১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি

সতীশচন্দ্র মিত্র

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – মগ ও ফিরিঙ্গি

আমরা যে মগ ও ফিরিঙ্গির কথা বলিয়াছি, তাহাদের অত্যাচার কাহিনী শুনিবার পূর্ব্বে তাহাদের পরিচয় জানা আবশ্যক। অগ্রে মগের কথা বলিতেছি। মগেরা আসিত ব্রহ্মদেশের অন্তর্গত আরাকাণ হইতে। আরাকাণ বর্ত্তমান চট্টগ্রামের দক্ষিণভাগে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাজ্য। একটি পর্বতমালা এই রাজ্যের পূর্ব্বসীমা জুড়িয়া বসিয়া ইহাকে সমগ্র ব্রহ্মদেশ হইতে পৃথক্ করিয়াছে; আর পশ্চিমসীমার সর্ব্বত্রই বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গমালায় প্রতিহত। এই উভয় সীমার মধ্যে থাকিয়া রাজ্যখণ্ডের উত্তরদিকের বিস্তৃতি ৫০ মাইলের অধিক হইবে না এবং ক্রমে সরু হইয়া দক্ষিণ দিকে কোন কোন স্থানের প্রস্থ ১৫ মাইল মাত্র। পশ্চিম দিক হইতে সমুদ্রই নদীর নামে দেশের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে; অধিবাসীরা একপ্রকার সমুদ্রমধ্যেই বাস করে, সমুদ্রবক্ষে খেলা করে, তাহারা নাববিদ্যায় দক্ষ। জলপথ ও স্থলপথ উভয়ই দুর্গম; সমুদ্রের কূলে কূলে কতকগুলি দুর্গ আছে এবং সমুদ্রমধ্যেও অনেকগুলি দ্বীপ ইহাদের রাজ্যভুক্ত এবং সুরক্ষিত; পরদেশীর পক্ষে এ রাজ্য জয় করা বড় কঠিন। এইজন্য অতি প্রাচীনকাল হইতে প্রায় চারি সহস্র বৎসর ধরিয়া এই ক্ষুদ্ৰজাতি তাহাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছিল। রামাবতী তাহাদের রাজধানী ছিল, উহার বৰ্ত্তমান নাম সান্দোবয় (Sandoway)। ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে আরাকাণ রাজ্য ব্রহ্মবাসীরা অধিকার করিয়া লয়, কিন্তু পঞ্চাশ বৎসর যাইতে না যাইতেই, ব্রহ্মযুদ্ধের পর উহা ইংরাজাধিকৃত হইয়াছে (১৮২৬)। এখন আরাকাণ নিম্ন ব্রহ্মের একটি বিভাগ এবং আকিয়াব উহার প্রধান নগরী। বাণিজ্য বা রণসজ্জায় আরাকাণীরা উত্তরে চট্টগ্রামে আসিত এবং সেখান হইতে পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণ দিকে আসিবার পথে সন্দ্বীপ তাহাদের একটি প্রধান আড্ডা ছিল। ব্রহ্মবাসীর মত আরাকাণীদিগকেও সাধারণতঃ মগ বলে এবং ধর্ম্মের হিসাবে তাহারা বৌদ্ধ বলিয়া পরিচিত। কিন্তু সে উদার মতের কোন নীতি তাহারা অনুসরণ করিত বলিয়া বোধ হয় না; কারণ, হিংসা ও দস্যুতাই একসময়ে তাহাদের প্রধান ব্যবসায় ছিল।

আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পশ্চিম ভারত হইতে পর্তুগীজগণ আসিয়া আরাকাণ ও নিকটবর্ত্তী নানাস্থানে সমুদ্রতীরে বাস করে। প্রথমতঃ মগেরা এই বিদেশীকে বন্ধুভাবে লুফিয়া লইয়াছিল; কারণ তাহারা উৎকৃষ্ট নাবিক এবং দস্যু ব্যবসায়ের উপযুক্ত সহচর। বিশেষতঃ, বঙ্গে আসিয়া দস্যুতা করার জন্য বঙ্গের শাসক, পাঠান বা মোগল সকলেই মগের প্রতি বিরূপ ছিলেন; মগেরাও উহাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়ার জন্য বিশেষ সাহায্য পাইবে বলিয়া পর্তুগীজদিগকে আশ্রয় দিয়াছিল। কিন্তু সমব্যবসায়ীর সদ্ভাব বেশীদিন থাকে না; সুতরাং মগ ও পর্তুগীজের মধ্যে কখনও মিত্রতা, কখনও সংঘর্ষ হইত। উহার ফলে অনেক সময় বঙ্গের ভাগ্য পরিবর্তিত হইয়া যাইত। সেই কথাই আমরা বলিতেছি; কিন্তু অগ্রে দেখিব, এই পর্তুগীজগণ কোথা হইতে আসিল এবং কেমন করিয়া তাহারা ফিরিঙ্গি নাম পাইয়াছিল।

পর্তুগাল ইয়োরোপের একটি প্রান্তবর্ত্তী ক্ষুদ্ররাজ্য। কিন্তু ১৫শ শতাব্দীতে নৌসাধনে অনেক নূতন দেশ আবিষ্কার করিয়া এই ক্ষুদ্র রাজ্য অনেক বড় দেশের চক্ষু ফুটাইয়াছিল। পর্তুগীজ নরপতি মানুয়েলের রাজত্ব কালে ভাস্কো ডা গামা আফ্রিকার দক্ষিণ ঘুরিয়া ভারতবর্ষে আসেন। অনেককাল হইতে ইয়োরোপের লোকেরা স্বর্ণভূমি ভারতে আসিবার পথ আবিষ্কার করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছিল; পর্তুগীজ গামা সে পথ বাহির করিয়া খ্যাতিলাভ করিলেন। শুধু পথ দেখান নহে, পর্তুগীজরা বাণিজ্য ও রাজ্যবিস্তার এই উভয় কল্পনা লইয়া কাৰ্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইল। ক্রমে তাহারা পশ্চিম ভারতে সমুদ্র তীরবর্ত্তী নানাস্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য পত্তন করিল; অল্প কাল মধ্যে গোয়া নগরীতে দুর্গ ও রাজধানী স্থাপন করিয়া নানাস্থানের সহিত বাণিজ্য করিতে লাগিল। গামা বঙ্গদেশে না আসিলেও তাহার কথা জানিতেন এবং তৎসম্বন্ধে লিখিয়া যান। বঙ্গকে তখন ভারতের ভূ-স্বর্গ (Paradise of India) বলা হইত। মোগলদিগের সনন্দাদিতে ঐ নামেই বঙ্গদেশের পরিচয় ছিল।[১]

একে বঙ্গ নদীমাতৃক দেশ, তাহাতে আবার উহার দক্ষিণাংশ গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। এদেশে অসংখ্য নদীর জলে ক্ষেতে ক্ষেতে সোণা ফলে; নদীর কূলে দুর্গম প্রদেশে স্বচ্ছন্দে বাস করা যায়।[২] নদীপথে যাতায়াতের সুবিধা থাকিলেও যাহারা নাববিদ্যায় সুদক্ষ নহে, বঙ্গ তাহাদের পক্ষে দুর্গম প্রদেশ। তথায় নদী বেষ্টিত স্থান মাত্রই দুর্গের মত হয়। এজন্য এ প্রদেশ পলায়িত বা দুর্বৃত্তের আশ্রয়স্থল। রাজা প্রজা বহুজনে এদেশে আসিয়া গুপ্তভাবে রহিয়া গিয়াছেন। পাঠান আমলে খাঁ জাহান বা শাহ জালাল প্রভৃতি কত সাধু ফকির এখানে আস্তানা করিয়া ছিলেন; দনুজমৰ্দ্দন কিরূপে চন্দ্রদ্বীপে রাজ্যস্থাপন করেন, হুসেন-পুত্র নসরৎ কিরূপে খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাটে পিতার জীবদ্দশাতেই রাজত্ব করিয়া গিয়াছিলেন, তাহা আমরা প্রথম খণ্ডে দেখাইয়াছি।[৩] মোগল আমলেও হুমায়ুন, শের খাঁ, শাহজাহান প্রভৃতি কত রাজা বা আমীর এদেশে আসিয়া বিদ্রোহ পতাকা উড্ডীন করেন। ভূঞারাজগণ বহুকাল বঙ্গের নানাভাগে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়াছিলেন। তেমনি পর্তুগীজ, ইংরাজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ প্রভৃতি পাশ্চাত্য জাতিগণ বঙ্গে আসিয়াই সমৃদ্ধি ও শক্তিবৃদ্ধির পথ বাহির করেন।[৪] ইংরাজরাজ্যের প্রথম সোপান বঙ্গ হইতে আরব্ধ হয়। কিন্তু সে কথায় এখন আমাদের কাজ নাই।

আমরা দেখিতে পাই, পর্তুগীজদিগের প্রথম আমলে অথবা ১৬শ শতাব্দীর প্রথমভাগে তাহারা বঙ্গে আসিতে থাকে। শুধু বাণিজ্যের লোভে নহে, অন্য কারণেও বঙ্গ তাহাদের ক্রীড়াক্ষেত্ৰ হইয়াছিল। তাহারা নাববিদ্যায় দক্ষ, বঙ্গে তাহার যথেষ্ট প্রসার আছে। তাহারা দুঃসাহসিক অভিযান ভালবাসে, বঙ্গে তাহার সুযোগ মিলে। এখানে বীরত্ব দেখাইলে রাজ্য-জয় হয়, দস্যুতা করিলে অর্থলাভ হয় এবং ধন ও জীবন লইয়া পলায়ন বা বসতি স্থাপন উভয়ই সহজ-সাধ্য। সুতরাং এই দেশই তাহাদের জাতীয় প্রতিভা বা প্রকৃতির অনুকূল।[৫] পর্তুগীজেরা ১৬শ শতাব্দীর প্রথমভাগে হুসেন শাহের রাজত্বকালে প্রথম বঙ্গে আসে। ১৫১৭ খৃষ্টাব্দে সৰ্ব্বপ্রথম কোয়েলহো (Coelho) চট্টগ্রামে আসেন; পর বৎসর সিলভিরা (Silveria) আরাকাণে দেখা দেন। শেষে প্রতি বৎসর তাহাদের তরণী পণ্যভার লইয়া বঙ্গে আসিত। ১৫২৮ অব্দে ডে মেলো (De Mello) ধরা পড়িয়া বহুকাল গৌড়ে বন্দী ছিলেন। মামুদ শাহের রাজত্ব কালে পর্তুগীজেরা চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের আদেশ পায় (১৫৩৭-৮); তাহারা এই দুই স্থানকে যথাক্রমে বড় বন্দর (Proto Grande) ও ছোট বন্দর (Porto Pequeno) বলিত। ক্রমে হুগলীতে পর্তুগীজদিগের প্রধান আড্ডা হইলেও তাহাকেই ছোট বন্দর বলা হইত।[৬] সের খাঁর আক্রমণকালে পর্তুগীজেরা মামুদ শাহের পক্ষে যুদ্ধ করে এবং তাহারা শকড়িগলি ও তেলিয়াগড়িতে বঙ্গের দ্বার রক্ষা করিবার ভার পাইয়াছিল। ১৫৮৮ খৃষ্টাব্দে যখন র‍্যালফ্ ফিচ্ (Ralph Fitch) বঙ্গে আসেন, তখন হুগলী সম্পূর্ণরূপে পর্তুগীজদিগের অধিকৃত দেখিতে পান।[৭] পর্তুগীজেরা নৌবাহিনীর নিরাপদ আশ্রয় স্থানকে বন্দর বলিত, এই বন্দর কথা হইতে ‘ব্যাণ্ডেল’ হইয়াছে; এক সময়ে বঙ্গে তাহাদের অনেকগুলি ব্যাণ্ডেল ছিল। হুগলীর নিকটবর্ত্তী ব্যাণ্ডেল নামক স্থানের উৎপত্তি এইরূপ। এই সকল উপনিবেশে অবস্থান করিবার সময় তাহাদের বিশেষ কোন শাসন-ব্যবস্থা ছিল বলিয়া বোধ হয় না। ১৫৮৩ হইতে ১৫৮৯ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত লিন্‌সটেন (Van Linsechoten) নামক পর্যটক ভারতবর্ষে ছিলেন; তিনি বলিয়া গিয়াছেন, হুগলী প্রভৃতি স্থানে পর্তুগীজদিগের আড্ডা ছিল বটে, কিন্তু সেখানে তখনও তাহাদের কোন দুর্গ বা শাসন-শৃঙ্খলা ছিল না; তাহারা যেখানে সেখানে অব্যবস্থিতভাবে বাস করিত, স্ব স্ব প্রধান ছিল, কেহ কাহারও শাসন মানিত না। তাহারা নানা অপরাধে অপরাধী বলিয়া একস্থানে স্থায়িভাবে বসতি করিতে সাহসী হইত না।[৮]

পশ্চিম ভারতে বম্বে অঞ্চলে যে সব পর্তুগীজ বাস করিত, তাহাদের মধ্যে অনেকে গুরুতর দুর্বৃত্ততার জন্য অপরাধী হইত। তখন গোয়ার পর্তুগীজ গভর্ণমেন্টের হস্তে শাস্তি পাইবার ভয়ে পলায়ন করিয়া বঙ্গে আসিত। বম্বে অঞ্চল হইতে আসিত বলিয়া এই জাতীয় লোকের সাধারণ নাম ছিল ‘বম্বেটে’। দস্যুবৃত্তিই এদেশে তাহাদের প্রধান ব্যবসায় হইত, এজন্য তদবধি দস্যুদুৰ্ব্বত্তদিগকে এদেশে এখনও বম্বেটে বলা হয়। প্রথমতঃ আরাকাণ ও চট্টগ্রামের উপকূলে নানাস্থানে তাহাদের আড্ডা হয়। তথা হইতে তাহারা পূর্ব্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে প্রবেশ করিত; চট্টগ্রাম হইতে বঙ্গে আসিতে, পথে পড়িত সন্দ্বীপ। এই সন্দ্বীপ বা সোমদ্বীপ বঙ্গোপসাগরের মধ্যে একটি সমুব্বর সুন্দর দ্বীপ; উৎপন্ন শস্য ও পণ্যের গৌরবে উহার নাম ছিল স্বর্ণ দ্বীপ। সেই স্বর্ণ দ্বীপ কথা হইতেই সন্দ্বীপ নাম হইয়াছে। দ্বীপটি ১৪ মাইল দীর্ঘ ও ১২ মাইল প্রশস্ত।[৯] ফ্রেডারিক্ নামক একজন ভিনিসীয় পৰ্য্যটক ১৫৬৯ খৃষ্টাব্দে সন্দ্বীপ পরিদর্শন করেন। তাঁহার মতে সন্দ্বীপ তখন একটি প্রধান উর্ব্বরতাশালী বহুজনপূর্ণ সমৃদ্ধ দ্বীপ।[১০] ডু-জারিকের ১৬১০ খৃষ্টাব্দের বিবরণী হইতে জানা যায়, সন্দ্বীপ লবণের ব্যবসায়ের জন্য ভারতের মধ্যে প্রধান ছিল। প্রতি বৎসর দুইশতের অধিক জাহাজ লবণ বোঝাই করিবার জন্য এখানে উপস্থিত হইত।[১১] সন্দ্বীপের এইরূপ সমৃদ্ধির জন্য তৎপ্রতি মগ, পর্তুগীজ, মোগল বা ভুঞারাজগণের লোলুপ দৃষ্টি পড়িয়াছিল এবং তাহারই ফলে সন্দ্বীপের কূলে ও জলে বহুবার ভীষণ রণক্রীড়া হইয়াছিল, সে কথা আমরা যথাস্থানে বিবৃত করিব। ফ্রেডারিকের আগমন কালে সন্দ্বীপের প্রধান অধিবাসী ছিল মুর বা মুসলমানগণ। ক্রমে তথায় মগ ও পর্তুগীজগণের বসতি হয়। পুরাতন হিন্দু অধিবাসীর সংখ্যা খুবই কম ছিল। পর্তুগীজদিগের পূর্ব্বে কয়েক বৎসরকাল সন্দ্বীপ বারভুঞার অন্যতম কেদার রায়ের শাসনাধীন ছিল, পরে সে কথা বলিব।

চট্টগ্রামেই পর্তুগীজদের প্রধান উপনিবেশ ছিল। ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম আরাকাণ রাজের অধীন হয়। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, প্রথমতঃ সে রাজার সহিত পর্তুগীজদিগের সম্প্রীতি ছিল; সেই সম্প্রীতির ফলে তাহারা দলে দলে আসিয়া চট্টগ্রামে বাস করিতে থাকে, কারণ এই স্থানের রমণীয় অবস্থান গুণে তাহারা মোহিত হইয়াছিল। ক্রমে তথায় তাহাদের বংশবৃদ্ধি এবং বলবৃদ্ধি হইতে থাকে। অবশেষে ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে তাহারা অস্ত্রবলে চট্টগ্রাম অধিকার করিয়া লয়। কিন্তু তৎপূর্ব্বেও উক্ত সহরে পাহাড়তলীর নিকট তাহাদের একটি দুর্গ ছিল এবং চট্টগ্রামের দক্ষিণে অর্থাৎ কর্ণফুলি নদীর মোহানার অপরপারে ডিয়াঙ্গা (Dianga) নামক স্থান তাহাদের বসতির জন্য একটি বড় সহর হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ডাঙ্গা হইতে ডিয়াঙ্গা হইয়াছিল, এখনও উহাকে ফিরিঙ্গির বন্দর বা শুধু বন্দর নামে অভিহিত করা হয়। কেবল ডিয়াঙ্গায় নহে, আরও কয়েকটি স্থানে পর্তুগীজদিগের প্রধান উপনিবেশ ছিল। তন্মধ্যে একটি স্থানের নাম রামু (Ramu )।[১২] বোধ হয় ইহারই পূর্ব্বনাম রামাবতী ছিল। তবে ডিয়াঙ্গাই যে তাহাদের প্রধান উপনিবেশ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই স্থানেই তাহাদের প্রথম গীর্জ্জা নির্মিত হয় (১৫৯৯)।[১৩]

ভাস্কো ডা গামার সময় হইতে পর্তুগীজগণ যখন এদেশে আসিত, তাহারা স্বদেশ হইতে স্ত্রীলোক সঙ্গে আনিতে অনেকে পারিত না। উহার ফল এই হইয়াছিল যে, কোন সুযোগ পাইলে বা যুদ্ধ-বিদ্রোহ কালে তাহারা এদেশীয় স্ত্রীলোকদিগের উপর পাশবিক অত্যাচার করিত। অবশেষে গোয়া নগরী অধিকারের পর নরপতি মানুয়েলের আদেশক্রমে গোয়ার শাসনকর্তা আলবুকার্ক পর্তুগীজেরা এদেশীয় স্ত্রীলোক বিবাহ করিতে পারিবে বলিয়া অভিমত প্রচার করেন। তবে নিয়ম ছিল, তাহারা উত্তম বংশীয় স্ত্রীগণকে খৃষ্টান করিয়া লইয়া পরে বিবাহ করিবে।[১৪] যাহারা নিয়মানুসারে বিবাহ করিত, আলবুকার্ক তাহাদিগকে বসতির জমি দিতেন। কিন্তু নিয়ম আর কয়দিন থাকে? তবে বিবাহ হউক বা না হউক, বহুজনে স্ত্রীলোক গ্রহণ করিয়া গৃহস্থ হইল। এইভাবে গোয়ার লোক সংখ্যা বাড়িতে লাগিল বলিয়া অন্যস্থানের পর্তুগীজদিগের ঈর্ষা হইল এবং তাহারাও কোন প্রকারে বিবাহ করিয়া মনুষ্য-সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে লাগিল। এইরূপে যাহারা বিবাহ করিয়া বাস করিত, তাহারা অর্থপ্রাচুর্য্যে সুখে থাকিত, আর কখনও দেশে ফিরিতে চাহিত না। শুধু ভারতবর্ষে নহে, এইরূপে পর্তুগীজেরা নানাদেশে রক্ত সম্বন্ধ পাতাইয়া দেশ ভুলিয়া গেল; পর্তুগালে স্ত্রী সমাজে ব্যভিচার প্রবেশ করিল এবং দেশ ক্রমে মনুষ্যশূন্য হইতে লাগিল। অল্পকাল মধ্যে যে উদ্যমশীল পর্তুগীজ জাতির পতন হইল, তাহার প্রধান কারণ এই। অবশেষে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে পর্তুগাল যখন স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হইল, তখন হইতে পর্তুগীজ জাতির ব্যক্তিত্ব মুছিয়া যাইতে লাগিল, উপনিবেশের অধিবাসীর সঙ্গে স্বদেশের সম্বন্ধ শিথিল হইয়া গেল। তখন হইতে যাহারা ভারতবর্ষে ছিল, তাহাদের অধিকাংশের ব্যবসায় হইল দস্যুতা ও ইন্দ্রিয়-সেবা। তাহাদের সহিত এদেশীয় স্ত্রীলোকের সংযোগে যে বর্ণসঙ্কর জাতির উৎপত্তি হয়, তাহারাই ফিরিঙ্গি নামে খ্যাত।[১৫]

এই পর্তুগীজ বা ফিরিঙ্গিদের মধ্যে যাহারা দুর্বৃত্ততার জন্য পদচ্যুত হইয়া বা স্বজাতির নিকট মুখ দেখাইতে না পারিয়া বঙ্গদেশে পলাইয়া আসিত, তাহারা চরিত্রদোষে জাতি হারাইয়া এদেশে স্থায়িভাবে বাস করিত এবং বিলাস স্রোতে গা ঢালিয়া দিত; অনেকে একাধিক বিবাহ করিত বা উপপত্নী রাখিত এবং ক্রমে স্ত্রীপুত্রের জন্য ভারাক্রান্ত হইয়া অর্থসংগ্রহে ব্যস্ত হইয়া পড়িত। যখন বাণিজ্যে তাহাদের তৃষ্ণা মিটিত না, তখন তাহারা দস্যু-ব্যবসায় অবলম্বন করিবে, ইহাতে বিচিত্রতা কি? ফিরিঙ্গি দস্যুরা আরাকান, চাটিগাঁও, সন্দ্বীপ প্রভৃতি স্থানে বসতি করিয়া তথা হইতে লুঠপাটের জন্য বঙ্গের দক্ষিণভাগে ঢাকা হইতে সগরদ্বীপ পর্য্যন্ত যাতায়াত করিত। আরাকাণী মগ ও এদেশীয় অন্য দস্যুরা আসিয়া তাহাদের সঙ্গে যোগ দিত। মগদিগের সহিত ফিরিঙ্গিগণের চরিত্রের মিল ছিল; এজন্য তাহারা ফিরিঙ্গিদিগকে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়াছিল। মগেরা পূর্ব্ব হইতেই দস্যুতা করিত; দস্যুতার শাস্ত্রে কে কাহার শিক্ষক, তাহা বলিবার উপায় নাই। মগেরা অনেকে স্ত্রীপুত্ৰ লইয়া নৌকার উপর বাস করিত, যাযাবর জাতির মত একস্থান হইতে সপরিবারে অন্যত্র যাইবার আপত্তি ছিল না।[১৬] ফিরিঙ্গিদিগেরও স্ত্রী সঙ্গে লইয়া চলা ফেরা স্বভাবসিদ্ধ। অচিরে মগের সহিত ফিরিঙ্গিরা মিশিয়া গেল এবং দস্যুবৃত্তির মন্ত্র দেশময় ছড়াইয়া পড়িল। পতিত ফিরিঙ্গির সহিত মিশিয়া বৌদ্ধ মগগণও পতনের শেষ সীমায় নামিল। এই দুই জাতির দস্যুবৃত্তির সহিত যে দক্ষিণবঙ্গের অনেক পলায়িত বা পরিত্যক্ত হিন্দু মুসলমান যোগ দিত না, তাহা নহে। সকলে মিলিয়া এক নূতন দস্যুর জাতি গড়িয়াছিল, তাহাদের অমানুষিক উৎপাতে বঙ্গদেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া যাইতেছিল। এই দুর্দিনে, এই দুরন্ত দস্যুদলের দমন জন্য সগর্ব্বে দণ্ডায়মান হইয়া মহাবীর প্রতাপাদিত্য ও তাঁহার সহযোগী ভুঞাগণ বহুদিন পৰ্য্যন্ত দেশ রক্ষা করিয়াছিলেন। সে দস্যুতার বিভীষিকাময় দৃশ্য না দেখিলে কেহ বঙ্গবীরগণের কৃতিত্ব ও পুরুষত্বের পূর্ণ পরিচয় পাইবেন না। লেখনী কলঙ্কিত হইলেও আমরা সে নির্মমতার চিত্র প্রকটিত করিতে চেষ্টা করিব।

ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে বঙ্গে কোন সুশাসন ছিল না; তখন এই মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুগণ বঙ্গের দক্ষিণ দিক হইতে নদীপথে দেশের মধ্যে যেখানে সেখানে প্রবেশ করিত এবং লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও জাতিনাশ করিয়া বঙ্গের শান্ত পল্লীগুলিকে শ্মশানে পরিণত করিবার উপক্রম করিয়াছিল। বর্তমান বরিশাল, খুলনা ও চব্বিশপরগণা জেলার দক্ষিণাংশ উহাদের প্রধান ক্রীড়াক্ষেত্র হইয়াছিল। আমরা প্রথম খণ্ডে দেখাইয়াছি, এই মগ ও ফিরিঙ্গির অত্যাচার সুন্দরবন ধ্বংসের অন্যতম কারণ। সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস ছিল; শুধু নৈসর্গিক বিপর্যয়ে লোকের বাস উঠিয়া যায় নাই; গেলেও পুনরায় ভূমির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তথায় মনুষ্যাবাস বসিত। কিন্তু এই মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের অত্যাচারে কেহ আসিতে বা তিষ্টিতে পারে নাই। বৈদেশিক ভ্রমণকারিগণ এই অত্যাচারের জলন্ত সাক্ষ্য দিয়াছেন। বার্ণিয়ারের[১৭] ভ্রমণ কাহিনীতে আছে চৌর্য্য ও দস্যুতাই উহাদের প্রধান ব্যবসায় ছিল। তাহারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্রুতগামী জাহাজ লইয়া সমুদ্রপথে দ্বীপপুঞ্জের উপর পড়িত অথবা নদী নালা বাহিয়া শতাধিক মাইল পর্য্যন্ত দেশের ভিতর প্রবেশ করিত; সহর, বাজার বা জনসংঘ দেখিলে কিংবা দরিদ্র ভদ্রলোকগণের বিবাহাদি উৎসব ও কোন ক্রিয়াকর্ম্মের সন্ধান পাইলে তথায় গিয়া আক্রমণ করিত। যাহা পাইত লুটিয়া লইত; ছোট বড় সব স্ত্রীলোককে অসাধারণ নির্দয়তার সহিত ধরিয়া লইয়া দাস-শ্রেণীভুক্ত করিত; যাহা লইতে পারিত না, তাহা অগ্নিসাৎ করিয়া দিয়া যাইত। এই জন্যই গঙ্গার মোহানায় যে সকল দ্বীপ পূর্ব্বে জনাকীর্ণ ছিল, তাহা এক্ষণে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং সে সব স্থানে ব্যাঘ্রাদি বন্যজন্তু ভিন্ন অন্য অধিবাসী নাই। অধিবাসীদিগের মধ্যে যাহারা পলাইবার সুযোগ বা সামর্থ্য না থাকায় দস্যুহস্তে বন্দী হইত, দস্যুরা তাহাদের মধ্যে অচল অকর্ম্মণ্য বৃদ্ধ স্ত্রীপুরুষদিগকে হয়ত পরদিনই যেখানে সেখানে সস্তায় বেচিয়া ফেলিত। সমর্থ পুরুষদিগের মধ্যে কতক খালাসী করিত এবং কতককে খৃষ্টান করিয়া নিজেদের দস্যু-ব্যবসায়ের সহযোগী করিয়া লইত। অবশিষ্ট যাহা থাকিত, তাহাদিগকে গোয়া, সিংহল, মাদ্রাজ প্রভৃতি নানাস্থানে বিক্রয় করিয়া আসিত। এবং মিশনরীগণ শত চেষ্টা করিয়া দশ বছরে যাহা না পারিতেন, তাহারা এইভাবে এক বৎসরে তদপেক্ষা অধিক লোককে খৃষ্টান করিয়া গৰ্ব্ব অনুভব করিত।[১৮]

বাদশাহ আওরঙ্গজেবের রাজত্বের প্রথমভাগে যখন বাঙ্গালার নবাব মীরজুল্লা আসাম জয় করিবার জন্য বিরাট মোগলসৈন্য পরিচালনা করেন, তখন শিহাব্‌উদ্দীন মহম্মদ তালীশ নামক জনৈক কর্মচারী তাঁহার সহযাত্রী হন। তালীশ এই আসামাভিযানের এক বিস্তীর্ণ বিবরণী লিখিয়া গিয়াছেন। উহার অনেক প্রতিলিপি দেখা যায়, এমন কি, উর্দু, ফরাসী প্রভৃতি ভাষায় উহার অনুবাদ হইয়াছিল।[১৯] অক্সফোর্ডের বিখ্যাত বড়লিয়ান লাইব্রেরীতে তালীশের গ্রন্থের যে হস্তলিপি পুঁথি আছে, তাহার পশ্চাতে এক পরিশিষ্ট ছিল।[২০] অধ্যাপক যদুনাথ সরকার মহোদয় ঐ পরিশিষ্টের পত্র সমূহের ফটো আনাইয়া তাহার অনুবাদ প্রচার করেন।[২১] উহার মধ্যে সায়েস্তা খাঁর চট্টগ্রাম-বিজয়ের ইতিবৃত্ত আছে এবং সেই প্রসঙ্গে চট্টগ্রামে মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুগণের অত্যাচার-কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। অধ্যাপক সরকার মহাশয় উক্ত তালীশের বিবরণী এবং আলমগীর-নামার সাহায্যে এই অত্যাচার সম্বন্ধে একটি সুলিখিত প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছিলেন।[২২] উহা হইতে আমরা জানিতে পারি, কিরূপে আরাকাণী মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুগণ জলপথে আসিয়া বঙ্গদেশ লুণ্ঠন করিত। তাহারা হিন্দু, মুসলমান, স্ত্রী পুরুষ বহুজনকে ধরিয়া লইয়া যাইত। উহারা বন্দীদিগের হাতের তালু ছিদ্র করিয়া তন্মধ্য দিয়া সরু বেত চালাইয়া দিত এবং এই ভাবে হালি গাঁথিয়া লইয়া হতভাগ্যদিগকে তাহাদের জাহাজের পাটাতনের নিম্নে একটির উপর একটি রাখিয়া স্তূপীকৃত করিয়া বোঝাই করিয়া লইয়া যাইত। লোকে যেমন কুক্কুটাদি পক্ষীর খাদ্যের নিমিত্ত শস্য ছড়াইয়া দেয়, সেইভাবে বন্দীদিগের খাদ্যের নিমিত্ত সকালে বিকালে অসিদ্ধ তণ্ডুল-মুষ্টি নিক্ষেপ করিত। এই খাদ্যে যাহারা প্রাণ ধারণ করিতে পারিত, দেশে ফিরিয়া দস্যুরা তাহাদিগকে সামর্থ্য অনুসারে চাষ বা অন্য কঠিন কার্য্যে নিয়োজিত করিত। অবশিষ্টগুলিকে দাক্ষিণাত্যে লইয়া গিয়া ওলন্দাজ, ইংরাজ বা ফরাসী বণিকের নিকট বিক্রয় করিয়া আসিত। সময় সময় তাহাদিগকে তমলুক ও বালেশ্বর বন্দরে লইয়া গিয়া বিক্রয়ার্থ উপস্থিত করিত। তাহাদের বিক্রয়ের প্রণালী এইরূপ ছিল : বন্দীর জাহাজ উক্ত বন্দরে পৌঁছিলে, তাহারা লোক পাঠাইয়া স্থানীয় অধিবাসিগণকে সংবাদ দিত। দস্যুগণ তাহাদের উপর অত্যাচার করিতে পারে এই ভয়ে ক্রেতারা লোকজন সঙ্গে করিয়া তীরে উপস্থিত হইত এবং জনৈক লোককে টাকাকড়ি সঙ্গে দিয়া দস্যুদিগের জাহাজে প্রেরণ করিত। দর দামে বনিলে দস্যুরা টাকা লইয়া বন্দীদিগকে তীরে উঠাইয়া দিত। সাধারণতঃ এইভাবে ফিরিঙ্গিরাই বন্দীদিগকে বিক্রয় করিত; মগেরা তাহাদিগের দ্বারা কৃষিকার্য্যাদি করাইয়া লইত। পাদ্রী ম্যানরিক্ খৃষ্টান ফিরিঙ্গিগণের পক্ষ হইতে আরাকাণরাজের নিকট যে নিবেদন জানাইয়াছিলেন, তন্মধ্যে তাঁহার নিজের কথাতেই আছে : ‘প্রত্যেকেই জানেন এই পর্তুগীজগণ কিরূপে প্রতি বৎসর বালা, সলিমানাবাদ, যশোর, হিজলী ও উড়িষ্যা প্রভৃতি রাজ্যের উপর আক্রমণ করিয়া (মোগল) শত্রুর শক্তি নাশ এবং আপনার (আরাকাণরাজের) শক্তি বৃদ্ধি করিয়াছে। তাহারা সম্পূর্ণ নগরী ও গ্রামগুলি পর্য্যন্ত আপনার রাজ্যে লইয়া আসিয়াছে। এমনও বৎসর গিয়াছে, যে বৎসর তাহারা এই রাজ্যে এগার হাজার পরিবারকে আনিয়া বসিত করাইয়াছে।’[২৩] এই ম্যানরিকের বিবরণীর অন্যত্র হইতে জানা গিয়াছে যে, তিনি যে পাঁচ বৎসর কাল আরাকাণে ছিলেন, তন্মধ্যে পর্তুগীজ ও মগ দস্যুগণ বঙ্গদেশের এই সকল স্থান হইতে ১৮০০০ লোক ডিয়াঙ্গা ও অঙ্গারখালি (Angarcale) নামক স্থানে আনিয়াছিল। চট্টগ্রাম হইতে হুগলী পৰ্য্যন্ত কোন স্থানই তাহাদের উৎপাতে নিরাপদ ছিল না।[২৪] যশোরের উপরই যেন তাহাদের উৎপাত সর্ব্বাপেক্ষা বেশী ছিল। এখানে যশোর বলিতে যশোর-রাজ্য বা খুলনার দক্ষিণাংশই বুঝিতে হইবে। ম্যানরিক্ আরাকাণে যাইবার পথে যখন ডিয়াঙ্গায় উপস্থিত হন, তখন শুনিলেন পর্তুগীজ কাপ্তেনেরা ঐরূপ দস্যুতার জন্য যশোরে গিয়াছিল।[২৫] হুগলীর নিকট যে সকল পর্টুগীজেরা আড্ডা করিয়াছিল, তাহারা ভাগীরথী প্রভৃতি নদীপথে দস্যুতা করিত, মাশুল না লইয়া কোন জাহাজ বা নৌকাকে চলিতে দিত না। এই সময়ে গ্রামে গ্রামে ছেলে-ধরার ভয় হইয়াছিল। ‘পর্তুগীজেরা ছোট ছোট ছেলে ধরিয়া বিভিন্ন দেশে লইয়া গিয়া বিক্রয় করিত। ইহাদের উৎপাতে যে কত সহর, কত শত গ্রাম উৎসন্ন হইয়াছে, কত শত বণিকের সর্ব্বনাশ হইয়াছে, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।[২৬] এই জন্যই সম্রাট শাহজাহানের আদেশে ১৬৩৩ খৃষ্টাব্দে একবার এই ‘প্রতিমাপূজক ফিরিঙ্গিরা অধিকাংশ হত, আহত ও নিদারুণরূপে অপমানিত হইয়া হুগলি অঞ্চল হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিল।’

এইরূপে বহুকাল ধরিয়া অবিরত পাশবিক দস্যুবৃত্তি চলিয়াছিল। তাহার ফলে আরাকাণ অঞ্চলে যেমন লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছিল, দক্ষিণ বঙ্গ তেমনি ক্রমশঃ জনশূন্য ও আত্মরক্ষাকল্পে শক্তিশূন্য হইয়া পড়িতেছিল। চট্টগ্রাম হইতে ঢাকা পর্য্যন্ত নদীর কূলে সকল স্থানে মনুষ্যাবাসের চিহ্ন পৰ্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়াছিল; তাহাদের লুণ্ঠন ও মনুষ্যাপহরণের জন্য পথের পাশে কোন স্থানে কোন লোক বাস করিত না, প্রদীপের বাতি জ্বলিত না।[২৭] গ্যাষ্ট্রেল ও রেণেলের প্রাচীন ম্যাপের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, দক্ষিণবঙ্গের বহুস্থান এই দস্যুদিগের দ্বারা জনশূন্য হইয়াছিল বলিয়া স্পষ্টতঃ উল্লেখিত হইয়াছে।[২৮]

মগেরা আসিয়া যে মুল্লুকের উপর পড়িত, তাহার শাসন-নীতি মানিত না, একেবারে ধ্বংস করিয়া ছাড়িত। শাসনহীন প্রদেশকে এখনও লোকে ‘মগের মুল্লুক’ বলে। সমস্ত দক্ষিণবঙ্গ এইরূপে মগের মুল্লুক হইয়া গিয়াছিল। তাহার পরে আসিল ফিরিঙ্গি। তাহারাও অনেক দেশকে নিজের দেশ করিয়াছিল, অনেক জলপথকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত করিয়া লইয়াছিল। সুন্দরবনের সমৃদ্ধ নগরীসমূহ তাহারাই বিনষ্ট করিয়াছিল। এখনও সুন্দরবনের মধ্যে ‘ফিরিঙ্গিখালি’, ‘ফিরিঙ্গির দোয়ানিয়া’, ‘ফিরিঙ্গি ফাঁড়ি’ প্রভৃতি নামসমূহ অনেক প্রাচীন হৃদয়-বিদারক স্মৃতি জাগরূক করিয়া দিয়া থাকে। আমরা কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে পড়িয়াছি,– ‘ফিরিঙ্গির দেশখান বাহে কর্ণধার। ‘পর্তুগীজদিগের নৌবহরের নাম আরমাডা (Armada); উহারই অপভ্রংশে হাম্মাদ হইয়াছে। উহা হইতে ফিরিঙ্গি দস্যুদিগকেই এদেশের লোকে ‘হারমাদ’ বলিত।[২৯] দুঃসাহসিক বঙ্গীয় বণিকগণ “রাত্রিদিন বাহে ডিঙ্গা হারমাদের ডরে’, এইরূপ বর্ণনা আছে। কিন্তু বহুদিন সে বণিকের দুঃসাহস থাকিল না। যে বঙ্গবাসিগণ নানা দ্বীপোপদ্বীপে গিয়া উপনিবেশ স্থাপন ও সভ্যতা বিস্তার করিয়াছিল, তাহাদের গতিপথ রুদ্ধ হইল; যে বঙ্গবণিকেরা সচরাচর সিংহল পৰ্য্যন্ত স্বচ্ছন্দে বাণিজ্য করিত, তাহাদের ব্যবসায় বন্ধ হইয়া গেল। তাহাদের অগণ্য পণ্য কতক লুটিয়া লইত, কতক বা হাট বাজার হইতে সস্তায় কিনিয়া লইয়া এই ফিরিঙ্গিরা অর্থাগমের পথ সোজা করিত এই সময় হইতে দেশীয় বণিকদিগের পক্ষে সামুদ্রিক বাণিজ্য বন্ধ হইল। অনেক আদার ব্যাপারীও পূর্ব্বে জাহাজের খবর রাখিত, এখন তাহারা কুপমণ্ডূকের মত গণ্ডীবদ্ধ হইয়া পড়িল। তখন পণ্ডিতেরা কথায় কথায় বলিতেন ‘কিমাদ্রক-বণিজঃ বহিত্র-চিন্তয়া’, অর্থাৎ আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে কাজ কি? যে বঙ্গ একদিন শস্য-সম্ভারের প্রাচুর্য্যে জগতের পণ্যভাণ্ডার বলিয়া গণ্য হইত, সে বঙ্গ আজ অন্ন-বস্ত্রের অভাবে দীনা হীনা কাঙালিনী। আজ আমাদের প্রাচীন গৌরব বিলুপ্ত; আমাদের ঔপনিবেশিকতা বা বাণিজ্য প্রবৃত্তি একেবারে সুষুপ্ত; আমাদের সমুদ্রযাত্রা শাস্ত্রশাসনে নিষিদ্ধ। যাহারা এক দিন সগৰ্ব্বে সপ্ত ডিঙ্গা ভাসাইয়া সিংহলে, সৌরাষ্ট্রে বা আম্মাজে গিয়া অবাধে বাণিজ্য করিত, তাহারা আজ কালাপানির ভয়ে থরহরি কম্পিত। কেন এমন হইল? কখন হইতে এমন হইল? কে বঙ্গের ধ্বংসের পথ প্রথম প্রস্তুত করিল? অনুসন্ধিৎসু পাঠকমাত্রেই স্বচ্ছন্দে ঘোষণা করিতে পারিবেন, এই মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুর অবিশ্রান্ত আক্রমণ, অক্লান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অমানুষিক অত্যাচারই বঙ্গধ্বংসের অন্যতম কারণ। এই অত্যাচারে বঙ্গের যাহা অনিষ্ট হইয়াছে, এমন অনিষ্ট বোধ হয় কোন দেশের আধুনিক ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যিনি যখন এই অত্যাচার হইতে বঙ্গবাসীকে রক্ষা করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন, তিনিই ধন্য, তিনিই প্রকৃত স্বদেশহিব্রতে সর্বাগ্রগণ্য। মহারাজ প্রতাপাদিত্য এই অত্যাচার নিবারণ করিবার জন্য কত দুর্গ নির্ম্মাণ ও সৈন্য গঠন করিয়াছিলেন; তাহার বিবরণ পরে দিবার জন্যই পূর্ব্বক্ষণে এই অত্যাচারকাহিনী বর্ণনা করিয়া লইতেছি। আমরা দেখিব, প্রতাপাদিত্য যত দিন জীবিত ছিলেন, ততদিন এই দস্যুদিগের উৎপাত দমিত ছিল; তাঁহার মৃত্যুর পর হইতে সিবাষ্টি গঞ্জেলিস নামক এক দুর্দান্ত নায়কের কর্তৃত্বাধীন হইয়া আবার ফিরিঙ্গিরা ভীষণ হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপে আবার ৫০ বৎসর কাল তাহাদের দারুণ অত্যাচার চলিয়াছিল, ম্যানরিকের চাক্ষুষ সাক্ষ্য হইতে তাহার কতক আভাস পূর্ব্বে দিয়াছি। বঙ্গেশ্বর সায়েস্তা খাঁ সর্ব্বশেষে ইহাদের সর্ব্বনাশ সাধন করেন। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বিজয়কালে তিনি বহুক্ষেত্রে রণক্রীড়া করিয়া দুর্দান্ত দস্যুদলকে ‘সায়েস্তা’ করিয়া অর্থাৎ পর্যুদস্ত ও নিয়মানুবর্ত্তী করিয়া দিয়াছিলেন। এখনও আমাদের ভাষায় দুৰ্ব্বিনীত লোককে ‘সায়েস্তা’ করিবার কথা প্রচলিত আছে।

বাঙ্গালা মুল্লুক এই সব দস্যুদলের খাস তালুকের মত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। সায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রাম জয় করিলে, মগ ও ফিরিঙ্গি উভয় জাতিই তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। তখন জনৈক প্রধান কাপ্টেনের অধীন কতকগুলি ফিরিঙ্গি ঢাকায় গিয়া নবাবের শরণাপন্ন হয়। সায়েস্তা খাঁ তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা যে আরাকাণীদের পক্ষভুক্ত হইয়া মোগলের সহিত যুদ্ধ কর, মগেরা তোমাদের বেতন কি ভাবে দিত?’ তদুত্তরে তাহারা সরল ভাবে বলিয়াছিল, ‘মোগলরাজ্য আমাদের বেতনের জন্য নির্দ্দিষ্ট ছিল; বাঙ্গালা দেশকে আমাদের জায়গীর বলিয়া ধরিতাম; সেখানে বারমাস অনায়াসে আমাদের লুণ্ঠন সংগ্রহ করিতাম; এজন্য আমাদের কোন আমলা বা আমীন রাখিতে বা কাহারও নিকট হিসাব নিকাশ দিতে হইত না।’[৩০] এই উক্তিই তখনকার বঙ্গের প্রকৃত অবস্থা জ্ঞাপন করিতেছে।

এইরূপ অবাধ দস্যুতার ফলে বঙ্গবাসী এক সময়ে ধনেপ্রাণে যে কত নিৰ্য্যাতিত হইয়াছিল, তাহা বলিবার নহে। তবে এই সম্পর্কে তাহারা স্বদেশীয় সমাজের নিকটও কম নিগৃহীত হয় নাই। দস্যুর অত্যাচার সায়েস্তা খাঁর সময় হইতে সম্পূর্ণ বন্ধ না হউক, একেবারে কমিয়া গিয়াছিল,[৩১] কিন্তু সমাজের নির্যাতন আজ প্রায় সাড়ে তিন শত বর্ষকাল বা দশ পুরুষ ধরিয়া সমানভাবে চলিতেছে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ফিরিঙ্গি ও মগেরা নদীপথে দেশের মধ্যে বহুদূর প্রবেশ করিত এবং সুযোগমত গ্রামের উপর পড়িয়া রক্তারক্তি, লুটপাট করিত, কিছু না পারিলেও দুই একটি স্ত্রীলোক বা ছেলে ধরিয়া লইয়া যাইত। দেশের লোকে প্রাণের ভয়ে এবং ততোধিক মানের · দায়ে পলায়ন করিতে চেষ্টা করিত। কিন্তু তাহাতেও নিস্তার ছিল না। অনেকে ধরা পড়িয়া জীবন ও ধর্ম্ম ত্যাগ করিতে বাধ্য হইত। স্ত্রীলোকেরা, বিশেষতঃ যাহারা যুবতী অথবা যাহারা নিতান্ত বৃদ্ধা নহে, তাহারা যে কত ঘৃণিত পাশবিক অত্যাচার সহ্য করিত, সে কলঙ্ককাহিনী মসীবর্ণে চিত্রিত করিবার ভাষা নাই; যে সব স্ত্রীলোক পলাইবার কালে কোন প্রকারে ধৃত বা স্পর্শিত মাত্র হইত, তাহারা কোন গতিকে উদ্ধার পাইলেও সমাজের শাসনে জাতিচ্যুত বা সমাজবৰ্জ্জিত হইয়া থাকিত। তাহাদের স্বামী বা পিতা নিঃসন্দেহে তাহাদিগকে পবিত্র জানিয়া স্নেহের কোলে টানিয়া লইলেও, নিৰ্দ্দয় হিন্দু-সমাজের রুক্ষ কটাক্ষ তাহাদের প্রতি কিছুমাত্র সহানুভূতি দেখাইত না। বংশ-কাহিনীর তথ্য জানিতে গিয়া গল্প শুনিয়াছি, একটি স্ত্রীলোক নদীর ঘাটে স্নান করিতেছিল. এমন সময়ে দুই একজন মগ, দস্যুতার উদ্দেশ্যে না হইতে পারে, অন্য কারণে পার্শ্ববৰ্ত্তী পথ দিয়া যাইতেছিল। স্ত্রীলোকটি মগের ভয়ে জলে ডুব দিয়া রহিল, ভাবিল মগেরা চলিয়া গেলে উঠিবে কিন্তু একজন মগ তাহাকে ডুব দিতে দেখিয়া ভাবিল, স্ত্রীলোকটি বোধ হয় আত্মহত্যার জন্য ডুব দিয়াছে; অমনি সে ছুটিয়া গিয়া জল হইতে চুল ধরিয়া তাহাকে তুলিয়া ডাঙ্গায় আনিল; পরে জীবিত দেখিয়া, ব্যাপার বুঝিয়া, তৎক্ষণাৎ তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। স্ত্রীলোকটি কিন্তু সেই স্পর্শমাত্র দোষে চির-জীবনের জন্য চিহ্নিত ও কলঙ্কিত হইয়া থাকিল। তাহার অভিভাবকগণ তাহাকে গ্রহণ করার পাপে পুরুষানুক্রমে পাতিত্য ভোগ করিয়া আসিতেছেন। এমন সব গল্প আছে, দস্যুরা গ্রামের ভিতর দিয়া যাইবার কালে, শুধু রঙ্গরহস্যের জন্য পথের পার্শ্বস্থ স্ত্রীলোকদিগকে অঙ্গুলি দ্বারা স্পর্শ করিত বা তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া থুথু ফেলিত। অঙ্গুলি স্পর্শ হইত বা না হইত, থুথু গায়ে আসিয়া পড়িত বা না পড়িত, দূর হইতে যাহারা এই মগের চেষ্টা দেখিত বা অট্টহাসির রোল শুনিত, তাহারাই হতভাগ্য গৃহস্থকে নিগৃহীত করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিত। ফলে দাঁড়াইত এই, কতকগুলি গৃহস্থ আপনাদের দুর্ভাগ্যবশে অথবা অরক্ষিত অরাজক দেশের দোষে, সমাজে পতিত ও অপবাদগ্রস্ত হইয়া থাকিত। এই কলঙ্ককে ‘ফিরিঙ্গি বা মগো পরিবাদ’ বলিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন বর্গীয় উৎপাত হয়, তখন ‘বর্গীঠেলা’ পরিবাদও হইয়াছিল। কৌলিক বিশৃঙ্খলার আংশিক প্রতিকার কল্পে ব্রাহ্মণ সমাজে যে মেল-বন্ধন হইয়াছিল, এই জাতীয় পরিবাদ যে তাহার অন্যতম কারণ, তাহা বোধ হয় অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এইরূপে পরিবাদগ্রস্ত পরিবারকে মগো- ব্রাহ্মণ, মগো-বৈদ্য, মগো-কায়েত, মগো-নাপিত প্রভৃতি খেতাবে পরিচিত রাখা হইত। এই কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া তাহারা পরবর্ত্তীকালে উচ্চবংশে বিবাহ দ্বারা রক্তসম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারে নাই এবং ক্রমশঃ নিম্নপদস্থ স্বজাতীয়ের সঙ্গে যৌনসম্বন্ধযুক্ত হইতে হইতে তাহারা অবনতির চরম সীমায় উপনীত হইয়াছে। প্রচ্ছন্ন ব্যভিচারকে যে সমাজে কাৰ্য্যতঃ প্রশ্রয় দিতে দেখা যায়, সে সমাজ জানিয়া শুনিয়া হয়ত সাধারণ স্পর্শদোষেই একটা বংশকে চৌদ্দপুরুষ নরকস্থ করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের ধর্ম্ম বা সমাজের পংক্তি হইতে খরচ ব্যতীত জমা নাই; বহুকাল হইতে আমাদের সমাজের বিশেষতঃ হিন্দুসমাজের মা বাপ নাই; নতুবা স্বদেশীয় লোকের উপর এইরূপ অনর্থক অসম্ভব নিৰ্ম্মমতা দেখাইয়া, জাতীয়তার শক্তিকে নির্মূল করিবার ব্যবস্থা হইত না। এখনও যমুনা, সরস্বতী, ভৈরব বা মধুমতীর কূলে ত বটেই, এমন কি, যশোহর জেলার উত্তরভাগ স্থ নবগঙ্গার তীরে মাগুরা অঞ্চলের নানাস্থানে বা ফরিদপুরের অভ্যন্তরে ভূষণা প্রভৃতি স্থানে মগো পরিবাদগ্রস্ত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি নানা শ্রেণীর লোকের বাস রহিয়াছে। বংশ বা ব্যক্তির নামের তালিকা দিয়া লাভ নাই এবং সে পরিচয় দিতে গিয়া, তাঁহাদের পুরাতন পরিবাদের মাত্রা বৃদ্ধি করিতে চাহি না।

শুধু সাময়িক অত্যাচার বা সামাজিক নিগ্রহ হইতেই মগ ফিরিঙ্গির সহিত আমাদের সম্বন্ধে শেষ হয় নাই। এ স্থানে তাহাদের অত্যাচারের বর্ণনা করাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু এই প্রসঙ্গে এই সকল বৈদেশিকের সহিত আমাদের যে সকল অন্য সম্বন্ধ এখনও বৰ্ত্তমান আছে, তাহার সংক্ষিপ্ত আভাষ দেওয়া সঙ্গত মনে করি 1

প্রথমতঃ, আমাদের দেশের গায়ে নানাস্থানে তাহাদের গতিবিধি ও বসতির সম্বন্ধ এখনও আছে। দক্ষিণ বঙ্গে মঘিয়া, মগরা, মগুখালি, মগপাড়া প্রভৃতি স্থান তাহাদের নামাঙ্কিত হইয়া রহিয়াছে। স্থানে স্থানে খুলনা ও ২৪-পরগণায় সমুদ্রকূলে এবং বরিশালের অন্তর্গত গুল্সাখালি, চাপলি, নিশানবাড়ী, মউধোবি, থাপরাভাঙ্গা, মগপাড়া প্রভৃতি স্থানে বহুসংখ্যক মগফিরিঙ্গী বা তাহাদের যৌন সম্বন্ধজাত সঙ্করজাতি এখনও বাস করিতেছে। নোয়াখালিতে হাতিয়া, সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপে, চট্টগ্রামে আদিনাথ, বক্স বাজার, রামু প্রভৃতি স্থানে, সুন্দরবনে হরিণঘাটার মোহানার নিকটবর্ত্তী সমুদ্রতীরে অনেক মগপল্লী রহিয়াছে। ঢাকার নিকটবর্ত্তী ফিরিঙ্গিবাজারে ও চট্টগ্রাম সহরে অসংখ্য ফিরিঙ্গি অতি দুরবস্থায় হীনবৃত্তি অবলম্বন করিয়া এবং সীমাবদ্ধ স্বজাতির মধ্যে বিবাহাদি করিয়া উৎসন্ন যাইতে বসিয়াছে।

দ্বিতীয়তঃ, আমাদের রোগের তালিকায় ‘ফিরিঙ্গি-ব্যাধি’র মত এক প্রকার অতি কুৎসিত ভয়ঙ্কর উপদংশ জাতীয় ব্যাধি প্রবেশ লাভ করিয়াছে। চরক, সুশ্রুত, হারীত প্রভৃতি প্রাচীন কোন বৈদ্যক গ্রন্থে এই রোগের কিছুমাত্র উল্লেখ নাই, কেবলমাত্র ভাবপ্রকাশেই এই রোগের বিবরণ আছে। ভাবপ্রকাশ অপেক্ষাকৃত আধুনিক গ্রন্থ; এজন্য সহজে অনুমেয়, পূর্ব্বে এদেশে এ রোগের নাম গন্ধ ছিল না।[৩২] ভাবপ্রকাশে এই ‘ফিরঙ্গ-ব্যাধি’র এইরূপ নিদান প্রদত্ত হইয়াছে :

‘গন্ধরোগঃ ফিরঙ্গোহয়ং জায়তে দেহিনাং ধ্রুবম্।
ফিরিঙ্গিণোতিসংসর্গাৎ ফিরিঙ্গিণ্যাঃ প্রসঙ্গতঃ।
ব্যাধিরাগরুজোহ্যেষ দোষাণামত্র সংক্রমঃ।
ভবেত্তলক্ষয়েত্তেষাং লক্ষণৈর্ভিষজাং বরঃ॥’

ফিরিঙ্গিণ্যাঃ প্রসঙ্গতঃ ইতি বিশেষার্থং অর্থাৎ ফিরিঙ্গিণী সংসর্গই এই রোগের প্রধান কারণ। এই দুরারোগ্য ব্যাধির সাংঘাতিক বীজাণু নিম্ন শ্রেণী ও ইন্দ্রিয়সেবীর মধ্যে সংক্রামিত হইয়া গলিত কুষ্ঠাদি রোগে মানুষের যন্ত্রণা ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া দিতেছে।

তৃতীতয়ঃ, আমাদের গার্হস্থ্যজীবনের নিত্য ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদিতেও বৈদেশিক ফিরিঙ্গির সম্বন্ধ রহিয়াছে। অনেক নূতন ফলমূল বা ফুল তাঁহারা দূর দেশ হইতে এখানে আনিয়া দিয়াছেন। অনেক জিনিসের নাম এবং উহা প্রস্তুত করিবার বা ব্যবহারের প্রণালী আমরা তাঁহাদের নিকট হইতে শিখিয়াছি। আমাদের আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, জামরুল, কামরাঙ্গা, নোনা আতা, চীনের বাদাম, রাঙ্গা আলু প্রভৃতি তাঁহাদের নিকট হইতে পাইয়াছি। তাঁহারাই আফ্রিকা হইতে গান্ধাফুল আনিয়া আমাদের বাগান সাজাইয়াছিলেন; এইজন্য খৃষ্টান উৎসবে গান্ধাফুলের এত বাহার ও পসার। তামাক তাহারাই প্রথম দক্ষিণ ভারতে আনেন (১৫০৮), কিন্তু ১৬০৫ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে উহার বিশেষ ব্যবহার আরম্ভ হয় নাই। এখনও আমাদের দেশের লোকে ফিরিঙ্গি রুটি (পাওরুটি) খায়, স্ত্রীলোকেরা ফিরিঙ্গি খোপা বাঁধে। আমাদের ঘরের কড়ি, বরগা, জানালা, গরাদিয়া, কামরা, বারান্দা, পেরেক সকলই ফিরিঙ্গি কথা; আমাদের অফিসের আলমারী, কাদেরা, মেজ, আপিন, ফিতা, চাবি সবই তাঁহাদের আনীত জিনিস; আমাদের নিত্যব্যবহার্য্য বোতাম, বয়েম, বোতল, বালতি, বাসন প্রভৃতি তাঁহাদের ভাষা এবং হয়ত তাঁহাদের আনীত দ্রব্য। কামান, পিস্তল, লঙ্কর, বজরা, বয়া (Buoy), মাস্তুল, তুফান প্রভৃতি কথা তাঁহাদের নিকট হইতে শিখিয়াছি; আমরা তাঁহাদের অনুকরণে গীর্জা, পাদ্রী, ইংরাজ, মিস্ত্রী প্রভৃতি নাম দিয়াছি। আমরা পয়সা ‘রেস্ত’ করি, ‘কামিজ’ ‘ইস্ত্রি’ করিয়া পরি, বৎসর ‘কাবার’ করি, উপদেশের কথা ‘টুকিয়া’ লই, কুঠিতে ‘আয়া’ রাখি, পুস্তক ‘ছাপা’ করি, কোষ্ঠবদ্ধ হইলে ‘জোলাপ’ লই, দ্রব্যাদি ‘নীলাম’ করি,—এসব স্থলে তাঁহাদের কথাই ভাষাগত করিয়া লইয়াছি।[৩৩] আমাদের ভাষা তাঁহাদের প্রবর্তিত শব্দভারে সমৃদ্ধ হইয়াছে। অত্যাচার পীড়িত হইলেও বাঙ্গালী এ বিষয়ে তাঁহাদের নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে বাধ্য।

পাদটীকা :

১. Hill, S. C., Bengal in 1756-57, Vol III, p. 160; Campos, Portuguese in India, p. 19. note.

২. ‘প্রসিদ্ধা উর্ব্বরা ভুম্যো বহুশস্য বহুপ্রজাঃ।
নদীমাতৃকদেশোহয়ং লোকানাং সুখদায়কঃ।।’—লঘুভারত

৩. বর্ত্তমান গ্রন্থের প্রথম খণ্ড, ১৯০-১৯৬ পৃ, ২১৭-২২৫ পৃ এবং ২৩৫-২৪০ পৃ।

৪. পর্তুগাল রাজ্যের অধিবাসীদিগকে পর্টুগীজ, ইংলণ্ডের লোকদিগকে ইংরাজ, ফ্রান্সের লোককে ফরাসী, হল্যাণ্ডের অধিবাসীকে ওলন্দাজ এবং ডেনমার্কের লোককে এদেশীয়েরা দিনেমার বলিত। পর্তুগীজেরাই পরে ফিরিঙ্গি বলিয়া অভিহিত হইত। কেন তাহা পরে বলিতেছি।

৫. ‘In a labyrinth of rivers the adventurers could dive and dart, appear and disappear, ravage the coun- try and escape with impunity. Hence Bengal has been the victim of exploits and depradations of foreign and native adventurers alike.’-Campos, The Protuguese in Bengal. p. 24.

৬. পেড্রো ট্যাভারিস্ (Padro Tavares) নামক একজন পর্টুগীজের উপর বাদশাহ আকবর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে বঙ্গের কোথাও একটি নগরী প্রতিষ্ঠা করিবার আদেশ দেন। তখন এই ট্যাভারিসই হুগলী নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হন (১৫৭৯)। আকবর-নামায় এক পরতাপ বার (Partab Bar) ফিরিঙ্গির কথা আছে। বিভারিজ প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে, ট্যাভারিস ও পরতাপ বার অভিন্ন। — Akbarnama, Vol. III, pp. 349-51; Ain. (Blochmann), p. 440; Elliot, Vol. Vi p. 59. ম্যানরিকের Itinerario পুস্তকে ইহার বিশেষ বিবরণ আছে।— Bengal Past and Present, Part II, 1616; J.A.S.B.; 1904, p. 52; Campos, pp. 52-3; বারটলি (Bartoli) নামক পর্যটকের বৃত্তান্তে আছে, ‘Pietro Tavares as being a military servant of Akbar and also as captain of a port in Bengal.’

৭. Fitch, Ralph – England’s Pioneer to India, ed. by J. H. Riley, 1899.

৮. ‘The Portingalles deals and traffique thether, and some places are inhabited by them, as the havens which they call Porto Grande (Chittagong) and Porto Pequeno, that is the great haven and the little haven, but there are not Fortes, nor any government, nor police, as in (Portuguese) India (they have), but live in a manner like wild men and untamed horses for that everyman doth what he will, and everyman is lord (and maister), neither esteeme they anything of justice, whether there be any or none, and in this manner doe certayne Portingalles dwell among them, some here, some there (scattered abroade), and are for the most part such as dare not stay in India for some wickednesse by them committed.’-Van Linschoten (Hakluyt edition), p. 95; Bengal Past and Present, Part I, 1915, pp. 8081.

৯. ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে সন্দ্বীপ ও পার্শ্ববর্ত্তী হাতিয়া ও বামনী দ্বীপ গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক ১,৯৫,০০০ টাকায় বিক্রীত হয়। উহার অর্দ্ধেক Mr, Courjon এবং অপরার্দ্ধ সমানাংশে Mr. Delanny এবং শিবদুলাল তেওয়ারী একত্রযোগে খরিদ করেন; মোট রাজস্ব চিরস্থায়ীভাবে ৩৮,৪২০ টাকা স্থিরীকৃত হয়। এখন নিজ সন্দ্বীপের প্রায়। ছয় আনা কুর্জ্জনের কন্যা Mrs. Massingham এবং অপরাংশ তুল্যাংশে ডিলানি ও তেওয়ারীর জমিদারী ভুক্ত আছে। আমরা ১৯১২ অব্দে এই সকল জমিদারীর কাছারী পরিদর্শন করিয়াছিলাম।

১০. The Island was one of the most fertile places in the world, densely populated and well cultivat- ed’ – Noakhali Gazetteer (Webster), p. 17.

১১. Du Jarric—Histoire….des Indes Orientales, part IV, Chap, 32; নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৪৪৯- ৫০ পৃ।

১২. রেণেলের ১ নং ম্যাপে মহেশখালি ফাড়ির পূর্ব্বপারে নদীতীরে Ramoo আছে; উহা বৰ্ত্তমান কক্সবাজার (Cox’s Bazar) হইতে ৯ মাইল পূৰ্ব্বদিকে অবস্থিত। —Chittagong Gazetteer, p. 188. ভ্রমণকারী ম্যানরিক্ ডিয়াঙ্গা হইতে রামুতে আসিয়াছিলেন। Ibid, pp. 1767.

১৩. Father Barbe, Vicar of Chittagong, wrote on Sept, 5, 1843; ‘The first church of the Portuguese on the Chittagang side] was built by them at Deang (Dianga) which is at the mouth of the river.’- Bengal Past and Present, 1916, part II, pp. 261-2. মহামতি ব্লকম্যান বলেন দক্ষিণডাঙ্গা বা ব্রাহ্মণডাঙ্গা নামের অপভ্রংশ হইতে ডাঙ্গা ও পরে ডিয়াঙ্গা হইয়াছে।

১৪. Danver-Portuguese in India, Vol. 1: p. 217; ‘বিশ্বকোষ’, ১১ খণ্ড, ১৪ পৃ।

১৫. আমরা এই ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে (৩৩-৪০ পৃ) ফিরিঙ্গি নামের উৎপত্তির বিষয় বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছি। ফ্রাঙ্ক কথা হইতে ফিরিঙ্গি হইয়াছে। প্যালেষ্টাইনে যখন মুসলমানদিগের সহিত ইয়োরোপীয়দিগের সংঘর্ষ হয়, তখন আরবীয়েরা সকল ইয়োরোপীয় জাতিকেই ফ্রাঙ্ক বলিত। পরে পর্তুগীজ প্রভৃতি জাতিরা যখন বাণিজ্যার্থ ভারতে আসেন, তখনও সকল জাতির সাধারণ নাম হইয়াছিল ফ্রাঙ্ক বা ফিরিঙ্গি।

১৫. ‘Frank is the parent word of Feringht by which name the India-born Portuguese are still known. The Arabs and Persians called the French crusaders Frank, Ferang, a corruption of France. When the Portuguese and other Europeans came to India, the Arabs applied to them the same name Ferang, and the Feringhi,-Campos, Portuguese in Bengal, p. 47 note.

এই সকল ইয়োরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগীজেরাই প্রথম বঙ্গদেশে আসিয়া উৎপাত করিত এবং তাহারাই প্রথম ফিরিঙ্গি নাম পাইয়াছিল। তাহাদের চরিত্রদোষে ফিরিঙ্গি নামে কলঙ্ক আরোপিত হইয়াছে। এজন্য অন্যান্য ইয়োরোপীয় জাতিরা এ নাম ঘৃণা করেন এবং এ নামে পরিচিত হইলে অপমনিত বোধ করেন। এখন পর্তুগীজদিগের সংসর্গজাত বর্ণসঙ্করকে ফিরিঙ্গি বলা হয়; আমরা পর্তুগীজ দস্যুদিগকেই প্রতঙ্কীচের উল্লেখ আছে।

১৬. Fitch, Ralph (Riley), pp. 154-55.

১৭. Francois Bernier নামক একজন ফরাসী ডাক্তার ১৬৫৫-১৬৬১ পর্যন্ত ভারতবর্ষে ঘুরিয়া ১৬৭০ খৃষ্টাব্দে তাঁহার ফরাসী ভাষায় লিখিত পুস্তকের প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন। উহাতে (Bangabasi edition, pp, 156-57) আছে :

‘Their ordinary trade was robbery and piracy, With some small and light gallies they did nothing but coast about that sea, and enering into all rivers there about, and into the channels and arms of ganges and between all these isles of the lower Bengal and often penetrating even so far as forty of fifty leagues up into the country, surprized and carried away whole towns, assemblies, markets, feasts and weddings of the Gentiles and others of that country, making women slaves great and small, with strange cruelty and burning all they could not carry away and thence it is that at pre- sent there are seen in the mouth of Ganges so many fine isles quite deserted, which were formerly well-peopled, and where no other inhabitants are found but wild beasts and specially tigers.’ [Bernier, F.-Travels of the Mogul Empire; ed, by A. Constable, 1891, p. 175,-শি মি]

১৮. ‘This infamous rabble inpudently bragging, that they made more Christians in one year, than all the Missionaries of the Indies in ten: which would be a strange way of enlarging Christianity.’- Bernier, p. 158. [Bernier (Constable), p. 176. — শি মি]

১৯. Twarikh-i-Asham (Paris, 1815)

২০. Persian Ms. Bod. 569, Sachau and Ethe’s catalogue, entry No. 240.

২১. J. A. S. B. June, 1907, pp. 257-260.

২২. ‘The Feringhi Pirates of Chatgaon, 665 A. D. in J. A. S. B. 1907. pp. 419-25.

২৩. ….everybody knows how many raids they (Portuguese) make every year with their fleets on the lands and kingdoms of Bacala and solimanuas. Jassor, Angelim and Ourixa, thereby not only decreasing the power of the enemy, but also increasing yours…They brought to your dominions entire cities and villages (Poblaciones), there being years when they introduced over eleven thou- sand famillies.’–Bengal, Past and Present, 1916, Part II, p. 258.

২৪. Ibid., P. 281.

২৫. They had gone (to Jassor) evidently on one of their annual filibustering slave-raiding expeditions against the Moghuls of Bengal.— Ibid., p. 268.

২৬. ‘বিশ্বকোষ’, ১১শ খণ্ড, ৪১ পৃ।

২৭. ‘Not a householder was left on both sides of the rivers on their track from Dacca to Chittagong. They swept it with the broom of plunder and abduction leaving none to inhabit a house or kindle a fire all the tract’— J. A. S. B., 1907. pp. 422-3.

২৮. Gastrell Geographical and Statistical Report of the Districts of Jessore, Faridpur and Backergung, Surveyed 1764-72; Rennell-Bengal Atlas (1780).

২৯. ‘The tribe was called Harmad, This word (Harmad) is evidently Armad, a corruption of Armada, Armad is used in the sense of fleet in Kalimat-i-Taiyabat’-J. A. S. B., 1907, No. 6, p. 425 note.

৩০. “The Feringhis replied, ‘Our Salary was the Imperial dominion! We considered the whole of Bengal as our Jagir. All the twelve months we made our Collection (i. e. booty) without trouble, we had not to bother ourselves about amlas or amins, nor had we to render accounts and balances to anybody.”—J. A. S. B., 1907. No. 6. p. উক্ত প্রধান ক্যাপ্টেনের নাম মুর নহে। মূলে Captain Mor আছে, উহার অর্থ Chief Captain. অধ্যাপক সরকার তাঁহার Aurangzib, VI এর দ্বিতীয় সংস্করণে এ ভ্রম সংশোধন করিয়াছেন।

৩১. কিন্তু কমিয়া গেলেও সে অত্যাচার একেবারে যায় নাই। এমন কি বৃটিশ শাসনকালেও যায় নাই। Rev. J. Long 4 žlo Gifaro alfa : “The Mugs, as late as 1824, were object of terror even to Calcutta and in 1760, the Government had a bund thrown across the river near the site of the Botanical Gardens to prevent them and the Portuguese pirates coming up.’-J. A. S. B., 1864.

৩২. ‘বিশ্বকোষ’, ১২শ খণ্ড, ৬০২ পূ; ‘শব্দকল্পদ্রুম’, ফিরঙ্গ শব্দ, ২৮০৪ পৃ।

৩৩. Campos, Portuguese in Bengal Chap. XVII.

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন