাকিতে হইত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সকল ঘটনা বা সকল খণ্ডযুদ্ধের কোন ধারাবাহিক বিবরণ দিবার পন্থা নাই। তবে এই দস্যুদলের উৎপাতে যশোহরবাসী বণিকগণ এবং সাধারণ প্রজাকুল যে সৰ্ব্বদা নিগৃহীত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইত, তাহা সত্য কথা। এইজন্য রাজা এই ব্যাপারে প্রজামণ্ডলীর সাহায্য পাইতেন; সম্ভবতঃ আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন কয়েকটি গুরুতর ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহাতে দস্যুদলের অত্যাচারের চিত্র জ্বলন্ত ভাষায় সৰ্ব্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল। সত্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয় প্রবাদ হইতে লিখিয়া গিয়াছেন : ‘যে সময়ে দেশের জনসাধারণের হৃদয়ে বৈর-নির্যাতন স্পৃহা এরূপ বলবতী ছিল, সেই সময় কার্ভাল্‌হো নামক একজন পর্তুগীজ জলদস্যু-নায়ক চট্টগ্রাম (?) হইতে পলায়ন করিয়া যশোহর নগরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য যে, ক্রোধ বশবর্ত্তী যশোহর নগরের প্রজা সাধারণ সকলে মিলিত হইয়া ইহাকে পথিমধ্যে নিহত করে; ইহার মৃত্যু সংবাদ ধুমঘাটস্থিত মহারাজের নিকট রাত্রিকালে নীত হয়।’[১৪] ইহা যদি সত্য বলিয়া ধরা যায়, তাহা হইলে হয়ত হুগলী হইতে ধুমঘাট যাইবার পথে, প্রাচীন যশোহর রাজধানীর সন্নিকটে কোথায়ও কার্ভালোর হত্যা সাধিত হয়।[১৫] তাহা হইলে দেখা যায়, যদিই যশোহরে কার্ভালোর হত্যা হইয়া থাকে, তাহা প্রতাপ কর্তৃক হয় নাই, তাঁহার অজ্ঞাতসারে অন্য কর্তৃক হইয়াছিল। হয়ত ঐ জন্য ফিরিঙ্গি নৌ-সেনার সহিত দেশীয় লোকের ঘোর সংঘর্ষ হয় এবং তাহার ফলে প্রতিহিংসা পরায়ণ ফিরিঙ্গিরা রাজধানী উপকণ্ঠে প্রজাবর্গের প্রতি পাশবিক অত্যাচার করে; তাহাতেই উদ্ৰিক্ত হইয়া প্রতাপ ফিরিঙ্গিদিগকে বন্দী করেন ও পাদরীদিগকে দেশান্তরিত করেন। তবে তাঁহার আজ্ঞা না লইয়া যে-দুর্বৃত্ত কার্ভালো বা তাহার সঙ্গিগণের হত্যা ব্যাপারে লিপ্ত ছিল, তিনি তাহাকে সমুচিত শাস্তি দিতে পরাঙ্মুখ হন নাই। এই হত্যাকারী কে? প্রবাদ হইতে তাহাও জানা যায়। তাহার অস্তিত্বে কোন সন্দেহ নাই, তবে পূর্ব্বোক্ত ঘটনার সহিত কতটুকু সংশ্রব তাহাই বিচার্য্য হইতে পারে। আমরা সকল ঘটনা বিশ্বাস না করিলেও, সমসাময়িক দেশীয় ইতিহাসের অভাবে প্রচলিত জনশ্রুতি হইতে ছিন্নভিন্নভাবে কার্ভালো সম্বন্ধে যে গল্প শুনিতে পাই, তাহা এস্থলে বাদ দিতে পারি না। সত্যাসত্য নির্ণয়ের ভার পাঠকবর্গ গ্রহণ করিবেন।

আমরা প্রথম খণ্ডে (২৭৪-২৭৫ পৃ) বিবৃত করিয়াছি যে, লাউজানির প্রসিদ্ধ মুকুট রায়ের এক পুত্র ছিলেন কামদেব। তিনি শিশুকালে গাজী সাহেবের অত্যাচারে মুসলমান হইয়া যান এবং পিতৃবংশের পতনের পর নিজে বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া, বর্তমান গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে যমুনা ও ইচ্ছামতীর সঙ্গমস্থলে চারঘাট নামক স্থানে বাস করিতেন। তিনি সেই প্রাকৃতিক শোভায় অতুলনীয় রমণীয় স্থানে মুসলমান ফকিরের বেশে, চিরকুমার হিন্দু সন্ন্যাসীর মত বাস করিয়া সঙ্গোপনে সাধন ভজন করিতেন। তখন তাঁহার নাম হইয়াছিল ঠাকুরবর। তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ না থাকিলেও ধৰ্ম্মপ্রাণতা ও নির্মূল চরিত্রের গুণে যোগনিরত সাধুর মত সর্ব্বজাতীয় লোকের ভক্তি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। চারঘাটে এখনও তাঁহার দরগা ও সমাধিস্থান আছে।[১৬] তথায় নিত্য সকালে মুসলমান সেবায় কর্তৃক পুষ্প-বিল্বপত্রে সংক্ষেপে তাহার পূজা হয়। এই ঠাকুরবর সাহেব প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক এবং উদার হৃদয় নৃপতির মত তিনিও হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি সংস্থাপন করিয়াছিলেন। যমুনা ও ইচ্ছামতী সঙ্গমে অবস্থিত চারঘাট একটি প্রসিদ্ধ মোহানা, যশোর-রাজ্যের উত্তরদিকের প্রবেশ দ্বার স্বরূপ। সেখানে প্রতাপকে সময় সময় আসিতে হইত; কথিত হয়, ঠাকুরবরও কখনও কখনও ধুমঘাটে যাইতেন।

হ’রে শুঁড়ি বা হরি শৌণ্ডিক নামক এক ব্যক্তি এই ঠাকুরবর সাহেবের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিল। হরির পূর্ব্বনিবাস কাচদহে, সে অতি দরিদ্র এবং বাল্যকালেই পীর সাহেবের কৃপালাভ করিয়া যৌবনে ব্যবসায় বাণিজ্য দ্বারা অতুল ঐশ্বর্য্য লাভ করে। ঐশ্বর্য্যের ফল যাহা হয়, হরি শৌণ্ডিক ধনশালী বণিক হইয়া অতিরিক্ত গর্বিত হয় এবং পরে পীরের সহিত বিবাদ করিতে গিয়া তাঁহার অভিশাপেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এখনও গোবরডাঙ্গার নিকট যমুনার অপরপারে, মাঠের মধ্য দিয়া “হ’রে শুঁড়ির রাস্তা” নামক একটি প্রশস্ত পথের চিহ্ন আছে; লোকে এখনও উহা চিনিতে পারে এবং আমাকে তাহা দেখাইয়া দিয়াছিল। ঐ রাস্তা ‘গৌড়বঙ্গের’ প্রাচীন রাস্তা হইতে বাহির হইয়া চারঘাটে যমুনার মোহানা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুতরাং চারঘাটে যাইবার উহাই একমাত্র সদর রাস্তা এবং হ’রে শুঁড়ির কীর্ত্তি। ‘গৌড়বঙ্গের রাস্তা’র কথা আমরা পরে বলিব। সেই পথ দিয়াই মানসিংহ আসিয়াছিলেন।

হ’রে শুঁড়ি বলিলে যাহা বুঝায়, হরি শৌণ্ডিক তাহা ছিলেন না; তিনি রীতিমত ধনশালী খ্যাতনামা বণিক। তাঁহার পণ্যভারাক্রান্ত ডিঙ্গা নানা দিগ্‌ দেশে প্রেরিত হইত। চারঘাটে মাটির নিম্নে এক সময়ে তাম্রপাতযুক্ত প্রকাণ্ড নৌকার ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছিল। হরির কয়েকখানি পণ্য-তরী কয়েকবার পর্তুগীজ দস্যুদিগের দ্বারা লুণ্ঠিত হইয়াছিল। কার্ভালো নিজে বা তাহার দলভুক্ত অন্যে এই দুস্যতা করিয়াছিল, তাহা জানা যায় না। ইহার জন্য প্রতিহিংসা লইতে হরি সর্ব্বদাই চেষ্টা করিত; ধুমঘাটে রাজদরবারে বণিক বলিয়া তাহার কিছু খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল; কার্ভালোকে যশোহরে আসিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিতে যে আদেশ প্রচারিত হয়, তাহার মূলে হরির কোন চেষ্টা ছিল কি না বলা যায় না। কার্ভালো যখন যমুনা পথে যশোহরে আসিতেছিলেন, তখন প্রাচীন রাজবাটীতে গুপ্তভাবে তাঁহাকে বা তাঁহার দলভুক্ত কয়েক জন কাপ্তেনকে হরি শৌণ্ডিকের লোকেরা হত্যা করিয়াছিল, ইহাই প্রবাদের সার মর্ম্ম। দুর্বৃত্ত বণিক ন্যায়ান্যায় যাহাই করুক না কেন, তাহার আস্পর্দ্ধার কথা শুনিয়া প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত বিচলিত হন, এবং স্বহস্তে তাহাকে নিধন করিয়া শাস্তিবিধান করেন। কথিত আছে, হরি ধনদৃপ্ত হইয়া ঠাকুরবরকে মানিত না বলিয়া, পীরসাহেব স্বয়ং প্রতাপাদিত্যের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহার সমুচিত শাস্তিবিধানের জন্য উদ্রিক্ত করেন। ধীরভাবে বিচার করিয়াই হউক বা ক্রোধের বশবর্তী হইয়াই হউক, প্রতাপ হরি শৌণ্ডিককে নিধন করিলে, তাহার পরিবারবর্গ রাজভয়ে জলমগ্ন হইয়া মরিয়াছিল। এখনও চারঘাটের উত্তর দিকে যমুনা হইতে বহির্গত চালুন্দিয়া নদীর মোহানার কাছে একটি গভীর স্থানকে লোকে “হরে’ শুঁড়ির দহ” বলিয়া থাকে।

পাদটীকা :

১. এই অংশ Old French মূল ভাষায় এইরূপ আছে : নিখিলনাথের ‘Ceste Isle appartenoit de droiet a un des Roys de Bengala, qu’on appelle Cadarary: mais il y auoit plusieurs annees qu’il n’en joussoit pas a cause que les Mogores s’en estioent emparez par force. Or quand it sceut que les Portugais s’en estioent saisis, comme nous dirons bien tost, it la leur donna de fort bonne volunte renoncant en leur faveur a tous les droiets qu li y pouuoit pretendre. Du. Jarric, Histoire & part IV. p. 848. Campos, Portuguese in Bengal, p. 68, note; নিখিলনাথের ‘প্রতাপাদিত্য’ ৪২৩ পৃ। নিখিলনাথের উদ্ধৃত অংশে বহুসংখ্যক বর্ণাশুদ্ধি আছে এবং তাহার অনুবাদ মূলানুগত হয় নাই। Mr. Campos লিখিয়াছেন, ‘The passage referring to Kedar Rai has been mistranslated by (Babu) Nikhil Nath Ray in his প্রতাপাদিত্য’। পরে আরও কয়েক স্থানে এইরূপ ভুল হইয়াছে। উপরোক্ত ফরাসী অংশের অবিকল ইংরাজী অনুবাদ এই : This is land belonged by right to a king of Bengal, who was called Cadaray but for several years he could not enjoy it, because the Moguls took by force. But when he knew that the Portuguese had seized it as we shall tell you shortly, he gave it to them with great willingness giving up in their favour all the rights which he could maintain in the island.

২. যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখিয়াছেন যে, কেদার রায় স্বয়ং যুদ্ধমাত্রা করিয়া সন্দ্বীপ অধিকার করিয়াছিলেন (‘কেদার রায়’, ৪০-৪১ পৃ)। সে কথা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। কার্ভালো কেদারের রণতরীর সাহায্যে সন্দ্বীপ দখল করিয়াছিলেন, ঐ সংবাদ পাইয়া কেদার রায় সম্ভবতঃ পুরস্কার স্বরূপই সন্দ্বীপের শাসনভার কার্ভালোকে অর্পণ করেন। মূল বিবরণীতে ‘জানিবার’ (sceut) কথা আছে, তিনি উপস্থিত থাকিয়া যুদ্ধ জয় করিলে ‘জানিবার’ কথা থাকিত না। Purchas, Pilgrimes, part IV, Book V, p. 575 হইতে পাই : ‘The Mogols with the conquest of Bengala had possessed Sundiva. Cadarai Still continuing his title, under colour whereof, Carvalius and Manes, two portugals, conquered it in 1602.’ এখানেও কেদার রায়ের স্বত্বরক্ষার ছলে কার্ভালো প্রভৃতি সন্দ্বীপ দখল করেন, ইহাই আছে।

৩. ‘In 1599 A. D. the King of Burma sent two ambassadors with presents to Manrajagiri, King of Arakan, requesting his aid against the king of Pegu . ‘ – Chittagong Hill Tracts Gazetteer (R. H. Sneyd Hutchinson), 1909, p. 28. তাঁহার প্রকৃত নাম মানরাজগিরি, উহাই অপভ্রংশে ‘মেংরাজগি’ হইতে পারে। বাদশাহ সেলিম শাহ বা জাহাঙ্গীরের আমলে তিনি গৰ্ব্বভরে সেলিম শা উপাধি ধারণ করিতে পারেন, ইহা বিচিত্র নহে। কারণ পর্তুগীজদিগের পরাজয়ের পর পূর্ব্বাঞ্চলে তাঁহার অসীম ক্ষমতা হইয়াছিল। তখন কেদার রায় নির্জিত বা নিহত এবং প্রতাপাদিত্যের পতনাবস্থা আসিয়াছিল— নিখিলনাথ, ৬০ পৃ টীকা।

৪. কাতুর বা কার্লস একপ্রকার ৪০/৫০ হাত দীর্ঘ যুদ্ধতরণী, উহা দাঁড়দ্বারা বাহিত হইয়া জল-যুদ্ধে ব্যবহৃত হইত। সম্ভবতঃ ইহার সহিত ইংরাজী কাটার Cutter শব্দের কোন সম্বন্ধ আছে।

৫. ‘Kedar Rai also joind the king of Arakan and sent hundred Cosses from Sripure to help in the attack’—Campos, p. 69. ডু-জারিকের মূলগ্রন্থে ফরাসী ভাষায় এই স্থলের বর্ণনা আছে : ‘It auoit aussi du coste de Siripur cent cassess, qui sont d’autres vaisseaux de ce pays la, que le Candaray luy fournissoit. Car ils s’estoiet tous deux liguez pour cet effect : de maniere qu’en tout il У auoit quelqnes deux cent cinquante voiles.—’ ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৪২৫ পৃ; এই স্থানটির অনেকগুলি কথা শুদ্ধভাবে মুদ্রিত হয় নাই। যথাযথ অনুবাদ করিলে এইরূপ হয় : He had also on the coast (side) of Sripure one hundred cose (কোশা নৌকা) Which are other vesselof that country furnished him by Cadaray ( কেদার রায়). Because they both formed leagues for that prupose : so that in all there were some 250 ships. এখানে He বলিতে যে আরাকাণরাজকে বুঝাইতেছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কার্ভালোর নাম আগে, পরে নিকটেও নাই। তবুও নিখিলনাথ এইস্থানে অনুবাদ ভুল করিয়া কেদার রায় কার্ভালোকে একশত কোশা নৌকা পাঠায়াছিলেন, এইরূপ লিখিলেন কেন, বুঝিয়া পাইলাম না (৬১ পৃ, মূল ৫৪১ পৃ)। তিনি যে স্থলে এই কথা বলিতেছেন, তাহারই নিম্নে পার্কার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত হইতে নিম্নলিখিত স্থান উদ্ধৃত করা হইয়াছে : ‘Hereat the King of Arakan was angry that without his leave they had made themselvs Lords of that which is challenged to belong to his protec- tion, Fearing that by this means and the fortification of Sirium he should finde Portugals unneighbourly neighbours. He sent therefore a fleet of a hundred and fiftie firigates or little galleys with fifteene oares on a side and other greater furnished with ordanance and Cadry (which they say was true lord of it) sent a hundred Cosse from Siripur to help him. ‘Purchas, Pilgrimes, IV, Book V. p. 515. নিখিলনাথের এই ভুল যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (‘কেদার রায়’, ৪৪ পৃ) ও Dr. Radha Kumood Mukhopadhaya (Indian Shipping, p. 216) উভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া অবিকল নকল করিয়াছেন।

৬. De Jarric, Histoire, part IV, p. 860.

৭. ‘The Portuguese with the native converts of the place, therefore, evacuated Sandwip and trans- ported all their possessions to Sripur, Bakla and Chandecan, whereupon the king of Arakan at last become master of it. Carvalho curiously enough stayed with thiry frigates in Sripur which was the seat of Keder Rai. The Jesuit father Blasio Nunes and three others, who had begun build- ing a Church and a residence in Sandwip, abandoned their new ventures and repaired to their res- idence at Chandecan which was the only one left to them, all the others having been destroyed.’- Campos, Portuguese in Bengal, pp. 71-2. কেদার রায়ের সহিত কার্ভালোর কোন সদ্ভাব ছিল না বলিয়াই তাঁহার শ্রীপুরে আসা আশ্চর্য্যের বিষয়। এই জন্যই ‘curiously enough’ লেখা হইয়াছে।

৮. নিখিলনাথ রায় কৃত ডু-জারিকের গ্রন্থের অনুবাদ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৪৫৫ পৃ।

৯. অধ্যাপক সরকারের অনুবাদ; ‘প্রবাসী’, ১৩২৮, আষাঢ়, ৩২৩-৪ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র.—শি মি]

১০. [অধ্যাপক সরকারের অনুবাদ, ‘প্রবাসী’, আষাঢ়, ৩২৪-৫ পৃ–পরিশিষ্ট দ্র.—শি মি]

১১. ‘Carvalho, the gallant captain of the Portuguese was at Chandican and the king of Chndican who was then at Jasor sent for Carvalho and had him murdered to ingratiate himself with the King of Arracan.’ -Beveridge, Bakarganj, o. 178.

‘Not long after, Raja Pratapaditya a cruel monster as Beveridge calls him expiated his crimes in an iron cage in which he died.’-Campos, Portuguese in India, p. 73.

১২. ইসলাম খাঁ ১৬০৮ হইতে ১৬১৩ পৰ্য্যন্ত এবং তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতা কাশিম খাঁ ১৬১৩ হইতে ১৬১৮ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত বঙ্গে সুবাদারী করেন।

১৩. ‘প্রবাসী’, ১৩২৭, কার্ত্তিক ৭-৮ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র. —শি মি]

১৪. ‘প্রতাপাদিত্যের জীবন চরিত,’ ৯৩-৯৪ পৃ।

১৫. ‘Du Jarric adds that the news of Carvalho’s murder at Jasor reached Chandican on the following midnight, which may give us some idea about the distance of the two places.’-Beveridge, p. 178. এ কথা ঠিক নহে। কোন দুর্বৃত্ত অপরাধী কর্তৃক হত্যা সাধিত হইলে সে সংবাদ প্রথমতঃ বহুক্ষণ গুপ্ত রাখিবারই চেষ্টা হয়। তাহাতে ১০/১২ মাইল দূরেও সংবাদ যাইতে দীর্ঘ সময় লাগিতে পারে।

১৬. এই মসজিদটি ছোট হইলেও সুন্দর, উহার ভিতরের পরিমাণ ১৯-৩- ×১৯; একটিমাত্র গুম্বজ; চারি কোণে চারিটি মিনারেট এবং দক্ষিণ ও পূর্ব্বদিকে দুইটি দরজা আছে। দক্ষিণদিকে দরজার উপর একটি ইষ্টক-খচিত ক্ষুদ্র হস্তিমূর্তি এখনও হিন্দু সংস্রব বুঝাইয়া দেয়। পূৰ্ব্বদিকের দরজার উপর দুইখানি আরবী ইষ্টক-লিপি আছে। উহার পাঠোদ্ধার করিতে পারি নাই।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন