১১. শিল্প ও স্থাপত্য

সতীশচন্দ্র মিত্র

একাদশ পরিচ্ছেদ – শিল্প ও স্থাপত্য 

অতি সুপ্রাচীন কাল হইতে ভারতীয় সভ্যতা শিল্প-বিলাসে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। আদিম যুগে আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষাই মানবের প্রধান সাধনা হয়; ক্রমে সমাজ ও ধর্মরক্ষায় তাহাদের চিত্ত নিবিষ্ট থাকে; ইহার পর মানসিক স্ফূর্ত্তি বা আনন্দ প্রকাশের জন্য দেশমধ্যে কলা-বিদ্যার প্রচলন হয়। ভারতেও তাহাই হইয়াছিল। তবে ভারতীয় আর্য্যগণ যাহা যখন ধরিয়াছেন, তাহার শেষ না করিয়া ছাড়েন নাই; ‘ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি’—ইহাই তাঁহাদের ভাষা। একটি দুইটি নহে, ভারতে চতুঃষষ্টি কলা উদ্ভূত ও প্রচলিত হইয়াছিল। ৬৪টি মূল কলা হইতে শিল্প-কলার সমষ্টি ৫৮২ পৰ্য্যন্ত উঠিয়াছিল।[১] 

আধ্যাত্মিকতাই ভারতীয় সভ্যতার প্রধান প্রকৃতি; ভক্ত ভারত দেবপ্রীতির জন্য যেমন গানবাদ্যের উৎকর্ষ সাধন করে, তেমনই সঙ্গে সঙ্গে দেবচরিত্র চিত্রিত ও দেবমূৰ্ত্তি গঠিত হইত। উহা হইতে চিত্রবিদ্যা ভাস্কর্য্যের উদ্ভব হয়। চিত্র ও মূর্ত্তিগুলি সযত্নে সুরক্ষিত করিবার জন্য দেবমন্দির রচিত হইবার আবশ্যক হইয়াছিল; সেই জন্যই স্থাপত্য শিল্পকলার অঙ্গবিশেষ। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য এরূপভাবে ঘনিষ্ঠরূপে অপেক্ষিত যে, একটিকে বাদ দিয়া অন্যের কথা বলা চলে না। ভারতীয় প্রতিভা এই দুই বিদ্যার উৎকর্ষ সাধনে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করিয়াছিল যে, ভারতবর্ষের কোন নগণ্য অংশের ইতিহাস লিখিতে গেলেও তাহার দেবমন্দির বা দেবমূর্ত্তি অন্ততঃ সংক্ষিপ্ত পরিচয় না দিলে, সে ইতিহাসের অঙ্গহানি হয়। সামুদ্রিক বারিবিন্দুর মত আমাদের যশোহর-খুলনা অবশ্য নিতান্ত নগণ্য সামান্য স্থান মাত্র, তবুও ইহার নাতিপ্রাচীন মন্দির ও মূর্তি কিছু কিছু পুরাতন ভাব ও গৌরবের স্মৃতি বহন করিতেছে। 

প্রাচীন ভারতবাসীকে শুধু ধর্ম্ম-সৰ্ব্বস্ব বলিলে অবিচার করা হয়।` গৃহকর্ম্মেও তাঁহারা কম নিপুণ ছিলেন না; গোভিলাদি গৃহ্য-সূত্রে তাহার পরিচয় আছে। বাস্তুবিদ্যাকে তাঁহারা এত সুস্পষ্ট করিয়াছিলেন যে, সাধারণ শিল্পবিদ্যা উহার অঙ্গীভূত হইয়া পড়িয়াছিল। শ্রদ্ধেয় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বলেন, ‘মানব সভ্যতার প্রথম সোপান বাস্তু রচনা; গৃহ-নিৰ্ম্মাণ-কৌশল অধিগত করিয়াই মানব সমাজ নানাবিধ ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি লাভের অধিকারী হইয়াছে। গৃহকে কেবল প্রয়োজন সাধনের উপযোগী করিয়া গঠন করিয়াই মানব-সমাজ নিরস্ত হইতে পারে নাই। তাহাকে সাজসজ্জায় সুশোভিত করিবার আকাঙ্খা বিবিধ শিল্প-কৌশল উদ্ভাবিত করিয়া দিয়াছে। সুতরাং বাস্তবিদ্যাই শিল্প-বিদ্যার মূল বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। ৩ স্থপতিবিদ্যা এই বাস্তুশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং অতি পূৰ্ব্বকাল হইতে এদেশীয় লোক ইহার সূক্ষ্মতত্ত্বের অনুসন্ধান করিয়া সিদ্ধিলাভ করেন। 

বহু শতাব্দী পূর্ব্বে সমতটে সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে আমাদের আলোচ্য প্রদেশে যে ভাস্কর্য্য ও স্থাপত্যের বিকাশ হইয়াছিল, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের কথা আমরা প্রথম খণ্ডে নানাস্থানে বিচার করিয়াছি। এখানে প্রসঙ্গতঃ কতকগুলির নামোল্লেখ করিব মাত্র। সর্বাগ্রে ভাস্কর্য্যের কথা বলিতেছি। (১) বাগেরহাটের অন্তর্গত শিববাড়ির বুদ্ধমূর্ত্তি সর্ব্বপ্রথমে উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় স্থপতি বিভাগের (Indian Archaeological Department) সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহোদয় আমার সহিত ঐ মূর্ত্তি বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করিয়া স্বীকার করিয়া গিয়াছেন যে, এমন সুন্দর, এমন সৌষ্ঠব সম্পূর্ণ, বুদ্ধের জীবনাখ্যায়িকা জ্ঞাপক এত অধিক বিবরণযুক্ত, এমন মূর্ত্তিস্তবক (Stele) ভারতে আর আছে কি না সন্দেহ। তিনি আমাপেক্ষাও (১ম খণ্ড, ১৪১-১৪২ পৃ) কিছু কিছু নূতন তথ্যের সমুদ্ধার করিয়াছেন। (২) যশোরেশ্বরী দেবীর পীঠমূৰ্ত্তি (১ম খণ্ড, ১০৫ পৃ), সেখহাটির ভুবনেশ্বরী মূর্ত্তি (১ম খণ্ড, ১৫৫-১৫৬ পৃ), আমাদির চামুণ্ডা মূৰ্ত্তি (১ম খণ্ড, ১০৬-১০৭ পৃ), পাণিঘাটের অষ্টাদশভুজা মূর্ত্তি হিমাচল প্রদেশ হইতে আনীত, (১ম খণ্ড, ১০৭-১১০ পৃ)—এইগুলি এ প্রদেশের প্রাচীন নিদর্শন। (৩) যশোহর-খুলনার নানস্থানে যে বহুসংখ্যক চতুর্ভুজ বাসুদেব মূৰ্ত্তি বৰ্ত্তমান আছেন (১ম খণ্ড, ১৪৮-১৪৯, ১৫৬-১৫৯ পৃ) উহার রচনাকাল সহস্রাধিক বর্ষ পূর্ব্বে ধরা যায়। এই প্রসঙ্গে সেখহাট ও নলডাঙ্গার গণেশমূর্তির কথা বলিতে পারি। (৪) এতদ্ব্যতীত কষ্টিপাথরে বিনির্মিত যে সকল সুন্দর সুন্দর কৃষ্ণমূর্ত্তি ধাতু বা দারুময়ী রাধিকার সঙ্গে নানাস্থানে পূজিত হইতেছেন, উঁহাদের বয়স ৩/৪ শতবর্ষ হইবে। তবে প্রতাপাদিত্যের আনীত যে গোবিন্দদেব বিগ্রহ এক্ষণে কাটুনিয়ার রাজবাটীতে নূতন মন্দিরে (চলতি খণ্ড ২৪শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, সে মূর্ত্তির বয়স বেশী হইবে। ধাতু বা পাষাণের বালগোপাল মূর্ত্তি, শ্বেতকৃষ্ণ পাষাণে বা অন্যবিধ প্রস্তর খচিত ক্ষুদ্র বৃহৎ নানাজাতীয় অসংখ্য শিবলিঙ্গ, চাঁচড়ায় মহাবিদ্যা সমূহের সুন্দর দারুময়ী মূর্তিমালা, স্থানে স্থানে জগন্নাথ বা চৈতন্যদেবের দারুনির্ম্মিত স্বরূপ বিগ্রহ যশোহর-খুলনার সম্পত্তিমধ্যে গণ্য। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদিগের পুরাতন বংশে প্রত্যেকেরই গৃহবিগ্রহ ছিলেন, উঁহারই সম্পর্কে তাঁহারা চিহ্নিত ও পরিচিত হইতেন। সেদিন আর নাই; তাই কত শত অপূজিত শ্রীমূর্ত্তি বা শিবলিঙ্গের মন্দির চর্ম্মচটিকার আবাসভূমি হইতেছে! 

বিভিন্ন জাতির আক্রমণে, বিধৰ্ম্মীয় নির্যাতনে এবং শাসনযন্ত্রের অবিরাম বিবর্তনে যে আর কত দেববিগ্রহ বিলুপ্ত বা বিনষ্ট হইয়াছে, কত সৌধ চূর্ণীকৃত হইয়া স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহার হিসাব কবিরার সূত্র নাই। গত দুই হাজার বৎসর ধরিয়া এইরূপ জাতি বা ধর্ম্মগত অত্যাচার অবিচার চলিয়াছে। বৌদ্ধ হিন্দুর উপর, এবং হিন্দু বৌদ্ধের উপর অবিরত অত্যাচার করিয়াছে। ‘অহিংসা পরম ধর্ম্ম’ জীব-জন্তুর বেলায় যত খাটিয়াছি, মানুষের বেলায় তত খাটে নাই। দয়ার অবতার অশোকের রাজত্বকালেও জীবহত্যাকারী মানবকে শাস্তির জন্য হত্যা করা হইয়াছে। অনেক সময়ে মানুষের দয়ার পরিচয় প্রাণীতে যেমন পাইয়াছে, জড়বিগ্রহে বা ধর্মমন্দিরে তাহা পায় নাই। নতুবা সত্যনিষ্ঠ চীনদেশীয় পরিব্রাজক সমতটে যে ৩০টি সংঘারাম এবং একশত দেবমন্দির দেখিয়া গিয়াছেন, তাহা কোথায় গেল? বোধখানাকে বৌদ্ধস্থান বলিতে বোধ হয় কাহারও আপত্তি না হইতে পারে; সেখানে এখনও কতকগুলি পাথর পড়িয়া আছে, উহা কোথা হইতে আসিল? যেখানে কোন ধর্ম্মকেন্দ্র, সেই স্থানেই মুসলমান পীরগণ ধর্মপ্রচারে আসিতেন; চৈতন্য প্রভুও পতিতোদ্ধারের জন্য এমন অনেক নির্যাতিত স্থানে পদার্পণ করিতেন। তিনি বোধখানায় আসিয়াছিলেন, তথায় দ্বাদশ গোপালের অন্যতম কানাই ঠাকুরের শ্রীপাঠ আছে। পুরাতন কাহিনী সম্বন্ধে অনুমান করিবার কি কিছু নাই? আধুনিক বারবাজারের সন্নিকটে সাঁকো বা সঙ্কট নামে স্থান ছিল; কবিকঙ্কণে আছে, তথাকার সমৃদ্ধ বণিকেরা বহু বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করিতেন। কেহ কেহ অনুমান করেন, লক্ষ্মণ সেন নবদ্বীপ হইতে পলায়ন করিয়া এই সঙ্কট বা সাঁকনাটে আসিয়াছিলেন, উহাই মুসলমান ঐতিহাসিকের লেখায় সাত নকলে জগন্নাথ হইয়া গিয়াছে। বারবাজার যে এক সময়ে একটি জনবহুলা সমৃদ্ধ নগরী ছিল, তাহার পরিচয় পূর্ব্বে দিয়াছি (১ম খণ্ড ১২৪-১২৭ পৃ)। সেখানেও কতকগুলি প্রস্তর ও স্তম্ভ পড়িয়া রহিয়াছে, উহা কোথা হইতে আসিল? সম্প্রতি যশোহর শহরে চারখানি পাথর আবিষ্কার করিয়াছি; দুইখানি পুলিস সাহেবের বাড়ীর বাহিরে পড়িয়া আছে, একখানি কাব্বালা ট্যাঙ্কের পাহাড়ের কোণে অর্দ্ধপ্রোথিত অবস্থায় সিন্দুর-চর্চ্চিত ও দুগ্ধধৌত হইয়া পূজিত হইতেছে, অন্যখানি বচর গ্রামে অশ্বিনী বাবুর বাড়ীর বাহিরের প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরের সন্নিকটে মৃত্তিকা নিম্নে আবিষ্কৃত হইয়াছে। চারিখানিই  

রাজমহল অঞ্চলের কঠিন পাষাণ, প্রত্যেকখানি ১৫’’ ইঞ্চি বিস্তৃত এবং ৯/১০’’  পুরু, দৈর্ঘ্যও একখানির ৬’-১১’’ ইঞ্চি, অপরগুলির প্রায় ৬’ ফুট; পুলিশ সাহেবের বাড়ীর একখানি পাথরের মধ্যস্থলে চতুর্ভুজা মঙ্গলকলস-হস্তা লক্ষ্মীমূর্তি, অন্যখানিতে মধ্যস্থলে একটি অস্পষ্ট পুরুষ বা বিদ্যাধর মূর্ত্তি এবং বগচরের পাথরখানির নিম্নভাগে একটি মকরবাহনা গঙ্গামূর্ত্তি দণ্ডায়মানা। সব পাথরগুলিই আর্কিওলজিক্যাল বিভাগের সুপারিওেন্টেন্ট মহাশয়কে দেখাইয়া দিয়াছি; তিনি অনুমান করেন, প্রোথিত পাথরখানিতে একটি যমুনামূর্তি থাকিতে পারে। মোট কথা, এই চারিখানি পাথর পরীক্ষা করিলে, উহা কোন একটি প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের সদর দরজার চারি পার্শ্বের চারিখানি ফ্রেম, সে অনুমান বোধ হয় অসঙ্গত হইবে না।[৬] সম্ভবতঃ লক্ষ্মীমূৰ্ত্তিযুক্ত পাথরখানি উপরিভাগে ও পুলিশ সাহেবের বাড়ীর অন্য পাথরখানি নিম্নদেশে, বচরের পাথর খানি দক্ষিণভাগে এবং প্রোথিত পাথরখানি হয়ত বামভাগে ছিল। সে বিষ্ণু-মন্দির কোথায় গেল? সম্ভবতঃ মূৰ্ত্তিবিশিষ্ট বলিয়া চারিখানি পাথরই পরিত্যক্ত হইয়াছিল। মন্দিরের অন্য পাথর যে বাগেরহাট প্রভৃতি স্থানে নীত হয় নাই, তাহা কে বলিতে পারে? প্রোথিত পাথরখানির সন্নিকটে খাঁ জাহানের অনুচর বহরাম খাঁ পীরের ইষ্টক রচিত প্রকাণ্ড দরগা বর্ত্তমান। সেটিও কোন পুরাতন বৌদ্ধস্তূপের ভগ্নাংশ বলিয়া অনুমান করি। বাগেরহাটেও হিন্দু বৌদ্ধের প্রাচীন মন্দির ছিল। এবং তাহা সম্পূর্ণ প্রস্তর রচিত না হইলেও তাহার রচনায় যথেষ্ট পাথর ছিল, তাহার প্রমাণ অপ্রতুল নহে। এ বিষয়ে বিশেষ আলোচনা প্রথম খণ্ডে ষাট গম্বুজ ও মজিদকুড়ের মজিদ প্রসঙ্গে করিয়াছি। এখনও একখানি অষ্টভুজা মহিষমৰ্দ্দিনী মূর্তিযুক্ত প্রস্তরস্তম্ভ বাগেরহাটে জাহাজঘাটায় প্রোথিত আছে। ষাট গম্বুজের অনতিদূরে যেখানে খাঁ জাহানের আবাস গৃহ ছিল, সেখানে খুঁড়িতে গিয়া ১৪/১৫ খানি বড় পড় পাথর বাহির হইয়াছে। উহা দীর্ঘ ছড়ওয়ালা প্রাসাদের থামের খণ্ডাংশ এবং কতক বা অন্য প্রকারে ব্যবহৃত পাথর। ইহার অনেকগুলি ৮/১০ হাত মাটির নিম্নে প্রশস্ত ভিত্তিমূল খুঁড়িতে বাহির হইয়াছে, পার্শ্ববর্তী স্থানে আরও কত এমন পাথর লুক্কায়িত আছে, কে জানে? যে পালিশ করা পল তোলা খণ্ডগুলি বাহির হইয়াছে উহা জুড়িয়া দীর্ঘ থাম করিবার জন্য প্রত্যেকের কেন্দ্রস্থলে যে মোটা লৌহ পেরেক প্রোথিত ছিল, তাহা সেই অবস্থায় আছে। উহার একখানি নিটুট্ নিরেট পাষাণ খণ্ড যে এক সময়ে হিন্দুর আরাধ্য প্রকাণ্ড বাণলিঙ্গ শিবের গৌরীপট্ট বা নিম্নাংশ ছিল, তাহা বুঝিয়া লইতে কষ্ট হয় না। সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট মহাশয় উহার সাক্ষ্য দিতে পারেন। বাণলিঙ্গের বসিবার গর্ভটি আছে, স্নান জল সরিয়া পড়িবার নলী আছে। পাথরখানি ২৫’’ × ২৫’’ ইঞ্চি, উহার উচ্চতা সাড়ে ১৫’’ ইঞ্চি। এই গৌরীপট্ট দ্বারা একটি থামের নিম্নাংশ গঠিত হইয়াছিল, জোড়ার মুখ খুলিয়া গিয়া প্রকৃত মূর্ত্তি প্রকটিত করিয়াছে। যে বিরাট মন্দিরে এই বাণলিঙ্গ ছিল, তাহা এক্ষণে কল্পনাক্ষেত্রে দেখিবার জিনিস। 

ভরতভায়নার স্তূপের দীর্ঘ বিবরণ প্রথম খণ্ডে দিয়াছি। উহা যে গুপ্ত যুগের সমসময়ের বৌদ্ধস্তূপ, ইষ্টকাদির নানা নিদর্শনে তাহাও এক্ষণে স্থপতি বিভাগ কর্তৃক অনুমিত হইতেছে। উহার নিকট গৌরীঘনায় যে পাথরের কুমীর বা মকর এবং বিরাট স্তম্ভের পাদপীঠ ও ভগ্নমূর্তি পাওয়া গিয়াছে, তাহা লক্ষ্য করিবার বিষয়। সরকারী বিভাগের ব্যয়ে ভরতভায়না খনিত হইলে অনেক নূতন তত্ত্ব বাহির হইতে পারে। সরকারী রিপোর্ট [১ম খণ্ডের] পরিশিষ্টে দ্রষ্টব্য। 

প্রাচীন কীর্ত্তির উপর এইরূপ দারুণ দুরাচার (Vandalism) যে শুধু পূৰ্ব্বকালেই অনুষ্ঠিত হইত; তাহা নহে; ইংরাজ কোম্পানির আমলেও শাসকেরা উহা চক্ষু মুদ্রিত করিয়া প্রশ্রয় দিতেন একে গ্রীষ্মপ্রধান লবণাক্ত দেশ, তাহাতে আবার দুর্গম প্রদেশে অযত্নে থাকিলেই ইষ্টক রচিত গৃহগুলি বৃক্ষলতার লীলাভূমি হইয়া পড়ে। লবণাক্ত দেশে বৃক্ষলতাগুলি লবণের মর্যাদা মোটেই রক্ষা করে না, উহারা যাহাকে আশ্রয় করিয়া বড় হয়, সবলে শিকড় চালাইয়া তাহাকেই সৰ্ব্বাগ্রে ধ্বংস করে; আবার সাধারণ নির্ব্বোধ পল্লীবাসীরা স্বার্থের ও নূতনের এত পক্ষপাতী যে পুরাতনকে ধ্বংস করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না।[৭] সরকারী বিবরণী হইতে জানিতে পারি, মুর্শিদাবাদের নিজামত দপ্তরে ‘কিমাৎ খিতকার’ নামক একটি পৃথক্ বিভাগ ছিল, উহাতে গৌড়ের হর্ম্যগুলির ধ্বংসসাধন করিতে দিয়া প্রতি বৎসর পার্শ্ববর্তী জমিদারগণের নিকট হইতে ৮০০০ টাকা শুল্ক আদায় হইত।[৮] ইংরাজ আমলে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, রাজমহল ও রঙ্গপুর প্রভৃতি আধুনিক সহরগুলি প্রায় সম্পূর্ণই গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ হইতে গঠিত হইয়াছে।[৯] কত মসজিদ, মন্দির বা পুরাতন বাড়ী ভাঙ্গিয়া যে যশোহর-খুলনার কত স্থানে রাস্তা ও নীলকুঠি গঠিত হইয়াছিল, তাহার সংখ্যা নাই। মীর্জানগরের ইমারত ভাঙ্গিয়া রাস্তা নির্মাণের কথা যথাস্থানে (৩৬শ পরিচ্ছেদ) বলিয়াছি। 

কোম্পানীর হস্ত হইতে যখন মহারাণী ভিক্টোরিয়া এ দেশের রাজ্যভার গ্রহণ করেন, তখন হইতে হাওয়া ফিরিয়াছে। মহারাণীর আমলের প্রথম রাজপ্রতিনিধি সদাশয় লর্ড ক্যানিং ভারতীয় আর্কিওলজিকাল বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎপুত্র সপ্তম এডওয়ার্ডের প্রথম রাজপ্রতিনিধি মহামতি লর্ড কার্জ্জন ‘প্রাচীন-কীর্তি-সংরক্ষণ’ বিষয়ক নূতন আইন করিয়া চিরদিনের নিমিত্ত এদেশবাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়া রহিয়াছেন। দেশীয় পুরাতন কীর্তিরক্ষাকল্পে রাজার যে প্রজার নিকট একটা দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, তাহা উন্মুক্ত প্রাণে স্বীকার করিয়া, সংরক্ষণ কার্য্যের জন্য সর্ব্বজাতীয় ব্যবস্থা ও ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া দিয়া, তিনি অনুসন্ধানের নূতন পন্থা এবং ইতিহাস চর্চ্চার জন্য নবযুগের অবতারণা করিয়া গিয়াছেন। যশোহর-খুলনার মধ্যে ষাটগুম্বজ, খাঁ জাহানের সমাধি, মসজিদকুড়ের মসজিদ, ঈশ্বরীপুরের হামামখানা ও টেঙ্গা মসজিদ্ এবং মহম্মদপুরের রামচন্দ্রের বাটী, এই কীর্তিরক্ষার গণ্ডির মধ্যে পড়িয়াছে। আশা করি, এরূপ আরও অনেক উপযুক্ত পুরাকীর্তি এই ভাবে সংরক্ষিত হইবে। আমরা এক্ষণে যশোহর-খুলনার পুরাতন ইষ্টক-মন্দির ও মসজিদগুলির রচনাপ্রণালী ও উহার বিশেষত্ব এবং শ্রেণীবিভাগের বিচার করিয়া সঙ্গে সঙ্গে যেগুলি সংরক্ষণজন্য সদাশয় গবর্ণমেণ্টের কৃপাদৃষ্টি পাইবার যোগ্য, তাহারও প্রার্থনা জানাইব। 

ভারতবর্ষ বিস্তীর্ণ দেশ। নৈসর্গিক অবস্থা ও উপাদানের প্রভেদে প্রদেশ বিশেষে স্থাপত্যের ভিন্ন ভিন্ন বিকাশ হইয়াছে। পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে পাহাড়-পৰ্ব্বত নাই, তাই এ অঞ্চলের স্থায়ী গৃহ ইষ্টক-রচিত। পাহাড়িয়া দেশে যে ইষ্টক নাই, তাহা নহে; পশ্চিমাঞ্চলেও কোন কোন স্থানে পর্ব্বত-পৃষ্ঠে ইষ্টকমন্দির বর্তমান আছে। তবে সাধারণতঃ লোকে অনায়াসলভ্য উপাদানেরই পক্ষপাতী হয়। বঙ্গে ইষ্টক সহজলভ্য বা সুলভ হইলেও উপাদান হিসাবে উহা ভঙ্গুর বই অন্য কিছু বলা যায় না। বিশেষতঃ দক্ষিণ বঙ্গের মত সিক্তবাত ও লবণাক্ত দেশে ইষ্টকের আয়ু দীর্ঘ হয় না। তবুও ইষ্টকের একটা গুণ এই যে ইহা লইয়া কারু বা চারুশিল্পের খেলা চলে, শিল্পী ইষ্টক সাহায্যে স্বাধীন ভাবে বহুবিধ উচ্চনিম্ন ছোটবড় মনোমত গৃহ-রচনা করিতে পারেন। কিন্তু যে গৃহই তিনি নির্ম্মাণ করেন, তাহাতে দেশের প্রকৃতি বা চলনের মত একটা বিশিষ্টতা না থাকিয়া পারে না। ফার্গুসন লিখিয়া গিয়াছেন যে, ইষ্টকের উপর নির্ভর করিতে হইত বলিয়া বঙ্গদেশে সর্ব্বত্র খিলানের অধিক প্রয়োজন ও প্রচলন এবং এই বিষয়ে বঙ্গীয় রীতির একটা বিশেষত্ব আছে। শুধু তাহাই নহে, বংশনির্ম্মিত গৃহের ছাদের মত বঙ্গীয়েরা ইষ্টক-গৃহের ছাদও সমতল না করিয়া সময় সময় বর্তুলাকার করিতে ভালবাসে।[১০] কেন এমন হয়, তাহা দেখিতেছি। 

বাঙ্গালা দেশে বাঁশ খড় সুলভ ও অনায়াসলভ্য। এজন্য ধনীদরিদ্র সকলেই উহাদ্বারা গৃহ নির্ম্মাণ করে। গৃহের ছাদ চালদ্বারা গঠিত বলিয়া ঘরের নাম চালাঘর। চালের সংখ্যানুসারে উহা দ্বিবিধ—দোচালা এবং চৌচালা বা চৌরিঘর। পূর্ব্ববঙ্গের মত দোচালা ঘর তুলিবার রীতি অন্যত্র নাই, এজন্য দোচালা ঘরের অন্যনাম বাঙ্গালা ঘর, উহা বাঙ্গালীর বিশেষত্ব। ইষ্টক নির্মাণের সময় এদেশীয় লোকে সৰ্ব্বপ্রথমে দুই প্রকার পাকাঘর করিত; তন্মধ্যে চৌচালা ইষ্টক গৃহকে মন্দির বা মণ্ডপ বলে এবং উহা চূড়াকারে উচ্চ হইলে দেউল বা মঠ নাম দেওয়া হয়। দোচালা ইষ্টক-গৃহকে বাঙ্গালা-মন্দির বলে; উহার বারান্দা দেওয়া যায় না বলিয়া প্রায়ই দুইখানি জুড়িয়া দেওয়া হইত; পশ্চাতের খানিতে দেব-বিগ্রহ থাকিতেন এবং সম্মুখের খানি বারান্দারূপে ব্যবহৃত হইত; ঐরূপ মন্দিরের সাধারণ নাম জোড়-বাঙ্গালা। বাঙ্গালা-মন্দিরের নির্ম্মাণ পদ্ধতি যে কত পুরাতন, তাহা স্থির করা যায় না। কারণ বঙ্গদেশে যতগুলি ঐরূপ মন্দির দেখিতে পাই, তাহার কোনটিই ১৬শ শতাব্দীর পূর্ব্ববর্ত্তী নহে। মুসলমানী কীর্তির মধ্যে পাণ্ডুয়ার একলক্ষ্মী মসজিদে এবং গৌড়দুর্গের ফতে খাঁর সমাধিগৃহে এই প্রণালীর দৃষ্টান্ত দেখা যায়।[১১] 

বঙ্গীয় সাধারণ রীতি অনুসারে যশোহর-খুলনার মন্দিরগুলি অধিকাংশই চতুষ্কোণ এবং বারান্দাযুক্ত; মন্দিরের গর্ভাংশ প্রায়ই সমচতুষ্কোণ হয়। বাঙ্গালাগুলির এক একখানি দীর্ঘায়ত বটে, কিন্তু জোড়া একত্র ধরিলে বাহিরের মাপ প্রায়ই দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান দাঁড়ায়। চতুষ্কোণ মন্দিরগুলি একতল, দ্বিতল ও ত্রিতল হয়। চূড়াকে রত্ন বলে; উহার সংখ্যানুসারে একতলা মন্দির একরত্ন, দ্বিতল মন্দির পঞ্চরত্ন এবং ত্রিতল মন্দির নবরত্ন নাম ধারণ করে। রত্নের উপর ১টি, ৩টি বা ৫টি ত্রিশূল দেওয়া থাকিত, উহা বজ্রপাতভয় নিবারণ করিত। প্রথমতঃ রাজাদেশ না পাইলে এইরূপ ত্রিশূল বা ‘খুন্তী’ বসান যাইত না, শেষে সে রীতি ছিল না, সকল মন্দিরেই একটি বা তিনটি ত্রিশূল শোভা পাইত। দোতলা মন্দিরের গর্ভাংশ ক্ষুদ্রতর হয়, উহার একতলার চারি কোণে ৪টি এবং দ্বিতলের শীর্ষে ১টি, মোট ৫টি চূড়া থাকে। ত্রিতল মন্দিরের নিম্নতলের কোণশীর্ষে ৪টি, দ্বিতলের চারিকোণে ৪টি এবং ত্রিতলের মাথায় একটি, মোট ৯টি রত্ন থাকে। অধিকাংশ স্থলেই দোতলা নামমাত্র, উহাতে বাসের ঘর বা উঠিবার সিঁড়ি থাকে না। নবরত্ন মন্দিরে প্রায়ই দ্বিতলে বিগ্রহের বাসগৃহ ও সিঁড়ি থাকে, ত্রিতল অংশটি নামমাত্র হয়। পূর্ব্বে বলিয়াছি, যশোহর-খুলনার অধিকাংশ মন্দিরই চতুষ্কোণ, দুই একটি মাত্র ত্রিকোণ বা অষ্টকোণ মন্দির আছে। 

পঞ্চ বা নবরত্ন মন্দিরগুলি বারান্দাযুক্ত। পঞ্চরত্নগুলির একদিকে বা কদাচিৎ তিনদিকে সংলগ্ন বারান্দা থাকে, নবরত্নগুলির চতুর্দিকে বারান্দা থাকাই চাই। সম্মুখের বারান্দায় চারিটি স্তম্ভের উপর তিনটি খিলান থাকে; মধ্যবর্তী দুইটি থাম সম্পূর্ণ ও পার্শ্বের দুইটি অর্দ্ধেক স্তম্ভাকার এবং অবশিষ্টাংশ বৰ্দ্ধিত হইয়া কোণ পৰ্য্যন্ত দেওয়ালে পরিণত। খিলান তিনটি গৌড়ের কদম রসুল মজিদের মত সূচল (Pointed) অথবা উহা কার্যতঃ গোলাকার হইলেও বহির্ভাগে কৃত্রিমভাবে সূচল করিয়া দেওয়া হইত। সূচল খিলান সাধারণতঃ ‘মুসলমানী খিলান’ বলিয়া কথিত হইলেও, উহা যে ভারতবর্ষে মুসলমানগণ প্রবর্তিত করিয়াছিলেন, তাহা বলা যায় না। মহাপণ্ডিত হ্যাভেল প্রভৃতি সূক্ষ্মদর্শী শিল্পসমালোচকগণ বহু গবেষণার ফলে দেখাইয়াছেন, মুসলমান ধৰ্ম্ম প্রবর্তনের বহু শতাব্দী পূর্ব্বে এবম্বিধ খিলান মিশর, সিরীয়া, এশিয়া মাইনর ও ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল; ভারতের হিন্দু বৌদ্ধযুগে শিল্পীগণ উহা ব্যবহার করিতেন। সুলতান সেকন্দর শাহের সময়ে (১৩৫৮-৮৯) যে উহা প্রথম গৌড়ের বিখ্যাত আদিনা মজিদে প্রযুক্ত হয়, তাহা ঠিক নহে গৌড়ে বহু যুগ ধরিয়া হিন্দুরই রাজধানী ছিল; ঐ মসজিদও হিন্দুশিল্পীর কারুকর্ম মাত্র; উহা বিদেশ হইতে আগত মুসলমান শিল্পী দ্বারা গঠিত বলিয়া প্রমাণ নাই। মুসলমান আমলের পূর্ব্বে বঙ্গীয় শিল্পিগণ ব্রহ্মদেশে গিয়া এই প্রণালীতে বহু মন্দির ও চৈত্য নির্ম্মাণ করিয়া আসিয়াছিলেন।[১২] এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার স্থান এখানে নাই। এক্ষণে আমরা যশোহর-খুলনায় নানা স্থানে যে সকল হিন্দু মন্দির বা দেবস্থলী এবং মুসলমানের মজিদ্ বা সমাধিগৃহ আছে, তাহাদিগকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া তালিকা দিব। প্রসঙ্গক্রমে উহার অনেকগুলির উল্লেখ বা বর্ণনা এই পুস্তকের নানাস্থানে করিয়াছি, তাহার সন্ধান দিব[১৩] এবং কোন প্রসঙ্গে যেগুলির আলোচনা করা হয় নাই, তাহার সংক্ষিপ্ত কিছু বিবরণ দিয়া শিল্প-কাহিনীর উপসংহার করিব। 

মন্দির 

ক. ত্রিকোণ মন্দির। ঈশ্বরীপুরের চণ্ডভৈরবের মন্দির ইহার একমাত্র দৃষ্টান্ত (১৫শ পরিচ্ছেদ)। 

খ. চতুষ্কোণ মন্দির। ইহার কতকগুলি এক বা ততোধিক চূড়াযুক্ত এবং কতকগুলি সমতল ছাদ বিশিষ্ট। চূড়াওয়ালা মন্দিরগুলি প্রায়ই চৌচালা হিন্দু গুম্বুজের উপর চূড়াকারে পরিণত। চৌচালা গুম্বজ পাঠানেরাও নকল করিয়াছিলেন; বাগেরহাটের ‘ষাট গুম্বুজে’র (৭৭ গুম্বুজের) মধ্যবর্তী ৭টি গুম্বজ চৌচালা। চূড়ার সংখ্যানুসারে চতুষ্কোণ মন্দিরগুলিকে এইভাবে বিভাগ করা যায় : 

১. একরত্ন মন্দির— চাঁচড়ার শিবমন্দির (৩৮শ পরিচ্ছেদ), সত্রাজিৎপুরের মন্দির (৪৭শ পরিচ্ছেদ), অভয়ানগরের বড় মন্দির (৩৮শ পরিচ্ছেদ), শিবসা দুর্গের সন্নিকটবর্ত্তী কালীমন্দির (১ম খণ্ড, ৪৯-৫০ পৃ), নলডাঙ্গার গুঞ্জানাথ শিবমন্দির (৩৭শ পরিচ্ছেদ), এবং সাঁইহাটীর সুন্দর প্রাচীন মন্দির প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতদ্ভিন্ন সাধারণ গৃহস্থবাটীতে বা দেবস্থলীতে অধিকাংশ মন্দিরই এই জাতীয়। তন্মধ্যে মুড়লী, খুলনা—শিববাড়ী, বাঘুটিয়া (২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদ), পীলজঙ্গ (২য় অংশ, ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ), লখপুর, বাগেরহাট (মুনিগঞ্জ), খড়রিয়া (শিববাটী), নান্দুয়ালী (৩৭শ পরিচ্ছেদ), রায়গ্রাম (৩৬শ পরিচ্ছেদ), ধূলগ্রাম (৩৮শ পরিচ্ছেদ), বনগ্রাম (খুলনা), অভয়ানগর ও বুধহাটার মন্দির স্তবক, শ্রীধরপুর, নড়াইল প্রভৃতি স্থানের বহু মন্দিরের নাম করা যায়। 

২. পঞ্চরত্ন মন্দির— বসন্ত রায় প্রতিষ্ঠিত গোপালপুরের ভগ্ন মন্দির (২৪শ পরিচ্ছেদ), নলতার কৃষ্ণমন্দির (৩৪শ পরিচ্ছেদ), নলডাঙ্গা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির (৩৭শ পরিচ্ছেদ), কানাইনগরের হরেকৃষ্ণ মন্দির (৩৭শ পরিচ্ছেদ), বনগ্রামের মন্দির (৪৭শ পরিচ্ছেদ) এবং সোনাবাড়িয়ার দুইটি শিবমন্দির প্রধান। প্রায় সবগুলির বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি, কেবল সোনাবাড়িয়ার কথা নিম্নে বলিতেছি। 

৩. নবরত্ন মন্দির— দৃষ্টান্তস্বরূপ মাত্র ৩টি মন্দিরের কথা বলা যায়। বেদকাশীর মন্দির (২৪শ পরিচ্ছেদ), কিরূপ ছিল, জানা যায় নাই। ডামরেলীর সমাজমন্দির (৯ম পরিচ্ছেদ), ইছাপুরের নবরত্ন (১৫শ পরিচ্ছেদ), সোনাবাড়িয়ার শ্যামসুন্দর মন্দির। সোনাবাড়িয়ার এই সবরত্ন মন্দির বড় নয়নাভিরাম। খুলনার অন্তর্গত কলারোয়া হইতে ৫/৬ মাইল দূরে সোনাবাড়িয়া অবস্থিত; সেখানে পূর্ব্বে রেশম ও কার্পাস বস্ত্রের কারখানা ছিল, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি (২য় অংশ ১ম পরিচ্ছেদ)। চূড়াযুক্ত মন্দিরের মধ্যে বোধ হয় সোনাবাড়িয়ার নবরত্নই সর্বপ্রধান, তবে ইহার বয়স অধিক নহে উহার গায়ে অঙ্কিত যে অশুদ্ধ, অসম্পূর্ণ ইষ্টকলিপির এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়, তাহাতে পাই— ‘গ্রহবসু রসেন্দু শকাশে পণম্য দেবতপরং শ্রীরাধাশ্যামসুন্দর ইদং বনরত্নমন্দিরং পরমযত্নেন** রামেশ্বরাতুজ দীন শ্রীহরিরাম দাসেন কৃতং ১৬৮৯ সন ১১৭৪ জ্যৈষ্ঠ।’ অর্থাৎ এই মন্দির ১৬৮৯ শকে বা ১৭৬৭ খৃষ্টাব্দে হরিরাম দাস কর্তৃক শ্যামসুন্দর বিগ্রহের জন্য নির্ম্মিত হয়। মন্দিরের পাদদেশের বাহিরের মাপ ৩৩’ ×৩৩’, উচ্চতা তিন তলায় ১৩’+১৫’+১৩’ মোট ৪১’ ফুট। এই মন্দিরের পার্শ্বে যে অশুদ্ধ লিপিযুক্ত দোতলা ভোগ মন্দির আছে, তাহা ১৭১০ শকে বা ১৭৮৮ খৃষ্টাব্দে রাধাচরণ দাস কর্তৃক নির্ম্মিত হয়। উহারই দ্বিতলে বহুসংখ্যক বিগ্রহ রক্ষিত হইতেছেন। মন্দিরের পূর্ব্ব পার্শ্বে ৪টি শিবলিঙ্গ চারিটি ছোট ঘরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তন্মধ্যে ২টি লিঙ্গ ভগ্ন হইয়াছে। সম্মুখে দুইপার্শ্বে দুইটি পঞ্চবর শিবমন্দির আছে, একটিকে বুড়া শিবের মন্দির ও অন্যদিকে সদাশিবের মন্দির বলে। উভয়ই অত্যন্ত কারুকার্য্য মণ্ডিত। শেষোক্তটির গায়ে যে লিপি আছে, তাহা হইতে জানা যায় ‘রামবসুরসেন্দুমিতে’ অর্থাৎ ১৬৮৩ শকাব্দে বা ১৭৬১ খৃষ্টাব্দে হরিরাম দাস এই মন্দির রচনা করেন। উভয় শিবমন্দিরের মধ্যস্থলে একটি ছোট জোড়-বাঙ্গালা আছে। হরিরামের বংশীয়েরা কেহ কেহ নিকটবর্ত্তী স্থলে বসতি করিতেছেন। বিগ্রহগুলির নিত্যসেবার সুব্যবস্থা নাই! 

৪. সমতল ছাদবিশিষ্ট— ছাদবিশিষ্ট চতুষ্কোণ মন্দিরের মধ্যে ঈশ্বরীপুরের যশোরেশ্বরী মন্দির (১৬শ পরিচ্ছেদ), সেখহাটীর ভুবনেশ্বরীর মন্দির (১ম খণ্ড, ১৫৪-১৫৫ পৃ), চাঁচড়ার দশমহাবিদ্যার মন্দির (৩৮শ পরিচ্ছেদ), মহম্মদপুরের দশভুজা মন্দির ও রামচন্দ্র বিগ্রহের বাটী (৪৩শ পরিচ্ছেদ), এবং লক্ষ্মীপাশার প্রসিদ্ধ কালীবাটীর নাম করিতে পারি। 

গ. বাঙ্গালা মন্দির। দোচালা ক্রমোচ্চ ছাদযুক্ত বাঙ্গালা-মন্দির কতকগুলি অযুগ্ম থাকে এবং কতকগুলিকে যুগ্ম বা জোড়-বাঙ্গালা বলে। 

১. এক-বাঙ্গালা— এক বাঙ্গালা মন্দিরের দৃষ্টান্ত পরমানন্দকাটী, সেনহাটী (রাজা রাজবল্লভ সেন প্রদত্ত), এবং লোহাগড়ায় আছে। শেষোক্ত স্থানে জঙ্গল মধ্যে যে অভগ্ন পূর্ব্বদ্বারী বাঙ্গালাটি আছে, উহার বাহিরের মাপ ২০×১০-৬, ভিত্তি ২-৮ ইঞ্চি। উহার গায়ে যে ইষ্টকলিপি আছে তাহা এই : 

‘খসমুদ্ররসক্ষৌণী শকাব্দে শ্রীহরেগৃহং 
শ্রীমদভিরাম দত্তেন কৃতমিত্যৈকনিৰ্ম্মিতং।।’ 

অর্থাৎ ১৬৭০ শকে বা ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে এই কৃষ্ণমন্দির অভিরাম দত্ত কর্তৃক নিৰ্ম্মিত হয়। 

২. জোড়-বাঙ্গালা— সাধারণতঃ শিবের জন্য চৌচালা মন্দির ও শ্রীমূর্তির জন্য জোড়-বাঙ্গালা নির্ম্মাণ করিবার পদ্ধতি ছিল। এখনও বহুসংখ্যক জোড়-বাঙ্গালা দৃষ্ট হয়। চাঁচড়ার প্রাচীন শ্যামরায়ের মন্দির (৩৮শ পরিচ্ছেদ), মহম্মদপুরের কৃষ্ণজী মন্দির (৪৪শ পরিচ্ছেদ), রায়গ্রামের জোড়-বাঙ্গালা (৪৬শ পরিচ্ছেদ), মূলঘরের লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির (৪৭শ পরিচ্ছেদ), শালনগরের জোড়-বাঙ্গালা, ধুলগ্রামের কৃষ্ণমন্দির (৩৮শ পরিচ্ছেদ), লোহাগড়ার ও মহেশ্বরপাশার জোড়- বাঙ্গালার নাম করা যায়। ইহার প্রধান প্রধানগুলির বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি। কয়েকটির কথা সংক্ষেপে এখানে বলিতেছি। লোহাগড়ার নিকটবর্ত্তী শালনগরের চাক্লানবীশ উপাধিযুক্ত ব্রাহ্মণ ভূম্যধিকারিগণ বিখ্যাত। উঁহাদের পূর্ব্বপুরুষ রামভদ্র নবাব সরকারে চাকরী করিয়া ধনশালী হন, এবং নিজে বাসভূমিতে বহু কীৰ্ত্তিচিহ্ন রাখিয়া যান। তন্মধ্যে শ্রীমূর্ত্তির জন্য জোড়-বাঙ্গালা ও দোলমঞ্চ এখনও বৰ্ত্তমান। লোহাগড়ায় রায় যদুনাথ মজুমদার বাহাদুরের বাটীতে তাঁহার পূর্ব্বপুরুষ চন্দ্রশেখর মজুমদার কর্তৃক নির্ম্মিত একটি পুরাতন জোড়-বাঙ্গালা আছে। চন্দ্রশেখর হইতে ৭/৮ পুরুষ নামিয়াছে, অর্থাৎ এই মন্দিরের বয়স ২০০ বর্ষের কম নহে। সম্ভবতঃ রায়গ্রাম ও লোহাগড়ার জোড়-বাঙ্গালা এক সময়ে নির্ম্মিত। লোহাগড়ার মন্দিরটির পূর্ব্বদিকে সদর, উহা সম্পূর্ণ কারুকার্যখচিত। তিনটি খিলানের উপর তিনটি British Emblem অঙ্কিত আছে; আশ্চর্য্যের বিষয় এই, ইংরাজাধিকারের বহু পূর্ব্বে এই জাতীয় রাজচিহ্ন এ দেশীয় শিল্পীদিগের পরিজ্ঞাত ছিল। প্রত্যেক বাঙ্গালার ভিতরের মাপ ১২×৫, বাহিরের মাপ ১৭-৯ ×৮। ইহাতে কোন লিপি নাই। দৌলতপুরের নিকটবর্ত্তী মহেশ্বরপাশার জোড়-বাঙ্গালাটি বড়ই সুন্দর। প্রায় দ্বিশত বর্ষ পূৰ্ব্বে মল্লিক (শাণ্ডিল্য বন্দ্য) বংশীয় গোপীনাথ গোস্বামী নামক একজন সাধক-শ্রেষ্ঠ ভক্ত কর্তৃক গোবিন্দরায় বিগ্রহের জন্য এই মন্দির নির্মিত হয়।[১৪ ইহাতে যে ইষ্টকলিপি ছিল, তাহার অধিকাংশই খসিয়া পড়িয়া বিলুপ্ত হইয়াছে, যাহা আছে তাহা হইতে শেষ চরণের পাঠোদ্ধার করা যায় : 

‘*প্রশস্তি। শ্রীগোপীনাথনামা ক্ষিতিসুরসুতকে বৃষ্ণিরাশৌ দিনেশে। শ্রীহরিঃ’ 

ঘ. মঠ বা দেউল। চারিটি পুরাতন মঠের নাম করিতে পারি; জটার দেউল (১৯শ পরিচ্ছেদ), ইনার মঠ (৪৭শ পরিচ্ছেদ), রায়নগরের মঠ-মন্দির এবং কোদলার মঠ। ইহার মধ্যে জটার দেউল চব্বিশ-পরগণার অন্তর্গত হইলেও প্রতাপাদিত্য-প্রসঙ্গে তাহার বিবরণ দিয়াছি; ইনার ঘোষ-দুহিতার মঠের বিবরণও পূর্ব্বে দিয়াছি। উহার সঙ্গে রায়নগরের মঠের তুলনাও করিয়াছিলাম। এই রায়নগর মাগুরা (মহকুমা) হইতে ৭/৮ মাইল পূৰ্ব্বদিকে গোরাই (গড়ই) নদীর সন্নিকটে অবস্থিত। অতি কষ্টে পদব্রজে সেখানে পৌঁছিতে হয়। মঠটির উত্তর ও পশ্চিমদিকের দেওয়াল আছে, অপর দুইটি দেওয়াল নাই। বাহিরে মাপ ২২’-৩’’ ×২২’-৩’’, ভিতরের মাপ প্রত্যেক দিকে ১৩’-৫’’ ইঞ্চি; ভিত্তি ৪’-৫’’; ভিতরের উচ্চতা ২৫’ এবং চূড়া সমেত উচ্চতা ৪০’ ফুটের কম নহে। সম্ভবতঃ দক্ষিণ দিকে সদর ছিল। উত্তর দিকে বদ্ধ দরজার খিলানের উপর ৮ পংক্তিতে দুইটি শ্লোকে সুন্দর ইষ্টকলিপির কতকাংশ আছে, অবশিষ্ট ভাঙ্গিয়া পড়িয়া পাঠোদ্ধারের ব্যাঘাত করিয়াছে। যাহা আছে, তন্মধ্যে প্রথম শ্লোক হইতে জানা যায়, এই মন্দির শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের জন্য নির্ম্মিত এবং দ্বিতীয় শ্লোকের নিম্নোদ্ধৃত অংশ হইতে উহার সময় নির্দ্দেশ করা যায় : 

“শাকে ব্যোমামৃতকর-শর-ক্ষৌণি সংপাদিতেহস্মিন্ 
প্রাসাদোহয়ং ব্যরচি মহতা বিশ্বনাথাত্মজেন। 

ব্যোম=০, অমৃতকর=চন্দ=১, শর=৫, ক্ষৌণি-১; অর্থাৎ ১৫১০ শকে (১৫৮৮ খৃষ্টাব্দে) বা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে বিশ্বনাথের পুত্র কোন ভক্ত কর্তৃক এই প্রাসাদ বা মঠ বিনির্ম্মিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা শ্লোকে আত্মগোপন করিয়া দুইবার পিতৃনামে নিজপরিচয় দিয়াছেন। এই বিশ্বনাথাত্মজ কে, তাহা নির্ণয় করা যায় নাই। বোধ হয় তিনি কোন রাজনৈতিক পুরুষ নহেন। প্রবাদ এই, এই মন্দির মথুরাপুরের দেউল-নির্মাতা সংগ্রাম সাহার কীৰ্ত্তি। কিন্তু তিনি ১৬২১ খৃঃ অব্দের পূর্ব্বে বঙ্গে আসিয়াছিলেন বলিয়া মনে করি না। সে আলোচনা পূর্ব্বে করিয়াছি (৪০শ পরিচ্ছেদ)। সম্ভবতঃ যে শ্রোত্রিয়, ব্রাহ্মণ ‘রায়’-দিগের বসতির জন্য এই স্থানের নাম রায়নগর (রাইনগর নহে) হয়, বিশ্বনাথ ও তাঁহার কৃতী পুত্র সেই বংশীয়। মন্দিরটি অত্যন্ত কারুকার্য্য-খচিত সুন্দর ইষ্টকে নির্মিত। উত্তর দিকে লিপির অংশ বাদে ৯১টি চত্বরে পদ্ম ও লতাপাতা অঙ্কিত আছে। পশ্চিম প্রাচীরে দরজার উপরিভাগে ১২ খানি ছবি আছে, সবগুলিই শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও যুগলরূপ প্রভৃতি। উহা দেখিলে এটি যে কৃষ্ণ-মন্দির, তাহা বুঝিতে বাকী থাকে না। 

খুলনা হইতে বাগেরহাট যাইবার রেল-পথে যাত্রাপুর নামিলে তথা হইতে দুই মাইল দূরে কোলা গ্রাম; উহারই একাংশকে অযোধ্যা বলে। সেই স্থানে মরা ভৈরবের অনতিদূরে একটি উত্তুঙ্গ সুন্দর মঠ আছে, উহাকে সাধারণ লোকে ‘অযোধ্যার মঠ’ বলে। সম্ভবতঃ দক্ষিণভাগ বিধৌত করিয়া এক সময়ে বেগবান ভৈরব-নদ প্রবাহিত হইত, এখন চর পড়ায় নদীখাত একটু সরিয়া গিয়াছে। ইহা কোন দেব-মন্দির নহে; সম্ভবতঃ কোন মৃত মহাত্মার সমাধি-স্তম্ভ স্বরূপ এই মঠ রচিত হয়। উত্তরদিকে কোন দরজা নাই, অন্য তিন দিকে আছে। দক্ষিণে অর্থাৎ নদীর দিকে, কার্ণিসের নিম্নে দুই পংক্তিতে একটি ইষ্টকলিপি ছিল। প্রথম পংক্তির অক্ষরগুলি প্রায় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, যেটুকু পাইয়া পাঠোদ্ধার করিয়াছি, তাহা এই: 

‘**** শৰ্ম্মণা। 
উদ্দিশ্য তারকং (ব্রহ্ম) (প্রাসা) দোহয়ং বিনিৰ্ম্মিতঃ।’ 

তারকব্রহ্ম নাম কাহারও মরণের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়; মঠের প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাহাও বুঝা যাইতেছে। মাঠের নিম্নতল সমচতুষ্কোণ, ভিতরে প্রত্যেক দিকে ১’-৫’’, বাহিরে ২৭’-৮’’, ভিত্তি ৮’-৭১’’ ইঞ্চি। বাহিরের উচ্চতা মেজের উপর ৫০ ফুট হইবে। রক্তবর্ণ ইষ্টক রচিত উপরিভাগ এখনও খুব ভাল অবস্থায় আছে; নিম্নাংশে প্রবেশদ্বারের উপর খিলানের ইট কতক ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। খিলান দেখিলে মোগল আমলের হর্ম্য বলিয়া বোধ হয়। প্রত্যেক দরজা শীর্ষে হিন্দু শিল্পানুযায়ী চৌচালা গুম্বজ আছে। মন্দির গাত্রে সর্ব্বত্র শিল্পকলার বিকাশ। এই মঠ গবর্ণমেণ্টের স্থাপত্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষিত হইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। পূর্ব্ব প্রাচীরে একস্থানে দুইজন গজারোহীর পশ্চাতে দুইজন ধনুকধারীর ছবি এবং দক্ষিণপ্রাচীরের কার্ণিশের অগ্রভাগ মকরাঙ্কিত আছে। প্রবাদ এই, মঠটি প্রতাপাদিত্যের ব্যয়ে তাঁহার দ্বারপণ্ডিত অবিলম্ব সরস্বতীর স্মৃতিস্তম্ভস্বরূপ নিৰ্ম্মিত। উহা সমর্থন করিবার যোগ্য কোন প্রমাণ পাই না। এ প্রদেশে অবিলম্ব সরস্বতীর গতিবিধি ও স্মৃতিচিহ্নের পরিচয় পূর্ব্বে দিয়াছি (২৩শ পরিচ্ছেদ)। তবে রায়নগর ও অযোধ্যার মঠ যে প্রতাপের সমসাময়িক তাহাতে সন্দেহ হয় নাই। 

ঙ. অষ্টকোণ-মন্দির। অষ্টকোণ মন্দিরের দৃষ্টান্ত মহম্মদপুরের লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির। উহা দোতলা এবং সমতল ছাদবিশিষ্ট। 

চ. দোল ও রাসমঞ্চ এবং তোরণ ॥ এক সময়ে যশোহর-খুলনার সর্ব্বত্র দোল ও রাসযাত্রাদির উৎসব খুবই হইত; সঙ্গতি-সম্পন্ন ব্যক্তিরা তজ্জন্য ইষ্টকরচিত দোলমঞ্চ নিৰ্ম্মাণ করিতেন। যশোহরে মহম্মদপুর ও শালনগরে, খুলনায় কাটিপাড়া ও নতায় পুরাতন দোলমঞ্চ আছে। শুড়িখালির রাসমঞ্চের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি (২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদ)। ধূলগ্রামে ( ৩৮শ পরিচ্ছেদ), সেনহাটিতে ও চাঁচড়ার দশমহাবিদ্যার মন্দিরের সম্মুখে উৎকৃষ্ট তোরণদ্বার আছে। 

মসজিদ, ইমামবারা ও দরগা 

মুড়লীর ইমামবারা মহম্মদ মহসীনের মোতউল্লীদিগের সময়ে নির্ম্মিত হয়। ইহা এবং বহু মুসলমান পল্লীর আধুনিক জুম্মাঘর বা উপাসনা গৃহগুলি সমতল ছাদবিশিষ্ট। পীরের আস্তানার নাম দরগা। বিস্তৃত ময়দানে সর্ব্বসাধারণের নমাজস্থলে ইদ্‌গা রচিত হইত। অসংখ্য ইদ্‌গার তালিকা দেওয়া যায় না। মজিদগুলি গুম্বজওয়ালা। গুম্বুজের সংখ্যানুসারে উহাদিগকে শ্রেণীবিভক্ত করা যায়: 

ক. এক গুম্বজ। দরগা ও অধিকাংশ মসজিদই এক গুম্বজযুক্ত। প্রাচীন এক গুম্বজ মসজিদের মধ্যে রণবিজয়পুরে খাঁজাহান আলির সমাধি গৃহ (১ম খণ্ড, ২২৯-২৩০ পৃ) ও পার্শ্ববর্ত্তী বাবুর্চিখানা (১ম খণ্ড, ২৩২ পৃ), বারবাজার (১ম খণ্ড, ২০২ পৃ), চাকশিরি (১৯শ পরিচ্ছেদ) ও মৌতলার (২০শ পরিচ্ছেদ) মসজিদের নাম করা যায়। সাতক্ষীরার নিকটবর্ত্তী লাবসার মাইচাম্পার দরগা (১ম খণ্ড, ২৭৫ পৃ), যশোহরের গরিবশাহ মজিদ, মীর্জানগরের নিকট গোপালপুর ও মেহেরপুরের দরগা এবং তালার নিকটবর্ত্তী মদনমুন্সীর মজিদ উল্লেখযোগ্য। 

খ. তিন গুম্বজ।। মীর্জানগরের মজিদ (৩৬শ পরিচ্ছেদ) এই জাতীয়। অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা নিজবাটীতে ত্রিগুম্বজ মসজিদই করিতেন 

গ. চারি গুম্বজ॥ পরবাজপুরের প্রসিদ্ধ মজিদ (৮ম পরিচ্ছেদ) ত্রিগুম্বজ শ্রৌণভুক্ত, উহার সম্মুখে একটির স্থলে দুইটি ছোট গুম্বজ আছে মাত্ৰ। 

ঘ. পঞ্চম গুম্বজ। ধুমঘাটের প্রসিদ্ধ টেঙ্গা মসজিদ ইহার প্রধান দৃষ্টান্ত (১৬শ পরিচ্ছেদ)। বাগেরহাটের হুসেনশাহ মজিদ এই শ্রেণীভুক্ত, উহার গুম্বুজগুলির দুইটি সারির প্রত্যেকটিতে পাঁচটি গুম্বজ। 

ঙ. ষড় গুম্বজ।। তেঁতুলিয়ায় কাজিদিগের বাটীর মজিদ প্রধান দৃষ্টান্ত। উহার বাহিরের মাপ ৪৬৩৩ ফুট। 

চ. নব গুম্বজ ॥ বাগেরহাটের দিদার খাঁ মসজিদ ও মসজিদকুড়ের প্রসিদ্ধ উপাসনা গৃহ (১ম খণ্ড, ২০৪-২০৫ পৃ) এই শ্রেণীর প্রধান দৃষ্টান্ত। 

ছ. ষাট্ গুম্বজ (সাত গুম্বজ)॥ বাগেরহাটের ষাটগুম্বুজে ৬০টি স্তম্ভ আছে, কিন্তু গুম্বুজের সংখ্যা ৭×১১ অর্থাৎ ৭৭টি। সাতটি সারির প্রত্যেকটিতে ১১টি করিয়া গুম্বুজ ছিল। ইহার বিশেষ বিবরণ প্রথম খণ্ডে দিয়াছি। উহাতেই পাঠান মসজিদের গুম্বজ সংখ্যা সম্বন্ধীয় সাধারণ নিয়মের আলোচনা করিয়াছি (১ম খণ্ড, ২৮১-২৮২ পৃ)। 

.

পাদটীকা : 

১. পূজনীয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সর্ব্বসমেত ৫১৮টি কলার উল্লেখ করেন (‘মাসিক বসুমতী’ ১৩২৯, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭ পৃ) এবং শ্রদ্ধাস্পদ মৈত্রেয় মহোদয় উহাকে ‘অন্তর কলা’ সংজ্ঞা দিয়া মূল ৬৪ কলার সহিত সর্ব্বসমষ্টি ৫৮২ ধরিয়াছেন (‘সাহিত্য’, ভাদ্য, ১৩২৯, ৩৪৩ পৃ)। 

২. Grunwedel, Buddhist Art in India, p. I. 

৩. ‘সাহিত্য’, ভাদ্র, ১৩২৯, ৩৩৯-৪০ পৃ। 

৪. [পুরাতন যশোহর-রাজ্যের অন্তর্গত স্থান সমুদয় হইতে অধুনা আবিষ্কৃত নিম্নোক্ত উজ্জ্বল শিল্প- নিদর্শনগুলিও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য : 

(ক) বেড়াচাপা-চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন-কার্য্যের ফলে আবিষ্কৃত মথুরা-শিল্পীর নিদর্শন তুল্য আঃ খৃঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীর বুদ্ধের আবক্ষ লাল-বেলে-পাথরের বলিষ্ঠ মূৰ্ত্তি। ইহাই বঙ্গদেশে সৰ্ব্বাপেক্ষা পুরাতন বুদ্ধমূর্ত্তি। (১ম খণ্ড, ২৯৪-২৯৬ পৃ দ্র.) 

(খ) অনুরূপভাবে চন্দ্রকেতু গড়ে আবিষ্কৃত সুঙ্গ-কুশান যুগের অপূর্ব্ব কমনীয় পঞ্চচূড়-যক্ষিণী মৃৎফলক। (১ম খণ্ড, ২৯৪-২৯৬ পৃ দ্র.) 

(গ) বালাণ্ডার নিকটবর্ত্তী ভাঙ্গড় হইতে সম্প্রতি প্রাপ্ত মঞ্জুশ্রীদেবীর কষ্টিপাথরের নয়নাভিরাম ভঙ্গিমা- সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ দণ্ডায়মান মূৰ্ত্তি। ইহা আঃ একাদশ শতাব্দীর শিল্পসৃষ্টি। (১ম খণ্ড, ২৯৪-২৯৬ পৃ দ্র.) (ঘ) সুন্দরবনের খাড়ী অঞ্চল হইতে পরবর্ত্তীকালে সংগৃহীত ডোম্মনপালের পট্টোলীর পশ্চাদ্‌পটে উৎকীর্ণ মূর্তি। এলোরায় যে রেখা-নির্ভর চিত্র পরিকল্পনার সূত্রপাত হয়, ইহা তাহার এক পূর্ণ পরিণত রূপ বলা চলে। ইহার তারিখ, ১১৯৬ খৃষ্টাব্দ। (১ম খণ্ড, ১১৭-১৭৮ পৃ দ্রঃ)—শি মি 

৫. [প্রত্নতাত্ত্বিক কাশীনাথ দীক্ষিত মহোদয়—শি মি] 

৬. [গ্রন্থকারের এই ঐতিহাসিক অনুমান ও ভবিষ্যদ্বাণী বিজ্ঞাপিত হইয়া বর্তমান খণ্ড ১৩২৯ সালে পৌষ মাসে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। মাসার্দ্ধকাল যাইতে না যাইতে মাঘ মাসেই যশোহর সহরের পশ্চিমোত্তর কোণে পুরাতন কসবায় পদ্মপুকুরের অনতিদূরে ইটখোলার তিন হাত মাটির নিম্নে এক প্রকাণ্ড চতুর্ভুজ বাসুদেব মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হয় (১ম খণ্ড, ১৫৭-১৫৮ পৃ)। পেরিপ্লাসে উল্লেখিত গঙ্গে বা গঙ্গারোজিয়া সহর দেগঙ্গা বা দ্বিগঙ্গাতে অবস্থিত ছিল বলিয়া গ্রন্থকারের যে আর একটি ঐতিহাসিক অনুমান বৰ্ত্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য্যের ফলে সপ্রমাণিত হইতে চলিয়াছে, তাহাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় (১ম খণ্ড, ১১৪-১১৫ পৃ ও ২৯৪ পৃষ্ঠার ‘পরিশিষ্ট। গ’ এবং মঞ্জুশ্রী কষ্টি-পাথরমূর্ত্তি, ভাঙ্গড়; পঞ্চচূড় যক্ষিণী মৃতফলক, চন্দ্রকেতুগড়। এই শিরোণামের ছবিসমূহ দ্র.)—শি মি] 

৭. ‘Many of them (Monuments) are in out-of-the-way places and are liable to the combined rav- ages of a tropical climate, an exhuberant flora, and very often a local and ignorant population who see only in an ancient building the means of inexpensively raising a modern one for their own convenience.’ Speech of Lord Curzon delivered to the Asiatic Society of Bengal.

৮. Grant’s Essay (Fifth Report, p. 285); J. A. S. B., 187. p. 303 note. 

৯. ‘Vandalism as well as Time has contributed to the general destruction of the ancient capital. There is not a village, scarce a house in the district of Maldah or in the surrounding country that does not bear evidence of being partially constructed from its ruins. The cities of Murshidabad. Maldah, Rajmahal and Rangpur have almost entirely been built with materials from Gour.’-Ravenshaw, Gour. p. 2; They (Mahomedan Governors) had to depend almost entirely on Hindu artisans for con- struction and for materials they utilised the fragments of Hindu temples they had demolished.’-J. A. S. B. 1910. pp.-24-5-Pre-Moghal Mosques of Bengal by M. M. Chakravert; ‘Many indeed of the old Mahomedan mosques were Themselves built up with materials plundered from still more ancient Hindu Temples’-Arch. Survey, 1902-3. p. 21-Annual Report, by sir John Marshall.

১০. Fergusson. History of Architecture. Vol. III. p. 545. 

১১. J. A. S. B., May. 1909-Article by M. M. Chakravarti. 

১২. ‘The Bengali builders being brick-layers rather than stone-masns had learnt to use the radiat- ing arch whenever it was useful for constructive purposes long before the Mahomedans came there’-Havell, Indian Architecture. pp. 52-6. See also-Fergusson, History of Architecture, Vol. II. p. 353; Mitra, Rajendralal, Budhgaya, Ch. III. pp. 101-3; Ganguly, Monomohan. Orissa and Her Remains. 1912. p. 108-9; Dawn Magazine. April-May, 1913. p. 106. 

১৩. প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা সংখ্যার পূর্ব্বে ‘১ম’ লেখা থাকিবে; শুধু পৃষ্ঠাসংখ্যা থাকিলে দ্বিতীয় খণ্ডের বর্তমান সংস্করণ বুঝিতে হইবে। 

১৪. চাঁচড়ারাজ এই বিগ্রহের সেবার্থ ১০০ বিঘা নিষ্কর দান করেন। গোপীনাথের বৃদ্ধপ্রপৌত্রগণ এখনও জীবিত। তাঁহারা ভিক্ষালব্ধ অর্থে মন্দিরের সংস্কার কার্য্যে ব্রতী হইয়াছেন। আর্কিওলজিক্যাল বিভাগের সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট মহাশয় এই মন্দির দেখিয়া ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। 

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন