সতীশচন্দ্র মিত্র
আমরা প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের আলোচনা করিব বটে, কিন্তু সে ইতিহাস পাইব কোথায়? যাহাকে ইতিহাস বলিতে পারি, সে সময়ের এমন কোন বিবরণ দেশীয় হিন্দুতে লিখে নাই; সমসাময়িক বা পরবর্ত্তী বিখ্যাত মুসলমানী ইতিহাসে প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস নাই বলিলেও চলে। আবুল ফজলের বিরাট গ্রন্থে প্রতাপাদিত্যের নামগন্ধ নাই। অথচ সেই গ্রন্থ এবং নিজামউদ্দীন বা বদাউনীর বিস্তৃত ইতিহাস হইতে জানিতে পারি, মুনেম খাঁ, খাঁ জাহান টোডরমল্ল, বা মানসিংহের মত কত কৃতী মোগল সেনাপতি ২৫ বৎসর ধরিয়া বঙ্গভূমিতে বিদ্রোহ দমন করিলেন। কিন্তু সে বিদ্রোহী কে কে, তাহার পরিচয় নাই। সে সংঘর্ষের ফলে দিল্লী আগ্রার কত ওমরাহ দেশে না ফিরিয়া বঙ্গের কোণে নগণ্য পল্লীপ্রান্তরে কবরিত হইল; কত বিদ্রোহী যুদ্ধে বা গুপ্ত ঘাতকের হস্তে নিহত হইল, কেহ বা বন্দীভাবে ধৃত বা পিঞ্জরাবদ্ধ হইল, কিন্তু সে বিদ্রোহী কে কে, তাহার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া গেল না। ইতিহাসে বিদ্রোহের বার্তা যাহা কিছু আছে, সে কেবল বিদ্রোহী পাঠানের কথা; কারণ পাঠানের হস্ত হইতেই মোগলেরা বঙ্গের মসনদ কাড়িয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যে স্বল্পসংখ্যক পলায়িত পাঠান বিদ্রোহী বিরাট বঙ্গের হিন্দু অধিবাসীর মধ্যে মিশিয়া গিয়াছিলেন, পাঠানের স্নেহ ও কৃতজ্ঞতার পরিশোধকল্পে যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পাঠানের স্বত্বস্বামিত্বের দাবিতে নিয়ত যুদ্ধলিপ্ত হইতেছিলেন, বাঙ্গালার যে অসংখ্য ভুঞারাজগণ পাঠানকে স্বগণ বলিয়া গণ্য করিয়া মোগলের রক্তে তর্পণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কথা আকবরের বৃত্তিভুক্ লেখকগণের গ্রন্থে স্থান পায় নাই। মানসিংহ বিরাট বাহিনী সঙ্গে লইয়া বঙ্গে আসিয়াছিলেন, সপ্তদশবর্ষকাল সদর্পে বঙ্গে রণরঙ্গে মাতিয়াছিলেন এবং নিজের যৌবনকে বার্দ্ধক্যে পরিণত করিয়া হৃতস্বাস্থ্য হইয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি কাহার বিরুদ্ধে কিরূপে যুদ্ধ করিলেন, তাহা ‘আকবরনামা’ তন্ন তন্ন করিলেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। না পাইলেই কি সে সব যুদ্ধের কথা, দেশময় রণদর্পের বার্তা মুছিয়া ফেলিতে পারিব? যে প্রতাপাদিত্য বা কেদার রায়, যে ঈশা বা ওমান খাঁ বিদ্রোহী হওয়ায় মোগলকে বিংশাধিক বর্ষাকাল ব্যতিব্যস্ত থাকিতে হইয়াছিল, তাঁহাদের কথা, তাঁহাদের কীর্তিকাহিনী মুছিবার নহে। দেশের গাত্রে, দেশীয়দিগের লুপ্ত ইতিহাসের পত্রে, তাহার শতচিত্র এখনও বিলুপ্ত হয় নাই।
আমরা যে যুগের কথা বলিতে যাইতেছি, তাহাতে বঙ্গীয় ইতিহাসের অসদ্ভাব ছিল বটে, কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসের অভাব ছিল না। বাদশাহ আকবর স্বয়ং একপ্রকার অশিক্ষিত বা নিরক্ষর হইলে কি হয়, তাঁহার মত শিক্ষার উৎসাহদাতা, শিক্ষিতের ও পণ্ডিতের প্রতিপালক জগতের রাজন্যবর্গের মধ্যে অতি অল্পই দেখা যায়। তাঁহার একটা বিশেষ গুণ ছিল, তিনি অনুসন্ধিৎসু ছিলেন; তিনি ঐতিহাসিকগণের নিপুণ গবেষণার জন্য সর্ব্ববিধ সাহায্য করিতেন। রাজশক্তির সহায়তা পাইয়া প্রত্নতাত্ত্বিক মুসলমান ঐতিহাসিকগণ একাগ্র চেষ্টায় বিরাট গ্রন্থসমূহ রাখিয়া গিয়াছেন।[১] সেইজন্য অন্য যুগের ইতিহাস আলোচনা করিতে গেলে, যেমন উপাদানের অল্পতায় সন্দেহাকুল হইতে হয়, আকবরের যুগে আসিলে, উপাদানের প্রাচুর্য্যে ঐতিহাসিককে পরিশ্রান্ত হইতে হয়। কিন্তু যে বিরাট ইতিহাসের কথা বলিতেছি, তাহার অধিকাংশই শুধু মোগলের কথায় পূর্ণ; বাদশাহের কার্য্যকাহিনী, রাজ্যবিজয় ও শাসননীতি তাহাতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচিত হইয়াছে। শাহানশাহার একটি নেত্রপলকও হয়ত তাহাতে লিপিবদ্ধ হইতে বাদ পড়ে নাই, কিন্তু অন্যপক্ষে হয়ত একটি দেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইলেও তাহার উল্লেখমাত্র নাই। ভারতীয় মোগলের কথা বলিতে গিয়া আবুল ফজল ভারতবাসীর কথা ভুলিয়া গিয়াছেন; প্রভুর অনাবশ্যক স্তাবকতায় ও অনর্থক কবিতায় তিনি অনেক স্থলে লেখনী কলঙ্কিত করিতে করিতে আত্মশক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছেন। বিশেষতঃ বঙ্গের সহিত মোগলের কেবলমাত্র নূতন সম্বন্ধ হইতেছিল, আবার সে সম্বন্ধও শুধু বিদ্রোহীর সহিত বিজয়দৃপ্ত শাসকের সম্বন্ধ। সে শাসকের স্তাবক ঐতিহাসিকগণ বঙ্গঘটিত বর্ণনার অন্তরালে রোষকষায়িত দৃষ্টি লুক্কায়িত রাখিতে পারেন নাই; আর যাহা কিছু বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাও অযত্ন ও অনভিজ্ঞতায় কলঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে। মোগল পক্ষের ইতিহাসের প্রধান ঘটনাগুলির সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা ভিন্ন এসকল ইতিহাস দ্বারা আমাদের বিশেষ সাহায্য হয় না।
১৩৩৮ হইতে ১৫৩৮ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত পূর্ণ দুইশত বর্ষকাল বঙ্গদেশ স্বাধীন ছিল। পরে বঙ্গের শেরশাহ দিল্লীশ্বর হইলে, বঙ্গ-পাঁচ বৎসর মাত্র দিল্লীর অধীন ছিল; পুনরায় শেরশাহের অবসানের পর ১৫৪৫ হইতে ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত আবার বঙ্গ একপ্রকার স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করে। এ সময়ে বঙ্গের ইতিহাস ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ইতিহাস হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুই একটি সীমান্ত যুদ্ধ ব্যতীত বহির্জগতের সহিত বঙ্গের সম্বন্ধ নাই। কিন্তু এই স্বাধীন বঙ্গের যে ইতিহাস আমরা পাই, তাহা মুসলমান শাসকের ইতিহাস—মুসলমান ঐতিহাসিকের রচিত মুসলমান-শাসনের ইতিহাস। সে ইতিহাসেও বিরাট হিন্দু সম্প্রদায়ের কাহিনী নাই বলিলেও হয়। এখন যেমন বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় লোকসংখ্যায় অধিক, তখন তত অধিক ছিল না। তখন মুসলমানের কতক নবাগত হইতেছিলেন, হিন্দুরা কতক মুসলমান হইয়া যাইতেছিলেন এবং বঙ্গবাসী মুসলমানের বংশবৃদ্ধি নবোপনিবেশে দ্রুতগতিতে হইতেছিল—এই তিন কারণে কালক্রমে মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর অনুপাত ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু আমরা যে যুগের কথা বলিতেছি, তখন হিন্দুই প্রধান অধিবাসী; তাহাদের সমাজ, ধৰ্ম্ম ও গতিবিধি—ইহারই ইতিহাস তখন বঙ্গীয় ইতিহাসের প্রধান অঙ্গ। কিন্তু মুসলমানী ইতিবৃত্তে সে অঙ্গের চিত্র নাই; মোগল অপেক্ষা পাঠানেরা হিন্দুর প্রতি অধিকতর সন্তুষ্ট ও আকৃষ্ট হইলেও হিন্দুর গতিমতির পরিমাপ করিয়া হিন্দুর ইতিবৃত্ত সমুজ্জ্বল করা তাহাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। সুতরাং মোগল ও পাঠান কাহারও নিকট হইতে আমরা প্রস্তাবিত যুগের প্রকৃত ইতিহাস পাই না।
হিন্দু লেখকরা নিজের জাতীয় চিত্র বিশেষভাবে রাখিয়া যান নাই। যাহা কিছু আছে, তাহা সাহিত্যে, ধর্মপ্রচার-কাহিনীতে, সমাজ-চিত্রে ও ঘটকের কারিকায় আত্মগোপন করিয়া রহিয়াছে। যাহা কিছু আছে, তাহা প্রবাদবাক্যে জনশ্রুতিমুখে রঞ্জিত ভাষায় কতক প্রকাশ পায়; বংশবিবরণে এবং ব্রতকথা ও উপকথায় তাহাদের কতক সন্ধান পাওয়া যায়। বর্ত্তমান যুগের ঐতিহাসিককে এই লুকানো মাণিকের উদ্ধার সাধন করিতে হইবে। নতুবা বঙ্গের সর্ব্বাঙ্গীণ ইতিহাস আবির্ভূত হইবে না। রাজনৈতিক বিষয়ের প্রসঙ্গে আমরা মুসলমান ঐতিহাসিকগণের অনেক গ্রন্থ প্রামাণিক ধরিয়া লই বটে, কিন্তু সে বিষয়েরও অন্য পক্ষের কথা থাকিতে পারে। সেই কথার সন্ধান লইয়া, তাহার সহিত পারসীক গ্রন্থের প্রামাণিকতার সামঞ্জস্য করিয়া নূতন যুগের ইতিহাস গঠন করিতে হইবে। বৈদেশিক ভাষায় লিখিত কোন গ্রন্থে ঘটনাবিশেষের অবতারণা না দেখিলেই তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া চলিবে না। পারসীক গ্রন্থের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ পুস্তকগুলিতে প্রতাপের নামোল্লেখ নাই, তাহা বলিয়া কি তাঁহাকে অস্তিত্বশূন্য কল্পনা করিতে হইবে? আমাদের যশোহর-খুলনা প্রতাপাদিত্যের অস্তিত্বে পূর্ণ এবং তাঁহার বীরত্ব-প্রতাপে ধন্য। তাঁহার দানধর্ম ও পূজা-ভক্তির কথা এদেশে প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে। প্রতাপের যুগে দক্ষিণবঙ্গের জীর্ণশীর্ণ দেহে নবশক্তি সঞ্চারিত হইয়াছিল, বঙ্গপতির প্রকৃতি ও ব্যবসায় পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছিল। তাহার অভিব্যক্তি এখনও আছে; এখনও এদেশের অঙ্গে অঙ্গে তাহার প্রমাণ চিহ্ন বর্ত্তমান; আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যশোহর-খুলনা ‘প্রতাপময়’। এদেশের সেই প্রতাপময়তার সজীব আভাস দিবার জন্য আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করিব।
তবে সেই চেষ্টা বড় কঠিন চেষ্টা। সমসাময়িক পারসীক বা অন্য বৈদেশিক গ্রন্থে যেটুকু প্রমাণ বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাহারই আলোকে পথ দেখিয়া লইতে হইবে। দেশীয় সাহিত্যে, ঘটককারিকা বা পুঁথিপত্রে, প্রাচীন দলিলাদি বা স্বল্পসংখ্যক শিলালিপিতে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, সাবধানে তাহার সদ্ব্যবহার করিতে হইবে। সামাজিক ইতিহাস বা বংশ বিবরণে যে সকল ঘটনার ঐতিহাসিকতা সপ্রমাণ হয়, তাহার সন্ধান লইতে হইবে। প্রচলিত প্রবাদ বা জনশ্রুতির মূলে যেটুকু সত্য নিহিত থাকিতে পারে, সহিষ্ণুতার সহিত তাহার সমুদ্ধার করিতে হইবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের রাজধানীর সন্নিকটে বা দেশের নানাস্থানে যে অসংখ্য কীৰ্ত্তিচিহ্ন আছে, যে সকল মন্দির, মসজিদ, দুর্গ বা অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ এখনও সিক্তবাত নিম্নবঙ্গে আত্মরক্ষা করিতে পারিয়াছে, স্বচক্ষে দেখিয়া তাহার সংবাদ বা বিবরণ সংগ্রহ করিতে হইবে, যে সকল স্থাপত্য-নিদর্শন বা সংশ্লিষ্ট কিম্বদন্তী এখনও কালের কবলে বা বিস্মৃতির গর্ভে বিলুপ্ত হয় নাই, তাহারও তথ্য নির্ণয় করিতে হইবে। এই ভাবে সকল তথ্য ও প্রমাণের সামঞ্জস্য করিয়া ইতিহাসের সারতত্ত্ব প্রকটিত করিতে হইবে। চাক্ষুষ প্রমাণকে প্রধান সহায় করিয়া যথাসম্ভব বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে যতটুকু প্রকৃত চিত্র লোক-সমাজের নয়নপথবর্ত্তী করিতে পারি, তাহারই চেষ্টা করিব।
বৈজ্ঞানিক প্রণালীর অনুসরণ করিব বটে, কিন্তু তৎসম্পর্কে কয়েকটি বলিবার কথা আছে। প্রথমতঃ আজকাল যেরূপ বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাস লিখিত হইতেছে, তাহাতে প্রবাদের মূল্য স্বীকৃত হয় না। কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন এই, লিখিত ইতিহাস কয়জনের পাওয়া যায়? এবং যাহা আছে, তাহাই যে রঞ্জিত বা পক্ষপাতদুষ্ট নহে, তাহার প্রমাণ কি? দেশের মধ্যে কয়জনের কার্য্যকলাপের দৈনন্দিন লিপি প্রস্তুত হইত? শিলালিপি বা স্মারকলেখমালা হইতে দুই চারিজন রাজা ব্যতীত কয়জন প্রাচীন কৃতী পুরুষের বিবরণী সংগ্রহ করা যায়? আর সেই ইতিহাস পাইলেই কি দেশের ইতিহাস হইল? দেশ কি শুধু কতিপয় রাজা বা রাজপুরুষের সমষ্টি লইয়া গঠিত? রাজা শুধু দেশের রক্ষক মাত্র; রাজার ইতিহাস শুধু দেশ-শাসনের ইতিহাস – দেশের বাহ্যাবরণের ইতিহাস। প্রজাই দেশের প্রাণ; সে প্রাণের স্পন্দন বা অবস্থার ইতিবৃত্ত দেশের প্রকৃত ইতিহাস। আমরা যে সমস্ত ইতিহাস পড়ি, তাহার অধিকাংশই রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত মাত্র। প্রজার কাহিনী বা দেশের প্রকৃত চিত্র তাহাতে নাই। যুগের পর যুগ ধরিয়া জনশ্রুতি, প্রবাদ বা গল্পকথার মধ্যে সে চিত্র ক্রমে লুক্কায়িত হইয়া পড়ে। অসত্য বা অতিরঞ্জনের আবর্জ্জনা সরাইয়া সে প্রবাদপুঞ্জ হইতে সার সত্য সংগ্রহ করা বড় কঠিন ব্যাপার। কিন্তু সকল প্ৰবাদ হইতেই মূল সত্যের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টি থাকিলে, রাশীকৃত ইতিকথা হইতে সত্যের নির্য্যাস নির্গত করিয়া লওয়া যায়। সুতরাং প্রবাদ একেবারে বাদ দিলে চলে না।
দ্বিতীয়তঃ, পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদিগের মধ্যে যাঁহারা ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখিয়া যথেষ্ট যশোলাভ বা অর্থোপার্জ্জন করিয়াছেন, তাঁহাদের একটা প্রকৃতি এই দেখিতে পাই যে, তাঁহারা যতক্ষণ পর্য্যন্ত কোন পাশ্চাত্য লেখক বা পর্যটকের বর্ণনা হইতে আমাদের রাশি রাশি দেশী কথার কোন প্রকার সমর্থন করাইতে না পারেন, সে পর্য্যন্ত ভারতবর্ষীয় পুরাণ বা প্রাচীনকাহিনীর প্রতি কিছুমাত্র আস্থাবান হন না। ইবন্ বতুতা[২] বা মার্কো পোলোর[৩] মত ভ্রমণকারী অজানিত দূরদেশ হইতে ফিরিয়া নিজের দেশে আসর জমাইবার জন্য যে অসংখ্য আজগবি গল্পের অবতারণা করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে সত্য থাকিতে পারে, কিন্তু অসত্য যে কত ছিল তাহার সংখ্যা নাই; আমরা বুঝি না, তাহাই আমাদের ঋষিমুনির উপাখ্যান হইতে অধিক মূল্যবান বা আদরণীয় কেন! অনেকে নিজের ধর্ম্ম বা সংস্কারের নীল চসমা পরিয়া পরের দেশে ঘুরিয়া থাকেন এবং নিজের জ্ঞানবুদ্ধির মাত্রানুসারে পরের কাহিনীর পরিমাপ করেন— কাজেই তাঁহারা নিজের তুলিকায় পরের দেশের এক অভিনব বিকৃত চিত্র অঙ্কিত করিয়া থাকেন। বিশেষ সতর্ক না হইলে, সে চিত্র হইতে কোন সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে যেস্থলে অন্যত্র হইতে কোন সন্ধান পাওয়ার সুযোগ নাই, সেখানে বৈদেশিক বিবরণী হইতে যতটুকু আলোকপাত করা যায় ঐতিহাসিককে তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু যেখানে দেশের কথা দশের মুখে, বংশের কাহিনীতে, প্রবাদ-বাক্যে বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে, সেখানে উহা কোন প্রকারেই উপেক্ষণীয় নহে। ছাঁটিয়া কাটিয়া, অন্য ঘটনার সহিত প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান মিলাইয়া মিশাইয়া প্রকৃত তথ্যের উদ্ধার করিতে হইবে বটে, কিন্তু যে দেশে বেদ বা শ্রুতি জনশ্রুতিতে পর্যবসিত হইয়াছিল, সে দেশে প্রবাদসমূহ একেবারে বাদ দিলে চলে না। প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের জন্য আমাদিগকে অনেক প্রবাদের উপর নির্ভর করিতে হইবে।
তৃতীয়তঃ, নিম্নবঙ্গে পাহাড় পৰ্ব্বত নাই; এখানে পাষাণ নির্মিত মন্দির বা মসজিদ গড়িতে হইলে, সুদূর রাজমহল বা চট্টগ্রাম হইতে পাথর আনিতে হয়। সে বড় কঠিন কাৰ্য্য, সে কার্য্য সকলের সামর্থ্যে কুলায় না। খাঁ জাহান আলি প্রভৃতি দুই একজন কোন কোন স্থানে কতক গাঁথুনি পাথরের দ্বারা সম্পন্ন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহারও সব পাথর তাঁহাদের নিজের আনীত বা হিন্দু বৌদ্ধ আমলের পুরাতন মন্দির ভগ্ন করিয়া সংগৃহীত, তাহা স্পষ্ট বলা যায় না। পাথরের দেশ না হইলে সহজে পাথরের ইমারত হয় না। এজন্য এদেশের মন্দিরাদি প্রায় সবই ইষ্টক-রচিত। সেই ইষ্টক নিৰ্ম্মিত হর্ম্মে যদি কোন লিপি থাকে, তাহাও সাধারণতঃ শিলা-লিপি নহে, তাহা ইষ্টক-লিপি। নিম্নবঙ্গ বড় লবণাক্ত দেশ এবং ইহার বায়ু সর্ব্বদা জলীয় বাষ্পে আর্দ্র। ইহার ফলে, ইষ্টকে উৎকীর্ণ লিপি ত দূরের কথা, সব কঠিন জিনিসই বড় শীঘ্র শীঘ্র ক্ষয়িত ও বিনষ্ট হইয়া যায়। এই আশঙ্কায়ও অনেকে মন্দিরাদিতে লিপি-সংযোগ করিতেন না। যাহা করিতেন, তাহারও অধিকাংশ আর নাই। অথচ (যেমন পূজনীয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় লিখিয়াছেন) ‘আজকা’লকার ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ইতিহাসের দিনে পাথুরে প্রমাণ ভিন্ন ইতিহাস হয় না।’[৪] কিন্তু সে পাথুরে প্রমাণ কোথায় পাইব? এদেশে যেখানে ২/১ খানি প্রস্তরলিপি ছিল, তাহাও ইমারত ভাঙ্গিয়া পড়ায় স্থানান্তরিত হইয়া মানুষের অযত্নে বা অবজ্ঞায় অপহৃত বা দেশান্তরিত হইয়াছে। যথাস্থানে তাহার উল্লেখ করিব। সুতরাং দেখা যাইতেছে, শিলালিপির সাহায্যে এদেশের ইতিহাসের উদ্ধার-কল্পনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।[৫]
চতুর্থতঃ আজকাল আর এক ধরন দেখিতে পাই যে, কোন রাজার ইতিহাস লিখিতে গেলে তাঁহার স্বনামাঙ্কিত মুদ্রার সন্ধান পাওয়া চাই। মৌদ্রিক (numismatic) প্রমাণ যে বিশেষ বলবান, তাহাতে অবিশ্বাস করিতেছি না; তবে ইহাই রাজাদের বেলায় একমাত্র বা প্রধান প্ৰমাণ নহে। জনৈক প্রসিদ্ধ মনীষী একদিন আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকদিগের প্রতি কটাক্ষ করিয়া হাস্যচ্ছলে আমাদিগকে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার বৃদ্ধ প্রপিতামহের নামাঙ্কিত কোন মুদ্রা নাই, এজন্য তিনি তাঁহার অস্তিত্বে সন্দিহান। বাস্তবিকই আমরা আমাদের গবেষণার নিপুণতা এবং প্রস্তাবিত বিষয়ের প্রামাণিকতা দেখাইবার জন্য মুদ্রার সন্ধান করি। মুদ্রা পাইলেই প্রমাণের একশেষ হইল এবং না পাইলে অন্য শত প্রমাণ দিয়াও যেন ঐতিহাসিকের নিস্তার নাই। প্রকৃতপক্ষে সমুদ্র প্রমাণ সন্দেহের মধ্যে একটি মুদ্রাও যে ঐতিহাসিকের দিনির্ণয় করিয়া দিতে পারে, তাহা স্বীকার করি আমরা একদা সুন্দরবনে ভ্রমণকালে দৈবক্রমে দনুজমৰ্দ্দনের যে মুদ্রা পাইয়া বঙ্গীয় সাহিত্য- পরিষদে উপহার দিয়াছিলাম, তাহার কথা অনেকেই জানেন। উহা দ্বারা চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধারের অসামান্য সাহায্য করিয়াছে এবং অনেক লেখকের অনেক অদ্ভুত কল্পনা উড়াইয়া দিয়াছে। সে মুদ্রা যে খুব মূল্যবান, তাহা সকলেই স্বীকার করিয়াছেন।[৬] লোকমুখে শুনি, প্রতাপাদিত্যের এইরূপ মুদ্রা ছিল; মুদ্রা প্রচার স্বাধীনতা ঘোষণার একটি অঙ্গস্বরূপ। কেহ কেহ তাঁহার সে মুদ্রা দেখিয়াছেন বলিয়া প্রকাশও করিয়াছেন। আমি কিন্তু আজ ১৫/১৬ বৎসর যাবৎ বিশেষ অনুসন্ধান করিয়াও একটি মুদ্রা সংগ্রহ করিতে পারি নাই। ইহার জন্য অনেক স্থানে গ্রামে গ্রামে, বাড়ী বাড়ী ঘুরিয়াছি; এ পর্য্যন্ত শতাধিক লোকের নিকট কতশত পত্র লিখিয়াছি, অর্থব্যয় করিয়া বহুবিধ মুদ্রা সংগ্রহে বাধ্য হইয়াছি, প্রতাপের একটি মুদ্রার জন্য যথেষ্ট অর্থ দিব বলিয়া আমার প্রতিশ্রুতি বারংবার সংবাদপত্রে মুদ্রিত করিয়াছি। কত আশা পাইয়াছি, কিন্তু প্রতাপাদিত্যের মুদ্রা পাই নাই। কিন্তু তাই বলিয়া কি প্রতাপাদিত্যের কাহিনী উড়াইয়া দেওয়া যায়? এ দেশ ও সমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতাপের নামাঙ্কিত একটি মুদ্রার অভাবে তাঁহার ইতিহাসের বিশেষ অঙ্গহানি হয় বলিয়া ধরিতে পারি না। হয়ত এখনও তাঁহার নামাঙ্কিত ত্রিকোণ মুদ্ৰা অনেক পুরাতন গৃহস্থের ঘরে লক্ষ্মীর কৌটায় সঙ্গোপনে সযত্নে রক্ষিত হইতেছে এবং ভবিষ্যতে হয়ত তাহা কোন ঐতিহাসিকের হস্তগত হইবে। কিন্তু আপাততঃ সে মুদ্রা ব্যতীতও তাঁহার অতীত ইতিহাস গঠিত হইতে পারে কিনা, তাহাই আমাদের দ্রষ্টব্য।
‘আকবর-নামা’ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গ্রন্থে প্রতাপাদিত্যের নামোল্লেখ নাই বটে, কিন্তু অন্যান্য দুই একখানি পারসীক পুস্তকে যে তাহার বিবরণ ছিল, তাহা জানা গিয়াছে। ১৮০১ খৃষ্টাব্দে মুদ্রিত রাম রাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য-চরিত্রে’ আছে : ‘এদেশে প্রতাপাদিত্য নামে এক রাজা হইয়াছিলেন, তাহার বিবরণ কিঞ্চিত পারস্য ভাষায় গ্রন্থিত আছে, সাঙ্গপাঙ্গরূপে সামুদাইক নাহি।’[৭] এইরূপ কোন কোন পারস্য গ্রন্থ দেখিয়া এবং বংশগত প্রবাদাদির সাহায্যে যে বসু মহাশয় নিজ পুস্তক রচনা করেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।[৮] ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত খোড়গাছি-নিবাসী রাজা বসন্তরায়ের বংশধর রামগোপাল রায় মহাশয় ‘সারতত্ত্বতরঙ্গিনী’ নামক এক কবিতা পুস্তক প্রণয়ন করেন। উহার কতকাংশ ঐতিহাসিক নিখিল নাথ রায় মহোদয় স্বীয় ‘প্রতাপাদিত্য’ পুস্তকের অন্তর্নিবিষ্ট করিয়া প্রকাশিত করিয়াছেন। এই গ্রন্থে ‘রাজনামা’ নামক পারসী গ্রন্থের উল্লেখ আছে এবং ‘অতঃপর শুন রাজনামা বিবরণ’ এই বলিয়া গ্রন্থকার প্রতাপাদিত্য প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছেন।[৯]
সম্প্রতি গত বৎসরাধিক কালের মধ্যে অধ্যাপক যদুনাথ সরকার মহোদয়ের অসামান্য অনুসন্ধিৎসার ফলে এই প্রসঙ্গযুক্ত আরও দুইখানি পারসিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। একখানি-নবাব ইসলাম খাঁর সময়ে বঙ্গের দেওয়ান আসফ খাঁর অনুচর ও সঙ্গী আবদুল লতীফের ভ্রমণ-কাহিনী। যত দূর জানা গিয়াছে, ইহার একখানি মাত্র জীর্ণ হস্তলিখিত পুঁথি দিল্লী পাবলিক লাইব্রেরীতে আছে এবং উহার একখানি প্রতিলিপি অধ্যাপক সরকার মহাশয় সংগ্রহ করিয়াছেন। উহা হইতে জানা যায়, ১৬০৮ খৃষ্টাব্দে প্রতাপাদিত্য উপঢৌকন দ্রব্যসহ নবাব ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করেন।[১০] ইহাদ্বারা প্রমাণিত হয় যে প্রতাপাদিত্য ১৬০৬ খৃষ্টাব্দে মানসিংহ কর্তৃক বন্দী হইয়া মৃত্যুমুখে পড়েন নাই। দ্বিতীয় গ্রন্থখানির নাম ‘বহারিস্তান’[১১]; ইসলাম খাঁর সময়ে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যে বিরাট মোগল বাহিনী প্রেরিত হয়, তাহার গতিবিধি ও কার্য্য বিবরণী এই ‘বহারিস্তানে’ আছে এবং তাহা হইতে উক্ত আবদুল লতীফের উক্তিই সমর্থিত হয়। ইহার গ্রন্থকারের স্বহস্তলিখিত ৭০০ পৃষ্ঠার একমাত্র পুঁথি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের লাইব্রেরীতে রক্ষিত হইতেছে। অধ্যাপক সরকার মহাশয় বহুব্যয়ে উহার সমস্ত পত্রগুলি তথা হইতে ফটো করিয়া আনিয়াছেন এবং অতি কষ্টে তাহার পাঠোদ্ধার করিয়া কতকাংশের সংক্ষিপ্ত তথ্য ১৩২৭, কার্ত্তিক মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত করিয়াছেন; এ বিষয়ে পূর্ব্ব হইতে আমার সহিত আলোচনা হইয়াছিল এবং গ্রন্থোক্ত স্থানের পরিচয়ার্থ আমি কতকগুলি টিপ্পনী ঐ প্রবন্ধে সংযোজিত করিয়া দিয়াছিলাম।[১২] গ্রন্থকার সম্বন্ধে বিশেষ বিবরণ স্থানান্তরে প্রদত্ত হইবে। তবে এখানে এই মাত্র বলিয়া রাখিতে চাই যে, প্রতাপের বিরুদ্ধে যে মোগল অভিযান গিয়াছিল, তিনি তাহার অন্যতম সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন এবং স্বচক্ষে ঘটনাবলী দেখিয়া নিজ বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন। সুতরাং তাহার বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য না হইয়া পারে না। এ গ্রন্থে কোন কোন বিবরণ পক্ষপাতদুষ্ট বা অতিরঞ্জিত হইতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও স্থূল ঘটনার কথা মিথ্যা হইতে পারে না। ইহা হইতে জানিতে পারি, প্রতাপাদিত্যের শেষ পতন ইসলাম খাঁর হস্তে হইয়াছিল, মানসিংহের হস্তে নহে। মানসিংহ তাঁহাকে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, এ প্রবাদের মূলও খুঁজিয়া পাই না এবং ইহা সত্য বলিয়া ধরিতে পারি না। বিরুদ্ধ মতের সন্ধান না পাইলে হয়তঃ ইহারই উপর নির্ভর করিতে হইত; কিন্তু সমসাময়িক দুইজন লেখকের লিখিত ও পরস্পর সমর্থিত বিবরণ উপেক্ষণীয় নহে। শতাধিক বর্ষ পূর্ব্বে লিখিত রামরাম বসুর গ্রন্থেও ইসলাম খাঁর দ্বারা প্রতাপের শেষ পরাজয়ের কথা আছে এবং তাহাও পারসী গ্রন্থের অবলম্বনে লিখিত। আধুনিক ঘটককারিকার কাব্য-কথার বলে এ সকল প্রাচীন বিবরণ ত্যাগ করিতে পারি না। বিশেষতঃ প্রাচীন ঘটককারিকা হইতেও সত্যনির্ণয়ের সহায়তা পাওয়া যাইবে। যাহা হউক, এইরূপ বিবিধ মতের সমন্বয় করিয়া আমাদিগকে প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইবে।
পর্তুগীজ ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় মিশনারীগণের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত ঘটিত পুস্তক হইতেও প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আবিষ্কৃত হইয়াছে।[১৩] তাহা হইতেও আমাদের গন্তব্যপথ আলোকিত হইবে। এ সম্বন্ধে ইংরাজী ও বাঙ্গালায় লিখিত সকল আবশ্যক পুস্তক বা প্রবন্ধের যে আমরা সদ্ব্যবহার করিতে চেষ্টা করিব, সে কথা বলাই বাহুল্য। স্থানান্তরে যে প্রমাণ পঞ্জী দেওয়া হইল, উহাতে, যে সকল গ্রন্থ হইতে প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হইয়াছে, তাহার তালিকা দৃষ্ট হইবে
পাদটীকা :
১. ইহার মধ্যে আবুল ফজল কৃত ‘আকবরনামা’ ও তদন্তর্গত ‘আইন-ই-আকবরি’, নিজামউদ্দীন কৃত তবকাত-ই- আকবরি’ এবং বদাউনীকৃত ‘মুস্তাখাবুৎ-তারিখী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘But it must be remembered that Abul Fazl’s history was written too early for any notice of Pratapaditya’s life to have been inserted in it.’—See, ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ (বঙ্গবাসী সংস্করণ), ৫৮৫ পৃ; Calcutta Review, 1870.
২. ইবন্ বতুতা নামক একজন আফ্রিকাদেশীয় ভ্রমণকারী ২৫ বৎসর ভারতবর্ষ প্রভৃতি বহু দেশ ঘুরিয়া ১৩৪৯ খৃষ্টাব্দে ফেজ নগরে ফিরিয়া গিয়া, আরবীয় ভাষায় ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লিখেন। ঐতিহাসিকের মতে ‘He was deemed to be a daring liar.’
৩. ভিনিস নগরবাসী ভ্রমণকারী মার্কো পোলো ১৩শ শতাব্দীর শেষাংশে ভারতবর্ষ প্রভৃতি বহু দেশ ভ্রমণ করিয়া অদ্ভুত বিবরণ লিখেন।
৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয়ের ‘বেণের মেয়ে’ উপন্যাসের মুখপাত।
৫. Dr. Fleet ভারতীয় গুপ্ত সম্রাটগণের এবং কানিংহাম মহারাজ অশোকের শিলা-লিপিসমূহের প্রচারদ্বারাও তৎকালীয় ইতিহাস উদ্ধার করিবার প্রধান সহায় হইয়াছেন।
৬. সাহিত্য-পরিষদের ঊনবিংশ সাংবৎসরিক কার্য্যবিবরণীতে (১৬৮ পৃ) লিখিত হইয়াছিল : ‘শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় বহু আয়াস স্বীকার পূর্ব্বক চন্দ্রদ্বীপপতি দনুজমর্দনদেবের মুদ্রা উদ্ধার করিয়া বঙ্গের হিন্দু রাজত্বের ইতিহাসের এক তর্কসঙ্কুল অধ্যায়ের সুমীমাংসার সহায় হইয়াছিল।’ এই মুদ্রা সম্বন্ধে যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ১৯০-১৯৬ পৃ, প্রবাসী ১৩১৯, শ্রাবণ ও ভারতবর্ষ, ১৩২৫ জ্যৈষ্ঠ এবং রাখাল দাসের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস ১ম ভাগ, ১২৯ পৃ দ্রষ্টব্য।
৭. অর্থাৎ এ গ্রন্থে প্রতাপাদিত্যের কথা আছে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিবরণ নাই। শ্রীরামপুরে ১৮০১ অব্দে মুদ্রিত মূল গ্ৰন্থ ১-২ পৃ।
৮. তৎকালে বসুমহাশয়ের গ্রন্থের এইরূপ সমালোচনা হইয়াছিল : – The History of Rajah Pratapaditya, the last Rajah of the island of Saugar; an original in the Bengalee language composed from outhentic docu- ments by a learned native in college’ (Buchanon’s ‘College of Fort William’). Italics আমরা দিলাম।
৯. নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, ২৮১-৮৫ পৃ।
১০. এই গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত ‘প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ’ অধ্যাপক সরকার মহাশয় ১৩২৬, আশ্বিন মাসের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন (৫৫২-৫৩ পৃ)। [পরবর্তীকালে অধ্যাপক উক্ত প্রবন্ধ নূতন পাঠোদ্ধারান্তে কিছু সংস্কার করিয়া ১৩৫৫, আষাঢ় মাসের শনিবারের চিঠি’তে প্রকাশ করেন। উহাতে প্রতাপাদিত্যের এই সাক্ষাতের তারিখ ২৬ এপ্রিল, ১৬০৯ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করা হইয়াছে। পরিশিষ্টে এই প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। —শি মি]
১১. বহারিস্তান নামের অর্থ বসন্তের রাজ্য। বহার=বসন্তকাল। বোধ হয় দেশের প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হইয়াই গ্রন্থকার এইরূপ নামকরণ করিয়াছেন।
১২. অধ্যাপক সরকার ‘বহারিস্তানের’ অধিকতর পাঠোদ্ধারান্তে উক্ত প্রবন্ধ কিছু সংস্কার করিয়া ১৩৫৫ জ্যৈষ্ঠ মাসের ‘শনিবারের চিঠিতে’ প্রকাশ করেন। উহা বর্তমান সংস্করণের পরিশিষ্টে দ্রষ্টব্য। ইতিপূর্ব্বে ইহার অনুবাদও বাহির হইয়াছে।—Baharistani – Ghaybi; tr. by M. I. Borah, 1936. 2v. -শি মি।
১৩. Du Jarric, Peirre – Histoire … des Indes Orientales. 1610. Part IV Chap. 29 & 32; Pimenta, A. R. P. Nicalao-Historica Relatio de India Orientali; নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, ৪০৭-৫৯, ৪৬৩-৭৫ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন