সতীশচন্দ্র মিত্র
আদিশূরের সময়ে আগত পঞ্চকায়স্থের মধ্যে বিরাট গুহ একজন। তাঁহার অধস্তন নবম পর্য্যায়স্থ অশ্বপতি বা আশ্ গুহ বঙ্গজ কায়স্থগণের এক বীজপুরুষ। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে যখন চন্দ্রদ্বীপের রাজা পরমানন্দ (বসু) রায় সমাজ সমীকরণ করিয়া বঙ্গজ কায়স্থগণের ‘বালা-সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন আশ্ গুহ শ্রেষ্ঠ কুলীন বলিয়া স্বীকৃত হন। এই আশ্ গুহের এক প্রপৌত্রের নাম রামচন্দ্র। তিনি তখনকার হিসাবে কৃতবিদ্য বটে, কিন্তু ধনসমৃদ্ধ ছিলেন না। বরং তাহার পিতার অবস্থা শোচনীয় ছিল বলিয়াই জানা যায়। রামচন্দ্র উদ্যমশীল ও কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন।[১] তিনি অবস্থার উন্নতির জন্য অর্থান্বেষণে বালা হইতে সপ্তগ্রামে আসিয়াছিলেন।[২] সপ্তগ্রাম তখন গৌড়ের অধীন একটি শাসন কেন্দ্র। এখানে একজন প্রাদেশিক পাঠানশাসনকর্তার অধীন, রাজস্ব সংগ্রহ ও শাসনকার্য নির্ব্বাহের জন্য বহু কর্মচারী ছিল। বিশেষতঃ অতি প্রাচীনকাল হইতে সরস্বতী নদীর তীরবর্ত্তী সপ্তগ্রাম একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য বন্দর।[৩] সুতরাং সেখানে অর্থোপায়ের বহু পন্থা মিলিতে পারে। এই আশায় রামচন্দ্র সপ্তগ্রামে পৌঁছিয়া নিকটবর্ত্তী পাটমহলে শ্রীকান্ত ঘোষ মহাশয়ের বাটীতে আশ্রয় লন। শ্রীকান্ত ঘোষও বঙ্গজ কুলীন কায়স্থ এবং পূর্ব্ববঙ্গে তাহার পূর্ব্ব নিবাস ছিল; সেই সূত্রে রামচন্দ্রের সহিত তাহার পরিচয় হয়। তিনি রামচন্দ্রের রূপেগুণে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে কন্যা সম্প্রদান করেন। রামচন্দ্রের শ্বশুর ও শ্যালকেরা সপ্তগ্রামে চাকরী করিতেন। সেই সঙ্গে তিনিও তথায় মুহুরীরূপে প্রথম প্রবেশ লাভ করেন। ক্রমে তাহার দিন ফিরিল, তিনি ‘নিয়োগী’ উপাধি পাইলেন। সপ্তগ্রামে আসিবার পূর্ব্বে তাহার অন্য এক বিবাহ হইয়াছিল। ঘটককারিকায় উল্লেখ আছে, তিনি প্রথম ষষ্ঠীবর বসুর কন্যা বিবাহ করেন। সে স্ত্রীর গর্ভে রামচন্দ্রের তিন পুত্র হইয়াছিল— ভবানন্দ, গুণানন্দ ও শিবানন্দ। ক্রমে তাহারাও সংস্কৃত ও পারসীক ভাষায় কৃতবিদ্যা হইয়া সপ্তগ্রামে আসিলেন এবং রাজসরকারে কার্য্যারম্ভ করিলেন; কানুনগো দপ্তরে তাহাদের কার্য্যের অত্যন্ত সুযশঃ হইল; তিনজনের মধ্যে আবার শিবানন্দ সৰ্ব্বাপেক্ষা ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। ক্রমে তিনজনেরই বিবাহ হইল; ভবানন্দের এক পুত্র হইল – শ্রীহরি![৪] গুণানন্দের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম জানকীবল্লভ। শিবানন্দের তিন পুত্র হরিদাস, গোপাল দাস ও বিষ্ণু দাস; ইহারা কেহই যশোহরে আসেন নাই, পূর্ব্ববঙ্গে বাস করিয়াছিলেন। শ্রীহরি জানকীবল্লভ অপেক্ষা বয়সে কিছু বড়; উভয়ের মধ্যে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল, রামলক্ষ্মণের মত তাঁহাদের মধ্যে একাত্মভাব ছিল। শিবানন্দ ও তাঁহার পুত্রগণের সহিত তাঁহার ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রগণের বিশেষ সদ্ভাব ছিল বলিয়া মনে হয় না; তবে শিবানন্দ নিজে সৰ্ব্বাপেক্ষা কৃতবিদ্য ও রাজকার্য্যে উচ্চপদস্থ বলিয়া সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
দৈবযোগে একদিন সপ্তগ্রামের তখনকার শাসনকর্তার সহিত শিবানন্দের মতান্তর উপস্থিত হয়। তখন দেশে অরাজকতা চলিতেছিল। সেরশাহের অকর্ম্মণ্য বংশধর আদিল শাহ দিল্লীর তক্তে উপবিষ্ট; বঙ্গের শাসন কর্তা মহম্মদ খাঁ সুর স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়া মহম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করিয়াছেন; সুতরাং সপ্তগ্রামের শাসনকর্ত্তাও গৌড়ের অধীন থাকিতে অসম্মত। শিবানন্দের মতে সে প্রস্তাব সঙ্গত নহে বলিয়াই সম্ভবতঃ মতান্তর উপস্থিত হইল (১৫৫৪)। সামান্য অনৈক্য হইতে বিষম অনর্থের উৎপত্তি হয়। হুসেন শাহ যখন গৌড়েশ্বর সেই সময়ে রামচন্দ্র প্রথম সপ্তগ্রামে চাকরী আরম্ভ করেন; বিগত প্রায় ৪০ বৎসর ধরিয়া তিনি প্রতিষ্ঠার সহিত রাজকার্য্য করিয়াছেন। এক্ষণে শিবানন্দের সহিত অসদ্ভাব সূত্রে যখন রামচন্দ্রকেও অনর্থক অপদস্থ হইতে হইল, তখন তিনি আত্মরক্ষার জন্য সেই প্রায় ৬৫ বৎসর বয়সে পুনরায় ভাগ্যান্বেষণে গৌড় যাত্রা করিলেন। তিনি কেবলমাত্র ভবানন্দকে সঙ্গে লইয়া গেলেন; পরিবারবর্গ সপ্তগ্রামে রহিল। বৃদ্ধ রামচন্দ্র ও তৎপুত্র শিবানন্দের কার্য্যের খ্যাতি পূর্ব্বেই রাজধানীতে পৌঁছিয়াছিল; নবীন ভূপতি মহম্মদ শাহ পুরাতন কর্ম্মক্ষম ব্যক্তিকে ছাড়িলেন না; বিশেষতঃ সপ্তগ্রামের শাসকের বিদ্রোহিতার বার্তায় শিবানন্দের বিশ্বস্ততাসম্বন্ধে তাহার অতিরিক্ত বিশ্বাস হইল। ক্রমে রামচন্দ্রের পুত্রেরা রাজসরকারে প্রবেশ করিলেন। অল্পদিন মধ্যে রামচন্দ্রও পরলোক গমন করেন। তিনিই যশোহর-রাজবংশের আদিপুরুষ।
এদিকে মহম্মদ শাহ শীঘ্রই সেরশাহের অনুকরণে দিল্লীশ্বর হইবার কল্পনায় সসৈন্যে আগ্রাভিমুখে অগ্রসর হইয়া ছাপরা-মৌএর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। তখন তৎপুত্র খিজির খাঁ বাহাদুর শাহ নাম ধারণ করিয়া বঙ্গেশ্বর হন[৫] (১৫৫৫)। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ বড় বিষম গোলযোগের সময়। অল্পদিন মধ্যে আকবর সেনাপতি বৈরামখার সহিত অগ্রসর হইয়া পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে দিল্লীশ্বর আদিলের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত ও নিহত করিয়া রাজতক্ত কাড়িয়া লন (১৫৫৬)। তখন আদিল সসৈন্যে পূৰ্ব্বমুখে পলায়ন করেন। কিন্তু পরবৎসর গৌড়েশ্বর বাহাদুর শাহ এবং মগধের শাসনকর্তা সুলেমান কররাণী উভয়ে মুঙ্গেরের যুদ্ধে আদিলকে পরাজিত ও বিনষ্ট করেন। এইবার বাহাদুর শত্রুশূন্য হইয়া কয়েক বর্ষাকাল নিৰ্ব্বিবাদে বঙ্গদেশ সুশাসন করেন।[৬] সম্ভবতঃ তাঁহারই রাজদপ্তরে কার্য্যদক্ষতাগুণে ভবানন্দ প্রভৃতি তিন ভ্রাতাই ‘মজুমদার’ উপাধি লাভ করেন। এই সময়ে তাঁহাদের পরিবারবর্গ গৌড়ে আনীত হন। ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে বাহাদুর শাহ গৌড়ে নিঃসন্তান পরলোকগমন করিলে, তাঁহার ভ্রাতা জেলালউদ্দীন প্রায় তিন বৎসর রাজত্ব করেন। জেলালের দেহান্তে তাঁহার এক শিশুপুত্রকে সিংহাসনে বসান হয়, কিন্তু ৭ মাস পরে গিয়াউদ্দীন নামক এক ব্যক্তি সেই শিশুকে বধ করিয়া ১১ মাস গৌড়ে রাজত্ব করেন। তখন কররাণী বংশীয় পাঠান বীর তাজ খাঁ রাজদণ্ড কাড়িয়া লন (১৫৬৩)। কিন্তু অচিরে তাঁহার মৃত্যু হইলে, তদীয় ভ্রাতা সুলেমান রাজতক্তে উপবিষ্ট হন। এইরূপ অবিরত রাজপরিবর্তন দেখিয়াই একদা নরোত্তম ঠাকুর গাহিয়াছিলেন :
‘রাজার যে রাজ্য পাট, যেন নাটুয়ার নাট,
দেখিতে দেখিতে আর নাই।’
বাস্তবিকই পদ্মপত্রে জলের মত কিছু কাল হইতে গৌড়তক্তের রাজত্ব বড় চঞ্চল হইয়া পড়িয়াছিল। সুলেমানের সিংহাসন প্রাপ্তির সঙ্গে সেই চাঞ্চল্য আবার থামিল; নিপুণ কর্ণধারের হস্তে বঙ্গের শাসন-তরণী আবার কিছুকালের জন্য সদর্পে ও নিরুদ্বেগে চলিল।
সুলেমান চতুর শাসনকর্তা। তিনি অরাজকতার যুগে কঠোর ভাবে রাজদণ্ড পরিচালনা করিয়া শান্তি সংস্থাপন করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি গুণীর সমাদর করিতেও জানিতেন। কোন রাজনৈতিক বিদ্রোহে যোগদান না করিয়া সব কার্য্যে কৃতিত্ব দেখাইয়া, ভবানন্দ প্রভৃতি তিন ভ্রাতাই সুলেমানের কৃপালাভ করিয়াছিলেন; ক্রমে তাহারা উচ্চপদ পাইলেন, ক্রমে তাহাদের ভাগ্যাকাশ পরিষ্কৃত হইল। ভবানন্দ মন্ত্রিত্বলাভ করিলেন, আর শিবানন্দ হইলেন কানুনগো দপ্তরের অধ্যক্ষ। এই সময়ে শ্রীহরি ও জানকীবল্লভ উভয়ে উদীয়মান যুবক। সুলেমানেরও বয়াজিদ ও দায়ুদ নামে দুইপুত্র ছিল। মন্ত্রিপুত্রের সম্মান এত বাড়িয়াছিল যে, রাজপুরীতে শ্রী হরি ও জানকীবল্লভ রাজপুত্রদ্বয়ের সহিত একত্র অবস্থান, ভ্রমণ ও শিক্ষালাভ করিতেন। সে জন্য তাহাদের মধ্যে বিশেষ সৌহৃদ্য স্থাপিত হয়। এই সৌহৃদ্যই যশোহর রাজ্যস্থাপনের মূলীভূত কারণ।
গৌড়ের জলবায়ু অস্বাস্থ্যকর দেখিয়া সুলেমান নিকটবর্ত্তী তাণ্ডা ও টাঁড়া নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন (১৫৬৪)। ইহা গৌড় হইতে আকমহল (রাজমহল) যাইবার পথে গঙ্গার চড়ায় প্রাচীন খাত পাগলা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। এখন আর উহার চিহ্ন মাত্ৰ নাই। কিন্তু তখন গৌড় ও তাণ্ডা এক হইয়া গিয়াছিল।[৭] তাণ্ডাতে রাজধানী থাকিলেও রাজধানীর সাধারণ নাম গৌড় বা জিন্নতাবাদই ছিল। দশবৎসর রাজত্বের পর সুলেমান পরলোকগত হন। তাঁহার শাসনকালে তদীয় সেনাপতি কালাপাহাড় কর্তৃক উড়িষ্যা-বিজয় একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। কিন্তু হিন্দু- কুলাঙ্গার কালাপাহাড়ের[৮] হিন্দুবিদ্বেষ ও মন্দিরবিগ্রহাদির বিনাশজন্য সুলেমানের রাজত্বকাল কলঙ্কিত হইয়াছিল। কথিত আছে, যখন কালাপাহাড় উড়িষ্যা বিজয় করিয়া জগন্নাথদেবের মূর্ত্তি দগ্ধ করিবার আদেশ দেন, তখন শ্রীহরির চেষ্টায় পাণ্ডারা মূর্ত্তি স্থানান্তরিত করিতে পারিয়া তাহার শীর্ষে অশেষ আশীৰ্ব্বাণী প্রদান করিয়াছিলেন। শ্রীহরি ও জানকীবল্লভ শিশুকাল হইতে পরম বৈষ্ণব ছিলেন।[৯]
শ্রীহরির সহিত পরম কুলীন উগ্রকণ্ঠ বসুর কন্যার বিবাহ হইয়াছিল। যখন ভবানন্দ প্রভৃতি সপরিবারে গৌড়ে অবস্থিতি করিতেছিলেন, তখন ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে বা তাহার অব্যবহিত পরে, অতি অল্পবয়সে শ্রীহরির ওরসে উক্ত বসুকন্যার গর্ভে এক পুত্ররত্নের জন্ম হয়, তাহার নাম রাখা হইয়াছিল— প্রতাপ। ইনিই কালে বিশ্ববিশ্রুত বঙ্গেশ্বর প্রতাপাদিত্য নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন।[১০]
পাদটীকা :
১. ঘটককারিকায় আছে :
‘ছকড়ীতনয়ঃ শ্রেষ্ঠো রামচন্দ্ৰো মহাকৃতী।
মহামানী মহাশূরো নবভিৰ্গুণকৈৰ্ষতঃ।
২. পূর্ব্ববঙ্গে কোথায় রামচন্দ্রের বাড়ী ছিল, তাহা ঠিক জানা যায় না। কেহ কেহ বলেন, ফরিদপুরের অন্তর্গত চন্দনাতীরবর্ত্তী চন্দনা গ্রামে তাহার বাস ছিল এবং তিনি প্রথম জীবনে সাঁতের রাজ-সরকারে কর্মচারী ছিলেন (দুর্গাচরণ সান্যাল কৃত ‘সামাজিক ইতিহাস’, ১৬০ পৃ); কিন্তু ইহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
৩. সপ্তগ্রাম বন্দর অতি প্রাচীনকাল হইতে বিখ্যাত। প্লিনি হইতে র্যাফ্ ফিচ পর্য্যন্ত বহু ভ্রমণকারী ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। বঙ্গের পণ্যভার সপ্তগ্রাম হইত সরস্বতী পথে তাম্রলিপ্ত বা তমলুকে যাইত এবং তথা হইতে সমুদ্রপথে সুদূর ইয়োরোপ পর্য্যন্ত বাণিজ্য চলিত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে : ‘সপ্তগ্রামের বণিক কোথায় না যায়। ঘরে ব’সে সুখমোক্ষ নানাধন পায়।’ ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম হইতে সপ্তগ্রাম পর্তুগীজগণের একটি প্রধান আড্ডা হয়। তাহারা ইহাকে পোর্ট পেকিনো বা ক্ষুদ্র বন্দর বলিত, কারণ তাহাদের সর্বপ্রধান বন্দর ছিল চট্টগ্রাম। ‘The Royal Port of Bengal in the 16th Century and a great city but now a small village.’ সপ্তগ্রামের এই সমৃদ্ধির যুগেই রামচন্দ্র তথায় গিয়াছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগ হইতে ত্রিবেণী হইতে সরস্বতী নদী পলি পড়িয়া শাঁকরোল পর্য্যন্ত মজিয়া যাইতে লাগিল, তখন হইতে সপ্তগ্রামের পতন হইল। The silting up of the Saraswati led to the establishment of the town and Port of Hugli by the Portuguese in 1537’–Hunter, Statistical Accounts, Hugli, p 262; ‘সুবর্ণ বণিক’ ২২৪ পৃ।
৪. এই শ্রীহরিই পরে বিক্রমাদিত্য উপাধি লাভ করেন। তাহার পূর্ব্বনাম সম্বন্ধে বহু মতবাদ আছে। ইদিলপুরের ঘটককারিকায় ‘ভবানন্দ-সুতো জাতঃ শ্রীহর্ষ নামধেয়কঃ’ আছে, অর্থাৎ তাহার নাম শ্রীহর্ষ ছিল। মুসলমান ঐতিহাসিকেরা শ্রীধর বা শ্রীহরি এই উভয় নাম ব্যবহার করিয়াছেন। পারসীক গ্রন্থের মূলে বা ইংরাজী অনুবাদে লিপি বা পাঠোদ্ধারের দোষে এই দুই নামের আবার নানা অপভ্রংশ হইয়াছে। এমন কি কেহ সৰ্ম্মাদি, কেহ সৈয়দ হুরি পর্য্যন্ত করিয়াছেন। ‘Sarmadi’ (Ain (Blochmann) pp. 341-2], ‘Sirhari’ [Akbarnama (Beveridge), III, p. 172], ‘Sadhauri’ (Ibid III p. 31), ‘Sridhar’ (Tabakat., (Elliot); V. pp 373, 378], ‘Saiyid Huri’ (Elliot. VI. 41 ), and ‘Sarhor (Badaoni, (Lowe), II. p. 184 ]; See also, Jessore Gazetteer, p. 27 note.
[অধ্যাপক যদুনাথ সরকার লতীফের ফার্সী ভ্রমণকাহিনীতে প্রথমে ‘পৃথ্বী’ বা ‘ভারতী’ পড়িয়াছিলেন। ৩৩শ পরিচ্ছেদের শেষাংশে পাদটিকা দ্রষ্টব্য—শি মি]
৫. “বাঙ্গালার ইতিহাস’ ২য় খণ্ড, ৩৫৯ পৃ, Riaz-us-Salatin, p. 149.
৬. Stewart – History of Bengal, p. 166.
৭. Stewart – History of Bengal, p. 169. ‘Old Tanda has been utterly swept away by the Changes in the course of the Pagla’—Ain-i-Akbari (Jarret), II, p. 129. টাঁড়া শব্দের অর্থই চর বা উচ্চস্থান। পশ্চিম অঞ্চলে এমন অনেক টাঁড়া আছে এবং অনেক গ্রামের নামের সঙ্গে টাঁড়া সংযুক্ত দেখা যায়। রাজধানীকে বিশেষ করিবার জন্য তাহাকে খাস বা খাসপুর তাণ্ডা বলিত।—’গৌড়ের ইতিহাস’ ২য় খণ্ড, ১৬৮ পৃ।
৮. ইতিহাসে দুইজন কালাপাহাড়ের উল্লেখ আছে। ইনি দ্বিতীয় কালাপাহাড়। উভয়ই ভীষণ দেবদ্বেষী ছিলেন। প্রথম কালাপাহাড় জৌনপুরের রাজা বার্বাক শাহের সেনাপতি এবং দ্বিতীয় কালাপাহাড় সুলেমান ও দায়ুদের সেনাপতি। দ্বিতীয় কালাপাহাড় হিন্দু, তাহার পূর্ব্ব নাম কালাচাঁদ রায়, বাল্যকালে তাহাকে লোকে ‘রাজু’ বলিয়া ডাকিত। Akbarnama, III, p. 31; ‘বিশ্বকোষ;’ ৪র্থ খণ্ড, ২০ পৃ; ‘সামাজিক ইতিহাস’, ৮৮ পৃ; Elliot. IV, p. 512; Briggs, II, p. 248; Dow, II, p. 153; ‘গৌড়ের ইতিহাস’, ২য় খণ্ড, ১৬৯ পৃ।
৯. রামচন্দ্রের প্রথম জীবনে শ্রীচৈতন্যদেবের নাম প্রচার স্রোতে বঙ্গদেশ ভাসিয়া গিয়াছিল। সে স্রোত গৌড় হইতে রূপসনাতনকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল। সপ্তগ্রাম ও গৌড়— রামচন্দ্রের এই উভয় কর্মক্ষেত্রেই বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব লক্ষিত হয়। রামচন্দ্র বৈষ্ণব ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। তদবধি তাহার বংশীয়গণ সকলেই হরিনামামৃত পান করিয়া সময়ের সদ্ব্যবহার করিতেন। বসন্তরায় কিরূপে গোবিন্দদাস প্রভৃতি পদকর্তার সঙ্গলাভ করিতেন, তাহা পরে বর্ণিত হইবে।
১০. প্রতাপাদিত্যের জন্মাব্দ স্থির করা বড় কঠিন ব্যাপার। এ বিষয়ে বহুজনের বহুমত আছে। রামরাম বসু বলেন, যশোহরে আসিলে প্রতাপের জন্ম হয়। সুতরাং ১৫৭৪ খৃঃ অব্দের পূর্ব্বে জন্ম হইতে পারে না। জেসুইট মিশনরীগণ বলিয়া গিয়াছেন, ১৫৯৯ অব্দে প্রতাপের জ্যেষ্ঠ পুত্র উদায়াদিত্যের বয়স ১২ বৎসর, তাহা হইলে ১৫৮৭ অব্দে তাহার জন্ম হয়। কিন্তু তখন প্রতাপের বয়স ১৩ বৎসরের অধিক নহে, সুতরাং বসু মহাশয়ের মত টিকে না। পূর্ব্বে স্থির ছিল ১৬০৬ অব্দে মানসিংহের হস্তে প্রতাপের শেষ পতন হয় এবং সেই বৎসরই তাহার মৃত্যু হয়, নুরনগর ও কাটুনিয়ার রাজবংশীয়দিগের বংশগত প্রবাদে প্রতাপ ৩৯ বৎসর মাত্র জীবিত ছিলেন; এই উভয়ের সমন্বয় করিয়া শ্রদ্ধেয় সত্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয় ১৫৬৮ জন্মাব্দ স্থির করেন (‘প্রতাপাদিত্য’, ৩০ পৃ)। কিন্তু সম্প্রতি বহারিস্তান নামক নবাবিষ্কৃত প্রাচীন পারসীক গ্রন্থে দেখিতে পাই, ১৬০৯ অব্দে প্রতাপের মৃত্যু হয়। সুতরাং সে হিসাবে ১৫৭০ অব্দে প্রতাপের জন্ম এবং ১৫৭৮ অব্দে আগ্রা গমনকালে তাহার বয়স ৮ বৎসর মাত্র হয়, উহা অসম্ভব। ঐ একই প্রকারে ৪২ বৎসর বয়সের প্রবাদ মানিয়া লইয়া ‘বিশ্বকোষের’ সুলিখিত নিবন্ধে প্রতাপের জন্মাব্দ ১৫৬৪ স্থিরীকৃত হইয়াছে (১২শ খণ্ড, ২৫৮ পৃ)। কিন্তু উক্ত প্রবাদই অমূলক এবং মৃত্যু-তারিখও পরিবর্তিত হইয়াছে, সুতরাং এ মতও সাহস করিয়া গ্রহণ করিতে পারি না। ঘটকারিকায় আছে : —’ইষুবেদ প্রমাণাব্দং কৃতং রাজ্যং স্ববীৰ্য্যত’ অর্থাৎ প্রতাপ ৪৫ বৎসর রাজত্ব করেন এবং আরও আছে যে, সে রাজত্ব বসন্ত রায়ের মৃত্যুর পর আরব্ধ হয়। কিন্তু ১৬০২ অব্দের পূর্ব্বে বসন্ত রায়ের মৃত্যু না ধরিলে প্রতাপের মৃত্যু বাদশাহ শাহজাহানের সময়ে অর্থাৎ ১৬৪৭ অব্দে পড়ে। ঘটককারিকার অনেক হিসাবেরই সমন্বয় করা যায় না এবং ‘বহারিস্তানের’ প্রমাণ পরিত্যাগ করিতে পারি না। আমরা দেখিতে পাইব ১৫৭৮ অব্দে প্রতাপ আগ্রায় যান, তথায় বাদশাহ দরবারে তাহার প্রতিপত্তির কথাও আছে। সুতরাং তখন তিনি প্রাপ্তবয়স্ক যুবক এবং তাহার বয়স ১৭/১৮ বৎসর হইতে পারে। তাহা হইলে জন্মতারিখ ১৫৬০ ধরা যায়। যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয় স্বপ্রণীত ‘বঙ্গের বীরপুত্র’ নামক কাব্যের ভূমিকায় লিখিয়াছেন যে তাঁহার নিকট বসন্ত রায়ের জামাতা রামরূপ বসু প্রণীত অতি পুরাতন একখানি হস্ত লিখিত পুঁথি ছিল, তদনুসারে তিনি কাব্য রচনা করেন এবং ১৫৬০ অব্দে জন্ম তারিখ স্থির করেন (‘বঙ্গের বীর পুত্র’ ৩৮ পৃ)। আমাদের মতে উক্ত পুঁথিখানি বিশ্বাসযোগ্য; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১২৯১ সালের ২৭ শে ভাদ্র যোগেন্দ্রনাথের মাতার মৃত্যুদিনে উক্ত পুঁথিখানি তাঁহার হস্তভ্রষ্ট হয়, পরে আর পাওয়া যায় নাই। যাহা হউক, সব দিকের সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে গিয়া আমরা স্থির করিতেছি যে, ১৫৬০ অব্দে বা তাহার পরে ২/১ বৎসরের মধ্যে গৌড়ে প্রতাপাদিত্যের জন্ম হয়। শ্রদ্ধেয় নিখিলনাথও ১৫৬১ জন্মাব্দ স্থির করিয়াছেন।—’প্রতাপাদিত্য’, ৭৯ এবং মূল ৯৫ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন