২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ

সতীশচন্দ্র মিত্র

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – রামচন্দ্রের বিবাহ

বালার অধীশ্বর কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্রের সহিত প্রতাপাদিত্যের কন্যার বিবাহ-প্রস্তাব পূৰ্ব্ব হইতেই স্থির ছিল; পুত্রকন্যা উভয়ে তখন নিতান্ত শিশু বলিয়া বিবাহ হয় নাই; এ কথা পূৰ্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। সম্ভবতঃ ১৬০২ খৃঃ অব্দের শেষভাগে রাণী পুত্রের বিবাহের উদ্যোগ করিয়া দিনস্থির করেন; কারণ, এসময়ে প্রতাপের কন্যা বিমলা বা বিন্দুমতীর[১] বয়স দ্বাদশ বর্ষ হইয়াছিল; সাধারণতঃ তদপেক্ষা অধিক বয়সে বিবাহ দিবার রীতি ছিল না। রামচন্দ্রেরও বয়স তখন ১৩/১৪ বৎসর মাত্র। রাণী বিধবা হওয়ার পর এই তাঁহার প্রথম আনন্দোৎসব; সুতরাং জ্যেষ্ঠ পুত্রের শুভ বিবাহ উপলক্ষে তিনি যথেষ্ট ব্যয়ের আয়োজন করিলেন। মাধবপাশা হইতে যশোহর বহু দূরের পথ; নৌকা যান ব্যতীত যাতায়াতের অন্য পন্থা নাই। সুতরাং বিবাহ-যাত্রার জন্য বহুসংখ্যক নানা জাতীয় সুন্দর সুন্দর নৌকা সুসজ্জিত হইল; বরপাত্র ও তাঁহার সহযাত্রীদিগের জন্য ২/১ খানি মহলগিরি প্রভৃতি সুন্দর তরণী প্রস্তুত রহিল; আবশ্যক মত কয়েকখানি কামানযুক্ত সুদীর্ঘ কোশা নৌকাও সঙ্গে চলিল। অবশেষে অসংখ্য সামাজিক ও লোকলস্কর সঙ্গে লইয়া বালার রাজপুত্র রামচন্দ্র মহাসমারোহে বিবাহার্থ যশোহর যাত্রা করিলেন এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া প্রতাপাদিত্যের রাজধানীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হইলেন। রামমোহন মল্ল নামক একজন প্রসিদ্ধ কায়স্থ বীর রামচন্দ্রের শরীর-রক্ষী সৈন্যবর্গের অধিনায়ক ছিলেন।[২] বর্তমান উজিরপুরের সিংহ- রায়গণ এই রামমোহনের বংশধর।[৩]

এ দিকে মহারাজ প্রতাপাদিত্যেরও স্নেহের পুত্তলী কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ; তিনি এ সময়ে দূরবিস্তৃত সমৃদ্ধ রাজ্যের একচ্ছত্র রাজা; তাঁহার জ্ঞাতিবর্গের সমস্ত প্রভুত্ব বিলুপ্ত হইয়াছে; কিছুদিন পূর্ব্বে তিনি স্বীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছেন। যদিও মোগলের আক্রমণ ভয়ে তাঁহাকে সর্ব্বদা সতর্ক ও যুদ্ধার্থ থাকিতে হইত, তবুও তাঁহার জীবনের এই সর্ব্বাপেক্ষা উন্নত সময়ে কন্যার বিবাহ উপলক্ষে তিনি যশোহরে আনন্দের স্রোত বহাইয়া দিয়াছিলেন। ইহার বিশেষ কোন বিবরণী দিতে গেলেই তাহা কাল্পনিক না হইয়া পারে না। সুতরাং ঐতিহাসিককে শুধু আভাস মাত্র দিয়া ক্ষান্ত হইতে হয়। তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, দুইটি বিশিষ্ট ও কুলীন-প্রধান ভুঞা রাজপরিবারের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই বিবাহ উৎসব প্রকৃতই রাজোচিত মহাসমারোহে সুসম্পন্ন হইয়াছিল। ঘটকদিগের বংশকারিকা হইতে জানিতে পারিয়াছি (১১শ পরিচ্ছেদ), প্রতাপাদিত্য প্রথম যে কন্যার বিবাহ দেন, সে জামাতা কুলীন হইলেও রাজবংশীয় নহেন এবং তিনি উপগ্রহবৎ যশোহরেই বাস করিতেন। এবার প্রতাপ পরমকুলীন রাজা রামচন্দ্রকে বিনা পণে কন্যা সম্প্ৰদান করিবার অবসর পাইয়াছেন, সুতরাং তাঁহার আনন্দ আর ধরে না। বহুদূর হইতে সমাগত উভয় পক্ষের নিমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গের অভ্যর্থনায় এবং পান-ভোজনের বিপুল আয়োজনে সে আনন্দ ফুটিয়া পড়িতেছিল। সম্ভবতঃ বিবাহের পর বরপক্ষের সামাজিকগণ অধিকাংশই মর্য্যাদানুরূপ সম্মান লাভ করিয়া বাক্লায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন; কেবলমাত্র রামমোহন প্রভৃতি সামন্ত শরীর-রক্ষী সৈন্য লইয়া কিছুকাল রামচন্দ্রের সহিত যশোহরে ছিলেন। এমন সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটিল।

রামাই ঢুঙ্গী নামক একজন নরসুন্দর জাতীয় ভাঁড় রামচন্দ্রের বরযাত্রিদলের সঙ্গে ছিল। ভাঁড়ামি তাহার ব্যবসায়; সে নানা ভঙ্গিতে রঙ্গরসে সকলকে মোহিত করিয়া দেশে বিদেশে বাহবা লইত।[৪] বিবাহের আসরে সে অনেক ভাঁড়ামি করিয়া হাস্যরসের আমদানী করিয়াছিল; ভাঁড় বলিয়া অনেকে তাহার অনেক রঙ্গ সহ্য করিয়াছিল। অবশেষে সে মাত্রা ছাড়াইল। একদিন সে শ্মশ্রুগুম্ফ কামাইয়া স্ত্রীবেশে অন্দর মহলে ঢুকিল এবং মহারাণীর সহিতও রসিকতা করিতে ছাড়িল না। হঠাৎ তাহার কোন রহস্যে মহারাণী দুঃখিত ও অপমানিত বোধ করিলেন; অবশেষে যখন জানা গেল যে, সে ছদ্মবেশী পুরুষ লোক, তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন এবং রাত্রিকালে সেই ঘটনা প্রতাপাদিত্যের কর্ণগোচর করিলেন। সুন্দরবনের সেই দুর্দান্ত ব্যাঘ্রতুল্য নরপতি মহারাণীর কথা শুনিবামাত্র ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন; হয়ত তিনি সে সময় অত্যন্ত চিন্তাক্লিষ্ট বা সুরাপানে অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। তিনি ভাবিলেন, জামাতা রামচন্দ্র এ জন্য দোষী, তাই রুক্ষ্মকণ্ঠে হুকুম দিলেন, রামচন্দ্ৰ ও রামাই ভাঁড় উভয়েরই গদান লইতে হইবে। কথাটা তখনই অন্দর মহলে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল; লোকে ভাবিল, রাজার হুকুম, ইহা নড়িবে না। মহারাণী ব্যস্ত ও অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন, তিনি এত আশঙ্কা করেন নাই। এ সময়ে রামচন্দ্র শয়নঘরে ছিলেন, বালিকা বিমলা মায়ের নিকট হইতে সর্ব্বনাশের সংবাদ পাইয়া দৌড়িয়া গিয়া স্বামীকে জানাইল। রামচন্দ্র অল্পবয়স্ক যুবক, তিনি প্রাণভয়ে অস্থির হইয়া পড়িলেন। এমন সময়ে যুবরাজ উদয়াদিত্য আসিয়া তাঁহাকে বুঝাইলেন, কিন্তু কিছুতে তাঁহাকে শান্ত করিতে পারিলেন না। প্রতাপাদিত্যের এমন ক্রোধ যে সহসা প্রজ্বলিত হইয়া একটু পরে নিভিয়া যাইত এবং তাঁহার স্নেহার্দ্র হৃদয় উন্মুক্ত করিয়া দিত, উদয়াদিত্য তাহা জানিতেন। কিন্তু রামচন্দ্রের তাহাতে প্রত্যয় হইল না। তাঁহাকে অত্যন্ত ব্যাকুল দেখিয়া অবশেষে যুবরাজ কৌশল করিয়া তাঁহার পলায়নের পথ সোজা করিয়া দিলেন। রামচন্দ্র গোপনে সদলবলে নৌকায় উঠিলেন এবং চৌষট্টি দাঁড়যুক্ত নিজ তরণীতে উঠিয়া দ্রুতবেগে সেই রাত্রিতেই স্বদেশাভিমুখে পলায়ন করিলেন।[৫] তাঁহার সেই দ্রুতগামী কোশা নৌকাতে কামান সজ্জিত ছিল। যখন তাঁহারা নিরাপদে বাহিরে বড় নদীতে পড়িলেন, তখন কামানে অগ্নি সংযোগ করা হইল; তোপধ্বনির কারণ অনুসন্ধান করিয়া রাত্রিশেষে প্রতাপাদিত্য বুঝিলেন, রামচন্দ্র পলাইয়া গেলেন। তিনি তখনই তাঁহাকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোন ফল হইল না। সম্ভবতঃ তাঁহার সংবাদবাহক রামচন্দ্রের নৌকা ধরিতে পারে নাই, অথবা পারিলেও রামচন্দ্র শ্বশুরের ব্যবহারে ক্রোধান্ধ হইয়া ফিরিয়া আসিতে সম্মত হন নাই।[৬]

ব্যাপারটা এই মাত্র। ইহার ফলে কিন্তু প্রতাপের স্কন্ধে কলঙ্কের ডালি চাপিয়াছে। অনেকেই মনে করেন, তিনি জামাতার হত্যা সাধন করিয়া তাঁহার রাজ্য বা সমাজাধিপত্য দখল করিবেন, ইহাই তাঁহার কল্পনা ছিল; রামাই ঢুঙ্গির ঢঙ্গটা একটা উপলক্ষ্য মাত্র, রামচন্দ্রকে খুন করার উদ্দেশ্য তাঁহার পূর্ব্ব হইতে মনে মনে ছিল। ইহার উত্তরে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক; প্রথমত; হিন্দুর ছেলে প্রতাপ কি এতই রক্ত-পিপাসু পাষণ্ড ছিলেন যে, বিবাহান্তে বালিকা কন্যাকে বিধবা করিয়া জামাতা খুন করিতে উদ্যত হইবেন? দ্বিতীয়তঃ, সেই উদ্দেশ্যই যদি থাকিত, তবে বরযাত্রিগণ যশোহরে পৌঁছান মাত্র বিবাহের পূর্ব্বাহ্নে রামচন্দ্রকে খুন করা তাঁহার পক্ষে কি অসম্ভব হইত? প্রতাপাদিত্যের কি একটু বুদ্ধি-কৌশলও ছিল না? তৃতীয়তঃ সত্যসত্যই যদি তিনি রামচন্দ্রকে হত্যা করিবেন বলিয়া মনে ভাবিতেন, তবে কি রামচন্দ্র পলায়নের পন্থা পাইতেন? তৎক্ষণাৎ তাঁহার হুকুম তামিল করিবার লোক কি পুরীর মধ্যে ছিল না? চতুর্থতঃ, কন্যার মঙ্গল, মাতা যেমন দেখেন, অন্যে তেমন দেখে না; মহারাণী রামাই ভাঁড়ের উপর অসন্তুষ্টা হইয়াছিলেন এবং তাহার কারণও ছিল; জামাতার প্রতি তাঁহার আক্রোশ হইতে পারে না; প্রতাপাদিত্য রাক্ষস হইলেও মহারাণীর তেমন কোন অপবাদ ছিল না; সম্মুখে জামাতার হত্যার উপক্রম হইলে, তিনি কি কোন প্রকার প্রবোধ বা কাতর প্রার্থনা দ্বারা তাহা রদ্ করিতে পারিতেন না? পঞ্চমতঃ, প্রতাপের সে সংকল্প যদি থাকিত, তাহা হইলে তিনি ভাবী আত্মীয়তার প্রত্যাশায় বালা রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে চেষ্টা করিতেন না এবং প্রয়োজন হইলে কন্দর্পের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই স্ববলে দেশ অধিকার করিবার জন্য উদ্যোগী হইতেন। যে ভাবেই আমরা দেখিতে চেষ্টা করি, প্রতাপাদিত্য একেবারে মূর্খ বা একান্ত দস্যু-প্রকৃতির না হইলে জামাতাকে হত্যা করিতে উদ্যত হইতেন না। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, দৈবদোষে হঠাৎ পিতৃব্যকে হত্যা করিয়া তিনি চরিত্র কলঙ্কিত ও জীবন ব্যর্থ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। নতুবা যাঁহার দান-ধর্ম্মের শুভ্র যশোরাশি দিগন্ত আলোকিত করিয়াছিল, পুত্র-প্রতিম জামাতার হত্যা সাধনের নারকীয় প্রবৃত্তি তাঁহার স্কন্ধে আরোপিত হইতে পারে না।

ক্রোধান্ধ হইয়া প্রতাপাদিত্য রামাই ভাঁড়ের সঙ্গে রামচন্দ্রের হত্যার হুকুম চীৎকার করিয়া দিতে পারেন; এ কথা হয়ত অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বাস্তবিক পক্ষে তাঁহার মানসিক এই জাতীয় কোন সংকল্প জাগিয়াছিল বলিয়া ধরিতে পারি না। অনেক পিতা ঘটনাচক্রে ক্রোধান্ধ হইয়া রুক্ষকণ্ঠে পুত্রের মৃত্যুর আজ্ঞা দিয়া থাকেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁহার হৃদয়ের ভাব স্বতন্ত্র থাকে এবং যাহারা সে হুকুমের ভাষা শুনে, তাহারাও সত্য বলিয়া উহা ধরিয়া লয় না। তাই মনে হয়, এইরূপ এক প্রকার রাগত ভাষায় প্রতাপ জামাতাকে হত্যা করিবার কথা বলিয়া ফেলিয়াছিলেন, কিন্তু কাৰ্য্যতঃ তাহা মৌখিক ক্রোধের চিহ্ন মাত্র। সে শব্দে অন্দর মহল ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেও, প্রতাপাদিত্য নিজ আদেশ প্রতিপালিত হওয়াইবার জন্য আর কিছু করিয়াছিলেন বলিয়া কোন প্রমাণ নাই। রাত্রিশেষে তিনি যখন কামানের শব্দে জানিলেন যে, রামচন্দ্র পলায়ন করিয়াছেন, তখন তিনি অবস্থার গুরুত্ব বুঝিলেন এবং নিশ্চয়ই নিজে অনুতপ্ত হইয়া রামচন্দ্রকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন; সে চেষ্টায় কোন কাজ হয় নাই। তখন তিনি জামাতার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়া রহিলেন এবং তাঁহার সহিত সম্বন্ধ রহিত করিয়া দিয়াছিলেন। হয়ত তিনি ভাবিয়াছিলেন, ‘যম জামাই ভাগিনেয় কখনও আপনার হয় না।’

অনেক সহৃদয় লেখক প্রতাপের চরিত্র সম্বন্ধীয় এই নারকীয় প্রবাদ সত্য বলিয়া ধরিতে পারেন নাই। রোহিণীকুমার লিখিয়া গিয়াছেন, ‘বাস্তবিক পক্ষে প্রতাপের ন্যায় চরিত্রে এই সকল কথা কতদূর সত্য জানি না। শত্রুপক্ষ হইতে প্রতাপের সম্মান খর্ব্ব করিবার জন্য হয়ত মিথ্যা রটনা মাত্র। তাঁহার এই লোকাতীত প্রতিভা, অসাধারণ বাহুবল, দিঙ্মন্ডল বিঘোষিত শুভ্র যশোরাশি অবলোকন করিয়া ঈর্ষাপরবশ শত্রুগণ, আত্মীয়-বিচ্ছেদ মানসে প্রতাপের নামে অনর্থক এই প্রবাদের সৃষ্টি করিয়া তাঁহার শুভ্র যশোরাশিতে কালিমা ঢালিতে চেষ্টা করিয়াছিল।’[৭] শুধু এই একজন লেখক নহেন, বহুজনে মনে করেন, বসন্ত রায় ও তাঁহার পুত্রগণের ষড়যন্ত্রে প্রতাপের সহিত তাঁহার জামাতার বিবাদ সৃষ্টি করিবার জন্য, রামাই ভাঁড়কে প্ররোচিত করিয়া এই ঘটনা সংঘটিত হয়। কিন্তু ঘটনার এই কারণ আমরা মানিয়া লইতে পারি না। আমরা পূৰ্ব্বেই দেখাইয়াছি, ইহার ৭/৮ বৎসর পূর্ব্বে বসন্ত রায় ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র গোবিন্দ রায় প্রতাপহস্তে নিহত হন। কচু রায় এ সময় আগ্রা বা রাজমহলে ছিলেন; চাঁদ রায় প্রভৃতি বসন্তের অন্য পুত্রগণ কোথায় কি ভাবে ছিলেন, ঠিক জানা যায় না। যেখানেই থাকুক, তাঁহাদের কোন ষড়যন্ত্র করিবার সাহস বা সুযোগ ছিল বলিয়া মনে হয় না।

যাহা হউক, রামচন্দ্র নিরাপদে মাধবপাশায় পৌঁছিয়া শ্বশুর বা পত্নীর সহিত সকল সম্বন্ধ রহিত করিলেন; তিনি উঁহাদের নাম পর্য্যন্ত শুনিতে পারিতেন না। শ্বশুরের প্রতি তাঁহার ক্রোধের কারণ ছিল; কিন্তু যে বালিকা স্ত্রী একান্ত পতিব্রতার মত হয়ত পিতার বিরাগভাজন হইয়াও, স্বামীর জীবন রক্ষার হেতু হইয়াছিলেন, তাঁহার প্রতি বিরূপ হওয়া রামচন্দ্রের পক্ষে অর্ব্বাচীনতার পরিচায়ক ভিন্ন কিছু নহে। রামচন্দ্রের সে বার যশোহর যাত্রাই কেমন অমঙ্গলসূচক ছিল। তিনি ভাবিয়াছিলেন মাধবপাশায় পৌঁছিলে নিরুদ্বেগ হইবেন, কিন্তু বিধির চক্রে নূতন বিপদ তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। তাঁহার অনুপস্থিতি কালে আরাকাণের রাজা হঠাৎ বালা আক্রমণ করিয়া কতগুলি স্থান অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন। ডু-জারিকের বিবরণী হইতে জানিতে পারি, ‘আরাকাণ-রাজ পর্তুগীজদিগের হস্ত হইতে সন্দ্বীপ অধিকার করিয়া গর্ব্বে আত্মহারা হইয়াছিলেন; এক্ষণে বঙ্গের অন্যান্য সকল রাজ্য দখল করিয়া লইবার মতলব করিয়া তিনি অকস্মাৎ বালা রাজ্যের উপর পতিত হইলেন এবং অনায়াসে অধিকার করিয়া লইলেন, কারণ তথাকার রাজা তখন দেশে ছিলেন না এবং তিনি তখনও অল্পবয়স্ক।[৮] সম্ভবতঃ সন্দ্বীপের যুদ্ধকালে পূৰ্ব্ববর্ত্তী সন্ধি অনুসারে বালা বা যশোহর হইতে কোনও সাহায্য না পাইয়া আরাকাণ রাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সৰ্ব্বপ্রথমে বালার সমুদ্রকূলবর্তী কতকাংশ জয় করিয়া লইয়াছিলেন এবং প্রতাপের রাজ্যাক্রমণের উপক্রম করিতেছিলেন। এমন সময়ে রামচন্দ্র রাজধানীতে ফিরিয়া আসিলে, সমুদ্র-সংলগ্ন কতকাংশ আরাকাণ-রাজকে দিয়া সন্ধি করা হয়, তখন হইতে ঐ সকল স্থানে মাগেরা আসিয়া বসতি আরম্ভ করে। বিশেষতঃ এবার রামচন্দ্র শ্বশুরের শত্রু হইয়া তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করিবার জন্য মগরাজকে উত্তেজিত করেন এবং সম্ভবতঃ এজন্য তাহাকে সাহায্য দিতে উগ্যোগী হন। এই সময়ে যশোহরে কার্ভালোর আগমন ও তাঁহার কারারোধ ঘটে, সে কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। আত্মরক্ষার জন্য প্রতাপাদিত্যকে কিরূপ কূটনীতির আশ্রয় লইতে হয়, তদ্ভিন্ন গত্যন্তর ছিল কি না, তাহা ঐ ঘটনা হইতে স্পষ্টতঃ বুঝা যায়। কূটনীতি কখনই ধৰ্ম্মানুমোদিত না হইতে পারে, কিন্তু সকল সময়ে সব দেশেই দেখিতে পাওয়া যায়, রাজন্যবর্গের পক্ষে অবস্থাবিশেষে উহার শরণাপন্ন হওয়া ভিন্ন উপায়ান্তর থাকে না।

রামচন্দ্র বীরপুরুষ ছিলেন। ঘটকদিগের মুখে তাঁহার বীরত্বের প্রশংসা আর ধরে না। উক্ত ঘটনার কয়েক বৎসর পরে যখন তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক হন, তখন ভুলুয়াধিপতি দুৰ্দ্দান্ত লক্ষ্মণমাণিক্যকে স্ববলে ধরিয়া আনিয়া মাধবপাশায় কারারুদ্ধ করিয়া রাখেন। চিরকালই জানিতাম, বীরের মর্যাদা বীরপুরুষেই জানেন; কিন্তু রামচন্দ্র তাহা জানিতেন না। তাঁহার বীরত্বে কোন মার্জিত উদারতার পরিচয় পাই নাই, নতুবা রাম লক্ষ্মণে সম্প্রীতি সংস্থাপিত হইলে, উভয়েরই রাজশক্তির গৌরব বাড়িত। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরে রামচন্দ্র লক্ষ্মণমাণিক্যকে নৃশংসের মত নিহত করিয়া স্বীয় কাপুরুষতারই পরিচয় দিয়াছিলেন। এ ঘটনা পরে ঘটিয়াছিল। কিন্তু পূর্ব্ব হইতেও তাঁহার প্রতি প্রতাপাদিত্যের বিরক্তি বা অশ্রদ্ধার কারণ ছিল।

যশোহর হইতে পলায়ন করিয়া আসিবার পর, রামচন্দ্র বহুদিন মধ্যে বিবাহিতা পত্নীর কোন সংবাদ লন নাই এবং এমন কি, তাঁহার প্রেরিত পত্রবাহকের মুখেও কোন সংবাদ দেন নাই। অবশেষে বিমলা এক দুঃসাহসিক কাণ্ড করিলেন। বিবাহের চারি পাঁচ বৎসর পরে তিনি স্বামি-সন্নিধানে যাইবার জন্য পিতার নিকট অভিলাষ জানাইলেন। প্রতাপাদিত্য জামাতার প্রতি বিরক্ত থাকিলেও কন্যার দুঃখে অত্যন্ত মর্ম্মাহত ছিলেন। বিশেষতঃ এ সময়ে তাঁহার জীবনের বেলা শেষ হইয়া আসিতেছিল; পূর্ণ যুবতী রাজ-নন্দিনীর ভবিষ্যৎ ভাবিয়াও তিনি ব্যথিত হইতেছিলেন। তিনি কন্যার প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন; এমন কি, নিজেই উদ্যোগী হইয়া অপরিমিত ধন-রত্ন ও ভূমিবৃত্তি যৌতুকস্বরূপ দিয়া উপযুক্ত লোকজন ও সাজ-সরঞ্জাম সহ নৌকাযোগে কন্যাকে পাঠাইয়া দিলেন।[৯] উদ্বিগ্ন যশোহর-পুরী সাশ্রুনেত্রে সে দৃশ্য দেখিল। যদি রাজা রামচন্দ্র পত্নীকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা হইলে তাঁহার বা তাঁহার পিতার মুখ রাখিবার স্থান থাকিবে না; এজন্য প্রকাশ্যে সকলকে জানান হইল যে, রাজপুত্রী কাশী যাত্রা করিলেন। বাস্তবিকই যদি তিনি এবার স্বামী কর্তৃক গৃহীত না হইতেন, তাহা হইলে যশোহরে ফিরিয়া না আসিয়া কাশী যাইতে পারেন, এমন সমস্ত ব্যবস্থা স্থির ছিল।

যথাসময়ে রাজপুত্রীর তরণীসমূহ মাধবপাশার সন্নিকটে আসিয়া পৌঁছিল। বিমলার আশা ছিল, রাজা রামচন্দ্র সংবাদ শুনিবামাত্র তাঁহাকে গ্রহণ করিতে আসিবেন, কারণ তিনি ত স্বামীর চরণে কোন অপরাধ করেন নাই, স্বামীও ত তখন পর্যন্ত অন্য বিবাহ করেন নাই। ঘটকেরা তাঁহাকে ‘মহামতি’ বলিয়া ব্যাখ্যাত করিয়াছেন। বিমলা আসিয়াছেন, সে সংবাদ রটিল; কিন্তু সংবাদ পাইয়াও রামচন্দ্র তাঁহার কোন সংবাদ লইলেন না। মাধবপাশার অদূরে, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, যেখানে ক্ষুদ্র নদীর কূলে বিমলা স্বামি-দেবতার কৃপাকাঙ্ক্ষা করিয়া দিনের পর দিন মর্ম্মকষ্টে অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, তথায় রাজা রামচন্দ্র না আসুন, বধূমাতাকে দেখিবার কৌতূহলে প্রকাকুল ব্যাকুল হইয়া দলে দলে আসিতে লাগিল। জনসমাগমে সেখানে সপ্তাহে দুই দিন করিয়া হাট বসিতে লাগিল। সে হাটের নাম হইল, ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট।’ কত ব্রাহ্মণ বা ভিক্ষুক রাজপত্নীর দর্শন লাভ করিয়া রিক্তহস্তে ফিরিতেন না; কত দীন দুঃখী বধূমাতার চরণধূলি লইতে আসিত, তিনি তাহাদিগকে আশাতিরিক্ত দান করিতেন। দান-মাহাত্ম্য চতুৰ্দ্দিকে বিঘোষিত হইলে, লোকসংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িতে লাগিল এবং তত দীর্ঘকাল নৌকায় বাস করাও কষ্টকর হইয়া উঠিল। তখন বিমলা সেই স্থান হইতে একটু দূরে সারসী গ্রামের নিকট নৌকা রাখিয়া, তীরের উপর তাম্বু খাটাইয়া তন্মধ্যে বাস করিতে লাগিলেন।

রামচন্দ্র যে কৃপা করিয়া বিমলাকে দেখিতে আসিবেন, সে দুরাশা গেল; তিনি যে তাঁহাকে গ্রহণ করিয়া, কোন প্রকারে পদতলে আশ্রয় দিবেন, সে ভরসাও বিগতপ্রায়; যশোহর ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা বা সম্ভাবনা নাই; স্বামীর চরণপ্রান্ত ত্যাগ করিয়াই বা লাভ কি; এইরূপ চিন্তায় দিন কাটিতে লাগিল। অবশেষে রাজমাতা সমস্ত বাৰ্ত্তা শুনিয়া বধূকে আনিবার জন্য পুত্রকে আদেশ করিলেন। তৎপরে কি হইল, তাহা সিদ্ধহস্ত রোহিণীকুমারের সুন্দর সংযত ভাষায় বলিতেছি : ‘রামচন্দ্র জননীর আদেশ পালনের কোন উদ্যোগ করিলেন না। ইহাতে রাজমাতা নিতান্ত ক্ষুব্ধা হইয়া, পুত্রবধূকে স্বভবনে আনিবার জন্য স্বয়ং তাঁহার নৌকায় গমন করিলেন। শ্বশ্রূকে সমাগতা দেখিয়া রাজমহিষী বিমলাদেবীর পূর্ব্বস্মৃতি জাগিয়া উঠিল। তিনি অবগুণ্ঠনে মুখচন্দ্র আবৃত করিয়া স্বর্ণমুদ্রা পরিপূর্ণ এক সুবর্ণ থালা তাঁহার চরণ প্রান্তে রাখিয়া, তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। রাজমাতা বহুমূল্য অলঙ্কার পরিপূর্ণ গজদন্ত নিৰ্ম্মিত পেটিকা বধূর হস্তে দিয়া আশীর্ব্বাদ করতঃ তাঁহাকে ক্রোড়ে ধারণপূর্ব্বক মুখচুম্বন করিলেন। বধূর ভ্রমর-কৃষ্ণ-পক্ষ্ম-পংক্তি অশ্রু নিষিক্ত দেখিয়া, তিনিও অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন; পরে মহা সমারোহে বধূকে লইয়া রাজরাণী মাধবপাশায় প্রত্যাগতা হইলেন।[১০]

কয়েকদিন পরে রামচন্দ্র পত্নীকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রতাপ-দুহিতা তখন নিজের চরিত্রগুণে রাজ্যেশ্বরের হৃদয়রাজ্য অধিকার করিয়া লইলেন। তাঁহারই গর্ভে রামচন্দ্রের কীর্তিনারায়ণ ও বসুদেব নামক দুই মহাবলশালী পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। রামচন্দ্রের মৃত্যুর পর কীর্তিনারায়ণ রাজা হন; তিনি মহাবীর এবং নৌযুদ্ধে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন।[১১ তিনি মেঘনার উপকূল হইতে ফিরিঙ্গিদিগকে বিতাড়িত করিয়া ঢাকার নবাবের সহিত মিত্রতা স্থাপন করেন। কীর্ত্তির পরে বসুদেবনারায়ণ রাজত্ব করেন। প্রতাপ-দৌহিত্র বসুদেব নিজ পুত্রের নাম রাখিয়াছিলেন- প্রতাপনারায়ণ; তাঁহারই বর্তমান নিঃস্ব বংশধরেরা কাজে না হইলেও, অন্ততঃ নামে, এখনও চন্দ্রদ্বীপের রাজা ও সমাজপতি বলিয়া সম্মানিত।

পাদটীকা :

১. ঘটকারিকায় প্রতাপের কন্যার নাম বিন্দুমতী বলিয়াই লিখিত হইয়াছে :

‘যশোহরেশ্বরো মানী প্রতাপন্য দুহিতরং।
বিন্দুমতীং মহাসতীমুযেমে নৃপোত্তমঃ।।’

তদনুসারে শাস্ত্রী মহাশয় ও নিখিলনাথ বিন্দুমতী নামই গ্রহণ করিয়াছেন, এবং তাঁহাদের উভয়ের অনুবর্ত্তন করিয়া রায় সাহেব হারাণচন্দ্র রক্ষিত প্রণীত ‘বঙ্গের শেষবীর’ নামক উপন্যাসে এবং ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে ও এই সম্পর্কিত আরও বহু পুস্তকে বিন্দুমতী নামই প্রদত্ত হইয়াছে। প্রবাদ-মুখে ও অনেক স্থলে এই নাম শুনিতে পাওয়া যায়। মহাকবি রবীন্দ্রনাথের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাটে’ও বিভা বা বিভাবতী নাম গৃহীত হইয়াছিল। কিন্তু সতর্ক ঐতিহাসিক ও প্রসিদ্ধ লেখক বাখরগঞ্জ-কীর্তিপাশা-নিবাসী রোহিণীকুমার সেন মহাশয় লিখিয়া গিয়াছেন : ‘মাদবপাশার রাজা শ্রীযুক্ত বীরসিংহ নারায়ণ রায় বলেন যে, রামচন্দ্রের পত্নীর নাম বিমলা। প্রতাপাদিত্য-প্রদত্ত যৌতুকভূমি তৎকন্যা বিমলার নামেই প্রদত্ত হইয়াছে।’— ‘বাকলা’, ১৭১ পু। তদনুসারে তিনি স্বীয় পুস্তকে বিমলা নামই গ্রহণ করিয়াছেন। যৌতুক দিবার দানপত্রে যদি প্রকৃতই বিমলা নাম থাকে, তবে তাহাই গ্রাহ্য। আমরাও তাহাই করিলাম। বিমলার অন্য নাম বিন্দুমতীও থাকিতে পারে। আমরা পূর্ব্বে তাহাই ধরিয়াছি (১১শ পরিচ্ছেদ)।

২. ‘মল্লকুলোদ্ভবো মল্লো রামনারায়ণঃ শূরঃ।
সামন্তস্তস্য বিখ্যাতো মহাবল-সমন্বিত।’—ঘটককারিকা

৩. ‘বালা’, ২৯৪ পৃ।

৪. রাজদরবারে বিদূষক রাখা এদেশীয় চিরন্তন প্রথা। আকবরের সভায় বীরবল এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড়ের আস্পর্দ্ধার কথা সৰ্ব্বজনবিদিত। সেই ভাবে রামাই ভাঁড় কন্দর্পনারায়ণের সময় হইতে রাজসভায় প্রশ্রয় পাইয়াছিল। বালক রামচন্দ্রকে সে কিছুমাত্র ভয় করিত না।

৫. ঘটককারিকায় আছে (উহার ব্যাকরণদোষ অবশ্য উপেক্ষণীয়) :

শ্রুত্বা সকল-সংবাদং নৃপস্য প্ৰমুখাত্ততঃ।
চতুঃষষ্টিদণ্ডযুতা নৌরানীতা মহামতিঃ॥
নালীকৈঃ সজ্জিতা স্বৈরং সৈন্যাদ্যৈঃ পরিরক্ষিতা।
তস্যারোহণং কৃত্বা প্রগৃহ্য নালীকাযুধং।।
তূর্ণং গমনবার্ত্তাঞ্চ নালীকধ্বনিভিদদৌ।
কম্পয়িত্বা শত্রুপুরীং স্বরাজ্যে পুনরাগতঃ।।’

এইরূপ চৌষট্টি দাঁড়ের সশস্ত্র সুন্দর রণতরী তখন বঙ্গদেশে প্রস্তুত হইত। রামচন্দ্র ও তৎপুত্র কীর্তিনারায়ণ নৌযুদ্ধে বিখ্যাত ছিলেন। – History of Indian Shipping. pp. 217-8.

৬. গল্পটিকে আরও জাঁকাল করিবার জন্য এরূপ কথিত আছে, প্রতাপাদিত্যের লোকেরা নদীমধ্যে প্রকাণ্ড বৃক্ষ ফেলিয়া পথ বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু রামমোহন মল্ল চৌষট্টি দাঁড়ের সেই প্রকাণ্ড নৌকা উহার উপর দিয়া টানিয়া পার করিয়া দিয়াছিলেন। প্রতাপের লোকে যে কখন পথ বন্ধ করিবার সময় পাইল এবং কামানযুক্ত সুদীর্ঘ রণতরী মল্লবর কিরূপে টানিয়া পার করিয়া দিলেন, তাহা বিশ্বাস করিবার সাধ্য আমাদের নাই। কোন নদীতে পড়িয়া রামচন্দ্র তোপধ্বনি করিলেন, তাহাও তর্কস্থল হইয়াছে। ভৈরব- তীরবর্ত্তী আধুনিক যশোহর সহরকে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী মনে করিয়া রবীন্দ্রনাথ স্বপ্রণীত ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’ নামক উপন্যাস লিখিয়াছিলেন যে, রামচন্দ্র ভৈরববক্ষ হইতে যে তোপধ্বনি করেন, তাহাতে প্রতাপের নিদ্রাভঙ্গ হয়। কিন্তু ধুমঘাট হইতে ভৈরবের দূরত্ব অন্তত ৫০/৬০ মাইল হইবে। গত ২৫ বৎসরে উপন্যাসখানির বহু সংস্করণ পার হইয়াছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সাধারণ ভ্রমটি সংশোধিত হয় নাই। ইহা অতীব ক্ষোভের বিষয়। উক্ত উপন্যাসে ভৈরবস্থলে যমুনা বা ইছামতী হওয়া উচিত।— ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’, ১১শ পরিচ্ছেদ, নূতন সংস্করণ, ৭৩ পৃ দ্রষ্টব্য।

৭. ‘বালা’, ১৭৩ পৃ।

৮. Du-Jarric tells us: ‘The king of Arracan was proud of having taken the island of Sundwip from the Portuguese; and desiring now to pursue his design of conquering all the kingdoms of Bengal he suddenly threw himself upon that of Bacola, of which he possessed himself without difficult as the king of it was absent and still young’— Beveridge Bakarganj. p. 34.

The king of Arracan having… added Sundwiva and kingdome of Baccala intended to annex Chandecan to the rest of his conquest’,-Purchas. pilgrimes. Pt. IV, Book V, p. 514, ‘প্রতাপাদিত্য’, ৭০ পৃ।

৯. Afterwards Pratapaditya relented and sent his daughter to Ram Chandra and the place where she landed, near Madhabpasha, is still called Badhu Mata Hat, or the Brides Market, as a mar- ket was established there in her honour.’- Beveridge, Bakarganj. p. 77.

১০. ‘বাক্‌লা’ ১৭৫ পৃ। প্রতাপ-কন্যা প্রত্যাখ্যাতা হইয়া কাশী চলিয়া যান নাই। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস উপন্যাসই, উহাতে ঐতিহাসিক বিশেষ কিছু নাই।

১১. চন্দ্রদ্বীপের কায়স্থ-কুলকারিকায় আছে :

‘কীর্তি নারায়ণো বীরো মহামানী তদঙ্গজঃ।।
জগদেকশূরঃ সোহপি নৌযুদ্ধে সুপ্রসিদ্ধকঃ॥
মেঘনাদোপকূলে স ফেরঙ্গ-সৈনিকেঃ সহ।।
অদ্ভুতং সমরং কৃত্বা তীরাৎ সর্ব্বানতাড়য়ং।।
জাহাঙ্গীর পুরোধীশো নবাবো যবনস্ততঃ।
স্থাপয়ামাস মিত্রত্বং সার্দ্ধং তেন প্ৰযত্মতঃ।।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন