১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন

সতীশচন্দ্র মিত্র

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন

১৫৬০ খৃষ্টাব্দে বা তাহার কিছু পরে গৌড়ে বিক্রমাদিত্যের যে পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, বৈষ্ণব পরিবারের প্রকৃতি অনুযায়ী তাহার নাম রাখা হইয়াছিল—গোপীনাথ; তিনি পিতার ‘বিক্রমাদিত্য’ ও ‘মহারাজ’ উপাধি লাভের পর, যুবরাজ হইয়া প্রতাপাদিত্য নামে পরিচিত হন। প্রতাপের জন্মকোষ্ঠীর ফলে তাহার ‘পিতৃহন্তা’ দোষ ছিল। কার্যক্ষেত্রে তিনি মাতা ও পিতা উভয়েরই মৃত্যুর কারণ হইয়াছিলেন, দেখিতে পাই। প্রথমতঃ তাহার যখন বয়স ৫ দিন মাত্র, তখন সূতিকাগৃহেই তাহার জননীর মৃত্যুর হয়। শ্রীহরি পত্নী-বিয়োগে যেমন মর্ম্মব্যথা পাইলেন, পুত্রের পিতৃঘাতী হওয়া নিশ্চিত মানিয়া লইয়া তেমনই আরও অশান্তি ভোগ করিতে লাগিলেন। সুতরাং তিনি প্রতাপের প্রতি প্রথম হইতেই আন্তরিক বিরক্ত ছিলেন 1

কিন্তু খুল্লতাত জানকীবল্লভের স্নেহগুণে প্রতাপের তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় নাই। খুড়ামহাশয় স্নেহমমতার মূর্তিমান অবতার। কোষ্ঠীর ফলাফলে তাঁহার আস্থা থাকিলেও, পুরুষকারে তাঁহার আস্থা অধিক ছিল। সুতরাং শ্রীহরি পিতা হইয়া শিশুর প্রতি বিরক্ত হইলেও খুল্লতাত তাহার প্রতি অধিকতর স্নেহশীল। ইহার আরও একটি কারণ ছিল; প্রতাপের মাতা যখন হঠাৎ দেহত্যাগ করেন, তখন জানকীবল্লভের জ্যেষ্ঠা পত্নী সূতিকাগৃহেই তাহার মাতা হইয়া বসিলেন।[১] তাঁহার কোন সন্তান ছিল না, ভবিষ্যতে হয়ও নাই। সুতরাং তাঁহার অপার মাতৃ-স্নেহ সর্ব্বাংশে প্রতাপেরই প্রাপ্য হইল। অন্য স্ত্রীগণের গর্ভে বসন্ত রায়ের একাদশ পুত্রের পরিচয় পাইয়াছি। তন্মধ্যে দ্বিতীয়পক্ষের অর্থাৎ বসুকন্যার গর্ভজাত প্রথম সন্তানই সৰ্ব্ব-জ্যেষ্ঠ, তাহার নাম ছিল গোবিন্দ রায়। তিনি প্রতাপের কনিষ্ঠ হইলেও প্রায় সমবয়স্ক। রাঘব ও চন্দ্রশেখর বা চাঁদ রায় দত্তকন্যার গর্ভজাত।[২] এই রাঘবই পরে ‘যশোহরজিৎ’ উপাধি পান। ঘটকেরা তাহার নাম বাদ দিয়া সেই উপাধিই বসাইয়া দিয়াছেন। যাহা হউক, অন্য স্ত্রীগণের সকলেরই পুত্র সন্তান ছিল, প্রথমা স্ত্রীর কিন্তু একমাত্র স্নেহের ধন প্রতাপ। প্রতাপের যে নিজের জননী নাই, তাহা তিনি জানিতেন না, খুল্লতাত পত্নীর অতুল স্নেহে তাহার সে জ্ঞান ভাসিয়া গিয়াছিল। প্রতাপ সেই মাকে বড় ভক্তি করিতেন, ভয় করিতেন, তাহার সকল ঔদ্ধত্য সে মায়ের স্নেহের কটাক্ষে বিলুপ্ত হইত। প্রতাপের সেই মাতাই তাহার রাজত্ব-কালে ‘যশোহরের মহারাণী’ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। প্রতাপের পাটরাণী কখনও লোকমুখে মহারাণী পদবী পান নাই।

অতি শিশুকালে প্রতাপ অত্যন্ত শান্ত ও নিরীহ ছিলেন। কিন্তু বয়সের সঙ্গে ক্রমে তাহার চঞ্চলতা ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাইতে লাগিল। তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও মেধাবী ছিলেন। বিদ্যাশিক্ষা যাহা করিতে হয়, তিনি শীঘ্রই তাহা শেষ করিয়া ফেলিলেন। সময়ের প্রথামত তাহাকে সংস্কৃত, ফারসী ও বাঙ্গালা শিখিতে হইল। তাহার বিদ্যাবত্তার কোন বিশিষ্ট- পরিচয় পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু তিনি সংস্কৃত তান্ত্রিক স্তবাদি অতি সুন্দর আবৃত্তি করিতেন, ফারসীতে পত্র লিখিতে ও সুন্দরভাবে কথা কহিতে পারিতেন, নানাবিধ প্রাদেশিক বাঙ্গালায় সকল জাতীয় সৈন্যগণের সহিত কথা কহিতেন, ইহার পরিচয় আছে। গোবিন্দদাসের সহিত তাহার সম্প্রীতির কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি, আগ্রা দরবারে সমস্যাপূরণ ও নিজের সভাপণ্ডিতগণের সহিত সদালাপ ও শাস্ত্রচর্চ্চার কথা পরে বলিব। কিন্তু সে যাহাই হউক, এই সব শিক্ষায় তাহার তত মতি ছিল না তিনি স্বাভাবিক প্রতিভার ফলে শাস্ত্র অপেক্ষা শস্ত্র-শিক্ষারই অধিক পক্ষপাতী ছিলেন। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকের অভার ছিল না; পাঠান রাজ্যের ধ্বংসের সময় বহু কর্ম্মক্লান্ত পাঠানবীর যশোহর-রাজ্যে আশ্রয় লইয়াছিলেন তাঁহারা সকলেই উৎকৃষ্ট শিক্ষক এবং সর্ব্বাপেক্ষা ভাল শিক্ষক ছিলেন বসন্ত রায় স্বয়ং। সেই মসীজীবী কায়স্থ সন্তান বহুদিনের সাধনার ফলে যখন অসিহস্তে দণ্ডায়মান হইতেন, তখন সহজে কোন বীর তাহার সম্মুখীন হইতে সাহসী হইত না।

প্রতাপ তাঁহার উপযুক্ত শিষ্য ছিলেন এবং শিষ্যের মর্ম্মও গুরু বুঝিয়াছিলেন। উদীয়মান যুবকের অদম্য উদ্যম ও লোক-পরিচালনার ক্ষমতা দেখিয়া দূরদর্শী বসন্ত রায় প্রতাপের নিকট অনেক আশা করিতেন; এবং অগ্রজের মত তাহার প্রতি সন্দিগ্ধ না হইয়া প্রকৃতই ভ্রাতুষ্পুত্রের মত তাহার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। প্রতাপকে তিনি আশ্রয় দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন এবং আশার আলোক দেখাইতেন। কিন্তু ভাগ্যদোষে প্রতাপ তাহা বুঝিতেন না; বাহিরে যাহাই হউক, ভিতরে প্রতাপ চিরদিনই খুড়ার কথায় ও কার্য্যে সন্দেহযুক্ত ছিলেন। কিন্তু এই খুড়াই তাহার পিতার মত পিতা ভাগ্যের দোষ শুধু প্রতাপের নহে, সমগ্র বঙ্গের ভাগ্যদোষে, প্রতাপ হঠাৎ তাঁহার হত্যাসাধন করিয়া পিতৃঘাতীর ফল সপ্রমাণ করিয়াছিলেন।

প্রতাপের রাজোচিত বিপুল শরীর ছিল। মল্লযুদ্ধে, তীরসঞ্চালনে, তরবারি তাড়নায় তিনি অতুলনীয় ছিলেন। মহারাজ বিক্রমাদিত্য তাহার ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হইলেও তাহার বীরত্বে বাধা দিতেন বলিয়া মনে হয় না। দায়ুদ শাহ ইন্দ্ৰিয়াসক্ত হইলেও কার্যক্ষেত্রে বীরের মত বীর ছিলেন, এজন্য মোগলের পক্ষে তাঁহাকে পরাজিত করা সহজ হয় নাই। বিক্রমাদিত্য ছিলেন সেই দায়ুদের প্রধানমন্ত্রী। গৌড়রাজ্যের ধনবল ও জনবল পর্যালোচনা করিয়া, পাঠান পক্ষ হইতে স্বাধীনতা ঘোষণার যে মন্ত্র স্থির হইয়াছিল, তাহার অন্যতম উপদেষ্টা এই বিক্রমাদিত্য। লোদী খাঁ বা কতলুখার মত প্রধান প্রধান আমীরগণের সহিত বিক্রমাদিত্যই সমপদবীতে অবস্থিত ছিলেন। মুসলমান ইতিহাসে বসন্ত রায়ের বিশেষ উল্লেখ নাই, কিন্তু বিক্রমাদিত্যের উল্লেখ বহুস্থানে আছে। ইঁহাদেরই কার্যকারিতায় গৌড়রাজ্যের শৃঙ্খলা স্থাপিত ও রাজকোষ বর্দ্ধিত হয়। বিক্রমাদিত্যই যশোহর- রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাবীর প্রতাপাদিত্যের জন্মদাতা। আজকাল যাহারা এই বিক্রমকেশরী বিক্রমাদিত্যকে নাট্যরঙ্গমঞ্চে আনিয়া রক্তশূন্য ভয়াতুরের চিত্র দেখাইতেছেন, তাহারা বাঙ্গালী হইয়াও সাধ করিয়া লেখনীর মুখ দিয়া বাঙ্গালীর মুখে কালিমা লেপন করিয়া দিতেছে।[৩]

প্রতাপ সঙ্গীদিগকে লইয়া মৃগয়া করিতেন। সুন্দরবনের প্রান্তেই যশোররাজধানী। এখনও লোকে মৃগয়া করে; এখনও সুন্দরবনের নিকটবর্ত্তী স্থানের নিম্নশ্রেণীর অধিকাংশ লোকেই সামান্য সরঞ্জাম লইয়া শিকার করিতে বাহির হয়। কেমন করিয়া শিকার করে, তাহা আমরা প্রথম খণ্ডে দেখাইয়াছি।[৪] প্রতাপ রাজার পুত্র, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী; তাহার অস্ত্র সরঞ্জাম, দলবদ্ধ সঙ্গী ও লোকলস্করের অভাব ছিল না। প্রতাপও মৃগয়া করিতেন, ব্যাঘ্র, গণ্ডার মারিতেন,[৫] জীবজন্তু মারিতেন, কুমীর, শূকর গুলিবিদ্ধ করিতেন, হরিণ শিকার করিয়া স্তূপীকৃত করিতেন, আর মারিতেন অসংখ্য প্রকারের অসংখ্য পাখী। উড্ডীয়মান পক্ষীও তাহার লক্ষ্যভ্রষ্ট হইত না। উড্ডীয়মান পক্ষী শিকারে লক্ষ্যের উত্তম পরীক্ষা হয়; এজন্য এখনও শিকারি মাত্রই এই শিকারে আমোদ পায়। প্রতাপ ইহাতে অপূৰ্ব্ব আমোদ পাইতেন। একদিন তৎকর্তৃক শরবিদ্ধ এক পাখী ঘুরিতে ঘুরিতে বৃদ্ধ নৃপতি বিক্রমাদিত্যের সম্মুখে পড়িল। পক্ষীর তীব্র যাতনা ও অনর্থক হত্যা দেখিয়া তাঁহার মনে বড় কষ্ট হইল; বিশেষতঃ শিকারের ক্ষেত্র বনে জঙ্গলে অন্যত্র আছে, রাজপুরীর মধ্যে নিরীহ পক্ষীর হত্যায় শিকারের পৌরুষ অপেক্ষা নির্দয়তারই অধিক পরিচয় পায়। প্রতাপের ঔদ্ধত্য ও সঙ্গে সঙ্গে তাহার কোষ্ঠীর ফল মনে পড়িল। তিনি প্রতাপের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। এইরূপ ভাবে দিনে দিনে প্রতাপের এমন কত অত্যাচারের কথা বৃদ্ধ রাজার কর্ণগত হইত। ক্রমে তাঁহার বিরক্তির মাত্রা এত বাড়িল যে, শুনা যায়, তিনি পুত্রের বিনাশের কল্পনা করিয়াছিলেন। বসন্ত রায় তাঁহাকে বুঝাইয়া নিরস্ত করিতেন।

সূর্য্যকান্ত ও শঙ্কর নামে প্রতাপের দুইজন ভক্ত অনুচর জুটিয়াছিল। বঙ্গজ গুহ বংশীয় সূর্য্যকান্ত পূৰ্ব্বাঞ্চল হইতে আসেন এবং ব্রাহ্মণ বংশীয় শঙ্কর চক্রবর্ত্তী বর্ত্তমান বারাসাত হইতে আসেন। তিনজনে প্রাণে প্রাণে অত্যন্ত অনুরক্ত হইয়াছিলেন। তাহাদের বীরত্ব, উদারতা ও অসমসাহকিতার কথা সমগ্র যশোরে বিস্তৃত হইল। রাজপুরীর কক্ষে, যমুনার উন্মুক্ততীরে ও সুন্দরবনের অরণ্যানীর মধ্যে বসিয়া যখন তখন তিনজনে যে বিরাট কল্পনা আঁটিতেন, তাহারই ফলে উত্তরকালে আগ্রার সিংহাসন পর্য্যন্ত টলিয়াছিল। প্রতাপ কখনও বন্ধুদ্বয়ের সঙ্গ ছাড়া হইতেন না। তিনি যে- কোন অত্যাচারের নায়ক হইতেন, তাহার সঙ্গী থাকিতেন এই দুইজন। বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় প্রতাপকে লইয়া বড় বিপদে পড়িলেন। অবশেষে উভয়ে পরামর্শ স্থির করিলেন যে, বিবাহ দিলে প্রতাপের মতির পরিবর্ত্তন হইতে পারে এবং তাহা হইলে সঙ্গীদিগের সহিত মন্ত্রণা করিয়া কালক্ষেপ করিবে না। এজন্য ‘তাঁহারা উভয়ে উদ্যোগী হইয়া প্রতাপের বিবাহ দিলেন। ঘটককারিকায় প্রতাপের তিন বিবাহের উল্লেখ আছে। সর্ব্ব প্রথমে পরমকুলীন জগদানন্দ রায়ের (বসু) কন্যার সহিত তাহার বিবাহ হয়, হয়তঃ এ বিবাহ বাল্যকালেই হইয়াছিল। ঘটককারিকায় এ বিবাহের কোন সন্তানাদির উল্লেখ নাই। সম্ভবতঃ, এ স্ত্রী অকালে পরলোকগত হন। তৎপরে সম্মানিত মধ্যল্য জিতামিত্র নাগের কন্যা শরৎকুমারীর সহিত মহাসমারোহে প্রতাপের বিবাহ (১৫৭৮) হয়। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এই শরৎকুমারীই তাহার পাটরাণী বা প্রধানা মহিষী ছিলেন। জিতামিত্র নাগ রাজকার্য্য উপলক্ষ্যে গৌড়ে ছিলেন। তিনি বসন্ত রায়ের সহিত সম্পর্কিত ও বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ। বিদ্যাগৌরবে তিনি বিশেষ খ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন; ঘটককারিকা হইতেই আমরা জানিতে পারি, তাহার অন্য উপাধি ছিল কবিশ্চন্দ্র। বসন্ত রায় তাহাকে সমাদরে আহবান করিয়া রাজধানীর পার্শ্বে বসতি করাইয়া ছিলেন। এখনও সে স্থানকে ‘নাগবাড়ী’ বলে।[৬] সম্ভবতঃ, গোপাল ঘোষের কন্যার সহিত প্রতাপের বিবাহ তিনি রাজা হইবার অনেক পরে হইয়াছিল।

বিবাহ হইল; তিনি নাগকন্যা শরৎকুমারীকে পরম গুণবতী প্রণয়িনীরূপে পাইলেন। কিন্তু তাহাতে তাহার বিশেষ কিছু পরিবর্তন হইল বলিয়া মনে হয় না। সে ঔদ্ধত্য, সেই বনে জঙ্গলে মৃগয়াভিযান, সেই পথে প্রান্তরে কৃত্রিম সমরাভিনয়— সেই একইভাবে চলিতে লাগিল। তখন বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় পুনর্ব্বার পরামর্শ করিলেন; এবার স্থির হইল, রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য প্রতাপকে কিছুকালের জন্য রাজধানী আগ্রায় প্রেরণ করিতে হইবে। বসন্ত রায় এ প্রস্তাবে প্রথম আপত্তি করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষে দূরদর্শী বিক্রমাদিত্যের ব্যবস্থায় সম্মতি দিতে বাধ্য হইলেন। বিচার করিয়া দেখা হইল যে, বিক্রমাদিত্য মোগলের সামন্ত রাজা; রাজধানীতে প্রতিনিধি পাঠাইয়া দেওয়া কর্তব্য। যশোর-রাজ্যের সনন্দ প্রাপ্তির পর হইতে নিয়মমত রাজস্ব পাঠাইতেছেন বটে, কিন্তু তিনি বা বসন্ত রায় একবারও বাদশাহ দরবারে সাক্ষাৎ করেন নাই। আকমহলের যুদ্ধের পর যখন টোডরমল্ল আগ্রায় যাইতেছিলেন, তখন বসন্ত রায়কে তাঁহার সঙ্গে যাইতে অনুরোধ করেন। বসন্ত রায় শীঘ্র যাইবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়াও এ পর্য্যন্ত যাইতে পারেন নাই। এখন বিক্রমাদিত্যের শরীর তত সুস্থ নহে; রাজকার্য্যের অধিকাংশই বসন্ত রায়কে নির্ব্বাহ করিতে হয়। এ অবস্থায় তাঁহার নিজের আগ্রায় যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। বিশেষতঃ তিনি এখনও পাঠানের সহিত বন্ধুত্ব-সূত্রে আবদ্ধ বলিয়া নিজে যাইতেও ইচ্ছা করেন না। এমত অবস্থা প্রাপ্ত-বয়স্ক প্রতাপকে রাজধানীতে প্রেরণ করিতে পারিলে সব দিক রক্ষা হয়। বিশেষতঃ, বিশাল মোগল রাজধানীর যুদ্ধসজ্জা ও সৈন্যবাহিনী দেখিলে এবং বাদশাহ-দরবারের ব্যবহার পদ্ধতির সহিত পরিচিত হইলে, প্রতাপের অনেক শিক্ষালাভ হইবে; সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের উপকণ্ঠে যে ঐশ্বর্য্যের গর্ব্ব ও অনর্থক ঔদ্ধত্য জাগিতেছিল, তাহাও প্রশমিত হইয়া যাইবে।

এই সকল বিষয় বিবেচনা করিয়া প্রতাপের আগ্রা-গমন স্থিরীকৃত হইল। যে প্রতিভা ক্ষুদ্র রাজ্যের সীমাবদ্ধ গণ্ডীতে আদর্শের অভাবে মলিন হইতেছিল, বিশাল রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে তাহারই প্রকাশলাভের পথ খুলিল। প্রতাপ তাহা বুঝিতে না পারিয়া স্থির করিয়া বসিলেন যে, তাহাকে আগ্রা প্রেরণের মূল কারণ বসন্ত রায়। কিন্তু খুড়া মহাশয়ের স্নেহের গুণে প্রকাশ্য ভাবে সন্দেহ করিবার উপায় ছিল না। তিনি সুযোগ্য পুত্রের মত রাজাজ্ঞা শিরোধার্য্য করিলেন। উপযুক্ত যানবাহন, সঙ্গী, সরঞ্জাম ও উপঢৌকন দ্রব্যাদি লইয়া প্রতাপ শীঘ্রই আগ্রা যাত্রা করিলেন। সূর্য্যকান্ত ও শঙ্কর তাহার সঙ্গেই গিয়াছিলেন।

পাদটীকা :

১. সম্ভবতঃ ইনি জয়ন্ত ঘোষের কন্যা। পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে ঘটককারিকা হইতে উদ্ধৃত অংশে দেখিয়াছি, বসন্ত রায় ঘোষকন্যা, বসুকন্যা এবং দুইটি দত্তকন্যা বিবাহ করেন। তন্মধ্যে ঘোষদৌ বলিয়া কোন পুত্রের উল্লেখ নাই। তবে তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে সর্ব্বপ্রথম উল্লিখিত জগদানন্দ নারায়ণদাস রায়ের বেলায় তাহারা কাহার দৌহিত্র তাহার উল্লেখ দেখি না। তাহারা দুইজনে ঘোষ দৌহিত্র হইতেও পারেন, কারণ অন্য পুত্রগণের মধ্যে বসুদৌ ও দত্তদৌ এইরূপ স্পষ্ট উল্লেখ আছে। জগদানন্দের কোন বংশ নাই, তাহা নিশ্চিত; নারায়ণদাসের কোন বংশবৃদ্ধির পরিচয় পাই না। হয়ত তাহারা অল্পবয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হইতে পারেন। না হইলেও তাহাদিগকে ঘোষদৌহিত্র বলিয়া ধরিতে পারি না; কারণ বংশানুক্রমিক প্রবাদানুসারে প্রথমা পত্নীর কোন সন্তান হয় নাই, এইরূপেই জানা আছে; ঘটককারিকায় ঘোষদৌ বলিয়া উল্লেখ নাই, ইহাও সন্দেহের অন্য কারণ। সম্ভবতঃ বসন্ত রায় কৃষ্ণদেব রায়ের যে দুইকন্যা বিবাহ করেন, তাহারই একজনের গর্ভে প্রথম দুইপুত্র ও পরজনের গর্ভে যশোহরজিৎ প্রভৃতি পুত্রগণ জন্মগ্রহণ করেন।

২. কণৌজাগত মৌদগল্য-গোত্রীয় পুরুষোত্তম দত্তের পুত্র নারায়ণ পূর্ব্ববঙ্গে বাস করেন; তিনি বঙ্গজ কায়স্থ দত্ত বংশের আদি। নারায়ণ হইতে ৭ম পুরুষে কুমী দত্ত মধ্যল্য শ্রেণীভুক্ত হন; তৎপুত্র রবি দত্তের কুলে ৮ম পুরুষে কৃষ্ণ ও গোপী দত্ত মধুমতী তীরবর্ত্তী ইট্‌না বা ইতনায় বাস করিতেন। বংশাবলী এই : রবি-গোপাল- শূলপাণি-বাণেশ্বর-পুণ্ডরীকাক্ষ-চতুর্ভুজ-জগন্নাথ-কৃষ্ণ রায় দত্ত ও গোপী রায় দত্ত। রাজা বসন্ত রায় কৃষ্ণ রায় দত্তের দুই কন্যার পাণিগ্রহণ করেন এবং সেই বিবাহের ফলে কৃষ্ণ ও গোপী দুইভাতায় ভূসম্পত্তি লাভ করিয়া রাঙ্গদিয়া পরগণায় বাস করেন এবং রায় উপাধিধারী হন। বাগেরহাটের নিকটবর্ত্তী সিংহগাতি নিবাসী যদুনাথ রায় এই বংশীয়। গোপী রায়ের পুত্র চাঁদ রায়ের এক ধারা টাকীর নিকটবর্ত্তী শ্রীপুরে বাস করেন। স্কুল সমূহের ডেপুটি ইনস্পেক্টর সুরেশচন্দ্র রায় মহাশয় উক্ত চাঁদ রায় হইতে ৯ম পুরুষ। রবি দত্তের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভাস্করের বংশে ১০ম পুরুষে মহেশের এক কন্যা রাজা যশোহরজিৎ বিবাহ করেন।

৩. শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ মহাশয় তাঁহার ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে মহারাজ বিক্রমাদিত্য দ্বারা যে এক হাস্যাস্পদ চরিত্রাভিনয় করাইয়াছেন, তাহা বড়ই অপ্রীতিকর। প্রবীণ বিক্রমাদিত্যের সে দুর্দ্দশা দেখিলে শীতরক্ত বাঙ্গালীর মুখে বিরক্তির রক্তিমা প্রতিভাত না হইয়া পারিবে না। প্রতাপাদিত্যের মুল্লুক পর্য্যন্ত যাহারা জানেন না, কখনও দেখেন নাই, তাহারাই যদি সহরের ত্রিতলে বসিয়া নাট্যমঞ্চের তাগাদায় পড়িয়া স্বদেশীয় বীরের এরূপ অস্বাভাবিক অবমাননা করেন, তাহা হইলে দুঃখ রাখিবার স্থান থাকে না। কবির পথ কি এতই নিরঙ্কুশ! বাঙ্গালী আজকাল এতই গল্পরসিক যে তাহার নিকট হইতে সস্তায় বাহাবা লইতে কোনও প্রকার চেষ্টা, অনুসন্ধান বা ঐতিহাসিক সঙ্গতিরক্ষার প্রয়োজন হয় না।

৪ . বর্তমান পুস্তকের ১ম খণ্ড, ৭০-৭৫ পৃ।

৫. সুন্দরবনে যথেষ্ট গণ্ডার ছিল, এখন বোধহয় আর নাই। গণ্ডারের সংবাদ প্রথম খণ্ডে (৬২-৬৯ পৃ) দিয়াছি। গণ্ডারের চর্ম্মে ঢাল প্রস্তুত হইত; সে জন্যও গণ্ডার শিকারের প্রয়োজন ছিল। প্রতাপের রাজধানীতে এখনও মৃত্তিকার নিম্নে গণ্ডারের অস্থি পাওয়া যায়; সম্প্রতি আমিও গণ্ডারের অস্থি সেখান হইতে সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি।

৬. গোপালপুরের উত্তরাংশে ‘নাগবাড়ী’ গ্রাম এখনও আছে।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন