সতীশচন্দ্র মিত্র
সীতারাম আদর্শ হিন্দু নৃপতি। তাঁহার রাজ্য যতই ক্ষুদ্র হউক, তিনি সেই ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে হিন্দু- রাজত্বের আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া প্রজা পালন করিবার সমধিক চেষ্টা করিয়াছিলেন। হিন্দু রাজার মত তিনি রাজস্ব সংগ্রহ করিতেন, জনপ্রিয় লোকপালের মত তাহা ব্যয় করিতেন। তাঁহার সম্বন্ধেও বলা যায় :
‘প্রজানামেক ভূত্যর্থং স তাভ্যো বলিমগ্রহী।
সহস্রগুণমুসষ্টমাদত্তে হি রসং রবিঃ।।’
—রঘুবংশ, ১-১৮ পৃষ্ঠা।
সহস্রগুণ বর্ষণ করিবার জন্যই সূর্যদেব ভূমি হইতে রস গ্রহণ করেন, তিনিও প্রজার মঙ্গলের নিমিত্ত তাহাদের নিকট হইতে কর গ্রহণ করিতেন। প্রজাদের নিকট হইতে যাহা লওয়া যায়, তন্মধ্যে যে রাজা যত বেশী পরিমাণে তাহা প্রজাদিগকে কোন না কোন প্রকারে প্রত্যর্পণ করিতে পারেন, তিনি সেই পরিমাণে বড় রাজা। রাজ্যের পরিমাণ দ্বারা রাজত্বের কৃতিত্ব সূচিত হয় না, প্রজাপালন বিষয়ক নীতির প্রকর্ষই রাজার সিংহাসনকে উচ্চ করিয়া দেয়। প্রজার সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য সীতারামের যে সুদৃষ্টি ছিল, তাহাই তাঁহাকে সৰ্ব্বজনপ্রিয় করিয়াছিল; সেই জন্যই দলে দলে লোক আসিয়া তাঁহার শাসনতলে বাস করিতে ভালবাসিত। তাঁহার স্বল্পস্থায়ী রাজত্বের কোন প্রামাণিক লিখিত বিবরণী না থাকিলেও যতদিন তাঁহার দেশ-হিতৈষণার চিহ্ন থাকিবে, ততদিন তাঁহার স্মৃতি কেহ মুছিয়া ফেলিতে পারিবে না। অশোক বা হর্ষের সঙ্গে সীতারামের তুলনা করা চলে না, কারণ স্বাধীনতা ব্যতীত কেহ রাজার পর্যায়েই পড়ে না। আর সীতারামের মত ক্ষুদ্র রাজা মৌর্য্য-সম্রাটের বিরাট জন-হিতৈষণার গৌরব লাভ করিতে পারেন না। তবে ভাগ্যগুণে যদি তাঁহার স্বাতন্ত্র্যলাভের চেষ্টা ব্যর্থ না হইত, তাহা হইলে ক্ষুদ্রাধিকারের মধ্যে তিনিও অশোক-হর্ষের মত প্রজার শোকদুঃখ নিবারণ করিয়া, তাহাদের হর্ষসুখ বিধান করিতে সমর্থ হইতেন। নীতিই মানুষকে বড় করিয়া দেখায়, কার্যক্ষেত্র উহার সফলতার জন্য দায়ী।
প্রজাদিগের ঐহিক পারত্রিক উভয়দিকে তাঁহার দৃষ্টি ছিল। সেই কথাই এখন বলিব প্রজাদের স্বচ্ছন্দ জীবিকার জন্য তাহাদের খাদ্য পানীয় সুলভ করিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। সায়েস্তা খাঁর রাজত্বে টাকায় আটমণ চাউল বিক্রয় হইত। উহা কেবল রাজধানী ঢাকার কথা নহে; আবার তাঁহার কৃষক প্রজা যেমন বেশী, কৃষিক্ষেত্রও প্রচুর ছিল। বিশেষতঃ তিনি আবাদী সনন্দের বলে অনেক নূতন স্থল শাসনতলে আনিয়া প্রজাপত্তন করিয়াছিলেন; তাই উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য শস্যের মূল্য হ্রাস হয়। এক্ষণে সে অবস্থা কল্পনা করাও দুষ্কর হইয়াছে।
রাজধানী মহম্মদপুরে মনোরম রাজ্যের সংস্থাপন করিয়া উহাকে একটি প্রধান বাণিজ্যের কেন্দ্র করা হইয়াছিল; তজ্জন্য সকল স্থানের সব রকম জিনিস এখানে আসিয়া বিক্রয় হইত। লোকে রাজধানীতে আসিলে সৰ্ব্ববিধ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় পদার্থ সুলভে সহজে কিনিতে পারিয়া নানাবিধ বিলাস-সুখের কল্পনা করিত।
এদেশ পূর্ব্বে সম্পূর্ণ নদী-মাতৃক ছিল; নদীর কূলে ভিন্ন বসতি ছিল না। তখন লোকের জলকষ্ট ছিল না। কালে বহুস্থানে নদীর ভূমি-গঠন কার্য্য সম্পন্ন হওয়ায় এবং কৃত্রিম খাল নালা দ্বারা স্বাভাবিক গতির ব্যতিক্রম হইলে, অনেক স্থলে নদী মরিয়া মজিয়া যাইতেছিল, পানীয় জলের জন্য সে সব স্থানের লোককে পুকুর বা দীঘি খনন করিতে হইত; এবং সর্বত্র সম্পন্ন লোক না থাকায়, জলকষ্ট উপস্থিত হইত। সীতারাম স্বীয় রাজ্যমধ্যে সকল স্থানের জলকষ্ট নিবারণ করিয়াছিলেন। তিনি একদা এক প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী পণ্ডিতের নিকট শুনিয়াছিলেন যে, পূৰ্ব্বজন্মে জল-দান-পুণ্য – ফলে তিনি এ জন্মে রাজা হইতে পারিয়াছেন। জলদান প্রবৃত্তি তাঁহার পূর্ব্বপুরুষের কিরূপ ছিল, তাহা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (৪০শ পরিচ্ছেদ)। এই সব নানা কারণে, তাঁহার রাজ্যমধ্যে যাহাতে ‘জল-দুর্ভিক্ষ’ না থাকে, তাহার ব্যবস্থার জন্য তিনি বিশেষ ব্যাকুল হইয়াছিলেন। শুধু হিন্দু রাজা বলিয়াই যে কথা, তাহা নহে; এইরূপ জলদান-প্রবৃত্তি কিরূপ ভাবে পাঠান দলপতি খাঁ জাহান আলির ছিল, তাহা আমরা প্রথম খণ্ডে সবিস্তর বর্ণনা করিয়াছি। খাঁ জাহানের একদল বেলদার বা খনকসৈন্য ছিল; তিনি যে পথ দিয়া সমারোহে অগ্রসর হইতেন, তাহার দুইপার্শ্বে অচিরে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জলাশয় খনিত হইয়া তত্তৎস্থানের জলকষ্ট নিবারণ করিয়া দিত। এখনও যশোহর-খুলনায় অনেক স্থানে বড় বড় খাঞ্জালি দীঘি স্থানীয় লোকের জীবনোপায় হইয়া রহিয়াছে। সীতারামেরও এইরূপ একদল বেলদার সৈন্য ছিল; শুনা যায়, উহাদের সংখ্যা ২২০০ এবং উহাদের নায়ক ছিলেন, পলাশবাড়িয়ার বসু-বংশের পূর্ব্বপুরুষ, কায়স্থবীর মদনমোহন বসু। এই সৈন্যদল আবশ্যক হইলে যুদ্ধ করিত, আর সময় পাইলে পুষ্করিণী খনন করিত
সৰ্ব্বত্রই জলাশয় প্রতিষ্ঠা দ্বারা সীতারামের শুভাগমন ও শুভদৃষ্টি বিজ্ঞাপিত হইত। আর কিছুতে না হউক, তিনি জলদান-পুণ্যে অমর হইয়া রহিয়াছেন।[১] প্রবাদ আছে, তিনি প্রতিদিন নূতন পুষ্করিণীর জলে স্নান করিতেন এবং প্রত্যহ নানাস্থান হইতে এই সব খনিত জলাশয়ের জল রাজধানীতে আনীত হইত; উহার প্রকৃত কারণ পুষ্করিণী খনন কার্য্যের উৎসাহদান ভিন্ন কিছু নহে। কিন্তু সাধারণ লোকে উহার মধ্যে তাঁহার বিলাসিতার স্বপ্ন দেখিত। নূতন পুকুরের জলে স্বাস্থ্য ও বিলাসিতা বৃদ্ধি পায়, এমন কথা আমরা শুনি নাই; বরং উহার বিপরীত ফলই আমাদের অভিজ্ঞতা। সীতারাম যে সকল ক্ষুদ্র বৃহৎ জলাশয় প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন, এখনও তাহার অনেকগুলি বৰ্ত্তমান থাকিয়া তদঞ্চলের জলকষ্ট নিবারণ করিতেছে। রামসাগর, কৃষ্ণসাগর প্রভৃতির কথা বলিয়াছি; তদ্ভিন্ন অনেক জলাশয় এখনও নানাস্থানে আছে। মহম্মদপুর হইতে ৫/৬ ক্রোশ দূরে বলেশ্বরপুর ও লস্করপুরে দুইটি প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা আছে। রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমকোণে দেড় ক্রোশ দূরে শ্যামগঞ্জে সীতারামের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্যামসুন্দর রায়ের প্রাসাদ ছিল, তথায় এবং অদূরবর্ত্তী দিনগরে কতকগুলি উৎকৃষ্ট সরোবর আছে। সূর্য্যকুণ্ড গ্রামের ‘দাসের পুকুর’ এখনও তাঁহার মহিমা কীর্ত্তন করিতেছে। বাশগ্রাম-বগুড়ায়ও দীর্ঘিকা এবং গড় আছে। এতদ্ভিন্ন কানুটিয়া, ঘুল্লিয়া, যশপুর, গঙ্গারামপুর, মিঠাপুর ও সিঙ্গিয়া (হাড়িগড়া) গ্রামে, নড়াইলের পূর্ব্ব-দক্ষিণে সরখলডাঙ্গায় ও হরিহর নগরে সীতারামের জলাশয় আছে।
জ্ঞানচর্চ্চা ও শিক্ষা-সৌকর্য্যের জন্যও মহম্মদপুর খ্যাত হইয়াছিল। সীতারামের রাজসভায় বহু পণ্ডিতের সমাগম হইত; তিনি বহু অধ্যাপককে বৃত্তিদানে পোষণ করিতেন। তাঁহার গুরু- পুরোহিত উভয় কুলই পাণ্ডিত্যের জন্য সম্মানিত। ঘুল্লিয়ার গোস্বামিগণ তাঁহার গুরুবংশীয় এবং গোকুলনগরের বংশজ চট্টোপাধ্যায়গণ তাঁহার পুরোহিতের ধারা। শেষোক্ত বংশে বহু পণ্ডিতের আবির্ভাব হইয়াছিল। তাঁহার সময় হইতে বাগ্জানি, ধুপড়িয়া, গঙ্গারামপুর ও বারুইখালি প্রভৃতি স্থান বহু অধ্যাপক-পণ্ডিতের নিবাসস্থল হইয়াছিল। বারুইখালি নালিয়া, বানা, নহাটা ও বাটাজোড় প্রভৃতি স্থান পাশ্চাত্য-বৈদিক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একটি প্রধান কেন্দ্র। সীতারামের পতনের পরও এই সব স্থানের বিদ্যাগৌরব নিষ্প্রভ হয় নাই। বরং কালে বারুইখালি পাণ্ডিত্য-গরিমায় নবদ্বীপের নিম্নেই আসন পাইয়াছিল। এই স্থানে ঘরে ঘরে যে কত অসাধারণ পণ্ডিতের আবির্ভাব হইয়াছে, তাহার সংখ্যা করা যায় না। পলিতা-নহাটার বৈদিক ভট্টাচার্য্যগণের পূর্ব্বপুরুষ ভাস্করানন্দ আগমবাগীশ অনেক সময়ে সীতারামের সভাশোভন করিতেন। তাঁহার স্বহস্ত লিখিত কবিতা হইতে জানা যায়, তিনি সীতারামকে ইন্দ্রতুল্য রাজেন্দ্র বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন :
‘ভাস্করে উদয় ভাস, উদয় নারায়ণ দাস, তনয় রাজেন্দ্র সীতারাম
গুণেন্দ্র দেবেন্দ্র তথি, ভূ-অধিপতি, ভূষণে ভূষিত গুণগ্ৰাম॥’[২]
বহু অধ্যাপককে বৃত্তি দিয়া বিদ্যোৎসাহী রাজা মহম্মদপুরে অসংখ্য চতুষ্পাঠী খুলিয়াছিলেন। সে সকল টোলে কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি, দর্শন প্রভৃতি বহুশাস্ত্রের অধ্যাপনা হইত। এমন কি, জ্যোতিষ বা আয়ুর্ব্বেদ শাস্ত্রও বাদ পড়ে নাই। বৈদ্যকুল-প্রদীপ অভিরাম কবীন্দ্রশেখর প্রসিদ্ধ কবিরাজ এবং রাজসভার অলঙ্কার স্বরূপ ছিলেন। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি রাজার নিকট হইতে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি পাইয়াছিলেন।[৩] কলিকাতা পাথুরিয়াঘাটার প্রসিদ্ধ কবিরাজ মহামহোপাধ্যায় দ্বারকানাথ সেন অভিরামের উপযুক্ত বংশধর।[৪] সীতারাম অভিরামকে যে ভূমিবৃত্তি দিয়াছিলেন, তাহা এখনও ‘কবিরাজের তালুক’ বলিয়া পরিচিত। এইরূপ আরও অনেক কবিরাজ রাজধানীতে চিকিৎসা ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন।
উদার নৃপতি হিন্দুদের শিক্ষা ব্যবস্থা করিয়া ক্ষান্ত হন নাই; তিনি মুসলমান প্রজার শিক্ষার জন্য মৌলবীদিগের দ্বারা বহুসংখ্যক মক্তব খুলিয়াছিলেন। বালকদিগের বর্ণজ্ঞান ও বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা দিবার জন্য যে সর পাঠশালা ছিল, হিন্দু মুসলমান উভয় জাতীয় লোকে তাহার শিক্ষক হইতেন। মৌলবীদিগকে হিন্দুরা বিশ্বাস ও ভক্তি করিত, রাজাও উহাদিগকে প্রয়োজন মত উচ্চ রাজনৈতিক কার্য্যে নিয়োজিত করিতেন।
প্রজাবর্গের অন্নজল ও শিক্ষার সুব্যবস্থা করিয়া সীতারাম প্রকৃত রাজসম্মান লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু ধর্মপ্রাণতাই তাঁহার চরিত্রের বিশেষত্ব। কৈশোর কাল হইতেই তিনি ধাৰ্ম্মিক ও ভক্তিবিহ্বল ছিলেন। ক্রমে বয়োবৃদ্ধি ও রাজপ্রতিপত্তির সঙ্গে ধর্ম্মনিষ্ঠা বাড়িতে লাগিল। তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই তথায় সর্ব্বাগ্রে তাঁহার কুলদেবতা দশভুজা দুর্গাদেবীর মন্দির স্থাপন করেন।[৫] ঐ মন্দিরের গায়ে লিখিত ছিল :
‘মহী-ভুজ-রস-ক্ষৌণী শকে দশভুজালয়ম্।
অকারি শ্রীমতা সীতারামরায়েণ মন্দিরম্॥’
মহী=১, ভুজ-২, রস=৬, ক্ষৌণী (পৃথিবী)=১; অঙ্কের বামগতিতে ১৬২১ শক বা ১৬৯৯ খৃষ্টাব্দ হয়। মন্দিরের মধ্যে ইহাই সর্বপ্রথম। কয়েকবার সংস্কারে এই মন্দির-প্রাচীরের অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে, তবুও ইহার গায়ে কিছু চিত্রকলা ছিল। তন্মধ্যে পালকীতে রাজা চলিয়াছেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যগণ যাইতেছে, এরূপ একটি ছবি দেখা যায়। লোকে বলে, ঐ রাজার ছবিটি সীতারামের নিজমূর্ত্তি। সেই ইষ্টকের ছবি ভিন্ন সীতারামের অন্য কোন চিত্ৰ নাই।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সীতারাম তাঁহার নূতন গুরুদেব কৃষ্ণবল্লভ গোস্বামীর নিকট বৈষ্ণব-দীক্ষা গ্রহণ করেন। দশভুজার মন্দিরের পর তিনি সেই একই প্রাঙ্গণে পশ্চিমের পোতায় কারুকার্য্য খচিত এক অতি সুন্দর জোড়-বাঙ্গালা মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া তন্মধ্যে কৃষ্ণ বিগ্রহ স্থাপন করেন। এই মন্দিরে কোন ইষ্টকলিপি ছিল বলিয়া জানা যায় নাই। জোড়-বাঙ্গালাটি এখনও ভগ্নাবস্থায় দণ্ডায়মান আছে। এই কৃষ্ণজীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াও তাঁহার সাধ মিটে নাই। তিনি পিতৃপুণ্যার্থ যেমন রাজধানীতে লক্ষ্মীনারায়ণের অষ্টকোণ মন্দির স্থাপন করেন, গুরুদেবের তোষাভিলাষী হইয়া সেইরূপ কানাইনগর গ্রামে এক অপূর্ব্ব পঞ্চরত্ন মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া, তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ হরেকৃষ্ণ- বিগ্রহ স্থাপন করেন। কৃষ্ণজীর মন্দিরের মত এ মন্দিরও পূর্ব্বদ্বারী, উহার সদর দিকে একফুট পরিসর বিশিষ্ট একখানি কষ্টিপাথরের গোলাকার প্রস্তরে নিম্নলিখিত শ্লোকটি উৎকীর্ণ ছিল :[৬]
‘বাণ-দ্বন্দ্ব্বাঙ্গচন্দ্রৈঃ পরিগণিত-শকে কৃষ্ণতোষাভিলাষঃ শ্রীমদ্বিশ্বাসখাসোদ্ভবকুলকমলোদ্ভাসকো ভানুতুল্যঃ।
ভ্রাজচ্ছিল্লৌঘযুক্তং রুচিররুচি হরেকৃষ্ণগেহং বিচিত্রং
শ্রীসীতারামরায়ো যদুপতিনগরে ভক্তিমানুৎসসৰ্জ্জ॥’[৭]
বাণ=৫, দ্বন্দ্ব=২, অঙ্গ=৬, চন্দ্র=১; অঙ্কের বিপরীত ক্রমে ১৬২৫ শক বা ১৭০৩ খৃষ্টাব্দ পাওয়া যায়। ‘কৃষ্ণতোষাভিলাষঃ’ সীতারামেরই বিশেষণ। এ স্থলে শ্রীকৃষ্ণের তুষ্টির জন্য অথবা গুরুদেব কৃষ্ণবল্লভের তুষ্টির জন্য, এই উভয় অর্থই প্রচ্ছন্ন আছে। সীতারামের পূর্ব্বপুরুষের উপাধি ছিল ‘বিশ্বাস খাস’, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি; তিনি জন্মলাভে সেই বংশ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। শ্লোকটির সরলার্থ এই : সূর্য্যের মত যিনি বিশ্বাস-খাস-কুল-কমলকে প্রস্ফুটিত করিয়াছিলেন, সেই ভক্তিমান্ শ্রীসীতারাম রায় স্বীয় গুরুদেব কৃষ্ণবল্লবের তুষ্টির নিমিত্ত ১৬২৫ শকে যদুপতি (কানাই) নগরে সমুজ্জ্বল শিল্পরাজি সমন্বিত সুরুচিসম্পন্ন বিচিত্র হরেকৃষ্ণ-মন্দির উৎসর্গ করেন।
কানাইনগরের মন্দিরটি বাস্তবিকই সুন্দর কারুশিল্পসমন্বিত এবং সীতারামের সকল মন্দির অপেক্ষা বৃহৎ ও উচ্চ। পূর্ব্বদিকে উহার সদর; সে দিকে তিনটি খিলানের পশ্চাতে বারান্দা এবং পার্শ্বদ্বয়েও ঐরূপ খিলান ও বারান্দা আছে। গর্ভমন্দিরে কৃষ্ণ-রাধিকামূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। মন্দিরের পোতা দুই হস্ত উচ্চ এবং উহার শীর্ষদেশে চারি কোণে চারিটি এবং মধ্যস্থলে একটি, সৰ্ব্বসমেত পাঁচটি চূড়া আছে, এই জন্য এই জাতীয় মন্দিরকে পঞ্চরত্ন মন্দির বলে। সাধারণতঃ বঙ্গদেশের সকল উৎকৃষ্ট মন্দির এই প্রণালীতে রচিত। পূর্ব্বদিকের মন্দিরগাত্রই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক কারুকার্য্যমণ্ডিত, সে দিকে প্রত্যেক দরজার উপর চতুষ্কোণক্ষেত্রে দুইটি সিংহ একটি মঙ্গল ঘট রক্ষা করিতেছে, উপরে সারি সারি ভাবে মধ্যস্থলে কৃষ্ণ বলরাম ও দুইপার্শ্বে উপর হইতে নিম্ন পর্য্যন্ত সখিবৃন্দ ও নানা দেবদেবীর ছবি অঙ্কিত ছিল। এ মন্দিরকে সুন্দর ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী করিবার জন্য রাজা কোন প্রকার চেষ্টা, আয়োজন বা অর্থ-ব্যয়ের ত্রুটী করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। ইহার অপূর্ব্ব মাধুরী তাঁহার ভক্ত হৃদয়েরই সুন্দর চিত্র রচনা করিয়াছিল।
কানাইনগর হইতে এক মাইল দূরে গোপালপুর গ্রামে সীতারামের প্রতিষ্ঠিত বুড়া শিবের এক ভগ্ন মন্দির এখনও বর্ত্তমান আছে। অবশ্য শিবলিঙ্গের পূজা সে মন্দিরে হয় না, নিকটবর্ত্তী একখানি ক্ষুদ্র টিনের ঘরে উক্ত লিঙ্গের দৈনিক পূজাদি কার্য্য কোন প্রকারে সমাহিত হয়। সীতারামের রাজপ্রসাদের সম্মুখে কৃষ্ণ বিগ্রহের দোলোৎসবের জন্য যে মঞ্চ নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা এখনও মনুমেন্টের মত দাঁড়াইয়া আছে। দেবভক্ত নৃপতি এই সকল বিগ্রহের প্রত্যেকের সেবা ও পর্ব্বোৎসবের জন্য রাজোচিত ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। প্রত্যেক বিগ্রহের জন্য কয়েকখানি করিয়া গ্রাম দেবোত্তর দেওয়া ছিল। কানাইনগরের ব্যবস্থাই ছিল সর্ব্বোৎকৃষ্ট, কারণ এখানে তিনি বৈষ্ণববৃন্দের একমাত্র আরাধ্যক্ষেত্র শ্রীবৃন্দাবনের কল্পনা করিয়াছিলেন। স্থানটির নাম রাখিলেন যদুপতিনগর বা কানাইনগর; সেই স্থানেই কৃষ্ণরাধার যুগল রূপ বর্তমান; মন্দিরপ্রাঙ্গণে বহু অনুষ্ঠানে দিবারাত্র অষ্ট প্রহর সমভাবে হরিনামানুকীৰ্ত্তন হইত। ‘কানাইবাড়ীর কীর্ত্তন’ কিছুতেই থামিত না।ঐ পূৰ্ব্বপার্শ্ববর্ত্তী প্রশস্ত অট্টালিকার দুইটি প্রকোষ্ঠে দুই দল কীৰ্ত্তনওয়ালা বেতনভোগী হইয়া বাস করিতেন, এক দল বিশ্রাম করিবার সময়ে অন্য দল গান গাহিতেন। মন্দিরপ্রাঙ্গণ দিবানিশি ভক্তমণ্ডলীর প্রেমোচ্ছ্বাসে কোলাহলময় থাকিত। প্রাচীন বৃন্দাবনে গোপগণের বসতি ছিল; সীতারামের নববৃন্দাবনেও গোপগণের বসতি হইল। যে পাড়ায় তাঁহারা বাস করিতেন, তাহার নাম গোকুলনগর। এখনও সেখানে কয়েক ঘর গোপের বাস আছে। কানাইনগরের হরেকৃষ্ণ বিগ্রহের সেবক গোপ ব্যতীত আর কেহ হইতে পারিতেন না। কিছুদিন পূর্ব্বেও সেই নিয়ম চলিতেছিল। কানাইনগরের চতুঃপার্শ্বে যে অন্য সকল গ্রাম আছে, তাহাদের নাম শ্যামনগর, রাধানগর, মথুরানগর প্রভৃতি। তথাকার বিগ্রহগণের বৃত্তিস্বরূপ যে তিনখানি গ্রাম উৎকৃষ্ট হয়, তাহাদের নাম হরেকৃষ্ণপুর, লক্ষ্মীপুর ও বলরামপুর। পূর্ব্বে বলিয়াছি, এই হরেকৃষ্ণপুরেই অপূর্ব্ব জলাশয়, কৃষ্ণসাগর; উহাই কালীয় হ্রদ বলিয়া কল্পিত হইত। কানাইনগর হইতে রাজদুর্গের রাস্তা পৰ্য্যন্ত যে এক মাইল দীর্ঘ বাহিরের পরিখার কথা বলিয়াছি, তাহাই ছিল যমুনা নদী। রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীনারায়ণ শিলাকে রথোৎসবে ও অন্যান্য পর্ব্বে উক্ত পরিখার তীরবর্তী প্রশস্ত পথে রথারোহণে লইয়া যাওয়া হইত, পরে তিনি সুন্দর ময়ূরপঙ্খী তরণীতে কল্পিত যমুনা পার হইয়া কানাইনগরে গিয়া কিছুদিন বাস করিতেন। প্রবল শত্রুর সতি যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও এই সকল পুরাণসম্মত আনন্দলীলা সীতারামের পরমভক্ত প্রজাবৰ্গকে সৰ্ব্বদা আনন্দসাগরে নিমজ্জিত করিয়া রাখিত। সীতারামের এই সকল উৎসবের প্রকৃত তত্ত্ব অনুসন্ধান করিলে তাঁহাকে ভক্তপ্রাণ পরম হিন্দু বলিয়া সন্দেহ করিবার কারণ থাকে না।
সীতারামের বিলাসিতা সম্বন্ধে কতকগুলি প্রবাদ প্রচলিত আছে। উহার সবগুলিই যে কিছু অতিরঞ্জিত, তাহাতে সন্দেহ নাই। চিরকালই এই জাতীয় প্রসঙ্গে রাজাদের সম্বন্ধে লোকমুখে অদ্ভুত গল্প রচিত হইয়া থাকে; প্রামাণিক বিবরণী না থাকিলে, এই সকল গল্প কালসহকারে ক্রমেই রঞ্জিত হইয়া ইতিহাসের স্থান পূরণ করে। সীতারামের সম্বন্ধেও তাহাই হইয়াছে। উক্ত প্রবাদগুলির মধ্যে কতক সীতারামের অশনবসনাদি সম্বন্ধীয়, কতকগুলি তাঁহার নৈতিক চরিত্র বিষয়ক। আমরা পৃথকভাবে এই দুই জাতীয় প্রবাদের বিচার করিব। প্রথমতঃ প্রবাদ এই, সীতারাম নিত্য নূতন বিছানায় শয়ন করিতেন, প্রত্যহ তাঁহার জন্য সদ্য দুগ্ধ হইতে ঘৃত মাখন দধি ক্ষীর ও অন্যান্য মিষ্টান্ন প্রস্তুত হইত; তিনি কোন বাসি বা পৰ্য্যুষিত অজানিতভাবে প্রস্তুত, বৈদেশিক বা দূরবর্তী স্থান হইতে আনীত খাদ্যাদি গ্রহণ করিতেন না। সামান্য অতিরঞ্জন বাদ দিয়া, আমরা এ সকল কথা বিশ্বাস করিয়া লইতে পারি। এখনও অনেক এদেশীয় রাজা বা বড় জমিদারের সম্বন্ধে এসব কথা খাটে। কেবল সদ্য খনিত পুকুরের জলে স্নান করা সকলের ভাগ্যে বা সাধ্যে কুলায় না। উহার মধ্যে সীতারামের বিলাসিতা কতটুকু ছিল, তাহা পূর্ব্বে বিচার করিয়াছি। অন্যগুলির মধ্যে বিলাসিতা যেমন আছে, তাহার সঙ্গে হিন্দুয়ানী রক্ষা, স্বাস্থ্য বিষয়ে সাবধানতা ও শিল্পিগণকে উৎসাহদান, ইহাও আছে। দেশের মধ্যে যে রাজা স্বাধীন হইবার নাম করেন, তাঁহাকে শিল্প-সাহিত্যের সহায়তার জন্য তজ্জাতীয় বিলাসের প্রশ্রয় দিতে হয়। অযোধ্যার নবাব গান ভালবাসিতেন বা শুনিতে জানিতেন বলিয়া সে দেশে সঙ্গীতচর্চ্চার উৎকর্ষ ছিল, এখন তাহা নাই। ঢাকার নবাবী প্রাসাদের উপকণ্ঠে বা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানীর পার্শ্বে শান্তিপুর প্রভৃতি স্থানে, যে সূক্ষ্ম বস্ত্র, সোনারূপার কারুশিল্প ও পুতুল গড়ার অত্যুন্নতি হইয়াছিল, তাহার প্রকৃত কারণ রাজ-পরিবারের বিলাসিতা। সীতারামের দেশেও অনেক কাল পরে দস্যুর উৎপাত গেল, শান্তি আসিল, শস্যাদি সুলভ সুভিক্ষ হইল, শিল্পাদির শ্রীবৃদ্ধি হইল, ধন সম্পদ নিরাপদ হইল, এক কথায় প্রজারা সুখের মুখ দেখিল। আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, এই সুখের নামই সীতারামী সুখ।
দ্বিতীয়তঃ প্রবাদ এই, সীতারামের নৈতিক চরিত্র কলুষিত ছিল, কতকগুলি বিবাহিত স্ত্রী ব্যতীত তাঁহার শত শত উপপত্নী ছিল, তিনি উহাদের সঙ্গে চিত্ত-বিশ্রামের নিভৃত নিকুঞ্জে বা সুখসাগরের গর্ভস্থ দ্বিতল গৃহে বিলাস রঙ্গে মজিয়া থাকিতেন। ‘দাতার মধ্যে খেলারাম, বদমায়েসে সীতারাম’[১০]-এমন সব প্রবাদোক্তিও অপ্রতুল ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামকে বহু রমণীর সংস্পর্শে আনিলেও, একটিমাত্র বিবাহিতা স্ত্রী রূপমোহে পাগল করিয়া তাঁহার সর্ব্বনাশের পথ দেখাইয়া গিয়াছেন। পুরুষের সেবায় রমণী পরিচারিকার নিয়োগ এদেশে নূতন নহে। মৌৰ্য-চন্দ্র গুপ্ত স্ত্রীরক্ষিসেনাদ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবারে বা মৃগয়ায় যাইতেন, বারনারীকে গুপ্তচর নিযুক্ত করিতেন; তাঁহার অন্দরের বিশেষ খবর আমরা রাখি না। মোগল-কেশরী আকবরের অন্দরের খবর রাখিলেও তাঁহার বেগমের সংখ্যা বলিতে পারিব না; তিনি নৃত্যগীতে, মৃগয়ায়, মৎস্য-শিকারে, দশপঁচিশী খেলায় অসংখ্য রমণীকে ক্রীড়নক করিয়া লইতেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত ও আকবর উভয়ই প্রসিদ্ধ বীর ও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। রমণীবর্গের সংস্রবই যে রাজার পতনের একমাত্র কারণ, তাহা নহে। হয়ত সীতারামের পতনেরও অন্য কারণ ছিল। তাঁহার কয়েকটি বিবাহিতা স্ত্রী ছিল, তাহার ৩/৪টির উল্লেখ করিয়াছি; ইহা ভিন্ন তাঁহার উপপত্নী ছিল কিনা বা কতগুলি ছিল, তাহা বলিতে পারি না। অন্ততঃ ছিল বলিয়া পরিচয় পাই নাই। স্ত্রীলোক সংগ্রহের দিকে যে তাঁহার লালসা ছিল, রাজ্য দখল করিবার সময় তিনি কাহাকেও জোর করিয়া বিবাহ করিয়াছেন বা রাজবলের অপব্যয়ে কোন পরস্ত্রীকে করায়ত্ত করিয়াছেন, এমন কোন প্রমাণ নাই।[১১] তাঁহার মৃত্যুর পরেও বন্দী পরিবারের মধ্যে অধিক সংখ্যক স্ত্রীলোক ছিল না। সুতরাং পঞ্চাশ বৎসরের রণক্লান্ত বীর শত যুবতী সঙ্গে আমোদ প্রমোদে দিনক্ষয় বা দেহক্ষয় করিতেন, এমন ‘রচা’ গল্প আমি বিশ্বাস করি না।
তাঁহার এবম্বিধ ক্রীড়া কৌতুকের সময় কখন ছিল? তাঁহাকে পরগণার পর পরগণা জয় করিয়া রাজ্য গড়িতে হইয়াছিল; দুর্গ, রাজধানী বা কামানাদি যুদ্ধাস্ত্র, সবই তাঁহাকে গড়িয়া তুলিতে হইয়াছিল, কিছুই সঞ্চিত ছিল না। রাজসিংহাসন গড়িয়া তাহাতে বসিতে না বসিতে দুৰ্দ্দান্ত মোগলের সহিত সংঘর্ষ বাধিল। শুধু রাজ্যের খাতিরে নহে, প্রাণের দায়ে দিবারাত্র তাঁহাকে সেজন্য ব্যাপৃত ও চিন্তিত থাকিতে হইত। উহার মধ্যে তিনি দেবমন্দির গড়িয়া বিগ্রহ রচনা করিয়া, শত শত জলাশয় প্রতিষ্ঠা করিয়া ধৰ্ম্মপ্রাণতা দেখাইয়াছিলেন; নিজে দেবদ্বিজভক্ত সন্ধ্যাহ্নিকপরায়ণ পরম হিন্দু ছিলেন, ধর্মোৎসবে ও শাস্ত্রালোচনায় যোগ দিতেন, কীৰ্ত্তন-রঙ্গে রাজধানী মুখরিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। কানাইবাড়ীর অষ্টপ্রহর কীর্তনের কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। সুতরাং সংক্ষিপ্ত পনর বৎসর রাজত্বকালের মধ্যে যাঁহাকে এই সকল কার্য্য করিতে হইয়াছে, তাঁহার অনিয়মিত বিলাসিতা বা ইন্দ্রিয়সেবার সময় কোথায়?
সীতারাম অত্যন্ত ধর্ম্মভীরু ছিলেন এবং শাস্ত্রানুশাসন মানিয়া চালিতেন, এজন্য ব্রাহ্মণদিগের প্রতি অত্যন্ত ভক্তিমান ছিলেন। তিনি তাঁহাদের অনুজ্ঞা পালনে সাধ্যপক্ষে কোন মতে দ্বিরুক্তি করিতেন না। রাজার নিকট কোন বিষয়ে দরবার করিবার ইচ্ছা করিলে, প্রজারা সাধারণতঃ কয়েকজন ব্রাহ্মণকে অগ্রণী করিয়া পাঠাইত। তিনিও সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালের মধ্যে যখন তখন, যেখানে সেখানে ব্রাহ্মণকে নিষ্কর ভূমিদান করিয়া গিয়াছেন, এখনও উহার শত শত জীর্ণ সনন্দ আবিষ্কৃত হইতেছে। উত্তরকালে তাঁহার দান যাহাতে বজায় থাকে, তজ্জন্য তীব্র ভাষা প্রয়োগ করিতে ছাড়েন নাই।[১২] এইরূপ ধর্মভীরুতা হইতে সীতারামের প্রকৃত চরিত্র ফুটিয়া উঠে, তাহার সঙ্গে কলুষিত চরিত্রগত অপবাদের সামঞ্জস্য হয় না। আর সর্ব্বোপরি তিনি পরম ভক্ত ছিলেন। আমরা ভক্তচূড়ামণি গোসাঁই গোরাচাঁদের সমসাময়িক উক্তি অবিশ্বাস করিতে পারি না। তিনি লিখিয়া গিয়াছেন :
‘হরিনাম সংকীর্ত্তন ভজনের সার,
চিত্ত শুদ্ধ যাহে হয় আনন্দ অপার।
প্রত্যক্ষ সাক্ষী দেখ রাজা সীতরাম,
দেবের সমান হইল শুনি কৃষ্ণনাম।
রাজা হঞা রাজ্য পাট সব দিল ছাড়ি,
কাঙ্গাল হইয়া আইসে গোপীনাথের বাড়ী।
শ্রীহরেকৃষ্ণ রায় স্থাপন করিল,
গৃহী হঞা বৈরাগ্য সে রাজর্ষি হইল।।’
যে রাজা গৃহী হইয়াও বৈরাগ্য-গৌরবে রাজর্ষির মত অনাসক্ত হইয়াছিলেন বলিয়া এই ভক্তের সাক্ষ্য পাইতেছি, তাঁহাকে কেমন করিয়া বিলাসী বা ঘৃণিত কামুক বলিয়া ধরিয়া লইব?[১৩] সুতরাং স্বচ্ছন্দে বলিব, ‘সীতারামী সুখের’ অর্থ অন্য প্রকার। সীতারামের কামুকতার অপবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাঙ্গালী স্বদেশের কীর্তি রক্ষা করিতে জানে না; কীর্তিমানের চরিত্র বিকৃত করিয়া গল্প করিতে ভালবাসে।
.
পাদটীকা :
১. জলাশয় প্রতিষ্ঠার জন্য মহামতি এডমণ্ড বার্ক কর্ণাট রাজগণের সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছিলেন, সীতারামের সম্বন্ধেও ঠিক তাহা খাটে :
‘These (tanks) are the monuments of real kings, who were he fathers of their people; testators to a posterity which they embraced as their own. These are the grand sepulchres built by ambition, but by the ambition of an insatiable benevolence which not contented reigning in the dispensation of happiness during the contracted tenure of human ife, had strained to extend the dominion of their bounty beyond the limits of nature and to perpetuate themselves through generations of generations as the guardians, the protectors, the nourishers of mankind.’-(Burke, E., Works, 1815, Vol. IV, P. 266.’ -fat fa]
২. যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ৭৮ পৃ।
৩. যদুক্তং রামতনু হড়-কবিশেখরেণ-
‘অভিরামঃ কবীন্দ্রোহসৌ সীতারামাদ্ধি ভূপতেঃ।
মহোপাধ্যায়পদবীং মহৎপূৰ্ব্বামবাগুবান্।।’
৪. খুলনা জেলার পয়োগ্রাম নিবাসী হিন্দু-বংশীয় চন্দ্রশেখর সেনের পুত্র জয়রাম ফরিদপুরের অন্তর্গত খান্দারপাড়ায় বিবাহসূত্রে বাস করেন। তৎপুত্র মধুসূদন কালক্রমে বংশানুক্রমিক ‘কবিরাজ’ উপাধি পান এই মধুসূদনের পুত্র অভিরাম সীতারামের সভার রাজপণ্ডিত এবং মহামহোপাধ্যায় উপাধি-ভূষিত। অভিরামের পুত্রের বংশ নাই। অভিরামের ভ্রাতা রতিরামের পুত্র শঙ্কর বাচস্পতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও কবিরাজ ছিলেন। ইঁহারই শিষ্য গোপাল কর ‘রসেন্দ্র-সারসংগ্রহ’ নামক প্রসিদ্ধ আয়ুর্ব্বেদ গ্রন্থ প্রণেতা। শঙ্করের ভ্রাতুষ্পুত্র রামসুন্দর মহামহোপাধ্যায় দ্বারকানাথের পিতামহ। বংশধারা এই : চন্দ্রশেখর— জয়রাম—মধুসূদন—অভিরাম ও রতিরাম—রামমোহন—রামসুন্দর–রাজীবলোচন— গঙ্গাচরণ ও দ্বারকানাথ। গঙ্গাচরণের পুত্র নগেন্দ্রনাথ বি,এল (উকীল, খুলনা) জ্ঞানেন্দ্রনাথ কবিরত্ন বি, এ (কবিরাজ), সত্যেন্দ্রনাথ বিদ্যাবাগীশ এম, এ (প্রফেসর, সিটি কলেজ) প্রভৃতি। দ্বারকানাথ-যোগীন্দ্রনাথ বৈদ্যরত্ন এম, এ, যতীন্দ্র প্রভৃতি
৫. দশভূজার যে মূৰ্ত্তি ছিল, তাহা পিত্তল-নির্মিত। সীতারাম স্বর্ণ-প্রতিমা গঠনেরই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কথিত আছে, রাজ-কর্ম্মকার কোন প্রসঙ্গে গর্ব্ব করিয়া বলিয়াছিল যে, ইচ্ছা করিলে সে ষোল আনাই চুরি করিতে পারে। রাজা তাহাকে পরীক্ষা করিবার জন্য রাজবাটীতে প্রহরী বেষ্টিত রাখিয়া, তাহার দ্বারা সুবর্ণ-মূর্ত্তি গঠন করাইতেছিলেন। কর্ম্মকার প্রত্যহ নিজ বাটীতে গিয়া রাত্রিযোগে সেই একই আকার প্রকারে অন্য এক পিত্তল প্রতিমা গড়িত এবং প্রতিষ্ঠার পূর্ব্বদিন রাত্রিযোগে সে প্রতিমা রামসাগরের জলে ডুবাইয়া রাখিয়াছিল। প্রতিষ্ঠার দিন প্রাতে যখন কর্ম্মকার স্বর্ণ-প্রতিমা মস্তকে করিয়া মহাসমারোহে রামসাগরে স্নান করাইতে গেল, তখন জলে ডুব দিয়া মূর্তিটি বদলাইয়া লইয়াছিল। প্রতিষ্ঠা শেষ হইলে যখন সে প্রকৃত ঘটনা রাজাকে বুঝাইয়া দিল, তখন তিনি তাহার সুকৌশল ও নির্মাণ-চাতুরীর পুরস্কার স্বরূপ স্বৰ্ণ- প্রতিমাখানিই তাহাকে দান করিয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় এখন মহম্মদপুরে সে পিত্তলময়ী মূর্তিখানিও নাই।
৬. আমি এই প্রস্তরখানি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। কানাইনগরের মন্দির ভগ্নদশায় পড়িলে প্রস্তরখানি খুলিয়া লইয়া “রামচন্দ্র বিগ্রহের বাটীর মধ্যে দেবোত্তরের কাছারী ঘরে উহা রাখা হইয়াছিল। সেখানে ১৩০৯ সালের পৌষ মাসে, নায়েব গঙ্গাচরণ দাস মহাশয়ের অনুগ্রহে আমি উহা দেখিতে পারিয়াছিলাম। পাথরখানি পরিষ্কৃত ও তৈলাক্ত করিয়া উহা হইতে যে পাঠোদ্ধার করিয়াছিলাম, অবিকল তাহাই এখানে প্রকাশ করিলাম। দাস মহাশয়ের পর আরও কয়েক জন নায়েবী করিয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছি, পাবনা জেলায় গয়েশবাড়ী নিবাসী নিত্যানন্দ নন্দী মহাশয় ১৩১৪ হইতে ১৩১৮ সাল পর্য্যন্ত উক্ত কাছারীর নায়েব ছিলেন। তিনি কার্য্যে ইস্তাফা দিয়া যাইবার পর ঐ পাথরখানির আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
৭. এই সুন্দর শ্লোকটির নানাবিধ অশুদ্ধ পাঠ এ পর্য্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। প্রকৃত শ্লোকটিতে কিন্তু কোন অশুদ্ধি নাই। ‘পরিগণিত-শকে’ স্থলে পূৰ্ব্বাপেক্ষিত পরিগণিত শব্দের সহিত (বামনের মতে) শক শব্দের
৭. সমাস হইয়াছে। সৰ্ব্বপ্রথমে ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেবের বিকৃত পাঠে ‘বিশ্বাস ভাস’, ‘অজস্র সৌধযুক্তে’ প্রভৃতি পাঠ ছিল। দুঃখের বিষয় শ্রদ্ধাস্পদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহোদয় ফলকখানি স্বচক্ষে না দেখিয়া সাহেবের অনুকরণ করিতে গিয়া ‘অজস্রং সৌধযুক্তে’, ‘রুচির রুচি হরে’ এই অংশকে যদুপতি নগরের বিশেষণ করিয়া দেন এবং বহুকষ্টকল্পনা করিয়া ‘রুচিররুচিহরে’ অংশের ‘সুন্দর হইতেও সুন্দর’ এইরূপ অর্থ করিয়া লন (‘সীতারাম’, ৬২ পৃ)। নিখিলনাথ উহারই অনুবর্তন করেন। প্রকৃত অর্থ তাহা নহে। বিগ্রহটির নামই ‘হরেকৃষ্ণ’; ইহা শুদ্ধ সংস্কৃত কথা না হইলেও বিগ্রহের নাম বলিয়া অবিকল রাখা হইয়াছে। গোসাঁই গোরাচাঁদের গ্রন্থে ‘শ্রীহরেকৃষ্ণ রায় স্থাপন করিল’ এইরূপই আছে। এই বিগ্রহের জন্য উৎসৃষ্ট গ্রামের নাম ‘হরেকৃষ্ণপুর’। ‘রুচিররুচি’ শব্দটি ‘হরেকৃষ্ণগেহং’ পদের বিশেষণ; এখানে রুচি শব্দে (স্থাপত্য) পদ্ধতি বুঝিতে হইবে; অর্থাৎ মন্দিরটি সুন্দর পদ্ধতিমত রচিত। মূলে ‘ভ্রাজৎ’ অর্থাৎ উজ্জ্বল ‘শিল্পৌঘযুক্তং” এইরূপই আছে, অজস্রং কথা নাই। যুদনাথ (সরকার মহাশয়ের অনুবর্ত্তন করিয়া) ‘ভ্রাজৎ স্নেহোপযুক্তং” এইরূপ পড়িয়াছেন, ইহার অর্থবোধ হয় না। বরদাকান্ত দে মহাশয় পাথরখানি স্বচক্ষে দেখিলেও পরের মুখে পাঠোদ্ধার করিয়াছেন। তবুও তাঁহার পাঠে ‘ভ্রাজচ্ছিল্লৌঘযুক্তে’ আছে, উহাদ্বারা তিনি যদুপতিনগরকে বিশেষিত করিয়াছেন।
৮. ‘The whole face of the building and partly also of the towers is one mass of tracery and fig- ured ornament.** The figures are very well done and the tracery is all very perfectly regular, haveing none of the slipshod style which too often characterises native art in these districts.’- Westland, Jessore, 1871. PP. 44-5.
৯. কথাটা দেশময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছিল। এখনও লোকে যাহা কিছু একভাবে অনবরত চলিতে থাকে তাহার সহিত ‘কানাইবাড়ীর কীর্তনের’ তুলনা করিয়া থাকে।
১০. খেলারাম ঢাকার অন্তর্গত চাঁদপ্রতাপের একজন প্রসিদ্ধ ধনী। চাঁচড়ার মনোহর রায় নিজে উত্তর রাঢ়ীয় উচ্চ কুলীন এবং সীতারাম সেই সমাজের নিম্নশ্রেণীর কায়স্থ অথচ ধন জন সম্পদে তাঁহার অপেক্ষা উন্নত। সুতরাং উভয়ের মধ্যে দ্বেষাদ্বেষি ছিল; তাহা হইতে অনেক অপবাদের সৃষ্টি হইত।
১১. সীতারাম কায়স্থসমাজের মধ্যে আন্তর্গণিক বিবাহ প্রচলন করিবার উদ্দেশ্যে তাহার দৃষ্টান্ত নিজেই দেখাইবার জন্য, স্বকীয় উকীল বঙ্গজ কায়স্থবংশীয় মুনিরাম রায়ের কন্যা বিবাহ করিবার প্রস্তাব করেন। মুনিরাম আভিজাত্যে গর্বিত ছিলেন, সুতরাং তাহাতে রাজী হন নাই। তিনি তখন বাড়ী ছিলেন না; গল্প আছে, তাঁহার পুত্র নাকি বিষপ্রয়োগে ভগিনীকে হত্যা করিয়া সামাজিক গৌরব রক্ষা করিয়াছিলেন!
১২. সীতারামের একখানি সনন্দে আছে : ‘এই ব্রহ্মোত্তর জমি যে খাস করিবে, হিন্দু গো-গোস্ত খাবে। মুসলমান শূয়ার খাবে’, ইত্যাদি— যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ২৪৬ পৃ। ইহা কঠোর অশিষ্ট ভাষা বটে, কিন্তু ইহার মধ্যে নিজের দান অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা আছে। সনন্দদাতা সকল রাজন্যই এই প্রণালী অবলম্বন করিতেন। আবার যিনি সনন্দের মর্য্যাদা রক্ষা করিবেন, তাঁহার নিকটও ‘দাসানুদাস’ হইবার প্রবৃত্তি জানান হইত। শ্যামল বর্মার একখানি ভূমিদান পত্রে দেখিতে পাই :
‘স্বদত্তাং পরদত্তাং বা যো লভেচ্চ বসুন্ধরাং।
স বিষ্ঠায়াং কৃমি ভূত্বা পচ্যতে পিতৃভিঃ সহ।।
ময়া দত্তামিমাং ভূমিঃ যঃ করোতি হি পালনং।
তস্য দাসস্য দাসোহহং ভবেয়ং জন্মজন্মানি।।’
১৩. যে গোঁসাই গোরাচাঁদ সীতারামের সম্পর্কে এই সতর্ক মন্তব্য লিখিয়াছেন, বৈষ্ণবের কামুকতার প্রতি তিনি কি তীব্র কটাক্ষ করিতেন, তাহা তাঁহার অসংখ্য গানে ব্যক্ত হইয়াছিল। একটি গান এই :
‘বৈষ্ণব হঞা নারী সঙ্গ যার।
সে গৌড়দেশে হয় কলঙ্ক জাতিনাশা কুলাঙ্গার।।
গৌরপ্রেম কি সহজে হয়, বৈরাগ্য যার মূলাধার।
নারীর নফর বৈরাগী নাম হাড়িমারা সে নচ্ছার।।
গোসাঁই গোরাচাঁদে বলে ফেলায়ে নয়নের ধার।
যারা মণ্ডপে পায়খানা বনায়, তাদের নাম করো না আর।।’
রাজা সীতারামের এই জাতীয় দোষ থাকিলে সীতারামের মৃত্যুর পর যখন গোরাচাঁদ গ্রন্থ রচনা করিতেছিলেন, তখন তিনি কিছুতেই তাঁহাকে ক্ষমা করিতেন না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন